৭.
দাওয়াতের পদ্ধতি
কোন কোন ধর্মীয় মহলে আল্লাহ জানেন কোথা থেকে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে, তাবলীগরে আদর্শিক এবং নবীদের অনুসৃত পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, হাতে একটি লাঠি এবং ঝোলায় কিছু চানা বুট নিয়ে দীন প্রচারের জন্য বের হয়ে পড়তে হবে। পায়ে জুতাও থাকবেনা, মাথায় টুপিও থাকওবেনা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে এবং কোথাও কোন লোক পাওয়া গেলে তার কাছে তাবলীগ শুরু করে দেবে- চাই সে শুনুক বা না শুনুক। কোন শহরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় যদি কোন স্থানে বা চৌরাস্তার মোড়ে দু-চার ব্যক্তিকে জমায়েত পাওয়া যায় তাহলে তাদের সামনে ওয়াজ নসীহত শুরু করে দিতে হবে। রেলের কামরায়, স্টেশনে, বাজারে, রাস্তার ওপর যেখানেই ভীড় দেখা যাবে সেখানেই তারা ওয়াজ শুরু করে দেবে। যে কোন সভায় ঢুকে পড়বে, প্রতিটি সম্মেলনে নিজের স্থান করে নেবে, যে কোন মঞ্চ উঠে তাদের পশ্চাদ্ধাবনে লোকেরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু তারা খোদার বাহিনী হয়ে তাদের প্রত্যেকের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বসবে। লোকেরা তাদের সওয়াল জওয়াবের ভয়ে আত্মগোপন করে ফিরবে, বরং কখনো কখনো বিরক্ত হয়ে বেয়াদবী ও খারাপ ব্যবহার করে বসবে, কিন্তু তারা জোশ ও ব্যস্ততার সাথে নিজেদের কাজ জারী রাখবে। যেখানে ওয়াজ করার আড্ডা হবে সেখানে ওয়াজ করে দেবে। যেখানে মীলাদ পড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করা হবে সেখানে মীলাদ পড়িয়ে দেবে। যেখানে বিরুদ্ধবাদীদের সাথে বিতর্কযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে সেখানে বিতর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে।
এই হচ্ছে তাবলীগের আসল পন্থা, এই হচ্ছে একজন সত্যনিষ্ঠ মুবাল্লিগের দৃষ্টিভংগী- যা আমাদের অনেক দীনদার লোকের মন মস্তিষ্কে বিদ্যমান রয়েছে। তাবলীগ এবং তালীমের বর্তমান উন্নত ও বৈজ্ঞানিক পন্থার কিছুটা উপারিতার কথা তারা অস্বীকার করেনা বটে; কিন্তু তাদের মতে কল্যাণ ও বরকতপূর্ণ পন্থা হচ্ছে তাই- যা তাদের খোশখেয়াল অনুযায়ী নবী-রসূলগণ অবলম্বন করেছিলেন।
আমাদের মতে এই পন্থাকে নবীদের পন্থা মনে করার কিছুটা কারণ নবীদের পন্থা সম্পর্কে তাদে অনভিজ্ঞতার ফল, আর কিছুটা তাদের খাহেশ যে, তাদে গৃহীত পন্থা(যে পন্থা ছাড়া অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করার যোগ্যতা থেকে তারা বঞ্চিত) একটি মর্যাদাপূর্ণ এবং পবিত্র পান্থা বলে প্রমানিত হয়ে যাওয়া। নবীদের তাবলীগের পন্থা সম্পর্কে আমরা যতদূর অধ্যয়ণ করেছি তাতে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, নবী-রসূলগণ তাবলীগের যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা তাঁদের যুগের বিচারে অত্যন্ত উন্নত এবং সবোত্তম ছিল। আর এই পদ্ধতি পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে পরিবর্তনও হতে থাকে। মতা একথাই প্রমাণ করে যে, এব্যাপারে কোন একটি পদ্ধতির ওপর অবিচল থাকা ঠিক নয়। বরং হকের সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করবে যা তাদের সময় আবিষ্কৃত হয়েছে এবং যা অবলম্বন করে তারা নিজেদের শ্রমসাধনা এবং যোগ্যতাকে অধিক ফলপ্রসূ বানাতে পারে।
জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে দাওয়াতের পদ্ধতিও উন্নতি হয়েছে
এক্ষেত্রে সর্বাধিক বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম দাওয়াতের কোন একটি পদ্ধতির ওপর নির্ভর করেননি। রং যে গতিতে দুনিয়ায় জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি হতে থাকে, তদানুযায়ী তাঁদের প্রচার ও প্রশিক্ষণের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে। সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে যখন লেখা-পড়ার কলাকৌশল অস্তিত্ব লাভ করেনি, তখন নবীদের প্রচার ও প্রশিক্ষণও মৌখিক ভাবে চলতে থাকে। নেকী ও সত্যবাদিতার কতিপয় মূলনীতি তাঁরা লোকদের মুখে মুখে শিক্ষা দিতেন এবং তারা তা মুখস্ত করে নিত। এগুলো বংশ পরমপরায় বর্ণনার আকারে তার অনুসারীদের কাছে পৌঁছে যেত। অবশেষে যখন তা কালের প্রবাহে বিলীন হয়ে যেত অথবা এর সাথে অন্য কিচুর সংমিশ্রণ ঘটত, তখন আল্লাহ তাআলা কোন নবী পাঠাতেন। তিনি এসে এই শিক্ষাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে জীবন্ত করে তুলতেন। যতদিন লেখা-পড়ার কলা-কৌশল উদ্বাবিত হয়ীন, তাবলীগের ব্যাপারে কেবল ব্যক্তিগতহ সহযোগ, মৌখিক প্রকাশ, বর্ণনা এবং শ্রোতার স্মরণ শক্তির ওপর নির্ভর করতে হত। কিন্তু লোকেরা যখন লেখার কৌশল উদ্ধাবন করতে সক্ষম হল এবং অন্যদের কাছে কোন জিনিস পৌছাতে এবং তাদের মধ্যে সংরক্ষণ করার একটি উন্নততর পন্থা আবিষ্কৃত হল- তখন নবীগণও এই পন্থা অবলম্বন করলেন। সুতরাং হযরত মুসা আলাইহিস সালাম মৌখিক ভাবে শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে তাওরাতের নির্দেশসমূহ তাঁর জাতির লোকদের তক্তার ওপর লিখে দিতেন। অনুরূপভাবে আরবদেরকে কলমের সাহায্যে লিখিত আকারে দীনের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই ইহসানের কথা উল্লেখপূর্বক বলেছেন যে, তাদেরকে মৌখিকভাবে শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে লেখনির মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এটা শিক্ষঅ ব্যবস্থার একটি উন্ন ত এবং সুরক্ষিত উপায়। পবিত্র কুরআনের বাণীঃ
اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ
“তুমি পড়। তোমার রব অত্যন্ত দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন যে সম্পর্কে তারা অনবহিত ছিল।।” (সূরা আলাকঃ৩-৫)
এ আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যাচ্ছে যে, এটা আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি মানুষকে কলম ব্যবহারে কায়দা শিখিয়েছেন এবং এই উন্নত পদ্ধতিকে দীনের প্রাচার ও প্রশিক্ষণের উপায়ে পরিনত করেছেন। এর ফলে তারা আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বড় নিআমত কুরআনে অধিকারী হয়েছে। মৌখিক শিক্ষা পদ্ধতির তুলনায় কলম এবং পুস্তক ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির যে শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে- কুরআনও বিভিন্ন স্থানে সেদিকে ইংগিত করেছে। এ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার স্থান এটা নয়। এখানে আমরা যে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে চাই তা হচ্ছে এই যে, নবীদের প্রবর্তিত তাবলীগের পদ্ধতি কোন নিশ্চল, নিষ্প্রাণ এবং গতিহীন পদ্ধতি নয়। বরং মানব জাতির মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির সাথে সাথে এর মধ্যেও পরিবর্তন ও উন্নতি হতে থাকে। বিজ্ঞান এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষের কাজের উপায় উপকরণ এবং জানার মাধ্যমেও পরিবৃদ্ধি ঘটেছে। হকের আহ্বানকারীগণই এ থেকে সর্বপ্রথম এবং সর্বাধিক লাভবান হওয়ার অধিকারী। নবীদের কর্মনীতি সেদিকেই ইংগিত করেছে। যেমন, আজকের যুগে রেডিও টেলিভিশন, সিনেমা, মুদ্রণযন্ত্র ইত্যাদি মানুষের প্রচার প্রোপাগান্ডা ও প্রশিক্ষণের শক্তিকে কোন্ পর্যায় থেকে কোন্ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। ছোট-বড় যে কোন ধরনের বক্তব্য কয়েক মিনিটের মধ্যে দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে নিয়ে অপরপ্রান্তে পৌছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। যে কোন বৃহত্তর আন্দোলন সম্পর্কে গোটা বিশ্বের সচেতন লোকদের কয়েক দিনের মধ্যেই অবহিত করা যায়। কঠিন থেকে কঠিনতর বক্তব্য অতি সহজে সাধারণ বিশেষ-নির্বিশেষে সবাইকে বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। এই যুগে বাতিল পন্থীরা এসব উপায়-উপকরণকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের যে কোন বাতিলকে ইচ্ছামত বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের বর্তমানি আবিষ্কার সমূহ দূরত্বের পরিধি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। দুই জাতির মাঝখানের অলংঘনীয় পাহাড় এবং সমুদ্রের ব্যবধান আজ কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধক নয়। গতকাল পর্যন্ত একজন শিক্ষক তার সামনে উপস্থিত ছাত্রদের নিজের কথা যেভাবে শুনাত, আজ ইচ্্যছা করলে নিজের কথা গোটা দুনিয়ার মানুষকে একই সময় শুনানো যেতে পারে। গতকাল পর্যন্ত যে জিনিস মাসের পর মাস শিক্ষা দিয়েও হৃদয়ংগম করানো সম্ভব হয়নি, আজ ইচ্ছা করলে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে তা কোন শহরে সাধারণ-বিশেষ সব লোকদের কয়েক ঘন্টা অন্তর অন্তর সহজেই বুঝিয়ে দেয়া যেতে পারে।
এ কারণে আজ হকের প্রচারের জন্য এসব উপায় উপকরণ হস্তগত করা একান্ত প্রয়োজন। হকপন্থীরা যদি এসব মধ্যমকে এই ধারনা করে উপেক্ষা করে যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম আল্লাহ দীনের প্রচারের জন্য এসব মাধ্যম ব্যবহার করেননি, বরং প্রতিটি ব্যক্তির কাছেসশরীরে উপস্থিত হয়ে দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন অতএব আমাদের জন্যও উত্তম পন্থা হচ্ছে এই যে, আমরাও এসব জিনিসে ভুলেও হাত লাগাবনা, বরং ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়ে দীনের দাওয়াত দেব তা না হলে এটা নবীদের তাবলীগের পদ্ধতির অনুসরণ হতে পারনা। বরং এটা হচ্ছে শয়তানের এক বিরাট ধোকা এবং প্রবঞ্চনা। সে দীনের আহ্বানকারীর জন্য এই ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে রেখেছে। যতক্ষণে সে তার দীনদারী পন্থার অনুসরণ করে দুই ব্যক্তি পর্যন্ত নিজের কথা পৌঁছাতে পারবে, ততক্ষণে বাতিল পন্থীরা বৈজ্ঞানিক মাধ্যগুলো কাজে লাগিয়ে হাজারো, লাখো, বরং কোটি কোটি মানুষের কাছে নিজেদের বাতিলের দাওয়াত অত্যন্ত প্রভাবশালী পন্থায় পৌঁছে দেবে। শয়তান এ ধরণের ধোকা দিয়ে অধিকাংশ হক পন্থীদের চেষ্টা সাধনা এবং যোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং তাদের তুলনায় নিজের পাল্লা ভারী রেখেছে। শেষ পর্যন্ত তারা এখন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছে পড়ে গেছে এবং শয়তান সামনে অগ্রসর হয়ে জাতি সমূহের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই দুই দলের শ্রমসাধনার মধ্যে এখন আর কোন সম্পর্কই বাকি থাকলনা। হকপন্থীরা যতক্ষণ এই বিরাট শক্তিকে হকের খেদমতের ব্যবহার করার পদ্ধতি না শিখবে ততদিন এই অবস্থাই চলতে থাকবে। আজ এই শক্তি সম্পূর্ণরূপে শয়তানী শক্তির কবজায় বাতিলের খেদমতে নিয়োজিত রয়েছে।
