১০
সম্বোধিত ব্যক্তির মন-মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রাখা
একটি চারাগাছের ক্রমবিকাশ এবং ক্রমোন্নতির জন্য শুধু চারাগাছটির যোগ্যতার দিকে নজর রাখলেই চলেনা, বরং যমীনের উর্বরা শক্তি এবং ঋতুর আনুকুল্যের দিকেও দৃষ্টি রাখতে হয়। অনুরূপভাবে দীনে হকের কলেমার দাওয়াত পেশ করার ক্ষেত্রে শুধু হকের প্রকৃত যোগ্যতার ওপরই নির্ভর করা উচিৎ নয়, বরং যেসব লোকের সামনে এই হক পেশ করা হচ্ছে দাওয়াতের সময় মনোস্তাত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে তাদের অবস্থা কিরূপ তাও দেখা উচিৎ। যমীনের মত হৃদয় ও মনের ঋতু আছে। একজন কৃষক যেভাবে ঋতুর সাথে পরিচিত থাকে এবং অনুকুল ঋতুতেই যমীনে বীজ বপন করে, অনুরূপভাবে একজন হকের আহ্বানকারীকেও হৃদয়ের মওসুমের সাথি পরিচিত থাকতে হবে। যেসব লোক এই নীতির পরিপন্থী কাজ করে, চাই তা তার সরলতা বা ভুলের কারণেই হোক অথবা এই ধারনার বশবর্তী হয়ে যে, হক নিজের সৌন্দর্য ও আকর্ষণে মাধ্যমেই হৃদয়ের মধ্যে নিজের স্থান করে নিতে পারবে- এর জন্য অন্য কিচুর বিব্চেনা করার প্রয়োজন নেই- এই ব্যক্তি তার নিজের ভ্রান্তির শাস্তি তার দাওয়াতের ব্যর্থতার মাধ্যমেই পেয়ে যাবে। তার সৎ উদ্ধেশ্য তার এই অতর্কতার পরিণতি থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে না। এজন্য যার কাছে দাওয়াত পেশ করা হচ্ছে তার মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখা একান্ত প্রয়োজন।
সম্বোধিত ব্যক্তির মনোস্তাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করার দশটি নীতি
হকের আহ্বানকারীকে বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের সাথে মেলামেশা করতে হয। তাদের মানসিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে আহ্বানকারীকে বিভিন্নমুখী পন্থা অবলম্বন করতে হয়। এসবের পূর্ণ লক্ষ্য রেখে আহ্বানকারীকে বিভিন্নমুখী পন্থা অবলম্বন করতে হয়। এসবের পূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়া এখানে সম্ভব নয়। কিন্তু নবী –রসূলগণেল কর্মপন্থা থেকে যেস মৌলনীতি আমরা পেতে পারি উদাহরণ স্বরূপ তার কিচু আমরা এখানে উল্লেখ করব। লোকেরা এসব মূলনীতি সামনে রেখে আরো আরো প্রয়োজনীয় মূলনীতি এখান থেকে গ্রহণ করতে পারবে। সাধারণ মানবীয় বুদ্ধির সাথেই এর সম্পর্ক রয়েছে। একজন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন এবং সৎ উদ্দেশ্য প্রনোদিত এবং নিজের উদ্দেশ্যের সাথে সম্যকভাবে পরিচিত আহ্বানকারী যদি এই দৃষ্টান্তগুলো সামনে রাখে তাহলে আশা করা যায়, সে খুব দ্রুত নিজের দাওয়াতের কর্মপন্থাকে নবীদের কর্মপন্থার সাথে সামনঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম হবে। এখানে আমরা যে কয়টি মূলনীতি উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি তার সংখ্যা দশ।
প্রথম মূলনীতিঃ একই জিনিসের বিভিন্ন দিক থাক পারে। কোন কোন দিক থেকে তা সহজবোধ এবং কোন কোন দিক থেকে তা দুর্বোধ্য হতে পারে। সর্বপ্রথম কোন ব্যক্তির সামনে যদি তা সহজবোধ্যভাবে পেশ করা হয় তাহলে সেটা তার কাছে মোটেই অপরিচিত মনে হবে না। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই যদি তা দুর্বোধ্য দিক থেকে পেশ করা হয় তাহলে দাওয়াতকৃত ব্যক্তি তাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পলায়ন করবে। হয়তো সে আর কখনো দাওয়াতকারীর সামনে পড়তে প্রস্তুত হবে না। দানে হকের অবস্থাও কমবেশী এরূপ। একান্ত অপরিচিত ব্যক্তির কাছেও তা কেন কোন দিক থেকে হৃদয়গ্রাহী এবং চিত্তকর্ষক হয়ে থাকে। যদি এই দিক থেকে তার কাছে দীনের দাওয়াত পেশ করা যায় তাহলে সে ক্রমান্বয়ে দীনের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে তার নরম-কঠিন সব কিছুই গ্রহণ করে নেবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিও দীনের কোন কোন দিককে কঠিন এবং ভারবহ মনে করে। যদি এই কঠিন দিক থেকেই তার সামনে দীনকে পেশ করা হয় তাহলে সে এর সাথে আরো অধিক পরিচিত হওয়া তো দূরের কথা, তার পূর্বেকার পরিচিতই ভয় ও আশংকায় পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।
