চতুর্থঅধ্যায়
ইসলামী আন্দোলনঃ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে
ঈমানের আলোকে প্রশিক্ষণ
জনগণের মধ্যে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে যে কোনো ইসলামী আন্দোলনের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণই হচ্ছে মৌলিক ও আবশ্যকীয় কৌশল। শিক্ষা কর্মসূচির মৌলিক লক্ষ্য হওয়া উচিত মুসলিম অগ্রণী দল গড়ে তোলা, যারা ইসলামের কাজ এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। রাসূলুল্লাহ সা. এর যুগে তাঁর সাহাবিরা যেমন ছিলেন এ যুগে আমাদের কাছে অগ্রণী দলের গুরুত্ব সে রকম।
এ অগ্রণী দলের সদস্যদের সর্বপ্রথম যোগ্যতা হবে ঈমান। আমি বোঝাতে চাই কোরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত ঈমান, যে ঈমানের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সংশ্লিষ্ট সত্তরটির বেশি শাখা-প্রশাখা রয়েছে; যে ঈমানের ওপর বহু গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। কেননা ঈমান খেয়াল খুশি অথবা কল্পনা থেকে আসে না। ঈমান অন্তর থেকে উৎসারিত এবং আমল বা কর্মের দ্বারা প্রমাণিত।
সুতরাং ঈমান অর্থ কেবল বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞান নয়, যার ফলশ্রুতিতে অন্তরে আলোর ছোঁয়া লাগে না অথবা ইচ্ছা শক্তিকে আলোড়িত করে না। কিংবা আল্লাহ, প্রভু, দ্বীন ও ইবাদত- বন্দেগী; তাওহীদ ও তাগুত এবং জাহেলিয়াত- এর মত পরিভাষাকে আত্মস্থ করা নয়। এসব বিষয় মস্তিষ্কে ধারণ করে সত্যিকার ঈমানদারদের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তা অর্জিত হয়েছে বলে গৌরব বোধ করা নয়। মূলত এগুলোই হচ্ছে চরম ও পরম বিশ্বাস। ঈমান অর্থ শব্দ ও পরিভাষা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে যুক্তিতর্ক ও বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া নয়।
যুক্তিতর্ক বা বাকযুদ্ধ কোনোটিই সে রূপ ঈমান জাগ্রত করবে না যেমন ফেরাউনের যাদুকররা মূসা আ. ও হারুনের আ. প্রভুর ওপর ঈমান এনেছিল অথবা রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবিরা যেমন আল্লাহর কালামের ওপর ঈমান এনেছিলেন। যে ঈমান দরকার তা হচ্ছে কোরআন ও সুন্নাহ বর্ণিত প্রথম কাতারের ঈমান। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের যে আয়াতে আল্লাহতায়ালা আরব বেদুঈনদের ‘আমরা বিশ্বাস করি’ উক্তির জবাবে বলছেন, বিশ্বাস তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেনি- তা উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে। আল্লাহতায়ালা সূরা হুজরাতের ১৫ নং আয়াতে বলেনঃ কেবল মুমিন তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান এনেছে, অতঃপর তাতে সন্দেহ পোষণ করেনি, বরং আল্লাহর রাস্তায় জান ও মাল দিয়ে লড়াই করেছে; এরাই সত্যবাদী।
হযরত আনাস রা. কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ যার তিনটি গুণ রয়েছে, সেই বিশ্বাসের মাধুর্য উপলব্ধি করতে পারবে। সেগুলো হচ্ছে, যে কোনো জিনিসের চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসা, আল্লাহর জন্যেই কাউকে ভালোবাসা এবং আল্লাহ যে কুফর থেকে রক্ষা করেছেন সেই কুফরের দিকে ফিরে যাওয়াকে ঘৃণা করা এমনভাবে যেমন দোজখে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে ঘৃণা করা হয় (বুখারী ও মুসলিম)।
নেতার অনুসারী সাধারণ মানুষের জন্যে আধা আনুগত্য কিংবা এক-চতুর্থাংশ আনুগত্য যথেষ্ট হতে পারে, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের অগ্রণী দলের অবশ্যই খাঁটি ঈমান থাকতে হবে। তাদের বিশ্বাস কখনোই কম বা ঘাটতি হলে চলবে না।
ইমাম হাসান আল বান্না তার শিষ্যদের বলতেন, আমাকে বারো হাজার মুমিন দাও, আমি পাহাড় অতিক্রম করব, সাগর পাড়ি দেব, দেশ জয় করব। [ইমাম বান্না র. মনে হচ্ছে আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে খুজায়মা, ইবনে হিব্বান ও আল হাকীমের হাদিস সংকলনে সন্নিবেশিত একটি হাদিস থেকে এ মর্মার্থ গ্রহণ করেছেন। এসব হাদিসে ইবনে আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, বারো হাজার ঈমানদারের একটি দল অজেয়, এ সংখ্যা কম মনে হলেও। রাসূলুল্লাহ সা. এর সূত্রেই এ হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে।] ইসলামী উম্মাহর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে এ সংখ্যা কি যথেষ্ট। আমি বলি, হ্যাঁ, সম্ভব। বারো হাজার সত্যিকার মুমিন দিয়ে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারব। কিন্তু আমি এটিও বলব, চব্বিশ হাজার অর্ধ বিশ্বাসী বা আটচল্লিশ হাজার এক চতুর্থাংশ বিশ্বাসী লোককে দিয়ে কাজ হবে না। অথবা বিশ্বাসীদের এমন একটি দল যাদের বিপুল সংখ্যা দেখে যে কেউ হতভম্ব হয়ে যেতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনের সময়ে সেই বাহিনী কোনো কাজে লাগত না।
আমরা মদিনার আনসারদের মতো ঈমানদার চাই যুদ্ধের সময় যারা বিপুল সংখ্যায় যোগদান করত কিন্তু গণিমতের মাল বণ্টনের সময় তাদের খুবই কমই দেখা যেত।
যারা সংখ্যায় বিপুল হয় কিন্তু বাস্তবে কাজের নয় তারা প্রবল জলধারার ফলে সৃষ্ট ফেনার [সওবান বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. এর একটি হাদিসে উল্লিখিত হয়েছেঃ এমন একটা সময় আসবে যখন প্রত্যেক দিক থেকে বিভিন্ন জাতি তোমাদেরকে ঘিরে ফেলবে এবং তোমাদের পরাভূত করবে। ঠিক যেমন ক্ষুধার্ত লোকজন খাবারের পাত্রে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করা হলো, শত্রুদের তুলনায় মুসলমানরা সংখ্যা কম হওয়ার কারণেই কি এরকম হবে? তিনি বললেন, না; মুসলমানরা সে সময় প্রবল জলধারায় সৃষ্ট ফেনার মতো দুর্বল হবে। তোমাদের অন্তর দুর্বল হয়ে যাবে এবং তোমাদের শত্রুরা আর তোমাদের ভয়ে সন্ত্রস্ত হবে না। এর কারণ তোমাদের থাকবে দুনিয়ার প্রতি মোহ এবং মৃত্যুর প্রতি ঘৃণা।] চাইতে ভালো কিছু নয়। এরা যদি সংখ্যায় লাখ লাখও হয় তবুও কখনো আন্দোলনের অগ্রণী দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য হবে না। ঈমানভিত্তিক বা আল্লাহর কালামে অনুপ্রাণিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণই হচ্ছে ইসলামের স্বার্থরক্ষাকারী একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার পূর্বশর্ত। এ দলের কথাই মহান আল্লাহ আল-কুরআনে বর্ণনা করেছেনঃ হে বিশ্বাসীরা! তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি স্বীয় ধর্ম ইসলাম হতে ফিরে যায়, আল্লাহতায়ালা সত্বরই এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালোবাসবে। তারা ঈমানদারদের প্রতি বিনয় নম্র থাকবে, কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে, তারা আল্লাহর পথে জিহাদ এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবে না। এটিই আল্লাহ অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছে দান করেন; বস্তুত আল্লাহতায়ালা মুখাপেক্ষী নন, মহাজ্ঞানী (সূরা মায়েদাঃ ৫৪)।
যথার্থ সুফি শিক্ষা
কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক যথার্থ সুফি শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরণের শিক্ষা সুফি চরিত্র গঠনে সহায়ক হয়, যারা আল্লাহর সৃষ্টির আগে আল্লাহকে, ইহকালের চেয়ে পরকালকে এবং স্বীয় বাসনা চরিতার্থ করার চেয়ে দ্বীনি লক্ষ্য অর্জনকে গুরুত্ব দেবে।
যদিও কেউ কেউ মনে করেন, তা সত্ত্বেও সব তাসাউফ (সুফিবাদ) খারাপ নয়। সব সুফিও বিভ্রান্ত নন, যদিও অনেকে জ্ঞান বা সঠিক ধারণার অভাবে এটি দাবি করেন। সুফিরা অন্যান্য দলের মতোই একটি দল। এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ‘আলফুকারা’ নামে তার এক নিবন্ধে লিখেছেনঃ সুফিদের মধ্যে আপনি সৎ লোক এবং বিপথগামী দেখতে পাবেন। এদের মধ্যে কেউ তার নফসকে কলুষিত করে, কেউ মধ্যপন্থা অনুসরণ করে, আবার এমনও আছেন যিনি আল্লাহর অনুগ্রহে অত্যন্ত সৎকর্মপরায়ণ।
আমরা অবশ্যই দার্শনিক তাসাউফের সকল ভ্রান্ত তত্ত্বঃ যেমন- হুলুল (ঐশী অবতারবাদ) এবং ইত্তিহাদ (আল্লাহর সঙ্গে রূহানী সংযোগ অর্থে), গোমরাহ সুফিদের কথিত রূহানী সিদ্ধিলাভজনিত নানা উক্তি এবং অর্থ কামানোর মতলবী সুফিবাদকে প্রত্যাখ্যান করি। আমরা এরূপ বিশুদ্ধ সুফিবাদ চাই, যার উৎকৃষ্ট নিদর্শন হচ্ছেন বুজুর্গ সুফিগণ। যেমনঃ আল হাসান আল বসরী, আল ফুজায়েল ইবনে ইযাদ, ইব্রাহীম ইবনে আদহাম, আবু সুলাইমান আল দারানী, আবুল কাসি, আল জুনায়েদ প্রমুখ।
আমরা চাই কোরআন ও সুন্নাহর মধ্যপন্থা অনুসারী সুফিবাদ- যে সুফিবাদ অন্তরের পরিশুদ্ধিকে গুরুত্ব দেয়, যেখানে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নানা কসরতের স্থান নেই। তাসাউফ বাহ্যিক রূপ দেখার আগে তার অন্তর্নিহিত রূপটি দেখে। সহীহ হাদিসে স্পষ্টত বলা হয়েছেঃ আল্লাহ তোমাদের দেহ ও চেহারা দেখবেন না, বরং দেখবেন অন্তর (মুসলিম)।
আমরা চাই সেই সুফিবাদ যা মনের রোগ দূর, অন্তরে শয়তানের অনুপ্রবেশের পথ বন্ধ এবং মানব হৃদয়ের লালসা চরিতার্থের প্রবণতা প্রতিরোধ করবে, যেন মানুষ পাপাচার পরিত্যাগ করে প্রকৃত নৈতিক মূল্যবোধ ও পূণ্যের অধিকারী হয়।
জনৈক মনীষী সুফিবাদকে বর্ণনা করেছেনঃ সুফিবাদ হচ্ছে আল্লাহর নিকট সত্য থাকা এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর হওয়া। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা বলেনঃ নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা এমন লোকদের সঙ্গে আছেন যারা তাকে ভয় করে এবং নেককার (সূরা নাহ্লঃ ১২৮)।
আল্লামা ইবনুল কাইয়েম প্রাথমিক যুগের সুফিদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেনঃ সুফিবাদ হচ্ছে সদাচার, কেউ যদি সদাচারিতায় তোমাকে ছাড়িয়ে যায় তাহলে সে তোমার চেয়ে উত্তম। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করে ইবনুল কাইয়েম বলেছেনঃ না, দ্বীনই হচ্ছে সদাচারিতা এবং কেউ যদি তাকওয়া পরহেজগারিতে তোমাকে ছাড়িয়ে যায় তবে ধর্মের দৃষ্টিতে সে তোমার চেয়েও উত্তম সদাচারি। এ ক্ষেত্রে শুধু দরকার রাসূলের সা. একটি হাদিস স্মরণ করাঃ আমি নৈতিকতাকে উৎকর্ষতা দান করার জন্য বাণী বাহক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি (বুখারী)।
গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয়
শিক্ষা ক্ষেত্রে চারটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করতে হবেঃ
ক. নির্ভেজাল নিয়ত
প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নিজের নিয়তকে বিশুদ্ধ করা। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই কাজ করতে হবে। অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, মানুষের অনুগ্রহ লাভ কিংবা মনের গহীনে লুকায়িত অন্য কোনো মতলব অর্জনের জন্যে নয়।
ইসলামের কাজ হচ্ছে ইবাদত ও জিহাদ। ইবাদত তখনই কল্যাণকর যখন তা নির্ভেজাল নিয়ত সহকারে আল্লাহর জন্যেই সম্পন্ন করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেনঃ এবং তাদেরকে আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদতের নির্দেশ দেয়া হয়নি, এবং তাঁর ছাড়া আর কারো জন্য ইবাদত নয় (সূরা বাইয়েনাহঃ ৫)।
আল্লাহর পথে জিহাদ তখনই যথার্থ হয় যখন বিশুদ্ধ নিয়তে কেবল আল্লাহর বাণী সমুন্নত করার লক্ষ্যেই করা হয়। কেবল আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে করা হয় এমন কাজ কিংবা যে বিশ্বাসে অন্য কারো অংশ থাকে এমন কাজ তিনি কবুল করেন না। এ কারণে ইমাম হাসান আল বান্না তার পয়লা শ্লোগান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেনঃ আল্লাহ আমাদের লক্ষ্য। যাতে এটির ওপর জোর দেয়া হয় যে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কারই আমাদের পরম কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য।
বলতে পারি আমরা ইসলামী সমাজ কায়েম করতে চাই। একটি ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চাই কিংবা আমরা সংহত ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্যে অথবা অন্য কোনো স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছি। কিন্তু আমাদের সামগ্রিক লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। যেন তিনি আমাদেরকে তাঁর নেক বান্দাদের মধ্যে অন্তভুক্ত করেন। প্রত্যেক ইসলামী কর্মীর এ দুটো আয়াত মনে রাখা উচিতঃ আপনি বলে দিন- নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কোরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ জগত সমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তাঁর কোনো শরিক নেই। এভাবেই আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি সমস্ত অনুগতদের মধ্যে প্রথম (সূরা আন’আমঃ ১৬২–১৬৩)।
যশ খ্যাতি প্রত্যাশীদের কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের প্রচেষ্টা সফল হয় না। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী তাদেরই প্রচেষ্টায় বিজয় অর্জিত হয় যারাঃ হিতৈষী, সৎ ও শিষ্ট; তারা উপস্থিত থাকলে টের পাওয়া যায় না, অনুপস্থিত থাকলে অভাব অনুভূত হয়, যাদের অন্তর আল্লাহর পথের আলোক প্রদীপ (আল হাকিম)।
খ. আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব
দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করার দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, যে কোনো কাজে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করা যাতে সেই কাজে উৎকর্ষতার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে। এজন্যে রাসূলুল্লাহ সা. কে যখন জিব্রাইল উৎকর্ষতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি বললেনঃ উৎকর্ষতার চূড়ান্ত স্তর হচ্ছে এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা যেন আপনি তাঁকে দেখছেন। আর আপনি যদিও তাঁকে নাও দেখেন তবে তিনি আপনাকে দেখছেন।
এটি হচ্ছে দ্বীনি বা পার্থিব যে কোনো কাজের পূর্বশর্ত। কারণ কাজে উৎকর্ষতা এমন এক ফরজ যা অর্জনে প্রত্যেক মুসলমানের সচেষ্ট হওয়া উচিত। আল্লাহ প্রত্যেক ব্যাপারে উৎকর্ষতার তাগিদ দিয়েছেন। আর কোনো মানুষেরই উৎকর্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাকে দেখছেন ও তার কথা শুনছেন এবং সে যা যা করছে তিনি তার সব কিছু জানেন- এছাড়া তার অন্য কোনো অনুভূতি থাকা উচিত নয়।
