১৩
হকের দাওয়াতের প্রতিদ্বন্দী
প্রতিটি হকের দাওয়াতেকে তিন ধরণের প্রতিদ্বন্দীর সম্মুখীন হতে হয়:
১. অনমনীয় শত্রু
২. প্রতীক্ষাকারী
৩. অসেচতন
এদের মধ্যে প্রতিটি শ্রেণীর গুণবৈশিষ্ট্য এবং মানিসক অবস্থা পরস্পর থেকে ভিন্নতর। এ কারণে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারকে তাদের প্রত্যেকের সাথে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। ব্যবহারের এই পার্থক্যের ওপরই দাওয়াতের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভশীল। যদি কোন আহবানকারী এই বিভিন্ন শ্রেণীকে চিহ্নিত করতে এবং তাদের বিশেষ আচরণ ও ঝোঁকপ্রবণতা সম্পর্কে অনবহিত থাকে তাহলে তাদের দাওয়াত সফল হওয়ার আশা করা যায় না। বিষয়টি গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য করে আমরা এই সব শ্রেণীর শত্রুদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট এবং তাদের ঝোঁকপ্রবণতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
১. অনমনীয় শত্রু
অনমনীয় শত্রু বলতে তাদের বেঝানো হয়েছে যারা দাওয়াতের পরিচয় এবং প্রভাব অনুমান করতেই তার বিরোধীতা করার জন্য আদা-পানি খেয়ে ময়দানে অবতীর্ন হয়। তাদের বিরোধীতার মধ্যে এমনিতে তো বিভিন্ন প্রকারের আচরণ কার্যকর থাকে- কিন্তু তিনটি আচরণ আসল এবং মৌলিক। (এক) বর্বরতা মূলক শত্রুতা, (দুই) অহংকার ও ঘৃণাবিদ্বেষ, (তিন) ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তা। এই তিন ধরনের আচরণ হকের বিরোধীতায় অগ্রগামিতার দিক থেকে সম্পূর্ণ একই পর্যায়ভূক্ত; কিন্তু নিজের প্রাণসত্তার দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর প্রকৃতির। বর্বরতা মূলক শত্রুতার রোগ মূলত জাহেলী ব্যবস্থার সাথে একনিষ্ঠতা ও হৃদ্যতারই ফলশ্রুতি। যে সব লোক সমসাময়িক যুগের জাহেলী ব্যবস্থার একনিষ্ট এবং বিশ্বাস্ত খাদেম তারাই সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত থাকে। এই লোকেরা যখন দেখতে পায় যে, এমন একটি আহবান উথিত হয়েছে যা তাদের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করে তদস্থলে কোন নতুন ব্যবস্থা চালু করতে চায়- তখন তাদের মধ্যে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তারা এর মধ্যে নিজ জাতির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখতে পায়। তারা দেখতে পায় যে, এই নতুন আহবানের দ্বারা তাদের গোত্রের মধ্যে ভাংগন সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাদের গড়ে তোলা সংঘ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তারা এটাও অনমান করে যে, এই দাওয়াত বাপ-দাদা ও পূর্বপুরুষদের সুপরিচিত পন্থা এবং প্রাচীন রাজনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ কারণে তাদের অন্তার এর প্রতি বিষন্ন হয়ে পড়ে।
এই সবকিছু মিলে তাদের মধ্যে আহবানকারী এবং আহবানের বিরুদ্ধে একপ্রকার কঠিন বেদনা এবং প্রচন্ড উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং তারা পূর্ণ উদ্দমে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এবং প্রাণ দিতে তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু তাদের এই বিরোধিতা অনেকাংশে জাতীয় নিষ্ঠার ওপর ভিত্তিশীল, এজন্য তার মধ্যে নীচতা, জঘন্যতা ও হীনতার মিশাল কম থাকে। এটা একটা পুরুষোচিত বিরোধিতা হয়ে থাকে। এর মধ্যে উত্তেজনা আছে বটে, কিন্তু এই উত্তেজনা ভদ্রতা, সৌজন্য ও আভিজাত্যের পরিবর্জিত হয়না। এ ধরণের বিরোধীতার ক্ষেত্রে ভুল বুঝাবুঝি দূর হওয়ার পর এই বিরোধীতা প্রেম ভালবাসায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকে। যদি তাই হয়ে যায় তাহলে এই ভালবাসাও উত্তেজনাপূর্ণ দুর্দমনীয় বিরোধীতার মত দুর্দমনীয় ভালবাসার রূপ গ্রহণ করতে পারে। ইসলামের দাওয়াতের ইতিহাসে এর সর্বোত্তম দৃষ্টন্ত হচ্ছে- আবু জাহল এবং হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরোধীতা। আবু জাহল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াতের বিরোধীতায় যেরূপ তত্পর ছিল তা প্রতিটি মানুষেরই জানা আছে। কিন্তু এই চরম শত্রুতা সত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের ওপর কোন জঘন্য অপবাদ আরোপ করার চেষ্টা কখনো করেনি। তিনি যখন দাওয়াতের কাজে বের হতেন তখন সে বিরোধীতার জোশে ছায়ার মত তাঁর অনুসরণ করতো যাতে কেউ তার কথা শুনতে না পারে। কিন্তু সে যখন বিরোধীতা করত তখন তার ধরণটা এরূপ হত যে, “হে মুহাম্মদ! আমি তো একথা বলছিনা যে, তুমি মিথ্য বলছ। কিন্তু তোমার দাওয়াত বাপদাদা ও পূর্বপুরুষদের পন্থার পরিপন্থী।