তৃতীয় অধ্যায়
খেলাফতে রাশেদা ও তার বৈশিষ্ট্য
আগের অধ্যায়ে ইসলামের যে শাসননীতি বিবৃত হয়েছে, নবী (সঃ)- এর পরে সেসব মূলনীতির ওপর খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। হযরত (সঃ)-এর প্রত্যক্ষ শিক্ষা-দীক্ষা ও কার্যকর নেতৃত্বের ভিত্তিতে যে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার প্রত্যেক সদস্যই জানতো, ইসলামের বিধি বিধান ও প্রাণসত্তা অনুযায়ী কোন ধরনের শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়া উচিত। নিজের স্থলাভিষিক্তের ব্যাপারে হযরত (সঃ) কোন ফায়সালা না দিয়ে গেলেও ইসলাম একটি শূরাভিত্তিক খেলাফত দাবী করে- মুসলিম সমাজের সদস্যরা এ কথা অবগত ছিল। তাই সেখানে কোন বংশানুক্রমিক বাদশাহী প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বল প্রয়োগে কোন ব্যক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি, খেলাফত লাভ করার জন্য কেউ নিজের তরফ থেকে চেষ্টা-তদবীর করেনি বা নামমাত্র প্রচেষ্টাও চালায়নি। বরং জনগণ তাদের স্বাধীন মর্যীমতো পর পর চারজন সাহাবীকে তাদের খলীফা নির্বাচিত করে। মুসলিম মিল্লাত এ খেলাফতকে খেলাফত রাশেদ (সত্যাশ্রয়ী) বলে গ্রহণ করেছে। এ থেকে আপনা আপনিই প্রকাশ পায় যে, মুসলমানদের দৃষ্টিতে এটিই ছিল খেলাফতের সত্যিকার পদ্ধতি।
একঃ নির্বাচনী খেলাফত
নবী করীম (সঃ)-এর স্থলাভিষিক্তের জন্য হযরত ওমর (রাঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ)- এর নাম প্রস্তাব করেন। মদীনার সকলেই (বস্তুত তখন তারা কার্যত সারা দেশের প্রতিনিধির মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিল) কোন প্রকার চাপ-প্রভাব এবং প্রলোভন ব্যতীত নিজেরা সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁকে পসন্দ করে তাঁর হাতে বায়আত (আনুগত্যের শপথ) করে।
হযরত আবুবকর (রাঃ) তাঁর ওফাতকালে হযরত ওমর (রাঃ)- এর সম্পর্কে ওসিয়াত লিখান, অতঃপর জনগণকে মসজিদে নববীতে সমবেত করে বলেনঃ
“আমি যাকে স্থলাভিষিক্ত করছি তোমরা তার ওপর সন্তুষ্ট? আল্লার শপথ! সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বুদ্ধি-বিবেক প্রয়োগে আমি বিন্দুমাত্রাও ত্রুটি করিনি। আমার কোন আত্মীয়-স্বজনকে নয়, বরং ওমর ইবনুল খাত্তাবকে আমার স্থলাভিষিক্ত করেছি। সুতরাং তোমরা তাঁর নির্দেশ শুনবে এবং আনুগত্য করবে।”
সবাই সমস্বরে বলে ওঠেঃ আমরা তাঁর নির্দেশ শুনবো এবং মানবো। [আততাবারী- তারিখুল উমাম মুলুক, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬১৮। আল-মাতবাআতুল ইস্তেকামা, কায়রো ১৯৩৯।]
হযরত ওমর (রাঃ)- এর জীবনের শেষ বছর হজ্জের সময় এক ব্যক্তি বললোঃ ওমর (রাঃ) মারা গেলে আমি অমুক ব্যক্তির হাতে বায়আত করবো। কারণ, আবুবকর (রাঃ)-এর বায়আতও তো হঠাৎই হয়েছিলো।। শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হয়েছেন। [তিনি এদিকে ইঙ্গিত করেছেন যে সাকীফায়ে বনী-সায়েদার মজলিসে হযরত ওমর (রাঃ) হঠাৎ দাড়িয়ে হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর নাম প্রস্তাব করেছেন এবঙ হাত বড়িয়ে তখনই তাঁর হাতে বায়আত করেছেন। তাঁকে খলীফা করার ব্যাপারে পূর্বাহ্নে কোন পরামর্শ করেননি। ] হযরত ওমর (রাঃ) এ সম্পর্কে জানতে পেরে বললেনঃ এ ব্যাপারে আমি এক ভাষণ দেবো। জনগণের ওপর যারা জোরপূর্বক নিজেদেরকে চাপিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করছে, তাদের সম্পর্কে আমি জনগণকে সতর্ক করে দেবো। মদীনায় পৌঁছে তাঁর প্রথম ভাষণেই তিনি এ ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। সাকীফায়ে বনী-সায়েদার ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে বলেন যে, তখন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে হঠাৎ হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর নাম প্রস্তাব করে আমি তাঁর হাতে বায়আত করেছিলাম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ তখন যদি এ রকম না করতাম এবং খেলাফতের মীমাংসা না করেই আমরা মজলিস ছেড়ে উঠে আসতাম, তবে রাতারাতি লোকদের কোন ভুল সিদ্ধান্ত করে বসার আশংকা ছিল। আর সে ফায়সালা মেনে নেয়া এবং তা পরিবর্তন করা-উভয়ই আমাদের জন্য কঠিন হতো। এ পদক্ষেপটি সাফল্য মন্ডিত হলেও ভবিষ্যতের জন্য একে নযীর হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে না। আবুবকরের মতো উন্নত মানের এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তোমাদের মধ্যে আর কে আছে? এখন কোন ব্যক্তি যদি মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতিরেকে কারো হাতে বায়আত করে তাহলে সে এবং যার বায়আত করা হবে- উভয়েই নিজেকে মৃত্যুর হাতে সোপর্দ করবে। [বুখারী, কিতাবুল মোহরেবীন, অধ্যায়-১৬। মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, হাদীস নম্বর- ৩৯১। তৃতীয় সংস্করণ, দারুল মাআরেফ, মিসর ১৯৪৯। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় হযরত ওমর (রাঃ)- এর শব্দগুলো ছিল এইঃ মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত যে ব্যক্তি কোন আমীরের হাতে বায়আত করে, তার কোন বায়আত নেই; এবং যার হাতে বায়আত করে, তারও কোন বায়আত নেই। অপর এক বর্ণনায় হযরত ওমর (রাঃ)-এর এ বাক্যও দেখা যায়- পরামর্শ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে এমারাত দেয়া হলে তা কবুল করা তার জন্য হালাল নয়। – (ইবনে হাযার, ফতহুলবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৫, আল-মাতবায়াতুল খাইরিয়া, কায়রো, ১৩২৫ হিজরী।]
