১২
হকের আহ্বানকারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য
হকের আহ্বানকারীই হোক অথবা বাতিলের আহ্বানকারীই – তাদের কাউকেই আল্লাহ তাআলা দাওয়াত এবং প্রেরণার অধিক কোন কিছু ক্ষমতা দান করেননি। কোন নবীরও এই ক্ষমতা ছিলনা যে, তিনি কারো অন্তরে হেদায়াত ঢেলে দিতে পারেন এবং শয়তানের এই ক্ষমতা নেই যে, সে কোন ব্যক্তিকে ভ্রান্ত পথে লাগিয়ে দেবে। তাদের প্রত্যেকের কেবল এতটুকু ক্ষতা আছে যে, তারা নিজ নিজ পথের দিকে আল্লাহর সৃষ্টিকে ডাকতে পারেব। হেদায়াত অথবা গোমরাহী অবলম্বন করা দাওয়াতকৃত ব্যক্তির নিজের পছন্দ এবং আল্লাহর বিশেষ তৌফিক বা সহজলভ্যর ওপর নির্ভরশীল। এই তৌফিক এবং সহজলভ্যতার জন্য আল্লাহ তাআলা একটি নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই নিয়ম অনুযায়ী তিনি নিজের সুস্থ প্রকৃতির এবং হেদায়াতের আকংখী বান্দাদের নবীদের রাস্তায় চলার তৌফিক দান করেন এবং বক্র স্বভাবের এবং গোমরাহপ্রিয় বান্দাদের শয়তানের পথে চলার সহজতা দান করেন। নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এই সত্য তুলে ধরা হয়েছেঃ
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
“তুমি যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করতে পারনা, বরং আল্লাহ তাআলা যাকে চান হেদায়াত দান করেন। তুমি যতই আকাংখা করনা কেন অধিকাংশ লোকই ঈমান আনবেনা।” –(সূরা কসাসঃ৫৬)
إِنْ تَحْرِصْ عَلَى هُدَاهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ يُضِلُّ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ
“তুমি যদি তাদের হেদায়াত প্রাপ্তির আকাংখা কর তাহলে শুনে রাখ- আল্লাহ তাআলা যাদের গোমরাহ করে দেন তাদের হেদায়ত দান করেননা। এবং এদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।” –(সূরা নহল-৩৭)
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ
“এই কিতাব যা আমরা তোমার ওপর নাযিল করেছি এজন্য যে, তুমি লোকদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসবে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।” –(সূরা ইবরাহীমঃ১)
إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ
“আমার বান্দারেদ ওপর তোর (শয়তান) কোন জোর খাটবেনা। কেবল দুষ্ট প্রকৃতির লোক যারা তোর অনুসরণ করে- তাদের ওপরই তোর জোর খাটবে।” –(সূরা হিজরঃ৪২)
وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا أَنْ دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنْفُسَكُمْ
“তোমাদের ওপর কোন কর্তৃত্ব ছিলনা। আমি শুধু তোমাদের ডেকেছি আর তোমরা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছ। অতএব এ খন তোমরা আমাকে তিরষ্কার করনা, বরং নিজেদের নফসকে তিরষ্কার কর।” –(সূরা ইবরাহীমঃ২২)
এই বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন হকের আহ্বানকারী এ ব্যাপারে চিন্তা করেনা। এবং তার চিন্তা করা উচিৎ নয় যে, লোকেরা তার দাওয়াত কান লাগিয়ে শুনছে কিনা । তার দাওয়াতের জন্য যুগটা অনুকুল কিনা এ বিষয়ে সে মাথা ঘামায়না এবং তার মাথা ঘামানের প্রয়োজনও নেই। লোকদের দাওয়াত কুল করা বা প্রত্যাখ্যান করা নিজের প্রচেষ্টার সাফল্য বা ব্যর্থতা এবং হকের দাওয়াতের পরিনাম সম্পর্কে সে একবার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত করে নেয় যে, সে যে জিনিসটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছে এবং যেটাকে সে গোটা দুনিয়ার জন্য সমান ভাবে কল্যাণকর মনে করে- সেই উদ্দেশ্যের দিকে লোকদের আহ্বান করাই তার কর্তব্য। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর লোকেরা তার দাওয়াত কবুল করে নিজেদের কর্তব্য পালন করছে কিনা এবং আল্লাহ তাআলা এই দাওয়াতকে দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে দেবেন কিনা- এই চিন্তা করে সে বিচলিত হয়না।
