জাহেলিয়াতের মারাত্মক অস্ত্র
জাহেলী তাসাউফ কিছুসংখ্যক মুসলমানকে বিভ্রান্ত করে ইসলামের সত্য-সঠিক ও সহজ-সরল রাজপথ (সিরাতুল মুস্তাকীম) থেকে যে বিচ্যুত করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে জাহেলিয়াতের অতি মারাত্মক তিনটি অস্ত্র ইসলামের মূল বুনিয়াদকেই নড়বড়ে করে দিয়েছে। সে তিনটি হচ্ছে (১) খোদাহীন বা খোদাদ্রোহী জীবনব্যবস্থা (SECULARISM) (২) জাতিপূজা তথা জাতীয়তাবাদ (NATIONALISM) এবং (৩) সার্বভৌমত্বের দাবিদার গণতন্ত্র (DEMOCRACY)। এ তিনটি মারাত্মক অস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করলে বুঝা যাবে যে, এগুলো ইসলামী বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনাকে কতখানি প্রভাবিত করেছে এবং ইসলামের পরিপন্থী জীবনদর্শন ও মতবাদ কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সেকিউলারিজম
প্রথমে SECULARISM (সেকিউলারিজম) সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। এর মর্ম হচ্ছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বস্রষ্টার বিধান ও পথ-নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের রচিত বিধান ও পথ নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন যাপন করা। তবে অত্যন্ত চতুরতার সাথে বলা হয়, কারো বিবেক যদি এ সাক্ষ্য দেয় যে, খোদা বলে কেউ আছেন এবং তাঁর স্তবস্তুতি করা উচিত, তাহলে সে তার ব্যক্তিগত জীবনে তা করতে পারে। কিন্তু দুনিয়া, সমাজ ও তৎসম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে খোদা ও ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। এ তত্ত্বের ভিত্তিতে যে জীবনব্যবস্থার প্রাসাদ গড়ে উঠেছে তার মধ্যে মানুষের সাথে মানুষের এবং মানুষের সাথে দুনিয়ার সম্পর্কের সকল স্তর খোদা ও ধর্ম থেকে একেবারে স্বাধীন। গোটা সমাজব্যবস্থা ধর্ম থেকে স্বাধীন, শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীন, আইন-কানুন স্বাধীন, দেশের পার্লামেন্ট স্বাধীন, রাজনীতি, অর্থনীতি, দেশের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক সম্বন্ধ-সম্পর্ক সবই খোদা ও ধর্ম থেকে স্বাধীন; মানব জীবনের এসব বিভিন্ন দিক ও বিভাগে যে সিদ্ধান্তই করা হয়ে থাকে তাতে এ প্রশ্ন অবান্তর, মূলতঃ অর্থহীন এবং অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাপ্রসূত যে, খোদা এসব ব্যাপারে কোন মূলনীতি ও নির্দেশ আমাদের জন্যে নির্ধারিত করে দিয়েছেন কিনা। আর দিয়ে থাকলেও অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তা মেনে চলা সম্ভব নয়। এখন রইলো ব্যক্তিগত জীবন। কিন্তু ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিকতার প্রভাবে ব্যক্তিগত জীবনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মবিবর্জিত হয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। কারণ এখন অতি অল্পসংখ্যক লোকের মন এ সাক্ষ্য দেয় যে, খোদা বলে কেউ আছেন এবং তাঁর হুকুম মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে এ সেকিউলারিজমের ভিত্তিতে যে সমাজ-সভ্যতা গড়ে উঠেছে, তার কর্ণধার যারা তাদের জন্যে ধর্ম এখন ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারও আর নেই। খোদার সাথে তাদের আপন সম্পর্কও ছিন্ন হয়েছে।
এ সেকিউলারিজম তথা ধর্মহীনতা বা খোদাদ্রোহীতার জন্ম ইউরোপে এবং এর একটা পশ্চাৎ পটভূমিও (BACKGROUND) রয়েছে। সংক্ষেপে হলেও তার আলোচনা ব্যতীত বিষয়টি উপলব্ধি করা কষ্টকর হবে বলে মনে হয়।
খৃস্টান পাদ্রীগণ বিকৃত খৃস্টবাদের ভিত্তিতে নিজেদের মনগড়া শরিয়ত বা ধর্মীয় বিধি-বিধান রচনা করেন এবং ধর্মের নামে শাসন চালাতে থাকেন। সমাজ পরিচালনার উপযোগী শরিয়তের বিধান তাওরাতে ছিল। ইহুদী আলেমগণ তাওরাতকে যথাসম্ভব বিকৃত করলেও মূল তাওরাতকেই খৃস্টানগণ প্রত্যাখ্যান করেন। বাইবেলের মাধ্যমে কোন নতুন শরিয়ত নাযিল করা হয়েছিল না। ফলে খৃস্টান পাদ্রীগণ তাদের নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে বিকৃত করে ধর্মের নামে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। খোদা প্রেরিত আইনের পরিবর্তে মানুষের মনগড়া আইনের দ্বারা সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। এ শাসনের অধীনে অনাচার-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন চলতে থাকলেও তার উপর ধর্মের ছাপ থাকায় সাধারণ মানুষ তা অগত্যা নীরবে মেনে নিত। গোটা ইউরোপে পাদ্রীদের দ্বারা পরিচালিত বহু ছোটো-বড়ো রাজ্য ছিল যেগুলোকে PAPAL STATES বলা হতো। এ সবের উপর এক খৃস্টীয় সাম্রাজ্য কায়েম করা হয়েছিল যাকে বলা হতো HOLY ROMAN EMPIRE।
উল্লেখ্য, অষ্টম শতাব্দীর সূচনালগ্নে স্পেনে মুসলিম শাসন কায়েম হয় এবং কয়েকশ’ বছর সে শাসন বলবৎ থাকে (৭১১-১৪৯২ খৃঃ)। মুসলিম শাসন আমলে কর্ডোভা ও গ্রানাডায় সর্ববৃহৎ দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে জ্ঞানপিপাসু মানুষ জ্ঞানলাভের জন্যে দলে দলে এসব সুউচ্চ বিদ্যাপীঠে ভিড় করতে থাকে। উচ্চশিক্ষায় এসব প্রতিষ্ঠান ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত করে। তদানীন্তন বিশ্বে বাগদাদ, কর্ডোভা এবং কস্তুনতানিয়া (CONSTANTINOPLE) ছিল সমগ্র বিশ্বের মধ্যে শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি। কিন্তু কর্ডোভার স্থান ছিল সকলের উচ্চে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় কর্ডোভার (CORDOVA) খ্যাতি ছিল বিশ্ববিখ্যাত। ব্যাপক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ফলে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তার উন্মেষ ঘটে। সেইসাথে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারও হতে থাকে। পাদ্রীদের জীর্ণ পুরাতন কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা-চেতনার সাথে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রচণ্ড সংঘর্ষ শুরু হয়। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও আবিষ্কার বন্ধ করার জন্যে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও লোমহর্ষক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। যেহেতু এ সবকিছু ধর্মের দোহাই দিয়েই করা হচ্ছিল, সেজন্যে শিক্ষিত সমাজ ধর্মের প্রতিই বীতশ্রদ্ধ হতে থাকে।
প্রাচীনকালের খৃস্টান পণ্ডিত ও দার্শনিকগণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মানুষ ও বিশ্ব প্রকৃতি সম্পর্কিত ধারণার গোটা প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন গ্রীকদর্শন ও বিজ্ঞানের ধারণা-মতবাদ, যুক্তি-প্রমাণ ও তথ্যাদির উপর। তাদের এ ধারণাও ছিল যে, যেসব বুনিয়াদের উপর তাদের মতবাদের প্রাসাদ নির্মিত, তার কোন একটির উপর যদি আঘাত আসে, তাহলে গোটা প্রাসাদই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। সেইসাথে খৃস্টান ধর্মও শেষ হয়ে যাবে। গ্রীকদর্শন ও বিজ্ঞানের সর্বস্বীকৃত সত্যের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টিকারী কোন সমালোচনা ও গবেষণা তারা কিছুতেই বরদাশত করতে রাজি ছিলেন না। এমন কোন দার্শনিক চিন্তাধারাও তারা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না, যা এসব সর্বস্বীকৃত সত্যকে পরিহার করে অন্য কোন চিন্তা পেশ করতো, যার কারণে পাদ্রী সম্প্রদায় তাদের দর্শন পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন বোধ করতো। এমন কোন গবেষণা কাজেরও অনুমতি দেয়া যেতো না যার দ্বারা মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে বাইবেলে উপস্থাপিত ধারণা এবং দার্শনিকদের গৃহীত ধারণা মতবাদের কোন অংশ ভুল প্রমাণিত হতে পারতো। এ ধরনের প্রতিটি বিষয়কে তারা ধর্মের জন্য এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত গোটা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্যে প্রত্যক্ষ বিপদ মনে করতেন। পক্ষান্তরে যারা রেঁনেসা আন্দোলন ও তার দাবি অনুযায়ী সমালোচনা, গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের কাজ করছিলেন, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে সেসব দর্শন ও বিজ্ঞানের দুর্বলতা সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়তো যে সবের ভিত্তিতে ধর্মীয় বিশ্বাসের গোটা প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তারা যতোই গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রসর হচ্ছিলেন, ততোই পদ্রী বা খৃস্টান সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে দিন দিন কঠোরতার সাথে তাদের পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করতো। পূর্ববর্তীকালের বহু স্বীকৃত সত্যের পরিপন্থী বহুকিছু দিবালোকের মতো স্পষ্ট চোখে পড়তো। পাদ্রী সম্প্রদায় বলতো, সর্বস্বীকৃত সত্যাবলী পুনর্বিবেচনা করার পরিবর্তে সমালোচকদের চক্ষু উৎপাটিত করে দিতে হবে। গবেষকদের কাছে মনে হতো, যেসব মতবাদকে ধর্মীয় বিশ্বাসের অখণ্ডনীয় দলিল-প্রমাণ মনে করা হতো, তার মধ্যে বিস্তর ত্রুটি রয়েছে। পাদ্রী সম্প্রদায় বলতো, যাদের মন-মস্তিষ্কে এ ধরনের চিন্তার উদ্রেক হয় তাদের মস্তিষ্কই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে হবে। এ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পরিণাম ছিল এই যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক নবজাগরণের প্রথম প্রভাতেই ধর্ম ও ধার্মিকদের বিরুদ্ধে একগুঁয়েমির মনোভাব সৃষ্টি হয় এবং নতুন সভ্যতার শিরা-উপশিরায় খোদা-বিমুখতা এবং ধর্মহীনতার মানসিকতা সংক্রমিত হয়। অতঃপর এসব স্বাধীন চিন্তার প্রবক্তাগণের কাছে এটা আশা করা যেতো না যে, তারা অন্যান্য ধর্মকে গির্জার খৃস্ট ধর্ম থেকে পৃথক করে দেখবেন। এজন্যে স্বাভাবিকভাবেই তাদের এ একগুঁয়েমি খৃস্টধর্ম ও তার গির্জার মধ্যে সীমিত রইলো না। বরঞ্চ ধর্ম বলতে যা বুঝায় তা সবই তাদের একগুঁয়েমির শিকার হয়ে পড়লো। ধর্মের বিরুদ্ধে একগুঁয়েমির এরূপ মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার সাথে এ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ যখন জ্ঞানের অঙ্গন থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশ করলো, তখন গির্জা কর্তৃপক্ষের পরাজয়ের পর নতুন সভ্যতার পতাকাবাহীদের নেতৃত্বে একটি স্থায়ী জীবনদর্শনসহ জীবনের এক নতুন ধর্মীয় প্রাসাদ নির্মাণ করা হলো যার নাম ‘সেকিউলারিজম’। তার মূলনীতি এই যে, রাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিকতা, আইন কানুন, মোটকথা সামাজিক জীবনের কোন বিভাগেই ধর্মের হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার থাকবে না। ধর্ম নিছক এক ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ তার ব্যক্তিজীবনে খোদা ও পয়গম্বরদেরকে মানতে চায় তো মানতে পারবে। কিন্তু সামাজিক জীবনের সমগ্র বিধি-বিধান প্রণয়নে এ প্রশ্ন অবান্তর যে, এর সম্পর্কে খোদা কি পথনির্দেশনা দান করেন।
আধুনিক জগতের নতুন সভ্যতার চিন্তামূলক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থিনৈতিক ব্যবস্থার প্রাথমিক বুনিয়াদ হলো সেকিউলারিজম (SECULARISM)। ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ, নাৎসিবাদ, সমাজবাদ, কমিউনিজম, জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্বের দাবিদার গণতন্ত্র, ভোগবাদ (EPICURIANISM), উপযোগবাদ (UTILITARIANISM), নাস্তিকতা, ডারউইনবাদ (DARWINISM) প্রভৃতি মতবাদগুলি সেকিউলারিজমেরই শাখা-প্রশাখা মাত্র এবং সকলের মধ্যে সঞ্চারিত সেকিউলারিজমের প্রাণশক্তি।
এ জীবনব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর হচ্ছে ধর্মহীনতা, খোদাদ্রোহীতা অথবা নিছক পার্থিবতা। খোদা ও ধর্মের সম্পর্ক শুধু মানুষের ব্যক্তি জীবনেই সীমিত- এ মতবাদ একটি অর্থহীন ও অবান্তর মতবাদ, জ্ঞান ও বিবেকের সাথে যার কোন দূরতম সম্পর্কও নেই। একথা ঠিক যে, খোদা ও মানুষের ব্যাপার নিম্নের দুইয়ের যে কোন একটি অবশ্যই হবে। হয় খোদা মানুষের এবং এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা, প্রভু এবং শাসক ও আইনদাতা, অথবা কোনটাই নন। যদি তিনি স্রষ্টা, প্রভু ও শাসক না হন, তাহলে তার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাখারও কোন প্রয়োজন নেই। আর সম্পর্কহীন কোন সত্তার পূজা-অর্চনা করা একেবারে অর্থহীন। এমনকি এ চিন্তা করাও বিবেকহীনতার পরিচায়ক যে, খোদা তো স্রষ্টা বটে- কিন্তু মানুষ দুনিয়ায় কিভাবে তার জীবন-যাপন করবে, তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা কেমন হবে তা তিনি বলে দেননি অথবা, মায়াযাল্লাহ, তিনি বলতে অক্ষম। এমন খোদাকে মানার কোন প্রয়োজন আছে কি? কিন্তু তিনি যদি আমাদের এবং বিশ্বজগতের স্রষ্টা, প্রভু ও শাসক হয়ে থাকেন, তাহলে তার শাসন শুধু ব্যক্তিজীবনে সীমিত থাকবে অথবা শাসন নয় নিছক পূজা-অর্চনায় সীমিত থাকবে- এমন চিন্তা করা চরম মূর্খতা বৈ কিছু নয়। এক ব্যক্তির সাথে আর এক ব্যক্তি যুক্ত হওয়ার পর যখন সামাজিক সম্পর্ক শুরু হবে, তখন সেখানে আর স্রষ্টার শাসন-নিয়ন্ত্রণ চলবে না- এ বিবেকহীনের উক্তি হতে পারে। সামাজিক জীবনে মানুষ স্রষ্টার মুখাপেক্ষী না হয়ে যদি স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী হয়, তাহলে এ হবে তার স্রষ্টা, প্রভু ও শাসকের বিরুদ্ধে চরম বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের পর যে এ কথা বলে- আমি ব্যক্তিগত জীবনে খোদাকে মেনে চলি- তার মস্তিষ্ক-বিকৃতিই ঘটেছে বলতে হবে। এ স্রষ্টার সাথে ধোঁকা-প্রতারণা ও ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