“ তার এজন্যই বেশী রাগ হতো যে, তার দাওয়াত কোরাইশদের ঐক্যকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল। যে রসূলুল্লাহর (সা) ওপর সবচেয়ে যে অপবাদ আগাত তা হচ্ছে- তিনি পূত্রকে পিতার থেকে এবং ভাইকে ভাইয়ের থেকে পৃথক করে পরস্পরের শত্রু বানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং বদরের যুদ্ধে সে যখন দেখতে পেল ইসলামের দাওয়াত কোরইশদেরকে কোরাইশদেরই বিরুদ্ধে কাতারবন্দী করে দিয়েছে, তখন সে পরিপূর্ণ আবেগের সাথে আল্লাহর কাছে দোয়া করল:
(আরবী**********)
“হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আত্মিয়তার সম্পর্ককে অধিক ছিন্নকারী এবং এই বিদআতের উদ্ভাবক তাকে আগামী কাল পরাজিত কর।“
এই দোয়া যদিও জাহেলিয়াতের শত্রুতার বিষর মধ্যে ডুবানো, কিন্তু তার মধ্যে আবু জাহেলের সৌজন্যবোধ এবং জাতিপূজার যে দিকটি প্রতীয়মান হয়ে আছে- তা অস্বীকার করা যায়না। এই ধরণের বিরোধীরা দাওয়াতের বিরোধীতায় যতই তত্পর হোকনা কেন তাদের মধ্যে স্বজাতি প্রীতির একটি সৌন্দর্য প্রকট হয়ে থাকে। এ করণে হকের আহবানকারীর দৃষ্টিতে তাদের একটি বিশেষ সম্মান রয়েছে। তারা সব সময় অন্তরে এই আশা পোষণ করে যে, তাদের এই সৌন্দর্য বাতিলের পরিবর্তে হকের খেদমতে ব্যবহার হোক। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা) এ কারণে ইসলামী দাওয়াতের সমস্ত বিরোধীদের মধ্যে বিশেষ ভাবে আবু জাহল ও হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইসলাম গ্রহণের জন্য দোয়া করেছিলেন। তাহলে তাদের ইসলাম কবুল করার ফলে ইসলামের দাওয়াত শক্তি ও সুনাম অর্জন করতে পারবে।
তার এই দোয়া হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বেলায় কবুল হয়। ইসলামের ইতিহাসের প্রতিটি ছাত্রই জানে যে, তাঁর ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথেই হঠাৎ করে পরিস্থিতি ভিন্নতর হয়ে গেল। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি যে উদ্দাম উত্সাহ, যে তত্পরতার এবং যে বলবীর্য ও শত্রুতা নিয়ে ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরোধীতা করেছিলেন ইসলাম গ্রহণের পর তার চেয়েও অধিক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে এবং সাহসিকতার সাথে ইসলামের জন্য জীবন উত্সর্গ করতে থাকলেন। তাঁর জাহেলী বিদ্বেষ ইসলামের রং গ্রহণ করতেই শত্রুমিত্র সবাই অনুভব করতে লাগল যে, এখন ইসলামের কাতারে একজন ব্যাঘ্র অধিকারী মর্দে মুমিন এসে গেছে। হযরত উমরের (রা) জীবনাচারে সেই সৌন্দর্য বর্তমান ছিল যা মানুষের যাবতীয় উন্নত বৈশিষ্টের জন্য খামিরের কাজ দিতে পারে। কিন্তু এই সৌন্দর্য অসংখ্য জাহেলী ধ্যানধারণার নীচে চাপা পড়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমের দীনের দাওয়াতের ঘর্ষেণে যখন এই বাতিল ধ্যানধারণার আবর্জনা দুরিভূত হয়ে গেল তখন নীচে থেকে তা খাটি সোনা হয়ে বেরিয়ে এলো। এর উজ্জলতা শেষ পর্যন্ত দুনিয়ার দৃষ্টি সমূহের আলোহীন করে দিল।
নিজের যুগের জাহেলী ব্যবস্থার সাথে হযরত উমরের সম্পর্কটা কোন স্বার্থপরতার ভিত্তিতে ছিলনা। বরং ইসলাম গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই ব্যবস্থাকে হক মনে করতেন। এটাকে তিনি নিজের সম্মানিত পূর্ব-পুরুষদের উত্তরাধিকার মনে করতেন। নিজের জাতির মানমর্যাদার স্থয়িত্ব এর মধ্যেই দেখতে পেতেন। এসব কারণে তিনি এ ব্যবস্থার অনুসারীদের নিজের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা এবং বিরোধীদের নিজের দশমন হিসাবে চিহ্নিত করাকে নিজের ধর্মীয় এবং জাতীয় কর্তব্য মনে করতেন। কিন্তু যখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তিনি