যে ব্যক্তি একটি জিনিসের বিভিন্ন দিক এবং তার মধ্যেকার পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত নয় অথবা সে জানেনা সর্বপ্রথম দাওয়াত পেশ করার সমায় একটি জিনিসকে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির সামনে কোন দিক থেকে পেশ করা উচিৎ, অথবা প্রকৃতিগত ভাবেই তার রুচি হচ্ছে প্রস্তরময় যমীনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সে কঠোরতাকেই পূর্ণ দীনদারী মনে করে- এই ধরনের লোকেরা যখন দীনের দাওয়াতের কাজ হাতে নেয় তখন তাদের দাওয়াতের ফল এই দাঁড়ায় যে, লোকেরা তাদের কাছে আসার পরিবর্তে দূরে পলায়ন করে। এর কারণ হচ্ছে এই যে, তারা দাওয়াত পেশ করার জন্য যে পথ অবলম্বন করেছে তা লোকদের মন-মানসিকতা দিক থেকে সম্পূর্ণ উল্টা। এর দ্বারা সুসংবাদের স্থলে ঘৃণা এবং আকর্ষণের পরিবর্তে অসন্তুষ্টি ছড়ায়। এই জিনিস থেকে বিরত রাখার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (আরবী********) (সুসংবাদ দান কর, ঘৃণা ছড়িও না) এবং হকের আহ্বানকারীদের জন্য সঠিক কর্মপন্থা এই বলেছেন, (আরবী*************) তোমাদের সহজতা সৃষ্টির জন্য পাঠানো হয়েছে, কাঠিন্য আরোপ করার জন্য পাঠানো হযনি)।
দ্বিতীয় মূলনীতিঃ মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এজন আহবানকারীকে দ্বিতীয় যে জিনিসটির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে তা হচ্্যেছ- কোন অবস্থায়ই নিজের দাওয়াতকৃত ব্যক্তির মধ্যে জাহেলিয়াতের দুশমণ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেনা। প্রতিটি হকের আহ্বানকারীকে একথা মনে রাখতে হবে যে, নিজের আকীদা-বিশ্বাসের সাথে আহ্বানকারীর যেরূপ সম্পর্ক রয়েছে প্রতিটি জাতির লোকেরও নিজ নিজ আকীদা-বিশ্বাসের সাথে কমবেশী অনুরূপ সম্পর্ক রয়েছে। এটা যদি ভ্রান্ত সম্পর্ক হয়ে থাকে তাহলে এর সংশোধনের পথ হচ্ছে এই যে, যেসব ভুল ধারণার কারণে এই ভ্রান্ত সম্পর্ক অটুট রয়েছে তা দূর করার অনুসরেণে আবগপ্লুত হয়ে অথবা বাতিলের বিরোধিতা উত্তেজনায় পরাজিত হয়ে এই বাতিল সম্পর্কের আদর্শিক কারণ সমূহের সংশোধন করার পরিবর্তে সরাসরি বাতিল সম্পর্কের ওপর হামলা করা কোন ক্রমেরই ঠিক নয়। এই ধরনের সরাসরি আক্রমণের পরিণতি কেবল এই হয়ে থাকে যে, দাওয়াতকৃত ব্যক্তি জাহেলী দুশমনীর জোশে আত্মহারা হয়ে দাওয়াতের বিরোধিতা করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। এই জোশে সে এতটা অন্ধ-বধির হয়ে যায় যে, হাতের কাছে যে ইট-পাথরই পায় তা তুলে আহ্বানকারীর দিকে নিক্ষেপ করতে থাকে। সূরা আনআমে এরূপ কর্মনীতি থেকে দূরে থাকার জন্য হকের আহ্বানকারীদের তাকিদ করা হয়েছে,
وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ كَذَلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ
“এই লোকেরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত করে তাদের তোমরা গালি দিওনা। অন্যথকায় তারা সীমা লংঘন করে মূর্খতাবশতঃ আল্লাহকেই গালি দিয়ে বসবে। আমরা এভাবেই প্রতিটি মানব মন্ডলীর জন্য তাদের কার্যকলাপকে চাকচিক্যময় করে দিয়েছি।” –(সূরা আনআমঃ১০৮)
এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরো একটি হেদায়াত কুরআন এই দিয়েছে যে, হকের প্রচারকার্যের ক্ষেত্রে গোটা আলোচনা আসল উদ্দেশ্য পর্যন্ত সীমিত রাখা উচিৎ। যদি দাওয়াতকৃত ব্যক্তির তরফ থেকে উষ্কানীমূলক কিছু করা হয়। যার ফলে উভয় দলের অনুসারী এবং নেতাদের মধ্যে আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্ব বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তখন হকের আহ্বানকারীদের কর্তব্য হচ্ছে- বিতর্কের ভ্রান্ত বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে তাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করা চেষ্টা করা এবং দাওয়াকৃত পক্ষের নেতা ও অনুসারীদের হেয় প্রতিপন্ন করার পরিবর্তে বরং তারা মূলত যতটুকু সম্মান পাবার অধিকারী তা তাদের প্রদর্শন করা।
وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوًّا مُبِينًا (53) رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِكُمْ إِنْ يَشَأْ يَرْحَمْكُمْ أَوْ إِنْ يَشَأْ يُعَذِّبْكُمْ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ وَكِيلًا (54) وَرَبُّكَ أَعْلَمُ بِمَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِيِّينَ عَلَى بَعْضٍ وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورً
“আমরা বান্দাদের বলে দাও, তারা যেন সেসব কথাই বলে যা অতি উত্তম। শয়তান তাদের মধ্যে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। নিশ্চিতই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের সম্পর্কে ভালভাবেই অবগত আছেন। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন, আবার ইচ্ছা করলে শাস্তি দেবেন। আমরা তোমাকে তাদের ঈমানের যিম্মাদার করে পাঠাইনি। তোমার প্রতিপালক জমীন ও আসমানের যাবতীয় সৃষ্টি সম্পর্কে ভাল করেই জানেন। আমরা কোন কোন নবীকে কোন কোন নবীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। আর আমরাই দাউদকে যাবুর দিয়েছি।” –(সূরা ইসরাঃ ৫৩-৫৫)
এই হেদায়াতের উদ্দেশ্যও এই যে, যেসব কথা জাহেলিয়াতের শত্রুতার পথে ঠেলে দিতে পারে- হকের আহ্বানকারীকে সেসব কথা পরিহার করে চলতে হবে।
তৃতীয় মূলনীতিঃ যেসব লোক মান-মর্যাদা ও নেতৃত্বের আসনে উপষ্টি থাকার কারণে অন্যদের পক্ষ থেকে নিজেদের জন্য সম্বোধন এবং কথাবার্তায় তাযীম ও সম্মান পেয়ে আসছে এবং আশংকা রয়েছে যে, তার বিরোধিতা করলে তার অহংকারী মনের শয়তান জেগে উঠবে এবং তাকে হক কথা শুনতে বাধা দেবে- এক্ষেত্রে হকের আব্হানকারী একটা বিশেষ সীমা পর্যন্ত তার এই রোগের প্রতি খেয়াল লাখবে যাতে তার নিজের মনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আহ্বানকারীর পক্ষ থেকে কোন নতুন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না পারে। হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে এই দিকটি সামনে রেখে হেদায়াত দান করা হয়েছেঃ
اذْهَبَا إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى () فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى
“ফিরআউনের কাছে যাও। সে অবাধ্য হয়ে গেছে। তোমরা উভয়ে তার সাথে নম্রভাবে কথা বলবে, তাহলে আশা করা যায় সে নসীহত গ্রহণ করবে অথবা ভয় পাবে।” –(সূরা তাহাঃ৪৪)
কিন্তু দাওয়াতকৃত ব্যক্তির পদমর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখারও একটা সীমা আছে। এক্ষেত্রে আহ্বানকারী যে সত্যকে তার সামনে পেশ করছে সেই সত্যের মর্যাদা ও গাম্ভীর্যের সীমা অতিক্রম করা যাবে না। এরূপ খেয়াল রাখতে গিয়ে যদি কোন দিক থেকে সত্যের মাহাত্ম ও মর্যাদায় আঘাত লাগে তাহলে এটা জায়েয হবে না। কুরআনে পরিষ্কারভাবে এ সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
চতুর্থ মূলনীতিঃ একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার যেভাবে রোগীর বয়স, তার মেজাজ প্রকৃতি এবং তার রোগের তীব্রতা ও লঘুত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে তার জন্য পথ্য নির্ধারণ করে, অনুরূপভাবে সত্যের এবঙ আহ্বানকারীরও কর্তব্য হচ্ছে- সে দাওয়াতকৃত ব্যক্তির যোগ্যতা, তার চাহিদা এবং তার ধারণ ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রেখে তার সামনে দাওয়াত পেশ করবে। এই জিনিসের সঠিক অনুমাণ করার জন্য শুধু দাওয়াতকৃত ব্যক্তির ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও ব্যক্তিগত ধারণ ক্ষমতাকেই সামনে রাখলে চলবে না, বরং তার জাতিগত বৈশিষ্ট্য এবং তার ব্যক্তিগত অবস্থার প্রতিও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। এসব জিনিস বিবেচনায় না রাখলে কোন দাওয়াতের সাফল্য আশা করা যেতে পারে না। একারণেই কুরআন মজীদ ক্রমাগতভাবে অল্প অল্প করে নাযিল হয়েছে।
وَقُرْآنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلَى النَّاسِ عَلَى مُكْثٍ وَنَزَّلْنَاهُ تَنْزِيلًا
“আমরা এই কুরআনকে বিভিন্ন সময়ে অল্প অল্প করে নাযিল করেছি- যেন তুমি বিরতি দিয়ে তা লোকদের শুনাও। আর একে আমরা [অবস্থামত] ক্রমশ নাযিল করেছি।” –(সূরা ইসরাঃ১০৬)
