১৪
হকের দাওয়াতের সমর্থনকারী দল
হরেক দাওয়াতের বিরোধীদের মত এর সমর্থনকারী লোকেরাও তিন শ্রেণীতে বিভক্ত-
১. অগ্রবর্তী দল (সাবেকীনাল আওয়ালীন)।
২. উত্তম অনুসারী দল (মুত্তাবিঈনা বি-ইহসান)।
৩. দুর্বলচেতা এবং মোনাফিকের দল।
অগ্রবর্তী দল
হকের দাওয়াতের সমর্থনকারী লোকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হচ্ছে অগ্রবর্তী দলের লোকেরা। হকের দাওয়াত উথিত হওয়ার সাথে সাথেই যেসব লোক তা কবুল করে নেয় এবং অসংকোচে তার জন্য জীবন উত্সর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়- তারাই হচ্ছে অগ্রবর্তীদলের লোক। এরা হচ্ছে সুস্থ প্রকৃতির অধিকারী লোকদের দল- যারা দাওয়াত পাবার পূর্বেও নিজেদের মধ্যে এমন জিনিসের অনভব করতে থাকে বেদিক হকের আহবানকারী লোকদের ডেকে থাকে। এরা বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে এতটা উন্নত হয়ে থাকে যে, তারা শুধু দুনিয়ার প্রকাশ্য দিক নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেনা, বরং এর অদৃশ্য দিকের ইংগিতসমূহও অবলোকন এবং হৃদয়াংগম করতে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে প্রকাশ্য দিকের চেয়ে এই গোপন রহস্যেরই প্রকৃত মূল্য রয়েছে। তারা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় কেবল প্রবৃত্তির গোলাম হয় না, বরং বৃদ্ধিবিবেক এবং স্বাভাব- প্রকৃতির দাবীসমূহ জানার চেষ্টা করে এবং জীবনের প্রতিটি স্তরে এই দাবীগুলোকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। তাদের জ্ঞানবুদ্ধি এতটা শক্তিশালী এবং কর্মতত্পর হয়ে থাকে যে, তারা বাপদাদা ও পূর্ব পুরুষদের রীতিনীতি ও প্রচলিত প্রথার জিঞ্জিরে বন্দী থেকে অসহায়ভাবে পড়ে থাকাটা কখনো পছন্দ করে না। তারা প্রতিটি কথার ভাল এবং মন্দ দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়ার চেষ্টা করে, এটাকে সমালোচনা ও পর্যবেক্ষণের মানদন্ডে স্থাপন করে, এর মধ্যে যে জিনিসকে বুদ্ধিবিবেক, স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সমাঞ্জস্যপূর্ণ পায় তা কবুল করে নেয়। সাম্প্রদায়িক এবং সাংগঠনিক গোঁড়ামী অন্ধ অনুসারিতা থেকে এরা মুক্তি এবং স্বাধীন। তাদের মতে সত্য কোন ব্যক্তি বিশেষের আঁচলে বন্দী থাকতে পারে না, কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠির মধ্যেও অবরুদ্ধ থাকেনা এবং তা পরিত্যাক্ত সম্পত্তির ন্যয় ওয়ারিসদের কাছে হস্তান্তিরিত হয় না, তারা কোন কথাকে সত্য বলে মেনে নেয়ার জন্য জ্ঞানবুদ্ধি এবং প্রকৃতির সাক্ষ্যকেই যথেষ্ট মনে করে। তারা একথার মোটেই পরোয়া করে না যে, কে এ কথার বিরোধী আর কে সমর্থক। তারা অতীতেরও মুরীদ নয়, বর্তমানেরও দাস নয়। তারা আল্লাহ এবং তাঁর রসূল ছাড়া কোন মহান থেকে মহত্তম নেতাকেও হূজ্জাত এবং সনদ হওয়ার মর্যাদা দান করেনা।
অনৃরূপভাবে এসব লোক নৈতিক এবং কর্ম সম্পাদনার দিক থেকেও অনেক উন্নত হয়ে থাকে। তাদের জ্ঞান যে জিনিসের সত্য হওয়াকে তাদের সামনে তুলে ধরে-তাদের নৈতিক সাহস তাদেরকে তা গ্রহণ করতে এবং তার জন্য যে কোন ক্ষতিকে বরদাশত করতে প্রস্তুত করে দেয়। হকের সাহায্যের জন্য এসব লোক প্রখর অনুভুতি সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাদের পক্ষে হককে নির্যাতিত অবস্থায় দেখা সম্ভব নয়। এ জন্য তাদের মন সব সময় দুখ্য ভারাক্রান্ত থাকে। তারা সমসাময়িক যুগের এমন প্রতিটি কাজেই অংশ গ্রহণ করে যার মধ্যে তারা সামষ্টিক কল্যাণের কোন দিক দেখতে পায়। হকের জন্য কোন কাজ হচ্ছে, অন্যরা তার জন্য দুখ্য-মসীবত ভোগ করছে, জানমাল কোরবানী করছে- আর তারা নীরবে তামাশা দেখার মত তা অবলোকন করে যাচ্ছে- এমন আচরণ তাদের ব্যক্তিত্ব কখনো বরদাশত করতে পারে না। বরং এই দাওয়াতকে সম্প্রসারিত করার জন্য তারা নিজেরাও সক্রিয় হয় এবং এ পথে বড় থেকে বৃহত্তর কোরবানী পেশ করার জন্য নিজেদের পেশ করে দেয়। তারা নিকৃষ্টিতম পরিবেশেও উত্তম ও নিষ্কলুস জীবন যাপন করার জন্য চেষ্টিত থাকে এবং এজন্য নিজেদের যুগের জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত থাকে। যেখানে সবার হাত যুলুম এবং অন্যায়-অবিচারে পরিপূর্ণ সেখানে তারা আদল-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। যেখানে এতীমদের হক আত্মসাৎ হয়ে যাচ্ছে, যেখানে কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া হয়, যেখানে বিধবাদের সংগীহীন সাহায্যহীন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়- সেখানে তারা এতিমের হক পৌছে দেয়, যালেম পিতার কন্যা সন্তানদের নিজ খরচে লালন-পালন