তৃতীয়অধ্যায়
ইসলামী আন্দোলনঃ প্রচার অভিযান ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে
প্রচার অভিযান
সমাজের সকল গ্রুপ ও শ্রেণীর মধ্যে দাওয়াতি তৎপরতা এবং দিগ্দিগন্তে জনসাধারণের মধ্যে ইসলামী পুনর্জাগরণের চেতনা সৃষ্টির জন্যে ইসলামী আন্দোলনের কঠোর প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এভাবে কাজ করলে সমাজের কোনো স্তরই ইসলামী আন্দোলনের উপস্থিতি ও তৎপরতা শূণ্য থাকবে না। সর্বত্র আন্দোলনের আহ্বান পৌঁছে যাবে। এর নিবেদিত কর্মী বাহিনীও এ প্রচেষ্টায় শামিল থাকবে। এভাবে আন্দোলনের অনুসারী, সমর্থক ও প্রবক্তার সংখ্যাও বহুগুণ বেড়ে যাবে।
তথ্য ও গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে কাজ করেই এ পর্যায়ে উপনীত হওয়া সম্ভব। এজন্যে সংগঠিত ও সুপরিকল্পিতভাবে বিজ্ঞানের সর্বশেষ উদ্ভাবনা, তথ্য ও গণসংযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এরূপ কাজের জন্যে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সকল কৌশল ও সামর্থ্য যতটা সম্ভব এবং যেখানেই পাওয়া যায় কাজে লাগাতে হবে। আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে যতদিন সহায়ক হবে ততদিন এ পদ্ধতি ব্যবহার করে যেতে হবে। একজন সৎ ঈমানদারের সব সময় উচিত জ্ঞানগর্ভ বাণীর সন্ধান করা। যখনই সে এর সন্ধান পায়, সেটা তারই প্রাপ্য।
আন্দোলনের উচিত সে সব বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়া যারা সাধারণ সমাবেশ ও প্রত্যেক আলাদা গ্রুপের সামনে কিভাবে বক্তব্য রাখতে হবে সে ব্যাপারে অভিজ্ঞ। এসব বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি ও গণসংযোগ বিজ্ঞানে পণ্ডিত এবং তারা জানেন কিভাবে এ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আন্দোলনের এবং ইসলামের সর্বোত্তম স্বার্থে কাজে লাগানো যায়।
আন্দোলনকে আজই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এমন এক দাওয়াতি গ্রুপ তৈরী করতে, যারা এ যুগের ভাষায় কথা বলতে এবং সমান পারদর্শিতার সঙ্গে সমকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেন। তারা ইসলামী দাওয়াতের মহিমা, ব্যাপকতা, সার্বজনীনতা ও ভারসাম্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আজকের ভাষায় যুক্তি প্রয়োগ করে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর যোগ্যতা রাখেন এমন একদল গণমাধ্যম কর্মীকে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে।
এখন আমরা সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিক্ষিত, শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য শ্রেণীর মাঝে পুনর্জাগরণ এবং আন্দোলনের কাজ কিভাবে বিস্তৃত করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করব।
সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী
প্রথমে সাংস্কৃতিক গ্রুপের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের বিস্তার ঘটাতে হবে যাতে করে ইসলাম ও ইসলামের মর্মবাণী, আইন, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারা সঠিক খাতে প্রবাহিত করা যায় এবং ইসলামী আন্দোলন, এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ফলাফল সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করা যায়।
ভ্রান্ত ধারণা
সংস্কৃতিবান অনেক যুবকের মধ্যে ইসলামী পুনর্জাগরণ বিস্তৃত হলেও কেউ কেউ এখনো ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা ইসলাম সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ, বিকৃত বা অস্পষ্ট। এজন্য দায়ী হচ্ছে যুগ যুগব্যাপী পশ্চাৎপদতা কিংবা বিজাতীয় আদর্শিক আগ্রাসনের নতুন বিকৃত প্রভাবের পরিণতি।
এদের মধ্যে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করা সত্ত্বেও এখনো কুসংস্কার ও কল্পকথায় বিশ্বাসী। বিশ্বাসে বহু ঈশ্বরবাদকে প্রশ্রয় দেয়, ইবাদত-বন্দেগীতে রসম রেওয়াজের মিশ্রণ ঘটায় এবং তাদের আচার-আচরণে এলোমেলো অবস্থা বিরাজমান। আবার এরাই নিজেদেরকে সত্যিকার দ্বীনদার বলে মনে করে। অনেক সংস্কৃতিবান ব্যক্তি এখনো সাধু-দরবেশদের মাজারে ঘুরে বেড়ায় যেন এসব মাজার-দরগাহ কাবা ঘরের অনুরূপ। তারা মৃতব্যক্তির কাছে সাহায্য চায়, তাবিজ-কবচ পড়ে, রূহকে ডেকে আনায় বিশ্বাস করে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে কসম খায় এবং মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পশু জবাই করে।
সুদূরপ্রসারী বস্তুবাদী জোয়ার এবং পাশ্চাত্যের আদর্শিক আগ্রাসনের কারণে এ ধরণের লোকের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হলেও বিপথগামী সুফিবাদের প্রভাবে এদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। বহু মুসলিম দেশে এখনো এরা ক্ষমতার দাপট দেখায় এবং সরকারী কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে ও গোপনে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আর একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে এর তাৎপর্য না বোঝার কোনো কারণ নেই। এসব সংস্কৃতিবান ব্যক্তির প্রকৃত ঈমান ও আকীদার মৌলিক বুনিয়াদ অনুধাবন করা এবং আল্লাহর অনুমোদিত ইবাদত-বন্দেগীর তরীকা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা উচিত। বহু শিক্ষিত ব্যক্তি ইসলামের শাশ্বত রূপ, শক্তি ও মহিমার নানা দিক সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ। তারা ইসলামের নীতি-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু জানে না বললেই চলে। তারা প্রাচ্যবিশারদ ও মিশনারী এবং মুসলমানদের বর্তমান হাল-অবস্থা থেকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। মনে করে, তাদের চারপাশে মুসলমানদের যে অবস্থা তাতে ইসলাম বুঝি এরকমই। সুতরাং মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা, কলুষতা ও অজ্ঞতার জন্যে ইসলামই দায়ী। অথচ ইসলামের সাথে এসবের কোনো সম্পর্কই নেই।
সংস্কৃতিবান ব্যক্তিদের জানা উচিত, ইসলাম সম্পর্কে কোথায় জ্ঞান লাভ করা যায় এবং কোন কোন সূত্র তাদের ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারে। তাদের জানা উচিত, মুসলমানদের দেখে ইসলাম নয় বরং ইসলামের নিরিখে মুসলমানদের বিচার করতে হবে। বিভ্রান্ত মুসলমানরা ইসলামের মানদণ্ড নয় বরং সত্যিকার মুসলমানরাই ইসলামের মানদণ্ড।
কোনো কোনো সাংস্কৃতিক লোক এখনো মনে করেন, তারাই সত্যিকার দ্বীনদার মুসলমান হতে পারেন। অথচ তারাই ইসলামী শরীয়াহ ছাড়া অন্য আইনের শাসন মেনে নেন এবং এমন দেশে বাস করেন যার নিয়ম কানুন ও ক্ষমতাসীন সরকার ইসলামী নয়।
এটি তাদের অনুধাবন করা উচিত ইসলাম একটি জীবন ব্যবস্থা ও আইন বিধান এবং আল্লাহ তাঁর কোরআন এজন্যে নাজিল করেননি যে তা মৃতদের উদ্দেশ্যে তেলাওয়াত করা হবে। বরং তা জীবিত মানুষের পরিচালনার জন্য। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আপনার নিকট আমি এ সত্য কিতাব আল-কোরআন নাজিল করেছি যা দ্বারা আপনি মানুষের মধ্যে বিচার ফায়সালা করেন যা আল্লাহ আপনাকে ওহী দ্বারা জানিয়ে দিয়েছেন (সূরা আন নিসাঃ ১০৫)। তাদের এটিও বুঝে নেয়া উচিত, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার আলোকে যে ফায়সালা করে না, তারা কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী কুফরী, অবিচার অথবা দুরাচারের আওতায় পড়ে কিংবা একত্রে সব দোষই তাদের ওপর বর্তায়।
কোনো কোনো সংস্কৃতিবান ব্যক্তি এখনো মনে করেন, ইসলাম খৃস্টধর্মের একটি রূপ এবং খৃস্টধর্ম মানুষের শ্রেণীভেদ এবং ঈশ্বর ও সিজারের মধ্যে জীবনের বিভক্তি মেনে নেয়। মেথিউ ২২:২১-এ বর্ণিতঃ ‘অতএব, সিজারের প্রাপ্য সিজারকে দাও আর ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে প্রদান করো।’ এমনিভাবে তারা মানুষ ও আল্লাহর সম্পর্কের মধ্যে ইসলামকে সীমিত করে ফেলে। আর এ বিশেষ সম্পর্কের একমাত্র স্থান হচ্ছে মানুষের বিবেক। এ সম্পর্ক যদি বিবেকের বাইরে চলে যায়, তার একমাত্র স্থান হবে মসজিদ, অন্য কোথাও নয়। জীবন ও তার পদ্ধতি, সংস্কৃতি ও তার ধারা, শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম, অর্থনীতি ও তার প্রয়োগ, আইন ও দণ্ডবিধান এসব ব্যাপারে ইসলামের কি করণীয় আছে?
