১১
নবীদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি
দীনে হকের কোন দাওয়াতই দুনিয়াতে ফলপ্রসু হতে পারে না যদি তার সাথে একটি ক্রমবিন্যস্ত ও স্থায়ী প্রশিক্ষণ কর্মসূচী না থাকে। যে কোন ধরনের আন্দোলনের জন্য এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু বিশেষ করে একটি হকের দাওয়াতের ক্ষেত্রে তা এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রশিক্ষণ কর্মসূচী ছাড়া হকের দাওয়াতের কল্পনাই করা যায় না। এই বিপ্লব জীবনের কোন একটি দিককে প্রভাবিত করে না, বরং তার প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সব দিককে এক নতুন আলোকশিখা দান করে। এ আন্দোলন কোন আংশিক পরিবর্তনের দাবী নিয়ে উত্থিত হয়না, বরং আমাদের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত জীবনের জন্য একটি সম্পূর্ণ নতুন ছাঁচ এবং পরিকল্পনা পেশ করে । এ করণে তার মেজাজের দাবী হচ্ছে এই আন্দোলন যে ক্রমিকতা অনুসরণ করে সামনে অগ্রসর হয়, অনুরূপ ক্রমিক ধারা অনুযায়ী সম্পূর্ণ ভারসাম্যপূর্ণ একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীও থাকতে হবে। এটা মূল দাওয়াতো চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং যদি বলা হয় যে, মূল দাওয়াতের চেয়ে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব কিছুটা বেশীই তাহলে এটা খুব বেশী বলা হবে না। কেননা এই প্রশিক্ষণের ফলেই কোন দাওয়াত হৃদয়ের মধ্যে শিকড় গড়তে সক্ষম হয়, অতপর তা ক্রমবিকাশ লাভ করে, অতপর তা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। অবশেষে একদিন নিজের উপকারিতা ও কল্যাণের দ্বারা গোটা সমাজকে পরিপূর্ণ করে দেয়।
একজন হকের আহ্বানকারীর কাজের সঠিক দৃষ্টান্ত একজন চাষীর কাজের মাধ্যমে দেয়া যেতে পারে। কোন ক্ষেত্রে কিছু বীজ ছড়িয়ে দিলেই যেভাবে একজন কৃষকের উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে না, অনুরূপভাবে লোকদেরকে কিছু ওয়াজ-নসীহত শুনিয়ে দেয়ার মাধ্যমে একজন হকের আহ্বানকারীর কাজ সমাপ্ত হতে পারে না। বরং তার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে- তার নিজের মধ্যে পরিব্যাপ্ত দাওয়াতের সাথে তখন গভীর সংযোগ থাকতে হবে- যেমন সংযোগ থাকে বীজের সাথে একজন কর্ত্য পরায়ণ কৃষকের। সে সর্বদা লক্ষ্য রাখে চারা গাছগুলো যাতে যমীনে শিকড় গাড়তে পারে, সঠিক সময়ে যাতে পানি সিঞ্চন করা হয়, ঋতুর প্রতিকুলতা থেকে যাতে নিরাপদ থাকতে পারে, তার পরিবর্ধনে যাতে আগাছা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে না পারে, কীট পতংগ ও পশু-পাখীল আক্রমন থেকে যাতে নিরাপদ থাকতে পারেব। এসব দিকে লক্ষ্য রাখতে সে তার রাতের ঘুম এবং দিনের আরাম হারাম করে দেয়। সে অবিরতভাবে পরিশ্রম করতে থাকে, শস্য ক্ষেত্রের দেখাশুনায় ব্যস্ত থাকে। অতপর এক সময় সে তার নিজের পরিশ্রমের ফল পেয়ে যায়। অনুরূপভাবে হকের আহ্বানকারীও একটি পর্যায়ে পৌছে নিজের দাওয়াতকে ফুলে ফলে সুশোভিত দেখতে পায়- যখন সে দাওয়াতের সাথে সাথে প্রশিক্ষণের প্রাণন্তকর এবং দীর্ঘ অনুশীলনকে সহ্য করার সাহস ও যোগ্যতা রাখে। অন্যথায় একজন অলস কৃষকের রূপিত বীজ যেভাবে যমীন ও আবহাওয়া প্রতিকুলতা এবং পশুপাখী ও কীট পতংগের আক্রমনে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে যায়, অনুরূপভাবে একজন প্রচারকের দাওয়াতও মরুভূমির নিষ্ফল ক্রন্দনে পরিণত হতে পারে।
নবীদৈর দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের পন্থার ওপর গভীর মনোনিবেশ সহকারে চিন্তা করলে সাংগঠনিক প্রশিক্ষণের জন্য যেসব মূলনীতি পাওয়া যায় তার মধ্যে কতিপয় গুরুত্ব পূর্ণ মূলনীতি আমরা এখানে উল্লেখ করব।
সাংগঠনিক প্রশিক্ষণেল প্রথম মূলনীতি
সাংগঠনিক প্রশিক্ষণের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হচ্ছে এই যে, আহ্বানকারীকে দাওয়াত ও প্রশিক্ষওণের কাজে তাড়াহুড়া করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাকে সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, শিক্ষা-প্রশিক্ষণের যে খোরাক যে সরবরাহ করেছে তা ভালভাবে হজম হয়ে লোকদের চিন্তা ও কাজের অংশ পরিণত হয়ে গেছে কিনা? এর সঠিক অনুমান না করেই যদি আরো খোরাক দেয়া হয় তাহলে এর পরিণতি পাকস্থলীর গোলমাল এবং বদ-হজমের আকারে প্রকাশ পাবে। যে লোক হকের আহ্বানকারীদের ইতিহাস পাঠ করেছ সে এ সম্পর্কে অনবহিত নয় যে, প্রতিটি হরেক আহ্বানকারীর দাওয়াতো ব্যাপারে তাড়াহুড়া করার বিবিধ কারণ হতে পারে।
যেসব লোক দাওয়াতকে কবুল করে নিয়েছে তারা হকের স্বাদের সাথে এইমাত্র নতুনভাবে পরিচিত হয়েছে। এই নতুন পরিচিতি তাদের মধ্যে হকের প্রতি এমন আগ্রহ সৃষ্টি করে যে, তাদের কাছে প্রশিক্ষণের ধারাবাহিক কর্মসূচী খুবেই কঠিন মনে হয়। তারা হকের লালসায় এতটা মগ্ন হয়ে পড়ে যে, তারা নিজেদের ক্ষুধা এবং হজম শক্তিরও সঠিক অনুমাণ করতে পারে না, আর সংগঠনের অন্যান্য দুর্বলদের দুর্বলতাকেও বিবেচনা করতে প্রস্তুত থাকে না। তারা নিজেদেরকে নিজেদের আসল মর্যাদা থেকেও অধিক অনুমাণ করে এবং নিজেদের সংগীদেরও তাঁদের যোগ্যতা থেকে অধিক অনুমাণ করে। এ করণে তাদের পক্ষ থেকে সব সময় দাবী ওঠে, আরো অধিক আছে কি?