করার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং বিধবাদের দেখাশুনা করে। যেখানে জুয়া, শরাব, ব্যভিচার, রাহাজানি এবং লুটতরাজকে কৌশল মনে করা হয় এবং এজন্য গৌরব করা হয়- সেখানে তারা উদারতা, বদান্যতা, সৃষ্টিরসেবা, অতিথি সেবা, আর্তগরীবদের সেবা, নির্যাতিতের সাহায্য এবং অন্যান্য ব্যাপারে উন্নত চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়। তাদের মধ্যে গর্ব-অহংকারের পরিবর্তে বিনয় ও নম্রতা এবং সত্য প্রীতির আবেগ দেখা যায়। হিংসা বিদ্বষের স্থলে হকের পথে বেচে থাকা এবং অগ্রবর্তী হওয়ার চেষ্টা করে। আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার স্থলে স্বার্থ ত্যাগ ও খেদমতে-খালকের আবেগে পরিপূর্ণ থাকে। কোন ব্যবস্থাকে সত্য বলে মেনে নেয়ার পর অপমান ও লাঞ্ছিত হওয়ার আশংকায় এবং আরাম-আয়েশের সুযোগ খতম হয়ে যাওয়ার ভয়ে তার সাহায্য করতে এগিয়ে না আসাকে তারা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার মনে করে। অনুরূপভাবে কোন একটি জিনিসেকে বাতিল বলে স্বীকার করে নেয়ার পর এর সাথে নিজের কোন পার্থিব স্বার্থ জড়িত থাকার কারণে তাকে উদারতা, বাদান্যতা, সৃষ্টিরসেবা, অতিথি সেবা, আর্তগরীবদের সেবাম নির্যাতিতের সাহায্য এবং অন্যান্য ব্যাপারে উন্নত চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়। তাদের মধ্যে গর্ব-অহংকারের পরিবর্তে বিনয় নম্রতা এবং সত্য প্রীতির আবেগ দেখা যায়। হিংসা-বিদ্বেষের স্থলে হকের পথে বেঁচে থাকা এবং অগ্রবর্তী হওয়ার চেষ্টা করে। আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার স্থলে স্বার্থত্যাগ ও খেদমতে-খালেকের আবেগে পরিপূর্ণ থাকে। কোন ব্যবস্থাকে সত্য বলে মেনে নেয়ার পর অপমান ও লাঞ্ছিত হওয়ার আশংকায় একং আরাম-আয়েশের সুযোগ খতম হয়ে যাওয়অর ভয়ে তার সাহায্য করতে এগিয়ে না আসাকে তারা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার মনে করে। অনুরূপভাবে কোন একটি জিনিসকে বাতিল বলে স্বীকার করে নেয়ার পর এর সাথে নিজের কোন পার্থিব স্বার্থ জড়িত থাকার কারণে তাকে পরিত্যাগ না করাকেও তারা জঘন্য ব্যাপার মনে করে। কোন একটি সৎ কাজ করতে গেলে কোন ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, অথবা বাতিল খুবই শক্তিশালী, এর মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, অথবা যুগের পরিস্থিতি অত্যন্ত প্রতিকুল এবং এই প্রতিকুল অবস্থায় হরেক নাম উচ্চারণ করার অর্থ হচ্ছে দু:খ ও বিপদাপদকে ডেকে আনা। এ কারণে হকের সাহায্যকারী না হওয়াটাও তাদের পৌরষসুলভ ব্যক্তিত্বের জন্য অসম্মানজনক মনে করে। প্রথম কথা হচ্ছে এই ধরনের (শব্দ বুঝা যাচ্ছে না। ১৬৬পৃ.) তাদের প্রশস্ত হৃদয়ের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে না, যদিও বা সৃষ্টি হয় তাহলে তাদের উন্নত মনোবল শীঘ্র তা দূর করে দিতে সক্ষম হয়। এবং তাদের অন্তরে গভীর থেকে যে কাজের ডাক উঠেছে তা করার জন্য তারা নতুন উদ্যমেপ্রস্তুত হয়ে যায়।
এ ধরনের একটি পবিত্র ও নিষ্কলুষ দল প্রত্যেক যুগের জাহেলী ব্যবস্থার মধ্যে বর্তমান থাকে। বৃষ্টির অন্ধকার রাতে জোনাকীরা যেভাবে আলোর চমক দেখায়, অনুরূপ ভাবে এই লোকেরা নিজেদের যুগের অন্ধকারের মধ্যে আলোকের মত বিচরণ করে। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে তাদের যুগের আলোর একটি দৃশ্য অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু তাদের শক্তি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে। এজন্য তাদেরকে সংঘবদ্ধ করে ঐক্যসূত্রে গেঁথে নেয়ার জন্য কোন হকের আহবানকারীর উথিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাদের মধ্যে এসব সৌন্দর্য ও যোগ্যতার সমাবেশ থাকা সত্ত্বেও দুটি কারণে তারাএকজন হকের আহ্বানকারীর মুখাপেক্ষী।
একটি কারণ তো হচ্ছে যে, তাদের যুগে হক তার সমষ্টিগত আকারে বর্তমান থাকে না। শুধু তার কতগুলো অংশ বিচ্ছিন্নভাবে বর্তমান থাকে। যেমনটা নবীদের (দুই নবীর মধ্যবর্তী) যুগে হয়েছিল। এই রকম সময়ে সালেহীনদের এই দলটি এক দুর্বিপাক এবং অস্থির অবস্থায় নিমোজ্জিত থাকে। এই লোকেরা দুনয়ায় সাধারণভাবে দুস্কৃতির ছড়াছড়ি দেখে বিধ্বস্ত হলো ঠিকই, কিন্তু এই দুষ্কৃতির সংশোধন কিভাবে কা যায় তা তাদের জানা থাকে না। আর নিজেদের সমসাময়িক যুগের দূর্ণীকি থেকে যতদূর সম্ভব নিজেদের মুক্ত রাখেন, কিন্তু নেকী এবং সৌভাগ্যের রাজপথ তাদের সামনে বর্তমান থাকে না। সুতরাং অন্যদের সেদিকে ডাকার প্রশ্নই উঠে না। তারা এটা ঠিকই অনুভব করেন যে, দাসত্ব এবং আনুগত্য করার পন্থা সরাসরি তাদেরও জানা থাকে না এবং তা জানারও কোন উপায় তাদের কাছে থাকে না। এই শ্রেণীর লোকেরাই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্বে কোরাইশদের জাহেলী ধর্মের প্রতি বিরাগ হয়ে নিজস্বভাবে আল্লাহর ইবাদত করতো এবং কাবা ঘরের দেয়ালের সাথে মিশে গিয়ে অত্যন্ত অনুতাপের সাথে বলত,
