পঞ্চমঅধ্যায়
ইসলামী আন্দোলনঃ রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক ফিকাহ
প্রতিকূল আদর্শিক পরিস্থিতি
ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে, এমন প্রতিকূল আদর্শিক পরিস্থিতি বিরাজমান যা কোনো সতর্ক পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি এড়াতে পারে না।
আদর্শের ক্ষেত্রে এমন সব অকল্যাণকর চিন্তাধারা বিদ্যমান যা এখনো ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও লেখক গোষ্ঠী এবং দাওয়াতি অথবা শিক্ষা কার্যক্রমের জন্যে লিখিত বই পুস্তকসহ রাজনৈতিক চিন্তাপ্রবাহে কোনো না কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। আন্দোলনকে এ চিন্তাধারার প্রভাব মুক্ত হয়ে কল্যাণকর আদর্শের আলোকে সামগ্রিকভাবে জনগণ, জীবন ও জগত নিয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে।
জাহিরী ভাবাদর্শ মূল গ্রন্থের আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয়ে যায়, এর বাইরে তারা শরীয়াহর প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে চর্চা করে না। ফলে মানুষের স্বার্থের প্রতি তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বিশিষ্ট আলেমগণ গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষের কল্যাণ সাধনেই শরীয়াহর লক্ষ্য। ইমাম ইবনুল কাইয়েমের ভাষায়ঃ কোনো বিধিবিধান যদি অশুভের পক্ষে শুভকে পরিত্যাগ করে, বিচক্ষণতা পরিহার করে নির্বুদ্ধিতাকে প্রশ্রয় দেয়, তবে শরীয়াহর সাথে কোনোই সম্পর্ক থাকে না। এমনকি ভুল ধারণাবশত এগুলোকে শরীয়াহর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হলেও।
এরূপ আদর্শ ব্যক্তি বিশেষের জন্যে প্রযোজ্য কোনো রসম-রেওয়াজ বা বিধানের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, কিন্তু এ পদ্ধতি কখনোই শরীয়াহভিত্তিক রাজনীতির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা শরীয়াহভিত্তিক রাজনীতির ভিত হওয়া উচিত নমনীয়তা, সহিষ্ণুতা এবং স্থান কাল পাত্র ও মানুষের পরিবর্তনকে বিবেচনায় রাখা।
খারেজী ভাবাদর্শের প্রবক্তারা সততা ও সাহসিকতার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মনে হলেও তারা সঙ্কীর্ণমনা এবং দ্বীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অদূরদর্শী। এছাড়া অন্যের সঙ্গে আচার আচরণে তারা সহিংস এবং সব সময় সকলকে এমনকি ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে প্রত্যাখ্যান, অভিযুক্তকরণ ও সন্দেহ করার বাতিকগ্রস্থ। তারা কেবল নিজেদের মতামতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর এ আত্মপ্রসাদ অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এরপর রয়েছে তাকলিদী ভাবাদর্শ যা অন্ধ অনুকরণের নামান্তর। এ পদ্ধতির অনুসারীরা তাদের আদর্শিক, রাজনৈতিক ও আইনগত প্রশ্নের উত্তর খোঁজে নিজ নিজ মাজহাবের পূর্ববর্তী ইমাম ফকিহদের রচিত বই পুস্তকের মধ্যে। তারা কখনো নিজস্ব গণ্ডীর বাইরে যেতে চায় না। মাজহাবের অনুসরণকারীরা শরীয়াহকে প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে না। তারা নিজ নিজ তরিকা ও পদ্ধতির আলোকে যেমন বিচার বিবেচনা করে তেমনি বর্তমান যুগ, সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ এবং উদ্ভূত সমস্যাদি সমাধানেও তাদের আগ্রহ নেই। এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি আল্লাহতায়ালা যা প্রশস্ত করেছেন তাকে সঙ্কীর্ণ এবং ইসলাম যা সহজসাধ্য করেছে তাকে দুঃসাধ্য করে ফেলে।
ইসলামী আন্দোলন এসব অস্বাভাবিক ভাবাদর্শ এবং এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে তার অনুসারীদের মুক্ত করতে না পারলে এবং অনুমোদিত আমলের ফিকাহ বা ফিকহ উস সুনান, শরীয়াহর উদ্দেশ্য সংক্রান্ত ফিকাহ, ভারসাম্যের ফিকাহ এবং অগ্রাধিকারের ফিকাহ সমন্বিত যে নতুন ধারার ফিকাহর ওপর আমরা দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করতে চাই সেই ফিকাহর লালন পালন ও চর্চা না হলে ইসলামী আন্দোলন একটি যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে তুলতে পারবে না।
রাজনৈতিক ফিকাহর অসম্পূর্ণতা
ইসলামী আন্দোলনের ত্রুটিপূর্ণ, অস্বাভাবিক ধ্যানধারণা ও সিদ্ধান্তসমূহ এবং অস্বাভাবিক বিয়োজন পদ্ধতির সংশোধন করা দরকার।
রাজনৈতিক ফিকাহর ক্ষেত্রে এসব অদ্ভূত ধারণা, নিয়মকানুন ও পদ্ধতি বহুলাংশে সুস্পষ্ট। অতীতে ইবাদত, লেনদেন, বিবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তা এতো গুরুত্ব পায়নি।
আজকের রাজনৈতিক ফিকাহতে নানারকম ভ্রান্ত ধারণা ও দুর্বল সিদ্ধান্ত অনুপ্রবেশ করেছে। ইসলামপন্থীদের মন মানসিকতায় এগুলো এমন ভিন্ন ভিন্নভাবে শেকড় গেড়েছে যে কেউ যখন কোনো বিধি প্রয়োগ করেন তখন তা অন্যের বিধি বিধানের সাথে পূর্ব ও পশ্চিমের মতো ব্যবধান সৃষ্টি করে।
কেউ কেউ পরামর্শ বা শূরাকে বাধ্যতামূলক কর্তব্য নয়, নিছক তথ্য আদান প্রদানমূলক ব্যাপার বলে মনে করেন। আবার অন্যরা জাতির প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ ছাড়াই রাষ্ট্রপ্রধানকে যুদ্ধ ঘোষণা এবং চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা অর্পণ করেন। আবার আরেক গ্রুপ গণতন্ত্রকে একটি কুফরী মতবাদ বলে মনে করেন।
আবার এমন লোকও আছে যারা বিশ্বাস করে ইসলামী রাজনীতিতে নারীদের কোনো স্থান নেই এবং তাদের একমাত্র স্থান হচ্ছে পিত্রালয়। সেখান থেকে তারা দু’টি গন্তব্যে যেতে পারে-স্বামীগৃহে অথবা কবরে। এ গোষ্ঠীর মতে, স্থানীয় সরকার অথবা পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, নির্বাচনেও নারীর ভোটদানের অধিকার নেই।
আরো এক শ্রেণীর লোক আছে যারা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ইসলাম নাকচ করে দিয়েছে বলে মনে করে। তাদের বিশ্বাস, মুসলিম রাষ্ট্রে কোনোরকম রাজনৈতিক মত ও পথের অনুসারী দল বা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
কয়েকজন দ্বীনি ভাই আমাকে জনৈক উৎসাহী লেখকের ‘এন্টারিং পার্লামেন্ট ইজ এগেইনস্ট তাওহীদ’ শিরোনামে রচিত নিবন্ধটি দেখালে আমি হতবাক হয়ে যাই। কেননা এ নিবন্ধে পার্লামেন্টের সদস্য হওয়াকে তাওহীদ বিরোধী বলা হয়েছে। আমি এতে আমল ও আকিদার মধ্যে অদ্ভূত বিভ্রাট লক্ষ্য করলাম। আমলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে ন্যায় ও অন্যায়, বিশ্বাস অবিশ্বাস নয়। এসব শরীয়াহ রাজনীতির অংশ যেখানে ইজতিহাদের পুরস্কার সঠিক হলে দ্বিগুণ এবং ভুল হলেও একটি সওয়াব নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাজনীতি সংক্রান্ত একটি পার্থিব বিষয়কে কেন্দ্র করে সে যুগের খারিজীরাও ইমাম আলী রা.-কে অবিশ্বাসী বলে ফতোয়া দিয়ে একই ভুল করেছিল। যে বিষয়টিকে তারা মূল ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অঙ্গীভূত করেছিল সেটি হচ্ছেঃ তিনি আল্লাহর দ্বীনের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছেন, কিন্তু আল্লাহ ছাড়া কারো ফায়সালার অধিকার নেই। ইমাম অত্যন্ত প্রঞ্জল ভাষায় তাদের অভিযোগের জবাব দিয়ে বলেছিলেনঃ ভুলকে প্রতিষ্ঠার জন্যে একটি সঠিক বাণীর আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক ফিকাহর প্রয়োগ
আফগানিস্তানের আলেমগণ বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে জিহাদে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি তাদের মধ্যে কেউ কেউ নারী শিক্ষাকে হারাম মনে করেন এবং একইভাবে জনপ্রতিনিধি অথবা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের জন্যে নির্বাচনকে একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহারের প্রশ্নেও একই মত পোষণ করেন। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ নির্ধারণ এবং শূরা বাধ্যতামূলক হওয়ার বিষয়টিকে তারা হারাম বলে বিশ্বাস করেন।
কতিপয় দ্বীনি ভাই যারা এসব চিন্তায় বিশ্বাস করেন তারা এসব বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করার সময় বললেন, আজকের যুগে ইসলামী আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে এমন ধ্যানধারণায় বিশ্বাস করা হয় যেটাকে তারা অনৈসলামী বলে মনে করেন এবং আমরা মুসলমানরা সফল হতে পারব না যতক্ষণ না ইসলামের লক্ষ্য অর্জনে ইসলামী কৌশল ব্যবহার করা হয়।
আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাঃ মুসলমানরা যদি তাদের স্বার্থেই প্রেসিডেন্টের কার্যকালের মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয় তাহলে হারাম হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে?
তারা জবাব দিলেনঃ এটি প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. এর সময় থেকে চলে আসা মুসলিম প্রথার বরখেলাপ। কোনো খলিফাই নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে নির্বাচিত হননি। বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশেদীন আজীবন শাসন ক্ষমতার বহাল ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সা. খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রতিটি রীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করার জন্যে আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ সা. নব-উদ্ভাবিত বিষয় বা বিদআত সম্পর্কে আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেনঃ দ্বীনে প্রতিটি নব উদ্ভাবন বা বিদআত হচ্ছে সরল পথ থেকে বিচ্যুতি। আর এটি মানুষের উদ্ভাবিত একটি নতুন বিষয় (আবু দাউদ ও তিরমিজি)।
এর জবাবে আমি বললাম, আমাদেরকে খোলাফায়ে রাশেদীনের রীতি অনুসরণের আগে রাসূলের সা. সুন্নাহ অনুসরণের আদেশ দেয়া হয়েছে। কেননা সুন্নাহ ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস বিধায় যে কোনো বিষয়ে মতভেদ হলে কোরআনের পাশাপাশি সুন্নাহরও শরণাপন্ন হতে হবে। আল ইরবাদ বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছেঃ আমার সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের রীতি অনুসরণ করো। সুতরাং পয়লা আপনাকে রাসূলের সা. সুন্নাহর আশ্রয় নিতে হবে।
সকলেই জানেন রাসূলের সা. সুন্নাহ হচ্ছে তাঁর কথা, কাজ অথবা কোনো কাজের প্রতি তাঁর সম্মতি। তাঁর কাজ কোনো ক্ষেত্রে বিশেষে বাধ্যতামূলক নাও হতে পারে বরং কেবলমাত্র সম্মতি বা অনুমোদনের ইঙ্গিত দেয় যদি না এর সাথে এমন সাক্ষ্য প্রমাণ থাকে যাতে তার সম্মতি বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে পড়ে।
এ কারণে খোলাফায়ে রাশেদীন যখন দেখেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. যে উদ্দেশ্যে একটি কাজ করেছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ কাজ বা পদক্ষেপ মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূল হবে না তখন তারা রাসূলের সা. সে কাজের বিপরীতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এর একটি উদাহরণ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সা. খায়বর বিজয়ের পর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। কিন্তু ওমর রা. ইরাকের পল্লী অঞ্চল জয়ের পর তা করেননি। কারণ সে সময়ের প্রেক্ষিতে তার করা তিনি সমীচীন মনে করেননি। রাসূলের সা. অনেক সাহাবি ওমরের এ মতের বিরুদ্ধে যুক্তি পেশ করেন, বিশেষ করে এ কারণে যে তাঁর সিদ্ধান্ত আক্ষরিক অর্থে সূরা আন্ফালের ৪১ নং আয়াতে বর্ণিত সাধারণ বিধিমালার পরিপন্থী ছিল। এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ আর জেনে রাখো যুদ্ধলব্ধ যা কিছু গণিমতস্বরূপ তোমাদের হস্তগত হয় তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহর জন্যে।
ওমর রা. এ বলে মন্তব্য করেনঃ আমি সম্পদকে বর্তমান ও ভবিষ্যতে মানুষের জন্যে যথেষ্ট মনে করছি। আপনারা কি চান আগামী প্রজন্ম এমন অবস্থঅয় পড়ুক যে তাদের জন্যে কিছুই রাখা হয়নি?
এর অর্থ, ওমর রা. আগামী প্রজন্মের কথা ভেবেই উপরোক্ত বিবেচনা করেছেন যা মুসলিম উম্মাহর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার লক্ষ্যে এক চমকপ্রদ পদক্ষেপ। যেন আগামী প্রজন্মের স্বার্থ উপেক্ষা করে কেবল বর্তমান প্রজন্ম বিলাসী জীবনযাপন করতে না পারে। হযরত ওমরের এ পদক্ষেপ নেয়ার পেছনে যুক্তির ভিত্তি ছিল সূরা আল হাশরের ১০ নং আয়াত। যেখানে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে গণিমতের মাল বণ্টনের বিধান উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ আর যারা তাদের পরে এসেছে। ইমাম ইবনে কুদামা রাসূলুল্লাহর সা. এবং ওমরের পদক্ষেপের মধ্যে পার্থক্যের ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ উভয়ে সেটাই করেছেন যা তাদের সময়ের জন্যে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত মনে হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সা. এর কোনো কোনো কাজ সুন্নাহর অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীদের জন্য তা বাধ্যতামূলক নয়। তাঁর সাহাবিরা কখনো কখনো কোনো কোনো বিষয় বিবেচনায় রেখে এর বিপরীত কাজ করেছেন। তাহলে পরবর্তী মুসলমানদের পদক্ষেপ কেন তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে যারা তাদেরও পরে আসবে?
কোনো দৃষ্টান্ত আইনগত বাধ্যবাধকতার যথার্থ কারণ হতে পারে না। দৃষ্টান্ত কেবল সংশ্লিষ্ট স্থান, কাল ও পরিস্থিতির জন্য পর্যাপ্ত। এসব উপাদান যদি পরিবর্তিত হয় তবে তার ভিত্তিতেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
এখানে মুল বিষয় হচ্ছে, আমাদের আগের যে সব ব্যবস্থা ও বিধান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আমাদের সময়, পরিবেশ ও পরিস্থিতির জন্য উপযোগী ব্যবস্থা মূল গ্রন্থ ও আমাদের উদার শরীয়াহর লক্ষ্যের আওতার মধ্য থেকেই বেছে নিতে হবে।
শাসকদের কার্যকালের মেয়াদ সীমিতকরণের বিরুদ্ধে মুসলিম পণ্ডিতদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে যে বিতর্ক, তা বেশ বিভ্রান্তিকর বিষয়। একজন শাসক আজীবন রাজত্ব করতে পারেন বলে যে ঐকমত্য রয়েছে তা নিয়ে বিতর্কের প্রশ্ন নেই। তবে কার্যকালের মেয়াদ সীমিতকরণের বিষয়টি নিয়ে কখনো আলোচনা হয়নি বা গবেষণা করা হয়নি। এটি সম্পূর্ণ একটি নীরব বিষয় ছিল। বলা হয় নিশ্চুপ মানুষ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। তেমনি যে বিষয়ে স্কলারদের সিদ্ধান্ত নেতিবাচক বা ইতিবাচক কোনোটিই নয় সেটাতেও তাদেরকে জড়ানো উচিত নয়।
অন্যদিকে বলা হয় রাষ্ট্র প্রধানের মেয়াদ নির্ধারণ ইসলামে একটি নব উদ্ভাবিত বিষয় বা বিদআত এবং এ ব্যাপারে সর্বসম্মত রায় হচ্ছে প্রতিটি বিদআতই বিচ্যুতি। আমরা এ বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ স্বীকার করি অর্থাৎ প্রতিটি বিদআত মানে বিচ্যুতি-কিন্তু বক্তব্যের প্রথম অংশ অর্থাৎ এ ধরণের সিদ্ধান্ত শরীয়াহর দৃষ্টিতে বিদআতের পর্যায়ে পড়ে এর কোনো প্রমাণ নেই।
কোনো নতুন জিনিস বা আবিষ্কারের বিরুদ্ধে ইসলাম বিদআত নামে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে এরূপ ধারণা করা ভুল। প্রকৃতপক্ষে কোনো নির্ভেজাল দ্বীনি বিষয়ে কিছু উদ্ভাবনেই কেবল বিদআত হতে পারে। যেমন ঈমান, ইবাদত ও এগুলোর শাখা প্রশাখা। কিন্তু জীবনের পরিবর্তনশীল বিষয়গুলো যেমন রীতি, ঐতিহ্য, প্রথা, প্রশাসনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতি এগুলো আলেমদের ভাষায় ‘জনগণের’ আওতায় পড়ে, যার ব্যাখ্যা আমরা পাই ইমাম আল শাতিবীর ‘আল-ইতিসাম’ গ্রন্থে। একারণেই রাসূলের সা. সাহাবিরা অনেক কিছু করেছেন যা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা. করেননি। যেমন আল-কোরআনের অনুলিপি লিখন, রেজিস্টার খাতাপত্র ব্যবহার, ভূমি কর আরোপ ও জেলখানা নির্মাণ। রাসূলের সা. সাহাবিদের পরবর্তী মুসলমান তাবেঈনরা তাদের সময়ে এমন কিছু করেছেন যা তাদের পূর্ববর্তী সাহাবিরা করেননি। যেমন মুদ্রা তৈরী, ডাক সার্ভিস প্রবর্তন ইত্যাদি।
মুসলমানরা আরো অনেক কিছু উদ্ভাবন করেছেন যা রাসূলুল্লাহ সা. বা তাঁর সাহাবিদের জামানায় শোনাও যায়নি। যেমন ধর্ম বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব ও মানবিক বিজ্ঞানের মতো বিজ্ঞানের নানা শাখা প্রশাখার উদ্ভাবন।
সীরাতের ভুল প্রয়োগ
রাজনৈতিক ফিকাহর ক্ষেত্রে ভ্রান্তি ও ভুল সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ হচ্ছে রাসূলের সা. সুন্নাহ এবং সীরাত বিষয়ক বিভ্রাট। ইসলামে পবিত্র কোরআন ছাড়াও সুন্নাহ হচ্ছে আইনের একটি উৎস। আল-কোরআন হচ্ছে আইনের ভিত্তি ও মূল এবং সুন্নাহ হচ্ছে ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ।
তবে কেউ কেউ সুন্নাহর স্থলে সীরাতকে স্থান দিয়ে ভুল করে থাকেন এবং সীরাতের ঘটনাবলী এমনভাবে উল্লেখ করেন যেন এগুলো কোরআন ও সুন্নাহর মতোই বাধ্যতামূলক।
সীরাত সুন্নাহর সমার্থবোধক নয়। কারণ সীরাতে এমন বিস্তারিত বিষয় থাকে আইনের ক্ষেত্রে যেগুলোর আদৌ কিছু করার নেই। এ জন্য ফকিহগণ সুন্নাহর সংজ্ঞার সাথে সীরাতকে জড়িয়ে ফেলেননি। তারা শুধু এটুকুই বলেছেনঃ সুন্নাহ হচ্ছে তাই যা রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, করেছেন বা সম্মতি দিয়েছেন। তারা এখানে সীরাতকে অন্তর্ভুক্ত করেননি।
কিন্তু মুহাদ্দিসগণ রাসূলের সা. কাজ, কথা ও সম্মতির সঙ্গে তিনি দেখতে কেমন ছিলেন, তাঁর আচার ব্যবহার কেমন ছিল এবং তাঁর জীবন পদ্ধতি কি রকম ছিল এসবের বিবরণ সংযোজন করেছেন। আইন কানুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা সে বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ না করে তারা সাধারণত রাসূলুল্লাহ সা. সংক্রান্ত খুঁটিনাটি সব বিষয় সংগ্রহ করেন। রাসূলের সা. জীবনের সব কিছু তথা তাঁর জন্ম, পরিচর্যা, লালন-পালন, বিবাহ, আচার আচরণ, শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং জন্ম মৃত্যু সংক্রান্ত অন্য সকল খুঁটিনাটি বিষয় সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।
এখানে আমাদের চিন্তার কারণ হচ্ছে কোনো কোনো ইসলামী কোন গ্রুপ কোনো সিদ্ধান্তের সমর্থনে সীরাতকে চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে গণ্য করে। তারা বিশ্বাস করে সকল মুসলমানের জন্য এটি বাধ্যতামূলক। এখানে আমি দু’টি বিষযের উল্লেখ করতে চাই।
প্রথমত, সীরাতের মধ্যে এমন সব ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা অকাট্য প্রমাণ ছাড়া এক বর্ণনাকারীর কাছ থেকে আরেক বর্ণনাকারী পর্যন্ত চলে এসেছে। কারণ এসব বর্ণনাকারী এমন হালকাভাবে সীরাতের বর্ণনা করেছেন যে শরীয়াহর বিধিবিধান এবং হালাল হারাম সম্পর্কিত বর্ণনা দিতে গিয়ে কোনো হাদিসের বরাত ব্যবহার করেননি।
দ্বিতীয়ত, সীরাত রাসূলের সা. জীবনযাত্রার ব্যবহারিক অংশের চিত্র। রাসূলের কোনো কর্মকান্ড বাধ্যবাধকতা আরোপ করে না, তা কেবল সম্মতির আভাস দেয়। বাধ্যবাধকতা কার্যকর করতে আরেকটি প্রমাণ থাকা চাই।
এটি সত্য, আমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে ঘোষনা করা হয়েছেঃ নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ বিদ্যমান রয়েছে তোমাদের অনুসরণের জন্য (সূরা আহ্জাবঃ ২১)। নৈতিক আচার ব্যবহার, মূল্যবোধ ও সাধারণ ক্ষেত্র রাসূলুল্লাহ সা. এর আদর্শ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক তবে খুঁটিনাটি বিষয়ে নয়।
যদি প্রকাশ্যে দাওয়াত প্রচার সম্ভব হয় এবং অনুমোদিত হয় তবে রাসূলের সা. আদর্শ অনুকরণের জন্য গোপন কাজ করার দরকার নেই। প্রয়োজন না হলে কেবল রাসূলের সা. দৃষ্টান্ত অনুসরণের জন্য দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আমাদের আবাসভূমি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে হিজরত করার দরকার নেই।
এ কারণেই মক্কা বিজয়ের পর প্রত্যেক মুসলমানের জন্য মদিনায় হিজরত করা আর বাধ্যতামূলক নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ জিহাদ ও জিহাদের জন্য আকূল আকাঙ্ক্ষা ছাড়া মক্কা বিজয়ের পর আর হিজরত নেই; যখন তোমাদের ডাকা হবে তখন যাওয়া উচিত (বুখারী ও মুসলিম)। এর অর্থ হচ্ছে মদিনায় আর হিজরত করতে হবে না। তবে মুসলমানরা যদি কোনো দেশে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয় তা হলে সেখান থেকে হিজরত করার অনুমতি রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সা. শক্তিশালী গোত্রদের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়েছিলেন এবং আওস ও খাজরাজ গোত্র তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিল। এখন আমাদের এরূপ করার আর দরকার নেই। কেননা এ যুগে আর এ পদ্ধতি যথেষ্ট নয়।
রাসূলুল্লাহ সা. মক্কায় দাওয়াতি কাজ তেরো বছর ধরে করেছিলেন বলেই আমাদের জন্যও তেরো বছর ধরে ঈমানের চর্চা এবং দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। কেননা এখন আমরা যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাস করি তারা বিশ্বাস করেঃ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসূল। সুতরাং আমাদের ঈমন-আকিদা শেখার জন্য এত দীর্ঘ সময়ের দরকার নেই।
আমরা যদি এখন সামাজিক সুবিচার, শূরা, স্বাধীনতা, ফিলিস্তিনী অভ্যুত্থান ও আফগান জিহাদের মত বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দেই তবে তা রাসূলের সা. দিক নির্দেশের পরিপন্থী কাজ হবে না। তিনি মদিনায় এ ধরণের কাজগুলো নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। কারণ হিজরতের পূর্বে মক্কায় রাসূলুল্লাহ সা. এমন এক জাহেল ও মুশরেক সমাজে বাস করছিলেন যারা ঔদ্ধত্যের সঙ্গে দাওয়াতকে অগ্রাহ্য করেছিল। সুতরাং সে সমাজের সঙ্গে তাঁর পয়লা লড়াই ছিল তাওহীদ ও দাওয়াতকে কেন্দ্র করে। আমাদের সমাজ অনুরূপ নয়। এ সমাজ আল্লাহ, তাঁর দ্বীন ও তাঁর রাসূলকে সা. বিশ্বাস করে যদিও সমাজে দোষ-ত্রুটি এবং আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুতি থাকতে পারে।
মুসলিম ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার
