নবম অধ্যায়
ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ)
ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর জীবন তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এবং সরকারের সাথে তাঁর অসহযোগের ফলে আব্বাসীয় সাম্রাজ্য এবং হানীফা চিন্তাধারার সম্পর্ক একান্ত তিক্ত-সংঘাতমুখর হয়ে ওঠে। পরেও দীর্ঘদিন এ ধারা অব্যাহত ছিল। এক দিকে এ চিন্তাধারার সেরা পুরুষরা অসহযোগিতায় অটল থাকেন। ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর অন্যতম খ্যাতনামা শাগরেদ যুফার ইবনুল হোযায়েল (ইন্তেকালঃ ১৫৮ হিজরী-৭৭৫ খৃষ্টাব্দ)-কে কাযীর পদ গ্রহণে বাধ্য করা হলে তিনিও তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে প্রাণ বাঁচাবার জন্য আত্মগোপন করেন। [আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৮৩। মেফতাহুস সাআ’দাত, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১১৪।] অন্যদিকে আল-মনসুর থেকে শুরু করে হারুনুর রশীদের প্রাথমিক শাসনকাল পর্যন্ত এ চিন্তাধারার প্রভাব রোধের দিকেই সরকারের দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল। এ কারণে মনসুর এবং তাঁর উত্তরসুরীরা চেষ্টা করেছিল যে, দেশে আইন অবস্থার শূন্যতা যে সংকলিত আইন দাবী করছে, অন্য কোন সংকলন দ্বারা তা পূরণ করা হোক। এ উদ্দেশ্যে আল-মুনসুর এবং আল-মাদীও তাদের শাসনামলে ইমাম মালেক (রঃ)-কে সামনে আনার চেষ্টা করে। [ইবনে আবদুল বারঃ আল-ইন্তেকা, পৃষ্ঠা- ৪০-৪১।] হারুনুর রশীদও ১৭৪ হিজরী সালে (৭৯১ খৃষ্টাব্দে) ইমাম মালেক (রঃ)-এর আল-মুয়াত্তাকে দেশের আইন হিসাবে গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। [আবু নুয়াইম আল-ইসফাহানীঃ হুলাইয়াতুল আওলিয়া, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৩২।] কিন্তু পরে এ চিন্তাধারা থেকে এমন এক শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের উদ্ভব হয়, যিনি আপন শ্রেষ্ঠতম, যোগ্যতা এবং বিরাট প্রভাব-প্রতাপ বলে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের আইনগত শূন্যতার অবসান ঘটান। হানাফী ফিকাহকে দেশের আইনে পরিণত করেন, একটা আইনের ওপর দেশের শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর সবচেয়ে বড় শাগরেদ ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ)।
জীবন কথা
তাঁর আসল নাম ছিল ইয়াকুব। আরবের বাজীলা কবীলায় তাঁর জন্ম। মদীনার আনসারদের সাথে মাতৃকুলের সম্পর্ক এবং হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে তাঁর বংশকে আনসারী বংশ বলা হতো। তিনি কুফার বাসিন্দা ছিলেন। ১১৩ হিজরী মুতাবিক ৭৩১ খৃষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। প্রাথমিক শিক্ষার পর ফিকাহকেই তিনি বিশেষ শিক্ষার জন্য পসন্দ করেন এবং আবদুর রহমান ইবনে আবি লাইলার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অতঃপর ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর দরসে শরীক হন এবং স্থায়ীভাবে তাঁর সাথেই সম্পৃক্ত হন। তাঁর পিতা-মাতা অত্যন্ত গরীব ছিলেন। তাঁরা তার পড়া-লেখা চালাতে চাইতেন না। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) তাঁর অবস্থা জানতে পেরে কেবল তাঁরই নয়, বরং তাঁর গোটা পরিবারেও ব্যয়ভারের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেন। তাঁর নিজের উক্তি, ইমাম ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর কাছে কখনো আমার প্রয়োজনের কথা বলার দরকার হয়নি। সময়ে সময়ে তিনি নিজেই আমার গৃহে এ পরিমাণ টাকা পাঠাতেন, যার ফলে আমি সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত হয়ে যাই।’ [আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২১২।] প্রথম থেকেই তিনি এ শাগরেদ সম্পর্কে একান্ত আশাবাদী ছিলেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ)-এর পিতা তাঁকে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি বলেনঃ আবু ইসহাক। ইনশাআল্লাহ ছেলেটি একদিন বড়লোক হবে। [আল-মাক্কী, পৃষ্ঠা- ২১৪।]
জ্ঞানের রাজ্যে খ্যাতি
তিনি ইমাম আবু হানীফা (রঃ) ছাড়া সে কালের অন্যান্য খ্যাতনাম শিক্ষকদের কাছ থেকেও শিক্ষা লাভ করেন। হাদীস, তাফসীর, মাগাযী, আরবের ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য এবং কালাম শাস্ত্রেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। বিশেষ করে হাদীসে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি ছিলেন হাফেযে হাদীস। ইয়াহইয়া ইবনে মুইন, আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) এবং আলী ইবনুল মাদানীর মতো ব্যক্তিরা তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকার করেছেন। [ইবনে খাল্লেকান, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪২২। ইবনে আবদুল বারঃ আল-ইন্তিকা, পৃষ্ঠা- ১৭২।] তাঁর সম্পর্কে তাঁর সমকালীন মনীষীদের সর্বসম্মত অভিমত ছিল এই যে, ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর মাগরেদদের মধ্যে কেউ তাঁর সমকক্ষ ছিল না। তালহা ইবনে মুহাম্মদ বলেন, তিনি তাঁর যুগের সবচেয়ে বড় ফকীহ (ফিকাহ শাস্ত্রবেত্তা) ছিলেন। তাঁর চেয়ে বড় ফকীহ আর কেউ ছিল না। [ইবনে খাল্লেকান, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪২৪।] দাউদ ইবনে রশীদের উক্তিঃ ইমাম আবু হানীফা (রঃ) যদি এ একজন মাত্র শাগরেদও সৃষ্টি করতেন, তা হলে ইনিই তাঁর গৌরবের জন যথেষ্ট ছিলেন। [আল মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৩২।] ইমাম আবু হানীফা (রঃ) স্বয়ং তাঁকে অনেক মর্যাদা দিতেন। তাঁর উক্তিঃ আমার শাগরেদদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী জ্ঞান লাভ করেছে, সে হচ্ছে আবু ইউসুফ। [আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৬।] একবার তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। জীবনের কোন আশাই আর রইলো না। