প্রথম অধ্যায়
কুরআনের রাজনৈতিক শিক্ষা
একঃ বিশ্ব-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা
বিশ্ব-প্রকৃতি সম্পর্কে কুরআনের মৌলিক চিন্তাধারার উপরই রাজনৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠিত। কুরআনের রাজনৈতিক মতবাদ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে তা অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। রাজনৈতিক দর্শনের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব-প্রকৃতি সম্পর্কে কুরআনের চিন্তাধারা পর্যালোচনা করলে নিন্মোক্ত ধারাগুলো আমাদের চোখের সামনের ভেসে ওঠেঃ
(ক) সমগ্র বিশ্ব-জাহান, মানুষ এবং বিশ্ব-জাহানে যে বস্তুরাজি দ্বারা উপকৃত হয়, আল্লাহ তায়ালা সে সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা।
*************************
– এবং তিনিই আসমান যমীনকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন।
*************************
– বল, আল্লাহ সকল বস্তুর সষ্টা, আর তিনিই একক, মহা-প্রতাপশালী।
*************************
– লোক সকল! তোমাদের সে রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া, আর এতদোভয় থেকে তিনি অসংখ্য নারী-পুরুষ ছড়িয়ে দিয়েছেন। – আন-নিসাঃ ১
*************************
– তিনিই সেই সত্বা, যিনি তোমাদের জন্য যমীনের সমূদয় বস্তু সৃষ্টি করেছেন।
*************************
– আল্লাহ ছাড়া এমন কোন স্রষ্টা আছে কি, যে আসমান-যমীন থেকে তোমাদেরকে রিয্ক (জীবিকা) দান করে?- আল-ফাতিরঃ ৩
*************************
– তোমরা কি ভেবে দেখেছো? তোমরা যে শুত্রপাত করো তা থেকে শিশু তোমরা জন্ম দাও, না আমি তার জন্মদাতা? ………. তোমরা কি চিন্তা করেছো? এই যে তোমরা বীজ বপন করো, তা তোমরা উৎপাদন করো, না আমি তার উৎপাদক? ……… তোমরা কি চিন্তা করেছো? তোমরা যে পানি পান করো, মেঘমালা থেকে তোমরা তা বর্ষণ করো, না আমি তার বর্ষণকারী? ………. তোমরা কি চিন্তা করে দেখেছো? তোমরা যে আগুন জ্বালো, তার বৃক্ষ তোমরা সৃষ্টি করেছো? না আমিই তার স্রষ্টা? – আল-ওয়াকিয়াঃ ৫৮-৭২
*************************
-আসমান-যমীন, এতদোভয়ের মধ্যস্থল এবং মাটির গভীর তলদেশে যা কিছু আছে, সমস্তই তাঁর।-ত্বা-হাঃ৬
(খ) তাঁর সৃষ্টি এ বিশ্বের মালিক, পালক, নিয়ন্ত্রক, এবং পরিচালকও আল্লাহ তায়ালা-ইঃ
*************************
-আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, সব কিছুই তাঁর। সব কিছুই তাঁর ফরমানের অনুগত।
*************************
-চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারকা তিনি সৃষ্টি করেছেন, সবই তাঁর নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত। সাবধান! সৃজন এবং কর্তৃত্ব তাঁরই। আল্লাহ সারা জাহানের মালিক-পরওয়ারদেগার, একান্ত বরকতের অধিকারী।
*************************
-আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালনা তিনিই করেন।
(গ) এ বিশ্ব-জগতে সার্বভৌমত্ব (Sovereignty) একমাত্র আল্লাহ তায়ালার, আর কারো তা নেই, হতেও পারে না। সার্বভৌমত্বে তাঁর অংশীদার হওয়ার অধিকারও নেই কারোঃ
*************************
-তুমি কি জাননা যে, আসমান-যমীনের রাজত্ব আল্লার?
*************************
-এবং রাজত্বে তাঁর কোন শরীক নেই। -আল-ফোরকানঃ২
*************************
-দুনিয়া-আখেরাতের সকল প্রশংসা তাঁরই জন্য; হুকুম দেয়ার ইখতিয়ার কেবল তাঁরই আছে। তোমরা তাঁর নিকটেই ফিরে যাবে।
*************************
-আল্লাহ ছাড়া আর কারো ফায়সালার ইখতিয়ার নেই।-আনআমঃ৫৯
*************************
-তিনি ছাড়া বান্দাদের আর কোন ওলী-পৃষ্ঠপোষক নেই। আপন নির্দেশে তিনি কাউকে শরীক করেন না। – আল-কাহাফঃ ২৬
*************************
-তারা বলে, আমাদের ইখতিয়ারের মধ্যে কিছু আছে কি? বল, ইখতিয়ার সর্বতোভাবে আল্লারই। -আলে-ইমরানঃ ১৫৪
*************************
-ইখতিয়ার আল্লারই হাতে-শুরুতেও এবং শেষেও। -আর-রুমঃ৪
*************************
-আসমান যমীনের বাদশাহী তাঁরই। সমূদয় ব্যাপার তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়।-আল-হাদীদঃ৫
*************************
-যে পয়দা করে, সে কি তার মতো হতে পারে, যে পয়দা করে না? তোমরা কি চিন্তা করো না?-আন-নাহালঃ১৭
*************************
-তারা কি আল্লাহর জন্য এমন কিছু শরীক বানিয়েছে, যারা আল্লাহর মতো কিছু সৃষ্টি করেছে? যাতে সৃষ্টির ব্যাপারটি তাদের কাছে সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েছে।-আর-রাআ’দঃ১৬
*************************
-বল, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা (রব হিসেবে) ডাকো, তোমাদের সে সব কল্পিত শরীকদেরকে তোমরা কি কখনো দেখেছো? আমাকে দেখাো, যমীনে তারা কী সৃষ্টি করেছে? অথবা আসমানে তাদের কোন অংশ আছে? …….. মূলত আল্লাহ-ই আসমান যমীনকে বিচ্যুতি থেকে আটকে রেখেছেন। আর যদি তা বিচ্যুত হতে থকে তাহলে তিনি ব্যতীত এমন কেউ নেই, যে তাকে সামলে রাখতে পারে।-ফাতেরঃ ৪০-৪১
(ঘ) সার্বভৌমত্বের সকল গুণ-বৈশিষ্ট্য, সকল ক্ষমতা-ইখতিয়ার কেবলমাত্র আল্লার সত্তাতেই কেন্দ্রীভূত। এ বিশ্ব-চরাচরে অন্য কেউ এমন গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং ক্ষমতা-ইখতিয়ারের অধিকারী আদৌ নেই। তিনি সকলের ওপর পরাক্রমশালী, তিনি সব কিছুই জানেন, ত্রুটি-বিচ্যুতি মুক্ত তিনি। সকলের নেগাহবান, রক্ষক। সকলের নিরাপত্তা বিধায়ক। চিরঞ্জীব, সদাজাগ্রত, সকল বস্তু-নিচয়ের ওপর ক্ষমতাবান। সকল ক্ষমতা ইখতিয়ার তাঁর হাতে নিবদ্ধ। সমুদয় বস্তু ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁরই ফরমানের অনুগত। কল্যাণ-অকল্যাণ সবকিছুই তাঁর ইখতিয়ারভুক্ত। তিনি ব্যতীত এবং তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ কারো ক্ষতি করতে পারে না; পারে না কোন উপকার করতে। তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ তাঁর সামনে সুপারিশ পর্যন্ত করতে পারে না। তিনি যাকে চান, পাকড়াও করেন, যাকে খুশী ক্ষমা করেন। তাঁর নির্দেশের ওপর পুনরুক্তি করতে পারেন এমন কেউ নেই। তাঁকে কারো সামনে জবাবদিহি করতে হয় না, কৈফিয়ত দিতে হয় না। সকলেই তাঁর সামনে জবাবদিহি করতে বাধ্য। তাঁর নির্দেশ কার্যকর হয়েই থাকে। তাঁর নির্দেশ রদ করতে পারে এমন ক্ষমতা কারুর নেই। সার্বভৌমত্বের এ সকল গুণ-বৈশিষ্ট্য কেবল আল্লার জন্য নির্দিষ্ট। এতে কেউই তাঁর শরীক-অংশীদার নেইঃ
*************************
-তিনিই তো তাঁর বান্দাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতার অধিকারী-কর্তৃত্বের মালিক। তিনি মহাজ্ঞানী, সকল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত। -আল-আনআমঃ ১৮
*************************
-প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বিষযের জ্ঞাতা মহান, বিপুল মর্যাদার অধিকারী। -রাআ’দঃ৯
*************************
-রাজ্যাধিপতি, ত্রুটি-বিচ্যুতি মুক্ত। ভুল ভ্রান্তি মুক্ত, শান্তি-নিরাপত্তা দাতা, হেফাজতকারী, প্রতাপশালী, শক্তিবলে নির্দেশ জারিকারী, বিপুল মহিমার অধিকারী, মহত্বের মালিক।
*************************
-তিনি চিরঞ্জীব, আপন ক্ষমতাবলে উদ্ভুত। নিদ্রা-তন্দ্রা কিছুই তাঁকে স্পর্শ করে না। আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, সবই তাঁর। তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর সামনে সুপারিশ করতে পারে, এমন কে আছে? যা কিছু মানুষের সামনে আছে, তাও তিনি জানেন; আর যেসব বিষয় তাদের নিকট প্রচ্ছন্ন তাও তিনি পরিজ্ঞাত। -আল-বাকারাঃ ২৫৫
*************************
-সকল বরকত-মহিমা সে মহান সত্তার, বাদশাহী যাঁর হাতে। তিনি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। -আল-মূলকঃ ১
*************************
-সমুদয় বস্তুর ইখতিয়ার তাঁর হাতে। তোমাদেরকে তাঁর নিকটেই ফিরে যেতে হবে।
*************************
-আসমান-যমীনে বসবাসকারী সকলেই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁরই নির্দেশের অনুগত।-আলে ইমরানঃ ৮৩
*************************
-সকল ক্ষমতা তাঁরই হাতে ন্যাস্ত। তিনি সব কিছু শোনেন, জানেন। – ইউনুসঃ ৬৫
*************************
-বল, আল্লাহ যদি তোমাদের ক্ষতি করতে চান, তাহলে তা থেকে তোমাদেরকে সামান্য পরিমাণ বাঁচাবার ক্ষমতা কার আছে? অথবা তিনি যদি তোমাদের উপকার করতে চান (তা হলে কে তাকেঁ বাধা দিতে পারে?)।-আল-ফাতহঃ১১
