অষ্টম অধ্যায়
খেলাফত ও এতদসংক্রান্ত বিষয়ে ইমাম আবু হানীফা (র: )-এর মতামত
রাজনীতির ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (র:) অত্যন্ত সুস্পষ্ট অভিমত পোষন করতেন। রাষ্ট্রদর্শন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল দিক এবং বিভাগ সম্পকেই তাঁর এ অভিমত ব্যাপৃত ছিল। কোন কোন মৌলিক বিষয়ে তাঁর অভিমত অন্যান্য ইমামদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল। এখানে আমরা প্রতিটি দিক-বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করে তাঁর মতামত পেশ করবো।
এক : সার্বভৌমত্ব
রাষ্ট্র-চিন্তার যে কোন দর্শন নিয়েই আলোচনা করা হোক না কেন, তাতে মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, সার্বভৌমত্ব কার, কার জন্য এ সার্বভৌমত্ব প্রতিপন্ন করা হবে? সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর মতবাদ ছিল ইসলামের সর্বসজন স্বীকত মৌলিক মতবাদ। অর্থাৎ সত্যিকার সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তায়ালা। তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রাসুল আনুগত্যের অধিকারী। আল্লাহ এবং রাসুলের বিধান হচ্ছে সে সর্বোচ্চ সার্বিক বিধান, যার মুকাবিলায় আনুগত্য ব্যতীত অন্য কোন কর্মপন্থা গ্রহণ করা চলে না। যেহেতু তিনি একজন আইনজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, তাই তিনি এ বিষয়টিকে রাষ্ট্র দর্শনের পরিবর্তে আইনের ভাষায় ব্যক্ত করেছেন:
আল্লার কিতাব কোন বিধান পেলে আমি তাকেই দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করি। আল্লার কিতাবে সে বিধানের সন্ধাননা পেলে রাসুলের সুন্নাহ এবং তাঁর সে সব বিশুদ্ধ হাদীস গ্রহণ করি, যা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের কাছে নির্ভরযোগ্য সুত্রে প্রসিদ্ধ। আল্লার কিতাব এবং রাসুলের সুন্নায়ও কোন বিধান না পেলে রাসুলুল্লাহ (স:)-এর সাহাবীদের উক্তি অর্থাৎ তাদেঁর ইজমা বা সর্বসম্মত মতের অনুসরণ করি। আর তাঁদের মতভেদের অবস্থায় যে সাহাবীর উক্তি খুশী গ্রহণ করি, আর যে সাহাবীর উক্তি খুশী বর্জন করি। কিন্তু এদের উক্তির বাইরে গিয়ে কারো উক্তি গ্রহণ করি না….. অবশিষ্ট রইল অন্য ব্যক্তিরা। ইজতিহাদের অধিকার তাদের যেমন আছে তেমনি আছে আমারও। [ আল-খতীব আল-বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, ১৩শ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৬৮; আল মাক্কী মানাকেবুল ইমামিল আযম আবিহানীফা, ১ম খন্ড, পষ্ঠা-৮৯; আযযাহাবী : মানাকেবুল ইমাম আবু হানীফা ওয়া সাহেবাইহে, পৃষ্ঠা-২০।]
ইবনে হাযম বলেন:
ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর মাযহাব ছিল এই যে, কোন যঈফ ( দুর্বল ) হদীসও পাওয়া গেলে তার মুকাবিলায় কেয়াস এবং ব্যক্তিগত মত পরিত্যাগ করা হবে। তাঁর সকল শাগরেদ এ ব্যাপারে একমত। [ আয্-যাহাবী,পৃষ্ঠা-২১ ]
তিনি কুরআন এবং সুন্নাহকে চুড়ান্ত সনদ (Final Authority ) বলে গ্রহণ করতেন- এ থেকে এ কথা নি:সন্দেহে প্রতিভাত হয়। তাঁর আকীদা ছিল এ যে, আইনানুগ সার্বভৌমত্ব
(Legal Sovereignty) আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের। তাঁর মতে, কেয়াস এবং ব্যক্তিগত মতামত দ্বারা আইন প্রনয়নের সীমা সে বৃত্ত পর্যন্তই সীমাবদ্ধ যেখনে আল্লাহ এবং রাসুলের কোন বিধান বতর্মান নেই। রাসুল (স:)-এর সাহাবীদের ব্যক্তিগত উক্তিকে অন্যান্যদের উক্তির ওপর তিনি যে অগ্রাধিকার দিতেন, তার মৌল কারণ এই ছিল যে, সাহাবীর জ্ঞানে রাসুলুল্লার কোন নির্দেশ থেকে থাকবে আর সেটাই তাঁর উক্তির উৎস মূর- সাহাবীর ক্ষেত্রে এমন সম্ভাবনা রয়েছে। তাই যেসব ব্যাপারে সাহাবীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, সেসব ব্যাপারে তিনি কঠোর ভাবে কোন সাহাবীর উক্তি গ্রহণ করতেন, আপন মত মতো সকল সাহাবীর উক্তির পরিপন্থী কোন ফায়সালাই তিনি করতেন না। কারণ, এতে জেনে-শুনে সুন্নার বিরুদ্ধাচরণের আশংকা ছিল। অবশ্য, এ সকল উক্তির মধ্যে কারো উক্তি সুন্নার নিকটতর হতে পারে, কেয়াস দ্বারা তিনি তা নির্ণয় করার চেষ্টা করতেন। ইমামদের জীবদ্দশায়ই তাঁর বিরুদ্ধে অভযোগ করা হয় যে, তিনি কেয়াসকে ’নছ’ ( স্পষ্ট বিধানের ) ওপর অগ্রাধিকার দিতেন। এ অভিযোগ খন্ডন করে তিনি বলেন :
‘আল্লার শপথ করে বলছি, যে বলে আমরা কেয়াসকে নছ-এর ওপর অগ্রাধিকার দেই-সে মিথ্যা বলে, আমাদের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করে। আছ্ছা, নছ-এর পরও কি কেয়াসের কোন প্রয়াজন থাকতে পরে? [ আশ্-শারানী: কিতাবুল মীযান, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৬১, আল-মাতবাআতুল আল- যাহারীয়্যাহ, মিসর,৩য় সংস্করণ,১৯২৫। ]
একদা খলীফা আল-মনসুর তাঁকে লিখেন, আমি শুনেছি, আপনি কেয়াসকে হাদীসের ওপর অগ্রাধিকার দান করেন। জবাবে তিনি লিখেন :
আমিরুল মুমিনীন। আপনি যা শুনেছেন, তা সত্য নয়। আমি সর্বাগ্রে কিতাবুল্লার ওপর আমল করি। অত:পর রাসুলুল্লার সন্নার ওপর। এরপর আবুবকর, ওমর, ওসমান, আলী আলাইহিম আজমাঈন-তাঁদের সকলের প্রতি আল্লার সন্তুষ্ট থাকুন )-এর ফায়সালার ওপর। অবশ্য, তাদেঁর মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে আমি কেয়াস করি। [ আশ-শারানী : কিতাবুল মীযান, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৬২। ]
দুইঃ খেলাফত নিষ্পন্ন করার সঠিকপন্থা
খেলাফত সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর অভিমত এই ছিল যে, প্রথমে শক্তি প্রয়োগে ক্ষমতা অধিকার করে পরে প্রভাব খাটিয়ে বায়আত ( আনুগত্যের শফত ) গ্রহণ করা তা সম্পাদনের কোন বৈধ উপায় নয়। মতামতের অধিকারী ব্যক্তিদের সম্মতি এবং পরামর্শক্রমে প্রতিষ্ঠিত খেলাফতই সত্যিকার খেলাফত। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে তিনি এ মত ব্যক্ত করেছেন, যখন এ মত মুখে উচ্চারণকারীর ঘাড়ে মস্তক থাকার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। আল-মনসুর-এর সেক্রেটারী রবী ইবনে ইউনুসের উক্তি তিনি ইমাম মালেক (র:) ইবনে আবি যে’ব এবং ইমাম আবু হানীফা (র:)-কে ডেকে বলেন : আল্লাহ তায়ালা এ উম্মাতের মধ্যে আমাকে এ রাজত্ব দান করেছেন, এ ব্যাপারে আপনাদের কি মত? আমি কি এর যোগ্য?’
