৫
নবীদের সম্বোধন পন্থা
একথা সুস্পষ্ট যে, নবীদের আগমন এমন এক যুগের হয়ে থাকে যখন হক বাতিল ও সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় আল্লাহর অহীর সাহায্য ছাড়া অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং কার্যত সমস্ত জীবন ব্যবস্থা হকের পরিবর্তে বাতিলের হাতে চলে যায়। এরূপ সময়ে হক কেবল নবীদে সাথেই থাকে। তাদে নির্ধারিত সীমার বাইরে হকের কিছু অংশ তো পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু পূর্ণাংগ হক পাওয়া সম্ভব নয়। একারণে আম্বিয়ায়ে কেরাম যদি সূচনাতেই লোকদের এভাবে সম্বোধন অনুপযোগী ও অসংগত হতে পারেনা। কারণ বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই যে, তাঁদের কর্মসীমার বাইরে যা কিছু আছে তা কেবল কুফর এবং শিরক। কিন্তু যে ব্যক্তিই নবীদের ইতিহাস পড়ছে সে জানে যে, তাঁরা এভাবে সম্বোধন করননি। বরং তাঁরা লোকদেরকে- হে জনগণ, হে লোকসকল, হে আমার জাতির লোকেরা, হে কিতাবের অধিকারী সম্প্রদায়, হে ইহুদী সম্প্রদায়, হে নাসারা (খ্রীষ্ঠান) সম্প্রদায়, হে ঈমান গ্রহণকারীগণ- ইত্যাদি বাক্যে সম্বোধন করতেন।
নবী-রসূলগণ তাঁদের আহ্বানের এই ধরনটা ততক্ষণ অব্যাহত রাখেন- যতক্ষণ লোকেরা নিজেদের জিদ, একগুঁয়েমী এবং সত্যের বিরোধিতায় তাদেরকে এতটা নিরাশ করতে না পারে যে, তাদের জন্য নিজ সম্প্রদায় থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া অথবা হিজরত করার সময এসে যায়। যখন কোন জাতি সত্যের বিরোধিতায় এতটা সামনে অগ্রসর হয়ে যায় যে, তারা নিজেদের মাঝে হকপন্থীদের অস্তিত্বকে সাহায্য করতে মোটেই প্রস্তুত নয় এবং তাদে একগুঁয়েমীর সামনে হকের সমর্থনকারীর বড় থেকে বৃহত্তর প্রমাণও নিষ্ফল হয়ে যায়- তখন নবীগণ, নিজ নিজ জাতিকে পরিত্যাগ করেন। এ সময়ই তাঁরা পরিষ্কার ভাবে তাদের জন্য কাফের , মুশরিক, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন।
হযরত ইবরাহীমের আদর্শ
এমনিতেই এই সত্য প্রত্যেক নবীর দাওয়াতের মধ্যে প্রতিয়মান হয়ে আছে, কিন্তু বিশেষভাবে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে যার অভিজ্ঞাতা রয়েছে সে এ সত্যকে কোন ক্রমেই অস্বীকার করতে পারেনা। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজের পিতাকে, নিজের জাতিকে এবং সমসাময়িক বাদশাহকে যে বাক্যে সম্বোধন করেছেন। কিন্তু যখন দাওয়াত ও তাবলীগ করতে করতে একটা উল্লেখযোগ্য সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং দলীল-প্রমাণ ও মু‘জিযা সমূহের সার্বিক শক্তি জাতির একগুঁয়েমীর সামনে কেবল প্রভাবহীনই হয়ে যায়নি বরং হুমকি হয়ে দাঁড়ায়- এসময় তারা নিজ নিজ জাতির সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন এবং এমন বাক্যে এই ঘোষণা দেন, যা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, জাতির কুফর ও শিরকের সাথে উদারতা ও সহিষ্ণতার যে সর্বশেষ সীমা হতে পারে, তা এখন শেষ হয়ে গেছে। অতপর এখন তারা নিজ নিজ জাতির লোকদের ঘৃনা এবং শত্রুতার কথাও ঘোষণা করে দেন। তারা তৌহীদরে ওপর ঈমান আনা পর্যন্ত এই সংগাত চলতে থাকে।
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ
“তোমাদের জন্য ইবরাহীম এবং তার সাথীদের জীবনর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। তারা যখন জাতির লোকদের বলল, আমরা তোমাদের প্রতি এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া যেসব জিনিসের ইবাদত কর তার প্রতি অসন্তুষ্ট। আমরা তোমাদের প্রত্যাখ্যান করলাম। তোমরা ও আমাদের মাঝে শত্রুতা ও ঘৃণা-বিদ্বেষের ঘোষণা দেয়া হল।” –(সূরা মুমতাহনিাঃ৪)