তাঁর নিজের ব্যাখ্যা করা এ পদ্ধতি অনুযায়ী হযরত ওমর (রাঃ) খেলাফতের ফায়সালা করার জন্য তাঁর ওফাতকালে একটি নির্বাচন কমিটি গঠন করে বলেনঃ মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত যে ব্যক্তি জোর করে আমীর হওয়ার চেষ্টা করবে, তাকে হত্যা করো। খেলাফত যাতে বংশানুক্রমিক পদাধিকারে পরিণত না হয়, সে জন্য তিনি খেলাফত লাভের যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা থেকে নিজের ছেলের নাম সুস্পষ্টভাবে বাদ দিয়ে দেন। [আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৯২। ইবনুল আসীর, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৪-৩৫। ইদারাতুল তিবআতিল মুনীরিয়া, মিসর, ১৩৫৬ হিজরী। তাবাকাতে ইবনে সাআদ, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৪৪, বৈরুতে সংস্করণ ১৯৫৭। ফতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৯।] ছ’ব্যক্তিকে নিয়ে এ নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয়। হযরত ওমর (রাঃ)-এর মতে এরা ছিলেন কওমের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয়।
কমিটির সদস্য আবদুর রহমান (রাঃ) ইবনে আওফকে কমিটি শেষ পর্যন্ত খলিফার নাম প্রস্তাব করার ইখতিয়ার দান করে। সাধারণ লোকদের মধ্যে ঘোরা-ফেরা করে তিনি জানতে চেষ্টা করেন, কে সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়। হজ্জ শেষ করে যেসব কাফেলা বিভিন্ন এলাকায় ফিরে যাচ্ছিল, তিনি তাদের সাথেও আলোচনা করেন। এ জনমত যাচাইয়ের ফলে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে,
আধিকাংশ লোকই হযরত ওসমান (রাঃ)-এর পক্ষে। [আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৯৬। ইবনুল আসীর, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৬। আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৪৬।] তাই তাঁকেই খেলাফতের জন্য নির্বাচিত করা হয়। সাধারণ জনসমাবেশে তার বায়আত হয়।
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাতাদাতের পর কিছু লোক হযরত আলী (রাঃ)-কে খলীফা করতে চাইলে তিনি বললেনঃ ”এমন করার ইখতিয়ার তোমাদের নেই। এটা তো শুরার সদস্য এবং বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কাজ। তারা যাঁকে খলীফা করতে চান, তিনিই খলীফা হবেন। আমরা মিলিত হবো এবং এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করবো।” [ইবনে কোতায়বা, আল-ইমামা ওয়াস সিয়াসা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪১।] তাবারী হযরত আলী (রাঃ)- এর যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছ, তা হচ্ছেঃ “গোপনে আমার বায়আত অনুষ্ঠিত হতে পারে না, তা হতে হবে মুসলমানদের মর্জী অনুযায়ী।” [আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৫০।]
হযরত আলী (রাঃ)- এর ওফাতকালে লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, আমরা আপনার পুত্র হযরত হাসান (রাঃ)-এর হাতে বায়আত করবো? জবাবে তিনি বলেনঃ “আমি তোমাদেরকে নির্দেশও দিচ্ছি না, নিষেধও করছি না। তোমরা নিজেরাই এ ব্যাপারে ভালোভাবে বিবেচনা করতে পারো।” [আততাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১১২। আল-মাসউদী, মুরুজুয্ যাহাব, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৬। আল-মাতাবাআতুল বাহিয়্যা, মিসর, ১২৪৬ হিজরী।] তিনি যখন আপন পুত্রদেরকে শেষ ওসিয়াত করছিলেন, ঠিক সে সময় জনৈক ব্যক্তি আরয করলো, আমীরুল মু’মিনীন। আপনি আপনার উত্তরসুরী মনোনয়ন করছেন না কেন? জবাবে তিনি বলেনঃ “আমি মুসলমানদেরকে সে অবস্থায় ছেড়ে যেতে চাই, সে অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম।” [ইবনে কাসীর, আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩-১৪। মাতবাআতুস সাআদাত, মিসর। আল-মাউদি, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৬।]
এসব ঘটনা থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, খেলাফত সম্পর্কে খোলাফায়ে রাশেদীন এবং রাসুল্লাহ (সঃ)- এর সাহাবীদের সর্বসম্মত মত এই ছিল যে, খেলাফত একটা নির্বাচন ভিত্তিক পদমর্যাদা। মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শ এবং তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের মাধ্যমেই তা কায়েম করতে হবে। বংশানুক্রমিক বা বল প্রয়োগের দ্বারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব তাঁদের মতে খেলাফত নয়, বরং তা বাদশাহী-রাজতন্ত্র। খেলাফত এবং রাজতন্ত্রের যে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ধারণা সাহাবায়ে কেরামগণ পোষণ করতেন, হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) তা ব্যক্ত করেন নিন্মোক্ত ভাষায়ঃ
********************************************************************************************
– এমারাত (অর্থাৎ খেলাফত) হচ্ছে তাই, যা প্রতিষ্ঠা করতে পরামর্শ নেয়া হয়েছে, আর তরবারীর জোরে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হচ্ছে বাদশাহী বা রাজতন্ত্র। [তাবকাতে ইবনে সাআদ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১১৩।]
দুইঃ শূরাভিত্তিক সরকার
এ খলীফা চুতষ্টয় সরকারের কার্যনির্বাহ এবং আইন প্রণয়ণের ব্যাপারে জাতির বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের অধিকারী ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ না করে কোন কাজ করতেন না। সুনানে দারামীতে হযরত মায়মুন মাহরানের একটি বর্ণনা আছে যে, হযরত আবুবকর (রাঃ)- এর নীতি ছিল, তাঁর সামনে কোন বিষয় উত্থাপিত হলে তিনি প্রথমে দেখতেন এ ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব কি বলে। সেখানে কোন নির্দেশ না পেলে এ ধরনের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সঃ) কি ফায়সালা দিয়েছেন, তা জানতে চেষ্টা করতেন। রাসুলের সুন্নায়ও কোন নির্দেশ না পেলে জাতীয় শীর্ষস্থানীয় এবং সৎ ব্যক্তিদের সমবেত করে পরামর্শ করতেন। সকলের পরামর্শক্রমে যে মতই স্থির হতো, তদানুযায়ী ফায়সালা করতেন। [সুনানে দারামী, ফুতইয়া ওয়ামা ফিহে মিনাশ শিদ্দাতে।] হযরত ওমর (রাঃ)- এর কর্মনীতিও ছিল অনুরূপ। [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস- ২২৮১।]