যা বুঝেছেন তা সত্য নয়, বরং সত্য তার বিপরীত রয়েছে, তখন যে আবেগ উদ্দীপনা তাকে জাহেলী ব্যবস্থার একনিষ্ঠ সেবক বানিয়ে রেখেছিল তা ইসলামের সেবা এবং সাহয্যে নিয়োজিত করলেন। এ ধরণের উন্নত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিরা হীন স্বার্থের উর্ধে অবস্থান করার কারণে কোন সত্য প্রতিভাত হয়ে যাবার পর তা প্রত্যাখ্যান করতে উঠেপড়ে লাগেনা এবং কোন জিনিস গ্রহণ করার পর তার অত্যাবশ্যকীয় দাবী পুরন করা থেকেও পিছপা হয়না। বরং কোন একটি সত্য প্রমাণিত হওয়ার পর তা কবুল করে নেয়ারও সত্সাহস রাখে এবং তার জন্য নিজেদের যে কোন ধরণের ব্যাক্তিস্বার্থ কোরবানী করতে পারে। তার চরিত্র ও নৈতিকতার এই দিকটির কারণে তারা যেখানেই থাকুক না কেন নিজেদের একটি বিশেষ মর্যাদা এবং স্থানের অধিকারী হয়ে থাকে।
এই গ্রুপের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের লোক রয়েছে। কতকের শত্রুতা নিজের সীমা অতিক্রম করে আত্মম্ভরিতা এবং দাম্ভিকতার রূপ লাভ করে। এদের শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত জাহেলীয়াতের ফাঁদ থেকে বের হওয়ার সৌভাগ্য হয়না। যেমন আবু জাহেল। কতিপয় লোক সামান্য দ্বন্দ সংঘাতের পর সামান্য হুশীয়ারীর পর সতর্ক হয়ে সত্পথ পেয়ে যায়। যেমন হযরত উমর এবং হযরত হামযা রাদিয়াল্লহু আনহুমা। কতিপয় লোকের জাহেলীয়াতের পর্দা ভেদ করে বের হয়ে আসতে অনেক বিলম্ব হয়। যেমন আবু সুফিয়ান (রা)। কিন্তু একটি বৈশিষ্ট্য এদের সবার মাধ্যে সমানভাবে বর্তমান থাকে। তা এই যে, তারা তখন জাহেলীয়াতকে পরিত্যাগ করে ইসলামকে গ্রহণ করে নেয়, তখন আসার সাথে সাথেই ইসলামের প্রথম সারিতে নিজেদের স্থান করে নেয়- যেভাবে তারা গতকাল পর্যন্ত জাহেলীয়াতের প্রথম কাতারে ছিল।
خياركم في الجاهلية خياركم في الاسلام
“তাদের জাহেলী যুগে যারা সর্বোত্তম, ইসলামেও তারাই সর্বোত্তম। তবে শর্ত হচ্ছে যখন তারা (দীনের) গভীর জ্ঞান অর্জন করে।“(বুখারী-কিতাবুল মানাকিব ও কিতাবুল আম্বিয়া, মুসলিম-কিতাবুল ফাযায়েল)
গর্ব অহংকার এবং হিংসা বিদ্বেষের বসবর্তী কয়ে সাধারণত যেসব লোক হকের দাওয়াতের বিরোধীতা করে তারা হচ্ছে সেই লোক যারা কৃত্রিম দীনদারী এবং পরুষানুক্রমে প্রাপ্ত ধানাঢ্যতার কারণে জাহেলী ব্যবস্থার মধ্যে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের পদে সমাসীন থাকে। তারা সামনে চলার কারণে সামনে চলতে এতটা অভ্যস্ত হয়ে পরেছে যে, হকের পেছনে চলাটা নিজেদের জন্য প্রতিবন্ধক মনে করে। তাই তারা হকের পেছনে চলার পরিবর্তে হককে নিজেদের পেছনে চলতে বাধ্য করতে চায়। পৈত্রিক সত্রে প্রাপ্ত ধার্মিকতার মনমানসিকতা সাধারণত এই হয়ে থাকে যে, তারা হককে বাপদাদার মীরাস এবং নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করতে থাকে। পৌরহিত্য এবং মর্যাদাপূর্ন পরিবেশে লালিত পালিত এবং বড় হওয়ার কারণে তারা এটা ধারনাই করতে পারেনা যে, তাদের নিজেদের সত্তা এবং পরিমন্ডলের বাইরেও হক থাকতে পরে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রাচুর্যের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা পার্থিব শান-শওকত ও জাকজমকে নিজেদের হকপন্থি হওয়ার স্বপক্ষে দলীল সাব্যস্ত করে এবং খেয়াল করে যে, যখন তারা সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী তখন অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদের চিন্তা এবং কর্মও হক। এই ধরণের মানসিকতা সম্পন্ন লোকদের যখন এমন কোন দাওয়াত চ্যালেঞ্জ করে যা তাদের বাহ্যিক দীনদারীর পরিপন্থী অথবা যার আঘাত তাদের প্রবৃত্তির ওপর পড়ে তখন তারা অস্থির হয়ে এই দাওয়াতের বিরোধীতায় কোমর বেধে দাড়িয়ে যায়। বিশেষ করে এই দাওয়াত যখন তাদের পরিমন্ডল ছাড়া অন্য কোন পরিমন্ডল থেকে উথিত হয় তখন এই অবস্থায় তাদের বিরোধীতা চরম আকার ধারণ করে। তারা এই অহংকারে ডুবে থাকে যে, হক তাদের সাথেই রয়েছে এবং তা চিরকাল তাদের সাথেই থাকবে। যদি ধরেও নেয়া যায় যে, তা তাদের মধ্য থেকে বিলীন হয়ে গেছে তাহলে যখনই তা পূনরায় দুনিয়ায় পুন প্রকাশ পাবে- তাদের মধ্যেই প্রকাশ পাবে। অতএব এই অহমিকতায় লিপ্ত ব্যক্তিদের কখনো এমন হককে কুবল করা প্রায় অসম্ভব যার আহবানকারী স্বয়ং তারা নয়।