সামাজিক উন্নতিকেও দাওয়াতের কাজে লাগাতে হবে
দাওয়াতের পদ্ধতি যেমন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি কোন থেকে অত্যন্ত উচ্চ এবং উন্নত মানের হওয়া দরকার যাতে বাতিলের সাথে পূর্ণ শক্তি নিয়ে মোকাবিলা করা যেতে পারে, অনুরূপভাবে সামাজিক এবং সামগ্রিক দিক থেকে জীবনযাত্রায় যে উন্নতি সাধিত হয়েছে তা থেকেও ফায়দা উঠাতে হবে, যাতে সময়ের মানদন্ডে দাওয়াতকেও পূর্ণরূপে প্রভাবশালী করা যেতে পারে। এ উদ্দেশ্যে সমাজে আপোশে মিলেমিশে থাকা, একত্রে উঠাবাসা করা, মতবিনিময় করা, নিজের মত অপরকে শুনানো এবং অপরের মত শুনা ইত্যাদি একান্ত প্রয়োজন। কোন কাজ সমষ্টিগতভাবে আঞ্জাম দেয়ার যে পদ্ধতি চালূ আছে, যদি তার মধ্যে নৈতিক অথবা শরঈ কোন অনিষ্ট না থেকে থাকে, তাহলে হকপন্থীদেরও তাতে অংশ গ্রহণ করতে হবে এবং হকের প্রচারে তাকে কাজে লাগাতে হবে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যেসব পন্থা সমাজে পরিচালিত ছিল তার মধ্যে যেগুলো দাওয়াতের কাজে লাগানো উপযুক্ত ছিল তিনি দাওয়াতের কাজে এসব পন্থা থেকে ফায়দা উঠিয়েছেন। প্রথম প্রথম তিনি যখন নিজের বংশের নেতাদের, যারা মূলত জাতিরও নেতা ছিল, নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিক করতে চাইলেন, তখন সেজহন্য এই পন্থা অবলম্বন করলেন যে, তিনি হযরত আলীকে (রা) প্রীতিভোজের আয়োজন করার এবং গোটা মোত্তালিব গোত্রকে দাওয়াত দেয়ার নির্দশ দিলেন। হযরত আলী (রা) নির্দেশমত কাজ করলেন। মোত্তালিব গোত্রের সবলোক একত্র হল। হযরত হামযা (রা), আবু তালিব, আব্বাস (রা) সবাই প্রীতিভোজে অংশ গ্রহণ করল। লোকেরা যখন আহার শেষ করল, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে দাঁড়িয়ে একটি ভাষণ দিলেন। তার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে এই যে, “আমি আপনাদের কাছে এমন এক জিনিস নিয়ে এসিছি, যা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জীবনের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি” ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি উপস্থিত লোকদের কাছে প্রশ্ন রাখলেন, “এই ভারবোঝা বহন করার জন্য আপনাদের মধ্যে কে আমার সংগী হতে প্রস্তুত আছেন?” সবাই চুপ করে বসে থাকল। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর হযরত আলী (রা) এক কোণ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবেগময় ভাষায় বললেন “যদিও আমার চোখে ব্যাথা, যদিও আমি শক্তিহীন এবং যদিও আমি সবার চেয়ে বয়সে নবীন, তথাপি আমিই আপনার সংগী হব।”
এ পদ্ধতি ছাড়াও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাবলীগের জন্য উপকারী অন্যান্য সাধারণ পদ্ধতিও অবলম্বন করেছেন। যেমন, মক্কা এবং তায়েফের নেতৃস্থানীয় লোকদের সামনে দাওয়াত পেশ করার জন্য তিনি নিজেই তাদের সাথে গিয়ে মিলিত হতেন। হজ্জের মওসুমে যেসব গোত্র মক্কার আশে পাশে তাবু ফেলত, তিনি তাদে গোত্র পতিদের সাথে মিলিত হতেন এবং তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতেন। বিভিন্ন এলাকার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের কাছে প্রতিনিধি পাঠাতেন। আরবে কিছু কিছু মওসূমী মেলা বসত। এতে বিভিন্ন স্তরের লোক উপস্থিত হত। এপা কেবল ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আমোদ-প্রমোদের উৎস ছিলনা। বরং তাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য মেলাও বসত। রসূলুল্লাহ (সা) এসব মেলায় গিয়েও উপস্থিত হতেন এবং লোকদের সামনে দীনের দাওয়াত পেশ করার পরিবেশ সৃষ্টি করতেন। অনেক লোককে তিনি চিঠি পত্রের মাধ্যমেও দাওয়াত দিয়েছেন।
মোট কথা সেই যুগে লোকদেরকে কোন জিনিসের নিকটবর্তী করার জন্য অথবা লোকদের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য যেসব পন্থা উদ্ভাবিত হয়েছিল, তার মধ্যে কোন নৈতিক দোষ না থাকলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব পদ্ধতিকে পূর্ণরূপে দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করতেন। প্রত্যেক যুগের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে যেসব পন্থা উদ্ভাবিত হত, সেই যুগের লোকেরা তার সাথে পরিচিত থাকত। এজন্য লোকদের সাথে কাজকর্ম ও আচার ব্যাবহার করার জন্য তাদের মেজাজের সাথে সংগতিপূর্ণ পন্থাই অবলম্বন করা আবশ্যক। লোকেরা যেভাবে মিলিত হতে চায় তাদের সাথে সেভাবেই মিলিত হতে হবে। লোকেরা যেভাবে যেভাবে শুনতে চায় সেভাবেই শুনানোর চেষ্টা করা উচিৎ। যে কর্মপন্থাকে লোকেরা ফলপ্রসূ মনে করে তাকে গ্রহণ করা উচিৎ।