পরামর্শের ব্যাপারে খোলাফায়ে রাশেদীনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, শূরার সদস্যদের সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। এ ব্যাপারে হযরত ওমর (রাঃ) এক পরামর্শ সভার উদ্বোধনী ভাষণে খেলাফতের পলিসি ব্যক্ত করেছেন এরূপেঃ
“আমি আপনাদেরকে যে জন্য কষ্ট দিয়েছি, তা এছাড়া আর কিছুই নয় যে, আপনাদের কার্যাদির আমানতের যে ভার আমার ওমর ন্যস্ত হয়েছে তা বহন করার কাজে আপনারও আমার সঙ্গে শরীক হবেন। আমি আপনাদের অন্তর্ভূক্ত এক ব্যক্তি। আজ আপনারাই সত্যের স্বীকৃতি দানকারী। আপনাদের মধ্য থেকে যাদের ইচ্ছা, আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন; আবার যাদের ইচ্ছা আমার সাথে এক মতও হতে পারেন। আপনাদের যে আমার মতামতকে সমর্থন করতে হবে- এমন কোন কথা নেই এবং আমি তা চাই-ও-না।” [ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা- ২৫।]
তিনঃ বায়তুলমাল একটি আমানত
তাঁরা বায়তুলমালকে আল্লাহ এবং জনগণের আমানত মনে করতেন। বেআইনীভাবে বায়তুলমালের মধ্যে কিছু প্রবেশ করা ও বেআইনীভাবে তা থেকে কিছু বের হয়ে যাওয়াকে তারা জায়েয মনে করতেন না। শাসক শ্রেণীর-ব্যক্তিগত স্বার্থে বায়তুলমাল ব্যবহার তাঁদের মতে হারাম ছিল। তাদের মতে খেলাফত এবং রাজতন্ত্রের মৌলিক পার্থক্যই ছিল এই যে, রাজা-বাদশাহরা জাতীয়ভান্ডারকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করে নিজেদের খাহেশ মতো স্বাধীনভাবে তাতে তসরুফ করতো, আর খলীফা তাকে আল্লাহ এবং জনগণের আমানাত মনে করে সত্য-ন্যায়- নীতি মোতাবেক এক একটি পাই পয়সা উসুল করতেন, আর তা ব্যয়ও করতেন সত্য-ন্যায়-নীতি অনুসারে। হযরত ওমর (রাঃ) একদা হযরত সালমান ফারসীকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আমি বাদশাহ, না খলীফা?” তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দেনঃ “মুসলমানদের ভূমি থেকে আপনি যদি এক দেরহামও অন্যায়ভাবে উসুল এবং অন্যায়ভাবে ব্যয় করেন তাহলে আপনি খলীফা নন, বাদশাহ।” অপর এক প্রসঙ্গে একদা হযরত ওমর (রাঃ) স্বীয় মজলিসে বলেনঃ “আল্লার কসম, আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না যে, আমি বাদশা, না খলীফা। আমি যদি বাদশাহ হয়ে গিয়ে থাকি। তবে তা তো এক সাংঘাতিক কথা।” এতে জনৈক ব্যক্তি বললোঃ “আমীরুল মুমিনীন। এতদোভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।” হযরত ওমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কি পার্থক্য? তিনি বললেনঃ “খলীফা অন্যায়ভাবে কিছুই গ্রহণ কনের না, অন্যায়ভাবে কিছুই ব্যয়ও করেন না। আল্লার মেহেরবানীতে আপনিও অনুরূপ। আর বাদশাহ তো মানুষের ওপর যুলুম করেন, অন্যায়ভাবে একজনের কাছ থেকে উসুল করে; আর অন্যায়ভাবেই অপরজনকে দান করে।” [তাবাকাতে ইবনে সা’আদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩০৪-৩০৭।]
এ ব্যাপারে খোলাফায়ে রাশেদনীনের কর্মধারা প্রণিধান যোগ্য। হযরত আবুবকর (রাঃ) খলীফা হওয়ার পরদিন কাপড়ের থান কাঁধে নিয়ে বিক্রি করার জন্য বেরিয়েছেন। কারণ, খেলাফতের পূর্বে এটিই ছিল তাঁর জীবিকার অবলম্বন। পথে হযরত ওমর (রাঃ)- এর সাথে দেখা। তিনি বললেন, আপনি একি করছেন? জবাব দিলেন, ছেলে-মেয়েদের খাওয়াবো কোত্থেকে? হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, মুসলমানদের নেতৃত্বের ভার আপনার ওপর অর্পিত হয়েছে। ব্যবসায়ের সাথে খেলাফতের কাজ চলতে পারে না। চলুন আবু ওবায়দা (বায়তুল মালের খাজাঞ্চী)-এর সাথে আলাপ করি। তাই হলো। হযরত ওমর (রাঃ) আবু ওবায়দার সাথে আলাপ করলেন। তিনি বললেন, একজন সাধারণ মুহাজিরের আমদানীর মান সামনে রেখে আমি আপনার জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দিচ্ছি। এ ভাতা মুহাজিরদের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তির সমানও নয়; আবার সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তির পর্যায়েরও নয়। এমনিভাবে তাঁর জন্য একটি ভাতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর পরিমাণ ছিল বার্ষিক চার হাযার দিরহামের কাছাকাছি। কিন্তু তাঁর ওফাতের সময় ঘনিয়ে এলে তিনি ওসিয়াত করে যান যে, আমার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে আট হাযার দিরহাম বায়তুলমালকে ফেরত দেবে। হযরত ওমর (রাঃ)-এর নিকট তা আনা হলে তিনি বলেনঃ “আল্লাহ আবুবকর (রাঃ)- এর প্রতি রহমত করুন। উত্তরসূরিদেরকে তিনি মুশকিলে ফেলেছেন।” [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড,হাদীস নঙ- ২২৮০-২২৮৫।]
“গ্রীষ্মকালে এক জোড়া কাপড়, শীতকালে এক জোড়া কাপড়, কুরাইশের একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির সমপরিমাণ অর্থ আপন পরিবার-পরিজনের জন্য-এ ছাড়া আল্লার সম্পদের মধ্যে আর কিছুই আমার জন্য হালাল নয়। আমি তো মুসলমানদের একজন সাধারণ ব্যক্তি বৈ কিছুই নই।” [ইবনে কাসীর, আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, পৃষ্ঠা- ১৩৪।]
অপর এক ভাষণে তিনি বলেনঃ
“এ সম্পদের ব্যাপারে তিনটি বিষয় ব্যতিত অন্য কিছুকেই আমি ন্যায় মনে করি না। ন্যায় ভাবে গ্রহণ করা হবে, ন্যায় মুতাবিক প্রদান করা হবে এবং বাতেল থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হবে। এতীপের সম্পদের সাথে তার অভিভাবকের যে সম্পর্ক, তোমাদের এ সম্পদের সাথে আমার সম্পর্কও ঠিক অনুরূপ। আমি অভাবী না হলে তা থেকে কিছুই গ্রহণ করবো না, অভাবী হলে মারুফ পন্থায় গ্রহণ করবো। [ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা- ১১৭।]
হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং হযরত ওমর (রাঃ)- এর বেতনের মান যা ছিল, হযরত আলী (রাঃ)- এর তাঁর বেতনের মান তাই রাখলেন। তিনি পায়ের হাঁটু ও গোড়ালীর মাঝবরাবর পর্যন্ত উচু তহবন্দ পরতেন। তাও আবার ছিল তালিযুক্ত। [ইবনে সাআদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৮।] সারাজীবন কখনো একটু আরামে কাটাবার সুযোগ হয়নি। একবার শীতের মওসুমে জনৈক ব্যক্তি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। দেখেন, তিনি একখানা ছেঁড়া-ময়লা কাপড় পরে বসে আছেন আর শীতে কাঁপছেন। [ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩।] শাহাদাতের পর তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তির হিসাব নিয়ে দেখা গেল মাত্র ৭শত দিরহাম। তাও তিনি এক পয়সা এক পয়সা করে সঞ্চয় করেছেন। একটা গোলাম খরিদ করার জন্য। [ইবনে সাআদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৮।] আমীরুল মুমিনীন বলে চিনতে পেরে তাঁর কাছ থেকে যাতে কম মূল্য কেউ গ্রহণ না করে-এ ভয়ে কোন পরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে বাজারে কখনো কোন জিনিস কিনতেন না। [ইবনে সাআদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৮। ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩।] সে সময় হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)- এর সাথে তাঁর সংঘর্ষ চলছিল, কেউ কেউ তাঁকে পরামর্শ দেনঃ হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) যে রকম লোকদেরকে অঢেল দান-দক্ষিণা করে তাঁর সাথি করে নিচ্ছেন আপনিও তেমনি বায়তুলমালের ভান্ডার উজাড় করে টাকার বন্যা বইয়ে দিয়ে সমর্থক সংগ্রহ করুন। কিন্তু তিনি এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করলেন “তোমরা কি চাও, আমি অন্যায়ভাবে সফল হই?” [ইবনে আবিল হাদীদ, নাহজুল বালাগার ভাষ্য, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৮২। দারুল কুতুবিল আরাবিয়্যা, মিসর, ১৩২৯ হিজরী।] তাঁর আপন ভাই হযরত আ’কীল (রাঃ) তাঁর কাছে টাকা দাবী করেন বায়তুলমাল থেকে। কিন্তু তিনি তা দিতে অস্বীকার করে বলেনঃ “তুমি কি চাও তোমার ভাইও মুসলমানদের টাকা তোমাকে দিয়ে জাহান্নামে যাক?” [ইবনে কোতাইবা-আল-ইমামা ওয়াস সিয়াসা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭১। হাফেয ইবনে হাজার তাঁর আল-ইসাবা গ্রন্থে লিখেছেন যে, হযরত আ’কীলের কিছু ঋণ ছিল। হযরত আলী (রাঃ) তা পরিশোধ করতে অস্বীকার করেন। তাই তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)- এর দলে ভিড়ে ছিলেন। আল-ইসাবা, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৮৭। মাতবাআতু মুস্তফা মুহাম্মাদ, মিসর ১৯৩৯।]
চারঃ রাষ্ট্রের ধারণা
রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁদের ধারণা কি ছিল, রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে নিজের মর্যাদা এবং কর্তব্য সম্পর্কে তাঁরা কি ধারণা পোষণ করতেন, স্বীয় রাষ্ট্রে তাঁরা কোন নীতি মেনে চলতেন? — খেলাফতের মঞ্চ থেকে ভাষন দান প্রসঙ্গে তাঁরা নিজেরাই প্রকাশ্যে এসব বিষয় ব্যক্ত করেছেন। মসজিদে নববীতে গণ বায়আত ও সপথের পর হযরত আবুবকর (রাঃ) যে ভাষণ দান করেন, তাতে তিনি বলেছিলেনঃ
“আমাকে আপনাদের শাসক নিযুক্ত করা হয়েছে, অথচ আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। সে সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন ন্যস্ত, আমি নিজে ইচ্ছা করে এ পদ গ্রহণ করিনি। অন্যের পরিবর্তে আমি নিজে এ পদ লাভের চেষ্টাও করিনি, এ জন্য আমি কখনো আল্লার নিকট দোয়াও করিনি। এ জন্য আমার অন্তরে কখনো লোভ সৃষ্টি হয়নি। মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ এবং আরবদের মধ্যে ধর্ম ত্যাগের ফেতনার সূচনা হবে- এ আশংকায় আমি অনিচ্ছা সত্ত্বে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এ পদে আমার কোন শান্তি নেই। বরং এটা এক বিরাট বোঝা, যা আমার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এ বোঝা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই। অবশ্য আল্লাহ যদি আমার সাহায্য করেন। আমার ইচ্ছা ছিল, অন্য কেউ এ গুরুদায়িত্ব- ভার বহন করুক। এখনও আপনারা ইচ্ছা করলে রাসুলুল্লা (সঃ)- এর সাহাবীদের মধ্য হতে কাউকে এ কাজের জন্য বাছাই করে নিতে পারেন। আমার বায়আত এ ব্যাপারে আপনাদের প্রতিবন্ধক হবে না। আপনারা যদি আমাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)- এর মানদন্ডে যাচাই করেন, তাঁর কাছে আপনারা যে আশা পোষণ করতেন, আমার কাছেও যদি সে আশা করেন, তবে তার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ, তিনি শয়তান থেকে নিরাপদ ছিলেন, তাঁর ওপর ওহী নাযিল হতো। আমি সঠিক কাজ করলে আমার সহযোগিতা করবেন, অন্যায় করলে আমাকে সোজা করে দেবেন। সততা হচ্ছে একটি আমানত-গচ্ছিত ধন। আর মিথ্যা একটি খেয়ানত-গচ্ছিত সম্পদ অপহরণ্ তোমাদের দুর্বল ব্যক্তি আমার নিকট সবল। আল্লার ইচ্ছায় যতক্ষণ আমি তার অধিকার তাকে দান না করি। আর তোমাদের মধ্যকার সবল ব্যক্তি আমার নিকট দুর্বল-যতক্ষণ আল্লার ইচ্ছায় আমি তার কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে না পারি। কোনজাতি আল্রার রাস্তায় চেষ্টা সাধনা ত্যাগ করার পরও আল্লাহ তার ওপর অপমান চাপিয়ে দেননি-এমনটি কখনো হয়নি। কোন জাতির মধ্যে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করার পরও আল্লাহ তাদেরকে সাধারণ বিপদে নিপতিত করেন নাএমনও হয় না। আমি যতক্ষণ আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)- এর অনুগত থাকি, তোমরা আমার আনুগত্য করো। আমি আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)- এর নাফরমানী করলে তোমাদের ওপর আমার কোন আনুগত্য নেই। আমি অনুসরণকারী, কোন নতুন পথের উদ্ভাবক নই।” [আততাবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৫০। ইবনে হিশাম, আস সীরাতুন নববিয়্যা, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩১১, মাতবাআতু মুস্তফা আল-বারী, মিসর- ১৯৩৬, কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং- ২২৬১, ২২৬৪, ২২৬৮, ২২৭৮, ২২৯১, ২২৯৯।]
হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর এক ভাষণে বলেনঃ
