কুরআন অধ্যয়ন সহায়িকা
খুররম জাহ মুরাদ
অনুবাদকের কথা
Way to the Quran বইটি লিখেছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব খুররম মুরাদ। আধুনিক বিশ্বে যে ক’জন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ যুগোপযোগী চিন্তার জন্য প্রাচ্যও পাশ্চাত্যের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন এবং আধুনিক যুব মানসে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন,তাঁদের মধ্যে খুররম মুরাদের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য লিখিত তাঁর বই “ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক” যেকোন পাঠকের হৃদয় না স্পর্শ করে পারেনা। এছাড়াও অনেক সৃষ্টিশীল রচনা রয়েছে তাঁর। পেশাগত দিক থেকে একজন খ্যাতিমান প্রকৌশলী ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও অধ্যয়ন ও অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি ইসলাম সম্পর্কে যে গভীর জ্ঞান ও পান্ডিত্যের অধিকারী হয়েছেন তা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র-যুবকদের জন্য অনুসরণ যোগ্য। তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভাষার সৌন্দর্য,মাধুর্য ও হৃদয় গ্রাহিতা। মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করা,আলোড়িত করা ও উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে তাঁর লেখনী সত্যিই অসাধারণ।
Way to the Quran বইটি যখন আমার হাতে আসে তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমি বইটি দ্রুত পড়ে ফেলি। ইংরেজীতে লেখা তাঁর বইটি প্রথম পাঠেই আমাকে অভিভূত করে। আমার বিশ্বাস জন্মেযে,তাঁর এই হৃদয় স্পর্শীর চনাটি বাংলা ভাষায় পাঠকদের জন্য পবিত্র কুরাআন মজীদ পড়া ও হৃদয়ঙ্গম করার জন্য খুবই সহায়ক হবে। বইটি আমাকে পড়তে দিয়ে অ গ্রজপ্রতীম জনাব মীর কাসিম আলীও অনুরূপ কথাই বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,”এই বইটির বাংলা তরজমা হওয়া জরুরী। এথেকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যাপক তরুণ ছাত্র সমাজ লাভবান হতে পারবে।” বইটি দ্বিতীয় বার পড়ার পর সাহস করে বাংলা তরজমায় হাত দিই। আমার মত অতিসাধারণ একজন কর্মী যার ইংরেজী বা বাংলা ভাষার উপর কোন দখল নেই,উপরন্তু আরবী ভাষা থেকে পবিত্র কুরআন মজীদ বুঝার কোন যোগ্যতা নেই,তারপক্ষে এধরনের একটি অতি মূল্যবান বইয়ের তরজমায় হাত দেয়া ঠিক হবে কি হবেনা এ নিয়েও দ্বন্দে ভুগেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বইটির ব্যাপারে আমার ব্যাক্তিগত আগ্রহ এবং অনুরাগের কারণেই অনুবাদ সম্পন্ন করি।
আমি গভীর ভাবে বিশ্বাস করি,পবিত্র কুরআন থেকে শিক্ষা লাভ করে হৃদয়কে আলোকিত করা এবং কুরআনের মহান শিক্ষা অনুধাবন ও অনুশীলন করার ক্ষেত্রে এই বইটি বিরাট অবদান রাখতে পারে। কুরআন বুঝার জন্য,ইসলামের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য আরবী ভাষায় সুপন্ডিত হতেই হবে-এমন ধারণা যদি বদ্ধমূল হয়ে যায়, তাহলে ভয়ে কেউ কুরআনের তরজমা, তাফসীর থেকে শিক্ষা লাভে অগ্রসর হতে পারবেনা। কিন্তু এই বইটির লেখক তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে পদ্ধতিতে কুরআন অধ্যয়নের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন এবং কুরআন থেকে ফায়দা লাভের পরামর্শ দিয়েছেন, তা অনুসরণ করা হলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস কুরআনকে জানাও বুঝা অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, পবিত্র কুরআন মজীদ বুঝা ছাড়া ইসলাম কে জানা সম্ভব নয়। আর মানব জাতির হিফাযত ও পরকালীন মুক্তির জন্য ইসলাম ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সুতরাং কুরআন বুঝা ও জানার ব্যাপারে আমাদের অনুসন্ধিৎসা থাকতেই হবে। আর বিশেষ করে ভাষা গত অসুবিধার জন্য মূল উৎস থেকে আমরা যারা কুরআনকে সরাসরি বুঝতে পারিনা, তাদের তরজমা ও তাফসীর থেকেই বুঝার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের এ প্রয়াসে Way to the Quranএকটি বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। একারণেই সব কিছু বিবেচনা করে আমি বইটির বাংলা নাম দিয়েছি ‘কুরআন অধ্যয়ন সহায়িকা’।
বইটি পাঠ করে বাংলা ভাষা ভাষী পাঠক যদি সামান্যতমও উপকৃত হন, তাহলে আমার শ্রম সার্থক হবে বলে মনে করি। অসতর্কতা বশত বইটির অনুবাদে ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া ছাপার ভুলও খুব স্বাভাবিক। ইন্শা আল্লাহ আমরা চেষ্টা করবো পরবর্তী সংস্করণে বইটি আরও উন্নত ও নির্ভুল করতে। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টা কবুল করুন। যারা আমার এই ক্ষুদ্র অনুবাদ বইটি প্রকাশে নানা ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন আল্লাহ তাদের পুরস্কৃত করুন। আমার স্ত্রী নুরুন্নাহারের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ না করে পারছিনা। তার সহযোগিতা না হলে ব্যস্ততার মাঝে এ বইয়ের অনুবাদ সম্পন্ন করা সম্ভব হতোনা। সবশেষে আমি মহান আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি, যাঁর মেহেরবানীতে বইটির তরজমা করা সম্ভব হইয়েছে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।
মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান
তাং ৫/৫/৯১
৪২৩,এলিফ্যান্টরোড,বড় মগবাজার,ঢাকা।
ভূমিকা
আমার মত একজন ঈমানে ও আনুগত্যে দুর্বল অজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রথমেই এই ধরনের একটি বই লেখার চরম অযোগ্যতা স্বীকার করে নেয়া কর্তব্য মনে করি। কেননা মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন-“আমরা যদি এই কুরআনকে কোন পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতাম,তাহলে তোমরা দেখতে পেতে আল্লাহ্র ভয়ে পর্বত ধসে পড়তো এবং খন্ড-বিখন্ড ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতো।” (সূরা হাশর,আয়াত-২১)
একজন মানুষ যার রয়েছে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং আত্মার পবিত্রতার অভাব, তিনি কি করে মহান গ্রন্থ আল-কুরআনের মাহাত্ম্য, করুণা, সৌন্দর্য ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে দিক-নির্দেশের দুঃসাহস করতে পারেন। যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে তাহলো আমার অনেক বন্ধুর অব্যাহত তাগাদা। তারা অনুভব করে ছিলেন যে, এ সম্পর্কে আমি যা ভাবি বা চিন্তা-ভাবনা করি, তাতে আরো অনেককে শরীক করা প্রয়োজন। কিন্তু আমার সত্যিকারের সাহস বা শক্তি আসে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সেই ওয়াদা থেকে, যেখানে তিনি বলেছেন-
“যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে অবশ্যই আমি তাদের পথ প্রদর্শন করে থাকি।” (সূরা আনকাবূত,আয়াত-৬৯)