ইমাম আবু হানীফার মতামত
ইমাম মালেক (র:) বলেন : ‘আপনি এর যোগ্য না হলে আল্লাহ তায়ালা তা আপনাকে সোপর্দ করতেন না’
ইবনে আবি যেব বলেন :
‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, দুনিয়ার রাজত্ব দান করেন। কিন্তু পরকালের রাজত্ব তিনি তাকে দান করেন, যে তা কামনা করে এবং এ জন্য আল্লাহ যাকে তাওফীক দেন। আপনি আল্লার আনুগত্য করলে আল্লার তাওফীক আপনার নিকটতর হবে। অন্যথায় তাঁর নাফরমানী করলে তাঁর তাওফীক আপনার থেকে দুরে সরে যাবে। আসল কথা এই যে, আল্লাভীরু ব্যক্তিদের সম্মতিক্রমে খেলাফত নিষ্পন্ন হয়। আর যে ব্যক্তি নিজে খেলাফত অধিকার করে, তার মধ্যে কোন তাকওয়া-আল্লাভীতি নেই। আপনি এবং আপনার সহায়করা তাওফীক থেকে দুরে এবং সত্যচ্যুত। এখন আপনি যদি আল্লার কাছে শান্তি কামনা করেন, পূত-পবিত্র কমধারা দ্বারা তাঁর নৈকট্য অর্জন করেন, তাহলে এ জিনিসটি আপনার ভাগ্যে জুটবে। অন্যথায় আপনি নিজেই নিজের শিকার হবেন’
ইমাম আবু হানীফা (র:) বলেন, ইবনে আবি যেব যখন এ কথা বলছিলেন, তখন আমি এবং মালেক (র:) নিজ নিজ কাপড় সংবরণ করে নিচ্ছিলাম যে, সম্ভবত তখনই তাঁর গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে। তাঁর রক্তের ছিটা আমাদের কাপড়ে পড়বে।
অত:পর মনসুর ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর দিকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করেন, আপনার কি মত? তিনি জবাবে বলেন :
‘দ্বীনের খাতিরে সত্য পথের সন্ধানী ব্যক্তি ক্রোধ থেকে দুরে থাকে। আপনি আপনার বিবেককে জিজ্ঞেস করলে নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন যে আপনি আমাদেরকে আল্লার খাতিরে ডাকেন নি; বরং আপনার অভিপ্রায় হচ্ছে, আমরা আপনার অভিপ্রায় অনুযায়ী কথা বলি। আর আমাদের উক্তি জনসন্মুখে আসুক। জনগণ জানুক, আমরা কি বলি। সত্য কথা এই যে, আপনি এমন পন্থায় খলীফা হয়েছেন যে, আপনার খেলাফতের ব্যাপারে মতামতের অধিকারী ব্যক্তিদের মধ্য হতে দুজন লোকের ঐক্যমতও স্থাপিত হয়নি। অথচ মুসলমানদের সর্বসম্মতি এবং পরামর্শক্রমেই খেলাফত সম্মত হয়। দেখুন, ইয়ামনের অধিবাসীদের বয়আত না আসা পর্যন্ত আবুবকর সিদ্দিক (র:) দীর্ঘ ছমাস যাবৎ সিদ্ধান্ত গ্রহন থেকে বিরত ছিলেন।‘
কথাগুলো বলে তিনজনই ওঠে পড়েন। পেছনে মনসুর রবীকে তিন থলি দেরহাম দিয়ে ব্যক্তিত্রয়ের নিকট প্রেরণ করেন। তাকে তিনি বলে দেন, মালেক তা গ্রহণ করলে তা তাকে দিয়ে দেবে। কিন্তু আবু হানীফা এবং ইবনে আবি যেব তা গ্রহণ করলে তাদের শিরচ্ছেদ করবে। ইমাম মালেক এ দান গ্রহণ করেন। ইবনে আবি যেব-এর নিকট গমন করলে তিনি বলেন, আমি স্বয়ং মনসুরের জন্যও তো এ অর্থকে হালাল মনে করি না, নিজের জন্য কি হালাল মনে করি। ইমাম আবু হানীফা (র:) বলেন, আমার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হলেও আমি এ অর্থ স্পর্শ করবো না। এ বিবরণী শোনে মনসুর বলে-এ নিস্পৃহতা তাদের দুজনের প্রাণ রক্ষা করেছে। [ আল-কারদানী : মানাকেবুল ইমামিল আযম, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১৫-১৬। আল-কারদারীর এ বর্ণনায় এমন একটি বিষয় উল্লেখ আছে যা আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে সক্ষম হইনি। তা এই যে, ইয়ামনবাসীদের বায়আত আসা পর্যন্ত হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা:) মাস যাবত ফায়সালা থেকে নিবৃত্ত ছিলেন।]
তিন : খেলাফতের যোগ্যতার শর্ত
ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর যুগ পর্যন্ত খেলাফতের যোগ্যতার শর্তাবলী ততটা সিবস্তারে বর্ণিত হয়নি, যতটা পরবর্তী কালের গবেষক আল-মাওয়ার্দী এবং ইবনে খালদুন ইত্যাকার লেখক-গবেষকরা বর্ণনা করেছেন। কারণ, এর অধিকাংশ শর্তই তখন প্রায় বিনা আলোচনায়ই স্বীকৃত-গৃহীত ছিল। যথা, মুসলমান হওয়া, পুরুষ হওয়া, স্বাধীন হওয়া ( দাস না হওয়া ), জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, সুষ্ঠু জ্ঞানের অধিকারী এবং দৈহিক ত্রুটিমুক্ত হওয়া ইত্যাদি। অবশ্য দুটি বিষয় তখন পর্যন্ত আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল এবং এ সম্পর্কে স্পষ্ট করে জানার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। এক : অত্যাচারী এবং দুরাচারী- পাপাচারী ব্যক্তি ( যালেম এবং ফাসেক) বৈধ খলীফা হতে পা কিনা ? দুই : খেলাফতের জন্য কোরায়শী হওয়া প্র্রয়োজন কিনা ?
যালেম ফাসেকের নেতৃত্ব
ফাসেকের নেতৃত্ব সম্পর্কে তার মতামতের দুটি দিক রয়েছে। যা ভালভাবে উপলব্ধি করা । আবশ্যক। তিনি যে সময়ে এ ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করেন, বিশেষ করে ইরাকে এবং সাধারণভাবে গোটা মুসলিম জাহানে তা ছিল দু’চরমপন্থী মতবাদের ভীষণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যুগ। এক দিকে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হচ্ছিল যে, যালেম ফাসেকের নেতৃত্ব একেবারেই না-যায়েয-সম্পূর্ণ অবৈধ। এ নেতৃত্বের অধীনে মুসলমানদের কোন সামাজিক কাজও নির্ভুল হতে পরে না। অপর দিকে আবার বলা হচ্ছিল যে, যালেম-ফাসেক যে কোনভাবেই রাষ্ট্রের ওপর জেকে বসুক না কেন, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নেতৃত্ব এবং খেলাফত সম্পূর্ণ বৈধ হয়ে যায়। এ দু’চরম মতবাদের মাঝামাঝি ইমাম আযম (র:) এক অতি ভারসাম্যপূর্ণ দর্শন উপস্থাপিত করেন। তাঁর এ দর্শনের বিস্তারিত বিবরণ এই :
আল-ফিকহুল আকবার-এ তিনি বলেন : ‘নেক-বদ যে কোন মুমিনের পেছনে সালাত জায়েয। [ মোল্লা আলী ক্বারী : ফিকহে আকবরের ভাষ্য, পৃষ্ঠা-৯১ ]
ইমাম তাহাভী আকীদা-ই-তাহাবীয়ায় এ হানাফী মতের ব্যাখ্যা করে লিখেন :
‘এবং হজ্জ ও জিহাদ মুসলিম উলিল আমর-এর অধীনে কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে-তা সে উলিল আমর নেক হোক, বা বদ-ভাল হোক, কি মন্দ। কেউ এ সব কাজ বাতিল করতে পারে না, পারে না তার সিলসিলা বন্ধ করতে। [ ইবনু আবিল ইয্ আল-হানাফী : শরহুত-তাহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৩২২। ]
এটা আলোচ্য বিষয়ের একটি দিক। অপর দিক হচ্ছে এই যে, তাঁর মতে খেলাফতের জন্য আদালাত অপরিহার্য শর্ত। কোন যালেম-ফাসেক ব্যক্তি বৈধ খলীফা, কাযী, শাসক বা মুফতী হতে পারে না। এমন ব্যক্তি কার্যত অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলমানরা তার অধীনে তাদের সামাজিক জীবন যেসব কাজ শরীয়াতের সঠিক বিধান অনুযায়ী আঞ্জাম দেবে, তা জায়েয-বৈধ হবে, তার নিয়োগকৃত কাযী-বিচারক ন্যায়ত যেসব ফায়সালা করবে, তা জারী হবে-এটা স্বতন্ত্র কথা। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আবুবকর আল-জাসসাস তাঁর ‘আহকামুল কুরআন ( কুরআনের বিধি-বিধান ) গ্রন্থে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেন :
‘সুতরাং কোন যালেম-অত্যাচারী ব্যক্তির নবী বা নবীর খলীফা হওয়া জায়েয নয়। বৈধ নয় তার কাযী বা এমন কোন পদাধিকারী হওয়া, যার ভিত্তিতে দ্বীনের ব্যাপারে তার কথা গ্রহণ করা মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে ; যেমন মুফতী, সাক্ষ্যদাতা বা নবী (স:)-এর তরফ থেকে হাদীস বর্ণনাকারী হওয়া ,,,,,,,,,[ ‘আমার অঙ্গীকার যালেমদের পৌছায় না’-(আল-বাকারা : ১২৪ ) ]-একথা প্রতিপন্ন করে যে, দ্বীনের ব্যাপারে যে লোকই নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব লাভ করে, তার সৎ এবং ন্যয়পরায়ণ হওয়া শর্ত।………এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিতযে, ফাসেক-পাপচারীর নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব বাতেল। সে খলীফা হতে পারে না। আর কোন ফাসেক ব্যক্তি যদি নিজেকে এ পদে প্রতিষ্ঠিত করে বসে, তা হলে জনগণের ওপর তার আনুগত্য অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়। এ কথাই নবী (স:) বলেছেন যে, স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই। এ আয়াত এ কথাও প্রতিপন্ন করে যে, কোন ফাসেক ব্যক্তি বিচারপতি ( জজ-ম্যাজিষ্ট্রেট ) হতে পারে না। সে বিচারক হলেও তার রায় জারী হতে পারে না। এমনি করে, তার সাক্ষ্য গ্রাহ্য হতে পারে না, পারে না নবী (স:) থেকে তার বর্ণনা গ্রহণ করাযেতে। সে মুফতী হলে তার ফতোয়া মানা যেতে পারে না। [ আবুবকর আল জাসসাস : আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৮০। ]
সামনে অগ্রসর হয়ে আল-জাসাস ষ্পষ্ট করে বলেন যে, এটাই ইমাম আবু হনীফা (র:)-এর মাযহাব। অত:পর তিনি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন যে, ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর ওপর এটা কত বড় যুলুম যে, তাঁর বিরুদ্ধে ফাসেকের ইমামত ও নেতৃত্ব বৈধ করার অভিযোগ উথ্থাপন করা হয় :
‘কেউ কেউ ধারনা করে নিয়েছে যে, ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর মতে ফাসেকের ইমামত-খেলাফত বৈধ। ………ইচ্ছা করে মিথ্যা না বলা হলে এটা এক ভ্রান্ত ধারণা। সম্ভবত এর কারণ এই যে, তিনি বলতেন, কেবল তিনিই নন, ইরাকের ফকীহদের মধ্যে যাদের উক্তি প্রসিদ্ধ, তাঁরা সকলেই এ কথা বলতেন যে, কাযী-বিচারপতি স্বয়ং ; ন্যয়পরায়ণ হলে-কোন যালেম তাকে নিযুক্ত করলেও-তার ফায়সালা সঠিকভাবে জারী হয়ে যাবে। আর তাদের ফিসক সত্ত্বেও এ সব ইমামের পেছনে সালাত জায়েয হবে। এ মতটি যথাস্থানে সম্পূর্ণ ঠিক। কিন্তু এ দ্বারা এ কথা প্রমাণ করা যায় না যে, আবু হানীফা (র:) ফাসেকের ইমামত-কর্তৃত্বকে জায়েয-বৈধ জ্ঞান করতেন। [ আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৮০-৮১। শামসুল আইম্যা সারাখসী ও আল-মাবসুত-এ ইমামের এ মত ব্যক্ত করেছেন। ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৩০। ]