“হে আল্লাহ! তোমার ইবাদত করার পদ্ধতি কি তা আমাদের জানা নেই। অন্যথায় আমরা সেই পদ্ধতিতে ইবাদত করতাম।”
তাদের মধ্যে উন্নত মানসিকতা সম্পন্ন কবিও ছিল। তাদের কবিতার ঢং তাদের যুগের সাধারণভাবে পরিব্যপ্ত ইন্দ্রিয়াসক্ত ও (শব্দটি বুঝা যাচ্ছে না। ৬৭ পৃ.) কবিতার চেয়ে এতটা ভিন্নতর যে, স্বয়ং নবী করীম (সা) তাদের কবিতা শুনে এভাবে প্রশংসা করলেনঃ
“এরা মুসলমান হওয়র পথে রয়ে গেল। তাদের মধ্যে ******** বক্তাও ছিল, যাদের বক্তৃতা বর্তমান কালেও মওজুদ রয়েছে। তা পাঠ প্রতিটি ব্যক্তি অনুমান করতে পারেবে যে, তারা সত্যের দরজায় করাঘাত করছিল, অবশ্যেই যদিও তা খুলতে সক্ষম হয়নি। তাদের মধ্যে অরাকা ইবনে নওফাল, আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ, উসমান ইবনে হুয়াইরিস, ইয়াযীদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল প্রুমুখের মত নির্ভীক লোক ছিল। তারা প্রকাশ্যভাবেই বলত, “এটা বাজে এবং অর্থহীন কাজ যে, আমরা ইকটি পাথরের সামনে মাথা নত করি। অথচ এটা না শুনতে পায়, না দেখতে পায়, না কোন ক্ষতি করতে পারে, আর না কারো কোন উপকার করতে পারে।
এই লোকেরা সত্যের সন্ধানী ছিল, কিন্তু তাদের সময় পূর্ণ হক বর্তমান ছিল না। এজন্য তারা হক নিয়ে আগমনকারী একজন লোকের মুখাপেক্ষী ছিল যে, তিনিতাদের পথ প্রদর্শন করবেন। সুতরাং যখনই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব হল এবং তিনি হকের আওয়াজ করলেন তখনই যুগের হকের অনুসন্ধানী সমস্ত লোক তার চারপাশে এসে জমা হয়ে গেল। এই লোকেরা হকের স্বাদের সাথে পরিচিত ছিল, তাই হককে চেনার ব্যাপারে তাদের কোন কষ্ট হয়নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি কথা তাদের কাছে তাদের নিজেদের হৃদয়ের কথাই মনে হল। তারা একজন সহজ সরল ব্যক্তি এবং একজন মিথ্যূকের মধ্যে সহজেই পার্থক্য করতে পারত। এ জন্য তাঁর পূতপবিত্র চরিত্র দেখার পর তাদের এরূপ ধারণাও হয়নি যে, এই ব্যক্তি মিথ্যাও বলতে পারে। তারা তাঁর আহবান এবং তাঁর চেহেরা দেখেই তাঁর নবুওয়াতকে চিনে ফেলেছে এবং ডাক দিয়ে উঠেছে-
رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা এক আহবানকারীর ডাক শুনেছি-তিনি ঈমানের দাওয়াত দিচ্ছেন যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ওপর ঈমান আন। অতএব আমরা ঈমান এনেছি।“(সূরা আলে ইমরান: ১৯৩)
এই লোকেরা যেহেতু হকের জন্য অপেক্ষামান ছিল, এজন্য তা পেয়ে যাওয়ার পর তারা বিতর্কে লিপ্ত হয়নি। বরং তা পেয়ে যাওয়ার পর তাদের অবস্থা এমন হয়ে গেল- যেমন হারানো বন্ধুকে অনেক দিন পর ফিরে পাবার পর যে অবস্থা হয়ে থাকে।
وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَى أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ
“রসূলের ওপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তা যখন তারা শুনতে পায়- তখন তোমরা দেখতে পাও হককে চিনতে পারার আবেগ তাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে যায়। তারা বলে, হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমাণ এনেছি, অতএব আমাদেরকে হক প্রকাশকারীদের মধ্যে লিখে নিন।“(সূরা মায়েদা: ৮৩)
দুই: তাদের বিচ্ছিন্নতা এবং অসংগঠিত থাকার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এই যে, হক তাদের সামনে বর্তমান থাকতে পারে, তারা এ দাবী এবং দায়িত্ব-কর্তব্য বোঝার জন্য কোন নবীর আগমন এবং কোন কিতাব নাযিলের মখাপেক্ষী না হতে পারে, কিন্তু তাদের পথ প্রদর্শনের জন্য কোন নেতার অভাব থেকে যায়- যে তাদের বিক্ষিপ্ত শক্তিকে এক পথে নিয়োগ করতে পারে। যে সমাজে রাতের গাঢ়ো অন্ধকারের ন্যায় জাহেলীয়াত ছেয়ে রয়েছে-এমন একটি বিকৃত পরিবেশে সত্পথের সাথে পরিচিত হওয়া সত্বেও প্রতিটি লোকর মধ্যে এরূপ যোগ্যতা বর্তমান থাকে না যে, সে নিজেই কাফেলার পথ প্রদর্শন এবং জাতির নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য সামনে এগিয়ে আসতে পারে। ইমামত এবং নেতৃত্বের পাগল তো নিসন্দেহে অন্ধ হওয়া সত্বেও অন্যদের পথ প্রদর্শনের জন্য এগিয়ে আসে, কিন্তু নেককার লোক-যারা নেতৃত্বের ভাল-মন্দ ও সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন-যতদূর সম্ভব