এর চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এদের কেউ কেউ নিজেকে কেবল মুসলমান হিসেবেই দাবি করে না, মুসলমান বলে গর্বও করে। নামাজ পড়ে, উমরাহ অথবা হজ্ব পালন করে। আবার একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার গুণকীর্তন করে, ইসলামের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদী বন্ধন পছন্দ করে এবং তারা কিসের পেছনে ছুটছে সেটার কোনো বাছবিচার অথবা পরীক্ষা নিরীক্ষা না করেই পুরোপুরি পাশ্চাত্য চিন্তাধারা গ্রহণ করে।
তারা ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব, ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষা তত্ত্ব, মার্ক্সের ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা এবং ডার্কহেমের ধর্মের উৎপত্তিতত্ত্ব গ্রহণ করে। অথচ তারা এটি দেখে না, এসব তত্ত্বকথার মধ্যে ইসলামের কি ভূমিকা রয়েছে। এদের একজন তো একবার বলেই ফেলেছেনঃ আমি একজন মুসলিম মার্ক্সবাদী। এটি বোধগম্য নয়, এক ব্যক্তির মধ্যে এ দু’টি জিনিসের অস্তিত্ব কিভাবে থাকতে পারে। এ প্রেরণা তিনি কোত্থেকে পেলেন- কোরআন, না দাস ক্যাপিটাল অথবা কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো থেকে? যদি কোনো বিরোধ দেখা দেয়, তখন কে হবে তার দৃষ্টান্ত ও ফায়সালাকারী- মুহাম্মদ সা., না মার্ক্স?
কোনো ব্যক্তি যদি বলে, ‘আমি একজন মুসলিম বৌদ্ধ কিংবা মুসলিম খৃস্টান’- তা কি মেনে নেয়া যায়? যদি ‘না’ হয়, তবে তিনি কিভাবে বলতে পারেন, আমি একজন মুসলিম মার্ক্সবাদী? এটি কি এ কারণে যে মাক্সবাদ একটি ধর্ম নয় বরং সকল ধর্মের বিরুদ্ধেই তার লড়াই এবং ধর্মকে ‘মানুষের আফিম’ বলে মনে করে? যদি তাই হয়, তাহলে মার্ক্সবাদ প্রত্যাখ্যান করাই অধিক বাঞ্ছনীয়। কারণ ইসলাম আরেকটি ধর্মের সঙ্গে মিলে যেতে পারে না, যদি সেই ধর্ম কিতাবীও হয়। তাহলে ইসলাম কিভাবে সব ধর্মের বিরোধী একটি মতবাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে?
প্রকৃতপক্ষে মার্ক্সবাদ সকল ধর্মকে অস্বীকার করলেও এর একটি ধর্মীয় চরিত্র আছে। আর তা হচ্ছে মার্ক্সবাদ তার অনুসারীদের কাছ থেকে নিরঙ্কুশ আনুগত্য দাবী করে, সে কারণে অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদের সঙ্গে মার্ক্সবাদের মিশে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
মার্ক্সবাদ একটি নিরঙ্কুশ স্বৈরতান্ত্রিক দর্শন। এতে ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের স্থান রাখা হয়নি। এমন কি প্রয়োজন ছাড়া ধর্মের কোনো ভূমিকা নেই এবং মার্ক্সীয় সমাজে ধর্মকে মৌল নয় গৌণ হিসেবে দেখা হয়েছে।
কোনো কোনো সংস্কৃতিবান ব্যক্তি বিশ্বাস করেন, মুসলমানদের রাজনৈতিক দুর্বলতা, সামরিক পরাজয়, সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দীনতার কারণ হচ্ছে ইসলাম। আর পাশ্চাত্যের বিজয় ও প্রগতি সম্ভব হয়েছে ধর্মের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথককারী ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ বরণ করার কারণে।
এ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে ধর্মের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে মৌলিক উৎসদ্বয় পবিত্র কোরআন ও রাসূলের সা. সুন্নাহর আলোকে। যেভাবে উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম সাহাবি ও তাদের অনুসারীরা জ্ঞানলাভ করেছিলেন। তাহলে তারা দেখবেন ইসলামের প্রকৃত তত্ত্ব সঠিকভাবে জানা এবং সর্বান্তকরণে অনুসরণ করা হলে সর্বোত্তম ফল লাভ করা যায়।
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অন্যকিছু নয়। এ শিক্ষা মনকে মুক্ত, নফসের তাজকিয়া, ইচ্ছাশক্তি সংহত, দেহকে সবল ও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর নির্মাণ করে। বিজ্ঞান, বিশ্বাস, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও নৈতিকতার মাধ্যমে সমাজকে প্রগতির দিকে নিয়ে যায়। সুবিচার ও পরামর্শ ভিত্তিক সরকার কায়েম করে, আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসন করে এবং সমগ্র মানবজাতিকে সর্বোত্তম পথ দেখায়।
ইসলামের ইতিহাস পাঠ করে তাদেরকে আরো জানতে হবে ইসলামের উত্থান-পতন, জয়-পরাজয়, বিকাশ ও বিপর্যয়, শক্তি ও দুর্বলতার কারণগুলো। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অবশ্যই দেখা যাবে মুসলমানরা তখনই বিজয়, অগ্রগতি ও শক্তি অর্জন করেছে যখন তারা একজন খলীফা, একজন সেনাধ্যক্ষ, একজন মনীষীর নেতৃত্বে একটি আন্দোলনের আওতায় ইসলাম, ইসলামের মূল্যবোধ ও শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরেছে। যেমনটি হয়েছিল খোলাফায়ে রাশেদীন, উমর ইবনে আবদুল আজীজ, আবু জাফর আল মনসুর, হারুন আল রশীদ, নূরুদ্দিন মাহমুদ আল শহীদ, সালাউদ্দিন আল আইয়ুবী প্রমুখের আমলে।
অন্যদিকে পরাজয়, বিপর্যয় এবং দুর্বলতা ও পতনের কাল তখনই এসেছে যখন মুসলমানরা ইসলামের সত্য থেকে সরে গেছে। যত দূরে সরে গেছে ততই আপদ তাদেরকে গ্রাস করেছে।
কোনো কোনো সাংস্কৃতিবান ব্যক্তি ইসলামের নামে প্রচলিত অনেক বিষয়ে এখনো অজ্ঞ। যেমন আমরা দেখেছি কোনো লেখক বিষয়বস্তু হিসেবে সত্য মনে করে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে বেছে নেন। অথচ ইসলাম হযরত ঈসা আ. এর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার কথিত ঘটনাকে দ্ব্যর্থহীনভঅবে নাকচ করে দিয়েছে। কেউ কেউ আবার এ কাহিনী বর্ণনা করেন, কিভাবে বিবি হাওয়া আ. নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের জন্য আদম আ. কে প্রলুব্ধ করেন এবং এর পরিণতিতে তারা বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে মানবজাতির জন্যে দুঃখ দুর্দশা বয়ে আনেন।
এ তত্ত্ব তাওরাত ও ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে নেয়া হয়েছে, ইসলামে যার কোনো ভিত্তি নেই। কারণ, আদমই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়েছিলেন এবং আদমই আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিলেন। সূরা ত্বাহা’র ১১৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেনঃ আর আমরা ইতোপূর্বে আদমকে এক অঙ্গীকার করিয়েছিলাম, কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমি তাঁর মধ্যে দৃঢ়তা পাইনি। একই সূরার ১২১–১২২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ আর আদম তার প্রভুর অবাধ্যতা করল, ফলে সে পথভ্রান্ত হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর প্রভু তাঁকে দয়ার জন্য মনোনীত করলেন, অতঃপর তাঁর প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাঁকে সুপথে আনয়ন করলেন।
দেখা যাচ্ছে আসল দায়-দায়িত্ব আদমেরই এবং তাঁর স্ত্রী নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ব্যাপারে কেবল তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন।
বহু সংস্কৃতিবান ব্যক্তি এখনো পাশ্চাত্যের প্রেক্ষিতে সংস্কৃতির বিচার করেন। তাদের কাছে সংস্কৃতির প্রথম সারির উপাদান হচ্ছে নৃত্য। তাই যে ব্যক্তি নৃত্য করে না সে সংস্কৃতিবান নয়। আমাদের যে নৃত্য আছে তা তরবারি নিয়ে। তাদেরকে আরো জানান, আমাদের আছে লেবাননী দারকা লোকনৃত্য এবং যে কোনো দেশের মতো অন্যান্য আরো লোকনৃত্য যা বিয়ে ও অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয়। এসব কথা যদি তাদের বলেন তাহলে আপনি হয়ে যাবেন তাদের উপহাসের পাত্র। কেননা আপনি তো নাচের একমাত্র অর্থটিই বোঝেননি। আর সেটা হচ্ছে নৃত্য মানে পরপুরুষের সাথে নারীর নৃত্য, পরনারীর সঙ্গে পুরুষের নৃত্য। আর এ নৃত্য করতে গিয়ে তারা পরস্পরের দেহের স্পর্শ অনুভব করে এবং সঙ্গীতের তালে তালে আন্দোলিত হয়। কিন্তু খবরদার, তাদের সম্পর্কে কোনো কু-ধারণা করবেন না কারণ তারা আপনার ও আমার মতো সাধারণ মানুষ নন, যাদের প্রবৃত্তি ও কামনা আছে। তারা সন্দেহ ও পাশববৃত্তির ঊর্ধ্বে, এমন কি তারা যেন পৃথিবীতে বিচরণকারী ফেরেশতা।