ইমাম যাহাবী এবং আল-মুয়াফফাক আল-মাক্কী উভয়েই ইমাম আবু হানীফা (র:)-এর এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন:
‘যে ইমাম ফাই অর্থাৎ জনগণের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ-ব্যবহার করে, অথবা নির্দেশে অন্যায়ের আশ্রয় নেয়, তার ইমামত-কর্তৃত্ব বাতেল; তার নির্দেশ বৈধ নয়। [ আয-যাহাবী : মানাকেবুল ইমাম আবি হানীফা ওয়া সাহেবাইহে, পৃষ্ঠা-১৭। আল –মাক্কী : মানাকেবুল ইমামিল আযম আবি হানীফা, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১০০ ]
এ সব বিবৃতি গভীরভাবে অনুধাবন করলে এ কথা একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইমাম আবু হানীফা (র:) খারেজী এবং মুতাষিলাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে আইনত (Dejure) এবং কার্যত (defacto)-এর মধ্যে পার্থক্য করতেন। খারেজী এবং মুতাযিলাদের মতামত দ্বারা ন্যায়পরায়ণ এবং যোগ্য ইমামের অনুপস্থিতিতে মুসলিম সমাজ এবং মুসলিম রাষ্ট্রের গোটা ব্যবস্থাই অকেজো হয়ে পড়া অবধারিত ছিল। জজ-বিচারক থাকবে না, থাকবে না জুমা-জামায়াত, আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে না, মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-কো কাজই চলবে না বৈধভাবে। ইমাম আবু হানীফা (র:)-এ ভ্রান্তির অপনোদন করেছেন এভাবে যে, আইনানুগ ইমাম যদি সম্ভব না হয়, তবে যে ব্যক্তিই কার্যত মুসলমানদের ইমাম হবে, তার অধীনে মুসলমানদের গোটা সমাজ জীবনের পুরো ব্যবস্থাই বৈধভাবে চলতে থাকবে- সে ইমামের কর্তৃত্ব যথাস্থানে বৈধ না হলেও তা অব্যাহত থাকবে।
মুতাযিলা এবং খারেজীদের এ চরমপন্থার মুকাবিলায় মুর্জিয়া এবং স্বয়ং আহলুস সুন্নার কোন কোন ইমামও যে স্বতন্ত্র এক চরম পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, ইমাম আবু হানীফা (রঃ) মুসলমানদেরকে তা এবং তার পরিণতি থেকে রক্ষা করেছেন। তারাও কার্যত আর আইনতঃ এর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। ফাসেকের কার্যত কর্তৃত্বকে তারা এমনভাবে বৈধ প্রতিপন্ন করে যেন তাই আইনত-এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এ হতো যে, মুসলমানরা অত্যাচারী-অনাচারী এবং দুরাচারী শাসনকর্তাদের শাসনে নিশ্চুপ-নিশ্চিন্ত বসে পড়তো। তাকে পরিবর্তনের চেষ্টা তো দূরের কথা, তার চিন্তাও ত্যাগ করতো। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এ ভ্রান্ত ধারণা আপনোদনের নিমিত্ত সর্বশক্তি নিয়োজিত করে এ সত্য ঘোষণা করেন যে, এমন লোকদের ইমামত কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ বাতেল।
খেলাফতের জন্য কুরাইশী হওয়ার শর্ত
এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর অভিমত ছিল এই যে, খলীফাকে কুরাইশী হতে হবে। [আল-মাসউদী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৯২।] এটা কেবল তাঁরই নয়, বরং সমস্ত আহলুস সুন্নার সর্বসম্মত অভিমত। [আশ-শাহরিস্তানীঃ কিতাবুল মিলাল ওয়ান-নিহাল, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১০৬। আবদুল কাহের বাগদাদীঃ আল-ফারকো বাইনাল ফিরাকে, পৃষ্ঠা- ৩৪০।] এর কারণ কেবল এ ছিল না যে, শরীয়াতের দৃষ্টিতে ইসলামী খেলাফত কেবল একটি গোত্রের শাসনতান্ত্রিক অধিকার। বরং এর আসল কারণ ছিল সে সময়ের পরিস্থিতি, যে পরিস্থিতিতে মুসলমানদেরকে সংঘবদ্ধ রাখার জন্য খলীফার কুরাইশী হওয়া যরুরী ছিল। ইবনে খালদুন এ কথা অত্যন্ত স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন যে, তখন ইসলামী রাষ্ট্রের মূল রক্ষা কবচ ছিল আরব। আর আরবদের সর্বাধিক ঐক্য সম্ভব ছিল কুরাইশের খেলাফতের ওপর। অপর গোত্রের লোককে গ্রহণ করলে বিরোধ এবং অনৈক্যের সম্ভাবনা এতটা প্রকট ছিল যে, খেলাফত ব্যবস্থাকে এ আশংকার মুখে ঠেলে দেয়া সমীচীন ছিল না। [আল-মোকাদ্দমা, পৃষ্ঠা- ১৯৫-১৯৬।] এ কারণে নবী (সঃ) হেদায়াত দিয়েছিলেন যে, ইমাম হবে কুরাইশের মধ্য থেকে। [ইবনে হাজারঃ ফতহুল বারী, ১৩শ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৯৩, ৯৬ ও ৯৭। মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৯, ১৮৩, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪২১। আল-মাতবাআতুল মায়মানিয়্যা, মিসর, ১৩০৬ হিজরী। মুসনাদে আবুদাউদ আত-তায়ালেসী, হাদীস সংখ্যা ৯২৬, ২১৩৩। দায়েরাতুল মাআরেফ, হায়দরাবাদ, ১৩২১ হিজরী সংস্করণ।] অন্যথায় এ পদ অ-কুরাইশীর জন্য নিষিদ্ধ হলে ওফাতকালে খলীফা ওমর (রাঃ) বলতেন না যে, ‘হোযাইফার মুক্ত দাস সালেম জীবিত থাকলে আমি তাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করার প্রস্তাব করতাম।’ নবী (সঃ) নিজেও কুরাইশের মধ্যে খেলাফত রাখার হেদায়াত দিতে গিয়ে এ কথা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, যতদিন তাদের মধ্যে কতিপয় বিশেষ গুণাবলী বর্তমান থাকবে, ততদিন তাদের জন্য এ পদ। [ইবনে হাজারঃ ফতহুল বারী, ১৩শ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৯৫।] এ থেকে স্বতই প্রমাণিত হয় যে, এ সকল গুণাবলীর অবর্তমানে অ-কুরাইশীর জন্য খেলাফত হতে পারে। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এবং সকল আহলুস সুন্নার পথ এবং যে সকল খারেজী ও মুতাযিলার মতের মধ্যে এটাই হচ্ছে মুল পার্থক্য, যারা অ-কুরাইশীর জন্য অবাধ খেলাফতের বৈধতা প্রমাণ করে বরং এক কদম অগ্রসর হয়ে অ-কুরাইশীকে খেলাফতের অধিক হকদার প্রতিপন্ন করে। তাদের দৃষ্টিতে আসল গুরুত্ব ছিল গণতন্ত্রের, তার পরিণতি বিচ্ছেদ অনৈক্যই হোক না কেন। কিন্তু আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত গণতন্ত্রের সাথে রাষ্ট্রের স্থিতি সংহতির কথাও চিন্তা করতেন।
চারঃ বায়তুল মাল
সমকালীন খলীফাদের যে সকল ব্যাপারে ইমাম সাহেব সবচেয়ে বেশী আপত্তি করতেন, রাষ্ট্রীয় ধনভান্ডারে তাদের দেদার ব্যবহার এবং জনগণের সম্পদের ওপর হস্ত সম্প্রসারণ ছিল তার অন্যতম। তাঁর মতে নির্দেশ দানে অন্যায় এবং বায়তুল মালে খেয়ানত কোন ব্যক্তি নেতৃত্ব রহিত করার মতো গর্হিত কাজ। ইমাম যাহাবীর উদ্ধৃতি দিয়ে আমরা ইতিপূর্বে এ কথা উল্লেখ করেছি। বৈদেশিক রাষ্ট্র থেকে খলীফার নিকট যেসব উপহার উপটোকন আসতো, তাকেও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করাকেও তিনি জায়েয মনে করতেন না। তাঁর মতে এ সব হচ্ছে জনগণের ধনভান্ডারের হক, খলীফা এবং তার খান্দানের নয়। তাঁর মতে তারা মুসলমানদের খলীফা না হলে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি প্রচেষ্টার বদৌলতে খলীফার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হলে গৃহে বসে খলীফা এ সব উপহার উপটৌকন লাভ করতেন না। [আস-সারাখসীঃ শারহুস সিয়ারিল কাবীর, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৯৮।] তিনি বায়তুল মাল থেকে খলীফার যথেচ্ছ ব্যবহার এবং দান-দক্ষিণায়ও আপত্তি করতেন। যেসব কারণে তিনি খলীফাদের দান গ্রহণ করতেন না, এটাও ছিল তার অন্যতম প্রধান কারণ।
খলীফা মনসুরের সাথে যখন তাঁর ভীষণ দ্বন্দ্ব চলছিল, সে সময়ে একবার মনসুর তাঁকে প্রশ্ন করেনঃ আপনি আমার হাদিয়া গ্রহণ করেন না কেন? তিনি জবাব দেনঃ আমীরুল মুমিনীন নিজের অর্থ থেকে কখন আমাকে দান করেছেন যে, আমি তাঁর দান গ্রহণ করবো না। আপনি নিজের সম্পদ থেকে দান করলে আমি নিশ্চয়ই গ্রহণ করতাম। আপনি তো আমাকে দিয়েছেন মুসলমানদের বায়তুল মাল থেকে। অথচ তাদের সম্পদে আমার কোন অধিকার নেই। আমিতো তাদের প্রতিরোধের জন্য যুদ্ধ করি না যে, একজন সৈনিকের অংশ পাবো। আমি তো আর তাদের সন্তানাদি নই যে, সন্তানের অংশ গ্রহণ করবো, আমি তো আর ফকীর নই, যে ফকীরের প্রাপ্য হিস্যা পাবো। [আল-মাক্কী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২১৫।]
কাযীর পদ গ্রহণ না করায় মনসুর তাঁকে ৩০ ঘা বেত্রাঘাত করে। তাঁর দেহ রক্তাপ্লুত হয়ে যায়। এ সময় খলীফার চাচা আবদুস সামাদ ইবনে আলী তাঁকে কঠোর তিরস্কার করে বলেনঃ আপনি এ কি করেছেন? এক লক্ষ তরবারী আপনার জন্য ডেকে এনেছেন। ইনি ইরাকের ফকীহ। বরং গোটা প্রাচ্যের ফকীহ তিনি। মনসুর এতে লজ্জিত হয়ে প্রতি কোড়ার বিনিময়ে এক হাজার দেরহাম হিসেব করে ইমামের নিকট ৩০ হাজার দেরহাম প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁকে বলা হয়, গ্রহণ করে দান করে দিন। জবাবে তিনি বলেনঃ তার কাছে কোন হালাল সম্পদও কি আছে? [আল-মাক্কী, পৃষ্ঠা- ২১৫-২১৬।]
এর কাছাকাছি সময় উপর্যুপুরী নির্যাতন সইতে গিয়ে যখন তাঁর অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসে তখন তিনি ওসিয়াত করেন যে, বাগদাদ শহর পত্তনের জন্য মানসুর মানুষের যেসব এলাকা জবর দখল করে নিয়েছিল সে সব এলাকায় যেন তাঁকে দাফন করা না হয়। তাঁর এ ওসিয়াতের কথা শোনে মনসুর চিৎকার করে বলে ওঠেঃ ‘আবু হানীফা। জীবনে মরণে তোমার পাকড়াও থেকে কে আমাকে রক্ষা করবে।’