তারা এই মহান কাজের দায়িত্ব থেকে নিজেদের বাচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তারা নিজেদের খোদাভীতি এবং দায়িত্বানুভূতির কারণে প্রথমত নিজেদের পরিমাপ করার ব্যাপারে অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে থাকে। যদি পরিমাণ করার ব্যাপারে তারা কোনরূপ ভুল করওে বসে তাহলে এই ভুল তাদের দ্বারা সচেতন অবস্থায় এবং সজ্ঞানে সংঘটিত হয় না। তারা কখনো নিজেদের দিকের পাল্লা ভারী করার চেষ্টা করে না। বরং তারা সাধ্যমত সতর্কতা অবলম্বন করার করণে নিজেদের সম্পর্কে প্রকৃত যোগ্যতা থেকেও কমই অনুমান করে থাকে। নিজেদেরকে নিজেদের আসল যোগ্যতা থেকেও কম করে পরিমাণ করাটা সতর্কতা এবং তাকওয়ার একটি আবশ্যকীয় দাবী। অযোগ্য এবং অপদার্থ লোকেরা রাজনীতি এবং নেতৃত্বে যতটা লোভী হয়ে থাকে- যোগ্য এবং উপযুক্ত ব্যক্তিরা তার প্রতি ততটা ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রা) এবং হযরত উমর ফারুক (রা) উভয়ে নিজনিজকে সাকীফায়ে বনী সায়েদার যেভাবে খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণও আমাদের সামনে রয়েছে। খেয়াফতে রাশেদার পরবর্তী যুগে এই জিনিসের জন্য অযোগ্য এবং লোভী ব্যক্তিরা যেভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং খনখারাবী করেছে তাও আমাদের জানা আছে। যেসব লোকের মধ্যে খোদার ভয় রয়েছে তারা অগ্রবর্তী হয়ে নেতৃত্ব গ্রহণ করার পরিবর্তে অন্যরা তা গ্রহণ করুক সাধ্যমত এই চেষ্টা করেন। এই ধরণের অনুভূতি মূলতই কল্যাণকর। কিন্তু তারও একটি নির্দিষ্ট সীমা রয়েছে। তারা যদি এই সীমা অতিক্রম করে যায় তাহলে এর ফল এই দাঁড়ায় যে, নেককার লোকদের ওপর ব্যক্তিগত পর্যায়ের নেকীর ধারণা প্রভাবশালী হয়ে পড়ে এবং হকের প্রতিষ্ঠার জন্য সমষ্টিগতভাবে আন্দোলন পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আল্লাহর যে সব বান্দা সামগ্রিকভাবে আন্দোলন পরিচালনা করার গুরুত্বকে ভালভাবে হৃদয়াংগম করতে সক্ষম তারা এই ধরণের পরিস্থিতিকে বরদাশত করতে পরেনা। তারা জানে যে, এই ধরণের ব্যক্তিগত আমল এবং বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার দ্বারা দীনে হকের দাবী পূর্ণ করতে পারে না। এই অনুভূতি যখন কোন ব্যক্তির ওপর এতটা প্রভাবশালী হয়ে পড়ে যে, সে তাকে আর দাবিয়ে রাখতে পারে না- তখন সে আল্লাহর সাথে নিয়ে একাকিই দাড়িয়ে যায় এবং দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্য আহবান জানাতে থাকে।
এই আযান জামায়াতে নামায পড়ার জন্য অপেক্ষামান লোকদেরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে নেয়। তারা তার সাথে এজন্য ঝগড়া বাধায়না যে, তুমি কেন আযান দিলে। কেননা তারা জানে যে, আযানের সময় কখন হয়ে গেছে। তারা এজন্য হিংষায় পুড়ে মরেনা যে, এই কাজ সে করল কেন। তারা করলনা কেন। বরং তারা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যে, সে এমন কাজ করেছে যার অপেক্ষায় তারা বিছানায় শুয়ে শুয়ে পার্শ্ব পরিবর্তন করতে থেকেছে, কিন্তু উঠার সাহস করতে পারেনি। তারা এটাও দেখার প্রয়োজন মনে করে না যে, এই ব্যক্তি পূর্ণাংগ মুত্তাকী রাত্রী জাগরণকারী সাধক কি না। কেননা তারা জানে যে, সমস্ত শবজিন্দা সাধক এবং পরিপূর্ণ মুত্তাকী শুয়ে আছে এবং সময়ের কর্তব্য কাজ জানার তৌফীক এই ব্যক্তিরই হয়েছে। তারা এটাও চিন্তা করে না যে, সে আজ যেভাবে আজকের দায়িত্ব পালন করেছে, আগামীকালের দায়িত্ব অনরূপভাবে পালন করতে পারবে কি না। বরং তারা আশা রাখে যে, সে আজকের কাজ যেভাবে আঞ্জাম দিয়েছে, অনরুপ ভাবে আগামী কালের কাজও সম্পাদন করার তৌফীক পেয়ে যাবে। যদি সে তৌফীক না হয় তাহলে আল্লাহ তাআলা আগামী কালের কাজের জন্য আর কোন বান্দাকে দাড় করিয়ে দিবেন। সে কোন গোত্রের? কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রীধারী? তার অতীত কেমন ছিল? এসব প্রশ্ন তাদের কাছে অজানার বাইরে। এজন্য যে, সত্য কোন গোষ্ঠি অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। যে ব্যক্তি বর্তমান সময়ের করণীয় কাজ কি তা বুঝতে সক্ষম হয়েছে তার কাছে অতীতের জট খোলার অবসর নেই। এধরণের নির্মল মানসিকতার অধিকারী লোক যারা পূর্ব থেকেই হকের কালিমা সমুন্নত করার আকাংখা পোষণ করে আসছে তারা সময়ের এই দাওয়াতের মধ্যে নিজেদের ব্যথা বেদনার নিরাময় লাভ করে থাকে। এ কারণে তারা অবিলম্বে এই দাওয়াত কবুল করে নেয় এবং তাকে সফলতার দ্বার পর্যন্ত পৌছানোর সংগ্রামে তত্পর হয়।