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) তাঁকে দেখার জন্য বেরিয়েছেন। এ সময় তিনি বললেনঃ এ যদি মারা যায়, তাহলে দুনিয়ায় তাঁর চেয়ে বড় আর কোন ফকীহ অবশিষ্ট থাকবে না। [ইবনে খাল্লেকান, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪২৪। আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৬।]
হানাফী ফিকাহ সংকলন
ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর পরে তিনিও হানাফী চিন্তাধারার ঐতিহ্য অনুযায়ী দীর্ঘ ১৬ বৎছর যাবত রাষ্ট্র সরকার থেকে দূরে থাকেন। এ সময় তিনি তাঁর শিক্ষকের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শিক্ষা দান কার্য চালু রাখেন। এর সাথে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও তিনি আঞ্জাম দেন। তা এই যে, আইনের অধিকাংশ বিভাগ সম্পর্কে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন। এ সকল গ্রন্থে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর মজলিসের ফায়সালা এবং তাঁর নিজের উক্তি যথাযথভাবে বিধিবদ্ধ করেন। [ফিহরিস্তে ইবনে নাদীম, রহমানিয়া প্রেস, মিসর, ১৩৪৮ হিজরী। তালহা ইবনে মুহাম্মাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে খাল্লেকান লিখেন যে, আবু ইউসুফ (রঃ) প্রথম ব্যক্তি, যিনি ফিকাহ শাস্ত্রের সকল মৌলিক বিভাগের ওপর হানাফী মাযহাব অনুযায়ী গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং আবু হানীফা (রঃ) এর জ্ঞানকে সরার বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন।_ ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪২৪।] এ সকল গ্রন্থ দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর তিনি কেবল সুধী সমাজকেই প্রভাবিত করেননি। বরং হানাফী ফিকাহ-এর অনুকূলে আদালত এবং সরকারী বিভাগে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মতও গঠন করেন। কারণ, এভাবে তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এমন কোন সুসংবদ্ধ সুসংহত আইন ভান্ডার তখন ছিল না। অবশ্য ইমাম মালেক (রঃ)-এর আল-মুয়াত্তা তৎক্ষণাৎ জনসমক্ষে উপস্থিত হলেও একটা রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূরণে তা ততটা সর্ব্ব্যাপক ছিল না, ছিল না সংকলনের বিচারে ততটা স্পষ্ট। [প্রকাশ থাকে যে, মালেকী মাযহাব অনুসারে একটা রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূরণের নিমিত্ত ফিকাহ শাস্ত্র সংকলণ পরবর্তীকালে ইমাম মুহাম্মদ (রঃ)-এর কিতাবের অনুকরণেই করা হয়েছে।] আবু ইউসুফ (রঃ)- এর এহেন কাজের ফল এ হলো যে, তাঁর ক্ষমতায় আসার আগেই মানুষের মন-মগয এবং দৈনন্দিন কার্যে হানাফী ফিকাহ প্রভাব বিস্তার করে বসে। কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা তাকে দেশের যথারীতি আইনে পরিণত করাই অবশিষ্ট ছিল।
বিচারকের পদ
সম্ভবত আবু ইউসুফ (রঃ)-ও সারা জীবন আপন ওস্তাদের মতো সরকারের সাথে অসহযোগিতা করেই অতিবাহিত করতেন- যদি তাঁর আর্থিক অবস্থা কিছুটাও ভাল হতো। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন নিঃস্ব ব্যক্তি। ইমাম আবু হানীফা (রঃ)- এর ওফাতের পর একজন দানশীল পৃষ্ঠপোষকের অনুগ্রহ থেকেও বঞ্চিত হয়ে যান। দৈন্যের চাপে পড়ে একদা স্ত্রীর গৃহের একখানা কড়িকাঠ বিক্রি করতেও তিনি বাধ্যহন। এতে তাঁর শাশুড়ী তাঁকে এমন কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেন, তাঁর আত্মমর্যাদা তা বরদাস্ত করতে পারেনি। এ কারণে তিনি সরকারী চাকুরী গ্রহণ করতে বাধ্য হন। এ ঘটনার পর হিজরী ১৬৬ সালে (৭৮২ খৃষ্টাব্দে) তিনি বাগদাদ গমন করে খলীফা মাহদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মাহদী তাঁকে পূর্ব বাগদাদের বিচারপতি (কাযী) নিযুক্ত করেন। আল-হাদীর শাসনামলেও তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। হারুনুর রশীদের শাসনকাল পর্যন্ত ক্রমশ খলীফা তাঁকে গোটা আব্বাসীয় সাম্রজ্যের কাযীউল কোযাত (প্রধান বিচারপতি) নিযুক্ত করেন। মুসলিম রাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো এ পদের সৃষ্টি হয়। ইতিপূর্বে খেলাফতে রাশেদা বা উমাইয়া-আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে কাউকে চীপ জাস্টিস করা হয়নি। [আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২১১, ২৩৯। ইবনে খালদুন, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪২১।] বর্তমান যুগের ধারণা অনুযায়ী এ পদটি নিছক উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির পদ-ই-ছিল না; বরং আইন মন্ত্রীর দায়িত্ব এ পদের অন্তর্ভূক্ত ছিল। অর্থাৎ কেবল মামলার রায় দানও নিম্ন আদালতে সমূহের বিচারপতি নিয়োগ পর্যন্তই তার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং দেশের আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বিষয়ে আইনগত পথ নির্দেশ দান করাও ছিল তার কাজ।