উৎকর্ষতা আরো বেশি দরকার যদি কাজটি হয় দ্বীন সম্পর্কিত। বিশেষত তা যদি হয় ইসলামী দাওয়াত ও ইসলামী আন্দোলনের জন্য- এ ধরণের কাজ তা ফরজে আইন বা ফরজে কেফায়া যাই হোক না কেন। ইসলামী দাওয়াত ও ইসলামী আন্দোলনের কাজে যেখানে অন্যান্য মুসলমান যারা শুধু অলসভাবে সময় কাটায় ও পর্যবেক্ষণ করে তাদের পক্ষে কর্মীরা দায়িত্ব পালন করে। এমনকি তারা সুযোগ পেলে ইসলামী কর্মীদের ওপর হামলাও চালায় এবং এ দ্বীনি কাজ ছেড়ে দেয়ার জন্যে কর্মীদের প্ররোচিত করে।
ইসলামী কর্মীদের তত্ত্বাবধানের কোনো অভাব নেই। তাদের কাজের প্রশাসনিক পরিদর্শনেরও দরকার নেই, কারণ তারা আত্ম-তত্ত্বাবধানের আওতায় থাকে এবং তারাই তাদের কাজের প্রথম পরিদর্শক। তাদের অন্তরে আল্লাহর এ বাণী সব সময় জাগরুক থাকেঃ আর তিনি তোমাদের সঙ্গেই আছেন যেখানেই তোমরা থাক না কেন এবং তোমরা যা কর আল্লাহতায়ালা তোমাদের সব কাজকে দেখেন (সূরা হাদীদঃ ৪)।
গ. আত্মসমালোচনা
তৃতীয় কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে আত্মসমালোচনা (এহতেসাব) করা। যদি কাজ শুরুর আগে আমাদের নিয়ত স্পষ্ট এবং কাজের সময় আল্লাহ হাজির আছেন এ অনুভূতি সৃষ্টি হয় তবে তাই আত্মসমালোচনা। আর এটিই হচ্ছে জবাবদিহিতা। হাদিসে বর্ণিত হয়েছেঃ বুদ্ধিমান সেই যে নিজের নফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পর যা আসবে সে জন্যে প্রস্তুত হয়, আর সেই অসহায় যে নফসের মর্জিমাফিক কাজ করে এবং অতঃপর আল্লাহর উপর নির্ভর করে (তিরমিজি)।
এটিও বর্ণিত হয়েছে যে হজরত ওমর রা. বলেছেনঃ তোমার কাছ থেকে হিসাব নেয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব নাও। তোমার আমলের ওজন করো, সেসব তোমার বিরুদ্ধে ওজন করার আগেই। মায়মুন ইবনে মাহরানের একটি উক্তি হচ্ছেঃ ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর ব্যাপারে সচেতন যে নিজের নফসের হিসেব স্বৈরশাসক এবং কৃপণ ব্যক্তির চেয়েও কঠোরভাবে নেয়। এর উৎস হচ্ছে মহান আল্লাহর কালামঃ আর এমন সত্তার কসম করছি, যে নিজেকে তিরস্কার করে (সূরা কিয়ামাহঃ ২)।
এহতেসাব ভুলভ্রান্তির পরিশুদ্ধি এবং দুর্বলতা দূর করার প্রচেষ্টা সর্বদা তীব্রতর করে। ফলে একজন সব সময় উৎকর্ষতা অর্জনে সচেষ্ট হয় এবং আত্ম-প্রশংসা, অহমিকা ও অপরের নিন্দা করার অভ্যাস পরিহার করে।
ইসলামে নিজের হিসাব গ্রহণের এ নীতি নৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্যতম মৌলনীতি। এ কারণে সকল সুফি ও শিক্ষাবিদ এ নীতিকে আবশ্যকীয় বলে বিবেচনা করেছেন।
অধুনা মানুষ প্রায়ই আত্মসমালোচনা শব্দটি উচ্চারণ করে। এ শব্দটি ব্যবহারে কোনো দোষ নেই। তবে আসল দোষণীয় হচ্ছে এটিকে প্রচলিত অর্থে গ্রহণ এবং অন্যের কাছ থেকে ধার বলে মনে করা। কেননা আত্মসমালোচনা নিজেই নিজের হিসাব নেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এটি মূলত কোরআন, সুন্নাহ ও আমাদের সংস্কৃতি নির্দেশিত।
ঘ. আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল
চতুর্থ কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে আল্লাহর ওপর আস্থা (তাওয়াক্কুল) রাখা। এটি এমন এক রূহানী হাতিয়ার যা দুর্বলতাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এটি সেই অস্ত্র যা দিয়ে রাসূল সা. বিভিন্ন জাতির স্বৈরশাসকদের মোকাবিলা করেছেন। তাদের স্বৈরাচার তাঁকে কখনো ভীত করেনি; না তাদের দুরভিসন্ধি তাঁকে দুর্বল করতে পেরেছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ আর আল্লাহর ওপর আমাদের ভরসা না করার কি কোনো কারণ থাকতে পারে? অথচ তিনি আমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন যা আমরা অনুসরণ করি এবং তোমরা আমাদেরকে যে রূপ কষ্ট দিয়েছ, আমরা তাতে সবর করব। আর আল্লাহর ওপরেই ধৈর্যশীলদের আস্থা রাখা উচিত (সূরা ইব্রাহীমঃ ১২)।
আল্লাহর ওপর আস্থার অর্থ হচ্ছে আল্লাহকে পথ প্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করা, তাঁর নির্দেশ মেনে চলা এবং তাঁর ওপরেই নির্ভর করা। আল্লাহতায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেনঃ তিনিই পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। সুতরাং তাঁকেই নিজ কাজের কার্যনির্বাহক হিসেবে গ্রহণ করুন (সূরা মুয্যাম্মিলঃ ৯)।
অবশ্য নিজেকে প্রস্তুত করে সব রকম পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করেই আল্লাহকে কার্যনির্বাহী হিসেবে গ্রহণ করা উচিত; অতঃপর আল্লাহ আপনাকে পরিত্যাগ করবেন না এ আস্থা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আল্লাহর ওপর আস্থা রাখার অর্থ কোনোভাবেই এটি গ্রহণ করা উচিত নয় যে কেউ নিজ কাজে অবহেলা, লক্ষ্যে পৌঁছার নির্ধারিত কৌশল পরিহার, অনুমোদিত নিয়মবিধির প্রতি ঔদাসীন্য প্রদর্শন অথবা বীজ না বুনেই বা ক্ষেতের যত্ন না করেই ফসল কাটার প্রতীক্ষা করবে। তাওয়াক্কুলের অর্থ তাই যা রাসূলুল্লাহ সা. এবং তাঁর পূর্বের নবী-রাসূলগণ করেছেন। তা হচ্ছে আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে, তাঁর ওয়াদার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং তাঁর সমর্থনের আশা করেই নিজে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ফলাফল আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়।
মহানবী সা. হিজরতের উদ্দেশ্যে সর্বোত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবুও তিনি যে গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন কাফেররা সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। হযরত আবু বকর রা. যখন বললেনঃ ওদের মধ্যে কেউ যদি তার পায়ের নীচে তাকায় তাহলে সে নিশ্চয়ই আমাদেরকে দেখে ফেলবে। রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ আবু বকর তুমি সেই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে কি চিন্তা করো, যাদের সঙ্গে তৃতীয় আরেকজন আছেন- তিনি হচ্ছেন আল্লাহ। সূরা তাওবার ৪০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছেঃ তুমি বিষণ্ন বা ভীত হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।
এ কথা হযরত মূসা আ. ও বলেছিলেন তাঁর কওমকে যখন ফেরাউন তার বাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেছিল। হযরত মূসার কওম সামনে সাগর ও পেছনে ফেরাউনের বাহিনীর মধ্যে আটকা পড়ল। আল্লাহ বলেনঃ অতঃপর যখন উভয় পক্ষ পরস্পরকে দেখতে পেল, তখন মূসার সঙ্গীগণ বলল, আমরা তো নিশ্চিত তাদের হাতে ধরা পড়লাম। মূসা বললেন, কখনোই না। কেননা, আমার প্রভু আমার সঙ্গে আছেন। তিনিই আমাদের পথ দেখাবেন (সূরা আশ শূ’আরাঃ ৬১–৬২)।
আমাদের আসলেই যা প্রয়োজন তা হচ্ছে এ ধরণের মজবুত ঈমান। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন- এ বিশ্বাসে বলীয়ান হয়েই ফেরাউন ও আবু জেহেলের বংশধরদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা যাদের সঙ্গে রয়েছেন তারা ব্যর্থ হতে পারে না। আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ আল্লাহ যদি তোমাদেরকে সাহায্য করেন, তবে তো কেউই তোমাদের ওপর জয়ী হতে পারবে না। আর তিনি যদি তোমাদেরকে সহায়তা না করেন, তবে তাঁর পর এমন কে আছে যে তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারে? আর মুমিনদের শুধু আল্লাহর ওপরেই ভরসা করা উচিত (সূরা আলে ইমরানঃ ১৬০)।
যথার্থ কাজের গুরুত্ব
প্রয়োজনীয় অগ্রণী দল তৈরী করতে গিয়ে দু’টি বিষয়ের সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবেঃ নিয়তে সততা ও সঠিক কাজ।
প্রত্যেক ইসলামী কাজে বিশুদ্ধ নিয়ত ও সদিচ্ছা আবশ্যক। কেননা, প্রতিটি ইসলামী কাজ মানেই ইবাদত ও জিহাদ। আমরা আগেই বলেছি কোনো ইবাদত বা জিহাদ কবুল হবে না, যদি তাতে বিশুদ্ধ নিয়ম না থাকে। এ জন্যে আমাদের আলেমগণ রাসূলুল্লাহ সা. এর হাদিস ‘নিয়ত অনুযায়ীই কর্মের মূল্যায়ন বা পরিমাপ করা হয়’- এর ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আলেম সমাজ সামগ্রিকভাবে নিয়তকে ইসলামের এক-চতুর্থাংশ, এক তৃতীয়াংশ, এমন কি অর্ধাংশ বলে মনে করেন।
কিন্তু ইসলামী আন্দোলনকে প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেয়ার জন্যে কেবল নিয়তই যথেষ্ট নয়। সৎ নিয়ত ছাড়াও সঠিক ও বেঠিক এমন কি দু’টি মতের কোনটি বেশি সঠিক এগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা এবং দু’টি মন্দের কম মন্দটি অথবা দু’টি ভালোর মধ্যে সবচেয়ে ভালোটি বেছে নেয়ার ক্ষমতা থাকা উচিত। কথিত আছে, ঐ ব্যক্তি বুদ্ধিদীপ্ত যে মন্দ থেকে ভালোকে চিনতে পারে, আর ঐ ব্যক্তি বিজ্ঞ যে দু’টি মন্দের মধ্যে কম মন্দটি চিহ্নিত করতে পারে।
আসলেই একজন মুসলমানকে জানার চেষ্টা করতে হবে কোনটি সঠিক। চেষ্টা করার পরেও কেউ যদি ভুল করে, তাকে ক্ষমা এমনকি পুরস্কৃত করা হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, কেউ যদি সত্য জানার চেষ্টা করার পর ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে তবুও তাকে একটি পুরস্কার দেয়া হবে, আর কেউ যদি চেষ্টা সাধনার পর সঠিক পথ পায় তবে তাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেয়া হবে। একটি পুরস্কার চেষ্টা সাধনার জন্যে, আর দ্বিতীয়টি সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য। সঠিক সিদ্ধান্তের জন্যে দ্বিগুণ পুরস্কারের ওয়াদা এ জন্যেই যে যারা চেষ্টা সাধনা করে তাদের সর্বদা উদ্দেশ্য হবে ‘প্রকৃত সত্য’ জ্ঞাত হওয়া এবং সকল বিজ্ঞ ঈমানদার যেন তাদের চেষ্টা সাধনায় প্রকৃত সত্য জানার ওপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারে। এ পর্যায়ে আমি দু’টি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব।
প্রথমত, যারা চেষ্টা সাধনার জন্যে পুরস্কৃত হবেন তাদেরকে সর্বপ্রথম এ প্রচেষ্টা চালানোর যোগ্য হওয়া উচিত অর্থাৎ তার ব্যক্তিগত বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগের (ইজতিহাদ) ন্যূনতম যোগ্যতা থাকতে হবে। আমি ইজতিহাদ বলতে এখানে ফিকাহর গ্রন্থসমূহে এ ধরণের প্রচেষ্টার ব্যাপারে বর্ণিত আইনগত ও পারিভাষিক অর্থ বোঝাচ্ছি না বরং কোনো ক্ষেত্রে করা হয়েছে এমন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টাকে বোঝাচ্ছি যার জন্য প্রয়োজন বিশেষ জ্ঞান, রাজনৈতিক বিষয়ে ইজতিহাদ- সামরিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা বিষয়ে ইজতিহাদের চেয়ে নিশ্চিতই ভিন্ন ধরণের। কেননা প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞান আবশ্যক।
কিন্তু কেউ যদি এমন কোনো বিষয়ে গবেষণা শুরু করে যে বিষয়ে তার নিজের ভালো জ্ঞান নেই, সে যদি যথার্থ জ্ঞান ছাড়া রায় দেয় তাহলে সে নিজের উপর জুলুম করল, তার গবেষণার প্রতি অবিচার করল এবং তার জাতির ক্ষতি করল। সে তো পুরস্কার পাবেই না বরং এক অনস্বীকার্য পাপের জন্যে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। কারণ সে অজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও রায় দেয়, যেমন কেউ সাঁতার না জানা সত্ত্বেও পানিতে নেমে সাঁতার কাটার ভান করে। এ জন্যে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ বিচারক তিন ধরণের, একজন যাবে বেহেশতে আর বাকি দু’জন যাবে জাহান্নামে। প্রথম জন হচ্ছে ঐ বিচারক যে সত্য জানে এবং সে আলোকে বিচার করে, তাই সে বেহেশতে যাবে। দ্বিতীয় বিচারক অজ্ঞ অথচ রায় দেয়, সে জাহান্নামে যাবে। তৃতীয় বিচারক সত্য জানা সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে রায় দেয়, সেও জাহান্নামী হবে (আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজা, নাসাঈ ও আল হাকিম)।
এ হাদিসে যে বিচারক অজ্ঞতা সত্ত্বেও রায় দেয় এবং যে বিচারক সত্য জানা সত্ত্বেও অন্যায় রায় দেয় উভয়কে সমপর্যায়ে ফেলা হয়েছে। কেননা, সে নিজেকে এমন এক ক্ষেত্রে জড়িয়েছে যে বিষয়ে সে অভিজ্ঞ নয়। এক্ষেত্রে সেখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঐ পদের যোগ্য লোকের হাতে তা ছেড়ে দেয়াই উত্তম হবে।
এ ধরণের বিচারক যদি সঠিক কাজটিও করে তবুও সে পুরস্কৃত হবে না। কারণ ভুল অবস্থান থেকে সঠিক কথাটি বলা হয়েছে। যথাযথ পদ্ধতিভিত্তিক নয় বলে এসব কাজের কোনো মূল্য নেই। হাদিসে বর্ণিত হয়েছেঃ যে জ্ঞান ছাড়াই কোরআনের বিষয়ে মতামত দেয় তা সঠিক মনে হলেও ভুল। [আবু দাউদ ও তিরমিজি এ হাদিসটি একজন বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত বলে ‘গরিব’ বলেছে এবং আন নাসাঈ ও অন্যান্যরা হাদিসটিকে দুর্বল বা জঈফ বলে অভিহিত করেছেন।] এটি অদক্ষ হাতে গুলি ছোড়ার মত।
এমন বিচারকের মতামত সঠিক হলেও ভুল বলে গণ্য হবে। যেহেতু তার মহামত (ইজতিহাদ) খেয়াল খুশি মতো তৈরী হয়েছে, কোনো যথার্থ নিয়ম পদ্ধতি কঠোরভাবে অনুসরণ করে নয়। সুতরাং এমন এলোপাথাড়ি চেষ্টার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করা যায় না।
দ্বিতীয়ত, কেবল ইজতিহাদী প্রচেষ্টার জন্যে পুরস্কৃত হবেন, এমন কি একটি মাত্র পুরস্কার পাবেন তারাই যারা সত্য অনুসন্ধানে আপ্রাণ চেষ্টা চালান এবং বিষয়টি যথার্থ নিশ্চিতভাবে অনুধাবন করার ওপর পূর্ণরূপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। এটি করতে গিয়ে তাদেরকে সত্য উদঘাটনে প্রাপ্ত সকল উপায় উপকরণ এবং সত্য উদঘাটনে প্রাপ্ত সকল তথ্য উপাত্ত অনুধাবন করে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথেও পরামর্শ করে সঠিক মতামত এবং মূল্যবান অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে হবে। এসবই তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।
ভবিষ্যত নেতৃত্ব
বহু দেশে ইসলামী আন্দোলনের সমস্যা হচ্ছে আন্দোলনের ভিত এতো বিস্তৃত যে তা সামলানোর মতো নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। এটি স্বীকার করার মধ্যে কোনো সঙ্কোচ নেই।
এ অবস্থার কারণ হচ্ছে সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলন সারা বিশ্বে বিস্তৃতি লাভ করেছে। সকল দেশে আন্দোলনের শিকড় গভীরে প্রোথিত হয়েছে। ফলে এর বিস্তৃতি ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু এ ক্রমবিকাশের পাশাপাশি আদর্শিক, শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক পর্যায়ে উপযুক্ত নেতা সৃষ্টি হচ্ছে না। বর্তমান নেতৃত্বকে এ পরিস্থিতির কথা মনে রেখেই ভবিষ্যত পর্যায়ের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে।
