দ্বিতীয় অধ্যায়
ইসলামের শাসন-নীতি
ইতিপূর্বে কোরআন মাজীদের যে রাজনৈতিক শিক্ষা বর্ণিত হয়েছে তা বাস্তবে রূপায়িত করাই ছিল রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর কাজ। তাঁর নেতৃত্বে ইসলামের অভ্যূদয়ের পর যে মুসলিম সমাজ অস্তিত্ব লাভ করে এবং হিজরতের পর রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে তা যে রাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করে, তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল কুরআন মজীদের রাজনৈতিক শিক্ষার ওপর ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য তাকে অন্যান্য শাসন ব্যবস্থা থেকে পৃথক করে।
একঃ আল্লার আইনের কর্তৃত্ব
এ রাষ্ট্রের প্রথম মূলনীতি ছিল এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং ঈমানদারদের শাসন হচ্ছে মূলতঃ খেলাফত বা আল্লার প্রতিনিধিত্বশীল শাসন। কাজেই বলগাহীন ভাবে কাজ করার তার কোন অধিকার নেই। বরং আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাতের উৎস থেকে উৎসারিত আল্লাহর আইনের অধীনে কাজ করা তার অপরিহার্য কর্তব্য। কুরআন মজীদের যেসব আয়াতে এ মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে আগের অধ্যায়ে আমরা তা উল্লেখ করেছি। তন্মদ্ধে বিশেষ করে নিম্নোক্ত আয়াতগুলো এ ব্যাপারে একান্ত স্পষ্টঃ
আন-নিসাঃ ৫৯, ৬৪, ৬৫, ৮০, ১০৫; আল-মায়েদাঃ ৪৪, ৪৫, ৪৭; আল-আরাফঃ ৩; ইউসুফঃ ৪০; আন-নূরঃ ৫৪, ৫৫; আল-আহযাবঃ ৩৬ এবং আল-হাশরঃ ৭।
নবী (সঃ)-ও তার অসংখ্য বাণীতে এ মূলনীতি অত্যান্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেনঃ
*********************
-আল্লার কিতাব মেনে চলা তোমাদের জন্য অপরিহার্য। আল্লার কিতাব যা হালাল করে দিয়েছে তোমরা তাকে হালাল মনে করো, আর যা হারাম করেছে, তোমরা তাকে হারাম মনে করো। [কানযুল ওম্মাল, ত্বাবরানী এবং মুসনাদে আহমাদের উদ্ধৃতিতে, ১ম খন্ড, হাদীস নং-৯০৭-৯৬৬; দায়েরাতুল মায়ারেফ, হায়দরাবাদ সংস্করণ ১৯৫৫।]
*********************
-আল্লাহ তাআলা কিছু ফরায়েয নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তোমরা তা নষ্ট করো না, কিছু হারাম বিষয় নির্দিষ্ট করেছেন, তোমরা তা লংঘন করো না, কিছু সীমা নির্ধারণ করেছেন, তোমরা তা অতিক্রম করো না, ভুল না করেও কিছু ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করেছেন, তোমরা তার সন্ধানে পড়ো না। [মিশকাত, দারেকুতনীর উদ্ধৃতিতে-বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ, কানযুল ওম্মাল, ১ম খন্ড, হাদীস নং-৯৮১, ৯৮২।]
*********************
-যে ব্যক্তি আল্লার কিতাব মেনে চলে, সে দুনিয়ায় পথভ্রষ্ট হবে না, পরকালেও হবে না সে হতভাগা। [মিশকাত, রাযীন-এর উদ্ধৃতিতে উল্লেখিত অধ্যায়।]
*********************
-আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে থাকবে, কখনো পথভ্রষ্ট হবে না, -আল্লার কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাহ। [মিশকাত মুয়াত্তার উদ্ধৃতিতে, আলোচ্য অধ্যায়, কানযুল ওম্মাল, ১ম খন্ড, হাদীস নং-৮৭৭, ৯৪৯, ৯৫৫, ১০০১।]
আমি তোমাদেরকে যে বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছি, তা গ্রহণ করো, আর যে বিষয় থেকে বারণ করছি, তা থেকে তোমরা বিরত থাক। [কানযুল ওম্মাল, ১ম খন্ড, হাদীস নং-৮৬৬।]
দুইঃ আদল-সকল মানুষের প্রতি সুবিচার
দ্বিতীয় যে মুলনীতির ওপর সে রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, তা ছিল এ কুরআন-সুন্নার দেয়া আইন সকলের জন্য সমান, রাষ্ট্রের সামান্যতম ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র প্রধান পর্যন্ত সকলের উপর তা সমভাবে প্রয়োগ করা উচিত। তাতে কারো জন্য কোন ব্যতিক্রমধর্মী আচরণের বিন্দু মাত্র অবকাশ নেই। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে এ কথা ঘোষণা করার নির্দেশ দিচ্ছেনঃ