কাযী আবু ইউসুফ (রঃ)-এর প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফল দেখা দেয়ঃ
একঃ নিছক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা নির্জন প্রকোষ্ঠে বসে গ্রন্থ প্রণয়ন কার্যে নিয়োজিত থাকার তুলনায় আরও ব্যাপক কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ লাভ করেন তিনি। সেখানে তিনি তৎকালের বৃহত্তম সাম্রাজ্যের কাজ-কারবারের সাথে কার্যত পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। এ পরিস্থিতিতে হানাফী ফিকাহকে বাস্তব পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যশীল করে তাকে অধিকতর একটি বাস্তব আইন ব্যবস্থায় পরিণত করার সুযোগ ঘটে।
দুইঃ সারা দেশে বিচারপতিদের নিয়োগ ও বদলীর কাজ যেহেতু তাঁর হাতে ছিল, ফলে হানাফী চিন্তাধারার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকায় বিচারকের পদে নিয়োজিত হয়। এবং তাঁর মাধ্যমে হানাফী ফিকাহ আপনা আপনি দেশের আইনে পরিণত হয়।
তিনঃ উমাইয়াদের শাসনামল থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে এক ধরনের আইনের শূন্যতা এবং বাদশাহদের উচ্ছৃংখলতা বিরাজ করছিল, তিনি তাঁর বিরাট নৈতিক এবং পাণ্ডিত্য সুলভ প্রভাব দ্বারা তাকে আইনের অনুবর্তী করতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয়, তিনি মুসলিম সাম্রাজ্যকে একটি আইন গ্রন্থও সংকলিত করে উপহার দেন। সৌভাগ্য বশত এ গ্রন্থটি কিতাবুল খারাজ নামে আজও আমাদের নিকট বর্তমান রয়েছে।
চরিত্রের দৃঢ়তা
তাঁর প্রণীত আইন-গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা করার আগে একটা সাধারণ ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন অপরিহার্য। ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ)-এর জীবনী রচয়িতারা তাঁর সম্পর্কে এমন সব কল্প-কাহিনীর অবতারণা করেছে, যা পাঠ করে পাঠকের সামনে তাঁর জীবন-চিত্র অনেকটা এমনভাবে উদ্ভাসিত হয় যে, তিনি বাদশাহদের মোষামোদ করতেন, তাদের মনষ্কামনা অনুযায়ী আইনের অপব্যাখ্যা করতেন। এটাই ছিল তাঁর বাদশাহদের নৈকট্য লাভের মাধ্যম। অথচ তোষামোদ দ্বারা যে ব্যক্তি বাদশাহদের নৈকট্য লাভ করে, তাদের মনোবাসনা অনুযায়ী শরীয়াতের ব্যাপারে কাট-ছাট করে, সে ব্যক্তি যতই সান্নিধ্য লাভ করুক না কেন, বাদশাহদের ওপর কখনো তার নৈতিক প্রভাব পড়তে পারে না- একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিও এ কথা উপলব্ধি করতে পারে। খলীফা তাঁদের মন্ত্রীবর্গ এবং সেনাপতিদের সাথে তাঁর আচরণের যেসব কাহিনী আমরা নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থে দেখতে পাই, তা পর্যালোচনা করলে একজন তোষামোদ প্রিয় এবং ছল-চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যক্তি কখনো এহেন আচরণের সাহস করতে পারে, তা বিশ্বাস করা অসম্ভব মনে হয়।
খলীফা আল-হাদীর শাসনামলের কথা। তখন তিনি শুধু পূর্ব বাগদাদের বিচারপতি। এ সময় এক মামলায় তিনি স্বয়ং খলীফার বিরুদ্ধে রায় দান করেন। [আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১২৮।]
হারুনুর রশীদের শাসনামলে জনৈক বৃদ্ধ খৃষ্টান খলীফার বিরুদ্ধে একটি বাগানের দাবী উত্থাপন করে। কাযী আবু ইউসুফ (রঃ) খলীফার মুখোমুখী কেবল বৃদ্ধের আর্জীই শুনেননি, বরং এ দাবীর বিরুদ্ধে খলীফাকে শপথ নিতে বাধ্য করেন। এরপরও তিনি মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে পর্যন্ত অনুতাপ করেছিলেন যে, আমি তাকে কেন খলীফার বরাবর দাঁড় করাইনি। [আস-সারাখসীঃ কিতাবুল মাবসুত, ১৬শ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬১। আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৩-২৪৪।]
হারুনুর রশীদের উযীরে আযম আলী ইবনে ঈসার সাক্ষ্য তিনি অগ্রাহ্য করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমি তাকে খলীফার গোলাপ বলতে শুনেছি। সত্যিই যদি সে গোলাপ হয়ে থাকে, তাহলে তার সাক্ষ্য অগ্রাহ্য। আর যদি খোশামোদী করে এমন উক্তি করে থাকে, তাহলেও তার সাক্ষ্য গ্রাহ্য নয়। [আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২৬-২২৭।] এমন তোষামোদের জন্য এ রকম খোশামোদদেরকে এমন নৈতিক শাস্তি হারুনের সিপাহসালা (প্রধান সেনাপতি) কেও দিয়েছেন। [ আল-মাক্কী, পৃষ্ঠা- ২৪০।]
আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেন, তিনি এমন মর্যাদার সাথে হারুনুর রশীদের দরবারে হাযির হতেন যে, সওয়ারীর ওপর আরোহন করে পর্দার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেন (যেখানে উযীরে আযমকেও পায়ে হেঁটে যেতে হতো।) খলীফ এগিয়ে এসে তাঁকে প্রথমে সালাম জানাতো। [ আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪০। মোল্লা আলী ক্বারীঃ যায়লুল জাওয়াহেরিল মুযিয়্যাহ, পৃষ্ঠা- ৪২৬।]