এদের ছাড়া আরো এচটি দল রয়েছে যারা এখনো দাওয়াতের বিরোধিতাকারী হিসাবে চিহ্নিত। তারা সব সময় দাওয়াতের দুর্বল দিকের অন্বেষণে লেগে থাকে। এরা যদি তাদে পেশকৃত কর্মসূচীতে নাক গলোনের কোন সুযোগ না পায় তাহলে এই দাবী উত্থাপন করে যে, তোমাদের পুরা পরিকল্পনা পেশ কর। তাদের উদ্দেশ্য কেবল এই যে, তাদের দাবীর জবাবে যদি তৎক্ষনাৎ কোন জিনিস পেশ না করা হয় তাহলে জারা জনগণের সামনে বলে বেড়াবার সুযোগ পাবে যে, এটা একটা উদ্দেশ্যহীন এবং লক্ষ্যহীন দল। তাদের সামনে কোন নির্দিষ্ট মঞ্জিলে মকসুদও নেই এবং সেই সঞ্জিল পর্যন্ত পৌঁছার কোন সুস্পষ্ট এবয় পূর্ণাং কর্মসূচীও নেই। আর যদি কোন জিনিস পেশ করা হয়, তাহলে এর মধ্যে কোন ফাঁক খুঁজে না পায় তাহলে ছিদ্র সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।
উপরন্তু হকের একজন সত্যিকার আহ্বানকারীর মধ্যে হকের জন্য প্রবল আকাংখা নিহিত থাকে। তা এতটা শক্তিশালী হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তাআলার দেয়া হিকমত যদি তার প্রষ্ঠপোষকতা না করত ধৈর্য ও অপেক্ষা এবং ধারাবাহিকতা ও প্রশিক্ষণের যাবতীয় সীমা ও শর্ত সে লংঘন করে ফেলত। এই আগ্রহকে যখন উল্লেখিত দ্বিবিধ দাবী উত্তেজিত করে দেয় তখন অনেক সময় এমন হয় যে, আহ্বানকারী মধ্যম পন্থা অবলম্বনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। অথচ এই মধ্যম পন্থা অবলম্বন তার উদ্দেশ্যের সফলতা এবং সংগঠনের সঠিক প্রশিক্ষণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। যদিও হকের জন্য সত্যিকার ভালবাসার দাবী হচ্ছে এই যে, হকের জন্য মানুষের মধ্যে লোভীদে রমত ক্ষুধা থাকবে যা তাকে অস্থিরও করে রাখবে, ধৈর্যহীনও বানিয়ে দেবে এবং তাড়াহুড়া করতেও বাধ্য করবে। কিন্তু সংগঠনের প্রশিকণের দাবীও হকের প্রতি মর্যাদাবোধ এ বং ভালবাসার দাবীর চেয়ে কম গুরুত্ব রাখে না। এর কারণে একজন প্রচাকের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে, সে এই উভয়টির মধ্যে সঠিক ভরসাম্য বজায় রাখবে। যদি প্রথম জিনিসটির দাবী তাকে তাড়হুড়া করার জন্য ব্যাকুল করে দেয়-তাহলে দ্বিতীয় জিনিসটির দাবী যেন তাকে অপেক্ষা করতে বাধ্য করে। যদি হকের প্রতি আহ্বান করার আগ্রহ এবং হকের সহায়তার আবেগ তাকে আগহী লোকদের আগ্রহকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ছেড়ে না দিতে বাধ্য করে এবং দীনের পথে বাধা দানকারীদের সামনে চূড়ান্ত প্রমাণ পেশ না করা পর্যন্ত ক্ষ্যান্ত হতে না দেয়- তাহলে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে সে যেন পাত্রের ধারণ ক্ষমাতর অধিক পানি না ঢেলে দেয়।
যদি কখনো এমন হয়ে থাকে যে, প্রথমটির আবেগ এতটা প্রবল হয়ে গিয়েছিল যে, দ্বিতীয় জিনিসটির প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি দেয়া সম্ভব হয়নি, তাহলে সংগঠনের প্রশিক্ষণের মধ্যে এমন ত্রুটি রয়ে গেছে যার প্রতিকার পরে আর সম্ভব হয়নি। এই ছিদ্র দিয়ে শয়তান সংগঠনের অভ্যন্তর ঢুকে ডিম এবং বাচ্চা উৎপাদন করেছে এবং গোটা জামাআতা তার ছড়ানো বিপর্যয় ও বিশৃংখলার আওতায় এস গেছে। এর সবচেয়ে দুঃখজনক দৃষ্টান্ত আমরা বণী ইসরাঈলের ইতিহাসে দেখতে পাই। হযতর মূসা আলাইহিস সালাম যখন মিসর থেকে বের হয়ে সাইনা উপত্যকায় পৌছলেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে শরীআতের নির্দেশাবলী সম্পর্কে অবহিত করার জন্র তূর পর্বতে যেকে নিলেন এবং এ উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ দিন দিন নির্দিষ্ট করলেন। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এই নির্দিষ্ট দিনের পূর্বেই তূর পাহাড়ে পৌছে গেছেন। আল্লাহর নির্দেশ অবগত হওয়ার এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের যে আবেগ তাঁর মধ্যে বর্তমান ছিল, প্রথমত তা এতটা প্রবল ছিল যে, আল্লাহর তরফ থেকে ইংগিত পাবার পর সময় এবং তরিখের অনুরসরণ করা তাঁর জন্য কষ্টকর ছিল। দ্বিতীয়ত জাতির পক্ষ থেকে একের পর এক যে দাবী উত্থাপিত হচ্ছিল তার দ্বারাও এই আবেগ আরো উত্তেজিত হয়ে থাকতে পারে। যদিও এটা ছিল অতি উচ্চ ও প্রশংসনীয় আবেগ, আরেক দিক থেকে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে তূল পাহাড়ে পৌছে যাওয়া একথারই প্রমাণ বহন করছিল যে, তিনি আল্লাহর নির্দেশ জানার জন্য খুবই অস্থির এবং উদ্বিগমনা ছিলেন।
