দ্বিতীয়অধ্যায়
ইসলামী আন্দোলনঃ বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে
বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে
বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রই প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। কারণ ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াত প্রসারের এটিই হচ্ছে ভিত্তি। বস্তুত বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটই প্রধান সমস্যা। অনেক লোকের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে যেমন পরিষ্কার ধারণার অভাব রয়েছেন, তেমনি ইসলামের শিক্ষা ও এসব শিক্ষার পর্যায়ক্রমিক গুরুত্ব অর্থাৎ কোনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি সাধারণ গুরুত্বের এবং কোনটি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয় এসব ব্যাপারে জ্ঞানের গুরুতর অভাব রয়েছে।
আমরা বর্তমানে যে যুগে বাস করছি তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা সম্পর্কেও জ্ঞানের গুরুতর অভাব দেখা যায়। অন্যদের সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এমন যে হয় তাদেরকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেই নয় তো খাটো করে দেখি। অথচ অন্যেরা আমাদের সব ধরণের খবর রাখে এবং তারা আমাদের বিষয়ে গভীরভাবে অবহিত।
এমনকি নিজেদের সম্পর্কেও আমাদের অজ্ঞতা রয়েছে। আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের শক্তি ও দুর্বলতার দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখিনি। বরং প্রায়শই ক্ষুদ্র বিষয়কে বড় করে দেখি অথবা চায়ের কাপে ঝড় তুলি। আমাদের শক্তি সামর্থ্য অথবা দোষ ত্রুটি যে দিকেই দেখি না কেন, উভয়ক্ষেত্রে একই অবস্থা। এ অজ্ঞতা কেবল সাধারণ মুসলমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের স্বার্থ এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব যাদের উপর নির্ভর করে সেই অগ্রণী দল, যাদের মৌলিক কাজের ওপর ইসলামী আন্দোলন গড়ে উঠবে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উভয়ের ক্ষেত্রে এ অজ্ঞতা প্রকট।
নতুন ফিকাহ
বস্তুত আমাদের দরকার এক নতুন ফিকাহ যাতে করে আমরা আল্লাহ যাদেরকে সমঝদার লোক বলে বর্ণনা করেছেন তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করতে পারি। এখানে ফিকাহ বলতে ইসলামী পরিভাষায় ব্যবহৃত ফিকাহ বোঝানো হয়নি। অর্থাৎ সেই আইনশাস্ত্র যা অজু, পাক-পবিত্র, ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, বিবাহ, তালাক, শিশু লালন-পালনের শর্তাবলীর মতো বিস্তারিত বিশেষ বিধিবিধান নির্ণয় করে। এসব বিধিবিধান যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, আমরা এখানে তা বোঝাতে চাই না। কোরআন ও হাদিসেও ফিকাহ শব্দটি এ প্রসঙ্গে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে আমরা সে অর্থেও বোঝাতে চাই না। যেহেতু, এটি এমন সব শব্দ ও ভাবের মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন ইমাম গাজ্জালীও তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘এহিয়া উলমুদ্দীন’-এর জ্ঞান অধ্যায়ে এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
আল-কোরআনের মক্কী সূরাগুলোকে শরীয়াহর আওতায় আদেশ নিষেধের বিস্তারিত বিধান এমন কি সকল ফরজ, হুদুদ (দণ্ডবিধি) ও বিচারের আইন প্রবর্তনের পূর্বেই মূল শব্দ ফিকাহর উল্লেখ দেখা যায়।
মক্কায় অবতীর্ণ সূরা আল আন’আমের ৬৫ নং আয়াতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলছেনঃ বলুন তিনি এতই শক্তিমান যে তোমাদের উপর আযাব প্রেরণ করতে আসমান এবং যমীন থেকে কিংবা তোমাদেরকে দলে উপদলে বিভক্ত করে দ্বিধায় ফেলতে। এবং তোমাদের এককে অপরের উপর আক্রমণের স্বাদ গ্রহণ করান; লক্ষ্য কর! আমরা কিরূপে প্রমাণসমূহকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করছি, যাতে তারা বুঝতে পারে।
একই সূরার ৯৮ নং আয়াতে আরো উল্লেখ রয়েছেঃ আর তিনি এমন যে যিনি তোমাদেরকে এক সত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন; থাকার জন্য দিয়েছেন একটি স্থান (পৃথিবীতে বা মাতৃগর্ভে) আর একটি হচ্ছে গচ্ছিত স্থান। নিশ্চয়ই আমরা প্রমাণসমূহের বিশদরূপে বর্ণনা করেছি ঐ সকল লোকের জন্যে যারা উপলব্ধি করে।
এ দু’টি আয়াতে ফিকাহ শব্দের অর্থ হলো আত্মা, অন্তর ও অভিজ্ঞতার আলোকে আল্লাহর অপরিবর্তনীয় বিধান, তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর নির্ধারিত সঠিক পথ থেকে যারা সরে যায় তাদের জন্যে তাঁর শাস্তি গভীরভাবে উপলব্ধি করা।
মক্কী সূরা আল আ’রাফের ১৭৯ নং আয়াতে যে সব লোক জাহান্নামে যাবে বলে মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন তাদের সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি তাদের সম্পর্কে বলছেনঃ তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। এরপর এদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ এ সকল লোক চতুষ্পদ জন্তুর মতো বরং এরা তার চেয়েও বেশি পথভ্রষ্ট। এসব লোক হচ্ছে গাফেল।
বিভিন্ন সূরায় কোরআনের প্রতি বহু ঈশ্বরবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলছেনঃ আর আমরা তাদের অন্তরের উপর আবরণ রেখে দিয়েছি, যাতে তারা কোরআনকে না বোঝে এবং তাদের কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছি (আল আন’আমঃ ২৫, বানী ঈসরায়ীলঃ ৪৬, আল কাহ্ফঃ ৫৭)।
আল-কোরআনের বেশ কয়েকটি মাদানী সূরায় ফিকাহ শব্দটি বহু ঈশ্বরবাদী ও মুনাফিকদের বোধশক্তি না থাকার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা আল আন্ফালের ৬৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের সম্বোধন করে বলছেনঃ তোমাদের মধ্যে যদি বিশ জন দৃঢ়তাসম্পন্ন ব্যক্তি থাকে, তবে তাঁরা দুইশ’র উপরে জয়লাভ করবে, আর তোমাদের মধ্যে যদি একশ ব্যক্তি থাকে, তবে এক হাজার অবিশ্বাসীর উপর জয়লাভ করবে, এ কারণে যে তারা এমন লোক যারা বোঝে না।
এখানে অবিশ্বাসীদের জ্ঞান না থাকার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেয়ার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অপরিবর্তনীয় বিধিবিধান এবং পালাক্রমে সকল লোককে কিভাবে তিনি বিভিন্ন রহম সৌভাগ্যের দিন প্রদান করেন সে সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে।
সূরা তাওবার ৮৭ নং আয়াতে আল্লাহ মুনাফিকদের নিন্দা করে বলেছেনঃ এরা অন্তঃপুরবাসিনী মহিলাদের সাথে থাকতে তৃপ্তিবোধ করল এবং তাদের অন্তরের ওপর মোহর লাগানো হলো, যাতে তারা উপলব্ধি না করে।