সূচনা কাল থেকেই ইসলামী আন্দোলন সকল মুসলিম ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার এবং মুক্তি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেছে। কোনো শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তা অস্বীকার করতে পারে না।
ইমাম হাসান আল বান্না তার এক বক্তৃতায় বলেছেন, আমাদের প্রচেষ্টা ও জিহাদ দ’টি প্রধান লক্ষ্যের ওপর কেন্দ্রীভূত- ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম ভূখণ্ড।
তিনি এ দু’টো লক্ষ্যকে সমন্বিত করেছিলেন এ কারণে যে আদর্শ কেবল একটি স্বাধীন ও মুক্ত ভূমিতেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যেখানে এর মূল্যবোধ সংরক্ষণ ও আইনের বিধান বাস্তবায়ন করা যায়। এতেই নিহিত রয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র বা দারুল ইসলামের তাৎপর্য। এমনি ভূখণ্ডের মধ্যেই ইসলাম টিকে থাকে, এখান থেকেই এর কর্মকাণ্ড পরিচালিত এবং জাতিকে দিক নির্দেশনা দান করা হয়।
এ জন্যই ইসলামের ফকিহগণ বিধর্মীদের হাতে দখলীকৃত সকল মুসলিম ভূখণ্ড উদ্ধার ও রক্ষা করা কর্তব্য বলে একমত হয়েছেন এবং সেই ভূখণ্ডের মূসলমানদের জন্য জিহাদ ব্যক্তি হিসেবে যেমন বাধ্যতামূলক তেমনি সমষ্টিগতভাবে সকল মুসলমানকে আগ্রাসীদের হাত থেকে তাদের ভূখণ্ড মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এ জিহাদে জানমাল ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে অবশ্যই সাহায্য করতে হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
সুতরাং মুসলিম ভূখণ্ডের একটি অংশও যদি বিদেশী আগ্রাসনকারীদের দখলে চলে যায় ইসলামী আন্দোলন তা নীরব দর্শকের মত দেখতে পারে না। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কায়রোতে ইখওয়ান সদর দফতর ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত আরব ও মুসলিম বিশ্বের সকল অংশে দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদীন ও বিপ্লবীদেরও কর্মকেন্দ্র ছিল।
হাসান আল বান্না একবার একটি জাতীয় সম্মেলনে ইখওয়ানের জাতীয় দাবিদাওয়া পেশ করেন। তিনি মুসলিম আবাসভূমি গড়ে তোলার কথা বলেন। মিসর ও সুদান সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র আবাসভূমি, আরব জাহানকে নিয়ে একটি বৃহৎ আবাসভূমি যার বিস্তৃতি হবে উপসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত এবং মুসলিম বিশ্বকে নিয়ে বৃহত্তর আবাসভূমি, যার সীমানা আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ভারত মাহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সব ধরণের বৈদেশিক প্রভাব থেকে বৃহত্তম মুসলিম আবাসভূমিতে মুক্ত করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ এবং ইখওয়ানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
হাসান আল বান্না ফিলিস্তিনকে অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে তালিকার শীর্ষে স্থান দেন। তিনি এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে মুসলিম জনতাকে নবী-রাসূল, ইসরা ও মিরাজের পবিত্র ভূমির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার এবং ইহুদী হুমকি সম্পর্কে সতর্ক থাকার তাগিদ দেন। কেননা ইহুদীরা এ ভূমিতে তাদের হিংস্র নখর বসানোর জন্য ওঁত পেতে আছে। আরব ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ দু’টি কিবলার প্রথমটি আল আকসা মসজিদের বিরুদ্ধে যে চক্রান্তের জাল বোনা হচ্ছে সে সম্পর্কে বেখবর অথচ আল আকসায় আল্লাহর রহমত বিজড়িত।
হাসান আল বান্না ফিলিস্তিনী স্বার্থ সমুন্নত করার লক্ষ্যে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন, বহু মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অনেক সভার আয়োজন করেছেন, অসংখ্য লোক বিক্রুট করেছেন, প্রচুর অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। এ ব্যাপারে তার কৃতিত্ব এটি উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হবে যে তার আধ্যাত্মিক অনুসারী ও যোদ্ধারা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে যে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিলৈন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। যার সত্যতা মিসরীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল আল মাওয়াবীসহ অন্যান্য কমাণ্ডার এমন কি খোদ ইহুদীরাও স্বীকার করেছে। কামাল আল শরীফ বিরচিত ‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন এন্ড দি প্যালেস্টিন ওয়ার’ গ্রন্থে এ গৌরবময় জিহাদের অনেক তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন সকল মুসলিম জাতির প্রতিটি স্বার্থ রক্ষায় এবং সব বর্ণের সাম্রাজ্যবাদের মোকাবেলায় স্বীয় ভূমিকা পালন করেছে।
এ কারণেই ইসলামী আন্দালন কমিউনিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্দে পয়লা প্রতিরক্ষা ব্যুহের প্রতীক আফগানিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। এ স্বার্থ এতই গভীর যে অনেকে মনে করেছিলেন ইসলামী আন্দোলন বোধ হয় ফিলিস্তিনী স্বার্থের কথা ভুলেই গেছে। বস্তুত ইসলামী আন্দোলন কখনোই ফিলিস্তিনকে ভোলেনি এবং কখনো ভুলবে না। কেননা ফিলিস্তিন হচ্ছে প্রথম ও সর্বোচ্চ ইসলামী স্বার্থ, এর মুক্তি পয়লা ও সর্বোচ্চ কর্তব্য যা আফগান মুজাহিদরাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।
এখন ফিলিস্তিনী লড়াইয়ে দরকার হচ্ছে একটি ইসলামী পতাকার যা এর চারপাশে লোকদের সমবেত এবং এক সত্তা হিসেবে ঐক্যবদ্ধ করবে। মসজিদসমূহে বিপ্লবের বিস্তার এবং গণঅভ্যুত্থান বা ইনতিফাদার মাধ্যমে এটিই ঘটেছে যার মুল শ্লোগান আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এবং আল্লাহ সর্বশক্তিমান (আল্লাহু আকবর)। অটল, সাহসী ও সজাগ ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস এ অভ্যুত্থানকে এক সংঘবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করেছে।
হামাস-মুসলিম ও আরবিয় আদি ঐতিহ্যে লালিত ফিলিস্তিনী জনগণের বিশ্বাসের এক প্রতীকী প্রতিষ্ঠান। এ জনগোষ্ঠী এখনো সতেজ। আল্লাহর সাহায্যে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কখনো নির্জীব হবে না। পূতপবিত্র দেহমনের অধিকারী ও জনগোষ্ঠী জিহাদের ঝাণ্ডা এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আন্দোলনকে ইসলামী স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিটি কার্যক্রমের মূল ভূমিকায় থাকতে হবে। যেখান থেকেই ডাক আসুক না কেন, সাহায্যের প্রতিটি ডাকে সাড়া দিতে হবে। ইসলামী আন্দোলনকে ইরিত্রিয়ায় মার্ক্সবাদী খৃস্টান দুঃশাসনের বিরুদ্দে জিহাদে শামিল হতে হবে। সেখানকার জান্তা ইরিত্রিয়াকে গ্রাস করে দেশটিকে একটি উপনিবেশ হিসেবে কব্জা করে রাখতে চায়, জনগণকে সামন্তবাদী ব্যবস্থাধীনে দাস শ্রেণীতে পরিণত করতে চায়।
বিশ্বাসঘাতক খৃস্টান বর্ণবাদী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনকে সুদানের পাশে দাঁড়াতে হবে। খৃস্টানরা সুদানের সকল ভূখণ্ডে তাদের বর্ণবাদী ধর্মান্ধতা চাপিয়ে দিয়ে দেশটিকে মুসলিম উম্মাহ ও আরব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
ফিলিপাইনে পক্ষপাতদুষ্ট খৃস্টান শাসকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সমর্থন দিতে হবে। কেননা খৃস্টান জান্তা সেখানে মুসলমানদের নির্মূল করে যারা কেবল দাসত্বের জীবন মেনে নেবে তাদেরকেই সেখানে ঠাঁই দিতে চায়। যারা না নিজেদের কোনো কল্যাণে আসবে, না অন্যদের।
কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ অথবা স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কাশ্মীরী মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের লড়াইয়ে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। যাতে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদীদের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেয়া যায়। পাকিস্তান ও সামগ্রিকভাবে মুসলিম জগতের বিরুদ্দে কাশ্মীরকে একটি চক্রান্তের ঘাঁটি বানানোর জন্য ভারত সাম্রাজ্যবাদ ধর্মহীন শিক্ষা, পাপাচার ও মাদকাসক্তি ছড়িয়ে দিয়ে এ অঞ্চলের মুসলিম পরিচিতি মুছে ফেলার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
সোমালিয়ার স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে ইসলামী আন্দোলনের সমর্থন দেয়া উচিত। দেশটির স্বৈরাচারী জান্তা মুসলিম পণ্ডিতদের হত্যা করছে এবং ধর্মীয় অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক চরিত্রের অধিকারী যে কোনো ব্যক্তির ওপর জুলুম নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
এসব মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে ইসলামী আন্দোলনের হাতে সঠিক তথ্য থাকতে হবে। এসব মুক্তি আন্দোরনের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামোতে ইসলামী আন্দোলনের কোনো না কোনো পর্যায়ে উপস্থিত থাকা বাঞ্ছনীয়। সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে দূরত্ব দূর করে ঐক্যের জন্য অবশ্যই নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ এবং বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে ছোটখাট মতানৈক্য দূর করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। জিহাদ ক্ষতিগ্রস্ত করার মত সবচেয়ে মারাত্মক উপসর্গ হচ্ছে গ্রুপগুলোর মধ্যেকার অনৈক্য। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন যারা তাঁর রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে, যেন তারা এক নিরেট গাঁথুনির কাঠামো (সূরা সা’ফঃ ৪)।
ফিলিস্তিনী স্বার্থের জন্য বিশ্বের মুসলমানদের সংগঠিত করার দায়িত্বও ইসলামী আন্দোলনকে নিতে হবে। কেননা ইহুদীবাদী আন্দোলন ইসরাইলের স্বার্থে বিশ্বের ইহুদীদের সংগঠিত করেছে। আমাদের ন্যায্য স্বার্থের পক্ষে সারা বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন লোকদের সমর্থন আদায়ে ইসলামী আন্দোলনকে তৎপর হতে হবে।
বর্তমানে ইসলামী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম থেকে এরূপ প্রচেষ্টা চালানো নেহাত জরুরী। কারণ ফিলিস্তিনী সংগ্রাম এখন গুরুতর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ফিলিস্তিনী স্বার্থ পদদলিত করে অধিকৃত অঞ্চলে সোভিয়েত ইহুদীদেরকে এনে বসতি স্থাপনের চক্রান্ত করা হয়েছে। যে চক্রান্তের লক্ষ্য হচ্ছে বৃহত্তর ইসরাইলের স্বপ্ন বাস্তবায়ন, যার সীমানা বিস্তৃত হবে নীল নদ থেকে ফোরাত অতঃপর তাদের খায়েশ হচ্ছে হেজাজ, মদিনা ও খায়বর পর্যন্ত সম্প্রসারণ।
মুক্তি আন্দোলন
ইসলামী আন্দোলনের দৃষ্টি কেবল মুসলিম ভূখণ্ডের দিকে কেন্দ্রীভূত থাকলেই চলবে না। অবশ্যই ইসলামের নীতি অনুসারে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সংহতির স্বার্থে মুসলিম ভূখণ্ড বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে। কিন্তু মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সারা বিশ্বে যারাই ভূমি দখলদারিত্ব, সাম্রাজ্যবাদ, অত্যাচার অবিচার থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করছে তাদের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে।
ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে মানুষের মুক্তির সর্বব্যাপী আবেদন নিয়ে। আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়ে তাকে সম্মানিত করেছেন এবং এ কারণে আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছু তার আয়াত্তাধীন করে দিয়েছেন।
যে কোনো খোদাদ্রোহী তাগুত শক্তির দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করার এবং তাগুতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে তাকে যথোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ইসলামের আগমণ।
হযরত মূসা আ. এর দাওয়াতের মূল কথা ছিল ফেরাউন, কারুন ও হামানের উৎপীড়ন থেকে বনি ইসরাইলকে মুক্ত করা। হযরত মুহাম্মদ সা. এর দাওয়াতের উদ্দেশ্য ছিল সকল ফেরাউন, কারুন ও হামানের কবল থেকে সমগ্র মানব জাতিকে মুক্তি দেয়া যারা মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্দ করে অতি ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে চেপে বসে যার কোনো অধিকার তাদের নেই। এসব শাসক আল্লাহর বান্দাদের প্রতি এমন উন্নাসিক আচরণ করে যেন তারা আল্লাহ মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের অংশীদার। নিজেদেরকে খোদা হিসেবে জাহির করে ও মানুষকে তাদের দাসে পরিণত করে।
রাসূলের সা. এর মাধ্যমে শাসক ও রাজন্যবর্গকে আহ্বান জানিয়ে আল-কোরআন সুস্পষ্ট ও সুউচ্চ কণ্ঠে স্বাধীনতার বাণী উচ্চারণ করেছেঃ আস একটি কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সঠিক, আমরা আল্লাহ ব্যাতীত আর কারো ইবাদত করব না এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করব না এবং আমাদের মধ্যে থেকে কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে প্রভূ বলে মেনে নেব না (সূরা আল ইমরানঃ ৬৪)।
রাবি ইবনে আমির পারস্য সেনাবাহিনীর কমান্ডার রুস্তমের সামনে ঘোষণা দিয়ে বলেছেনঃ আল্লাহ আমাদেরকে পাঠিয়েছেন মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে ও কেবল তাঁরই বন্দেগীর জন্য এবং নানা ধর্মের অবিচার অনাচার থেকে ইসলামের সুবিচারের দিকে মানুষকে ফিরিয়ে আনার জন্য।
সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে কেবল সুবিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়েই তাঁর কিতাব ও রাসূল পাঠিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী দিয়ে প্রেরণ করেছি এবং আমি তাদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও মানদণ্ড যেন মানুষ ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে (সূরা হাদীদঃ ২৫)।
অতএব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির, গ্রুপের বিরুদ্ধে গ্রুপের অথবা জনগণের বিরুদ্ধে জনগণের যে কোনো অত্যাচার অবিচার বিশেষ করে দুর্বল ও নিপীড়ত মানুষের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী ও শক্তিধর মানুষের অত্যাচার অবিচার মূলত সকল ঐশী বাণীরই লঙ্ঘন। এ কারণেই আল-কোরআনে স্বৈরাচারীদের তীব্র সমালোচনা করে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছেঃ কিন্তু তারা (রাসূলগণ) বিজয় ও সাহায্য কামনা করতে লাগল এবং প্রত্যেক অবাধ্য, হঠকারী স্বৈরশাসক সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও ধ্বংস হলো। তার (প্রত্যেক অবাধ্য ও হঠকারী স্বৈরশাসকের) সামনে দোযখ রয়েছে এবং তাকে পুঁজ ও রক্তযুক্ত ফুটন্ত পানি পান করানো হবে (সূরা ইব্রাহীমঃ ১৫–১৬)।
এমনিভাবে আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক অহঙ্কারী স্বৈরাচারীর অন্তরের ওপর মোহর মেরে দেন (সূরা মু’মিমঃ ৩৫)।
অতএব দোযখের দ্বারসমূহে প্রবেশ করো, তাতে অনন্তকাল থাক; বস্তুত অহঙ্কারীদের আবাস কতই না নিকৃষ্ট (সূরা নাহ্লঃ ২৯)।
আল-কোরআনের মক্কী ও মাদানী সূরাগুলোকে অনিষ্টকারীদের কঠোর নিন্দা করা হয়েছেঃ নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা সে সমস্ত লোককে পথ দেখান না যারা জালেম (সূরা মায়েদাঃ ৫১)।
নিশ্চয়ই যারা জালেম তারা কখনো কোনো সাফল্য লাভ করবে না (সূরা ইউসুফঃ ২৩)।
এবং এসব জনপদ আমরা ধ্বংস করলাম যখন তারা জুলুম করল (আল কাহ্ফঃ ৫৯)।
এগুলোই তাদের বাড়িঘর, যা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে তাদের জুলুমের জন্য (সূরা আন নাম্লঃ ৫২)।
আর আপনার রবের পাকড়াও এরূপই হয়ে থাকে, তিনি তখন পাকড়াও করেন জনপদের অধিবাসীদেরকে যখন তারা জুলুম করে, নিঃসন্দেহে তাঁর পাকড়াও হচ্ছে যন্ত্রণাদায়ক ও অত্যন্ত কঠিন (সূরা হূদঃ ১০২)।
অতঃপর যালেমদের শিকড় কেটে ফেলা হলো। আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা ও শোকর যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক (সূরা আন’আমঃ ৪৫)।
আর যারা জুলুম করে তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না, যাতে না আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করে। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো রক্ষাকারী নেই। অতএব কোথাও সাহায্য পাবে না (সূরা হুদঃ ১১৩)।
ইসলাম জুলুম অবিচারকে কঠোরভাবে অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সকল পন্থায় এর বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ জারি করেছে। আর যারা অবিচারের মূলোৎপাটনে কিছুই করবে না তাদেরকে পৃথিবীতে পাপাচারীদের শরিক বলে সাব্যস্ত করা হবে এবং পরকালেও তাদেরকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
এমন কি যে জাতি নির্দ্বিধায় অবাধে অন্যায় অপকর্ম চালিয়ে যায়, কেউ তাদের কুকীর্তির প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে না ইসলাম সেই জাতিগোষ্ঠীকে ঐশী দণ্ডের যোগ্য বলে বিবেচনা করে এবং তাদের ধ্বংস অনিবার্য। আর এরূপ জাতির ওপর যখন আল্লাহর আজাব নাজিল হয় তখন কেউই এ থেকে পরিত্রাণ পাবে না। পাপীরা তাদের পাপের জন্য আর নীরব দর্শকরা তাদের নীরবতার জন্য শস্তির আওতায় পড়বে। আল্লাহতায়ালা বলেনঃ আর সেই ফিতনাকে ভয় কর, যা কেবল জালেমদের ওপরেই পতিত হবে না, আর একথা জেনে রাখো যে আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা (সূরা আল আন্ফালঃ ২৫)।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ মানুষ যদি অন্যায়কারীকে অন্যায় করতে দেখে অথচ তাকে বাধা না দেয়, তাহলে তারা আল্লাহর তরফ থেকে শাস্তির নিকটবর্তী হয়ে যায়, সেই শাস্তি আসে তাদের সকলের ওপরে (আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান ও সহীহ আল জামি আল সগীর)। অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছেঃ যখন আমার উম্মতকে দেখবে তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং কোনো অন্যায়কারীকে বলে না তুমি অন্যায় করছ, তাহলে তুমি তাদের আশা ছেড়ে দিতে পার (আল হাকিম)।
সকল পাপাচারী উল্লিখিত ঘোষণার আওতার মধ্যে পড়ে। তাদের অন্যায় অবিচার মুসলমানদের বিরুদ্ধেই হোক বা অন্যদের বিরুদ্ধে, কারণ সকল অন্যায় অপকর্মই পাপ।
এতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, ইসলাম অন্যায়কারীদের প্রতিরোধ এবং উৎপীড়িত ও দুর্বলদের রক্ষায় সকল ইতিবাচক পদক্ষেপকে উৎসাহিত করে। এমনকি প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষাকে ইবাদত এবং আল্লাহর পথে জিহাদ বলে গণ্য করে। পবিত্র কোরআনে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং উৎপীড়িতদের রক্ষার তাগিদ দিয়ে বলা হয়েছেঃ আর তোমাদের কি হলো যে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করছ না এবং ঐ সব দুর্বল নির্যাতিত ও অত্যাচারিত পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্য যারা প্রার্থনা করছে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে এ জনপদ থেকে উদ্ধার করুন যার অধিবাসীরা অত্যাচারী, আর আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কোনো অভিভাবক দাঁড় করিয়ে দিন যিনি রক্ষা করবেন এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কাউকে পাঠান যিনি সাহায্য করবেন (সূরা আন নিসাঃ ৭৫)।
এখানে মূলত দুর্বল শ্রেণী বলতে বিশ্বাসীদের প্রসঙ্গ এসেছে। তাই এ আয়াতে তাদের দোয়ার কথাই উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু ইসলাম কারো বিরুদ্ধে অন্যায় অবিচার সমর্থন করে না যদিও সে কাঠের হয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছেঃ মজলুমের আর্জি অনুযোগের ব্যাপারে সাবধান হও যদিও সে কাফের হয়। কারণ তাদের আর্জি আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর পথে কোনো বাধা নেই (আহমাদ ও সহীহ আল জামি আল সগীর)।
রাসূলুল্লাহ সা. একবার আবিসিনিয়ার এক ক্ষমতাধর নিষ্ঠুর ব্যক্তির হাতে এক দুর্বল মহিলার ওপর উৎপীড়নের কাহিনী শুনে মন্তব্য করেছিলেনঃ আল্লাহতায়ালা সেই জাতিকে কিভাবে পবিত্র বলে গণ্য করবেন যেখানে শক্তিধরদের হাত থেকে দুর্বলদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয় না (ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান ও সহীহ আল জামি আল সগীর)। উল্লেখ্য, সে সময় আবিসিনিয়ায় খৃস্টান রাজত্ব ছিল।
বাস্তবিকই ইসলামের বিজয় অভিযানের লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচারীদের জুলুম, নিপীড়কদের নিপীড়ন থেকে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষকে উদ্ধার এবং এ জনগোষ্ঠীকে পারস্য ও রোমান সম্রাটদের আধিপত্য থেকে মুক্ত করা। এ কারণেই এসব মানুষ ইসলামকে স্বাগত জানিয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে যারা ঈমান ও নৈতিক সাহসের অধিকারী তাদের কর্তব্য হচ্ছে দুর্বলের ওপর নিপীড়ন প্রতিরোধে পরস্পরকে উৎসাহিত করা এবং উৎপীড়কের কাছ থেকে পূর্ণরূপে দুর্বলের অধিকার ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত তাকে সাহায্য করা। রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে এমনি এক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তিনি আইয়্যামে জাহেলিয়াতে কিশোর বয়সে এমনি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিলফুল ফুজুলের মাধ্যমে। একদল সৎ, কল্যাণকামী ও নিষ্ঠাবান মানুষকে নিয়ে এ সংস্থা গঠিত হয়েছিল যা উদ্দেশ্য ছিল সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের পাশে দাঁড়ানো যেন দুর্বলের অধিকার ও মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
নিরীহ নির্বাক প্রাণীর স্বার্থরক্ষায় যেখানে ইসলাম সোচ্চার, সেখানে নিপীড়িত, নির্যাতিত ও অত্যাচারিত মানুষের অধিকার আদায়ে সে কেন তাদের পাশে দাঁড়াবে না?
