আমাদের জাতি সত্ত্বার বিকাশ ধারা
মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান
মুখবন্ধ
বাংলাদেশের ইতিহাসকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় অষ্টম শতক থেকে। এর পূর্বের ইতিহাস আছে, কিন্তু তা সুস্পষ্ট নয়। তখন সুস্পষ্টভাবে এবং বিশেষ ধারাক্রম অনুসারে এ অঞ্চলের কর্মকাণ্ড প্রবাহিত হয়নি। সুতরাং সে সময়কার কথা আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করার কোন প্রয়োজন হয় না। অষ্টম শতক থেকে পাল রাজত্বের আরম্ভ। তারা এ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজ্য শাসন করতেন। তাদের আমলে সুস্পষ্ট এবং শৃঙ্খলিত কোন নগর-জীবন গড়ে ওঠেনি। এর ফলে সে সময়কার সংস্কৃতি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। নৃত্য, গীত এবং লোকরঞ্জনের বহুবিধ উপকরণ সকল মানুষের আচরণবিধি এবং জীবন যাপনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। পালরা যেহেতু বৌদ্ধ ছিল, সুতরাং তারা মানুষে মানুষে বিভাজন মানত না। তখন এমন অবস্থা ছিল যে, কর্মের দায়ভাগে এবং অধিকারে একজন শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারত, আবার ব্রাহ্মণও ইচ্ছা করলে শূদ্র হতে পারত। শূদ্র হওয়াটা তখন ঘৃণার বা অপরাধের ছিল না। বাংলা ভাষার প্রথম কবি সরহপা ব্রাহ্মণের পুত্র ছিলেন, বড় হতে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হন এবং নালন্দা বিদ্যাপীঠের একজন আচার্যের সম্মান লাভ করেন। তিনি তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে একজন অন্ত্যজ শ্রেণরি রমণীকে গ্রহণ করে নিম্ন পর্যায়ের মানুষের মধ্যে বসবাস করতে থাকেন। এভাবে তিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, মানুসের পরিচয় হচ্ছে তার বুদ্ধিতে, বিবেকে, অনুভূতিতে এবং মননে, তার পরিচয় জাতিগত বিচারে নয়।
দ্বাদশ শতকে কর্ণাটক থেকে বহিরাগত সেনরা এসে যখন এদেশকে অধিকার করল, তখন তারা একটি নিষ্ঠুর শোষন-কার্যের মধ্য দিয়ে এদেশবাসীকে নির্যাতন করতে লাগল। তারা সংস্কৃতিকে নিয়ে এল রাজসভার মধ্যে এবং মন্দিরের অভ্যন্তরে। পাল আমলে বাংলা ভাষা ক্রমশ রূপলাভ করছিল। সরহপা পুরবী অপভ্রংশে তাঁর দোঁহাকোষ রচনা করেছিলেন। সেনরা এসে সংস্কৃতিকে প্রশাসনিক ভাষা হিসাবে গ্রহন করেন এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতর ভাষা হিসেও সংস্কৃতকে গ্রহণ করেন। তার ফলে এদেশের মানুষের নিজস্ব উচ্চারণের ভাসা সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। আমরা লক্ষ্য করি যে, সেনদের আমলে দেশীয় ভাষায় চর্চা সম্পূণরূপে বন্ধ ছিল। সেনরা যে সংস্কৃতি নিয়ে এল, স সংস্কৃতি ছিল হিন্দুদের এবং তাও সকল শ্রেণীর হিন্দুদের নয়, তা ছিল কৌলিন্যবাদী ব্রাহ্মণদের এবং অংশত ক্ষত্রিয়দের। সর্বশেষ সেন রাজা লক্ষণ সেনের রাজদরবারে যে সমস্তু কবি-সাহিত্যিক ছিলেন, তাঁরা সংস্কৃত ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে জয়দেব রাধা-কৃষ্ণ উপাখ্যানকে কাব্যে রূপান্তরিত করে একটি বিশেষ কাব্যধারার জন্ম দিলেন। এর ফলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি পরিপূর্ণভাবে বর্ণহিন্দুদের অধিকারে চলে গেল।
১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজীর আগমনে এদেশের সাধারণ মানুষ নতুন করে চেতনা পেল। সুকুমার সেন তাঁর একটি রচনায় স্বীকার করেছেন যে, অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা বখতিয়ারের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিল, এমনকি কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণও বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেনকে বিভ্রান্ত করে দেশত্যাগ করতে সহায়তা করেছিল। মানুষে মানুষে বিভাজন মুসলমান আমলে আর রইল না, পাল আমলেও এটা ছিল না। মুসলমানরা একটি নতুন বিশ্বাসকে আনলেন, এদেশের সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলেন এবং একটি বিস্ময়কর মানবিক চৈতন্যের উদ্বোধন ঘটালেন।
আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষ এবং বিকাশকে আলোচনা করতে গেলে পাল আমলের বিস্তৃত পরীক্সা করা প্রয়োজন এং সেনরা যে অসৌজন্যের জন্ম দিয়েছিল, তারও সুস্পষ্ট পরিচিতি উপস্থিত করা প্রয়োজন। অবশেষে মুসলমান আমলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি যে নতুন মানবিক রূপ পরিগ্রহ করল তারও বিস্তৃত সমীক্ষার প্রয়োজন। এ নিয়ে অল্পস্বল্প লিখিত হলেও বিস্তৃতভাবে এ নিয়ে কেউ গবেষণা করেননি। সম্প্রতি মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এ নিয়ে গবেষণা করছেন এবং তাঁহার ‘মুক্তি সংগ্রামের মূলধারা’ গ্রন্হটি এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। তাঁর বর্তমান গ্রন্হটি যার নাম ‘আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা’ আমাদের সংস্কৃতির পরিচয়কে নতুন করে উদঘাটন করেছে। আমরা বিশেষ একটি ভূখণ্ডের অধিবাসী এবং সেই ভূখণ্ডের অতীত এবং বিশ্বাস আমাদের সংস্কৃতি নির্মাণে যে বিপুলভাবে সহায়ক, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান তা তাঁর গ্রন্হের মধ্যে সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন। এ অঞ্চলের মানুষের যে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা আছে এবং তা পাল আমল থেকে ক্রমশ গড়ে উঠেছে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এবং সতর্ক বিবেচনা মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের গ্রন্হে পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক হিন্দু ঐতিহাসিকের কারণে বহিরাগত সেনদের সং স্কৃতিকে বিরাট এবং মহার্ঘ করে দেখানো হয়েছে এবং আমাদের দেশের আত্মবোধবিমুখ কিছু সংখ্যক লোক হিন্দুদের বিবেচনাটি মেনে নিয়েছে। এহেন অবস্থা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। মোহাম্মদ আবদুল মান্নান যে এ পথে এগিয়ে এসেছেন সেজন্য তাঁকে আমি সাধূবাদ দেই।
তার এই গ্রন্হটি সর্বজনগ্রাহ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস। আম গ্রন্হটির বহুল প্রচার কামনা করি।
ভুমিকা
রাষ্ট্র কখনো সাগরের বুকে একটি দ্বীপের মতো হঠাৎ জেগে ওঠে না। রাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমারেখারও একটি পুরাতত্ত্ব থাকে, তার একটি অতীত থাকে। বর্তমান জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম হলো পূর্বপুরুষদের সংগ্রামেরই ধারাবাহিকাতা। সেই সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত ভিত্তিভূমিতে প্রোথিত হয় বর্তমান স্বাধীনতার শিকড়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রসত্তা ও জাতিসত্তার উদ্বোধন ও বিকাশ ঘটেছে এ পাললিক জনপদের মানুষদের নিরন্তর সংগ্রাম ও অব্যাহত সাধনার মাধ্যমে। এই সংগ্রামের রয়েছে এক বিস্ময়কর ধারাবাহিকতা ও অসামান্য বহমানতা। সুপ্রাচীন সভ্যতার গৌরব-পতাকা হাতে এই ভাটি অঞ্চলের সাহসী ও পরিশ্রমী মানুষেরা শতাব্দীর পর শতাব্দী লড়াই করেছেন আর্য আ্গ্রাসনের বিরুদ্ধে। তাদের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ সংগ্রাম ও মুক্তির লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে এই জনপদ বিবেচিত হয়েছে উপমহাদেশের বিশাল মানচিত্রে আর্যপূর্ব সুসভ্য মানবগোষ্ঠীর নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থলরূপে। এ এলাকায় জনগণের অস্তিত্ব ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সংগ্রামে স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়েছে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা। নিকট-অতীতে এ লড়াই তীব্র হয়েছে ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় কোলাবোরেটর বর্ণহিন্দুদের সাথে। আর্যরা তাদের অধিকার বিস্তৃত করে নানা ঘোরপথে যখন এ বদ্বীপে উপনীত হলো, তখন থেকে একেবারে হাল আমলের বাংলাদেশের জনগণের আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াই পর্য্ত এ জাতির সংগ্রাম ও সংক্ষোভের মূলধারা রচিত হয়েছে অভিন্ন প্রেরণার এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে।
এ অঞ্চলের মানুষের বংশধারায় বহু-বিচিত্র রক্ত প্রবাহের মিশেল ঘটেছে। সেমিটিক দ্রাবিড় রক্তের সাথে এস মিশেছে অষ্ট্রালয়েড. মঙ্গোলীয়, এমনকি আর্য-রক্তের ধারা। এ প্রবাহ এমনভাবে মিশে গেছে যে, নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় কাউকে এখন আর স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। চেহারার বৈচিত্র্য সত্ত্বেও এলাকার গরিষ্ঠ মানুষের মিল রয়েছে তাদের জীবনদৃষ্টিতে। জীবনদৃষ্টির অভিন্নতাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে তাদের জীবনের অভিন্ন লক্ষ্য এবং একত্রে বসবাসের ও জীবনধারণের স্বতঃস্ফূর্ত বাসনা ও প্রতিজ্ঞা। অভিন্ন বোধ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে জন্ম হয়েছে তাদের একটি জীবনচেতনা ও আচরণরীতি। তাদের আকাঙ্কায় ও তাদের সংগ্রামে এই জীবনচেতনারই স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। তাদের সংগ্রামের লক্ষ্যকে এই জীবনচেতনাই নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং নির্মাণ করেছে তাদের ইতিহাস। এভাবে এ এলাকার মানুসের বোধ, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনার ভিত্তিতে পরিচালিত নিরন্তর সংগ্রামের ধারাকে অবলম্বন করেই তাদের একটি পরিচয় নির্মিত হয়েছে। এ পরিচয়ই তাদের জাতিসত্তার ভিত্তি।