এখানে প্রথম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, দাওয়াতি কাযর্ক্রমের প্রতি বিশ্বস্ত হওয়া। এ জন্যে ত্যাগ স্বীকার করা অথবা আন্দোলনে প্রথম অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে গণ্য হওয়াই কেবল ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বের গুণাবলী নয়। যদিও আল্লাহ ও মানুষের দৃষ্টিতে এসব গুণ বৈশিষ্ট্যের নিজস্ব মূল্য আছে। যে ধরণের নেতৃত্ব প্রয়োজন তা হচ্ছে, নেতৃত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিশেষ বুদ্ধিবৃত্তিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বাস্তব সামর্থ্য থাকা উচিত। এসব বৈশিষ্ট্য হবে নৈতিক, আচরণ ও বিশ্বাসগত প্রচলিত পূর্বশর্তের অতিরিক্ত।
আমি নেতৃত্ব বলতে আন্দোলন শীর্ষপদের কথা বোঝাচ্ছি না। বরং সেই গ্রুপকে বুঝাচ্ছি যারা কাজের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকে এবং তাদের অধীন লোকদের কাছ থেকে যথাসম্ভব কাজ আদায় করে নেয়। তারা সংশ্লিষ্ট কর্মী বাহিনীকে ক্ষতিকর কাজ থেকে গঠনমূলক প্রক্রিয়ায়, তর্কবিতর্ক থেকে কর্মব্যস্ততায় এবং অলসতা থেকে কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত করে।
নেতৃত্ব একটি জীবনব্যাপী অধিকার, কেবল মৃত্যুই সে অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারে এ ভেবে যারা গোড়া থেকে নেতৃত্বের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের নতুন নেতাদের পথে বাধা হওয়া উচিত নয়। তাহলে তারুণ্যে ভরা মেধাবী ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আসার পথে বাধা সৃষ্টি করা হয। খোলাফায়ে রাশেদীনকে আমাদের আদর্শ হিসেবে অনুসরণের তাগিদ দেয়া হয়েছে যাদেরকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে কাউকে সারাজীবনের জন্যে নেতা হিসেবে বেছে নেয়ার মনোভাব আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে।
বস্তুত এসব ঐতিহাসিক নজীর এমন কোনো আইন নয় যে উম্মাহকে কিয়ামত পর্যন্ত তা মেনে চলতে হবে। এ বিষয়ে আমরা অন্যত্র আলোচনা করেছি। এখানে আমাদের যে বিষয়টির ওপর অবশ্যই জোর দিতে হবে তা হচ্ছে আগামী পর্যায়ের জন্যে এমন নেতৃত্ব প্রস্তুত করা যাতে দৃঢ়, সৎ, নির্ভরযোগ্য ও বুদ্ধিদীপ্ত নেতারা নিশ্চিতভাবে আন্দোলনের হাল ধরতে পারেন। আমাদেরকে আদর্শিক, শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবশ্যই নেতৃত্ব তৈরী করতে হবে।
এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে চিন্তা করে আমাদের বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এবং তত্ত্বকে কর্মে রূপান্তর করতে হবে।
নেতৃত্ব বিনির্মাণে বিশেষ ইনস্টিটিউট
এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে ইসলামী নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্যে আমি একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিচ্ছি। যাদের প্রয়োজনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক, মনস্তাত্ত্বিক, আচরণগত ও ঈমানী গুণাবলী রয়েছে এমন প্রত্যয়দীপ্ত মেধাবী ব্যক্তিদেরকে এ ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী হিসেবে বেছে নিতে হবে। মানুষের গুণ বৈশিষ্ট্য বিচারে সক্ষম বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সুপারিশের আলোকেই এসব শিক্ষার্থী নির্বাচন করা উচিত। তাদেরকে ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণের জন্য রিক্রুট করার আগে লিখিত ও মৌলিক পরীক্ষাও নিতে হবে আবাসিক ধরণের ইনস্টিটিউট হওয়াই উত্তম যেখানে শিক্ষার্থীরা একটি কমিউনিটি হিসেবে বাস করবে। সেখানে জীবনযাপনের মূল উপাদান হবে ধর্ম, জ্ঞান, দাওয়াতি কার্যক্রম, ভ্রাতৃত্ব ও জিহাদ।
এ ইনস্টিটিউটের পাঠ্যক্রম হওয়া উচিত ব্যাপক, গভীর ও বিভিন্নমুখী। এ পাঠ্যক্রমে ঐতিহ্য ও সমসাময়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয় এবং ইসলামী প্রেক্ষাপটে ধর্ম ও মানবিক বিজ্ঞানের সংমিশ্রণ থাকতে হবে। সেই সাথে স্থানীয়, আরব, ইসলামী ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির দিকেও যথাযথভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমাদের ধর্ম, উম্মাহ এবং অগ্রাভিযানের বিরোধী চক্রের ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের ওপর পাঠ্যক্রমে গুরুত্ব দিতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানটি জ্ঞানের সঙ্গে কর্মের এবং তত্ত্বের সঙ্গে অনুশীলনের সমন্বয় সাধন করবে।
এ পাঠ্যক্রম শিক্ষা দেয়ার জন্যে উচ্চশিক্ষিত, পরিপক্ক চিন্তা ও বিশ্বাসের অধিকারী নির্ভরযোগ্য শিক্ষকদেরকে মনোনীত করতে হবে। এসব শিক্ষককে কোমলতা অথবা কঠোরতা থেকে অনেক দূরে থাকা উচিত। তারা হবেন সংহত ও সমন্বিত চিন্তা-চেতনার অধিকারী। তাদের মধ্যে কেউেই পরস্পরের মতামতকে অপাংক্তেয় মনে করবেন না, কেউ পাশ্চাত্য বিশারদ ও প্রাচ্য বিশারদ কিংবা বাম ও ডানপন্থী হবেন না। তাই যদি হন তাহলে তারা চিন্তার ক্ষেত্রে বৈপরীত্য ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন যার ফলে শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি হবে।
এর অর্থ আমি এটি বোঝাতে চাই না যে এসব সুবিজ্ঞ শিক্ষক একে অপরের হুবহু প্রতিকৃতি হবেন। আমি শুধু এটি বলতে চাই, প্রধান প্রধান ইস্যুতে তাদের সার্বিক চিন্তাধারা এবং ইনস্টিটিউটের গৃহীত মৌল দর্শনের মধ্যে একটি মতৈক্য থাকতে হবে।
এখন আমি এ উচ্চাভিলাষী উদ্যোগের মাধ্য আমরা যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চাই তার কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব।
কাঙ্ক্ষিত আদর্শের বৈশিষ্ট্য
কোনো রকম সন্দেহ বা দ্ব্যর্থতা ছাড়াই একটি বিষয়ে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত নেতৃবৃন্দের জন্যে নৈতিক বিকাশের মূল চাবিকাঠি ঈমানভিত্তিক শিক্ষা ছাড়াও সুদৃঢ় আদর্শিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হবে। এটি হবে ইতিপূর্বে বর্ণিত ফিকাহ ভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ যা আগামী দিনের আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন।
আমাদের কাছে ঈমান যুক্তি বা বুদ্ধির পরিপন্থী নয়। বরং ঈমান যুক্তিভিত্তিক ও যুক্তি দ্বারা চালিত এবং কোরআনে মুমিনদেরকে বুদ্ধিমান মানুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কোরআন তাদের জন্যেই দিকনির্দেশক যারা বুদ্ধিধমান ও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে। উম্মাহর বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের কাছে যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সকল ওহীর জ্ঞান। কেননা ওহীর জ্ঞান ছাড়া আল্লাহর অস্তিত্ব কিংবা রিসালাতের বৈধতা প্রমাণ করা যায় না।
কোরআনে বর্ণিত নির্দেশাবলী যৌক্তিক মানসিকতা নির্মাণ করে যা ইবাদতের ভিত রচনা করে এবং সকল কুসংস্কার ও পূর্ব পুরুষদের অথবা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনুকরণকে নাকচ করে দেয়। [আমার বই ‘দি প্রফেট এন্ড নলেজ’, পৃষ্টা ৩৮–৪০)]
বিজ্ঞানসম্মত আদর্শ
যে আদর্শের ভিত্তিতে আমরা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে চাই তার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। শিক্ষকদের উচিত হবে এসব বৈশিষ্ট্যের অনুধাবন ও বাস্তবায়ন করা। আর শিক্ষা পাঠ্যক্রমে এসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে হবে।
পূর্ণ আক্ষরিক অর্থে এ শিক্ষা হবে বিজ্ঞানভিত্তিক। বিজ্ঞানভিত্তিক বলতে আমি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিজ্ঞান সম্পৃক্ত বিজ্ঞঅনকে বোঝাতে চাইনি। যদিও মুসলমানদের বিজ্ঞানের এসব বিষয় নিয়ে চর্চা করা উচিত। কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ যেখানে প্রমাণ ছাড়া কোনো দাবি, প্রস্তাবনা ছাড়া কোনো ফলাফল, দলিল ছাড়া কোনো সাক্ষ্য অথবা সম্পূর্ণরূপে সন্দেহমুক্ত না হলে কোনো প্রস্তাবনা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আমরা চাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারা ও বৈজ্ঞানিক চেতনা যা আমাদেরকে পথ দেখাবে যেন আমরা যে কোনো বিষয়, ইস্যু, পরিস্থিতি এবং মানুষকে বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় বিবেচনা করতে পারি এবং আবেগ, তাৎক্ষণিকতা, আত্নকেন্দ্রিকতা, গোষ্ঠীস্বার্থ এবং প্রাত্যহিক নানা অজুহাতের প্রভাবমুক্ত হয়ে বৈজ্ঞানিক মানসিকতা নিয়ে অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষাসহ অন্য সকল ক্ষেত্রে বিচক্ষণ ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারি। উপরোক্ত প্রতিকূল দিকগুলো আমাদের আচার আচরণ বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। একজন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তি তার অথবা তার দলের খেয়াল খুশির প্রভাবে চালিত হলে জনগণ যা পছন্দ করে তাই করে তাদেরকে তোষণ করতে চাইবে- জনগণ, স্বদেশ ও সামগ্রিকভাবে জাতির ভবিষ্যতের জন্যে যা কল্যাণকর সে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে না।
আমার ‘দি ইসলামিক সলিউশনঃ এ ফরিদাহ এন্ড এ মাস্ট’ গ্রন্থে ইসলামী আন্দোলনে আত্মসমালোচনা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক চেতনার কতকগুলো প্রধান বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাত করেছি। আমদানি করা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের জন্যে নয়- উম্মাহ্র প্রয়োজনের ওপর জোর দিয়ে এসব বৈশিষ্ট্য এখানে পুনরুল্লেখ করা দরকার বলে মনে করি।
দরকার বৈজ্ঞানিক চেতনা
বৈজ্ঞানিক চেতনার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছেঃ
১. কোন উৎস থেকে এসেছে সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বিভিন্ন বিষয়, পরিস্থিতি ও প্রসঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ। হযরত আলী রা. বলেছেনঃ মানুষকে দিয়ে সত্য জানার চেষ্টা করো না, বরং সত্য কি প্রথমে সেটাই জানো, তাহলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষকে সহজেই চিনতে পারবে।
২. স্পেশালাইজেশন গুরুত্ব প্রদান করা। আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ সুতরাং কিতাবের বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকদের জিজ্ঞাসা করো (সূরা নাহ্লঃ ৪৩), তাঁর সম্পর্কে যিনি অবগত তাকে জিজ্ঞাসা করো (সূরা ফুরকানঃ ৫৯), আর তোমাকে সর্বজ্ঞ আল্লাহর ন্যায় কেউই অবহিত করতে পারবে না (সূরা ফাতিরঃ ১৪)।
দ্বীনের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ আছে যেমন আছে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ও জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় বিশেষ করে আমাদের এ যুগে। যে ব্যক্তি দ্বীন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে জ্ঞান রাখে এবং সব বিষয়ে মতামত দেয় সে তো বাস্তব পক্ষে কিছুই জানে না।
৩. আত্মসমালোচনা, ভুল স্বীকার, এগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং স্পষ্টভাবে অতীতের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনার আগ্রহ থাকতে হবে। আত্মতুষ্টি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে থাকতে হবে। কেননা তা অতীতকে কেবল গৌরব ও বিজয়ে পূর্ণ দেখতে পায়।
৪. সফলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্বাধুনিক ও সর্বোত্তম কৌশল প্রয়োগ এবং শত্রুসহ অন্য সকলের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা। জ্ঞান মুমিনদের হারানো সম্পদ, তা যেখান থেকেই পাওয়া যাক না কেন। অন্য যো কোনো মানুষের চেয়ে মুমিনই সে জ্ঞানের বেশি হকদার।
কেবলমাত্র অকাট্য ধর্মীয় ও আদর্শিক তত্ত্ব ছাড়া সকল বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং তার ফলাফল কারো পক্ষ-বিপক্ষ বিবেচনা না করেই গ্রহণ করা।
সিদ্ধান্ত ও মতামত প্রদানে তড়িঘড়ি না করা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের আলোকে সতর্ক পর্যালোচনা এবং অপর পক্ষের সঙ্গে গঠনমুলক আলাপ-আলোচনার পরই কেবল একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে আলোচ্য বিষয়ের ভালো মন্দ সব কিছুই সামনে চলে আসবে।
ফিকাহর বিভিন্নমুখী ইস্যু এবং জ্ঞানের সকল শাখায় যারা বিপরীত ধারণা পোষণ করেন তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ণ করা যতক্ষণ প্রতিটি বিষয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে যুক্তি প্রামাণ থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত কোরআন-সুন্নাহর আলোকে বিষয়টি এমনভাবে মীমাংসা করা যাতে বিরোধ এড়ানো যেতে পারে। আমাদের আলেম সমাজ রায় দিয়েছেন ইজতিহাদ ভিত্তিক মতামতের ওপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। সেহেতু কেউ ইজতিহাদ ভিত্তিক মতামত দিলে তাকে অন্যের চেয়ে উত্তম গণ্য করা উচিত হবে না। তবে ইজতিহাদের মাধ্যমে গঠনমূলক আলাপ-আলোচনা এবং সহনশীল ও আন্তরিক পরিবেশে তাত্ত্বিক ও পক্ষপাতহীন যাচাই বাছাই বন্ধ হওয়া উচিত নয়।
বৈজ্ঞানিক তত্ত্ববিরোধী রীতি
জটিল বিষয় অতি সরলীকরণ, গুরুতর ইস্যু অবমূল্যায়ন, কঠিন সমস্যা হালকা করে দেখা অথবা প্রধান প্রধান ইস্যু অশিক্ষিত লোকের মতো এবং দরবেশী আচার আচরণ দিয়ে মোকাবিলা করা বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার পরিপন্থী।
অদৃশ্য হাত ও অশুভ বিদেশী শক্তি আমাদেরকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্যে দুবৃত্তের মতো নীলনকশা তৈরী করে ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না আমরা নিজেরাই সেই ফাঁদে পা দেই। এ অবস্থঅয় আমরা সব কিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পাই এবং মনে করি এসব অশুভ চক্রের মোকাবিলা করার মতো শক্তি আমাদের নেই। অতএব হাত গুটিয়ে নেয়াই ভালো। এ ধরণের মন মানসিকতা আমাদের জন্যে ক্ষতিকর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি সত্য হতে পারে কিন্তু এটিকে ঢালাও ব্যাপার বলে মনে করা ভুল। ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের এরূপ ব্যাখ্যা বস্তুত ষড়যন্ত্র ও নীলনকশারই ফলশ্রুতি। এসব ঘটনা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক যাই হোক না কেন উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করার দু’টি খারাপ ফল রয়েছেঃ