কোন ব্যক্তি যদি এসব কর্মপন্থা গ্রহণ করা থেকে কেবল একারণে বিরত থাকে যে, এগুলো তার নিজের রুচির পরিপন্থী অথবা সে এসব পন্থা অবলম্বন করার যোগ্যতা রাখেনা, অথবা এই পদ্ধতি পূর্ববর্তীগণ অবলম্বন করেননি, তাই তার ধারনামতে এগুলো আদর্শ কর্মপন্থা নয়- তাহলে এর অবশ্যম্ভাবী পরিনতি তার প্রচার কার্যের ব্যর্থতার আকারে প্রকাশ পাবে এবং উদ্দেশ্য যতই মহৎ ও নির্ভেজাল হোক না কেন, তা তার প্রচার কার্যকে এই দুঃখজনক পরিনতি থেকে রক্ষা করতে পারবেনা। আজ যদি কোন ব্যক্তি দীনে দাওয়াত নিয়ে ইউরোপ আমেরিকার কোন দেশে যায়, হাতলে সেখানকার লোকদের সাথে নিজের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য এবং তাদের মধ্যে নিজের চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সেখানকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে প্রচলিত উপায় ও পন্থা অবলম্বন করা তার জন্য জরুরী হয়ে পড়বে। যদি সে তা না করতে পারে বা না করতে চায়, বরড় রাস্তায় রাস্তায় হেটে লোকদের কলেমা এবং নামায শিখাতে বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে সে যতবড় নিষ্ঠাবান ব্যক্তিই হোক না কেন, নিজের এই অযৌক্তিক মনোভাবের কারণে সে তার সমস্ত শ্র সাধনাকে ব্যর্থ করে দেবে। এবং কলেমা ও নামাযের ইজ্জতও ভুলুণ্ঠিত হবে।
এ ক্ষেত্রে হকের আহ্বানকারীকে কেবল এই পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ যে, সমসাময়িক যুগের স্বীকৃত ও প্রচলিত পদ্ধতিসময়হের যেগুলোর ম্যেধ্য নৈতিক দিক থেকে কোন ত্রুটি রয়েছে- কে তা অবলম্বন করবেনা। কোন বিশেষ প্রয়োজনে যদি এ ধরণের কোন ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি গ্রহণ করতেই হয়, তাহলে একে নৈতিক ত্রুটি থেকে পাক করেই তা গ্রহণ করা আবশ্যক। প্রথম প্রথম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের সম্প্রদায়কে অমনোযোগিতা ও উদাসীনতা থেকে সজাগ করার জন্য এবং লোকদেরকে নিজের বক্তব্যের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ডাক দিলেন। জাহেলী আরবে আহ্বানের এই পন্থার আসলরূপ ছিল এই , বিপদের তীব্রতা প্রকাশ করার জন্য উচ্চস্বরে আহ্বানকারী নিজের পরিধানের সমস্ত কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলংগ হয়ে যেত। আরবর পরিভাষায় একে ‘নাযীরুল উরিয়অন’ (উলংগ সতর্ককারী) বলা হত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের সজাগ করার জন্য যেহেতু উলংগ সতর্ককারীর পদ্ধতিই অবলম্মন করেছেন। কিন্তু উলংগ হওয়াটা যেহেতু চরম পর্যায়ের একটি নিরজ্জতা এবং চরিত্রহীনতা, তাই তিনি এই পদ্ধতিকে উল্লেখিত দোষ থেকে পাক করে নিলেন। এই দৃষ্টান্ত থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, বর্তমান যুগে প্রচারের যে বৈঠকি এবং সামষ্টিক পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে তার মধ্যে কোন খারাপ দিক থেকে থাকে, তাহলে একারণে তাকে এক ঠেলায় প্রত্যাখ্যান করার প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে যা করতে হচ্ছে তা হচ্ছে এই পদ্ধতিকে দোষত্রুটি থেকে পাক করে তাকে হকের উদ্দেশ্য সাধনের কাজে ব্যবহার করতে হবে।
আজ পৃথীবীর সভ্য দেশসমূহ কোন আন্দোলনকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার যে অসংখ্য পন্থা উদ্ভাবিত হয়েছে তা যেভাবে জাহেলিয়াতকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে সক্রিয় রয়েছে, অনুরূপ ভাবে কল্যাণ ও মঙ্গলকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজেও তাকে অত্যন্ত সক্রিয় করা যেতে পারে। কেবল প্রয়োজন হচ্ছে এক ক্ষতিকর দিক থেকে পাক করে তা থেকে ফায়দা উঠানো। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে যে, আজ যেসব লোক এই পন্থঅকে গ্রহণ করছে, তারা অতীব উত্তম উদ্দেশ্যেও এগুলোকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট রূপ দিয়ে ব্যবহার করছে। যেমন, জিহাদের মত একটি পবিত্রতম উদ্দেশ্যের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে চাইলে আনন্দমেলা বা মিনা বাজার লাগিয়ে দেয়া হয়। নারবীদের রূপসৌন্দর্যের পসরা, অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতাকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে বানানো হয। মুহাজির উদ্ভাস্তুদের সাহায্যের মত একটি মহৎ কাজের জন্য যদি ফাগু তৈরীর প্রয়োজন হয়, রক সংগীত ও নৃত্য সংগীতের আসর বসিয়ে দেয়া হয়। সুপ্ত যৌনবৃত্তিকে সুরসুরি দিয়ে জনগণের পকেট থেকে পয়সা আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়।