এটা কি বিবেকহীনের কথা নয় যে, এক এক ব্যক্তি পৃথকভাবে পৃথকভাবে তো খোদার বান্দাহ এবং তাঁর হুকুম মেনে চলতে বাধ্য কিন্তু এ পৃথক পৃথক ব্যক্তিসত্তা মিলিত হয়ে যখন একটা সমাজ গঠন করে তখন আর তারা খোদার বান্দাহ থাকে না। অংশগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি বান্দাহ, কিন্তু অংশগুলোর সমষ্টি বান্দাহ নয়। এ একজন বিবেক-বুদ্ধিহীন পাগলেরই উক্তি হতে পারে। একথা কি করে মেনে নেয়া যায় যে, যদি খোদা এবং তাঁর পথনির্দেশনার প্রয়োজন আমাদের না থাকে আমাদের পারিবারিক জীবনে, আমাদের বস্তি ও শহরে, আমাদের শিক্ষাঙ্গনে, আমাদের হাট বাজারে, আমাদের পার্লামেন্ট ও গভর্নমেন্ট হাউসে, প্রশাসনে, হাইকোর্টে, সেনা ছাউনিতে, পুলিশ লাইনে, যুদ্ধ ও সন্ধিতে, তাহলে তাঁর প্রয়োজন আর কোথায় হবে? যে খোদা এতো অথর্ব ও অযোগ্য (মায়াযাল্লাহ) যে, জীবনের কোন ক্ষেত্রেই তিনি পথ-নির্দেশনা দিতে পারেন না, আমাদের জন্যে কোনটি কল্যাণকর কোনটি অকল্যাণকর তা বলে দিতে পারেন না, আমাদের জীবন সমস্যার সমাধান বলে দিতে পারেন না, তাহলে এমন খোদাকে মেনে লাভ কি? কিন্তু তিনি যদি এসবের প্রকৃত যোগ্য হয়ে থাকেন এবং আমাদের জীবন বিধান দিয়ে থাকেন, তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করার অর্থ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। এ কারণেই ইংরেজি শব্দ SECULARISM-এর সার্থক বাংলা তর্জমা খোদাদ্রোহিতা ব্যতীত আর কিছু হতে পারে না। বাস্তব জীবনে এ মতবাদটির পরিণাম ফল অত্যন্ত মারাত্মক। জীবনের যে কোন বিভাগ ও দিককে খোদা বা ধর্ম বিবর্জিত করলে তা শয়তানের প্রভাবাধীন হতে বাধ্য। মানুষের প্রাইভেট জীবন বলতে কিছুই নেই। একটি মানবসন্তান মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হবার পর মুহূর্ত থেকেই তার সামাজিক জীবন শুরু হয়। সে তার চারধারে দেখতে পায় তার মা, বাবা, ভাইবোন, দাদা-দাদী, মামু, খালা, ফুফু ও আরও অনেক আত্মীয়-স্বজন। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হওয়ার পর একটি সমাজ, একটি জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, একটা বস্তি, একটি জাতি, একটি সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। এ ধরনের বহু সম্পর্ক তাকে অন্যান্য মানুষের সাথে এবং অন্যান্য মানুষকে তার সাথে জড়িত করে। এসব সম্পর্ক সঠিক, সুন্দর ও ইনসাফপূর্ণ হলেই এক একটি মানুষের এবং সামগ্রিকভাবে সকল মানুষের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি সম্ভব। এ ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহতায়ালাই সেই মহাজ্ঞানী সত্তা যিনি মানুষকে এসব সম্পর্ক-সম্বন্ধের জন্য ইনসাফপূর্ন ও স্থায়ী মূলনীতি ও সীমারেখা বলে দিয়েছেন। জীবনের যে কোন বিভাগ ও ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার হেদায়েত ও পথ-নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করে আপন ইচ্ছামত এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলে কোন স্থায়ী মূলনীতি, ইনসাফ ও সততার কোন স্থান থাকে না। এ জন্যে খোদার হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর প্রবৃত্তি, কুসংস্কার, ত্রুটিযুক্ত অপূর্ণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যতীত হেদায়েতের জন্যে আর এমনকিছু থাকে না মানুষ যার শরণাপন্ন হতে পারে। এর পরিণাম ফল দেখতে পাওয়া যায় এমন প্রতিটি সমাজে যা ধর্মহীনতা বা নিছক পার্থিবতার (SECULARISM) নীতিতে পরিচালিত হয়। এসব স্থানে দেখা যায় যে, প্রবৃত্তির অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যে প্রতিদিন নিত্য-নতুন মূলনীতি রচিত হয় এবং রহিত করা হয়। মানবীয় সম্পর্ক-সম্বন্ধের এক একটি দিক ও বিভাগ যে কতটা অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নিপীড়ন ও পারস্পরিক অনাস্থায় কলুষিত, তা বিশ্ববাসীর কাছে সুস্পষ্ট। সকল মানবীয় ব্যাপারে ব্যক্তিগত, দলীয়, জাতীয় এবং বংশীয় স্বার্থপরতার প্রবল প্রভাব বিদ্যমান। প্রত্যেক জাতি ও দেশ আপন আপন এখতিয়ারের অধীন যথাসাধ্য ও যথাসম্ভব স্বার্থপরতার সাথে আপন আপন অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যে মূলনীতি, আইন-কানুন ও রীতি-পদ্ধতি তৈরি করে নিয়েছে। তারা এ বিষয়ের কোন পরোয়া করে না যে, অন্যান্য ব্যক্তি, দল ও জাতির উপর তার কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে। অতএব এ কথা দ্বিধাহীনচিত্তে বলা যেতে পারে যে, সেকিউলারিজম তথা খোদাদ্রোহিতা বা পার্থিবতার পরিণামফল শুধু এই যে, যে ব্যক্তিই এ মতবাদ অনুযায়ী তার কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করবে, সে লাগামহীন, দায়িত্বহীন এবং প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়বে, তা সে কোন ব্যক্তি হোক, দল, দেশ বা জাতি হোক, অথবা জাতিসমষ্টি হোক।
উপরের আলোচনায় এতোটুকু জানা গেল যে, ইহুদী ও খৃস্টধর্মের চরম পতনযুগে ইউরোপে সেকিউলারিজমের জন্ম এবং তা মানবজীবনের সকল স্থান থেকে খোদা ও ধর্মকে উচ্ছেদ করে শুধু ব্যক্তিজীবনের অতি সংকীর্ণ পরিসরে ধর্মকে মেনে চলার অনুমতি দেয়। মোটকথা, সেকিউলারিজম হচ্ছে খোদার সার্বভৌমত্ব এবং পথনির্দেশনা উপেক্ষা করে মানব জীবনের যাবতীয় বিষয়ের ফয়সালা করা এবং আখিরাতের (পরকালীন জীবনের) সাফল্যের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবন এবং তার সাফল্যকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা। ‘সেকিউলারিজম’ তার এ অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ সমগ্র দুনিয়ার উপর অক্টোপাসের মতো তার বাহু বিস্তার করে আছে। দুনিয়াতে এখনো যদিও খোদা ও ধর্মে বিশ্বাসী লোকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু এ ধার্মিকতা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি জীবনের অতি সংকীর্ণ পরিসরেই সীমিত এবং এ পরিসরের মধ্যেও যারা নিজেদেরকে ধর্মের প্রতি বিশ্বাসী বলে পরিচয় দেন, তাদের অধিকাংশ ধার্মিকতার প্রতি নিষ্ঠাবান নন। বাইরের পরিবেশের প্রভাবে তারা ক্রমশঃ ধর্মের প্রতি, খোদার প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় দেখা যায় গির্জা ও সিনাগগসমূহ পরিত্যক্ত হচ্ছে। ইহুদী-খৃস্টান যুবসমাজ নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ব্যক্তিজীবনের অতি সংকীর্ণ পরিসরের বাইরে গোটা জীবনের উপর খোদার পরিবর্তে ‘সেকিউলারিজমের’ প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব চলছে এবং বলতে গেলে গোটা মানবজগতের উপর ধর্মের নয়, ‘সেকিউলারিজমের’ রাজত্বই চলছে। এর থেকে অন্য যেসব মতবাদ জন্মগ্রহণ করেছে, যেমন ফ্যাসিবাদ, সমাজবাদ, নাৎসিবাদ, কমিউনিজম, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি যার উল্লেখ পূর্বে করা হয়েছে, এসবের মধ্যে এ বিষয়টি সার্বজনীন মূল্যবোধ হিসেবে বিদ্যমান যে, এসব আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উপরে নয়, বরঞ্চ মানবীয় প্রবৃত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। এ যাবতীয় মতবাদ ও ব্যবস্থাগুলো আল্লাহতায়ালার পথনির্দেশনার ভিত্তিতে গৃহীত নয়, বরঞ্চ খোদাদ্রোহী চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির ফসল। অতএব দ্বিধাহীনচিত্তে এ কথা বলা যেতে পারে যে, ধর্মহীনতা ও খোদাদ্রোহীতার অপর নামই ‘সেকিউলারিজম’।
‘সেকিউলারিজমকে’ ইসলামের মুকাবিলায় জাহেলিয়াতের মারাত্মক অস্ত্র এজন্যে বলা হয়েছে যে, তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস পোষণকারী মুসলমান জাতিও দ্বিধাহীনচিত্তে ‘সেকিউলারজমকে’ তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নীতি নির্ধারক মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ মতবাদের উৎপত্তি হয়েছিল খৃস্টান ধর্মীয় পণ্ডিতদের ধর্মের নামে মনগড়া শাসন ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আধুনিক চিন্তাশীল ও বিজ্ঞানীদের বিদ্রোহী ঘোষণার মাধ্যমে। তাওরাত ও ইঞ্জিল (বাইবেল) এতোটা বিকৃত ও পরিবর্তিত যে, তার মধ্যে খোদার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ মূল বাণীর অতি সামান্য অংশই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বাইবেলে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার বিভাগ, যুদ্ধ-সন্ধি প্রভৃতি বিষয়ে কোন নীতিমালা ঘোষণা করা হয়নি। যার ফলে দেশ পরিচালনায় এবং যাবতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোন ভারসাম্যপূর্ণ ও সুবিচারপূর্ণ নীতি অবলম্বন করা সম্ভব ছিল না। ধর্মীয় পণ্ডিত তথা পাদ্রীগণ তাদের নিজেদের স্বার্থে ধর্মের নামে এক ধর্মহীন ও শোষণমূলক শাসন কায়েম রেখেছিলেন যার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ‘সেকিউলারিজম’ জন্মলাভ করেছে। কিন্তু মুসলমানদের ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের সামনে কুরআন ও সুন্নাহ ছিল এবং এখনো আছে। প্রায় অর্ধ শতাব্দীব্যাপী অবিকৃতভাবে বিদ্যমান এক নজিরবিহীন ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রের দৃষ্টান্তও তাদের সামনে রয়েছে। এতদসত্ত্বেও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে মানুষের রচিত মতবাদ ও আইনের কাছে তাদের মাথানত করা জাহেলিয়াতের এক বিরাট কৃতিত্বই বলতে হবে।
তবে একথা ঠিক যে, মুসলমানগণ তাদের নৈতিক অধঃপতনের কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর যখন গোলামির জীবন যাপন করে, তখন বিজয়ী শক্তির চিন্তাধারা, জীবনদর্শন, জীবনের মূল্যবোধ তাদরকে প্রভাবিত করে। অবশেষে তারা বিজয়ী শক্তির এমন মানসিক দাসে পরিণত হয় যে, তারা সবকিছু তাদের মন দিয়ে চিন্তা করতে থাকে এবং তাদের চোখ দিয়েই দেখতে থাকে।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে সেকিউলারিজম
এ উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ইংরেজ জাতির ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত হয় ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে। শঠতা, প্রতারণা, উৎকোচ ও বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন শাসনকর্তা সিরাজউদ্দৌলাকে বিনাযুদ্ধেই পরাজিত ও নিহত করে এ অঞ্চলে এবং পরবর্তী একশ’ বছরের মধ্যে সমগ্র উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ শাসনের পূর্বে গোটা উপমহাদেশে কয়েকশ’ বছর যাবত মুসলিম শাসন বলবৎ ছিল। উল্লেখ্য যে, মুসলিম শাসন আমলে দেশের সর্বত্র ইসলামী আইন প্রবর্তিত ছিল এবং সকল জাতি ও ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পরিপূর্ণ সুবিচার প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুসলমানদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ইংরেজ শাসক হয়ে বসে এবং তারপর দেশের প্রচলিত ইসলামী আইন রহিত করে তদস্থলে মানব রচিত আইন কার্যকর করা হয়।
মুসলিম শাসকদের চরম নৈতিক অধঃপতন, ভোগ বিলাস ও দায়িত্বহীনতার কারণেই মুসলিম শাসনের অবসান হয়েছিল। কিন্তু মুসলমানগণ দু’টি কারণে বিদেশী ও বিধর্মীদের শাসন মেনে নিতে পারেনি। এক- শাসকের জাতি হয়ে তাদেরকে পরাধীনতা তথা গোলামির শৃঙ্খল পরতে হয়েছিল যা তাদের জন্যে ছিল একেবারে লজ্জাকর ও অসহনীয়। দুই- ইসলামী আইনের পরিবর্তে মানবরচিত খোদাহীন তথা সেকিউলার আইন তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। তা ছিল তাদের ঈমান-আকীদার পরিপন্থী।
ইসলামের মৌল বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহতায়ালা শুধু মানবজাতিসহ বিশ্বজাহানের স্রষ্টাই নন, বরঞ্চ তিনি সকল জীবের রিযিকদাতা, প্রতিপালক, প্রভু, বাদশাহ ও আইনদাতা। কুরআনের সূরা ‘আন নাসে’ আল্লাহতায়ালাকে মানবজাতির বাদশাহ বলে অভিহিত করে তাঁর কাছে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। আল্লাহ মানবজাতির বাদশাহ এবং মানুষ তাঁর প্রজা। বাদশাহের পক্ষ থেকে প্রজার জন্যে অবশ্যই প্রয়োজনীয় আইন-কানুন নির্ধারিত থাকবে যা প্রজার জন্যে অবশ্য পালনীয়। অন্যথায় আইন লংঘনের অপরাধে শাস্তির যোগ্য অবশ্যই হতে হবে।
এই উপমহাদেশের মুসলমানদের নিকটে এ প্রশ্নটি প্রকট হয়ে দেখা দেয় যে, আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মানুষের রচিত আইন কি করে মেনে নেয়া যায়। আল্লাহর আইন-শাসন রহিত করে যে বা যারা নিজেদের আইন-শাসন মানবসমাজে কার্যকর করতে চায়, তারা খোদায়ীর দাবিদার বাতিল শক্তি যাদেরকে কুরআনের ভাষায় ‘তাগুত’ বলা হয়েছে। আর তাগুতের হুকুম-শাসন, প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করেই আল্লাহর উপর ঈমান আনতে হবে। একই সাথে আল্লাহ ও তাগুতের আনুগত্য অযৌক্তিক ও ইসলামের মৌল বিশ্বাসের পরিপন্থী। অবশ্যি এ কথা ঠিক যে, ব্রিটিশ সরকার এ উপমহাদেশে তাদের প্রায় দু’শ’ বছর শাসনকালে মুসলমানদের নামায, রোযা, হাজ্জ্ব, যাকাত প্রভৃতি ধর্ম-কর্মে কোন বাধা দান করেনি। তাদের কথা ছিল, প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ধর্মকর্ম করার পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু দেশের আইন-কানুন, বিচার ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতির উপর ধর্মের কোন অনুশাসন থাকবে না। আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘সেকিউলারিজম’। এতে ব্যক্তি জীবনের বাইরে জীবনের সকল ক্ষেত্রে খোদার আইন-কানুন ও প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করা হচ্ছে। চরম খোদাদ্রোহীতা ছাড়া একে আর কি বলা যেতে পারে?