প্রথমত, এ ধরণের মনোভাব বৃদ্ধি পেলে তা এক ধরণের অদৃষ্টবাদের জন্ম দেবে যেন এসব শয়তানী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ এসব দুষ্টচক্রের বিপুল আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার কাছে আমরা অতিশয় দুর্বল ও হীনবুদ্ধি। এভাবে আমরা দাবার গুটিতে পরিণত হই। এরূপ চিন্তাভাবনা কেবল হতাশা ও পরাজয়ের ধ্বংসাত্মক মনোভারই সৃষ্টি করবে।
দ্বিতীয়ত, এ মানসিকতা আমাদেরকে আত্মসমালোচনা বিমুখ করে এবং দোষত্রুটি অনুধাবন, সমস্যার প্রতিকার কিংবা ব্যর্থতা ও অপরাধ খতিয়ে দেখার কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানোর আগ্রহ সৃষ্টি করে না। ফলে রোগের কারণ নির্ণয় করে নিরাময়ের চেষ্টাও বিঘ্নিত হয়। যতদিন পর্যন্ত আমরা মনে করবো আমাদের দুর্বলতা, ঔদাসীন্য, দুর্নীতি কিংবা ধ্বংসের কারণ দুষ্ট বৈদেশিক চক্রান্ত, আমাদের নিজ আচরণের ফলশ্রুতি নয়, ততদিন এ অবস্থা বিরাজ করবে।
আমরা প্রায়শই এ ধরণের মানসিকতা পোষণ করি অথচ কোরআন আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে আমরা কখনো দুর্ভাগ্য, দুর্যোগ ও পরাজয়ের সম্মুখীন হলে কেবল নিজেদেরকেই দোষী মনে করতে হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা বলেনঃ আর তোমাদের ওপর যে কোনো বিপদ আপতিত হয়, তা তোমাদেরই হস্তের অর্জিত কার্যকলাপের দরুন। আর অনেক বিষয় তো তিনি মাফ করে দেন (সূরা শূরাঃ ৩০)।
ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানরা তাদের সত্তর জন বীর যোদ্ধাকে হারিয়ে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হয়েছিল। অথচ এ মুসলিম বাহিনীই বদরের যুদ্ধে এক দীপ্তিময় বিজয় অর্জন করেছিল। তারা নিজেদের কাছে নিজেরাই এর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে আল্লাহতায়ালা এর জবাব পাঠান এভাবেঃ তোমাদের এ কি অবস্থা তোমাদের উপর যখন একটি মুসিবত ঘনিয়ে এল, যদিও একবার তোমরাই তোমাদের শত্রুদের ওপর দ্বিগুণ আঘাত হেনেছিলে, তোমরা বলেছ- এটি কোথা থেকে এল? আপনি তাদেরকে বলুন, এ বিপদ তোমাদের নিজেদের কারণেই এসেছে (সূরা আলে ইমরানঃ ১৬৫)।
বাস্তবসম্মত আদর্শ
আমরা আগামীতে ইসলামী আন্দোলনের জন্যে বিজ্ঞানসম্মত আদর্শের যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে চাই তা হবে বাস্তবভিত্তিক, কোনো অলীক ও স্বপ্ননির্ভর নয়।
উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামর্থে্যর ভারসাম্য
একটি বাস্তব সত্য আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে নিতে হবে যে আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মসূচি আমাদের সামর্থে্যর অনুপাতে সুষম হওয়া উচিত। এর পাশাপাশি এটিও যাচাই করে নিতে হবে, আমরা কী পেতে চাই আর বাস্তবে কতটুকু পেতে পারি। আমরা যেন এমন কিছু পাওয়ার আশা না করি যে জন্য আমরা প্রস্তুত নই অথবা অর্জন করার মতো প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণ আমাদের আয়ত্তে নেই। কোরআন একজন যোদ্ধাকে রণকৌশল বাস্তবায়নের চেষ্টায় অথবা স্বীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার লক্ষ্যে পশ্চাৎপরসরণ করার অনুমতি দিয়েছে।
একজন মুজাহিদকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তখনই সরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে যখন মুসলিম বাহিনীর তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বিপুল সংখ্যক শত্রু সৈন্যের উপস্থিতির ফলে পরিস্থিতি তার অনুকূল থাকে না। আল্লাহতায়ালা বলেনঃ এখন আল্লাহ তোমাদের ভার লঘু করে দিয়েছেন এবং তিনি জানেন যে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যদি একশজন দৃঢ়তাসম্পন্ন থাকে তবে তারা দু’শতের ওপর জয়লাভ করবে, আর যদি তোমাদের মধ্যে এক হাজার থাকে, তবে আল্লাহর হুকুমে দু’হাজারের ওপর বিজয়ী হবে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন (সূরা আন্ফালঃ ৬৬)।
মু’তার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর চেয়ে রোমান বাহিনীর সংখ্যা ছিল বহুগুণে বেশি। দেড় লাখ রোমান সৈন্যের মোকাবিলায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। উভয়পক্ষের সৈন্য সংখ্যার এ অনুপাতের দরুণ সমর কুশলী খালিদ বিন ওয়ালিদ আত্মঘাতী হতে পারে এমন যুদ্ধের মুখে ঠেলে না দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার পরিকলপনা গ্রহণ করেন।
তিনি যখন তার বাহিনী নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন তখন মদিনার ক্ষুব্ধ যুবকরা তাদের দিকে পাথর নিক্ষেপ করে অভ্যর্থনা জানায় এবং তাদের পলায়নকারী বলে আখ্যা দেয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. তাদের সমর্থনে বললেনঃ না, তারাই আক্রমণকারী হবে ইন্শাআল্লাহ।
তিনিই বিজ্ঞ সেনাপতি যিনি তার সৈন্যদের প্রতি খেয়াল রাখেন। ওমর ইবনে খাত্তাব রা. তাঁর শাসনামলের প্রথম দিকে এ কারণে বাইজান্টাইন অভিযানে আগ্রহী হননি। যারা এ ব্যাপারে তাঁকে তাগিদ দিচ্ছিলেন তিনি তাদেরকে বলেনঃ আল্লাহর কসম, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য এবং এর সকল ধনসম্পদের চেয়ে একজন মুসলমান আমার কাছে অধিক প্রিয়।
যে কাজ করার সাধ্য নেই তাতে নিজেকে জড়ায় না যে সেই বিজ্ঞ মুসলমান। এ প্রসঙ্গে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা বলেনঃ অতএব তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাকে যথাসম্ভব ভয় করো (সূরা তাগাবুনঃ ১৬)।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছেঃ নিজকে অবমাননা করার অনুমতি একজন মুসলমানকে দেয়া হয়নি। রাসূল সা. কে বলা হলোঃ একজন নিজেকে কিভাবে অবমাননা করে, হে আল্লাহ রাসূল সা.? রাসূলুল্লাহ সা. জবাবে বললেনঃ এমন বোঝা কাঁধে চাপিয়ে নেয়া যা সে বইতে পারে না।
ইসলামী আন্দোলন একটি ভুল সহজেই করতে পারে। সেটি হচ্ছে সাধারণ মানুষের আবেগ তাড়িত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কোনো কোনো দেশে মুসলিম জনতা আন্দোলনের কোনো কোনো নেতাকে রাজনৈতিক লড়াইয়ে নামিয়ে দেয়। সেখানে তারা এ কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় মানসিক, রাজনৈতিক ও বিশেষ দক্ষতা পূর্ণরূপে অর্জন না করেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটি করতে গিয়ে তারা সাধ্যের চেয়ে অতিরিক্ত বোঝা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নেয়। এ পদক্ষেপের ব্যর্থতা নিশ্চিত।
তাড়াহুড়ো, ভ্রান্ত ধারণা, কারো দক্ষতা সম্পর্কে অতিমূল্যায়ন এবং অন্যদের সামর্থ্য সম্পর্কে অবমূল্যায়নের ফলেই এ ধরণের ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের সামনে রাসূলুল্লাহ সা. এর সেই উদাহরণ রয়েছে যখন তিনি তাঁর সাহাবিদেরকে মুশরিকদের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামের অনুমতি দেননি, এমনকি তারা যখন নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। তিনি বলতেনঃ লড়াই থেকে তোমাদের হাত গুটিয়ে নাও এবং সালাত কায়েম করো।
রাসূলুল্লাহ সা. আল্লাহর তরফ থেকে জিহাদ শুরু এবং যুদ্ধাভিযান চালানোর জন্যে একটি মুক্ত ভূখণ্ড এবং একটি শক্ত ঘাঁটি না পাওয়া পর্যন্ত এ রীতি অনুসরণ করেছেন। এ সম্পর্কে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেনঃ তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হয়, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে, আর নিশ্চয় আল্লাহতাদেরকে বিজয়ী করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন (সূরা হজ্জঃ ৩৯)।
পুরানো সমস্যা মিটিয়ে ফেলা
আমরা নতুন আদর্শ গ্রহণের মাধ্যমে সে সব পুরোনো সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে চাই যেগুলো আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে এবং মুসলমানদের বহু প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন যাবৎ নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। এমন সমস্যাগুলো হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্ব ও সিফাত। আল্লাহর সিফাতগুলো কি আল্লাহর মৌলিক প্রকৃতি না অন্যকিছু? অথবা এসব গুণাবলী মৌলিক প্রকৃতি নয়, অন্যকিছুও নয়?
সমস্যাগুলোর মধ্যে ছিল কোরআন সৃষ্ট কি সৃষ্ট না, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে ইসলামের কয়েকজন বিশিষ্ট ইমামের ওপর খড়গ নেমে এসেছিল। সে সব বিষয়ে কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গূঢ় অর্থ অনুসন্ধান (তা’বিল), পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অহেতুক অতিরঞ্জিত বিতর্ক উত্থাপন এবং মুসলিম বিশ্বের আল আজহার, আল জায়তুনা, আল কারাবিয়ীন, দেওবন্দ প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের মধ্যে আশারীয়, মাতুরিদিস ও এসবের প্রবক্তাদের মতবাদ খণ্ডনের চেষ্টা করা।
এসব সমস্যার কোনোটি নিয়ে আমাদের ব্যতিব্যস্ত হওয়া উচিত নয। আমাদের মনকে আগামী পর্যায়ে ইহুদীবাদ, ক্রুসেডার, মার্ক্সবাদ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাতের ধ্বংসাত্মক দর্শনের প্রবক্তাদের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
অহেতুক বিতর্ক
যে বাস্তববাদী আদর্শ আমাদের দরকার তা হচ্ছে দরকষাকষি ও বিতর্ক নয় গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের ওপর দৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করা। কেননা আল্লাহ যখন কোনো জাতিকে শাস্তি দিতে চান তখন তিনি তাদেরকে বিতর্ক ও কর্মবিমুখতার মধ্যে ডুবিয়ে দেন। বিতর্ক বলতে আমি সে সব সমস্যা নিয়ে বিতর্ক বোঝাতে চাই যেগুলো ঐতিহাসিক, সম্পূর্ণ অনুমানভিত্তিক অথবা যে সব সমস্যা স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কিত।
একটি বিতর্ক প্রায়শই উত্থাপিত হয় যার কোনো প্রয়োজন নেই কিংবা এ বিতর্কে আজ আমাদের কোনো লাভ হবে না, তা হচ্ছে ইসলামে সশস্ত্র জিহাদের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক। তা ইসলামের ধর্ম বিশ্বাস, পবিত্র স্থান ও ভূখণ্ড রক্ষার্থে আত্মরক্ষামূলক জিহাদ হবে নাকি বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রসারে আক্রমণাত্মক জিহাদ হবে।
সমসাময়িককালের বহু স্কলার এ বিষয়ের ওপর লিখেছেন এবং তারা দু’টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন। জিহাদ হবে আত্মরক্ষামূলক এ মতের সপক্ষে রয়েছেন সাইয়েদ মুহাম্মদ রশীদ রিদা, শায়খ মাহমুদ শালত, শায়খ মুহাম্মদ আবু জাহরা, শায়খ মুহাম্মদ আল গাজালী ও শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ আল মাহমুদ প্রমুখ।
তাদের যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে আল-কোরআনের বহু সংখ্যক আয়াতঃ আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে সীমা লঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভঅলোবাসেন না (সূরা আল বাকারাঃ ১৯০)। অন্যত্র বলা হয়েছেঃ সুতরাং তারা যদি তোমাদের থেকে নিবৃত্ত থাকে ও তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদেরকে শান্তি প্রস্তাব দেয় তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ রোখেননি (সূরা আন নিসাঃ ৯০)।
অন্যমতের পক্ষে রয়েছেন মাওলানা সাইয়েদ আবূল আলা মওদূদী, শহীদ সাইয়েদ কুতুব প্রমুখ।
তাদের যুক্তির ভিত হচ্ছে তলোয়ারের আয়াত (আয়াতুস সাইফ)। তাদের দাবি অনুযায়ী এ আয়াত পূর্বেকার সকল আয়াত রদ করে দিয়েছে এবং যে পরিস্থিতিতে এগুলো নাজিল হয়েছিল তার অবসান ঘটেছে। তবে তারা খোদ তলোয়ারের আয়াত প্রশ্নেও দ্বিমত পোষণ করেছেন, কারণ কোরআনের কোন আয়াতটি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ হতে পারে তা সর্বসম্মতভাবে নির্ধারণ করতে পারেননি।
বর্তমান তিনটি কারণে এ ইস্যু নিয়ে বিতর্কের আর প্রয়োজন নেইঃ
প্রথমত, আমরা মুসলমানরা জিহাদের দায়িত্ব পালন করিনি যা ইসলামী দেশগুলোর প্রত্যেকের জন্যে ফরজ। বিশেষ করে দখলদার ও আগ্রাসীদের হাত থেকে মুসলিম ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করা। আর এ মুসলিম ভূখণ্ডগুলো হচ্ছে ফিলিস্তিন, ইরিত্রিয়া, ফিলিপাইন, আফগানিস্তান, তাসখন্দ, বোখারা, সমরখন্দ, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, সোভিয়েত ইউনিয়নের [১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগের অবস্থা। এখন ছয়টি মুসলিম প্রজাতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এগুলো হচ্ছেঃ আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরঘিজিয়া, কাজাখিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান।] অন্যান্য মুসলিম প্রজাতন্ত্র এবং চীন, ইথিওপিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের অন্যান্য স্থান। কোনো মুসলমানই ইসলাম বিরোধী শক্তির হাত থেকে এসব দেশ উদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার বিপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে পারে না। আর তাদের ব্যাপারে প্রযোজ্য আল্লাহর সিদ্ধান্ত আল-কোরআনের এ আয়াতঃ আর তোমাদের কি হলো যে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করছ না এবং ঐ সব দুর্বল নির্যাতিত ও অত্যাচারিত পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্য যারা প্রার্থনা করছে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে এ জনপদ থেকে উদ্ধার করুন যার অধিবাসীরা অত্যাচারী, আর আমাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে কোনো অভিভাবক দাঁড় করিয়ে দিন যিনি রক্ষা করবেন এবং আমাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে কাউকে পাঠান যিনি সাহায্য করবেন (সূরা আন নিসাঃ ৭৫)।
মুসলিম উম্মাহ এ বাধ্যতামূলক আত্মরক্ষামূলক কর্তব্য পালন করেনি, তাহলে এখন আক্রমণাত্মক জিহাদের কথা কিভাবে উঠতে পারে?