আবেগকে উত্তোজিত করার আর কোন সহজ পন্থা না পাওয়া গেলে অন্তত কিছু সংখ্যক কবি সাহিত্যিককে এক্রত করে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের আসর বসানো যায়। কবিতার সুরমূর্ছনায় লোকদের ঈমানকে জাগ্রত করার চেষ্টা করা যায়। যেসব জিনিসের মধ্যে অন্তত কিছু কল্যাণকর উপাদান মওজুদ রয়েছে- জাতির রুচির কারনে তাও নিকৃষ্টতার ছাঁচে ঢালাই হয়ে যাচ্ছে। তাহলে এটা কিভাবে আশা করা যেতে পারে যে, কোন গার্হিত জিনিসের মুলোৎপাটান করে তদস্থলে কোন কল্যাণ নিয়ে আসা হবে? তথাপি ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে এই যে, কোন জিনিসের মধ্যে খারাপ কিছু থাকলে তার সংশোধন করে এটাকে হকের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাজে লাগাতে হবে। এটাকে এক বাক্যে উপেক্ষা করা ঠিক নয়।
হকের আহ্বানকারী হকের প্রচারের জন্য যেসব উপায় ও পন্থা অবলম্বন করবে- এই দুটি মৌলিক হেদায়াত সেইসব পন্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। তাকে এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এখন একজন হকের প্রচারককে যেসব পন্থা অবলম্বন করা থেকে বিরত থাকতে হবে, তার সাথে সংশ্লিষ্ট কতিপয় হেদায়াত আমরা এখানে উল্লেখ করব। এ প্রসংগে মৌলিক কথা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর দীনের আহ্বানকারী কখনো এমন পদ্ধতি গ্রহণ করবেনা যা দীনের প্রচার, অথবা প্রচারেকের মর্যাদা, অথবা প্রাচরকার্যের পরিপন্থী। এধরনের পদ্ধতির সংখ্যা অনেক হতে পারে। তা গুনে গুনে বলা কঠিন। আমরা উদাহরণ স্বরূপ মাত্র কয়েকটি কথা উল্লেখ করব। তা থেকে মোটামোটি জানা যাবে যে, হকের আহ্বানকারীদের কোন কোন প্রকারের পন্থা পরিত্যাগ করা উচিত।
মর্যাদার পরিপন্থী পদ্ধতি সমুহ পরিত্যাজ্য
আল্লাহ দীনের দিকে লোকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রচারকের অবশ্যই এমন সব পদ্ধতি অবলম্বন করা থেকে দূরে থাকতে হবে যা কারণে দাওয়াতের মর্যাদা অথবা প্রচারকের নিজের মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার আশংকা রয়েছে। নিজের কাজের মধ্যে অস্বাভাবিক ভাবে ব্যস্ত থাকা এবং লোকদেরকে হকের দিকে আকৃষ্ট করার অত্যাধিক আগ্রহ নিসন্দেহে একজন প্রচারকের সর্বোত্তম বৈশিষ্ট। কিন্তু এই ব্যস্ততা এবং এই আগ্রহ এতটা বর্থিত হওয়া উচিত নয়, যার ফলে প্রচারক নিজের নফসের অধিকার সম্পর্কে হুশহারা হয়ে পড়বে, নিজের সাথী ও বন্ধুদের সম্পর্কে খেয়াল হারিয়ে ফেলবে এবং নিজের দাওয়াতের মর্যাদা ও অবস্থানের কোন পরোয়া থাকবেনা। যে ব্যক্তি শুনতে প্রস্তুত নয় তাকে শুনাতে চেষ্টা করা এবং অহংকারীদের পিছে ছুটে বেড়ানো, ঘৃণা-বিদ্বেষকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা এবং অহংকারীদের খাতির তোয়াজ করা। কেবল এই পর্যন্তই জায়েয, তাতে প্রচারকের ব্যক্তিত্ব ও দাওয়াতের মর্যাদার কোন ক্ষতি হতে না পারে এবং দাওয়াতের কাজে কোনরূপ হীনমন্যতাবোধ অথবা খেলোভাব সৃষ্টি হতে না পারে। ব্যাপার যদি এই সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে বলে দৃষ্টিগোচর হয়, তাহলে যে সত্যের ভালবাসা প্রচারককে এসব লোকদের জন্য ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে- সেই সত্যের মর্যাদার দাবী হচ্ছে এই যে, সে নিজের ব্যক্তিত্বকে অক্ষুন্ন রেখে তাদের থেকে আলগ হয়ে যাবে এবং কেবল সেই লোকদের নিজের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু বানাবে, যাদের মধ্যে সত্যের অনুসন্ধান এবং জানার আগ্রহ বর্তমন রয়েছে। সুলা আবাসার নিম্নোক্ত আয়াতগুলোতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরাইশ নেতাদের সাথে এ ধরণের খাতির তোয়াজ করা থেকে নিবৃত রাখা হয়েছে এবং সেই সত্যের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, তুমি যেমন মহান মর্যদাপূর্ণ দাওয়াত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে, তা এমন নয় যে, তাকে এতটা অবনত হয়ে পেশ করতে হবে। এইা আয়াতগুলোতে কুরান মজীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও উন্নত মর্যাদার উল্লেখেএ উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে যে, এই উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন কালাম যার সামনেই পেশ করার সময় অবশ্যই এর মর্যাদার দিকে খেয়াল রাখতে হবে যে, এটা মহান আল্লাহর নির্দেশনামা, কোন যাঞ্চনাকারীর আবেদন পত্র নয়।
أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى فَأَنْتَ لَهُ تَصَدَّى وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى وَأَمَّا مَنْ جَاءَكَ يَسْعَى وَهُوَ يَخْشَى فَأَنْتَ عَنْهُ تَلَهَّى كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ فَمَنْ شَاءَ ذَكَرَهُ فِي صُحُفٍ مُكَرَّمَةٍ مَرْفُوعَةٍ مُطَهَّرَةٍ بِأَيْدِي سَفَرَةٍ كِرَامٍ بَرَرَةٍ
“যে লোক উন্নাসিকতা দেখায় তুমি তুমি তার পেছনে লেগে গেছ। অথচ সে যদি পবিত্রতা অর্জন না করে, তাহলে তোমর ওপর কোন অভিযেগ নেই। আর যে ব্যক্তি তোমার কাছে আগ্রহ সহকারে আসে এবং সে খোদাকেও ভয় করে তার প্রতি তুমি অনীহা প্রদর্শন করছ। কক্ষণও নয়, (এ অহংকারকারীদের এতটা পরোয়া করার প্রয়োজন নেই।) এতো এক উপদেশ মাত্র। যার ইচ্ছা তা গ্রহণ করবে। তা এমন এক সহীফায় লিপিবদ্ধ- যা সম্মনিত, উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন এবং পবিত্র। তা মর্যাদাবান এবং পূণ্যবান লেখকদের হাতে থাকে। (সূরা আবাসা- ৫-১৬)