*********************
-এবং তোমাদের মধ্যে আদল-সুবিচার কায়েম করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অর্থাৎ পক্ষপাতমুক্ত সুবিচার-নীতি অবলম্বন করার জন্য আমি আদিষ্ট ও নিয়োজিত। পক্ষপাতিত্বের নীতি অবলম্বন করে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে যাওয়া আমার কাজ নয়। সকল মানুষের সাথে আমার সমান সম্পর্ক-আর তা হচ্ছে আদল ও সুবিচারের সম্পর্ক। সত্য যার পক্ষে, আমি তার সাথী; সত্য যার বিরুদ্ধে, আমি তার বিরোধী। আমার দ্বীনে কারও জন্য কোন পার্থক্য মূলক ব্যবহারের অবকাশ নেই। আপন-পর, ছোট-বড়, শরীফ-কমীনের জন্য পৃথক পৃথক অধিকার সংরক্ষিত নেই। যা সত্য তা সকলের জন্যই সত্য; যা গুনাহ, তা সকলের জন্যই গুনাহ; যা হারাম, তা সবার জন্যই হারাম; যা হালাল, তা সবার জন্যই হালাল; যা ফরয, তা সকলের জন্যই ফরয। আল্লার আইনের এ সর্বব্যপী প্রভাব থেকে আমার নিজের সত্ত্বাও মুক্ত নয়, নয় ব্যতিক্রম। নবী (সঃ) নিজে এ মূলনীতি বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ
*********************
-তোমাদের পূর্বে যেসব উম্মাত অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা এ জন্য ধ্বংস হয়েছে যে, নিম্ন পর্যায়ের অপরাধীদেরকে আইন অনুযায়ী শাস্তি দান করতো, আর উচ্চ পর্যায়ের অপরাধীদেরকে ছেড়ে দিতো। সে সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ নিহিত, (মুহাম্মাদের আপন কন্যা) ফাতেমাও যদি চুরি করতো, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে ফেলতাম। [বুখারী, কিতাবুল হুদূদ, অধ্যায়ঃ ১১-১২]
হযরত উমর (রাঃ) বলেনঃ
*********************
-আমি নিজে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে আপন সত্তা থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে দেখেছি। [কিতাবুল খারাজ, ইমাম আবু ইউসুফ, পৃষ্ঠা-১১৬, আল-মাতবাআতুস সলফিয়া, মিশর, ২য় সংস্করণ, ১৩৫২ হিঃ; মুসনাদে আবু দাউদ আত-তায়ালেসী, হাদীস নং-৫৫, দায়েরাতুল মাআরেফ হায়দারাবাদ সংস্করণ, ১৩২১ হিজরী।]
তিনঃ মুসলমানদের মধ্যে সাম্য
এ রাষ্ট্রের তৃতীয় মূলনীতি ছিল, বংশ-বর্ণ-ভাষা এবং দেশ-কাল নির্বিশেষে সকল মুসলমানের অধিকার সমান। এ রাষ্ট্রের পরিসীমায় কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠি, দল, বংশ বা জাতি কোন বিশেষ অধিকার লাভ করতে পারে না।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
*********************
-মুমিনরা একে অন্যের ভাই। -আল-হুজুরাতঃ ১০
*********************
-হে মানব মন্ডলী। এক পুরুষ এবং নারী থেকে আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে নানা গোত্র, নানা জাতিতে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। মূলত আল্লার নিকট তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী সম্মানার্হ, যে সবচেয়ে বেশী আল্লাকে ভয় করে। -আল-হুজরাতঃ১৩
নবী (সঃ)-এর নিম্নোক্ত উক্তি এ মূলনীতিকে আরও স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেঃ
*********************
-আল্লাহ তোমাদের চেহারা এবং ধন-সম্পদের দিকে তাকান না বরং তিনি অন্তর ও কার্যাবলীর দিকে তাকান। [তাফসীরে ইবনে কাসীর, মুসলিম এবং ইবনে মাজার উদ্ধৃতিতে, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-২১৭, মুস্তফা মুহাম্মদ প্রেস, মিশর-১৯৩৭।]
*********************
-মুসলমানরা ভাই ভাই। কারো ওপর কারো কোন ফযীলত নেই কিন্তু তাকওয়ার ভিত্তিতে। [তাফসীরে ইবনে কাসীর, তিবরাণীর উদ্ধৃতিতে, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-২১৭।]
*********************
-হে মানব জাতি। শোন, তোমাদের রব এক। অনারবের ওপর আরবের আর আরবের ওপর অনারবের কোন মর্যাদা নেই। সাদার ওপর কালোর বা কালোর ওপর সাদারও নেই কোন শ্রেষ্ঠত্ব। হাঁ, অবশ্য তাকওয়ার বিচারে। [তসীরে রুহুল মাআনী, বায়হাকী এবং ইবনে মারদুইয়ার উদ্ধৃতিতে ২৬শ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৪৮, ইদরাতুত তাবয়াতিল মুনিরিয়া, মিশর।]