পাঁচঃ শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
বিচার বিভাগ সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট অভিমত ছিল এই যে, ন্যায়ের খাতিরে তাকে কেবল শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ এবং প্রভাব মুক্তই হতে হবে না; বরং বিচারককে এতটুকু ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে যে, স্বয়ং খলীফাও যদি জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, তিনি যেন তার ওপরও নির্দেশ জারী করতে পারেন। জীবনের শেস পর্যায়ে তিনি যখন নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন যে, সরকার আর তাঁকে বেঁচে থাকতে দেবে না, তখন তিনি তাঁর শাগরেদদের সমবেত করে এক ভাষণ দান করেন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া এ ভাষণে তিনি এ কথা ও বলেনঃ
‘খলীফা যদি এমন কোন অপরাধ করে যা মানুষের অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত, তখন মর্যাদায় তার নিকটতম কাযী (অর্থাৎ কাযীউল কোযাত- প্রধান বিচারপতি)-কে তার ওপর নির্দেশ জারী করতে হবে।’ [আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১০০।]
বনী-উমাইয়া এবং বনী-আব্বাসীয়দের শাসনামলে সরকারী পদ বিশেষত কাযীর পদ গ্রহণ না করার অন্যতম প্রধান কারণ এই ছিল যে, তিনি এদের রাজত্বে কাযীর এ মর্যাদা দেখতে পাননি। সেখানে খলীফার ওপর আইনের বিধান প্রয়োগের সুযোগ ছিল না, কেবল তাই নয়, বরং তাঁর আশংকা ছিল যে, তাঁকে অত্যাচারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তাঁর দ্বারা অন্যায় ফায়সালা জারী করান হবে জোর করে। আর তাঁর ফায়সালায় কেবল খলীফা-ই নয়, বরং খলীফা প্রাসাদের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য ব্যক্তিরাও হস্তক্ষেপ করবে।
বনী-উমাইয়াদের শাসনামলে সর্ব প্রথম ইরাকের গবর্ণর ইয়াযীদ ইবনে ওপর হোবায়রা তাঁকে সরকারী পদ গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এটা হিজরী ১৩০ সালের কথা। তখন ইরাকে উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিপর্যয়ের এমন এক ঘনঘটা দেখা দেয়, যা মাত্র দুবছরের মধ্যেই উমাইয়াদের সিংহাসন ওলট-পালট করে ফেলে। এ সময় বড় বড় ফকীহদের সঙ্গে নিয়ে তাদের প্রভাব দ্বারা কার্যোদ্ধার করতে চেয়েছিল ইবনে হোবায়রা। তাই তিনি ইবনে আবি লায়লা, দাউদ ইবনে আবিল হিন্দু, ইবনে শুবরোমা প্রমুখ ব্যক্তিকে ডেকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দান করেন। অতঃপর ইমাম আবু হানীফাকে ডেকে বলেন, আমার সীল মোহর আপনার হাতে সমর্পণ করছ্ আপনি সীল না দিলে কোন নির্দেশ জারী হবে না, আপনার অনুমোদন ব্যতীত ট্রেজারী থেকে কোন অর্থ বাইরে যাবে না। তিনি এ পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে তাকে আটক করা হয়। চাবুক মারার ভয় দেখান হয়। অন্যান্য ফকীহরা ইমাম সাহেবকে পরামর্শ দেন, নিজের প্রতি অনুগ্রহ করুন। আমরাও পদ গ্রহণে রাযী নই; কিন্তু বাধ্য হয়ে গ্রহণ করেছি। আপনিও গ্রহণ করুন। তিনি জবাবে বলেন, ‘সে কোন ব্যক্তির হত্যার নির্দেশ দেবে, আর আমি তা অনুমোদন করবো, এটা দুরের কথা, সে যদি আমাকে ওয়াসেতের মসজিদের দরজা গণনার নির্দেশ দেয়, আমি তা গ্রহণ করতেও প্রস্তুত নই। আল্লার কসম, এ দায়িত্বে আমি অংশ নেবো না।’ এ প্রসঙ্গে ইবনে হোবায়রা তাঁর সামনে অন্যান্য পদও পেশ করে, তিন্তিু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর তিনি তাকে কুফার কাযী নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কসম করে বলে যে, এবার আবু হানীফা অস্বীকার করলে তাঁকে চাবুক মারবো। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) ও কসম করে বলেন, দুনিয়ায় তার চাবুকের ঘা সহ্য করা আমার জন্য আখেরাতের শাস্তি ভোগ করার চেয়ে অনেক সহজ। আল্লার কসম, সে আমায় হত্যা করলেও আমি তা গ্রহণ করবো না। শেষ পর্যন্ত সে তাঁর মাথায় ২০ বা ৩০ চাবুক মারে। কোন কোন বর্ণনানুযায়ী দশ-এগার দিন ধরে দৈনিক দশটি করে চাবুক মারা হয়। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতিতে অটল। শেষ পর্যন্ত তাকে জানান হয় যে, লেকাটি মারাই যাবে। তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে অবকাশ চেয়ে নেয়ার জন্য তাঁকে পরামর্শ দেয়ার মতও কি কেউ নেই? ইবনে হোবায়রারা এ উক্তি ইমাম আবু হানীফাকে জানান হলে তিনি বলেন, বন্ধুদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়ার জন্য আমাকে মুক্তি দাও। এ কথা শোনেই ইবনে হোবায়রা তাঁকে ছেড়ে দেয়। তিনি কুফা ছেড়ে মক্কা চলে যান। বনী-উমাইয়াদের সাম্রাজ্যের পতনের পূর্বে সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। [আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২১, ২৪। ইবনে খাল্লেকান, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪১। ইবনুল আবদিল বার আল-ইন্তেকা, পৃষ্ঠা- ১৭১।]
এরপর আব্বাসীয়দের শাসনকালে আল-মনসুর কাযীর পদ গ্রহন করার জন্য পীড়া-পীড়ি করতে শুরু করে তাঁর সাথে। এ বিষয় সম্পর্কে আমরা পরে উল্লেখ করবো। মনসুরের বিরুদ্ধে নফসে যাকিয়্যা এবং তাঁর ভাই ইবরাহীমের বিদ্রোহে ইমাম সাহেব প্রকাশ্যে তাদের সহযোগিতা করেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে মনসুরের হৃদয়ে তিক্ততা স্থান লাভ করেছিল। ঐতিহাসিক আয-যাহাবীর ভাষায়, মনসুর তাঁর বিরুদ্ধে ক্রোধে বিনা আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছিল। [মানাকিবুল ইমাম, পৃষ্ঠা- ৩০।] কিন্তু তাঁর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তি ওপর হস্তক্ষেপ করা মনসুরের জন্য সহজ ছিল না। এক ইমাম হুসাইন (রাঃ)- এর হত্যা বনী-উমাইয়াদের বিরুদ্দে মুসলমানদের মধ্যে কতটা ঘৃণার সঞ্চার করেছিল এবং এর ফলে শেষ পর্যন্ত কতো সহজে তাদের ক্ষমতার মূলোৎপাটন হয়েছিল, সে কথা মনসুরের জানা ছিল। তাই, মনসুর তাঁকে না মেরে বরং স্বর্ণের যিঞ্জীরে আবদ্ধ রেখে নিজের উদ্দেশ্যের জন্য ব্যবহার করাকে শ্রেয়মনে করে। এ উদ্দেশ্যেই মনসুর তাঁর সামনে বারবার কাযীর পদ পেশ করেছে, এমনকি তাঁকে গোটা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের কাযী উল-কোযাত-প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন টাল-বাহানা করে তা এড়িয়ে যান। [আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭২, ১৭৩, ১৭৮।] শেষ পর্যন্ত মনসুর আরও বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করলে ইমাম সাহেব তাকে উক্ত পদ গ্রহণ না করার কারণ জানিয়ে দেন। একদা আলোচনা প্রসঙ্গে একান্ত নরম সুরে অক্ষমতা প্রকাশ করে বলেনঃ আপনার, আপনার শাহজাদা এবং সিপাহশালারদের ওপর আইন জারী করার মতো সাহস যার নাই, সে ব্যক্তি এ পদের জন্য যোগ্য হতে পারে না। এমন সাহস আমার নেই। আপনি যখন আমাকে ডাকেন তখন ফিরে এসেই তো আমার প্রাণ বেরুবার উপক্রম। [আল-মাক্কী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২১৫।] আর একবার কড়া কথাবার্তা বলে। এতে তিনি খলীফাকে সম্বোধন করে বলেনঃ আল্লার কসম, সন্তুষ্ট হয়ে আমি এ পদ গ্রহণ করলেও আপনার আস্থাভাজন হতে পারবো না। সুতরাং অসুন্তুষ্ট হয়ে দায়ে পড়ে এ পদ গ্রহণ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। কোন ব্যাপারে যদি আমার ফায়সালা আপনার বিরুদ্ধে যায়, আর আপনি আমাকে ধমক দিয়ে বলেন যে, তোমার ফায়সালা পরিবর্তন না করলে আমি তোমাকে ফোরাত নদীতে ডুবিয়ে মারবো, তখন আমি নদীতে ডুবে মরা কবুল করবো কিন্তু ফায়সালা পরিবর্তন করবো না। এ ছাড়াও আপনার তো অনেক সভাসদ রয়েছে। তাদের এমন একজন বিচারক দরকার, যিনি আপনার খাতিরে তাদের কথাও বিবেচনা করবেন। [আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭০। আল-খতীব, ১৩শ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩২০।] এ সব কথা শুনে মনসুর যখন নিশ্চিত হলো যে, এ লোকটিকে সোনার পিঞ্জীরায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়, তখন সে প্রকাশ্য প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য অগ্রসর হয়। তাঁকে চাবুক মারা হয়, কারাগারে নিক্ষেপ করে খাওয়া-দাওয়ার ভীষণ কষ্ট দেয়, একটি গৃহে নযর বন্দী করে রাখে, কারো মতে স্বাভাবিক মৃত্যৃ, কারো মতে বিষ প্রয়োগে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। [আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭৩, ১৭৪, ১৮২। ইবনে খাল্লেকান, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৬। আল-ইয়াফেরয়ী, মিরাআতুল জানান, পৃষ্ঠা- ৩১০।]
ছয়ঃ মত প্রকাশের অধিকার
