জাহেলিয়াতের নতুন রণকৌশল
‘ইসলাম ও জাহেলিয়াতের চিরন্তন দ্বন্দ্ব’ শীর্ষক দীর্ঘ আলোচনায় এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করি যে, সকল যুগে এ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলেছে ইসলামের বিরুদ্ধে জাহেলিয়াতের। অর্থাৎ ইসলামের অনুসারী ও পতাকাবাহীদের বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধী শক্তিসমূহের। ইসলাম ও জাহেলিয়াত দুই বিপরীতমুখী শক্তি হওয়ার কারণ- একটির অস্তিত্ব ও প্রাধান্য অপরটির কাছে অসহনীয়। জাহেলিয়াত তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও ইসলামকে নির্মূল করতে পারেনি। কারণ ইসলাম মহাসত্য ও মহাসুন্দর। সত্য ও সুন্দরের প্রতি মানব মনের আকর্ষণ সহজাত ও স্বভাবসুলভ। কিন্তু ইসলামের নবজাগরণ যেহেতু জাহেলিয়াতের জন্য অসহনীয় সেজন্যে জাহেলিয়াত এক নতুন স্ট্র্যাটেজি বা রণকৌশল অবলম্বন করে সাময়িকভাবে হলেও সাফল্য অর্জন করেছে। এ রণকৌশল সে সকল যুগেই অবলম্বন করেছে। ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাস থেকে একথা প্রমাণিত যে, মুসলমানগণ ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের রজ্জু দৃঢ়হস্তে আঁকড়ে ধরে থাকলে জাহেলিয়াত তাদের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারে না। তাই জাহেলিয়াত এ রণকৌশল অবলম্বন করে যে, মুসলমানের দ্বারাই ইসলামের উপর আঘাত হানতে হবে। জাহেলিয়াত স্বনামে ইসলামের উপর আক্রমণ করে বসলে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সে আক্রমণ প্রতিহত করার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ইসলামের নাম নিয়ে কোন মুসলমান ইসলামের ক্ষতিসাধন করতে চাইলে মুসলিম ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি হতে বাধ্য। ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার অবসানের পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে উৎসাহ ও প্রেরণা সৃষ্টি করেছে জাহেলিয়াত এবং প্রকাশ্যে কাজ করেছে নামধারী মুসলমান। খিলাফত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার পর শাসনদণ্ড যাদের হাতে ছিল, তারা ইসলামী সুবিচার, ন্যায়নীতি, জানমালের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করার দিকে মনোযোগ দিতে পারেনি। ইসলামের প্রাণশক্তি জীবন্ত রাখার এবং মৌল শিক্ষা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছেন।
বিভিন্ন যুগে জাহেলিয়াতের অনুসারীগণ কতিপয় মুসলমানকে অর্থ ও পদমর্যাদায় প্রলুব্ধ করে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এমনকি আলিম নামধারী কতিপয় লোককেও ইসলামের দুশমনগণ মুসলিম মিল্লাত ও ইসলামের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে।
সারা বিশ্বে জাহেলিয়াতের জয়ভেরী নিনাদিত হতে থাকে যখন দু’তিনটি ব্যতীত সকল মুসলিম দেশ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। শাসকবৃন্দ বিজিত মুসলিম দেশগুলোতে সেকিউলার জীবনদর্শন ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করে মুসলমানদের মধ্যে ইসলামবিমুখ রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীর প্রজন্ম সৃষ্টি করে। পশ্চিমী শাসকবৃন্দ ইসলামী রীতিনীতি ও মূল্যবোধ যতোটুকু অবশিষ্ট ছিল তার উপর নিজেরা হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। তাদের চলে যাওয়ার পর যেসব মুসলমান তাদের স্থলাভিষিক্ত হয় তারা ইসলামের উপর ছুরিকাঘাত করতে থাকে। পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক শাসন ও তাদের প্রবর্তিত সিক্ষাব্যবস্থা বহু ছোটো-বড়ো কামাল আতাতুর্ক, কর্নেল নাসের, আইয়ুব খান, সুকর্ন কায়েম করে।