অনুরূপভাবে কুরআন থেকে এ কথাও জানা যায় যে, কুরআনী দাওয়াতে অনেক কথা আরবদের নিমজ্জিত মেজাজের দিকে লক্ষ্য রেখে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, তারা যেহেতু অনমনীয় এবং ঝগড়াটে (কাওমান লু্দ্দান) স্বভাবের ছিল, এ কারণে তাদের সাথে কথাবার্তা ও বিতর্কের এমন পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে যা একটি ঝগড়াটে এবং অমনীয় মনোভাবাপন্ন জাতির জন্য উপযুক্ত ছিল। অনন্তর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অ সাল্লাম গ্রাম অঞ্চল থেকে আগত লোকদের সামনে যে ভংগীতে দীনে হকের দাওয়াত পেশ করতেন- তা মক্কা- মদীনার লোকদের সামনে দীনের দাওয়াত পেশ করার ভংগী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। আবদুল কায়ে গোত্রের প্রতিনিধিদল তাঁর কাছে অভিযোগহ করল, আমাদের এবং আপনাদের মাঝখানে কোরাইশ বংশ প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। তাদের শত্রুতার কারণে হারাম মাসগুলে (মুহাররম, রজব, যিলকাদ ও যিলহজ্জ) ছাড়া অন্য কোন মাসে আপনার কাছে আসতে পারি না। এ কারণে আমাদের এমন কয়েকটি মৌলিক কথা বলে দিন যা আমরা নিজেরাও অনুসরণ করব এবং অন্যদেরও তার দাওয়াত দেব। রসূলুল্লাহ (সা) তাদের প্রযোজন এবং অবস্থাকে সামনে রেখে মাত্র চারটি জিনিস করার নির্দেশ দেন এবং চারটি জিনিস থেকে বিরত থাকতে বলেন। তিনি আরো বললেন, নিজের কওমের লোকদেরও এগুলো করতে বলবে এবং এগুলো থেকে বিরত রাখবে। এর অধিক কিছু তিনি তাদের সামনে বলেননি।
একথা সুষ্পষ্ট যে, দাওয়াতের পদ্ধতির এই পার্থক্য কেবল এই সব দলের মনোস্তাত্ত্বিক পার্থক্যের ভিত্তিতে ছিল। যাদের মধ্যেকার পার্থক্যটা স্বাভাবিক পর্যাযের এবং যারা সহজ-সরল প্রকৃতির ছিল তাদের সামনে দীনের সহজ-সরল শিক্ষা পেশ কর া হত যাতে তারা এর ওপর আমল করতে পারে। পক্ষান্তরে যারা জটিল প্রকৃতির লোক তাদের মন-মগজেকে পরিষ্কার করার জন্য একটি উপযুক্ত ক্রমধারা অনুযায়ী অবিরতভাবে দাওয়াত দিয়ে যাওয়া হত।
পঞ্চম মূলনীতিঃ একজন কৃষকের জন্য যেভাবে যমীনকে তৈরী না কর এবং অনুকূল ঋতু ছাড়া বীজ বপন করা ঠিক নয় এবং যেভাবে একজন ডাক্তারের জন্য মুমুর্ষূ অবস্থায় রোগীকে ঔষধ দেয়া ঠিক নয়- অনুরূপভাবে দাওয়াতকৃত ব্যক্তি যখন প্রতিবাদ, প্রতি উত্তর ও সমালোচনার দিকে ঝুঁকে পড়ে তখন হকের আহ্বানকারীর কর্তব্য হচ্ছে এ সময় তার সামনে দাওয়াত পেশ না করা। শুধু এ অবস্থায়ই দাওয়াত পেশ করা থেকে বিরত থাকা জরুরূ নয় বরং যদি দাওয়াত পেশ করার পরও দাওয়াতকৃতি ব্যক্তি প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে- তখন দাওয়াত দানকারীর কর্তব্য হচ্ছে- বাদ- প্রতিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করার পরিবর্তে তাকে এখানেই শেষ করে সেখান থেকে সরে পড়া এবং উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষ করা। দাওয়াতকৃত ব্যক্তি যখন উন্মুক্ত মনের অধিকারী হয়ে যাবে অন্তত পক্ষে বাদ-প্রতিবাদ করার প্রবণতা দূরীভূত হবে তখন তার কাঠে পুনরায় দাওয়াত পেশ করতে হবে।
وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
“যখন দেখ যে, এই লোকেরা আমার আয়াত সমূহের দোষ সন্ধান করছে তখন তাদের নিকট থেকে সরে যাও, যতক্ষণ না তারা এই প্রসংগের কথাবার্তা বন্ধ করে অপর কোন প্রসংগে মগ্ন হয়। আর যদি কখনো শয়তান তোমাকে এ কথা ভুলিয়ে দেয় তাহলে তা স্মরণ হওয়ার পর এই যালেমদের সাথে বসনা।” (সূরা আনআমঃ৬৮)
এরূপ পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা বর্তমান থাকার পরও আশ্চর্য লাদে আমাদের আলেম সমাজ দীনের প্রচারের জন্য বিতর্ক-বাহারেস পন্থাকে কি করে জায়েয মনে করতে পারল! অথচ উভয় দল কেবল এই উদ্দেশ্যেই পরস্পরের মুখামুখী হয় যে, নিরেজ প্রতিপক্ষের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান এবং মিথা সাব্যস্ত করতে হবে- তা আসলে সত্যই হোক না কেন। যাদের বিতর্ক-বাহাসের অনুষ্ঠান সম্পর্কে কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে তারা জানে যে, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কেবল প্রতিপক্ষতে হেয় প্রতিপন্ন করা বিকৃত রুচিই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এ সম্পর্কে কুরআনের নির্দেশ হচ্ছে এই যে, এ ধরনের গন্ধ অনুভব করার সাথে সাথে হকের আহ্বানকারী সসম্মানে সরে পড়বে। কিন্তু আমাদে পেশাদার তার্কিকদেরকে এই গন্ধ এতটা প্রভাবিত করে রেখেছে যে, এই গন্ধ যতই বৃদ্ধি পেথে থাকে- তাদের আগ্রহ ও উৎসাহ ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ষষ্ঠ মূলনীতিঃ যে ব্যক্তির কাছে দীনের দাওয়াত পেশ করা হবে, সে যদি নিজের কোন আকর্ষণীয় ব্যাপারে এতটা নিমগ্ন থাকে যে, তা থেকে পৃথক হয়ে হকের দাওয়াতের দিকে মনোযোগ দেয়া তার কাছে বিরক্তিকর ঠেকবে- এরূপ ক্ষেত্রে হকের আহ্বানকরী তার কাছে দাওয়াত পেশ করা থেকে বিরত থাকবে। যদিও এই অবস্থাটি হিংসা-বিদ্বেষ এবং বিরোধিতার অবস্থা থেকে ভিন্নতর, কিন্তু দাওয়াতকৃত ব্যক্তির মানসিক অপ্রস্তুতির দিক থেকে বিচার করলে এই দু‘টি অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছেঃ (আরবী**********)