এই দলটির মধ্যে ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহরে-গ্রাম্য, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ প্রত্যেক পর্যায়ের লোক পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের মধ্যে কোন ব্যক্তিই নৈতিক দিক থেকে কখনো নীচু মানের নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে নিজের গুণাবলীর দিক থেকে পূর্ব থেকেই বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী এবং নিজের পরিমণ্ডলে অন্যদের কাছে নির্ভর যোগ্য বলে স্বীকৃত। এই লোকদের একত্র করার জন্য হকের আহবানকারীকে ব্যাপক পরিশ্রম করতে হয়না। বরং তারা নিজেরাই প্রতিটি স্থান থেকে আকর্ষিত হয়ে আহবানকারীর চারপাশে জড়ো হয়। আহবানকারী তাদের খোজ করে বের করে না। বরং তারাই আহবানকারীকে খুজে নেয়। এরা পিপাসার্ত। এজন্য তারা এটা আশা করে না যে, নদীর প্রবাহ তাদের কাছে এসে যাক, বরং মরুভূমি ও পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে তারাই পানির উত্সর কাছে পৌছে যায়। তাদের প্রকৃতির স্বচ্ছ তৈল আগুনে স্পর্শ করার পূর্বেই প্রজ্জলীত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে। এ জন্য দিয়াশলাই দেখার সাথে সাথে প্রজ্জলিত হয়ে উঠে। তারা কোন মু‘জিযা বা অলৌকিক কিছু দেখানোর দাবি করে না। নাম, বংশ পরিচয় ও বংশ তালিকা জিজ্ঞেস করেনা, অর্থহীন বিতর্ক ও যুক্তিপ্রমাণ দাড় করায় না। শুধু এতটুকুই দেখে যে, আহবানকারী যে কথার দিকে ডাকছে তা সত্য কি না। এবং নিজেও এ পথের অনসরণ করছে কিনা। যদি এদিক থেকে তারা নিশ্চিত হয়ে যায় তাহলে তারা পরিপূর্ণ মনোনিবেশ সহকারে তার অনসারী হয়ে যায়। ভবিষ্যতের কোন সম্ভাব্য বিপদের আশংকায় আজকের একটি বাস্তব সত্যকে তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করেনা। তারা একথার ওপর নিশ্চিত থাকে যে, যে জ্ঞানের ভিত্তিতে তারা আজ হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে হককে গ্রহণ করছে সেই জ্ঞান আগামী কালও হক এবং বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্নয় করার জন্য তাদের কাছে বর্তমান থাকবে। যদি তারা দেখতে পায় যে, কোন স্তরে আহবান কারীর রাস্তা হকের রাজপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে, তখন সেখান থেকে তারা আহবানকারীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের লক্ষ্য অপবিত্র না করে হকের রাজপথে নিজেদের সফর শুরু করে দেয়া।
২. উত্তম অনুসারী দল
হকের দাওয়াত কবুল কারীদের দ্বিতীয় পর্যায়ের লোক হচ্ছে উত্তম অনুসারীদের দল। অর্থাৎ যারা অগ্রবর্তী দলের দেখা দেখি হকের দিকে অগ্রসর হয়। এই লোকরা জ্ঞানবুদ্ধি এবং চরিত্র নৈতিকতার দিক থেকে অগ্রবর্তী দলের সমান পর্যায়ের নয়। একারণে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোন বড় ধরণের পদক্ষেপ নিতে পারে না। এবং কোন নতুন পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য পা উঠাতে ভয় পায়। তাদের মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতা বর্তমান থাকে না। এজন্য তাদের পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী লোকদের সাহসিকতা ও বীরত্ব তাদেরকে যতটা প্রভাবিত করে, হকের দাওয়াতের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রমাণিক শক্তি তাদেরকে ততটা প্রভাবিত করেতে পারেনা। এরা যখন দেখতে পায় হকের কোন দাওয়াত আত্মপ্রকাশ করছে, কতিপয় লোক সামনে অগ্রসর হয়ে সাহসিকতার সাথে তা কবুল করে নিয়েছ, তাকে নিয়ে তারা আরো সামনে অগ্রসর হচ্ছে এবং তাকে দুনিয়ায় প্রসারিত করার জন্য তারা যে কোন ধরণের বিপদের ঝুকি নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা বরদাশত করার জন্য প্রস্তুত আছে- তখন এটা তাদের অন্তরকে প্রভাবিত করে এবং তারা এর সহযোগীতা করার জন্য নিজেদের সাহস-শক্তিকে পরীক্ষা করতে থাকে। এই লোকদের যোগ্যতা এবং প্রতিবন্ধকতা বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। এজন্য এই দন্দ্বে কিছুটা সময় লেগে যায়। কিন্তু হকের আহবানকারীদের অবিরত প্রচেষ্টা এবং তাদের সামনে আগত বিপদাপদে তাদের ধৈর্য ও অবিচলতা দেখতে দেখতে শেষ পর্যন্ত তাদের অন্তরের রংও পরিষ্কার হয়ে যায়। এবং তারা সাহস করে একের পর এক বাতিল থেকে বের হয়ে এসে হকের সাথে মিলিত হয়।