বাংলাদেশের জনগণের আর্য-ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে সংগঠিত হয়েছে প্রথমে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের মানবিক আদর্শকে অবলম্বন করে। এরপর বৌদ্ধ ধর্ম তার অভ্যন্তরীণণ দুর্বলতার কারণে জনগণের নেতৃত্ব গ্রহণে অসমর্থ হলো। বৌদ্ধ সংস্কৃতির পতনের সাথে সাথে সমগ্র দেশ অর্থনৈতিক দুর্গতি, রাজনৈতিক অত্যাচার, সামাজিক নিপীড়ন, বিচারবুদ্ধির স্বেচ্ছাচারিতা আর আধ্যাত্মিক অনাচারে ডুবে গেল। এ সময় ইসলাম তাদের জীবনে নতুন প্রেরণা ও আশাবাদ সঞ্চার করলো। এ এলাকার বিপন্ন নর-নারী ইসলামের মধ্যে খুঁজে পেল তাদের আত্মরক্ষার বিশ্বস্ত অবলম্বন। ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রেরণা, উদার অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন মানবিক আবেদন, ইসলামের প্রচারশীলতা ও ইহলৌকিকতা, এর সাংগঠনিক বুনিয়াদ ও সাংস্কৃতির ভিত্তি এবং এর সাম্যভিত্তিক বিধিবদ্ধ সামাজিক সংবিধান এই এলাকার মানুষকে সুদৃঢ কাঠামোর ওপর মেরুদণ্ডবান জনগোষ্ঠীরূপে দাঁড় করিয়ে দিল। ইসলাম এলো একটি পূর্ণ বিকশিত সংস্কৃতি নিয়ে এবং সেই সংস্কৃতি তাদেরকে আর্য-আগ্রাসনের মুখগহ্বর থেকে বের করে এনে তাদের নির্লিপ্ত, নিষ্ক্রিয় জীবনক্ষেত্রকে জাগ্রহ, সচেতন ও সক্রিয় করে তুলল। ফলে এ এলাকার মানুষেরা আর্য-আগ্রাসনকে সাফল্যের সাথে প্রতিহত করল এবং ইসলাম বৌদ্ধ সংস্কৃতির মতো বিলুপ্ত হয়ে গেল না, জনগণের অস্তিত্বের গভীরে ঠাঁই করে নিয়ে টিকে থাকল।
কে এম পানিক্কর দেখিয়েছেন যে, ইসলামের আগে আর্য-আগ্রাসনের মোকাবিলায় যে দুটো সংস্কৃতি জনগণের সংগ্রামকে শক্তি যুগিয়েছে, প্রকৃতিগতভাবে সেগুলো কতটা আনুভূতিক ব্যাপার। ফলে আর্য-সংস্কৃতির সাথে নিজেদের পার্থক্যটাকে জৈন ও বৌদ্ধরা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। এই দুটো সংস্কৃতি ক্রমশ আর্য-সংস্কৃতির গ্রাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ইসলাম আর্য-সংস্কৃতির মোকাবিলায় শুধু আত্মরক্ষা করতেই সমর্থ হলো না, ভারবীয় সমাজকে আপাদমস্তক দু’ভাগে বিভক্ত করে স্পষ্ট দু’টি জাতিত্ব সৃষ্টি করল। (এ সার্ভে অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি)
ইসলাম এদেশের সামাজিক অচলায়তন গুঁড়িয়ে দিল এবং নৃতত্ত্বের তথাকথিত প্রাচীরও অপসৃত করল। ফলে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী বংশ ও বর্ণচেতনার অবসান ঘটলো। গোড়াপত্তন হলো জীবনদৃষ্টি, বিশ্বাস ও আদর্শের ঐক্যের ভিত্তিতে এক নতুন জনগোষ্ঠীর। জেগে উঠলো এক নতুন জাতিসত্তা । ইসলাম এসে একানে সামাজিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করেছে এবং বংশ ও রক্তভিত্তিক গোষ্ঠী-ধারণাকে সমূলে উচ্ছেদ করে বিশ্বাসের ঐক্যকে সামাজিক ঐক্যে রূপান্তরিক করেছে। এই প্রক্রিয়ায়ই বর্ণাশ্রমের এই দেশ-আদিবাসী ও বৌদ্ধদের এই দেশ- মাত্র কয়েকশ’ বছরে একটি নতুন জাতির দেশরূপে গড়ে উঠলো। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ভিত্তিমূলে রয়েছে এদেশে ইসলামের অভ্যূদয়কালে যারা বাস করতেন, তাদের সাথে বিদেশাগত মুসলামনদের রক্তের অবাধ মিশ্রণ। স্থানীয় অধিবাসীরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করলেন। মুসলমানদের সংখ্যা এদেশে দ্রুত বেড় গেল এবং এদেশের জন-কাঠারোর রূপ বদল ঘটলো পুরোপুরি। ফলে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রেরণায় উজ্জীবিত একটি নতুন জাতির অভ্যূদয় ঘটলো এখানে। যারা ইসলাম গ্রহণ করলো না, তারাও তাদের অনড় বর্ণাশ্রম ও জাতিবৈষম্য নিয়ে মুসলমানদের পাশাপাশি বাস করতে থাকলো পৃথক ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে। ইসলাম তাদের গ্রাস করল না, তাদের জন্যও বিশ্বাসের স্বাধীনতা নিশ্চিত করল।
মুসলিম শাসনের শুরু থেকে শত শত বছর বাংলাদেশের মুসলমান ও হিন্দুগণ অভিন্ন ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় স্বতন্ত্র ধর্মবিশ্বাস ও আলাদা জীবনাচরণের মাধ্যমে ধর্মীয় জীবনের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পাশাপাশি বাস করেছেন। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য অর্জনে এই স্বাতন্ত্র্যচেতনা বড় ধরনের কোন সংঘাত সৃষ্টি করেনি। বাংলায় সাড়ে পাঁচশ’ বছরের মুসলিম শাসনের মাঝখানে মাত্র একবার সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের অমাত্য, ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশ, পনেরো, শতকের গোড়ার দিকে বাংলার শাসনক্ষমতা দখন করেছিলেন চার বছরের জন্য। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, গণেশের এই স্বল্পস্থায়ী রাজত্ব ছিল ‘হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা ও হিন্দু ধর্মের প্রধান্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্ঠা’। এই ঘটনার একশ’ বছর পর ষোল শতকের শুরুতে আলউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে শ্রীচৈতন্য মুসলিম সালতানাত ধ্বংসের চেষ্টা করেন। সে সম্পর্কেও রমেশচন্দ্র মজুমদারের মন্তব্য হলোঃ ‘তিন শত বছরের মধ্যে বাঙালি ধর্ম রক্ষার্থে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়ায় নাই।…………. চৈতন্যের নেতৃত্বে অসম্ভব সম্ভব হইল’। (বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্য যুগ)
ব্রিটিশ শাসনকে ঘিরেই হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় পার্থক্য তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের স্তরে স্তরে প্রভাব বিস্তার করে। এ আমলের ঘটনাপ্রবাহকে নিম্ন ক্রমানুসারে সাজানো যেতে পারেঃ
এক. ইংরেজরা ১৬৩৪ সালে বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি লাভের পর কলকাতা ও কাসিম বাজারে যেসব দেশীয় কর্মচারী নিয়োগ করে, তারা সবাই ছিল হিন্দু। এই বাণিজ্যিক যোগসূত্রের মধ্য দিয়ে একটি ষড়যন্ত্রমূলক ইঙ্গ-হিন্দু মৈত্রী গড়ে ওঠে। মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল হয়ে উঠে। বর্ণহিন্দু মিত্রদের সহযোগিতা নিয়েই ইংরেজনরা এদেশের রাজনীতির দিকে হাত বাড়াতে থাকে।
দুই. ব্রিটিশ শাসন হিন্দুদের কাছে ছিল নিছক শাসক বদলের ঘটনা। ইংরেজদের আস্থা ও অনুগ্রহ লাভের জন্য তারা নিজেদের মধ্যেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। অন্যদিকে মুসলমানরা ইংরেজ শাসনে তাদের জাতিসত্তা বিপন্ন দেখতে পায়। তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিরামহীন, আপসহীন সংগ্রামের পথে অগ্রসর হয়ে ‘রানীর বিদ্রোহী প্রজা’ রূপে চিহ্নিত হয়।
তিন. হিন্দুরা ইংরেজদের সমর্থনে পুষ্ট হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন পরিচালনা করে। মুসলমানদের সংগ্রামে হিন্দুদের কোন সহানুভুতি ছিল না।
চার. ইংরেজদের জুনিয়র পার্টনাররূপে একের পর এক শোষণ-সাফল্যের মধ্য দিয়ে বর্ণহিন্দুরা এগিয়ে যায়। কলকাতাকে কেন্দ্র করে হিন্দু পুনরুজ্জীনবাদী ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। তা ছিল মুসলমানদের প্রতি আক্রমণাত্মক। অন্যদিকে মুসলিম আমলের রাজধানী ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ অনধকারে তলিয়ে যায়। মুসলমানদের ভাগ্য মেঘের আড়ালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
পাঁচ. কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজরা প্রশাসনিক কারণে বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী ভাগ করে। ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’ গঠন করলে ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ববাংলার অবস্থার উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দেয়। কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দুরা এই প্রশাসনিক বিভাজনকে ‘বঙ্গভঙ্গ’ আখ্যায়িত করে একে ‘এক গুরুতর জাতীয় বিপর্যয়’ হিসেবে গণ্য করে এর বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তারা সর্বত্র সন্ত্রাসের আগুন ছড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ঢাকাকেন্দ্রিক মুসলমানরা বঙ্গ বিভাগকে বিবেচনা করেছিল তাদের ‘ভাগ্যোদয়ের নতুন প্রভাত’ রূপে।
ছয়. হিন্দুদের তুষ্ট করার জন্য ইংরেজরা ‘বঙ্গভঙ্গ’ রদ করে। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে বাংলার মুসলমানরা ক্ষব্ধ হয়, অন্যপক্ষে হিন্দুরা খুশি হয়। তারা করজোড়ে ইংরেজদের বন্দনা গায় ‘জনগন-মন-অধিনায়ক জয় হে ভারত-ভাগ্য-বিধাতা’ রূপে।
সাত. বঙ্গভঙ্গের ঘটনা প্রবাহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে কেন্দ্র করেই মুসলামানদের জাতি-স্বতন্ত্র্যচেতনার ভিত্তিতে তাদের স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক মঞ্চরূপে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। মুসলিম লীগ ৪০ কোটি মানুসের অখণ্ড ভারতীয় শাসনতন্ত্রে সংখ্যলঘু ৯ কোটি মুসলমানদের জন্য নিরাপত্তার গ্যারান্টি বা রক্ষাকবচ দাবি করে। তাদের দাবি কংগ্রেস শিবিরের পাষাণ প্রাচীরে মাথা কুটে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। ফলে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ভিত্তি পৃথক মুসলিম আবাসভূমির দাবিতে সংগ্রামে লিপ্ত হয় মুসলিম লীগ। সে আন্দোলনে বাংলার মুসলমানগন সংগ্রামে, সাহসে ও ত্যাগে উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন।