একদা হারুনকে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ আপনি আবু ইউসুফ (রঃ)-কে এত বড় মর্যাদা কেন দিয়েছেন? জবাবে তিনি বলেনঃ জ্ঞানের যে ক্ষেত্রেই আমি তাঁকে পরীক্ষা করেছি, সবক্ষেত্রেই তাঁকে পূর্ণ পেয়েছি। উপরন্ত তিনি একজন সত্যাশ্রয়ী এবং কঠোর চরিত্রের লোক তাঁর মতো অপর কোন ব্যক্তি থাকলে নিয়ে এসো দেখি। [ আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৩২।]
১৮২ হিজরী তথা ৭৯৮ খৃষ্টাব্দে তাঁর ইন্তেকাল হলে হারুনুর রশীদ নিজে পায়ে হেঁটে তাঁর জানাযার অনুগমন করেন। নিজে তাঁর জানাযার ইমামতি করেন। পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করেন এবং বলেনঃ এটা এমন এক শোকাবহ ঘটনা যে, গোটা মুসলিম জাহানের সকলে একে অপরকে সমবেদনা জানানো উচিত। [ আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২০।]
তাঁর কিতাবুল খারাজ আমাদের নিকট সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কোন তোষামুদে ব্যক্তি বাদশাহকে যে কোন সম্বোধন করে এ সব কথা লিখতে পারেন- এ গ্রন্থের ভূমিকা পড়ে যে কোন ব্যক্তি এ কথা উপলব্ধি করতে পারে।
কিতাবুল খারাজ
কাযী আবু ইউসুফ (রঃ) হারুনুর রশীদের সত্ত্বায় এমন এক খলীফা লাভ করেছিলেন, যিনি ছিলেন পরস্পর বিরোধী গুণাবলীর অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে কড়া মেজাযের সৈনিক, আরাম প্রিয় বাদশা এবং একজন আল্লাভীরু দ্বীনদার। আবুল ফারাজ আল-ইসফাহানী এক কথায় তাঁর গুণাবলীর উল্লেখ করেন- ওয়ায-নসীহতের ক্ষেত্রে তিনি সকলের চেয়ে বেশী কাঁদেন, আর ক্রোধকালে সবচেয়ে বেশী অত্যাচারী ছিলেন তিনি। [ কিতাবুল আগানী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭৮।] ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) একান্ত প্রজ্ঞা এবং দুরদর্শীতা বলে তার দুর্বল দিকগুলোকে উত্যক্ত না করেই তার প্রকৃতির দ্বীনী দিকসমূহকে আপন জ্ঞান এবং নৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত এমন এক সময় উপস্থিত হয়, যখন তিনি নিজেই রাষ্ট্রের জন্য একটি আইন গ্রন্থ প্রণয়নের অনুরোধ জানান। যে গ্রন্থের আলোকে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র-শাসন কার্য পরিচালনা করা যায়। কিতাবুল খারাজ গ্রন্থ রচনার এটাই ছিল কারণ। ইমাম ইউসুফ (রঃ) আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকায় এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেনঃ
আমীরুল মুমিনীনের ইচ্ছা- আল্লাহ তায়ালা তাঁর সহায় হোন- আমি তাঁর জন্য এমন একটি সর্বাত্মক গ্রন্থ প্রণয়ন করি, যে গ্রন্থ অনুযায়ী কর, ওশর, ছদকা এবং জিযিয়া উসুল ও অন্যান্য ব্যাপারে আমল করা যায়, যেসব বিষয়ে দায়িত্ব পালনের ভার তাঁর ওপর ন্যস্ত। ….. তিনি কোন কোন ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করেছেন। তিনি এ সব প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব চান, যাতে ভবিষ্যতে তদনুযায়ী কাজ করতে পারেন।
উক্ত গ্রন্থের স্থানে স্থানে তিনি হারুনুর রশীদ প্রেরিত প্রশ্নমালায় যেসব উদ্ধৃতি দিয়েছেন তা দৃষ্টে মনে হয় যে, সেক্রেটারীয়েটের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক, আইনগত, প্রশাসনিক এবং আন্তর্জাতিক সমস্যাবলীর আলোকে এ প্রশ্নমালা প্রণীত হয়েছিল, যাতে আইন বিভাগ থেকে এ সকল প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব পেয়ে রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়। গ্রন্থের নাম থেকে বাহ্যত ধোঁকা হয়ে থাকে যে, নিছক রাজস্বই (Revenue) এ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। কিন্তু আসলে এতে রাষ্ট্রের প্রায় সকল বিষয়ই আলোচিত হয়েছে।
এখানে আমরা বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে কেবল এ দৃষ্টিকোণ থেকেই-এর বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করে দেখাবো যে, এতে রাষ্ট্রের কি মৌল দর্শন এবং ধারণা উপস্থাপন করা হয়েছে।
খেলাফতে রাশেদার দিকে প্রত্যাবর্তন
গোটা গ্রন্থটি অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করলে যে বিষয়টি মানুষের সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে এই যে, ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) খলীফাকে বনী-উমাইয়া ও বনী-আব্বাসীয়দের কাইজার-কেসরা সুলভ ঐতিহ্য থেকে সরিয়ে সর্বতভাবে খিলাফতে রাশেদার ঐতিহ্যের অনুসরণের দিকে নিয়ে যেতে চান। অবশ্য তিনি গ্রন্থের কোথাও পূর্বসুরীদের ঐতিহ্য ত্যাগ করতে বলেননি, কিন্তু বনী-উমাইয়া তো দুরের কথা, গ্রন্থের কোথাও তিনি স্বয়ং হারুনুর রশীদের পূর্বপুরুষদের কোন কর্মধারা এবং ফায়সালাকে নযীর হিসেবে পেশ করেননি ভুলেও। প্রত্যেক ব্যাপারে তিনি হয় কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, অথবা আবুবকর, ওমর, ওসমান আলী (রাঃ)-এর শাসনামলের নযীর পেশ করেছেন। পরবর্তী কালের খলীফাদের কারো কর্মধারাকে নযীর হিসেবে পেশ করে থাকলে তিনি আল-মনসুর, আল-মাহদী নন, বরং তিনি হচ্ছেন বনী-উমাইয়্যাদের খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয। এর স্পষ্ট তাৎপর্য এই যে, আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের এ আইন গ্রন্থ প্রণয়নকালে তিনি ওমর ইবনে আবদুল আযীযের আড়াই বছরকে বাদ দিয়ে হযরত আলী (রাঃ)-এর ওফাত থেকে শুরু করে হারুনুর রশীদের শাসনামল পর্যন্ত প্রায় ১৩২ বছরের শাসনকালের গোটা ঐতিহ্য এবং কার্যধারাকে এড়িয়ে যান। কোন সত্যভাষী ফিকাহ শাস্ত্রবেত্তা নিছক ওয়ায-নসীহত হিসেবে একান্ত বেসরকারীভাবে এ কাজটি করলে তার বিশেষ কোন গুরুত্ব হতো না। কিন্তু একজন প্রধান বিচারপিত এবং আইন মন্ত্রী সম্পূর্ণ সরকারীভাবে তদানীন্তন খলীফার ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ কাজ করেছেন, তা দেখে এর গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়ে যায়।