“ইকরামা থেকে বর্ণিত। ইবন আব্বাস (রা) আমাকে বললেন, সপ্তাহে মাত্র একদিন লোকদের জন্য ওয়াজ-নসীহত কর। এতে যদি রাজী না হও তাহলে (সপ্তাহে) দুই দিন, এতেও যদি সন্তুষ্ট না হও তাহলে (সপ্তাহে) তিন বার। মোট কথা কুরআনকে মানুষের কাছে বিরক্তিকর করে তুল না। আর এরূপ যেন না হয় যে, তুমি লোকদের কাছে পৌছবে, তখন তারা নিজেদের কোন আলোচনায় মশগুল থাকবে, আর তুমি তাদের নিকট ওয়াজ শুরু করে দেবে এবং তাদের আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করে তাদের বিরক্তি উৎপাদন করবে। বরং এ সময় তুমি চুপ করে থাকবে। যখন তারা তোমার প্রতি আকৃষ্ট হবে তখন তাদেরকে উপদেশ দাও। তাহলে তারা আগ্রহ সহকারে তোমার কথা শুনবে।”
সপ্তম মূলনীতিঃ হকের আহ্বানকারীকে এ দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে য, দাওয়াতের নিরস আবেদন, তার অপ্রয়োনীয় আলোচনা এবং তার মূল্যহীন দীর্ঘ বক্তব্যের যেন শ্রোতার মধ্যে বিরক্তি উৎপাদন না করতে পারে।
(আরবী************)
“শাকীক [তাবেঈ] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) প্রতি বৃহস্পতিবার লোকদে ওয়াজ-নসীহত করতেন। এক ব্যক্তি তাঁকে বলল, হে আবু আবদুর রহমান। আমার আকাংখা ছিল আপনি যদি প্রতিদিন আমাদের জন্য ওয়াজ-নসীহত করতেন; তিনি উত্তরে বললেন, এরূপ করা থেকে আমাকে এ কথাই বাধা দিয়ে থাকে যে, আমি তোমাদের বিরক্তি উৎপাদন করাকে পছন্দ করিনা, এজন্য আমি বিরতি দিয়েই তোমদের সামনে ওয়াজ করে থাকি। যেমন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বিরক্তির ভয়ে মাঝে মধ্যেই আমাদের ওয়াজ-নসীহত করতেন।” –(বুখারী, মুসলিম)
এই কথাগুলো লেখার সময় আমাদের সামনে এক ধরনের বক্তা ও তাদের দুর্ভাগা এবং মজলুম শ্রোতাদের একটি চিত্র ভেসে উঠেছে। তাদের ওয়াজের সবচেয়ে বড় নৈপূন্য হচ্ছে তাদের অর্থহীন বক্তব্যের দীর্ঘ সূত্রিতা। তারা এই মোটা কথাটুকু সম্পর্কেও অবহিত নয় যে, সর্বোত্তম কথাও নিষ্প্রয়োজনে বারবার পুনরাবৃত্তি করলে বিস্বাদ হয়ে যায় এবং ওয়াজ শুনানোর জন্য লোকদের পেছনে লেগে যাওয়াতে কেবল দীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যই ব্যবহুদ হয়না বরং উল্টো এর দ্বারা দাওয়াতের উদ্দেশ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রসূল (সা) এবং তাঁর সাহাবীগণ লোকদেরকে বিরতি দিয়ে ওয়াজ-নসীহত করতেন যাতে লোকেরা বিরক্তি বোধ করতে না পারে। তাঁর ভাষণ হত অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। অনন্তর হাদীসের বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বলেছেন, “তোমরা যখন ওয়াজ-নসীহত কর তখন তা সংক্ষিপ্ত কর।” আবার কোন কোন বর্ণনায় আছে, তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষণকে বক্তার প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন সাব্যস্ত করে বলেচেন, “কোন কোন বক্তৃতায় যাদুকরী আকর্ষণ রয়েছে।” একথা বলে ইংগিত করা হয়েছে যে, বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত এবং তাৎপর্যপূর্ণ হতে হবে, যাতে তা অন্তরের ওপর যাদুর মত প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বক্তৃতা এমন হওয়া উচিৎ নয় যা শ্রোতার মেজাজ ও স্বভা-প্রকৃতিকে ভোঁতা করে দিতে পারে। ফলে তার মধ্যে কোন কথা শুনা এবং তা গ্রহণ করার কোন যোগ্যতাই অবশিষ্ট থাকবে না।
অষ্টম মূলনীতিঃ হকের আহ্বানকারীকে অত্যন্ত সতর্কতার ও যোগ্যতার সাথে নিজের আশে পাশের পরিবেশ মূল্যায়ন করতে হবে। কখন দাওয়াতের বীজ বপণ করার উপযুক্ত সময় হাতে এসে যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যখনেই সে অনুভব করতে পারবে যে, তার উদ্দেশ্য সাধনের কোন সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গেছে- তখনই আর বিলম্ব না করে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে। এর সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হযরত ইউসুফ আলাইহি সালামের জীবন-চরিত্রে পাওয়া যায়ঃ