এখানে উপলব্ধি অর্থ হচ্ছে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা এবং দ্বীন রক্ষার উপলব্ধির অর্থ হচ্ছে জীবন, ইজ্জত সম্পত্তি ও সামগ্রিক অর্থে সমাজকে রক্ষার জন্যে সচেষ্ট থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা। এসব কাজ যে কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ- তা যতোই জরুরী হোক তার চেয়েও অগ্রাধিকার পাবে।
একই সূরার ১২৭ নং আয়াতে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা (যাদের বোধশক্তির অভাব রয়েছে) এ ধরণের লোকদের সম্পর্কে বলছেনঃ আর যখন কোনো সূরা নাজিল করা হয়, তখন তারা একে অপরের দিকে তাকাতে থাকে; (এবং বলে যে) তোমাদেরকে কি কেউ দেখে না? অতঃপর তারা সরে পড়ে। আল্লাহ তাদের অন্তরগুলোকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, কারণ তারা হচ্ছে নির্বোধ সমাজ মাত্র।
এসব নির্বোধ লোক ভুলে যায় যে কোনো মানুষ তাদেরকে দেখার আগেই আল্লাহ তাদেরকে দেখতে পান। আসলেই তারা তাদের ফিকাহ এবং বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
সূরা আল হাশরের ১৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমানদারদেরকে লক্ষ্য করে মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেছেনঃ নিশ্চয় তাদের অন্তরে আল্লাহর অপেক্ষা তোমাদের ভয় অধিক; এটি এ কারণে যে তারা বুঝতে পারে না।
সূরা আল মুনাফিকুনের ৩ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেনঃ এটি এ কারণে যে তারা ঈমান এনেছে, অতঃপর কাফের হয়েছে। তাই তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে, অতএব তারা বুঝতে পারছে না।
একই সূরার ৭ নং আয়াতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরো বলেনঃ তারাই বলে, আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে যারা রয়েছে তাদের জন্যে কিছুই ব্যয় করো না, যতক্ষণ না তারা তাকে পরিত্যাগ করে। অথচ আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদরাজি আল্লাহরই অধিকারে আছে, কিন্তু মুনাফিকরা বোঝে না।
এতে দেখা যায়, ‘সে সব লোক যারা বোঝে না’- এ মুনাফিকদের সম্পর্কেই কোরআনের একটি বিরাট অংশ জুড়ে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, মুনাফিকদের ধারণা তারা বুদ্ধিমান। তাই তারা পক্ষাবলম্বন না করে সুবিধাবাদী অবস্থান নেয়, দ্বিমুখী নীতি নিয়ে আল্লাহ ও ঈমানদারদের ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে। বিশ্বাসীদের সঙ্গে মিলিত হলে তারা বলে, আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন তাদের দুষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে একত্রিত হয় তখন তারা বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি।
কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ বহু আয়াতে তাদের রহস্য, দ্বিধা এবং ধোঁকাবাজি প্রকাশ করে দিয়েছেন। সূরা আল বাকারার ৯ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেনঃ তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে বলে মনে করে, বস্তুত তারা নিজেদের সাথেই ধোঁকাবাজি করে এবং তারা তা অনুধাবন করতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও মানুষের সামনে তাদের মুনাফিকী ধরা পড়েছে। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনকে তারা হারিয়েছে এবং নিশ্চিতই তারা দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে নিক্ষিপ্ত হবে। এর চেয়ে মর্মান্তিক পরিণতি আর কী হতে পারে?
সুতরাং, এ বর্ণনা অনুযায়ী কারো মধ্যে মুনাফিকীর লক্ষণ পরিলক্ষিত হলে নিঃসন্দেহে বুঝতে হবে তার মধ্যে ন্যূনতম পরিমাণ বোধশক্তি নেই।
উপসংহার
আল-কোরআনের বাচনভঙ্গি অনুযায়ী ফিকাহ শব্দটি আজকের ভাষায় আইনশাস্ত্রের পারিভাষিক অর্থ বোঝায় না। বরং আল্লাহর কালাম এবং সৃষ্টি জগত, জীবন ও সমাজ সম্পর্কিত তাঁর বিধিবিধান উপলব্ধি ও জ্ঞান আহরণ বোঝায়।
এমন কি সূরা তাওবার ১২২ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ তাদের প্রত্যেক দলের মধ্যে হতে একটি করে অংশ যেন জিহাদে যায়। যাতে অবশিষ্ট লোক দ্বীনি জ্ঞান-গবেষণায় আত্মনিয়োগ করতে পারে এবং জিহাদে যোগদানকারীরা নিজ কওমে ফিরে এলে যাতে তারা অসৎ কাজ সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে।
এ আয়াতের ফিকাহ শব্দটি প্রচলিত অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। আইনশাস্ত্র সম্পর্কিত এরূপ অর্থ করলে তাতে সেই হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হবে না যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অর্থের হেরফের করা অথবা নিজেকে রক্ষা এবং দাওয়াতি কাজের প্রাথমিক দায়িত্ব পালনে গাফিলতির ব্যাপারে সতর্ক হয়।
আল-কোরআনের উপরোক্ত আয়াতে ‘ফিকাহ’ শব্দের যে ব্যবহার এবং রাসূলুল্লাহ সা. এর একটি হাদিসেও এর ব্যবহারের মধ্যে সাযুজ্য রয়েছে। হাদিসটি হচ্ছেঃ আল্লাহ যদি কোনো ব্যক্তির কল্যাণ করতে চান তবে তিনি তাকে দ্বীনি এলমে পারদর্শী করেন। অর্থাৎ আল্লাহ তার দৃষ্টিকে আলোকিত করবেন যাতে করে সে কেবল শব্দাবলী আর ভাসাভাসা অর্থ নিয়ে আত্মতৃপ্তির পরিবর্তে দ্বীনের সত্যতা, গূঢ়তত্ত্ব ও লক্ষ্য আরো ভালোভাবে অনুধাবনের জন্যে গভীর সাধনা চালাতে পারে।
যে ফিকাহ প্রয়োজন
আমাদের কোন কোন ধরণের ফিকাহ প্রয়োজন, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি আমার ‘ইসলামিক এয়োকেনিং বিটুইন রিজেকশন এন্ড এক্সট্রিমিজম’ বইয়ে আলোচিত হয়েছে। তাতে আমলের ফিকাহ এবং কর্মের ক্রমবিন্যাসের ফিকাহ প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে।
বক্তব্যের আরেকটি অংশ আমার ‘ইসলামিক এয়োকেনিং বিটুইন পারমিটেড ডিফারেন্সেস এন্ড ব্লেমওয়ার্দি ডিজইউনিটি’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে আমাদের অন্যতম প্রধান প্রয়োজনীয় ‘মতানৈক্যের ফিকাহ’ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয় যে আমাদের পাঁচ ধরণের ফিকাহ দরকার। এখানে এর মধ্যে মাত্র দু’টি ফিকাহর ওপর আলোচনা করা হয়েছেঃ
১. ভারসাম্যের ফিকাহ (ফিকহ উল মুয়াজানাত)
২. অগ্রাধিকারের ফিকাহ (ফিকহ উল আওলাইয়াত)
এ ধরণের ফিকাহর প্রত্যেকটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
ভারসাম্যের ফিকাহ
ভারসাম্যের ফিকাহ বলতে আমরা কয়েকটি বিষয় বুঝিঃ
১. আকার ও সামর্থ্য, মূল্য ও ফলাফল এবং সহনক্ষমতার আলোকে কোনটির চেয়ে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে ভারসাম্য রক্ষা করা, যাতে কোনটির উপর অগ্রাধিকার দেয়া যায় এবং কোনটি স্থগিত রাখা যায় তা নির্ণয় করা যায়।