আর হালাল-হারাম একজন মুসলমানকে এ বিধান দেয় যে সে তার ইচ্ছেমত কোনো কিছু করতে পারে না। বরং আল্লাহর নির্ধারিত অলঙ্ঘনীয় সীমার মধ্যে থেকে তাকে কাজ করতে হয়। আল্লাহতায়ালা সূরা তালাকে’র প্রথম আয়াতে বলেনঃ আর যে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করলো, সে নিজের ওপর জুলুম করলো। সংস্কৃতিবানদের কাছে এ এক অদ্ভূত তত্ত্ব, যা তারা মানতে রাজি নয়।
সংস্কৃতিবানদের প্রতি আচরণ
সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে ইসলামী পুনর্জাগরণের দিকে আকৃষ্ট করার জন্যে দু’টি পন্থা গ্রহণ করা উচিতঃ প্রতিকারমূলক ও প্রতিরোধমূলক।
প্রতিকারমূলক পন্থা হচ্ছে, সংস্কৃতিবানদের লালিত ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করার পদক্ষেপ। ধীরস্থির, বস্তুনিষ্ঠ, তাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমে তাদের কাছে বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে। অপমান করে, এলোপাতাড়ি কথা বলে কিংবা উত্তপ্ত বাক্যবাণে বিদ্ধ করে নয়। বরং তাদের প্রামাণিক সূত্রগুলোর সন্ধান দিতে হবে যে সূত্র থেকে তারা ইসলাম, কিতাব, রাসূল, ধর্মতত্ত্ব, শরীয়াহ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে পারবে।
এ পন্থাটি সেই তরুণদের জন্যে সর্বাপেক্ষা উপযোগী যারা উগ্রপন্থার খপ্পরে পড়ে সেটিকে একটি নীতি হিসেবে গ্রহণ অথবা তার আলোকে জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে না। যেসব তরুণ সত্যের খাতিরে সত্যের অন্বেষণে সচেষ্ট তাদের জন্যেও এ পন্থা ফলপ্রসূ হতে পারে। যারা উগ্রপন্থী ও প্রগতিশীল, উদারপন্থা, ডানপন্থা, বামপন্থা ইত্যাদিকে আঁকড়ে ধরেছে তাদের সাথে তর্ক করা বৃথা। তবে বিশেষ কোনো একটি বিষয় ব্যাখ্যা করা বা খণ্ডন করার ক্ষেত্রে হয়তো সহায়ক হতে পারে।
দ্বিতীয় পন্থাটি প্রতিরোধমূলক। নির্ভুল তত্ত্ব ও স্বচ্ছ অভিব্যক্তি সহকারে বিশুদ্ধ, প্রামাণ্য ইসলামী সংস্কৃতির রূপ তুলে ধরাই হবে এ প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য। ইসলাম অনুধাবনের জন্যে দিক নির্দেশনা দেয়া, সংস্কৃতিবানদের মধ্যে গড়ে ওঠা বিভিন্নমুখী ভুল ধারণা দূর করা এবং এর পাশাপাশি মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত চিন্তা-বিশ্বাসের মোকাবিলা করা।
প্রতিরোধমূলক পন্থার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, তরুণ সমাজকে আগ্রাসী আদর্শের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করা। এ পন্থায় কাজ করার ফলে তরুণরা যে জ্ঞান অর্জন করবে তা আমাদের ভূখণ্ডে গোপনে বা প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়া আদর্শিক মহামারী প্রতিরোধে ভ্যাকসিন হিসেবে কাজ করবে।
সাধারণ মুবাল্লিগ বা ধর্মপ্রচারকদেরকে সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। এসব মুবাল্লিগ ও ওয়ায়েজগণ না যুগের ভাষায় কথা বলতে পারে, না তারা সংস্কৃতিবানদের কাছে বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বক্তব্য পেশ করতে পারে। এসব ধর্মপ্রচারক কেবল তাদের আবেগময় বাগ্মিতা দিয়ে মুসল্লীদের মধ্যে জজবা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু উদারমনা ব্যক্তিদের হৃদয়ে নাড়া দিতে পারে না। এসব উদারবাদী কদাচিৎ ‘হ্যাঁ’ বলে, বরং সব সময় তাদের জিজ্ঞাসা ‘কেন, কিভাবে’?
জনপ্রিয় মুবাল্লিগগণ জনপ্রিয় লেখকদের মতো। প্রথমোক্তরা তাদের সুরেলা ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে জজবা সৃষ্টি করে, আর শোষোক্তরা প্রাঞ্জল লেখনীর মাধ্যমে আবেগ অনুভূতি সঞ্চার করে। আরবের একটি প্রাচীন প্রবাদ অনুযায়ী কলম হচ্ছে দু’টি জিহ্বার একটি। কণ্ঠ এবং এর আওয়াজে শ্রোতাকে উত্তেজিত ও অভিভূত করার ক্ষেত্রে জিহ্বার কার্যকারিতা অনেক বেশি। আর এর সাথে যদি যোগ হয় কল্পনাশক্তি, তাহলে তো কথাই নেই। এসব ওয়ায়েজ ও লেখকদের ভূমিকা ও উপযোগিতা ততটুকুই যতটুকু জ্ঞান তাদের রয়েছে। তবে সংস্কৃতিবান মহলে তারা যে ক্ষতি করেন, সাধারণত তাদের ভালো করার মাত্রার চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়ে যায়।
জনগণ
সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর দিকে নজর দেয়া মানে সাধারণ মানুষকে অবহেলা করা নয়। উভয় ক্ষেত্রে কাজ পরস্পর বিরোধী নয়। ইসলামী আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনপ্রিয়তা। আন্দোলন জনপ্রিয় এ অর্থে যে এটি সরকারী বা অভিজাততান্ত্রিক আন্দোলন নয়। এ এমন এক আন্দোলন যা জনগণের হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় এবং অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে। পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আন্দোলন জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটায়। তাদের পক্ষে কথা বলে এবং তাদের দায়িত্ব ও অধিকার আদায়ে সহযোগিতা প্রদান করে।
আন্দোলনের বিদেশী শত্রুরা এবং দেশের ভেতরে তাদের এজেন্টরা ইসলামী আন্দোলনকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালায়। কখনো অপপ্রচার ও বিকৃতির মাধ্যমে, কখনো ভয়ভীতি কিংবা চাপ প্রয়োগ করে। আবার অনেকে বিভিন্ন ধরণের পন্থায় এ অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে।
এর চেয়েও বিপজ্জনক হচ্ছে ঔদ্ধত্য, অভিযোগ, অশ্রদ্ধা, বেপরোয়াভাব ও ব্যস্ততার অজুহাতে আন্দোলন যদি নিজেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখনই আসল বিপদ, যখন আন্দোলন জনগণের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কের কথা ভুলে যায়, জনগণের সমস্যা, দুঃখ-দুর্দশা অবজ্ঞা করে কেবল নিজেকে নিয়ে নিজের কথা নিজেই শুনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনিভাবে আন্দোলন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জন প্রকোষ্ঠে আশ্রয় নেয়।
ইসলামী আন্দোলন তখনই সফল হবে যখন জনগণকে সাথে নিয়ে চলতে সক্ষম হবে। জনগণ আন্দোলনের স্বার্থের সাথে একাত্ম হয়ে আন্দোলনের সমস্যা বা সংকট নিজের বিপদাপদ মনে করবে। আন্দোলনের আনন্দ তাদের আনন্দের কারণ হবে, আন্দোলনের সকল ভূমিকা, অবস্থান ও প্রচেষ্টার তারা প্রশংসা করবে এবং শত্রুকে অভিসম্পাত দেবে। ইসলামী আন্দোলন তখনই সফল হবে যখন শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত রক্তের মতো জনগণের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রতি এর প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত হবে। আন্দোলনের সম্পর্ক হবে দেহের সাথে আত্মা ও চোখের সাথে দৃষ্টির সম্পর্কের মতো। তখন জনতার স্রোত ও ইসলামী আন্দোলন একাত্ম হয়ে যাবে যেন একটিকে আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা না যায়।
এটি তখনই সম্ভব যখন ইসলামী আন্দোলন জনগণের স্বার্থ আপন করে নেবে, তাদের অনুভূতি, অভিব্যক্তির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করবে, তাদের শোক-দুঃখে সমব্যথী হবে, আপদে-বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াবে, তাদের সাথে একাত্ম হয়ে যাবে।
অলীক স্বপ্ন
জনগণের ওপর আমাদের বিশ্বাস এবং জনগণের শক্তিতে আমাদের আস্থার কারণে আমরা যেন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে না দেই অথবা অলীক স্বপ্নে বিভোর না করি। ইসলামী আন্দোলনের প্রবক্তা ও তাত্ত্বিকদেরকে জাতির সামনে তাদের প্রকৃত রোগ তুলে ধরতে হবে। রোগ লুকিয়ে রাখা যাবে না যেমনটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর বেলায় করা হয়। যতই তিক্ত হোক জাতিকে আসল সত্য জানাতে হবে। এমন অলীক স্বপ্ন দেখানো উচিত হবে না যদি সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা না যায়।
মুসলিম সুফি মনীষীরা আশা ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে বলেছেন, আশার সঙ্গে থাকে কর্ম সাধনা, অন্যথায় তা ইচ্ছে মাত্র। আশা হচ্ছে ঈমানদারদের লক্ষ্য, আর যারা কিছু করতে চায় না, ইচ্ছে হচ্ছে তাদের চাতুরী। আল-কোরআন তাদেরকে লক্ষ্য করে বলছে, যারা দাবি করে যে বেহেশত কেবল তাদেরই অথচ তারা ঈমানও আনে না আমলও করে না। সূরা আল বাকারা’র ১১১ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ ওগুলো তাদের মনের বাসনা, আপনি বলুন (হে মুহাম্মদ) তোমাদের প্রমাণ আন যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