وَدَخَلَ مَعَهُ السِّجْنَ فَتَيَانِ قَالَ أَحَدُهُمَا إِنِّي أَرَانِي أَعْصِرُ خَمْرًا وَقَالَ الْآخَرُ إِنِّي أَرَانِي أَحْمِلُ فَوْقَ رَأْسِي خُبْزًا تَأْكُلُ الطَّيْرُ مِنْهُ نَبِّئْنَا بِتَأْوِيلِهِ إِنَّا نَرَاكَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ (36) قَالَ لَا يَأْتِيكُمَا طَعَامٌ تُرْزَقَانِهِ إِلَّا نَبَّأْتُكُمَا بِتَأْوِيلِهِ قَبْلَ أَنْ يَأْتِيَكُمَا ذَلِكُمَا مِمَّا عَلَّمَنِي رَبِّي إِنِّي تَرَكْتُ مِلَّةَ قَوْمٍ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَهُمْ بِالْآخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ (37) وَاتَّبَعْتُ مِلَّةَ آبَائِي إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ مَا كَانَ لَنَا أَنْ نُشْرِكَ بِاللَّهِ مِنْ شَيْءٍ ذَلِكَ مِنْ فَضْلِ اللَّهِ عَلَيْنَا وَعَلَى النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَشْكُرُونَ (38) يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ (39) مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ (40) يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَمَّا أَحَدُكُمَا فَيَسْقِي رَبَّهُ خَمْرًا وَأَمَّا الْآخَرُ فَيُصْلَبُ فَتَأْكُلُ الطَّيْرُ مِنْ رَأْسِهِ قُضِيَ الْأَمْرُ الَّذِي فِيهِ تَسْتَفْتِيَانِ
“তার সাথে আরো দুজন যুবক জেলখানায় প্রবেশ করে। তাদের একজন বলল, আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি মদ প্রস্তুত করছি। অপরজন বলল, আমি দেখি যে, আমার মাথার ওপর রটি রাখা আছে, আর পাখি তা খাচ্ছে। আমাদেকে এর ব্যাখ্যা বলে দিন। আমরা দেখছি আপনি একজন সদাচারী লোক। ইউসুফ বলর, এখানে তোমরা যে খাবার পাও তা আসার পূর্বেই এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেব। আমার প্রতিপালক আমাকে যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন এটা তারই অংশ। আসল কথা এই যে, যারা আল্লাহর ওপর ঈমান আনেনা এবং আখেরাতকে অস্বীকার করে- আমি তাদের ধর্ম পরিত্যাগ করেছি। আমি আমার পূর্বপূরুষ ইবরাহীম, ইসাহক ও ইয়াকুবের ধর্ম অনুসরণ করছি। আল্লাহর সাথে কোন জিনিসকে শরীক করা আমাদের জন্য শোভণীয় নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহর অনুগ্রহ আমাদের ওপর এবং সমগ্র মানব জাতির ওপর (যে, তিনি আমাদেরকে অন্য কারো দাসানুদাস বানাননি)। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তার প্রতি কৃতজ্ঞ নয়। হে কয়েদখানার সংগীরা! তোমরা নিজেরাই ভেবে দেখ, বহু সংখ্যক খোদা বানানো ভাল না সেই আল্লাহকে গ্রহণ করা ভাল যিনি সব কিছুর ওপর বিজয়ী? তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের ইবাদত কর তারা কয়েকটি নাম ছাড়া আর কিছুই নয়- যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরূষরনা রেখে নিয়েছে। আল্লাহ তাদের জন্য কোনই সনদ নাযিল করেননি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না। এটাই হচ্ছে প্রকৃতিগত ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানেনা। হে জেলখানর দুই বন্ধু! তোমাদের মধ্যে একজন তো নিজের মনিবকে শরাব পান করাবে, আর অপরজনকে তো শূলে (ফাঁসি) দেয়া হয়ে এবং পাখিরা তার মস্তক ঠুকরে ঠুকরে খাবে। তোমরা যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করছিলে তার ফয়সালা হয়ে গেছে।” –(সূরা ইউসুফঃ৩৬-৪১)
এরওপর এক নজর তাকিয়ে ঘটনার পুরা চিত্র কল্পনার চোখের সামনে নিয়ে আসা যাক। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সাথে দুই ব্যক্তি জেলখানায় বন্দী হয়। উভয় স্বপ্ন দেখে। তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার কৌতুহল জাগে। গোটা জেলখানার লোকদের মধ্যে যে কোন দিক থেকে কেবল ইউসুফ আলাইহিস সালামই তাদের দৃষ্টিগোচর হয়, যাঁর কাছে তারা এ উদ্দেশ্য নিয়ে হাযির হতে পারে। অতএব সাধারণা ও সম্মানের আবেগ সহকারে তার নিজেদের স্বপ্ন তাঁর কাছে খুলে বলে। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাদের সপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েই বিদায় দেননি বা সুধারণার আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের ওপর নিজের ব্যক্তিগত কামালিয়াতের প্রবাব জমানেরও চেষ্টা করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করেননি। বরং তাদের এই আকর্ষণকে গণীমাত মনে করে তিনি তাদের সামনে দীনের দাওয়াত পেশ করেন যা তাদের অন্তরে স্থান করে নিতে সক্ষম।