*********************
-যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, আমাদের কেবলার দিকে মুখ করে, আমাদের মত সালাত আদায় করে, আমাদের জবাই করা জন্তু খায়, সে মুসলমান। মুসলমানের যে অধিকার, তারও সে অধিকার, মুসলমানের যে কর্তব্য, তারও সে কর্তব্য। [বুখারী, কিতাবুস সালাত, অধ্যায়-২৮]
*********************
-সকল মুমিনের রক্তের মর্যাদা সমান, অন্যের মুকাবিলায় তারা সবাই এক। তাদের একজন সামান্যতম ব্যক্তিও তাদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিতে পারে। [আবু দাউদ, কিতাবুদ দিয়াত, অধ্যায়-১১, নাসায়ী, কিতাবুল কাসামাত, অধ্যায়-১০, ১৪]
*********************
মুসলমানদের ওপর জিজিয়া আরোপ করা যেতে পারে না। [আবু দাউদ, কিতাবুল ইমরত, অধ্যায়-৩৪]
চারঃ সরকারের দায়িত্ব ও জবাবদিহি
এ রাষ্ট্রের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ছিল, শাসন কর্তৃত্ব এবং তার ক্ষমতা-ইখতিয়ার ও অর্থ-সম্পদ আল্লাহ এবং মুসলমানের আমানত। আল্লাভীরু, ঈমানদার ও ন্যায়পরায়ণ লোকদের হাতে তা ন্যাস্ত করা উচিত। কোন ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামত বা স্বার্থবুদ্ধি প্রোণোদিত হয়ে এ আমানতে খেয়ানত করার অধিকার রাখে না। এ আমানত যাদের সোপর্দ করা হবে তারা এজন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। আল্লাহ তয়ালা কুরআন মাজীদে বলেনঃ
*********************
আমানত বহনের যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে আমানত সোপর্দ করার জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন। আর যখন মানুষের মধ্যে ফায়সালা করবে। ন্যায়নীতির সাথে ফায়সালা করবে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালো উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও দেখেন।
রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ
*********************
-সাবধান। তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় নেতা-যিনি সকলের ওপর শাসক হন-তিনিও দায়িত্বশীল তাঁকেও তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। [বুখারী, কিতাবুর আহকাম, অধ্যায়-১। মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৫।]
*********************
যিনি মুসলিম প্রজাদের কাজ-কারবারের প্রধান দায়িত্বশীল, কোনো শাসক যদি তাদের সাথে প্রতারণা এবং খেয়ানতকারী অবস্থায় মারা যান তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। [বুখারী, কিতাবুর আহকাম, অধ্যায়-৮। মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়-৬১; কিতাবুল এমারাত, অধ্যায়-৫।]
*********************
-মুসলিম রাষ্ট্রের কোন পদাধিকারী শাসক যিনি নিজের পদের দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন না, নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন না; তিনি কখনো মুসলমানদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবেন না। [মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৫।]
*********************
-(নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যারকে বলেন) আবু যার! তুমি দুর্বল মানুষ, আর সরকারের পদ-মর্যাদা একটা আমানত। কেয়ামতের দিন লজ্জা এবং অপমানের কারণ হবে; অবশ্য তার জন্য নয়, যে পুরোপুরি তার হক আদায় করে এবং তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। [কানযুল ওম্মার, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৬৮, ১২২।]
*********************
-শাসকের জন্য আপন প্রজাদের মধ্যে ব্যবসা করা সবচেয়ে নিকৃষ্ট খেয়ানত। [কানযুল ওম্মার, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৭৮।]