আলী ইবনে আবু তালিব রা. তার পুত্র হাসান রা. কে বলেছেনঃ সাবধান, ইচ্ছের ওপর মোটেই নির্ভর করো না। ইচ্ছে আহম্মকদের অবলম্বন। একজন আরব কবি বলেছেনঃ ইচ্ছের দাস হয়ো না। কেননা, ইচ্ছে সম্বলহীনদের সম্বল।
যে আন্দোলন অমানিশার অন্ধকারকে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করতে চায়- আশা, আকাঙ্ক্ষা ও সুন্দর ভবিষ্যত কামনা সে আন্দোলনের চালিকা শক্তি। আশা-আকাঙ্ক্ষা ইচ্চে থেকে ভিন্ন। কেননা ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু না পেলে হতাশায় পর্যবসিত হয়, আর আশা-আকাঙ্ক্ষায় নিরাশা ও আশাহীনতার কোনো স্থান নেই।
আমাদেরকে জনগণের সামনে অবশ্যই কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরতে হবে। তাদেরকে ভবিষ্যতের বিপদ সম্পর্কে সাবধান করতে হবে যেন তারা সে দুর্ভোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে পারে। তারা যেন এ বিভ্রমে না থাকে সে ভবিষ্যতের পথ কুসুমাস্তীর্ণ, কণ্টকহীন অথবা যেখানে বিনাশ্রমে ফল লাভ করা সম্ভব।
ইসলামী আন্দোলন মুসলিম জনগণের কাছে ইসলামী শ্লোগান ও সমস্যার সমাধান সম্বলিত উক্তি প্রচারের ক্ষেত্রে যে ভুল করছে তা সংশোধন করতে হবে। যখন শ্লোগানে বলা হয়, ‘ইসলামই সমাধান’, ‘ইসলাম ছাড়া কোনো আশা নেই’ অথবা ‘আমাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার একমাত্র সমাধান ইসলাম’- তখন সাধারণ মানুষ মনে করে, এসব শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পার্লামেন্টে পাঠালেই যাদুর কাঠির স্পর্শে বা অলৌকিকভাবে তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ইসলামী আন্দোলনকারী ও আন্দোলনের বুদ্ধিজীবীদের সরাসরি ও সহজভাবে জনগণকে বোঝাতে হবে ইসলাম জনগণের মাধ্যমেই জনগণের সমস্যার সমাধান চায়। আল্লাহ তাদের কাজগুলো- জমি চাষ, পশুপালন, শিল্পায়ন, বাণিজ্যের প্রসার, অবকাঠামো গড়ে তোলা, উৎপাদনমুখী কাজ করার জন্যে মুসলিম জনশক্তির সমাবেশ ঘটানো অথবা জাতিকে অলসতা ও শক্তির অপচয় থেকে রক্ষার জন্যে পৃথিবীতে ফেরেশতা পাঠাবেন না।
সুন্দর জীবনযাপনের জন্যে প্রয়োজন ন্যায়পরায়ণ সমাজ। সে সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকেই কাজ করতে হবে। আল্লাহ সাহায্য পাঠাবেন এ প্রত্যাশায় মসজিদে অবস্থানকারী কয়েক জন লোককে ওমর ইবনে খাত্তাব রা. বললেনঃ তোমাদের অলসভাবে বসে থাকা উচিত নয় এবং আল্লাহ তোমাদের ভাগ্যে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা সাথে সাথে পাওয়ার চেষ্টা করো না। এরপর বললেনঃ ইয়া আল্লাহ, আমার ভাগ্যে যা কিছু আছে আমার কাছে পাঠাও। অথচ তিনি জানতেন যে আকাশ থেকে সোনা-রূপা বর্ষিত হবে না। আল্লাহ বলেনঃ আর যখন জুম’য়ার নামাজ শেষ হয়ে যায়, তখন তোমরা জমিনের ওপর ছড়িয়ে পড় এবং কাজের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকা তালাশ করো (সূরা জুম’আঃ ১০)। আল-কোরআনে পারিষ্কারভাবে এ অলঙ্ঘনীয় বিধানের কথা বলা হয়েছে এভাবেঃ নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনে (সূরা রা’দঃ ১১)।
এটি হচ্ছে সূচনা বিন্দু। আমাদের ভুল ধারণা, খারাপ চিন্তাধারা, ঘৃণ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অগ্রহণযোগ্য নীতি-নৈতিকতাকে সঠিক ধারণা, স্বচ্ছ ও সৎ চিন্তা, প্রশংসনীয় চরিত্র ও উন্নত নৈতিকতায় পরিবর্তিত করতে হবে। মানুষ এখন যে জীবনধারায় অভ্যস্ত তা অবশ্যই পাল্টাতে হবে। জীবনকে কাজ ও উৎপাদনমুখী করতে হবে। অলস ও ভবঘুরে হলে চলবে না। জীবনকে তামাশা নয় গুরুতর বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। জীবন কৃচ্ছ্রতার, বিলাসিতার নয়। সুবিচারের, অবিচারের নয়। জীবন মেহনতের, অলসতার নয়।
ভ্রান্ত ধারণার সংশোধন
ইসলামী আন্দোলন ও তার প্রবক্তাদের দায়িত্ব হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে যে সব ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে তা সংশোধন করা। কারণ ইসলামী চিন্তা-চেতনাই সমাজ গঠন ও প্রগতির হাতিয়ার হতে পারে।
বহু ধার্মিক লোক ইসলামের কয়েকটি প্রধান মূল্যবোধ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন। এর মধ্যে রয়েছে ঈমান, তাকওয়া, সততা ও স্পষ্টবাদিতা।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ আর এসব জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনতো ও তাকওয়া সম্পন্ন হতো, তবে আমি তো তাদের জন্যে আকাশ ও পৃথিবীর বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম (সূরা আল আ’রাফঃ ৯৬)। আরও বলা হয়েছেঃ এবং যে আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর প্রতি স্বীয় দায়িত্ব পালন করে, আল্লাহতায়ালা তার জন্যে সকল বিপদ থেকে মুক্তির পথ বের করে দেন। তাকে এমন স্থান থেকে রিজিক পৌঁছিয়ে দেবেন যা সে চিন্তাই করতে পারে না (সূরা তালাকঃ ২–৩)। অথবা বলা হয়েছেঃ এবং বস্তুত আমরা লাওহে মাহফুজের পর যবুরে উপদেশ বাণী লিপিবদ্ধ করেছি যে আমার সৎ বান্দারা পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভ করবে (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৫)। অন্য সূরায় বলা হয়েছেঃ আর এরা (অমুসলিমরা) যদি আল্লাহতে বিশ্বাসী হতো এবং ইসলামের সঠিক পথে চলত তাহলে আমি নিশ্চয়ই তাদেরকে প্রচুর পানি বর্ষণে সিক্ত করতাম (সূরা জ্বীনঃ ১৬)।
সাধারণ মানুষ যখন এসব আয়াত তেলাওয়াত করে, তারা মনে করে এসব আয়াতে কতিপয় আচার-অনুষ্ঠানর ও ফরজ পালনের কথা বলা হয়েছে। যেমন নামাজ, রোজা, তসবিহ, তাহলিল, তাকবীর ইত্যাদি জিকির-আজকার করা এবং সকল নিষিদ্ধ কাজ মদ-জুয়া ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা। নিঃসন্দেহে এগুলো ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দ্বীন, ঈমান ও তাকওয়া কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। সূরা জারিয়া’র ৫৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ আর আমি জ্বীন ও মানুষকে এজন্যে সৃষ্টি করেছি যেন তারা আমারই ইবাদত করে। আল্লাহতায়ালা যখন মানুষকে তাঁর ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেন তখন তিনি এ দ্বারা এটিও বুঝিয়েছেন যে মানুষ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি বা খলীফা হবে, যে পৃথিবীতে তারা জ্ঞান ও শ্রম দিয়ে আবাদ করবে ও গড়ে তুলবে। আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই আমি ভূপৃষ্ঠে একজন প্রতিনিধি পাঠাবো (সূরা আল বাকারাঃ ৩০)। তিনিই তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানে তোমাদেরকে আবাদ করেছেন (সূরা হুদঃ ৬১)। এখানে আবাদ শব্দটির অর্থ হলো তিনি চান তোমরা এটি আবাদ করো ও গড়ে তোল। এ আবাদ ও গড়ে তোলার কাজটিও ইবাদতের মধ্যে গণ্য।
ঈমান, তাকওয়া, সততা ও স্পষ্টবাদিতার দাবি হচ্ছে আমাদের বৈষয়িক জীবনের সাথে দ্বীনি জিন্দেগীর ভারসাম্য রচনা করা, ইসলামের বিশ্বজনীন আচার-বিধি অনুসরণ করে আল্লাহর বন্দেগী করা, আমাদের শত্রুর মোকাবিলায় সর্বশক্তি দিয়ে প্রস্তুত থাকা, জমি চাষ করা এবং কলকারখানায় কাজ করা। জাতির দ্বীনি ও বৈষয়িক জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান ও শিল্পের সকল দিক কাজে লাগান। কেননা মুসলিম ফকিহগণ একাজকে সমগ্র জাতির জন্যে সামষ্টিক দায়িত্ব (ফরজে কেফায়া) বলে গণ্য করেছেন। যদি সবাই মিলে এ কর্তব্য পালন না করা হয় তবে তা হবে গর্হিত অপরাধ।
কাঙ্ক্ষিত দ্বীনদারী দরবেশের হাতের তসবিহ নয়, স্বঘোষিত শায়খে’র মাথার পাগড়িও নয়, কিংবা ইবাদত-বন্দেগীর জন্যে মুসল্লীর বেছে নেয়া নির্জন স্থান বা খানকা নয়। দ্বীনদারী মানে জ্ঞান ও কর্মসাধনা, দ্বীনদারী ও দুনিয়াদারী, দেহ ও আত্মা, পরিকল্পনা ও সংগঠন, উৎপাদন ও উন্নয়ন, পূর্ণতা ও ঊৎকর্ষতা অর্জন। হাদিসে উল্লিখিত হয়েছেঃ যত সুন্দরভাবে একটি কাজ করা উচিত, মানুষ ঠিক সেভাবে কাজটি সমাধা করলে আল্লাহ খুশি হন (বায়হাকী)। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর মধ্যে নৈপুণ্য নিহিত রেখেছেন (মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ সা. মুসলমানদের সকল কাজে সুদক্ষ হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি একটি ক্ষুদ্র সরীসৃপ মারার ক্ষেত্রেও। রাসূলের সা. এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছেঃ যে এক আঘাতে একটি টিকটিকি মারে সে যেন একশ নেকী অর্জন করল। যে দু’টি আঘাতে মারল সেও নেকী করল (প্রথমটার চেয়ে কম), আর যে তিনটি আঘাতে মারতে পারল সেও নেকী করল (দ্বিতীয়টার চেয়ে কম) (মুসলিম)। সব কাজ ভালোভাবে করার চেষ্টা চালাতে হবে, যদি কাজটি তুচ্ছও হয়।