একঃ রাষ্ট্র-সরকারের ধারণা
গ্রন্থের শুরুতেই খলীফার সামনে তিনি রাষ্ট্র-সরকারের যে ধারণা পেশ করেন, তাঁর নিজের ভাষায় তা এইঃ
‘আমীরুল মুমিনীন। আল্লাহ তায়আলা- যিনি সকল প্রশঙসা-স্ততির অধিকারী-আপনার ওপর এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ কার্যভার ন্যস্ত করেছেন। এ কাজের সওয়াব সবচেয়ে বড় এবং শাস্তি সবচেয়ে কঠোর। তিনি উম্মাতের নেতৃত্ব আপনার ওপর সোপর্দ করেছেন। আর আপনি প্রতিনিয়ত এক বিশাল জনতার নির্মাণ কাজে নিয়োজিত। তিনি আপনাকে জনগণের রক্ষক করেছেন। তাদের নেতৃত্ব আপনাকে দান করেছেন। তাদের দ্বারা আপনাকে পরীক্ষায় ফেলেছেন। তাদের কার্যাবলী পরিচালনার দায়িত্ব আপনার ওপর ন্যস্ত করেছেন। আল্লার ভয় বাদ দিয়ে অন্য কিছুর ওপর যে প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপিত, তা খুব বেশীদিন স্থায়ী হয় না। আল্লাহ তাকে সমূলে উৎপাটিত করে নির্মাতা এবং নির্মাণ কার্যে তার সহযোগিতা দানকারীর ওপর নিক্ষেপ করেন। …….. দুনিয়ায় রাখাল যেমন মেষ পালের আসল মালিকের সামনে হিসেব দেয়, রক্ষককে আপন প্রভুর সামনে ঠিক তেমনি হিসেব দিতে হবে। ……… বাঁকা পথে চলবে না, তাহলে আপনার মেষ-পালও বাকা পথে চলতে শুরু করবে। ………..সকল ব্যক্তিকে- আপনার নিকট-দূর যাই হোক না কেন- আল্লার বিধানে সমান রাখবেন।……….. কাল যেন আপনাকে আল্লার সামনে অত্যাচারী হিসেবে হাযির হতে না হয়। কারণ, শেষ দিবসের বিচারক কার্যধারার ভিত্তিতে মানুষের বিচার করবেন-পরদ-মর্যাদার ভিত্তিতে নয়। ………মেষ পালের ক্ষতি সাধনে ভয় করুন। মেষ পালের মালিক আপনার নিকট থেকে পুরো প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ৩, ৪, ৫। সালফিয়া প্রেস, মিসর, ২য় সংস্করণ ১৩৫২ হিজরী।]
এরপর গোটা গ্রন্তের স্থানে স্থানে তিনি হরুনুর রশীদকে এ অনুভূতি দিয়েছেন যে, তিনি দেশের মালিক নন, বরং আসল মালিকের খলীফা মাত্র। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-৫।] তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক হলে সুফল দেখতে পাবেন আর অত্যাচারী শাসক হলে নিকৃষ্ট পরিণতির সম্মুখীন হবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ৮] এক স্থানে তিনি তাকে হযরত ওমর (রাঃ)-এর উক্তি শুনিয়েছেনঃ আল্লার অবাধ্যতায় তার আনুগত্য করতে হবে- কোন অধিকার সম্পন্ন ব্যক্তিরই দুনিয়ায় এ মর্যাদা নেই। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ১১৭]
দুইঃ গণতন্ত্রের প্রাণ-শক্তি
কেবল স্রষ্টার সম্মুখেই নয়, বরং সৃষ্টির সম্মুখেও খলীফার জবাবদিহির ধারণা পেশ করেন তিনি। এ জন্য তিনি স্থানে স্থানেহাদীস এবং সাহাবীদের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। এ সকল হাদীস এবং সাহাবীদের উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, শাসকবর্গের সামনে স্বাধীনভাবে সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে মুসলমানদের। আর এ সমালোচনার স্বাধীনতার মধ্যেই সরকার এবং জনগণের কল্যাণ নিহিত। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ১২]
ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ মুসলমানদের অধিকার এবং কর্তব্য উভয়ই। এর দ্বার রুদ্ধ হওয়ার অর্থ হচ্ছে জনগণ শেষ পর্যন্ত সর্বগ্রাসী ধ্বংসে নিমজ্জিত হবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ১০, ১১] সত্য কথা শোনার মতো ধৈর্য শাসক শ্রেণীর থাকা উচিত। তাদের কটুভাষী এবং অসহিঞ্চু, হওয়ার চেয়ে ক্ষতিকর কিছু নেই। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ১২] শরীয়াতের দৃষ্টিতে শাসক শ্রেণীর ওপর প্রজাদের যে অধিকার অর্পিত হয়, জনগণের সম্পদের যে আমানত তাদের ওপর ন্যাস্ত, এ ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে হিসেব নেয়ার এবং জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার মুসলমানদের রয়েছে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ১১৭।]
তিনঃ খলীফার দায়িত্ব-কর্তব্য
খলীফার যেসব দায়িত্ব-কর্তব্য তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, তা এইঃ আল্লার সীমা-রেখা প্রতিষ্ঠা, সঠিক অনুসন্ধান করে হকদারদেরকে তাদের অধিকার দান।
সৎ-ন্যায়পরায়ণ শাসকদের কার্যধারা (অতীতের যালেম শাসকরা যা ত্যাগ করেছে) পুনরুজ্জীবিত করণ। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ৫।]
অন্যায় -অত্যাচার প্রতিরোধ এবং অনুসন্ধান করে জনগণের অভিযোগ বিদূরীত করণ। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ৬] আল্লার বিধান অনুযায়ী জনগণকে আনুগত্যের নির্দেশ দান এবং পাপাচার থেকে বারণ।
আপন পর সকলের ওপর সমভাবে আল্লার বিধান কার্যকরী করণ। কার ওপর এর আঘাত পড়ে, এ ব্যাপারে তার পরওয়া না করা। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ১৩।]