*********************
-যে ব্যক্তি আমাদের রাষ্ট্রের কোন পদ গ্রহণ করে, তার স্ত্রী না থাকলে বিবাহ করবে, খাদেম না থাকলে একজন খাদেম গ্রহণ করবে, ঘর না থাকলে একখানা ঘর করে নেবে, (যাতায়াতের) বাহন না থাকলে একটা বাহন গ্রহণ করবে। যে ব্যক্তি এর চেয়ে বেশী অগ্রসর হয়, সে খেয়ানতকারী অথবা চোর। [কানযুল ওম্মার, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩৪৬।]
*********************
-যে ব্যক্তি শাসক হবে, তাকে সবচেয়ে কঠিন হিসাব দিতে হবে, আর সবচেয়ে কঠিন আযাবের আশংকায় পতিত হবে। আর যে ব্যক্তি শাসক হবে না, তাকে হালকা হিসেব দিতে হবে, তার জন্য হালকা আযাবের আশংকা আছে। কারণ শাসকের মাধ্যমে মুসলমানদের ওপর যুলুমের সম্ভাবনা অনেক বেশী। আর যে ব্যক্তি মুসলমানদের ওপর যুলুম করে, সে আল্লার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। [কানযুল ওম্মার, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫০৫।]
হযরত উমর (রাঃ) বলেনঃ
*********************
-ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি বকরীর বাচ্চাও হারিয়ে যায় (বা ধ্বংস হয়) তবে আমার ভয় হচ্ছে, আল্লাহ আমাকে সে জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। [কানযুল ওম্মার, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫১২।]
পাঁচঃ শুরা বা পরামর্শ
এ রাষ্ট্রের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ছিল মুসলমানদের পরামর্শ এবং তাদের পারস্পারিক সম্মতি ক্রমে রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হতে হবে। তাঁকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনাও করতে হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
*********************
-আর মুসলমানদের কাজকর্ম (সম্পন্ন হয়) পারস্পরিক পরামর্শ ক্রমে।
*********************
-হে নবী। কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করো।
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসুল্লাহ (সঃ) এর খেদমতে আরয করি যে, আপনার পর আমাদের সামনে যদি এমন কোন বিষয় উপস্থিত হয়, যে সম্পর্কে কুরআনে কোন নির্দেশ না থাকে এবং আপনার কাছ থেকেও সে ব্যাপারে আমরা কিছু না শুনে থাকি, তখন আমরা কি করবো?
তিনি বলেনঃ
*********************
-এ ব্যাপারে দ্বীনের জ্ঞান সম্পন্ন এবং ইবাদত গুযার ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ কর এবং কোন ব্যক্তি বিশেষের রায় অনুযায়ী ফায়সালা করবে না। [হাদীসে ইবাদতগুযার অর্থে এমন সব ব্যক্তিদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা আল্লার বন্দেগী করে, স্বাধীনভাবে নিজের মন মতো কাজ করে না। এ থেকে এই অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয় যে, যাদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা হবে, কেবল তাদের ইবাদতগুযারীর গুণটিই দেখে নেয়া হবে; মতামত এবং পরামর্শ দানের যোগ্যতা দানের সম্পন্ন হওয়ার জন্য অন্যান্য যেসব গুণাবলী প্রয়োজন, তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হবে না।]
হযরত উমর (রাঃ) বলেনঃ
*********************
-মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া যে ব্যক্তি তার নিজের বা অন্য কারো নেতৃত্বের (এমারত) প্রতি আহবান জানায়, তাকে হত্যা না করা তোমাদের জন্য হালাল নয়। [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৭৭। হযরত ওমর (রাঃ)-এর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে কোন ব্যক্তির জোর-পূর্বক চেপে বসার চেষ্টা করা এক মারাত্মক অপরাধ, তা বরদাস্ত করা উম্মাতের উচিত নয়।]
অপর এক বর্ণনায় হযরত ওমর (রাঃ)-এর এ উক্তি বর্ণিত আছেঃ
*********************
পরামর্শ ব্যতীত কোন খেলাফত নেই। [কানযুর ওম্মাল, ৫ম খন্ডম হাদীস নং-২৩৫৪]
ছয়ঃ ভাল কাজে আনুগত্য