মুসলিম সংখ্যালঘু
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম সংখ্যালঘুদের স্বার্থের প্রতি ইসলামী আন্দোলনকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
এ প্রসঙ্গে আমাদেরকে নিম্নোক্ত বিষয়সহ কয়েকটি উপাদান বিবেচনা করতে হবেঃ
১. সারা বিশ্বের মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ বা আরো বেশি হচ্ছে সংখ্যালঘু। প্রায় সাতাশ বছর আগে রিয়াদের ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
২. এ মুসলিম সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিপুল সংখ্যা নিয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সম্প্রদায় হচ্ছে ভারতের মুসলম সংখ্যালঘুরা। প্রায় বিশ কোটির বেশি মুসলমান ভারতে বসবাস করে। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং সাধারণভাবে ইসলামী সংস্কৃতির ওপর এ মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক ও কৃষ্টিগত প্রভাব পড়েছে।
৩. কয়েকটি তথাকথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রকৃত মুসলিম দেশেরই জনগণ। এসব দেশকে শক্তি প্রয়োগ করে কোনো কোনো পার্শ্ববর্তী বড় দেশের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে মুসলিম সম্প্রদায় তাদের মধ্যে বিলীন হয়ে বৃহত্তর সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিপীড়িত সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। এসবের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম প্রজাতন্ত্র উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান। সমীক্ষা চালিয়ে প্রমাণিত হয়েছে এসব দেশ মুসলিম বিশ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
৪. কোনো কোনো মুসলিম সম্প্রদায়কে পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্ব পরিসংখ্যানে সংখ্যালঘু হিসেবে দেখানো হয়েছে। বাস্তব চিত্র এর সম্পূর্ণ উল্টো। সত্যিকার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে মুসলমানরা বিপুলভাবে সংখ্যাগুরু যদিও ভুয়া পরিসংখ্যানে ইচ্ছেকৃতভাবে মুসলিম জনসংখ্যা কম বলে উল্লেখ করা হয়, বিশেষ করে ইসলামের শত্রুরা রাজনৈতিক মতলব হাসিলের জন্যে কয়েকটি অঞ্চলের মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘু হিসেবে পতিপন্ন করে। ইথিওপিয়ার মুসলমানরা হচ্ছে এর অন্যতম জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। সে দেশের মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে অধিকাংশ মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত ও পদদলিত করে রাখা হয়েছে।
সংখ্যালঘুদের যা প্রয়োজন
বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের কাছ থেকে এসব সংখ্যালঘুরা অনেক কিছু পাওয়ার রয়েছেঃ
১. তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে সাহায্য প্রয়োজন যেন এগুলোর মুসলিম চরিত্র সংরক্ষণ করা যায়। ইসলাম নির্মূলের লক্ষ্যে খৃস্টীয়করণের প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলো যে ভয়াবহ অভিযান শুরু করেছে সে প্রেক্ষিতে এ সাহায্য অত্যন্ত জরুরী।
২. ইসলামের মৌলিক আকীদা বিশ্বাস, ইবাদত বন্দেগী, নৈতিক মূল্যবোধ ও বিধি বিধান এসব মুসলিম সংখ্যালঘুর ভাষায় তুলে ধরার জন্যে জ্ঞানের সঠিক উৎস হিসেবে তাদের কাছে মৌলিক ইসলামী বই পুস্তক সরবরাহ করা প্রয়োজন। তাদের জন্যে বিশেষভাবে প্রয়োজন পবিত্র কোরআনের তাফসীর এবং বেশ কিছু সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদিস সংকলন।
৩. মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু ছাত্রকে আরব দেশগুলোর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেয়া জরুরী, সেখান থেকে তারা জ্ঞান অর্জন করে নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে ইসলামের শিক্ষা প্রচার প্রসারে আত্মনিয়োগ করবে। যেমন কুরআনে বলা হয়েছেঃ নিজ কওমে ফিরে এলে যাতে তারা অসৎ কাজ সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে (সূরা তাওবাঃ ১২২)।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এসব বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন দেশের মুসলিম সংখ্যালঘু ছাত্রদের জন্যে তাদের দরজা সম্প্রতি বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ এ সিদ্ধান্ত মুসলিম সংখ্যালঘু, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ইসলামী দাওয়াত এমনকি খোদ মুসলিম উম্মাহর জন্যে বিপজ্জনক।
৪. সংখ্যালঘু দেশগুলোতে আরবি ভাষা শিক্ষা এবং আরবি স্কুলগুলোতে আর্থিক সহায়তাসহ অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতাদান জরুরী অথচ এক্ষেত্রে আরবদের ব্যর্থতার কোনো সীমা নেই। উন্নত দেশগুলো তাদের ভাষা শিক্ষা দেয়ার জনে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। আর এ ভাষার মাধ্যমে তাদের সভ্যতা সংস্কৃতিও প্রচার করছে। কিন্তু আরবরা এক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়। আরবি ভাষার প্রচার ও প্রসারের কথা যখন ওঠে তখন তারা তাদের ধনভাণ্ডর আঁকড়ে ধরে থাকে। মুসলিম সংখ্যালঘুরা তাদের দ্বীন, রাসূল সা. এবং তাদের কিতাবের প্রতি ভালোবাসার আকর্ষণে আল-কোরআন, হাদিস, ইবাদত বন্দেগী, ইসলামী সংস্কৃতি এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সৌহার্দ্য সমঝোতার ভিত হিসেবে আরবি ভাষা শিক্ষার জন্যে স্ব-উদ্যোগে যদি স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা না করত তাহলে আরব বিশ্বের বাইরে আরবি জানা কোনো লোক আমরা দেখতে পেতাম না।
প্রিন্স মুহাম্মদ আল ফয়সাল আল সউদের নেতৃত্বে এবং ড. তওফিক আল শাবী’র পরিচালনায় আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশে আরবি ভাষা শিক্ষা ও প্রসারের জন্যে ‘এসোসিয়েশন অব আরব স্কুলস’ বেশ কিছু উপযোগী কোর্সের আয়োজন করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এ উদ্দেশ্যে সাহায্য সহযোগিতা দান করে। এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
৫. মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্যে এমন ধর্ম প্রচারক বা মুবাল্লিগ ও শিক্ষক প্রয়োজন যারা সংখ্যালঘুদের ভাষায় পারদর্শী। তারা তাদেরই মধ্যে বসবাস করে অজ্ঞদের জ্ঞান, বিপথগামীদের নসিহত, বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব ও ফতোয়া দেবে এবং দ্বীনদারী, তাকওয়া, সম্প্রীতি ও সদিচ্ছার ভিত্তিতে মানুষকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করবে।
অবশ্য সর্বনাশা মুবাল্লিগের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তারা কেবল সমাজের ক্ষতিই করে না, অনর্থক তর্ক বিতর্কের আগুন জ্বালিয়ে হিংসা বিদ্বেষের জন্ম দেয়। এদের মধ্যে কিছু কিছু মুবাল্লিগের নিয়ত ভালো হতে পারে কিন্তু এ নিয়তের সঙ্গে যদি থাকে মূর্খতা তবে তা লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণ হয় বেশি। একটি প্রাচীন প্রবাদে ররয়েছেন, মূর্খ বন্ধুর চেয়ে শিক্ষিত শত্রু কম বিপজ্জনক।
৬. বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও মুবাল্লিগদের সঙ্গে সংখালঘুদের মিটিং, দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাহলে তাদের সামনের চিন্তার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে এবং তাদের মনোবল উজ্জীবিত হবে। যতোটা সম্ভব ঘন ঘন এ ধরণের সাক্ষাত, মিটিং ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা উচিত যেন উম্মাহর প্রাণকেন্দ্র থেকে দূরে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সংখ্যালঘু ভাইয়েরা উম্মাহর মূলস্রোত থেকে নিজেদের উপেক্ষিত অথবা ইসলামী আন্দোলনের চিন্তাপ্রবাহের কেন্দ্রবিন্দু ও নেতৃবৃন্দের সমমর্মিতা থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে না পারেন।
৭. সম্ভবত সর্বাগ্রে তাদের প্রয়োজন হচ্ছে একটি অভিন্ন ফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যেন তারা তাদের অস্তিত্ব ও ধর্মীয় পরিচিতি সংরক্ষণে সক্ষম হতে পারে। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে সারা বিশ্বের সংখ্যালঘুরা যখন সংখ্যাগুরুদের মোকাবিলায় তাদের অস্তিত্ব মজবুত করার জন্যে সব ভেদাভেদ পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন মুসলিম সংখ্যালঘুরা সব সময় একে অপরের বিরুদ্ধে লেগে আছে এবং তাদের সময় ও শ্রম অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন বিবাদ, বিশেষ করে ফিকাহ ও আকীদা সংক্রান্ত ইস্যুকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় বাক-বিতণ্ডার পেছনে নষ্ট করছে।
সকল মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহতায়ালার হুকুম অনুযায়ী একে অপরের পাশে দাঁড়ানো মুসলমানদের জন্যে তো এটিই যথেষ্ট, তাদের মধ্যে এমন একটি ঐক্যবোধ রয়েছে যেখান থেকে তারা যাত্রা শুরু করতে পারে। সেটি হচ্ছে আল্লাহ, রাসূল সা. ও পবিত্র কোরআনের ওপর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তারা ঐক্যবদ্ধ। আমি এটি বলছি যদিও আমি জানি মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে বসবাসকারী মুসলমানদেরই অনেক দুঃখ দুর্দশা আছে। তাহলে মুসলিম বিশ্বের বাইরে অবস্থানকারী সংখ্যালঘু মুসলমানদের অভাব অভিযোগ থাকবে না তা কিভাবে সম্ভব? মুসলিম দেশগুলোর মুসলমানরাই যদি মুসলিম নামধারী শাসকদের হাতে অত্যাচার অবিচারের শিকার হয় তবে আমরা কিভাবে আশ করতে পারি খৃস্টান, কমিউনিস্ট, পৌত্তলিক নির্বিশেষে অমুসলিম শাসকদের অধীনে অমুসলিম দেশের মুসলিমানদের কোনো অভিযোগ থাকতে পারে না?
নেতৃত্ববিহীন জাতি
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলিম ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে সম্প্রসারণশীল এ বিপুল জনগোষ্ঠীর এমন কোনো নেতৃত্ব নেই যারা তাদেরকে সকল ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিতে পারে।
কোনো একদিন আমাদের ছিল খেলাফত ব্যবস্থা যা মুসলিম জাতিকে এক পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আমাদের একজন খলিফা ছিলেন, যিনি ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিভূ ছিলেন। খেলাফত ব্যবস্থার শত্রুরা এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মুসলিম জাতির ঐক্যের প্রতীক এ মহিমান্বিত প্রতিষ্ঠানটিকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। আমাদের আর থাকল না এক অভিন্ন অস্তিত্ব, না রইল এক পতাকা যার তলে আমরা সমবেত হতে পারি।
আমরা খেলাফত পদ্ধতি হারালাম। কিন্তু এর কোনো বিকল্প পদ্ধতিও আমরা উদ্ভাবন করতে পারিনি। সুতরাং কোনো ধরণের নেতৃত্ব ছাড়াই আমাদেরকে চলতে হচ্ছে।
খৃস্টধর্মের নিজস্ব নেতৃত্ব আছে যা এর অনুসারীদের দ্বারা স্বীকৃত। এ নেতৃত্ব এ সুসংগঠিত ধর্মীয় নেতৃত্ব যার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, প্রথা ও জনবল রয়েছে। এর আর্থিক সহায়সম্পদ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরে তৃতীয় স্থানে। খৃস্টান ধর্মপ্রচারকরা মুসলিম দেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িযে আছে। কিন্তু আমাদের মুসলমানদের না আছে মহামান্য খলীফা, না আছে পোপ। আমরা হচ্ছি সেই এতিমের মতো, যে দরজাতেই কড়া নাড়ি সেটাই মুখের ওপর বন্ধ হয়ে যায়।
এক সময় শায়খুল ইসলাম নামে পরিচিতি একটি পদ ছিল। ইসলামের যদিও এ নামে কোনো সরকারী পদ ছিল না। কোনো কোনো পণ্ডিত এতোই জ্ঞানী গুণী শ্রদ্ধাভাজন সাধু-সজ্জন ছিলেন যে মুসলিম জনগণ শ্রদ্ধাভরে তাদেরকে এ উপাধিতে সম্বোধন করতো। আজকের আলেম সমাজ শাসকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে কেবল ন্যায্য কথা বলা থেকেই বিরত থাকে না বরং বিভ্রান্তিকর বক্তব্যও দিয়ে থাকে। ফলে জনগণ বহু বড় বড় শায়খের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাই কোনো আলেমকে আর শায়খুল ইসলাম বলা হয় না। এসব আলেম তাদের মনিবদের ইঙ্গিতে বিপুল সহায়সম্পদ ও উপায় উপকরণ হাতিয়ে নিযে প্রলোভনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনকারী হাক্কানী আলেকদেরকে একধরে করার অথবা তাদেরকে হেয় করার জন্যে উঠে পড়ে লাগে যতক্ষণ না এসব হাক্কানী আলেমের প্রতিরোধ বন্ধ হয়ে যায় এবং জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে।
আন্দোলনের মিশন
ইসলামী আন্দোলনকে সকল ভাবধারা ও গ্রুপসমেত মুসলিম জাতির এ হারানো নেতৃত্বের হাল ধরতে হবে। তাদের মধ্যে থেকে আনুগত্য ও সমর্থনের উপযুক্ত একজন প্রকৃত শায়খুল ইসলামের অভ্যুদয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন সত্যিকার স্কলারদের সহায়তায় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে যাবে। আর ভবিষ্যতে যে শায়খুল ইসলাম আবিভূত হবেন প্রয়োজনের মুহূর্তে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর ডাক দেয়ার সামর্থ্য তার থাকতে হবে এবং সেই ডাকের প্রতি সাড়াও পেতে হবে।
প্রবাসী মুসলমান
ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াসহ দূরপ্রাচ্যে বসবাসকারী মুসলিম সংখ্যালঘু ছাড়াও মুসলিম দেশ থেকে গমনকারী অভিবাসীদের প্রতিও ইসলামী আন্দোলনকে বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।
গুরুত্বের কারণ
মুসলিম অভিবাসীরা এখন আর সংখ্যার কম নয়। তাদের সংখ্যা এখন লাখ লাখ। বিশেষ করে ফ্রান্সে বিপুলসংখ্যক উত্তর আফ্রিকান রয়েছে। বৃটেনে রয়েছে বাংলাদেশী, ভারতীয় ও পাকিস্তানী। জার্মানিতে তুর্কীদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের উপস্থিতির দরুণ মুসলমানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য- এদের পূর্বপুরুষদের বহু দিন পূর্বে আফ্রিকা থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল। এছাড়া ব্যাপক অভিবাসনের কারণেও সেখানে মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে। এমন একটি পশ্চিমা দেশ নেই যেখানে অস্থায়ী অভিবাসী নেই যারা সেখানে লেখাপড়া অথবা কাজের জন্যে গমন করেনি। আবার অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যেও সে সব দেশে গমন করে।
যেসব মুসলিম দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার সুযোগ নেই কেবল সেসব বিষয় অধ্যয়নের লক্ষ্যে বৃত্তি প্রদান করার জন্যে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার পক্ষ থেকে বহু সুপারিশ রয়েছে। এছাড়াও নিজস্ব খরচে অথবা দেশের খরচে প্রতিদিন বহু ছাত্র ছাত্রী বিদেশে সেখানে লেখাপড়া করতে যাচ্ছে। আবার অনেকে চাকরির সন্ধানে অথবা নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার জন্যেও মুসলিম দেশ ছেড়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। সূরা আনকাবুতের ৫৬ নং আয়াতে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা বলেনঃ হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ। নিশ্চয়ই আমার যমিন প্রশস্ত সুতরাং তোমরা কেবল আমারই ইবাদত করো। পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রথমে আল্লাহর নির্দেশনায় ইসলামী আন্দোলনের সূচনা হয়েছে, কোনো ইসলামী সংগঠনের পরিকল্পনা মাফিক হয়নি। তরুণ নরনারীরা স্বদেশের দ্বন্দ্ব-কলহ থেকে ধর্ম নিয়ে বাঁচার জন্যে এবং জ্ঞান, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা অর্জনের আশায় পশ্চিমা বিশ্বে পাড়ি জমায়। সেখানে তারা কাজ করার এবং প্রাচ্যের অভিবাসী, পণ্ডিত ও অন্যান্যের মধ্যে দাওয়াতি কার্যক্রম ছড়িয়ে দেয়ার চমৎকার সুযোগ পায়।
পাশ্চাত্যে ইসলামের উপস্থিতি
আজকের যুগে বিশ্ব রাজনীতিতে যে সমাজের প্রভাব বিদ্যমান সেই সমাজে ইসলামী গোষ্ঠীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ইউরোপ, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় ইসলামী গোষ্ঠীর উপস্থিতি আবশ্যক। কারণঃ
১. অমুসলিমদের মধ্যে সুবচন, যুক্তিসঙ্গত আলাপ আলোচনা এবং অনুকরণীয় আচরণের মাধ্যমে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দেয়ার জন্যেই ইসলামী গোষ্ঠীর উপস্থিতি প্রয়োজন।
২. সুস্থ ইসলামী জীবনযাপনে সহায়ক একটি ইসলামী পরিবেশে নওমুসলিমদের আচার ব্যবহার তদারকি এবং তাদের ঈমানের লালন পালনের জন্যে ইসলামী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আবশ্যক।
৩. পশ্চিমা দেশগুলোতে নবাগত বিশেষ করে পণ্ডিত ও অভিবাসীদের স্বাগত জানানো আবশ্যক এ কারণে যে এসব নবাগত মুসলমান আনসারদের সংস্পর্শ লাভ করবেন যারা নবাগতদের তাদের দেশে বরণ করে নেবেন এবং একটি ইসলামী আবহ সৃষ্টিতে নবাগত মুহাজিরদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন।
৪. ইসলাম বিরোধী শক্তির সক্রিয় বিরোধীতা ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহ ও মুসলিম ভূখণ্ডের স্বার্থ রক্ষার জন্যে ইসলামী গোষ্ঠীর উপস্থিতি আবশ্যক।
খৃস্টধর্ম মতই এসব দেশে অপ্রতিহতভাবে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে থাকবে অথবা কেবল ইহুদীবাদই প্রতিপক্ষ হিসেবে তাদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমানদের বিরোধিতায় লিপ্ত হবে এটি ঠিক নয়। একথা আমি বেশ কয়েক বছর আগে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশে আমাদের মুসলিম ভাইদের কাছে তুলে ধরেছি। অবশ্য একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা, উপযুক্ত সংগঠন এবং অগ্রাধিকারের ফিকাহর আলোকে এ কাজ সমাধা করতে হবে। এজন্যে আমাদের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান, সর্বোত্তম কর্মসূচি ও সবচেয়ে কার্যকর কৌশল অবলম্বনে তৎপর হওয়া উচিত। সুপরিচিত দেশ ও নগরসমূহে মুসলমানদের নিজস্ব সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয়, শিক্ষা ও বিনোদনমূলক সংস্থা থাকা দরকার। প্রবাসী মুসলমানদের মধ্যে আলেম ও ধর্মীয় নেতা থাকাও আবশ্যক যাতে প্রবাসীরা বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে জবাব পেতে পারে এবং কোনো মতভেদ বা বিরোধ দেখা দিলে আলেমগণ যেন সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারেন।
রক্ষণশীলতা ও উদারতা
বিদেশে অবস্থানকারী ভাইদের আমি বলে থাকি, বৃহত্তর সমাজের মধ্যে নিজেদের ক্ষুদ্র সমাজ সংরক্ষণের চেষ্টা করুন। তা না হলে আপনারা অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হবেন না এবং বিলীন হয়ে যাবেন। ইহুদীরা বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে নিজ চিন্তা ও আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে। মুসলমানদেরকেও তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে।
আমি চারপাশের লোকদের জন্যে আমাদের দরজা বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছি না। এটি হবে মৃত্যুর শামিল। যা দরকার তা হলো একীভূত আদর্শের বাণী পৌঁছে দেয়র জন্যে মুক্ত মন নিয়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। এ উদারতা অন্যের অনুকরণ কিংবা অপরের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করা নয়।
অনেক দিন ধরে আমরা একটি অভিযোগ শুনে আসছি, স্বদেশে উপযুক্ত স্থান না থাকায় বহু বিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞের দেশান্তরী হওয়ার ফলে আরব ও মুসলিম মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এ অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তবে কোনোভাবেই তাদের নিজ ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি ও পিতৃভূমির প্রতি আনুগত্য হারালে চলবে না। জনগণ ও আবাসভূমির প্রতি তাদের আনুগত্য ও অনুভূতি নিশ্চিত করার জন্যে আমাদের সব ধরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আর এটি তখনি সম্ভব যখন আল্লাহ, রাসূল সা. এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি তাদের আনুগত্য থাকে। আর শুধু স্বীয় স্বার্থ নয়, জাতির দুঃখ দুর্দশার প্রতি যদি তাদের সহানুভূতি থাকে তাহলেও এ আনুগত্য আশা করা যায়।
অভিবাসীরা যেন পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী জীবনে মিশে না যায়, ইসলামী আন্দোলনের কর্তব্য সেদিকেও খেযাল রাখা। কোথা হতে তারা এসেছে সে ব্যাপারেও প্রবাসীদেরকে অবশ্যই সচেতন করতে হবে।
বিভিন্ন ইসলামী ছাত্র সংগঠন গত তিন দশকে এক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। এর আগে বাম, জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলারপন্থীরা এসব সংগঠন দখল করে রেখেছিল এবং তাদেরই দিক নির্দেশনায় কার্যক্রম পরিচালিত হতো। পশ্চিম গোলার্ধে ইসলামী তৎপরতা সম্পর্কে যারা অবগত তাদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে মুসলিম স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের (এমএসএ) অবদান অস্বীকার করার নয়। এরা বিভিন্ন স্থানে শাখা অফিস স্থাপন করেছে এবং বেশ কয়েকটি সম্মেলনেরও আয়োজন করেছে। মূল সংগঠন এমএসএ থেকেই ইউনিয়ন অব ইসলামিক সোসিওলজিস্ট, সোসাইটি অব মুসলিম সায়েন্টিস এন্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, ইসলামিক মেডিক্যাল সোসাইটি, ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকা ও অন্যান্য সংগঠনের সূত্রপাত হয়। সমাজে স্বাভাবিক অবস্থান থেকে কাজ করার সুবিধার্থে যুক্তরাষ্ট্রেই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রবাসীদের কর্তব্য