বৈধ-সঙ্গতভাবে জনগণের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় এবং বৈধ খাতে তা ব্যয় করা। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ১০৮।]
চারঃ মুসলিম নাগরিকদের কর্তব্য
অপরদিকে সরকারের ব্যাপারে তিনি মুসলমানদের যে কর্তব্যের উল্লেখ করেছেন, তা এইঃ তার সরকারের আনুগত্য করবে, নাফরমানী করবে না।
তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে না।
তাদেরকে গালমন্দ দেবে না।
তাদের কঠোরতায় ধৈর্য ধারণ করবে।
তাদেরকে প্রতারিত করবে না।
আন্তরিকভাবে তাদের কল্যাণ কামনা করার চেষ্টা করবে।
মন্দ কাজ থেকে তাদেরকে বারণ করবে।
ভাল কাজে তাদের সহযোগিতা করবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ৯, ১২।]
পাঁচঃ বায়তুল মাল
বায়তুল মাল (রাষ্ট্রীয় ধনভান্ডার)-কে তিনি বাদশাহের ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিবর্তে স্রষ্টা এবং জনগণের আমানত বলে অভিহিত করেন। বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি খলীফাকে হযরত ওমর (রাঃ)- এর উক্তি স্মরণ করিয়ে দেন। এ সকল উক্তিতে খলীফা ওমর (রাঃ) বলেছেন, খলীফার জন্য রাষ্ট্রীয় ধন-ভান্ডার যেমন ইয়াতীমের পৃষ্ঠপোষকের জন্য ইয়াতীমের সম্পদের অনুরূপ। সে যদি বিত্তবান হয়, তাহলে কুরআনের হেদায়াত অনুযায়ী এতীমের সম্পদ থেকে তার কিছুই খরচ করা উচিত নয়। বরং আল্লার পথে তার সম্পদ দেখাশুনা করা উচিত। আর যদি সে অভাবী হয়, তাহলে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী অতটুকু সেবার বিনিময়ে সে গ্রহণ করতে পারে, যতটুকু গ্রহণ করাকে সকল ব্যক্তি বৈধ বলে মনে করেন। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ৩৬, ১১৭।]
তিনি হযরত ওমর (রাঃ)-এর এ কার্যধারাকেও খলীফার সামনে নমুনা স্বরুপ তুলে ধরেন। কোন ব্যক্তি নিজের সম্পদ থেকে ব্যয় করার ব্যাপারে যতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে, বায়তুলমাল থেকে ব্যয়ের ব্যাপারে খলীফা ওমর (রাঃ)- তার চেয়েও বেশী সতর্কতা অবলম্বন করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আর একটি ঘটনারও উল্লেখ করেন। ঘটনাটি এই যে, খলীফা ওমর (রাঃ) কুফার কাযী, আমীর এবং অর্থমন্ত্রী নিয়োগ কালে এদের সকলের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দৈনিক একটি বকরী দানের নির্দেশ দেন। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলে দেন যে, যে দেশ থেকে অফিসারদেরকে দৈনিক একটি বকরী দেয়া হয়, সে দেশ অনতিবিলম্বে ধ্বংস হয়ে যাবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ৩৬।]
তিনি খলীফাকে এ নির্দেশও দান করেন যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করা থেকে শাসকদেরকে বারণ করতে হবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা- ১৮৬।]
ছয়ঃ কর ধার্যের নীতি
কর আরোপের ব্যাপারে তিনি যেসব মূলনীতির উল্লেখ করেন, তা এইঃ
কেবল প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের ওপরই কর ধার্য করা হবে।
সম্মতিক্রমে তাদের ওপর বোঝা চাপাবে।
কারো ওপর তার ক্ষমতার অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দয়া যাবে না।
বিত্তবানদের কাছ থেকে উসুল করে বিত্তহীনদের জন্য তা ব্যয় করতে হবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১৪।]
রাজস্ব নির্ধারণ এবং তার নিরূপণে এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে যে, সরকার যেন জনগণের রক্ত চুষে না নেয়।
কর আদায়ের ব্যাপারে যেন অন্যায় পন্থা অবলম্বন না করা হয়। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১৬, ৩৭, ১০৯, ১১৪।]
আইনানুগ উপায়ে আরোপিত কর ব্যতীত সরকার যেন অন্য কোন অবৈধ কর আদায় না করে, ভূমির মালিক এবং অন্যান্য কর্মচারীরাও যাতে এ ধরনের কোন কর আদায় না করতে পারে, সে দিকেও সরকারকে কড়া নযর রাখতে হবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১০, ১৩২।]
যেসব যিম্মী ইসলাম গ্রহণ করে, তাদের নিকট থেকে যেন জিযিয়া আদায় না করা হয়। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১২২, ১৩১।]
এ প্রসঙ্গে তিনি খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মধারাকে নযীর হিসেবে তুলে ধরেন। উদাহরণস্বরূপ হযরত আলী (রাঃ)-এর এ ঘটনাঃ গভর্ণরদের হেদায়াত দান কালে জনসমক্ষে তিনি বলতেন, তাদের কাছ থেকে পুরোপুরি ব্যয়ভার আদায় করতে, বিন্দুমাত্র অবহেলা করবে না। কিন্তু তাদের একান্তে ডেকে বলতেনঃ সাবধান! কাউকে মারপিট করে বা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে রাজস্ব আদায় করবে না। তাদের সাথে এমন কঠোরতা করবে না, যা সরকারের দায় দায়িত্ব শোধ করতে গিয়ে জামা-কাপড়, বাসন-কোসন বা গবাদি পশু বিক্রি করতে তারা বাধ্য হয়। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১৫, ১৬।] হযরত ওমর (রাঃ)-এর এ নিয়মের কথাও তিনি উল্লেখ করেন যে, বন্দোবস্ত দানকারী কর্মকর্তাদেরকে জেরা করে তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতেন যে, কৃষকদের ওপর কর আরোপে হাড় ভাঙ্গার কারণ ঘটাননি। কোন অঞ্চলের উসুলকৃত সম্পদ আসার পর গণ-প্রতিনিধিদের ডেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করতেন যে, কোন মুসলমান বা যিম্মী কৃষকের ওপর অত্যাচার করে এসব উসুল করা হয়নি। [আল-খারাজ-পৃষ্ঠা-৩৭, ১১৪।]