অতএব হকের দাওয়াতের গোটা ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যেসব লোক এই ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকে হকের প্রতি ঈমান আনার সৌভাগ্য তাদের খুব কমই হয়েছে। মক্কা এবং তায়েফের নেতৃত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ- যারা বলত, আল্লাহ তায়ালাকে যদি কোন নবী পাঠাতেই হত তাহলে তিনি আমাদের মধ্য থেকেই কাউকে পাঠাতেন- এই রোগেই আক্রান্ত ছিল। এই লোকেরা ইসলামের সত্য দীন এবং আল্লাহর দীন হওয়ার ব্যপারটিকে এই জন্য অস্বীকার করত যে, এটা যদি সত্য এবং আল্লাহর নাযিল করা দীন হত তাহলে আমাদের পূর্বে এই অধম ও দ্রারিদ্রক্লিষ্ট ব্যক্তি তা পেতনা। এই লোকদের সাথে ইহুদীরাও শরীক ছিল। তাদের ইসলাম বিরোধীতার অন্তরালে শুধু এই আবেগেই কার্যকর ছিল যে, তারা যদি এই সত্যকে মেনে নেয় তাহলে তাদের ধর্মীয় নেতৃত্বের সমস্ত সম্মান এবং মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হয়ে যাবে। এই ধরণের লোক যদিও হকের দাওয়াতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এবং সন্দেহ পেশ করে থাকে- যাতে তাদের বিরোধীতাকে বৈধ এবং যুক্তিসংগত প্রমাণ করতে পারে- কিন্তু বাস্তবে এই সব অভিযোগ এবং সন্দেহ শুধু বিরোধীতা, অহংকার ও বিদ্বেষের মূল কারণ গুলোকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য দাঁড় করানো হয়ে থাকে। এই ধরণের বিরোধীরা হকের আহবানকারী সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আশার চেয়ে নিরাশাই অধিক দেখতে পায়। এদের মধ্যে খুব কম লোকেরই হককে গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়ে থাকে। এসব লোক গর্ব অহংকারের বর্শবর্তী হয়ে নিজেদেরকে খোদার আসনে বসিয়ে নেয় এবং যতক্ষণ তাদেরকে এই আসন থেকে হটাতে বাধ্য করা না হয় ততক্ষণ তা পরিত্যাগ করতে প্রন্তুত হয় না।
কুরআন মজীদে গর্ব অহংকারকে সত্য দীন কবুল করার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতার মধ্যে শুমার করা হয়েছে। এ কারণে কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এসব লোকের পেছনে অধিক সময় নষ্ট করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এসব লোক পার্থিব ধনম্পদের প্রাচুর্য অথবা ধর্মীয় এবং পার্থিব নেতৃত্বের কারণে নিজেদের গর্ব-অহংকারে মত্ত হয়ে থাকে। হযরত ঈসা আলাইহিস সাল্লাম নিজের সমসাময়িক আলেম এবং ফকিহদের অহংকার ও দাম্ভিকতার ভিত্তিতে বলেছিলেন, “কল্যাণ হোক তাদের যারা হৃদয়ের কাংগাল, আসমানের রাজত্ব তারাই প্রবেশ করবে।“তিনি আরো বলেন, “সুইয়ের ছিদ্রে উঠ প্রবেশ করা সহজ, কিন্তু সম্পদশালীরা খোদার রাজত্বে প্রবেশ করতে পারবে না।“ সময়ের প্ররিক্রমা তার এই ভবিষ্যদ্বানীকে সত্য প্রমান করেছে। ইনজীল এবং কুরআন মজীদ উভয় গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জেরুজালেমের আলেম এবং ফকীহদের মধ্যে একজন লোকও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দাওয়াতের উপর ঈমান আনেনি। এমন কি তাদের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে নদীর তীরে জেলেদের কাছে নিজের দাওয়াত পেশ করতে হয়। তিনি তাদের মধ্যে এমন কিছু সংখ্যক আল্লাহর বান্দাকে পেয়ে গেলেন যারা হকের দাওয়াত প্রচারের দ্বায়িত্ব নিয়ে নেয়।
নবী (সা) যখন দীনের দাওয়াত পেশ করেন তখনও প্রায় এই একই অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল। আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের আলেম সমাজের মধ্যে মুষ্টিমেয় লোক ইসলাম গ্রহণ করে। অন্যান্যরা সবাই নিজেদের পৌরহিত্ব ও বুজর্গীর অহংকারে হকের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়িয়ে থাকে। যেসব লোক ঈমান আনে কুরআন মজীদের যেখানেই তাদের বিশেষ গুণ উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেকযোগ্য গুণ এই বলা হয়েছে-
انهم لا يستكبرون
“আর তাদের মধ্যে অহংকার ও অহমিকাবোধ নেই।“(মায়েদা: ৮২)