লোকদের দাওয়াত কবুল অথবা প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপার বলা যায় তারা তার আহ্বানের সাড়া দিক বা না দিক উভয় অবস্থায় তার নিজের দায়িত্ব রীতিমত বহাল থাকে। তারা যদি তার দাওয়াত কবুল করে নেয় তাহলে তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য এবং মুক্তির পথ খুলে যাবে এবং সে আল্লাহর কাছে নিজের দায়িত্ব পালন ও দাওয়াতের সওয়াব পেয়ে যাবে। আর তারা যদি দাওয়অত কবুল না করে তাহলে তার মধ্যমে লোকদেগর সামনে আল্লাহর চুড়ান্ত প্রমান পূর্ণ হয়ে যাবে এবং আহ্বানকারীকে দায়িত্বমুক্ত ঘোষণা করা হবে। অর্থাৎ তার যে কর্তব্য ছিল তা সে পূর্ণ করেছে। কুরআন মজীদের হকের আহ্বানকারীদের একটি দলের জবাব উল্লেখ করা হয়েছে। তাদেরকে এমন একদল লোকের সামনে অথবা নিজেদের দাওয়াত পেশ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল- যারা কোনক্রমেই দাওয়াত কবুলকারী ছিল না। এই জবাব থেকে হকের আহ্বানকারীর দায়িত্বের ধরণ পরিষ্কারূপে বুঝা যায়। তা হচ্ছে লোকেরা তার দাওয়াত কবুল করুক বা না করুক উভয় অবস্থায় তার দায়িত্ব হচ্ছে দাওয়াত দিতে থাকা। লোকেরা যদি তা কবুল করে তাহলে তারা হেদায়াত পেয়ে যাবে, আর যদি কবুল না করে তাহলে সে আল্লাহর দরবারে দায়িত্বমুক্ত সাব্যস্ত হবে।
وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
“যখন তাদের মধ্যে একটি দল (অপর দলকে) বলল, তোমরা এমন লোকদের কেন নসীহক কর- যাদেরকে আল্লাহ তাআলা হয় ধ্বংস করে দেবেন অথবা কঠিন শাস্তি দেবেন? তারা জবাবে বলল- আমরা তা এজন্য করছি যে, আল্লাহর কাছে আমাদের অপারগতা প্রমাণ হয়ে যায় এবং তারা হয়ত খোদাভীতির পথ অবলম্বন করতে পারে।” –(সূরা আ’রাফঃ ১৬৪)
এখন থাকল আল্লাহ তাআলার সাহায্য সহায়তার প্রসংগ। এ ব্যাপারে শুধু এই কথাটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা তার কাছে এই হককে সুষ্পষ্ট করে দিয়েছেন- এটা তার মনের মধ্যে এই নিশ্চয়তা সৃষ্টি করে যে, এই হকের দাওয়াত দেয়া, লোকদের তা কবুল করা এবং হকের দিকে আহ্বান করা এবং দুনিয়াতে তা বিস্তৃত করার সংকল্প নিয়ে অগ্রসর হয় তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এই কাজে তাকে সাহায্য করবেন। এক দয়াময় ও অনুগ্রশীল প্রভু সম্পর্কে সে কখনো এই সন্দেহ করতে পারেনা যে, তিনি যে রাস্তার ব্যাপারে বলেছেন যে, এটাই হচ্ছে সরল সহজ পথ- সেই পথে চলা অসম্ভব এবং যে জীবানকে ব্যবস্থাকে তিনি স্বভাগত জীবন বিধান বলেছেন- তা এতটা জটিল এবং তার ওপর আমল করা এতটা অসম্ভব যে, লোকেরা তা গ্রহণই করবেনা। অনন্তর একজন ন্যায়নিষ্ঠ আহ্বানকারী তার মেহেরবান প্রভূ সম্পর্কে সে এই সন্দেহগ করতে পারে না যে, তিনি তার ওপর একটি দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে এই নির্দেশ দেবেন যে, তোমরা করনীয় কাজ হচ্ছে এই এবং এটা করার মাধ্যেই রয়েছে তোমার মুক্তি এবং আমার অনুগ্রহ, কিন্তু যখন সে এ কাজ করা শুরু করে দেবে এবং তার সামনে বিপদ এসে যাবে তখন তিনি তাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রাখবেন এবং কোনরূপ সাহায্য করবেন না।
আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে এই সুধারনা এবং ভরসা প্রতিটি আহ্বানকারীর মধ্যে বর্তমান থাকে যে, তার বাতানো পথে চলা কঠিন নয়, তাঁর দেয়া জীবন ব্যবস্থা জটিলও নয় এবং এর ওপর আমল করাও কঠিন নয়, তিনি তাকে অসহায় পরিত্যাগ করবেননা এবং তাঁর সাহায্য অবশ্যই সে লাভ করবে। বিরুদ্ধবাদীরা যখন তার পথে প্রতিবন্ধকরাত সৃষ্টি করতে আরম্ভ করে এবং বাহ্যত মনে হতে থাকে যে, এই কাজ এখন আর সামনে অগ্রসর করা যাবেনা, তখন এই ভরসা তার মনে দৃঢ়তা ও উৎসাহ যোগায় যে, যে রাস্তার দিকে আল্লাহ তাআলা নিজেই আংগুলি নির্দেশ করে বলেছেন, এটাই হচ্ছে সত্য পথ- তখন সে পথে বিচরণকারী মঞ্জিলে মাকসুদ পর্যন্ত অবশ্যই পৌঁছে যাবে এবং এ পথে যত কঠিন বাধাই আসুক না কেন- কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য আসবেই। আল্লাহ তাআলার সাতে হকের আহ্বানকারীদের এই সম্পর্ক এবং তাঁর ওপর এই ভরসা রয়েছে। সুরা ইবরাহীমের নিম্নোক্ত আয়াতে তা প্রকাশ পেয়েছেঃ
وَمَا لَنَا أَلَّا نَتَوَكَّلَ عَلَى اللَّهِ وَقَدْ هَدَانَا سُبُلَنَا وَلَنَصْبِرَنَّ عَلَى مَا آذَيْتُمُونَا وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ
“আমরা কেন আল্লাহর ওপর ভরসা করবনা? অথচ তিনি আমাদরে জন্য আমাদের চলার পথ খুলে দিয়েছেন। আর তোমরা আমাদের যে উৎপীড়নই করবে- আমরা তাতে ধৈর্য ধারণ করব। ভরসাকারীরা যেন আল্লাহর ওপরই ভরসা করে।” (আয়াতঃ১২)
কখনো কখনো এরূপ হয়ে থাকে যে, আহ্বানকারী তার দায়িত্বের সীমা নির্দিষ্ট করার ভুল করে বসে। সে মনে করতে থাকে যে, লোকদের নিকট ঠিক ঠিকভাবে হককে পৌঁছে দেয়া পর্যন্তই তার দায়িত্ব সীমাবদ্ধ নয়। বরং লোকদের দ্বারা হককে কবুল করিয়ে নেয়া পর্যন্ত তার দায়িত্ব রয়েছে। এই ভ্রান্তির একটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি একেতো এই হয়ে থাকে যে, নির্ভেজাল হককে পেশ করার পরিবর্তে আহ্বানকারীর মধ্যে বিরুদ্ধবাদীদের বাতিল আকীদা ও চিন্তার সাথে সমঝোতা করার ঝোঁক প্রবণতা সৃষ্টি হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, একটি ভুল দায়িত্ব নিজের মাথায় তুলে নেয়ার কারণে সে নিজের জীবনকে কঠিন চিন্তাধারা এবং জটিলতার মধ্যে নিক্ষেপ করে। এই ধরনের ভ্রান্তি থেকে বাঁচানোর জন্যে কুরআন মজীদ বিস্তারিত পথনির্দেশ দার করেছে। যেমন,
وَمَا عَلَى الَّذِينَ يَتَّقُونَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَلَكِنْ ذِكْرَى لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
“তাদের কাজের কোন দায়িত্ব পরহেজগার লোকদের ওপর অর্পিত নয়। অবশ্য তাদের উপদেশ দান করা কর্তব্য-এই আমায় যে, তারা ভ্রান্ত নীতি ও চরিত্র থেকে বিরত থাকবে।” –(সূরা আনআমঃ৬৯)
اتَّبِعْ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ (106) وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكُوا وَمَا جَعَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا وَمَا أَنْتَ عَلَيْهِمْ بِوَكِيلٍ