মহানবী (সাঃ)-এর বাণী হচ্ছে-
“আমার পক্ষ থেকে পৌঁছিয়ে দাও যদি তা একটি আয়াতও হয় এবং তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যাক্তি তিনি,যিনি কুরআন শিক্ষা লাভ করেন এবং কুরআনের শিক্ষা প্রচার করেন।”
এ বাণী আমার এ কর্তব্য সম্পর্কে আমাকে আরও ব্যাকুল করে তোলে।
আমার এ বই লেখার লক্ষ্য খুবই সাধারণ। এটা কোন পান্ডিত্যপূর্ণ লেখা নয়। আমি একজন সুপন্ডিত মুফাস্সিরও নই অথবা পন্ডিত গবেষকদের জন্যও এ বই লিখছিনা। শিক্ষা বা দিক-নির্দেশনা দেয়ার সাহস আমি করছিনা। কারণ এ কাজের যোগ্যতা আমার নেই। আমি সেই সব সাধারণ অনভিজ্ঞ, অশিক্ষিত কুরআন সন্ধানী লোক বিশেষ ভাবে যুবক-যুবতীদের জন্য লিখছি, যারা আমার মত কুরআন বুঝার আকাঙ্ক্ষা পূরণ, কুরআনের মর্ম বাণী এবং কুরআন অনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্য কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত। আমি ছাত্রদের জন্য এমন একটি বিষয়ই লিখছি, যা আমি নিজেই শিখছি। আমার সমস্ত দুর্বলতা সহ কুরআনের সহজ এবং পুরস্কৃত পথে চলতে একজন পথচারী হিসেবে আমার হোঁচট খাওয়া ও চড়াই উৎড়াই-এর অভিজ্ঞতা যা আমি উপলব্ধি করেছি এবং প্রয়োজনীয় মনে করেছি তাই এই বইয়ের মাধ্যমে আর একজন কুরআনের পথিকের লিখছি। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, তারা তাদের গভীর আন্তরিকতা,নিষ্ঠা এবং যোগ্যতার মাধ্যমে এই বইতে আমি যে উপহার তাদের দিয়েছি তাকে আরও উন্নত করতে সক্ষম হবেন।
এই বইটি হলো দীর্ঘ এবং অদ্যাবধি অব্যাহত অনুসন্ধান এবং অনেক বছরের অধ্যয়নের ফসল। আজ থেকে কয়েক দশক আগে যখন আমি সবেমাত্র কুরআন অনুযায়ী চলার সংগ্রামের সূচনা করি এবং প্রতিশ্রুতিশীল একদল তরুণ ছাত্রকে কুরআন অধ্যয়নের উপায় ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়, তখন আমি যা বলেছিলাম তাহলো আমি নিম্নোক্ত উৎস সমূহের কাছে ঋণীঃ হামীদউদ্দীন ফারাহীর তাফসীরে ফারাহী, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর তাফহীমুল কুরআন, আমীন আহসান ইসলাহীর তাদ্দারুরে কুরআন, আল-গাযযালীর ইহইয়ায়ে উলূমিদ্দীন, শাহ্ ওয়ালিউল্লাহর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা এবং আল-ফাওযুল কবীর ফী উসুলিত তাফসীর, সুয়ূতির আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন। আমি কৃতজ্ঞতার সাথে এইসব গ্রন্থের ঋণ স্বীকার করছি যদিও বা আমার নিজের কোন বুঝার ভুল বা উপস্থাপনার জন্য তারা দায়ী নন। আমার চিন্তা-ভাবনাগুলোকে লিপিবদ্ধ করার প্রথম সুযোগ আসে ১৯৭৭ সালে যখন আমি ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইউ.কে.) কর্তৃক প্রকাশিত আল্লামা ইউসুফ আলীর পবিত্র কুরআনের অনুবাদ গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত ভূমিকা “কুরআনের পথে” লিখি।
কতগুলো স্থায়ী প্রত্যয় থেকেই এই বইটির জন্ম। বইটিতে সেসবের ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। কিন্তু তথাপি সংক্ষেপে সেসবের কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজনীয় মনে করি।
এক:আল্লাহর অবতীর্ণ গ্রন্থ কুরআন অনুযায়ী যদি আমরা পরিচালিত না হই, তাহলে আমাদের জীবন অর্থহীন এবং ধ্বংস হতে বাধ্য।
দুই:চিরঞ্জীব আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে কুরআন কে অনন্ত কালের জন্য মানব জাতির পথ-নির্দেশনা হিসেবে দেয়া হয়েছে, তা আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগেও যেমন আজকেও তেমনি এবং অনন্ত কালব্যাপী সেরূপ শাশ্বত থাকবে।
