৬
দীন প্রচারের ক্রমিক ধারা
আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম লোকদেরকে আহ্বান করার ব্যাপারে একটা বিশেষ ক্রমধারা অনুসরণ করতেন। এই ক্রমধারা প্রচারকার্যের একটি বিরাট কৌশলের ওপর ভিত্তিশীল। এই ক্রমথারাকে ওলোটপালট করে দিলে সেই কৌশল ও হিকমতের অবলুপ্তি ঘটে। একথা আমরা পূর্বেও বলে এসেছি। অনুরূপভাবে নবী-রসূলগণ যে কথাগুলো লোকদের সামনে পেশ করতেন, তা উপস্থানি করার ক্ষেত্রেও তার একটা বিশেষ ক্রমধারা প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। দীন প্রচারে ক্ষেত্রে এই ক্রমিকতার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এইা ধারাবাহিকতার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করলে গোটা শ্রমই পন্ড হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে, বরং তাতে দীন প্রচারের উদ্দেশ্যও ব্যাহত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এ কারণে লোকদের সামনে দীনের দাওয়াত পেশ করার ক্ষেত্রে যে ধারাবাহিকতা অবলম্বন করা একান্ত জরুরী আমরা সে সম্পর্কে এখানে আলোচনা করব।
নবীদের দাওয়াতের সূচনা
নবীদের আগমন সব সময় এমন যুগে হয়ে থাকে যখন সত্য দীনের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে যায় এবং একটি জাহেলী ব্যবস্থা গোটা সমাজকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেয়। এ করণে যেসব মৌলিক বিষয়ের ভিত্তিতে একটি নির্ভেজাল ইসলামী সমাজ গঠিত হয় নবীগণ পেথমে সেসব বিষয়ের দাওয়াত বুলন্দ করেন। এই মৌলিক বিষয় হচ্ছে তিনটিঃ
১. আল্লাহর ওপর ঈমান-পূর্ণ একত্ববাদ সহকারে।
২. রিসালাতের প্রতি ঈমান-পূর্ণ আনুগত্য সহকারে।
৩. আখেরাতের ওপর ঈমান- পূর্ণ জিম্মাদারী সহকারে।
এই তিনটি জিনিস –যার বিকৃতি সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে সমাজ জাহেলিয়াতের দিকে ধাবিত হতে শুরু করে। যখন এর মধ্যে বিকৃতি ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন গোটা সমাজের ওপর জাহেলিয়াতের অন্ধকার ছেয়ে যায়। আবার এই তিনটি জিনিস উদ্ভাসিত হওয়ার সাথে সাথে সমাজ ইসলামের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে এবং যখন তা পূর্ণরূপে পরিষ্ফুটিত হয়ে সামনে এসে যায় তখন সমাজ দিনের পূর্ণ আলোকের মধ্যে এসে যায়। এই তিনিটি জিনিসের বিশ্বাস মানব প্রকৃতির ম্যে এতটা গভীরভাবে প্রেথিত যে, দুনিয়াতে তা খুব কমই অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্ত শয়তানের যেহেতু ভালভাবে জানা আছে যে, এই তিনটি জিনিসের ওপর সত্য জীবন বিধানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত- এজন্য চিরকাল তার প্রচেষ্টা রয়েছে, যেভাবেই হোক এর মধ্যে অবশ্যই কোন না কোনো ছিদ্র সৃষ্টি করতে হবে। সুতরাং বাস্তব ঘটনা হচ্ছে এই যে, এই তিনটি জিনিসকে যেভাবে খুব কমই অস্বীকার করা হয়েছে, ঠিক সেভাবে শয়তানের অপচেষ্টা প্রভাবে এগুলোকে নির্ভুলভাবে খুব কমই স্বীকার করা হয়েছে। আকীদা- বিশ্বাসে এই অধ্যায়ে দুনিয়া কখনো তা প্রত্যাখ্যান করেনি এবং কখনো তা সঠিক ভাবে স্বীকারও করেনি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বীকৃতির সাথে অস্বীকৃতিও রয়েছে। লোকদেরকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্যই আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী-রসূল পাঠিয়েছেন।