এটা কখনো জায়েয হতে পারেনা যে, তাবলীগের জোশে এসে আহ্বানকারী যেকোন সভায় ইচ্ছা ড়িয়ে ধমকাবে এবং শোতিাদের কোন মনোযোগ থাক বা না থাক নিজের বক্তব্য না শুনিয়ে ক্ষান্ত হবেনা।
যে পথিকই পাওয়া যাবে তার পেছনে লেগে যাবে এবং যতক্ষণ তাকে কিছু শুনাতে না পারবে অথবা তার কাছ থেকে কিছু শুনে না নেবে ততক্ষণ তার পিছু ছাড়বে না। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণেত আছে যে,
(আরবী****************)
“আমি তোমাকে এমন অকস্থায় যেন না দেখি যে, তুমি কোন দলের কাছ দিয়ে যাচ্ছ, তখন তারা নিজেদের কোন কাজে ব্যস্ত রয়েছে, আর এই অবস্থায় তুমি তাদেরকে নিজের ওয়াজ শুনানো আরম্ভ করে দিলে। বরং তোমায় তখন চুপ থাকা উটচিৎ। যখন তারা তোমাকে বলাবর সুযোগ দেবে তখন তুমি তাদের কাছে নিজের বক্তব্য পেশ করবে। তাহলে তারা আগ্রহ সহকারে তোমার কথা শুনবে।” –(বুখারী)
এমন কোন পদ্ধতি অবলম্মবন করা থেকেও একান্তই বিরত থাকা উচিৎ যার ফলে দাওয়াতের ব্যাপারটি লোকদের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং তারা এতে ঘাটড়ে যেতে পারে।
(আরবী***********************)
“শাকীক (তাবেঈ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) প্রতি বৃহস্পতিবার লোকদের সামনে ওয়াজ-নসীহত করতেন। এক ব্যক্তি তাকে বলল, হে আবু আবদুর রহমান। আমি চাচ্ছিলাম আপনি যদি প্রতিদিন আমাদের জন্য ওয়াজ-নসীহত করতেন। আবদুল্লাহ (রা) বললেন, এরূপ করতে আমাকে একথাই বাধা দেয় যে, আমি তোমারেদ বিরক্তি উৎপাদন করাকে অপছন্দ করে। এ কারণে আমি তোমাদের জন্য মাঝে মধ্যেই ওয়াজ করে থাকি যেভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বিরক্তির ভয়ে মাঝে মধ্যেই আমাদের জন্য ওয়াজ-নসীহাত করতেন।”- (বুখারী, মুসলিম)
উদ্দেশ্যের পরিপন্থী পদ্ধতি পরিত্যাজ্য
হকের আহ্বানকারীর কখনো এমন কোন পন্থা অবলম্বন করা উচিৎ নয়, যা তার বৈশিষ্টের দিক থেকে দাওয়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যেমন, বিতর্কযুদ্ধ। এই পন্থাকে যদিও একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে দাওয়াত ও তাবলীগের সর্বাধিক কার্যকর পন্থা বলে ধারনা করা হচ্ছে এবং তার এই গুরুত্বের কারণে আমাদের লেখকগণ এই বিষয়ের ওপর বই পুস্তুকও লিখে ফেলেছেন। যা আমাদের আরবী মাদ্রাসাসমূহের পাঠতালিকাভুক্তও করা হয়েছে- কিন্তু হকের আন্দোলনের প্রাণসত্তার সাথে এই পন্থার যে দূরতম সম্পর্ক রয়েছে অনুরূপ দূরতম সম্পর্ক অন্য কো পন্থার সাথে নেই। এতে সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বিতর্ক-বাহাসের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে যে বিতর্ক বাহাসের শিক্ষা দেয়া হয় এবং আমাদে প্রচারক ও তার্কিকগণ দিনভর বিতর্কের যে আখড়া জমিয়ে বসে- কুরআনে উল্লেখিত মুজাদালা এবং মুহাজ্জা শব্দের অর্থ এই ধরনের ‘বিতর্ক’ করাটা সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের তর্কবিশারদগণ যেহেতু কুরআনের এই দুটি শব্দকেই তাদে বিতর্ক যুদ্ধের সপক্ষ্যে দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন, এজন্য আমরা সংক্ষেপে এ দুটি শব্দের তাৎপর্য কুরআন মজীদর সাহায্যেই তুলে ধরার চেষ্টা করব। এর ফলে নবী-রসূলদের মুজাদালা ও মুহাজ্জা এবং বর্তমানে প্রচলিত বিতর্কযুদ্ধের মধ্যেকা পার্থক্য পরিষ্ফুটিত হয়ে উঠবে।
কুরআনে যে ধরনের বিতর্কের অনুমতি দিয়েছে
কুরআন মজীদ দুই ধরনের মুজাদালা (বিতর্ক) উল্লেখ আছে। বাতিল পন্থায় মুজাদালা এবং উত্তম পন্থায় মুজাদালা। বাতিল বিতর্কে কুরআন মজীদ কাফের এবং ইসলামের শত্রুদের সাথে সংশ্লিষ্ট করেছে। বর্তমান যুগে সাধারণভাবে প্রচলিত বিতর্ক বাহাসের মধ্যে যে বৈশিষ্টগুলো লক্ষ্য করা যায়, উল্লেখিত বিতর্কের বৈশিষ্টও প্রায় তাই বর্ণনা করেছে। কোন যুক্তিসংগত দলীল ছাড়াই নিজের মতের ওপর অটল থাকা এবং অন্যকে তা মানকে পীড়াপীড়ি করা, অপ্রাসংগিক কথার সাথে আসল ব্যাপারকে জড়িত করার প্রবণষতা, নিষ্ফল বক্র বিতর্কে সময় নষ্ঠ করা, প্রতিপক্ষের বক্তব্য না নিজে শুনবে, না অপরকে শুন তে দেবে, সেই অর্থহীন বাচালতা ও নিষ্ফল গলাবাজি যা সাধারণ ভাবে বর্তমান কালের তার্কিকদের বৈশিষ্টের অন্তর্ভূক্ত। কুরআন মজীদ এগুলোকে বাতিল বিতর্কের বৈশিষ্ট বলে উল্লেখ করেছে এবং হকের অনুসারীদের কঠোরভাবে তা থেকে বিরত থাকতে বলেছে। তাদেরকে কেবলী উত্তম পন্থায় বিতর্ক করা অনুমতি দিয়েছে। জ্ঞানগত এবং কর্মগত উভয় দিক থেকে কুরআন এই উত্তম পন্থার ব্যাখ্যা করে দিয়েছে, যাতে প্রতিটি লোক তা ভালভাবে হৃদয়ংদগম করতে পারে।