আমি কয়েক বছর ইউনিয়ন অব মুসিলম স্টুডেন্টস আয়োজিত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছি। এসব অনুষ্ঠানে আমি আনন্দের উৎস খুঁজে পাই। বৃটেনের মুসলিম স্টুডেন্ট সোসাইটি, ফেডারেশন অব স্টুডেন্ট ইসলামিক সোসাইটিস এবং ইউরোপের অন্যান্য সংগঠনের ক্ষেত্রেও একথা সত্য।
প্রবাসীদের সঙ্গে আমার আলাপ আলোচনায় সব সময় আমি তাদেরকে পাঁচটি কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিঃ
১. প্রবাসীর নিজের প্রতি দায়িত্বঃ নিজেকে হেফাজত করা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
২. পরিবারের প্রতি কর্তব্যঃ ভাঙনের হাত থেকে পরিবারকে রক্ষা করা এবং ইসলামের ভিত্তিতে পরিচালিত করা।
৩. স্বীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি কর্তব্যঃ তাদেরকে এক প্ল্যাটফরমে ঐক্যবদ্ধ করা।
৪. প্রতিবেশী অমুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি কর্তব্যঃ বিচক্ষণতা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় আহ্বান করা।
৫. মুসলিম উম্মাহর স্বার্থরক্ষায় প্রবাসীর কর্তব্যঃ তাদের স্বার্থের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং সাহায্যের হাত বাড়ানো।
সতর্কতামূলক বিষয়
দু’টি ব্যাপারে আমি সতর্ক করতে চাই। বর্ণবাদী ও জাতীয়তাবাদী মানসিকতা এবং চরম পন্থা ও মতানৈক্য। দুঃখজনক যে আমরা কয়েকটি মুসলিম গ্রুপের মধ্যে বর্ণবাদী ও জাতীয়তাবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। এরকম প্রত্যেক গ্রুপ স্বীয় সদস্যদেরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এর ব্যতিক্রম কেবল তারাই যারা আল্লাহর রহমতে এ অন্যায় থেকে রক্ষা পায়।
এমনকি মসজিদগুলোও বিভিন্ন গ্রুপের বলে চিহ্নিত করা হয। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যে আপনি কোনো শহরে গেলে আপনাকে জানানো হতে পারে এটি তুর্কীদের মসজিদ, ঐ মসজিদ মরক্কোর লোকদের, তৃতীয়টি যুগোস্লাভদের, চতুর্থটি ভারতীয়দের, পঞ্চম মসজিদটি পাকিস্তানীদের, ষষ্ঠটি আরবদের অথবা অন্য কোনো আরব গ্রুপের। আর যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের জন্যে তো বিশেষ মসজিদ রয়েছেই।
ইসলাম এসেছে মানুষের মধ্যে নানা মতভেদ দূর করে তাদেরকে সমতার আসনে বসাতে। মসজিদে হচ্ছে এ লক্ষ্য অর্জনে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থা। তাহলে সেটি কিভাবে বিভেদের পন্থা হতে পারে?
এটি সত্যি, প্রবাসীদের প্রথম প্রজন্ম স্থানীয় ভাষা না জানার কারণে প্রথমদিকে এ পৃথকীকরণ জরুরী ছিল। কিন্তু প্রত্যেক দেশে অথবা নগরে বিভিন্ন মুসলিম জনগোষ্ঠেীর মধ্যে একটি বোধগম্য অভিন্ন ভাষার চর্চা না হওয়া পর্যন্ত একই মসজিদে প্রত্যেক গ্রুপের জন্যে আলাদা আলাদা বক্তৃতার ব্যবস্থা করে এ অবস্থার প্রতিকার করা যেতো। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ পৃথক ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেলেও কোনো কোনো গ্রুপ অথবা জাতি গোষ্ঠীর নামে মসজিদ রয়ে গেছে। একটি মসজিদ কেবল সকল মুসলমানদের জন্যেই হওয়া উচিত। আর যে পতাকাটির তলে সকল প্রবাসীর একত্রিত হওয়া উচিত সেটি অবশ্যই ইসলামের পতাকা।
প্রবাসী মুসলমানরা কেবল তখনি শক্তিশালী হবে যখন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। কারণ ঐক্যই শক্তি, অনৈক্য দুর্বলতা। সংহতি সব সময় কাম্য হলেও এটি আরো বেশি দরকার বিদেশী ভূমিতে যেখানে নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে ওঠার জন্যে প্রত্যেকেরই তারই মতো আরেকজনের সংশ্রব আবশ্যক।
দ্বিতীয়ত, উগ্রতা এবং তুচ্ছ খুঁটিনাটি ব্যাপারে আমি হুঁশিয়ার করে দিতে চাই। এ অস্বাভাবিক ব্যাপারটি পশ্চিমা দেশগুলোতে কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করা গেলেও এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে।
প্রাচ্যের মুসলিম ভাইদের উচিত হলো তাদের মতভেদ ও সমস্যাবলী পাশ্চাত্যে আমদানি না করা। এতে এসব নেতিবাচক দিক তাদের নতুন আবাস ভূমিতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। কেননা তাদের স্থান কাল পাত্রের পরিবর্তন হয়েছে। প্রবাসীরা তাদের ধর্মীয় শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন যে স্থান কাল পাত্রের পরিবর্তনের সাথে সাথে ফতোয়ারও পরিবর্তন হয়। সুতরাং তারা যা শিখেছেন, সে অনুযায়ী কাজ করবেন না কেন?
প্রায় বছর দশেক আগে আমি লস এঞ্জেলসের ইসলামি সেন্টার পরিদর্শন করি। সেখানে কয়েকজন নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে- শিক্ষামূলক হলেও কি মসজিদে ফিল্ম দেখানো উচিত? আমি জবাব দিয়েছিলাম, তাতে কি ক্ষতি? এসব চলচ্চিত্রে সৎকর্মের শিক্ষা দেয়া হলে সেগুলো দেখা তো ইবাদতের কাজ। আর মসজিদ তো ইবাদতের স্থান, জ্ঞান ও শিক্ষা লাভের ফোরাম।
আমি আরো বললাম, রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর মসজিদে আবিসিনীয়দেরকে বর্শাসহ নৃত্য করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং তাঁর সহধমির্নী হযরত আয়েশা রা. কে তাদের নাচ দেখার ও তাদেরকে তা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
অন্যেরা জিজ্ঞেস করল, ওয়াজ নসিহত শোনার জন্যে ইসলামী পোশাক পরিহিত নয় এমন মহিলাদের কি মসজিদে প্রবেশ করতে দেয়া যায়? আমি জবাব দিলামঃ হ্যা। আমরা যদি তাদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করি, তাহলে তারা আর কোথায় ইসলামের বাণী ও আল্লাহর কালাম শ্রবণ করবে? যদি আমরা তাদেরকে মসজিদে ঢুকতে বারণ করি, ওয়াজ নসিহত শুনতে বাধা দেই তাহলে আমরা তো তাদেরকে চিরদিনের জন্যে হারাবো। তাদের কাছে তো দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছবে না। কিন্তু তারা যদি মসজিদে আসার সুযোগ পায়, আশ করা যায় আল্লাহ তাদেরকে ইসলামের পথে চলার জন্যে হেদায়েত করবেন।
এ পাণ্ডুলিপিটি ছাপাখানায় পাঠানোর জন্যে প্রস্তুতি নেয়ার সময় আমি আমার সম্মানিত ভাই, বিজ্ঞানী, কবি ও ইসলামের প্রবক্তা ড. হাসানের কাছ থেকে একটি চিঠি পাই। চিঠিতে তিনি লস এঞ্জেলসের ইসলামিক সেন্টারের বেশ কিছু কর্মতৎপরতা এবং মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের সাহায্যার্থে সেন্টারে কাজকর্মের কথা তুলে ধরেন। যে কোনো মুসলমান এ চিঠিটি পড়লে উৎফুল্ল হবেন। কারণ এতে এ সত্যই প্রতিভাত হয়েছে, সঠিক উপলব্ধি ও নেক নিয়তের সমন্বয়ে মানুষ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে ইসলাম কখনোই বিলীন হবে না।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র
আগামী পর্যায়ে ইসলামী আন্দোলনের কর্তব্য হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক ও একনায়কত্ববাদী শাসন, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার ও জনগণের অধিকার হরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। মেকী নয়, প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক স্বাধীনতার পথে আন্দোলনকে সোচ্চার হতে হবে। স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিতে হবে তারা জালেম শাসকদের স্বীকার করে না এবং একনায়কত্ববাদীদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে না। এমনকি কোনো জালেম শাসক সাময়িকভাবে কোন স্বার্থসিদ্ধির জন্যে দৃশ্যত আন্দোলনের প্রতি সদিচ্ছা পোষণ করলেও।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ যখন আমার উম্মাতকে দেখবে তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং কোনো অন্যায়কারীকে বলে না তুমি অন্যায় করছ, তাহলে তুমি তাদের আশ ছেড়ে দিতে পার (আল হাকিম)। তাহলে দাম্ভিক জালেম শাসকদের ব্যাপারে কি করতে হবে যে জনগণকে তারই উদ্দেশ্যে বলতে বাধ্য করে- কী ন্যায়পরায়ণ, কী মহান আপনি, হে আমাদের বীর, আমাদের ত্রাণকর্তা, মুক্তিদাতা।
আল-কোরআন কেবল নমরুদ, ফেরাউন, হামান ও অন্যান্য জালেম শাসকদের নিন্দা করেনি বরং যারা তাদের অনুসরণ করে, তাদের হুকুম মেনে চলে সে সব লোককেও ভর্ৎসনা করেছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ নূহের কওমের নিন্দা করে বলেছেনঃ আর তারা এমন লোকদের অনুসরণ করেছে, যাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি তাদের সমৃদ্ধি নয় ক্ষতির কারণ হয়েছে (সূরা নূহঃ ২১)।
মহান আল্লাহ হুদের লোকদের সম্পর্কেও বলছেনঃ এবং তারা অনুসরণ করল প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারীর আদেশ (সূরা হুদঃ ৫৯)।
ফেরাউনের লোকদের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছেঃ তারা ফেরাউনের আদেশমতো চলতে থাকল এবং ফেরাউনের আদেশ মোটেও ঠিক ছিল না (সূরা হুদঃ ৯৭)। অন্যত্র আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ এবং তারা তার আনুগত্য করল। নিশ্চয়ই তারা নিতান্ত আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ছিল (সূরা যুখরুফঃ ৫৪)।
আধুনিক কালের মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে দৃষ্টিপাত করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন পরিবেশ ছাড়া ইসলামী চিন্তাধারা, ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী জাগরণ বিকাশ লাভ করেনি অথবা ফলপ্রসূ হয়নি। জনগণের ইসলামকে আঁকড়ে থাকার ইচ্ছা স্বৈরাচারী জালেম শাসকদের আমলেই অবদমিত হওয়ার ফলে আন্দোলন ও জাগরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্বৈরশাসকরা গুপ্ত নির্যাতন, প্রকাশ্যে হত্যা ছাড়াও অন্যান্য নিষ্ঠুর কৌশল প্রয়োগ করে জনগণের ওপর জোরপূর্বক সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম ও সেক্যুলারিজম চাপিয়ে দিয়েছে।
আমরা বিভিন্ন সময়ে তুরস্ক, মিসর, সিরিয়া, ইরাক, দক্ষিণ ইয়েমেন, সোমালিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশসহ বহু মুসলিম রাষ্ট্রে স্বৈরশাসনামলে এ নিষ্ঠুর আচরণ প্রত্যক্ষ করেছি।
অন্যদিকে, স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক শাসনামলে ইসলামী আন্দোরন ফলপ্রসূ ও বিকশিত হয়। যেসব সরকার জনগণের ওপর ত্রাস ও জুলুমের রাজত্ব কায়েম করেছিল তাদের পতনের পর ইসলামী আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চারিত হতে দেখা যায়। সুতরায় আমি কল্পনাও করতে পারি না যে ইসলামী আন্দোলন রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে সমর্থন দিতে পারে, স্বৈরশাসকরা কেবল ইসলামের কণ্ঠ ছাড়া আর সব কণ্ঠ সোচ্চার হতে দেবে, ইসলামী চিন্তাচেতনা ছাড়া আর সব চিন্তা-মতবাদ রাজনৈতিক অথবা অন্য যে কোনো রূপে প্রকাশ করতে দেবে। অথচ ইসলামী চিন্তাধারাই এ উম্মাহর প্রাণের কথা বলে এবং তাদের আকীদা বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চেতনা ও অস্তিত্বের অভিব্যক্তি ঘটায়।
অবশ্য কোনো কোনো ইসলামপন্থী গণতন্ত্রের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে। এমনকি ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির প্রতিও তারা সহনশীল নয়। এখানে আমি জোরের সাথে বলতে চাই, ইসলাম গণতন্ত্র নয় আর গণতন্ত্রও ইসলাম নয়। বরং আমি বলব অন্য কোনো নীতি বা পদ্ধতির সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই। উদ্দেশ্য, পন্থা ও পদ্ধতি সবদিক দিয়ে ইসলাম অতুলনীয়। আমি চাই না পশ্চিমা গণতন্ত্র তার খারাপ দিকসহ ইসলামের মাঝে স্থান পাক। আমাদের স্বকীয় মূল্যবোধ ও আদর্শ যোগ করেই কেবল আমরা আমাদের সুবিস্তৃত কাঠামোর মধ্যে পশ্চিমা গণতন্ত্রকে অঙ্গীভূত করতে পারি।
তবে শাসকদের অভিলাষ ও খামখেয়ালীর লাগাম টেনে ধরার জন্যে পৃথিবীতে ইসলাম যে রাজনৈতিক নীতিমালার রূপায়ণ ঘটায় গণতন্ত্রের সৃষ্ট কৌশল ও রক্ষাকবচ তার অনেক কাছাকাছি। এ মূলনীতি হচ্ছে- পরামর্শসভা বা শূরা, সদুপদেশ, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ, অন্যায় আদেশ অমান্য করা, কুফরী প্রতিরোধ করা এবং সম্ভব মতো শক্তি প্রয়োগ করে অন্যায় অবিচারের প্রতিকার। কেবলমাত্র গণতন্ত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে পার্লামেন্টের ক্ষমতার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে। শাসনতন্ত্র লঙ্ঘন করলে জনগণের প্রতিনিধিরা যে কোনো সরকারের ওপর অনাস্থা আনতে পারে। কেবল এরকম এক পরিবেশেই স্বাধীন সংবাদপত্র, স্বাধীন পার্লামেন্ট, বিরোধী দল ও জনতার শক্তির সর্বাধিক উপস্থিতি অনুভূত হয়।
এক্ষেত্রে অনেকের আশঙ্কা যে গণতন্ত্র জনগণকে শক্তির উৎস মনে করে এমনকি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও, যদিও আইন কেবল আল্লাহরই। এ আশঙ্কা অমূলক, কারণ আমরা যে জনগণের কথা বলছি তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে মুসলমান এবং তারা আল্লাহকে প্রভু, মুহাম্মদ সা. কে রাসূল ও ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মেনে নিয়েছে। এ জনগণ তো ইসলাম এবং ইসলামের অলঙ্ঘনীয় নীতিমালা, চূড়ান্ত বিধিবিধানের পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করবে বলে আশা করা যায় না।
যাহোক ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিধানের পরিপন্থী যে কোনো আইন বাতিল বরে গণ্য হবে এমন একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন করে এ আশঙ্কা দূর করা যেতে পারে। কেননা ইসলাম হচ্ছে রাষ্ট্র ধর্ম এবং রাষ্ট্র সকল প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতির বৈধতার উৎস বিধায় এর লঙ্ঘন করা যেতে পারে না।
এটি জেনে রাখা দরকার আইন আল্লাহর, এ মূলনীতি মেনে নেয়ার মাধ্যমে সতত পরিবর্তনশীল জীবন ও জাগতিক ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইন কানুন তৈরীর ক্ষেত্রে জাতির অধিকার হরণ করা হয় না।
আমরা মূলগ্রন্থ কোরআন, শরীয়াহর সামগ্রিক লক্ষ্য ও ইসলামের মর্মবাণীর সীমার মধ্যে থেকে আইন বিধি প্রণয়ন করতে চাই। বাধ্যতামূলক আদেশ নিষেধের সংখ্যা খুবই কম, অন্য দিকে ঐচ্ছিক অথবা আইন প্রণয়নের উন্মুক্ত পরিসর খুবই ব্যাপক। কোরআনের হুকুম আহকাম এতো নমনীয় ও বিস্তীর্ণ যে এগুলো থেকে একাধিক উপলব্ধির অবকাশ রয়েছে এবং একাধিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যেতে পারে। এরই ফলে ইসলামের সুবিস্তৃত কাঠামোর আওতায় কয়েকটি মাজহাব ও দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে।
সম্প্রতি কাতারে প্রবর্তিত কয়েকটি আইন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছি এগুলোর মধ্যে কল্যাণ অর্জন ও অকল্যাণ বর্জনের ভিত্তিতে বহু সংখ্যক অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোরআনে দু’একটি ছাড়া এসব বিষয়ের সরাসরি উল্লেখ নেই।
মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী আন্দোলনের প্রতি সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হচ্ছে ফেরাউনী আইন। ফেরাউনরা মনে করতো তাদের মতামতই অভ্রান্ত ও সঠিক যা কখনো ভুল হতে পারে না। এ ধরণের শাসকরা ফেরাউনের যুক্তিকে গ্রহণ করেঃ আমি সেই পথই দেখাই যা আমি সঠিক মনে করি এবং তোমাদেরকে কেবল মঙ্গলের পথই দেখাই (সূরা মু’মিনঃ ২৯)।
এসব শাসক বিরুদ্ধবাদী যে কোনো মতামতকে অগ্রাহ্য করে এমনকি দোষারোপও করে, ঠিক যেমন মূসা আ. এর ব্যাপারে ফেরাউন বলেছিলঃ আমার আশঙ্কা হয় যে সে তোমাদের ধর্মই পরিবর্তন করে ফেলবে অথবা রাজ্যের মধ্যে কোনো বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলবে (সূরা মু’মিনঃ ২৬)।
জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু
মুসলিম ও আরব বিশ্বের নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের একটি চূড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে।
জাতিগত সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান
ইসলামী ব্যবস্থায় নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগত সংখ্যালঘুরা কোনো সমস্যা নয়। কারণ ইসলাম এক বিশ্বাস, এক কিবলা এবং ঘনিষ্ঠ ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সব বর্ণগোষ্ঠীকে এক প্লাটফরমে সমবেত করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ণ, ভাষা ও আবাসভূমি নির্বিশেষে সকল মুসলমান এক জাতি। আরব, পারসিক, বার্বার, কুর্দী, তুর্কী, ভারতীয় অথবা অন্য যে কোনো জাতিগোষ্ঠীর সব মুসলমানকে ইসলাম সমান চোখে দেখে। তাদের মধ্যে নিম্নস্তরের মানুষটিও স্বীয় পরিচয়ে সর্বোচ্চ স্তরের মানুষটির মতোই কথা বলার হকদার এবং তারা একদেহ একপ্রাণ হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা তাদের সম্পর্কে বলছেনঃ মুমিনগণ তো সকলেই পরস্পর ভাই (সূরা হুজুরাতঃ ১০)।
তাকওয়া ছাড়া কোনো আরব অনারবের চেয়ে, কোনো অনারব আরবের চেয়ে, কোনো শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ’র চেয়ে, কোনো কৃষ্ণাঙ্গ শ্বেতাঙ্গ’র চেয়ে উত্তম নয়। মহান আল্লাহ বলেছেনঃ নিশ্চয়, তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত যার তাকওয়া সর্বাধিক (সূরা হুজুরাতঃ ১৩)।
সকল যুগের সকল মুসলমানের চোখে পারস্যের সুলায়মান রা. আবিসিনিয়ার বেলাল রা. এবং রোমান সুহায়েবের রা. মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান কী ছিল প্রত্যেকের কাছে তা সুবিদিত।
অনারব পণ্ডিতরা ইসলাম ও আরবি ভাষার জন্যে যে অবদান রেখেছেন ইসলামের কোনো পণ্ডিত তা অস্বীকার করতে পারবেন না। ইসলামের ইতিহাস এরূপ প্রখ্যাত পণ্ডিত ও প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বদের দৃষ্টান্তে ভরপুর। যেমন, আল হাসান আল বসরী, ইবনে শিরীন, আতা, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, আবু হানিফা, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, আল তিরমিজি, আল নাসাঈ, ইবনে মাজাহ প্রমুখ।
তারা সকলে মূলত অনারব হলেও ইসলামের সুবাদে তারা আরব বলে পরিচিতি লাভ করেন। আরবি তাদের ভাষা হয়ে ওঠে যেন তারা কোরআনের ভাষায় কথা, লেখা ও গবেষণা করতে পারেন। ইবনে আসাকির বর্ণিত এক হাদিসে উল্লিখিত হয়েছেঃ আরব হওয়ার জন্যে আরব মাতা পিতার দরকার নেই, ভাষাই যথেষ্ট। যে আরবি ভাষায় কথা বলে সেই আরব।
কুর্দী, বার্বার, পারসিক, মালয়েশীয় এবং অন্যান্য অনারবদের মতো যারা ইসলাম গ্রহণের সময় আরবিকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করেনি তাদের হৃদয় মন ইসলামী সংস্কৃতি তথা ইসলামের প্রভাবে আরবিয় হয়ে যায়। কারণ আল্লাহর অনুপ্রেরণায় তাদেরকে সরল পথ প্রদর্শনের জন্যে বহু শতাব্দী আগে আরবরাই ইসলামের বাণী নিয়ে তাদের ভূখণ্ডে পদার্পণ করেন।
প্রত্যেক মুসলমান আরবি ভাষাকে ভালোবাসে কেননা এটি কোরআন, সুন্নাহ ও ইবাদতের ভাষা। প্রতিটি মুসলমান আরব ভূমিকে ভালোবাসে কারণ সেখানে কাবা, মসজিদে নববী ও রাসূল সা. এর রওজা মুবারক অবস্থিত। প্রত্যেক মুসলমান আরবদেরকে ভালোবাসে, কেননা তারা রাসূল সা. ও ইসলামের অতন্ত্র প্রহরী এবং তারা সারা বিশ্বে ইসলামকে ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রাচীন এক প্রবাদ হচ্ছে- আরবরা শক্তিশালী হলে ইসলামও শক্তিশালী হবে; তারা দুর্বল হলে ইসলামও দুর্বল হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগত সমস্যা নেই বরং ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিই নৃতাত্ত্বিক বা জাতিগত সমস্যার অভ্রান্ত সমাধান দিতে পারে। কিন্তু আরবরা যদি আরব জাতীয়তাবাদের ডাক দেয়, যার সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই, তাহলে কুর্দীরা কুর্দী জাতীয়তাবাদের দাবি করবে, বার্বাররা বার্বার জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলবে আর এভাবে চলতে থাকলে এক উম্মাহ নিঃসন্দেহে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এমনকি আলাদা আলাদাভাবে দেশগুলোতেও আইয়্যামে জাহেলিয়াতের মতো জাতিগত অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, যে সংকীর্ণতা কেবল ইসলাম এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্ব দিয়ে জয় করা হয়েছিল। যে কেউ অন্ধ জাতীয়তাবাদ অথবা গোত্রবাদের জিগির তোলে, এর জন্যে লড়াই করে কিংবা মৃত্যুবরণ করে আমাদের মহানবী সা. তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।
সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান
ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানের দিকে যথাযথভাবে নজর দেয়া উচিত। আমি এক নিবন্ধে তাদেরকে মুসলিম সমাজের মধ্যে অমুসলিম সম্প্রদায় বলে অভিহিত করি। অমুসলিম সম্প্রদায়ের সমস্যা খোলাখুলি ও মুক্ত মন নিয়ে সমাধানে তৎপর হওয়া উচিত, রাজনৈতিক কুমতলব ও কপটতার মাধ্যমে নয়।
এ সংখ্যালঘুদের প্রতি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমার ‘ইনএভিটেবিলিটি অব দি ইসলামিক সলিউশন’ গবেষণা গ্রন্থে আলোকপাত করেছি। পুনরাবৃত্তি না করেই তার কয়েকটি বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরছিঃ
প্রথমত, সাধারণত সেক্যুলারপন্থী যাদের ইসলাম বা খৃস্টধর্ম কোনোটির প্রতিই আনুগত্য নেই তারা অভিযোগ করেন যে ইসলামী সমাধান ও ইসলামী আইন অমুসলিমদের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। কারণ তারা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ, আরো তাৎপর্যপূর্ণ দিক হয় ভুলে যান, নয় উপেক্ষা করেন। সেটি হচ্ছে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের স্বার্থে ইসলামী আইন ও ইসলামী সমাধান পরিত্যাগ করা সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ধর্মীয় আদেশ পালনের স্বাধীন নীতির পরিপন্থী। যখন সংখ্যালঘুর অধিকার সয়ংখ্যাগুরুদের অধিকারের পরিপন্থী হয় তখন কোন অধিকারটি অধিক গুরুত্ব পাবে?