*************************
-আল্লাহ যদি তোমাদের ক্ষতি করেন, তবে তিনি ছাড়া আর কেউ তা দূর করার নেই। আর তিনি যদি তোমাদের মঙ্গল করতে চান, তাহলে তাঁর অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেয়ার কেউ নেই। নিজের বান্দাদের মধ্যে থেকে তিনি যাকে চান, অনুগ্রহ করেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
*************************
-তোমরা মনের কথা প্রকাশ কর বা গোপন রাখ, আল্লাহ তার হিসাব নেবেন; অতঃপর যাকে ইচ্ছা মাফ করেন, যাকে খুশী শাস্তি দেন। আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতা বান। -বাকারাঃ ২৮৪
*************************
তিনি পূর্ণমানের শ্রোতা ও দ্রষ্টা। তিনি ছাড়া বান্দাদের কোন ওলী-পৃষ্ঠপোষক নেই। তিনি স্বীয় নির্দেশে কাউকে শরীক করেন না।-আল-কাহাফঃ ২৬
******************************
-বল, কেউ আমাকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। তিনি ব্যতীত আমি কোন আশ্রয়স্থলও পেতে পারি না। -আল-জ্বিনঃ ২২
*********************
-তিনি আশ্রয় দান করেন, তাঁর মুকাবিলায় কোনো আশ্রয় দেয়া যায় না। -মুমিনঃ ৮৮
*********************
-তিনিই সুচনা করেন, তিনিই পুনরুত্থান করেন। তিনি ক্ষমা, মার্জনাকারী। তিনি ভালবাসেন। রাজ্য-সিংহাসনের মালিক, মহান তিনি। তিনি যা ইচ্ছা তা করেন। -আল-বুরুজঃ ১৩-১৬
*********************
-নিঃসন্দেহে আল্লাহ ফায়সলা করেন। তাঁর ফায়সলা পূনর্বিবেচনা করার কেউ নেই। -আর-রাআদঃ৪১
*********************
-তিনি যা কিছু করেন, তার জন্য তাঁকে কারো সামনে জবাবদিহি করতে হয় না। অন্য সকলকেই তাঁর সামনে জবাবদিহি করতে হয়। -আল-আম্বিয়াঃ ২৩
*********************
-তাঁর ফরমান পরিবর্তন করার কেউ নেই। তাঁর মুকাবিলায় তুমি কোন আশ্রয়স্থল পাবে না। -আল-কাহাফঃ২৭
*********************
-আল্লাহ কি সব শাসনকর্তার বড় শাসনকর্তা নন? -আত-তীনঃ ৮
*********************
-বল, হে খোদা! রাজ্যাধিপতি! যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করো; আর যার কাছ থেকে খুশী, রাজ্য ছিনিয়ে নাও। যাকে খুশী সম্মান দাও, যাকে খুশী অপমান কর। সকল কল্যাণ তোমার ইখতিয়ারাধীন। তুমি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। -আলে-ইমরানঃ ২৬
*********************
-বস্তুত যমীন আল্লার। আপন বান্দাদের মধ্য হতে যাকে চান, তাঁর উত্তরাধিকারী করেন। -আল-আরাফঃ১২৮
দুইঃ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
বিশ্ব-জাহান সম্পর্কে এহেন ধারণার ভিত্তিতে কুরআন বলে, বিশ্ব জাহানের যিনি শাসক পরিচালক, মানুষের শাসক পরিচালকও তিনিই। মানুষের কাজ কারবারেও তিনিই সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী এবং তিনি ছাড়া অন্য কোন মানবীয় ও অ-মানবীয় শক্তির পক্ষ থেকে নির্দেশ-ফয়সালা দান করার কোন অধিকার নেই। তবে এ ক্ষেত্রে পার্থক্য কেবল এতটুকু যে, বিশ্ব ব্যবস্থায় আল্লাহর নিজস্ব শক্তিতেই তাঁর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত, এজন্য কারোর স্বীকৃতির প্রয়োজন হয় না। এমনকি ক্ষুদ্র অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে নক্ষত্র ও নীহারিকাপুঞ্জ পর্যন্ত সমুদয় বস্তু যেমন তাঁর অনুগত, ঠিক তেমনি মানুষও তার জীবনের ইখতিয়ার বহির্ভূত বিভাগে স্বভাবত তাঁর সার্বভৌমত্ব এবং কর্তৃত্বের অধীন। তাঁর এ সার্বভৌমত্ব জোর করে চাপিয়ে দেন না। বরং প্রত্যাদিষ্ট গ্রন্থাদির মাধ্যমে, যার মধ্যে সর্বশেষ গ্রন্থ হচ্ছে আল-কুরআন- তিনি মানুষকে আহবান জানান ইচ্ছা ও চেতনা সহকারে তাঁর এ সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার এবং তাঁর আনুগত্য গ্রহণ করার জন্য। এ পর্যায়ের বিভিন্ন দিক কুরআনে স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে।
(ক) বস্তুত বিশ্ব-জাহানের রবই মানুষের রব। তাঁর রবুবিয়্যাত স্বীকার করে নেয়াই বাঞ্ছনীয়ঃ
*********************
-বল, আমার সালাত, আমার জীবন-মৃত্যু সব কিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিমিত্ত ….. বলঃ আল্লাহ ছাড়া আমি কি অন্য কোন রব তালাশ করবো? অথচ তিনিই তো সকল বস্তুর রব। -আল-আনআমঃ ১৬২-১৬৪
*********************
-বস্তুত আল্লাহ তোমাদের রব, যিনি আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন। -আল-আরাফঃ ৫৪
*********************
-বল, মানুষের রব, মানুষের বাদশাহ, মানুষের মা’বুদের কাছে আমি আশ্রয় চাই।
*********************
-বল, কে তোমাদেরকে আসমান-যমীন থেকে রিযক দান করেন? শ্রবণ এবং দর্শন শক্তি কার ইখতিয়ারভুক্ত? কে নিষ্প্রাণ থেকে প্রাণী এবং প্রাণী থেকে নিষ্প্রাণ বের করেন? কে বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনা করেন? তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। বল, তবুও কি তোমরা ভয় করো না? আল্লাহ তো তোমাদের প্রকৃত রব। সত্যের পরে গুমরাহী ব্যতীত আর কি-ই বা অবশিষ্ট থাকে? তাহলে তোমরা কোথায় ঠোকর খেয়ে বেড়াচ্ছো? -ইউনুসঃ ৩১-৩২
(খ) নির্দেশ দান এবং ফায়সালার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই। মানুষের উচিত তাঁর বন্দেগী করা। এটাই সঠিক পন্থাঃ
*********************
-তোমাদের মধ্যে মতভেদই হোক না কেন, তার ফায়সালা করা আল্লার কাজ।
*********************
-আল্লহ ছাড়া আর কারো নির্দেশ নেই। তাঁরই ফরমান যে, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করো না। এটিই তো দ্বীনে কাইয়্যেম-সত্য-সঠিক জীবন বিধান। কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না। -ইউসুফঃ ৪০
*********************
-তারা বলে, আমাদেরও কি কোন ইখতিয়ার আছে? বল, সমস্ত ইখতিয়ার আল্লাহর।
(গ) একমাত্র আল্লাই হুকুম দেয়ার অধিকার ও ইখতিয়ার রাখেন। কারণ তিনিই স্রষ্টাঃ
*********************
সাবধান। সৃষ্টি তাঁর, নির্দেশও তাঁরই। -আল আরাফঃ ৫৪
(ঘ) একমাত্র আল্লাই নির্দেশ দেয়ার অধিকার রাখেন। কারণ তিনিই সমগ্র জগতের বাদশাহঃ
*********************
-চোর-নারী-পুরুষ-উভয়ের হাত কেটে দাও। তুমি কি জানোনা যে আসমান-যমীনের বাদশাহী আল্লারই জন্য? -আল-মায়েদাঃ ৩৮-৪০
(ঙ) আল্লার নির্দেশ সত্য-সঠিক এজন্য যে, তিনিই বাস্তব বিষয়ের জ্ঞান রাখেন এবং তিনিই সঠিক পথ নির্দেশ দিতে পারেনঃ
*********************
হতে পারে একটি জিনিস তোমাদের মনপুত নয়; অথচ তা তোমাদের জন্য উত্তম এবং হতে পারে, একটি জিনিস তোমাদের মনপুত, অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাই জানেন, তোমরা জান না। -আল-বাকারাঃ ২১৬
*********************
-কে বিপর্যয়কারী, আর কে সংশোধনকারী তা আল্লাহ জানেন। -আল-বাকারাঃ ২২০
*********************
-যা কিছু তাদের সামনে আছে, তাও তিনি জানেন আর যা তাদের নিকট প্রচ্ছন্ন, তার খবরও তিনি রাখেন। তিনি যেসব বিষয় জ্ঞান দান করতে চান তা ব্যতীত তারা তাঁর জ্ঞানের কোন বিষয়ই জানতে পারে না। -আল-বাকারাঃ ২৫৫
*********************
-তোমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দাও আর তারা তাদের ইদ্দতের মেয়াদে পৌঁছে, তখন তাদেরকে (নিজেদের পছন্দসই) স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বারণ করো না। …. ইহা তোমাদের জন্য অধিক মর্জিত এবং পবিত্র পন্থা। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।
*********************
-তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়েত দিচ্ছেন। …. তোমাদের পিতা-মাতা এবং সন্তানদের মধ্যে কে উপকারের দিক থেকে তোমাদের নিকটতর, তা তোমরা জান না। উত্তরাধিকারের হিস্যা আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহাজ্ঞানী।
*********************
-তারা তোমার কাছে জানতে চায়! বল, আল্লাহ ’কালালা’ সম্পর্কে তোমাদেরকে জানাচ্ছেন। … আল্লাহ তোমাদের সম্পর্কে বিধান বিশ্লেষণ করেছেন, যাতে তোমরা বিপথগামী না হয়ে যাও। এবং তিনি সকল বিষয়ের জ্ঞান রাখেন। -আন-নিসাঃ ১৭৬
*********************
-আল্লাহ কিতাবে আত্নীয়-স্বজনরা (অন্যদের তুলনায়) বেশী হকদার। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। -আল-আনফালঃ ৭৫
*********************
-সদকা তো নিঃস্বদের জন্য। …. ইহা আল্লার পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহাজ্ঞানী। -আত-তওবাঃ ৬০
*********************
হে ইমানদারগণ! তোমাদের দাস-দাসীরা অনুমতি নিয়ে যেন তোমাদের কাছে হাযির হয়। … এমনি করে আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর বিধান সমূহ খুলে বলেন। তিনি সব কিছু জানেন; মহাজ্ঞানী তিনি। -নূরঃ৫৮-৫৯
*********************
-হে ঈমানদারগণ! যেসব মুমিন মহিলা হিজরত করে তোমাদের কাছে আসে, তাদেরকে পরীক্ষা করো …. এটা আল্লাহর বিধান। তিনি তোমাদের ব্যাপারে ফায়সালা করেন। তিনি সর্বজ্ঞ, মহাজ্ঞানী।