দাওয়াতের পথের একটি সমস্যা
হক-বাতিলের এই সংমিশ্রণ দাওয়াত ও সংশোধনের কাজটি কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ বানিয়ে দেয়। যদি কেবল বাতিলের সাথে মোকাবিলা করতে হয় তাহলে এটাকে সহজেই পরাভূত করা যায়। কিন্তু যেখানে হক এবং বাতিল সংমিশ্রিত হয়ে আছে এবং বাতিলের সাহায্যের জন্য হককে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করা হয় সেখানে হকের সাহায্যের জন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্বে হকের আহ্বানকরীদের একটি বিরাট যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। এই জিহাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে লোকদের সামনে একথা প্রমান করা যে, প্রচলিত ব্যবস্থায় যদি আংশিক ভাবে কিচুটা হক থেকেও থাকে তাহলে তা হকের স্বার্থে নয়- বরং বাতিরের খেদমতের জন্য। নবী-রসূলগণ এবং যেসবরোক দুনিয়াকে সত্য দীনের দিকে দাওয়াত দেন- তাদেরকে সাধারণত এই ধরনের বিকৃত আকীদার লোকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের লিপ্ত হতে হয়- যারা আল্রাহর দীন এবং নিজেদের নফসের খাহেশের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন করে একিট ভিন্নতর নতুন ব্যবস্থা দাঁড় করিয়ে নেয় এবং তাকে পুরোনো ব্যবস্থার নামে চালিয়ে দেয়। এই ধরনের লোকেরা নিজেদের বাতিলের হেফাজতের জন্য যেহেতু আল্লাহর দীনকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে, এজন্য তাদে ওপর পূর্ণ স্বাধিনতা সহকোরে সরাসরি আক্রমন করা সম্ভব হয়না। বরং ধীরে ধীরে তাদে বিশ্বাসও কার্যকলাপ থেকে হকের অংশকে পৃথক এবং বাতিলের অংশকে পৃথক করতে হয়। আর যেহেতু তাদে প্রতিটি বাতিল হক হিসেবে পুঞ্জিত হতে থাকে, এজন্য তাকে পৃথক করাটা এতদূর হয়ে পড়ে যে, তারা এর প্রত্যেকটির ওপর এক একটি ব্যুহ কায়েম করে নেয়। যতক্ষণ তারা এর প্রতিরক্ষায় নিরাশ হয়ে না পড়ে ততক্ষণ তাকে পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়না।
এ কাজ অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ। একাজে সুদুরপ্রসারী দৃষ্টি, চরম ধৈর্য এবং গভীর কারণ যে লোকদের সম্পর্কে কোন ব্যক্তির এই ধারণা হয় যে, তাদের অস্বীকৃতির সাথে স্বীকৃতিও সংশ্লিষ্ট রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই তারা বাতিলের সাথে নম্র ব্যবহার করে। এই নম্রতা থেকে হকের পরিবর্তে বাতিলই সুবিধা লাভ করে থাকে।
শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ব্যাপারে দুটি জিনিস বিবেচ্য
এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলশ্রুতেতে যেসব লোক নির্ভেজাল হকের সাথে সংযুক্ত হতে এবং বাতিলের সাথে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সত্যনিষ্ঠ মন নিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, তারা একটি জামাআতে পরিণত হয়ে যায়। এই লোকদেরকে নবী-রসূলগণ প্রথমে এমন জিনিস শিক্ষা দেন- যার মাধ্যমে একদিকে সর্বোত্তম পন্থায় আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়, অপরদিকে তারা নিজেরা সীসা ঢালা প্রাচীরের মত একতাবদ্ধ হয়ে যায়। আল্লাহর সাথে বান্দাকে সঠিকভাবে জুড়ে দেয়ার নীতিমালাগুলো ওপরে উল্লেখিত তিনটি নীতিমালা থেকে নির্গত। যেসব