নয়. উনিশ শ’ সাতচল্লিম সালের ভারত বিভাগের সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বেঙ্গল প্রদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে হিন্দু মহামভা ও কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে নতুন করে বঙ্গভঙ্গের দাবি ওঠে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে অখণ্ড রাখা জন্য চেষ্টা চালায় মুসলমানরা। অখণ্ড বাংলাদেশকে পাকিস্তাদের অংশ বানানো যাবে না- বিবেচনা করে বাংলার মুসলমান নেতৃবৃন্দ স্বতন্ত্র স্বাধীন অখণ্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। মুসলিম লীগ হাই কমান্ড তাতে সম্মত হলেও গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেলের কংগ্রেস তার বিরোধিতা করে এবং বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অনমনীয় রায় দেয়।
দশ. সবশেষে ১৯৭১ সালে পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলমানদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা নিজেদের ঘর-বাড়িতে তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, এ সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। তাদের ধারণা ছিল, পূর্ববাংলার জনগণের মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে তার ফলে দুই জাতিতত্ত্বের মৃত্যু হবে। এটি তারা শুধু মনেই করেননি, প্রচারও করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বাঙালি হিন্দুরা এ আন্দোলনকে সমর্থন দিলেন, কিন্তু একাত্ম হলেন না বাঙালি মুসলমানদের সাথে।
বস্তুত, ব্রিটিশ শাসনের আগে-পরের সমস্ত ঘটনাই স্বতন্ত্র দৃষ্টিভুঙ্গিজাত পার্থক্যের ভেতর দিয়ে বাঙালি জীবনের দুটি বিপরীত স্রোতধারাকে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিলোপ হলে এ আন্দোলনে শরীক হয়ে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গড়ার সংগ্রামে ওপারের বাঙালিদের যোগদানে বাধা ছিল কিসের?
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বাঙালিরা নিজেদেরকে বাঙালি মানেন এবং এপার আর ওপার নিয়ে বাঙালি এক অবিভাজ্য অখণ্ড সত্তা বলে তারা প্রচাও করেন। কিন্তু ভারতীয় জাতীয়তায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ওপার বাংলার শ্রেষ্ঠ বাঙালিরা অনেক আগেই নিজেদের জাতীয়তা ভারতের ‘মহামানবের সাগরতীরে’ নির্ধারিত করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনাই সর্ব ভারতীয় জাতীয়তার রসে সিক্ত, যার মূল প্রস্রবণ তাঁর নিজের ভাষায়ই হলো উপনিষদ। অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে দিল্লীর অধীনে অখণ্ড বঙ্গপ্রদেশে তারা আস্থাশীল; কিন্তু অখণ্ড বাংলাদেশ কিংবা অখণ্ড বাঙালির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে তারা বিশ্বাস করেন না।
এখানে একটি সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিকবোধ কাজ করে এবং তা বিভিন্ন সময় স্থূলভাবেই প্রকাশও পেয়েছে। তা হলো, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বাংলাভাষীরা পূর্ববাংলার সাথে মিলিত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সাথে মিলিত হলে সেখানে মুসলমানরাই হবে সংখ্যাগুরু। (ড. অতুলসুর তাঁর ‘দুই বাংলা কি এক হবে’ নামক বইয়ে এই বিপদের কথা কিছু দিন আগেও প্রকাশ করেছেন।) সাতচল্লিশের সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার সময়ও তাদের অনেকে এ হিসাবটা করেছিলেন। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? ওপারের বাঙালিরা দিল্লীর অধীনতা ত্যাগ করে এস এপারের সাথে মিলিত হতে রাজি নন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভয়ে। আর এপােো বাংলাদেশের বাঙালিরাও পশ্চিমবঙ্গের সাথে মিলিত হয়ে দিল্লীর জোয়ালের নিচে নিজেদেরকে জুড়ে দিতে রাজি নন হিন্দু অধীনতার ভয়ে। ওপার আর এপারের বাংলাভাষী লোকদের নিয়ে এক দেশ এ জন্যই কখনো হলো না।