“তুমি সেই জিনিসের অনুসরণ কর- যা তোমার ওপর তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নাযিল করা হচ্ছে। তিনি ছাড়া আর কোন মা‘বুদ নেই। তুমি এই মুশরিকদের জন্য ব্যতিব্যস্ত হবেনা। আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে (তিনি এমন ব্যবস্থা করতে পারতেন যে) আমরা তোমাকে এদের ওপর পাহারাদারদ নিযুক্তি করিনি। (যে তারা কোন ভুল করতে পারবেনা)। আর তুমি তাদের জন্য দায়িত্বশীল নও (যে তাদের ঈমান আনার ব্যাপারটি তোমার দায়েত্বে বর্তাবে)।” –(সূরা আনআমঃ ১০৭. ১০৭)
فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَعَلَيْنَا الْحِسَابُ
“তোমার দায়িত্ব শুধু পূর্ণরূপে পৌছছে দেয়া, হিসা নেয়ার দায়িত্ব আমার।” (সূরা রা’দঃ ৪০)
طه () مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى () إِلَّا تَذْكِرَةً لِمَنْ يَخْشَى
“তাহা। আমরা তোমার ওপর কুরআন এজন্য নাযিল করিনি যে, তুমি নিজের জীবনকে বিপদের মধ্যে নিক্ষেপ করবে। এটা তো স্মারক সেই সব লোকের জন্য যারা আল্লাহকে ভয় করে।” –(সূরা তা’হাঃ ১-৩)
বর্তমান যুগে যেসব লোক বিশ্বব্যাপী খোদাদ্রোহী শক্তির বিজয় দেখে হাতের ওপর হাত রেখে বসে আছে এবং হরেক দাওয়াতের কোন সুযোগ দেখতে পাচ্ছেনা। অথবা হরেক দাওয়াত বিস্তৃতি হওয়ার সম্ভাবনা না দেখে বাতিলের প্রচারে লেগে গেছে- তার পুর্বোল্লেখিত ভ্রান্তি নিমজ্জিত রয়েছে। এই লোকদের সামনে যদি এই সত্য পরিষ্কার করা বা না করা এবং এই দাওয়াতের ব্যপকতা লাভ করা বা না করা তাদের সাথে সম্পর্কিত নয় বরং এ ব্যাপারটি আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্কিত- তাহলে তারা সম্ভাবনা বা অসাম্ভাবনার জটিলতায় জড়িয়ে পড়তনা এবং একটি বাতিলের প্রচারের দায়িত্বও নিজেদের কাঁধে তুলে নিতনা। বরং তারা নিজেদের সাধ্যমত হকের প্রচার করত এবং আল্লাহ তাআলার কাছে আশা রাখত যে, যখন তিনি নিজেই হক এবং কহকের ভালবাসেন- তখন এ হককে তিনি অবশ্যই প্রসারিত করবেন। কিন্তু তারা নিজেদের বোঝার সাথে আল্লাহ তাআলার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে চাইল। যখন তারা অনুমান করতে পারল যে, এটা অত্যন্ত ভারী বোঝা, তাদের পক্ষে তা বহন করা অসম্ভব, তখন তাদেরকে বাধ্য হয়ে এই ঘোষণা দিতে হল যে, যাই হোক কল্যাণ ও বরকত পূর্ণ ব্যবস্থা হচ্ছে তাই যা ইসলাম পেশ করেছে- কিন্তু বর্তমান যুগে তাকে ব্যাপক ভাবে প্রতিষ্ঠা করা যেহেতু সম্ভব নয়- এই কারণে একটি অনৈসলামিক ব্যবস্থার প্রচার এবং তা কবুল করে নেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।
এই ধারণার মধ্যেই গোমরাহী লুকিয়ে আছে। এসবকিছু প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই এবং এখানে তা প্রকাশ করার সুযোগও নেই। অবশ্য আমরা একটি কথার দিকে ইশারা করতে চাই। এই লোকেরা জ্ঞাতসারে হকের পথ পরিত্যাগ করে কেবল এই ধারণার শিকার হয়ে বাতিলের পথ অবলম্বন করেছে যে, এই পথে চলা তারা সহজেই নিজেদের উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবে। অথচ এ পথেও যদি সফলতা আসে (যাকে তারা সফলতা মনে করছ) তবে আল্লাহর হুকুমেই আসতে পারে, তাদের নিজেদের চেষ্টা তদবীরে নয়। তারা একটি ভ্রান্ত পথে চালিত হয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের অবাকশ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে যদি নিজেরাও হকের পথে চলত, অন্যদেরও এ পথে চলার আহ্বান জানাত এবঙ আল্লাহর কাছ থেকে তৌফীক ও সফলতার জন্য অপেক্ষা করত- তাহলে এটা কি উত্তম ছিলনা?