এ থেকে জানা যায়, এসব লোকদের অন্তর ধর্মীয় এবং পার্থিব নেতৃত্বের রোগ আক্রমণ করতে পারেনি এবং তারা নিজেদের হকের উর্ধে মনে করতেন। এই লোকদের আরেকটি বিশেষ ভৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, প্রথম প্রথম তারা নিজেদের দাম্ভিকতার কারণে দাওয়াতকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে থাকে এবং সেদিন কোন গুরুত্বই দেয়না। কিন্তু দাওয়াত যখন সামনে অগ্রসর হতে থাকে এবং তারা নিজেদের পায়ের তলার মাটি সরে যেতে দেখে; তখন তাদের হিংসা বিদ্বেষ প্রবল আকার ধারণ করে। এসময় তারা দাওয়াত এবং দাওয়াত দানকারীর বিরুদ্ধে এমন সব কিছুই করতে থাকে যা অহংকার ও বিদ্বেষে নিমজ্জিত লোকেরা করতে পারে।
স্বার্থপুজার কারণে আত্মকেন্দ্রীক লোকেরাই সাধারণত হকের দাওয়াতের বিরোধীতা করে থাকে। তাদের যাবতীয় নৈতিক এবং সমষ্টিগত দর্শন নিজেদের সত্তা থেকে শুরু হয় এবং অনবরত নিজেকে কেন্দ্র করেই তা আবর্তিত হতে থাকে। মানুষ সামাজিক জীব হিসাবে একাকি বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করা সম্ভব নয়- এই প্রকৃতিগত দুর্বলতার কারণে তারা কোন সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে শামিল হয় বটে, কিন্তু তার ভেতর প্রতিটি পদক্ষেপে নিজের স্বার্থ খুঁজে বেড়ায়- কিন্তু কোথাও দায়িত্বের বোঝা বহনের জন্য প্রস্তুত নয়। তাদের কাছে হক এবং বাতিলের মানদন্ড হচ্ছে তাদের নিজেদের সত্ত্বা। যে জিনিস তাদের নিজেদের স্বার্থের অনূকুলে তা সত্য এবং যে জিনিসের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্চে তা বাতিল। যেসব লোকের নৈতিক এবং সমষ্টিক ধ্যানধারণা এতটা নীচ- তারা নিজেদের স্বার্থবিরোধী যে কোন দাওয়াতের বিরোধীতা করে থেকে। তাদের মধ্যে উন্নত মানবীয় গুনাবলী কখনো বর্তমান থাকে না। এ কারণে কোন হকের ব্যবস্থার জন্য স্বাভাবিক ভাবে তাদের অস্তিত্ব এতটা নিষ্ফল, যতটা নিষ্ফল একজন স্ত্রীর জন্যে নপুংসক স্বামী। এসব লোক নিজেদের স্বভাবগত হীন চরিত্র ও স্বার্থপরতার কারণে কোন বাতিল দাওয়াত বা বাতিল জীবন ব্যবস্থার দিকেই আকর্ষণ রাখে। কিন্তু এর সাথেও তাদের সম্পর্কটা হচ্ছে সম্পূর্ণ রূপে মুনাফেকী সলভ ও স্বার্থপরতাপূর্ণ। এর জন্য তারা আন্তরীক আবেগ- উত্সাহের সাথে কোন আঘাত সহ্য করতে প্রস্তুত নয়।
ইসলামের প্রচারের ইতিহাসে এর বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে আবু লাহাবের অস্তিত্ব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের সাথে তার সমস্ত বিরোধ শুধু এই কারণে ছিল যে, তার প্রচারকার্যের ফলে আবু লাহাবের চরিত্রের যাবতীয় দোষত্রুটি জনসমক্ষে এসে যাচ্ছিল। স্বার্থপরতা অর্থগৃধ্মুতার মাধ্যমে সে যে ধনসম্পদ কুক্ষিগত করেছিল তা সবই বিপদের মাথায় ছিল। একেতো সে কোরাইশদের কায়েমকৃত জাহেলী ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিল- কিন্তু এই ব্যবস্থার সাথে তার সমস্ত যোগসূত্র কেবল এই জন্য ছিল যে, সম্মানজনক পদ এবং কা‘বা ঘরের তত্ত্বাবধানের কারণে ধনসম্পদ অর্জনের অনেক সুযোগ তার হস্তগত ছিল। এর অধিক তার জাতির জন্য তার সহানুভূতিও ছিলনা, আর যে জাহেলী ব্যবস্থার সে সর্বোচ্চ নেতৃত্বে সমসীন ছিল তার কল্যাণ অকল্যাণের সাথেও তার কোন আগ্রহ ছিল না। এর সর্বাপেক্ষা বড় প্রমাণ হচ্ছে এই যে, এমনি তো সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের বিরোধীতা করার ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ছিল এবং লোকদের সামনে প্রকাশ করতো যে, এটা বাপ-দাদার পূর্ব পুরুষদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে ধ্বংসকারী দাওয়াত। কিন্তু বদরের যুদ্ধে কোরাইশ গোত্রের সব নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি ধর্মীয় আবেগ-উত্তেজনা সহকারে অংশ গ্রহণ করে, অথচ ইবরাহীমী উত্তরাধিকারের সবচেয়ে বড় দাবীদার এই ব্যক্তি যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকে এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি ভাড়া করা লোক যুদ্ধে পাঠায়। অথচ কোরাইশদের দৃষ্টিতে এটা ছিল একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী যুদ্ধ।