নতুন প্রজন্মের এসব বিভ্রান্ত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী ইসলামের সংস্কার সাধনে ব্রতী হয়। শেখ মুহাম্মাদ আব্দুহু, স্যার সৈয়দ আহমদ, গোলাম আহমদ পারভেজ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ- পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার সাথে সমন্বয় সাধন করে ইসলামকে নতুন ছাঁচে ঢেলে গড়ার প্রচারণা চালান। মির্জা গোলাম আহমদ তো এক নতুন ইসলামই আবিষ্কার করে বসেন। তবে ইসলামের মৌলিক বিধানগুলো পরিহার করে নারী-পুরুষের মিশ্র সমাবেশ, সহশিক্ষা, নাচগান, মদ্যপান, নারী স্বাধীনতার আন্দোলন আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানদেরকে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করে। কোথাও ইসলামী পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা দেখা দিলে অথবা কোথাও ইসলামী আন্দোলন চলতে থাকলে উপরোক্ত শ্রেণীর মুসলমান সর্বাগ্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শুধু তা-ই নয়, শক্তি প্রয়োগ করে, ফ্যাসিবাদী কর্মকৌশল অবলম্বন করে, এমনকি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলন নির্মূল করার সকল প্রচেষ্টা চালায়। এ কারণেই দুনিয়ার কোথাও সত্যিকার ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সাফল্য লাভ করতে পারছে না।
জীবনের সকল স্তর ও বিভাগে পূর্ণাংগ ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা জাহেলিয়াত তথা ইবলিসের কাছে সবচেয়ে অসহনীয়। তবে জীবনের অতি সংকীর্ণ পরিসরে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে খোদার কিছু স্তবস্তুতি, পূজা-অর্চনা যেমন- নামায, রোজা, কালেমার যিকির, কিছু দান-খয়রাত প্রভৃতিতে ইবলিসের কোন আপত্তি নেই। জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে- সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থায়, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তার আধিপত্য মেনে চললেই সে যথেষ্ট মনে করে। ইসলাম একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান হিসেবে কোথাও প্রতিষ্ঠিত হোক এটা যেমন ইবলিস বরদাশত করতে রাজি নয়- তেমনি বরদাশত করতে রাজি নয় তার একান্ত অনুগত দাস পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতির পতাকাবাহীগণ। তবে জাহেলিয়াতের আপাতঃ সাফল্য এটাই যে, ইসলাম-বিরোধিতার প্রকাশ্য সংগ্রামের প্রথম সারিতে সে তথাকথিত কতিপয় নামধারী মুসলমানকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। ইসলাম-বিরোধী রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলো পেছনে থেকে অর্থ, উপায়-উপাদান, প্রেরণা ও সাহস যোগাচ্ছে। কিন্তু এতোসব সত্ত্বেও ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সর্বত্র শিক্ষিত-চিন্তাশীল মানুষ এ সত্য উপলব্ধি করছে যে, সমস্যা জর্জরিত মানবসমাজের সকল সমস্যার সমাধান একমাত্র ইসলামেই রয়েছে। ইসলাম ছাড়া মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির আর কোন পথ নেই।
এই সাথে এ সত্যটিও উপলব্ধি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যে, যে বস্তুটিকে কোন রোগের একমাত্র মহৌষধ বলে মেনে নেয়া হয়, তা অবশ্যই খাঁটি ও ভেজালমুক্ত হতে হবে। ভেজাল ঔষধ বার বার প্রয়োগেও রোগের কোন উপশম হয় না, বরঞ্চ রোগ বৃদ্ধির কারণ হয়। অতএব সর্বশেষ নবী কর্তৃক প্রচারিত প্রতিষ্ঠিত নির্ভেজাল ইসলামকেই বেছে নিতে হবে। তার মৌল শিক্ষার মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তন-পরিবর্ধনও মেনে নেয়া যাবে না। এ ব্যাপারে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তাফার (সা) পরিপূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে।