তিনঃ আল্লাহর আইনানুগ সার্বভৌমত্ব
এ সব কারণে কুরআন ফায়সালা করে যে, আনুগত্য হবে নিরঙ্কুশ ভাবে আল্লার আর অনুসরণ অনুবর্তন হবে তাঁর আইন-বিধানের; এটিই বাঞ্ছনীয়। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যদের অথবা নিজের নফসের খাহেশের অনুসরণ নিষিদ্ধঃ
*********************
-(হে নবী) আমরা এ কিতাব যথাযথভাবে তোমার প্রতি নাজিল করেছি। সুতরাং দ্বীনকে আল্লার জন্য খালেছ করে তাঁর বন্দেগী করো। সাবধান! খালেছ দ্বীন আল্লারই জন্য।
*********************
-বল দ্বীনকে আল্লার জন্য খালেছ করে তাঁর বন্দেগী করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর আমাকে এ নির্দেশও দেয়া হয়েছে যে, আমিই যেন সর্বপ্রথম আনুগত্যের শির অবনতকারী হই। -আয-যুমারঃ ১১-১২
*********************
-এবং আমি প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি (এ নির্দেশ দিয়ে) যে, আল্লার বন্দেগী করো এবং তাগুত থেকে বিরত থাকো। -আন-নহলঃ ৩৬ [যে সত্তা আল্লার মুকাবিলায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে এবং আল্লাহ ব্যতীত যার বন্দেগী করা হয়- বন্দেগীকারী ব্যক্তি তার প্রভাব-প্রতাপে বাধ্য হয়ে বন্দেগী করুক বা সেচ্ছায় সন্তুষ্টচিত্তে করুক- তাকেই বলা হয় তাগুত। সে মানুষ, শয়তান, প্রতীমা বা অন্য যাই কিছু হোক না কেন। (ইবনে জারীর, আত-ত্বাবারী-জামেউল বয়ান ফী তাফসীরুল কুরআন, ৩য় খন্ডঃ পৃষ্ঠা-১৩)]।
*********************
-দ্বীনকে আল্লাহর জন্য খালেছ করে নিবিষ্টভাবে বন্দেগী করা ব্যতীত তাদেরকে আর কোন নির্দেশই দেয়া হয়নি। -আল-বাইয়্যেনাঃ৫
*********************
-তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ কর তা বাদ দিয়ে তোমাদের নেতাদের অনুসরণ করো না। -আল-আরাফঃ ৩
*********************
-তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে, তারপরও তুমি যদি তাদের খাহেশাতের অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহর মুকাবিলায় তোমার কোন সাহায্যকারী হবে না, হবে না কোন রক্ষাকারী।
*********************
-অতঃপর আমি তোমাকে দ্বীনের এক বিশেষ পদ্ধতির ওপর স্থাপন করেছি। সুতরাং তুমি তারই অনুসরণ করো। যাদের কোন জ্ঞান নেই, তাদের খাহেশের অনুসরণ করো না।
কুরআন বলে, মানুষের কার্যাবলীকে সংগঠিত সুবিন্যস্ত করার জন্য আল্লাহ যে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা লংঘন করার অধিকার কারোর নেইঃ
*********************
…. এসব হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। এগুলো লংঘন করো না। যারা আল্লার সীমারেখা লংঘন করে, তারাই যালেম-অত্যাচারী। -আল-বাকারাঃ ২২৯
*********************
…. এসব হচ্ছে আল্লার সীমারেখা। যে আল্লার সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজেই নিজের নফসের ওপর যুলুম করে। -আত-তালাকঃ ১
*********************
… এসব হচ্ছে আল্লার সীমারেখা। বাধ্য-বাধকতা মেনে চলতে যারা অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। -আল-মুজাদালাঃ৪
কুরআন এও বলে যে, আল্লার হুকুমের বিরুদ্ধে যে হুকুমই হোক না কেন, তা শুধু অন্যায় অবৈধই নয়, বরং তা হচ্ছে কুফরী, গুমরাহী, যুলুম-শিরক-অন্যায় এবং স্পষ্ট পাপাচার। এ ধরনের যে কোন ফায়সালা জাহেলিয়াতের ফায়সালা-ঈমান বিরুদ্ধ ফায়সালা। এ ধরনের ফায়সালা অস্বীকার করা ঈমানের অপরিহার্য দাবী-অবিচ্ছেদ্ধ অংশঃ
*********************
-আল্লার নাযিল করা বিধান অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না, তারাই কাফের। -মায়েদাঃ৪৪
*********************
-আল্লার নাযিল করা হুকুম অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না, তারাই যালেম। -মায়েদাঃ৪৫
*********************
-আল্লার নাযিলকৃত নির্দেশ অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না, তারাই ফাসেক, পাপাচারী। -আল-মায়েদাঃ ৪৭
*********************
তারা কি জাহিলিয়াতের ফায়সালা চায়? অথচ বিশ্বাসীদের জন্য আল্লার চেয়ে উত্তম ফায়সালাকারী আর কে হতে পারে? -আল -মায়েদাঃ ৫০
*********************
-তুমি কি সেসব লোককে দেখোনি, যারা দাবী করে যে, তোমার ওপর নাযিল করা কিতাবের প্রতি তারা ঈমান এনেছে, ঈমান এনেছে তোমার পূর্বে নাযিলকৃত কিতাবসমূহের ওপরও, অতঃপর ফায়সালার জন্য নিজেদের ব্যাপারে ‘তাগুতের’ কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তাকে অস্বীকার করার? শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দূরে নিয়ে যেতে চায়। -আন-নিসাঃ৬০
চারঃ রাসূলের মর্যাদা
ওপরের আয়াতসমূহে আল্লার যে বিধান মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা মানুষের নিকট পৌছার একমাত্র Media তাঁর রাসূল (সাঃ)। তিনিই আল্লার পক্ষ থেকে তাঁর বিধান এবং হেদায়েত মানুষের কাছে পৌঁছান এবং নিজের কথা এবং কাজের দ্বারা সে সব বিধি-বিধান ও হেদায়াতের ব্যাখ্যা দান করেন। সুতরাং রাসূল (সাঃ) মানব জীবনে আল্লাহর আইনগত সার্বভৌমত্বের (Legal Sovereignty) প্রতিনিধি। এর ভিত্তিতে আনুগত্য অবিকল আল্লাহরই আনুগত্য। রাসূলের আদেশ নিষেধ এবং ফায়সালাকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়ার জন্য আল্লাহই নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলের আদেশ-নিষেধ ফায়সালা এমনভাবে স্বীকার করে নিতে হবে, যেন অন্তরে সামান্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং সংকোচও না থাকে, অন্যাথায় ঈমান কোন কাজেই আসবে নাঃ
*********************
-আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তা করেছি এ জন্য যে, আল্লার নির্দেশক্রমে তাঁর আনুগত্য করা হবে। -আন-নিসাঃ ৬৪
*********************
-যে রাসূলের আনুগত্য করে, সে মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করে। -আর নিসাঃ৮০
*********************
-হেদায়েত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও যে ব্যক্তি রাসূলের সাথে মতবিরোধ করে, তাঁর বিরোধিতা করে এবং ঈমানদারদের পথ ত্যাগ করে অন্য পথ অবলম্বন করে সে নিজে যে দিক ফিরে যেতে চায়, আমি তাকে সে দিকে ফিরিয়ে দেবো। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। জাহান্নাম অতি নিকৃষ্ট ঠিকানা। -আন-নিসাঃ১১৫
*********************
-রাসূল তোমাদেরকে যা কিছু দেন, তোমরা তা গ্রহণ করো, আর যেসব সম্পর্কে নিষেধ করেন, সে সব থেকে বিরত থাকো। আল্লাকে ভয় করো। আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।
*********************
-না, তোমার রবের শপথ, তারা কখনো মুমিন হবে না, যতক্ষণ তারা তোমাকে (হে নবী) নিজেদের সকল মতবিরোধে ফায়সালাকারী বলে মেনে না নেয়। অতঃপর তুমি যে ফায়সালা করবে, তাতে নিজেদের অন্তরে তারা কোন রকম সংকীর্ণতা বোধ করবে না; বরং পুরোপুরি তা মেনে নেবে। -আন নিসাঃ৬৫
পাঁচঃ উর্ধ্বতন আইন
কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহ এবং রাসূলের নির্দেশ হচ্ছে এমন এক উর্ধ্বতন আইন (Supreme Law), যার মুকাবিলায় ঈমানদার ব্যক্তি শুধু আনুগত্যের পন্থাই অবলম্বন করতে পারে। যেসব ব্যাপারে আল্লাহ এবং রাসূল ফায়সালা দিয়েছেন, সে সব ব্যাপারে কোন মুসলমান নিজের পক্ষ থেকে কোন স্বাধীন ফায়সালা দেয়ার অধিকারী নয়। আল্লাহ ও রাসূলের ফায়সালা থেকে দূরে সরে দাঁড়ানো এবং তার বিরোধিতা-অবাধ্যতা ঈমানের পরিপন্থীঃ
*********************
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়সালা দেয়ার পর সে ব্যাপারে কোন মুমিন নারী-পুরুষের কোন প্রকার ইখতিয়ারই থাকে না। যে কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমারী (অবাধ্যতা) করে, সে স্পষ্ট গুমরাহীতে নিমজ্জিত। -আল-আহযাবঃ ৩৬
*********************
তারা বলে, আমরা আল্লাহ ও রাসূলের উপর ঈমান এনেছি এবং আনুগত্য কবুল করেছি, অতঃপর তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়; তারা কখনো মু’মিন নয়। তাদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয়, যাতে রাসূল তাদের মধ্যে ফায়সালা করেন, তখন তাদের একটি দল মুখ ফিরিয়ে নেয়। -আন-নূরঃ ৪৭-৪৮
*********************
-ঈমানদারদের কাজ হচ্ছে এই যে, যখন রাসূল তাদের মধ্যে ফায়সালা করবেন এজন্য তাদেরকে আল্লাহ এবং রাসূলের দিকে আহবান জানানো হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং আনুগত্য করেছি। এমন ব্যক্তিরাই সফলতা লাভ করবে। -আন-নূরঃ ৫১
ছয়ঃ খেলাফত