লোক উল্লেখিত তিনটি মৌলনীতিকে মেনে নিয়েছে তাদের জন্য এই নীতিগুলো মেনে নিতে কোনরূপ কষ্ট হয়না। একটি মূলনীতিকে মেনে নেয়ার পর কোন দীনদার ব্যক্তি তার অবশ্যম্ভাবী ফলকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে পারেনা। কেননা একটি জিনিসের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান সমূহকে প্রকৃত পকেষ মূল বিষয়টি সংক্ষেপে বর্ণনা করার পর তার ব্যাপক বর্ণনা বলা যায়। লোকেরা যেহেতু মূল বিষয়কে মেনে নিয়েছে, অতএব তারা এর অত্যাবশ্যকীয় উপাদানসমূহ সহজেই গ্রহণ করবে- এরূপ ধারণার ওপর ভিত্তি করে নবীগণ কিন্তু তাদের সামনে এই উপাদানগুলো এলোপাতাড়ি ছুড়ে মারেননি। বরং এ ক্ষেত্রে তারা একটি যুক্তিসংগত ক্রমিক ধারা অবলম্বন করেছেন। এই ধারবাহিক কর্মতৎপরতার মধ্যেই তাদে মিশনের সাফল্য নিহিত রয়েছে। ক্রমিক ধারার এই স্তর বিন্যাসের ক্ষেত্রে দুটি জিনিসের দিকে নজর রাখা হয়। (এক) জামাআতে মানসি ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা (দুই) জামাআতের সমষ্টিগত শক্তি। এই দুটি জিনিস কিচুটা ব্যাথা সাপেক্ষ।
মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা
মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা বলতে আমরা বুঝাতে চাচ্ছি যে, দীনের নির্দেশাবলী এবং শিক্ষার মধ্যে একটি শৃংখল বা যোগসুত্র রয়েছে।( এখানে একটি শব্দ বুঝা যাচ্ছেনা। ৬৮ পৃ. শেষ লাইনের শেষ শব্দ) বুনিয়াদি মূলনীতি রয়েছে, তা থেকে কতিপয় প্রাথমি নীতি বেরিয়ে আসে, আবার এর ভিত্তিতে মৌলিক শিক্ষা গড়ে ওঠে, অতপর তা থেকে আনুসাংগিক শাখা- প্রশাখার অস্তিত্ব লাভ করে। যে ব্যক্তি এই ধারাবাহিকতা সহকারে দীন শিক্ষা করে সে একদিকে প্রতিটি স্তরে পরবর্তী স্তরের জন্য নিজের মধ্যে যোগ্যতা সৃষ্টি করে, অপরদিকে সে গোটা ব্যবস্তাকে হৃদয়ংগম করতে সক্ষম হয় যা এর মধ্যে বর্তমান রয়েছে। এর উদারহণ সম্পূর্ণ এইরূপ যে, একটি শিশুকে প্রথমে স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ শেখানো হয়, অতপর তা দিয়ে শব্দ গঠন শেখানো হয়, অতপর তাকে শব্দ ও বাক্য পড়া শেখানো হয়, অতপর তার সামনে একটা পূর্ণ বক্তব্য রাখা হয়। সে যেহেতু অক্ষর থেকে শুরু করে বাক্য পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে একটি শৃংখলকে অনুসরণ করে আসছে, এজন্য প্রতিটি স্তরে সে সম্মুখবর্তী স্তরের জন্য যে যোগ্যতার প্রয়োজন তা আপনা আপনি হৃদয়ংগম করতে পেরেছে এবং কোন জিনিস তার স্বভাবের ওপর বোঝা হয়ে দাড়ায়নি। প্রতিটি যোগ্যতাই যেহেতু কাজ চায়, এজন্য সে এক স্তর থেকে অপর স্তরে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য নিজের স্বভাবের মধ্যে আপনা আপনিই একটি তাগিত অনুভব করে।
অপর দিকে এক ব্যক্তি দীনকে এভাবে পায়নি, বরং এর বিভিন্ন অংশ তার সামনে সমস্যাহীনভাবে এবং ধারাবাহিকতাহীন ভাবে রেখে দেয়া হয়েছে। তাকে এমন একটি শিশুর সাথে তুলনা করা যায়, যার সামনে প্রাথমিক স্তর সমূহ অতিক্রম না করিয়ে একটি বাক্য রচনা করে রেখে দেয়া হয়েছে। এ বাক্য হয়ত সে আওড়াতে পারবে এবং স্মৃতিশক্তির সাহায্যে তা মুখস্তও করতে পারবে। কিন্তু এটা সব সময়ের জন্য তার স্মৃতিশক্তির ওপর একটা বোঝা হয়ে থাকবে এবং তা কখনো তার প্রকৃতিগত যোগ্যতার অংশে পরিণত হতে পারে না।
আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম দীনকে পেশ করার ক্ষেত্রে এই পন্থা কখনো অবলম্বন করেননি। তাঁরা বরং প্রকৃতিগত এবং যুক্তি সংগত ধারা অবলম্বন করতেন। ফলে যে ব্যক্তি দীনকে কবুল করত সে নিজের স্বভাবের তাগিতেই তা কবুল করতে। গোটা দীন তার চিন্তা-চেতনা এবং হৃদয় ও প্রাণের মধ্যে গভীর ভাবে বসে যেত। এইা প্রক্রিয়াই ব্যক্তির মধ্যে অবিচল ঈমান সৃষ্টি হয়, যা করাত দিয়ে চিড়ে দ্বিখন্ডিত করে ফেলার পরও অন্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়না। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তাকওয়ার সেই স্বাদ লালিত হতে থাকে যা জীবনের বহুমুখী কার্যকলাপের দূরতম কোণেও দীনের ভাবধারা বিরোধী কোন জিনিস বরতাশত করতে প্রস্তুত নয়।
যেসব লোক দীনের এই ব্যবস্থাকে এবং নবীদের দাওয়াতের পদ্ধতির সৌন্দর্যকে হৃদয়ংগম করতে চায়না, তারা জনগণকে আল্লাহর পরিচয় জ্ঞান দান করার পূর্বে কেবল ফরজ নামাযেরই নয়, বরং তাহাজ্জুদ, ইশরাক ইত্যাদি নামাযেরও নিয়মানুবর্তী বানাতে চায়। তারা নবীর প্রয়োজনীয়তা এবং তাঁর আনুগত্যের আকীদা সৃষ্টি করার পূর্বে লোকরেদ দাড়ি, গোঁফ এবং জামা পাজামা দৈর্ঘ-প্রস্থ পরিমাপ করে বেড়ায়। তারা আঘেরাতের ওপর দৃঢ় ঈমান পয়দা করার পূর্বে লোকদের মধ্যে তাকওয়া, খোদাভীতি, নিষ্ঠ, সৌজন্যবোধ, বিনয় ও নম্রতার সৌন্দর্য দেখতে চায়। তাদে উল্টা প্রচেষ্টায় দাড়ি এতহাত লম্বা হয়ে যায়, পাজামা তার নিম্নতম সীমায় এসে যায়, চলা ফেরা, উঠা-বসা, কথাবর্তা প্রতিটি জিনিরেস মধ্যে একটা কৃত্রিম দরিত্রতা হয়ত ফুটে ওঠে, পানাহর, লেহ্য-পেয় প্রতিটি ক্ষেত্রে বাহ্যত সুন্নতের অনুসরণকারী হয়ত হয়ে যায়। কিন্তু এসব জিনিস যেহেতু অযৌক্তিক এবং অপ্রাকৃতিক পন্থায় সৃষ্টি করা হয়, এ কারণে এই প্রদর্শনীমূলক তাকওয়ার বৈশিষ্ট এর চেয়ে বেশী কিছু নয় যে, “মাছি বেছে বেছে ফেলে দেয়া হয়, কিন্তু গলাধকরণ করা গয়।”
এই ধরণের তাকওয়ার অধিকারীগণ এটা দেখেনা যে, তাদের কণ্ঠনালীতে খাদ্যের যে গ্রাস যাচ্ছে তা পাক-পবিত্র না তাগুতের খেদমত করে অর্জণ করা হয়েছে। কিন্তু খাদ্যের এই হারাম গ্রাস গলাধকরণ করার পর পানি বা হাতের পরিবর্তনের ডান হাতে পান করার প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করে। এই লোকদের ধর্মীয় দৃষ্টিভংগী হচ্ছে এই যে, কোন ব্যক্তির নিয়াত যদি ঠিক থাকে তাহলে সে কোন বাতিল ব্যবস্থার অধীনে দারোগা, জেলা প্রশাসক, সংসদ সদস্য ইত্যাদি পদের কাজ পরিচালনা করেও আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখতে পারে এবং ইসলামের ঝান্ডা উন্নত করতে পারে। এই মোত্তাকীদের মধ্যে এমন লোকও পাওয়া যাবে যে নিজের সৌভাগ্যের জন্য গর্বিত যে, তার কণ্যার জন্য এমন দীনদার বর পাওয়া গেছে যার পাজামা কখনো পায়ের গোছার নিচে পড়েনা এবং অমুক হযরতজীর মুরীদ। কিন্তু তার দৃষ্টি কখনো এদিকে যায়না যে, তার জামাতা জীবিকা অর্জনের জন্য যে উপায় অবলম্বন করেছে, তা ঈমানের অনুভূতি সম্পন্ন কোন মুসলমান কল্পনাও করতে পারেনা।