রসূলুল্লাহর আদর্শ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের অবস্থাও ঠিক এইরূপ। হিজরতের নিকটবর্তী সময়ের পূর্বেকার কোন সূরায়ই একথার প্রমান পাওয়া যাবেনা। যে, তিনি তার জাতিকে অথবা আহলে কিতাব সম্প্রদায়কে প্রকাশ্যভাবে কাফের, মুশরিক, মোনাফিক ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে সম্বোধন করা হয়েছে তা হচ্ছে- হে মানুষ, হে মানব সমাজ, হে জাতির লোকেরা ইত্যাদি। অনুরূপ ভাবে আহলে কিতাবদের জন্য ‘হে আহলে কিতাব’ অথবা সম অর্থ প্রকাশক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি মোনাফিকদের জন্যও মক্কা বিজয়ের পর পর্যন্ত সেই ধারণ বাক্য ‘হে ঈমানদাগণ’ হে ব্যবহার হতে থাকে। কোথাও প্রকাশ্যভাবে ‘হে মোনাফিক গণ!’ বলে সম্বোধন করা হয়নি।
কিন্তু যখন একটা বিশেষ সময় পর্যন্ত দাওয়াত ও তাবলীগ করার পর জাতির ওপর আল্লাহর দীনের চুড়ান্ত প্রমাণ পূর্ণ হয়ে গেল এবং দীন প্রত্যাক্ষানকারীগণ কেবল দীনকে প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হলনা, বরং তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল- তখন তিনি হিজরত করলেন এবং কুরাইশ কাফেরদের পরিষ্কার ভাষায় ‘হে কাফেরগণ’ শব্দ দ্বারা সম্বোধন করলেন এবং তাদের ধর্মের সাথে নিজের স্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিলেন। এই হিজরতের প্রাক্কালে সেই সুরা নাযিল হয়- যা কুরাইশদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা বরং যুদ্ধের ঘোষণা সম্বলিত সুরাঃ
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ (1) لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ (2) وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ (3) وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ (4) وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ (5) لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ (6)
“বলে দাও, হে কাফেরগণ! তোমরা যেগুলোর ইবাদাত কর, আমি সেগুলোর ইবাদাত করিনা। আর আমি যাঁর ইবাদত করি, তোমরা তাঁর ইবাদাতকরী নও। তোমরা যেগুলোর ইবাদত কর, আমি সেগুলোর ইবাদাত করতে প্রস্তুত নই। আর আমি যাঁর ইবাদাত করে, তোমরা তাঁরা ইবাদাতকারী নও। তোমাদের জন্য তোমাদের দীন, আর আমার জন্য আমার দীন। [এই সূরার সর্বশেষ বক্তব্যকে লোকেরা উদারতার ও সহিষ্ণুতার ঘোষণা বলে সাব্যস্ত করতে চায়। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল। এটা মূলত সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা এবং যুদ্ধের ঘোষণা। বিস্তারিত জানার জন্য মাওলানা হামীদুদ্দীন ফারাহীর “তাফসীরে সূরা কাফিরূন” দ্রষ্টব্য।
কাফের এবং কুফরী কাজে লিপ্ত ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য
আম্বিয়ায়ে কেরাম এই যাবতীয় সতর্কতা ও সাবধানতা কেবল সেই সীমা পর্যন্তই অবলম্বন করতেন, যেখানে লোকদের কাফের সুলভ ও মুশরিক সুলভ কার্যকলাপকে কুফর এবং শিরক সাব্যস্ত করার ব্যাপারে তারা মোটেই উদারতা দেখাতেননা। এক্ষেত্রে তাঁরা যদি কোন কারণে সামান্য শিথিলতা প্রদর্শন করতে চাইতেন তাহলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁদেরকে সে অনুমতি দেয়া হতনা। কঠিন বিরোধপূর্ণ অবস্থায়ও তাঁদেরকে এই হেদায়াত দান করা হত যে, কোন কুফর অথবা শিরককে কুফর অথবা শিরক সাব্যস্ত করার ব্যাপারে তাঁরা কোন বিপদেরও পরোয়া করবেননা। এবং কোন সামাজিক- সামগ্রিক স্বার্থকেও বিবেচনা করবেননা। এর