কুরআনের বিধান মতে শাসনের সত্যিকার রূপ হচ্ছে, রাষ্ট্র আল্লাহ এবং রাসূলের আইনগত কর্তৃত্ব (Legal Supremacy) স্বীকার করে তাঁর স্বপক্ষে সার্বভৌমত্ব (sovereignty) ত্যাগ করবে এবং আসল শাসকের খেলাফত (প্রতিনিধিত্ব) এর ভূমিকা গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার আইনগত, প্রশাসনিক বা বিচার সম্বন্ধীয় যাই হোক না কেন-উপরে আল্লার আইনের সার্বভৌমত্ব, রাসূলের মর্যাদা ও উর্ধ্বতন আইন শিরোনামে বর্ণিত চৌহদ্দীর মধ্যে অবশ্য সীমিত থাকবেঃ
**********************
-(হে নবী!) আমি তোমার প্রতি এ কিতাব সত্য-সঠিকভাবে নাযিল করেছি। তা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যতা প্রতিপন্ন করে এবং তার হেফাজত করে। সুতরাং আল্লাহ যা কিছু নাযিল করেছেন, তদানুযায়ী লোকদের মধ্যে তুমি ফায়সালা করো। আর মানুষের খাহেশের অনুবর্তন করতে গিয়ে তোমার নিকট আগত সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না।
**********************
-হে দাউদ! আমি আমি তোমাকে যমীন খলীফা (প্রতিনিধি) করেছি। সুতরাং তুমি সত্যানুযায়ী মানুষের মধ্যে ফায়সালা করো এবং নফসের খাহেশ (মনের অভিলাষ এবং কামনা বাসনা)-এর অনুসরণ করো না। এমন করলে তা তোমাকে আল্লার পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে।
সাতঃ খেলাফতের তাৎপর্য
কুরআনে এ খেলাফতের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা হচ্ছেঃ যমীনের বুকে মানুষ যে শক্তি-সামর্থ লাভ করেছে, তা সবই সম্ভব হয়েছে আল্লার দান ও অনুগ্রহে। আল্লাহ মানুষকে এমন মর্যাদা দান করেছেন, যার ফলে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি-সামর্থ তাঁরই দেয়া স্বাধীন ক্ষমতা বলে তাঁর যমীন ব্যবহার করে। এ জন্য দুনিয়ার বুকে মানুষের স্বাধীন মালিকানা নেই। বরং সে প্রকৃত মালিকের খলীফা বা প্রতিননিধি মাত্রঃ
**********************
-এবং স্মরণ কর, তোমার রব যখন ফিরিশতাদের বলেছিলেন, আমি যমীনে একজন খলীফা বানাবো। -আল-বাকারাঃ ৩১
**********************
-(মানব মন্ডলী!) আমি তোমাদেরকে যমীনের বুকে স্বাধীন কর্মক্ষমতা দিয়ে সংস্থাপন করেছি এবং তোমাদের জন্য তার অভ্যন্তরে জীবিকার উপায়-উপকরণ সরবরাহ করেছি। -আল-আরাফঃ ১০
**********************
-তোমরা কি দেখতে পাওনা যে, যমীনে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহ তোমাদের জন্য বিজিত করে দিয়েছেন? -আল-হজ্জঃ ৬৫
যমীনের কোনও অংশে যে জাতি ক্ষমতা লাভ করে, মূলত সে জাতি সেখানে আল্লার খলিফাঃ
**********************
-(হে আদ কওম)! যমীনে আল্লাহ যখন তোমাদেরকে নূহের কওমের পরে খলীফা করেছিলেন, তখনকার কথা স্মরণ করো। -আ’রাফঃ ৬৯
**********************
-(হে সামুদ কওম)! স্মরণ কর তখনকার কথা, যখন তিনি আদ কওমের পরে তোমাদেরকে খলীফা করেছিলেন। -আল-আরাফঃ ৭৪
**********************
-(হে বনী-ইসরাঈল)! সে সময় নিকটবর্তী যখন তোমাদের রব তোমাদের দুশমন (ফেরাউন)- কে ধ্বংস করে তোমাদেরকে যমীনে খলীফা করবেন। এবং তিনি দেখবেন, তোমরা কেমন কার্য কর। -আল-আরাফঃ ১২৯
**********************
-অতঃপর তাদের পরে আমি তোমাদেরকে যমীনে খলীফা করেছি, তোমরা কেমন কাজ কর, তা দেখার জন্য। -ইউনুসঃ ১৪
কিন্তু এ খেলাফত কেবলমাত্র তখন সঠিক এবং বৈধ হতে পারে; যখন তা হবে সত্যিকার মালিকের (আল্লাহ তায়ালার) নির্দেশের অনুসারী। তা থেকে বিমুখ হয়ে যে স্বেচ্ছাচার মূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হবে, তা খেলাফত হবে না। বরং খেলাফতের পরিবর্তে তা হবে ‘বাগওয়াত’ তথা প্রকাশ্য বিদ্রোহঃ
**********************
-তিনি তোমাদেরকে যমীনে খলীফা করেছেন। অতঃপর যে কুফরী করবে-তার কুফরী তার ওপর শাস্তি স্বরূপ আপতিত হবে। কাফেরদের কুফরী তাদের রব-এর কাছে তাঁর গযব ছাড়া অন্য কোন বিষয় বৃদ্ধি করতে পারে না। কাফেরদের জন্য তাদের কুফরী কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি করতে পারে। -আল-ফাতেরঃ ৩৯
**********************
তুমি কি দেখনি, তোমার রব আদ এর সাথে কেমন ব্যবহার করেছেন? …. …. এবং সামুদের সাথে; যারা উপত্যাকায় পাথর কেটেছিল (গৃহ নির্মানের জন্য) এবং খুটি-তাঁবুর অধিকারী ফেরাউনের সাথেও -যারা দেশে অবাধ্যতা সৃষ্টি করেছিল? -আল ফজর
**********************
-(হে মুসা!) ফেরাউনের কাছে যাও। করণ, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে। …. ফেরাউন লোকদের বলেছিল, আমিই তোমাদের সবচেয়ে বড় রব-পালনকর্তা-পরওয়ারদেগার। -আন-নাযেআতঃ ১৭-২৪
**********************
-তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের সাথে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাদেরকে যমীনে খলীফা করবেন, যেমন তিনি খলীফা করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে …. …. তারা আমার বন্দেগী করবে, আমার সাথে অন্য কিছুকেই শরীক করবে না।
আটঃ সামষ্টিক খেলাফত
কোন ব্যক্তি গোষ্ঠি বা দল বৈধ এবং সত্য-সঠিক ধরনের খেলাফত (প্রতিনিধি) -এর একক ধারক-বাহক নয়। বরং যে দল (Community) উপরোক্ত মূলনীতিগুলো স্বীকার করে সমষ্টিগতভাবে রাষ্ট্র-সরকার প্রতিষ্ঠা করে, সে দলই হয় এ খেলাফতের ধারক-বাহক। সূরায় নূর-এর ৫৫ নং আয়াতের **********************
বাক্যাংশ এ ব্যাপারে অত্যন্ত দ্বার্থহীন। এ বাক্যাংশের আলোকে ঈমানদারদের জামায়াতের প্রতিটি ব্যক্তিই খেলাফতের সমান অংশীদার। সাধারণ মুমিনদের খেলাফতের অধিকার হরণ করে তা নিজের কুক্ষিগত করার অধিকার কোন ব্যক্তি-গোষ্ঠির নেই। কোন ব্যক্তি বা দল নিজের স্বপক্ষে আল্লার বিশেষ খেলাফতের দাবীও করতে পারে না। এ বিষয়টিই ইসলামী খেলাফতকে মুলুকিয়্যাত (একনায়কতন্ত্র, সৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র) গোষ্ঠীতন্ত্র এবং ধর্মীয় যাজক-সম্প্রদায়ের শাসন থেকে পৃথক করে তাকে গণতন্ত্রাভিমুখী করে। কিন্তু ইসলামী গণতন্ত্র এবং পাশ্চত্য গণতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এই যে, পাশ্চত্য গণতন্ত্র জনগণের সার্বভৌমত্ব (Popular Soverignty) -এর মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে ইসলামী গণতন্ত্রে (ইসলামের জমহুরী খেলাফত) জনগণ স্বয়ং আল্লার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে স্বেচ্ছায় সন্তুষ্টচিত্তে নিজেদের ক্ষমতা-ইখতিয়ারকে আল্লার বিধানের সীমার মধ্যেই সীমিত করে দেয়।
নয়ঃ রাষ্ট্রের আনুগত্যের সীমা
এ খেলাফত ব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য যে রাষ্ট্র-সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, জনগণ শুধু ভাল কাজে (মারুফ) তার আনুগত্য করতে বাধ্য থাকবে মাসিয়াত (আইনের বিরুদ্ধাচরণ, পাপ অন্যায়)-এ কোন আনুগত্য নেই; নেই কোন সহযোগিতাঃ
**********************
হে নবী! ঈমানদার মহিলারা যখন তোমার নিকট এসব বিষয়ে বায়আত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করার জন্য আসে যে, তারা আল্লার সাথে শরীক করবে না, এবং কোন বৈধ বিধানের ব্যাপারে তোমার নাফরমানী (অবাধ্যতা) করবে না, তখন তুমি তাদের বায়আত কবুল করো। -আল-মুমতাহানাঃ১২
**********************
-নেকী এবং পরহেযগারী-ভাল কাজ এবং তাকওয়ার ব্যাপারে সহযোগীতা করো; পাপ এবং ঔদ্ধত্যে সহযোগিতা করো না। আল্লাকে ভয় করো। আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।
**********************
দশঃ শুরা
সে রাষ্ট্রের সমস্ত কার্যাবলী-প্রতিষ্ঠা-সংগঠন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান এবং উলিল আমর-এর নির্বাচন, শাসনতান্ত্রিক এবং প্রশাসনিক কার্যাবলী পর্যন্ত সমস্ত কিছুই ঈমানদারদের পারস্পারিক পরামর্শক্রমে সম্পন্ন হওয়া উচিত; এ পরামর্শ কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি হউক বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেঃ
**********************
-এবং মুসলমানদের কার্যাবলী পারস্পারিক পরামর্শক্রমে সম্পন্ন হয়। [এ আয়াতের বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য তাফহীমুল কুরআন, উর্দু সংস্করণ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৫০৮-৫১০ দ্রষ্টব্য]।
এগারঃ উলিল আমর-এর গুণাবলী
এ রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য উলিল আমর এর নির্বাচনে যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার, তা এইঃ
(ক) যেসব মূলনীতির ভিত্তিতে খেলাফত ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব তার ওপর ন্যাস্ত হচ্ছে, তাকে সে সব মূলনীতি মেনে চলতে হবে। কারণ যে ব্যক্তি নীতিগতভাবে একটি ব্যবস্থার বিরোধী, তার ওপর সে ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করা যায় নাঃ