ইসলামের পরিপন্থী এ দর্শন এবং সমাজব্যবস্থা মুসলমানগণ মেনে নিতে পারেননি যার জন্যে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (র) ‘তাহরিকে মুজাহেদীন’ নামে সত্যিকার অর্থে এক ইসলামী আন্দোলন শুরু করেন। উপমহাদেশের সকল অঞ্চল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ আন্দোলনে হাজার হাজার মুসলমান যোগদান করেন। অতঃপর তাঁরা আল্লাহর পথে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করে একটি নির্ভেজাল ইসলামী রাষ্ট্রও কায়েম করেন। তা যদিও স্থায়ী হতে পারেনি নানান কারণে তথাপি আল্লাহতায়ালার প্রকৃত বান্দাহগণ তাগুতী আইনের শাসন উৎখাত করে অল্পকালের জন্যে হলেও আল্লাহর আইন-শাসন কায়েম করে তাঁদের ঈমানী দায়িত্ব পালন করেছেন।
জাহেলিয়াত তথা শয়তানের এ এক বিরাট কৃতিত্বই বলতে হবে যে, সে সামগ্রিকভাবে মুসলিম জাতিকে এ খোদাদ্রোহী দর্শনের (সেকিউলারিজম) প্রতি প্রভাবিত ও উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। যারা খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়, অথবা যারা তিন খোদা কিংবা বহু খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসী তাদের এ দর্শন মেনে নিতে কোন অসুবিধা নেই। ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মে যারা বিশ্বাসী, তাদের ধর্মের পক্ষ থেকে কোন জীবনবিধান ঘোষণা করা হয়নি। কিছু পূজা-অর্চনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন ব্যতীত জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে কোন পথনির্দেশনা দেয়া হয়নি। এমনকি আসমানী গ্রন্থ ইঞ্জিলেও সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। আল্লাহপাকের সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ ‘আল কুরআন’-এ মানুষের সমগ্র জীবনের জন্যে পরিপূর্ণ বিধান দেয়া হয়েছে। জীবনের যে কোন ক্ষেত্রে কোন বিষয়ের বিচার-ফয়সালা করতে হলে তা আল্লাহর নাযিল করা আইন-বিধান অনুযায়ী করতে হবে। তা যারা করেন না তাদেরকে সুস্পষ্ট ভাষায় ‘কাফের’ ‘জালেম’ ও ‘ফাসেক’ বলা হয়েছে। কিন্তু মুসলমান নামে পরিচিত ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গ দ্বিধাহীনচিত্তে এ সুস্পষ্ট নির্দেশ লঙ্ঘন করে চলেছে। এর একমাত্র কারণ এ ছাড়া আর কী হতে পারে যে, এসব হতভাগ্য মুসলমান ইসলাম-বিরোধী শক্তির অধীনে রাজনৈতিক গোলামির জীবন যাপন করে এবং তাদের প্রবর্তিত শিক্ষা মেনে নিয়েছে। এ তাদের চরম হীনমন্যতা ও মানসিক গোলামি ছাড়া আর কিছু নয়।
পরম পরিতাপের বিষয়, মুসলিম জগতের দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম তুরস্ক সমাজ, রাষ্ট্র এবং সভ্যতা-সংস্কৃতির পুনর্গঠনে সেকিউলারিজমকে বুনিয়াদ হিসেবে গ্রহণ করে। এ খোদাদ্রোহী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার স্থপতি ছিলেন মুস্তাফা কামাল পাশা।
কামাল পাশা ১৮৮১ খৃস্টাব্দে সালোনিকার এক জীর্ণ কুটিরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আলী রেজা সরকারি অফিসে কেরানীগিরি করতেন। দারিদ্র্যের নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে চাকুরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। কিন্তু ব্যবসায় তিনি কোন উন্নতি করতে পারেননি। বরঞ্চ ক্রমশঃ অধিকতর দারিদ্র্যের সম্মুখীন হন। অবশেষে জীবন সম্পর্কে চরম হতাশা তাকে মাদকাসক্ত করে ফেলে এবং তিনি যক্ষ্মারোগে প্রাণত্যাগ করেন। তার স্ত্রী অর্থাৎ মুস্তাফা কামালের মা ছিলেন অত্যন্ত খোদাভীরু মুসলমান এবং পর্দানশীন। তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলেকে একজন ধার্মিক পণ্ডিত বানাতে। কিন্তু শৈশবকাল থেকে কামাল ছিলেন দুর্বিনীত ও উচ্ছৃংখল চরিত্রের। শিক্ষকদের প্রকাশ্যে অপমানিত ও গালাগালি করা তার স্বভাব ছিল। ফলে স্কুলে লেখাপড়া তার হয়নি। পরে তার চাচা তাকে সামরিক স্কুলে ভর্তি করে দেন। এভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের তার সুযোগ হয়।
কামাল পাশা ছোটোবেলা থেকেই ইসলাম ও ইসলামী আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি একেবারে বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। এসব ব্যাপারে তিনি তার মায়ের উপদেশ-নসিহত শুধু প্রত্যাখ্যানই করতেন না, তার সাথে খুব রূঢ় আচরণও করতেন। খোদা, ওহী, নবুওত, আখিরাত প্রভৃতির প্রতিও তার অবিশ্বাস দানা বাঁধতে থাকে এবং তিনি পরিণত বয়সে একজন নাস্তিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
প্রথম মহাযুদ্ধ
বিগত প্রথম মহাযুদ্ধে ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ (The Sick Man of Europe) তুরস্ক ইংরেজদের বিরুদ্ধে জার্মানীর পক্ষে যুদ্ধ করে। সে সময় পর্যন্ত তুরস্কের ওসমানীয়া সাম্রাজ্য খিলাফতের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে গণ্য হতো। প্রতিপক্ষকে চরম আঘাত এবং মুসলিম ঐক্য ভেংগে চুরমার করার উদ্দেশ্যে ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’কে ইংরেজগণ আরব জাতীয়তাবাদের প্রচারক হিসেবে আরব দেশে প্রেরণ করে। মক্কার তৎকালীন শাসক শরীফ হুসাইন হাশমী এ জাতীয়তাবাদের প্রচারণায় এতোটা প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে, ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি আরবদের জাতীয় স্বাধীনতার জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধেই অস্ত্রধারণ করে তুরস্কের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করেন। প্রথম মহাযুদ্ধে ইংরেজ তথা সম্মিলিত বাহিনী (Allied Force) বিজয় লাভ করে। তারা যুদ্ধের প্রারম্ভেই এক গোপন চুক্তির মাধ্যমে ওসমানীয়া সাম্রাজ্যকে তাদের নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে রেখেছিল। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষে তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়। ইউরোপীয় অংশ তার হাতছাড়া হয়। আরব জাতীয়তাবাদের বিষক্রিয়ার ফলে আরব দেশগুলো তুরস্ক সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো বটে কিন্তু সেগুলোকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও গ্রীসের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হলো। অবশেষে ওসমানীয়া সাম্রাজ্য প্রাচীন আনাতোলিয়াতে (ইস্তাম্বুল) সীমিত হয়ে রইলো। ১৯১৯ সালের মে মাসে ওসমানিয়া রাজধানীতে শুধুমাত্র নামসর্বস্ব সুলতানের অস্তিত্ব রয়ে গেল। কিন্তু এখানেও তার স্বাধীনতা ছিল বিপন্ন।
এদিকে ব্রিটিশ ভারতের তথা এ উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের মনে এ বিশ্বাস সৃষ্টি করেছিলেন যে, খলিফাতুল মুসলিমীন এবং খিলাফত ব্যবস্থা তাদের প্রকৃত ঈমানের অংগ-অংশ। অতঃপর ওসমানীয়া সাম্রাজ্যের পতন ও তার ছিন্নভিন্ন অবস্থাদৃষ্টে উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে এ সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, ব্রিটিশ হয়তো খিলাফতের কেন্দ্রকেই ধ্বংস করে দেবে যাকে মুসলমানগণ তাদের দ্বীনী এবং রূহানী কেন্দ্র মনে করতো।
অতঃপর মুসলিম নেতৃবৃন্দ ভারতের বড়লাটের সাথে দেখা করে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। তাদের সাক্ষাৎ সন্তোষজনক হয়নি। অতঃপর মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহর, মাওলানা সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল লন্ডনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের বক্তব্য পেশ করেন। প্রত্যুত্তরে তাদেরকে বলা হয় যে, মূল তুরস্কের ভূখণ্ড ব্যতীত অন্যান্য এলাকাসমূহ তাদেরকে দেয়া যাবে না।
ব্রিটিশ সরকারের এ ধরনের মুসলিম-বিদ্বেষী আচরণে উপমহাদেশের মুসলমানগণ অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং খিলাফতের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যে ভারতে প্রচণ্ড খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়। এ বছরের (১৯১৯) ১০ আগস্ট সমগ্র উপমহাদেশে খিলাফত দিবস পালন করা হয়। এবং এ সময় থেকে বিভিন্ন স্থানে হরতাল পালিত হতে থাকে। মোটকথা, উপমহাদেশে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ শুরু হয়। এক মাসের মধ্যে প্রায় বিশ হাজার মুসলমান স্বেচ্ছায় কারাবরণের জন্যে নিজেদেরকে পেশ করেন। এ আন্দোলন ১৯২২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয়, এতো বড়ো আন্দোলন ও ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ বিস্ফোরণ সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
তার কারণ এই যে, কামাল পাশা তুরস্কের মুসলমানদের জিহাদী প্রেরণার সুযোগ গ্রহণ করে অসাধারণ বীরত্ব ও বিচক্ষণতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বহু এলাকা ইংরেজদের নিকট থেকে পুনরুদ্ধার করেন। তুরস্কবাসীদের একতাবদ্ধ করেন এবং তাদের হৃত মর্যাদা ও গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এভাবে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পর কামাল পাশা ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে ওসমানীয়া খিলাফতের সুলতান মুহাম্মাদ হাশিমকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কাষ্ঠপুত্তলিসম সর্বশেষ সুলতান আব্দুল মজিদকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে খিলাফতের উচ্ছেদ সাধন করেন।
ক্ষমতাগ্রহণের পর পরই কামাল পাশা ঘোষণা করেন যে, তিনি তুর্কী জাতির জীবন থেকে ইসলামের সকল চিহ্ন মুছে ফেলবেন। শুধুমাত্র ইসলামের কর্তৃত্ব নির্মূল করার পরই তুর্কীরা অগ্রগতি লাভ করতে পারে এবং সম্মানিত আধুনিক জাতিতে পরিণত হতে পারে। তিনি এভাবে ইসলাম ও ইসলামের সকল দিকের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে একের পর এক ভাষণ দিতে থাকেন।
তিনি ১৯২৪ সালের তেসরা মার্চ সম্পূর্ণ ‘সেকিউলার’ তুর্কীজাতি প্রতিষ্ঠার জন্য পরিষদে বিল উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করতে হবে। তুর্কী প্রজাতন্ত্রকে সত্যিকার অর্থে সেকিউলার রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে।
বিলের বিরোধিতাকে তিনি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তার ভয়াবহ পরিণতির জন্য সকলকে সাবধান করে দেন। পরবর্তী পর্যায়ে কোন বিতর্ক ছাড়াই বিলটি গৃহীত হয়।
এখানে সেকিউলার শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ যে ধর্মহীনতা বা খোদাদ্রোহীতা তা রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে প্রমাণিত। খোদাহীন জড়বাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে পানাহার, পোশাক পরিচ্ছদ, চালচলন, অশ্লীল নাচগান, মদ্যপান ও অন্যান্য ইসলাম-বিরোধী সংস্কৃতি তুরস্কের জাতীয় প্রতীক বলে ঘোষণা করা হয়। ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ইসলামী শিক্ষা উচ্ছেদ করা হয়। ফলে বহু মাদ্রাসা-মক্তব ধ্বংস হয়ে যায়। তুরস্কের নিজস্ব ভাষার প্রাচীন বর্ণমালা পরিবর্তন করে রোমান বর্ণমালা প্রবর্তন করা হয়। আরবিতে আজান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আকস্মিকভাবে শুধু ক্ষমতার দাপটে একটি মুসলিম জাতিকে ইসলামবিমুখ জাতিতে পরিণত করা হয়।
কিছুকাল পর তুরস্কের একটি প্রতিনিধিদল দিল্লী আগমন করেন। তারা নিজেদেরকে বার বার ইউরোপীয় জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। দিল্লীর মুসলমানগণ তাদেরকে দিল্লী জামে মসজিদে জুমার নামায আদায়ের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু সে আমন্ত্রণ তারা প্রত্যাখ্যান করেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণও তারা প্রত্যাখ্যান করেন। অথচ পূর্ব থেকে কোন কর্মসূচি না থাকলেও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় তারা আনন্দের সাথে পরিদর্শন করেন। অর্থাৎ মুসলমান বলে পরিচয় দিতে তারা রাজি ছিলেন না। এ হলো সেকিউলারিজমের বাস্তব পরিণাম ফল।
সেকিউলারিজমের পতাকাবাহীগণ বলেন, সেলিউলারিজম ধর্মবিরোধী নয়। তবে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক মনে করে। এ একটা মনভোলানো প্রতারণা মাত্র। তুরস্কের সেকিউলারিজমের স্থপতি ধর্মের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখতেন না এবং ইসলাম নির্মূল করাই তার বাসনা ছিল। তিনি বলতেন, ইসলাম একজন ধর্মতাত্ত্বিক নীতিহীন আরবের প্রচলিত একটি মৃত বস্তু। এখানে নবী মুহাম্মাদের (সা) প্রতিই তিনি ইংগিত করেছেন, তাতে সন্দেহ নেই।
তিনি আরও বলেন, সম্ভবতঃ এটি মরুর উপজাতিদের জন্যে উপযোগী ছিল। বর্তমান আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্যে এর তেমন মূল্য নেই। খোদার ওহী? কোন খোদাই তো নেই! এগুলো হচ্ছে শৃঙ্খল, যার দ্বারা মোল্লা এবং অসৎ শাসকগণ জনগণকে নতশির হয়ে থাকতে বাধ্য করে।
খোদা ও ধর্মের প্রতি যার অবিশ্বাস, তার চরিত্রও সে ধরনের হয়ে থাকে। সে হয় চরম স্বেচ্ছাচারী, নিষ্ঠুর চরিত্রহীন ও আত্মগর্বিত। কামাল পাশাও ছিলেন সেই চরিত্রের। তিনি লতিফা নাম্নী একজন শিক্ষিতা সুন্দরী মহিলাকে বিয়ে করেন। তিনি এ মহিলাকে পুরুষের পোশাক পরিধান এবং মহিলাদের নিরংকুশ সাম্যের দাবি করতে উৎসাহিত করেন। কিন্তু আত্মসম্মানবোধসম্পন্না হয়ে যখন তিনি সম্মানিত স্ত্রীর মতো আচরণ দাবি করেন, তখন রাগান্বিত হয়ে কামাল তাকে তালাক দেন। তালাক দেওয়ার পর তার লজ্জাহীনতা সীমালঙ্ঘন করে। তিনি এতো বেশি মদ্যপান শুরু করেন যে, একেবারে দুর্দান্ত মদখোর বনে যান এবং প্রায় মদালস হয়ে পড়তেন। সুন্দর যুবক ছেলেরাই তার কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থের লক্ষ্য হয়ে পড়ে। তার রাজনৈতিক সমর্থকদের স্ত্রী-কন্যাদের প্রতি তার আচরণ এতোই অশালীন হয়ে পড়ে যে, তারা তাদের মহিলাদেরকে তার কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করতেন। যৌনব্যাধিতে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে।
তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না। তার নিজের মতের কোন বিরোধী মতের প্রতি তিনি কর্ণপাত করতেন না। তিনি সব কাজ আত্মস্বার্থের মাপকাঠিতে বিবেচনা করতেন।
কোন স্বৈরাচারী শাসক তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে কিছুতেই বরদাশত করতে পারে না। কামাল পাশাও তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করার কোন সুযোগই হাতছাড়া করেননি। তাদের বিচারের জন্যে একটি স্বৈরাচারী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। কোন বিচার-পদ্ধতি বা সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
কামালের ইসলাম বিরোধী সংস্কার অভিযান তুর্কী জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তাদের বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। ১৯২৬ সালে পার্বত্য অঞ্চলের কুর্দী উপজাতিরা কামাল প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কামাল পাশা তুর্কী কুর্দিস্থানে বর্বর অত্যাচার শুরু করেন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেন। গৃহপালিত পশু ও শস্যক্ষেত ধ্বংস করেন। মহিলা ও শিশুদের পাইকারীভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। বহু কুর্দী নেতাকে জনসমক্ষে ফাঁসি দেয়া হয়। আর্তনাদ, হাহাকার ও মার্সিয়া মাতমের ভেতর দিয়ে কামাল তার স্বৈরাচারী ও ইসলাম-বিরোধী সেকিউলার শাসন পাকাপোক্ত করেন।
কিন্তু তুরস্ক থেকে ইসলাম নির্মূল করা যায়নি। কামালবাদের পতন শুরু হয়েছে এবং শুরু হয়েছে ইসলামের নবজাগরণ। যুব সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সেনাছাউনিতে। জাহেলিয়াতের অস্ত্র কামালবাদ এখন ক্ষয়িষ্ণু। ইসলামের নবজাগরণকে ঠেকাবার শক্তি তার আর নেই।
‘সেকিউলারিজম’-এর ভিত্তিতে যে জীবনদর্শন রচিত হয়েছিল, ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ, লাভ-লোকসান, জয়-পরাজয় ও পাপপুণ্যের যে মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছিল এবং যে সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল, তার প্রভাব প্রতিপত্তি ক্রমশঃ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি অগ্রগতির মাধ্যমে এ নতুন সভ্যতা মানুষের মনে এক চমক ও আকর্ষণ সৃষ্টি করে। ফ্রান্সিস বেকন, ভলটেয়ার, ডারউইন, হেগেল, কার্ল মার্কস, ফ্রয়েড প্রমুখ চিন্তাশীল পণ্ডিতদের নতুন নতুন চিন্তাধারা এ সভ্যতা-সংস্কৃতিকে নাস্তিক্য ও জড়বাদিতার পাতাকাবাহী বানিয়ে দেয়। মুসলিম দেশগুলো এক একটি করে এ সভ্যতা-সংস্কৃতি ও তার রাজনৈতিক আধিপত্যের কাছে মাথা নত করে। গোলামির জীবন যাপন তাদের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন এনে দেয়। ইসলামী আকীদাহ-বিশ্বাস, চারিত্রিক মান এবং তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসজনিত অদম্য সাহস, বিরাট মনোবল ও শৌর্যবীর্য তারা হারিয়ে ফেলে। বিজয়ী সভ্যতার অধীন সেকিউলার তথা খোদাহীন শিক্ষাব্যবস্থা তাদেরকে একেবারে খোদাবিমুখ বানিয়ে দেয়। নামে তারা মুসলমান রইলো বটে, কিন্তু আখিরাতে খোদার কাছে জবাবদিহির কোন অনুভূতিই তাদের মনের মধ্যে বিদ্যমান রইলো না।
কিন্তু গোটা মুসলিম সমাজের অবস্থা একই রকম ছিল না। জনসাধারণের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক এমন ছিল যাদের কিছুটা বিকৃতি ঘটে থাকলেও তাদের মধ্যে ইসলামী চেতনা ও প্রাণশক্তি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল না এবং সঠিক পথে নের্তৃত্ব দেয়ার লোকেরও বড়ো অভাব ছিল। আলেম সমাজ ইসলামকে জিইয়ে রাখার জন্যে এতোটুকু করেছেন যে, ইসলামী শিক্ষার জন্যে নিজেদের উদ্যোগে মাদ্রাসা-মক্তব, দারুল উলুম কায়েম রেখেছেন, কুরআন-হাদীসের ইলম চর্চা বজায় রেখেছেন। বিভিন্ন স্থানে ইলমে তাসাউফ শিক্ষা দানের খানকাও গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসবের দ্বারা তারা জাহেলিয়াতের অগ্রগতিকে রুখতে পারেননি। জাহেলিয়াত মানবজীবনের সর্বত্র- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি প্রশাসন ও বিচারালয় পর্যন্ত; বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক-সম্বন্ধ পর্যন্ত, আহার-বিহার, খেলাধুলা, আমোদ-প্রমোদ ও আপ্যায়নে, বিয়ে-শাদী, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পর্বাদিতে- তার সর্বময় কর্তৃত্ব-প্রভুত্ব কায়েম করেছে। তাগুতী সরকারগুলো তাদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন কিছু লোক তৈরি করতে থাকে যারা প্রশাসনকার্যে তাদের সাহায্য করবে এবং সময় এলে তাদের ওপরই দেশের শাসনভার অর্পিত হবে। ইসলামী জ্ঞান ও চরিত্র বিবর্জিত এসব লোক তাদের পশ্চিমী প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্যে তাদের অন্ধ অনুকরণ করতে থাকে। তারা মন থেকেই ইসলামকে বিদায় দিয়েছিল। কারণ তাদের বিশ্বাস, মুসলমান জাতির উন্নতি-অগ্রগতির পথে ইসলাম বিরাট প্রতিবন্ধক।
পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতির মানসপুত্র এসব বিকৃত ও বিপথগামীদের ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এক সময়ে সুসংবাদ শোনানো হল। লর্ড ক্রোমার তার রচিত ‘হিস্ট্রী অব মডার্ন ইজিপ্ট’ গ্রন্থে ব্রিটিশ সরকারের মুখপাত্র হিসেবে বলেন-
England is prepared to grant eventual political freedom to all of her colonial possessions as soon as a generation of intellectuals and politicians imbued through English education with our ideals & culture, is ready to take over. But we shall not tolerate for a single moment the establishment of an independent Islamic state anywhere in the world.