২. ভালো বিষয়গুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার মতো মন্দ বিষয়গুলোর মধ্যেও ভারসাম্য রক্ষা করা, যেন কোনটি গ্রহণ এবং কোনটি পরিহার করতে হবে তা নির্ধারণ করা যায়।
৩. ভালো ও মন্দ বিষয়গুলো যদি সাংঘর্ষিক হয়, তবে ভালো লাভের চাইতে মন্দ বিষয় পরিহারের উপর অগ্রাধিকার দেয়া এবং ভালো লাভের স্বার্থে কোন কোন ক্ষেত্রে মন্দকে কখন উপেক্ষা করা যায় তা স্থির করা।
দু’ধরণের ফিকাহ
এ প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রয়োজন দু’পর্যায়ের ফিকাহঃ
শরীয়াহর ফিকাহ
প্রথম হচ্ছে শরীয়াহর ফিকাহ। শরীয়াহর প্রকৃত মর্ম গভীরভাবে অনুধাবনই হবে এর ভিত্তি। এর লক্ষ্য হচ্ছে উপরোক্ত ‘ভারসাম্য নীতিমালার’ অকাট্যতা প্রতিপন্ন করে এর প্রামানিকতা নির্ণয় করা। এটি তাদের কাছে স্পষ্ট হতে হবে যারা শরীয়াহর মূল উৎস ও হুকুম-আহকাম অনুধাবন এবং এগুলোর গুঢ় তত্ত্ব উদঘাটনে সচেষ্ট।
শরীয়াহ কেবল মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণে কয়েক ধরণের সহজাত চাহিদাকে সামনে রেখেই পাঠানো হয়েছে। এর কল্যাণকর পর্যায়গুলো হচ্ছেঃ অপরিহার্য (আল দুরুবিয়াহ), প্রয়োজনীয় (আল হাজিয়াহ) ও সৌন্দর্যবোধক (আল তাহসিনিয়াহ)।
বাস্তবতার ফিকাহ
দ্বিতীয় পর্যায়ের এ ফিকাহ আসলে ইতিবাচক যার ভিত্তি হচ্ছে সমকালীন বাস্তবতা নিয়ে গবেষনা। অত্যন্ত সঠিক তথ্য উপাত্ত নির্ভর গবেষণা সতর্কতার সঙ্গে ব্যাপক ক্ষেত্রে চালাতে হবে। এ ব্যাপারে প্রচারমূলক উপাত্ত ও প্রশ্নমালা ভিত্তিক বিভ্রান্তিকর ও অবাস্তব তর্থ পরিসংখ্যানের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এসবের পেছনে একটি মতলব কাজ করে। এতে সামগ্রিকভাবে সত্য প্রকাশের উদ্দেশ্য থাকে না।
ফিকাহর সমন্বয়
শরীয়াহর ফিকাহ ও বাস্তবতায় ফিকাহ উভয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার। যাতে করে আমরা যথাযথ তাত্ত্বিক ভারসাম্যকরণ প্রক্রিয়ায় পৌঁছতে পারি, যা একই সাথে উগ্রতা ও ঔদাসীন্য মুক্ত হবে। নীতিগতভাবে এখানে শরীয়াহর ফিকাহ’র বিষয়টি স্পষ্ট। এ বিষয়ে উসূল আল ফিকাহ গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘আল-মুসতাসফা’ (ইমাম গাজ্জালী) থেকে শুরু করে ‘আল-মুয়াফাকাত’ (ইমাম আল শাতিবি) পর্যন্ত এবং নিয়মবিধি, সাদৃশ্য ও ভিন্নতা সংক্রান্ত বই-পুস্তকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
যখন নানামুখী স্বার্থের সংঘাত হয়, তখন উচ্চতর স্বার্থে নিম্নতর স্বার্থ এবং সাধারণের স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থের মালিককে তার ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া উচিত। পরস্পর বিরোধী স্বার্থের ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদীর স্থলে দীর্ঘ মেয়াদী অথবা স্থায়ী স্বার্থ, তুচ্ছ স্বার্থের স্থলে প্রকৃত স্বার্থ এবং অনিশ্চিত স্বার্থের পরিবর্তে সুনিশ্চিত স্বার্থের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া আবশ্যক।
আমরা দেখেছি রাসূলুল্লাহ সা. হুদায়বিয়ার সন্ধিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত, মৌলিক ও ভবিষ্যত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যা অন্য কেউ হলে কখনোই ছাড় দিতে চাইতো না। তিনি এমন শর্ত মেনে নিয়েছিলেন যা প্রথম নজরেই মুসলমানদের জন্যে অন্যায্য ও অবমাননাকর মনে হয়েছিল। তিনি ‘পরম করুণাময় আল্লাহর নামে’ বাক্যটি তুলে ফেলতে সম্মত হয়েছিলেন। সে স্থলে লেখা হয়েছিল ‘হে প্রভু আপনার নামে’। তিনি চুক্তিতে ‘আল্লাহর রাসূল’ কথাটি উল্লেখ না করে কেবল তার নাম ‘মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ’ লিখতেও রাজী হন। এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে।
ক্ষতিকর বিষয়গুলো পরস্পর বিরোধী হলে এবং এগুলোর মধ্যে কোনোটি যদি অপরিহার্য হয় তবে দু’টি মন্দের কম মন্দটি এবং অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর মন্দ বিষয়টি বেছে নেয়া উচিত। মুসলিম মনীষীরা ক্ষতিকর বিষয় যথাসম্ভব নির্মূল করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে কোনো বড় ধরণের ক্ষতিকর বিষয়ের স্থলে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর বিষয় নির্মুল করা উচিত নয়। একটি ছোট ক্ষতি সহ্য করা উচিত যদি তাতে একটি বড় ক্ষতি পরিহার করা সম্ভব হয়। আবার সাধারণের ক্ষতি এড়ানোর স্বার্থে ব্যক্তির ক্ষতি স্বীকার করে নেয়া উচিত। এর বহু উদাহরণ ‘আল কাওয়ায়িদুল ফিখিয়া’ ও ‘আল আসবাহ্ ওয়ান নাজায়ের’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।
যদি লাভ ও ক্ষতির সংঘাত দেখা দেয় তবে আকার, ফলাফল ও মেয়াদের নিরিখে তার বিচার করতে হবে। একটি বৃহত্তর স্বার্থ অর্জনের লক্ষ্যে সামান্য ক্ষতি উপেক্ষা করা যায়। দীর্ঘমেয়াদী অথবা স্থায়ী স্বার্থের জন্যে কোনো সাময়িক ক্ষতি মেনে নেয়া উচিত। এমন কি কোনো বড় ক্ষতিকেও মেনে নেয়া যায় যদি এর চেয়েও বড় ক্ষতি নির্মূলের সম্ভাবনা থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় স্বার্থ আদায়ের আগেই ক্ষতিকর বিষয় এড়ানোর চেষ্টা করা উচিত।
এ ভাবধারা কেবল তত্ত্ব হিসেবে মনে করা উচিত নয়, বরং এগুলো আমাদেরকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। কারণ, সক্রিয় ইসলামী গ্রুপগুলোর মধ্যে এসব ভারসাম্যকে ঘিরেই নানা মতপার্থক্য বিদ্যমান।
বৈরী শক্তির সাথে জোট বাধা
যেসব সরকার ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ত নয় তাদের সঙ্গে সমঝোতা বা সন্ধি স্থাপন কি মেনে নেয়া যায়?
যে ক্ষমতাসীন সরকার বিশুদ্ধ ইসলামী চরিত্রের সরকার নয়, ত্রুটিপূর্ণ সংবিধান দ্বারা পরিচালিত অথবা যার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন নেই- সেই সরকারে অংশগ্রহণ করা কি উচিত?
একটি ধর্মবিরোধী, স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী অসৎ সরকারকে হটানোর জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত বিরোধী ফ্রন্টে আমাদের যোগদান করা কি উচিত?
সুদভিত্তিক মানব রচিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাবাধীন পরিবেশে আমরা কি ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারি?
সাধারণভাবে মুসলমানদেরকে সুদভিত্তিক ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে দেয়া অথবা ইসলামের শিক্ষা অনুসরণকারী দ্বীনদার লোকদেরকে এ ধরণের প্রতিষ্ঠানে কাজ করা থেকে বিরত রাখা কি উচিত?
বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
নীতিমালা প্রণয়ন করা সহজ, কিন্তু এগুলো মেনে চলা কঠিন। সাধারণ মানুষ এবং যারা সামান্য কারণে শোরগোল করেন তাদের পক্ষে ভারসাম্যের ফিকাহ অনুধাবন করা সহজ নয়।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এবং তার দল জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ষাটের দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের স্থলে ফাতেমা জিন্নাহকে নির্বাচনে সমর্থন করা ভারসাম্যের ফিকাহর আলোকে কম ক্ষতিকর বলে মত প্রদান করায় তিনি ও তাঁর অনুসারীরা তীব্র প্রতিরোধ ও হয়রানির সম্মুখীন হয়েছিলেন। একটি জাতি কোনো মহিলাকে তাদের নেতা নিযুক্ত করলে কখনোই উন্নতি করতে পারবে না- এ হাদিসকে ভিত্তি করে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক প্রচারণা চালানো হয়। তাহলে সেই জাতির কী হবে যারা কোনো স্বৈরশাসককে তাদের নেতা হিসেবে বরণ করে নেয়? তারা কী কাজটা খুব ভালো করবে? কখনোই না। এখানেই ভারসাম্যের ফিকাহর কাজ হচ্ছে দু’টি অনিষ্টের মধ্যে কম অনিষ্টকে বেছে নিয়ে বৃহত্তর ক্ষতি পরিহার করা।
সুদানের ইসলামী আন্দোলনের নেতা ড. হাসান আল তুরাবী এবং তার সহযোগীবৃন্দ সোস্যালিস্ট ইউনিয়নে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নেয়ায়, এমন কি সুদানে ইসলামী শরীয়াহ চালু করার ঘোষণা দেয়ার আগেই তারা জাফর নুমায়ের সরকারের পদ গ্রহণ করায় কোনো কোনো ইসলামপন্থী তাদের কঠোর সমালোচনা করে।
সিরিয়ায় আমাদের সহযোগী ভ্রাতৃবৃন্দ তাদের সমূলে ধ্বংসে উদ্যত স্বৈরশাসনের প্রতিরোধে কোনো কোনো অনৈসলামী শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে একই রকম বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অথচ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. স্বয়ং বহু ঈশ্বরবাদী খুজয়াহ গোত্রের সঙ্গে মিত্রতা করেছিলেন এবং কখনো কখনো বহু ঈশ্বরবাদী এক গ্রুপের বিরুদ্ধে অপর এক গ্রুপকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
অবশ্য আমি এখানে কোনো পক্ষ নিচ্ছি না। আমি কেবল একটি নীতি তুলে ধরছি, সেটি হচ্ছে ভারসাম্যের ফিকাহ-যার ওপরে ‘শরীয়াহ রাজনীতির’ কাঠামো নির্মাণ করা উচিত। অনৈসলামী শাসনে অংশগ্রহণ অথবা অমুসলিম শক্তির সঙ্গে জোট বাঁধা অনুমোদনযোগ্য- এ বক্তব্যের সমর্থনে রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাহাবীদের গৃহীত অবস্থান এবং আমাদের সুবিস্তৃত শরীয়াহর বিধানে বহু দলিল রয়েছে।
ভারসাম্যের ফিকাহ’র প্রমাণ
আমরা যদি আল-কোরআনের মক্কী ও মাদানী সূরাগুলো সতর্কতার সঙ্গে অধ্যয়ন করি তাহলে ভারসাম্যের ফিকাহর অনেক প্রমাণ এবং একটি বিষয়ের সাথে আরেকটির গুরুত্ব পরিমাপের উপায় দেখতে পাব।
আমরা ভারসাম্যের স্বার্থের উদাহরণ দেখতে পাই হযরত মূসা আ. এর প্রশ্নে হযরত হারুনের আ. জবাবে বিভিন্ন স্বার্থের মধ্যেঃ হে আমার মাতৃতনয়। তুমি আমার দাড়ি ধরো না, মাথাও স্বর্শ করো না, আমি এ আশঙ্কা করেছিলাম যে তুমি বলবে, তুমি বনি ইসরাইলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ, আর তুমি আমার কথার সম্মান দাওনি (সূরা ত্বাহাঃ ৯৪)।
আবার অনিষ্টকর বিষয়গুলোর মধ্যে ভারসাম্যের নজির দেখা যায় আল খিজির আ. কর্তৃক নৌকা ফুটো করে দেয়ার ব্যাখ্যার মধ্যেঃ আর নৌকাটির ব্যাপার হচ্ছে, বস্তুত তা ছিল কতিপয় গরীব লোকের যা দিয়ে তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত, সুতরাং তাতে ফুটো সৃষ্টি করতে চাইলাম এবং তাদের অপর দিকে ছিল এক বাদশাহ যে প্রত্যেকটি নিখুঁত নৌকা জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিত (সূরা আল কাহ্ফঃ ৭৯)।
নৌকাটি পুরোপুরি হারানোর চেয়ে ফুটো নৌকাটি রাখাই মালিকের জন্যে কম ক্ষতিকর। অর্থাৎ সব কিছু হারানোর পরিবর্তে নিঃসন্দেহে কিছুটা বাঁচিয়ে নেয়া অনেক ভালো।
আল্লাহর কালামেও ভারসাম্যের ফিকাহ’র বিষয়টি স্পষ্ট রয়েছেঃ মানুষ আপনাকে সম্মানিত মাসে যুদ্ধ করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, এ সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধ করা আল্লাহর কাছে গুরুতর অপরাধ। আর মানুষকে আল্লাহর পথে চলতে বাঁধার সৃষ্টি করা এবং আল্লাহর সাথে কুফরি করা, মসজিদে হারামের পথে বাধা দেয়া এবং মসজিদে হারামের অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কৃত করা আল্লাহর নিকট তার চেয়ে গুরুতর অপরাধ। আর ফেতনা সৃষ্টি করা হত্যা অপেক্ষা অধিক জঘন্য (সূরা আল বাকারাঃ ২১৭)।
সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে বলছেন, নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা গুরুতর অপরাধ, কিন্তু এরচেয়েও কোনো মরাত্মক অপরাধের প্রতিরোধে যুদ্ধ করা যেতে পারে।
মূর্ত ও বিমূর্ত স্বার্থের মধ্যে তুলনার লক্ষ্যে আসুন আমরা পড়ি সেই আয়াত যেখানে আল্লাহতায়ালা বদরের যুদ্ধের পর মুসলমানদের ভর্ৎসনা করেছেনঃ নবীর পক্ষে শোভনীয় নয় যে তাঁর কাছে যুদ্ধবন্দী রয়েছে এবং তা তিনি মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেন অথচ তিনি ভূমিতে কাফেরদের প্রচুর রক্তপাত ঘটাননি; তোমরা তো দুনিয়ার ধনসম্পদ চাইছো, কিন্তু আল্লাহ চাইছেন আখেরাত; আর আল্লাহ অতি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় (সূরা আল আন্ফালঃ ৬৭)।
ভালো ও মন্দের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্নে আসুন আমরা দেখি মহান আল্লাহ কি বলছেনঃ তারা আপনাকে মদ ও জুয়ার ব্যাপারে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, উভয়ের ব্যবহারের মধ্যে গুরুতর পাপ রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু কল্যাণও আছে। আর এ দু’টোর মধ্যে কল্যাণ অপেক্ষা পাপই অধিক গুরুতর (সূরা আল বাকারাঃ ২১৯)।
বিভিন্ন অমুসলিম গ্রুপ ও চক্র একে অপরের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে সূরা আল রুমের প্রারম্ভিব কয়েকটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা পারসিকদের উপর রোমকদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বানী করেছেন। এ সূরায় উল্লেখ করা হয়েছে যে ঐ দিন ঈমানদাররা আনন্দিত হবে। যদিও উভয় পক্ষই অমুসলিম। তবুও অগ্নিপূজক পারসিকদের তুলনায় রোমানরা মুসলমানদের ঘনিষ্ঠ। তারা আহলে কিতাব বলে মুসলমানদের অধিক কাছাকাছি।