**********************
-হে ঈমানদারগণ। আনুগত্য কর আল্লার এবং আনুগত্য কর রাসূলের আর তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে উলিল আমর। -আন-নিসাঃ৫৯
**********************
-হে ঈমানদারগণ। নিজেদের ছাড়া অন্যদেরকে গোপনীয় বিষয়ের অংশীদার করো না। -আলে-ইমরানঃ১১ [মূলে **********************(বিতানাতুন) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যামাখশারী (মৃত্যু ৫৩৮ হিঃ ১১৪৪ খৃঃ) এর ব্যাখ্যা করেছেন এরূপেঃ কোন ব্যক্তির ‘বিতনা’ এবং ওয়ালিজা সে ব্যক্তি যে তার বিশিষ্ট বন্ধু নির্বাচিত সাথী, যার ওপর নির্ভর করে সে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তার দিকে প্রত্যাবর্তন করে। (আল-কাশ শাফ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৬২)।]।
**********************
-তোমরা কি মনে করে বসেছ যে, তোমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে? অথচ তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে, আল্লাহ, রাসূল এবং মুমিনদের ছাড়া অন্য কাউকে নিজেদের ব্যাপারে দখলদার বানায়নি আল্লাহ এখনও তা পরখ করেননি। -আত-তাওবাঃ১৬ [মূলে ********************** (ওয়ালীজ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যামাখশারীর উদ্ধৃতি দিয়ে ওপরে তার একটি ব্যাখ্যাও উল্লেখিত হয়েছে। অপর এক ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাগেব ইসফাহানী। তিনি লিখেছেনঃ ওয়ালীজা বলা হয় তাকে মানুষ যাকে তার নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করে। অথচ সে নিজস্ব লোকদের পর্যায়ভুক্ত নয়। ********************** আরবের এ বাগধারা থেকে এটি গৃহীত। এর অর্থ- ‘অমুক ব্যক্তি সে জাতির মধ্যে ঢুকে পড়েছে, অথচ সে ব্যক্তি সে জাতির লোক নয়।’ (মুফরাদাত ফি গারীবিল কুরআন, আল-মাতবাআতুল খাইরিয়া, মিশর ১৩২২ হিজরী।)]
(খ) সে যালেম ফাসেক-ফাজের, আল্লাবিমুখ এবং সীমালংঘনকারী হবে না। বরং ঈমানদার, আল্লাহভীরু এবং নেককার হতে হবে তাকে। কোন যালেম বা ফাসেক ব্যক্তি যদি এমারত বা ইমামের পদ অধিকার করে বসে, তবে ইসলামের দৃষ্টিতে তার এমারত (নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব) বাতেলঃ
**********************
-এবং স্মরণ কর, ইব্যাহীমকে তার রব যখন কয়েকটি কথার ব্যাপারে পরীক্ষা করছিলেন এবং তা সে পূর্ণ করেছিল। তখন তার রব বলেছিলেন-আমি তোমাকে লোকদের ইমাম (নেতা) বানাবো। ইব্যাহীম বললো-আমার বংশধরদের মধ্যেও? তিনি বললেন, যালেমরা আমার আহাদ-অঙ্গীকার লাভ করে না। -আল-বাকারাঃ১২৪ [প্রসিদ্ধ হানাফী (ফিকাহ শাস্ত্রবেত্তা) আবুবকর আল জাসসাস (মৃত্যু ৩৭০ হিজরী, ৯৮০ ঈসায়ী) এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন যে, অভিধানে ইমামের অর্থ সে ব্যক্তি, যার অনুসরণ করা হয় -সে অনুসরণ হক-বাতিল, ন্যায়-অন্যায় যে কোন ব্যাপারেই হোক না কেন। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে ইমাম বলতে কেবল সে ব্যক্তিকেই বুঝায়, যে আনুগত্যের যোগ্য, যার অনুকরণ অবশ্য করণীয়। সুতরাং এদিক থেকে ইমামতের উন্নত পর্যায়ে রয়েছেন নবী-রাসূলগণ, সত্যাশ্রয়ী খলীফাগণ এবং পরে সত্যানুসারী ওলামা এবং কাযী। এরপর তিনি লিখেছেনঃ সুতরাং কোন যালেম নবী হতে পারে না। নবীর প্রতিনিধি কাযী বা এমন পদ মর্যাদার অধিকারী হওয়াও তার জন্য বৈধ নয়, দ্বীনের ব্যাপারে যার কথা মেনে চলা অপরিহার্য কর্তব্য। এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ফাসেক পাপাচারী-দূরাচারী ব্যক্তির ইমামত বাতেল। সে খলীফা হতে পারে না। সে যদি নিজেই এমন পদ-মর্যাদায় জেকে বসে, তবে তার অনুগমন-অনুসরণ এবং আনুগত্য জনগণের জন্য ব্যধ্যতামূলক নয়। (আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ডম পৃষ্ঠা ৭৯-৮০, আল-মাতবায়াতুল বাহিয়্যা, মিশর, ১৩৪৬ হিজরী।]]
-যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদেরকে আমরা কি সে সব লোকেদের মত করবো, যারা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে? আমরা কি মুত্তাকী-পরহেযগারদেরকে ফাসেকদের মত করবো? -ছাদঃ ২৮
**********************
-এমন কোন লোকের আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে তার নফসের কামনা-বাসনা (খাহেসে-নফস)-এর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে এবং যার কার্যধারা সীমাতিক্রম করেছে। -আল-কাহাফঃ ২৮
**********************
-সে সব সীমালংঘনকারীর আনুগত্য করো না, যারা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে- সংস্কার-সংশোধন করে না। -আশ-শুয়ারাঃ ১৫১-১৫২
**********************
-তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশী সম্মানিত, যে সবচেয়ে বেশী মুত্তাকী-পরহেযগার-সবচেয়ে বেশী আল্লাভীরু।
(গ) সে অজ্ঞ-মূর্খ হবে না; বরং তাকে হতে হবে বিজ্ঞ-জ্ঞানী। প্রয়োজনীয় বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে হবে তাকে। খেলাফতের কার্যাবলী পরিচালনার জন্য তাকে পর্যাপ্ত শারীরিক-মানসিক যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবেঃ
**********************
-যে ধন-সম্পদকে আল্লাহ তোমাদের জীবন-জীবিকার অবলম্বন করেছেন, তা নির্বোধ ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিও না। -আন-নিসাঃ ৫
**********************
-(বনী-ইসরাইল) বললো সে (ত্বালুত) আমাদের ওপর শাসন-কর্তৃত্ব চালাবার অধিকার পেল কোথায়? অথচ তার তুলনায় আমরা শাসনকার্যের বেশী হকদার। আর তাকে তো ধন-সম্পদে প্রাচুর্যও দেয়া হয়নি। নবী বললেন, আল্লাহ তোমাদের মুকাবিলায় তাকে নিযুক্ত করেছেন এবং তার জ্ঞান-শক্তিতে প্রশস্ততা দান করেছেন। -আল-বাকারাঃ ২৪৭
**********************
-এবং দাউদের রাজত্বকে আমরা সুদৃঢ় করেছি, তাকে দিয়েছি জ্ঞান-কৌশল এবং চূড়ান্ত ফায়সলাকারী কথা বলার যোগ্যতা। -সাদঃ ২০
**********************
ইউসুফ বললো, আমাকে যমীনের ভান্ডারসমূহের কার্যে নিযুক্ত করো। কারণ, আমি হেফাযতকারী এবং ওয়াকেফহাল। -ইউসুফঃ ৫৫
**********************
-আর এরা যদি (গুজব না ছড়িয়ে) খবরটি রাসূল এবং তাদের উলিল আমর-এর নিকট পৌঁছাতো, তাহলে তা এমন ব্যক্তিদের জ্ঞানে আসতো, তাদের মধ্যে যারা বিষয়ের গভীরে পৌঁছাতে সক্ষম। -আন-নিসাঃ ৮৩
**********************
-বল, যাদের জ্ঞান আছে এবং যাদের জ্ঞান নেই, উভয়ে কি সমান হতে পারে? -যুমারঃ৯
(ঘ) তাকে এমন আমানতদার হতে হবে, যাতে আস্থার সাথে তার ওপর দায়িত্ব ন্যাস্ত করা যেতে পারেঃ
**********************
-আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানতসমূহ তার যোগ্য ব্যক্তির কাছে ফেরত দেয়ার জন্য। -আন নিসাঃ৫৮ [দায়িত্বপূর্ণ পদ তাদেরকেই দান করা উচিত, যারা তার যোগ্য অধিকারী-এ অর্থও এতে শামিল রয়েছে। (আলুসী, রুহুল মাআনী, ৫ম খন্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা, ইদারাভুজ তাবায়াতিল মুনিরিয়া, মিশর, ১৩৪৫ হিজরী।)]
বারঃ শাসনতন্ত্রের মৌলনীতি
এ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র যেসব মৌলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে, তা এইঃ
**********************
(ক) তোমরা যারা ঈমান এনেছো। আনুগত্য করো আল্লার এবং আনুগত্য করো রাসূলের, আর তোমাদের উলিল আমর-এর। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোন বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তবে তা আল্লাহ এবং রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করো-যদি তোমরা আল্লাহ এবং শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখো। -আন-নিসাঃ৫৯
আলোচ্য আয়াতটি শাসনতন্ত্রের ছটি ধারা স্পষ্ট তুলে ধরেঃ
একঃ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য সকল আনুগত্যের চেয়ে অগ্রগণ্য।
দুইঃ উলিল আমর-এর আনুগত্য আল্লাহ-রাসূলের আনুগত্যের অধীন।
তিনঃ উলিল আমর ঈমানদারদের মধ্য হতে হবে।
চারঃ শাসকবর্গ এবং সরকারের সাথে মতবিরোধের অধিকার জনগণের রয়েছে।
পাঁচঃ বিরোধ দেখা দিলে আল্লাহ এবং রাসূলের বিধানই হবে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী দলীল।
ছয়ঃ খেলাফত ব্যবস্থায় এমন একটি প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে, যা উলীল আমর এবং জনগণের চাপ-প্রভাব মুক্ত হয়ে উর্ধ্বতন আইন অনুযায়ী সকল বিরোধ মীমাংসা করতে পারে।