“লোক সকল। আল্লার অবাধ্যতায় কারোর আনুগত্য করতে হবে- নিজের সম্পর্কে এমন অধিকারের দাবী কেউ করতে পারে না। ….. লোক সকর। আমার ওপর তোমাদের যে অধিকার রয়েছে, আমি তোমাদের নিকটতা ব্যক্ত করছি। এসব অধিকারের জন্য তোমরা আমাকে পাকড়াও করতে পারো। আমার ওপর তোমাদের অধিকার এই যে, খেরাজ বা আল্লার দেয়া ‘ফাই’ (বিনা যুদ্ধে বা রক্তপাত ছাড়াই যে গনীমাতের মাল লব্ধ হয়) থেকে বেআইনীভাবে কোনো কিছু গ্রহণ করবো না। আর আমার ওপর তোমাদের অধিকার এই যে, এভাবে যে অর্থ আমার হাতে আসে, অন্যায়ভাবে তার কোন অংশও আমি ব্যয় করবো না।” [ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা- ১১৭।]
সিরিয়া ও ফিলিস্তিন যুদ্ধে হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ)-কে প্রেরণ কালে হযরত আবুবকর (রাঃ)- যে হেদায়াত দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
“আমার! আপন প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল কাজে আল্লাকে ভয় করে চলো। তাঁকে লজ্জা করে চলো। কারণ, তিনি তোমাকে এবং তোমার সকল কর্মকেই দেখতে পান। ………….পরকালের জন্য কাজ করো। তোমার সকল কর্মে আল্লার সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রেখো। সঙ্গী-সাথীদের সাথে এমনভাবে আচরণ করবে, যেন তারা তোমার সন্তান। মানুষের গোপন বিষয় খুঁজে বেড়িয়ো না। বাহ্য কাজের ভিত্তিতেই তাদের সঙ্গে আচরণ করো। ……. নিজেকে সংযত রাখবে, তোমার প্রজা সাধারণও ঠিক থাকবে।” [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নঙ- ২৩১৩।]
হযরত ওমর (রাঃ) শাসনকর্তাদের কোন এলাকায় প্রেরণকালে সম্বোধন করে বলতেনঃ
” মানুষের দন্ড-মুন্ডের মালিক বনে বসার জন্য আমি তোমাদেরকে মুহাম্মদ (সঃ)-এর উম্মাতের ওপর শাসনকর্তা নিযুক্ত করছি না। বরং এ জন্য নিযুক্ত করছি যে, তোমরা সালাত কায়েম করবে, মানুষের মধ্যে ইনসাফের ফায়সালা করবে, ন্যায়ের সাথে তাদের অধিকার বন্টন করবে।” [আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৭৩।]
বায়আতের পর হযরত ওসমান (রাঃ) প্রথম যে ভাষণ দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
“শোন, আমি অনুসরণকারী, নতুন পথের উদ্ভাবক নই। জেনে রেখো, আল্লার কিতাব এবং রাসূল (সঃ)-এর সুন্নাহ মেনে চলার পর আমি তোমাদের নিকট তিনটি বিষয় মেনে চলার অঙ্গীকার করছি। একঃ আমার খেলাফতের পূর্বে তোমরা পারস্পরিক সম্মতিক্রমে যে নীতি নির্ধারণ করেছো, আমি তা মেনে চলবো। দুইঃ যেসব ব্যাপারে পূর্বে কোন নীতি-পন্থা নির্ধারিত হয়নি, সেসব ব্যাপারে সকলের সাথে পরামর্শক্রমে কল্যাণভিসারীদের পন্থা নির্ধারণ করবো। তিনঃ আইনের দৃষ্টিতে তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে না পড়া পর্যন্ত তোমাদের ওপর হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবো।” [আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৪৬।]
হযরত আলী (রাঃ) হযরত কায়েস ইবনে সা’দকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠাবার কালে মিসরবাসীদের নামে যে ফরমান দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
“সাবধান! আমি আল্লার কিতাব এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর সুন্নাহ মুতাবিক আমল করবো- আমার ওপর তোমাদের এ অধিকার রয়েছে। আল্লার নির্ধারিত অধিকার অনুযায়ী আমি তোমাদের কাজ-কারবার পরিচালনা করবো এবং রাসুলুল্লার সুন্নাহ কার্যকরী করবো। তোমাদের আগোচরেও তোমাদের কল্যাণ কামনা করবো।”
প্রকাশ্য জনসমাবেশে এ ফরমান পাঠ করে শোনাবার পর হযরত কায়েস ইবনে সাআ’দ ঘোষণা করেনঃ “আমি তোমাদের সাথে এভাবে আচরণ না করলে তোমাদের ওপর আমার কোন বায়আত নেই।” [আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৫০-৫৫১।]
হযরত আলী (রাঃ) জনৈক গবর্ণরকে লিখেনঃ
“তোমরা এবং জনসাধারণের মধ্যে দীর্ঘ প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করো না। শাসক ও শাসিতের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা দৃষ্টির সংকীর্ণতা এবং জ্ঞানের স্বল্পতার পরিচায়ক। এর ফলে তারা সত্যিকার অবস্থা জানতে পারে না। ক্ষুদ্র বিষয় তাদের জন্য বৃহৎ হয়ে দাঁড়ায়, আর বিরাট বিষয় ক্ষুদ্র। তাদের জন্য ভাল মন্দ হয়ে দেখা দেয়, আর মন্দ গ্রহণ করে ভালর আকার; সত্য-মিথ্যা সংমিশ্রিত হয়ে যায়।” [ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮।]
“হযরত আলী (রাঃ) কেবল এই কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, তিনি অনুরূপ কাজও করেছেন। তিনি নিজে দোররা নিয়ে কুফার বাজারে বেরুতেন, জনগণকে অন্যায় থেকে বারণ করতেন, ন্যায়ের নির্দেশ দিতেন। প্রত্যেকটি বাজারে চক্কর দিয়ে দেখতেন, ব্যবসায়ীরা কাজ-কারবারে প্রতারণা করছে কিনা! এ দৈনন্দিন ঘোরাঘুরির ফলে কোন অপরিচিত ব্যক্তি তাঁকে দেখে ধারণাই করতে পারতো না যে, মুসলিম জাহানের খলীফা তার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কারণ, তাঁর পোশাক থেকে বাদশাহীর কোন পরিচয় পাওয়া যেতোনা, তাঁর আগে আগে পথ করে দেয়ার জন্য কোন রক্ষীবহিনীও দৌড়ে যেতো না।” [ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪-৫।]
একবার হযরত ওমর (রাঃ) প্রকাশ্য ঘোষণা করেনঃ
” তোমাদেরকে পিটাবার জন্য আর তোমাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য আমি গবর্ণরদেরকে নিযুক্ত করিনি। তাদেরকে নিযুক্ত করেছি এ জন্য যে, তারা তোমাদেরকে দ্বীন এবং নবীর তরীকাপদ্ধতি শিক্ষা দেবে। কারো সাথে এই নির্দেশ বিরোধী ব্যবহার করা হলে সে আমার কাছে অভিযোগ উত্থাপন করুক। আল্লার কসম করে বলছি, আমি তার (গবর্ণর) কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবো। এতে হযরত আমর ইবনুল আস (মিসরের গবর্ণর) দাঁড়িয়ে বলেনঃ “কেউ যদি মুসলমানদের শাসক হয়ে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদেরকে মারে, আপনি কিতার কাছ থেকেও প্রতিশোধ নেবেন?”