কিন্তু এই ব্যাপারটির ওপর আপত্তি তোলারও একটি দিক ছিল- যেদিক হযরত মূসা আলাইহিস সালামের দৃষ্টি পড়েনি। আল্লাহ তাআলা তাঁকে অবিলম্বে ডেকে নেয়ার পরিবর্তে তাঁ জন্য যে একটি বিশে সময় নির্দিষ্ট করেছিলেন- এর দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্য এই ছিল যে, মূসা (আ) এই অকবাশটুকু জাতির প্রশিক্ষণের কাজে ব্যয় করবেন এবং তাদেরকে যে মৌলনীতির শিক্ষা দেয়া হয়েছিল তা তাদের অন্তরে শক্তভাবে বসিয়ে দেবেন। তাহলে তারা কঠিন পরীক্ষা এবং বিপদের সম্মুখীন হওয়ার পরও নিজেদের ঈমান ও ইসলামকে নিরাপদ রাখতে পারবে।
কিন্তু আল্লাহ তাআলার কাছে থেকে আরো অধিক নির্দেশ জানার আগ্রহ তার ওপর এতটা প্রভাবশালী হয়ে পড়ে যে, প্রশিক্ষণের গুরুত্বের অনুভূতি এই আগ্রহের সামনে পরাভূত হয়ে যায়। এর পরিণতি এই দাঁড়ালো যে, আল্লাহর দীনের দুশমনেরা তাঁর এই অনুপস্থিতি এবং জাতির দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করল এবং জাতির একটা বিরাট অংশকে গরুর বাছুর পূজায় লিপ্টত করে দিল। এই অনাচারের সময় দায়দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের তাড়াহুড়া প্রিয়তার ওপর রাখলেন। যদিও তিনি শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও দাওয়াতের কাজেই ব্যাপৃত ছিলেন, কিন্তু এই তাড়াহুড়া প্রশিক্ষণেল দায়িত্বের ক্ষেত্রে অমনোযোগিতার কারণ সাব্যস্ত হল। অতএব কুরআন মজীদ তাঁর এই তাড়াহুড়া এবং এর পরিণতি নিম্নোক্ত বাক্যে উল্লেখ করেঃ
“আর তুমি নিজের জাতিকে পরিত্যাগ করে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে কেন চলে আসলে যেহ মূসাঃ সে বলল, তারা আমার পেছনেই আসছে। আর আমি তাড়াহুড়া করে তোমার দরবারে চলে এসেছি- হে খোদা তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। তিনি বললে, আচ্ছা, তাহলে শোন! আমরা তোমার পেছনে তোমার জাতিকে পরীক্ষার সম্মুখীন করে দিয়েছি এবং সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছে।” –(সূরা ত’হাঃ ৮৩-৮৫)
وَمَا أَعْجَلَكَ عَنْ قَوْمِكَ يَا مُوسَى () قَالَ هُمْ أُولَاءِ عَلَى أَثَرِي وَعَجِلْتُ إِلَيْكَ رَبِّ لِتَرْضَى () قَالَ فَإِنَّا قَدْ فَتَنَّا قَوْمَكَ مِنْ بَعْدِكَ وَأَضَلَّهُمُ السَّامِرِيُّ
এ আয়াত থেকে জানা গেল, জনগণকে আল্লাহর নির্দেশ এবং আইন-কানুন সম্পর্কে অবহিত করানো একজন আহ্বানকারীর যেমন অবশ্য কর্তব্য, অনুরূপভাবে পূর্ণ গুরুত্ব ও দূরদর্শিতা সহকারে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়াও তার অবশ্য কর্তব্য। তাহরে দীনে শিক্ষা তাদের চিন্তা-চেতনা ও ব্যবহারিক জীবনে এতটা মজবুত হয়ে যাবে যে, কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও তারা এই শিক্ষার ওপর অবিচল থাক পারবে। যে আহ্বানকারী কেবল শিক্ষা-প্রশিক্ষণের দিকটির ওপর নজর রাখে এবং এই জিনিসের আকর্ষণ তার ওপর এতটা প্রভাবশালী হয়ে পড়ে যে, প্রশিক্ষণের জন্য যে ধৈর্য ও ধীরস্তিরতা প্রয়োজন সে তার হক আদায় করতে পারে না। তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে- সেই অস্থির বিজয়ী বীল যে বিজিত এলাকায় নিজের কলম মজবুত করার চিন্তান না করেই কেবল সামনের দিকে ধাবিত হয়। এই ধরনের তাড়াহুড়ার পরিনাম কেবল এই হতে পারে যে, একদিকে সে এলাকার বনভূমির অগ্নিকাণ্ডের মত বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়বে।
সূরা তাহায় হযরত মূসা আলাইহিস সালামের জাতির এই শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত পেশ করে আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাড়াহুড়া সম্পর্কে সতর্ক করে দেন- যা আল্লাহর নির্দেশ জানার জন্র তার মধ্যে বর্তমান ছিল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও জ্ঞানের প্রতি নিজের স্বভাব সুলভ আগ্রহ ও জাতির তাড়াহুড়ার কারণে চাইতেন যে, আল্লাহর অহী দ্রুত নাযিল হোক। তাহলে তিনি নিজের জ্ঞান আহরেণের আগ্রহকেও শান্ত করতে পারতেন এবঙ জাতির দাবীকেও পূর্ণ করতে পারতেন। অতএব যখন অহী নাযিল হত, তিনি এই আগ্রহের অতিশয্যে একজন উৎসাহী ছাত্রের মত তা আয়ত্ব করার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতেন। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায়ঢ তাঁকে এজন্র সতর্ক করেছেন যে, অহীর পূর্ণতার জন্য যে সময়সীমা নির্দিষ্ট রয়েছে তার পূর্বে গোটা কুরআন নাযিল করে দেয়র জন্য তাড়াহুড়া করনা। তোমরা অন্তরকে মজবুত করার জন্য এবং তোমর জাতির প্রশিক্ষণের জন্য এই অবকাশ এবং বিরতি দেয়া হচ্ছে। তাহলে তোমাকে যা কিছু শেখানো হচ্ছে তুমি তা ধারণ করতে পারবে এবং তোমর জাতিও তা গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে।
وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُقْضَى إِلَيْكَ وَحْيُهُ وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا (114) وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَى آدَمَ مِنْ قَبْلُ فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا
“কুরআনের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করনা, যতক্ষণ তোমার প্রতি এর অহী পূর্ণতারয় না পৌছে যায়। [অবশ্য] এই দোয়া করতে থাক, হে প্রভু! আমাকে অধিক জ্ঞান দান র। ইতিপূর্বে আমরা আদমের ওপর একটি দায়িত্ব দিয়েছিলাম, কিন্তু সে তা ভুলে গিয়েছিল। আর আমরা তার মধ্যে সংকল্পের ওপর কোন দৃঢ়তা পাইনি।” –(সূরা তা’হাঃ১১৪, ১১৫)
এই আয়াতের শেষাংশে তাড়াহুড়া করা থেকে বিরত থাকা এবং প্রশিক্ষণের গুরুত্ব পর্যিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষের মধ্যে এই স্বভাবগত দুর্বলতা রয়েছে যে, আশা-আকাংখা ও আগ্রহের সামনে তার প্রতিজ্ঞা দুর্বল হয়ে যায়। এজন্য প্রয়োজন হচ্ছে- তার ওপর যে দায়িত্ব অর্পন করা হবে সে সম্পর্কে পূর্ণ চেতনা ও অনুভূতি সৃষ্টি করার জন্য তাকে উত্তমরূপে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাহলে সে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও নিজেকে অবিচল রাখতে পারবে।
এই পশিক্ষণের দাবী অনুযায়ী কুরআন মজীদ অল্প অল্প করে নাযিল করা হত। এর ওপর অধৈর্য বিরুদ্ধবাদীরা অভিযোগ উত্থাপন করত যে, কুরআন মজীদ যদি আল্লাহর কিতাব হয়ে থাকে তাহলে তা অল্প অল্প করে নাযিল হচ্ছে কেন? আল্লাহর জ্ঞান তো বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব কিছুতেই বেষ্টন করে আছে, তাঁকে তো চিন্তা করার প্রয়োজন হয়ণা, পরীক্ষ-নিরীক্ষা করারও প্রয়োজন পড়ে না এবং কোন সামগ্রিক কল্যাণের দিকেও নজর রাখার প্রয়োজন হয়না। তাহলে শেষ পর্যন্ত কি কারণে তিনি গোটা কুরআন শরীফ একই সময় নাযিল করেন না? অতএব একথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করছে যে, এটা মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিরেই রচিত গ্রহন্থ। চিন্তা-ভাবনা এবং পরিশ্রম ও অনুশীলনের পর যতটা পরিমাণ তৈরী করতে পারে তা উপস্থাপন করে দেয়।
এই অভিযোগের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই অনেক মুসলমানের ওপরও পড়েছিল এবং এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র হৃদয়েও অত্যন্ত অসহনীয় ঠেকছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বিরুদ্ধবাদীরেদ অভিযোগেরও কোন গুরুত্ব দেননি এবং দোষ অন্বেষণকারীদের এই অভিযোগ ও জ্ঞানার্জনের স্বভাবসুলভ আগ্রহের কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইগি ওয়া সাল্লাম এবঙ তাঁর সাথীদের অনেএতর যে বেদনার সৃষ্টি হয়েছিল- তারও কেন গুরুত্ব দেননি। বরং তিনি বলেছেন, তোমার এবং তোমার সাথীদের পশিক্ষণের দাবী হচ্ছে এই যে, আমার নির্দেশ সমূহ অল্প অল্প করে ধারাবাহিকভাবে নাযিল হবে। তাহলে তোমার হৃদয়ও তা বরদাশত করার জন্য পূর্ণরূপে শক্তিশালী হয়ে যাবে এবং জামাআতের শক্তিমান ও দুর্বলেরাও ভালভাবে তা গ্রহণ করে নিতে পারবে। যদি তাড়াহুড়া কর তাহলে তোমার উম্মতের মধ্যে দুর্বলতা থেকে যাবে। এবঙ সামেরী যেভাবে বণী ইসলাঈলের সম্প্রদায়কে পথভ্রষ্ট করেছে- অনুরূপ ভাবে তোমার উম্মতের মধ্যে কোন সামেরী জন্মগ্রহণ করে তাদেরকে ভ্রান্তিতে নিক্ষেপ করবে।
কুরআনের নাযিলের ব্যাপারে আমরা যে ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করছি, সাহাবাগণ এবং তাদের পরবর্তীকালের লোকেরাও তা শেখার এবং শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে হুবহু এই ধারাবাহিকতার প্রতি দৃষ্টি রেখেছেন। এর সামগ্রিক কল্যাণও ঠিক তাই ছিল যে, যেসব লোক তা শিখবে- এমনভাবে শিখবে যেন তা তাদের মন-মগজের মধ্যেও বসে যায় এবঙ তাদের বস্তব জীবনও তার রংএ রঞ্জিত হয়ে যায়। এটা কেবল এই অবস্থায়ই সম্ভ ছিল যে, কুরআনে জ্ঞানও লোকদেরকে ধারাবাহিকভাবে অল্প অল্প করে দেয়া হবে এবং সাথে সাথে এই জ্ঞান অনুযায়ী তাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হবে। অতএব হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, (আরবী****************************)