(খ) প্রশাসন যন্ত্রের (Executive Body) ক্ষমতা ইখতিয়ার অবশ্যই আল্লার সীমারেখা দ্বারা সীমিত হবে, হবে আল্লাহ-রাসূলের আইনে বাঁধা। তা লংঘন করে, প্রশাসন যন্ত্র এমন কোন নীতি (Policy) গ্রহণ করতে পারে না, এমন কোন নির্দেশ দিতে পারে না, যা মাসিয়াত (পাপাচার; কুরআন-সুন্নার যে কোন স্পষ্ট দ্বার্থহীন নির্দেশের পরিপন্থী)-এর সংজ্ঞায় পড়ে। কারণ, এ আইনানুগ সীমারেখার বাইরে গিয়ে আনুগত্য দাবী করার অধিকারই তার নেই। (এ সম্পর্কে ওপরের ৩, ৫ ও ৯ নং প্যারাগ্রাফে আমরা কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ উল্লেখ করেছি।) এছাড়াও প্রশাসনিক কাঠামো অবশ্যই শূরা অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হবে। এবং শূরা অর্থাৎ পারস্পারিক পরামর্শক্রমে তাকে কার্য পরিচালনা করতে হবে। ওপরে ১০ নং প্যারাগ্রাফে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন এবং পরামর্শ সম্পর্কে কুরআন কোন সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট রূপ-কাঠামো নির্ধারণ করে দেয়নি। বরং এক সামগ্রিক মূলনীতি নিরূপণ করে বিভিন্ন যুগে সমাজের পরিবেশ পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে তা কার্যকর করার পথ উন্মুক্ত রেখেছে।
(গ) আইন পরিষদ (Legislature) অবশ্যই পরামর্শভিত্তিক হবে (১০ নং প্যারাগ্রাফ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু তার আইন প্রণয়নের অধিকার সর্বাবস্থায় ৩ এবং ৫ নং প্যারাগ্রাফে বর্ণিত সীমারেখায় সীমিত হতে বাধ্য। যেসব ব্যাপারে আল্লাহ এবং রাসূল কোন স্পষ্ট নির্দেশ দেননি বা মূলনীতি এবং সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, আইন পরিষদ সে সব ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে পারে। তা কার্যকর করার জন্য প্রসঙ্গিক নিয়ম-নীতির পরামর্শ দিতে পারে, প্রস্তাব পেশ করতে পারে। কিন্তু তাতে রদবদল করতে পারে না। অবশ্য যেসব ব্যাপারে উর্ধ্বতন আইন প্রণেতা কোন সুস্পষ্ট বিধান দেয়নি, সীমারেখা এবং মূলনীতি নির্ধারণ করেননি; সে সব ব্যাপারে ইসলামের স্পিরিট (Spirit) এবং সাধারণ মূলনীতি অনুযায়ী আইন পরিষদ যে কোন প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করতে পারে। কারণ সে ব্যাপারে কোন নির্দেশ না থাকাই এ কথার প্রমাণ যে, শরীয়ত প্রণেতা তা ঈমানদারের শুভবুদ্ধির ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
(ঘ) বিচার বিভাগকে (Judiciary) সকল প্রকার হস্তক্ষেপ এবং চাপ ও প্রভাবমুক্ত হতে হবে; যেন সরকার এবং জনগণ সকলের ব্যাপারে আইন অনুযায়ী পক্ষপাতহীন রায় দিতে পারে। ওপরে ৩ এবং ৫ নম্বর প্যারাগ্রাফে যেসব সীমারেখার উল্লেখ করা হয়েছে, তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। নিজের এবং অন্যের অভিলাষ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সত্য এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে মামলার রায় দেয়া হবে তার কর্তব্যঃ
**********************
-আল্লার নাযেলকৃত বিধান অনুযায়ী তাদের মধ্যে ফায়সালা করো এবং তাদের কামনা-বাসনা (খাহেশ)-এর অনুসরণ করো না। -আল-মায়েদাঃ৪৮
**********************
-নিজেদের নফসের কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। (এরূপ করলে) তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে নিয়ে যাবে। -সাদঃ২৬
**********************
-মানুষের মধ্যে যখন ফায়সালা করবে, ইনসাফের সাথে করবে। -আন-নিসাঃ৫৮
তেরঃ রাষ্ট্রের লক্ষ্য
এ রাষ্ট্রকে দুটি মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য কাজ করতে হবে।
একঃ মানব জীবনে ইনসাফ-সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হোক; যুলুম-নির্যাতনের অবসান হোকঃ
**********************
-আমরা স্পষ্ট হেদায়াত দিয়ে আমাদের রাসূল প্রেরণ করেছি, আর তাদের সাথে কিতাব এবং আল-মিযান [মুজাহিদ কাতাদা ইত্যাকার তাফসীরকারকদের মতে মীযান অর্থ আদল ন্যায় বিচার। (ইবনে কাসীরঃ তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩১৪; মাতবাআতু মুস্তফা মুহাম্মাদ, মিশর, ১৯৩৭)] নাযিল করেছি, যেন মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমরা লোহা [লোহার অর্থ রাজনৈতিক শক্তি। এদ্বারা এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মানুষ ঔদ্ধত্য অবলম্বন করলে তাদের বিরুদ্ধে তরবারীর শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। (আর-বাযীঃ মাফাতিহুল গায়েব, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১০১, আল-মাতবাআতুশ শারফিয়া, মিশর, ১৩২৪ হিজরী)] নাযিল করেছি, যাতে রয়েছে কঠিন শক্তি এবং মানুষের জন্য কল্যাণ। -আল-হাদীদঃ২৫
দুইঃ সরকারী ক্ষমতা এবং উপায়-উপকরণ দ্বারা ‘সালাত প্রতিষ্ঠা’ এবং যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে – যা ইসলামী জীবনের স্তম্ভ। কল্যাণ এবং পূণ্যের উন্নতি সাধন করতে হবে। বিশ্বে ইসলামের আগমনের ইহাই আসল উদ্দেশ্য। অন্যায়-অকল্যাণের প্রতিরোধ করতে হবে। অন্যায় -অকল্যাণ আল্লার নিকট সবচেয়ে বেশী ঘৃণ্যঃ
**********************
-তারা এমন ব্যক্তি, আমরা তাদেরকে দুনিয়ায় ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে, ন্যায়ের আদেশ করে অন্যায়ের প্রতিরোধ করে। -আল-হজ্জঃ৪১
চৌদ্দঃ মৌলিক অধিকার
এ ব্যবস্থায় বসবাসকারী মুসলিম অমুসলিম নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো এই। এসব অধিকার সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। [মৌলিক অধিকার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য মানুষের মৌলিক অধিকার তাফহীমাত, ৩য় খন্ড, ২৪৮-২৬৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]
(ক) জীবন সংরক্ষণঃ
**********************
-যে জীবনকে আল্লাহ হারাম-সম্মানার্হ করেছেন, হক ব্যতীত তাকে হত্যা করো না।
(খ) মালিকানার অধিকার সংরক্ষণঃ
**********************
-নিজেদের সম্পদ পরস্পরে অবৈধ পন্থায় ভক্ষণ করো না।
(গ) সম্মান-সম্ভ্রম সংরক্ষণঃ
**********************
-একদল যেন অপর দলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ না করে। …. একে অপরকে দোষারোপ করো না, একে অন্যকে বিরূপ পদবী দিও না। …. একে অন্যের গীবত করো না-তার অনুপস্থিতিতে তাকে মন্দ বলো না। -আল-হুজুরাতঃ ১১-১২
(ঘ) ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা সংরক্ষণঃ
**********************
-অনুমতি গ্রহণ না করে নিজেদের গৃহ ব্যতীত অপরের গৃহে প্রবেশ করো না। -নুরঃ২৭
**********************
-মানুষের গোপন কথা খুজে বেড়াইও না। – আল-হুজুরাতঃ১২
(ঙ) যুলুমের বিরুদ্ধে আওয়ায তুলবার অধিকারঃ
**********************
-প্রকাশ্য নিন্দাবাদ আল্লাহ পছন্দ করেন না, অবশ্য যদি কারো ওপর যুলুম হয়ে থাকে।
(চ) ন্যায়ের আদেশ এবং অন্যায় থেকে নিবৃত্ত করার অধিকার, সমালোচনার স্বাধীনতার অধিকারও এর পর্যায়ভুক্তঃ
**********************
-বনী-ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফরী করেছে, দাউদ এবং ঈসা ইবনে মারইয়াম-এর ভাষায় তাদের ওপর লানত (অভিসম্পত) করা হয়েছে। এটা এজন্য যে, তারা নাফরমানী করেছিল; করেছিল বাড়াবাড়ি, সীমালংঘন। তারা একে অপরকে মন্দ কাজ করা থেকে বারণ করতো না। তারা যা করতো, কতই না মন্দ ছিল। -আল-মায়েদাঃ৭৮-৭৯
**********************
-যারা মন্দ কার্য থেকে বারণ করতো, আমরা তাদেরকে আযাব থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছি; আর যালেমদের কঠোর আযাবে পাকড়াও করেছি-তারা যে ফিসক-পাপাচার করতো, তার প্রতিদানে। -আল-আরাফঃ১৬৫
**********************
-তোমরা সে সর্বোত্তম উম্মাত, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের সৃষ্টি। তোমরা ভাল কাজের আদেশ করবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে এবং আল্লার ওপর ঈমান রাখবে।
(ছ) সংগঠনের স্বাধীনতা (Freedom of Association) -এর অধিকার। অবশ্য এজন্য শর্ত এই যে, তা মঙ্গল-কল্যাণ কার্যে ব্যবহার হবে। সমাজে দলাদলি এবং মৌল-বিরোধ ছড়াবার কাজের মাধ্যম হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হবে নাঃ
**********************
-তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা বাঞ্ছনীয়, যারা কল্যাণের দিকে আহবান জানাবে, ভাল কাজের নির্দেশ দেবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। এমন লোকেরাই হবে সফলকাম। যারা নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, স্পষ্ট হেদায়োত আসার পরও যারা মতভেদ করেছে, তোমরা তাদের মত হয়ো না। এমন লোকদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।
(জ) বিবেক-বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারঃ
**********************
-দ্বীনে কোন যবরদস্তি নেই। -আল-বাকারাঃ ১৫৬
**********************
-মুমিন হয়ে যাওয়ার জন্য তুমি কি লোকদেরকে বাধ্য করবে?