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় জাতি-স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করে যে মানচিত্র তৈরি করা হয়েছিল, সেটাকে রক্ষা করাই বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের জন্য নিরাপদ মনে করে। এটাকেই তারা নিজেদের ভৌগলিক স্বাধীনাত ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম বলেও গণ্য করে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ নিজেদের এক ইঞ্চি জায়গাও একে অপরকে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। ভারতের বন্ধুত্বের আশায় মুজিব সরকার বেরুবাড়ি হস্তান্তর করেছিলেন সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। কিন্তু তার বিনিময় তিন বিঘা করিডোরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন লাভের জন্য আজো সংগ্রাম করছে বাংলাদেশের মানুষ। ব্রিটিশ ভারতের প্রাচীন রাজধানী এবং ভারতীয় বাঙালিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল কলকাতার বন্দরকে নাব্য করার উছিলায় ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে আন্তর্জাতিক নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করা হলো এপারের বাঙালিদের। তার বিরুদ্ধে ওপারের ভারতীয় বাঙালিরা প্রতিবাদ করলেন না। বরং এত বড় অন্যায়কে সমর্থন করলেন। গঙ্গার পানির অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে বৈঠক করতে বাংলাদেশের নেতা হিসেবে ভারতে গেলেন আমাদের নৌবাহিনী প্রধান। কলকাতার বাঙালি হিন্দুদের বাংলা ভাষার পত্রিকাগুলো তাঁকে ‘ডিঙ্গি’ নৌকার মাঝি’ বলে কটাক্ষ করল। এভাবে তারা দিল্লীল অধীনে নিজেদের বড়ত্ব জাহির করল এবং আমাদের স্বাধীন সত্তার প্রতি তাচ্ছিল্যও দেখাল।
এর পেছনে কোন মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে? ফারাক্কার পানি, কাঁটাতারের বেড়া, অঙ্গরপোতা-দহগ্রাম. দক্ষিণ তালপট্টি, এগুলোর কোনটাই বাংলাদেশের জন্য ছোট ইস্যু নয়। এসব ইস্যুতে ওপার বাংলার আর এপার বাংলার অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। দুয়েল মনোভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। এপার আর ওপারের এই পার্থক্যটি চিরন্তন। “এ প্রভেদ মনের, মানসের, আবেগের, অনুভূতির, ধর্মের, কর্মের, নামের, নিশানের, ঐতিহ্যের, উত্তারধিকারের, খোরাকের, পোশাকের, আদবের, লেহাযের, কায়দা-কানুনের, জীবনবোধের, জীবনধারণের, জীবন দর্শনের ও জীবন সাধনার”। ভাষঅ এক হলেই যে জাতিসত্তা সব সময় এক হয় না, তার প্রমাণ একই ভাষাভাষী বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের জনগণের জীবনদৃষ্টিজাত মনস্তত্ত্ব।
হাজার বছরের সংগ্রামী ঐতিহ্য লালিত একটি সুচিহ্নিত জীবনদৃষ্টিই বিকশিত করেছে এ এলাকার মানুষরে জাতিসত্তাকে। এই সত্তাকে অবলম্বন করে বিকশিত হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রসত্তা। নিজস্ব পরিচয়, ভাব ও গৌরব নিয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে একটি শক্ত মেরুদণ্ডবান জনগোষ্ঠীর আবাসস্থলরূপে। আমাদের জাতিসত্তার এই ভিত যতদিন অটুট থাকবে, আমরা আমাদের স্বাধীন মর্যাদাপূর্ণ অস্তিত্ব ততদিন অক্ষণ্ন রাখতে সক্ষম হব। এই ভিত্তি নষ্ট হলে এদেশের স্বাধীন-সার্বভোম অস্তিত্বের যৌক্তিকতা হারিয়ে যাবে। একটি স্বাধীন অস্তিত্বের ভিত্তিতে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হচ্ছে বলেই বাংলার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ মাথা উঁচিয়ে, তর্জনী নাচিয়ে উচ্চারণ করতে পারেন, ‘ঢাকা এখন শুধু বাংলাদেশের রাজধানী নয়, বাংলাভাষারও রাজধানী’। এই স্বাধীন অস্তিত্বের অহঙ্কারেই বরেণ্য ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমদ নিজের বুকে আঙ্গুল ঠুঁকে আপন জাতিসত্তার প্রতি ইঙ্গিত করে বলতে পারেন, ‘বাংলা সাহিত্যে এখন আমরাই ডমিনেট করবো’।
ঐতিহ্যবাহী স্বাধীন জাতির রাজধানী মেজাজ নিয়ে শত শত বছর ধরে বেড়ে ওঠা ঢাকা শহর শত বছরে পরাধীনতার গ্লানি ঝেড়ে ফেলে মর্যাদা নিয়ে আবার মাথা তুলেছে এই ‘আমরা’র স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে অবলম্বন করে। অন্যদিকে ‘নাবিক বণিক লোফার’ ইংরেজ আর তাদের দালাল. বেনিয়ান ও মুৎসুদ্দীদের ষড়যন্ত্রের ঘাঁটিরূপে এবং ঔপনিবেশিক রাজধানীরূপে বেড়ে ওঠা কলকাতা এখন ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে একটি নির্জিত শহররূপে দিল্লীর অধীনে দ্রুত অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে কোন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের কণ্ঠে এমন প্রত্যয়ী উচ্চারণ আর শোনা যায় না। সেখান থেকে ভেসে আসে ডুবন্তপ্রায় বাঙালিদের এক ধরনের আর্ত-চিৎকার।
এই বইয়ে আমি আমাদের পূর্বপুরুষদের সংগ্রামের ধারাবাহিকতার একটি রেখাচিত্র তুলে ধরে আমাদের জাতিসত্তা বিকাশের ধারাক্রমকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। এই জাতিসত্তার সুরক্ষা ও বিকাশ দানের মধ্যেই আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের ও অহঙ্কারের বীজ নিহিন। এ জন্য আমাদের পূর্বপুরুষগণ সংগ্রাম করেছেন, এ জন্য আমরা লড়াই করছি এবং আমাদের এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। কেননা, নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের চাইতে মহত্তর আর কিছু নেই। এই সংগ্রাম কারো বিরুদ্ধে নয়। এ্ই সংগ্রাম আত্মরক্ষার এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের।