গণতন্ত্র, যার পক্ষে সেক্যুলারপন্থীরা সোচ্চার এর যুক্তি হচ্ছে সংখ্যাগুরুর অধিকার সংখ্যালঘুর অধিকারের ওপরে অগ্রাধিকার পাবে। বিশ্বের সকল দেশে এ নিয়মই চলে আসছে। প্রত্যেকের সমর্থন পাবে এমন পদ্ধতি এখনো উদ্ভাবিত হয়ানি। কারণ নানামুখী প্রবণতা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। একই জিনিস কখনো সবাই মেনে নিতে পারে না। একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির জন্যে এটিই যথেষ্ট যে সংখ্যাগুরু মানুষ সেটি মেনে নেয় এবং তা সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো অন্যায় অবিচার কিংবা সংখ্যালঘুর ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন না করে। মুসলমানরা যাতে তাদের ধর্ম অনুযায়ী শাসন কাজ চালাতে পারে এবং আল্লাহর রহমতের আশায় তাঁর আইন বলবত করতে পারে এ লক্ষ্যে খৃস্টান ও অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায় যদি তাদের অধিকার ত্যাগ করে তাতে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যদি এরূপ না করে সংখ্যাগুরুদের অধিকার ত্যাগ করার জন্যে চাপ দেয় তাহলে সংখ্যাগুরুদের ওপর সংখ্যালঘুদের একনায়কত্ব চাপিয়ে দেয়ার শামিল হবে। উদাহরণস্বরূপ, চার কোটি সংখ্যাগুরুর উপর যেন ত্রিশ লাখ সংখ্যালঘুর শাসন। এ ধরণের পরিস্থিতি ধর্মীয় অথবা সেক্যুলার কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তদুপরি সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অধিকার ত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না এ কারণে যে ইট তো ধর্মত্যাগের শামিল, আর আল্লাহ নির্ধারিত এর শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম।
দ্বিতীয়ত, সেক্যুলারপন্থীদের উল্লিীখত অভিযোগ এ ধারণার ভিত্তিতে করা হয়েছে যে মুসলিম সংখ্যাগুরুর অধিকার এবং অমুসলিম সংখ্যালঘুর অধিকারের মধ্যে পরস্পর বিরোধীতা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ দুয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কোনো খৃস্টান যদি ধর্মীয় নয় সেক্যুলার শাসনের আওতায় নাগরিক হতে পারে তাহলে ইসলামী শাসনের অধীনে থাকতে তার আপত্তি করার যুক্তি থাকে না।
তদুপরি যে খৃস্টান তার ধর্মকে সঠিকভাবে অনুধাবন করে তার ইসলামী শাসনকে স্বাগত জানানো উচিত। কেননা এরূপ শাসনের ভিত হচ্ছে মহান আল্লাহ, তার ওহী ও আখেরাতের পুরস্কার। এ শাসন বিশ্বাস ও নৈতিকতার সেই মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সকল নবী রাসূল যার ডাক দিয়েছেন। ইসলাম হযরত ঈসা আ., মরিয়ম আ. ও ইঞ্জিলকে সম্মানের চোখে দেখে এবং আহলে কিতাবদের বিশেষ মর্যাদা দেয়। সুতরাং যে ধর্ম আল্লাহ, তাঁর নবী রাসূল ও পরকালকে স্বীকার করে তার অনুসারীরা এমন একটি শাসনকে কিভাবে ভয় করতে পারে যে শাসন ঐশীবিধান, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত। অথচ খৃস্টধর্মে বিশ্বাসীরা ধর্মহীন সেক্যুলার শাসনে ভীত বা উৎকণ্ঠিত নয়, যে শাসন সকল ধর্মকে ঘৃণা করে এবং যদি কখনো ধর্ম চর্চার অনুমতি দেয়ও তবে তা জীবনের একটি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে?
অন্যান্য সকল শাসন পদ্ধতির মতো বিবেচনা করে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা মেনে নেয়াই বিশ্বাসী খৃস্টানদের জন্যে উত্তম। আর মুসলমানরা এ শাসন ব্যবস্থাকে তাদের দ্বীনি পদ্ধতি বলেই মনে করে যার মাধ্যমে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর নৈকট্য লাভের আশা করে।
এটি তো খৃস্টানদের জন্যেই উত্তম। কারণ হাসান আল হুদাইবির ভাষায়- এ বিশ্বাসের ফলে মুসলমানরা ইসলামী আইন বলবৎ করার ক্ষেত্রে কোনো ভুল ভ্রান্তি যেন না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকবে। তাদের মধ্যে এ অনুভূতি কাজ করবে যেন তারা আল্লাহতায়ালার সতর্ক দৃষ্টির আওতায় রয়েছে, সেখানে কোনো শাসকের ভয় তাদের মনে স্থান পাবে না- যে ভয় সাধারণত কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে। [ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাবেক মুর্শিদে আম হাসান আল হুদায়বির ‘আওয়ার কন্সটিটউশন’ গ্রন্থ হতে।]
সুতরাং বিচক্ষণ ও উদারমনা বস্তুবাদের অগ্রগতি রোধে এক অপ্রতিরোধ্য বাধা হিসেবে ইসলামী শাসনকে স্বাগত জানিয়েছে। কেননা, বস্তুবাদ বিশ্ব কমিউনিজমের প্রশ্রয়ে সকল ধর্মকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। প্রখ্যাত মনীষী ফারিস আল খোরী এমন কথাই বলেছেন।
আমি এখানে একটি ভুল ধারণার সংশোধন করতে চাই। অনেকে মনে করেন যে খৃস্টীয় পাশ্চাত্য থেকে যে মানব রচিত আইন আমদানি করা হয় সেটির সঙ্গে খৃস্টধর্মের সম্পর্ক রয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভুল ধারণা। যারা আইনের উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক সূত্র নিয়ে চর্চা করেন তারা এটি ভালো করেই জানেন। এ যুক্তিই সত্য যে পাশ্চাত্যের এসব আইনের চেয়ে খৃস্টধর্ম ও খৃস্টান ধর্মের অনুসারীরা ইসলামী ফিকাহর অধিকতর নিকটবর্তী। প্রথমত ধর্মীয় কারণ এবং অন্য দিকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাব।
তৃতীয়ত, বাস্তবক্ষেত্রে মুসলিম শাসন অমুসলিমদের ধর্মবিশ্বাসের পরিপন্থী কাজকর্ম সম্পাদনে বাধ্য করবে এ অভিযোগও মিথ্যা। ইসলামের চারটি শাখা- ঈমান, ইবাদত, নৈতিক মূল্যবোধ ও শরীয়াহ। ইসলাম কোনোভাবেই তার ধর্মবিশ্বাস অথবা ইবাদত অমুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয় না।
এ ব্যাপারে আল-কোরআনে দু’টি সুস্পষ্ট আয়াত রয়েছে। একটি মক্কী, অন্যটি মাদানী। প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সা. সম্বোধন করে বলছেনঃ তবে কি আপনি মানুষের ওপর জবরদস্তি করবেন যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে (সূরা ইউনুসঃ ৯৯)?
দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহতায়ালা আরো স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেনঃ ধর্মে জবরদস্তি নেই (সূরা আল বাকারাঃ ২৫৬)।
রাসূলের সা. সাহাবিরা আহলে দিম্মী [আহলে দিম্মী হচ্ছে মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম প্রজাবৃন্দ।] সম্পর্কে বলতেন, তাদেরকে তাদের ধর্ম নিয়ে থাকতে দাও।
খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকে ইহুদী ও খৃস্টানরা নির্বিঘ্নে উপাসনাসহ তাদের অধিকার ভোগ করেছে। হযরত আবু বকর রা. ও হযরত ওমরের রা. শাসনকালে মুসলমান ও তাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিই এর প্রমাণ। এ সবের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হযরত ওমর রা. এবং জেরুজালেমের জনগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি।
ইসলামের বিধিবিধান এতোই সুবিবেচনাপ্রসূত যে অমুসলমানদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করা হয় না কিংবা তাদেরকে জিহাদেও অংশ নিতে হয় না। কেননা দুটিই ইসলামের অন্যতম প্রধান ইবাদত। যাকাত এক প্রকার আর্থিক কর আর জিহাদ সামরিক সেবা। এর পরিবর্তে ইসলাম অমুসলমানদের ওপর অন্য এক ধরণের কর আরোপ করে যাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় জিজিয়া। তবে নারী, শিশু, গরীব ও পঙ্গু লোকজন এ করের আওতাবহির্ভূত।
কেউ যদি জিজিয়া শব্দটা মানতে রাজি না হন তাহলে এটিকে তাদের যা খুশি বলতে দিন। আরব খৃস্টান গোত্র বনু তাগলিবের লোকেরা জিজিয়ার পরিবর্তে দ্বিগুণ যাকাত প্রদানের জন্যে ওমর ইবনে খাত্তাবের কাছে অনুমতি চাইল। হযরত ওমর এতে সম্মত হয়ে তাদের সঙ্গে এ মর্মে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন- এ লোকেরা নির্বোধ, তারা অর্থ মেনে নেয় কিন্তু নাম অস্বীকার করে।
ইসলামের নৈতিক মূল্যবোধ প্রসঙ্গে বলা যায়, অন্যান্য ধর্ম থেকে এটি আলাদা কিছু নয়। কেননা সকল ধর্মের দৃষ্টিতে নৈতিকতা একই রকম।
ইসলামে আহকাম বা শরীয়াহর বিশেষ অর্থ রয়েছে। অর্থাৎ সে সব আইন যা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে। এ আইন ব্যক্তির সাথে জাতির, তার সম্প্রদায় ও তার রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণ করে এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে তার নাগরিকদের ও অন্যান্য রাষ্ট্রের সম্পর্কও নিয়ন্ত্রন করে।
পারিবারিক সম্পর্ক ও দাম্পত্য সংক্রান্ত বিষয় যেমন বিয়ে, তালাক ইত্যাদি ব্যাপারে অমুসলমানরা তাদের ধর্ম বা আমাদের মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে পারে। শরীয়াহর বিধিবিধান মেনে নেয়ার ব্যাপারে তাদের ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। উদাহরণস্বরূপ সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে তারা যদি চায় ইসলামী আইন মেনে নিতে পারে। যেমন কোনো কোনো আরব দেশে খৃস্টানরা তা স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছে। তারা যদি তাদের জীবনযাপনে ইসলামী আইন প্রয়োগ না করতে চায় তাহলে তা তাদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে না।
এ কারণেই আহলে দিম্মীর জন্যে নিজস্ব আদালত থাকা বাঞ্ছনীয় যেখানে তারা বিচারপ্রার্থী হতে পারে। আবার তারা ইসলামী আদালতের আশ্রয়ও নিতে পারে। ইতিহাসে এমন নজির আছে।
অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন বেসামরিক, বাণিজ্যিক অথবা প্রশাসনিক আইনের ক্ষেত্রে অমুসলিমরা অন্যান্যের মতোই প্রাচ্য অথবা পাশ্চাত্য থেকে উৎসারিত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বারা স্বীকৃত এমন যে কোনো আইনের আওতাধীন।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসলাম অমুসলমানদেরকে তাদের ধর্মের কোনো প্রয়োজনীয় বিষয় ত্যাগ করতে বাধ্য করেনি। কিংবা এমন কিছু করতেও বলেনি যা তাদের ধর্মবিশ্বাসে নিষেধ আছে। আবার তাদের ধর্মের পরিপন্থী কোনো কিছুতে বিশ্বাস স্থাপনেও জবরদস্তি করেনি।
কেবল কিছু কিছু এমন বিষয় আছে যেগুলো ইসলামে নিষিদ্ধ কিন্তু অমুসলিমরা বৈধ মনে করে। যেমন মদ ও শূকরের মাংস। বৈধ বিষয়গুলোও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তাদের স্বাধীন ইচ্ছা মতো পরিহার করতে পারে। সুতরাং খৃস্টানরা মদপান ছেড়ে দিলে তাদের ধর্মের দৃষ্টিতে দোষী হবে না। আমি চিন্তাও করতে পারি না, কোনো ধর্ম সূরা পান উৎসাহিত করবে এবং মাদকাসক্ত হয়ে মাতলামি করাকে সুনজরে দেখবে। বাইবেলে মদ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা হলো, সামান্য পরিমাণ পান করলে পাকস্থলির জন্যে ভালো। আর এ কারণে খোদ খৃস্টানরাই মদপানের ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত।
একজন খৃস্টান শূকরের মাংসে একটি কামড় না দিয়েও সারাজীবন পার করে দিতে পারে। কারণ এটি খাওয়া কোনো ধর্মীয় প্রথা নয়, না এটি নবী রাসূলদের দেয়া যুগ যুগ ধরে চলে আসা কোনো নিয়ম। শূকরের মাংস ইসলাম-পূর্ব যুগে ইহুদী ধর্মেও নিষিদ্ধ ছিল।
অবশ্য অনেক আলেম এ মত পোষণ করেছেন যে খৃস্টানরা তাদের নিজস্ব এলাকার মধ্যে শূকরের মাংস খেতে পারে, মদপান করতে পারে, এমন কি নিজেদের মধ্যে উভয় পণ্যের ব্যবসাও করতে পারে। তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এগুলো ছড়ানো যাবে না কিংবা এগুলোর মারফত মুসলিম অনুভূতিকেও অবজ্ঞা করা যাবে না। এ এক অনুপম সহিষ্ণুতা। [আমার লিখিত ‘দি এভিডেন্সেস অব দি ইসলামিক সলিউশন এন্ড দি এমবিগিউটিস অব সেক্যুলারিস্টস এন্ড অকসিডেন্টালিস্টস’ বইয়ের ‘রিলিজিয়াস মাইনরিটিস এন্ড দি ইসলামিক সলিউশন’ শীর্ষক অধ্যায়।]
আন্দোলন ও সংলাপ
ইসলামী আন্দোলনকে আগামী পর্যায়ে কেবল নিজের সমস্যা সুরাহার মধ্যে সীমিত রাখলে চলবে না। আন্দোলনের পরিধি অবশ্যই সম্প্রসারিত করতে হবে যাতে অন্যদের সমস্যার দিকেও দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যায়।
অনেক ইসলামী লেখক ও চিন্তাশীল ব্যক্তি নিজেদের জন্যেই লিখে থাকেন। অর্থাৎ তাদের জন্যে লেখেন যারা তাদের পদক্ষেপ অনুসরণ করেন এবং তাদের মতামত প্রচারে নিয়োজিত থাকেন। কেবল পরস্পরের মধ্যে কথা বলার এ গণ্ডি তারা অতিক্রম করতে পারেন না যেন পৃথিবীতে তারা ছাড়া আর কোনো লোক নেই। তারা যদি এ বৃত্ত থেকে বের হন তাহলে কেবল অন্য ইসলামী গ্রুপের উদ্দেশ্যেই লেখেন যারা ইসলাম ও দাওয়াতের প্রশ্নে তাদেরই মতাবলম্বী, তবে ভিন্ন কৌশল ও ভিন্ন ভাবধারা প্রয়োগ করেন।
যখন তারা দ্বিতীয় বৃত্তটি ত্যাগ করেন তখন কেবল সাধারণভাবে ধার্মিক লোকদের জন্যে লেখেন- এসব ধার্মিক কোনো গ্রুপ অথবা আন্দোলনের সদস্য হোক বা না হোক।
এখন যেহেতু ইসলামী আন্দোলন একটি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এর ভিত্তি প্রশস্ত হয়েছে তাই উচিত, তাদের দিকে দৃষ্টি দেয়া যারা আদর্শ ও চিন্তাধারার দিক দিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদেরকে সঠিক দিক নির্দেশ কিংবা আলোর পথ দেখানোর চেষ্টা না করে প্রাচীন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জাহেলিয়াত, ইসলামের প্রতি অবিশ্বাস এবং অপপ্রচারকারীদের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত নয়।
অতএব ইসলামী আন্দোলনের স্ব-আরোপিত বিচ্ছিন্নতা অবসানের এটিই উপযুক্ত সময় যেন আন্দোলন সকল মুসলমানকে এর অংশ বলে মনে করতে পারে এবং প্রথমেই তাদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করে দেয়। অতঃপর একদিকে আন্দোলন ও এসব সমমনা মুসলমান এবং অন্যদিকে তাদের বিরোধী এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী- এ উভয়পক্ষের মধ্যে সংলাপ শুরু করা আবশ্যক। যুক্তিসঙ্গত, ধীরস্থির, তাত্ত্বিক সংলাপে যাদের দ্বীনের প্রতি তাচ্ছিল্য রয়েছে তারা আগ্রহী হবে, যারা উৎকণ্ঠিত তারা সুস্থির হবে, যারা অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঘুরপাক কাচ্ছে তারা আস্থা ফিরে পাবে। এমনকি যারা বিদ্বেষপূর্ণ বৈরিতা পোষণ করে সেই মানসিকতারও অবসান ঘটতে পারে। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা বলেনঃ আশা করা যায়, আল্লাহ তোমাদের মধ্যে এবং তাদের মধ্যে- যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে- বন্ধুত্ব কায়েম করে দেবেন; আর আল্লাহ সর্বশক্তিমান; আর বড় ক্ষমাশীল ও দয়ালু (সূরা মুমতাহিনাঃ ৭)।
জর্দানের আম্মানে অনুষ্ঠিত এক সিম্পোজিয়ামের কথা উল্লেখ করতে চাই যেখানে আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘দি ইসলামী এয়োকেনিং এন্ড দি উজ অব দি আরব ওয়ার্ল্ড’।
সিম্পোজিয়ামে মুসলমান, খৃস্টান, কমিউনিস্ট এবং সকল মতের জাতীয়তাবাদীরা অংশগ্রহণ করে। এ সিম্পোজিয়ামের ব্যাপারে আমি কয়েকজন দ্বীনি ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করলে তারা মত দিলেন আমার যাওয়া উচিত নয়। কারণ যথার্থ ইসলামী ধারা অনুসরণ ছাড়া আয়োজিত এ সব সিম্পোজিয়ামে আমার উপস্থিতি তাদের বৈধতা দিতে পারে। কিন্তু আমি এ ধরণের আশঙ্কা এবং নেহাত কাল্পনিক বিষয়ের প্রতি কর্ণপাত করিনি। কারণ এরূপ কল্পনা সরিষায় ভূত দেখার মতো। আমি দাওয়াত গ্রহণ করে সিম্পোজিয়ামে একটি নিবন্ধ পাঠ করি। পরে এটি একটি আলাদা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়।
সেখানে আমার এবং ড. হাসান আল তুরাবী, ফাহমী হুবাইদী ও কামাল আল শরীফসহ বেশ কয়েক জন ইসলামী চিন্তাবিদের উপস্থিতিতে মধ্যপন্থী ইসলামী ধারার মাধ্যমে উত্থাপিত ইসলামপন্থীদের মতামত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। উল্লেখ্য, আমি মধ্যপন্থী ইসলামী ধারায় বিশ্বাস করি এবং এর পক্ষে সোচ্চার। সিম্পোজিয়ামে ইসলামপন্থীদের সংখ্যা কম হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রভাবই ছিল সবচেয়ে বেশি ও তাদের বক্তব্যই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে।
আমি কখনোই ভুলবো না একজন জাতীয়তাবাদী খৃস্টান বক্তার কথা। তিনি আমাকে খাবার টেবিলে বলেছিলেন, আপনার সম্পর্কে আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের কী ধারণা ছিল? তিনি জবাব দিলেন, এটিই যে আপনি একজন কট্টরপন্থী, ধর্মান্ধ। আমি বললাম, কোত্থেকে এ ধারণা পেয়েছিলেন? তিনি জবাবে বললেন, জানি না, তবে খোলাখুলি বলতে গেলে আপনার সম্পর্কে এটিই ছিল আমাদের ধারণা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর এখন? তিনি বললেন, এখন দেখেশুনে, আলোচনা করে ও সরাসরি যোগাযোগের ফলে আমরা যা জানতে পারলাম তাতে আপনার সম্পর্কে আমাদের অসঙ্গত ধারণা পুরোপুরি বদলে গেছে। এখন আমরা দেখছি যুক্তির প্রতি আপনি শ্রদ্ধাশীল। আপনার চিন্তাভাবনা যুক্তিনির্ভর। আপনি জানেন কিভাবে অন্যের মতামত শুনতে হয়। কারণ আপনি এমন ব্যক্তি যিনি একগুঁয়ে বা জেদী নন বরং অত্যন্ত নমনীয় ও সহিষ্ণু।
আমি এ ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে এটিই বলতে চাই, সরাসরি যোগাযোগ এবং সমমর্যাদায় অনুষ্ঠিত যুক্তিসঙ্গত ধীরস্থির সংলাপ ইসলামী আন্দোলনের স্বার্থেই দরকার। আন্দোলন এ থেকে লাভবান হবে, হারাবার আদৌ কিছু নেই।
ইসলামপন্থী ও ইসলামপন্থী নন এমন লোকদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সকল সভা সমাবেশ থেকে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি স্বয়ং এ সাক্ষ্য দিচ্ছি। এ ধরণের সর্বশেষ সিম্পোজিয়ামটি হয়েছিল আলজেরিয়ায়। আলোচ্য বিষয় ছিল ‘ইস্যুস অব দি ইসলামিক ফিউচার’।
অতএব আমরা বলতে পারি, আগামী পর্যায়ে ইসলামী আন্দোলনের শ্লোগান হওয়া উচিত ‘অন্যদের সঙ্গে সংলাপ স্বাগতম’। অন্যদের বলতে আমি বুঝি, যারা ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য, কর্মপন্থা, দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ এমনকি ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে দ্বিমত পোষণ করে। ভিন্নমত পোষণকারী সকলের সঙ্গে সংলাপকে আন্দোলনের স্বাগত জানানো উচিত। আর যাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে তা অব্যাহত রাখতে হবে।