যে কোন হকের দাওয়াতের সাথে এ ধরণের লোকের স্বাভাবিক সম্পর্ক কেবল বিরোধীতাই হতে পারে এবং বিরোধীই হয়ে যায়। এরা নীচতা ও নিকৃষ্টতায় এতটা পাকাপোক্ত এবং নিপুন হয়ে যায় যে, এমন কোন দাওয়াত যা উন্নত নৈতিকতার দিকে আহবান জানায়, যা সহানুভূতি, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের দাবী জানায়, যা কোরবানী, স্বার্থত্যাগ এবং প্রাণ উত্সর্গ করার জন্য ডাক দেয়-তা তাদের কাছে কোন আবেদনই সৃষ্টি করতে পারেনা। এই প্রকারের দাওয়াতের জন্য তাদের কান বধির এবং তাদের অন্তর মৃতবৎ হয়ে থাকে। তারা এ দাওয়াতের প্রতি নিজেদের মধ্যে কোন আকর্ষণ বা ঝোঁক তো অনুভব করেইনা বরং এর প্রতি ঘৃনা বিদ্বেষ অনুভব করে। এই ধরনের লোকদের বিরোধীতাও তাদের নৈতিক অধপতনের কারণে অত্যন্ত নীতিগত বিরোধীতার পরিবর্তে তারা সাধারণ চোগলখোরী, অপবাদ ইত্যাদীর আশ্রয় নেয় এবং গালাগালি ও দোষ প্রচারের মাধ্যেমে নিজেদের নেতৃত্বের অহংকার বজায় রাখার চেষ্টা করে।
২. প্রতীক্ষাকারী দল
প্রতিক্ষাকারী (মুতারাব্বিসীন) বলতে এমন লোকদের বুঝায় যারা হকের দাওয়াতকে তো একটা সীমা পর্যন্ত হক বলে অনুভব করে, কিন্তু তাদের মধ্যে এতটা নৈতিক শক্তিও বর্তমান নেই যে, হককে হক হওয়ার ভিত্তিতে কবুল করে তার জন্য জীবন বাজি রাখতে পারে; আর বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকেও তারা এতটা উন্নত নয় যে, হকের ব্যবস্থা কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ হওয়ার পূর্বে এর সফল হওয়ার সম্ভাবনাকে অনুমান করতে পরে- যার নিদর্শন এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই দুর্বলতার করণে এই লোকেরা কোন সত্যকে সত্য হওয়ার ফয়সালা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধির ভিত্তিতে করার পরিবর্তে এটাকে ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। যদি ভবিষ্যৎ তাকে সফলতা দ্বারে পৌছতে সুযোগ দেয় তাহলে তারা এটাকে গ্রহণ করবে, অন্যথায় জীবনটা যে ভাবে কেটে যাচ্ছে এভাবেই শেষ করবে। এই লোকেরা নিজেদের নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকে দুর্বলতার কারণে একটি মানসিক দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়নের মধ্যে পড়ে থাকে। এ কারণে তারা হকের দাওয়াতের বিরোধীতা করার ক্ষেত্রে খুব তত্পর নয়। কিন্তু সমসাময়িক প্রচলিত ব্যবস্থার প্রভাবে এরা দাওয়াতের বিরোধী পক্ষের সাথেই যোগ দেয়। আর হক বাতিলের দন্দ্ব-সংঘাত চলাকালীন সময়ে তারা চেষ্টা করে যে, সমঝোতার কোন উপায় সৃষ্টি হয়ে যাক, যাতে হক ও বাতিল মিলে মিশে পাশাপাশি চলতে পারে। হকের সহায়ক ব্যক্তিদের মধ্যে মোনাফিকদের যে ভূমিকা রয়েছে- হকের বিরোধীদের মধ্যে এদের ভূমিকা ঠিক তদ্রুপ। হকের বিরাট বিজয় সাধিত হওয়ার পরও তাদের নৈতিক দুর্বলাতর করণে অপেক্ষা আর শেষ হয় না।
ইসলামের দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব লোকের এরূপ মানসিক অবস্থা ছিল। তারা বদরের যুদ্ধের সময় বলত এই যুদ্ধে যদি মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর সাথীরা জয়যুক্ত হয় তাহলে আমরা তাঁর দাওয়াতকে হক বলে মেনে নেব এবং তাঁর সাথে সংযুক্ত হব। কিন্তু এই যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে গেল এবং মুসলমানরা বিজয়ী হল তখন তারা নিজেদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারটি ভবিষ্যত যুদ্ধের ফলাফলের ওপর মুলতবী করে করে দিল। এসব যুদ্ধের ফলাফলও যখন কোরাইশদের বিরুদ্ধে গেল এবং কার্যত তাদের সাময়িক শক্তি সম্পূর্ণ খতম হয়ে গেল তখন তারা অপেক্ষা করতে লাগর- দেখা যাক ইহুদীদের সুসংহত শক্তির সামনে ইসলামের অবস্থাটা কি দাড়ায়? যখন ইহুদীদের শক্তিও বিপর্যস্ত হয়ে গেল তখন তাদের অপেক্ষা সমাপ্তি হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু এরপরও তাদের মধ্যে এমন একটি দল রয়ে গেল যারা রোমীয়দের সাথে মুসলমানদের সংঘাতের ফলাফল কি দাড়ায় তার অপেক্ষাক করতে লাগল। এভাবে তাদের অপেক্ষা আর শেষ হবার নয়- যতক্ষণ কুফরী ব্যবস্থার উপর টিকে থাকাটা তাদের জন্য অসম্ভব না হয়ে দাঁড়ায়।