হযরত ওমর (রাঃ) জবাব দেনঃ “হা, আল্লার শপথ করে বলছি, আমি তার কাছ থেকেও প্রতিশোধ নেবো। আমি আল্লার রাসূল (সঃ)-কে তাঁর নিজের সত্তা থেকেও প্রতি বিধান দিতে দেখেছি।” [আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা- ১১৫। মুসনাদে আবু দাউদ আততায়ালেসী, হাদীস নঙ-৫৫। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩০। আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৭৩।]
আর একবার হজ্জ উপলক্ষে হযরত ওমর (রাঃ) সমস্ত গবর্ণরকে ডেকে প্রকাশ্য সমাবেশে দাঁড়িয়ে বলেনঃ এদের বিরুদ্ধে কারোর ওপর কোন অত্যাচারের অভিযোগ থাকলে তা পেশ করতে পারো নির্দ্ধিধায়। গোটা সমাবেশ থেকে মাত্র একজন লোক উঠে হযরত আমর ইবনুল আস-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেনঃ তিনি অন্যায় ভাবে আমাকে একশ দোররা মেরেছেন। হযরত ওমর (রাঃ) বলেনঃ ওঠ এবং তার কাছ থেকে প্রতিশোধ নাও। হযরত আমর ইবনুল আস প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, আপনি গবর্ণরদের বিরুদ্ধে এ পথ উন্মুক্ত করবেন না। কিন্তু তিনি বললেনঃ “আমি আল্লার রাসূলকে নিজের থেকে প্রতিশোধ দিতে দেখেছি। হে অভিযোগকারী, এসে তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করো।” শেষ পর্যন্ত আমর ইবনুল আস (রাঃ)-কে প্রতিটি বেত্রাঘাতের জন্য দুআশরাফী দিয়ে আপন পিঠ রক্ষা করতে হয়। [আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা- ১১৬।]
পাঁচঃ আইনের প্রাধান্য
এ খলীফারা নিজেকেও আইনের উর্ধে মনে করতেন না। বরং আইনের দৃষ্টিতে নিজেকে এবং দেশের একজন সাধারণ নাগরিককে (স মুসলমান হোক বা অমুসলিম যিম্মি) সমান মনে করতেন।রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে তাঁরা নিজেরা বিচারপতি (কাযী) করলেও খলীফাদের বিরুদ্ধে রায়দানে তারা ছিলে সম্পূর্ণ স্বাধীন- যেমন স্বাধীন একজন সাধারণ নাগরিকের ব্যাপারে। একবার হযরত ওরম (রাঃ) এবং হযরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ)-এর মধ্যে এক ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয়। উভয়ে হযরত যায়েদ (রাঃ) দাঁড়িয়ে হযরত ওমর (রাঃ)-কে তাঁর আসনে বসাতে চাইলেন; কিন্তু তিনি উবাই (রাঃ)- এর সাথে বসলেন। অতঃপর হযরত উবাই (রাঃ)- তাঁর আর্যী পেশ করলেন, হযরত ওমর (রাঃ) অভিযোগ অস্বীকার করলেন। নিয়ম অনুযায়ী যায়েদ (রাঃ)-এর উচিত ছিল হযরত ওমরের কাছ থেকে কসম আদায় করা। কিন্তু তিনি তা করতে ইতস্তত করলেন, হযরত ওমর নিজে কসম খেয়ে মজলিস সমাপ্তির পর বললেনঃ “যতক্ষণ যায়েদের কাছে একজন সাধারণ মুসলমান এবং ওমর সমান না হয়, ততক্ষণ যায়েদ বিচারক হতে পারে না।” [বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, ১০ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩৬। দায়েরাতুল মাআরেফ, হায়দরাবাদ, ১ম সংস্করণ, ১৩৫৫ হিজরী।]
এমনি একটি ঘটনা ঘটে জনৈক খৃষ্টানের সাথে হযরত আলী (রাঃ)- এর। কুফার বাজারে হযরত আলী (রাঃ) দেখতে পেলেন, জনৈক খৃষ্টান তাঁর হারানো লৌহবর্ম বিক্রি করছে। আমীরুল মু’মিনীন হিসেবে তিনি সে ব্যক্তির নিকট থেকে বর্ম ছিনিয়ে নেননি বরং কাযীর দরবারে ফরিয়াদ করলেন। তিনি সাক্ষ্য- প্রমাণ পেশ করতে না পারায় কাযী তাঁর বিরুদ্ধে রায় দান করলেন। [বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, ১০ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩৬। দায়েরাতুল মাআরেফ, হায়দরাবাদ, ১ম সংস্করণ, ১৩৫৫ হিজরী।
ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লেকান বর্ণনা করেন যে, একবার হযরত আলী (রাঃ) এবং জনৈক যিম্মী বাদী-বিবাদী হিসেবে কাযী শোরাইহ-এর আদালতে উপস্থিত হন। কাযী দাঁড়িয়ে হযরত আলী (রাঃ)- কে অভ্যর্থনা জানান। এতে তিনি (হযরত আলী) বলেন, “এটা তোমার প্রথম বে-ইনসাফী।” [ইবনে খাল্লেকান, ওয়াফায়াতুল আইয়ান, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬৮, মাকতাবাতুন নাহযাতিল মিসরিয়্যাহ, কায়রো, ১৯৪৮।]
ছয়ঃ বংশ-গোত্রের পক্ষপাতমুক্ত শাসন
ইসলামের প্রাথমিক যুগের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, ইসলামের নীতি এবং প্রাণশক্তি অনুযায়ী তখন বংশ-গোত্র এবং দেশের পক্ষপাতের উর্ধে উঠে সকল মানুষের সাথে সমান আচরণ করা হতো- কারো সাথে কোন রকম পক্ষপাতিত্ব করা হতো না।
আল্লার রাসূলের ওফাতের পরে আরবের গোত্রবাদ মাথাচড়া দিয়ে ওঠে ঝঞ্জার বেগে। নবুয়াতের দাবীদারদের অভ্যুদয় এবং ইসলাম ত্যাগের হিড়িকের মধ্যে এ উপাদান ছিল সবচেয়ে ক্রিয়াশীল। মোসায়লামার জনৈক ভক্তের উক্তিঃ আমি জানি, মোসায়লামা মিথ্যাবাদী। কিন্তু রাবীআর মিথ্যাবাদী মোযারের সত্যবাদীর চেয়ে উত্তম।’ [আততাবরী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫০৮।] মিথ্যা নবুয়্যাতের অপর এক দাবীদার তোলাইহার সমর্থনে বনু গাতফানের জনৈক সর্দার বলেনঃ ‘খোদার কসম, কুরাইশের নবীর অনুসরণ করার চেয়ে আমাদের বন্ধুগোত্রের নবীর অনুসরণ আমার নিকট অধিক প্রিয়।” [আততাবরী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৮৭]
মদীনায় যখন হযরত আবুবকর (রাঃ)- এর হাতে বায়আত অনুষ্ঠিত হয়, তখন গোত্রবাদের ভিত্তিতে হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা (রাঃ) তাঁর খেলাফত স্বীকার করা থেকে বিরত ছিলেন। এমনি করে গোত্রবাদের ভিত্তিতেই হযরত আবু সুফিয়ানের নিকট তাঁর খেলাফত ছিল অপসন্দনীয়। তিনি হজরত আলী (রাঃ) নিকট গিয়ে বলেছিলেনঃ “কুরাইশের সবচেয়ে ছোট গোত্রের লোক কি করে খলীফা হয়ে গেল? তুমি নিজেকে প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে দাঁড় করাতে প্রস্তুত হলে আমি পদাতিক এবং অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা সমগ্র উপত্যকা ভরে ফেলবো।” কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) এক মোক্ষম জবাব দিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেনঃ তোমার এ কথা ইসলাম এবং মুসলমানদের সাথে শত্রুতা প্রমাণ করে। তুমি কোন পদাতিক বা অশ্বারোহী বাহিনী আনো, আমি তা কখনো চাই না। মুসলমানরা পরস্পরের কল্যাণকামী। তারা একে অপরকে ভালবাসে। – তাদের আবাস ও দৈহিক সত্তার মধ্যে যতোই ব্যবধান থাক না কেন। অবশ্য মুনাফিক একে অন্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী। আমরা আবুবকরকে এ পদের যোগ্য মনে করি। তিনি এ পদের যোগ্য না হলে আমরা কখনো তাঁকে এ পদে নিয়োজিত হতে দিতাম না। [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস-২৩৭৪। আততাবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৪৯। ইবনুআব্দিল বার, আল-ইস্তিআব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬৮৯।]