আন্দোলনের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণকারী সকল ইসলামী শক্তির সমর্থন আদায়েও সচেষ্ট হওয়া উচিত। যেসব গ্রুপ বা ব্যক্তিবর্গের বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে তাদের সমর্থনও আন্দোলনকে অর্জন করতে হবে। যারা আমাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে আল-কোরআন তাদের সাথে সংলাপের আদেশ দিয়েছে। তাদের ব্যাপারে কোনো আশা নেই এমন মনে করা এবং তাদের থেকে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন মনে না করারও তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ আপনি আপনার প্রতিপালকের পথের দিকে আহ্বান করুন জ্ঞানগর্ভ কথা ও উত্তম উপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন (সূরা নাহ্লঃ ১২৫)।
আল-কোরআন যা করতে বলে তা হচ্ছে সর্বোত্তম উপায়ে, সর্বোত্তম কৌশলে, যুক্তিতর্ক ও সংলাপ চালাতে যেন মনে বিশ্বাস ও হৃদয়ে জাগরণ নিশ্চিত করা যায়। এ আয়াতে কোরআনের ভাব প্রকাশের এক বিস্ময়কর নিদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। আল-কোরআনের দৃষ্টিতে দাওয়াতি কাজ উত্তমরূপে করতে হবে কিন্তু সেই যুক্তি ও আলোচনাই কেবল গ্রহণযোগ্য হতে পারে যা সর্বোত্তম পন্থায় উপস্থাপন করা হয়। কারণ দাওয়াত সাধারণত তাকেই দেয়া হয় যে ইতোমধ্যে একমত হয়েছে আর যুক্তি তার কাছেই উত্থাপন করতে হয় যে একমত পোষণ করে না। সুতরাং যে কোনো অবস্থায় সর্বোত্তম পন্থায় দাওয়াত বা যুক্তি উপস্থাপন করাই সঙ্গত।
সেক্যুলারপন্থীদের সঙ্গে সংলাপ
আবশ্যকীয় সংলাপের মধ্যে সেক্যুলারপন্থীদের সঙ্গে সংলাপও অন্তর্ভুক্ত। সে সব সেক্যুলারপন্থী যারা যুক্তিবাদী, মোটামুটি ভালো মানুষ, ইসলামপন্থীদের কথা শুনতে ইচ্ছুক এবং তাদের লক্ষ্য ও কর্মসূচি বুঝতে চেষ্টা করে।
এসব সেক্যুলারপন্থী মূলত মুসলমান। অনেকে তো মুসলিম পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। কেউ কেউ মুসলিম আচার অনুষ্ঠান পালন করে, নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, সম্ভবত হজ্জ্ব, ওমরাহ করে থাকে। কিন্তু তাদের সমস্যা হচ্ছে অনেক সংস্কৃতিবান ব্যক্তির মতোই তারা ইসলামকে কখনো সঠিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করে না। এর কারণ, তারা কখনোই মৌলিক বা বিশুদ্ধ সূত্র থেকে ইসলামের শিক্ষা গ্রহণের কিংবা কোনো নির্ভরযোগ্য পণ্ডিত ও চিন্তাশীল লোকের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পায়নি। বরং তারা প্রাচ্যবিশারদ অথবা খৃস্টান মিশনারী, তাদের শিষ্য-সাদরেদদের কাছ থেকে ধর্মের ধারণা লাভ করেছে। কিংবা মুসলমানদের বর্তমান চরম দৈন্যদশা থেকে অথবা চরমপন্থী বা ইসলামের অনুসারী হিসেবে দাবিদার বিপথগামী লোকদের কাছ থেকে শুনে বা পড়ে ইসলাম সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরী করে নিয়েছে।
যাহোক তাদের লালন পালন, শিক্ষা দীক্ষা ও জীবনযাত্রা তাদেরকে কখনো নির্ভেজাল বিশুদ্ধ ইসলামকে জানার সুযোগ দেয়নি। ভ্রান্ত ধারণা, ভুল প্রয়োগ ও অপব্যবহারসহ এ পীড়াদায়ক অতীত ও বর্তমান ইসলামের ক্ষতি করেছে।
শীর্ষবিন্দুতেত পৌঁছে যাওয়া পাশ্চাত্য সভ্যতার চাকচিক্যের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বে বিরাজমান অন্ধকার পরিস্থিতি ইসলাম, ইসলামী শরীয়াহ ও জীবনপদ্ধতিকে ভুল বোঝার জন্যে সেক্যুলারপন্থীদের কাছে একটি অজুহাত হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে তারা বিশ্বাস করে, বর্তমান উভয় সঙ্কট থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে অগ্রগতি অর্জন করার জন্যে পাশ্চাত্যের পথ ধরতে হবে। কারণ ধর্ম, ধর্মীয় রীতিনীতি ও যাজক সম্প্রদায় থেকে মুক্ত হয়ে পাশ্চাত্য কেবল বিজ্ঞানের বাহন ধরে আবিষ্কার, উদ্ভাবন, উৎপাদন, নির্মাণ-সৃজনের পথে যাত্রা শুরু করে মানুষের সুখ সমৃদ্ধির জন্যে প্রকৃতির শক্তিকে আয়ত্ত করেছে।
আমরা ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মকালে কায়রোতে ফিজিশিয়ানস এসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে দার আল হিকমায় সেক্যুলারপন্থীদের সঙ্গে ঐতিহাসিক সংলাপ শুরু করি। এতে ইসলামপন্থীদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম আমি ও শায়খ মোহাম্মাদ আল গাজালী। আর তাদের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন ডা. ফুয়াদ জাকারিয়া।
সাংবাদিক ও চিন্তাশীল মহল সিম্পোজিয়ামকে উষ্ণ স্বাগত জানায়। কারণ এতে একই আবাসভূমিতে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংলাপের গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়েছে।
ফাহমী হুবাইদীসহ বহু লেখক এ মিটিংয়ে কতিপয় ভালো দিক তুলে ধরেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে প্রত্যেক পক্ষ সরাসরি অপর পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ করেন। অবশ্য আমি এ সভার একটি ত্রুটি লক্ষ্য করেছি। সেটি হচ্ছে, ইসলাম ও সেক্যুলারপন্থীদের মধ্যে সংলাপের পরিবর্তে সিম্পোজিয়াম বিতর্ক সভায় রূপ নেয়।
বিতর্ক উত্তেজনার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে সেখানে যদি বিপুলসংখ্যক শ্রোতা থাকে। তাছাড়া এ সংলাপে সেক্যুলারপন্থীদের প্রতিনিধি ছিলেন একগুঁয়ে স্বভাবের লোক যার মধ্যে বিন্দুমাত্র নমনীয়তা, সহিষ্ণুতা ও শালীনতা ছিল না। ফলে প্রতিপক্ষের বক্তব্য শোনার মতো মানসিকতা তার ছিল না- যে বক্তব্য শুনে ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানতে পারতেন। আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে তার অজ্ঞতা ছিল অগাধ।
তিনি আসলে তার বক্তব্যের দুর্বলতা এবং যুক্তির অসারতা বুঝতে পেরে তার সমর্থক পত্রিকাগুলোতে সাধারণভাবে সকল শোতা, বিশেষভাবে ইসলামপন্থী এবং আমার নাম উল্লেখ করে মারাত্মক বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা করে প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। এ সমালোচনার জবাবে আমি সামগ্রিক ইস্যু ব্যাখ্যা করি আমার ‘ইসলাম এন্ড সেক্যুলারিজমঃ ফেস টু ফেস’ বইয়ে।
আমি আবারো বিতর্ক নয়, সংলাপ অনুষ্ঠানের আবেদন জানাচ্ছি। ‘বিতর্ক’ শব্দটির মধ্যেই একটি চ্যালেঞ্জের সুর এবং জয়ী হওয়ার মানসিকতা রয়েছে। ফলে প্রত্যেক পক্ষই প্রতিপক্ষকে প্রচণ্ডভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা চালায়।
আমি মনে করি না এ ধরণের বিতর্কে তেমন লাভ হবে। কারণ, বিতর্কে সম্ভবত কোনো পক্ষই ছাড় দিতে বা স্বীয় অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াতে চাইবে না বরং আরো একগুঁয়ে ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারে।
প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জের মুখে ইসলামী পক্ষ যদি বিব্রতবোধ করে তাহলেই তাদের কাছে বিতর্ক গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তখন ইসলামপন্থীদের সংঘাতের ভয়ে পলায়ন এবং রণে ভঙ্গ দেয়ার অভিযোগ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু সংলাপের নীতি হচ্ছে যথাযথ শিষ্টতা পালন, আল-কোরআন যেটাকে বলেছেঃ সর্বোত্তম পন্থায় যুক্তি প্রদর্শন করো।
শাসকদের সঙ্গে সংলাপ
আরেক ধরণের সংলাপ দরকার, সেটি হচ্ছে বিচক্ষণ যুক্তিবাদী শাসকদের সঙ্গে সংলাপ-যেসব শাসক ভিন্নমতের পক্ষাবলম্বন করে ইসলামের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ভূমিকা নেয় না। যেসব শাসক ভিন্নমত গ্রহণ করে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাদের সঙ্গে সংলাপ নিরর্থক। কারণ তারা ইসলামের বিলুপ্তি ও সম্পূর্ণ ধ্বংস ছাড়া ভালো কিছু চায় না। কিন্তু আল্লাহ বলেনঃ তারা আল্লাহর নূরকে নিজেদের মুখের ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়, অথচ আল্লাহ তা হতে দেবেন না স্বীয় নূরকেই পূর্ণতা দান ব্যতীত যদিও অবিশ্বাসীরা তা ঘৃণা করে (সূরা তাওবাঃ ৩২)।
তবে আরেক ধরণের শাসক আছে যারা ইসলামকে ঘৃণা করে না কিন্তু ভয় করে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ভয় হচ্ছে ইসলামের বাস্তবতা, ইসলামী শরীয়ত ও দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা। এদের অনেককে ক্ষমার চোখে দেখা যায় এ কারণে যে ইসলাম আসলে কী তারা তা জানার সুযোগ পায়নি এবং বিশুদ্ধ সূত্র ও নির্ভরযোগ্য পণ্ডিতদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করতে পারেনি। এ অজ্ঞতার বিচারে তাদেরকে ইতোপূর্বে উল্লিখিত আমাদের সংস্কৃতিবান বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাতারে ফেলা যায়। বিভিন্ন ধ্যানধারণা তাদের মাথায় জট পাকিয়ে ফেলেছে এবং বাস্তব ঘটনা ও কল্পকাহিনী তাদের কাছে একই রকম মনে হয়।
সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় এসব শাসকের কাছে বিভাজন ছাড়া সামগ্রিকভঅবে, কোনো বিকৃতি ছাড়া বিশুদ্ধ মত হিসেবে এবং কঠিন ছাড়া সহজ বিষয় হিসেবে প্রকৃত ইসলামের ব্যাখ্যা দিয়ে কল্যাণকর দিকগুলো তুলে ধরতে পারলে তারা বুঝতে পারবে- ইসলামই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনের জন্যে কল্যাণকর এবং জাতির নৈতিক বল ও বৈষয়িক সমৃদ্ধির সংরক্ষণে ইসলাম সব অশুভ তৎপরতা নির্মূল করতে চায়। তারা মুক্তমনে এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে অবশ্যই তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসবে এবং ইসলাম ও দাওয়াতের প্রতি অংশত অথবা সামগ্রিকভাবে এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবে। কেননা শাসকরা আমাদেরই মতো মানুষ। তাই তাদের মধ্যেই পরিবর্তন আসতে পারে, প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে, উপলব্ধি ঘটতে পারে- এমনভাবে যা শেষ পর্যন্ত তাদের আদর্শ ও আচরণেও পরিবর্তন আনতে পারে।
ইতিহাস এমন শাসকদের দৃষ্টান্তে ভরপুর, সত্যিকার আলেম ও পণ্ডিতদের প্রভাবে যাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। অনেক শাসক তাদের মতলববাজ মন্ত্রনাদাতার মিথ্যা হুঁশিয়ারির প্রভাবে অথবা বিদেশী ‘শয়তানের’ চক্রান্তের শিকার হয়ে ইসলাম সম্পর্কে একটি শঙ্কিত মনোভাব পোষণ করে।
এসব শাসকের হৃদয়ে এখানো যে সুমতি রয়ে গেছে তাকে ভিত্তি করে এবং তাদের ধমনীতে এখনো যে মুসলিম রক্ত প্রবহমান তাকে উজ্জীবিত করে তাদের সংস্পর্শে আসতে হবে। তাদেরকে এ আশ্বাস দিতে হবে যে সাময়িকভাবে হলেও তাদেরকে সিংহাসন বা ক্ষমতায় বহাল রাখা হবে যদি তারা ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনার স্বাধীনতা দেন- যে কার্যক্রমের মিশন হচ্ছে যুবকদের নৈতিক মূল্যবোধ, বোধোদয়, নির্মল চরিত্রের আলোকে গড়ে তোলা, তাদেরকে নেশাদ্রব্য, মাদকদ্রব্য ও পতিতাদের হাত থেকে রক্ষা করা এবং শাসক ও শাসিত উভয়ের জন্যে ক্ষতিকর ধ্বংসাত্মক নীতির মোকাবিলা করা।
শাসকদের সঙ্গে এরূপ সন্ধি বা সমঝোতার মধ্যে খারাপ কিছুই নেই। এমনকি আন্দোলন তাদের আচরণ ও অন্যদের সঙ্গে সংশ্রব রাখা পছন্দ না করলেও। কারণ ভারসাম্যের ফিকাহর আলোকে পরিচালিত আন্দোলন বিশ্বাস করে, এ নীতি শাসকদের অবজ্ঞা করা অথবা তাদের প্রতি অব্যাহত শত্রুতা পোষণ করারে চেয়ে উত্তম।
এ প্রসঙ্গে আমি একটি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে চাই। এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি এসব শাসকদের প্রতি কোনোভাবেই তোষামোদি অথবা আন্তরিকতাহীন ‘কথার কথা’ হওয়া উচিত নয়। সমঝোতা ও কপটতার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
পাশ্চাত্যপন্থীদের সঙ্গে সংলাপ
ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংলাপ আবশ্যক যদিও এ সংলাপের পথে রয়েছে অনেক বাধা বিপত্তি।
আমাদের ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বেশ কিছু তফাৎ রয়েছে। ধর্মের তফাৎ আছে। পাশ্চাত্য মূলত খৃস্টান আর আমরা মুসলমান। ভাবধারার ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। পাশ্চাত্য বস্তুবাদী ও বাস্তববাদী আর আমরা আধ্যাত্মবাদী ও আদর্শবাদী। রাজনীতির ক্ষেত্রেও তফাৎ আছে। পাশ্চাত্য সাধারণত ইসরাইলের পক্ষে, আমাদের বিপক্ষে। যদিও সামর্থ্য ও অবস্থানের বিচারে পাশ্চাত্যের এক দেশ থেকে আরেক দেশে এ দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য থাকতে পারে।
তা সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের সঙ্গে সংলাপ আমরা এড়িয়ে চলতে পারি না। আমরা পছন্দ করি আর না করি, এটি ঠিক যে পাশ্চাত্যই শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্ব শাসন করে আসছে। বর্তমান বিশ্বের তাদেরই সভ্যতা বিরাজমান। তারা আমাদের বিভিন্ন দেশ শাসন করছে এবং বিভিন্ন মেয়াদে আমাদের ভূখণ্ড দখল করে রেখেছিল। পরে তারা স্বেচ্ছায় বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে দখলকৃত দেশ ছেড়ে গেছে কিন্তু এখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে। তারা আমাদের সিদ্ধান্ত প্রণেতাদের ওপর কোনো না কোনোভাবে প্রভাব খাটায়। আমাদের শাসকদের মনমানসিকতা ও ইচ্ছার ওপরেও তাদের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
তদুপরি কোনো জনগোষ্ঠীর পক্ষে চারপাশের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস ও নীতি নিয়ে কাল্পনিক জগতে বসবাস করা সম্ভব নয়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সতত প্রবহমান প্রযুক্তিগত পরিবর্তন একজন লেখকের ভাষায় পৃথিবীকে এক বিশ্ব পল্লীতে পরিণত করেছে।
সুতরাং পাশ্চাত্যের সঙ্গে সংলাপ আমাদের জন্যে একটি অবশ্য কর্তব্য, যেন আমরা পাশ্চাত্যবাসীকে বোঝাতে পারি আমরা নিজেদের জন্যে এবং অপরের জন্যে কী চাই। কারণ আমরা একটি আদর্শের প্রচারক, লুটেরা নই। কল্যাণের বার্তাবাহক, অমঙ্গলের বাহক নই। শান্তির প্রবক্তা, যুদ্ধবাজ নই। সুবিচার ও ন্যায়ের সমর্থক, অন্যায় অবিচারের মদদদাতা নই।
আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বিভ্রান্ত মানবতাকে আল্লাহর পথ প্রদর্শন করা এবং ইহলৌকিক জীবনকে পারলৌকিক জীবনের সঙ্গে, জমিনকে আসমানের সঙ্গে ও মানুষকে মানুষের সঙ্গে যুক্ত করা যেন একজন মানুষ নিজের জন্যে যা পছন্দ করে তা অপরের জন্যেও পছন্দ করে, নিজের জন্যে যা ঘৃণা করে অপরের জন্যেও তা করে- যেন মানবজাতি সকল জাতির অভিন্ন ব্যাধি, হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে পারে। এ ব্যাধি মানবতাকে ধর্মশূণ্য করে ফেলে।
আমরা জানি পাশ্চাত্য এখনো এক বিষাদঘন প্রেক্ষিত সামনে রেখে আমাদের দিকে দৃষ্টি দেয়, যে প্রেক্ষিত ক্রুসেডের সময় থেকে আমাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পঙ্কিল করে রেখেছে এবং আজো অধিকাংশ পাশ্চাত্যবাসীর হৃদয়ে এটি বাসা বেঁধে আছে।
ফরাসী দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক গুস্তাভ লা বন সহ পাশ্চাত্যের বহু নিরপেক্ষ চিন্তাবিদ একথা স্বীকার করেছেন। তিনি তার ‘দি সিভিলাইজেশন অব আরবস’ গ্রন্থের কয়েকটি পাদটিকায় খোলাখুলি একথা বলেছেন। কোনো পাশ্চাত্য পণ্ডিত যখন ইসলামী বিষয়ে চর্চা করেন তখন তিনি তার স্বাভাবিক, নিরপেক্ষ চরিত্র হারিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট ও ইসলাম বিরোধী হয়ে উঠেন। এমনকি সেটি তিনি বুঝতেও পারেন না অথচ এসব পণ্ডিত অন্যান্য ইস্যূ স্বাভাবিক ও নিরপেক্ষ মন নিয়ে বিচার করেন। সম্প্রতি প্রাচ্যবিশারদ মণ্টেগোমারী ওয়াট তার ‘হোয়াট ইজ ইসলাম’ গ্রন্থে একই কথা বলেছেন।
আমরা আরো দেখি বিভিন্ন সময়ে নানা ক্ষেত্রে এ ক্রুসেড চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আগ্রাসী ইসরাইল এবং আগ্রাসনের শিকার ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতি পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গিতেও এ প্রভাব লক্ষ্যণীয়। খৃস্টান লিথুনিয়া এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের মুসলিম আজারবাইজানের প্রতি পাশ্চাত্যের মানসিকতায় এ প্রভাব দেখা যায়।
ফরাসী, স্পেনীয় এবং ইতালীয় কর্মকর্তাদের কার্যকলাপের মধ্যেও এ লক্ষণ দেখা যায়। তারা আলজেরিয়া ইসলামী চেতনা প্রবাহে ভীত হয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিত কর্মকাণ্ড চালায়। দক্ষিণ সুদান, ইরিত্রিয়া, কাশ্মীর, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুতেও পাশ্চাত্যের এ মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়।
আমরা কতিপয় সামাজিক ইস্যুতেও এ প্রভাব লক্ষ্য করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সালমান রুশদী। যে রুশদী তার খোলস পাল্টে স্বীয় ধর্ম বিশ্বাস ও স্বজাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ফ্রান্সে হিজাব ইস্যুতেও এ প্রভাব লক্ষ্যণীয়। কিভাবে একটি দেশ নিজেকে ‘স্বাধীনতার প্রসূতি’ বলে দাবি করে যখন সে দেশটি কয়েকটি মুসলিম ছাত্রীর শালীনতার খাতিরে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্যে পোশাকের ধর্মীয় বিধি পালনকে বরদাশত করতে পারেনি। স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ভূমি বলে কথিত দেশটি মেয়েদের একটি নেহায়েত ব্যক্তিগত ব্যাপারেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অধিকার দেয়নি।
দুর্ভাগ্যজনক যে ক্রুসেডের চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিস্থিতি এখনো এমনভাবে বর্তমান যার পরিমাপ করা দুঃসাধ্য। এমন কি তুরস্ক, যে দেশটি প্রায় পৌণে এক শতাব্দী ধরে অত্যন্ত উৎসুক হয়ে পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে তলোয়ারের মাধ্যমে রক্তপাত ঘটিয়ে মুসলমানদের ওপর পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা সেক্যুলারিজম চাপিয়ে দিয়েছে, সর্বত্র ইসলামী শরীয়াহ বিতাড়িত করেছে, তারাও ইউরোপীয় কমন মার্কেটের সদস্যপদের জন্যে আবেদন করে পাশ্চাত্যের সমর্থন পায়নি। পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর তুরস্কের আবেদন অগ্রাহ্য হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, তুরস্কের এমন এক সংস্কৃতি রয়েছে যা পাশ্চাত্য থেকে ভিন্ন। তারা মুসলিম সংস্কৃতির ধারক আর আমরা ইহুদী ও খৃস্টান সংস্কৃতির।
এসব সত্ত্বেও আমরা পাশ্চাত্যের ব্যাপারে হতাশ অথবা নিরাশ হতে পারি না। তাদেরকে এ ভেবে ত্যাগও করতে পারি না যে তাদেরকে হয়তো কখনোই সংলাপে আনা যাবে না। যদিও তাদের সভ্যতা থেকে আমাদের সভ্যতা ভিন্ন। কিন্তু দু’টি পক্ষ ছাড়া কি সংলাপ হতে পারে? কাজেই সভ্যতা নিয়েই সংলাপ হতে পারে। বিখ্যাত চিন্তাবিদ রজার গারোদি এভাবেই বিষয়টা উল্লেখ করেছেন। সভ্যতার সংঘাত নয়, চাই সভ্যতার সংলাপ।