এদের মৌলিক দুর্বলতা হচ্ছে এই যে, এরা বুদ্ধিবিবেকের সাহায্যে সত্যকে যাচাই করে তার পর ঈমান আনতে চায়না। বরং তার বিজয় স্বচক্ষে দেখে তার উপর ঈমান আনার খায়েশ পোষণ করে। যে সব লোক আল্লাহর উপর ঈমান আনার পূর্বে তাঁকে স্বচক্ষে দেখে নেয়ার আকাংখা পোষণ করত- তাদের সাথেই এদের আকাংখার হুবহু মিল রয়েছে। এটা হচ্ছে একটা শিশুসুলভ আকাংখা। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল এর ওপর কোন গুরুত্বই দেননি। বরং পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে,জ্ঞান বুদ্ধির সাহায্যে যে ঈমানকে উপলব্ধি করা হয়েছে তাই নির্ভরযাগ্য, চোখের দেখা ঈমান নয়। যে ব্যক্তি একটি সত্যকে এজন্য সত্য বলে মানে যে, তার উত্তম ফল তার সামনে উপস্থিত রয়েছে, তার বিরোধীদের খারাপ পরিণতি তার নিজের চোখে দেখছে- সে মূলত সত্যের ওপর ঈমান আনেনি। বরং সে হয় স্বার্থের পুজারী অথবা ক্ষতির ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। যে ব্যক্তি বাহ্যিক পুজার এই পর্যায় পর্যন্ত নেমে যায় তার মধ্যে এবং একটি পশুর মধ্যে শুধু গঠন প্রকৃতির পার্থক্য অবশিষ্ট থাকে। তার পক্ষে দুনিয়াতে এমন কোন নৈতিক ব্যবস্থার অনুগত থাকা মোটেই সম্ভব নয়- যার ফলাফল আজ নয় বরং কাল প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষা থাকে।
এই হচ্ছে আসল রহস্য যার কারণে এই ধরণের লোকেরা হকের আহবানকারীদের দৃষ্টিতে কোন মূল্যই রাখেনা। তাদের মানসিকতা হচ্ছে অন্ধ অনুসরণ প্রিয় মানসিকতা। এরা চলন্ত গাড়ির আরোহী হতে অভ্যস্ত, চাই তা যেদিকেই যাক। এরা কুফরীর অনুসারী। কারণ কুফরী ব্যবস্থা বিজয়ী হয়ে আছে। তারা ইসলামেরও সহযাত্রী হয়ে যাবে যদি তা বিজয়ীর আসন দখল করতে পারে। তাদের মধ্যে সেই পৌরূষত্ব নেই যার অভ্যন্তরীন আকর্ষনে হকের দিকে ছুটে আসবে। বরং তারা চাপের মুখে হকের দিকে ছুটে আসে। এই কারণে এ ধরণের লোকের দ্বারা সংগঠনের শক্তি বাড়েনা বরং কমে যায়। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে যারা ঈমান এনেছিল তাদের সাহস শক্তির অবস্থা এমন ছিল যে, তাদের একজন দশজন কাফেরের মোকাবিলায় যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর যখন তাদের সাথে ইসলাম গ্রহণকারী বিরাট সংখ্যক লোক যুক্ত হল তখন এই শক্তি কমে গেল এবং এর অনুপাত প্রতি দুইজন কাফেরের বিরুদ্ধে একজন মুসলমান- এই পর্যায়ে নেমে আসলো।
নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক দুর্বলতার কারণে এই ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন লোকেরা কখনো কোন হকের দাওয়াতের এমন পর্যায়ে ঈমান আনতে পারেনা যখন তা দ্বন্দ্ব সংঘাতে বিভিন্ন রকম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়। এটা হয়ত সম্ভব যে, তারা হকের দাওয়াতের স্বপক্ষে গোপনে শস্তর্পনে কোন ভাল মন্তব্য করতে পারে, অথবা তাদের হৃদয়ের গোপন কোনে এই দাওয়াত সফল হওয়ার আকাংখা সৃষ্টি হতে পারে। এটাও অসম্ভব নয় যে, যেসব লোক হকের দাওয়াতের বিরোধীতা করে তাদেরকে তারা মনে মনে ভাল নাও জানতে পারে। বরং এটাও সম্ভব যে, এই ধরণের লোকেরা কখনো হকের দাওয়াতের আর্থিক অথবা নৈতিক সাহায্য লাভের আশাও করতে পারে। এ সব কিছুই সম্ভব। কিন্তু এই লোকেরা ইতস্ত বিক্ষিপ্ত তক্তাগুলো একত্র করে তা দিয়ে নৌকা তৈরী করে তাকে নদীর উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে ভাসিয়ে দিয়ে প্রতিকোল আবহাওয়া মোকাবেলা করে তীরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার কোন যোগ্যতাই রাখেনা।