তিন:কুরআনের প্রথম বিশ্বাসীদের মত আমরাও এর আশীর্বাদ গ্রহণ করতে সক্ষম এবং এ অধিকার আমাদের আছে। অবশ্য যদি আমরা এর নিকটবর্তী হই এবং এর থেকে ফায়দা হাসিলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারি।
চার:প্রত্যেক মুসলমানের জন্য এটা কর্তব্য যে, তিনি কুরআন অধ্যয়নে মনোনিবেশ করবেন, বুঝতে চেষ্টা করবেন এবং মুখস্থ করতে চেষ্টা করবেন।
পাঁচ:কুরআন তাকে যা কিছু দিয়েছে তার প্রেক্ষিতেই একজনকে তার নিজস্ব সব কিছু কর্মে ও চিন্তায় পরিহার করতে হবে। যেকোন অহংকার, গর্ব, এক গুঁইয়েমি,স্বনির্ভরতার ভাব, আপত্তি, অনীহা,যথার্থ নয় বলে গণ্য করা ইত্যাদি কুরআন বুঝার জন্য খুবই মারাত্মক বাধা হতে বাধ্য এবং আশীর্বাদের দরজাও বন্ধ করে দিতে পারে।
ছয়:কুরআনের পথ হচ্ছে নিজেকে সমর্পণের পথ, অনুশীলনের পথ যদি কেউ একটি আয়াতও শিখে। একটি আয়াত শিখা এবং সে অনুযায়ী আমল বা কর্ম সম্পাদন এমন হাজার আয়াত থেকে উত্তম, যা খুব সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করা হয় অথচ পাঠকের জীবনে সেই সৌন্দর্যের কোন প্রতিফলন ঘটেনা। আনুগত্যই হচ্ছে সত্যিকারের চাবিকাঠি।
এই বইটির ৭ টি অধ্যায় রয়েছে। প্রত্যেকটি কুরআনের পথ-পরিক্রমায় বিভিন্ন দিকের উপর আলোকপাত করেছে। প্রথম অধ্যায়ে আছে আমাদের জীবনে কুরআনের পথে চলার অর্থ বা তাৎপর্য কি। দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনায় হৃদয় ও মনের গভীরে কোন্ সব শর্তের সমাবেশ ঘটাতে হবে, তা আলোক পাত করা হয়েছে। হৃদয়, মন ও দেহের জন্য কোন্ ধরনের মেজাজ ও তৎপরতা প্রয়োজন তা বর্ণনা করা হয়ছে তৃতীয় অধ্যায়ে। চতুর্থ অধ্যায়ে আছে অধ্যয়নে কি ধরনের বিধি মেনে চলা উচিৎ এবং কিভাবে বুঝতে হবে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে আছে একজন মানুষ কি করে তার জীবন কে কুরআনের মিশনের পরিপূর্ণতার পথে উৎসর্গ করতে পারে। মহানবী (সাঃ)পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন নির্দিষ্ট অংশ সম্পর্কে কি বলেছেন, তা একটি পরিশিষ্টে সন্নিবেশিত হয়েছে। অন্য একটি পরিশিষ্টে ব্যাক্তিগত ও সামষ্টিক অধ্যয়নের জন্য একটি পাঠক্রম নির্দেশ করা হয়েছে, যা অনেকের জন্য বেশ কাজে লাগতে পারে। পাঠ-সহায়িকা হিসেবে আরও কিছু জিনিস সংযোজিত হয়েছে।
এটা এমন কোন বই নয়, যা তাড়াহুড়ো করে একবার পাঠ করে রেখে দেয়া যায়। যদি পছন্দ না হয় বা প্রয়োজনীয় বলে মনে না হয় তবে ভিন্ন কথা। যাদের এ ধরনের একটি বইয়ের প্রয়োজন আছে এবং এটাকে খুবই দরকারী বলে মনে হয়, আমি আশা করি প্রতিটি অধ্যায়ই তারা বিশেষ সময় দিয়ে বার বার অধ্যয়ন করবেন। তাদের কাছে আমার আবেদন, এই বইটিকে আপনারা একজন সার্বক্ষণিক সাথী হিসেবে নিয়োজিত করতে পারেন।
কতিপয় বিষয় আপনাকে খুবই সতর্কতার সাথে অধ্যয়ন করতে হবে। কিছু আপনাকে সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে এবং কিছু আপনাকে বারবার উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়ে পড়বে। কিন্তু যা আপনি অনুশীলন করবেন, তাই হবে আপনার জন্য খুব মূল্যবান। এই গ্রন্থ পথের সীমানা নির্দেশ করেছে এবং ফলক-চিহ্ন রচনা করে দিয়েছে, যাতে পথিক তার পথ সঠিক ভাবে চিনতে পারে, পথ নির্দেশনা, সতর্কতা, হুঁশিয়ায়রি বা নিষেধাজ্ঞা যা প্রয়োজন পথিক তা পেতে পারে। এতদসত্ত্বেও আপনাকে একটি বাহন নিয়ে সুসজ্জিত হতে হবে, এতে জ্বালানী ভর্তি করে রাস্তায় নামতে হবে এবং তা চালাতে হবে। বইয়ের কোন কিছুই আপনার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা শক্তি, দৃঢ়সংকল্প এবং কঠোর প্রচেষ্টার বিকল্প হতে পারেনা।