তাহলে পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমরা কেন সংলাপ চালাবো না যখন আল-কোরআন আমাদেরকে ভিন্নমত পোষণকারীদের সঙ্গে সংলাপের তাগিদ দিয়েছে। এভাবে সংলাপকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়ার একটি মাধ্যম বানানো হয়েছে।
তাছাড়া আল-কোরআনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ এবং তাঁর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি ইবলিসের মধ্যে সংলাপের উল্লেখ রয়েছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ অভিশপ্ত শয়তানের মুখের ওপরেও সংলাপের দরজা বন্ধ করে দেননি। সূরা সাদ–এর ৭১–৮৫ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছেঃ স্মরণ করুন আর যখন আপনার রব ফেরেশতাগণকে বললেন, প্রকৃতই আমি মাটি দ্বারা একজন মানুষ সৃষ্টি করব। অতএব যখন আমি তার সৃষ্টি কার্য সম্পূর্ণ করব এবং তাতে আমার তরফ হতে রূহ ফুঁকে দেব তখন তোমরা সকলে তার সামনে সেজদায় অবনত হও। তারপর ফেরেশতাগণ সকলেই আদমকে সেজদা করল ইবলিস ছাড়া। সে অহঙ্কার করল এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলিস! যে বস্তু আমি নিজ হাতে গড়েছি তাকে সেজদা করতে তোমাকে কিসে নিবৃত্ত করল। তুমি কি অতি অহঙ্কার করছ নাকি তুমি উচ্চ মর্যাদাবানদের অন্তর্ভুক্ত? ইবলিস বলল, আমি তার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বললেন, অতএব এখান থেকে বের হয়ে যাও কেননা নিঃসন্দেহে তুমি বিতাড়িত। আর নিঃসন্দেহে তোমার ওপর আমার লা’নত থাকবে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত। সে বলল, হে আমার প্রভু! আমাকে অবকাশ দিন ঐ দিন পর্যন্ত যেদিন মৃতকে পুনরুত্থান করা হবে। আল্লাহ বললেন, নিশ্চয় তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে অবকাশ দেয়া হয়েছে নির্ধারিত সময়ের দিন পর্যন্ত। সে বলল, তবে আপনার ইজ্জতের শপথ! আমি অবশ্যই তাদের সকলকে পথভ্রষ্ট করব, আপনার নির্বাচিত সেই বান্দাগণ ব্যতীত। আল্লাহ বললেন, সত্য হচ্ছে- এবং আমি তো সত্যই বলে থাকি- আমি দোযখ পূর্ণ করব তোমার দ্বারা এবং তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তাদের সকলের দ্বারা।
পাশ্চাত্যের সঙ্গে সংলাপ একাধিক পর্যায়ে হওয়া উচিত। এ সংলাপ হতে পারে ধর্মীয়, বৃদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক পর্যায়ে।
ধর্মীয় সংলাপ
ইসলাম ও খৃস্টধর্মের মধ্যে বিভিন্ন লক্ষ্য সামনে রেখে ধর্মীয় সংলাপ হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ
১. নাস্তিক্যবাদী ও বস্তুবাদী চিন্তাধারার মোকাবিলা করা। যে চিন্তাধারা ঐশীবাণীর ঘোরতর বিরোধী, গায়েবে বিশ্বাসকে পরিহাস করে, আল্লাহ, তাঁর নবী রাসূল, তঁঅর শাস্তি ও নৈতিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। এ সংলাপ আরো মোকাবিলা করবে অবাধ মেলামেশা, নৈতিক স্খলন যা ওহী প্রদত্ত মহৎ মানবিক বৈশিষ্ট্যকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলেছে।
২. দু’টি ধর্মের মধ্যকার ঐক্যসূত্রগুলো নির্ধারণ করা। আহলে কিতাবদের সঙ্গে কিভাবে কথা বরতে হবে সে সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে কোরআন নির্দেশ করছেঃ আমরা ঐ কিতাবের প্রতিও ঈমান রাখি যা আমাদের ওপর নাজিল করা হয়েছে এবং যা তোমাদের ওপর নাজিল করা হয়েছে, আর আমাদের ও তোমাদের মাবুদ এক, আর আমরা মুসলমান হিসাবে তো তাঁর আনুগত্য করছি (সূরা আনকাবুতঃ ৪৬)।
৩. অতীতের ক্রুসেড এবং বর্তমান সম্রাজ্যবাদের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট বৈরী সম্পর্ক স্বাভাবিকিকরণের পাশাপাশি ভ্রাতৃত্ব, মানবতা ও কল্যাণকর মনোভাব সৃষ্টির মাধ্যমে সুন্দরতর ও পরিচ্ছন্ন সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা। এর মধ্যে রয়েছে মুসলমান ও খৃস্টানদের মধ্যে যেসব সংঘর্ষ হয় তাতে চার্চের তরফ থেকে খৃস্টান পক্ষকে সমর্থন দান বন্ধ করা। দক্ষিণ সুদান, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য অঞ্চলে এ ধরণের সংঘাত সংঘর্ষ ঘটে। চার্চ তো মুসলমানদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট ও পৌত্তলিকদেরও সমর্থন দেয়।
আমি জানি, অনেক ইসলাপন্থী এ ধরণের সংলাপের ব্যাপারে সন্দেহ প্রবণ। তারা মনে করেন এ সংলাপের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল অদৃশ্য হাত বিশেষ উদ্দেশ্যে তাড়িত হয়ে এটিকে ব্যবহার করে। কারণ তাদের বিশ্বাস সংলাপে মুসলমানরা নিঃসন্দেহে দুর্বল পক্ষ বলে তাদের অজ্ঞাতে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তাদেরকে ব্যবহার করে। সুতরাং কেউ এরকম সংলাপে অংশগ্রহণ করলে তাকে আহাম্মক অথবা দালাল বলে অভিযুক্ত করা হয়।
আমি মনে করি, এ ধরণের সন্দেহ অমূলক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সন্দেহ সঠিক হতে পারে। সব ক্ষেত্রে সব সময় নয়। আমরা আমাদের নিজেদের ওপর এতোটা আস্থা হারাবো কেন? আমরা নিজেদেরকে দুর্বল পক্ষ ভাবনো কেন? আমরা আমাদের যা কিছু আছে তা নিয়েই তো শক্তিশালী। কেউ সংলাপে অংশ নিলেই সে তার ঈমানের অধিকার হারিয়েছে এবং অপর পক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বলে আমরা মনে করব কেন? আসলে যা গুরুত্বর্পূর্ণ তা হচ্ছে, শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যারা আমাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করবে তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে এবং সংঘর্ষ বা পলায়নী মনোবৃত্তির চেয়ে সংলাপ শ্রেয়তর এমন বিশ্বাস নিয়েই আমরা সংলাপে যাবো।
বস্তুত সংলাপ প্রচার অভিযানেরই অন্যতম কৌশল যেটি রাসূলুল্লাহ সা. সূচনা করেছেন হারকিউলিস, মিসরের প্রধান খৃস্টান আল মুকাওয়াকিস, আবিসিনিয়ার নাজ্জাসী এবং আহলে কিতাবের অন্যান্য শাসকদের কাছে পাঠানো তাঁর ঐতিহাসিক চিঠির মাধ্যমে। এ চিঠিগুলো তিনি এ আয়াত দিয়ে শেষ করেছিলেনঃ হে আহলে কিতাবীরা! আস একটি কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সঠিক, আমরা আল্লাহ ব্যতিত আর কারো ইবাদত করব না আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করব না এবং আমাদের মধ্য থেকে কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে প্রভু বলে মেনে নেব না। অতঃপর তারা যদি বিমুখ থাকে, বল সাক্ষী থাক যে আমরা মুসলিম (সূরা আলে ইমরানঃ ৬৪)।
সম্প্রতি এ ধরণের একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং যার ফল ইতিবাচক। ওস্তাদ মোহাম্মাদ আল মোবারাক র. আমাদেরকে একথা জানিয়েছে। এ সংলাপ হয়েছিল রোমে। রাবেতা আল আলম আল ইসলামী এবং ভ্যাটিকানের প্রতিনিধি দলের মধ্যে। রাবেতার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্রেটারী জেনারেল শেখ মুহাম্মদ আল হারকান। তার সাথে ছিলেন মারুফ আল দাওয়ালিবি ও মুহাম্মদ আল মোবারাক।
এ সংলাপের ফলে এক পক্ষের কাছে অপর পক্ষের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হয়। বিশেষ করে ইসলামের ভাবমর্যাদা, যে ইসলাম সম্পর্কে অন্যায় ও বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা পোষণ করা হতো। কখনো কখনো মুসলিম-খৃস্টান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন দেখা গেছে।
আরেকটি সংলাপ হয় লিবিয়ায় কয়েকজন মুসলিম বুদ্ধিজীবি ও চার্চের উর্ধ্বতন সদস্যদের মধ্যে। এরও ভালো ফল পাওয়া গেছে বলে ড. ইজ্জ আল দীন ইব্রাহীম জানিয়েছেন। তিনিও এতে অংশ নিয়েছিলেন। আমি সংলাপে তার পঠিত প্রবন্ধটি পড়েছি। প্রবন্ধটির বক্তব্য খুব যুক্তি নির্ভর ও ভারসাম্যপূর্ণ ছিল। উগ্রতা অথবা উন্নাসিকতার কোনো ছাপ তাতে ছিল না।
বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপ
পাশ্চাত্যের সঙ্গে ধর্মীয় সংলাপের পাশাপাশি আরেকটি পরিপূরক সংলাপ আবশ্যক। সেটি হচ্ছে পাশ্চাত্যবিদ ও প্রাচ্যবিশারদের মধ্যে সংলাপ যারা ইসলাম, কোরআন, রাসূল, ধর্ম বিশ্বাস, ইতিহাস, সংস্কৃতি, জ্ঞান, জনগণ, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কিত বিষয়ে অধ্যয়নে আগ্রহী। বিশেষ করে যেসব পণ্ডিত বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা, আধুনিক পুনরুজ্জীবন আন্দোলন এবং সমসাময়িক পুনরুভ্যুত্থান সম্পর্কে আগ্রহী, তাদের সঙ্গে সংলাপ জরুরী।
চিন্তাধারার পরিশুদ্ধি, সকল দৃষ্টিভঙ্গি আরো ঘনিষ্ঠভাবে জানা, দু’পক্ষের মধ্যে পরিবেশ ও সম্পর্ক আরো উন্নত করার পথ প্রশস্ত করার লক্ষ্যে এ সংলাপ প্রয়োজন। যদি যাজক সম্প্রদায় ও চার্চের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ সম্ভব হয় (যারা তাদের অবস্থান এবং যুগ যুগ ধরে লালিত গভীর বিশ্বাসের ধারক) তাহলে প্রাচ্যবিশারদদের সঙ্গে সংলাপ তো আরো সহজ ও কল্যাণকর হওয়ার কথা। যদিও অনেকে মনে করেন পাশ্চাত্য যাজক সম্প্রদায় এবং পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের মধ্যে অথবা মিশনারী ও প্রাচ্যবিশারদদের মধ্যে কোনো তফাত নেই। তাদের মতে পার্থক্যটা কেবল তাদের পোশাকে। যাজকরা পুরোহিতের আর পাশ্চাত্যবিদ ও প্রাচ্যবিশারদরা পণ্ডিতের পোশাক পরিধান করে, আসলে তারা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
কিন্তু দৃঢ় ইচ্ছা, উদ্দেশ্য সচেতনতা ও পথ পরিষ্কার থাকলে সংলাপ অসম্ভব হওয়ার কথা নয। বিশ্ববিদ্যালয় ও বুদ্ধিজীবী ফোরাম পক্ষপাত ও উস্কানিমুক্ত নির্ধারিত কতকগুলো বিষয়ে গবেষণা শুরুর জন্যে দু’পক্ষের প্রতিনিধিদেরকে একত্রিত করে সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারে।
এ ব্যাপারে আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে যে ইসলাম, মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রতি প্রাচ্যবিশারদদের দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন নয়। প্রাচ্য পণ্ডিতদের সম্বন্ধে বহু লেখা হয়েছে। যেমন আল আকিকীর বই। আবার তাদের অভিযোগের জবাবে অথবা তাদের পক্ষ সমর্থন করে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এসব রচনার শ্রেণী বিভাগ করেও প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখা হয়েছে। যেমন ড. মোহাম্মদ আল বাহাই’র প্রবন্ধ। তিনি আলোচিত বিষয়ের নাম দিয়েছেন ‘ওরিয়েন্টালিস্টস এন্ড দেয়ার এটিচউডস টুওয়ার্ডস ইসলাম’।
আমাকে বলতে হচ্ছে, অধিকাংশ প্রাচ্যবিশারদদের মধ্যে বেশকিছু অভিন্ন দুর্বল দিক রয়েছে।
প্রথমত, প্রাচ্যবিশারদরা আরবি ভাষায় আরদর্শী নয় বলে এর বিভিন্ন ব্যঞ্জনা পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। ফলে স্বভাবতই মূল ইসলামী সূত্র বিশেষ করে কোরআন ও সুন্নাহ অনুধাবনের ক্ষেত্রে তাদের হোঁচট খেতে হয়। সুতরাং ইসলাম ও এর বাণী সম্পর্কে উপলব্ধি হয় অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্যের মন, মানুষ ও সভ্যতা সম্পর্কে প্রাচ্যবিশারদরা এক ধরণের অহমিকায় ভোগে। তারা পাশ্চাত্যকে বিশ্বের প্রভু এবং ইউরোপকে সকল দেশের জননী বলে মনে করে। তাদের ধারণা পাশ্চাত্য থেকেই ইতিহাসের শুরু এবং সেখানেই তার সমাপ্তি ঘটবে।
তৃতীয়ত, তারা এমন সব বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করে যা পরখ করার মতো বিষয় নয়। কেননা তারা মনে করে কোরআন আল্লাহর প্রেরিত নয় এবং মুহাম্মদ সা. তাঁর রাসূল নন। এভাবে তারা গবেষণা শুরুর আগেই একটি ধারণা তৈরী করে এবং তার ভিত্তিতে গবেষণা চালায় এবং যে কোনো প্রকারে তাদের ধারণাগুলো্ই প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এটি করতে গিয়ে তারা দুর্বল সূত্রের বর্ণনা গ্রহণ করে, মিথ্যাকে বিশ্বাস করে, তিলকে তাল করে, উঁইপোকার ঢিবিকে পাহাড় বানায়, সন্দেহকে প্রমাণ বলে মেনে নেয় এবং তাদের ধারণার বিপরীত সকল বিষয়কে নাকচ করে দেয়। এমনকি তাদের স্বকল্পিত ধারণা তাদেরই মুখে মুষ্ঠাঘাত করলেও।
চতুর্থত, প্রাচ্যবিশারদরা অনেক ক্ষেত্রে মহল বিশেষের ফরমায়েশ অনুযায়ী রাজনৈতিক মতলব হাসিলের লক্ষ্যে তাদের গবেষণা চালিয়ে থাকে। এ গবেষণা কর্মের জন্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। ফলে এসব গবেষণা পুরোপুরি পক্ষপাতমুক্ত এবং মতলবহীন হয় না।
এতদসত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রে এখনো সংলাপ আবশ্যক। মুক্ত চিন্তার অধিকারী মানুষদের সঙ্গে এটি চলতে পারে যাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কেননা বহু লোকই পুরনো মনমানসিকতা পরিহার করে নব নব চিন্তায় প্রভাবিত হচ্ছে।
এ সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেয়ার সময় আমাদেরকে সে সব প্রাচ্যবিশারদদের বেছে নিতে হবে যারা সকল জাতির মধ্যে বেশ নিরপেক্ষ ও নমনীয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন প্রফেসর জেক বেরেক। তাকে কয়েকবার কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
অবশ্য সমসাময়িক প্রাচ্যবিশারদদের অনূদিত গ্রন্থ থেকে মনে হয় আজকের প্রাচ্যবিশারদরা সে দিনের প্রাচ্যবিশারদদের চেয়ে নিরপেক্ষতার অনেক কাছাকাছি এবং অতিরঞ্জন ও উগ্রতা থেকে আরো দূরে অবস্থান নিচ্ছেন। বিশেষ করে মুসলমানরা এখন তাদের বইপত্র পড়ে, তাদের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করে কিংবা তাদের বক্তব্য অপছন্দনীয় হলে খণ্ডন করে। কিন্তু অতীতের প্রচ্যবিশারদরা লিখতেন তাদের নিজেদেরই জন্যে অর্থাৎ একে অপরের জন্যে। সে কারণে তাদের লেখা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ আলোচ্য বিষয়ের পরিবর্তে বিশেষ প্রতিবেদনের মতো মনে হতো।
রাজনৈতিক সংলাপ
ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপ সম্পন্ন করার পর ইসলামী আন্দোলনকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে আরেকটি সংলাপ চালাতে হবে, তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণেতাদের সাথে- সে সব রাজনীতিবিদ যারা রাজনৈতিক মঞ্চে প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে ভূমিকা পালন করেন তাদের সাথে।
আমি মনে করি পূর্বোল্লেখিত দু’টি সংলাপ এ গুরুত্বপূর্ণ সংলাপের পথ প্রশস্ত করবে। চার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও রাষ্ট্রের কাণ্ডারীদের ওপর এখনো যথেষ্ট প্রভাব রাখে এবং পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইসলাম ও মুসলমান সংক্রান্ত বিষয়ে পর্দার অন্তরালে কলকাঠি নাড়ে।
প্রাচ্যবিশারদরা দৃশ্যত তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত হলেও গোয়েন্দা বিভাগ, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ও পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ অনস্বীকার্য।
অনেকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপের যে কোনো উদ্যোগের ব্যাপারে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেন। অনেকে আবার প্রাচীন পাশ্চাত্য কবির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘ইস্ট ইজ ইস্ট, ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট, দে নেভার মিট’ (প্রাচ্য প্রাচ্যই, পাশ্চাত্য পাশ্চাত্যই, তারা কখনও মিলিত হয় না)। কিন্তু আমরা দেখেছি পাশ্চাত্য ভারত, জাপান এবং অতি সম্প্রতি চীনের সাথেও মিলিত হয়েছে।
অন্যেরা বলেন পাশ্চাত্য ভারত, জাপান, চীন অথবা হিন্দু, বৌদ্ধ, কমিউনিস্টদের সাথে মিলিত হতে পারে কিন্তু মুসলমানদের সাথে নয়। তারা এ প্রসঙ্গে মিশনারী, প্রাচ্যবিশারদ ও পশ্চিমী রাজনীতিবিদদের ঘোরতর ইসলাম বিদ্বেষী উক্তি থেকে উদ্ধৃতিও দিয়ে থাকেন।
আবার এমন লোকও আছে যারা পাশ্চাত্যের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ বা কোনো সংলাপ আয়োজনের চেষ্টা করলে তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখেন। এরূপ উদ্যোক্তাদের কলঙ্কিত করার জন্যে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, দালালী, বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি অভিযোগ সব সময় প্রস্তুত করে রাখেন। কেউ ভুলতে পারে না মি. ইভান্সের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে আমাদের বিশ্বস্ত ভাই ইখওয়ানুল মুসলিমিনের দ্বিতীয় মুর্শিদ আল আম হাসান আল হুদায়বীকে কী দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। মিসরীয় বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ এ যোগাযোগের কথা জানতেন, এর প্রতি সমর্থনও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা এ যোগাযোগকে হুদায়বীর বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। ইভান্সের সাথে এ যোগাযোগকে ব্যবহার করে তারা হুদায়বী, ইসলামী আন্দোলন, আন্দোলনের লোকজন ও নীতির ভাবমর্যাদায় কলঙ্ক লেপন করেন।
এসব বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে আন্দোলনের শত্রুরা এর ক্ষতি করার জন্যে এ ধরণের যোগাযোগকে কাজে লাগাতে না পারে। আমাকে এখানে বলতেই হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে অস্বাভাবিক ধরণের ভীতি ও বিদ্বেষ এখনো সাধারণত পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের আচরণকে প্রভাবিত কলে। ইয়ারমুক ও আজনাদিনের যুদ্ধ, ক্রুসেড এবং আরব ও ওসমানী বিজয় এখনো তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে। খালিদ বিন ওয়ালিদ, তারিক ইবনে জিয়াদ, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও কনস্ট্যান্টিনোপল বিজেতা মোহাম্মদ আল ফাতিহর মতো নাম এখনো তাদের ঘুম নষ্ট করে দেয়।
কিন্তু আমাদেরকে এরূপ অস্বাভাবিক মানসিকতা থেকে উদ্ভূত ভীতির শিকার হওয়া উচিত নয়। আমাদের সকল মনস্তাত্ত্বিক বেড়াজাল ভেঙে নতুন ও পুরোনো সকল মানসিক জটিলতা ঝেড়ে ফেলতে হবে।
গত কয়েক শতাব্দী ধরে যুদ্ধ, বিরোধ ও রক্তপাতে ইউরোপ ক্ষতবিক্ষত হওয়া সত্ত্বেও এ মহাদেশের দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে একদেশে পরিণত হবে।
মার্কিনী ও সোভিয়েতরা তাদের উত্তপ্ত ও শীতল যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে উভয়ের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলেছে। তাহলে মুসলমানদের সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে না কেন?