তাদের মানসিক অবস্থা দাওয়াতের বিভিন্ন ধরণের অনুকূল এবং প্রতিকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হতে থাকে। কখনো দাওয়াতের সাফল্যের লক্ষণ দেখে তাদের অন্তরে কাতুকুতু সৃষ্টি হয়ে যায় যে, সামনে অগ্রসর হয়ে দাওয়াতকে কবুল করে নিতে চায়। কখনো বিপদ মুসীবত এবং বাধাবিপত্তি দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে নীরব হয়ে যায় এবং দাওয়াতকে নির্বূদ্ধিতা এবং আহবানকারীকে নির্বোধ এবং পাগল সাব্যস্ত করতে থাকে। কিন্তু বিরোধীদের মত উদ্দীপনা নিয়ে দাওয়াতের মূলোত্পাটনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাওয়া অথবা প্রকাশ্য ভাবে তার উপর ঈমান এনে এর সাহায্য সহযোগীতার জন্যে আদাপানি খেয়ে লেগে যাওয়াটা তাদের পক্ষে খুব কমই ঘটে থাকে। এরা যদি দাওয়াতের মূলোত্পাটনের কামনা করে তাহলে এভাবে নয় যে, তার মুলোত্পাটন করার জন্য তাদের নিজেদের কোন বিপদের ঝুঁকি বহন করতে হতে পারে। বরং তারা চায় েএই নৌকা কোন শিলাখন্ডের সাথে ধাক্কা খেয়ে আপনা আপনি চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে যাক। অনরূপভাবে এরা যদি দাওয়াতের সাফল্য কামনা করে তাহলে এমন ভাবে নয় যে, এ পথে তাদের কোন আঘাত সহ্য করতে হবে। বরং তারা চায়, অন্যরা দাওয়াতের জন্য ধনসম্প এবং জীবন উত্সর্গ করে তাকে সাফল্যের শিখরে পৌছে দেবে আর এরা তার ফল ভোগ করবে।
৩. অসচেতন গ্রুপ
অসচেহন (মোগাফফিলীন) বলতে জনসাধারণের সেই অংশকে বুঝানো হচ্ছে যারা নিজেদের রুজি রুটি এবং দৈনন্দিনের প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে কখনো এতটুকু অবসর পায়না যে, তারা সমাজের ভাংগা-গড়ার কাজে অগ্রগামী হয়ে অংশ গ্রহণ করতে পারে। এরা মানসিক এবং নৈতিক উভয় দিক থেকে নিজেদের সমসাময়িক ব্যবস্থার অনুগত এবং এর বাহক বা কুলি হয়ে থাকে। এবং এই ব্যবস্থার অধিনে বেচে থাকাকে তারা বিরাট নিয়ামত এবং যে সব লোকের নেতৃত্বে এই ব্যবস্থা চালু আছে তাদের দয়া অনুগ্রহ মনে করে। দীনের হকের বিরোধীরা যে নৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে লিপ্ত থাক- এরা সাধারণত তা থেকে পবিত্র থাকে। এ কারণে তারা কোন হকের দাওয়াতের বিরোধীতায় তত্পর হয়ে অংশ গ্রহণ করে না এবং তাদের অংশ গ্রহণের কোন কারণও নেই। কিন্তু এরা নিজেদের সমসাময়িক যুগের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতাদের অন্ধ অনুসারী হয়ে থাকে এবং তাদের সাথে এক ধরণের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সুধারণা রাখে। এ কারণে এমন কোন কথা যা তাদের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতাদের মতের পরিপন্থি হয়ে থাকে, প্রথমত তাদের অন্তরকে আকর্ষণ করতে পারেনা, যদি আকর্ষণ করতে পারে তাহলে প্রথম প্রথম তারা এটাকে অপরিচিত অনুভব করে। তারা চায় প্রথমে তাদের নেতারা পদক্ষেপ (এখানে একটি শব্দ বুঝা যাচ্ছেনা। ১৬২প. ) তাহলে এরা দাতের সাথে সাথে চলবে।
তাদের নেতারা উপরোল্লেখিত কারণে সহযোগিতার পরিবর্ত বিরোধিতার পথে পা উঠঅয় এবং নিজেদের সাথে নিজেদের অনুসারীদের চলাতে চেষ্টা করে। এই সময় লোকেরা দাওয়অতের সাথে পরিচিত হতে শুরু করে এবং পর্যায়ক্রমে বাতিলের দ্বন্দ্ব চলাকালে তারা আহবানকারীর নিরপেক্ষ চরিত্র এবং তার দাওয়াতের হৃদয় গ্রহিতার অনুমান করার সুযোগ পায়। এর ফলে এদের মধ্যকার কিছু সংখ্যক বিজ্ঞ এবং চারিত্রিক শক্তির অধিারী লেক দাওয়াতের সাহায্যকারী হয়ে যায়। সামসাময়িক নেতারা যখন দেখতে পায় যে, তাদের অনুসারীরা তাদের হাত থেকে ছুটে চলে যাচ্ছে, তখন তারা দাওয়াত এবং দাওয়াত দানকারীর বিরোধিতায় পূর্ণ শক্তি নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয় এবং জনসাধারণকে নিজেদের সাথে সংযুক্ত রাখার জন্য অপপ্রচারের যাবতীয় হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরুয করে দেয়। এই জিনিস যদিও অনেক লোককে দাওয়াত সম্পর্কে সন্দেহে নিক্ষেপ করে, কিন্তু এ সময় তারা দাওয়াত প্রেরণ কারীর উন্নত চরিত্র এবঙ তাদের দাওয়াতের শক্তিকে নিজেদের নেতাদের চরিত্র এবং তাদের দাওয়াতের শক্তির সাথে তুলনা করার উত্তম সুযোগ পায়। এর ফল এই দাড়ায় যে, জনসাধারণ ক্রমান্বয়ে নিজেদের পূর্বতন নেতাদের সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং নতুন দাওয়াতের দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করে। যদিও দীর্ঘকালের অন্ধ অনুকরণের বঁধন দ্রুত খুলেনা, কিন্তু তাদের সাহসিকতা, নির্ভীকতা এবং উন্নত চরিত্র ব্যক্তি পুজার অজ্ঞতা অতিক্রম করে হরেক পূজার পথ খুলে দেয়। এবং একের পর এক এই স্তরের লোকরেদ একটা বিরাট অংশ হকের বাহু বন্ধনে এসে যায়।