অর্থাৎ ইংল্যান্ড তার ঔপনিবেশিক শাসনাধীন দেশগুলোকে চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দানে প্রস্তুত যখনই রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রজন্ম ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের আদর্শ ও সংস্কৃতির প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের জন্যে তৈরি হবে। কিন্তু দুনিয়ার কোথাও কোন স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র আমরা এক মুহূর্তের জন্যেও বরদাশত করব না।
লর্ড ক্রোমার শুধু ব্রিটিশ শাসকদের মনের কথাই বলেননি, ইউরোপের সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মনের কথা ছিল তাই। আমরা দেখতে পাই যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মুসলমান দেশগুলোতে যখন স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়, তখন মুসলমান জনসাধারণ ইসলামী জিহাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু সর্বত্র একই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। স্বাধীনতা লাভের পর একটি বিশেষ চক্র (পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুসারী) ক্ষমতা হস্তগত করে এবং মুসলমানদের আশা-আকাংক্ষা নির্মূল করে ইসলামী শাসনের পরিবর্তে তাগুতী শাসনই কায়েম করে। এভাবে জাহেলিয়াত বিজয় লাভ করে। নতুন স্বাধীনতা লাভকারী প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে একই অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়।
প্রথম মহাযুদ্ধের পরই এ উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। তিরিশের দশকে এ আন্দোলন জোরদার হয়। হিন্দু ও মুসলমান পৃথক দু’টি জাতি এ উপমহাদেশে কয়েক শতাব্দী যাবত পাশাপাশি বসবাস করে আসলেও তাদের নিজ নিজ জাতীয় স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা তারা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। হিন্দু এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। তারা ভৌগোলিক জাতীয়তার দাবি উত্থাপন করে বলে- এ দেশে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে মিলে এক জাতি, ‘মুসলমান’ বলে পৃথক কোন জাতির অস্তিত্ব এখানে নেই। এ দাবি ছিল হাস্যকর, অবাস্তব ও সত্যের পরিপন্থী।
উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমানের পক্ষ থেকে হিন্দুদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানানো হলো- মুসলমানগণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতি। মুসলমান এবং অমুসলমান মিলে কোন একদিন এক জাতি ছিলও না এবং তা হতেও পারে না।
হিন্দুদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দাবি ছিল এক জাতীয়তার ভিত্তিতে এখানে একটি সেকিউলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
মুসলমানদের দাবি ছিল- যেহেতু মুসলমান একটি আলাদা জাতি এবং তাদের ঈমান-আকীদার দাবি অনুযায়ী ইসলামের তথা কুরআনেরই পূর্ণাংগ শাসন কায়েম করতে হবে, অতএব এ ইসলামী শাসনের জন্যে মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি অবশ্যই দরকার। উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে মুসলমানদের একটি পৃথক রাষ্ট্র হবে- যার নাম হবে পাকিস্তান।
প্রায় আট বছর প্রচণ্ড আন্দোলন ও সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামে মুসলমানদের জন্যে একটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ পাকিস্তান ও তথায় ইসলামী শাসনের দাবিতে অকাতরে জীবন দিল। লক্ষ লক্ষ নারী-শিশুর তাজা খুনে ধরণী রঞ্জিত হলো- ১৪ আগস্টের পর লক্ষ লক্ষ মানুষ খুনের দরিয়া সাঁতরিয়ে নবজাত পাকিস্তানের যমীনে পা দিল।
সকলের বুকভরা আশা- বহুকালের ইপ্সিত ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হতে যাচ্ছে। সকল অনাচার-অত্যাচার, আর্তনাদ, হাহাকার শোধ হয়ে যাবে। এক পরিপূর্ণ সত্য ও সুবিচারের সমাজ কায়েম হবে। মানুষে মানুষে বৈষম্য ও বিভেদের প্রাচীর ভেঙ্গে চুরমার হবে- লুটতরাজ, শোষণ-বঞ্চনা বন্ধ হয়ে যাবে। কুরআন ও সুন্নাহর আইনের অধীনে দুনিয়াতে নতুন করে এক স্বর্গীয় সমাজ গড়ে উঠবে।
কিন্তু হলো বিপরীত। লর্ড ক্রোমারদের কথাই অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হলো। একে তো ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে কোন লোক তৈরি করা হয়নি এবং তার কোন পরিকল্পনাও ছিল না। অনেকে এ মারাত্মক ভুল ধারণা পোষণ করেছিলেন যে, ইসলামী রাষ্ট্র চালনার জন্যে তো শুধুমাত্র মুসলমান হওয়াই যথেষ্ট। আর কোন বৈশিষ্ট্যের কোন প্রয়োজন নেই। এই চিন্তা-ধারণা একেবারে ভুলই প্রমাণিত হয়েছে।
তার কারণ উপমহাদেশে ব্রিটিশ কর্তৃক প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি মুসলমানদেরকে ইসলামের শাশ্বত বিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত মুখে ঠেলে দিয়েছে। গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়াই যে জাতির শিক্ষানীতি, তাদের নৈতিক মেরুদণ্ড কখনো মজবুত হতে পারে না। ইসলাম আমাদেরকে এ কথাই শিক্ষা দেয় যে, স্রোতের গতি যেদিকে এবং যে মুখেই হোক না কেন, সর্বাবস্থায় খুব দৃঢ়তার সাথে আমাদেরকে শুধু আল্লাহ নির্ধারিত পথেই চলতে হবে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব লাভ করেও তাকে ইসলামের আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত করা সেকিউলার বা ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে তৈরি নেতৃবৃন্দের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রে পুলিশ, আদালত, সেনাবাহিনী, প্রশাসনিক ও শিক্ষা বিভাগ, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার জন্যে যে ধরনের মন-মানসিকতা এবং চারিত্রিক শক্তিসম্পন্ন লোকের দরকার তা তৈরি করার কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে যে ধরনের শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তা একটা অনৈসলামী বা তাগুতী রাষ্ট্রের জন্যে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সর্বস্তরের দায়িত্বশীল সংগ্রহ করে দিতে পারতো একথা ঠিক। কিন্তু তা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে একজন চাপরাশি বা ইসলামী পুলিশ বিভাগের একজন সাধারণ সিপাই তৈরি করে দিতে পারে না।
দুঃখের বিষয় উপমহাদেশে অসংখ্য মাদ্রাসা, দারুল উলুম প্রভৃতি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে যে ধরনের বিচারপতি, বিভিন্ন বিভাগের সেক্রেটারি এবং রাষ্ট্রদূতের আবশ্যক, আমাদের প্রাচীন মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি সে ধরনের একজন লোকও তৈরি করতে পারেনি। এমন অবস্থায় যারা মনে করতো যে, ‘মুসলমান’ নামক লোকদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এলেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, তাদের চিন্তা-ধারণা যে কত ভ্রান্ত ছিল তা প্রমাণিত হলো।
উপমহাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী শাসন পরিচালনার লক্ষ্যে কোন লোক তৈরি করা হয়নি এবং মাদ্রাসা দারুল উলুমগুলোও এ কাজ করেনি। তার ফলে ক্রোমার সাহেবদের তৈরি লোকদের হাতেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব এলো। তারা সর্বশক্তি দিয়ে ইসলামের নামে তৈরি পাকিস্তানে ইসলাম আগমনের সকল পথ রুদ্ধ করে রাখলো।
পাকিস্তান হওয়ার পর কিভাবে তার শাসনভার ইংরেজদের তৈরি এ দেশীয় মুসলমান নামধারী লোকদের হাতে এলো তার সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন- জনাব আলতাফ গওহর। তিনি ব্রিটিশ আমলেই চাকুরিতে যোগদান করেন এবং পরবর্তীকালে ষাটের দশক পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি বলেন-
ব্রিটিশ আমাদের শাসক মহলকে ঔপনিবেশিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠান চালাবার দক্ষতা শিক্ষা দিয়েছিল। দেশীয় শাসকরা (Bureaucrats) মনে করে নিয়েছিলেন যে, পূর্ববর্তী শাসকদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বের সাথেই তাদের নিজেদের অস্তিত্ব জড়িত। স্বাধীনতা তাদেরকে পরোক্ষ প্রাধান্যের মর্যাদা থেকে সরাসরি শাসকের পদে অধিষ্ঠিত করে দিয়েছে। তাদের মতে পূর্বতন প্রতিষ্ঠানসমূহ ও সিস্টেম (ব্রিটিশ শাসন পদ্ধতি) অপেক্ষা আর কোন উত্তম ব্যবস্থা দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্যে হতে পারে না।
আলতাফ গওহর আরও বলেন, তখন খাস ইংরেজরা ছিলেন আমাদের আদালতের জজ-ম্যাজিস্ট্রেট। আমাদের নতুন শাসকদের অন্ধ অনুকরণপ্রীতি দেখুন যে, ঐসব জজদের পরিবারে এদের বিয়ে-শাদী ও দাফন-কাফনের সুযোগ না থাকলেও তাদের এবং অ্যাংলো স্যাক্সনদের (Anglo-saxsons) রীতি-পদ্ধতি এরা অন্ধভাবে মেনে চলতেন। ঠিক তেমনি ব্রিটিশদের প্রচলিত শাসনপদ্ধতি ও অর্থব্যবস্থা থেকেও এক ইঞ্চি সরে যেতে এরা প্রস্তুত ছিলেন না।
পাকিস্তান হাসিলের জন্যে জনগণ সন্তুষ্টচিত্তে যথাসর্বস্ব কুরবানী করেছে এ জন্যে যে, তারা তাদের নিজস্ব আবাসভূমিতে আপন আকীদা-বিশ্বাস ও জীবনপদ্ধতি বাস্তবায়িত করবে। কিন্তু তারা বিক্ষুব্ধ, মর্মাহত ও নিরাশ হয়ে পড়লো। তাদের মনোবল একেবারে ভেঙ্গে গেল যখন তারা দেখলো যে, পাকিস্তান ইংরেজ শাসনের ধারাবাহিকতারই নামান্তর হয়ে পড়েছে।
দুনিয়ার কোথাও একমুহূর্তের জন্যে কোন স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র ব্রিটিশ তথা জাহেলিয়াত বরদাশত করবে না তা আমরা লর্ড ক্রোমারের মুখে শুনলাম। দুনিয়ার সকল ইসলামবিরোধী শক্তি ইসলামী শাসনের বিরোধী, নতুন পাকিস্তানে যারা ক্ষমতায় এলো তারাও ইসলামী শাসনের বিরোধী। কিন্তু দেশের জনসাধারণ ও আলেম সমাজ ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও ইসলামী শাসনের আন্দোলন করতে থাকে। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করে মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। এ জামায়াতটি গঠিত হয় ১৯৪১ সালে। এ সময়ে সমগ্র এশিয়া-ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রলয় নাচন চলছিল। উপমহাদেশে একদিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস একজাতীয়তার ভিত্তিতে একটি সেকিউলার রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ব্রিটিশের নিকট থেকে ক্ষমতা দখলের আন্দোলন করছিল এবং অপরদিকে মুসলমানগণ আন্দোলন করছিলেন তাদের জন্যে একটি পৃথক আবাসভূমি চিহ্নিত করে তথায় হুকুমতে ইলাহীয়া বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে; এমন সময়ে জামায়াতে ইসলামী নামে একটি দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা কি- এ প্রশ্ন ছিল অনেকের মনে। এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পেতে হলে যে হুকুমতে ইলাহীয়া বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে পাকিস্তান আন্দোলন চলছিল সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে হবে।
হুকুমতে ইলাহীয়া তথা ইসলামী রাষ্ট্রের গোটা কাঠামো আল্লাহতায়ালার প্রভুত্ব কর্তৃত্বের বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বজগতের স্রষ্টা, প্রভু ও বাদশাহ-আইনদাতা একমাত্র আল্লাহতায়ালা। এ হলো ইসলামী রাজনীতির মৌলিক ধারণা। কোন ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী বা জাতির মানুষের উপর প্রভুত্ব বা শাসন করার কোন অধিকার নেই। সমগ্র সৃষ্টি যেহেতু আল্লাহতায়ালার সে জন্যে তার উপর হুকুম-শাসনের অধিকার একমাত্র তাঁরই। আর মানুষ তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে। একথা মানুষের সর্বদা স্মরণ রাখা দরকার যে, তার উপর যে আল্লাহর খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা এজন্য নয় যে, সে অন্যান্য মানুষের প্রভু হয়ে বসবে- তাদেরকে তার দাসানুদাস বানিয়ে রাখবে, তাদের প্রভু সেজে নিজের লালসা ও পাশবিক বৃত্তি চরিতার্থ করবে। বরঞ্চ প্রকৃতপক্ষে খিলাফতের দায়িত্ব তার উপর এ জন্যে অর্পিত হয়েছে যে, সকলে মিলে আল্লাহর বান্দাদের উপর আল্লাহরই আইন জারি করবে। নিজেরাও পুরোপুরি সে আইন মেনে চলবে। তাদের মধ্যে এ বিশ্বাসও সর্বদা জাগ্রত থাকবে যে, আল্লাহর আইন অন্যের উপর জারি করতে কোন প্রকার অবহেলা বা ত্রুটি করলে, অথবা সামান্য স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা, হিংসা-বিদ্বেষ, পক্ষপাতিত্ব বা বিশ্বাসঘাতকতা করলে এ দুনিয়ার জীবনে তার কোন বিচার না হলেও পরকালে আল্লাহর আদালতে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।
উপরের আদর্শ, বিশ্বাস ও ভাবধারা-ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয় তাকেই বলে ইসলামী রাষ্ট্র এবং তা মূল থেকে শুরু করে শাখা-প্রশাখা পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিভাগই ধর্মহীন রাষ্ট্র (Secular State) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হয়ে থাকে। অন্য কোন রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে তার কোন তুলনাই হতে পারে না। তার সেনাবাহিনী, পুলিশ, আদালত, রাজনীতি, অর্থনীতি, যুদ্ধ ও সন্ধি তৎসংক্রান্ত নীতি ও কার্যকলাপ প্রভৃতি ধর্মহীন রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সেকিউলার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্রের কোন সামান্য পদ লাভের যোগ্যও হতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রের একটি বিভাগ ও পদের জন্যে এমন সব নিঃস্বার্থ লোকের প্রয়োজন যাদের ধনদৌলতের লালসা ও ভোগ-বিলাসের কোন লিপ্সা থাকবে না। তারা হবে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও আমানতদার। প্রতিটি কাজ সম্পাদন করবে পূর্ণ দায়িত্বানুভূতির সাথে। বিপুল ধনভাণ্ডার হস্তগত হলেও একটি কপর্দকও আত্মসাৎ করবে না। তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে ও সততার সাথে পালন করছে কিনা তার জন্যে আখিরাতে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে- এ অনুভূতি তাদের মনে সর্বদাই জাগ্রত থাকে। জাহেলিয়াতের কোন চিন্তা-ধারণা তাদের মন-মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করতে পারে না।
কিন্তু প্রস্তাবিত বা ইপ্সিত ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে এ ধরনের কোন কর্মীবাহিনী তৈরি করা হয়েছে কি, অথবা তৈরি করার কোন পরিকল্পনা আছে কি?