এ পরিবেশে হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং তারপর হযরত ওমর (রাঃ) নিরপেক্ষ এবং পক্ষপাতমুক্ত ইনসাফপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে কেবল আরবের বিভিন্ন গোত্রে নয়, বরং অ-আরব নওমুসলিমদের সাথেও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করেন এবং আপন বংশ-গোত্রের সাথে কোন প্রকার ব্যতিক্রমধর্মী আচরণ থেকে তাঁরা সম্পূর্ণ বিরত থাকেন। এর ফলে সব রকম বংশ গোত্রবাদ বিলীন হয়ে যায়। মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের দাবী অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক প্রাণশক্তি ফুটে ওঠে। হযরত আবুবকর (রাঃ) তাঁর খেলাফতকালে আপন গোত্রের কোন লোককে কোন সরকারী পদে নিয়োগ করেননি। হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর গোটা শাসনকালে তাঁর গোত্রের একজন মাত্র ব্যক্তিকে- যার নাম ছিল নোমান ইবনে আদী- বসরার নিকটে মায়দান নামক এক ক্ষুদ্র এলাকার তহশিলদার নিযুক্ত করেছিলেন। অল্প কিছুদিন পরই আবার এ পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করেছিলেন। [হযরত নুমান ইবনে আদী (রাঃ) ছিলেন প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের অন্যতম। হযরত ওমর (রাঃ)-এরও আগে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবিসিনিয়ায় হিজরতকালে যারা মক্কা ত্যাগ করে আবিসিনিয়া চলে যান, তাঁদের মধ্যে তিনি এবং তাঁর পিতা আদীও ছিলেন। হযরত ওমর (রাঃ) যখন তাঁকে মাইসান- এর তহসিলদার নিযুক্ত করে প্রেরণ করে প্রেরণ করেন, তখন তাঁর স্ত্রী তাঁর সঙ্গে যাননি। তিনি সেখানে স্ত্রীর বিরহে কিছু কবিতা রচনা করেন। এ সকল কবিতায় কেবল মদের বিষয় উল্লেখ ছিল। এতে হযরত ওমর (রাঃ) তাকে পদচ্যুত করেন। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে তাকে কোন পদ না দেয়ারও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি। ইবনে আব্দুল বার, আল-ইস্তীআ’ব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯৬। দায়েরাতুল মাআরেফ, হায়দরাবাদ, মুজামুল বুলদান, ইয়াকুত হামাবী, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪২-২৪৩। দারে ছাদের, বৈরুত, ১৯৫৭। অপর এক ব্যক্তি, হযরত কোদামা ইবনে মাযউন- যিনি হযরত ওমর (রাঃ)- এর ভগ্নিপতি ছিলেন- তিনি তাঁকে বাহরাইন-এর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন আবিসিনিয়ার হিজরতকারী এবং বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের অন্যতম। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মদ্যপানের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি তাঁকে বরখাস্ত করে দণ্ড দান করেন। (আল- ইস্তীআব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৩৪, ইবনে হাজার, আল-ইসাবা) ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২১৯-২২০।] এদিক থেকে এ দুজন খলীফার কর্মধারা সত্যিকার আদর্শভিত্তিক ছিল।
হযরত ওমর (রাঃ) জীবনের শেষ অধ্যায়ে আশংকাবোধ করলেন, তাঁর পরে আরবের গোত্রবাদ (ইসলামী আন্দোলনের বিরাট বিপ্লবী প্রভাবের ফলেও যা এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়নি) পুনরায় যেন মাথাচা দিয়ে না ওঠে এবং তার ফলে ইসলামের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি না হয়ে যায়। একদা তাঁর সম্ভাব্য উত্তরশুরীদের সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লা ইবনে আব্বাস (রাঃ)- কে হযরত ওসমান (রাঃ)- এর ব্যাপারে বলেনঃ ‘আমি তাঁকে আমার স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করলে তিনি বনী আবিমুয়াইত (বনী উমাইয়্যা)-কে লোকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন। আর তারা লোকদের মধ্যে আল্লার নাফরানী করে বেড়াবে। আল্লার কসম আমি ওসমানকে স্থলাভিষিক্ত করলে সে তাই করবে। আর ওসমান তাই করলে তারা অবশ্যই পাপাচার করবে। এক্ষেত্রে জনগণ বিদ্রোহ করে তাকে হত্যা করবে। [ইবনে আব্দুল বার, আল-ইস্তীআব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৬৭। শাহ ওয়ালীউল্লাহ, ইযালাতুল খিফা, মাকসাদে আউয়াল, পৃষ্ঠা- ৩৪২,বেরিলা সংস্করণ। কেউ কেউ এখানে প্রশ্ন তোলেনঃ হযরত ওমর (রাঃ)- এর ওপর কি ইলহাম (সূক্ষ্ম ওহী) হয়েছিল, যার ভিত্তিতে তিনি হলফ করে এমন কথা বলেছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে যা অক্ষরে অক্ষরে ঘটে গিয়েছিল? এর জবাব এই যে, দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি কখনো কখনো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তাকে যুক্তির আলোকে পুনর্বিন্যাস করলে ভাবীকালে ঘটিতব্য বিষয় তাঁর সামনে এমনিভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, যেমন ২ + ২ = ৪। ফলে ইলহাম ব্যতীতই তিনি দিব্য দৃষ্টি বলে সঠিক ভবিষ্যদ্বানী করতে পারেন। আরবদের মধ্যে গোত্রবাদের বীজাণু কতো গভীরে শিকড় গেড়ে বসেছে, হযরত ওমর (রাঃ) তা জানতেন। তিনি এ-ও জানতেন যে, ইসলামের ২৫-৩০ বৎসরের প্রচার এখনও সে সব বীজাণু সমুলে উৎপাটিত করতে পারেনি। এ কারণে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যদি তাঁর এবং হজরত আবুবকর (রাঃ)- এর নীতিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করা হয়। তাঁর উত্তরসূরীরা যদি নিজ গোত্রের লোকদেরকে বড় বড় পদ দান করা শুরু করেন, তাহলে গোত্রবাদ পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠবে-কেউ তাকে ঠেকাতে পারবে না। ফলে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দেবে।] ওফাতকালেও এ বিষয়টি তার স্মরণ ছিল। শেষ সময়ে তিনি হযরত আলী (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ) এবং হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)- এর প্রত্যেককে ডেকে বলেনঃ ‘আমার পরে তোমরা খলীফা হলে স্ব-স্ব গোত্রের লোকদেরকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবে না। [আততাবারী, ৩য় খন্ড- পৃষ্ঠা- ২৬৪। তাবাকাতে ইবনে সা’দ ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৪০-৩৪৪।] পরন্তু ছয় সদস্যের নির্বাচনী শুরার জন্য তিনি যে হেদায়াত দিয়ে যান, তাতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে নিন্মোক্ত বিষয়টিও ছিলঃ নির্বাচিত খলীফার এ কথাটি মেনে চলবেন যে, তাঁরা আপন গোত্রের সাথে কোন ব্যতিক্রমধর্মী আচরণ করবেন না। [ফতহুলবারী, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৯-৫০। মুহিবুদ্দদীন আততাবারী, আর- রিয়াযুন নাযেরা ফী মানাকিবিল আশারা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭৬, হোসাইনিয়া প্রেস, মিসর, ১৩২৭ হিজরী। ইবনে খালদুন, দ্বিতীয় খন্ডের পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা- ১২৫, আল- মাতবাআতুল কুবরা, মিসর, ১২৮৪ হিজরী। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাঃ) তাঁর ইযালাতুল খিফায় এ বর্ণনার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মাকসাদে আউয়াল, পৃষ্ঠা- ৩২৪ দ্রষ্টব্য।] কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রাঃ) এ ক্ষেত্রে ঈপ্সিত মানদন্ড বজায় রাখতে সক্ষম হননি। তাঁর শাসনামলে বনী উমাইয়াকে ব্যাপকভাবে বিরাট বিরাট পদ পএবং বায়তুলমাল থেকে দান-দক্ষিণা দেয়া হয়। অন্যান্য গোত্র তিক্ততার সাথে তা অনুধাবন করতে থাকে। [তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬৪, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৬।] তাঁর কাছে এটা ছিল আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদাচারের দাবী। তিনি বলতেনঃ ওমর (রাঃ) আল্লার জন্য তাঁর নিকটাত্মীয়দের বঞ্চিত করতেন আর আমি আল্লার জন্য আমার নিকটাত্মীয়দের দান করছি। [আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৯১] একবার তিনি বলেনঃ ‘বায়তুলমালের ব্যাপারে আবুবকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ) নিজেও অসচ্ছল অবস্থায় থাকা পসন্দ করতেন এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনকে সেভাবে রাখতে ভাল বাসতেন। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদাচার পসন্দ করি। [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস- ২৩২৪। তাবাকাতে ইবনে সাদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬৪] অবশেষে এর ফল তাই হয়েছে হযরত ওমর (রাঃ) যা আশংকা করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-বিক্ষোভ দেখা দেয়। কেবল তিনি যে শহীদ হন তাই নয়, বরং গোত্রবাদের চাপা দেয়া স্ফুলিঙ্গ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং অবশেষে এরি অগ্নিশিখা খেলাফতে রাশেদার ব্যবস্থাকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
সাতঃ গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি
সমালোচনা ও মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতাই ছিল এ খেলাফতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যরাজির অন্যতম। খলীফারা সর্বক্ষণ জনগণের নাগালের মধ্যে থাকতেন। তাঁরা নিজেরা শূরার অধিবেশনে বসতেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন। তাঁদের কোন সরকারী দল ছিল না। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোন দলের অস্তিত্ব ছিল না। মুক্ত পরিবেশে সকল সদস্য নিজ নিজ ঈমান এবঙ বিবেক অনুযায়ী মত প্রকাশ করতেন। চিন্তাশীল, উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সামনে সকল বিষয় যথাযথভাবে উপস্থাপিত করা হতো। কোন কিছুই গোপন করা হতো না । ফায়সালা হতো দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে, কারোর দাপট, প্রভাব-প্রতিপত্তি, স্বার্থ সংরক্ষণ বা দলাদলির ভিত্তিতে নয়। কেবল শূরার মাধ্যমেই খলীফারা জাতির সম্মুখে উপস্থিত হতেন না। বরং দৈনিক পাঁচবার সালাতের জামায়াতে, সপ্তাহে একবার জুময়ার জামায়াতে এবং বৎসরে দুবার ঈদের জামায়াতে ও হজ্জ-এর সম্মেলনে তাঁরা জাতির সামনে উপস্থিত হতেন। অন্যদিকে এ সব সময়জাতিও তাঁদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেতো। তাঁদের নিবাস ছিল জনগণের মধ্যেই। কোন দারোয়ান ছিল না তাঁদের গৃহে। সকল সময়ে সকলের জন্য তাঁদের দ্বার খোলা থাকত। তাঁরা হাট-বাজারে জনগণের মধ্যে চলাফেরা করতেন। তাঁদের কোন দেহরক্ষী ছিল না, ছিল না কোন রক্ষী বাহিনী। এ সব সময়ে ও সুযোগে যে কোন ব্যক্তি তাঁদেরকে প্রশ্ন করতে, সমালোচনা করতে ও তাঁদের নিকট থেকে হিসাব চাইতে পারতো। তাঁদের নিকট থেকে কৈফিয়ত তলব করার স্বাধীনতা ছিল সকলেরই। এ স্বাধীনতা ব্যবহারের তাঁরা কেবল অনুমতিই দিতেন না, বরং এ জন্য লোকদেরকে উৎসাহিতও করতেন। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, হযরত আবুবকর (রাঃ) তাঁর খেলাফতের প্রথম ভাষণেই প্রকাশ্যে বলে দিয়েছিলেন, আমি সোজা পথে চললে আমার সাহায্য করো, বাঁকা পথে চললে আমাকে সোজা করে দেবে। একদা হযরত ওমর (রাঃ) জুমআর খোতবায় মতপ্রকাশ করেন যে, কোন ব্যক্তিকে যেন বিবাহে চারশ দেরহামের বেশী মোহর ধার্যের অনুমতি না দেয়া হয়। জনৈকা মহিলা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেন, আপনার এমন নির্দেশ দেয়ার কোন অধিকার নেই। কুরআন স্তুপিকৃত সম্পদ (কেনতার) মোহর হিসাবে দান করার অনুমতি দিচ্ছে। আপনি কে তার সীমা নির্ধারণকারী? হযরত ওমর (রাঃ) তৎক্ষণাৎ তাঁর মত প্রত্যাহার করেন। [তাফসারী ইবনে কাসীর, আবু ইয়ালা ও ইবনুল মুনযির, এর উদ্ধৃতিতে, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৬৭।] আর একবার হযরত সালমান ফারসী প্রকাশ্য মজলিসে তাঁর নিকট কৈফিয়ত তলব করেন- ‘আমাদের সকলের ভাগে একখানা চাদর পড়েছে। আপনি দু’খানা চাদর কোথায় পেলেন? হযরত ওমর (রাঃ) তৎক্ষণাৎ স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) এর সাক্ষ্য পেশ করলেন যে, দ্বিতীয় চাদরখানা তিনি পিতাকে ধার দিয়েছেন। [মুহিবুদ্দদীন আত-তাবারী আররিয়াযুন নাযেরা ফী মানাকিবিল আশারা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৬। মিসরীয় সংস্করণ। ইবনুল জাওযী, সীরাতে ওমর ইবনে খাত্তাব, পৃষ্ঠা- ১২৭।] একদা তিনি মজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করলেনঃ আমি যদি কোন ব্যাপারে শৈথিল্য দেখাই তাহলে তোমরা কি করবে? হযরত বিশর (রাঃ) ইবনে সাদ বললেন, এমন করলে আমরা আপনাকে তীরের মতো সোজা করে দেবো হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, তবেই তো তোমরা কাজের মানুষ। [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস- ২৪১৪।] হযরত ওসমান (রাঃ) সবচেয়ে বেশী সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি কখনো জোরপূর্বক কারো মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেননি। বরং সব সময় অভিযোগ এবং সমালোচনার জবাবে প্রকাশ্যে নিজের সাফাই পেশ করেছেন। হযরত আলী (রাঃ) তাঁর খেলাফত কালে খারেজীদের অত্যন্ত কটু উক্তিকেও শান্ত মনে বরদাশত করেছেন। একদা পাঁচজন খারেজীকে গ্রেফতার করে তাঁর সামনে হাযির করা হলো। এরা সকলেই প্রকাশ্যে তাঁকে গালি দিচ্ছিলো। তাদের একজন প্রকাশ্যেই বলছিল-আল্রার কসম আমি আলীকে হত্যা করবো। কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) এদের সকলকেই ছেড়ে দেন এবং নিজের লোকদেরকে বলেন, তোমরা ইচ্ছে করলে তাদের গাল-মন্দের জবাবে গালমন্দ দিতে পারো। কিন্তু কার্যত কোন বিদ্রোহাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত নিছক মৌখিক বিরোধিতা এমন কোন অপরাধ নয়, যার জন্য তাদেরকে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। [সুরুখসী, আল-মাবসুত, ১০খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৫। সাআদাত প্রেস, মিসর, ১৩২৪ হিজরী।]
ওপরে আমরা খেলাফতে রাশেদার যে অধ্যায়ের আলোচনা করেছি, তা ছিল আলোর মীনার। পরবর্তীকালে ফোকাহা-মোহাদ্দেদসীন এবং সাধারণ দ্বীনদার মুসলমান সে আলোর মীনারের প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন। ইসলামের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, নৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তাঁরা এ মীনারকেই আদর্শ মনে করে আসছেন।