সাতঃ অমুসলিম প্রজার অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের ব্যাপারে ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) হযরত ওমর (রাঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ৩টি মুলনীতি বারবার এ গ্রন্থে উল্লেখ করেনঃ
এক : তাদের সাথে যে অঙ্গীকারই করা হোক না কেন, তা পূরণ করতে হবে।
দুই : রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তাদের নয়, বরং মুসলমানদের।
তিন : সাধ্যের চাইতে তাদের ওপর জিযিয়া এবং আয়করের বোঝা আরোপ করা যাবে না। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১৪, ৩৭, ১২৫।]
অতঃপর তিনি লিখেন যে, মিসকিন, অন্ধ, বৃদ্ধ, ধর্মযাজক, উপসানালয়ের কর্মচারী, স্ত্রী এবং শিশুদেরকে জিযিয়া কর থেকে রেহাই দিতে হবে। এদের ওপর জিযিয়া আরোপ করা যাবে না। যিম্মীদের সম্পত্তি এবং পশুপালনের ওপর কোন যাকাত ধার্য করা যাবে না। যিম্মীদের নিকট থেকে যিজিয়া উসুল করার ব্যাপারে মারপিট এবং দৈহিক নির্যাতন জায়েয নেই। জিযিয়া দানে অস্বীকৃতির শাস্তি হিসেবে বড় জোর শুধু আটক করা যেতে পারে। নির্ধারিত জিযিয়ার অতিরিক্ত কিছু তাদের কাছ থেকে আদায় করা হারাম। অচল-অক্ষম এবং অভাবী যিম্মীদের লালন-পালন সরকারী ভাণ্ডার থেকে করা উচিত। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১২২-১২৬।]
ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে তিনি হারুনুর রশীদকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, যিম্মীদের সাথে উদার এবং ভদ্রোচিত আচরণ করা স্বয়ং রাষ্ট্রের জন্যই কল্যাণকর। এ ধরনের ব্যবহারের ফলে হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামলে সিরিয়ার খৃষ্টানরা স্বধর্মী রোমকদের মুকাবিলায় মুসলমানদের কৃতজ্ঞ এবং কল্যাণকামী হয়ে যায়। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১২৯।]
আটঃ ভূমি বন্দোবস্ত
ভূমি বন্দোবস্ত প্রসঙ্গে ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) সে ধরনের জমিদারীকে হারাম প্রতিপন্ন করেন, যাতে কৃষকদের নিকট থেকে কর আদায়ের জন্য সরকার এক ব্যক্তিকে তাদের ওপর ভুস্বামী হিসেবে বসিয়ে দেয় ্রবেং তাকে কার্যত এ ক্ষমতা দান করে যে, সরকারের কর পরিশোধের পর কৃষকদের নিকট থেকে যতো খুশী উসুল করা যাবে। তিনি বলেন, এটা প্রজাদের প্রতি জঘন্য অত্যাচার এবং রাষ্ট্রের ধ্বংসের কারণ। এহেন পন্থা অবলম্বন করা রাষ্ট্রের জন্য কখনো উচিত নয়। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১০৫।]
অনুরূপ সরকার কোন ভূমি দখল করে তা কাউকে জায়গীর হিসেবে দান করাকেও তিনি হারাম প্রতিপন্ন করেন। তিনি লিখেছেনঃ “কোন আইনানুগ বা সুবিহিত অধিকার ব্যতিরেকে কোন মুসলিম বা যিম্মীর অধিকার থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয়ার কোন অধিকারই নেই ইমাম বা রাষ্ট্র-নেতার।” আপন খুশীমতে জনগণের মালিকানা ছিনিয়ে নিয়ে তা অন্য কাউকে দেয়া, তাঁর মতে ডাকাতি করে আদায়কৃত অর্থ অপরকে দান করার সমার্থক। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-৫৮, ৬০, ৬৬।]
তিনি বলেন, ভূমি প্রদানের কেবল একটি মাত্র পন্থাই আইন সিদ্ধ। তা হচ্ছে এই যে, অনাবাদী বা মালিকানা বিহীন ভূমি বা লাওয়ারিস পরিত্যক্ত ভূমি চাষাবাদের উদ্দেশ্যে, বা সত্যিকার সমাজ-সেবার জন্য পুরস্কার হিসেবে যুক্তিযুক্ত সীমার মধ্যে দান। যে ব্যক্তিকে এ ধরনের দান হিসেবে দেয়া হবে, যস যদি তিন বছর যাবৎ তা অনাবাদী ফেলে রাখে তা হলে তাও তার নিকট থেকে ফেরত নিতে হবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-৫৯-৬৬]
নয় : অত্যাচার-অনাচারের মূলোৎপাটন
অতঃপর তিনি হারুনুর রশীদের উদ্দেশ্যে বলেন, অত্যাচারী-খেয়ানতকারী লোকদেরকে রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত করা, তাদেরকে মহকুমা প্রশাসক বা আঞ্চলিক কর্মকর্তা নিয়োগ করা আপনার জন্য হারাম। এমতাবস্থায় তারা যেসব অত্যাচার চালাবে, তার পরিণতি আপনাকে বহন করতে হবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১১১।]
তিনি বারবার বলেন, সৎ, আল্লাভীরু, এবং আমানতদার ব্যক্তিদেরকে আপনি রাষ্ট্রীয় কার্যে নিয়োজিত করুন। সরকারী কাজের জন্য যাদেরকে বাছাই করা হবে, যোগ্যতার সাথে সাথে তাদের চরিত্রের ব্যাপারে নিশ্চিত হোন। এরপরও তাদের পিছনে নির্ভরযোগ্য যোগায়েন্দা নিয়োগ করুন। যাতে তারা বিকৃত হয়ে অত্যাচার-অনাচার শুরু করলে খলীফা যথাসময়ে সে সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন এবং চুলচেরা হিসেব নিতে সক্ষম হন। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১০৬, ১০৭, ১১১, ১৩২, ১৮৮।]
তিনি হারুণকে আরও বলেন যে, খলীফাকে সরাসরি জনগণের অভিযোগ শোনাতে হবে। তিনি যদি মাসে একবারও গণসমাবেশের ব্যবস্থা করেন, যেখানে প্রতিটি নির্যাতিত ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে নিজের অভিযোগ পেশ করতে পারে, আর সরকারী কর্মকর্তারা জানতে পারে যে, তাদের কর্মকাণ্ডের খবর সরকারি খলীফার কাছে পৌঁছায়, তবেই অত্যাচার-অনাচারের মুলোৎপাটন হবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১১১, ২১২।]
দশ : বিচার বিভাগ