আমাদের জাতিসত্তা সম্পর্কে কয়েকটি প্রবন্ধ আমি লিখেছিলাম ১৯৭৭-৭৮ সালে মাসিক ঢাকা ডাইজেস্ট পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ফযলে আযীমের তাকীদ ও অনুপ্রেরনায়। এর পর ১৯৯২-৯৩ সালে কয়েকটি জাতীয় সেমিনারের জন্য প্রায়-অভিন্ন বিষয়ে আমাকে কয়েকটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হয়। সমাজ অধ্যায়ন কেন্দ্রের উদ্যোগে ‘আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা’ নামে এবং বাংলা চৌদ্দ শতক জাতীয় উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বঙ্গভঙ্গ ও রাষ্ট্রসত্তা’ শীর্ষক সেমিনার দু’টি এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব সেমিনারে পঠিত আমার প্রবন্ধগুলো দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের বিবেচনা লাভে সমর্থ হয়। তাঁদের পরামর্শ আমাকে বিশেষভাবে উপকৃত ও উৎসাহিত করে। এই বই বিভিন্ন সময়ে লেখা আমার সেসব প্রবন্ধের সংকলন নয়, তবে সেগুলোর ওপর বহুলাংশে ভিত্তিশীল।
বইটির ব্যাপারে যাঁরা আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন, পরামর্শ ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন, তাঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অধ্যাপক আবদুল গফুর, জনাব মাশীর হোসেন, জনাব শামসুল হক, জনাব আবদুল মান্নান তালিব, জনাব মোহাম্মদ সাখী মিয়া, জনাব মাহবুবুল হক, জনাব আবুল হাসান মাহমুদ ও সহকর্মী জনাব নজরুল ইসলাম খানের কাছে আমি নানাভাবে ঋণী। স্নেহভাজন রাফে সামনানের অব্যাহত তাকীদ না থাকলে আমার পক্ষে এ বইয়ের কাজ এ সময় হাতে নেওয়াই হয়ে উঠতো না। বইটির লেখা থেকে এর প্রুফ দেখা পর্যন্ত সমস্ত কাজে আমাকে সাহায্য করেছেন আমার স্ত্রী মাকসুদা বেগম। আশা প্রকাশনের জনাব আবদুল আউয়াল জাতির প্রতি একটি অঙ্গীকার পোষণ করেন এবং সেই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তিনি আন্তরিক আগ্রহের সাথে এ বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছেন। আশা কম্পিউটারের কর্মীগণ বইটির দ্রুত প্রকাশের সার্বিক সহযোগীতা করেছেন। বন্ধবর হামিদুল ইসলামের প্রচ্ছদ বইটির আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ প্রবীণ ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের কাছে। তিনি আমার সামান্য কাজকে সমাদর করেছেন এবং মুখবন্ধ লিখে বইটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর মূল্যবান মতামত ও মন্তব্য আমার জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।
সকলের এ সার্বিক প্রচেষ্টাকে পিপাসু পাঠক যদি সমাদর করেন, তবেই আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে তৃপ্তিবোধ করবো।
১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪ খ্রি. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান
৩৭ গ্রীন রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা ১২০৫
দ্বিতীয় সংস্করণে লেখকের আরয
আমাদের জাতিসত্তা বিকশিত হয়েছে ইতিহাসের নানা বাঁক পরিবর্তন, মোড় অতিক্রমণ এবং বহু বিচিত্র ক্রান্তিকালীন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। এ বইয়ে আমি ইতিহাসের সেই আঁকা-বাঁকা গতিপথের একটি রেখাচিত্র আঁকার চেষ্টা করেছি। অনেক শুভানুধ্যায়ী বন্ধ এবং চিন্তাশীল পাঠক আমার এই সামান্য কাজকে অসামান্য বিবেচনায় প্রশংসা করেছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে বইটি সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কিছু পাঠকের কাছ থেকেও এ বই সম্পর্কে সাড়া পেয়েছি। ১৯৯৪ সালে এ বই প্রথম প্রকাশের অথি অল্ সময়ের মধ্যে এর সব কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। বইটির পাঠক চাহিদা থেকেও আমি আশ্বস্তবোধ করেছি যে, এ বই লেখার প্রয়োজন ছিল। আমার পরিশ্রম আশাতীত সফল হয়েছে ভেবে আমি উৎসাহিত হয়েছি।
পেশাগত দায়িত্ব পালনে কয়েক বছর দেশের বাইরে থাকার কারণে সময়মতো দ্বিতীয় সংস্করণের কাজে হাত দিতে পারিনি। কিছু পরিমার্জিত ও নতুন কিছু তথ্য সংযোজনের তাকীদ দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ বিলম্বিত করেছে। খুশির কথা যে, জনাব মোহাম্মদ শরীফ হোসেনের আগ্রহ ও উদ্যোগে দারুস সালাম পাবলিকেশন্স থেকে এখন দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে।