মজার ব্যাপার এই যে, ভেজাল ইসলামে জাহেলিয়াত বা ইসলামবিরোধীদের আপত্তির কোন কারণ নেই। তাওহীদের যে ব্যাখ্যা কুরআন ও হাদীসে আছে তা উপেক্ষা করে কবরপূজা ইত্যাদির মত শির্কমূলক কাজ করা, মানুষকে সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী মনে করা, পাশ্চাত্য জড়বাদী সভ্যতার অনুকরণ করা, সুদ-ঘুষ, ব্যভিচার, অন্যায়-অবিচার প্রভৃতির প্রশ্রয় দেয়া এবং এসবের উপরে ইসলামের লেবাস পরিয়ে দেয়া ইসলামবিরোধীদেরই অভিপ্রেত। আঞ্চলিকতা, স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব, ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আভিজাত্যের ভিত্তিতে মানবজাতিকে বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত করাই জাহেলিয়াতের কাজ। এসবের বিপরীত তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের প্রচেষ্টাই ইসলাম বিরোধী শক্তির চরম আপত্তির কারণ। জাহেলিয়াত এটাকেই মৌলবাদ বলে আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ যুদ্ধের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে ওসব মুসলিম শাসক ও তাদের অনুগ্রহপুষ্ট দলগুলো যারা নির্ভেজাল ইসলামকে তাদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে করে। ইসলামের সাচ্চা সৈনিকগণও যুদ্ধের ময়দানে আছেন এবং অকাতরে জীবন দিচ্ছেন। আর এ যুদ্ধ নতুন নয়, কারণ ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব সংঘর্ষও নতুন নয়। কারবালা থেকে বালাকোট পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল যাবত চলেছে এ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ। চলছে বালাকোটের পরেও এবং চলতেই থাকবে- যতোদিন না পূর্ণ বিজয় সূচিত হবে নির্ভেজাল ও বিশুদ্ধ ইসলামের।
চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য প্রয়োজন
সর্বপ্রথম প্রয়োজন যে জিনিসের তা হচ্ছে এই যে, যাঁরা ইসলামের পুনর্জাগরণ দেখতে আগ্রহী, যাঁরা চান যে আল্লাহর সৃষ্ট যমীনের উপরে এবং মানবসমাজে একমাত্র আল্লাহরই পূর্ণাংগ আইন-শাসন কায়েম হোক, তাঁদের মধ্যে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ঐক্যের উৎস হবে কুরআন ও সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক হবে এ ঐক্যের আদর্শ ও প্রেরণার উৎস। জাহেলিয়াত যেন হানাফী-আহলে হাদীস, শাফেয়ী-হাম্বলী, দেওবন্দী-বেরেলভী প্রভৃতি নামে ইসলামপন্থীদেরকে শতধাবিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত করে রাখতে না পারে।
দ্বিতীয়তঃ ইসলাম ও তার কল্যাণকারিতা হৃদয়গ্রাহী ভাষায় সর্বশ্রেণীর জনগণের মধ্যে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। আধুনিক খোদাহীন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে যে ভুল ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছে, তা দূর করতে হবে। ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে।
তৃতীয়তঃ যেসব স্বৈরশাসন ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক, তা অপসারণের জন্যে সর্বাত্মক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। এ ব্যাপারে নবী-রসূলগণের কর্মসূচিই অনুসরণ করতে হবে।
সর্বশেষে যেহেতু এ কাজ আল্লাহতায়ালার সাহায্য ব্যতীত কিছুতেই সম্ভব নয়, তার জন্যে তার সাথে অত্যন্ত গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। তার সন্তুষ্টির জন্যে সমগ্র জীবন বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। এভাবেই বিশ্বনবীর নেতৃত্বে মদীনার বুকে ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রের ভিত রচিত হয়েছে। সে গৃহীত কর্মসূচি ও পন্থা-পদ্ধতি এখনো অবলম্বন করলে একই সুফল লাভ অত্যন্ত স্বাভাবিক।