ইবনে তাইমিয়ার মত
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া একটি অনৈসলামিক রাষ্ট্রে কোনো মুসলমানের সরকারী পদ গ্রহণ অনুমোদনযোগ্য বলে দৃঢ় মত প্রকাশ করেছেন, যদি সংশ্লিষ্ট পদাধিকারী ব্যক্তি কিছু কিছু অন্যায় অবিচারের প্রতিকার অথবা অসৎ কাজ ও দুর্নীতি দমনে ইচ্ছুক হন (পরিশিষ্ট–১)।
তিনি ভালো ও মন্দের দ্বন্দ্ব অথবা দু’টোই যদি একসাথে সামনে আসে এ দু’য়ের সমন্বয় এবং আলাদা করা সম্ভব না হলে সাময়িকভাবে গ্রহণ অথবা বর্জনের ওপরে একটি বিস্তারিত অনুচ্ছেদও রচনা করেছেন (পরিশিষ্ট–২)।
ইসলামী অর্থনীতির ওপরে আয়োজিত এক সিম্পোজিয়ামে [আলজেরিয়ায় ১৯৯০ সালের ২–৫ মার্চ ৬ষ্ঠ বারাকাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আরো কয়েকজন ফকীহর সঙ্গে অংশগ্রহণের সযোগ পেয়েছিলাম। তারা হচ্ছেন, শায়খ আব্দুল হামিদ আল সায়েহ, শায়খ মুখতার আল সালামী, ড. আবদুস সাত্তার আবু গুদ্দাহ, ড. সাইয়েদ দার্শ ও ড. তালাল বাফাকীহ।] অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন ফিকাহবিদ ও অর্থনীতিবিদ মত প্রকাশ করেন, মুসলিম দেশগুলোতে অনুমোদিত খাতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বেচাকেনা করা শরীয়াহর দৃষ্টিতে জায়েজ। যদিও এরূপ লেনদেনে সুদ-সংশ্লিষ্টতার কিঞ্চিৎ সন্দেহ থাকে। ভারসাম্যের ফিকাহর আলোকে এ ইস্যু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিম্পোজিয়ামে মত প্রকাশ করা হয়, এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর খাত অমুসলিম অথবা অধার্মিক মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। কেননা এ পদক্ষেপ বিশেষত কোনো কোনো দেশে মারাত্মক বিপদ সৃষ্টি করবে। বরং শেয়ার হোল্ডারগণ সুদ-সংশ্লিষ্ট লেনদেন থেকে যে লভ্যাংশ পান বলে মনে করেন আনুপাতিকভাবে সেই অংশটি সাদাকাহ বা জনহিতকর কর্ম হিসেবে দান করে দিতে পারেন।
এ ফিকাহ অনুসারে বিবেকবান মুসলিম তরুণদেরকে ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্সের মতো কোম্পানিগুলো থেকে চাকরি না ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে অবশ্যই কিছু গুনাহর আশঙ্কা থাকলেও তারা সেখান থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন তা ইসলামী অর্থনীতির বিকাশে কাজে লাগাতে পারেন। এভাবে তারা মনে মনে ক্ষতির দিকটা প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি গোটা পদ্ধতি ইসলামীকরণের প্রচেষ্টায় যারা নিয়োজিত তাদের সঙ্গেও অংশ নিচ্ছেন।
ভারসাম্যের ফিকাহর অনুপস্থিতি
আমরা যদি ভারসাম্যের ফিকাহ প্রয়োগ না করি তাহলে আমরা বহু কল্যাণ ও লাভের দরজা নিজেরাই বন্ধ করে দেব। পরিণামে সব ব্যাপারে প্রত্যাখ্যানের দর্শনই একটি হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াবে, ঝামেলা এড়ানোর অজুহাতে একঘরে হয়ে যাব এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে তার নিজের যুক্তি মোতাবেক সংঘর্ষে না জড়ানোর পথ বেছে নেব। তখন ইজতেহাদ সাপেক্ষ প্রত্যেক ব্যাপারে আমাদের পক্ষে ‘না’ বলা অথবা ‘এটি হারাম’ বলা সহজ হয়ে যাবে।
কিন্তু আমরা যদি ভারসাম্যের ফিকাহ প্রয়োগ করি তাহলে এক পরিস্থিতির সাথে আরেক পরিস্থিতির তুলনা, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে এবং ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক পর্যায়ে ক্ষতির স্থলে লাভের পরিমাপ করার উপায় খুঁজে পাব। আর এভাবে আমরা সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে কল্যাণ লাভ ও অকল্যাণ পরিহারের পথ বেছে নিতে পারব।
১৯৮০ সালে কাতার থেকে প্রকাশিত ‘দোহা’ ম্যাগাজিনে লেখার অনুরোধ পেয়েছিলেন। এটি একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা এবং এর অধিকাংশ সম্পাদকীয় কর্মী সেক্যুলারপন্থী। এর মূলনীতি ইসলাম বিরোধী না হলেও ইসলামপন্থী বা ইসলামের সমর্থকও নয়। আমি অনেক দিন ধরে ইতস্তত করার পর ভারসাম্যের নীতিতে প্রস্তাবটি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেই পত্রিকাটি বয়কট না করে এতে লেখা দেয়াই বেশি ভালো হবে। কারণ এর পাঠকরা এক ব্যাপকভিত্তিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন যারা সাধারণত ইসলামী পত্র পত্রিকা পড়েন না। ‘আল উম্মাহ্’র মতো সাময়িকীর যে ধরণের পাঠক রয়েছে এ পত্রিকার পাঠকরা সেই শ্রেণীর নন বিধায় আমরা যখন সুযোগ পাচ্ছি তখন তাদের কাছে আমাদের কথা পৌঁছে দেয়া দরকার। আর এটি আল্লাহ প্রদত্ত আমাদের প্রতি দায়িত্ব।
এ কারণে এসব পত্র পত্রিকার নীতি আমাদের মতের অনুকূল না হলেও তাদেরকে সাক্ষাতকার বা লেখা দিতে রাজী হওয়া উচিত। যে সব দৈনিক পত্রিকা স্পষ্টভাবে ইসলামী ধারা অনুসরণ করে না সে সব পত্রিকায় লেখালেখি করলে অনেকে এখনো দোষারোপ করেন। অনেকে আমার ‘ইসলামিক এয়োকেনিং বিটুইন পারমিটেড ডিফারেন্সেস এন্ড ব্লেমওয়ার্দি ডিজইউনিটি’ বইটি সউদী দৈনিক ‘শারক আল আওসাত’ এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের জন্যেও আমাকে দোষারোপ করেছেন। কারণ তারা এ পত্রিকার কোনো কোনো দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন না। কিন্তু আমি বহুল পঠিত এ পত্রিকায় বইটি ছাপানোর সুফলের দিকই বেশি বিবেচনা করেছি।
এমন অনেক লোক রয়েছেন যারা বিশ্বাস করেন, বিপথগামী চিন্তা চেতনার কারণে অডিও-ভিডিওসহ সকল গণসংযোগ মাধ্যম বর্জন করা উচিত। তারা ভুলে যান গণসংযোগ মাধ্যম বর্জন করা মানে এগুলো আরো জঘন্য রূপ নেবে এবং সেক্যুলার ও নোংরা মানসিকতার লোক ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করে নাশকতামূলক কাজ চালানোর সুযোগ পাবে। আর আমরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব যার কোনো বিকল্প নেই।
আমরা যদি ভারসাম্যের ফিকাহ’র আলোকে বিষয়টি পরীক্ষা করি তাহলে দেখব এ অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিতে কাজ করা কেবল জায়েজ ও বাঞ্ছনীয় নয় বরং অত্যাবশ্যক। কারণ এটি আমাদের দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং অশুভ কর্মকাণ্ডের যথাসাধ্য মোকাবিলায় ন্যায্য একটি হাতিয়ার হতে পারে।
অগ্রাধিকারের ফিকাহ