“আমাদে মধ্যে যে ব্যক্তিই কুরআনের দশটি আয়াত শিখে নিত সে তার অর্থ জেনে নিয়ে তদনুযায়ী নিজের বাস্তব জীবনকে গড়ে তোলার পূর্বে সামনে অগ্রসর হত না।”
দ্বিতীয় মূলনীতি
সাংগঠনিক প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে এই যে, আহ্বানকারী সংখ্যার চেয়ে গুনের দিকে বেশী নজর রাখবে। কখনো কখনো অবস্থা এই হয় যে, ‘হারানে মেষের সন্ধান’ করার আগ্রহ আহ্বানকারীর ওপর প্রভাবশালী হয়ে পগে যে, সে পালের মেষগুলো সম্পর্কে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। এই অমনোযোগিতর পরিণাম এই দাঁড়ায় যে, সে তো হারানের মেষগুলের সন্ধানে মাঠ-জংগল চষে বেড়ায়, আর এদিকে পালের মেষগুলো হয় খাদ্যের অভাবে মরতে থাকে অথবা কোন নেকড়ে বাঘ বেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে পড়ে এগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। আপনজনকে উপেক্ষা এবং পরকে আপন করার এই আগ্রহ হকের আহ্বানকারীর মধ্যে নেহায়েত উত্তম আবেগ থেকেই সৃষ্টি হয়। তার ওপর প্রচার কার্যের জোশ এতটা প্রবল হয়ে যায় যে, প্রশিক্ষণের দায়িত্বানুভূতি তার সামনে হয় পরাভূত হয়ে যায় অথবা অন্তত পক্ষে পেছনে পড়ে যায়। সে এই কথার ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে থাকে যে, যেসব লোক খোদাদ্রোহী এবং নাফরমাণ, তারা প্রথমে আল্লাহর নাম উচ্চারণকারী হয়ে যাক, অতপর তাদের প্রশিক্ষণ ও সংশোধণ পরে হতে থাকবে।
বাহ্যত এটা একটা সৎ উদ্দেশ্য, কিন্তু যদি এর গভীরে চিন্তা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, গুণ ও মানের ওপর সংখাধিক্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার মূল কারণ এখানেই নিহিত রয়েছে। অতপর আরো সামনে অগ্রসহ হয়ে এই ভ্রান্ত দৃষ্টি ভংগী সৃষ্টি হয়ে যায় যে, লোকেরা হৃদয়েরে পরিবর্তে মাথার পরিসংখ্যান নিয়ে পূর্ণরূপে আশ্বস্ত হয়ে যায়। হরেক আহ্বানকারীদের এই ভ্রান্তি থেকে বাঁচানোর জন্য কুরআন মজীদ তাদেরকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে, যেসব লোক হকের দাওয়াতের সাথে পরিচিত নয় তাদেরকে ডাকার এবং আপন করে নেয়ার আগ্রহ এতটা প্রবল হওয়া উচিৎ নয়- যার ফলে দাওয়াত গ্রহণকারী লোকদের হক মারা যেতে পারে- যারা এখন প্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধির জন্য অপেক্ষায় রয়েছে এবং এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
لَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ
“এবং তাদের [কাফের] কোন কোন দলকে আমরা যে পার্থিব সম্পদ দিয়ে রেখেছি- তুমি সেদিকে তাকাবে না এবং তাদের প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকৃতির জন্য দুঃখ বোধ করবে না, বরং ঈমানদার লোকদের নিজের অনুগহের ছায়াতলে নিয়ে নাও।” –(সূরা হিজরঃ ৮৮)
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
“আর তোমার দিলকে সেই লোকদের সংস্পর্শে স্থিতিশীল রাখ যারা নিজেদের প্রতিপালকের সন্তোষ লাভের আশায় সকাল-সন্ধায় তাঁকে ডাবে। তাদের সম্পর্কে অন্যমনষ্ক হয়ে তোমার দৃষ্টি যেন পার্থিব জীবনের ভোগবিলাসের দিকে না যায়।” –(সূরা কাহাফঃ ২৮)
عَبَسَ وَتَوَلَّى () أَنْ جَاءَهُ الْأَعْمَى () وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى () أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرَى () أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى () فَأَنْتَ لَهُ تَصَدَّى
“সে ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং মুখ ফেরাল- এই কারণে যে, তার কাছে এক অন্ধ ব্যক্তি এসেছে। তুমি কি জান সে হয়ত পরিশুদ্ধ হবে, অথবা উপদেশ গ্রহণ করবে এবং উপদেশ তার উপকারে আসবে। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তুমি তার পিছে লেগে গেছ।” –(সূরা আবাসাঃ ১-৬)
উল্লেখিত সব আয়াতগুলোতে আহ্বানকারীকে এই হেদায়াত দান করা হয়েছে যে, যেসব লোক দাওয়াত কবুল করে নিয়েছে, তারা যদিও সংখ্যার দিক থেকে কম এবং মর্যাদার দিক থেকে সাধারণ, কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণে যে সময় ব্যয় হওয়া উচিৎ- তা যেন প্রভাবশালী লোকদের পেছনে নষ্ট করা না হয়। কারণ তাদের এই প্রভাব দাওয়াতের উপকারে আসার সম্ভাবনা থেকে থাকলেও কিন্তু তারা গর্ব-অহংকারের নেশায় মাতাল এবং দাওয়াতের প্রতি অসন্তুষ্ট।
তৃতীয় মূলনীতি