জামায়াতে ইসলামী গঠনের পূর্বে এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী মুসলিম সমাজের মর্মান্তিক নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার চিত্র তুলে ধরে বলেন-
“ভালোমন্দ সকল প্রকার লোকই এ সমাজে বর্তমান। চরিত্রের দিক দিয়ে যত প্রকারের মানুষ দুনিয়ায় অমুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়, ঠিক তত প্রকারের মানুষ এ মুসলিম নামধারী জাতির মধ্যে বিদ্যমান। আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে একজন অমুসলিম যতোখানি সক্ষম, একজন মুসলমানও তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সুদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতি, ব্যভিচার, মিথ্যাবাদিতা, ধোঁকা-প্রতারণা এবং অন্যান্য সকল প্রকার অপরাধ অমুসলিমগণ যে হারে করে, মুসলমানগণ তাদের চেয়ে কিছুমাত্র কম করে না। বিশেষ স্বার্থলাভ এবং অর্থ উপার্জনের জন্যে কাফিরগণ যেসব কৌশল অবলম্বন করে, মুসলমানগণও সে সব করতে কুণ্ঠিত হয় না। মুসলিম আইন ব্যবসায়ী জেনে বুঝে প্রকৃত সত্যের বিরুদ্ধে ওকালতি করে। সে মুহূর্তে একজন অমুসলিম আল্লাহকে যতোখানি ভুলে যান, একজন মুসলিম আইন ব্যবসায়ীও ততোখানি ভুলে যান। ….যে জাতির নৈতিক অবস্থা এতো হীন ও অধঃপতিত, তার সে নানা মতের ও নানা প্রকৃতির বিরাট ভিড় জমিয়ে একটি বাহিনী গঠন করে দিলে অথবা রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে তাদেরকে শৃগালের চেয়ে চতুর করে তুলতে পারলে অথবা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তাদের মধ্যে ব্যাঘ্রের হিংস্রতা সৃষ্টি করে দিলে অরণ্যজগতের হয়তো প্রভুত্ব করা সহজ হতে পারে। কিন্তু তার সাহায্যে ইসলামী শাসন কায়েম হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ এমতাবস্থায় কেউই তাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করবে না, কারো দৃষ্টি তাদের সামনে শ্রদ্ধায় অবনমিত হবে না। তাদের দেখে কারো মনে ইসলামের আবেগময়ী ভাবধারা ও অনুপ্রেরণা জাগ্রত হবে না এবং এসব কারণেই ইসলামের সীমার মধ্যে দুনিয়ার মানুষের দলে দলে প্রবেশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার ভাগ্য কখনোই হবে না।”
মাওলানা আরও বলেন, “এ ধরনের লোকদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ার ফলে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করার পরও আমরা ঠিক সে অবস্থায়ই জীবন যাপন করতে বাধ্য হবো, যে অবস্থায় ছিলাম স্বাধীনতা লাভের পূর্বে একটি অমুসলিম রাষ্ট্রের অধীনে। বরঞ্চ তার চেয়েও নিকৃষ্ট ও মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। কারণ যে ধরনের রাষ্ট্রের উপর ‘ইসলামী রাষ্ট্র’-এর লেবেল লাগানো থাকবে তা ইসলামী বিপ্লবের পথ রোধ করার ব্যাপারে অমুসলিম রাষ্ট্র অপেক্ষাও অধিকতর সাহসী ও নির্ভীক হবে। এমনকি একটি অমুসলিম রাষ্ট্র যেসব অপরাধের দরুন কারাদণ্ড দেবে, এ ‘মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্র’ সেসব ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ড অথবা নির্বাসন দণ্ড দেবে।”
সূক্ষ্মদর্শী ও দূরদর্শী মাওলানার এসব ভবিষ্যদ্বাণী পাকিস্তানে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। ১৯৪৭-এর পর থেকে এ যাবত পর্যন্ত সেখানে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলতেই আছে। ইসলাম এখনও বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
এখন জামায়াতে ইসলামী কেন গঠন করা হয়েছিল- এ প্রশ্নের জবাব অতি সহজেই পাওয়া যাবে। আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান নামে একটি দেশ হয়তো লাভ করা যাবে। সে দেশকে দ্বিতীয় তুরস্ক হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্যে এবং দেশ বিভক্তির পর অনিবার্যরূপে ভারতে রয়ে যাওয়া চার-পাঁচ কোটি মুসলমানকে রক্ষা করার জন্যে একটি মজবুত আদর্শবাদী ইসলামী জামায়াত গঠন অপরিহার্য। এ উদ্দেশ্যে দলটি গঠিত হয় এবং ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অন্য সকল প্রকার কর্মতৎপরতা থেকে মুখ ফিরিয়ে দলটি তার কর্মী বাহিনীকে নিরিবিলি প্রশিক্ষণ দিতে থাকে যেন সকল ইসলামবিরোধী তৎপরতার মুকাবিলা করতে পারে, এবং ইপ্সিত পাকিস্তানকে সত্যিকার অর্থে একটি ইসলামী রাষ্ট্র বানাবার প্রাণপণ সংগ্রাম করতে পারে।
পাকিস্তানের বিগত কয়েক যুগের ইতিহাস এ কথার সাক্ষ্য বহন করে যে, যে উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয়েছিল সে উদ্দেশ্যেই সে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে এ যাবত সংগ্রাম করে এসেছে এবং এখনও করছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মলাভের পর জাহেলিয়াত তার পরিপূর্ণ রূপ ও অবয়বসহ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। বিগত সাত বছর জামায়াত যে কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছিল কিন্তু যে কাজ তার করতে হয়নি, এখন সে কাজে সে আত্মনিয়োগ করলো। জাহেলিয়াত-সর্পের উত্তোলিত ফণা অবদমিত ও তার গতিরোধ করে সর্বশক্তি দিয়ে ইসলামী আন্দোলন শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। জাহেলিয়াতের পতাকাবাহীগণ যে পাকিস্তানকে তুরস্কের মতো একটি সেকিউলার বা ধর্মহীন রাষ্ট্র বানাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, ইসলামী আন্দোলনের প্রবল চাপে ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, ইসলামী শাসনের মূলনীতি হিসেবে ঐতিহাসিক আদর্শ প্রস্তাব গ্রহণ করতে তারা বাধ্য হন। এ তাদের করতে হয়েছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের চাপে। এ জন্যে শাসকগোষ্ঠীর সকল ক্রোধ-আক্রোশের শিকার হয়ে পড়েন ইসলামী আন্দোলনের নেতা মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে অমূলক অভিযোগ আরোপ করে সামরিক আদালতে বিচারের প্রহসন করা হয় এবং তাঁর প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়। জাহেলিয়াত মনে করেছিল ইসলামের মহান নেতাকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে অপসারিত করতে পারলে জাহেলিয়াতের পথ রোধ করার সাধ্য আর কারো হবে না। কিন্তু জাহেলিয়াতকে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। মাওলানার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়নি। বরঞ্চ তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুর বহু পূর্বে জাহেলিয়াতের পতাকাবাহীদেরকে অতীব লাঞ্ছনার মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব ও জয়-পরাজয় চলতেই থাকে এবং এখনও চলছে।
ইসলাম ও জাহেলিয়াতের এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে অন্য এক বেদনাদায়ক যে চিত্রটি ফুটে উঠে তা এই যে, কতিপয় বুযর্গানে দ্বীন বলে পরিচিত ও স্বীকৃত ব্যক্তি তাদের আচরণে ইসলামের পরিবর্তে জাহেলিয়াতের হাতকেই মজবুত করে দিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের নেতার বিরুদ্ধে নানান ধরনের অমূলক ও ভিত্তিহীন অভিযোগ রচনা করা হতে থাকে এবং ফতোয়াবাজির মেশিনগান থেকে ঘন ঘন ফতোয়ার গোলাবর্ষণ হতে থাকে। বহুবিধ অভিযোগের সাথে এ অভিযোগও করা হয় যে, ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও তাঁর দল ইলমে তাসাওউফে বিশ্বাসী নন। রূহানিয়াত বলে কোন জিনিসও তাদের মধ্যে নেই এবং সেই সাথে তাকওয়ার ভয়ানক অভাব। এমনকি আন্দোলনের নেতাকে পথভ্রষ্ট এবং ইহুদী-কাদিয়ানী থেকে নিকৃষ্ট বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে একটি শব্দও তাদের মুখ থেকে বেরোয়নি।
ইসলামপন্থী জনগণ এবং বিশেষ করে তাসাওউফপন্থী মুসলমানগণের অনেকেই উপরোক্ত প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানান আলাপ-আলোচনা এবং কল্পনা-জল্পনাও চলেছে। অনেকে অনুভব করছিলেন যে, বিষয়টির ইসলামসম্মত ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ফলে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে এবং সকল বিভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। এখন দেখা যাক এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতা কিছু আলোকপাত করেছেন কিনা।
তাযকিয়ায়ে নফস (তাসাওউফ) ও রূহানিয়াত
শতাব্দীর অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুজাহিদ সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে যে বিজ্ঞ অভিমত প্রকাশ করেন তা নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-
“কয়েক শতাব্দীর অধঃপতন ও বিকৃতির ফলে মুসলমানদের মধ্যে যেখানে বহুবিধ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, সেখানে তাযকিয়ায়ে নফস (আধ্যাত্মিক আত্মশুদ্ধি)-এর ব্যাপারেও তাদের ধারণা প্রকৃত ইসলামী ধারণা থেকে অনেকটা ভিন্নতর হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যও বদলে গেছে, দৃষ্টিকোণও সীমিত হয়েছে এবং ‘তাযকিয়ায়ে নফসে’র নিয়ম-পদ্ধতিও সেসব নিয়ম-পদ্ধতি থেকে ভিন্নতর হয়ে পড়েছে যা নবীযুগে অবলম্বন করা হয়েছিল। তার ফল এই হয়েছে যে, যেসব বিরাট বিরাট প্রতিষ্ঠান এবং বুযর্গানে দ্বীনের তা’লিম ও তরবিয়তের সিলসিলা যুগ যুগ ধরে কায়েম আছে তার বরকতে বিরাট বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষও তৈরি হয়েছেন। কিন্তু সে ধরনের গুণসম্পন্ন লোক এখনো তৈরি হতে পারেননি, যাঁরা জাহেলিয়াতের পথে জগত পরিচালনাকারী বিরাট শক্তির মুকাবিলায় দাঁড়াবেন এবং তার বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে ইসলামকে দুনিয়ায় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বশীল দ্বীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবেন। এ তো এক বিরাট কাজ। এখানে তো নিদেনপক্ষে এমন একজন লোকও তৈরি হলেন না যিনি অন্ততঃ এতোটুকু করতে পারতেন যে, ইসলামের প্রভাবাধীন পরিমণ্ডলে জাহেলিয়াতের অগ্রগতিকে বাধাদান করতেন। বিরাট বিরাট পূতঃচরিত্র মহান ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান ছিলেন এবং এখনো আছেন। তাঁরা তাঁদের ইলম ও আমল, দিয়ানতদারী, পরহেজগারী এবং নিজেদের নিষ্কলুষ জীবনের জন্যে অবশ্যই প্রশংসার পাত্র। কিন্তু এসব মহান ব্যক্তির উপস্থিতিতেই জাহেলিয়াত তার তলোয়ারের সাহায্যে, তার লেখনীর সাহায্যে, তার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার সাহায্যে এবং তার সভ্যতা-সংস্কৃতির সাহায্যে শুধু দুনিয়াকে নয়, বরঞ্চ মুসলমান দেশ ও জাতিকে পরাভূত করে চলেছিল এবং এখনো চলছে। এ দুর্বলতার কারণ তো অবশ্যই থাকার কথা। আর যে কোন কারণই থাক না কেন, কারো প্রতি অসঙ্গত ও অযৌক্তিক শ্রদ্ধাবোধ সে কারণ নির্ণয়ে প্রতিবন্ধক না হওয়াই উচিত।
আমাদের এখানে একটি মহলের নিকটে ‘তাযকিয়ায়ে নফসের’ উদ্দেশ্য ছিল এই যে, এ জীবনেই যেন সত্য পর্যবেক্ষণের নসীব হয়ে যায়। ঈমান বিল গায়েবের মকাম অতিক্রম করে যেন ঈমান বিশ-শাহাদাতের দৌলত হাসিল করা যায়। দৃশ্যতঃ এ একটি অতি মহান ও পবিত্রতম উদ্দেশ্য। কিন্তু কুরআন কোথাও আমাদেরকে এ শিক্ষা দেয়নি যে, আমরা তাকে উদ্দেশ্য বলে গণ্য করে এ পথে আমাদের চেষ্টা চরিত্র চালাতে থাকব। ঠিক এর বিপরীত, আমরা যদি তাকে আমাদের উদ্দেশ্য বলে গণ্য করিও, কুরআন আমাদেরকে এ নিশ্চয়তা দান করে যে, এ জীবনে নবী ব্যতীত এ সম্পদ আর কেউ লাভ করতে পারবে না।
কুরআনে বলে-
তিনি (আল্লাহ) গায়েবের জ্ঞান রাখেন। তাঁর গায়েব তিনি কারো কাছে প্রকাশ করেন না। (অবশ্যি) সেই রসূল ব্যতীত যাকে তিনি (গায়েবী কোন জ্ঞানদানের জন্যে) পছন্দ করে নিয়েছেন। তখন তার সম্মুখে ও পেছনে পাহারা দেয়ার জন্যে তিনি ফেরেশতা নিযুক্ত করেন- এটা জানার জন্যে যে, তারা তাদের খোদার পয়গামসমূহ পৌঁছিয়ে দিয়েছে- (সূরা জ্বিনঃ ২৬-২৮)।
এর থেকে জানা গেল যে, অদৃশ্য পর্দার মধ্যে লুক্কায়িত প্রকৃত তথ্যাবলী অন্য কথায় অতিপ্রাকৃতিক তথ্যাবলী পর্যবেক্ষণের চেষ্টা অনাবশ্যকও এবং ভুলও। এর সাফল্যের কোন সম্ভাবনা নেই। এসব তথ্যাবলীর যতটুকু এবং যত পরিমাণ জ্ঞান মানুষের প্রয়োজন ছিল, আল্লাহতায়ালা সে জ্ঞান তার রসূলগণের মাধ্যমে দান করেছেন। আর এ আল্লাহতায়ালার বিরাট ইহসান যে, এভাবে তিনি মানুষকে এসব অনুসন্ধানের কষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন। এখন মানুষের কাজ শুধু এই যে, সে রসূলগণের দেয়া জ্ঞানের ভিত্তিতে ঈমান বিল গায়েব পোষণ করবে এবং যে দায়িত্ব তার উপর আরোপিত তা সন্তুষ্টচিত্তে আঞ্জাম দেয়ার কাজে লেগে যাবে।
এর চেয়ে নিম্নতর স্তরের ‘তাযকিয়ায়ে নফসের’ যে উদ্দেশ্য বলা হয়, তা হলো ‘রূহানী’ উন্নতি। কিন্তু এ ‘রূহানী উন্নতি’ এমন দ্ব্যর্থবোধক ও রহস্যপূর্ণ যে, সারাজীবন আলেয়ার আলোর পেছনে ছুটে বেড়ানোর পরও মানুষ কিছুই জানতে পারে না যে, সে কোন মকামে পৌঁছেছে। এর পরিভাষা, এর স্তরসমূহ এবং এর ফলাফল সবই রহস্যাবৃত যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে অবোধগম্য। আমরা যা কিছু দেখতে পাই তা হলো এই যে, এর পথে যেসব স্তর অতিক্রম করা হয় সেসবের মধ্যে সে স্তর কখনো আসে না যা বেলাল (রা), আম্মার (রা) এবং সুহাইব (রা) অতিক্রম করেছিলেন। আর না সে স্তর কখনো আসবে বলে আশা করা যায়, যা আবু বকর (রা) এবং ওমর (রা) অতিক্রম করেছিলেন।