দ্বিতীয়ত, আক্রমণাত্মক জিহাদ হচ্ছে এর প্রবক্তাদের মতে আল্লাহর বান্দাদের পথে যে শক্তি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজে মুসলমানদেরকে বাধা দেয়ার অপচেষ্টা চালায়, তাদেরকে অপসারণ করা। কিন্তু আজ আমাদের পথে কেউ বাধা হতে পারে না যদি আমরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আমাদের দাওয়াত সারা বিশ্বে অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। মৌলিক, লিখিত ও অডিও-ভিডিও মাধ্যমে সকল ভাষায় বিশ্বের সর্বত্র দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়া যায়। বর্তমানে রেডিও, টেলিভিশন, বইপত্র, সংবাদপত্র ও বিশ্বের সকল দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মাধ্যমে দাওয়াতের বাণী পৌঁছে দেয়া যেতে পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের লোকদের অবহেলা অন্তহীন। আমরা যদি খৃস্টান মিশনারীদের সাথে আমাদের কাজ কর্মের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে, তারা তাদের ধর্মমত প্রচারের জন্যে অন্তত এক হাজার ভাষা-উপভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করে হাজার হাজার নারী-পুরুষ মিশনারীকে পৃথিবীর চতুর্দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাদের প্রচারাভিযান এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে তারা এখন আমাদেরকেও খৃস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার ইচ্ছে পোষণ করছে যেন আমরা তাদের অনুসরণ করে চলি।
তৃতীয়ত, আমরা সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে পরনির্ভলশীল। যাদের বিরুদ্ধে আমরা আক্রমণাত্মক জিহাদ শুরু করতে চাই তারাই সবরকম অস্ত্র তৈরী করে এবং আমাদের কাছে বিক্রি করে। এটি যদি তারা না করত, তাহলে তাদের মোকাবিলায় আমরা নিরস্ত্র, প্রতিরক্ষাহীন এবং কোনো কিছুই করতে সক্ষম নই। এ যদি অবস্থা হয়, তাহলে সারা বিশ্বকে আমাদের দাওয়াতের আওতায় আনার জন্যে কিভাবে আক্রমণাত্মক জিহাদের কথা বলতে পারি। যখন আমরা কেবল সেই অস্ত্রই সংগ্রহ করতে পারি যা তারা আমাদেরকে দেয় এবং সেই সব অস্ত্রই কেবল আমাদের হাতে আসতে পারে যেগুলো তারা আমাদের কাছে বিক্রি করতে রাজী নয়।
ঐতিহ্যবাদী আদর্শ
এ আদর্শের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি একটি ঐতিহ্যবাদী (সালাফি) আদর্শ। এখানে ঐতিহ্যবাদী বলতে আমরা বোঝাতে চাচ্ছি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি যা কোরআন ও সুন্নাহর নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত, যার যথার্থ প্রয়োগ প্রথমে প্রজন্মের উম্মাহ-সাহাবিরা করেছিল এবং পরে যারা তাদের পথ সঠিকভাবে অনুসরণ করে।
সালাফি পদ্ধতির মৌলনীতি
সাধারণভাবে এ পদ্ধতির ভিত্তি হচ্ছেঃ
১. কোনো মানুষের উক্তি নয়, অভ্রান্ত মূল গ্রন্থের আলোকে বিশ্লেষণ করা।
২. মূল গ্রন্থের দুর্বোধ্য (মুতাশাবিহাত) বক্তব্যসমূহের অর্থ নির্ণয়ে প্রাঞ্জল বা স্পষ্টভাবে (মুহকামাত) প্রকাশিত বক্তব্যের এবং অনির্দিষ্ট (জান্নিয়াত) বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট (কাতিয়াত) বক্তব্যের আশ্রয় গ্রহণ।
৩. গৌণ (ফুরু) ধারণা এবং সম্পূরক (জুজিয়াত) সিদ্ধান্তগুলো মূলতত্ত্ব ও সাধারণ সূত্রের আলোকে অনুধাবন।
৪. ব্যক্তি পর্যায়ে গবেষণা (ইজতিহাদ) ও নবায়নে (তাজদিদ) উৎসাহ প্রদান এবং অনমনীয়তা ও অনুকরণ (তাকলিদ) নিরুৎসাহিত করা।
৫. নৈতিকতার ক্ষেত্রে শিথিলতা নয়, যথাযথ আমলের প্রতি অটল থকাতে উৎসাহিত করা।
৬. জটিলতা নয় ফিকাহর ক্ষেত্রে সরলতার প্রসার।
৭. পথ নির্দেশনার ও পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্কশ আচরণের মাধ্যমে ভীত সন্ত্রস্ত করার (তানফির) পরিবর্তে মানুষের প্রতি সহৃদয় হওয়া এবং তাদের সামনে সুশৃঙ্খল সুন্দর দৃষ্টান্ত (তাব্শির) তুলে ধরা- এ নীতি প্রয়োগে উৎসাহিত করা।
৮. ঈমানের প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক নয়, খাঁটি ও সুদৃঢ় ঈমান গড়ার প্রতি মনোযোগী হওয়া।
৯. ইবাদতের ক্ষেত্রে পদ্ধতির নয়, পরিতৃপ্তির প্রতি মনোযোগী হওয়া।
১০. ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার প্রতি মনোযোগ দেয়া এবং পার্থিব বিষয়ের রীতিনীতি উদ্ভাবনে সচেষ্ট হওয়া।
প্রাথমিক যুগের মুমিনদের অনুসৃত পদ্ধতির এটিই হচ্ছে মূলকথা এবং উম্মাহর ঐ প্রজন্মের মনীষীদের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষায় এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ সা. এ পদ্ধতির অনুসরণকারীদের প্রশংসা করেছেন। ইতিহাস থেকেও আমরা জানতে পারি, এ পদ্ধতি সত্যিই প্রশংসাযোগ্য।
কারণ প্রাথমিক যুগের মনীষীরা তাদের উত্তরাধিকারীদের কাছে পবিত্র কোরআনের শিক্ষা রেখে গেছেন এবং এ কোরআনের আলোকে তারা জীবন গড়ে অনুমোদিত জীবনাচরণকে সংরক্ষণ, বিজয় অর্জন, ন্যায় বিচার ও কল্যাণকামিতার প্রসার ঘটিয়েছেন এবং জ্ঞান ও বিশ্বাসের ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। এভাবে তারা এক বিশ্বজনীন, নৈতিকতাবাদী, মানবতাবাদী ও ধর্মীয় সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন, যার অম্লান স্মৃতি ইতিহাসের পাতায় এখনো জাগরুক।
সালাফিয়া আদর্শের ভুল ব্যাখ্যা
ঐতিহ্যবাদী (সালাফিয়া) পরিভাষাটির ভুল ব্যাখ্যা করেছে এর অনুসারী ও বিরোধীরা একইভাবে।
সালাফিয়া আদর্শের প্রবক্তা এবং তাদের সমর্থকদের অনেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক ধর্মতত্ত্ব (ইলমুল কালাম ফিকাহ) অথবা সুফিদের বিষয়গুলোকে একটি আনুষ্ঠানিক কাঠামো ও যুক্তিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। যারা এসব ইস্যুতে সালাফিয়া মতের বিরোধী কিংবা খুঁটিনাটি বিষয়ে সালাফি মত খণ্ডন করে তারা দিনরাত সালাফিদের কঠোর সমালোচনায় লিপ্ত থাকে।
তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এতো অযৌক্তিক যে কেউ কেউ সালাফি আদর্শকে একটি তর্কশাস্ত্রের পদ্ধতি বলে মনে করেন যা গঠনমুলক বা কর্মমুখী নয় অথবা এ পদ্ধতি সর্বজনীনের পরিবর্তে খুঁটিনাটি ব্যাখ্যার ওপর, অনুমোদিত ভাবধারার স্থলে বিতর্কিত ভাবধারার ওপর এবং নিগূঢ় অর্থের পরিবর্তে বাহ্যিকতার ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়।
সালাফি পদ্ধতির বিরোধীরা এটিকে পশ্চাৎপদ চিন্তা বলে মনে করে। এ পদ্ধতি সর্বদা পেছনে তাকায়, সামনে এগোয় না এবং কখনোই বর্তমান বা ভবিষ্যতের পরোয়া করে না। তারা সালাফিদেরকে গোঁড়া বলে আখ্যা দেয়, যারা অপরের মতামতের তোয়াক্কা করা তো দূরের কথা শুনতেও নারাজ। বিরোধীরা সালাফিদের এ মানসিকতাকে নবায়ন (তাজদিদ), উদ্ভাবন (ইবদা) ও ইজতিহাদের পরিপন্থী মনে করে যাতে নমনীয়তার কোনো নমুনাই দেখা যায় না। বস্তুত প্রকৃত সালাফি আদর্শ এবং তার সত্যিকার প্রবক্তাদের প্রতি এটি অবিচার।
সম্ভবত সালাফি আদর্শের পূর্ব যুগের সবচেয়ে খ্যাতনামা প্রবক্তা হচ্ছে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এবং তার শিষ্য ইবনুল কাইয়েম। তারা তাদের কালের ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের সত্যিকার অর্থে যোগ্যতম প্রতিনিধি। তারা গত কয়েক শতক ধরে ইসলামী চিন্তাধারার ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী অন্ধ অনুকরণ (তাকলিদ) এবং আদর্শিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও ফিকাহ কেন্দ্রিক গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাদের আন্দোলনের পুরোটাই ছিল ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণ করা।
অবশ্য তারা তাকলিদের গোঁড়া পদ্ধতির বিরোধিতা করলেও মাজহাবের ইমামদের প্রাপ্য যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করেন। ইবনে তাইমিয়ার ‘লিফটিং দি ব্লেইম অফ্ দি প্রমিনেন্ট ইমামস’ গ্রন্থে এর প্রমাণ রয়েছে।
তদুপরি, আদর্শগত ও তাত্ত্বিক বিচ্যুতি বিশেষ করে হুলুল ও ইজতিহাদের প্রবক্তাদের নীতিভ্রংশতা এবং জাহেল, ভণ্ড ও ভাড়াটে লোকদের মারফত সুফিবাদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট আচরণগত বিপথগামীতার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালালেও ইবনে তাইমিো ও ইবনুল কাইয়েম প্রকৃত সুফিবাদ এবং এর প্রবক্তাদের প্রতি সুবিচার এবং শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন। তারা এ বিষয়ে অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ইবনে তাইমিয়ার ফতোয়া সম্বলিত দুই খণ্ডের গ্রন্থ ‘মাজমু ফতোয়া’ এবং ইবনুল কাইয়েমের বেশ কয়েকটি বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘মাদারিজ আল সালিকিন’ এবং তিন খণ্ডে ‘শারাহ মানাজিল আল সায়েরিন’।
পদ্ধতি গ্রহণ
আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কেবল সিদ্ধান্ত নয় বরং তাদের অনুসৃত পদ্ধতিও অবলম্বন করতে হবে। কেননা কেউ কোনো বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে পারেন, কিন্তু তাদের সুষম ও সুসংহত পদ্ধতির ব্যাপারে কিছুই জানতে পারবেন না।
কেউ এ পদ্ধতির তাৎপর্য প্রয়োগ ও এর লক্ষ্য অনুধাবনে যেমন সচেষ্ট হতে পারেন, তেমনি এর পাশাপাশি প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কোনো কোনো সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমতও পোষণ করতে পারেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও ইমাম ইবনুল কাইয়েমের ব্যাপারে আমার অবস্থান এরূপ। আমি তাদের সামগ্রিক পদ্ধতিকে সম্মান করি ও সঠিকভাবে মূল্যায়ন করি। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে আমি তাদের সব মতামতকে গ্রহণ করি। আমি যদি তাদের সব বক্তব্য গ্রহণ করি, তাহলে তাদের অনুকরণ করা হবে। আর এভাবে তারা যে পদ্ধতির প্রবক্তা সেটারই লঙ্ঘন করা হবে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে তাদেরকে তীব্র বিরোধিতা ও দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ তাদের পদ্ধতি গভীর চিন্তা, প্রমাণ সাপেক্ষ রায় নির্ভর সিদ্ধান্ত প্রদানকারী ব্যক্তি নিয়ে নয়। যে কোনো সিদ্ধান্ত যাচাই বাছাই করতে হবে খোদ ঐ সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি ও গুরুত্বের আলোকে।
যে ব্যক্তি ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কাইয়েমকে অন্ধ অনুকরণ (তাকলিদ) করেন তিনি কিভাবে ইমাম আনু হানিফা ও ইমাম মালিকের তাকলিদকারীদের সমালোচনা করতে পারেন?
এ ইমামদ্বয়ের জীবনের কেবল তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকের ওপর আলোকপাত করে তাদের জীবনের অন্যান্য উজ্জ্বল দিকগুলো উপেক্ষা করাও অন্যায় হবে। ইবনে তাইমিয়ার সেই সৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের উপেক্ষা করা উচিত হবে না যার প্রতিফলন ঘটেছে তার এ উক্তিতেঃ একটি কথা আমি প্রায়ই বলি বেহেশতবাসীরা যদি আমার মতো জীবনযাপন করে থাকে তাহলে তারা সত্যিই সুন্দর জীবন যাপন করছে। দুর্দশা ও বন্দী জীবন কাটানোর সময়েও তিনি বলতে পেরেছিলেন শত্রুরা আমার কী ক্ষতি করতে পারে? আমার বন্দিদশা তো নির্জনে ইবাদতের জন্যে। আমার নির্বাসন তো দ্বীনি সফর যা মূলত জ্ঞানের সন্ধান। আর আমার মৃত্যু তো শাহাদাত।
তিনি ছিলেন রূহানী মেজাজের মানুষ এবং তার শিষ্য ইবনুল কাইয়েমও ছিলেন একই রকম। যারা তাদের রচনাবলী মনোযোগ ও নেক নিয়ত নিয়ে অধ্যয়ন করবেন, তারা অবশ্যই এটি অনুধাবন করতে পারবেন। তদুপরি, এ দুই ইমামের জীবনে দাওয়াত ও জিহাদে সাহায্য করার দিকটিও আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়। ইবনে তাইমিয়া নিজেই বেশ কয়েকটি সামরিক লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। সশরীরে যুদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি তার কণ্ঠনিঃসৃত বাণী দিয়েও অন্যান্য মুজাহিদদের হৃদয়ে অনুপ্রেরণার অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করেছেন। এ দুই ইমাম ইসলামের পুনর্জাগরণে অবিশ্রান্ত সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আর ঐকান্তিক সংগ্রামের কারণে বেশ কয়েকবার কারাগারে গিয়েছেন। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ৭২৮ হিজরীতে কারাগারের ইন্তেকাল করেন। প্রকৃত ঐতিহ্যবাদের এটিই হচ্ছে অনন্য দৃষ্টান্ত।
আমরা যদি আমাদের সমসাময়িক ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, সবচেয়ে প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব সাইয়েদ মুহাম্মদ রশীদ রিদা তার রচনাবলী, বই-পুস্তক ও স্বীয় ম্যাগাজিনের মাধ্যমে আধুনিক ঐতিহ্যবাদী পতাকাবাহক ও সালাফি পদ্ধতির প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ‘আল মানার’ সাময়িকীর তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। এ ম্যাগাজিনেই তিনি ‘আল মানার তাফসীর’ প্রকাশ করেন যা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত হয়।
ইমাম মুহাম্মদ রশীদ রিদা ছিলেন তার সময়ে সত্যিকার অর্থে ইসলামের পুনরুজ্জীবনবাদী। যে কেউ তার তাফসীর, ফতোয়া কিংবা পুস্তক ‘দি ইন্সপিরেশন অব মুহাম্মদ’, ‘দি ফ্যাসিলিটি অব ইসলাম’, ‘এ কল টু দি ফেয়ার সেক্স’, ‘দি খলিফা’, ‘দি আরগুমেন্টস অব দি রিফর্মার এন্ড দি ইমিটেটর’ এবং অন্যান্য বহু বই ও রচনাবলী পাঠ করবেন তাহলে তিনি অবশ্যই উপলব্ধি করবেন যে তার চিন্তাধারা সত্যিই একটি আলোকবর্তিকা (মানার) ছিল। এ ‘মানারই’ ইসলামের অনুসারীদেরকে আলোর পথ দেখিয়েছে- তার জীবনও ছিল সালাফি আদর্শের এক বাস্তব নমুনা
ইমাম রিদা এক সোনালী সূত্রের উদ্ভাবক ছিলেন, পরবর্তীকালে ইমাম হাসান আল বান্না যা অনুসরণ করেন। সূত্রটি হচ্ছেঃ আমরা যে বিষয়ে একমত সে সব ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা করা উচিত। আর যে বিষয়ে মতপার্থক্য বিদ্যমান তা পরস্পর এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
কী অপূর্ব সূত্র। [আমি এ সূত্রের যথার্থতা প্রতিপন্ন করে এবং এর সমর্থনে শরীয়াহর সাক্ষ্য প্রমাণ উল্লেখ করেছি ‘কনটেম্বরারি ফতোয়া’ গ্রন্থে।] ঐতিহ্যবাদের প্রবক্তারা শুধু যদি এ সূত্রটি যথার্থভাবে উপলব্ধি ও অনুসরণ করতেন, কতই না ভালো হতো।
পুনরুজ্জীবনবাদী আদর্শ