এই বিতর্কের বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থা কুরআন মজীদে এই বলেছে যে, সম্বোধিক ব্যক্তির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে এই চেষ্টা করা উচিৎ যে যেসব মৌলিক ব্যাপারে তার সাথে ঐক্য ও মিল রয়েছে এবং যেগুলো মেনে নিতে সে অস্বীকার করেনা- তা তার সামনে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরতে হবে। এর ফলে সে প্রচারকের বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হবে। অতপর তার স্বীকৃত মূলনীতি থেকে অবশ্যম্ভাবীরূপে যে ফলাফল বেরিয়ে আসে তা তার সামনে তুলে ধরতে হবে। তাহলে সে এটাকে নিজের কথা মনে করে তা গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত হবে। একে নিজের প্রতিপক্ষের দাবী মনে করে তা প্রত্যাখ্যান করার জবাব তার মধ্যে সৃষ্টি হেতে পারেনা। করআন মজীদ নিজেই এর অতি উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন।
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ وَقُولُوا آمَنَّا بِالَّذِي أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَأُنْزِلَ إِلَيْكُمْ وَإِلَهُنَا وَإِلَهُكُمْ وَاحِدٌ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ
“আর উত্তম রীতি ও পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করনা। তাদের মধ্যে যারা নিজেদের ওপর যুলম করেছে তাদের সাথে মূলত কোন বিতর্ক নেই। তোমরা আরো বলো, আমরা ঈমান এনেছি যা আমাদের ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং তোমদের ওপর নাযিল করা হয়েছে। আমাদের খোদা এবং তোমাদের খোদা একই এবং আমরা তাঁরই অনুগত।”
এ আয়াতে প্রথমত একথা বলে দেয়া হয়েছে যে, যেসব লোক নিকৃষ্ট প্রকৃতির এবং বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী, যারা কেবল ঝগড়া-ঝাটি করতে অভ্যস্ত এবং সত্যতে বুঝার ও মেনে নেয়ার কোন আগ্রহই যাদের মধ্যে নেই- তাদের সাথে মূলত কথা বলারই কোন প্রয়োজন নেই। অবশ্য যারা অনুসন্ধানকারী তাদের সাথে কথা বার্তা বলতে হবে, আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তার পদ্ধতি হচেছ এই যে, তাদের ও আমাদের মধ্যে স্বীকৃত মূলনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে।
এই মূলনীতি অনুযায়ী আহলে কিতাবদের সামনে তৌহীদের দাওয়াত এমন পেশ করতে হয়েছে যার মাধ্যমে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, আহলে ঈমান (মুসলমান) ও আহলে কিতাবদে মাঝে তৌহীদ যখন একটি মৌলিক নীতি হিসাবে স্বীকৃত, তখন এর ফলাফল ও দাবীর ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ কেন হবে? আহলে কিতাবগণ যখন এই মূলনীতিকে স্বীকার করে নিচ্ছে, তখন এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফলকেও তাদের মেনে নেয়া উচিৎ। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে।
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ
“বলে দাও, হে আহলে কিতাব! এসো এরূপ একটি কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সম্পূর্ণ সমাব। তা এই যে, আমরা (উভয়েই) আল্লাহ চাড়া আর কারো ইবাদত করবনা, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবনা এবং আমাদের মধ্যে কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে নিজেদের রব হিসাবে গ্রহণ করবনা। এই দাওয়াত কবুল করেতে তারা যদি প্রস্তুত না হয় তাহলে তোমরা পরিস্কার বলে দাও- তোমরা সাক্ষী থাক আমরা মুসলমান – কেবলমাত্র আল্লাহর বন্দেগী ও আনুগত্যে নিজেদের সোপর্দ করে দিয়েছি।” –(সূরা আলে –ইমরানঃ৬৪)
কুরআন মজীদ বিতর্কের যে বাস্তব উদাহরণ পেশ করেছে এবং যার প্রশংসা করেছে, তার ওপর চিন্তা করলে জানা যায়, নিজের বক্তব্য মানিয়ে নেয়ার জন্য প্রেম ভালবাসাম আত্মবিশ্বাস, সচ্চরিত্র ও উত্তম যক্তির মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে অভিবুত করার নামই হচ্ছে মূলত মুজাদালা বা বিতর্ক। প্রতিপক্ষ শেষ পর্যন্ত হকের আহ্বানকারীর আন্তরিকতা, তার নিরপেক্ষতা এবং তার নিষ্ঠার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে চিন্তা করতে এবং তা মেনে নিহে প্রস্তুত হয়ে যাবে।
কুরআন মজীদ এই ধরনের বিতর্কের বিভিন্ন উদাহরণ পেশ করেছে। তার সবগুলো বর্ণনা করতে গেলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা এখানে একটি মাত্র বিতর্কের ঘটনা উল্লেখ করব। এ থেকে পরিষ্কার জানা যাবে, কি ধরণের মহব্বতপূর্ণ প্রকাশভংগী এবং একাগ্রতাকে মুজাদালা (বিতর্ক) শব্দের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং তার প্রশংসা করা হয়েছে।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, লুত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার সাথে যে মুজাদালা করেছেন, কুরআন মজীদ তার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছে যে, এই মুজাদালা ইবরাহীমের (আ) আন্তরিক সহানুভুতি, মমতা ও ব্যতা-বেদানারইফল। এখন দেখা যাক কুরআন মজীদ ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যে বিতর্কের প্রশংসা করেছে তার বিস্তারিত রূপ কি ছিল। কুরআন মজীদে কেবল এর প্রশংসা করা হয়েছে, তার কোন বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়নি। এজন্য আমরা এর বিস্তারিত বর্ণনা তাওরাত কিতাব থেকে সংগ্রহ করেছি। তাওরাতের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত ইবরাহীম (রা) লূত সম্প্রদায়ের ওপর শাস্তির দণ্ড নিয়ে আগত ফেরেশতাদের সাথে নিম্নোক্ত কথাবার্ত বলেছেনঃ