বিচার বিভাগ সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ইনসাফ-সুবিচার এবং কেবল পক্ষপাতমুক্ত ইনসাফ বা সুবিচারই হচ্ছে বিচার বিভাগের দায়িত্ব। শাস্তিযোগ্য ব্যক্তিকে শাস্তি না দেয়া, আর শাস্তির অযোগ্য ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া-উভয়ই হারাম। সন্দেহ-সংশয়ের ব্যাপারে শাস্তি না দেয়া উচিত। ভুল করে শাস্তি দানের চেয়ে ভুল করে ক্ষমা করা শ্রেয়। ইনসাফের ব্যাপারে সকল প্রকার হস্তক্ষেপ এবং সুপারিশের দরজা বন্ধ করা উচিত। কোন ব্যক্তির পদ-মর্যাদা বা পজিশনের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করা যানে বা। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১৫২-১৫৩।]
এগার : ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণ
তিনি এ-ও বলেন যে, নিছক অপবাদের ভিত্তিতে কাউকে আটক করা যাবে না। কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ উত্থাপিত হলে যথারীতি মামলা দায়ের করা উচিত। এ ব্যাপারে সাক্ষ্য-প্রমাণ নেয়া হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে আটক করা হবে, অন্যথায় ছেড়ে দেয়া হবে। তিনি খলীফাকে পরামর্শ দেন, কারাগারে যেসব লোক আটক রয়েছে, তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো উচিত। কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতীত যাদেরকে আটক করা হয়েছে, তাদেরকে মুক্তি দেয়া উচিত। নিছক অভিযোগ এবং অপবাদের ভিত্তিতে মামলা দায়ের না করে ভবিষ্যতে কাউকে গ্রেপতার করা যাবে না এ মর্মে সকল গভর্ণরকে নির্দেশ পাঠাতে হবে। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১৭৫-১৭৬।]
তিনি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেন যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে নিছক অপবাদের ভিত্তিতে মারপিট করা আইন বিরুদ্ধ। আদালতের কাছ থেকে দণ্ডযোগ্য বলে প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শরীয়াতের দৃষ্টিতে প্রতিটি নাগরিকের পৃষ্ঠদেশর সম্পূর্ণ সংরক্ষিত। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১৫১।]
বার : কারাগারের সংস্কার
কারাগার সম্পর্কে তিনি সংস্কারের যে পরামর্শ দান করেন, তাতে তিনি বলেন, আটককৃত ব্যক্তি সরকারী ভাণ্ডার থেকে আহার্য এবং পরিধেয় বস্ত্র পাওয়ার যোগ্য। এটা তার অধিকার। উমাইয়া এবং আব্বাসীয় শাসনামলের প্রচলিত পন্থার কঠোর নিন্দা করে তিনি বলেন, তাদের শাসনামলে কয়েদীদেরকে হাতে-পায়ে বেড়ি লাগিয়ে কয়েদখানার বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো এবং তারা ভিক্ষা করে নিজেরদের জন্য আহার্য এবং পরিধেয় সংগ্রহ করতো। তিনি খলীফা ক বলেন, এ প্রথা বন্ধ হওয়া উচিত। সরকারের তরফ থেকে তাদেরকে শীত-গ্রীষ্মের বস্ত্র এবং পেটপুরে খাবার দেয়া অপরিহার্য।
তিনি কঠোর নিন্দা করে বলেন, লা-ওয়ারেসি কয়েদী মারা গেলে গোসল, কাফন এবং সালাতের জানাযা ছাড়াই তাদেরকে পুঁতে ফেলা হতো। তিনি বলেন, মুসলমানদের জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কয়েদীদের দাফন-কাফন এবং সালাতে জানাযার ব্যবস্থা করা উচিত।
তিনি এ সুপারিশও করেন যে, হত্যার অপরাধে আটক ব্যক্তি ছাড়া অন্য কোন কয়েদীকে কারাগারে বেঁধে রাখা যাবে না। [আল-খারাজ, পৃষ্ঠা-১৫১।]
তাঁর কাজের সঠিক মূল্যায়ণ
আজ থেকে ১২ শত বছর পূর্বে একজন যথেচ্ছাচারী নৃপতির সামনে তাঁর আইনমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) যেসব আইনগত সুপারিশ করেছেন, ওপরে তার সংক্ষিপ্তসার পেশ করা হলো। ইসলামী রাষ্ট্রের মূল নীতি, খেলাফতে রাশেদার কর্মনীতি এবং স্বয়ং তার ওস্তাদ ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর শিক্ষার সাথে তুলনা করে দেখলে তাঁর এ সকল সুপারিশকে অনেকটা ন্যূনতম বলেই প্রতীয়মান হবে। এতে নির্বাচন ভিত্তিক খেলাফতের ধারণার বিন্দুমাত্র লক্ষণও উপস্থিত পাওয়া যায় না। শুরা বা পরামর্শের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার কোন উল্লেখ এতে নেই। যালেম-অত্যাচারী শাসকের শাসনকার্য চালাবার কোন অধিকার নেই, অত্যাচারী শাসকের স্থলে উন্নতকর শাসক নিয়োগের চেষ্টা করার ক্ষমতা জনগণের রয়েছে-এমন ধারণাও তাঁর পরামর্শে অনুপস্থিত। এমনি করে আরও অনেক দিক থেকেই তাঁর এ সকল প্রস্তাব সত্যিকার ইসলামী দর্শনের তুলনায় অনেক অসম্পূর্ণ। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, কিতাবুল খারাজ-এ উল্লেখিত প্রস্তাবাবলি পর্যন্তই ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ)-এর রাষ্ট্র দর্শনের ব্যাপকতা সীমাবদ্ধ ছিল। এ গ্রন্থে তিনি যা উল্লেখ করেছেন, মূলত তার চেয়ে বেশী কিছু তিনি কামনা করতেন না-এমন ধারণাও ঠিক নয়। বরং সেকালে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের নিকট একজন বাস্তববাদী দার্শনিক যা আশা করতে পারে, মূলতঃ এটা তার চেয়ে অনেক বেশী কিছু ছিল। সেকালের বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে একটা নিছক কাল্পনিক চিত্র অংকনই-নিছক ধারণা-কল্পনা পর্যন্তই যা সীমাবদ্ধ, যার বাস্তবায়নের কোন সম্ভাবনাই নেই- তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তিনি এমন এরকটি আইনানুগ স্কীম তৈরী করতে চেয়েছিলেন, যার মধ্যে নিহিত থাকবে ইসলামী রাষ্ট্রের ন্যূনতম প্রাণ শক্তি, সাথে সাথে তৎকালীন পরিস্থিতিতে তাকে কার্যে রূপায়িতও করা যাবে।