এই দেউলিয়াত্বের মূল কারণ হচ্ছে এই যে, একটা দীর্ঘ সময় ধরে মুসলমানদের মধ্যে গোটা দীনকে তার সুশৃংখল পদ্ধতিসহ পেশ করার এবং প্রতিটি স্তরে লোকদের সামনে দীনের যতটুকু অংশ উপস্থাপন করা প্রয়োজন তার অবশ্যম্ভাবী দাবীসহ তা তাদের সামনে পরিষ্কার করে তুলে ধরার মত কোন দাওয়াত উথিত হয়নি। বরং যারাই দাওয়াতের কোন কাজ শুরু করেছে মূল প্রয়োজনের অনুভূতির অভাবে এবং দীনের ব্যবস্থার সাথে পরিচিত না হওয়ার কারণে যেখান থেকে ইচ্ছা শুরু করেছে এবং কিছটা দীনী চেতনা থাকলেও তা এতটা বিপরীত এবং যে, যেসব মুলমানের মধ্যে কিছুটা দীনী চেতনা থাকলেও তা এতটা বিপরীত এবং নিষ্প্রাণ যে, তাকে কোন সঠিক দাওয়াতের জন্য ভিত্তি বানানো তো দূরের কথা, তাকে কায়েম রেখে সম্ভবত কোন সঠিক দাওয়াত শুরু করাও যেতে পারেনা।
সাংগঠনিক যোগ্যতা
আম্বিয়ায়ে কেরাম দীনকে পেশ করার ক্ষেত্রে যে সমষ্টিক শক্তির প্রতি খেয়াল রাখতেন তাও একবার চিন্তা করে দেখা যাক। দীনের নির্দেশ সমূহ সম্পর্কে চিন্তা করলে জানা যায় যে, তা দুই ধরণেল (এক) ব্যক্তিগত নির্দেশ, (দুই) সমষ্টিগত নির্দেশ। ব্যক্তিগত নির্দেশ ব্যক্তিদেরজন্য এবংতা প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পর্যায়েই পালনীয় হওয়া প্রয়োজন। যেমন নামায, রোযা, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা ইত্যাদি। সামষ্টিক পর্যায়ের নির্দেশের সম্পর্ক রয়েছে জামাআতের সাথে। জামাআত অস্তিত্বে এসে গেলে এই নির্দেশ পালন করা তার জন্য ফরজ হয়ে যায়। যেমন, সমাজ, রাজনীতি এবং জিহাদের সাথে সংশ্লিষ্ট আইন।
ব্যক্তিগত পর্যায়ের নির্দেশের দাওয়াত এবং তা শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির ধারণ ক্ষমতা ও হজম শক্তির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তার ওপর আদেশ নিষেদের বৃষ্টি বর্ণণ করা ঠিক হবেনা। তাহলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সবকিছু ছেড়ে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয় ধরনের নির্দেশের বোঝা তার ওপর চাপানো হচ্ছে তা বহন করার ক্ষমতা তার আছে কি না? এই সাংগঠনিক অনুমান করাও নেহায়েত কষ্টকর। আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এব্যাপারে সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে পথ নির্দেশ পেতেন। কেননা সমষ্টির ধারণ ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রেখেই তাদের ওপর আদেশ নিষেধ নাযিল হত। অবশ্য যারা নবীদে পন্থায় কোন জামাআতকে পরিচালিত করেতে চায় তাদেরকে এব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে ইজতেহাদের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। তারা যতক্ষণ দীনের নির্দেশাবলী নাযিলের পর্যায়সমূহ নিজেদের সময়কার বিশেষ অবস্থা এবং একজন নবীর জামাআত ও অ-নবীর জামাআতের মধ্যেকার পার্থক্য পূর্ণরূপে অনুমান করতে না পারবে ততক্ষণ তাদের পদক্ষেপ কখনো সঠিক রাস্তায় পড়তে পারেনা। আর সব সময় এই আশংকা থাকে যে, তারা যে, সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা নৌকার তীরভাগে পৌছার পূর্বে কোন শিলান্ডের সাথে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণ –বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে।