এই লোকেরা যদিও অগ্রবর্তী দলের দেখাদেখি হকের হকের দাওয়াতের সহযোগী হয়ে থাকে, কিন্তু যখন সহযোগীতা করে তখন পূর্ণ সহযোগীতা করে, কোন প্রকারের দুর্বলতা, সংশয় সন্দেহ, কাপুরুষতা, মানসিক দুর্বলতা এবং নিফাকের প্রাকশ করেনা। তার কারণ এই যে, তারা বুদ্ধিবিৃত্তিক এবং নৈতিক দিক থেকে যদিও প্রথম কাতারের লোক নয়, কিন্তু দ্বিতীয় সারির উন্নত ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকে। তারা নিজেদের অহংবোধের দুর্বলতার কারণে নিজেদের যুগের জাহেলিয়াতের দ্বারা অবশ্যই প্রভাবিত হয়, কিন্তু তাদের মধ্যেকার হকের চেতনা একেবারে মরে যায়না। এ করণে বাতিল ব্যবস্থার গাড়ী যতক্ষণ টানতে থাকে, কষ্ট এবং অস্থিরতা সহকারে টেনে থাকে এবং নিজেদের হৃদয়ের গভীরে হকের প্রতি মর্যাদা অনভব করতে থাকে। বাতিল ব্যবস্থার সাথে তাদের এই সংযোগ কখনো সংকুচিত হয়ে যায়, আবার কখনো প্রসারিত হয়। কিন্তু এই সংযোগ কখনো একেবারে ছিন্ন হয়ে যায়না। নি:সন্দেহে বলা যায় নিজেদের পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে তাকে পরিবর্তন করে দেয়ার মত যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকে না। একারণে তাদেরকে নিজেদের যুগের জাহেলী ব্যবস্থার ওপর পরিতৃপ্ত থাকেতে হয়। কিন্তু তাদের এই পরিতৃপ্তির গভীরে একটি বেদনা চাপা পড়ে থাকে। যখন তাদের সামনে হকের কোন দাওয়াত এসে যায় তখন এই বেদনা উথিত হয়ে আসে। এই যাতনা বৃদ্ধি পেতে পেতে যখন তাদের সহ্যের সীমার বাইরে চলে যায়, তখন তারা সাহস করে সেই পথে অগ্রসর হতে থাকে যে পথে কতিপয় সত্যপন্থী লোকদের তারা চলতে দেখে। তাদের এই আসাটা যেহেতু নিজেদের ইচ্ছায় হয়ে থাকে, অন্য কারো চাপের কারণে নয় এবং তাদের এই পদক্ষেপ যেহেতু তাদের নির্ভীকতার দাবী অনযায়ী হয়ে থাকে, কোন গোপন স্বার্থপরতার করণে নয়, এজন্য সংলাপ ও দুরদৃষ্টির পাথেয় তাদের কাছে মওজুদ থাকে- যা পরবর্তী স্তরসমূহে এবং বিপদে আপদে তাদের ঈমানের হেফাজন করে এবং বড় থেকে বৃহত্তর কোন পরীক্ষায়ও তাদের পা ফসকে যেতে দেয়না।
এই লোকদের হকের দিকে টেনে আনার জন্য হকের আহবানকারীকে যথেষ্ট পরশ্রম করতে হয়। আমরা পূর্বেও বলে এসেছি যে, এই লোকেরা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকেও এতটা অগ্রগামী নয় যে, হকের বাস্তব নমুনা দেখা ছাড়াই তারা তাদের আয়ত্বে আসতে পারে, আর নৈতিক দিক থেকেও তারা এতটা উন্নত নয় যে, তার সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতে পারে। তাদের এই দুই দুর্বলতার করণে হকের আহবানকারীকে তাদের সাথে কিছুকার যাবত সংঘাতে লিপ্ত থাকতে হয়। সর্বপ্রথমেই তারা এই কথার মুখাপেক্ষী যে, তাদের সামনে হককে সুস্পষ্ঠ ভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে এর কোন দিকই অস্পষ্ট থেকে যেতে না পারে। তাদের মনের মধ্যে যেসব সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয় তাও দূর করতে হবে এবং অন্যদের দ্বারা যেসব সন্দেহ তাদের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে যতদূর সম্ভব তাও দুরীভূত করার চেষ্টা করতে হবে। এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে তাদের হৃদয় পূর্ণরূপে দাওয়াতের সত্যতার ওপর জমে যেতে পারে। যখন এটা সম্ভব হবে তখন তাদের নৈতিক মনোবল বৃদ্ধি করার জন্য তাদের সামনে দৃঢ় সংকল্পপূর্ণ এবং বীরত্বপূর্ণ ঘটনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হবে। এসব দৃষ্টান্ত তাদের মনের শক্তি বৃদ্ধি করে দেবে, তাদের দুশ্চিন্তা ও সংশয় দূর করে দেবে, প্রতিকূল পরিবেশেও তাদেরকে হক পথে চলার পন্থা বলে দেবে। েএভাবে তাদের জ্ঞানবুদ্ধি এবং তাদের অন্তর উভয়ই পূর্ণরূপে জীবন্ত এবং জাগ্রত হয়ে যাবে। এরপর আল্লহর তৌফীক যদি তাদের সহায়তা করে তাহলে তারা হকের রাস্তায় চলার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
৩. দুর্বলচেতা এবং মোনাফিকের দল
দুর্বলচেতা লোক এবং মোনাফিকদের আমরা শুধু বাহ্যিক সাদৃশ্যের কারণে একই দরভুক্ত করছি। কিন্তু নিয়াত ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে তারা পৃথক দুটি দল। এজন্য আমরা এখানে সংক্ষেপে এবং পৃথক পৃথক ভাবে তাদের গুণাবলী ও বিশেষত্ব আলোচনাকরব।
দুর্বলচেতা বলতে এমন লোকদের বুঝায় যারা বুঝেশুনে হককে তো কবুল করে নেয় এবং সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করার নিয়াতও রাখে, কিন্তু তাদের ইচ্ছাশক্তি ও সংকল্প দুর্বল থাকে। এ কারণে একটিনষ্ঠ উদ্দেশ্য থাকা সত্বেও তারা হকের পথে নড়বড়ে অবস্থায় অগ্রসর হয় এবং পদে পদে হোঁচট খেতে খেতে চলতে থাকে। এই লোকেরা বারবার পড়ে যায় আবার উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু প্রত্যেকবার পতিত হওয়ার পর তাদের উঠে দাঁড়ানোটা হকের পথে চলার জন্যই হয়ে থাকে। এমনটা হয়না যে, হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে তো উঠে দাঁড়ানোর