তাঁর মতে, মুসলিম সমাজ তথা ইসলামী রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সাথে মত প্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্বও ছিল বিরাট। কুরআন এবং সুন্নায় এ জন্য ন্যায়ের নির্দেশ এবং অন্যায়ের নিষেধ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। নিছক মত প্রকাশ একান্ত অন্যায়ও হতে পারে, হতে পারে বিপর্যয়াত্মক, নীতি-নৈতিকতা এবং মানবতা বিরোধী, যা কোন আইন-বরদাস্ত করতে পারে না। কিন্তু অন্যায় কার্য থেকে নিবৃত্ত করা এবং ন্যায়ের নির্দেশ দেয়া সত্যিকার অর্থেই মত প্রকাশ। ইসলাম এ পরিভাষা গ্রহণ করে মত প্রকাশের সকল খাতের মধ্যে কেবল এটিকে বিশেষ করে জনগণের অধিকারই প্রতিপন্ন করেনি, বরং এটাকে জনগণের কর্তব্য বলেও চিহ্নিত করেছে। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এ অধিকার এবং কর্তব্যের গুরুত্ব গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। কারণ তদানীন্তন শাসন ব্যবস্থায় মুসলমানদের এ অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। এর ফরয হওয়া সম্পর্কেও মানুষের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। একদিকে তখন মুর্জিয়ারা তাদের আকীদা-বিশ্বাসের প্রচার দ্বারা জনগণকে পাপ কাজে উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রানিত করছিল, অপর দিকে ‘হাশবিয়া’ নামে আর একটি ফেরকা মনে করতো যে, সরকারের বিরুদ্ধে ন্যায়ের নির্দেশ এবং অন্যায়ের নিষেধ আর একটি ফেতনা। এ ছাড়া বনী-উমাইয়া এবং বনী-আব্বাসীয়দের সরকার শাসক শ্রেণীর ফিসক-ফুজুর এবং অত্যাচার-অনুচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মুসলমানদের প্রাণ শক্তিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন, চেষ্টা করেন এর সীমা চিহ্নিত করতে। আল-জাসসাস-এর বর্ণনা মতে, ইবরাহীম আস-সায়েগ (খোরাসানের প্রসিদ্ধ এবং প্রভাবশালী ফকীহ)-এর এক প্রশ্নের জবাবে ইমাম সাহেব বলেনঃ আমর বিল মারুফ ও নাহই আনিল মুনকার ফরয। ইকরামা হতে ইবনে আব্বাসের সনদে তাঁকে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর হাদীসটিও স্মরণ করিয়ে দেনঃ হযরত হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব শহীদদের মধ্যে সকলের চেয়ে উত্তম। অতঃপর সে ব্যক্তি উত্তম যে যালেম শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বরে, অন্যায় কার্য থেকে তাকে নিবৃত্ত করে এবং এ অপরাধে প্রাণ হারায়। ইবরাহীমের ওপর তাঁর এ দীক্ষার এতটা বিরাট প্রভাব পড়েছিল যে, তিনি খোরাসান প্রত্যাবর্তন করে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবু মুসলিম খোরাসানীকে (মৃত্যুঃ ১৩৬ হিজরী-৭৫৪ ঈসায়ী) তার যুলুম-নির্যাতন এবং নির্বিচারে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আপত্তি জানান। বারবার বাধা দান করেন। শেষ পর্যন্ত আবু মুসলিম তাঁকে হত্যা করে। [আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮১।]
নাফসে যাকিয়্যার ভাই ইবরাহীম ইবনে আবদুল্লাহ (১৪৫ হিজরী-৭৬৩ ঈসায়ী) এর বিদ্রোহকালে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর কর্মপদ্ধতি ছিল এই যে, তিনি প্রকাশ্যে তাঁর প্রতি সমর্থন জানাতেন, আর আল-মনসুরের বিরোধীতা করতেন। অথচ আল-মনসুর তখন কুফায় অবস্থান করতো। ইবরাহীমের সেনাবাহিনী বসরার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, শহরে সারা রাত কারফিউ থাকতো। তাঁর প্রসিদ্ধ শাগরিদ যুফর ইবনুল হোযাইল এর বর্ণনাঃ এ নাজুক সময়ে ইমাম আবু হানীফা (রঃ) অত্যন্ত জোরে শোরে প্রকাশ্যে তাঁর মতামত ব্যক্ত করতেন। এমনকি এক দিন আমি তাঁকে বললাম আমাদের সকলের গলায় রজ্জু আঁটকে না যাওয়া পর্যন্ত আপনি নিবৃত্ত হবেন না। [আল-খাতিব, ১৩শ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৩০। আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭১।]
হিজরী ১৪৮ সাল তথা ৭৬৫ ঈসায়ীতে মুছেল-এর অধিবাসীরা বিদ্রোহ করে। এর আগের এক বিদ্রোহের পর মানসুর তাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি গ্রহণ করে যে, আগামীতে তারা পুনরায় বিদ্রোহ করলে তাদের জান-মাল তার জন্য হালাল হবে। তারা পুনরায় বিদ্রোহ করলে মনসুর বড় বড় ফকীহদেরকে-তাঁদের মধ্যে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-ও ছিলেন-ডেকে জিজ্ঞেস করেনঃ চুক্তি অনুযায়ী তাদের জান-মাল আমার জন্য হালাল হবে কিনা? অন্যান্য ফকীহরা চুক্তির আম্রয় নিয়ে বলেন, আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলে তা আপনার মর্যদার যোগ্য, অন্যথায় যে শাস্তি খুশী, আপনি তাদেরকে দিতে পারেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (রঃ) চুপ। মনসুর জিজ্ঞেস করেনঃ আপনার কি মত? তিনি জবাব দেনঃ মুছেল-এর অধিবাসীরা আপনার জন্য এমন বস্তু বৈধ করেছিল যা তাদের নিজের নয় (অর্থাৎ তাদের রক্ত)। আর আপনি তাদের দ্বারা এমন এক শর্ত মানিয়ে নিয়েছেন, যার অধিকার আপনার ছিল না। বলুন, কোন স্ত্রী যদি বিবাহ ছাড়াই নিজেকে কারো জন্য হালাল করে দেয়, তাহলে কি তা হলাল হবে? কোন ব্যক্তি যদি কাউকে বলে, আমায় হত্যা করো, তবে কি তাকে হত্যা করা সে ব্যক্তির জন্য বৈধ হবে? মনসুর জবাব দেয়ঃ না। ইমাম সাহেব বলেনঃ তা হলে আপনি মুছেলবাসীদের ওপর থেকে হস্ত সংকুচিত করুন। তাদেরকে হত্যা করা আপনার জন্য হালাল নয়। তাঁর এ জবাব শুনে মনসুর অসন্তুষ্ট হয়ে ফকীহদের মজলিস ভেঙ্গে দেয়। অতঃপর আবু হানীফা (রঃ)-কে একান্তে ডেকে বলেঃ আপনি যা বলেছেন, তা-ই ঠিক। কিন্তু এমন কোন ফতোয়া দেবেন না, যাতে আপনার মহত্বে আচড় লাগে এবং বিদ্রোহীদের উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। [ ইবনুল আসীর, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৫। আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৭। আল-সারাখসীঃ কিতাবুল মাবসুত, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৯।]
আদালতের বিরুদ্ধেও তিনি স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতেন। কোন আদালত ভুল ফায়সালা দান করলে তিনি আইন বা বিধির যে কোন ভুল স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতেন। তাঁর মতে, আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অর্থ এই যে, আদালতকে ভুল ফায়সালা করতে দেয়া হবে। এ অপরাধে একবার তাঁকে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ফায়সালা দান থেকে বিরত রাখা হয়। [ আল-কারদারী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬০, ১৬৫, ১৬৬। ইবনে আবদুল বারঃ আল-ইস্তিকা, পৃষ্ঠা- ১২৫, ১৫৩। আল-খতীব, ১৩শ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৫১।]
মতামতের স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি এতটা অগ্রসর ছিলেন যে, বৈধ নেতৃত্ব এবং ন্যায়পরায়ণ সরকারের বিরুদ্ধেও কেউ যদি কোন কথা বলে, সমকালনি নেতাকে গালমন্দ দেয়, এমনকি তাকে হত্যার মত প্রকাশও করে, তাহলেও তাকে শাস্তি দান এবং আটক করাও তাঁর মতে বৈধ নয়; যতক্ষণ না সে সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে তিনি হযরত আলী (রাঃ)-এর একটি ঘটনাকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। ঘটনাটি এইঃ তাঁর শাসনকালে ৫ ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তারা কুফায় তাঁকে প্রকাশ্যে গালি দিচ্ছিল। তাদের এক ব্যক্তি বলছিল যে, আমি তাঁকে হত্যা করবো। হযরত আলী (রাঃ) তাদের মুক্তির নির্দেশ দেন। হযরত আলী (রাঃ)-কে বলা হয়, লোকটি তো আপনাকে হত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তিনি বলেনঃ এ ইচ্ছা প্রকাশ করার জন্য আমি কি তাকে হত্যা করবো? বলা হলোঃ এরা তো আপনাকে গালিও দিচ্ছিল। তিনি জবাব দেনঃ ইচ্ছা করলে তোমরাও তাকে গালি দিতে পারো। এমনিভাবে তিনি সরকার বিরোধীদের ব্যাপারে হযরত আলী (রাঃ)-এর সে ঘোষণাকেও প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, যা তিনি খারেজীদের সম্পর্কে ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি খারেজীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেনঃ আমি তোমাদেরকে মসজিদে আসা থেকে বারণ করব না, বিজিত সম্পদ থেকেও নিবৃত্ত করবো না; যতক্ষণ না তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র পন্থা অবলম্বন করো। [আস-সারাখসীঃ কিতাবুল মাবসুত, ১০ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৫।]
সাতঃ অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রসঙ্গ
মুসলমানদের নেতা যালেম-ফাসেক হলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (Revolt) করা যায় কিনা? -এটা ছিল সে সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। স্বয়ং আহলুস-সুন্নাহর মধ্যেও এ বিষয়ে মত দ্বৈততা ছিল। আহলুল হাদীস (হাদীস অনুসারীদের) এক বিরাট দলের মতে, কেবল মুখের দ্বারা এমন নেতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে, তুলে ধরতেহবে সত্য কথা; কিন্তু বিদ্রোহ করা যাবে না। নেতা অন্যায় খুন-খারাবী কররে, অন্যায়ভাবে জনগণের অধিকার হরণ করলে এমনকি স্পষ্ট ফিসক-পাপাচার করলেও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। [আল-আশআরীঃ মাকালাতুল ইসলামিয়্যান, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৫।]
পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর মত ছিল এই যে, যালেমের নেতৃত্ব কেবল বাতেলই নয়, বরং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করা যাবে। কেবল করা যাবে না, বরং করতে হবে। অবশ্য এ জন্য শর্ত এই যে, সফল স্বার্থক বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকতেহবে, যালেম-ফাসেকের পরিবর্তে সৎ-ন্যায়পরাণ ব্যক্তিকে ক্ষমতাসীন করতে হবে; বিদ্রোহের ফল কেবল প্রাণ হানি এবং শক্তি ক্ষয়হবে না। আবুবকর আল-জাসসাস তাঁর মতের ব্যাখ্যা করে লিখেছেনঃ
‘যালেম-অত্যাচারী নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে তাঁর মাযহাব প্রসিদ্ধ। এ কারণে আওযাঈ বলেছেন, আমরা আবু হানীফা (রঃ)-এর সকল কথা সহ্য করেছি, এমন কি তিনি তরবারীর সাথেও একমত হয়েছেন অর্থাৎ যালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমর্থক হয়েছেন। আর এটা ছিল আমাদের জন্য অসহ্য। আবু হানীফ (রঃ) বলতেন, আমর বিল মারুফ ও নাহই আনিল মুনকার প্রথমত মুখের দ্বারা ফরয। কিন্তু এ সোজা পথে কাজ না হলে তরবারী ধারণ করা ওয়াজেব। [আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮১।]
অন্যত্র আবদুল্লা ইবনুল মুবারকের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি স্বয়ং ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-একটি উক্তি উদ্ধৃত করেন। এটা সে সময়ের কথা, যখন প্রথম আব্বাসীয় খলীফার শাসনামলে আবু মুসলিম খোরাসানী যুলূম-নির্যাতনের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সে সময় খোরাসানের ফকীহ ইবরাহীম আস-সায়েগ ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আমার বিল মারুফ এবঙ নাহই আনিল মুনকার, বিষয়ে আলোচনা করেন। পরে ইমাম নিজে আবদুল্লা ইবনুল মুবারকের নিকট এ আলোচনার বিষয়ে উল্লেখ করে বলেনঃ
‘আমর বিল মারুফ ও নাহই আনিল মুনকার ফরয- এ বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে উপনীত হলে হঠাৎ ইবরাহীম বলেন, হস্ত সম্প্রসারিত করুন, আপনার বায়আত করি। তাঁর এ কথা শোনে আমার চোখের সামনে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। ইবনুল মুবারক বলেন, আমি আরয করলাম, এমন হোল কেন? তিনি জানালেন, তিনি আমাকে আল্লার একটি অধিকারের দিকে আহ্বান জানান আর আমি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করি। অবশেষে আমি তাকে বললাম, একা কোন ব্যক্তি এ জন্য দাঁড়ালে প্রাণ হারাবে। এ প্রাণ দান মানুষের কোন কাজে আসবে না। অবশ্য সে যদি একজন সৎ সাহায্যকারী ব্যক্তি লাভ করে, নেতৃত্বের জন্যও এমন একজন ব্যক্তি পাওয়া যায়, আল্লার দ্বীনের ব্যাপারে যে নির্ভরযোগ্য, তাহলে আর কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। এরপর ইবরাহীম যখনই আমার কাছে এসেছেন, এ কাজের জন্য আমাকে এমন চাপ দিয়েছেন, যেমন কোন মহাজন ঋণ আদায়ের জন্য করে থাকে। আমি তাকে বলতাম, এটা কোন একক ব্যক্তির কাজ নয়। নবীদেরও এ ক্ষমতা ছিল না, যতক্ষণ না এ জন্য আসমান থেকে নির্দেশ না আসে। এ দায়িত্ব পালন করতে পারে। কিন্তু এটা এমন এক কাজ যে, কোন ব্যক্তি এ জন্য দাঁড়ালে নিজের জ্ঞান হারাবে। আমার আশংকা হচ্ছে, সে ব্যক্তি আপন প্রাণ সংহারে সহায়তার অপরাধে অপরাধী হবে। সে ব্যক্তি প্রাণ হারালে এ বিপদ মাথা পেতে নিতে অন্যদের সাহসও লোপ পাবে। [আহকামুল কুরআন, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৯।]
বিদ্রোহের ব্যাপারে ইমামের নিজের কর্মধারা
ওপরের আলোচনা দ্বারা এ ব্যাপারে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট জানা যায়। কিন্তু তাঁর সমযে সংঘটিত বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীতে তিনি কি কর্মধারা অবলম্বন করেছেন, তা দেখার আগে তাঁর পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়।
যায়েদ ইবনে আলী বিদ্রোহ
প্রথম ঘটনা যায়েদ ইবনে আলীর। শীআ’দের যায়দিয়া ফেরকা নিজেদেরকে এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বরে দাবী করে। ইনি ছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)- এর পৌত্র এবং ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকের-এর ভাই। তিনি তাঁর সময়ের বিরাট আলেম, ফকীহ, আল্লাভীরু এবং সত্যাশ্রয়ী বুযুর্গ ব্যক্তি। স্বয়ং ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-ও তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করেছেন। ১২০ হিজরী তথা ৭৩৮ ঈসায়ীতে হিশাম ইবনে আবদুল মালেক খালেদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-কাসীরকে ইরাকের গভর্ণরের পদ হতে বরখাস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালালে এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দানের জন্য হযরত যায়েদকেও মদীনা থেকে কুফায়তলব করা হয়। দীর্ঘদিন পরে এ প্রথমবারের মতো হযরত আলী (রাঃ)-এর বংশের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি কুফা আগমন করেন। কুফা ছিল শীআদের কেন্দ্রস্থল। তাই তার আগমনে হঠাৎ আলভী আন্দোলনে প্রাণ স্পন্দন সঞ্চার হয়। বিপুল সংখ্যক লোক তাঁর পাশে জড়ো হতে থাকে। এমনিতে ইরাকের অধিবাসীরা বছরের পর বছর ধরে ধনী-উমাইয়াদের যুলুম-নির্যাতন সইতে সইতে অস্থির হয়ে ওঠেছিল। মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য দীর্ঘদিন থেকে তারা পথ খুঁজছিল। আলীর বংশের একজন সত্যাশ্রয়ী আলেম ফকীহকে পেয়ে তারা ধন্য হলো। নিজেদের জন্য গণীমাত মনে করলো। কুফার অধিবাসীরা তাঁকে নিশ্চয়তা দিয়ে জানায় যে, এক লক্ষ লোক আপনার সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত। ১৫ হাযার লোক বায়আত করে যথারীতি নিজেদের নামও রেজিষ্ট্রিভূক্ত করেছে। এ সময় ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলাকালে উমাইয়া গবর্ণরকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। সরকার অবহিত হয়ে পড়েছে দেখে যায়েদ ১২২ হিজরীর সফর মাসে (৭৪০ খৃস্টাব্দ) সময়ের পূর্বেই বিদ্রোহ করে বসেন। সংঘর্ষ দেখা দিলে কুফার শীআরা তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে। যুদ্ধের সময় কেবল ২১৮ ব্যক্তি তাঁর সাথে ছিল। যুদ্ধকালে একটি তীরবিদ্ধ হয়ে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন। [আত-তাবারী, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৮২, ৫০৫।]
এ বিদ্রোহে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)- এর সম্পূর্ণ সহানুভূতি তিনি লাভ করেন। তিনি যায়েদকে আর্থিক সাহায্য করেন, জনগণকে তাঁর সহযোগিতা করার দীক্ষা দেন। [আল-জাসসাস, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮১।] তিনি যায়েদের বিদ্রোহকে বদর যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর বহির্গমনের সাথে তুলনা করেন। [আল-মাক্কী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৬০।] এর অর্থ এই যে, তাঁর মতে তখন রাসুলুল্লাহ (সঃ)- এর সত্যের ওপর থাকা যেমন সন্দেহমুক্ত ছিল, ঠিক তেমনি যায়েদ ইবনে আলীর সত্যের ওপর থাকাও তেমনি সন্দেহমুক্ত। কিন্তু যায়েদের সহযোগিতা করার জন্য তাঁর কাছে যায়েদের পয়গাম পৌঁছলে তিনি বার্তাবাহককে জানান জনগণ তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করবে না, সত্য সত্যই তাঁর সহযোগিতা করবে জানলে আমি অবশ্যই তাঁর সাথে শরীক হয়ে জিহাদ করতাম। কারণ, তিনি সত্য-সঠিক ইমাম। কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে এরা তার দাদা সাইয়্যেদেনা হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর মতো তাঁর সাথেও বিশ্বাস ঘাতকতা করবে। অবশ্য অর্থ দ্বারা আমি নিশ্চয়ই তাঁর সাহায্য করবো। [আল-মাক্কী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৬০।] যালেম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ব্যাপারে তিনি যে নীতিগত মত ব্যক্ত করেছিলেন, তাঁর এ মত ছিল ঠিক তারই অনুরূপ। কুফার শীআদের ইতিহাস এবং তাদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে তিনি ওয়াকেফহাল ছিলেন। হযরত আলী (রাঃ)-এর সময় থেকে এরা ক্রামগত যে চরিত্র এবং কার্যের পরিচয় দিয়ে আসছিল, তার পূর্ণ ইতিহাস সকলের সামনে ছিল। কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে যথাসময় অবহিত করে ইবনে আব্বাসের পৌত্র দাউদ ইবনে আলীও বিদ্রোহ থেকে যায়েদকে বারণ করেন। [আত-তাবারী, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৮৭, ৪৯১।] ইমাম আবু হানীফা (রঃ)- এও জানতেন যে, এ আন্দোলন কেবল কুফায় চলছে। উমাইয়াদের গোটা সাম্রাজ্যের অপরাপর এলাকায় এর কোন চাপ নেই। অন্য কোন স্থানে এ আন্দোলনের এমন কোন সংগঠনও নেই সেখান থেকে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। আর কুফায়ও কেবল ছ’মাসের মধ্যে এ অপরিপক্ক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠেছে। তাই সকল বাহ্যিক লক্ষণ দেখে যায়েদের বিদ্রোহ দ্বারা কোন সফল বিপ্লব সাধিত হবে- এমন আশা তিনি করতে পারেননি। উপরন্ত তাঁর এ বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ না করার সম্ভবত এটাও অন্যতম কারণ ছিল যে, তখন পর্যন্ত তাঁর এতটা প্রভাবও হয়নি যে, তাঁর অংশ গ্রহণের ফলে আন্দোলনের দুর্বলতা কিছুটা দূরীভূত হতে পারে। ১২০ হিজরী পর্যন্ত ইরাকের আহলুর রায় মাদ্রাসার নেতৃত্ব ছিল হাম্মাদের হাতে। তখন পর্যন্ত আবু হানীফা (রঃ)- ছিলেন নিছক তাঁর একজন শিষ্য মাত্র। যায়েদের বিদ্রোহকালে তাঁর এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব গ্রহণের মাত্র দেড়-দুই বছর বা তার চেয়ে কিছু কম বেশী সময় অতিবাহিত হয়েছে। তখনও তিনি প্রাচ্যের ‘ফিকাহবিদ’-এর মর্যাদায় অভিষিক্ত হননি, লাভ করেননি এর প্রভাব এবং মর্যাদা।