যারা ‘তাযকিয়ায়ে নফস’ থেকে ‘তাকওয়া’ হাসিল করতে চান, ইসলামের উদ্দেশ্যের নিকটতম উদ্দেশ্য তাদের। কিন্তু এখানে বিপদ এই যে, তাকওয়া সম্পর্কে সাধারণতঃ মানুষের দৃষ্টিকোণ বড়ো সীমিত হয়ে রয়ে গেছে। অধিকাংশ বুযর্গানের কাছে তাকওয়া বলতে বুঝায় লেবাসপোশাক, তার বিশেষ ধরন, ওঠাবসা, পানাহার প্রভৃতি ব্যাপারে এমন প্রকাশ্য নকশায় জীবনকে ঢেলে সাজানো যার খুটিনাটি বিষয় হাদিসসমূহে বয়ান করা হয়েছে। উপরন্তু কিছু মাযহাবী ক্রিয়াকর্ম নিয়মিত পালন করে চললে এবং চিরাচরিত অভ্যাস থেকে বেশি বেশি ইবাদাত-বন্দেগী করলে তাকওয়ার পরিপূর্ণতা লাভ করা যায়। এর ফল এই যে, যারা তাকওয়ার এ প্রকাশ্য আকার-আকৃতি অবলম্বন করেছেন, তাদেরকে মুত্তাকী বলা হয় এবং মনে করা হয়। তারাও নিশ্চিন্ত হয়ে যান যে, তারা নিজেদের মধ্যে তাকওয়া পয়দা করে নিয়েছেন। বস্তুতঃ প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে তাকওয়ার বিরাট অভাব থাকে এবং অধিকাংশ সময়ে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন অগ্নিপরীক্ষায় এমন এমন তাকওয়াবিরোধী আচরণ তাদের দ্বারা হয়ে যায় যার কারণে তাকওয়ার সে প্রকাশ্য আকার-আকৃতির মর্যাদাও বিনষ্ট হয়। তাকওয়ার এ সাধারণ ধারণা থেকে উচ্চতর ও ব্যাপকতর যে ধারণা বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পাওয়া যায়, তাও এর চেয়ে বেশি নয় যে, ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ খোদাভীরু, ইবাদাতগুজার এবং যিকিরকারী ও শোকরকারী হবে। কাজ-কারবারে বিশ্বস্ততা, সততা এবং আল্লাহর সীমারেখা অবলম্বন করে চলবে। সেইসাথে সমাজে অন্যান্য লোকের সাথে সদাচার, সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব, সুবিচার এবং অধিকার পৌঁছিয়ে দেয়ায় পন্থা-পদ্ধতি মেনে চলবে। কিন্তু এ সীমিত ধারণায় ব্যাপকতর সামাজিক সামষ্টিক সমস্যাবলী উপলব্ধি করার কোন সুযোগ নেই। এজন্যে আমাদের অতি নেক লোকদের মধ্যেও যে ‘তাযকিয়ায়ে নফস’ করা হয়, তার সুফল এর চেয়ে বেশি কিছু হয় না যে, খোদাদ্রোহী সরকারগুলোর জন্যে খোদাভীরু প্রজা এবং ধর্মভীরু কর্মচারি সরবরাহ করা হয়। স্বয়ং এসব সরকারের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যেসব প্রজা ও কর্মচারি সরবরাহ করা হয় তাদের মধ্যে অন্যান্য যোগ্যতা তো থাকে, কিন্তু ঈমানদারি ও সততা থাকে না। সেজন্যে তারা সরকারের বড়ো ক্ষতিসাধনও করে। এ অভাব পূরণ করা হয় আমাদের ‘তাযকিয়ায়ে নফসের’ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। কুফরি শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করার এবং কুফরি শাসন চালাবার জন্যে এসব প্রতিষ্ঠান সত্যনিষ্ঠ লোক তৈরি করে এবং কুফরি শাসনের জন্যে এমন সব প্রজা তৈরি করে যারা তাদের জন্যে খুব কমই উদ্বেগের কারণ হয়। এমনকি আমাদের এখানে যদি কোন ব্যক্তি প্রকাশ্যে খোদাহীন ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে আত্মনিয়োগও করে তথাপি সে অবিকল মুত্তাকীই রয়ে যায়। তবে শর্ত এই যে, উপরে বর্ণিত তাকওয়ার খুটিনাটি বিষয়গুলো তার জীবনে যেন পাওয়া যায়। এ হচ্ছে অনিবার্য ফল সে সীমিত ধারণার যা তাকওয়া এবং তাযকিয়ায়ে নফস সম্পর্কে আমাদের ধর্মীয় মহলে আম-খাস নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে আছে”- (তরজুমানুল কুরআন, জুলাই-আগস্ট, ১৯৫৩)।
মানবজীবনের উপর সেকিউলারিজমের প্রভাব
‘সেকিউলারিজম’ দৃশ্যতঃ একটি সাদাসিধে ধারণা-মতবাদ হলেও তা এখন একটি সার্বিক জীবনদর্শনে পরিণত হয়েছে যা মানবজীবনের উপরে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে এবং গোটা জীবনকে এক নতুন ছাঁচে ঢেলে সাজায়। তার কিছু বুনিয়াদী প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আলোচনা করা যাক। ‘সেকিউলারিজম’ তথা ধর্মহীনতার প্রথম অনিবার্য কুফল হচ্ছে এই যে, এ মানুষকে লাগামহীন স্বাধীনতা দান করে এবং কোন ঊর্ধ্বতন শক্তির কাছে জবাবদিহির অনুভূতি বিলুপ্ত করে দেয়। এ দায়িত্বহীনতার মানসিকতা ব্যক্তি ও জাতির প্রতি সমভাবে প্রযোজ্য। কোন শক্তিধর ব্যক্তি অথবা জাতি যদি মানবসমাজে জুলুম ও অনাচার সৃষ্টি করে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, তাহলে কোন শক্তি তাদেরকে এর থেকে বিরত রাখতে পারে? কতিপয় ব্যক্তি ও জাতি ক্ষমতামদমত্ত হয়ে সাধারণতঃ দুর্বল মানুষ ও জাতির রক্তে হাত রঞ্জিত করছে। কারণ এ ধারণা তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল যে, এর জন্যে তাদেরকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। সর্বশক্তিমান খোদার অস্তিত্ব যদি মেনে নিতে হয়, যিনি প্রতিটি মানুষ বা জাতির কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেবেন এবং পুরস্কার বা শাস্তি দেবেন তাহলে ‘সেকিউলারিজম’ দর্শনের ভিত্তিই তো ধসে পড়ে। খোদা ও আখিরাত থেকে বেপরোয়া করাই তো ‘সেকিউলারিজম’-এর কাজ। অতএব এ দর্শনের মূলকথা হলো- (MIGHT IS RIGHT, SURVIVAL OF THE FITTEST) অর্থাৎ জোর যার মুল্লুক তার। জোর করে কোনকিছু হস্তগত করাই ন্যায়সঙ্গত। তার জন্যে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন অবান্তর। আর যে সবচেয়ে শক্তিশালী, সে-ই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে- তা অন্যায়ভাবেই হোক না কেন। আর দুর্বল যতোই ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত হোক, তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।
আধুনিক জগতে ‘সেকিউলারিজমের’ এ দর্শনই সর্বত্র কার্যকর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও তাহজিব-তামাদ্দুনের প্রভূত উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হওয়া সত্ত্বেও ধর্মবিবর্জিত মানুষ (SECULAR MAN) ক্ষমতালিপ্সু ও রক্তপিপাসু হয়ে পড়েছে- যার ফলে মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ-বিগ্রহের অনির্বাণ অনল শিখা প্রজ্জ্বলিত করে রাখা হয়েছে যার থেকে দুনিয়া এখনো অব্যাহতি লাভ করতে পারেনি। লীগ অব নেশনস এবং ইউএনও (জাতিসংঘ) উভয়েই যুদ্ধের উন্মাদনা বন্ধ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহ বিশেষ করে শক্তিশালী জাতিসমূহ দায়িত্বানুভূতি থেকে মুক্ত। কারণ কোন শক্তিমান সত্তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে- এ বিশ্বাসই তারা পোষণ করে না। এর ফলে দুনিয়ার বুক থেকে মজলুম মানুষ ও জাতির আর্তনাদ-হাহাকার কোনদিন বন্ধও হতে পারে না।
‘সেকিউলারিজমের’ দ্বিতীয় কুফল প্রবৃত্তির দাসত্ব। প্রবৃত্তির দাসত্ব বা প্রবৃত্তিপূজা চরিত্রহীনতারই বুনিয়াদ এবং সকল দুষ্কৃতির মূল কারণ। প্রবৃত্তির অতৃপ্ত লালসা-বাসনা মানুষকে কুপথে পরিচালিত করে- যদি এ পথে কোন প্রতিবন্ধক শক্তি না থাকে। তখন সমাজে নানান অশান্তি-অনাচার দানা বাধে।
প্রবৃত্তির এ অতৃপ্ত লালসা-বাসনা মানুষকে পশুত্বের নিম্ন পর্যায়ে ঠেলে দেয় এবং এ লালসা চরিতার্থ করতে গিয়ে ব্যক্তি ও জাতির রক্তে হাত রঞ্জিত করতে হয়, শিশু ও নারী-পুরুষের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস মথিত হয়। প্রবৃত্তির লালসা-বাসনা পূরণের পথে একমাত্র প্রতিবন্ধক শক্তি খোদার ভয় এবং আখিরাতে তার কাছে জবাবদিহির তীব্র অনুভূতি। এ খোদার ভয় ও জবাবদিহির অনুভূতি প্রতি মুহূর্তে অশরীরি এক পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মানুষকে দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখে। কিন্তু ‘সেকিউলারিজম’ যেহেতু সর্বত্র প্রতি মুহূর্তে খোদার ‘হাজির ও নাজির’ (সর্বদ্রষ্টা হিসেবে বিদ্যমান) থাকার, মানুষের গোপন ও প্রকাশ্য প্রতিটি কর্মেরও প্রত্যক্ষ জ্ঞান রাখার বিশ্বাস, তাঁর ভয় এবং তাঁর কাছে জবাবদিহির অনুভূতি মানুষের মন থেকে মুছে ফেলে দিয়েছে, সে জন্যে মানবসমাজ থেকে অনাচার-অবিচার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, হত্যা, লুটতরাজ প্রভৃতি পাপাচার দূর করার আর কোন উপায় নেই।
উল্লেখ্য যে, জীবনের সকল স্তর থেকে বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক স্তর থেকে সকল স্তর পর্যন্ত খোদা ও ধর্মকে বর্জন করে সেকিউলার শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করার ফলে যুবসমাজের মধ্যে অস্বাভাবিক অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে এবং এমন সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে যা স্মরণ করতে শরীর রোমাঞ্চিত হয়। মানবসমাজ আতংকগ্রস্ত হয়। অতি অপরিমিত বয়সেই তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতী যৌন অপরাধ ও তজ্জনিত হত্যাকাণ্ড, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটতরাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। একই কারণে পরীক্ষায় নকল প্রবণতার ব্যাধি তাদের মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করছে। এ সবকিছুই সেকিউলারিজমের মারাত্মক কুফল।
সেকিউলারিজমের তৃতীয় কুফল স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদ। এ এক অনস্বীকার্য সত্য যে, মানুষের শ্রম সাধনা, চেষ্টা-চরিত্র ও জীবনের একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অবশ্যই থাকা উচিত। খোদা ও আখিরাতের প্রতি যারা বিশ্বাসী, তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি এবং সকল চেষ্টা-চরিত্রের লক্ষ্য আখিরাতের সাফল্য ও মুক্তি। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের সাফল্য- এ দু’টি বস্তুর উপর তাদের সকল দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। দুনিয়ার নগণ্য ও ক্ষণস্থায়ী স্বার্থের পরিবর্তে তারা আখিরাতের বিরাট ও চিরন্তন সাফল্যের প্রতিই অনুরক্ত হয়। তারা দুনিয়ার সাথে ততোটুকু সম্পর্ক রাখে যা আখিরাতের সাফল্যের উপযোগী হয়। দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধা ও স্বার্থ লাভের জন্যে সকল প্রকার দ্বন্দ্বসংগ্রাম থেকে তারা দূরে থাকে। তারা সত্যনিষ্ঠ, সুবিচার, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং এসবকেই গন্তব্যে পৌঁছার রাজপথ হিসেবে গ্রহণ করে।
ঠিক এর বিপরীত খোদা ও আখিরাতের প্রতি যাদের দৃঢ় প্রত্যয় নেই তাদের জীবনের সকল চেষ্টা-চরিত্রের লক্ষ্য হলো দুনিয়ার হীনস্বার্থ লাভ। ফলে পার্থিব স্বার্থ লাভের জন্যে সংঘাত-সংঘর্ষ ও যুদ্ধবিগ্রহ অনিবার্য হয়ে পড়ে। বর্তমান জগতে, যা প্রকৃতপক্ষে সেকিউলার জগত (SECULAR WORLD), মানুষে মানুষে, দেশে দেশে ও জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ-বিগ্রহের বহ্নি প্রজ্জ্বলিত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এ স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদ ছাড়া আর কিসের বহিপ্রকাশ? আজ সুযোগ-সুবিধা লাভেচ্ছু ও স্বার্থান্বেষী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্তহীন দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ মানবজাতিকে বার বার ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে ও দিচ্ছে। এ স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবীরা কারা? এরা ‘সেকিউলারিজমের’ই ধারক ও বাহক।
সুবিধাবাদ রাজনীতিকেও কলুষিত করছে এবং কোন কোন দেশে কল্যাণকর ও স্থিতিশীল কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে জাতীয় সম্পদকে লুটেরাদের কুক্ষিগত করার সুযোগ করে দিচ্ছে। আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বিনষ্ট করছে এবং দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল অর্থ ও পদমর্যাদার বিনিময়ে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের কেনাবেচার মাধ্যমে সুবিধাবাদকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে জাতির চারিত্রিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে চুরমার করছে। ব্যক্তিস্বার্থ ও সুবিধাবাদ ‘সেকিউলারিজমের’ দু’টি অতি আকর্ষণীয় বস্তু- উন্নত মানবীয় চরিত্র ব্যতীত যার থেকে দূরে থাকা বড়ো কঠিন। এ দু’টিকে ‘অচ্ছুৎ’ বলে পরিহার করা তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা ইসলামের শিক্ষার ভিত্তিতে নিজেদের জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা-সাধনা করে।
‘সেকিউলারিজমের’ চতুর্থ কুফল চরম নৈতিক অবক্ষয়। নৈতিক মূল্যবোধের ভিত মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে বিধায় তা জানা ও উপলব্ধি করা মোটেই কষ্টকর নয়। বরঞ্চ নৈতিক মূল্যবোধের বাস্তব অনুসরণ ও তার নির্দিষ্ট ছাঁচে জীবনকে ঢেলে সাজানো অবশ্যই কঠিন। এ মূল্যবোধ প্রতি পদে পদে কিছু বাধা-নিষেধ মানুষের কাছে দাবি করে। আর এ বাধা-নিষেধ অপেক্ষা কঠিন জিনিস মানুষের জন্যে আর কিছু নেই। এ মূল্যবোধের অনুসরণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে যখন মানুষের অতৃপ্ত লালসা-বাসনা ও প্রিয়বস্তুর সাথে তা সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। নৈতিক মূল্যবোধের দাবিই তো এই যে, প্রবৃত্তির ওসব লালসা-বাসনা, হীনস্বার্থ ও পার্থিব সুযোগ-সুবিধা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এজন্যে মানবজাতিকে নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করার জন্যে এতোটুকুই যথেষ্ট নয় যে, নৈতিক মূল্যবোধের কথা তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। বরঞ্চ সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন এমন এক শক্তিশালী প্রেরণাদায়ক কর্মপ্রক্রিয়ার যা নৈতিক বাধা-নিষেধ মেনে নেয়ার জন্যে মানুষের মনকে প্রস্তুত করতে পারে। সেকিউলারিজম এ প্রয়োজন পূরণ করেনি। বরঞ্চ সে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার দাবি হ্রাস করার পরিবর্তে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে মানুষকে তার দাস বানিয়ে দিয়েছে। সেকিউলারিজমের স্বাভাবিক ও অনিবার্য পরিণামস্বরূপ দায়িত্বানুভূতির শূন্যতা, প্রবৃত্তির দাসত্ব এবং স্বার্থসিদ্ধি ও সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্যে সংঘাত-সংঘর্ষ মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অধঃপতন ডেকে এনেছে। নারী-পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে মানুষের উপর বর্ণনাতীত পৈশাচিক নির্যাতন, বছরের পর বছর এবং কারো কারো ক্ষেত্রে জীবনের অধিকাংশ সময় বিনা বিচারে কারাজীবন ভোগ, হত্যাযজ্ঞ ও নারী ধর্ষণ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের মাধ্যমে দুর্বল দেশ ও জাতিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাসত্বের শৃঙ্খল পরিধান করতে বাধ্য করা প্রভৃতি অমানবিক ক্রিয়াকর্ম দেখে মনে হয় যেন মনুষ্যত্ব মৃত্যুবরণ করেছে এবং সমগ্র জগতে মানুষের আকৃতিতে হিংস্র পশুর রাজত্ব চলছে। সেকিউলারিজম চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে যে চরম অধঃপতন ডেকে এনেছে তারই কুফল মানবজাতিকে ভোগ করতে হচ্ছে। এর সমাধান একটিই এবং তা হচ্ছে এই যে, মন-মস্তিষ্ক ও জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে সেকিউলারিজম উৎখাত করে মানবজাতির জন্যে প্রদত্ত দয়াময় বিশ্বস্রষ্টার বিধান নতশিরে মেনে নেয়া এবং আখিরাতে জবাবদিহির তীব্র অনুভূতির ভিত্তিতে গোটা জীবনকে গড়ে তোলা। আর এ জীবন গড়ার বুনিয়াদ বানাতে হবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে।