বইটিতে যেসব সতর্ক বাণী ছড়িয়ে আছে, তা গ্রহণ এবং ব্যবহার সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে,তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে যে,আপনি কি নিজস্ব ভাবেই কুরআন বুঝতে চেষ্টা করছেন নাকি পাঠ্যসূচী ও পাঠক্রম ব্যবহার করছেন অথবা অন্য কোন ভাবে তা করছেন।
কুরআন বুঝার জন্যে প্রত্যেক মুসলমানের ব্যাক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণের অপরিহার্যতা সম্পর্কে আমি খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছি ও জোর দিয়েছি। আমার মতে, এটাই কুরআনের সবচেয়ে মৌলিক দাবী। অবশ্য আমি এ পথে চলার ত্রুটি গুলো সম্পর্কেও সজাগ এবং তা আমি উল্লেখ করারও চেষ্টা করেছি। এ সম্পর্কে আমি এটাই পছন্দ করবো যে, আপনারা সর্বদা সাইয়েদুনা আবুবকর (রা)-এর সেই বাণী আপনাদের সামনে রাখবেন,যাতে বলা হয়েছেঃ
“মাটি আমাকে গ্রহণ করবে না, আকাশ আমাকে রক্ষা করবে না, যদি আমি কুরআনের ব্যাখ্যা করতে মনগড়া কথা বলি।”
এ বাণী আমার উপর এক সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছে এবং আমাকে সংযমী ও দৃঢ় হতে প্রেরণা যুগিয়েছে, এ থেকে আপনাদেরও ফায়দা হাসিল করা উচিত।
আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, যখন আমাদের জীবনকে কুরআন কেন্দ্রিক করা খুবই জরুরী এবং অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এটা ছাড়া আমরা মুসলমানরা কোন ক্রমেই আমাদেরকে আবিষ্কার করতে পারবো না, আমাদের আমিত্বকে তাৎপর্যময় করতে পারবো না এবং এ বিশ্ব-চরাচরে আমরা কোন সর্বশক্তি লাভ করতে পারবো না। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, কুরআন কেন্দ্রিক জীবন ছাড়া আমরা আমাদের স্রষ্টা ও প্রভুকে কোন ক্রমেই সন্তুষ্ট করতে পারবো না। উপরন্তু কুরআন ব্যাতীত মানব জাতিও ধ্বংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে।
আজকে মুসলমানদের মধ্যে এই জরুরী প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দ্রুত গতিতে উপলব্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুরআন বুঝার আকাংখা এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনার স্পৃহা আজ অত্যন্ত ব্যাপক। বিশ্বব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণের ঢেউ এই আকাংখা, সচেতনতা এবং উদ্দীপনারই ফলশ্রুতি। আমাদের মুসলিম উম্মাহর এ সংকটের দিনে আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যদি কিছু লোকের অন্তরে কুরআনের পথে চলার আকংখা জেগে ওঠে এবং এটি যদি তাদের জীবনে পথ চলার সাথী হতে পারে, তাহলে আমার পরিশ্রম ব্যাপক সার্থকতা লাভ করবে এবং পুরষ্কৃত হবে। আমার জন্য কেবল মাত্র তখনই এটা উপকারে আসবে যদি আল্লাহ আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি গুলো ক্ষমা করেন এবং আমার এই আন্তরিক প্রচেষ্টা কবুল করেন। যারা এই বই থেকে উপকৃত হবেন, তাদের প্রতি আমার একটিই আবেদন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনার সময় আমাকে ভুলবেন না।
–খুররম মুরাদ
লেস্টার
১৫ শাবান,১৪০৫ হিজরী
৬ মে,১৯৮৫