এ ব্যাপারে পাশ্চাত্যের যুক্তি সুবিদিত। স্থায়ী বন্ধুত্ব ও স্থায়ী শত্রুতা বলে কিছু নেই। আছে কেবল স্থায়ী স্বার্থ।
আমাদের ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার নীতির আলোকে সংলাপ শুরু করতে আমাদের আপত্তি নেই। আমি মনে কির, কোটি কোটি মুসলমানের বৈরিতা এড়ানো এবং তাদের আস্থা, বন্ধুত্ব ও সম্মান অর্জনের মধ্যেই পাশ্চাত্যের স্বার্থ নিহিত। এর বিনিময়ে আমরা পাশ্চাত্যের চোখে আমাদের ভাবমর্যাদা উন্নত করতে চাইব যাতে তিক্ত সংঘাতের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে পুঞ্জীভূত ধারণা পরিবর্তন করা যায়, যে ধারণা অতিরঞ্চত ও কল্পকাহিনী মুক্ত ছিল না।
আমরা অস্বীকার করছি না, আমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা তাদের চিন্তাধারা অথবা আচার আচরণের মাধ্যমে ইসলামের সর্বোত্তম ভাবমর্যাদা তুলে ধরছেন না। তারা এমনভাবে ইসলামের ভাবমর্যাদা তুলে ধরেন যেন ইসলাম সহিংসতা, ধর্মান্ধতা ও অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং স্বাধীনতা, মানবাধিকার বিশেষত সংখ্যালঘু ও নারী অধিকারের প্রতি তাচ্ছিল্যকে প্রশ্রয় দেয়। বহু মুসলিম দেশে বিরাজমান প্রকৃত অবস্থা এ ধরণের ভাবমর্যাদা গড়তে সহায়ক হয়েছে যেটিকে ইসলাম ও ইসলামী আইনের পরিণতি বলে ধরে নেয়া হয়।
এ ধরণের মারাত্মক বিভ্রম আপনা-আপনি বিলীন বা রাতারাতি দূর হতে পারে না। বরং সদিচ্ছা ও দীর্ঘস্থায়ী সংলাপের মাধ্যমেই দূর করা যেতে পারে। যে সংলাপের ভিত্তি হবে খোলা মন ও স্পষ্টবাদিতা, কূটকৌশল ও ছলনা নয়। অবশ্য রাজনীতিতে এরূপ সংলাপের আশা করা যায় না, কিন্তু অসম্ভব নয়। কারণ অধুনা রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
আমরা পাশ্চাত্য নেতৃবৃন্দ এবং যাদের রাজনীতিতে প্রভাব আছে তাদেরকে যদি নিশ্চিত করে বোঝাতে পারি যে ইসলামের আকীদা, বিশ্বাস, শরীয়াহ, মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ড নিয়ে আমাদের জীবন যাপনের অধিকার আছে, যেখানে পাশ্চাত্যের প্রতি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বা তাদের ক্ষতি করার মানসিকতা পোষণ করা হয় না। এভাবে আমরা আমাদের আবাসভূমির জন্যে কাঙ্ক্ষিত মুসলিম সমাজ কায়েমের লক্ষ্য অর্জনের পথে অনেক দূর এগিয়ে যাব।
কোনো সন্দেহ নেই যে এ লক্ষ্য অর্জনের প্রথম বাধা হচ্ছে আমাদের শাসকরা যারা আমাদেরকে সতর্ক পর্যবেক্ষণে রেখেছেন, আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর খবরদারি করছেন এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিধান হিসেবে ইসলাম কায়েমের যে কোনো প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করছেন।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাক্রমশালী পাশ্চাত্য ও তার নেতৃবৃন্দ আমাদের শাসকদের ওপর প্রভাব খাটায়, তাদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে সাবধান করে দেয়। তাদের মনে ইসলামপন্থীদের সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কৌশল, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে সংশয়ী করে তোলে।
সুতরাং একটি পথ নির্দেশক ও বৃহৎ শক্তি হিসেবে ইসলামের অভ্যূদয়ের আবশ্যকতা পাশ্চাত্যকে ব্যাখ্যা করতে পারলে সম্ভবত তা আরব ও মুসলিম নেতৃবৃন্দকে বোঝানোও সম্ভব। আর এটিই হবে একটি বড় সাফল্য।
সরকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
ইসলামী আন্দোলনকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সমর্থন আদায়ের জন্যে কঠোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মিসরের আল আজহার, তিউনিসিয়ার আল জায়তুনাহ, মরক্কোর আল কারাভিন এবং উপ-মহাদেশের দেওবন্দ।
আন্দোলনকে তার অপরিহার্য পরিকল্পনায় একটি বড় উদ্দেশ্য অর্জনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। তা হলো সরকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিজেদের আদর্শ ও জনশক্তি নিয়ে ঢুকে পড়তে হবে এবং তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে। আন্দোলন যদি এ প্রচেষ্টায় সফল হয়, তাহলে নিম্নোক্ত বিষয়সহ তাৎপর্যপূর্ণ ফল লাভ করা যাবেঃ
১. আন্দোলন সে সব প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলতে সক্ষম হবে মুসলিম জনতার মধ্যে যাদের এখনো সমর্থন রয়েছে। এসব সদস্য বিশেষ করে শাসকদের সেবাদাসরা সত্য-মিথ্যা নানা অভিযোগ তুলে অশিক্ষিত অথবা অর্ধশিক্ষিত মানুষের চোখে আন্দোলনের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার সামর্থ্য এখনো রাখে।
তাদের এসব অভিযোগ আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করে এবং আন্দোলনকে আত্মপক্ষ সমর্থন ও অসত্য অভিযোগ খণ্ডন করার প্রচেষ্টায় অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। সুতরাং এদের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলতে পারলে, যারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর দ্বীনের আলো নিভিয়ে ফেলতে চায়, ইসলামের সে সব প্রকৃত শত্রুর মোকাবিলায় আন্দোলন নির্বিঘ্নে প্রয়াস চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
২. এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি হবে যাতে সংস্কারের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা বিস্তারের মৌলিক ও আবশ্যিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান এমনভাবে ইসলামের সামগ্রিক, প্রকৃত ও অবিকৃত রূপ তুলে ধরবে যেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান জালেম শাসক, কমিউনিজম ও খৃস্টানদের কবলমুক্ত হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠবে ইসলামের শত্রুদের চক্রান্তের মোকাবিলায় ইসলামী দাওয়াতের এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। সরকারী ধর্মীয় এসব প্রতিষ্ঠান যদি সংস্কার করা যায় তাহলে এমন কিছু লোক তৈরী হবে যারা কেবল সরকারী দায়িত্ব পালনই নয় দাওয়াত ও দ্বীনের সেবায়ও আত্মনিয়োগ করবে।
৩. ইসলামের প্রধান প্রধান স্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সরকারী ধর্মীয় এসব প্রতিষ্ঠানের উপায় উপকরণ কাজে লাগানো সম্ভব হবে। ইসলামের প্রধান স্বার্থের মধ্যে রয়েছে সারা বিশ্বের মুসলমানদের সমস্যাবলী, ইসলামী ভাবাদর্শে ও মুসলিম ভূখণ্ডের প্রতি মুসলিম জনতার কর্তব্য। সেই সাথে জ্ঞান, কার্যক্রম, শিক্ষা ও মুসলিম ব্যক্তিত্ব গঠনের ক্ষেত্রে ইসলামী সাংস্কৃতিক উত্থানের রূপায়নে আন্দোলনের কর্মকাণ্ড।
ইসলামের শত্রুদের চক্রান্ত এবং আভ্যন্তরীণ মোনাফেকদের মদদে যে অশুভ ধারা গোপনে ও প্রকাশ্যে উম্মাহর মধ্যে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে তার মোকাবিলায়ও সরকারী প্রতিষ্ঠানের উপায় উপকরণ কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
জনপ্রিয় ইসলামী আন্দোলন ও সরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এরূপ সহযোগিতা ও সংহতির ফলে ইসলামী দাওয়াত এবং এর মহতী সাংস্কৃতিক প্রয়াসের প্রতি জনসমর্থন আরও প্রসারিত হবে।
৪. যেসব সরকার জীবন ও সমাজের চালিকাশক্তি হিসেবে ইসলামী আইনকানুন পরিহারে যে অজুহাত খাড়া করার চেষ্টা করে তা খণ্ডন করা সম্ভব হবে। সরকার এসব সরকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কোনো কোনো দুর্বল ও বিভ্রান্তিকর ফতোয়াকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে।
আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনের দাবি ও প্রচেষ্টার বৈধ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, যে রাষ্ট্রটি আল্লাহর প্রেরিত আইনে পরিচালিত হয় এবং সকল মানুষের জন্যে পথপ্রদর্শন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ইসলামকে একটি মৌলবিশ্বাস, একটি জীবনব্যবস্থা ও একটি বাণী হিসেবে গ্রহণ করে।
ইমাম হাসান আল বান্না সব সময় আল আজহারের পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহ পোষণ করতেন। তাদের মধ্যে অনেকে তার বন্ধু ছিলেন। একবার তান্তায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মনীষী উপস্থিত ছিলেন, যেখানে আমি ইমাম হাসান আল বান্নাকে বলতে শুনেছি- আপনারা, আলেমরা হচ্ছেন ইসলামের নিয়মিত সৈন্যবাহিনী আর আমরা আপনাদের পেছনে আছি রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে।
স্বাভাবিকভাবে এ কথা সে সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় যেগুলো ইহকালের সুখ সম্ভোগের বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করে দিয়েছে, স্বৈরশাসকদের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে, অত্যাচারী শাসকদের হাতের তলোয়ারে পরিণত হয়েছে- যে তলোয়ার প্রকৃত ইসলামপন্থীদের আঘাত হানার জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা বা নিষ্কৃতি দিলে চলবে না, বরং জনগণের সামনে এগুলোর মুখোশ খুলে ফেলতে হবে যাতে জনগণ এসব প্রতিষ্ঠানের অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে পারে এবং তারা কারা তা জানতে পারে।
যারা স্বৈরশাসকদের হাতে ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে এবং যারা স্বৈরশাসকদের ঘৃণা করে, কিন্তু দুর্বলতা ও ভীতির দরুণ তাদের প্রতিহত করতে সাহস পায় না, এ দু’য়ের মধ্যে আমাদেরকে পার্থক্য করতে হবে। কারণ যারা দুর্বল তারা এতোদূর ভীত যে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করে এবং ন্যায্য কথাও উচ্চারণ করতে ভয় পায়। কিন্তু অন্যায় কথাবার্তার সঙ্গেও নিজেদেরকে জড়িত করে না। সুতরাং এ অস্বাভাবিক অবস্থা বিবেচনা করে দুর্বলতা ও ভয়ভীতি কাটিয়ে উঠতে তাদের সাহায্য করা উচিত।
ইরানে শাহের বিরুদ্ধে বিপ্লবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। জাফরী ভাবাদর্শের নির্দেশনা মাফিক জনগণের নিরঙ্কুশ আনুগত্যের দাবি অনুযায়ী বিপ্লব বিপুল সাড়া ও সহযোগিতা পেয়েছিল। এ ছাড়া জনগণ শায়খ ও আয়াতুল্লাহদের আহ্বানে বিপ্লবের জন্যে জানমাল কুরবানী করতে সব সময় প্রস্তুত ছিল।
এ বিপ্লবে জনগণের স্বেচ্ছায় প্রদত্ত তহবিলও সহায়ক হয়েছিল। জাফরী ফিকাহ অনুযায়ী দানের পরিমাণ হচ্ছে খুমুস অর্থাৎ এক পঞ্চমাংশ যা মোট আয়ের ওপর নির্ধারিত হয়। এ পরিমাণ দান সামগ্রী ‘অনুপস্থিত ইমামের’ প্রতিনিধিত্বকারী আলেমকের হতে তুলে দেয়া হয়।
এভাবে ইরানের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সরকারের দয়ার পাত্র ছিলেন না। যদি তা হতো তাহলে সরকারই তাদের বেতন ভাতা দিতো তাদের ও তাদের পরিবারবর্গের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতো। তাদেরকে ইচ্ছামতো নিয়োগ দেয়ার এবং বরখাস্ত করার ক্ষমতাও থাকতো সরকারেরই হাতে।
সুতরাং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের অন্যতম অপরিহার্য নীতি হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান তাত্ত্বিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং দখলকৃত ওয়াকফ সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করে উপযুক্ত খাতে এগুলো ব্যবহারের স্বাধীনতাও থাকবে যেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তাদের নির্দিষ্ট ক্ষমতা ফিরে পায়। ইমাম হাসান আল বসরীর এমন ক্ষমতার গোপন রহস্য সম্পর্কে কোনো এক শাসক বলেছিলেন, তার ধর্ম আমাদের সরকার কিন্তু আমাদের অর্থের তার প্রয়োজন নেই।
এটিই হচ্ছে আসল সমস্যা যখন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রের কর্মকর্তা বনে যান, অথচ রাষ্ট্রের ধর্মের কোনো প্রয়োজন নেই কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থ তাদের দরকার।
ইসলামী পুনর্জাগরণ
দুনিয়ার বুকে ইসলাম কায়েম এবং ইসলামী দাওয়াতের বিরোধী সকল আগ্রাসী শক্তিকে রুখে দাড়ানোর লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলনকে সকল ইসলামী গ্রুপ এবং সকল ইসলামী পুনর্জাগরণ গ্রুপকে এক মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ ফ্রন্ট সংলাপের যথার্থ পন্থা নির্ধারণ এবং বিরোধী পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিকভাবে মোকাবিলার জন্যে অবশ্যই সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে যেন যে ব্যাপারে আমরা একমত পোষণ করি সে ব্যাপারে সহযোগিতার এবং যে ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে সে ব্যাপারে সহনশীল হওয়ার ভিত রচনা করতে পারি।
ইমাম হাসান আল বান্না মিসরের ইসলামী গ্রুপগুলোর মতানৈক্য অবসানে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালান এবং একমত হওয়া যেতে পারে এমন ন্যূনতম কর্মসূচি হিসেবে বিখ্যাত বিশ দফা প্রণয়ন করেন।
প্রধান প্রধান লক্ষ্য অর্জনে ইসলামী আন্দোলনের সব সময় এটিই করা উচিত। কেননা ইসলামী অঙ্গনে কর্মরত সকল গ্রুপের সম্মিলিত শক্তিই কেবল ইসলামী আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারে। আমি এখানে গুরুত্ব ও নিষ্ঠার সাথে আন্দোলনকারী ইসলামী গ্রুপের কথাই বোঝাচ্ছি। সে সব তুচ্ছ অথবা বিপথগামী গ্রুপ নয় কিংবা ইসলামের নামে ভাওতাবাজি করে এমন গ্রুপ নয়।
কোনো ইসলামী গ্রুপ যদি মনে করে তারা একাই এ সময়ে ইসলামী শাসন কায়েম এবং আভ্যন্তরীণ সমস্যা ও বৈদেশিক চক্রান্ত মোকাবিলায় সক্ষম তবে মারাত্মক ভুল করবে।
সকল ইসলামী গ্রুপ ও আন্দোলনের প্রকৃতপক্ষে যা করা উচিত তা হচ্ছে একটি শক্তিশালী ইসলামী জোট গঠনের লক্ষ্যে তাদের সকল প্রচেষ্টা সংহত করা এবং মতানৈক্যের অবসান ঘটানো যেন এ জোট ইসলামের মিত্রদের সহায়তা এবং শত্রুদের প্রতিরোধ করতে পারে।
আমি যেটি সবচেয়ে বেশি ভয় করি সেটি হচ্ছে স্বার্থপরতা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে ক্ষুণ্ন করে। প্রত্যেক গ্রুপ নিজেকে বড় করে দেখায় এবং অন্যকে অসমর্থ প্রমাণে উঠে পড়ে লাগে- এত দূর পর্যন্ত যে নিজ দলকে সমগ্র জোটের একটি শক্তিশালী অংশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা না করে অন্যকে ধ্বংসের লক্ষ্যে সকল তৎপরতা কেন্দ্রীভূত করে।
আমি আরো ভয় করি সেই সঙ্কীর্ণতা যা ইসলামী গ্রুপগুলোকে গ্রাস করে এবং তাদের চিন্তাচেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের দ্বন্দ্ব সংঘাতগুলোকে বড় করে দেখায়, উঁইপোকার ঢিবি দিয়ে পাহাড় বানায়, গৌণ বিষয়কে মৌলনীতিতে পরিণত করে, ইজতিহাদের বিষয়কে শরীয়াহর মৌলিক নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করে, যেমনটি করেছিলেন ‘দি রাইট অপিনিয়ন অন দি কনট্রাডিকশন বিটুইন মেম্বারশীপ অব পার্লামেন্ট এন্ড তাওহীদ’ শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক।
যে শক্তিশালী ইসলামী শাসন উম্মাহর ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারে এবং আমাদের পার্থিব জীবনকে উন্নততর করতে পারে সেটি কায়েমের জন্যে নানা মত-পথ-নীতি নির্বিশেষে সকল ইসলামী গ্রুপ ও শক্তির সম্মিলিত উদ্যোগ চাই। এর পাশাপাশি সে সব ধর্মপরায়ণ ও উৎসাহী ব্যক্তি যারা কোনো গ্রুপ ও সংগঠনের সদস্য নন তাদেরকেও এ প্রচেষ্টায় শামিল করতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি, ইসলামী আন্দোলন যদি এ লক্ষ্য অর্জনে সকল ইসলামী শক্তির প্রচেষ্টাকে এক মঞ্চে সমন্বিত করতে সক্ষম হয় যেখানে সকলেই মনে করবে এ রাষ্ট্র তাদেরই রাষ্ট্র, এ শাসন তাদেরই শাসন, এর বিজয় তাদেরই বিজয়, এর পরাজয় তাদেরই পরাজয়- তাহলেই আন্দোলনের সাফল্য সুনিশ্চিত।