রাসূলুল্লাহ সা. এর সাহাবিরা ইসলামকে ফকীর-দরবেশের ধর্ম মনে করেননি, কিংবা ঈমান ও দ্বীনদারিকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি অথবা উন্নত জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা বাদ দিয়ে একমাত্র ফরজ আমল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাননি। সা’দ ইবনে আল রাবীর রা. কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে দান গ্রহণের প্রস্তাব পেয়ে আব্দুর রহমান বিন আউফ রা. বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে বললেন- আমি ব্যবসায়ী, বাজার কোথায়, আমাকে দেখি দিন। তিনি ব্যবসা করে বিপুল মুনাফা অর্জন করেন। আর এ ব্যবসা তার ঈমন ও দ্বীনদারীকে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন করেনি, বরং তিনি এমন ঈমানদার ও দ্বীনদার ছিলেন যে বেহেশত লাভের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ জনের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। রাসূলুল্লাহ সা. যার বেহেশতে প্রবেশের আগাম সুসংবাদ দিয়েছিলেন এবং যার জন্য রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর ওফাতের সময় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। আব্দুর রহমান বিন আউফ রা. হযরত ওমর রা. এর গঠিত ছয় সদস্যের মজলিশে শূরার সদস্যও ছিলেন। হযরত ওমর তাঁর অবর্তমানে তাদের মধ্য থেকে একজন খলীফা নির্বাচনের জন্য এ মজলিশ গঠন করেন।
তারাই ধর্মভীরু ঈমানদার যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস এবং সততার বলে পার্থিব কল্যাণের জন্য কঠোর পারিশ্রমের পাশাপাশি নেক কাজ করার ব্যাপারেও সদা সচেষ্ট। তাই আল্লাহতায়ালা তাদের ইহলৌকিক প্রচেষ্টায় রহমত দান করেন এবং আখেরাতেও তাদের পুরস্কার দিতে কার্পণ্য করবেন না।
মেহনতী মানুষ
মেহনতী মানুষ বলতে আমি বোঝাতে চাই বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্প শ্রমিক ও কারিগর। এরা বর্তমানে বড় বড় শহর নরে কর্মরত এক বিশাল জনগোষ্ঠী। এ সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণী তাদের অধিকার আদায় এবং অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অচল করে দিতে পারে।
এক্ষেত্রে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়, আজ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণীর ওপর সামান্যই প্রভাব ফেলতে পেরেছে। আমাদের সমাজের এ স্তরে বামপন্থীরা এখনো অধিকতর প্রভাবশালী ও সোচ্চার কণ্ঠ। বামপন্থীরা ব্যাপকভাবে তাদের স্বার্থে শ্রমিকদের দাবি ও ইচ্ছাকে কাজে লাগায়। মিসরে ইসলামী আন্দোলনের মূল সংগঠন ইমাম হাসান আল বান্নার নেতৃত্বাধীন ইখওয়ানুল মুসলিমিন মিসরীয় শ্রমিকদের একটি গ্রুপ নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। ইমাম যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছিলেন তার প্রতি সমর্থনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এসব শ্রমিক ইসমাইলিয়ায় আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে।
অধিকাংশ মুসলিম দেশে (মিসর, সুদান, জর্ডান, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, পাকিস্তান ইত্যাদি) ছাত্র ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের শেকড় গভীরে প্রোথিত করা সম্ভব হলেও, শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে আন্দোলনের উপস্থিতি নগণ্য। সুদানী সমাজে ইসলামী আন্দোলন অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও সুদান ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্টের নেতা ড. হাসান আল তুরাবী তার ‘সুদানে ইসলামী আন্দোলন’ নামক গ্রন্থে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্দোলনের একচেটিয়া দাপট রয়েছে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা বেশ প্রভাব খাটাতে সক্ষম।
শ্রমিক শ্রেণীর মাঝে ইসলামী আন্দোলনের বিস্তারে ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে আমি অবগত নই। শ্রমিকদের মাঝে ধর্মীয় চেতনার দীনতাই কি এর কারণ? কিন্তু ধর্ম যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবিচ্ছেদ্য অংশ শ্রমিকরা তার অন্তর্ভুক্ত হয়েও তাদের ধর্মবোধ দুর্বল হলো কেন? প্রকৃত ইসলাম ও জীবনে ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং আমদানি করা বিজাতীয় ধ্যান-ধারণার প্রভাবই কি এর কারণ? এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।
নাকি শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতি স্বীকৃতি ও স্বার্থরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ এবং তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি ইসলামী আন্দোলনের সমর্থন দানে ব্যর্থতা কিংবা লোভী পুঁজিপতি ও শোষক-শাসকদের কর্মকাণ্ডই এর কারণ? নাকি এটি বামপন্থীদের সফলতা যারা তাদের ধ্বংসাত্মক নীতি ও বস্তুবাদী দর্শন প্রসারে শ্রমিকদেরকে ব্যবহারের লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। বামপন্থীরা এসব কাজে সিদ্ধহস্ত। প্রলুব্ধ করার কৌশলও তাদের জানা আছে এবং ইসলামী আন্দোলন শ্রমিকদের কখনো কোনো উপকারে আসবে না- বামপন্থীরা এ অপপ্রচার চালাতেও পারঙ্গম।
কারণ যাই হোক, এক্ষেত্রে ইসলামী আন্দোলনের কর্মকৌশল পর্যালোচনা করা উচিত। কেননা, শ্রমিক শ্রেণী মুসলিম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসলাম এখনো মেহনতী মানুষের জীবনের সুদৃঢ় চালিকা শক্তি। কেননা তারা বিশ্বাস করে যে ইসলামই হচ্ছে একমাত্র ধর্ম যা সবার ওপরে শ্রমের মর্যাদা দেয় এবং শ্রমিকদের প্রতি সুবিচারে আপসহীন। ইসলামের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত বিধিবিধান শ্রমিক ও শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণ করে এবং যারা তাদের প্রতি অন্যায় করে ও স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করে ইসলাম এ মহলের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায়। ইসলাম প্রত্যেক বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থান এবং সমাজের সকল কর্মক্ষম লোকের ভরণপোষণে সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেয়।
শ্রমিক সমাজে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি অনুকূল মনোভাব সৃষ্টিতে একটি নতুন উপাদান এখন কাজে লাগছে। সেটি হচ্ছে কমিউনিস্ট দর্শন ও পদ্ধতির পতন। এর ফলশ্রুতিতে পূর্ব ইউরোপের একনায়ক সরকারগুলোর বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে। শ্রমিক শ্রেণী তাদেরই স্বার্থ রক্ষার নামে প্রতিষ্ঠিত একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এমন কি সমাজতন্ত্রের সূতিকাগার সোভিয়েত ইউনিয়ন পেরেস্ত্রয়কা দর্শনের আলোকে সামাজিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছে। মার্ক্সবাদী ও সমাজতন্ত্রী সরকার যা শ্রমিকদের জন্য শ্রমিকের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, শ্রমিকদের কাঙ্ক্ষিত সুখশান্তি আনতে ব্যর্থ হয়েছে- যে সুখের আশায় মেহনতী মানুষ সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। এটি প্রমাণিত হয়ে গেছে যে কমিউনিস্ট শাসনের নিগড়ের চেয়ে মুক্ত সরকারের শাসনাধীনেই শ্রমিকরা অনেক ভালো থাকে।
এ বিষয়টি বিশদভাবে বোঝার জন্য পুনরেকত্রীকরণ-পূর্ব জার্মানীর দুই অংশ হচ্ছে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উভয় অংশে শ্রমিকরা কিভাবে জীবনযাপন করতো, কি রকম ছিল তাদের অনুভূতি? পূর্ব জার্মানীর মানুষ মনে করত তারা যেন এক বিশাল কারাগারে বাস করছে। তারা সামান্য সুযোগ পেলেই গণহারে পশ্চিম জার্মানীতে পালিয়ে যেতো। এর চাইতে ভালো প্রমাণ আর কি হতে পারে?