অগ্রাধিকারের ফিকাহ বলতে আমরা বুঝি প্রত্যেকটি ইস্যু সত্যিকার প্রেক্ষিতে বিবেচনা করা। কোনো বড় ইস্যুকে স্থগিত রাখা যাবে না, কোনো ছোটখাটো ইস্যুকে বড় করে দেখা যাবে না, কোনো বড় বিষয়কে খাটো করে দেখা উচিত নয়। আবার কোনো ক্ষুদ্র বিষয়কে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া ঠিক হবে না। প্রাকৃতিক বিধান ও শরীয়াহর বিধান এ দিকনির্দেশই দেয়। আমি মনে করি, আল্লাহর সৃষ্টি ও বিধান এ প্রকৃত প্রেক্ষিত মেনে চলা অবশ্যম্ভাবী করে দিয়েছি। সূরা আল আ’রাফের ৫৪ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছেঃ নিশ্চয় তারই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা।
নবীর জীবনে অগ্রাধিকারের ফিকাহ
মক্কী পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সা. এর মিশন একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। আর এ মিশনের কর্মসূচি ছিল কেবল আল্লাহর রাস্তায় মানুষকে দাওয়াত দেয়া এবং এমন একটি বিশ্বাসী দল গড়ে তোলা যারা পরবর্তীতে সেই দাওয়াত আরবদের কাছে, অতঃপর বিশ্বের চারদিকে ছড়িয়ে দেবে। এ পর্যায়ে দ্বীনি আকীদা প্রতিষ্ঠা, তাওহীদের অনুশীলন, বহু ঈশ্বরবাদ ও মূর্তিপূজা নির্মূল এবং নেক ও সৎকর্মের চর্চার ওপর রাসূলের সা. কাজ কেন্দ্রীভূত ছিল।
এ পর্যায়ের কর্মধারার প্রতি কোরআনের সমর্থন ছিল বিধান কোরআন মুসলমানদেরকে কোনো বিশেষ গৌণ বিধিবিধানের দিকে মনোযোগ দিতে বলেনি বরং সূরা আল আসরে বর্ণিত ইসলামী ভাবধারা গড়ে তোলার ওপর সকল প্রচেষ্টা নিবদ্ধ করার তাগিদ দিয়েছে। এ সূরার ৩ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছেঃ কিন্তু যারা ঈমান আনে, যারা সৎকর্ম করে এবং একে অন্যকে সত্য ও ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে থাকে।
মক্কী পর্যায়ে দাওয়াতী কাজের সময় মুসলমানরা প্রতিদিন কাবা ঘরে যে মূর্তি দেখত সেগুলো ধ্বংস করার জন্যে আল্লাহর রাসূল সা. তাদের হাতে কুঠার নেয়া অথবা তাদের ও আল্লাহর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তলোয়ার তুলে নেয়ার অনুমতি দেননি অথচ কাফেররা ঐ মুসলমানদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছিল। সে সময় মার খেয়ে ও জখম হয়ে তারা যখন রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে আসতেন, কোরআনের ভাষায় তিনি তাদেরকে এটিই বলতেনঃ স্বীয় হাতকে বিরত রাখ এবং নামাজ কায়েম কর (সূরা আন নিসাঃ ৭৭)।
সব কিছুর জন্যে একটি উপযুক্ত সময় আছে। সেই নির্ধারিত মুহূর্তের আগেই যদি কিছু পাওয়ার আশা করা হয় তাতে উপকারের পরিবর্তে ক্ষতির আশঙ্কা থাকতে পারে।
অগ্রাধিকারের ফিকাহ ও ভারসাম্যের ফিকাহর পারস্পরিক সম্পর্ক
অগ্রাধিকারের ফিকাহ ভারসাম্যের ফিকাহর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উভয়েই একসঙ্গে জড়িয়ে যায় অথবা একে অপরের সমান্তরাল হয়ে দাঁড়ায় এবং আবার ভারসাম্যের প্রক্রিয়া অগ্রাধিকারের দিকে ঝুঁকে যায়। এভাবে এটি তখন অগ্রাধিকারের ফিকাহর আওতায় পড়ে।
অনুপাত বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা
অগ্রাধিকারের ফিকাহ অনুযায়ী শরীয়াহর হুকুম-আহকাম (তাকলিফ) ও আমলের ক্ষেত্রে অনুপাত রক্ষা করা আবশ্যক। শরীয়াহর ইসলাম নির্ধারিত অনুপাতে ব্যত্যয় ঘটলে দ্বীনি ও পার্থিব উভয় জীবনে দারুণ ক্ষতি হবে।
ইসলামে আমলের আগে ঈমানের স্থান। যেহেতু ঈমান হচ্ছে ভিত্তি আর আমল হচ্ছে ইমারত। ভিত্তি ছাড়া কোনো ইমারত হয় না। আমলের আগে ঈমান। আমল বহুমুখী। রাসূলুল্লাহ সা. একটি সহীহ হাদিসে বলেছেনঃ ঈমান ৭৭ টি শাখায় বিভক্ত, সর্বোচ্চ স্থান হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই আর সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে রাস্তা থেকে ক্ষতিকর জিনিস সরানো।
আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে আল্লাহর নিকট আমল কেবল একটি স্তরেই নয়, উচ্চ ও নিম্ন স্তরে বিভক্ত। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো এবং মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে সেই ব্যক্তির কাজের সমান সাব্যস্ত করে নিয়েছ- যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালা ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে? তারা আল্লাহর সমীপে সমান নয়। আর যারা অত্যাচারী, আল্লাহ তাদেরকে সুবুদ্ধি দান করেন না। আর যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে এবং জানমাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে তারা মর্যাদায় আল্লাহতায়ালার সমীপে অতি বড়। আর তারাই হচ্ছে সফলকাম (সূরা তাওবাঃ ১৯–২০)।
এ কারণে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, হজ্ব সম্পাদনের চেয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ অধিকতর উত্তম। হাম্বলী ফকিহগণ এবং অন্যান্য ফকিহ তো জিহাদকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে করণীয় সর্বোত্তম শারীরিক আমল বলে অভিহিত করেছেন। অনেক হাদিসে জিহাদের প্রশংসা করা হয়েছে। এর মধ্যে আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদিসও রয়েছে। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. এর জনৈক সাহাবি একটি সঙ্কীর্ণ উপত্যকা অতিক্রম করছিলেন- যেখানে একটি মিঠাপানির ঝর্ণা ছিল। উপত্যকাটি তার ভালো লাগে এবং বলেন, আমি আল্লাহর বন্দেগীর জন্যে কি করে অন্য লোকদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারি। আল্লাহর রাসূল সা. এর কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে আমি এটি করবো না। সেই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট তার ইচ্ছে ব্যক্ত করল এবং রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, এরূপ করো না। তোমার ঘরে সত্তর বছর ইবাদত করার চেয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করা অনেক উত্তম (তিরমিজি ও আল হাকিম)।
সালমান রা. বর্ণিত একটি হাদিসে কাফেরদের হাত থেকে মুসলমানদের পাহারার (রিবাত) গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ একদিন ও একরাতের রিবাত একমাসের রোজা ও রাত্রিকালীন ইবাদতের চেয়ে উত্তম এবং রিবাতের অবস্থায় কেউ ইন্তেকাল করলে তার অনুকূলে আমলে সালেহ’র হিসাব জারি থাকবে যেন সে জীবিত আছে, আর যদি জীবিত থাকে সে শয়তানের প্রলোভন থেকে নিরাপদ থাকবে (মুসলিম)।