**********************
-ফেতনা হত্যার চেয়েও মারাত্নক। -আল-বাকারাঃ ১৯১ [ফেতনার মানে কোন ব্যক্তির ওপর শক্তি প্রয়োগ করে তাকে নিজের দ্বীন পরিবর্তন করতে বাধ্য করা। (ইবনে জরীর, দ্বিতীয় খন্ড, পুষ্ঠা ৯১১)]
(ঝ) ধর্মীয় ব্যাপারে মনোকষ্ট থেকে মুক্ত থাকার অধিকারঃ
**********************
-আল্লাকে বাদ দিয়ে তারা যে সব উপাস্যকে ডাকে; তোমরা তাদের গালি দিও না।
এ ব্যাপারে কুরআনস্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে তাত্বিক আলোচনা করা যেতে পারে; কিন্তু তা করতে হবে সুন্দরভাবে, উত্তম পন্থায়ঃ
**********************
-সুন্দর (Fair) পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবের সাথে বহছ করো না।
(ঞ) প্রত্যেক ব্যক্তি কেবল তার নিজের কাজের জন্যই দায়ী, একের কর্মের জন্য অপরকে পাকড়াও করা যাবে না-এ অধিকারঃ
**********************
-প্রত্যেক ব্যক্তি যে মন্দ কাজ করে, তার ফল তাকেই ভোগ করতে হয়, কোন ভার বহনকারী অপরের বোঝা বহন করে না। -আল-আনআমঃ১৬৫ [অর্থাৎ কোন অপরাধী যে অপরাধই করুক না কেন সে জন্য সে-ই দায়ী। সে ছাড়া অন্য ব্যক্তি ধৃত হবে না। তার নিজের অপরাধ ব্যতীত অন্যের অপরাধের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হতে পারে না। (ইবনে জারীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৮৩)]
**********************
-কোন ফাসেক পাপাচারী যদি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তবে অনুসন্ধান করো। এমন যেন না হয় যে, তোমরা না বুঝে-শুনে কোন দলের ক্ষতি করে বসো, আর নিজের কাজের জন্য পরিতাপ করো। -আল-জুজুরাতঃ৬
(ট) বিনা প্রমাণে এবং সুবিচারের সুবিহিত দাবী পূরণ না করে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা যাবে না।-এ অধিকারঃ
**********************
-এমন কোন ব্যাপারের পেছনে পড়ো না, যার জ্ঞান তোমাদের নেই। বনী-ইসরাইলঃ৩৬
**********************
-মানুষের ব্যাপারে যখন ফায়সালা করবে, আদল (ন্যায়) এর সাথে ফায়সালা করবে। -আন-নিসাঃ৫৮
(ঠ) অভাবী এবং বঞ্চিত ব্যক্তিদেরকে তাদের জীবন ধারণের অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ করতে হবে-এ অধিকারঃ
**********************
-এবং তাদের সম্পদে সাহায্য প্রার্থী বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে। আয-যাবিয়াতঃ১৯
(ড) রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ-বৈষম্য করবে না বরং সকলের সাথে সমান আচরণ করবে-এ অধিকারঃ
*********************
-ফেরাউন যমীনে ঔদ্ধত্য করেছে, যমীনে বাসিন্দাদেরকে নানা দলে বিভক্ত করেছে, তাদের একদলকে দূর্বল করে রাখতো সে …. নিশ্চিত সে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পর্যায়ভুক্ত ছিল।
পনেরঃ নাগরিকদের ওপর সরকারের অধিকার
এ ব্যবস্থায় নাগরিকদের ওপর সরকারের অধিকার গুলো এইঃ
(ক) তারা সরকারের আনুগত্য করবে, সরকারকে মেনে চলবেঃ
**********************
-আনুগত্য করো আল্লার এবং আনুগত্য করো রাসূলের, আর তাদের তোমাদের মধ্যে যারা উলিল আমর। -আন-নিসাঃ ৫৯
(খ) তারা আইন মেনে চলবে, শাসন-শৃংখলায় ফাটল ধরাবে নাঃ
**********************
-সংস্কার-সংশোধনের পর যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।
**********************
-যারা আল্লাহ এবং রাসূলের সাথে যুদ্ধ করে এবং যমীনে বিপর্যায় সৃষ্টি করে তাদের শাস্তি এইঃ তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শুলিবিদ্ধ করা হবে ….। -আল-মায়েদাঃ ৩৩
(গ) তারা সরকারের সকল ভাল কাজে সহযোগিতা করবেঃ
**********************
-ভাল কাজ এবং তাকওয়ার ব্যাপারে তোমরা সহযোগিতা করো।
(ঘ) প্রতিরক্ষা কাজে তারা জান-মাল দ্বারা সর্বতোভাবে রাষ্ট্রের সাহায্য করবেঃ
**********************
-তোমাদের কি হয়েছে? আল্লার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার জন্য বলা হলে তোমরা যমীনকে আঁকড়ে ধরে থাকো। …. তোমরা যদি বেরিয়ে না পড়ো, আল্লাহ তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের পরিবর্তে অন্য কওমকে এনে দাঁড় করাবেন, তোমরা তাঁর কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। …. তোমরা বেরিয়ে পড়ো-হালকা হও বা ভারি হও। এবং জান-মাল দিয়ে আল্লার পথে জিহাদ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝতে পারো। -আত-তাওবাঃ ৩৮-৪১
ষোলঃ বৈদেশিক রাজনীতির মূলনীতি
ইসলামী রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি (Foreign Policy) সম্পর্কে কুরআন মাজীদে যেসব হেদায়েত দেয়া হয়েছে, তা এইঃ
(ক) চুক্তি -অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। চুক্তি ভঙ্গ করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়লে সে ব্যাপারে দ্বিতীয় পক্ষকে পূর্বাহ্নে অবহিত করতে হবেঃ
**********************
-চুক্তি-অঙ্গীকার পুরো করো, চুক্তি সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
**********************
-আল্লার সাথে কৃত অংঙ্গীকার পূর্ণ করো, যখন তোমরা অংঙ্গীকার করো। পাকা-পোক্ত শপথ করার পর তা ভঙ্গ করো না। …. সে মহিলার মতো হয়ো না যে আপন শ্রম-মেহনত দ্বারা সূতা কেটে পরে তা টুকরো টুকরো করে ফেলে। এক জাতি অন্য জাতির চেযে বেশী ফায়দা হাসিল করার জন্য তোমরা নিজেদের কসমকে নিজেদের মধ্যে প্রতারণার মাধ্যম করো না। আল্লাহ এদ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন। কেয়ামতের দিন তিনি অবশ্যই তোমাদের মত বিরোধের রহস্য উন্মেচন করবেন।
**********************
-দ্বিতীয় পক্ষের লোক যতক্ষন তোমাদের সাথে অঙ্গীকারে অটল থাকে, তোমরাও অটল থাকো। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকী-পরহেযগারদের পছন্দ করেন। -আত-তাওবাঃ ৭
**********************
-মুশরিকদের মধ্যে তোমরা যাদের সাথে অঙ্গীকার করেছো, অতঃপর তোমাদের সাথে ওফাদারীতে তারাও ত্রুটি করেনি, তোমাদের বিরুদ্ধে কারো সাহায্যও করেনি, তবে তাদের অঙ্গীকার মেয়াদ পর্যন্ত পূর্ণ করো। -আত-তাওবাঃ৪
**********************
-(আর যদি শত্রুর এলাকায় বসবাসকারী মুসলমানরা) তোমাদের কাছে সাহায্য চায়, তবে তাদের সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। অবশ্য এমন কোন জাতির বিরুদ্ধে এ সাহায্য করা যাবে না, যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে। -আল-আনফালঃ৪২
**********************
-কোন জাতির পক্ষ থেকে তোমাদের যদি খেয়ানত (চুক্তিভঙ্গ) এর আশংকা হয়, তা হলে (তাদের চুক্তি) তাদের প্রতি ছুড়ে মারো। অবশ্য সমতার প্রতি লক্ষ্য রেখে (তা করবে)। [অর্থাৎ তোমাদের এবং তাঁদের মধ্যে যে চুক্তি বা সন্ধি হয়েছিল, তা বাতিল হয়ে যাওয়ার খবর তাদেরকে দিয়ে দাও, যাতে তা বাতিল হওয়ার ব্যাপারে উভয় পক্ষ সমান হয়। আর তোমরা যদি তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ কর, তখন অপর পক্ষ যেন এ ধারণায় না থাকে যে, তোমরা তাদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছ। (আল-জাসসাস, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ৮৩] আল্লাহ নিশ্চয় খেয়ানতকারীকে পছন্দ করেন না। -আল আনফালঃ৫৮
(খ) কাজ-কর্মে বিশ্বস্ততা এবং সততাঃ
**********************
-তোমাদের শপথকে নিজেদের মধ্যে প্রতারণা-প্রবঞ্চনার মাধ্যম করো না। [অর্থাৎ প্রতারণা করার নিয়তে চুক্তি করবে না, যাতে অপর পক্ষ তো তোমাদের কসমের ভিত্তিতে তোমাদের পক্ষ হতে নিশ্চিত হয়ে যায় আর তোমাদের ইচ্ছা এই হয় যে, সুযোগ পেলে তোমরা লংঘন করবে। -ইবনে জারীর, ১৪শ খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ১১২]
(গ) আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচারঃ
**********************
-এবং কোন দলের শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এতটুকু ক্ষিপ্ত না করে, যাতে তোমরা না ইনসাফ করে বসো। ন্যায় বিচার করো, তা তাকওয়ার নিকটবর্তী। -আল-মায়েদাঃ ৮
(ঘ) যুদ্ধে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের সীমারেখার মর্যাদাঃ
**********************
-যদি তারা (অর্থাৎ দুশমনের সাথে মিলিত মুনাফেকেরা) না মানে, তাহলে তাদেরকে পাকড়াও করো; যেখানে পাও, তাদেরকে হত্যা করো। …. তাদেরকে বাদে, যারা এমন কোন জাতির সাথে মিলিত হয়েছে, যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে। -আন-নিসাঃ ৯০
(ঙ) সন্ধিকামিতাঃ
**********************
-তারা যদি সন্ধির প্রতি ঝুঁকে পড়ে, তবে তোমরাও ঝুঁকে পড়।
(চ) দুনিয়ার বিপর্যয় সৃষ্টি এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত্তিঃ
**********************
-যমীনে যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব-বাহাদুরী (প্রতিষ্ঠা করতে) চায় না বিপর্যয় সৃষ্টি করতে ; পরকালের নিবাস তো আমরা শুধু তাদের জন্যই নির্দিষ্ট করবো শুভ পরিণাম পরহেযগারদের জন্য।-আল-ক্বাসাসঃ৮৩
(ছ) শত্রুভাবাপন্ন নয়, এমন শক্তির সাথে বন্ধু সুলভ আচারণঃ
**********************
-যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি, তোমাদের নিবাস থেকেও তোমাদেরকে বের করেনি, তাদের সাথে সদাচরণ এবং ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে বারণ করেন না। ইনসাফকারীদেরকে আল্লাহ নিশ্চিত পছন্দ করেন। -আল-মুমতাহানাঃ৮
(জ) সদাচারীদের সাথে সদাচারঃ
**********************
-এহসানের বিনিময় এহসান ছাড়া অন্য কিছু কি হতে পারে ?