সাংগঠনিক প্রশিক্ষণের তৃতীয় মূলনীতি এই যে, যেসব মূলনীতির ওপর সংগঠনের ভিত্তি স্থাপিত- সংগঠনের কোন বিভাগই যেন তা থেকে বিচ্যুতি না ঘটে বা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের রোগ ছড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি না হয়। যদি এ ধরনের কোন বিশৃংখলা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখা যায় তাহলে সংগঠনের পরিচালকবৃন্দ এবং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে তার মূলোচ্ছেদ করার চিন্ত করা। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোন স্বার্থ অথবা উদারতা বা কোনরূপ হুমকি বা কারো ভালবাসা যেন প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়াতে পারে। এ ব্যাপারে সামান্য অবহেলা বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন এরূপ সামান্য অবহেলার সুযোগে মূসা আলাইহিস সালামের জাতির এক বিরাট অংশ আল্লাহর ইবাদত করার স্থলে বাছুর পুজায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই ধরনের বিশৃংখলার মূলোচ্ছেদ করার জন্য সংগঠনের নেতাদের শুধু শক্তিমান হৃদয়ের অধিকারী হলেই চলবে না, বরং কিছুটা কঠোর মনের অধিকারী হলেও কোন দোষ নেই। তাহলে নির্মমভাবে এই বিশৃংখলার মূল শিকড়সহ উপড়ে ফেলে দূরে নিক্ষেপ করতে পারবে।
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম যখন নিজের জাতির মধ্যে শিরকের ফিৎনা ছড়িয়ে পড়ার খবর জনতে পারলেন, তখন তিনি তূর পাহাড় থেকে ফিরে এসে সর্বপ্রথম সেই লোকদের কঠোর ভাষায় তিরষ্কার করেন- যারা তাঁর অনুপস্থিতিতে জাতির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল এবং যাদের নমনীয়তা ও উদারতার সুযোগে এই বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। অতপর তিনি আসল অপরাধীদেরকে তাদের নিজ নিজ গোত্রের লোকদের দ্বারা হত্যা করিয়েছিলেন। যাতে প্রতিটি লোকের সামনে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যেসব লোক সংগঠনের অভ্যন্তরে এ ধরনের বিশৃংখলা ছড়াবে- তারা নিজেদের রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকেও কোনরূপ সাহায্য-সহানুভূতি লাভ করার আশা করতে পারে না। উপরন্তু তিনি সামেরীর গড়া মূর্তিকেও ভেংগে খান খান করে দেন, যাতে ফিৎনার চিহ্ন মাত্রও জাতির মধ্যে অবশিষ্ট না থাকতে পারে। তিনি সামেরীকে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেন যা তার গোটা জীবনের জন্য গলার বেড়ি হয়ে থাকল।
সংগঠনকে এ ধরনের বিপর্যয় থেকে মুক্ত রাখার জন্য ইসলাম এই বিধান দিয়েছে যে, সংগঠনের কোন ব্যক্তির মধ্যে যখন সায়গঠনিক মূলনীতি থেকে বিচ্যুতি পাওয়অ যাবে, তখন গোটা সংগঠনের দায়িত্ব হচ্ছে- তার প্রতিরোধ এবং সংশোধনের চেষ্টা করা। সংগঠন যদি তা না করে, বরং লোকদেরকে যা ইচ্ছা তাই করতে দেয়া হয় তাহলে তাদের অপরাধের কুফল তাদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং সংগঠনের ফাসেক এবং মুত্তাকী সবাই তাতে অংশীদার হয়ে যাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমুদ্রযানের উপমা দিয়ে এই জিনিসের তাৎপর্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। যদি কোন যাত্রী সমুদ্র যানের তলদেশ ছিদ্র করতে উদ্ধৃত হয় এবং অন্য যাত্রীরা তাকে একাজ থেকে বিরত না রাখে তাহলে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এই হবে যে, সমুদ্রযানও ডুবে এবং এক ব্যক্তির দুষ্করেমর শাস্তি সবাইকে ভোগ করতে হবে। অনুরূপভাবে কোন সংগঠন যদি তার নিজের ভেতরে অবস্থানকারী দুষ্কৃতকারীদের সাথে উদার ব্যবহার করে তাহলে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে এই যে, এই দুষ্কৃতিকারীরা যে বিপদ ডেকে আনবে গোটা সংগঠন তার শিকার হবে। কুরআন মজীদ নিম্নোক্ত বাক্যে এই বিপরদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেঃ
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
“দূরে থাক সেই বিপর্যয় থেকে-যার অশূভ পরিণাম বিশেষ করে কেবল তোমাদের সেই লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না যারা গুনাহ করেছে। আর জেনে রাখ, আল্লাহ বড় কঠিন শাস্তি দানকারী।” –(সূরা আনফালঃ২৫)
এই ফরজ আদায় করার জন্য সংগঠনের বিভিন্ন সোপান অনুযায়ী কর্মপন্থও বিভিন্ন হবে। কিন্তু মূল ফরজ থেকে সংগঠন কোন অবস্থায়ই দায়িত্বমুক্ত হতে পারে না।