আবদুল্লাহ ইবনুল মোবারকের মতো একজন ইমাম জিহাদের সময় এক সৈন্যশিবির থেকে আল ফুজায়েল ইবনে ইয়াদ নামক তার এক বন্ধুকে কবিতা লিখছেন যিনি সব সময় দুই পবিত্র স্থান মক্কা ও মদিনার মধ্যে সফর করতেন। পঙ্ক্তিমালা হচ্ছেঃ
ওহে দুই পবিত্র স্থানে ইবাদতকারী,
তুমি যদি আমাদেরকে দেখতে,
তাহলে তুমি জানতে তোমার ইবাদত কেবলি খেলা।
কেউ কেউ তাদের অশ্রু দিয়ে গণ্ডদেশ ভেজায়;
আর আমরা নিজেদের রক্তে বুক ভিজাই…..।
[সূরা আল ইমরানের শেষ আয়াতটির তাফসীরে ইবনে কাছীর এ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য ইতিহাসবিদগণও একই কাহিনী বর্ণনা করেছেন।]
প্রচলিত ফিকাহ অনুসারে নফল ইবাদতকে (ঐচ্ছিক আমল যা ফরজ ইবাদতের মতো বাধ্যতামূলক নয়) ফরজের ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত নয়; সামষ্টিক বাধ্যবাধকতার (ফরজে কেফায়া) চেয়ে ব্যক্তির বাধ্যবাধকতা (ফরজে আইন) বেশি গুরুত্বপূর্ণ; যে সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা আদৌ কারো দ্বারা সম্পাদিত হয় না সে কাজ অগ্রাধিকার পাবে সেই দায়-দায়িত্বের ওপর যা সম্পন্ন করার জন্যে পর্যাপ্ত লোক আছে। আবার একটি গ্রুপ বা জাতির সাথে সম্পর্কিত দায়িত্ব ব্যক্তির অধিকারের চেয়ে গুরুত্ব পাবে এবং যে কাজ সম্পন্ন করার মেয়াদ সীমিত, সেই কাজ ঐ কাজের চেয়ে আগেই করে ফেলতে হবে যে কাজ করার যথেষ্ট সময় আছে।
শরীয়াহর বর্ণিত স্বার্থের গুরুত্বের ব্যাপারে ফিকাহতে বর্ণিত হয়েছে কোন বিষয়টি অধিকতর অগ্রাধিকার পাবে। যেহেতু প্রয়োজনীয় (আল মাসালিহ আল হাজিয়াহ) ও সৌন্দর্যবোধক (আল মাসালিহ আল তাহসিনিয়াহ) স্বার্থের চেয়ে অপরিহার্য (আল মাসালিহ আল দুরুরিয়াহ) স্বার্থের প্রাধান্য রয়েছে। আবার প্রয়োজনীয় স্বার্থকে তাহসিনিয়াহর চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অথচ জাতি ও ব্যক্তির স্বার্থের মধ্যে যখন সংঘাত দেখা দেয় তখন জাতীয় স্বার্থেই অগ্রাধিকার পাবে। এখানে ভারসাম্যের ফিকাহ ও অগ্রাধিকারের ফিকাহ এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে।
অগ্রাধিকারের ফিকাহর প্রতি অবহেলা
ইসলামী পুনর্জাগরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু গ্রুপকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তাদের কাছে অগ্রাধিকারের ফিকাহ’র কোনো অস্তিত্ব নেই, যেহেতু তারা প্রায়শ মুখ্য বিষয়ের আগে গৌণ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়। সামগ্রিক স্বার্থ অনুধাবনের চেয়ে কোনো বিশেষ দিক নিয়ে গবেষণায় লেগে যায়। আর প্রতিষ্ঠিত বিষয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করার পরিবর্তে বিতর্কিত বিষয় আঁকড়ে ধরে থাকে। দুঃখের বিষয়, আমরা পিঁপড়ার রক্তপাতের বিষয়ে আলোচনা করি, কিন্তু ইমাম হোসাইন রা. এর রক্তপাতের ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। অথবা নফল রক্ষার জন্যে মারমুখী হয়ে উঠি যখন মানুষ ফরজকে অবহেলা করছে। সারবস্তুর পরোয়া না করে খোলস নিয়ে ঝগড়া করি।
সার্বিকভাবে এ হচ্ছে আজকের মুসলমানদের অবস্থা। আমি দেখি প্রতি বছর রমযানে কিংবা অন্যান্য মাসে লাখ লাখ লোক উমরাহ পালন করে এবং কেউ কেউ দশ বার এমন কি বিশ বারের মতো হজ্ব পালন করে। তারা যদি এসব নফল কাজে ব্যবহৃত অর্থ সঞ্চয় করতো, তাহলে কোটি কোটি টাকা জমা করতে পারতো। আমরা ইসলামী সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে এক হাজার মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহে বছরের পর বছর ছুটোছুটি করি। কিন্তু এ অর্থের ১০ ভাগ এমন কি ২০ ভাগ বা ৩০ ভাগের এক ভাগও সংগ্রহ করতে পারি না। যদি এসব অতিরিক্ত হজ্ব ও উমরাহ পালনকারীকে তাদের ঐচ্ছিক সফরের খরচের টাকা এশিয়া ও আফ্রিকায় খৃস্টধর্মে দীক্ষিতকরণ প্রতিরোধে বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের কাজে লাগানোর জন্যে চান, তারা কিছুই দেবে না। এটি এমন এক পুরানো রোগ যে কোনো হৃদরোগ চিকিৎসক কখনো এর চিকিৎসা করতে পারবে না। [বাশার আল হাফী’র এ সংক্রান্ত একটি ঘটনা ‘আল এহিয়া’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ৪০৯ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করা হয়েছে।]
অগ্রাধিকারের ফিকাহ প্রয়োগ করলে আমরা জানতে পারি অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় কোন ইস্যুটির দিকে বেশি নজর দেয়া দরকার- যাতে এ ইস্যুটির জন্যে আমরা আরো বেশি শ্রম ও সময় দিতে পারি। অগ্রাধিকারের ফিকাহর আওতায় আরো জানা যায়, কোন শত্রুর বিরুদ্ধে শক্তি আরো বেশি কাজে লাগিয়ে তার বিরুদ্ধে আমাদের আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করতে হবে এবং তুলনামূলকভাবে কোন লড়াই চালানোর যোগ্য। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছেঃ মুসলমান, কাফের ও মুনাফিক।
কাফেরদের মধ্যে শান্তিকামী ও জঙ্গী মনোভাবাপন্ন শ্রেণী রয়েছে। এদের মধ্যে শুধু কাফেরই নয় বরং আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন কাফেরও আছে। মুনাফিকদের মধ্যে কম মুনাফিকী করে এমন লোক রয়েছে, আবার বেশি মাত্রায় মুনাফিকীতে লিপ্ত এমন লোকও রয়েছে। তাহলে কোথা থেকে শুরু করব? কোন ক্ষেত্রটি কাজের জন্য অধিকতর উপযোগী? কোন ইস্যুটির দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে?
অগ্রাধিকারের ফিকাহ সময়ের দাবি অনুযায়ী কাজ করার ব্যাপারে আমাদেরকে সচেতন করে, যাতে নির্দিষ্ট কাজটি কাল বিলম্ব না করে যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যায়। কেননা সুযোগ একবার হাতছাড়া হলে তা পুনরায় আসতেও পারে আবার নাও পারে। আর আসলেও দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। একজন কবি সময়ের মূল্য সম্পর্কে বলেছেনঃ
সুযোগ কাজে লাগাও, একটি সুযোগ
যদি হাতছাড়া করো, আসবে দুঃখ হয়ে।
আরবি এক প্রবচনে বলা হয়েছেঃ আজকের কাজ কালকের জন্যে ফেলে রেখো না।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে রা. কিছু কাজ আগামী দিনের জন্যে রেখে দেয়ার পরামর্শ দিলে তিনি জবাব দিয়েছিলেনঃ আমি তো ইতোমধ্যে একদিনের কাজ করেই ক্লান্ত, তাহলে আগামীকাল দু’দিনের কাজ করতে হলে কি অবস্থা হবে?