তারা হকের আহ্বানকারী হিসাবে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের সীমা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেনি। এই মারাত্মক ভূল তাদের সমস্ত চেষ্টা-সাধনাকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত পথে নিয়োজিত করেছে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে যে সত্যের দিকে হেদায়াত দান কেরছেন, তাকে কোনরূপ পরিবর্তন পরিবর্ধন ও সংকোচন ব্রতিরেকে লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়াকেই শুধু নিজেরেদ কর্তব্য মনে করেনি, বরং তাদেরকে হকের অনুসারীতে পরিণত করাকেও নিজেদের কর্তব্য মনে করেনি, বরং তাদেরকে হকের অনুসারীতে পরিণত করাকেও নিজেদের দায়িত্ব মনে করে বসল। এই কাজ যখন তাদের কাছে কঠিন মনে হল, তখন তারা হককে পরিত্যাগ করে বাতিলকেই গ্রহণ করে নিল। এই ভ্রান্ত পদক্ষেপ অবশ্যম্ভাবীরূপে একজন আহ্বানকারীকে দয়াময় আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে শয়তানের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন সে কেবল আহ্বানকারীই থাকেনা বরং দাবীদার হয়ে আল্লাহর অধিকার সমূহে হস্তক্ষেপ করা এবং একটি নতুন ধর্মমত পেশকারী হিসাবে আবির্ভূত হয়।
একজন আহ্বানকরী যদি নিজের মর্যাদা সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত থাকত তাহলে তার কাছ থেকে এটা আশাই করা যেতনা যে, সে নিরাস এবং সন্দেহপ্রবণ হয়ে বসে থাকবে অথবা হকের পরিবের্ত বাতিলের প্রচার শুরু করে দেবে। অবশ্য শুধু প্রচারকার্য পর্যন্তেই তার দায়িত্ব সীমবাবদ্ধ- এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তার মধ্যে যাতে বেপরোয়া মনোভাব লঘুত্ব সৃষ্টি হতে না পারে- সেদিক থেকে তার নিজের ওপর নিজের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এই জিনিস থেকে নিজেকে বাঁচানের জন্য সব সময় আহ্বানকারীর দায়িত্ব ও কর্তব্যকে দৃষ্টির সামনে রাখতে হবে। এ দিকে খেয়াল না রাখার কারণে আল্লাহর কাছে এই অভিযোগের ভিত্তিতে তার গ্রেপ্তার হওয়ার আশংকা রয়েছে যে, তাবলীগ অথবা সাক্ষ্যদানের ফরজ যেভাবে আদায় করার নিয়ম ছিল সেভাবে আদায় করা হয়নি। আম্বিয়ায়ে কেরামদের সম্পর্কে বলা যায়, রিাসালাতের দায়িত্বানুভূতি তাঁদের মধ্যে এতটা প্রবল ছিল যে, অনেক সয় তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনীয় বিশ্রামের কথাও ভুলে যেতেন। এমনকি নিজেদের এবং নিজেদের দাওয়াতের মর্যাদা ও মাহাত্মের কথাও স্মরণ থাকতনা। বরং তাঁদের অস্বাভাবিক ব্যস্তার মাধ্যমে প্রকাশ পেত যে, তারঁরা নিজেদেরকে লোকদের কুফর ও ঈমানের দায়িত্বশীল মনে রাছেন। এই ধরণের ব্যস্তার ওপর আল্লাহ তাআল্ তাঁর নবীদের মহব্বত সুলভ ভংগীতে অভিযুক্ত করেছেন। এর কতিপয় দৃষ্টান্ত আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করে এসেছি। এই ধরনর ব্যস্ততা এবং বাহুল্য থেকে বেঁচে থাকাটাই হকের প্রতিটি আহ্বানকারীর বৈশিষ্ট্য হওয়অ উচিৎ।