ব্যবসায়ী ও অর্থ লগ্নিকারী
যেসব ক্ষেত্রে ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব বিস্তার করতে হবে তার মধ্যে বণিক, ব্যবসায়ী এবং অর্থলগ্নিকারী গোষ্ঠীও গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্প্রদায়ের লোকজন অর্থ ও পুঁজি, লাভ ও লোকসান, একচেটিয়া কারবার ও প্রতিযোগিতার জগতে বাস করে। এ সম্প্রদায়ের মানুষ সাধারণত হালাল-হারামের বিধিনিষেধের কথা ভুলে যায়, আল্লাহর জিকির, সালাত ও জাকাত আদায়কে উপেক্ষা করে। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সা. বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে যে অশুভ ও ঝুঁকির দিক রয়েছে সে ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের দিকনির্দেশনা ও নসিহত দেয়ার ক্ষেত্রে সজাগ ছিলেন।
তিনি প্রতারণার বিরুদ্ধে তাদেরকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেনঃ যে প্রতারণা করে সে আমাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। একচেটিয়া কারবারের বিরুদ্ধে তিনি সতর্ক করে বলেছেনঃ যে পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করল সে অন্যায় করল অর্থাৎ সে পাপী। তিনি ব্যবসায়ীদের আল্লাহর নামে অতিরিক্ত কসম খাওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। যেসব ব্যবসায়ী সর্বশক্তিমান আল্লাহকে পণ্য বানায় তাদের সমালোচনা করে বলেছেন, তারা যেন আল্লাহর কসম না খেলে বেচাকেনা করতে পারে না। তিনি মিথ্যা শপথের বিরুদ্ধেও সতর্ক করে দিয়েছেন, যে শপথের কারণে হয়তো লেনদেন বাড়বে কিন্তু বিক্রেতা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। তিনি সুদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেনঃ যারা সুদ নেয়, যারা দেয়, যারা এর চুক্তিপত্র লেখে এবং যারা এর সাক্ষী হয়, আল্লাহ তাদের লা’নত দেন। তিনি যে পণ্য মজুদ নেই (গারার) তা বিক্রয়ের বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেছেন। কেননা পণ্য সম্পর্কে ক্রেতাকে অজ্ঞ রাখা হয় এবং যখন মাল হাজির করা হয় তখন অনিবার্যভাবেই বিবাদ সৃষ্টি হয়।
পবিত্র কোরআনে পরিমাণ ও ওজনে প্রতারণা করার বিরুদ্ধেও ভর্ৎসনা করে বলা হয়েছেঃ দুর্ভোগ রয়েছে মাপে ও ওজনে কম দাতাদের (যারা অন্যের অধিকার খর্ব করল), যখন তারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেয় তখন পুরোপুরি নেয়, আর যখন মেপে বা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে এবং মহান দিবসে, যেদিন সমস্ত মানুষ বিশ্ব জগতের প্রতিপালনের সামনে দণ্ডায়মান হবে (সূরা মুতাফ্ফিফীনঃ ১–৬)।
অন্য দিকে আল-কোরআন সে সব ব্যবসায়ীর প্রশংসা করেছে যারা আল্লাহর প্রতি তাদের কর্তব্য এবং ফরজসমূহ পালনে গাফেল নয়। পবিত্র কোরআনে নামাজ আদায়ে তাদের নিয়মিত মসজিদে যাতায়াতের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছেঃ (তারা রয়েছে) এমন সব গৃহে বা মসজিদে যা আল্লাহ পবিত্রতা ও মর্যাদায় উন্নীত করার জন্য আদেশ দিয়েছেন, এতে সকাল ও সন্ধ্যায় এমন সব লোক আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে থাকে যাদেরকে ক্রয় ও বিক্রয় গাফেল করে রাখতে পারে না আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং নামাজ আদায় করা ও যাকাত প্রদান থেকে, তারা সেদিনের ভয় করতে থাকে যেদিন বহু অন্তর ও চোখ উল্টে যাবে (সূরা নূরঃ ৩৬–৩৭)।
ব্যবসায়ী-বণিকরা জাতির সম্পদের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। তারা জনগণের কাছে পণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ভোগ্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। এভাবে তারা জাতীয় অর্থনীতি ও আর্থিক নীতির ওপরে প্রভাব খাটায়। সুতরাং ব্যবসায়ীদেরকে সতর্ক করতে হবে যা তাদের করা উচিত নয় তা যেন কখনোই না করে এবং তাদের সম্পদের যাকাত আদায় এবং যাকাত ছাড়াও অন্যান্য দান খয়রাত করে।
বণিক সম্প্রদায় ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের আওতায় পড়ে না এবং তারা কেবল দুনিয়াদারি নিয়ে ব্যস্ত, তাই তাদের মধ্যে কাজ করা নিরর্থক মনে করা উচিত নয়। তারাও অন্যান্যের মত মানুষ। উপদেশ ও হুঁশিয়ারী তাদেরকে নাড়া দেয়, বিচক্ষণ বচন, সহিষ্ণু ও সঠিক উপস্থাপনায় তারাও মুগ্ধ হতে পারে।
রাসূলুল্লাহ সা. এর দাওয়াতের প্রাথমিক দিনগুলোতে বহু ব্যবসায়ী আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা. এর ওপর ঈমান আনেন। এমন কি তাদের ব্যবসা ও পুঁজি ধ্বংস বা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও তারা তাওহীদের দাওয়াতে সাড়া দেন। দেখা যায় যারা একেবারে প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন আবু বকর রা., ওসমান রা. ও আব্দুর রহমান বিন আউফ রা.। তারা সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত লাভের আশায় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার জন্য তারা ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদ ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। তারা আল্লাহর জন্যই ভাগ্যের এ পরিবর্তন সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেন।
আমাদের এ যুগে, আমরা দেখছি বহু সৎ ব্যবসায়ীকে দুনিয়ার জীবনের চেয়ে পরকালের জীবনকে গুরুত্ব দিয়ে দ্বীনি কাজে স্বেচ্ছায় অর্থ ব্যয় করছেন। আল্লাহর রহমতের নিদর্শন হিসেবে প্রাপ্ত ধন সম্পদ তারা আঁকড়ে ধরে রাখেন না। কেননা তারা নিজেদের জান ও মাল ইসলামী দাওয়াহ ও আন্দোলনেরই সম্পদ বলে মনে করেন।
পাশ্চাত্যের খৃস্টান পুঁজিপতিরা তাদের ধর্ম প্রচারের জন্য সারা বিশ্বের খৃস্টান প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোটি কোটি ডলার প্রদান করছে। ইহুদী পুঁজিপতিদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। তাদের কৃপণতা ও অর্থপূজার স্বভাব সত্ত্বেও তারা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে ও পরে ইহুদী স্বার্থে অকাতরে অর্থ ব্যয় করে চলেছে। মুসলিম বিত্তশালীদেরকে তো কম করলে চলবে না। কারণ তারা জানেন, সম্পদের মালিক আল্লাহ। সুতরাং তাদেরকে আল্লাহর পথে এ ধন-সম্পদ ব্যয় করতে হবে। আর এ জন্য আল্লাহতায়ালা তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।
বৈষয়িক দান-খয়রাতের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের ওপর আলোকপাত করতে চাই। মুসলমানদের মধ্যে বহু ধনাঢ্য ব্যক্তি রয়েছেন যারা সৎ ও সত্যনিষ্ঠ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করতে আগ্রহী। তারা উদার হস্তে দান-খয়রাত করে থাকেন। কিন্তু তাদের জানা দরকার কিভাবে ও কোন পাত্রে তারা অর্থ ব্যয় করবেন।
এ অর্থ ব্যয়ের উপযুক্ত ক্ষেত্র হচ্ছে ইসলামী কাজকর্ম। তাই যারা দান-খয়রাতে সক্ষম তাদেরকে বুঝতে হবে অর্থ ব্যয় করা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে সঠিক পথে খরচ করা। এ প্রসঙ্গে অগ্রাধিকার অর্থাৎ এখন কোন খাতটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, পরবর্তী পর্যায়ে কোন ক্ষেত্রটি জরুরী- এভাবে অর্থ ব্যয়ের খাত ক্রমবিন্যাস করে নেয়া অত্যাবশ্যক। এটি সত্যিই দুঃখজনক যে অধিকাংশ ধনী মুসলমান বিশেষ করে যারা জনহিতকর কাজে অর্থ ব্যয় করেন তারা সাধারণত মসজিদ নির্মাণ কিংবা এ ধরণের দ্বীনি প্রতিষ্ঠানেই কেবল দান খয়রাতের ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখান। এ কারণে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ ও অভিযোগ রয়েছে।
আফ্রিকার ‘ইসলামিক দাওয়াহ অর্গানাইজেশন’ এ অভিযোগ উত্থাপন করেছে। ইন্দোনেশিয়ার ‘সুপ্রীম কাউন্সিল ফর ইসলামিক দাওয়াহ’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ড. মুহাম্মদদ নাসের এবং তাঁর সহযোগীরাও একই অভিযোগ করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, মার্ক্সবাদ ও অন্যান্য মতাদর্শের মোকাবিলায় যারা ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষার প্রচার প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের কাছ থেকেও একই ধরণের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
ইসলামী আন্দোলন ও দাওয়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও একনিষ্ঠ সমর্থকগণ একমত হয়েছেন যে কাজের এমন কোনো কোনো ক্ষেত্র রয়েছে যা মসজিদ নির্মাণের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন মানুষ তৈরী করা- যে মানুষ সভ্যতা নির্মাণ করে, দাওয়াতি কাজে সাফল্য বয়ে আনে, আশার দোলাচলে এগিয়ে যায়, মসজিদ নির্মাণ করে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ইসলামী আদলে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়।
ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমের বিস্তার এবং মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য ও যথাযথভাবে ইসলামের খেদমত করার অন্যতম পয়লা কর্মসূচি। আর এ পথে অর্থ ব্যয় অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য এবং মহতী কর্মের মাধ্যমে একজন মুসলমান নিঃসন্দেহে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। এ ধরণের কেন্দ্র মুসলিম তরুণদের কাছে খাঁটি ইসলামী আদর্শের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া এবং তাদের ধ্যান ধঅরণার পরিশুদ্ধি ও আচার-আচরণ সংস্কারে সহায়ক হবে। এ কেন্দ্র শিক্ষা শিবির, কর্মশালা, আলোচনা অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন উপায় ও কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে তরুণ মানসে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারবে।