ইবনে আতা’র রা. একটি জ্ঞানগর্ভ উক্তি হচ্ছেঃ অনেক কাজ আছে যেগুলো করার প্রচুর সময় থাকে, সেই সময়ের মধ্যে এগুলো করে ফেলা যায়। কিন্তু এমন কাজও থাকে যা নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে না করলে আর করা হয়ে ওঠে না। কারণ প্রত্যেক নতুন সময়ের সাথে থাকে নতুন নতুন দায়িত্ব আর আল্লাহ নির্ধারিত নতুন নতুন কাজ।
গাজ্জালী ও অগ্রাধিকারের ফিকাহ
ইমাম গাজ্জালী র. ‘আল এহিয়া’ গ্রন্থে যারা সৎকর্মের দিকে মনোযোগ না দিয়ে কেবল ইবাদত-বন্দেগীতে সন্তুষ্ট থাকে তাদের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আরেক দল নফলের ব্যাপারে যতোটা আগ্রহী ফরজের ব্যাপারে ততোটা নয়। আমরা দেখি তারা সকালের নফল ও রাতের তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নামাজ পড়ে খুব খুশি, কিন্তু ফরজ কাজ করে আনন্দ পায় না। কিংবা তারা সময় মতো ফরজ নামাজ আদায়েও তৎপর নয়। তারা রাসূলুল্লাহ সা. বর্ণিত হাদিসের কথা ভুলে যায়ঃ আমি যে সব কাজ ফরজ হিসেবে করার আদেশ দিয়েছি সেগুলো ছাড়া আমার বান্দার আর কোনো কাজ আমার অধিকতর নৈকট্য লাভের জন্যে অধিক উত্তম হবে না (বুখারী)। আমলে সালেহ’র গুরুত্বভিত্তিক ক্রমবিন্যাস অবহেলা করা অসদাচারের আওতায় পড়ে। এক ব্যক্তির দু’টি বাধ্যতামূলক কাজের মধ্যে মাত্র একটি করার মতো পরিস্থিতি আছে, অথবা একটি কাজ অল্প সময়ের মধ্যে করতে হতে পারে এবং আরেকটি কাজের জন্যে প্রচুর সময় আছে, এক্ষেত্রে সে যদি ক্রমবিন্যাস রক্ষা না করে তাহলে সে বিভ্রান্ত।
এ ধরণের বহু উদাহরণ রয়েছে যেখানে আল্লাহর হুকুমের বাধ্যতা ও অবাধ্যতা উভয়ই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে বিষয়টি বাস্তবিকই দ্ব্যর্থবোধক সেটি হচ্ছে কিছু কিছু বাধ্যতামূলক কাজকে অন্যান্য কাজের ওপর গুরুত্ব দেয়। যেমন নফলের চেয়ে ফরজ আমলকে অগ্রাধিকার দেয়া, ফরজে কেফায়া’র চেয়ে ফরজে আইনের প্রতি গুরুত্বারোপ, কম দরকারী কাজ যা স্থগিত করা যায় তার চেয়ে স্থগিত করা যায় না এমন কাজের ওপর গুরুত্ব দেয়া এবং পিতার প্রয়োজনের চেয়ে মায়ের চাহিদা পূরণের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া।
রাসূলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ কে আমার অধিকতর সেবাযত্ন পাওয়ার হকদার? তিনি জবাব দিলেনঃ তোমার মা। লোকটি বলল, এরপর কে? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলেন, অতঃপর কে এবং রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তোমার মা। লোকটি চতুর্থবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তোমার পিতা। লোকটি আবারো জিজ্ঞেস করল এরপর কে? এবং রাসূল সা. জবাব দিলেনঃ তোমার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যিনি নিকটতম এবং এরপর নিকটতর যিনি। কোনো ব্যক্তি আত্মীয়তার ঘনিষ্ঠতা অনুযায়ী এ সম্পর্কের হক আদায় করবে। যদি তার আত্মীয়দের দু’জন সমমর্যাদার হন, তাহলে যার সাহায্য বেশি প্রয়োজন তাকে সাহায্য করতে হবে। আর উভয়ের চাহিদা যদি সমান হয় তবে যে বেশি দ্বীনদার তাকে সাহায্য করা উচিত।
একইভাবে কেউ যদি পিতার ব্যয়ভার মিটাতে না পেরেও আবার হজ্ব পালন করতে চায়, সে ক্ষেত্রে তার হজ্বে যাওয়া উচিত নয়। যদি যায় তবে সে মূর্খের মতো কাজ করবে। কারণ তার উচিত পিতার স্বার্থ রক্ষার ওপর অগ্রাধিকার দেয়া। এভাবে সে একটি নিম্নক্রমের ধর্মীয় কর্তব্যের চেয়ে অপর একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার ওপর গুরুত্ব দেবে।
অধিকন্তু কারো যদি পূর্ব নির্ধারিত কাজের সময় জুমার নামাজের ওয়াক্ত হয়ে যায় তাহলে জামায়াতে শরিক হতে হবে। যদি সে পূর্ব নির্ধারিত কাজে যায় তাহলে সে আল্লাহর অবাধ্যতা করবে- যদিও প্রতিশ্রুত কাজ সম্পন্ন করাটাও একটি বাধ্যতামূলক বিষয়। কেউ যদি তার পোশাকে কিছু নাপাকী দেখে পিতামাতার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, নাপাকী অগ্রহণযোগ্য ঠিকই কিন্তু পিতামাতাকে আঘাত দেয়াও গ্রহণযোগ্য নয়। নাপাকী পরিহারে সাবধান হওয়ার চেয়েও পিতামাতাকে আঘাত দেয়া থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া বেশি জরুরী।
নিষিদ্ধ কাজ ও বাধ্যতামূলক দায়িত্বের পারস্পরিক সম্পর্কের অসংখ্য নজির রয়েছে। যে এসবের মধ্যে কোনো একটি বিষয়েও অগ্রাধিকারের ধারা উপেক্ষা করে সে নিশ্চিতই বিভ্রান্ত। [দেখুন ‘আল এহিয়া’, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০০–৪০৪, আমার বইও দেখুনঃ ‘ইমাম আল গাজ্জালীঃ বিটুইন হিজ প্রেইজারস এন্ড হিজ ক্রিটিকস’, পৃষ্ঠা ৮৭–৯৩]
ইবনে কাইয়েমের মত
কোন ইবাদত করা উত্তম- যে বন্দেগী করা খুব কঠিন সেগুলো, না যেগুলো খুব কল্যাণকর সেগুলো? এসব প্রশ্নে ইমাম ইবনুল কাইয়েম বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।
তিনি মত দিয়েছেন, একমাত্র পছন্দের ইবাদত বলতে কিছু নেই। তবে কোনো সময় কোনো কোনো ইবাদত করা পছন্দনীয় হতে পারে। [মাদারিজ আল সালিকীন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৫–৯০, আমার বই ‘ইবাদাহ ইন ইসলাম’।] দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য দ্রব্য প্রদান করা সর্বোত্তম কাজ, এতে একজন মুসলমান আল্লাহর অধিক নৈকট্য লাভ করে। যখন কুফরী শক্তি কোনো মুসলিম দেশে হামলা চালায়, তখন জিহাদ সর্বোত্তম আমল। এরপরের স্থান হচ্ছে মুজাহিদদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা। যখন কোনো আলেম ইন্তেকাল করেন অথচ তাদের কোনো উত্তরাধিকারী থাকে না, তখন দ্বীনি এলেম অর্জন করা সর্বোত্তম কাজ। এজন্যে একজন মুসলমান আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কারের প্রত্যাশা করতে পারে এবং তারা আল্লাহ ও ঈমানদারদের প্রশংসাও অর্জন করে। এভাবেই ভালো ভালো কাজগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুসারে একে অপরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যেতে পারে।