৬ষ্ঠ মূলনীতি-যার ওপর এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-এই ছিল যে, কেবল মাত্র মা’রূফ-ভাল কাজেই-সরকারের আনুগত্য অপরিহার্য। পাপাচারে (মাসিয়াত) আনুগত্য পাওয়ার অধিকার কারুর নেই। অন্য কথায়, এ মূলনীতির তাৎপর্য এই যে, সরকার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের কেবল সেসব নির্দেশই তাদের অধীন ব্যক্তিবর্গ এবং প্রজাবৃন্দের জন্য মেনে চলা ওয়াজেব, যা আইনানুগ। আইনের বিরুদ্ধে নির্দেশ দেয়ার তাদের কোন অধিকার নেই; তা মেনে চলাও কারো উচিত নয়। কুরআন মজিদে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বায়’আত-আনুগত্যের শপথ গ্রহণকেও মারূফে আনুগত্যের শর্তে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অথচ তাঁর পক্ষ থেকে কোন মা’সিয়াত (পাপাচার) এর নির্দেশ আসার কোন প্রশ্নই ওঠে নাঃ
*********************
-এবং কোন মারূফ কাজে তারা আপনার নাফরমানী-অবাধ্যতা করবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
*********************
-একজন মুসলমানের ওপর তার আমীরের আনুগত্য করা-শোনা এবং মেনে চলা-ফরয; তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যতক্ষণ তাকে কোন মাসিয়াত-পাপাচারের নির্দেশ না দেয়া হয়। মাসিয়াত-এর নির্দেশ দেয়া হলে কোন আনুগত্য নেই। [বুখারী, কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৪। মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৮। আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়-৯৫। নাসায়ী, কিতাবুল বায়আত, অধ্যায়-৩৩। ইবনে মাজা, আবওয়াবুল জিহাদ, অধ্যায়-৪০।]
-আল্লার নাফরমানীতে কোন আনুগত্য নেই, আনুগত্য কেবল মারূফ কাজে। [মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৮। আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়-৯৫। নাসায়ী, কিতাবুল বায়আত, অধ্যায়-৩৩।]
নবী (সাঃ) এর বিভিন্ন উক্তিতে বিভিন্নভাবে এ বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। কোথাও তিনি বলেছেন ****** (যে আল্লার নাফরমানী করে, তার জন্য কোন আনুগত্য নেই), কখনো বলেছেনঃ **************** (স্রষ্টার নাফরমানীতে সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই), কখনো বলেছেনঃ ***************** (যে আল্লার আনুগত্য করে না তার জন্য কোন আনুগত্য নেই), কখনো বলেছেনঃ ********************** (যে শাসক তোমাকে কোন মা’সিয়াত-এর নির্দেশ দেয় তার আনুগত্য করো না)। [কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-২৯৩, ২৯৪, ২৯৫, ২৯৬, ২৯৯, ৩০১।]
হযরত আবুবকর রাঃ) তাঁর এক ভাষণে বলেনঃ
*********************
-যে ব্যক্তিকে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মাতের কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, কিন্তু সে লোকদের মধ্যে আল্লার কিতাব অনুযায়ী কাজ করেনি, তার ওপর আল্লার লানত-অভিসম্পাত। [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ডম হাদীস নং-২৫০৫]
এ কারণেই খলীফা হওয়ার পর তিনি তাঁর প্রথম ভাষণেই ঘোষণা করেছিলেনঃ
*********************
-যতক্ষণ আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করি, তোমরা আমার আনুগত্য করো। যখন আমি আল্লাহ এবং রাসূলের নাফরমানী করবো, তখন তোমাদের ওপর আমার কোন আনুগত্য নেই। [কানযুর ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদিস নং-২২৮২। অপর এক বর্ণনায় হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর শব্দগুলো এইঃ **************** -আর আমি যদি আল্লার রাফরমানী করি, তাহরে তোমরা আমার নাফরমানী করো। -কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস-২৩৩০।]
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ
*********************
-আল্লার নাযিল করা বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করা এবং আমানত আদায় করে দেয়া মুসলমানদের শাসকের ওপর ফরয। শাসক যখন এভাবে কাজ করে তখন তা শুনা ও মেনে চলা এবং তাদেরকে আহবান জানালে তাতে সাড়া দেয়া লোকেদের কর্তব্য। [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৩১।]
একদা তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেনঃ
*********************
-আল্লার আনুগত্য করে আমি তোমাদেরকে যে নির্দেশ দেই, তা মেনে চলা তোমাদের ওপর ফরয-সে নির্দেশ তোমাদের পছন্দ হোক বা না হোক। আর আল্লার নাফরমানী করে আমি তোমাদেরকে যে নির্দেশ দেই, তাতে আল্লার সাথে মা’সিয়াত বা পাপাচারের ক্ষেত্রে কারো জন্য আন্যগত্য নেই; আনুগত্য কেবল মা’রূফে, আনুগত্যে কেবল মা’রূফে। [কারযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৮৭।]
সাতঃ পদ-মর্যাদার দাবী এবং লোভ নিষিদ্ধ
এটাও সে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিল যে, সাধারণত রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদ বিশেষত খেলাফতের জন্য সে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি অযোগ্য-অনুপযুক্ত, যে নিজে পদ লাভের অভিলাষী এবং সে জন্য সচেষ্ট।
আল্লাহ তা’আলা কুরআনে মাজীদে বলেনঃ
*********************
-আখেরাতের ঘর আমি তাদেরকে দেবো, যারা যমীনে নিজের মহত্ব খুজে বেড়ায় না, বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। -আল-কাসাসঃ ৮৩
নবী (সাঃ) বলেনঃ
*********************
-আল্লার শপথ, এমন কোন ব্যক্তিকে আমরা এ সরকারের পদ মর্যাদা দেই না, যে তা চায় এবং তার জন্য লোভ করে। [বুখারী, কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৭। মুসলিম, কিতাবুল এমারাত, অধ্যায়-৩]
*********************
-যে ব্যক্তি নিজে তা সন্ধান করে, আমাদের নিকট সে-ই সবচেয়ে বেশী খেয়ানতকারী। [আবু দাউদ, কিতাবুল এমারাত, অধ্যায়-২।]
*********************
-আমরা এমন কোন ব্যক্তিকে আমাদের সরকারী কর্মচারী হিসাবে গ্রহণ করি না, যে নিজে উক্ত পদের অভিলাষী। [কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ডম হাদীস নং-২০৬]
*********************
-আব্দুর রহমান ইবনে সামুরকে (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আব্দুর রহমান, সরকারী পদ দাবী করো না। কেননা চেষ্টা তদবীর করার পর যদি তা তোমাকে দেয়া হয়, তবে তোমাকে তার হাতে সপে দেয়া হবে, আর যদি চেষ্টা তদবীর ছাড়াই তা লাভ করো, তবে তার হক আদায় করার ব্যাপারে আল্লার পক্ষ থেকে তোমাকে সাহায্য করা হবে। [কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৬৯। এখানে কারো যেন সন্দেহ না হয় যে, এটা যদি মূলনীতি হয়ে থাকে, তা হলে হযরত ইউসুফ (আঃ) মিশরের বাদশার নিকট সরকারের পদ দাবী করলেন কেন? মূলত হযরত ইউসুফ (আঃ) কোন ইসলামী রাষ্ট্রে এ পদ দাবী করেন নি, দাবী করেছিলেন এক কাফের রাষ্ট্রে কাফের সরকারের কাছে। সেখানে এক বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক সন্ধিক্ষণে তিনি উপলব্ধি করেন যে, আমি যদি বাদশাহের নিকট রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ দাবী করি, তবে তা পেতে পারি। আর তার মাধ্যমে এদেশে আল্লার দ্বীন বিস্তার করার পথ সুগম হতে পারে। কিন্তু আমি যদি ক্ষমতার দাবী থেকে বিরত থাকি, তা হলে কাফের জাতির হেদায়াতের যে দূর্লভ সুযোগ আমি পাচ্ছি, তা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এটা ছিল এক বিশেষ পরিস্থিতি, তার ওপর ইসলামের সাধারণ নিয়ম আরোপ করা যায় না।
আটঃ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য
এ রাষ্ট্রের শাসক এবং তার সরকারের সর্ব প্রথম কর্তব্য এই সাব্যস্ত হয়েছিল যে, কোন রকম পরিবর্তন-পরিবর্ধন ছাড়াই যথাযথভাবে সে ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করবে, ইসলামের চারিত্রিক মানদন্ডানুযায়ী ভালো ও সদ-গুণাবলীর বিকাশ এবং মন্দ ও অসৎ গুণাবলীর বিনাশ সাধন করবে। কুরআন মজীদে এ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
********************
– (মুসলমান তারা) যাদেরকে আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, ভাল কাজের নির্দেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে বারণ করে।
– আল-হজ্জঃ ৪১