আমরা যে আদর্শ চাই তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি পুনরুজ্জীবনবাদী। এটি না প্রাচীন ধারার মধ্যে সীমিত, না উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, না এটি প্রচলিত রীতি বা অভ্যাসের অনুগত। এটি এমন এক আদর্শ যা ইজতিহাদে বিশ্বাস করে এবং সৃজনশীলতাকে অবলম্বন করে কেননা এ আদর্শ অন্ধ অনুকরণ (তাকলিদ) ও নির্বিচার আনুগত্য প্রত্যাখ্যান এবং স্থবিরতাকে মৃত্যুর শামিল মনে করে। এটি ফিকাহ, শিক্ষা, রাজনীতি ও অন্য সকল ক্ষেত্রে পুনর্জাগরণে বিশ্বাস করে।
পুনরুজ্জীবনবাদ ঐতিহ্যবাদের বিরোধী নয়
আমার ‘দি ইসলামি এয়োকেনিং এন্ড দি উজ অব দি আরব মুসলিম ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে এ বিষয়টি ব্যাখ্য করেছি। পুনরুজ্জীবনবাদী ও ঐতিহ্যবাদী আদর্শের মধ্যে কোনো অসঙ্গতি বা বিরোধ নেই। বরং এ দু’টি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। প্রকৃত পুনরুজ্জীবন কেবল তখনই সম্ভব যখন তা ঐতিহ্যমুখী হয় এবং ঐতিহ্যকে কেবল তখনই সংরক্ষণ সম্ভব যখন তা পুনরুজ্জীবন আদর্শে বিশ্বাসী হয়।
পুনরুজ্জীবনবাদের অনুমোদন
আমাদের কখনো বলা উচিত নয় উৎস, দিক-নির্দেশনা, লক্ষ্য ও নীতির দিক দিয়ে ইসলামী আন্দোলন একটি অনমনীয় বিষয় এবং সেখানে পুনর্জাগরণের অবকাশ নেই।
ইসলাম স্বয়ং পুনরুজ্জীবনের বৈধতা অনুমোদন করে। সহীহ হাদিসে বলা হয়েছেঃ আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক শতবর্ষের শুরুতে এমন কাউকে পাঠাবেন যিনি এ দ্বীনের পুনরুজ্জীবন ঘটাবেন (আবু দাউদ ও আল হাকিম)।
পুনরুজ্জীবনবাদ (তাজদিদ) বৈধ এবং হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সা. যা বলেছেন তার চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে? অতএব সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত দ্বীনে পুনরুজ্জীবনের কথা শুনে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের যা করা উচিত তা হচ্ছে পুনরুজ্জীবনের তাৎপর্য অনুধাবন করা যাতে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল তাদের তথাকথিত পুনরুজ্জীবনের নামে দ্বীনকে ব্যবহার করতে না পারে। কারণ এসব লোক পুনরুজ্জীবন থেকে বহুদূরে।
আমি এ হাদিসের ওপর গবেষণা করে লিখিত এক নিবন্ধে পুনরুজ্জীবনের অর্থ, এর বিভিন্ন দিক এবং কারা এর উদ্যোক্তা হতে পারেন সে সব বিষয় ব্যাখ্যা করেছি। সংক্ষেপে, পুনরুজ্জীবন মানে কোনো কিছুকে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছিয়ে অন্য কিছুর স্থলে এটিকে বসিয়ে দেয়া নয়। বরং এটি অস্তিত্ব লাভের সময় যেমন ছিল যথাসম্ভব সেই আকারে এটিকে পুনরুদ্ধার করা এবং বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণভাবে এর মৌলিক প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও আঙ্গিক বজায় রাখা। তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় অর্থে এটি প্রযোজ্য। একটি পুরানো ভবন যেমন একটি প্রাসাদ, সৌধ অথবা মসজিদ পুনর্নির্মাণ করার অর্থ এটি গুঁড়িয়ে দিয়ে সর্বাধুনিক নির্মাণ শৈলী অনুযায়ী সে স্থানে আরেকটি ভবন নির্মাণ করা নয়, বরং যথাসম্ভব আদিরূপে তা সংস্কার করার জন্যে সর্বপ্রকার যত্ন নেয়া। আর তাই হচ্ছে প্রকৃত পুনরুজ্জীবন।
দ্বীনের পুনরুজ্জীবন অর্থ হচ্ছে এর ফিকাহ বা উপলব্ধির পুনরুজ্জীবন। আর তাই হচ্ছে এক আদর্শিক পুনরুজ্জীবন। দ্বীনের প্রতি ঈমানের পুনর্জাগরণ হচ্ছে এক আধ্যাত্মিক অনুভূতি। দ্বীনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা এবং দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে নবোদ্যমে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে সত্যিকার অর্থে পুনরুজ্জীবন। প্রত্যেক যুগে যুগোপযোগী পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন যা সমসাময়িক ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর এবং ঐ যুগের ব্যাধিগুলোর নিরাময় করবে।
কিন্তু এমন একটি ক্ষেত্র আছে যেখানে পুনরুজ্জীবন কোনো অবস্থাতেই হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তা হচ্ছে সেই সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যে ব্যাপারে ইসলাম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে। এগুলো হচ্ছে আকীদা, ইবাদত ও আইন কানুনের (আহকাম) বিভিন্ন দিক যার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আচরণগত ঐক্য প্রতিফলিত হয়েছে। আমি অন্যান্য গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। [আমার ‘ইজতিহাদ ইন দি ইসলামিক শরীয়াহ’ বইয়ের ‘গাইড লাইনস এন্ড কন্ট্রোলস ফর এ প্রপার কনটেম্বরারি ইজতিহাদ’ শীর্ষক অনুচ্ছেদ। উস্তাদ উমর আবেদ হাসানা রচিত গ্রন্থ ‘দি ফিকাহ অব দি দাওয়াহঃ ইটস ফিচারস এন্ড হরাইজনস’ বইয়ের ‘ইজতিহাদ এন্ড রিনিউয়াল বিটুইন লিগ্যাল কন্ট্রোলস এন্ড কনটেম্বরারি নিডস’ শীর্ষক অনুচ্ছেদ, পৃষ্টা ১৪৭–১৮৮।]
কৌশল পুনর্বিন্যাস
আন্দোলন যদিও উৎস, পারিপার্শ্বিক অবস্থান, নীতি ও লক্ষ্যের বিচারে ইসলামী, কিন্তু এমন কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় যা সময়, স্থান ও অবস্থার প্রেক্ষিতে দ্বীন পালনে সহায়ক এবং পৃথিবীতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার উপযোগী হয়।
কৌশল, পদ্ধতি ও ব্যবস্থা ইসলামের মতো অবিনশ্বর নয়। ইসলামের মৌলিক নীতি ও তত্ত্বেও মতো এসব সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কেননা হৃদয়ে ও বাস্তব জীবনে ইসলামের পুনরুজ্জীবন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানবীয় চেষ্টা সাধনার ফলেই কৌশল পদ্ধতি প্রণীত হয়।
ইমাম হাসান আল বান্না ইসলামী পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলনের সুসংঘবদ্ধ কাজের জন্যে বিধান রচনা করেন। তিনি নিজকে বা আল্লাহর মেহেরবানীতে যে কৌশল প্রণয়ন করেছিলেন তা অভ্রান্ত বলে দাবি করেননি। অথচ তার কৌশল এতোই শক্তিশালী ছিল যে সাইয়েদ কুতুব শহীদ তা বুদ্ধিদীপ্ত গঠন কৌশল বলে অভিহিত করেন। ইখওয়ানের মুর্শিদ আল আম ওমর আল তিলমিসানী তাকে বর্ণনা করেছিলেন প্রেরণাদীপ্ত ও প্রতিভাময় নেতা হিসেবে। আর শায়খ মুহাম্মদ আল গাজালী বলেছেন, ইমাম হাসান আল বান্না ছিলেন হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দেদ। এসব পদ্ধতি কৌশল সময়ে সময়ে পর্যালোচনা সাপেক্ষ ঠিক যেমন শিক্ষাবিদরা পাঠ্যক্রম ও রেফারেন্স পুস্তক প্রতি বছর পর্যালোচনা করে সংযোজন, বিয়োজন বা সংশোধন করে থাকেন। যে কোনো মানবীয় কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন রয়েছে। সে প্রচেষ্টা যথার্থতার বা উৎকর্ষতার কাছাকাছি হোক বা না হোক।
হাসান আল বান্না নমনীয় ছিলেন
ইমাম হাসান আল বান্না নিজে নমনীয় ছিলেন। তিনি সব সময় আন্দোলনের কাঠামো, প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির কলাকৌশল পুনর্মূল্যায়ন ও উন্নয়ন করতেন। তিনি কোনো একটি ইস্যুতে আগে যে মত দিয়েছিলেন সে ব্যাপারে তার কোনো ভক্ত অনুসারী যদি বিরুদ্ধ মত পোষণ করত তাতে ক্ষুব্ধ হতেন না। ইসলামী রাষ্ট্রে বহুদলীয় ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আমার এক রচনায় আমি তার মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলাম।
কেউ তার মৌলনীতিসমূহের সঙ্গে সম্পূরক কোনো কিছু যোগ করে দিলেও তাতে তিনি কিছু মনে করতেন না। যেমন শায়খ মুহাম্মদ আল গাজালী তার ‘দি কনস্টিটিউশন অব দি কালচারাল ইউনিটি ফর মুসলিমস’ গ্রন্থে হাসান আল বান্নার বিশ দফা মৌলনীতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এরকম করেছিলেন। ইখওয়ানের প্রশিক্ষণের উসরা ও কাতিবার [কাতিবা হচ্ছে ইখওয়ানের একটি রূহানী প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। প্রশিক্ষণার্থী সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে অথবা প্রতি দু’সপ্তাহে নফল ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে রাত্রিযাপন করেন।] শিক্ষার কৌশলপদ্ধতি পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রে কোনো বিধিগত, ঐতিহ্যগত অথবা মানসিক বাধা ছিল না যাতে কর্মকৌশলে নতুন কিছু সংযোজন করা যায়।
স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তন ও ঘটনাপ্রবাহের আলোকে রাজনৈতিক কৌশল পর্যালোচনা করাতে কোনো ক্ষতি নেই। চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ইসলাম, উম্মাহ ও আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থে ফ্রন্ট বা এলায়েন্সে অংশগ্রহণ কিংবা চুক্তি বা জোটে শামিল হওয়া যেতে পারে। প্রতিটি দেশে একটি বিশেষ পরিবেশ থাকে, প্রতিটি যুগের বিশেষ নিয়ম থাকে এবং প্রত্যেক গ্রুপের থাকে নিজস্ব সামর্থ্য, তাগিদ ও অবস্থান যা সংশ্লিষ্ট গ্রুপ অন্য যে কোনো গ্রুপের চেয়ে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল থাকে।
ইসলামী আন্দোলন ফিকাহ ও অন্যান্য শরীয়াহ সংক্রান্ত শাস্ত্রের মতো অধ্যবসায়ী ও সৃজনশীল মনন ছাড়া অস্তিত্বমান, সমৃদ্ধিশীল ও বিকাশমুখী হতে পারে না। আর অন্ধ অনুকরণকারীদের মন মানসিকতার খপ্পরে পড়লে আন্দোলন কেবল স্থবির, সঙ্কুচিত ও শক্তিহীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ অন্ধ অনুকরণকারীদের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তা চেতনায় সৃজনশীল মননের প্রতিপালন ঘটে না।
অনমনীয়তা একটি ব্যাধি
অনমনীয়তা এমন একটি রোগ যা ইসলামী আন্দোলনের সুসংহত পদ্ধতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং ভেতর থেকেও আন্দোলনের পথে একটি অন্যতম বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আমার ‘দি ইসলামিক সলিউশনঃ এ ফরিদাহ এন্ড এ নেসেসিটি’ গ্রন্থে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছি।
অনমনীয়তা হচ্ছে সংগঠনে একটি একগুঁয়ে ধারা, শিক্ষায় স্থবির প্রক্রিয়া, দাওয়াতি কাজে একরোখা কৌশল, লক্ষ্য অর্জনে অনড় পদ্ধতি এবং কৌশল পরিবর্তন বা সংশোধনের চেষ্টা করে তাহলে তার প্রচেষ্টা কেবল ঈর্ষার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা হয় না, এমন কি সে নানা অপবাদ অভিযোগেরও সম্মুখীন হয়।
আমি আবারো জোর দিয়ে বলতে চাই, আমরা যে পুনরুজ্জীবন (তাজদিদ) চাই তার অর্থ পুরানো পথার অবলুপ্তি নয় বরং পুরানো প্রথার আধুনিকায়ন, উন্নয়ন, মান উন্নীতকরণ এবং নব নব সংযোজন বিশেষ করে কলাকৌশল ও পদ্ধতির ক্ষেত্রে, যা হবে স্বাভবিকভাবেই নমনীয় ও পরিবর্তনশীল। আমরা যেন সমসাময়িক আয়ত্তাধীন এসব কলাকৌশল অন্যদের মতোই কাজে লাগাতে পারি।
যা নিয়ে আমার ভয়
ইসলামী আন্দোলনের যে বিষয়কে আমি সবচেয়ে ভয় করি তা হচ্ছে এরা মুক্তচিন্তার বিরোধী এবং তাজদিদ ও ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে কেবল এক ধাঁচের চিন্তার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে, যা অন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতকে গ্রাহ্য করে না। এসব মতামতে আন্দোলনের জন্য ভিন্ন লক্ষ্য, কৌশল ও পর্যায়ক্রমে নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। ঘটনাপ্রবাহ, পরিস্থিতি ও মানুষ সম্পর্কে ভিন্ন ধরণের পর্যালোচনা পেশ করা হয় অথবা মানবীয় ইজতিহাদের আওতায় পড়ে এমন কোনো বিষয়ে একদেশদর্শী চিন্তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করা হয়। কারণ মানবীয় ইজতিহাদ পরিবর্তনশীল অবস্থার আলোকে সব সময় পরিবর্তন সাপেক্ষ। আমাদের ফকিহরা অনেক আগেই বলে গেছেন- স্থান, কাল, প্রথা ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে ফতোয়ার অবশ্যই পরিবর্তন হবে।
আমার ভয় যদি বাস্তবে রূপ নেয় তাহলে নব নব চিন্তা ও উদ্ভাবনে সক্ষম মননশীল মানুষ আন্দোলনের কাঠামো থেকে ছিটকে পড়বে যেমন আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পানি গড়িয়ে যায়। পেছনে থেকে যাবে সেই সব রক্ষণশীল ব্যক্তি যারা কেবল অন্ধ অনুকরণে পারদর্শী এবং যারা সব কিছু তা যতই প্রাচীন হোক না কেন বহাল রাখতে চায়। তাদের বিশ্বাস, আমরা যা জানি তা আমরা যা জানি না তার চেয়েও উত্তম এবং আমরা যা কিছু করেছি তা এখনো যা করতে পারিনি তার চেয়েও উত্তম।
এর পরিণতি এ হবে যে আন্দোলন তার সাংগঠনিক কাঠামো থেকে সৃজনশীল মেধার অধিকারী মানুষকে হারাবে এবং অনিবার্যভাবে স্থবির অথবা নির্জীব অবস্থার শিকার হবে যেমন তাকলীদের জামানায় ফিকাহ শাস্ত্র ও সাহিত্যের করুণ পরিণতি হয়েছিল। আন্দোলনের বাদ বাকি সদস্যরা ইসলামের সহায়তায় কোনো ফলপ্রসূ চেষ্টার আশা নেই দেখে চুপিসারে নিজেদের গুটিয়ে ফেলবে অথবা তারা এককভাবে নিজেরা কাজ করবে বা অন্যান্য কোনো সমন্বিত উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলবে যার পরিণাম কেউ জানে না।
যুগে যুগে মুসলিম মানসের সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করেছে এ প্রবচনটি- পূর্বসূরিরা উত্তরসূরিদের নতুন কিছু সংযোজন করার জন্যে ফেলে যাননি। অথবা অন্য কথায় এর চাইতে ভালো আর হতে পারে না।
বর্তমানে মুসলিম মানসের জন্যে এ প্রবচন অবলম্বন করা ছাড়া অন্য আর কিছুই উপকারী হতে পারে না আর তা হচ্ছে- পূর্বসূরিরা তাদের বহু আরদ্ধ কাজ উত্তরসূরিদের জন্য রেখে গেছেন অথবা এর চাইতে ভালো সব সময়ই হতে পারে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেনঃ এবং তিনি এরূপ বহু জিনিসও সৃষ্টি করেন, যে ব্যাপারে তোমরা জান না (সূরা নাহ্লঃ ৮)।
ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শ
আমরা যে আদর্শ চাই তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা উদ্দেশ্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ভারসাম্যপূর্ণ। কারণ তা এমন এক সুষম আদর্শ যা মানুষ ও জীবনের প্রতি এক মধ্যম, সমন্বিত ও প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায়। এ হচ্ছে চরমপন্থা ও ঔদাসীন্য থেকে মুক্ত এক সংহত ও সুষম উম্মাহর এক ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রধান প্রধান ইস্যুতে ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শ
বিভিন্ন প্রধান প্রধান ইস্যুতে এ আদর্শের দৃষ্টিভঙ্গির ভারসাম্য সুস্পষ্টঃ