বর্তমান সংস্করণে বইটির মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে ভাষা ও বিন্যাসের কিছুটা পরিমার্জিত করেছি। বেশ কিছু নতুন তথ্য এতে সংযোজন করেছি। বইটির ষষ্ঠ অধ্যায়ে বর্ণিত ‘পলাশী যদ্ধের বিজয়োৎসব’রূপে কলকাতায় ‘শারদীয় দুর্গোৎসব’ চালূ হওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে তথ্যশূণ্য কিছু অহেতুক বাদানুবাদ হয়। এ গ্রন্হের তথ্যের ভিত্তিতে একজন মন্ত্রী বক্তৃতা করেন। সে বক্তব্য পত্রিকায় প্রকাশিত হলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের একটি আদালতে মামলা হয়। পরে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। বর্তমান সংস্করণে সে প্রসঙ্গে শ্রীরাধারমণ রায়ের ‘কলকাতা বিচিত্রা’ গ্রন্হের ‘কলতাকাতায় দুর্গোৎসব’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি সংযোজিত হলো। দ্বাদশ অধ্যায়ের ‘ঢাকাকেন্দ্রিক’ বাংলায় জাগরণের ধারা’ উপ-শিরোনামীয় অংশ এবং ত্রয়োদশ অধ্যায়ের ‘গরমিলের রাজনীতির পয়লা দশক’, ‘গরমিলের রাজনীতি; দ্বিতীয় দশক’ এবং ‘উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান’ উপ-শিরোনামের অধীনেও কিছু নতুন সংযোজনী রয়েছে। এসব সংযোজনীর কারণে এবং অক্ষর বিন্যাস ও উপস্থাপনায় কিছু পরিবর্তন আনার ফলে বইটির আয়তন পূর্বের নয় ফর্মা থেকে এখন প্রায় পনেরো ফর্মায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমান সংস্করণ আগের চাইতে সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় করার কাজে যাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন এবং নানাভাবে এ সংস্করণের কাজের সাথে যুক্ত থেকেছেন, তাঁদের সকলকে আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টা কবুল করুন।
১৯ জুলাই ১৯৯৮ মোহাম্মদ আবদুল মান্নান
তৃতীয় সংস্করণে লেখকের আরয
‘আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা’র তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের এ মুহূর্তে আম পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। গ্রন্হটি দেশে-বিদেশে বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে আশাতীত সমাদৃত হয়েছে দেখে আমি উৎসাহ বোধ করছি। আমি আনন্দের সাথে লক্ষ্য করেছি, বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্হটি রেফারেন্স তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। এ গ্রন্হের ওপর ইতোমধ্যে ঢাকা ও কলকাতার বহু পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। অনেক বিদগ্ধজন তাঁদের ব্যক্তিগত মতামতের মাধ্যমে আমাকে উপকৃত ও উৎসাহিত করেছেন। তার মধ্যে জনাব শাহ আবদুল হান্নান ও জনাব এম. আযীযুল হকের নাম এ মুহূর্তে বিশেষভাবে স্মরণ করছি। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলনের প্রাণপুরুষ জনাব এম. আযীযুল হক তাঁর ঢাকার বাসা থেকে একদিন রিয়াদে আমার কর্মস্থলে ফোন করে এ গন্হ সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন জানান। তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল এ রকম : “আমি এইমাত্র আপনার বইটি পড়ে শেষ করলাম। কোনো ব্যাংকের এমডি হয়ে মারা যাওয়ার চেয়ে এ ধরনের একটি বই রেখে মৃত্যুবরণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ”। আমি তাঁর কথা দ্বারা সেদিন গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম।
এ ধরনের উৎসাহের মধ্যেই আমি আমার পেশাগত ব্যস্ততা সত্ত্বেও আমাদের গরীয়ান জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের দু-একটি প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কাজ করঠি। আমি এ কারণেও উৎসাহিত ও আনন্দিত যে, আমাদের দেশের গল্পপ্রিয় অনেক মানুষ এখন আমাদের ইতিহাস এবং জাতীয় ইতিহাসের প্রধান বাঙকগুলো সম্পর্কে জানার জন্য ক্রমেই অধিকতর আগ্রহী ও উৎসুক হয়ে উঠেছেন। এ ব্যাপারে বইপত্রের ঘাটতি পূরণে শিকড়সন্ধানী একদল লেখক-গবেষকও এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ সকল দিক থেকেই সামনে এগোচ্ছে- এটি একটি বড় সুলক্ষণ বলে আমি মনে করি।
‘আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা’র তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশে ‘কামিয়াব প্রকাশন’ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এজন্য এ প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এবং বিশেষভাবে অনুজপ্রতিম মুহাম্মদ হেলাল উদ্দীনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশিষ্ট গবেষক কবি সাংবাদিক বন্ধবর আবদুল মুকীত চৌধুরী এ গ্রন্হটি মুদ্রণের আদ্যোপান্ত দেখে দিয়েছেন। আমি তাঁর কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
১৮ মার্চ, ২০০৬ মোহাম্মদ আবদুল মান্নান