প্রাথমিক পর্যায়ে যখন সংগঠনের কোন রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাব থাকে না, তখন যেসব লোক সংগঠনের মূলনীতি সমূহ লংঘণ করে- সংগঠনের মেজাজ তাদের নিজের মধ্যে থেকে ছাটাই করে পৃথক করতে থাকে। সে প্রথমত এমন লোকরেদ নিজের মধ্যে স্থানই দেয় না যারা তার রং এ উত্তমরূপে রঞ্জিত না হয়। যদি এ ধরনের স্থবির লোক কোন মতে সংগঠনের মধ্যে ঢুকেও পড়ে, তাহলে যেভাবে একজন সুস্থ মানুষের পাকস্থলীতে মাছি ঢুকেও বেশীক্ষণ থাকতে পারে না- অনুরূপভাবে এই ধরনের লোক এই ব্যবস্থার মধ্যে টিকতে পারে না। যদি প্রাথমিক পর্যায়েই কোন সংগঠনের অবস্থা এই হয় যে, তার মূলনীতিসময়হ লংঘনকারী লোকেরা এর অভন্তিরে নির্বিঘ্নে লালিত পালিত হতে পারে- তাহলে এর অর্থ হচ্ছে এই যে, এই সংগঠনের কোন মেজাজই গড়ে ওঠেনি এবং অতি দ্রুত এই সংগঠন বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে পড়বে।
দ্বিতীয় স্তরে অর্থাৎ যখন সংগঠনের রাজনৈতিক শক্তি অর্জিত হয়- তখন সংগঠনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টা থাকে- যাতে এর অভ্যন্তর বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী উপাদান জন্ম নিতে বা অনুপ্রবেশ করতে না পারে। সে তার প্রতিরোধ করার জন্য প্রচার ও প্রশিক্ষণের সাধারণ উপায়-উপাদানের সাথে যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে শক্তিও ব্যবহার করে। এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যদি পূর্ণ দায়িত্বাণুভূতির সাথে নিজের যিম্মাদারী আদায় করে তাহলে গোটা সংগঠন দায়িত্বমুক্ত থাকে। কিন্বতু খোদা না করুন যদি এই প্রতিষ্ঠান বিপথগামী হয়ে পড়ে তাহলে গোটা সংগঠনের দায়িত্ব হচ্ছে- এর সংশোধনের জন্য ‘আমীর বিল-মারুফ এবং নাহী আনিল মুনকারের’ (ন্যয়ের প্রতিষ্ঠা অন্যায়ের প্রতিরোধ) পতাকা নিয়ে অগ্ররসর হবে এবং যতক্ষণ তার সংশোধন না হবে- আরামের ঘুম ঘুমাতে পারবে না। এই সংশোদনের আহ্বানকারীগণ সংশোধনের আওয়অজ তুলেই সন্তুষ্ট হয়ে যাবে না, বরং অপরাধীদের কর্মপন্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করে এই অপরাধ থেকে নিজেদেরও মুক্ত করে নেবে।
চতুর্থ মূলনীতি
সাংগঠনিক প্রশিক্ষণের চতুর্থ মূলনীতি হচ্ছে এই যে, দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে যতদূর সম্ভব লোকদেরকে তালীম ও দাওয়াতে মূল কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত থাকার জন্য তাকিদ করতে হবে এবং তার উপায় উপাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। যে পর্যায়ে যতদূর সম্ভব লোকদেরকে তালীম ও দাওয়াতের মূল কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত থাকার জন্য তাকিদ করতে হবে এবং তার উপায় উপাদানে ব্যবস্থা করতে হবে। যে পর্যায়ে যতদূর সম্ভব লোকদেরকে তালীম ও দাওয়াতের মূল কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত থাকার জন্য তাকিদ করতে হবে এবং তার উপায় উপাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। যে পর্যয়ে সংগঠনের মেজাজ কেবল গড়ে উঠছে- সেই পর্যায়ে উপযুক্ত পরিবেশ এবং মূল কেন্দ্রের সাথ সরাসরি সংযুক্তি সঠিক প্রশিক্ষণের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজনীয় জিনিস। এই পর্যায়ে যদি এই দু’টি জিনিসকে অবহেলা করা হয়, তাহলে সংগঠনের এমন লোক খুব কমই সৃষ্টি হবে- যারা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক উভয় দিক থেকে এতটা শক্তিশালী হবে যে, নিজেরাও এ রংএ নিজেদের রঞ্জিত করতে পারবে এবং অন্যদেরও রঞ্জিত করতে পারবে। বরং উল্টো দিকে এমন অনেক লোক সৃষ্টি হয়ে যায় যাদের ওপর দাওয়াতের রং এতটা হালকা থাকে যে, পরীক্ষার একটি মাত্র কঠিন স্তর অতিক্রম করার সাথে সাথে তা বিলীন হয়ে যায়। এই ধরনের লোক বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকেও এতটা পরিপক্ক হয়না যে, অন্যের মধ্যে দাওয়াতের সঠিক চেতনা সৃষ্টি করতে পারে, আর জীবনাচাররে দিক থেকেও এতটা মজবুত নয় যে, অনুকুল প্রতিকুল যেকোন অবস্থায় নিজের প্রচারকার্য অব্যাহত রাখতে পারে। এর পরিণতি এই দাঁড়ায় যে, যতক্ষণ কোন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বর্তমান থাকে- লোকদের মধ্যে এই দাওয়াতের চর্চা বর্তমান থাকে। কিন্তু যখনই তার অন্তর্ধান ঘটে সমস্ত কোলাহল ঠান্ডা হয়ে যায়।