১. এ আদর্শ ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যারা নির্দিষ্ট মাজহাব কঠোরভাবে অনুসরণের প্রবক্তা এবং যারা লা মাজহাবী উভয়ের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ।
২. এ আদর্শ যারা সুফিবাদকে ইবাদতের ক্ষেত্রে বিপথগামী অথবা মিথ্যাচরী যাই হোক না কেন সমর্থন করে এবং যারা সুফিবাদ যতোই সঠিক ও শরীয়াহসম্মত হোক না কেন তার বিরোধিতা করে- উভয়ের মাঝে সুষম দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে।
৩. এ আদর্শ নিয়ন্ত্রণাহীন মুক্তদ্বার নীতি এবং অযৌক্তিক রূদ্ধদ্বার নীতির প্রবক্তাদের মধ্যে ভারসাম্য অবস্থান বজায় রাখে।
৪. এ আদর্শ কোনো বিষয় কোরআন সুন্নাহর বিরোধী হলে যারা যুক্তির আশ্রয় নেয় এবং যারা কখনো কোরআন সুন্নাহ অনুধাবনে যুক্তির আশ্রয় নেয় না উভয়ের মাঝে সুষম দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে।
৫. এ আদর্শ যারা উত্তরাধিকারকে মানবীয় ব্যর্থতা সত্ত্বেও পবিত্র মনে করে এবং যারা উত্তরাধিকারের মাঝে ঐশী প্রেরণা নিহিত থাকলেও অগ্রাহ্য করে এ দু’য়ের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ।
৬. এ আদর্শ যারা শিক্ষাকে বাদ দিয়ে রাজনীতিতে নিয়োজিত হয় এবং যারা শিক্ষায় আত্মনিয়োগের অজুহাতে রাজনীতিকে সম্পূর্ণরূপে অবহেলা করে এ দু’য়ের মাঝে সুষম।
৭. এ আদর্শ ফল পাকার আগেই যারা সুফল পেতে চায় এবং ফল পেকে অন্যের হাতে না পড়া পর্যন্ত যারা ফল দেখতেই পায় না এ দু’য়ের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ।
৮. এ আদর্শ যারা কেবল বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত, ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে না এবং যারা ভবিষ্যতের ভাবনায় অতিশয় বাড়াবাড়ি করে উভয়ের কাছে ভারসাম্যপূর্ণ।
৯. এ আদর্শ যারা সাংগঠনিক কাঠামোর অধীনে কাজ করাকে বন্দেগীতূল্য মনে করে এবং যারা কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে কাজ করাকে প্রাধান্য দেয়- উভয়ের মাঝে সুষম।
১০. এ আদর্শ যারা সংগঠনের নেতার আনুগত্য করতে গিয়ে অতিভক্তির পর্যায়ে চলে যায় এবং যারা স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে যেন তারা সংগঠনের সদস্যই নয় এ উভয় গ্রুপের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে।
১১. এ আদর্শ স্থানীয় অবস্থা বিবেচনা না করেই যারা বিশ্বব্যাপী কার্যক্রমের প্রবক্তা এবং বিশ্ব আন্দোলনের সাথে কোনো সম্পর্ক না রেখে যারা সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিক কার্যক্রমে বিশ্বাসী তাদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।
১২. এ আদর্শ যারা বাধাবিপত্তির তোয়াক্কা না করেই অতি আশাবাদী এবং যারা অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখে না এমন অতি নৈরাশ্যবাদীদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে।
১৩. এ আদর্শ যারা নিষেধ করতে গিয়ে এমন চরমে পৌঁছায় যে দুনিয়ায় হালাল বলে কিছুই নেই এবং যারা ছাড় দিতে গিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করে যেন হারাম বলে কিছু নেই এ দু’য়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।
এ ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শই আমরা চাই। যদিও আমাদের আজকের সমাজের নিয়ম হচ্ছে কোনো একটি চরম পন্থাকে আঁকড়ে থাকা তা অতি বাড়াবাড়িই হোক বা চরম উদাসীন হোক। এর ব্যতিক্রম খুবই কম।
ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অবক্ষয়
কোনো কোনো ইসলামপন্থী কেবল দুটি রঙ দেখতে পান- সাদা আর কালো। তারা অন্য কোনো রঙ না চেনেন, না দেখতে পান কোনটি মৌলিক ও কোনটি মিশ্র রঙ, যে রঙ অন্যেরা দেখতে পায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ সকল রঙ বাদ দিয়ে নিজের দৃষ্টি এমন কি জীবনকে একটি মাত্র কালো রঙের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখেন। তারা মানুষ ও বস্তুকে কালো ফিল্মে আচ্ছাদিত চোখ দিয়ে দেখেন।
তারা এ কালো হতাশাবাদী দৃষ্টি দিয়েই প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব তৈরী রাখেন এবং কাকে বা কোথায় গিয়ে লাগল তার পরোয়া না করেই মিসাইলের মতো ছুঁড়ে দেন। তাদের কাছে গোটা সমাজই ইসলামপূর্ব যুগের মতোই জাহেল। জীবনের সব কিছুই পাপ। সব লোক হয় বেঈমান, নয় তো মুনাফিক। দুনিয়া অপশক্তিতে পূর্ণ, গোটা জগত অকল্যাণে পূর্ণ।
তাদের চোখে সমসাময়িক যুগে মানুষ যা কিচু করে তা হারাম ছাড়া কিছু নয়। সকল সঙ্গীত, অভিনয়, নাটক এবং শিল্পকলা হারাম।
হতাশাবাদীরা সাহসিকতার সঙ্গে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। অথচ আমাদের পূর্বসূরিরা সন্দেহাতীতভাবে হারাম বলে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত হারাম শব্দটি ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। আল-কুরআনের দু’টি আয়াতে মদের নিন্দা করে বলা হয়েছেঃ তারা আপনাকে মদ ও জুয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, উভয়ের ব্যবহারের মধ্যে গুরুতর পাপ রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু কল্যাণও আছে। আর এ দু’টোর মধ্যে কল্যাণ অপেক্ষা পাপই অধিক গুরুতর (সূরা আল বাকারাঃ ২১৯)।
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ এবং তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের নিকটেও যেও না (সূরা আন নিসাঃ ৪৩)। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. এর কোনো কোনো সাহাবি রা. মদপান অব্যাহত রাখেন এবং কেউ কেউ বললেন, ইয়া আল্লাহ, মদের ব্যাপারে আমাদের কাছে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাঠান, এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি জানানো হয় সূরা মায়েদার ৯০ নং আয়াতেঃ এ হতে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকো, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হতে পার।
আমাদের স্বীকার করতে হবে যে পঞ্চাশের দশকে বেশকিছু জাহেলী চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে। এসব চিন্তাধারা ইসলামী সমাজেও এমন মাত্রায় বিস্তার লাভ করে যে সব কিছু প্রত্যাখ্যান, হতাশা, সংশয় এবং মুসলমানসহ অন্যদের অভিযুক্ত করার প্রবণতা চিন্তার প্রধান ধারা হয়ে দাঁড়ায়।
সে সময়ে অন্যকে পাপী, অবিশ্বাসী এমন কি কাফের বলে রায় দেয়ার প্রবণতার ক্ষেত্র তৈরী হয় এবং এ রকম একটি নিপীড়নমূলক পরিবেশে এ চিন্তাধারা বিকাশে সহায়ক হয়। আর এমনি পরিবেশেই ইসলামী আন্দোলন এবং তার অনুসারীরা ঐ সময়ের সম্মুখীন হয়। ঐ সময়ে ইসলামী আন্দোলনের অনুসারীদেরকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। গোপনে তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়া হয়। অন্য সব ধরণের নিপীড়নও চালানো হয়। অন্য দিকে কমিউনিস্ট, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও ইসলামের শত্রুদের জন্যে সকল দরজা খুলে দেয়া হয়।
এ সময়েই শহীদ সাইয়েদ কুতুবের বইগুলো প্রকাশিত হয় যাতে তার সর্বশেষ চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটে। এসব গ্রন্থ সমাজকে একটি অবিশ্বাসী সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করে ইসলামী দাওয়াতের কাজ স্থগিত করার তাগিদ দেয়া হয়। ইসলামী ফিকাহর পুনরুজ্জীবন ও বিকাশ এবং ইজতিহাদের পুনরুজ্জীবনের নব উদ্যোগকে ব্যঙ্গ করা হয়। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাধারণভাবে সব মানুষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক জিহাদ শুরুর ডাক দেয়া হয়। সহিষ্ণুতা ও নমনীয়তার প্রবক্তাদের অর্বাচীন এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে মানসিক পরাজয় বরণকারী বলে শনাক্ত করা হয়।
শহীদ সাইয়েদ কুতুবের এরূপ চিন্তাধারার সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় তার সুবিখ্যাত তাফসির ‘ফি যিলালিল কোরআন’, ‘ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা’, ‘ইসলাম এন্ড দি প্রব্লেমস অব সিভিলাইজেশন’ সহ অন্যান্য গ্রন্থে। এসব রচনার ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব থাকলেও নেতিবাচক প্রভাবও লক্ষণীয়।
এছাড়া শায়খ সাইয়েদ হাওবা র. তার বই পুস্তকে অনুরূপ বক্তব্য জোরালোভাবে উত্থাপন করেছেন।
এদিকে আমাদের সামনে নব্য জাহিরীদের, যারা আক্ষরিক অর্থের আলোকে কোরআনের ব্যাখ্যা করেন, উদ্ভাবিত এক নতুন ধরণের ফিকাহর অভ্যুদয় ঘটে। তারা নিজেদেরকে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারার অনুসারী বলে দাবি করলেও পবিত্র কোরআনের আক্ষরিক তাফসীরের সঙ্গে ইবনে তাইমিয়া ও তার অনুসারীদের দূরতম সম্পর্কও খুজে পাওয়া যায় না। তারা কখনোই বাহ্যিক কাঠামো ও বিন্যাসের মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, যে বিষয়টির ওপর নব্য জাহিরীরা অধিক মাত্রায় গুরত্ব আরোপ করে।
এভাবেই ইসলামী চিন্তাধারায় অনমনীয়তা ও একগুয়েমির প্রাধান্য বিস্তার লাভ করে এবং কিছুকালের জন্যে সঠিক ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তার সহনশীল চেতনা অবদমিত থাকে। আমি মনে করি ইসলামী আন্দোলনের উচিত হবে এ ধরণের অস্বাভাবিক চিন্তাপদ্ধতি থেকে নিজেকে সরিয়ে আনা যেন আন্দোলন নমনীয়, ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শের পথে অগ্রসর হতে পারে যেন এক ভারসাম্যপূর্ণ মুসলিম উম্মাহ এবং এক পূর্ণ ভারসাম্যময় চিন্তাপদ্ধতির অভিব্যক্তি ঘটে। যে আদর্শের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা বান্দাদের জন্যে সহজসাধ্যতা চান, কাঠিন্য নয়।
মধ্যপন্থা ও সহজপন্থা
স্বাচ্ছন্দ্য সুনিশ্চিত করতে আমার মতে, মধ্যপন্থা বা ভারসাম্য পদ্ধতি হাত ধরাধরি করে চলে। দ্বীনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি একদিকে অনমননীয়তা ও অহেতুক বাড়াবাড়ি এবং অন্য দিকে শৈথিল্য ও লাগামহীনতার মধ্যে এক সুষম দৃষ্টিভঙ্গি।
সহজতর পথ
ইসলামী আন্দোলনকে অবশ্যই জটিলতা নয়, সহজতর পথ ধরে এগোতে হবে। সমাজ সম্পর্কে ইসলামী আইনবিদদের মতামত, অর্থনীতি, আইন, আচরণ ও আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে এ সহজতর নীতি অবলম্বন করতে হবে। একাধিক কারণে আমি এ কথা বলছি।
প্রথমত, আমাদের শরীয়াহ সহজসাধ্যতা, ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তা কাঠিন্য ও ক্লেশ নির্মূল করতে চায়। শরীয়াহর মূল গ্রন্থগুলোতে এ চেতনাই প্রতিফলিত হয়েছে।
সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা বলেনঃ আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না (সূরা আল বাকারাঃ ১৮৫)। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ আর আল্লাহর ইচ্ছে নয় যে তোমাদের ওপর কোনো অসুবিধা চাপিয়ে দেন (সূরা মায়েদাঃ ৬)।মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহতায়ালা তোমাদের ভার হালকা করতে ইচ্ছে করেন, কারণ মানুষকে দুর্বলভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে (সূরা আন নিসাঃ ২৮)। আল্লাহতায়ালা বলেনঃ এটি তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে সহজ ব্যবস্থা ও অনুগ্রহ (সূরা আল বাকারাঃ ১৭৮)।
মহানবী সা. বলেছেনঃ কাজকর্ম সহজ করে দাও, কঠিন নয় (বুখারী ও মুসলিম)। অন্য হাদিসে বলা হয়েছেঃ তোমাদেরকে বিষয়াদি সহজ করার জন্য পাঠানো হয়েছে এবং এগুলো কঠিন করে ফেলো না (তিরমিজি)।
আমর ইবনুল আস রা. এক শীতের রাতে নাপাকি সত্ত্বেও ফরজ গোসল না করেই নামাজ আদায় করেন। তখন তার সঙ্গীরা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট অভিযোগ করলে আমর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেনঃ আমি আল-কোরআনের ঐ আয়াত স্মরণ করেছি যেখানে আল্লাহতায়ালা বলেনঃ আর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতি করুণাশীল (সূরা আন নিসাঃ ২৯) এবং রাসূলুল্লাহ সা. স্মিত হাসলেন।
রাসূলুল্লাহ সা. কিছু লোকের এরূপ মানসিকতার তীব্র নিন্দাও করেন। যারা এক আহত ব্যক্তিকে নাপাকির দরুন তাকে অবশ্যই গোসল করতে হবে বলে পীড়াপীড়ি করেছিল এবং লোকটি গোসল করে ও তাদের নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের কারণে ইন্তেকাল করে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. বলেনঃ তারা তাকে হত্যা করেছে। তারা যখন জানে না তখন জিজ্ঞেস করলো না কেন? না জানার প্রতিকার হচ্ছে প্রশ্ন করা। তার ক্ষতস্থানের একটি ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে তায়াম্মুম করে নেয়াই যথেষ্ট ছিল (আহমাদ, আবু দাউদ ও আল হাকিম এবং সহীহ আল জামি আল সগীরেও এ হাদিস বর্ণিত হয়েছে)।
দ্বিতীয়ত, আমাদের এ যুগে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে মানুষের কল্যাণের স্বার্থে সহজসাধ্যতার প্রয়োজন অনেক বেশি। কারণ অধুনা মানুষের ইচ্ছা শক্তির এমন অবক্ষয় ঘটেছে যে সৎ ও কল্যাণকর কাজের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কমে গিয়ে দুষ্কর্মের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুতরাং, দ্বীনি হুকুম আহকাম পালনে কঠোরতম নিয়মবিধি অনুসরণের তাগিদ দেয়ার পরিবর্তে মানুষকে সহজসাধ্যতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করাই বাঞ্ছনীয়। রাসূলুল্লাহ সা. প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণকারী মানুষ এবং মরুভূমির বেদুঈনদের প্রতি এমন আচরণই করেছিলেন। যারা দ্বীনি আহকাম ফরজ পালন ছাড়া অন্যান্য নফল ইবাদত করার অঙ্গীকার করতো না। রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকেও গ্রহণ করে নিতেন এবং কারো কারো সম্পর্কে বলতেনঃ সে তার কথা অনুযায়ী ভালো কাজ করলে সে সৎ কর্মশীল হবে, অথবা সে তার ওয়াদা পালন করলে বেহেশতে যাবে অথবা তোমাদের কেউ যদি বেহেশতী লোক দেখতে চাও, তাহলে এ লোকটির দিকে দেখ।
রাসূলুল্লাহ সা. শুধুমাত্র তাদের প্রতি মমত্ববোধ এবং তাদের কঠোর অবস্থা বিবেচনা করেই এরূপ সদাচার করতেন।