নাফসে যাকিয়্যার বিদ্রোহ
দ্বিতীয় বিদ্রোহ ছিল মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লা (নাফসে যাকিয়্যা) এবং তাঁর ভাই ইবরাহীম ইবনে আবদুল্লার। ইনি ছিলেন ইমাম হাসান ইবনে আলীর বংশধর। ১৪৫ হিজরী তথা ৭৬২ -৬৩ সালের ঘটনা। তখন ইমাম আবু হানীফা (রঃ)- এর পুরো প্রভাব-প্রতাপ বিস্তার লাভ করেছে।
তাদের গোপন আন্দোলন বনী-ইমাইয়াদের শাসনকাল থেকেই চলে আসছে। এমনকি, এক সময় আল-মনসুরও ইমাইয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সঙ্গে অন্যান্যদের সাথে নাফসে যাকিয়্যার হাতে বায়আত গ্রহণ করে। [আত-তাবারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৫, ১৫৬।] আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর এরা আত্মগোপন করে। আর গোপনে গোপনে তাদের দাওয়াত বিস্তার লাভ করতে থাকে। খোরাসান, আলজাযিয়া, রায়, তাবারিস্তান, ইয়ামন এবং উত্তর আফ্রিকায় এদের প্রচারক ছড়িয়ে ছিল। নাফসে যাকিয়্যা হেজাযে তাঁর কেন্দ্র স্থাপন করেন। আর তাঁর ভাই ইবরাহীমের কেন্দ্র ছিল ইরাকের বসরায়। ঐতিহাসিক ইবনে আসীরের উক্তি অনুযায়ী কুফায়ও তাঁর সাহায্যে একশত তরবারী ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত ছিল। [আল-কামেল, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৮।]এঁদের গোপন আন্দোলন সম্পর্কে আল-মনসুর পূর্ব হতেই অবহিত ছিল এবং এদের ব্যাপারেই ছিল অত্যন্ত সন্ত্রস্ত। কারণ, আব্বাসীয় দাওয়াতের সমানে সমানে এদের দাওয়াতও চলছিল। আব্বাসীয় দাওয়াতের ফলে শেস পর্যন্ত আব্বাসীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এদের সংগঠন আব্বাসীয় সংগঠনের চেয়ে কম ছিল না মোটেই এ কারণে মনসুর কয়েক বছর যাবত এ আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে, তাকে প্রতিহত করার জন্য অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করে।
হিজরী ১৪৫ সালের রজব মাসে নাফসে যাকিয়্যা মদীনা থেকে কার্যত বিদ্রোহ শুরু করলে মনসুর অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে বাগদাদ শহরের নির্মাণ কার্য ছেড়ে দিয়ে কুফায় গমন করে। এ আন্দোলনের মূলোৎপাটন পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য টিকে থাকবে কিনা, সে নিশ্চিত ছিল না। মনসুর অনেক সময় উদভ্রান্ত হয়ে বলতোঃ আল্লার শপথ। কি করি কিছুই মাথায় ধরছে না, বসরা, কায়েস, আহওয়ায, ওয়াসেত, মাদায়েন, সাওয়াদ ইত্যাকার স্থান থেকে পতনের খবর আসছিল। চতুর্দিক থেকে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা ছিল। দীর্ঘ ২ মাস যাবৎ পোশাক পরিবর্তনের সুযোগ হয়নি তার, বিছানায় শোয়ার সুযোগ হয়নি, সারা রাত সালাতের মুসাল্লায় কাটিয়ে দিতো। [আত-তাবারী (৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৫ থেকে ১৬৩ পর্যন্ত এ আন্দোলনের বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। ওপরে আমরা তার সংক্ষিপ্তসার উল্লেখ করেছি।] কুফা থেকে পলায়ন করার জন্য সে প্রতিনিয়ত দ্রুদগামী সওয়ারী প্রস্তুত করে রেখেছিল। সৌভাগ্য তার সহায়ক না হলেএ আন্দোলন তার এবং আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ভিত ওলট-পালট করে ছাড়তো। [আল-ইয়াকেয়ী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৯৯।]
এ বিপ্লবকালে ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর কর্মধারা প্রথমোক্ত বিদ্রোহ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, সে বিদ্রোহের সময় মনসুর কুফায় অবস্থান করছিল, শহরে রাতের বেলা কারফিউ লেগেই থাকতো। তখন তিনি জোরে শোরে সে আন্দোলনের প্রকাশ্য সহযোগিতা করেন। এমনকি, তাঁর শাগরেদরা আশংকা বোধ করেন যে, আমাদের সবাইকে বেধে নিয়ে যাবে। তিনি জনগণকে ইবরাহীমের সহযোগিতার দীক্ষা দিতেন, তাঁর বায়আত করার জন্য উপদেশ দিতেন। [আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭২। আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮৪।] ইবরাহীমের সাথে বিদ্রোহে অংশ গ্রহণকে তিনি নফল হজ্জের চেয়ে ৫০ বা ৭০ গুণ বেশী পূন্যের কাজ বলে অবিহিত করতেন। [আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭১। আল-মাক্কী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮৩] আবু ইসহাক আল-ফাযারী নামক জনৈক ব্যক্তিকে তিনি এ কথাও বলেন যে, তোমার ভাই ইবরাহীমের সহযোগিতা করেছেন। তোমার কাফেরের বিরুদ্ধে জেহাদ করা থেকে তোমার ভাই-এর কাজ অনেক উত্তম। [আল-জাসসাসঃ আহকামুল কুরআন, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮১] আবুবকর আল-জাসসাস আল-মুয়াফফাক আল-মাক্কী, ফতাওয়া-ই-বাযযাযিয়ার রচয়িতা ইবনুল বাযযায আল- কারদারীর মতো উচু মর্তবার ফকীহরা ইমামের এ উক্তি উদ্বৃত করেছেন। এ সব উক্তির স্পষ্ট অর্ত এই যে, তাঁর মতে, মুসলিম সমাজকে আভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের গোলযোগ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা বাইরের কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করার চেয়ে অনেক গুণ অধিক মর্যাদার কাজ।
তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্ময়কর পদক্ষেপ ছিল এই যে, তিনি আল-মনসুরের একান্ত বিশ্বাসভাজন জেনারেল এবং প্রধান সেনাপতি হাসান ইবনে কাহতোবাকে নাফসে যাকিয়্যা এবং ইবরাহীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করেন। তাঁর পিতা কাহতোবা ছিলেন সে ব্যক্তি, যাঁর তরবারী আবু মুসলিম-এর দূরদর্শীতা এবং রাজনীতির সাথে মিশে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ভিত্তি পত্তন করেছে। তাঁর মৃত্যুর পর তদীয় পুত্রকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। সেনাপতিদের মধ্যে আল-মনসুর তাঁকেই সবচেয়ে বেশী বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তিনি কুফায় অবস্থান করে ইমাম আবু হানীফা (রাঃ) এর ভক্তে পরিণত হন। একবার তিনি ইমামকে বলেন, আমি এ পর্যন্ত যত পাপ করেছি (অর্থাৎ মনসুরেরচাকরী করতে গিয়ে আমার হাতে যেসব অন্যায়-অত্যাচার হয়েছে), তা সবই আপনার জানা আছে। এসব পাপ মোচনের কি কোন উপায় আছে? ইমাম সাহেব বলেনঃ “আল্লাহ যদি জানেন যে, তোমার কার্যের জন্য লজ্জিত অনুতপ্ত,ভবিষ্যতের কোন নিরপরাধ মুসলমানদেরকে হত্যার জন্য তোমাকে বলা হলে তাকে হত্যার করার পরিবর্তে নিজে হত্যা হতে যদি প্রস্তুত হও; অতীত কার্যাবলীর পুনরাবৃত্তি করবে না- আল্লার সঙ্গে এ মর্মে অঙ্গীকার করলে এটা হতো তোমার জন্য তাওবা।’ ইমাম সাহেবের এ উক্তি শোনে হাসান তাঁর সামনেই অঙ্গীকার করেন। এর কিছুকাল পরই নাফসে যাকিয়্যা এবং ইবরাহীমের বিদ্রোহের ঘটনা সংঘটিত হয়। মনসুর হাসানকে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তিনি এসে ইমামের নিকট তা জানান। তাওবা ঠিক থাকবে। অন্যথায় অতীতে যা করেছো, তার জন্যও আল্লার কাছে ধরা পড়বে আর এখন যা করবে, তার শাস্তিও পাবে।’ হাসান পুনরায় নতুন করে তাওবা করে ইমামকে বলেন, আমার প্রাণ নাশ করা হলেও আমি এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবো না। তাই তিনি মনসুর এর নিকট গিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেনঃ ‘আমীরুল মুমিনীন। আমি এ যুদ্ধে যাবো না। এ পর্যন্ত আমি আপনার আনুগত্যে যা কিছু করেছি তা আল্রার আনুগত্যে হলে আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট আর তা যদি আল্লার অবাধ্যতায় হয়ে থাকে তাহলে আমি আর পাপ করতে চাই না।’ মনসুর এতে ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়ে হাসানকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়। হাসানের ভাই হামীদ এগিয়ে এসে বললেনঃ ‘বছর খানেক থেকে তাকে ভিন্নরূপে দেখছি। সম্ভবত তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। আমি এ যুদ্ধে গমন করবো। পরে মনসুর তার বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিদের ডেকে জিজ্ঞেস করে, এ সকল ফকীয়দের মধ্যে হাসান কার নিকট গমন করতো? বলা হয়, অধিকন্তু আবু হানীফা (রাঃ)- এর নিকট তার যাতায়াত ছিল। [আল-কারদারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২২।]