ইসলামী আন্দোলনের উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সুদক্ষ, ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ শিক্ষিত মার্জিত কর্মীবাহিনী যাদের জীবিকার সঙ্গতি আছে তারা পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে যথাযথভঅবে তাদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে। এ কর্তব্যে অবহেলাকে তারা পাপ মনে করবে এবং এ মহৎ কর্ম সম্পাদন আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার এবং জনগণের প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। বস্তুত এ কর্মসূচির জন্য দরকার অর্থ ও সময়ের পাশাপাশি কর্মসূচির রূপায়ণে নিরন্তর প্রচেষ্টা।
মহিলাদের তৎপরতা
দাওয়াতী কাজের শুরু থেকেই ইসলামী আন্দোলন মহিলাদের দিকে মনোনিবেশ করেছে। ইমাম হাসান আল বান্না ‘আল আখাওয়াত আল মুসলিমাত’ নামে মহিলাদের একটি সংগঠন গঠন করেন এবং তাদেরকে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার ও এমন একদল মহিলা গড়ে তোলার দায়িত্ব অর্পণ করেন যারা জমিনে আল্লাহর দ্বনি কায়েমে নিয়োজিত ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রচেষ্টায় শরিক হয়ে তাদের সহযোগী হবে। এ সংগঠনের মহিলারা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের কারাবন্দী সদস্যদের পরিবারবর্গের দেখাশোনা এবং খাদ্য ও অর্থ সাহায্যের ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখেন যা উল্লেখ করার মত। গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের হাতে হয়রানির আশঙ্কা উপেক্ষা করেই তারা এ ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এমনি একজন হচ্ছেন জয়নাব আল গাজালী।
মহিলাদের মাঝে ইসলামী কাজের অভাব
কিন্তু আমাদেরকে স্বীকার করতেই হবে, মহিলাদের মধ্যে ইসলামী কাজ এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। যদিও মহিলাদের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও মাধ্যমিক ছাত্রীদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে গেছে।
আন্দোলন শুরুর পর ষাট সত্তর বছর পার হয়ে গেলেও তেমন কোনো মহিলা নেত্রী তৈরী হয়নি যারা এককভাবে দক্ষতার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও মার্ক্সবাদের মোকাবিলা করতে পারেন। মহিলাদের আন্দোলন পুরুষদের নিয়ন্ত্রণের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পুরুষরা কখনোই মহিলাদের গুণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ এবং তাদের নেতৃত্বের মেধা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ দেয়নি। এ সুযোগ পেলে পুরুষদের আধিপত্য ছাড়াই মহিলারা তাদের কাজের দায়িত্ব ভার গ্রহণের সামর্থ্য প্রমাণ করতে পারতো।
সফলতার শর্ত
আমার বিশ্বাস ইসলামী আন্দোলন যদি দাওয়াত, চিন্তাধারা, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে মহিলা ইসলামী নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারে তাহলে মহিলাদের ইসলামী কাজ সফল হবে।
এটি কোনো অসম্ভব বা কঠিন কাজ বলে আমি মনে করি না। প্রতিভাবান পুরুষদের মত প্রতিভাময়ী নারীও আছে। উৎকর্ষতা পুরুষদের একচেটিয়া নয়। পবিত্র কোরআন বিনা কারণে আমাদের সামনে এ কাহিনী বর্ণনা করেনি যেখানে একজন মহিলার বিচক্ষণ ও সাহসী নেতৃত্বে তার স্বজাতি সাফল্যের দ্বরপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। তিনি হচ্ছেন সাবা’র রাণী। রাণী ও হযরত সোলায়মান আ. কে নিয়ে এ কাহিনী সূরা নমলে বর্ণনা করা হয়েছে।
আমি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি লেখাপড়ায় মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অন্যান্য সহকর্মীদের মতও তাই। এটি বিশেষভাবে সত্য এ কারণে যে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে লেখাপড়ার সময় বেশি পায়। আর ছেলেরা অহেতুক কাজে ব্যস্ত।
কট্টর মনোভাবের বিস্তার
আমি অকপটে বলতে চাই, পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলামী আন্দোলনে একটি কট্টর মনোভাব বিরাজ করছে। এ ইস্যুতে এমন সব কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছে যা পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। ঠিক এ ধরণের ব্যবস্থা আমি বহু সম্মেলন ও সিম্পোজিয়ামে এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকাতেও লক্ষ্য করেছি। ১৯৭০ সালের মধ্যভাগে আমি একটানা কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মুসলিম স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলন যোগদান করি। নারী ও পুরুষ উভয়েই এখানে বক্তৃতা-বিতর্কে যোগদান করেন। প্রতিটি প্রধান ইসলামী ইস্যুর ওপর মন্তব্য, প্রশ্নোত্তর ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে তাত্ত্বিক, সামাজিক, শিক্ষা ও রাজনৈতিক ইস্যুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেসব অধিবেশন শুধু মহিলাদের জন্য নির্ধারিত ছিল তাতে কেবল নারী বিষয়ক প্রশ্ন নিয়েই আলোচনা করা হয়।
আশির দশকে আমি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে কয়েকটি সম্মেলনে যোগদান করে দেখতে পাই গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা-বিতর্কের মূল বিষয়বস্তুর অনেকাংশ থেকে মহিলাদের দূরে রাখা হয়। বেশ কয়েকজন মহিলা অভিযোগ করেন- ইসলামে মহিলাদের ভূমিকা, অধিকার, দায়িত্ব ও মর্যাদার ওপর কেন্দ্রীভূত বক্তৃতা শুনতে শুনতে তারা একঘেঁয়েমি অনুভব করছেন। এসব বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি তাদের ওপর এক ধরণের চাপিয়ে দেয়া শাস্তি বলে মনে হয়। আমি একাধিক সম্মেলনে এ দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচনা করে বলেছি, ইবাদত-বন্দেগী ও দ্বীনি এলেম অর্জনের ক্ষেত্রে সকলের শরিক হওয়াই নিয়ম। ইসলামে কখনোই এমন কোনো মসজিদ ছিল না যেটি কেবল মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত এবং যে মসজিদে পুরুষরা শরিক হয়নি। রাসূলুল্লাহ সা. যখন কোনো সমাবেশে নসিহত করতেন সেখানে মহিলারাও হাজির থাকতেন। তারা জুমা, দুই ঈদ ও অন্যান্য নামাজের জামায়াতে পুরুষদের সঙ্গে শরিক হতেন কিংবা অন্তত হাজির থাকতেন। মহিলারা তাদের একান্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন করতেন। তারা স্বভাবসুলভ লজ্জার অজুহাতে ধর্মীয় বিধিবিধান জানা থেকে বিরত থাকতেন না। হযরত আয়েশা রা. স্বয়ং একথা বলেছেন।
হাদিস গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ সা. কে মহিলাদের প্রশ্ন করার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর মধ্যে এমন সব প্রশ্ন রয়েছে যেগুলো মহিলারা কেবল নারী সংক্রান্ত বিষয়েই করেছেন আবার সকল মহিলার পক্ষে কিছু সংখ্যক মহিলাও প্রশ্ন করেছেন। যেমন একজন মহিলা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা. আমাকে মহিলারা আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
মহিলারা রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে তাদের জন্য আলাদা দিন ও সময় বরাদ্দ করারও অনুরোধ জানিয়েছেন, যাতে পুরুষদের উপস্থিতি ছাড়াই তারা একান্তে যে কোনো বিষয় নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে পারেন। এমনি করে পুরুষদের সঙ্গে একত্রে সাধারণভাবে শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি মহিলাদেরকে আরো একটি বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
কার্যক্রমে সমস্যা
মহিলাদের ইসলামী কার্যক্রমে সমস্যা হচ্ছে পুরুষরা এর নেতৃত্ব দেয়, মহিলারা নয়। আর পুরুষরা এক্ষেত্রে কর্তৃত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে তৎপর। কেননা তারা নারী নেতৃত্বের উত্থান দেখতে চায় না। মহিলাদের ইসলামী কাজে পুরুষরা নিজেদের কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয়, এমনকি মহিলাদের সভা সমাবেশেও। তারা নারীদের লাজুকতার সুযোগ নিয়ে কখনোই তাদের কাজকর্মে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণের সুযোগ দেয় না। ফলে ইসলামী আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় নারীর মেধা ও যোগ্যতা প্রমাণের কিংবা তাদের অভিজ্ঞতা ও সাধনা পরিপূর্ণ হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। জ্ঞান তিতিক্ষা ও এর মাধ্যমে জীবনের বিস্তৃত শিক্ষাঙ্গণ থেকে কিছু শেখারও সুযোগ তারা পায় না।
অবশ্য আমাদের মুসলিম বোনেরাও একেবারে দোষমুক্ত নন। তারাও তাদের পছন্দ-অপছন্দ পুরুষদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আরাম আয়েশে পরিতৃপ্ত হয়ে এ দুঃখজনক অবস্থার কাছে নতি স্বীকার করেছে। প্রচেষ্টার দরজা উন্মুক্ত ও দাওয়াতী কাজের সম্প্রসারণের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময় এবং স্ব-ঘোষিত সে সব নারী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার যারা মুসলিম উম্মাহর নীতি, আদর্শ, বিধিবিধান ও মূল্যবোধের কুশলী বলে দাবী করেছে। এসব কণ্ঠ যত উচ্চই হোক, কেবল পরাজিত পদদলিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। দ্বীন ও দুনিয়ার কোনো ক্ষেত্রেই এদের কোনো মূল্য নেই।
আমি ১৯৮৯ সালে আলজেরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। বক্তৃতার পর প্রথানুযায়ী আমি ছাত্রীদের লিখিত ও মৌখিক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। কয়েক জন তরুণও সেখানে উপস্থিত ছিল। একজন যুবক স্বউদ্যোগে প্রশ্নগুলো যোগাড় করে কোনটির জবাব দেয়া হবে আর কোনটি বাদ দেয়া হবে নিজেই বাছাই করে আমার কাছে পৌঁছে দিচ্ছিল। আমি এ ভূমিকাতে আপত্তি করে বললাম, কেন একটি ছাত্রী তার সহপাঠিনীদের পক্ষ থেকে এ কাজটি করছে না?