তৃতীয়ত, ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ নিজের ওপর কঠোরতা আরোপ করে স্বীয় ইচ্ছা শক্তির সীমানা পরখ করতে পারে। কিন্তু মধ্যপন্থা হচ্ছে সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে উপযোগী উপায়। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ আল্লাহ সে সব লোককে পছন্দ করেন যারা তাঁর প্রদত্ত সহজসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে, কারণ তিনি তাদের পাপকর্ম করাকে ঘৃণা করেন (আহমাদ, ইবনে হিব্বান ও বায়হাকী এবং সহীহ আল জামি আল সগীরেও এ হাদিস সন্নিবেশিত হয়েছে)।
সুতরাং, ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে একজন ফকিহর কঠোর শর্তাদি আরোপ করা উচিত নয়। তাকে এটি বিবেচনায় রাখতে হবে যে সর্বসাধারণের মধ্যে দুর্বল, বয়োবৃদ্ধ ছাড়াও এমন লোকও রয়েছে যাদের প্রতি উদার হওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। নামাজের জামায়াতে ইমামতী সম্পর্কে একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছেঃ যিনি নামাজে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তার উচিত নামাজকে সংক্ষিপ্ত করা, কেননা ইমামের পেছনে মানুষদের মধ্যে বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ এবং ব্যস্ত মুসাফির থাকতে পারে। সালাত হচ্ছে এমন একটি প্রতীক যেখানে জীবনের নানা দিকের প্রতিফলন ঘটে।
অতএব, ইসলামী আন্দোলনের ফকিহরা এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না যা বিধিনিষেধের প্রাচীর খাড়া করে, সহজসাধ্যতার পথ নির্দেশ করে না, কেবল নিষেধ করে, অনুমতি দেয় না। বিশেষ করে সে সব ইস্যুতে যেগুলোর সঙ্গে মহিলা, পরিবার, শিল্পকলা, বিনোদন ইত্যাদি বিষয় জড়িত।
এ জাতীয় অন্যান্য প্রশ্ন লেনদেনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যেখানে সুযোগ দেয়াটাই স্বাভাবিক নিয়ম এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করাটা ব্যতিক্রমী বিষয় বলে গণ্য হওয়া উচিত। দণ্ডবিধির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। ন্যূনতম সাজা প্রদান করা উচিত। অনুশোচনা দণ্ডবিধি রদ করে দেয় এ মত এখানে বিবেচনায় রাখা উচিত। যেমন মদপানের শাস্তি তাজীরভুক্ত [আমর প্রবন্ধ ‘দি ফ্যাক্টরস অফ ফ্লেক্সিবিলিটি ইন দি ইসলামিক শরীয়াহ’।] যার পরিমাণ কোরআন ও সুন্নাহকে উল্লেখিত হয়নি এবং তা আদালত বা আইন পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত হয় ইত্যাদি।
এ পর্যায়ে আমি ইমাম সুফিয়ান আল সাওরীর বক্তব্যের আলোকে আমাদের লক্ষ্য তুলে ধরতে চাইঃ কেবল বিশ্বাসযোগ্য ফকিহগণ সহজসাধ্যতা প্রসঙ্গে রায় দিতে পারেন, কিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে সে তো সবাই জানে।
ভবিষ্যতমুখী আদর্শ
ইসলামী আন্দোলনের জন্য যে আদর্শ আমরা চাই তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা একটি ভবিষ্যতমুখী আদর্শ অর্থাৎ তা বর্তমানের মধ্যে নিজেকে সীমিত না রেখে সব সময় ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ইসলামী আন্দোলন ভবিষ্যতের ব্যাপারে যত্নবান। কেননা তা ইসলামেরই যৌক্তিকতা এবং কোরআন ও সুন্নাহতে এ যৌক্তিকতার স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে।
আল–কোরআন ও ভবিষ্যত
পবিত্র কোরআন মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে মক্কী যুগ থেকে আল-কোরআন মুসলমানদের এক উজ্জীবিত ভবিষ্যতের দিকে আকৃষ্ট করে বলেছে, বিশ্বে পরিবর্তন ঘটছে এবং পরিস্থিতিও পরিবর্তনশীল। সমকালের বিজয়ীরা বিজিত হচ্ছে, দুর্বলরা শক্তিশালী হচ্ছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে ক্ষমতা গ্রহণের জন্যে প্রত্যেকেরই পালা থাকে।
মুসলমানদেরকেও নিজেদের ঘর গুছিয়ে প্রস্তুত হতে হবে পরিবর্তনের পালাকে বরণ করে নেয়ার জন্যে যা আজ হোক কাল হোক অবশ্যই আসবে, অনিবার্যভাবেই আসবে ইনশাআল্লাহ।
মক্কী সূরা আল কামারের ৪৫–৪৬ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা শক্তিশালী, অস্ত্রসজ্জিত, বিপুল সংখ্যার মুশরিকদের সম্পর্কে বলছেনঃ অচিরেই তারা অধিক সংখ্যায় পলায়ন করবে এবং তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। বরং কিয়ামত তাদের জন্যে প্রতিশ্রুত সময় তাদের পূর্ণ প্রতিফলের জন্য এবং কিয়ামত অতি ভয়ঙ্কর ও অতি তিক্ততর।
ইবনে কাছীর তার বিখ্যাত তাফসীরে ইকরামার বরাত দিয়ে বলেছেনঃ অচিরেই তারা অধিক সংখ্যায় পলায়ন করবে আয়াতটি যখন নাজিল হয় তখন ওমর ইবনে খাত্তাব রা. জিজ্ঞেস করলেনঃ কোন বিশাল বাহিনী পলায়ন করবে। বদরের দিনে আমি বর্মাচ্ছাদিত রাসূল্লাহ সা. কে চলন্ত অবস্থায় দেখলাম। তিনি বললেনঃ অচিরেই তারা অধিক সংখ্যায় পলায়ন করবে। আমি তখনই এ আয়াতের তাৎপর্য উপলব্ধি করলাম।
হযরত আয়েশার রা. বরাত দিয়ে ইমাম বুখারী বলেনঃ হযরত আয়েশা রা. বলেছেন, হযরত মুহাম্মদ সা. যখন মক্কায় তখনই এ আয়াত নাজিল হয় এবং সে সময় আমি ছোট্ট বালিকা। আয়াতটি হচ্ছেঃ বরং কিয়ামত তাদের জন্যে প্রতিশ্রুত সময় তাদের পূর্ণ প্রতিফলের জন্য এবং কিয়ামত অতি ভয়ঙ্কর ও অতি তিক্ততর।
এরূপ আয়াতের লক্ষ্য হচ্ছে, মুসলিম মানসকে অনিবার্য পরিবর্তন ও আসন্ন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পবিত্র কোরআনে সমসাময়িক দু’টি পরাশক্তির ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের উল্লেখ দেখতে পাই- রোমান ও পারসিক এবং মক্কায় মুসলমান ও কাফের- দু’গ্রুপই সংঘর্ষের ব্যাপারে উদ্বেগ পোষণ করতো। এ প্রেক্ষাপটে আল-কোরআন মুসলমানদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এমন দিন আসন্ন যখন আধিপত্য আহলে কিতাব রোমানদেরই হবে এবং অগ্নিপূজক পারসিকদের পরাজয় ঘটবে। যদিও আজ তারা বিজয়ী, কয়েক বছরের মধ্যেই তারা পরাজিত হবে। এ প্রসঙ্গে সূরা রূমের ১–৫ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ আলিফ লাম মীম। রোমানরা পরাজিত হয়েছে কয়েক বছরের মধ্যেই এক নিকটবর্তী স্থানে। এবং তারা তাদের এ পরাজয়ের পর শিগগিরই বিজয়ী হবে, পূর্বে ও পরের এখতিয়ার আল্লাহর হাতে। আর ঐ দিন মুমিনরা আনন্দিত হবে আল্লাহতায়ালার এ সাহায্যের জন্যে। তিনি যাকে ইচ্ছে সাহায্য করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী পরম দয়ালু।
উল্লিখিত আয়াতসমূহ আমাদেরকে দু’টি দিকের প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছেঃ
১. মুসলমানরা সংখ্যায় ও উপায় উপকরণে কম হলেও বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ, তাদের আশপাশের বৃহৎশক্তিগুলোর সংঘাত সংঘর্ষ এবং তাদের ওপর এ সংঘাতের ফলাফলের ব্যাপারে তারা বেশ সচেতন ছিল।
২. পবিত্র কোরআন এসব ঘটনা উল্লেখ করে পরিবর্তনের উপাদান ও বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে উত্তরণের দিকে মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সূরা মুয্যাম্মিলের শেষ আয়াতে আল্লাহতায়ালা তাহাজ্জুদ নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা. ও মুসলমানদের ওপর থেকে কড়াকড়ি শিথিল করার কথা বলেছেন। কেননা তাদেরকে শত্রুর সাথে মোকাবিলা করতে হচ্ছি। এসব শত্রু মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আল্লাহর পথে অগ্রযাত্রা ব্যাহত করছিল। ফলে মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়া এ সংঘর্ষের মোকাবিলার জন্যে তাদের শক্তি সঞ্চয় করা আবশ্যক ছিল।
সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা বলেনঃ আপনার প্রভু জানেন, আপনি ও আপনার সঙ্গীগণের মধ্যে কতিপয় লোক ইবাদতের জন্য রাতের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এবং কখনো অর্ধরাত্রি, আবার কখনো রাতের এক-তৃতীয়াংশ দণ্ডায়মান থাকেন। আর রাত ও দিনের পূর্ণ পরিমাপ আল্লাহই করতে পারেন। তিনি জানেন, আপনারা সারারাত ধরে ইবাদত করতে সক্ষম নন। অতএব, তিনি আপনাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সুতরাং যে পরিমাণ কোরআন সহজে তেলাওয়াত করা তেলাওয়াত করুন। তিনি অবগত আছেন, তোমাদের মধ্যে কতক পীড়িত হবে, আর কতক জীবিকান্বেষণের জন্যে দেশ বিদেশে ভ্রমণ করবে। আর কতক আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। সুতরাং যে পরিমাণ কোরআন সহজে তেলাওয়াত করা যায়, তেলাওয়াত করুন (সূরা মুয্যাম্মিলঃ ২০)।
সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি
মনোযোগ সহকারে রাসূলুল্লাহ সা. এর সীরাত অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর দাওয়াতের ভবিষ্যতের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না। বরং আল্লাহ প্রদত্ত সকল সুযোগ সুবিধা ও উপায় উপকরণের আলোকে ভবিষ্যতের জন্যে সব সময় চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করতেন।
হ্জ্ব মৌসুমে রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রচেষ্টা ও তৎপরতা সম্পর্কে পড়াশোনা করলেই তা বোঝার জন্য যথেষ্ট হবে- হজ্বের সময় আরবের সকল গোত্র সমবেত হতো এবং রাসূলুল্লাহ সা. তাদের কাছে কিভাবে দাওয়াত পেশ করতেন, তিনি তাদের সাহায্য কামনা করতেন রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের সম্পদপ্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এ থেকেই বোঝা যায়, ভবিষ্যতের দিকে তার দৃষ্টি কতটা প্রসারিত ছিল।
রাসূলুল্লাহ সা. দু’টি প্রধান নীতিতে বিশ্বাস করতেনঃ
প্রথমত, অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, কেননা পরিবর্তনের কারণ বিরাজমান ছিল। বিদ্যমান পরিস্থিতির বিকল্পই ছিল ইসলাম। অজ্ঞতার অন্ধকার ভেদ করে ঊষার আলো উদ্ভাসিত হবেই। সুতরাং, মুসলমানদেরকে দৃঢ়পদ ও সহিষ্ণু হতে হবে এবং যথাযথ সময় হওয়ার পূর্বেই ফলাফলের আশা করা ঠিক হবে না।
মক্কায় রাসূলুল্লাহ সা. এর সঙ্গীসাথীদের বিশেষ করে দুর্বল শ্রেণীর ওপর কাফেরদের অত্যাচার এতো বেড়ে গেল যে খাব্বাব ইবনে আরাত রা. রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে এসে ফরিয়াদ জানালেন এবং সাহায্য চাইলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তখন কাবা ঘরের ছায়ায় ঘুমাচ্ছিলেন। খাব্বাব বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্যে সাহায্য চাইবেন না? আপনি কি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা করবেন না? রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কোনো কোনো লোককে ধরে নিয়ে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয়েছে, অতঃপর তাদের মাথার খুলি করাত দিয়ে ভাগ করা হয়েছে, লোহার চিরুনি দিয়ে তাদের হাড় থেকে মাংস আলাদা করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও তাদেরকে দ্বীন থেকে বিমুখ করা যায়নি। আল্লাহর শপথ তিনি ইসলামী দ্বীনকে প্রভাবশালী করবেন এমনভাবে যে একটি কাফেলা সানা থেকে হাদ্রামাওত (ইয়েমেন) পর্যন্ত সফর করার সময় কেবল আল্লাহকে ভয় করবে। অবশ্য কাফেলার পাহারাও দেবে যাতে নেকড়ে বাঘ তাদের ভেড়ার পালে হামলা না চালায়। কিন্তু তোমাদের ধৈর্য নেই যে সেই সত্য বাস্তবে দেখার জন্যে প্রতীক্ষা করবে (বুখারী)।
দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ সা. বিশ্বাস করতেন এ কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যত তখনই বাস্তবে রূপলাভ করবে যখন মানুষ আল্লাহর অনুমোদিত বিধি অনুযায়ী কর্তব্য পালন ও নিজেকে যথাসম্ভব প্রস্তুত করবে। পথ থেকে সব বাধা অপসারণে তৎপর হবে এবং এর বাইরে সব কিছু সৃষ্টিকর্তার ওপরে ছেড়ে দেবে। কেননা মানুষ যা করতে পারে তা আল্লাহর জন্যে করা আদৌ কঠিন নয়।
রাসূলুল্লাহ সা. এর মদিনায় হিজরতের মধ্য দিয়ে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরব উপদ্বীপের মধ্যেই হিজরতের স্থান বেছে নিয়েছিলেন উপযুক্ত স্থান মনে করে, আবিসিনিয়ার মতো কোনো স্থান নয়। তিনি আনসারদের সাচ্চা আরব মনে করতেন। তারা নিজেদের পরিবারবর্গের মতোই তাঁকে রক্ষা করার ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিল। তিনি তাঁর সঙ্গীদের হিজরতকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এ জন্য যে যাতে তাদের জন্যে মক্কা ত্যাগ করা সহজতর হয়। বস্তুত তাদের পরে রাসূল সা. এর মদিনায় পৌঁছা যেন আরো গুরুত্ববহ হয়।
আল্লাহর অনুমতি পাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সা. যাত্রার বাহনের জন্যে পশু ঠিক করলেন। তাঁর সঙ্গী এবং পথের গাইড কে হবে তাও ঠিক করে নিলেন। এমন কি কাফেররা তাকে তালাশ করে ক্ষান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন গুহায় আত্মগোপন করবেন, এসব আগেই স্থির করে নিলেন।
তিনি মানুষের পক্ষে সম্ভব সব রকম গোপনীয়তা বজায় রেখে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন এবং যেসব বিষয়ের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেই সেগুলো আল্লাহর ওপর সোপর্দ করলেন। আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করবেন এ বিষয়ে তাঁর কোনোই সন্দেহ ছিল না। যখন হযরত আবু বকর রা. গুহায় তাঁকে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল সা., ওদের মধ্যে কেউ যদি তার পায়ের নিচে তাকায় তাহলে সে নিশ্চয় আমাদেরকে দেখে ফেলবে। রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ আবু বকর তুমি সেই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে কি চিন্তা করো, যাদের সঙ্গে তৃতীয় আরেক জন আছেন তিনি হচ্ছেন আল্লাহ। আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ যদি তোমরা তাঁকে (মুহাম্মদ) সাহায্য না করো তাতে কিছু আসে যায় না। তবে বস্তুত আল্লাহতায়ালাই তাঁকে সাহায্য করেছেন সেই সময়ে যখন কাফেররা তাঁকে দেশান্তর করে দিয়েছিল, যখন দুইজনের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি, যেই সময় উভয়ে (মুহাম্মদ ও আবু বকর) গুহার মধ্যে ছিলেন, যখন তিনি স্বীয় সঙ্গীকে বলেছিলেনঃ তুমি বিষন্ন বা ভীত হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর প্রতি স্বীয় সান্ত্বনা বর্ষণ করলেন এবং তাঁকে শক্তিশালী করলেন এমন সেনাদল ফেরেশতা দ্বারা যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি এবং আল্লাহ কাফেরদের বাক্য ক্ষীণতম করেছিলেন; আর আল্লাহর বাণীই সমুচ্চ রইল; আর আল্লাহতায়ালা হচ্ছেন সর্বশক্তিমান ও প্রজ্ঞাময় (সূরা তাওবাঃ ৪০)।