জাতীয়তাবাদ
জাহেলিয়াতের প্রথম অস্ত্র ‘সেকিউলারিজম’-এর আলোচনার পর দ্বিতীয় অস্ত্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আলোচনা করে দেখা যাক যে, গোটা মানবজাতির জন্যে এ কতটা মারাত্মক।
খৃস্টীয় পোপ ও রোমান সম্রাটদের বিশ্বব্যাপী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়ার বিস্ফোরণ ঘটে, তার থেকে জাতীয়তাবাদ তথা জাতিপূজার সূচনা হয়। সূচনাকালে এর অর্থ শুধু এতোটুকু ছিল যে, বিভিন্ন জাতি তাদের নিজেদের রাজনীতি ও বিচার-বিবেচনার নিরংকুশ অধিকারী হবে। তারা কোন বিশ্বজনীন আধ্যাত্মিক অথবা রাজনৈতিক শক্তির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হবে না। কিন্তু এ নিষ্পাপ সূচনা থেকে এ চিন্তা-চেতনা যখন সম্মুখে অগ্রসর হলো, তখন এ এমন স্থানে গিয়ে উপনীত হলো যে, যে স্থানে থেকে ধর্মহীনতা তথা সেকিউলারিজমের আন্দোলন খোদাকে অপসারিত করেছিল, সেখানে জাতীয়তাবাদকে অধিষ্ঠিত করে দিল। ক্রমশঃ এখন প্রত্যেক জাতির মহানতম নৈতিক মূল্যবোধ হয়ে পড়েছে তার জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় আশা-আকাংক্ষা ও উচ্চাভিলাষ। এখন পুণ্য কাজ তা-ই হয়ে পড়েছে যা জাতির জন্যে কল্যাণকর তা সে মিথ্যা হোক, বিশ্বাসঘাতকতা হোক, জুলুম-অত্যাচার হোক অথবা অন্য কোন কর্মকাণ্ড হোক, যা প্রাচীন ধর্ম ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে যতো বড়ো পাপই মনে করা হোক না কেন। আর পাপ কাজ তা-ই মনে করা হয়, যা জাতীয় স্বার্থের জন্যে ক্ষতিকর, তা সত্যবাদিতা হোক, সুবিচার হোক, অধিকার পূরণ করা হোক অথবা এমন কোন কাজ হোক যা এককালে চারিত্রিক মাধুর্য বলে গণ্য করা হতো। জাতির ব্যক্তিবর্গের গুণাবলী, জীবন ও কর্মতৎপরতার মাপকাঠি এই যে, জাতীয় স্বার্থ তাদের নিকটে যে ত্যাগ ও কুরবানী দাবি করবে, তা জান ও মালের কুরবানী হোক অথবা নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব ও আত্মসম্ভ্রমের কুরবানী হোক, তার জন্যে তারা কোন দ্বিধাবোধ করবে না এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির ক্রমবর্ধমান উচ্চাভিলাষ পূরণে বদ্ধপরিকর থাকবে। সামগ্রিক চেষ্টা চরিত্রের লক্ষ্য এখন এই যে, প্রত্যেক জাতি তার ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ঐক্য-শৃংখলা সৃষ্টি করবে যাতে অন্যান্য জাতির মুকাবিলায় স্বীয় জাতীয় পতাকা সমুন্নত করতে পারে।
অবশ্যি জাতীয়তার (NATIONALITY) বিরুদ্ধে কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ এ এক স্বাভাবিক বাস্তবতা। অতএব জাতির শুভাকাঙ্ক্ষার বিরোধিতা করা যায় না, যদি তার মধ্যে অন্য জাতির প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার মনোভাব না থাকে। জাতির জন্যে প্রেম ও ভালোবাসা কখনো নিন্দনীয় হতে পারে না, অবশ্য যদি এ প্রেম ও ভালোবাসা আপন জাতির জন্যে অন্যায় পক্ষপাতিত্ব এবং অন্যান্য জাতির জন্যে হিংসা ও শত্রুতার কারণ না হয়। প্রত্যেক জাতির স্বাধীনতাকেও অবশ্যই সমর্থন করতে হবে। কারণ নিজেদের ব্যাপার ও বিষয়াদি নিজের দ্বারাই মীমাংসিত হওয়া ও আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা নিজেই সম্পন্ন করা প্রত্যেক জাতির অধিকার এবং কোন জাতির উপর অন্য কোন জাতির আধিপত্য কিছুতেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। যা অন্যায় ও পরিহারযোগ্য তা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ (NATIONALISM) বা জাতিপূজা। জাতীয় অন্ধ স্বার্থপরতার দ্বিতীয় নামই জাতীয়তাবাদ। এর মূলনীতি এই যে, সত্য ও সঠিক তা-ই যা জাতীয় স্বার্থের অনুকূল এবং মিথ্যা ও অন্যায় তা-ই যা অনুকূল নয়। জাতীয় স্বার্থের অন্ধ আবেগে অন্য জাতির রক্ত পান করা, অন্য দেশ জবরদখল করা, অন্য দেশ ও জাতির ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করা, বিজিত দেশের সকল সম্পদ ও নারী উপভোগের উপর অবাধ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা কোন অন্যায় নয়, বরঞ্চ জাতীয় গৌরব মনে করা হয়। অপরের তুলনায় আপন জাতিকে শ্রেষ্ঠতর ও অধিক শক্তিশালী প্রমাণ করার জন্যে ভূখণ্ডের পর ভূখণ্ড জয় করা জাতীয়তাবাদেরই দাবি। তাই দুনিয়ায় মানবজাতির জন্যে জাতীয়তাবাদকে বিরাট অভিশাপ মনে করা হয়েছে। যদি একটি সমাজের মধ্যে সে ব্যক্তির অস্তিত্ব একটি অভিশাপ হয় যে তার প্রবৃত্তি ও স্বার্থের দাস হয়ে পড়েছে এবং আপন স্বার্থের জন্যে সবকিছু করতে প্রস্তুত; যদি একটি জনপদের মধ্যে সেই পরিবারটি একটি অভিশাপ হয় যার লোকজন পারিবারিক স্বার্থের অন্ধ পূজারী হয়ে পড়ে এবং ন্যায় অন্যায় যে কোন উপায়ে পরিবারের স্বার্থ হাসিলের জন্য বদ্ধপরিকর; যদি একটি দেশের মধ্যে সেই শ্রেণীটি একটি অভিশাপ হয় যে শ্রেণীস্বার্থের অন্ধ পূজারী হয় এবং অন্যের ভালো-মন্দের তোয়াক্কা না করে আপন স্বার্থ উদ্ধারের পেছনেই লেগে থাকে, যেমন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, কালোবাজারি, চোরাচালানি প্রভৃতি সমাজবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকে, তাহলে বিরাট ও বিশাল পরিমণ্ডলে সে স্বার্থান্ধ জাতি কেন একটি অভিশাপ হবে না যার আচরণ উপরে বর্ণনা করা হলো? এ অন্ধ জাতিপূজার আবেগ-অনুরাগ দু’টি বিশ্বযুদ্ধসহ বহু ছোট-বড়ো যুদ্ধের অনল প্রজ্জ্বলিত করে কত জাতি ও দেশ ছারখার করেছে, কত লক্ষ লক্ষ মানবসন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে, কত লক্ষ লক্ষ মানুষকে পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ করেছে।
জাতীয়তাবাদ নয়, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বই মানবজাতিকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারতো, আর এ বিশ্বভ্রাতৃত্বের উদার আহ্বান জানিয়েছিল ইসলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এ ইসলামের বাণীবাহক ছিল যে মুসলিম জাতি, সে আজ জাতীয়তাবাদকে খোদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আজ সমগ্র দুনিয়ায় এ জাতীয়তাবাদ; ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অথবা বংশ, গোত্র ও বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদ- মানবজাতির জন্যে এক বিরাট অভিশাপ হয়ে পড়েছে। জাতীয়তাবাদ তথা জাতিপূজার নীতি এই যে, সত্য ও সঠিক তা-ই যা জাতীয় স্বার্থের উপযোগী এবং মিথ্যা ও অন্যায় তা-ই যা জাতীয় স্বার্থের উপযোগী নয়। প্রত্যেকের বিবেক অবশ্যই সাক্ষ্য দেবে যে, সকল স্বার্থবাদিতা ও আত্মপূজার ন্যায় এ জাতীয় স্বার্থপরতা ও জাতীয় পূজাও এক বিরাট অভিশাপ। এ অভিশাপে আজ গোটা বিশ্ব জর্জরিত।
পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, যে মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহর কালামে পাক এবং রসূলের (সা) সুন্নাহ বিদ্যমান রয়েছে একেবারে অবিকৃত অবস্থায়, রয়েছে বিশ্বভ্রাতৃত্বের ইসলামী পয়গাম, সে মুসলমান আজ ভৌগোলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অভিশাপে জর্জরিত এবং এটাই জাহেলিয়াতের বিজয় বা কৃতিত্ব।
প্রাচীন জাহেলিয়াতের যুগে বংশে বংশে, গোত্রে গোত্রে, অঞ্চলে অঞ্চলে যে পারস্পরিক শত্রুতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলে আসছিল যুগের পর যুগ ও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, ইসলাম এসে তার অবসান ঘটিয়ে সবাইকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একত্র করে দিল, ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সকল দল ও গোষ্ঠীকে এক ও অভিন্ন করে দিল। এ ইসলামী জাতীয়তা ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব মুসলমানদের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তৈরি করেছিল, প্রায় অর্ধ পৃথিবীর উপরে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছিল। অতঃপর জাহেলিয়াত তাদেরকে জাতিপূজায় উদ্বুদ্ধ করলো। মুসলমানের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভ এবং এর জন্যেই তাদের সকল চেষ্টা-চরিত্র, সাধনা ও জানমালের কুরবানী। এখন তাদের সকল চেষ্টা-চরিত্র ও সাধনা হয়ে পড়েছে জাতি-খোদার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে। এ সন্তুষ্টি অর্জন করতে গিয়ে অন্য জাতির প্রতি কোন অন্যায়, এমনকি কোন ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন করা হোক না কেন, সেটাকে দূষণীয় মনে করা হয় না কিছুতেই। জাতির স্বার্থ হাসিলের জন্যে যে কোন দেশ, (তা মুসলিম হোক, অমুসলিম হোক) জবরদখল করাকে নেক কাজ মনে করা হয়। যারা খোদা ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী নয়, তারা জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারে, জাতীয় স্বার্থের জন্যে অন্য জাতির জান-মাল-ইজ্জত আব্রু লুণ্ঠন করতে পারে এবং তাদের এ জাতীয় উচ্চাভিলাষ ও লালসা-বাসনা দু’টি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত করেছে। কোন উচ্চতম শক্তিমান সত্তার নিকটে জবাবদিহির অনুভূতি তাদের নেই বলে জাতীয় স্বার্থকেই তারা জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু এ পথে মুসলমানদেরকে টেনে নিয়ে আসা আলবৎ জাহেলিয়াতের কৃতিত্বই বলতে হবে।
গণতন্ত্র
জাহেলিয়াতের তৃতীয় মারাত্মক অস্ত্র গণতন্ত্র তথা জনগণের সার্বভৌমত্ব। নিরংকুশ শাসন ক্ষমতার অধিকারী রাজা-বাদশাহ ও অন্যান্য স্বৈরাচারী শাসকদের একচ্ছত্র আধিপত্য খতম করার জন্যে গণতন্ত্রের ধারণা পেশ করা হয়। অর্থাৎ জনসাধারণের সুযোগ-সুবিধা ও অভাব-অভিযোগের প্রতি লক্ষ্য রেখে জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতেই শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। এ ধারণা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত যে, লক্ষ-কোটি মানুষের উপর এক ব্যক্তি, পরিবার অথবা গোষ্ঠীর খেয়াল-খুশি ও মর্জি চাপিয়ে দেয়ার এবং আপন স্বার্থ ও মর্জি পূরণের জন্যে তাদেরকে ব্যবহার করার কোনই অধিকার থাকতে পারে না। কিন্তু এ নেতিবাচক দিকটির সাথে যে ইতিবাচক দিকটি ছিল তা এই যে, এক এক দেশ ও এক এক অঞ্চলের অধিবাসী নিজেরাই শাসক ও নিজেরাই মালিক। এ ইতিবাচক দিকটির উপর গণতন্ত্র সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পর যে আকার ধারণ করে তা এই যে, প্রত্যেক জাতি তার ইচ্ছা ও মর্জি পূরণের নিরংকুশ অধিকারী। তার সামগ্রিক ইচ্ছা-বাসনা অথবা তার সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা-বাসনা দমিত করার শক্তি আর কারো নেই। নীতি-নৈতিকতা হোক, সভ্যতা-সংস্কৃতি হোক, সামাজিকতা হোক অথবা রাজনীতি হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক নীতি তা-ই হবে যা জাতীয় অভিলাষের ভিত্তিতে নির্ণীত হবে। যে নীতি জনমত প্রত্যাখ্যান করবে তা ভ্রান্ত ও অন্যায়। আইন জাতির ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। ইচ্ছা করলে যে কোন আইন প্রণয়ন করবে এবং ইচ্ছা করলে যে কোন আইন রহিত করবে। জাতির মর্জি অনুযায়ী সরকার গঠিত হবে এবং সরকার জাতির মর্জি পূরণে বাধ্য থাকবে। সরকার তার সকল শক্তি নিয়োজিত করবে জাতির মর্জি পূরণের জন্যে।
জাহেলিয়াতের আবিষ্কৃত উপরে উল্লেখিত তিনটি মতবাদ সেকিউলারিজম তথা ধর্মহীনতা বা খোদাদ্রোহীতা, জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র জীবনের সকল বিভাগ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্র থেকে খোদার প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব ও আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতি ও জনসাধারণকে খোদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
ইসলামের সুস্পষ্ট ঘোষণা এই যে, সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ (SOVEREIGNTY BELONGS TO ALLAH ALONE)। আর এটা ইসলামী ঈমান-আকীদার কথা। আসমান যমীন এবং মানুষসহ প্রতিটি জীব ও জন্তুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। তিনি সকলের প্রভু ও প্রতিপালক। তিনি মানবজাতির বাদশাহও। মানুষ তাঁর প্রজা। সৃষ্টি ও প্রজার উপরে স্রষ্টা ও বাদশাহেরই আইন-শাসন ও প্রভুত্ব চলবে- এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ও ন্যায়সংগত কথা। আইন-শাসনের এ স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার- যাকে সার্বভৌমত্ব বলা হয়, আল্লাহর নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে দেয়া হচ্ছে জনসাধারণকে। গণতন্ত্রের প্রথম ও মূলকথা হচ্ছে – SOVEREIGNTY BELONGS TO THE PEOPLE- সার্বভৌমত্ব জনগণের। তারা যেভাবে খুশি দেশ ও জাতির জন্যে আইন প্রণয়ন করবে এবং যখন খুশি যে কোন আইন রহিত করবে। জনগণকে আইন রচনার অধিকার দেয়ার ফলে দেখা যায়- একই বস্তু কখনো বৈধ, আবার কখনো অবৈধ ঘোষণা করা হয়। আমেরিকায় একবার মদ্যপানের সর্বনাশা পরিণাম লক্ষ্য করে, তা আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু যে জনসাধারণ আইন রচনার অধিকারী, সে জনগণের চাপেই আবার মদ্যপান বৈধ ঘোষিত হয়। গর্ভপাত বা ভ্রূণহত্যা সকল ধর্মে নিষিদ্ধ এবং বিবেকও তা-ই বলে। কিন্তু চরম নৈতিক অবক্ষয় ও যৌন অনাচারের ফলে যখন জনমত গর্ভপাতের দাবি জানায়, তখন আইন করে তা বৈধ ঘোষণা করা হয়। অত্যন্ত ঘৃণিত ও লজ্জাকর কাজ সমকামিতা (HOMO SEXUALITY)। জনগণের মধ্যে যখন সমকামিতার ব্যাধি মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়লো, তখন আইন করে এ অত্যন্ত গর্হিত পাপকাজ বৈধ বলে ঘোষণা করা হলো। যে মানুষ কখনো ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে হতে পারে না এবং যার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত তাকে আইন রচনার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে মানব সমাজ বিশৃঙ্খলা, অবিচার ও পাপাচারেই পূর্ণ হতে পারে।