কুরআনের দৃষ্টিতে মুসলিম মিল্লাতের অস্তিত্বের মূল লক্ষ্যও এটিইঃ
***********************
– এমনি করে আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মাত (বা ভারসাম্যপূর্ণ পথে অবিচল উম্মাত) করেছি, যেন তোমরা লোকদের ওপর সাক্ষী হও আর রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর। – আল-বাকারাঃ ১৪৩।
**************************
– তোমরা সে সর্বোত্তম উম্মাত, মানুষের (সংশোধন এবং পথ প্রদর্শনের) জন্য যাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে এবঙ আল্লার প্রতি ঈমান রাখবে।
এতদ্ব্যতীত যে কাজের জন্য মুহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর পূর্বেকার সকল নবী-রাসূল আদিষ্ট ছিলেন, কুরআনের দৃষ্টিতে তা ছিল এইঃ
******************************
– দ্বীন কায়েম করো এবং তাতে বিভিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ো না। – শূরাঃ ১৩
অমুসলিম বিশ্বের মুকাবিলায় তাঁর সকল চেষ্টা সাধনাই ছিল এ উদ্দেশ্যেঃ
****************************
– দ্বীন যেন সর্বতোভাবে আল্লার জন্যই নির্ধারিত হয়ে যায়।
অন্যান্য সকল নবী-রাসূলের উম্মাতের মতো তাঁর উম্মাতের জন্যও আল্লার নির্দেশ ছিলঃ
***************************
– তারা নিজের দ্বীনকে একমাত্র আল্লার জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে আল্লার বন্দেগী করবে। – আল-বাইয়োনাঃ ৫।
এ জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম কাজ ছিল, দ্বীনের পরিপূর্ণ ব্যবস্থাকে কায়েম করা, তার মধ্যে এমন কোন সংমিশ্রণ হতে না দেয়া, যা মুসলিম সমাজে দ্বিমুখী নীতি সৃষ্টি করে। এ শেষ বিষয়টি সম্পর্কে নবী (সঃ) তাঁর সাহাবী এবং স্থলাভিষিক্তদের কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেনঃ
***************************
– আমাদের এ দ্বীনে যে ব্যক্তি এমন কোন বিঝয় উদ্ভাবন করবে, যা তার পর্যায়ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। [মিশকাত, বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ।]
*************************
– সাবধান! নব উদ্ভাবিত বিষয় থেকে বিরত থাকবে। কারণ, সকল নব উদ্ভাবিত বিষয়ই বেদআত, আর সকল বেদআতই গুমরাহী, পথভ্রষ্টতার অন্তর্ভূক্ত। [মিশকাত, বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ।]
***********************
– যে ব্যক্তি কোন বেদআত উদ্ভাবকের সম্মান করে, সে ইসলামের মুলোৎপাটনে সাহায্য করে। [মিশকাত, বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ।
– এ প্রসঙ্গে আমরা তাঁর এ উক্তিও দেখতে পাই যে, তিন ব্যক্তি আল্লার সবচেয়ে বেশী না-পসন্দ, তাদের একজন হচ্ছে সে ব্যক্তিঃ
**********************
– যে ইসলাম কোনো জাহেলী রীতিনীতির প্রচলন করতে চায়। [মিশকাত, বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন্নাহ।]
নয়ঃ আমর বিল মা‘রূফ ও নাহ্ই আনিল মুনকার এর অধিকার এবং কর্তব্য
এ রাষ্ট্রের সর্বশেষ মূলনীতি- যা তাকে সঠিক পথে টিকিয়ে রাখার নিশ্চয়তা দেয়- তা ছিল, মুসলিম সমাজে প্রতিটি ব্যক্তি সত্যবাক্য উচ্চারণ করবে, নেকী ও কল্যাণের সহায়তা করবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের যেখানেই কোন ভুল এবং অন্যায় কার্য হতে দেখবে, সেখানেই তাকে প্রতিহত করতে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা করবে। মুসলিম সমাজের প্রতিটি সদস্যের এটা শুধু অধিকারই নয়, বরং অপরিহার্য কর্তব্যও। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের নির্দেশ হচ্ছেঃ
********************
-নেকী এবং তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করো এবং গুনাহ ও অবাধ্যতার কাজে সাহায্য করো না। – আল-মায়েদাঃ ২।
*********************
– ঈমানদাররা! আল্লাকে ভয় করো এবং সত্য সঠিক কথা বলো। – আল-আহযাবঃ ৭০