ইসলামে হিজরতের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার মধ্যে যে অনেক কৌশল নিহিত ছিল তার একটি বড় কৌশল ছিল এই যে, সমস্ত মুসলমান সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্যে এসে লাভবান হতে পারবে এবং একটি অনুকুল পরিবেশে অবস্থান করে ইসলামের রং তাদের ওপর উত্তমরূপে ছেয়ে যাবে। যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য দাওয়াতের দাবী হচ্ছে অন্তর প্রত্যেক এলাকার প্রতিভাবান এবং নেক্কার ব্যক্তিগণ দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্রে আসবে এবং দীনের জ্ঞান লাভ করার পর যখন নিজ এলাকায় ফিরে যাবে তখন তাদেরকে দীন সম্পর্কে অবহিত করবে।
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
“আর সব মুসলমানদের পক্ষে জ্ঞানার্জনের জন্য বের হয়ে পড়া সম্ভব ছিল না। অতএব এরূপ কেন হল না যে, তাদের প্রতিটি দল থেকে একটি করে প্রতিনিধি দল বের হয়ে পড়ত এবং দীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করত। এবং যখন তরা ফিরে আসত তখন নিজ নিজ গোত্রকে সতর্ক করত। তাহলে তারাও খোদাভীতির পথ অবলম্বন করত।” –(সূরা তাওবাঃ১২২)
পঞ্চম মূলনীতি
সাংগঠনিক প্রশিক্ষণের পঞ্চম মূলনীতি হচ্ছে এই যে, সংগঠনের সামনে পরীক্ষার যে সুযোগ আসবে তাতে সংগঠনের ভূল ভ্রান্তি এবং স্থবিরতার ওপর পূর্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। পরীক্ষার মুহূর্ত যখন শেষ হয়ে যাবে, শান্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ এসে যাবে তখন প্রতিটি ভূল এবং স্থবিরতা সম্পর্কে নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করতে হবে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা যেসব আকীদাগত স্থবিরতার ইংগিত করছে তাকে পরিষ্কারভাবে লোকদের সামনে তুলে ধরতে হবে। প্রথম প্রথম এই পর্যালোচনার সম্বোধন সাধারণভাবে হওয়া উচিৎ। এর উপকারিতা এই হবে যে, প্রতিটি ব্যক্তি নিজ নিজ স্থানে এই পর্যালোচনার দ্বারা সতর্ক হতে পারবে এবং স্বভাব –প্রকৃতিতে সংশোধনের যোগ্যতা থাকলে তার দ্বারা লাভবানও হবে। প্রথম পর্যায়েই নির্দিষ্টভাবে শুধু ভূলকারীর নাম ধরে ধরে তিরস্কার করার ফলে তাদের মধ্যে অপমানবোধ জাগ্রত হয়। এর ফলে তাদের সংশোধনের অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পরিবর্তে একগুঁয়েমী এবং হঠকারিতার মনোভাব সৃষ্টি হয়ে যায়। অবশ্য যখন কোন গ্রুপ সম্পর্কে বারবার তথ্যানুসন্ধান করার পরও এটা প্রমাণিত হয় যে, তারা কেবল কোন মানসিক জটিলতার কারণে অথবা ঘটনাক্রমে সংগঠনের মূলনীতীহ লংঘন করে না, বরং উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই তারা মুনাফেকী নীতিকে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছে- তাহলে এদেরকে সরাসরি নিজেদের ভূলের জন্য সতর্ক করতে হবে এবং গোপনীয়তা ও সহানুভূতির পন্থা পরিবর্তন করে দিতে হবে। এদের জন্য এটা হবে সর্বশেষ সতর্কিকরণ। এরপরও তারা যদি নিজেদের সংশোধন করে না নেয়, তাহলে এ ধরনের লোকদের নিজের ভিতর থেকে ছাটাই কর ফেলাই হচ্ছে সংগঠনের কর্তব্য।
রসূলুল্লাহ (সা) মোনাফিকদের ব্যাপারে এই পন্থাই অবলম্বন করেছেন এবং সাংগঠনিক প্রশিক্ষণের দিক থেকে এটা বুদ্ধিজ্ঞান ও স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যে ব্যক্তি কুরআন মজীদের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে সে জানে যে, ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধই ছিল পরীক্ষার প্রথম সুযোগ। এই যুদ্ধেই প্রমাণিত হয় যে, সংগঠনের অভ্যন্তরে কিছু সংখ্যক মোনাফিক আত্মগোপন করে আছে। যুদেধর পরিস্থিতি অতিক্রান্ত হওয়ার পর কুরআন মজীদ এই লোকদের কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করে। সূরা আনফাল থেকে এর সাক্ষ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু ঐ সময় সুনির্দিষ্টভাবে তাদেরকে সরাসরি সম্বোধন করে তাদের তিরষ্কার করাও হয়নি এবং সংগঠন থেকেও বহিষ্কার করা হয়নি। এরপর প্রতিটি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই লোকেরা নিজেদের দুর্বলতা প্রদর্শন করতে থাকে। কিন্তু সাধারণ সমালোচনা এবং উপদেশ ছাড়া কুরআন মজীদ সরাসরি তাদের ওপর কোন আঘাত হানেনি। তাবুকের যুদ্ধের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত এই অবস্থা বিরজিত থাকে। কিন্তু এই লোকদের ওপর যখন প্রমান চুড়ান্ত হয়ে যায় এবং একথাপূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, তাদের দুষ্কর্ম ও ঔদ্ধত্য কোন অজ্ঞতা বা সাময়িক পরাজিত মনোভাবের ফল নয়, বরং তারা যা কিছু করছে বুঝে শুনে ঠান্ড মাথায়ই করছে- তখন তাদেরকে ছাটাই করে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়।