আর নাম নেই, অথবা উঠলো তো হকের পথের পরিবর্তে বাতিরের পথ ধরে অগ্রসর হওয়া শুরু করলো। এরা নিজেদের ভুলত্রুটি স্বীকার করে এবং এজন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়। এবং অনবরত তওবা ইস্তেগফার করার মধ্যেমে এই লজ্জিত দূরীভূত করার চেষ্টা করে। মনমানসিকতা এবং নিয়াতের দিক থেকে এরা নিম্নতর পর্যায়ের নয়। একারপে তাদের মধ্যে এমন ভাল লোকও পাওয়া যায় যারা দাওয়াতের সূচনা মূহুর্তেই তা কবুল করে নেয়ার সাহস করে, কিন্তু পরীক্ষার ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতার প্রকাশ ঘটতে থাকে এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তারা সব ধরণের প্রশিক্ষণ ও সংশোধনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। সুরা তওবায় এ ধরণের লোকদের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে:
وَآخَرُونَ اعْتَرَفُوا بِذُنُوبِهِمْ خَلَطُوا عَمَلًا صَالِحًا وَآخَرَ سَيِّئًا عَسَى اللَّهُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“আরো কিছু লোক আছে যারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তারা কিছু ভাল কাজও করে এবং এর সাথে সাথে কিছু খারাপ কাজও তাদের দ্বারা প্রকাশ পায়। আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালা তাদের তওবা কবুল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং করুণাময়।“(আয়াত: ১০২)
এই লোকদের মধ্যে সাহসিকতা ও অবিচলতা সৃষ্টি করার জন্য তাদের সংকল্প ও ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতার কারণ-সমূহ ভালভাবে অনুসন্ধান করে তা দূর করার জন্য চেষ্টা করা প্রয়োজন। যদি এই দুর্বলতার কারণগুলো মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ের হয়ে থাকে তাহলে তাকে আল্লাহ তাআলার বিশেষ গুণাবলী, তার শক্তি ও ক্ষমতা, তার কৌশল এবং তার নির্ধারিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান সম্পর্কে অবহিত করা দরকার। তিনি এই বিধান মোতাবেক তার সাথে অগ্রসরমান লোকদের সাথে ব্যবহার করে থাকেন। যদি তার মধ্যে দুনিয়ার লোভ লালসা থেকে থাকে তাহলেতাকে আল্লহর রাস্তায় ধনসম্পদ খরচ করার জন্য অভ্যস্ত করতে হবে। তাহলে এই রোগ দুর হতে পারে। যদি তার মধ্যে জীবনের মায়া এবং মৃত্যুর ভয় অধিক প্রবল হয়ে থাকে তাহলে তার সামনে মৃত্যুর নিশ্চিত আগমন এবং হকপন্থিদের শুভ পরিণামের দিকটি পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরতে হবে। এই পর্যায়ভুক্ত লোকেরা শিক্ষা প্রশিক্ষণের সুযোগকে কাজে লাগায়। তাই ইচ্ছা শক্তির দুর্বলতার করণে তাদের উন্নতি ধীর গতিতে হলেও তারা এক জায়গায় থেমে থাকেনা। বরং শিক্ষা প্রশিক্ষণের সুযোগ থেকে কায়দা উঠেয়ে সামনে অগ্রসর হতে চেষ্টা করে। এই ধরণের লোকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“তুমি তাদের ধনমাল সদকা গ্রহণ করে তাদের পাকপবিত্র কর। অশ্রু তাদের জন্য দোয়া কর। কেননা তোমার দোয়া তাদের জন্য শান্তনার করণ হবে। আল্লহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।“(সূরা তওবা: ১০৩)
মোনাফিকদের দল মৌখিক স্বীকারোক্তি সীমা পর্যন্ত তো হকের দাওয়াতে অনুসারী হয়ে থাকে, কিন্তু তাদের অন্তর বাতিলের সাথে লেগে থাকে। কখনো তো এরূপ হয়ে যায় যে, শুধু কোন সাময়িক প্রভাবে হকের সাথে এসে যুক্ত হয়, অতপর এথেকে যখন বাধা বিপত্তি ও পরীক্ষা শুরু হয়ে যায় তখন তারা নিজেদের এই (হক গ্রহণ করার) ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু শুধু কৃত্রিম লজ্জাবোধের কারণে বাধ্য হয়ে হকের সাথে বন্দী হয়ে থাকে। কখনো এরূপ হয়ে থাকে যে, তারা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে হক পন্থিদের শিবিরে ঢুকে বিবাদ বিশৃংখলা সৃষ্টির সুযোগ সন্ধানের জন্য হকের দিকে এসে থাকে। শুধু দেখানোর জন্য হকের প্রতি সহানুভুতিপরায়ণ ও কল্যাণকামী হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে দুশমনদের এজেন্ট হিসাবেই কাজ করে। কখনো এমনও হয়ে থাকে যে, তারা হকের ক্রমবর্ধমান শক্তি অবলোকন করে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায় এবং নিজেদের পর্থিব সুযোগ সুবিধার খাতিরে হকের সাথে কিছুটা বাহ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এই কারণে এবং এজাতীয় আরো অন্যান্য কারণে তারা মুখে হকের প্রকাশ করে এবং সাধ্যমত এই প্রকাশকে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে বটে কিন্তু প্রতি পদে পদে তাদের ভ্রান্তি এবং দুস্কৃতি তাদের আসল চেহেরাকে উন্মোচিত করে তুরে ধরে।