কারণ তো এটা হতেই পারে না যে, তাঁরা (নাউযুবিল্লাহ) লোকদের কাফের এবং মুশরিক সাব্যস্ত করতে চান। বরং তাঁরা কেবল অযথা ফ্যাসাদ সৃষ্টি হওয়ার আশংকায় অথবা লোকদের হকের দাওয়াত থেকে সরে যাওয়ার ভয়েই এরূপ করা থেকে বিরত থেকেচেন। এ ধরনের পরিনামদর্শিতা যদি তাদের কাছে জায়েয হত তাহলে কাফেররা যে ধরনের সমঝোতার প্রস্তাব পেশ করত তা তাঁরা মঞ্জুর করে অতি সাহজেই সব ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে পারতেন। কিন্তু কোন নবীই দীনের ব্যাপারে কখনো এধরনের পরিণামদর্শিতাকে বিবেচনা করেননি- চাই এজন্য তাদে যত বড় বিপদেরই মোকাবিলা করার প্রয়োজন হোক না কেন। একারণে এই প্রশ্নটি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে যে, কুফর ও শিরককে কুফর ও শিরক সাব্যস্ত করার ব্যাপারে যাঁরা এতটা বেপরোয়া এবং এতটা নির্ভিক ছিলেন- তাঁর কুফর ও শিরকে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাফের এবং মুশরিক বলার ব্যাপারে এতটা সতর্কতা অবলম্বন করলেন কেন এবং তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতে এতটা বিলম্বই বা করলেন কেন?
এই পার্থ্যক্যের দুটি কারণ
আমাদের মতে আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম কুফরী কাজ ও শেরেকী কাজকে কুফর এবং শিরক সাব্যস্ত করা সত্বেও এসব কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাফের এবং মুশরিক বলতে এবং তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতে যে বিলম্ব করেছেন তার দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণঃ প্রথম কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাআলার দরবারে বান্দাদের জন্য যে তিরষ্কার ও ভর্ৎসনা রয়েছে তা চুড়ান্ত প্রমাণ পেশ করার এবং পূর্ণাংগ তাবলীগ হওয়ার পরই করা হয়। যদি চুড়ান্ত প্রমান পেশ এবং তাবলীগ ব্যতীতই লোকদেরকে পাকড়াও করা বা তাদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করা জায়েয হত, তাহলে আল্লাহ তাআলা নবীদেরই পাঠাতেননা। এজন্য নবীগণ লোকদেরকে পাকড়াও করা বা তাদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করা জায়েয হত, তাহলে আল্লাহ তাআলা নবীদের পাঠাতেননা। এজন্য নবীগণ লোকরেদকে কাফের সাব্যস্ত করার এবং তাদে সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার ঘোষণা দেয়ার পূর্বে তাদে ওপর আল্লাহ তাআলার প্রমাণ পূর্ণ হওয়ার অবকাশ দেয়ার প্রয়োজন ছিল। যাতে আল্লাহর দীন প্রত্যখ্যান করার জন্য তাদের কাছে জিদ এবং একগুঁয়েমী ছাড়া আর কোন কারণ অবশিষ্ট না থাকে। প্রমান চুড়ান্ত করার জন্য একটি বিশেষ সময় ধরে দীনের প্রচার এবং শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজন রয়েছে। নবীদের আগমন বন্ধ থাকা কালীন সময়ে গোমরাহীর যে অন্ধকার ছেয়ে যায় তা এতটা গভীর হয়ে থাকে যে, এর মধ্যে বিশিষ্ট লোকেরাও রাস্তা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়না, সাধারণের তো প্রশ্নই ওঠেনা। এজন্য প্রত্যেক সম্প্রদায়ই প্রচার এবং প্রশিক্ষণের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। যাবতীয় গোমরাহীর যেহেতু বাপ-দাদার রসম-রেওয়াজের আকারে অন্তরে শিকড় গেড়ে বসে যায় এবং এর সাথে কিছু সংখ্যক লোকের স্বার্থও সংশ্লিষ্ট থাকে- তাই তার মূলোৎপাটন করার জন্য একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে সংগ্রাম সাধনার প্রয়োজন দেখা দেয়। নবী-রসূলগণ পূর্ণ ধৈর্য় সহকারে একটা দীর্ঘ সময় ধরে এই সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন। শেষ পর্যন্ত সত্য এতটা স্পষ্ট হয়ে সামনে এসে যায় যে, বাতিলের সাথে যাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট রয়েছে- তারা ব্যতিত আর কেউই এ সত্যকে অস্বীকার করতে পারেনা। যখন তাবলীগের হক এই সীমা পর্যন্ত পূর্ণ হয়ে যায়, তখন সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের কুফর ও শিরকের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া নবীদের জন্য বৈধ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় কারণঃ দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, এই যে, গোটা সমাজ ব্যবস্থা যখন হকের পরিবর্তে বাতিলের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলতে থাকে- তখন যেসব লোক হকের অনুসরণ করতে চায়-তাদের জন্যও তা অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসময় জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুষ্কৃতি এমর ভাবে ঢুকে পড়ে যে, কোন সচেতন এবং হুশিয়ার ব্যক্তির পক্ষেও তার কিছু বিষ গলাধকররণ করা ছাড়া শ্বাস গ্রহণ সম্ভব হয়না। এই অবস্থায় নবী-রসূলগণ যদি পরিস্থিতির নাজুকতা বিবেচনা না করে লোকদের ওপর কুফর ও শিরকের ফতোয়া আরোপ করে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতেন, তাহলে এতে অনেকের ওপরই চরম অবিচার হত। এর কারণে তাঁরা কুফরীর ফতোয়া আরোপ এবং সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে জেদের প্রচার কার্য শুরু করেননি। বরং এর পরিবর্তে তাঁরা দাওয়াত ও প্রচারকদের মাধ্যমে এমন অনুসুল পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন, যাতে হকপন্থীরা নিজেদের নীতিমালার ভিত্তিতে জীবন যাপন করতে পারেব। এই পরিবেশ যখন সৃষ্টি হতে থাকে এবং হকপন্থীদের জীবন যাত্রার অনুকুল রাস্তা উন্মুক্ত হতে থাকে যদিও তা এখনো সংকীর্ণ এবং কঠিনই হোক না কেন- তখন যেসব লোক হকের পথ পরিত্যাগ করে কেবল নিজেদের আত্মাতৃপ্তি, বিলাসিতা, বাহ্যাড়ম্বর ও প্রদর্শনীমূলক মনোবৃত্তির খাতিরে বাতিলের রাস্তায় দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে- তাদের কুফরী কাজের ঘোষণা দেয়া এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় এসে যায়।
বর্তমান পরিবেশে
আম্বিয়ায়ে এই উত্তম আদর্শ থেকে আমরা যদি বর্তমনে পরিবেশে পথনির্দেশনা লাভ করতে চাই, তাহলে একথা সুস্পষ্ট যে, বর্তমানে গোটা দুনিয়ায় যে পরিবেশ বিরাজ করছে তা অনেক দিক থেকে নবীদের আগমানধারা বন্ধ থাকাকালীন সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলার কিতাব আজ অবিকল অবস্থায় আমাদের মাঝে বর্তমান রয়েছে। এজন্য বর্তমান সময়ে দুনিয়া নতুন কোন নবীর মুখাপেক্ষী নয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত কোন নতুন নবীর মুখাপেক্ষী হবেও না। কিন্তু সৃষ্টকুলের পথপ্রদর্শণ এবং মুসলমানদেরকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য আমাদের শরীআত অনুমোদিত ব্যবস্থা ছিল খিলাফত ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একারণে দুনিয়ার মানুষ বর্তমানে যে বিকৃতি ও পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়ে আছে এজন্য তাদেরকে অনেকটা অক্ষম বলা যায়। আমরা এই পুস্তকের ‘তাবলীগের প্রচলিত পন্থায় ত্রুটি’ অধ্যায়ে বিস্তারিত ভাবে বলে এসেছি যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য দুনিয়ার সামনে চুড়ান্তভাবে প্রমান পেশ করার দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের ওপর অর্পন করেছেন। আর এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার পন্থাও আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন। তা হচ্ছে, মুসলমানরা খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম করবে। তা একদিকে দুনিয়ার মানুষকে কল্যাণ ও মঙ্গলের দিকে ডাকবে, অপরদিকে ন্যায়ানুগ কাজের নির্দেশ এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার (আমর বিল- মারুফ ও নাহি আনিল মুনকজা) মাধ্যমে মুসলমানদের সিরাতে মুস্তাকীমের ওপর কায়েম রাখবে। খিলাফত ব্যবস্থা কায়েম না থাকার কারণে এই দুনিয়া একটি বাতিল ব্যবস্থার অধীনে বন্দী হয়ে পড়েছে। আর বাতিল এতটা শক্তি ও চাকচিক্যের সাথে জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে যে, বর্তমান জীবন ব্যবস্থায় হকের জন্য কোন জায়গা একেবারেই অবশিষ্ট নেই। শিক্ষা ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইত্যাদি সব বিভাগ হক থেকে দূরে সরে পড়েছে এবং বাতিলের সাহায্য সহযোগিতায় নিয়োজিত রয়েছে। এমনকি এর অধীনে যদি ইসলামের নামে কোন ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কাজ আঞ্জাম দেয়া হয়ে থাকেও তাহলে বর্তমান সময়ের প্রতিকুল পরিবেশের কারণে তাতে বাতিলেরই সাহায্য হচ্ছে। নেককার- লোক যারা মূলতই সত্য এবং ন্যায়ের পথে চলতে চায়- আজ বিনা বাধায় কয়েক কদমও হকের রাস্তায় অগ্রসর হতে পারছেনা। যদি দুরের ব্যক্তি কিছু সময়ের জন্যও তাকে অবকাশ দেয়, কিন্তু কাছের ব্যক্তি তাকে ঝঞ্জাটে ফেলে দেয় এবং কোন ক্রমেই বরদাশত করতে চায়না যে, তার নিজের বেছে নেয়া পথে দু‘রকম অগ্রসর হোক। হযরত মসীহ আলাইহিস সালাম বলেনঃ
“পাপের রাস্তা প্রশস্ত এবং এ পথের যাত্রীর সংখ্যা অনেক। কিন্তু পূণ্যের রাস্তা সংকীর্ণ এবং এ পথের যাত্রী খুবই কম।”
এই সত্যকে আজ চোখে দেখা যাচ্ছে। বাতিলের মঞ্জিলে পৌছার জন্য প্রশস্ত ও প্রতিবন্ধকহীন পথ পড়ে আছে। তার দু‘পাশে রয়েছে ছায়ঘণ বৃক্ষরাজি। আরো রয়েছে দ্রুতগামী বাহন, নিরাপত্তার জন্য রয়েছে পথপ্রদর্শক। প্রতিটি মঞ্জিলে রয়েছে বিলাসিতার প্রাচুর্য। এখন যে সময় ইচ্ছা নিরাপদের গন্তব্যস্থলে পৌছে যেতে পারে।
অপরদিকে হকের রাস্তায় প্রথম পদক্ষেপেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যদি সাহসিকতার সাথে এ বাধা দূর করা যায়, হাতলে সামনের প্রতিটি পদক্ষেপেই রয়েছে বিপদের আশংকা। এমনকি যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি পদে বিপদ ছাড়া আর কিছুর সাথে সাক্ষাত হবেনা। আজ কোন ব্যক্তি নিজের মাথা সাথে নিয়ে এ পথে পা রাখার খুব কমই দুঃসাহস দেখতে পারেব। এই নাজুক এবং বিভ্রন্তির যুগে লোকেরা হেদায়াতের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গোমরাহীর পথে চলে গেলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। যদি আশ্চর্যের বিষয়। এরা তিরষ্কারের পরিবর্তে প্রশংসা পাবার অধিকারী এবং সম্পর্ক ছিন্ন করে দূরে নিক্ষেপ করার পরিবর্তে বুকের সাথে লাগিয়ে নেয়ার উপযুক্ত।
যেসব লোক এতটা প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও নিজেদের ঈমানের আলোকবর্তীকা জীবন্ত রেখেছে- তারা যদি অনুকুল পরিবেশ পেত তাহলে অতীব উত্তম মুসলমান হয়ে যেত। এ কারণে তাদের ভুল-ভ্রান্তি এবং অজান্তে বা একান্ত বাধ্য হয়ে গোমরাহীতে লিপ্ত হওয়ার ভিত্তিতে ঈমান থেকে বঞ্চিত ঘোষণা করে তাদেরকে ঘৃণা করার পরিবর্তে তাদের মধ্যে ঈমান ও ইসলামের সঠিক দাবী সম্পর্কে চেতনা ও অনুভূতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করা উচিত।