সফল এবং সৎ বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকলে অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কেবল যায়েজ-বৈধই নয়, বরং ওয়াজেবও। ইমামের এ দর্শনের পুরোপুরি অনুকূলে ছিল তাঁর এ কর্মধারা। এ ব্যাপারে ইমাম মারেক (রঃ)-এর কর্মধারাও ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর পরিপন্থী ছিল না। নাফসে যাকিয়্যার বিদ্রোহকালে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ আমাদের ঘাড়ে তো মনসুরের বায়আত রয়েছে, এখন আমরা খেলাফতের অপর দাবীদারের সহযোগিতা করতে পারি কি ভাবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি ফতোয়া দিয়ে বলেনঃ আব্বাসীয়দের বায়াাত জোর-যবরদস্তীরায়াত আর জোর-যবরদস্তী বায়আত-কসম-তালাক-যাই হোক না কেন- তা বাতেল। [আব্বাসীয়দের নিয়ম ছিল, বায়আত গ্রহণ কালে তারা জনগণের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতেন-তারা এ বায়আতের বিরুদ্ধচারণ কররে তাদের স্ত্রী তালাক। তাই ইমাম বায়আতের সাথে কসম এবং জোরপূ্র্বক তালাকের কথা উল্লেখ করেছেন।] তাঁর এ ফতোয়ার ফলে অধিকাংশ লোক নাফসে যাকিয়্যার সহযোগি হয়ে পড়ে। পরে ইমাম মারেক (রঃ)-কে ফতোয়ার শস্তি ভোগ করতে হয়। মদীনার আব্বাসীয় শাসনকর্তা জাফর ইবনে সুলায়মান তাঁকে চাবুক মারেন, তার হস্তকে স্কন্ধ দেশের সাথে বেধে রাখা হয়। [আত-তাবারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৯০। ইবনে খাল্লেকুন, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৮৫। ইবনেকাসীরঃ আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১০ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮৪। ইবনে খাল্লেকান, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৯১।]
ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এ ক্ষেত্রে একক নন
বিদ্রোহের ব্যাপারে আহলুস সুন্নার মধ্যে ইমাম আবু হানীফা (রঃ) একা, এমন কথা মনে করা ঠিক হবে না। আসল কথা এই যে, হিজরী প্রথম শতকে শ্রেস্ঠতম ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মত তাই ছিল, ইমাম আবু হানীফা (রঃ) তাঁর কথা এবং কার্য দ্বারা যা প্রকাশ করেছেন। খেলাফতের বায়আত গ্রহণ করার পর হযরত আবু বকর (রাঃ) প্রথম যে ভাষণ দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
*******************
-যতক্ষণ আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের আনুগত্য করি, তোমরা আমার আনুগত্য করো। কিন্তু আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের নাফরমানী করলে তোমাদের ওপর আমার আনুগত্য যরুরী নয়। [ইবনে হিশাম, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩১১। আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ২৪৮।]
হযরত ওমর (রাঃ) বলেনঃ
*******************
– মুসলমানদের সাথে পরামর্শ না করে যে কারো বায়আত করে, সে এবং যার বায়আত করা হয়-সে ব্যক্তি নিজেকে এবং অপরকে প্রতারিত করে এবং নিজেকে হত্যার জন্য পেশ করে। [এটা বুখারী (কিতাবুল মুহারেবীন, বাবু রাজমিল হুবলা মিনায যিনা) এর বর্ণনার ভাষা। অপর এক বর্ণনায় হযরত ওমর (রাঃ)-এর এ শব্দও উক্তহয়েছে-পরামর্শ ব্যতিরেকে যাকে এমারাত দেয়া হয়, তা গ্রহণ করা তার জন্য হালাল নয়। – ফতহুলবারী, ১২শ খন্ড, পৃষ্ঠা- ১২৫। ইমাম আহমাদ হযরত ওমর (রাঃ)- এর এ উক্তিও উল্লেখ করেছেন যে, মুসলমানদের সাথে পরামর্শ না করে যে ব্যক্তি কোন আমীরের বায়আত করেছে, তার কোন বায়আত নেই। বায়আত নেই সেব্যক্তিরও যে তার হাতে বায়আত করেছে। -মুসনাদে আহমাদ, ১ম খন্ড, হাদীস সংখ্যা- ৩৯১।]
ইয়াযিদ প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে হযরত হুসাইন (রাঃ) যখন বিদ্রোহ করেন, তখন অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন। সাহাবীদেরকে দেখেছেন, এমন ফকীহদের তো প্রায় সকলেই বর্তমান ছিলেন। কিন্তু হযরত হুসাইন (রাঃ) একটা হারাম কাজ করতে যাচ্ছেন- কোন সাহাবী বা তাবেয়ীর এমন উক্তি আমাদের চোখে পড়েনি। যে সকল ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে বারণ করেছিলেন তাঁরা বারণ করেছিলেন এবলে যে, ইরাকবাসীদের বিশ্বাস নেই। আপনি সফল হতে পারবেন না, এ পদক্ষেপ দ্বারা কেবল নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করবেন। অন্য কথায়, এ ব্যাপারে তাঁদের সকলের মত তাই ছিল, পরে ইমাম আবু হানীফা (রঃ) যা ব্যক্ত করেছেন, অর্থাৎ অসৎ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মূলত কোন অবৈধ কাজ নয়। অবশ্য এ পদক্ষেপ গ্রহণ কার আগে দেখতে হবে যে, অসৎ নেতৃত্ব পরিবর্তন করে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব কি না। কুফাবাসীদের উপর্যুপুরী পত্রের ভিত্তিতে এ কথা মনে করেছিলেন যে, এত সহযোগী-সমর্থন তিনি লাভ করেছেন, যাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একটা সফল বিপ্লব করতে সক্ষম হবেন। তাই তিনি মদীনা থেকে রওনা করেন। পক্ষান্তরে যে সকল সাহাবা তাঁকে বারণ করেন, তাঁদের ধারণা ছিল কুফাবাসীরা তাঁর পিতা হযরত আলী (রাঃ) এবং ভ্রাতা হযরত হাসানের সাথে যেসব বে-ওয়াফী (বিশ্বাসঘাতকতা) করেছে, তাতে তাদের ওপর নির্ভর করা যায় না, তাই সে সকল সাহাবীদের সাথে ইমাম হুসাইন (রা:)-এর মতবিরোধ বৈধ এবং অবৈধের ব্যাপারে ছিল না, বরং মতভেদ ছিল কৌশল অবলম্বনের ব্যাপারে।
তেমনি হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের নির্যাতনমূলক শাসনামলে আবদুর রহমান ইবনে আশআস বনী উমাইয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তৎকালীন সেরা ফকীহ-সাঈদ-ইবনে জুবাইর, আশ-শা’বী ইবনে আবী লায়লা এবং আল-বুহতারী তাঁর পাশে দাঁড়ান। ইবনে কাসীসের বর্ণনা মতে আলেম-ফকীহদের এক বিরাট রেজিমেন্ট তাঁর সাথে ছিল। যেসব আলেম তাকেঁ সমর্থন জানাননি, তাদেঁর কেউই এ কথা বলেননি যে, এ বিদ্রোহ অবৈধ। এ উপলক্ষে ইবনে আশআস-এর বাহিনীর সম্মুখে এ সকল ফকীহরা যে ভাষণ দান করেছেন, তা তাঁর চিন্তাধারার পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করে। ইবনে আবি লায়লা বলেন:
‘ইমানদারগণ! যে ব্যক্তি দেখে যে যুলুম-নির্যাতন চলছে, অন্যায়ের প্রতি আহ্বান জনান হচ্ছে, সে যদি অন্তরে তাকে খারাপ জানে, তাহলে সে রেহাই পেয়েছে, মক্তি লাভ করেছে। মুখে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলে প্রতিদান লাভ করেছে এবং প্রথমোক্ত ব্যক্তি থেকে উৎকৃষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লার কালেমা বুলুন্দ করা এবং যলেমদের দাবী পদানত করার নিমিত্ত এ সব লোকের সাথে তরবরী দ্বারা বিরোধিতা করে সে লোকই হারামকে হালাল করেছে, উম্মাতের মধ্যে খারাপ পথ উন্মুক্ত করেছে, যারা সত্যচ্যুত, সত্যের পরিচয় যারা রাখে না, যারা অন্যায় মতে কাজ করে, অন্যায়কে যারা অন্যায় বলে স্বীকার করে না, তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো।’
আশ-শাবী বলেনঃ
‘ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। তোমরা এ কথা মনে করো না যে, ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করা খারাপ কাজ। আল্লার কসম। আমার জানা মতে আজ দুনিয়ার বুকে তাদের চেয়ে বড় কোন যালেম- অত্যাচারী এবং অন্যয় ফায়সালাকারী আর কেউ নেই। নেই এমন কোন দল। সুতরাঙ ওদের বিরুদ্ধে লড়াই-এ যেন কোন প্রকার শৈথিল্য প্রশ্রয় না পায়।’
সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেনঃ
‘ওদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো। কারণ, শাসন কার্যে তারা যালেম। দ্বীনের কার্যে তারা ঔধ্যত্বপরায়ণ। তারা দুর্বলকে হেয় প্রতিপন্ন করে। সালাতকে বরবাদ করে। [আত-তাবারী, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬৩।]
পক্ষান্তরে যেসব বুযুর্গ হাজ্জাজের বিরুদ্ধে লড়াই-এ ইবনে আশআস-এর সহযোগিতা করেনি, তারাও এ কথা বলেননি যে, এ লড়াই হারাম। বরং বক্তব্য ছিল এই যে, এটা করা কৌশলের পরিপন্থী। এ ব্যাপারে হযরত হাসান বসরীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ
‘আল্লার শপথ। আল্লাহ হাজ্জাজকে তোমাদের ওপর শুধু শুধু চাপিয়ে দেননি। বরং হাজ্জাজ একটি শাস্তি বিশেস। সুতরাং তরবারী দ্বারা আল্লার এ শাস্তি মুকাবিল করো না। বরং ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে নিরবে তা সহ্য করে যাও। আল্লার দরবারে কান্নাকাটি করে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। [তাবাকাতে ইবনে সাআদ ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬৪। আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৩৫।]
এ ছিল হিজরী প্রথম শতকের দ্বীনদারদের অভিমত। এ শতকেই ইমাম আবু হানীফা (রঃ) চক্ষু উম্মীলিত করেন। তাই, তাঁর অভিমতও ছিল তাই, যা ছিল তাদের অভিমত। এরপর হিজরী দ্বিতীয় শতকে সে অভিমত প্রকাশ পেতে থাকে, অধুনা যাকে জমহুর আহলুস সুন্নাহর অভিমত বলা হয়। এ অভিমত প্রকাশের কারণ এই ছিল না যে, এর স্বপক্ষে এমন কিছু অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা প্রথম শতকের মনীষীদের নিকট উহ্য ছিল; বা আল্লাহ না করুক, প্রথম শতকের মনীষীরা কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট প্রমাণের বিরুদ্ধে মত গ্রহণ করেছিলেন। বরং মূলত এর দুটি কারণ ছিল। একঃ শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিবর্তনের কোন পথই উন্মুক্ত রাখেনি যালেমরা। দুইঃ তরবারীর জোরে পরিবর্তনের যে সকল চেষ্টা হয়েছে, নিরবচ্ছিন্নভাবে তার এমন সব পরিণতি প্রকাশ পেতে থাকে, যা দেখে সে পথেও কল্যাণের কোন আশা অবশিষ্ট ছিল না। [এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য তাফহীমাত, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩০০ থেকে ৩২০ এবং তাফহীমুল কুরআন সূরা হুজুরাতের তাফসীর, ১৭ নং টীকা দ্রষ্টব্য। ]