(ঝ) যারা বাড়াবাড়ি করে, তাদের সাথে ততটুকু বাড়াবাড়ি করো- যতটুকু তারা করেছে।
**********************
-সুতরাং যারা বাড়াবাড়ি করে, তোমরাও তাদের সাথে ততটুকু বাড়াবাড়ি করো, যতটুকু তারা করেছে। এবং আল্লাকে ভয় করো নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। -বাকারাঃ ১৯৪
**********************
-আর যদি প্রতিশোধ নিতেই হয় তবে ততটুকু, যতটুকু তোমাদেরকে উত্যক্ত করা হয়েছে। আর যদি ধৈর্য ধারণ করো, তবে ধৈর্যধারণকারীদের জন্য তাই উত্তম। -আন-নাহালঃ ১২৬
**********************
-আর অন্যায়ের বিনিময়ের ততটুকু অন্যায়, যতটুকু অন্যায় করা হয়েছে। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং শুদ্ধি করে নেয়, তার বিনিময় আল্লার যিম্মায়। আল্লাহ যালেমদের পছন্দ করেন না। নির্যাতিত হওয়ার পর যারা প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর যুলুম করে। যমীনে না-হক ঔদ্ধত্য করে। এসব লোকেদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। -আশ-শুরাঃ ৪০-৪২
ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
কুরআনে এ ষোলটি দফায় রাষ্ট্রের যে চিত্র আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে, তার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো এইঃ
একঃ একটি স্বাধীন জাতি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাপ্রণেদিত হয়ে মহান আল্লাহ রাবুল আলামিনের সামনে আত্মসমর্পন করবে, তাঁর অধীনে কর্তৃত্ব-সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে খেলাফতের ভূমিকা গ্রহণ করে সে সব বিধি-বিধান এবং নির্দেশাবলী কার্যকরী করবে, আল-কুরআন এবং রাসূলের মাধ্যমে তিনি যা দান করেছেন। একটি স্বাধীন জাতির পক্ষ থেকে বুঝে শুনে এহেন ঘোষণার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে।
দুইঃ সার্বভৌমত্বকে আল্লার জন্য বিশেষিত করার সীমা পর্যন্ত সে রাষ্ট্র থিয়াক্রেসী (Theacracy)-এর বুনিয়াদী দর্শনের সাথে একমত। কিন্তু সে দর্শন কার্যকরী করার ব্যাপারে থিয়াক্রেসী থেকে তার পথ ভিন্ন হয়ে যায়। ধর্মীয় যাজকদের কোন বিশেষ শ্রেণীকে আল্লার বিশেষ ক্ষমতার ধারক বাহক করা এবং ‘হিল ও আকদ’ এর সমস্ত ক্ষমতা এ শ্রেণীর হাতে ন্যাস্ত করার পরিবর্তে ইসলামী রাষ্ট্র দেশের সীমানার মধ্যে বসবাসকারী সমস্ত ঈমানদারকে (যারা স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে আত্মসমর্পণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ) আল্লার খেলাফতের ধারক-বাহক প্রতিপন্ন করে। ‘হিল ও আকদ’-এর চূড়ান্ত ক্ষমতা সামগ্রিক ভাবে তাদের হাতে ন্যস্ত করে।
তিনঃ রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠা, পরিবর্তন, পরিচালন, সম্পূর্ণভাবে জনগণের রায় অনুযায়ী হতে হবে- জমহুরিয়াতের এ নীতিতে ইসলামী রাষ্ট্র গণতন্ত্র (Democracy)-র সাথে একমত। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণ লাগামহীন নয়। রাষ্ট্রের আইন-কানুন, জনগণের জীবন-যাপনের মূলনীতি, আভ্যন্তরীন এবং বৈদেশিক নীতি, রাষ্ট্রের উপায়-উপকরণ সব কিছুই জনগণের ইচ্ছানুযায়ী হবে, এমন নয়। এমনও হতে পারে না যে, যেদিকে জনগণ ঝুকে পড়বে, ইসলামী রাষ্ট্রও সেদিকেই নুয়ে পড়বে। বরং আল্লাহ-রাসূলের উর্ধ্বতন আইন তার নিজস্ব নিয়ম-নীতি, সীমারেখা, নৈতিক বিধি-বিধান এবং নির্দেশাবলী দ্বারা জনগণের ইচ্ছা-বাসনার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে। রাষ্ট্র এমন এক সুনির্দিষ্ট পথে চালিত হয়, তার পরিবর্তন সাধনের ক্ষমতা-ইখতিয়ার, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ- কারোই নেই। সামগ্রিকভাবে গোটা জাতিরও নেই সে ক্ষমতা-ইখতিয়ার। হ্যাঁ, জাতি যদি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ঈমানের বৃত্ত থেকে দূরে সরে যেতে চায়, তা স্বতন্ত্র কথা।
চারঃ ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শভিত্তক রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্র পরিচালনা স্বভাবতই তাদের কাজ হতে পারে, যারা তার মৌলিক দর্শন এবং বিধি-বিধান স্বীকার করে। কিন্তু তা স্বীকার করে না- এমন যতো ব্যক্তিই সে রাষ্ট্র সীমায় আইনের অনুগত হয়ে বাস করতে রাজী হয়, তাদেরকে সে সব নাগরিক অধিকার পুরোপুরিই দেয়, যা দেয় রাষ্ট্রের আদর্শ এবং মূলনীতি মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নাগরিকদেরকে।
পাঁচঃ তা এমন এক রাষ্ট্র, যা বংশ, বর্ণ, ভাষা এবং ভৌগলিক জাতীয়তার পরিবর্তে শুধু নীতি আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলের মানবজাতির যে কোন সদস্য ইচ্ছা করলে সে সব মূলনীতি স্বীকার করে নিতে পারে; কোন প্রকার ভেদ-বৈষম্য ছাড়াই সম্পূর্ণ সমান অধিকার নিয়ে সে ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। এ আদর্শের ভিত্তিতে বিশ্বের যেখানেই কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, নিশ্চিত তা হবে ইসলামী রাষ্ট্র, তা আফ্রিকায় হোক বা এশিয়ায়; সে রাষ্ট্রের পরিচালকমন্ডলী কালো হোক বা সাদা বা হরিদ্র। এধরনের একটি নিরঙ্কুশ আইনভিত্তিক রাষ্ট্রের বিশ্ব-রাষ্ট্রে (World state) রুপান্তরিত হওয়ায় কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলেও যদি এ ধরনের অনেক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তাও হবে ইসলামী রাষ্ট্র। কোন জাতীয়তাবাদী দ্বন্দ-সংঘাতের পরিবর্তে সে সব রাষ্ট্রের মধ্যে পরিপূর্ণ ভ্রাতৃসুলভ সহযোগিতা সম্ভব। কোনও এক সময় তারা একমত হয়ে বিশ্ব-ফেডারেশন (World-federation) -প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
ছয়ঃ রাজনীতিকে স্বার্থের পরিবর্তে নীতি নৈতিকতার অনুগত করা এবং আল্লাভীতি-পরহেযগারীর সাথে তা পরিচালনা করা সে রাষ্ট্রের মৌল প্রানশক্তি (Real Spirit)। নৈতিক-চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্বই সেখানে শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র ভিত্তি-একক মানদন্ড। সে রাষ্ট্রের পরিচালকমন্ডলী এবং ‘আহলুল হিল ওয়ার আকদ’-এর নির্বাচনের ব্যাপারেও শারীরিক মানসিক যোগ্যতার সাথে নৈতিক পবিত্রতাও সর্বাধিক লক্ষ্যণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তার সকল আভ্যান্তরীণ প্রশাসন বিভাগকেও পরিচালিত হতে হবে দিয়ানাত আমানত-সততা-বিশ্বস্ততা পক্ষপাতমুক্ত নির্ভিক ইনসাফ-সুবিচারের ভিত্তিতে। আর তার বৈদেশিক নীতিকেও প্রতিষ্ঠিত হতে হবে সম্পূর্ণ এবং সদাচরণের ভিত্তির ওপর।
সাতঃ নিছক পুলিশের দায়িত্ব পালন করার জন্য এ রাষ্ট্র নয়। শুধু আইন-শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশের সীমান্ত রক্ষা করা তার কাজ নয়; বরং তা হচ্ছে একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র। সামাজিক সুবিচার, ন্যায়ের বিকাশ আর অন্যায়ের বিনাশ সাধনের নিমিত্ত তাকে নেতিবাচকভাবে কাজ করতে হবে।
আটঃ অধিকার, মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধার সাম্য, আইনের শাসন, ভাল কাজে সহযোগিতা, খারাপ কাজে অসহযোগিতা, আল্লার সম্মুখে দায়িত্বের অনুভূতি, অধিকারের চেয়েও বড় করে কর্তব্যের অনুভূতি, ব্যক্তি সমাজ এবং রাষ্ট্র-সকলের এক লক্ষ্যে ঐক্যমত, সমাজের কোন কোন ব্যক্তিকে জীবন যাপনের অপরিহার্য উপাদান-উপকরণ থেকে বঞ্চিত থাকতে না দেয়া এসব হচ্ছে সে রাষ্ট্রের মৌলিক মূল্যমান (Basic Values)।
নয়ঃ এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের মধ্যে এমন এক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে, রাষ্ট্র লাগামহীন এবং সামগ্রীক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ব্যক্তিকে নিরীহ দাসে পরিণত করতে পারে না, আর ব্যক্তিও সীমাহীন স্বাধীনতা পেয়ে ঔদ্ধত্যপরায়ন এবং সামাজিক স্বার্থের দুশমন হতে পারে না। এতে ব্যক্তিকে একদিকে মৌলিক অধিকার দিয়ে এবং রাষ্ট্রকে উর্ধ্বতন আইন এবং শুরার অনুগত করে ব্যক্তি সত্ত্বার উদ্ভব-বিকাশের সকল সুযোগ-সুবিধা দান করা হয়েছে; ক্ষমতার অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে ব্যক্তিকে করা হয়েছে নিরাপদ; কিন্তু অপরদিকে ব্যক্তিকে নৈতিক নীতিমালার ডোরে শক্তভাবে বেঁধে দেয়া হয়েছে। তার ওপর এ কর্তব্যও আরোপ করা হয়েছে যে, রাষ্ট্র আল্লার বিধান অনুযায়ী কাজ করলে মনে-প্রাণে রাষ্ট্রের আনুগত্য করবে, ভাল কাজে তার সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে, রাষ্ট্র শৃংখলায় ফাটল ধরানো থেকে বিরত থাকবে, তার সংরক্ষণ কাজে জানমাল দিয়ে যে কোন ধরনের ত্যাগ স্বীকারে যেন বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধও না করে।