আবার অপর দিকে দীনকে এমন ভংগীতে পেশ করেছেন যেন প্রসংগক্রমে কথাবার্তার মধ্যে দীনের কথাও এসে গেছে। ইচ্ছাপূর্বক কথা বলার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। এই ঘটনা থেকে আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য এসে যায়। তা হচ্ছে একজন কৃষক বীজ বপন করার জন্য বৃষ্টির অপেক্ষায় যেভাবে ওৎ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে অনুরূপভাবে হকের আহ্বানকারীকেও তার চারপাশের পরিবেশের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কখন কার অন্তরে তার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে যায়- যা তার দাওয়াতের বীজ বপন করার জন্য অনুকুল ঋতুর কাজ দিতে পারে।
দ্বিতীয়ত আরো জানা যায়, আল্লাহ তাআলার অনু্গ্রহে কেউ যদি কখনো এরূপ সুযোগ পেয়ে যায় তাহলে এই সুযোগ নষ্ট করাও ঠিক নয় এবং দাওয়াতের মহৎ উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য তাকে ব্যবহার করাও জায়েয নয়। এই ধরনের সযোগ যখন কোন স্বার্থপর লোকেরা হাতে এসে যায় তখন সে তাকে দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করার পরিবর্তে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের উপায়ে পরিণত করার চেষ্টা করে। বর্তমন যুগে আমাদের আলেম সমাজ এবং পীর মাখায়েখ গণ সাধারণভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে আছেন। তারা যখন কাউকে নিজের দিকে আকৃষ্ট দেখতে পান তখন তারা খুব আনন্দ অনুভব করেন। কিন্তযু তাদের আনন্দের প্রকৃতিটা হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের আানন্দের প্রকৃতি থেকে ভিন্নতর। বরং তাদের আনন্দকে একট মাকড়শার আনন্দের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মাকড়শা নিজের চারপাশে জাল বিস্তার করে মাছির আগমনের আশায় অপেক্ষা করতে থাকে। যখন সে কোন মাছিকে নিকটে আসতে দেখে তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচতে শুরু করে-একটি মোটা তাজা শিকার হাতে এসে গেছে।
নবম মূলনীতিঃ হকের প্রতিটি আহ্বানকারীকে আলোচনা ও যুক্তি-প্রমাণ পেশ করার সময় দাওয়াতকৃত ব্যক্তির যোগ্যতার ও স্তরের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন বুদ্ধিজীবী সমাজকে যে ভংগীতে এবং যে ভাষায় আহ্বান করা হবে, সাধারণ পর্যায়ের লোকদের আহ্বান করার ক্ষেত্রে তার ভাষা ও ভংগী ভিন্নতর হবে। হকের আহ্বানকারীর জন্য নিছক এই ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, তার সাথেই পূর্ণ হক রয়েছে, অতএব আর যেসব দলের সাথে পূর্ণ হক নেই- তাদের সবাইকে এক কাতারে শামিল করে হাঁকিয়ে বেড়ানো মোটেই সংগত নয়। বরং তার কর্তব্য হচ্ছে- প্রতিটি দলের সঠিক মূল্যায়ন করে যায় যে মর্যাদা নিরূপিত হয় তাকে সেই স্থানে রেখে দেয়া এবং তদনুযায়ী তাদের সামনে দাওয়াত পেশ করা। যেমন আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের সামনে দাওয়াত পেশ করার জন্য কুরআন মজীদ নিম্নোক্ত হেদায়াত দান করেছেঃ
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ وَقُولُوا آمَنَّا بِالَّذِي أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَأُنْزِلَ إِلَيْكُمْ وَإِلَهُنَا وَإِلَهُكُمْ وَاحِدٌ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ
“আর উত্তম পন্থা ছাড়া আহলে কিতা সম্প্রদায়ের সাথে বিতর্ক করনা। তবে তাদে মধ্যে যারা যালেম তাদের ব্যাপারে স্বতন্ত্র কথা। তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি সেই জিনিসের ওপর যা আমাদের কাছে নাযিল হয়েছে এবং সেই জিনিসের ওপরও যা তোমাদের কাছে নাযিল করা হয়েছে। আমাদে ইলাহ এবং তোমাদের ইলাহ একই। আমরা তাঁরই অনুগত।” –(সূরা আনকাবুতঃ৪৬)