এই শ্রেনীর লোকদের দ্বারা হকের আহবানকারীর কাজ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পর্দার অন্তরালে হকের কল্যাণকামীর বেশে অবস্থানকারী মোনাফিকদের এই দল হকের আন্দোলনের জন্য যতটা বিপদজনক হক বিরোধীদের কোন দলই এর জন্য ততটা বিপদজনক নয়। এরা আপনজনের ভান ধরে অন্যের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কাজ করে এবং এতটা সুন্দর ও নিখুঁত ভাবে কাজ করে যে, অন্য কেউ ততটা সুন্দর ও নিখুঁতভাবে তা করতে সক্ষম নয়। এরা দাওয়াত এবং দাওয়াত দানকারীর বিরুদ্ধে জনগনের মধ্যে অসংখ্য ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে থকে। যেহেতু তাদেরকে নিজেদের লোক মনে করা হয় এবং তারা যা কিছু বলে নিষ্ঠা ও দরদের ভান করে বলে- এজন্য লোকেরা তাদের ছড়ানো বিভ্রান্তির শিকার হয়। এরা সব সময় সংগঠনের মধ্যে ভাংগন সৃষ্টির অপচেষ্টা করে এবং প্রতিটি অগ্নিষ্ফুলিংগকে চেপে ধরে নিরাপদে হেফাজত করে যাতে সুযোগ মত তাতে ফূত্কার দিয়ে বিবাদ বিশৃঙ্খলার আগুন জ্বালিয়ে দেয়া যায়। এরা সংগঠনের অভ্যন্তরে শত্রু বাহিনীর দালালদের ভূমিকা পালন করে। তাদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য আড্ডা জমিয়ে বেড়ায়। আর প্রচার করে যে, হকের খেদমতের জন্যই এই আড্ডা বসানো হয়েছে। হকের বিরোধীতা করার জন্য তারা হকের দুশমনদের সাথে সব সময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। আর প্রকাশ্যে দাবী করে যে, এ সবই হকের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে। হকপন্থিদের উদ্দম উত্সাহ নস্যাৎ করে দিতে পারে এমন প্রতিটি কথা তাদের মনোপুত এবং তা ছড়িয়ে বেড়াতে বিশেষ মজা পায়। পক্ষান্তরে হকপন্থীদের শক্তিসাহস বৃদ্ধিকারী প্রতিটি কথা তাদের জন্য দুশ্চিন্তা ও নিরাশার কারণ হয়ে থাকে। হকের পথে তারা কদমে কদমে বিপদ আর বিপদই দেখতে পায়। সংগঠনের কল্যাণের রং এ সবসময় তাদের প্রচেষ্টা থাকে যাতে এই বিপদের ভয় প্রতিটি অন্তরে বসিয়ে দেয়া যায়। তারা নিজেদের কাপুরুষতাকে লুকানোর জন্য বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অন্যদের আবেগ, উদ্দিপনা, শৌর্যবীর্য এবং স্বার্থ ত্যাগের মনোবৃত্তিকে দামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। হকের বিজয় এদের জন্য নৈরাশের কারন হয়ে দাঁড়ায় এবং ভবিষ্যতের গহবরে তারা হকের জন্য বিপদ এবং ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়না। কর্মগত দিক থেকে তারা শূন্যের কোঠায় অবস্থান করে। এ কারণে সংগঠনের অভ্যন্তরে নিজেদের অহংকার বজায় রাখার জন্য ভিত্তিহীন দাবী, মিথ্যা শপথ এবং তোবামদকে উপায় হিসেবে গ্রহণ করে। হকের প্রতিটি সাফল্যকে তারা বিদ্বেষের চোখে দেখে। খোদা না করুন যদি হকপন্থীদের ওপর কোন বিপদ এসে যায় তাহলে তারা নিজেদের মনে শান্তনা অনুভব করে।
এই শ্রেণীর লোকেরা যেহেতু উদ্দেশ্যমূলক ভাবে বিশৃংখলা ও ফেতনা ফাসাদ ছড়িয়ে বেড়ায় এজন্য তাদের মধ্যে সংশোধনকে গ্রহণ করার যোগ্যতা খুব কমই থাকে। এদের মধ্যে যারা শুধু কোন সামরিক অসতর্কতায় ও অমনোযোগিতার কারণে অন্যদের কপট ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মোনাফেকী কাজ করে বসে কেবল তারাই সংশোধন প্রক্রিয়াকে গ্রহণ করে। এ ধরণের লোকদের সামনে যখন প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠে তখন তারা অবশ্যই নিজেদের ভুলের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সংশোধন করারও চেষ্টা করে। কিন্তু যেসব পিশাচ দুস্কর্মকেই নিজেদের ধর্ম বানিয়ে নেয় এবং নিজেদের এই পেশায় পূর্ণ অভিজ্ঞ ও দক্ষ হয়ে যারা তারা সংশোধনের প্রতিটি প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয় এবং নিজেদের দৃষ্টিভংগীর মধ্যে সামান্য পরিবর্তন আনতেও প্রস্তুত হয় না। এই ধরণের লোকদের বেলায় হকের আহবানকারীর কর্মপ্রন্থা হচ্ছে এই যে, সংগঠনকে তাদের ফেতনা থেকে থেকে নিরাপদ রাখার জন্য পূর্ণরূপে চেষ্টা করতে হবে। তার কৌশল হচ্ছে এই যে, তাদের শিক্ষা-প্রশিক্ষন ও আত্মশুদ্ধিকে যতক্ষন সংগঠনের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধির উপায় বানানো যেতে পারে ততক্ষণ তাদেরকে সংগঠনের অভ্যন্তরে খোলামেলা ভাবে থাকার অনুমতি দেবে। যখন এই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে তাদেরকে অতিসত্বর সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক করে দিতে হবে। অতপর কোন প্রকারেই সংগঠনের সাথে তাদের কোনরূপ সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকতে পারে না।