যেসব লোক এ বিষয়ে অবহিত নয়, তারা সম্পূর্ণ কুরআন মজীদ নিজেদের সামনে উপস্থিত দেখেমনে করে যে, এর সম্পূর্ণটা এক দিনেই নাযিল হয়েছিল এবং তার সব আদেশ নিষেধ একই সময়ে কার্যকর হওয়ার কথা। অতএব তারা একদিকে তৌহীদের দাওয়াত দিতে থাকবে, অপরদিকে ইসলারেম বিচার ব্যবস্থাকেও প্রবর্তন করবে। এর দিকে কুফর ও তাগুতের ব্যখ্যা দিতে শুরু করবে, অপরদিকে তাগুতের কাছে চরম পত্রও প্রেরণ করবে। এসব ব্যাপার থেকে পরিষ্কার জানা যায়, কোন এলাকার জাহেলী ব্যবস্থাকে ইসলামী ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবর্তন করে দেয়ার জন্য যে আন্দোলন উথিত হয় তাতে সংগঠনের সামগ্রিক শক্তি ও ক্ষমতার কি পরিমান সঠিক অনুমান করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় এবং তাতে সামান্য ভুল হয়ে গেলে কি পরিমান ক্ষতির আশংকা আছে- তা মুসলমানদের মোটেই জানা নেই।
এখানে একথা বিস্তরিত ভাবে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই যে, কুরআন মজীদে সমাজ এবং রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নির্দেশাবলী তখনই নাযিল হয়েছে- যখন ইসলামী রাষ্ট্র কার্যত কায়েম হয়ে গিয়েছিল। আর এসব নির্দেশ নাযিল হওয়ার ক্ষেত্রে পর্যাক্রমিকতার পূর্ণ ভারসাম্য রয়েছে। মুসলমানদের সংখ্যাশক্তি যখন একটি স্বতন্ত্র সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পর্যায়ে পৌঁছে যায় এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য একটি স্বাধীন সর্বোভৌম ভূ-খন্ড হাতে এসে যায়- তখনই তাদেরকে কুফরী ব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সর্বশেষ নির্দেশ দেয়া হয়। এর ওপর অনুমান করে বলা যায়, বর্তমানেও মুসলমানরা যখন একটি স্বতন্ত্র সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা করার যোগ্য হবে, তখন তাদেরকে কুফরী ব্যব্যস্থার সাথে যে কোন ধরণের সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ সমূহও কার্কর হতে পারে। এরপর মুসলমানরা যখন অদম্য শক্তি হিসাবে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইন জারী ও তা কার্যকর করার পর্যয়ে পৌঁছে যাবে, তখন তাদের সামনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামী বিধান সমূহ এসে উপস্থিত হবে। একজন ছাত্রের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার মতই একটি সংগঠনের বস্তুগত শক্তি ও যোগ্যতা মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার মতই একটি সংগঠনেরর বস্তুগত শক্তি ও যোগ্যতা ধারাবাহিক ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর যেসব লোক এ সংগঠনের নেতৃত্বে থাকেন তাদেরকে অত্যন্ত জাগ্রত মস্তিষ্ক নিয়ে সংগঠনের এই শক্তি ও যোগ্যতার পরিমাপ করতে হবে। সঠিক পরিমাপ ছাড়াই যদি সংগঠনের ওপর কোন বোঝা ঢেলে দেয়া হয় তাহলে এর ফল দাঁড়াবে এই যে, তারা দীর্ঘ সময় ধরে সংগঠনের যে শক্তি সৃষ্টি করেছিল তা একেবারেই শেষ হয়ে যাবে। এ সত্যের দিকেই হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইংগিত করেছেন।
আরবী*****
“কুরআনে সর্বপ্রথম যা নাযিল করা হয়েছিল তা হচ্ছে একটি মুফাসসাল সুরা তাতে বেহেশত এবং দোযখের উল্লেখ আছে। অতপর লোকেরা যখন ইসলামের গন্ডির মধ্যে এসে গেল, তখন হালাল হারামের বিধান নাযিল হয়। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়েই যদি নির্দেশ আসত-শরাব পান করনা। তাহলে লোকেরা বলত, আমরা কখনো শরাব পান ত্যাগ করবনা। যদি নাযিল হত, তোমরা যেনা করনা- তাহলে লোকেরা অবশ্যই বলত, আমরা কখনো যেনা পরিত্যাগ করবনা।”- (বুখারী, ফাযায়েলে কুরআন, অনুচ্ছেদ-কুরআন সংকলন ও বিন্যাস্ত করণ।)