এখানে যে সর্বোত্তম পন্থায় আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের সাথে বিতর্ক ও আলোচনা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে তার পন্থাও বলে দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে- যেসব দিক থেকে তারা তোমাদের সম-মর্যাদা সম্পন্ন অথবা যেসব বিষয়ে তাদের ও তোমাদে মধ্যে অংশীদারিত্ব রয়েছে তার স্বীকার করে নাও। তাহলে তাদের এবং তোমাদের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়ার পরিবর্তে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা এবং দুরত্বের পরিবর্তে নৈকট্য সৃষ্টি হবে। অতপর তাদের কাছে দাবী করতে হবে যে, এই স্বীকৃত সত্যের ভিত্তিতে যেসব জিনিস মেনে নেয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে সে ব্যাপারেও যেন তারা আমাদের সাথে একমত হয়ে যায়।
দাওয়াতকৃত ব্যক্তির ওপর দাওয়াতের এই পন্থার মনোস্তাত্ত্বিক প্রভাব এই হবে যে- সে যখন দেখতে পাবে, আহ্বানকারী নিজেকে বিরাট কিছু মনে করছে না এবং নিজের দাওয়াতকেও কোন নতুন আবিষ্কার হিসাবেও পেশ করছে না, বরং এই দাওয়াতে তা যতটুকু অংশ রয়েছে তাও সে স্বীকার করে নিচ্ছে- তখন সে এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার দিকে অগ্রসর হবে। যদি সে হঠকারী, একগুঁয়ে এবং অবাধ্য না হয়ে থাকে তাহলে দাওয়াতকে কবুল করেও নিতে পারে। যদি এরূপ না করা হয়, বরং বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং আহলে কিতাব সম্প্রদায়কেও মূর্খ ও অশিক্ষিতদের মত একই ভংগীতে সম্বোধন করা হয়, তাহলে যারা আহবান –করীর মতই জ্ঞান, প্রজ্ঞিা এবং আসমানী কিতাবের দাবীদার- স্বাভাবিকভাবেই তাদে মান-সম্ভ্রমবোধ আহত হবে। আর এ জিনিসটি হককে গ্রহণ করার পথে মারাত্মক প্রতিবদ্ধকতার সৃষ্টি করবে।
দশম মূলনীতিঃ হকের আহ্বানকারী যদি আহ্বানকৃত ব্যক্তির মধ্যে অবাধ্যতা, অনমনীয়তা এবং তঠকারিতার আভাস পায় তাহলে সে যেন নিজের পক্ষ থেকে এই রোগ বৃদ্ধির কোন সুযোগ সৃষ্টি করে না দেয়। বরং তার থেকে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। এমনকি সম্বোধিত ব্যক্তি যদি আহ্বানকারীর কোন যুক্তি- প্রমানের ওপর এমন বিরোধিতা করে বসে যা প্রকাশ্যতই ঝগড়া ছাড়া আর কিছুই নয়- তাহলে এই যুক্তির পেছনে পড়ে যাওয়া এবঙ এর পক্ষে আরো যুক্তি পেশ কর র পরিবর্তে তার সামনে অন্য দিক থেকে হককে পেশ করার কৌশল অবলম্বন করা উচিৎ- যাতে সে নিজের হঠকারিতা প্রকাশ করার যুযোগ না পায়। বরং তার মধ্যে যদি সত্যকে গ্রহণ করার যোগ্যতা থাকে তাহলে সে তা কবুল করে নেবে। আর যদি শুধু হঠকারীই হয়ে থাকে তাহলে অন্তত হতভম্ব হয়ে থেকে যাবে, বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ করার সুযোগ পাবে না। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং এক বাদশার মধ্যে অনুষ্ঠিত বিতর্কের কথা কুরআন মজীদে উল্লেখ আছে । এটা এক্ষেত্রে সর্বোত্তম উদাহরণঃ
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
“তুমি সেই ব্যক্তিকে দেখনি, যে ইবরাহীমের সাথে তার রব সম্পর্কে এই কারণে বিতর্কে লিপ্ত হতে সাহস পেয়েছে যে, আল্লাহ তাকে রাজত্ব দান করেছেন? ইবরাহীম যখন তাকে বলল, তিনিই হচ্ছেন আমার রব যিনি জীবিত করেন এবং মারেন। সে বলল, আমিই মৃত্যু ঘটাই এবং জীবিত রাখি। ইবরাহীম বলর, আল্লাহ পূর্বদিক থেকে সূর্য উদিত করেন। তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে উদিত করে দেখাও তো। এতে কাফের ব্যক্তি লা-জওয়াব হয়ে গেল। আল্লাহ যালেমদের হেদায়াত করেন। না।” –(সূরা বাকারাঃ ২৫৮)
হযরত ইবরাহীম আলাইহিম সালাম যে দলীল পেশ করেছিলেন, প্রতিবাদকরীর প্রতিবাদের দরুন তার সামান্যও ক্ষতি হতনা। তিনি ইচ্ছা করলে এরপর আরো অনেক কিছু বলতে পারতেন। কিন্তু দাওয়াতকৃত ব্যক্তির মনোস্তাত্ত্বিক অবস্থা অনুমান করে নেয়ার পর যদি তিনি এর ওপর আরো বক্তব্য রাখতেন তাহলে সেটা কুরআন মজীদের শিখিয়ে দেয়া পদ্ধতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী হতঃ
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
“তোমরা রবের পথে ডাক বুদ্ধিমত্তার সাথে ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে সর্বোত্তম পন্থায় বিতর্কে লিপ্ত হও।” –(সূরা নহলঃ১২৫)