আমি বললাম, তোমরা ছেলেরা কেন মেয়েদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ? তোমরা হাত গুটিয়ে নাও। তাদেরকে তাদের মত করে কাজটি করতে দাও। তারাই প্রশ্নগুলো বাছাই করে কোনটির উত্তর দিতে হবে সিদ্ধান্ত নিক এবং তাদের মধ্য থেকেই একজন উচ্চস্বরে প্রশ্নগুলো পড়ে শোনাক।
আমি যেন মেয়েগুলোর মন থেকে একটি বিরাট বোঝা নামিয়ে দিলাম। একটি ছাত্রী দ্রুত এগিয়ে এসে সেই ভূমিকা পালন করল যা এতক্ষণ আমাকে সাথে করে নিয়ে আসা যুবকটি করছিল।
১৯৯০ সালের শীতকালে বৃটেনের ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত এক মুসলিম ছাত্র কনভেনশনে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে মুসলিম মহিলাদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তৃতা দেয়ার পর প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল। সেখানেও একজন উৎসাহী তরুণ প্রশ্ন সংগ্রহ ও বাছাই করার দায়িত্ব নিল। আমি তাকে স্পষ্টভাবে বললাম, তোমার এখানে থাকার কোনো কারণ নেই। মেয়েদের মধ্য থেকে একজন এ কাজটি করলেই হবে। কেননা, মেয়েদের নিজস্ব কাজকর্ম নিজেরাই চালিয়ে নেয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু উক্ত সজ্জন তরুণ আমাকে বললেন, এখানকার নিয়মানুযায়ী তাকেই এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাই সে এটি বন্ধ করতে পারে না। সে তার মতো ব্যাখ্যা দিল, আর আমাকে তা মেনে নিতে হলো।
মিসর ও আলজেরিয়ার বোনেরা আরেকটি অভিযোগ করে থাকেন। ইসলামী আন্দোলনের কোনো সক্রিয়া মহিলা কর্মী আন্দোলনের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে আন্দোলনের কোনো সক্রিয় পুরুষ কর্মীকে বিয়ে করার পর দেখা যায় তিনি মহিলাটিকে আন্দোলনে অংশ গ্রহণে শুধু বারণই করেন না, তাকে ঘরে থাকতে বাধ্য করেন। এভাবে তিনি একটি মশাল নিভিয়ে দেন যা এক সময় অপর মুসলিম নারীকে আলোর পথ দেখাচ্ছিল।
এগুলো এমন সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে যে ইসলামী আন্দোলনে কর্মরত একটি আলজেরীয় মেয়ে একবার আমাকে চিঠি লিখে জানতে চাইল এমনি পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য বিয়ে করতে অস্বীকার করা তার জন্যে হারাম কিনা। কারণ অনেক বোনকে দেখা গেছে, তারা আন্দোলন ও দাওয়াতি কাজ থেকে দূরে সরে গিয়ে অলস জীবন কাটানোর পথ বেছে নিয়েছে এমন এক সময়ে যখন কমিউনিস্ট, সেক্যুলার ও উদারপন্থী মহিলারা তাদের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে।
আপত্তি ও খণ্ডন
কট্টপন্থীরা প্রশ্ন করতে পারেন, আমরা কিভাবে মুসলিম মহিলাদের ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং ইসলামী কাজকর্মে তাদের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য নেত্রীত্বের দায়িত্ব অর্পণ করতে পারি- যখন পবিত্র কোরআনে তাদেরকে ঘরবাড়ির মধ্যে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ এবং তোমরা নিজেদের গৃহে অবস্থান করো এবং নিজেদেরকে অজ্ঞতা-যুগের মতো প্রদর্শন করো না (সূরা আহ্যাবঃ ৩৩)।
এ ধরণের অতি উৎসাহী ভাইদের প্রশ্নের জবাবে বলতে চাই, এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সা. এর সহধর্মিনীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, তাঁদের একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে যা অন্য মহিলাদের নেই। তাঁদের জন্যে এমন বিধিনিষেধ ছিল যা অন্য মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা কোরআন শরীফে তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ হে নবীর সহধর্মিনীগণ! আপনারা সাধারণ মহিলাদের মতো নন (সূরা আহ্যাবঃ ৩২)।
তাই বলে এ আয়াত হযরত আয়েশা রা. কে উটের যুদ্ধে গমন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তাঁর ধারণানুযায়ী রাজনীতিতে সততার দাবি পূরণেই তিনি এ যুদ্ধে যান। রাসূলুল্লাহ সা. এর দু’জন প্রবীণ সাহাবি তাঁকে সমর্থন দান করেন। এ দু’জন সাহাবি খেলাফতের জন্যে মনোনীত হয়েছিলেন এবং বেহেশতে প্রবেশের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে, পরবর্তীকালে এ পরিস্থিতির জন্যে হযরত আয়েশা রা. এর দুঃখ প্রকাশ এ জন্যে নয় যে তাঁর ঘরের বাইরে যাওয়া অবৈধ ছিল, বরং এ কারণে যে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক ছিল না। আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর রূহের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
কিন্তু যারা দাবি করেন, সকল মহিলাই এ আয়াতের লক্ষ্য, তাদের মত পরীক্ষা করলে আমরা দেখি, এর অর্থ মহিলাদের ঘরের মধ্যে থাকা এবং তাদেরকে বাইরে বের হতে বারণ করা নয়। কেননা কোরআন এভাবে ঘরের মধ্যে থাকার বিধান সে সব মহিলাদের জন্য শাস্তি স্বরূপ দিয়েছে যাদের ব্যভিচার চারজন সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। এ নিয়ম চালু ছিল কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত কঠোর শাস্তির বিধান ‘হদ’ (ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট) প্রবর্তনের আগে। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা বলেনঃ এবং তোমাদের যে সব স্ত্রীলোক ব্যভিচার করে ঐ স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চারজন সাক্ষী করে নাও। অতঃপর তারা যদি সাক্ষ্য প্রদান করে, তবে তাদেরকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখো যতক্ষণ না তাদের মৃত্যু আসে অথবা আল্লাহতায়ালা তাদের জন্যে অন্য কোনো পথ নির্ধারণ না করেন (সূরা আন নিসাঃ ১৫)।
এছাড়াও আল্লাহর আদেশঃ এবং নিজেদেরকে অজ্ঞতা-যুগের মতো প্রদর্শন করো না (আহ্যাবঃ ৩৩)। এখানে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, চাকচিক্যময় প্রদর্শনী না করে শালীন পোশাকে সজ্জিত হয়ে মহিলাদের বাইরে যাওয়া বৈধ। ঘরের মধ্যে কোনো মহিলার সাজসজ্জা করা নিষিদ্ধ নয়, কারণ ঘরের মধ্যে তার ইচ্ছামতো সুন্দর করে সাজসজ্জা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কেবল ঘরের বাইরে রাস্তাঘাটে, বাজারে অন্য কোথাও যাওয়ার সময় চাকচিক্যময় সাজসজ্জা গ্রহণ থেকে তাকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।