“তখন আব্রাহাম নিকটে গিয়ে বলল, তুমি কি নেককার লোকদের পাপিষ্ঠাদের সাথে ধ্বংস করে দেব? খুব সম্ভব এই শহরে পঞ্চাশজন ন্যায়পরায়ন ও সত্যবাদী লোক রয়েছে। তুমি কি তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে এবং এদের মধ্যে এই পঞ্চাশজন ন্যায়পরায়ণ লোক থাকা সত্তেও এই স্থানকে রোহই দেবেনা? তোমার দ্বারা এটা হতেই পারেনা যে, তুমি নেককার লোকদের দুষ্কৃতিকারীদের সাথে একত্রে মেরে ফেলবে এবং উভয়ে এক সমান হয়ে যাবে। সারা জাহানের ন্যায় বিচারক কি ন্যায় বিচার করবেনা? আল্লাহ তাআলা বললেন, সুদুম শহরে যদি পঞ্চাশজন ন্যায়পরায়ন লোক পাওয়া যায়, তাহলে আমি তাদের কারণেই এ স্থানকে ধ্বংস করা থেকে নিবৃত্ত থাক। তখন ইবরাহীম বলল, দেখুন আমি আল্লাহর সাথে কথা বলার সুসাহস করেছি। যদিও আমি তাঁর নগণ্য বান্দা। সম্ভবত ন্যায়পরায়ণ ও সত্যবাদীদের সংখ্যা পঞ্চাশ থেকে পাঁচ কম হবে। তুমি কি এই পাঁচজন কম হওয়ার কারণে গোটা জনবসতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে? সে বলল, সেখানে আমি যদি পঁয়তাল্লিশজন সত্যবাদী লোক পাই তাহলে আমি তা ধ্বংস করবনা। ইবরাহীম পূর্ণবার বলল, যদি সেখানে চল্লিশজন ন্যায়পরায়ণ লোক থেকে থাকে? ফেরেশতা বলল, চল্লিশজন পাওয়া গেলেও ধ্বংস করবনা। এমনকি ত্রিশজন সত্যপন্থী লোক পাওয়া গেলেও জনবসতিকে ধ্বংস করবনা। ইবরাহীম আবার বলল, আমি আল্লাহর সাথে কথা বলার দুঃসাহস করেছি। সম্ভবত সেখানে বিশজন সত্যপন্থী লোক পাওয়া যাবে। ফেরেশতা বলল, বিশজনের কারণেও আমি এই জনবসতিকে ধ্বংস করবনা। ইবরাহীম বলর, আল্লাহ যদি অসন্তুষ্ট না হন তাহলে আমি আরো একবার তাঁর কাছে আবেদন করে দেখব। সম্ভবত সেখানে দশজন সত্যবাদী লোক পাওয়া যাবে। ফেরেশতাবলল, এই দশজনের কারণেই আমি তা নিশ্চিহ্ন করবনা। আল্লাহ তাআলা যখন ইবরাহীমের সাথে কথা বলা শেষ করলেন, তখন ফেরেশতারা লে গেল এবং ইবরাহীম ঘরে ফিরলেন”- (আদিপুস্তকঃ অনুচ্ছেদ ১৮, আয়াত ২৩-৩৩)
কথোপকথনের এই ধরণ, সম্বোধনের এই পন্থা, যুক্তি পেশ করার এই পদ্ধতি এবং মহব্বতপূর্ণ এই প্রকাশ-ভংগী-একেই কুরআন মজীদে মুজাদালা (বিতর্ক) শব্দের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কুরআন মজীদ এই ধরনের মুজাদালারই প্রশংসা করেছে। লোকেরা যদি এই মুজাদালাকে নিজেদের বিতর্ক-যুদ্ধের বৈধতা প্রমানের জন্য দলীল হিসাবে গ্রহণ করতে চায় তাহলে এই মুজহাদালার মধ্যে যে প্রাণশক্তি রয়েছে তা তাদের বিতর্কের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে। এবং সেই সৌন্দর্য মহব্বত, মমতা ও সহানুভূতির সাথে নিজের বক্তব্য প্রতিপক্ষের সামনে পেশ করতে হবে। মুজাদালার নামে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধ-সংগ্রাম চালানো হবে আর এর নাম দেয়া হবে বিতর্ক এবং এর বৈধতা প্রমাণের জন্য নবীদের জীবন থেকে দলীল গ্রহণ করা হবে- এটা কখনো হতে পারেনা।
অনুরূপভাবে কুরআন মজীদ হযরত ইবরাহীমের (আ) আরো একটি বিতর্কের কথা উল্লেখ করেছে এবং তাকে ‘মুহাজ্জা’ শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছে। এই বিতর্ক হযরত ইবরাহীম (আ) এবং তাঁর সমসাময়িক যুগের এক স্বৈরাচারী বাদশাকে বললেন, “যিনি মারেন এবং জীবন্ত করেন তিনিই আমার রব।” এর উত্তরে বাদশা বলল, “ আমিই তো মারি এবং বাঁচাই।” একথার ওপর হযরত ইবরাহীম (আ) বললেন, “আমার প্রতিপালক পূর্বদিক থেকে সূর্য উদিত করেন। তুমি তা পশ্চিম দিকে থেকে উঠাও তো দেখি।”
এই বিতর্ককে যদি বর্তমান বিতর্ক শাস্ত্রের সেই মূলনীতির ওপর রাখা হয় যার শিক্ষা আমাদের বিতর্কমূলক বই পুস্তকে দেয়া হচ্ছে- তাহলে হযরত ইবরাহীম (আ) খুব একটা যোগ্য তার্কিক বলে সাব্যস্ত হতে পারবেননা। কেননা তিতি বাদশার দাবী ‘আমিই তো মারি এবং বাঁচাই’ প্রমাণের জন্য অনেক কিছু দাবী করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। অথচ একজন তার্কিক হিসাবে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলার এটাই ছিল মোক্ষম সুযোগ। কিন্তু তিনি একজন তর্কবাগিশের তর্কযুদ্ধের মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী কাজ করেছেন। তিনি নিজেই পেছনে সরে আসাটা উপযুক্ত মনে করেছেন। তিনি যখনই অনুভব করতে পারলেন, এই ব্যক্তি বিতর্ক এবং নিজের কথার মারপ্যাচ খাটানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তখন তিনি একটি মুখবন্ধ করা কথা বলে দ্রুত কেটে পড়লেন। এ ঘটনা থেকে প্রমান হয় যে, হতেরক আহ্বানকারীর যদি সম্বোধত ব্যক্তি সম্পর্কে এই অনুমান হয়ে যায় যে, সে কথা শুনতে এবং বুঝকে পারছেনা, বরং বিরোধ এবং বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাচ্ছে, তাহলে তার পেছনে লেগে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। বরং আলোচনা সংক্ষেপ করে সরে পড়া উচিৎ।