************************
– ঈমানদাররা! তোমরা সকলে ন্যায় বিচারে অটল-অবিচল থাকো এবং আল্লার জন্য সাক্ষ্যদাতা হও- তোমাদের সাক্ষ্য স্বয়ং তোমাদের নিজেদের বা তোমাদের পিতা-মাতা বা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যাক না কেন।
*************************
– মুনাফিক নারী-পুরুষ একই থলের বিড়াল, তারা মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়, ভাল কাজ থেকে বারণ করে। …… আর মু’মিন নারী-পুরুষ একে অন্যের সাথী, তারা ভাল কাজের নির্দেশ দান করে আর মন্দ কাজ থেকে বারণ করে। – আত-তাওবাঃ ৬৭-৭১।
আল-কুরআনে ঈমানদারদের এ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উক্ত হয়েছেঃ
***************************
– নেকীর নির্দেশ দানকারী, মন্দ কাজ থেকে বারণকারী এবং আল্লার সীমারেখা সংরক্ষণকারী। – আত-তাওবাঃ ১১২
এব্যাপারে নবী (সঃ)-এর এরশাদ এইঃ
***************************
-তোমাদের কেউ যদি কোন মুনকার (অসৎ কাজ) দেখে, তবে তার উচিত হাত দিয়ে তা প্রতিহত করা। তা যদি না পারে, তবে মুখ দ্বারা বারণ করবে, তাও যদি না পারে, তবে অন্তর দ্বারা (খারাপ জানবে এবং বরণ করার আগ্রহ রাখবে), আর এটা হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়। [মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়- ২০। তিরমিযি, আবওযাবুল ফিতান, অধ্যায়-১২। আবু দাউদ, কিতবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭, ইবনে মাজা, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-২০।]
****************************
-অতঃপর অযোগ্য লোকেরা তাদের স্থানে বসবে। তারা এমন সব কথা বলবে, যা নিজেরা করবে না, এমনসব কাজ করবে, যার নির্দেশ দেয়া হয়নি তাদেরকে। যে হাতের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করবে, সে মুমিন; যে জিহ্বার সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করবে, সে মুমিন; অন্তর দিয়ে যে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করবে, সে মুমিন। ঈমানের এর চেয়ে ক্ষুদ্র সামান্যতম পর্যায়ও নেই। [মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়-২০।]
********************
– যালেম শাসকের সামনে ন্যায় বা সত্য কথা বলা সর্বোত্তম জেহাদ। [আবু দাউদ, কিতাবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭। তিরমিযি, কিতাবুল ফিতান, অধ্যায়-১২। নাসায়ী, কিতাবুল বায়আত, অধ্যায়-৩৬। ইবনে মাজা, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-২০।]
************************
– যালেমকে দেখেও যারা তার হাত ধরে না (বাধা দেয় না) তাদের ওপর আল্লার আযাব প্রেরণ করা দূরে নয়। [আবু দাউদ, কিতাবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭। তিরমিযি, কিতাবুল ফিতান, অধ্যায়-১২।]
**************************
– আমার পরে কিছু লোক শাসক হবে। যে ব্যক্তি মিথ্যার ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করবে, সে আমার নয় এবং আতি তার নই। [নাসায়ী, কিতাবুল বায়আত, অধ্যায়- ৩৪-৩৫]
***********************
– অনতিবিলম্বে এমন সব লোক তোমাদের ওপর শাসক হবে, যাদের হাতে থাকবে তোমাদের জীবিকা, তারা তোমাদের সাথে কথা বললে মিথ্যা বলবে, কাজ করলে খারাপ কাজ করবে। তোমরা যতক্ষণ তাদের মন্দ কাজের প্রশংসা না করবে, তাদের মিথ্যায় বিশ্বাস না করবে, ততক্ষণ তারা তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবে না। সত্যকে বরদাশত করা পর্যন্ত তোমরা তাদের সামনে সত্য পেশ করে যাও। তারপর যদি তারা তার সীমালংঘন করে যায়, তাহলে যে ব্যক্তি এ জন্য নিহত হবে, সে শহীদ। [কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নঙ- ২৯৭।]
***********************
– যে ব্যক্তি কোন শাসককে রাযী করার জন্য এমন কথা বলে, যা তার প্রতিপালককে নারায করে, সে ব্যক্তি আল্লার দ্বীন থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছে। [কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ট খন্ড, হাদীস নঙ- ৩০৯।]