প্রকৃত ব্যাপার এই যে, কোনটি ভালো এবং কোনটি মন্দ, কোনটি কল্যাণকর ও কোনটি অকল্যাণকর তার পরিপূর্ণ জ্ঞান একমাত্র আল্লাহতায়ালারই রয়েছে। তাই তিনি মানুষের জন্যে যা ভালো ও মন্দ, হালাল ও হারাম নির্ধারিত করে দিয়েছেন- যে আইন অথবা আইনের মূলনীতি ঘোষণা করেছেন- তা অভ্রান্ত এবং মানুষের জন্যে একমাত্র কল্যাণকর। যিনি বিশ্ব প্রকৃতির স্রষ্টা ও ব্যবস্থাপক তিনি সকল ভুলের ঊর্ধ্বে। অতএব তাঁর আইনও নির্ভুল হতে বাধ্য। তাঁর আইন অথবা কোন বিষয়ের ফয়সালা পরিবর্তনের অধিকার কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী অথবা কোন দেশের পার্লামেন্টের নেই। তা কেউ করলে তা একদিকে যেমন খোদাদ্রোহিতা হবে অপরদিকে তা মানুষের অকল্যাণই ডেকে আনবে।
“আল্লাহ বলেন, কোন মুমিন পুরুষ অথবা মুমিনা নারীর এ অধিকার নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন বিষয়ে ফয়সালা করে দিয়ে থাকলে সে ব্যাপারে সে নিজে কোন ফয়সালা করার এখতিয়ার রাখবে”- (সূরা আল আহযাবঃ ৩৬)।
সমগ্র প্রকৃতি ও মানুষের স্রষ্টা, প্রভু ও বাদশাহ হিসেবে মানুষের জন্যে সুষ্ঠু কল্যাণকর আইন একমাত্র আল্লাহতায়ালাই রচনা করতে পারেন এবং তাঁর নির্দেশে তাঁর রসূলও আইন রচনা করতে পারতেন। কিন্তু জাহেলিয়াত এ আইন রচনার অধিকার নিরংকুশভাবে জনসাধারণকে তথা জনপ্রতিনিধিদের হাতে অর্পণ করেছে। এ ইসলামী আকীদাহ-বিশ্বাসের পরিপন্থী, বিবেকের এবং মানব কল্যাণের পরিপন্থী।
উপরে জাহেলিয়াতের মারাত্মক যে তিনটি মতবাদ বা মূলনীতির আলোচনা করা হলো, তার জবাবে ইসলাম অন্য তিনটি মূলনীতি পেশ করেছে। মানুষের বিবেকের কাছে আমরা অবশ্যই আবেদন জানাব এ তিনটি যাচাই ও পরীক্ষা করে দেখার জন্যে যে, মানবকল্যাণ প্রকৃতপক্ষে কোন তিনটির মধ্যে নিহিত। ইসলামের সে তিনটি মূলনীতি হচ্ছেঃ
১। সেকিউলারিজম তথা ধর্মহীনতার মুকাবিলায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে খোদার দাসত্ব-আনুগত্য।
২। জাতিপূজার মুকাবিলায় মানবতা।
৩। জনগণের সার্বভৌমত্বের মুকাবিলায় খোদার সার্বভৌমত্ব ও জনগণের খিলাফত।
প্রথম মূলনীতির মর্ম এই যে, আমরা সকলে সেই খোদাকে আমাদের প্রভু বলে মেনে নেব, যিনি আমাদের এবং সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির স্রষ্টা, মালিক ও শাসক। আমরা তাঁর থেকে স্বাধীন ও বেপরোয়া হয়ে নয়, বরঞ্চ তাঁর অনুগত হয়ে এবং তাঁর পথনির্দেশনা মেনে নিয়েই জীবন যাপন করব। আমরা শুধু তাঁর পূজা-অর্চনাই করব না, বরঞ্চ তাঁর আনুগত্য এবং দাসত্বও করব। আমরা শুধু আমাদের ব্যক্তি জীবনেই তাঁর হুকুম ও হেদায়েত মেনে চলব না, বরঞ্চ আমাদের সামষ্টিক-সামাজিক জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্র ও বিভাগে তাঁরই অনুগত হয়ে থাকব। আমাদের সমাজ, সভ্যতা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা, আমাদের যুদ্ধ ও সন্ধি, আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ- মোটকথা সবকিছুই সেই মূলনীতি ও সীমারেখার মধ্যেই হবে যা খোদা নির্ধারিত করে দিয়েছেন। পার্থিব বিষয়াদি নির্ণয় করার ব্যাপারে আমরা একেবারে স্বাধীন হবো না, বরঞ্চ আমাদের স্বাধীনতা সে সীমারেখার মধ্যেই সীমিত থাকবে, যা খোদার নির্ধারিত মূলনীতি টেনে দিয়েছে। এ মূলনীতি এবং সীমারেখা সর্বাবস্থায় আমাদের এখতিয়ার বহির্ভূত।
দ্বিতীয় মূলনীতির মর্ম এই যে, খোদাপরস্তির ভিত্তিতে যে জীবনব্যবস্থা গড়ে উঠে, সেখানে জাতি, বংশ, জন্মভূমি, বর্ণ ও ভাষার পার্থক্যের ভিত্তিতে কোন প্রকার পক্ষপাতিত্ব ও স্বার্থপরতার কোন স্থান থাকবে না। তা একটি জাতীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি নীতিগত ব্যবস্থা হওয়াই বাঞ্ছনীয়- যার দ্বার উন্মুক্ত থাকবে প্রত্যেক সে মানুষের জন্যে যে তার মূলনীতি মেনে নেবে। আর যে ব্যক্তিই তা মেনে নেবে সে কোনরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকেই সমঅধিকারের ভিত্তিতে তাতে শরীক হতে পারবে। এ ব্যবস্থার অধীনে নাগরিকত্ব (CITIZENSHIP) নিছক একটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যেই সীমিত হবে না, বরঞ্চ মূলনীতির ভিত্তিতে সার্বজনীন হবে। যারা এ মূলনীতির সাথে একমত নয় অথবা কোন কারণে তা মেনে নিতে রাজি নয়, তাদেরকে দমিত করা ও নির্মূল করা যাবে না। বরঞ্চ তারা নির্দিষ্ট অধিকারসহ এ ব্যবস্থার অধীনে নিরাপদে থাকবে এবং তাদের জন্যে সর্বদা এ সুযোগ থাকবে যে, যখনই এসব মূলনীতির সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে নিশ্চিন্ত হবে, তখনই তারা সমঅধিকারসহ নিজেদের স্বাধীন মর্জিমতো এ ব্যবস্থায় কর্তৃত্বশীল হতে পারবে।
এ বস্তুকে আমরা মানবতার নীতি বলে আখ্যায়িত করছি এবং তা জাতীয়তার পরিপন্থী নয়। বরঞ্চ তাকে তার প্রকৃত স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রাখতে চাই। এতে জাতীয় প্রেমের স্থান আছে, কিন্তু জাতীয় পক্ষপাতিত্বের স্থান নেই। জাতির জন্যে শুভাকাঙ্ক্ষাও জায়েজ, কিন্তু জাতীয় স্বার্থপরতা হারাম। জাতীয় স্বাধীনতা সর্বস্বীকৃত এবং একটি জাতির উপর অন্য জাতির আধিপত্যও মেনে নেয়া যায় না- যা মানবতাকে অনতিক্রমণীয় সীমারেখার মধ্যে বিভক্ত করে দেয়। মানবতার নীতির দাবি এই যে, যদিও প্রত্যেক জাতি তার আভ্যন্তরীণ বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা নিজেই করবে, এবং কোন জাতি জাতি হিসেবে অন্য কোন জাতির অধীন হবে না, কিন্তু যেসব জাতি মানবসভ্যতার বুনিয়াদী মূলনীতির সাথে একমত, তাদের মধ্যে মানবতার কল্যাণ ও উন্নতির কাজে পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে। প্রতিযোগিতার (COMPETETION) পরিবর্তে সহযোগিতা হবে। পারস্পরিক পার্থক্য, বিদ্বেষ ও ভিন্নতা থাকবে না। সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জীবনের উপায়-উপকরণের স্বাধীনভাবে লেনদেন হবে। আর এ সভ্য জীবনব্যবস্থার অধীনে বসবাসকারী দুনিয়ার প্রতিটি মানুষ এক জাতি ও এক দেশের নয়, বরঞ্চ এ সমগ্র দুনিয়ার নাগরিক হবে, যেন সে একথা বলতে পারেঃ যেহেতু সকল দেশ আমার খোদার, সেহেতু প্রত্যেক দেশও আমার। বর্তমানে এমন এক অবাঞ্ছিত অবস্থা বিরাজ করছে যে, এক ব্যক্তি না স্বয়ং আপন জাতি ও দেশ ব্যতীত অন্য কোন জাতি ও দেশের বিশ্বস্ত হতে পারে। আর না কোন জাতি তার আপন লোক ব্যতীত অন্য কোন জাতির লোকের প্রতি আস্থা রাখতে পারে। মানুষ তার দেশের সীমান্ত অতিক্রম করার সাথে সাথেই অনুভব করে যে, খোদার দুনিয়ার প্রতিটি স্থানে তার জন্যে শুধু প্রতিবন্ধকতাই রয়েছে। প্রত্যেক স্থানে তাকে যেন চোর-ডাকাতের মতো সন্দেহের চোখে দেখা হয়। প্রত্যেক স্থানে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি। কথাবার্তা ও চলাফেরায় বাধানিষেধ। কোথাও তার জন্যে না স্বাধীনতা আছে না অধিকার। তার মুকাবিলায় আমরা এমন এক বিশ্বজনীন ব্যবস্থা দেখতে চাই যেখানে মূলনীতির ঐক্যের ভিত্তিতে জাতিগুলোর মধ্যে ফেডারেশন হবে এবং এ ফেডারেশনের মধ্যে সমান ও সার্বজনীন নাগরিকত্ব (COMMON CITIZENSHIP) ও অবাধ যাতায়াত ব্যবস্থা প্রচলিত হবে। আমাদের চোখ যেন আর একবার এ দৃশ্য দেখতে পারে যে, আজকালের কোন ‘ইবনে বতুতা’ আটলান্টিক উপকূল থেকে কৃষ্ণ সাগরের উপকূল পর্যন্ত এমনভাবে ভ্রমণ করবেন যে, কোথাও তিনি বিদেশী (FOREIGNER) বলে গণ্য হবেন না।
এখন তৃতীয় মূলনীতির কথাই ধরা যাক। আমরা জনগণের সার্বভৌমত্ব বা বাদশাহীর (SOVEREIGNTY) পরিবর্তে জনগণের খিলাফত চাই। ব্যক্তি রাজতন্ত্র বা বাদশাহী (MONARCHY), আমীর-ওমরার শাসনক্ষমতা এবং শ্রেণীসমূহের একচেটিয়া অধিকারের আমরা ততোটা বিরোধী, যতোটা আধুনিককালের একজন চরম গণতন্ত্রী হয়ে থাকেন। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অতি উৎসাহী সমর্থকদের ন্যায় আমরাও সামাজিক জীবনে সকলের সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার দাবি করি। আমাদেরও একথা যে, শাসন পরিচালনার ব্যবস্থাপনা এবং শাসকদের নির্বাচন জনগণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে হতে হবে। সেইসাথে আমরা এমন জীবনব্যবস্থার চরম বিরোধী যেখানে সভা-সমিতির স্বাধীনতা এবং কোন আন্দোলন ও সংগ্রাম করার স্বাধীনতা নেই। অথবা যেখানে জন্ম, বংশ ও শ্রেণীর কিছুলোকের জন্যে বিশেষ অধিকার সংরক্ষিত থাকবে এবং অন্যদের জন্যে থাকবে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা। এই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল সারাংশ যে ব্যাপারে আমাদের গণতন্ত্র এবং পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই। এর মধ্যে এমন একটিও নেই যা পাশ্চাত্য আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে। এ গণতন্ত্রের সাথে আমরা সে সময় থেকেই পরিচিত ছিলাম এবং দুনিয়ার সামনে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছিলাম, যার বহু শতাব্দী পর পাশ্চাত্যের আধুনিক গণতন্ত্রের সূচনা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ নবজাত গণতন্ত্রের যে বিষয়টির সাথে আমাদের মতপার্থক্য তা হচ্ছে এই যে, এতে জনগণের নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব বা বাদশাহীর নীতি পেশ করা হয়েছে যা বাস্তবতার দিক দিয়ে ভ্রান্ত এবং পরিণামের দিক দিয়ে অত্যন্ত মারাত্মক। প্রকৃতপক্ষে বাদশাহীর (SOVEREIGNTY) অধিকার একমাত্র তাঁর যিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তাদের প্রতিপালন ও পরিবর্ধনের উপায় উপকরণ সরবরাহ করছেন, যাঁর ইচ্ছায় মানবজাতির ও সমগ্র সৃষ্টিজগতের অস্তিত্ব বিদ্যমান এবং যাঁর শক্তিশালী আইনের বন্ধনে সৃষ্টি জগতের প্রতিটি বস্তু আবদ্ধ। তাঁর বাস্তব ও প্রকৃত বাদশাহীর অধীনে যে বাদশাহীরই দাবি করা হোক না কেন তা এক ব্যক্তি অথবা পরিবারের বাদশাহী হোক, অথবা একটি জাতি ও তার জনগণের হোক সর্বাবস্থায় তা একটি বিভ্রান্তি ব্যতীত কিছু নয়। এ বিভ্রান্তির আঘাত প্রকৃত বাদশাহের গায়ে লাগবে না, বরঞ্চ লাগবে সে নির্বোধ বাদশাহীর দাবিদারের উপর যে তার আপন মর্যাদা সম্পর্কে অপরিজ্ঞাত। এ সত্যের আলোকে এটাই সঠিক যে, খোদাকে খোদা মেনে নিয়ে, মানবজীবনের শাসনব্যবস্থা খিলাফতের ধারণা-মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ খিলাফত নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক হতে হবে। স্বাধীন জনমতের ভিত্তিতেই সরকারপ্রধানের নির্বাচন হতে হবে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই পার্লামেন্ট (শুরা) সদস্য নির্বাচিত হবেন। তাদের পরামর্শক্রমেই সরকারের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা চলতে থাকবে। সরকারের সমালোচনা ও জিজ্ঞাসাবাদের তাদের পূর্ণ অধিকার থাকবে। কিন্তু এ সবকিছু এ অনুভূতিসহ হতে হবে যে, দেশ খোদার। আমরা মালিক নই, বরঞ্চ তাঁর প্রতিনিধি। আমাদের প্রতিটি কাজের হিসাব প্রকৃত মালিকের নিকট দিতে হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের জীবনের জন্যে যেসব চারিত্রিক মূলনীতি, আইনগত নির্দেশ ও সীমারেখা নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তা যথাযথ আপন আপন স্থানে বলবৎ ও অটল থাকবে। আমাদের পার্লামেন্টের বুনিয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি এ হতে হবে যে, আল্লাহর কুরআন এবং তাঁর রসূলের (সা) সুন্নাহ হবে সকল আইনের উৎস। আল্লাহ ও তাঁর রসূল যেসব বিষয়ে হেদায়েত ও আইনগত নির্দেশ দিয়েছেন সেসব বিষয়ে নতুন কোন আইন প্রণয়ন না করে তাঁদের নির্দেশ কার্যকর করার জন্যে বিস্তারিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। যেসব ব্যাপারে তাদের কোন হেদায়েত নেই, আমাদের মনে করতে হবে যে, সেসব ব্যাপারে আমাদেরকে কর্ম স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। অতএব শুধুমাত্র এসব ব্যাপারে আমরা পরামর্শের ভিত্তিতে আইন রচনা করতে পারব। কিন্তু এসব আইন অবশ্যই সেই সামগ্রিক কাঠামোর মেজাজ প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে যা খোদার মৌলিক হেদায়েত আমাদের জন্যে তৈরি করে দিয়েছে।
অতঃপর যে জিনিসের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো এই যে, এ গোটা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এমন সব লোকের উপর অর্পণ করা হবে যারা সর্বদা খোদার ভয়ে ভীত থাকে। তাঁর আনুগত্য করে এবং তারা তাদের প্রত্যেকটি কাজে খোদার সন্তুষ্টি লাভের অভিলাষী। তাদের জীবন এ সাক্ষ্যই দেয় যে, খোদার সামনে হাজির হয়ে জবাবদিহি করার প্রতি তাদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।
উপরের পৃষ্ঠাগুলোতে জাহেলিয়াতের তিনটি মারাত্মক মতবাদ ও দর্শনের আলোচনা করা হলো এবং সেইসাথে ইসলামী আকীদাহ-বিশ্বাস, মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গিও পেশ করা হলো। প্রত্যেক বিবেকবান ব্যক্তির নিকট জিজ্ঞাস্য যে, জাহেলিয়াতের এ তিনটি মতবাদের ভিত্তিতে সমগ্র দুনিয়ার প্রায় সকল দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সভ্যতা-সংস্কৃতির যে প্রাসাদ গড়ে উঠেছে, তা কি মানুষের জীবনে কোন সুখ-শান্তি, জান-মালের নিরাপত্তা, সুবিচার, শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে? মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ-বিগ্রহাদি, জানমালের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি, দুর্ভিক্ষ, অনাহার-দারিদ্র্য, মহামারী, দুরারোগ্য যৌনব্যাধি, চরম নৈতিক অবক্ষয়, হিংসা-বিদ্বেষ, হিংস্রতা-পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি যা মানবসমাজে অশান্তির মূল কারণ- তা কি বন্ধ হয়েছে, না হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে যে, আমরা কি জাহেলিয়াতের মতবাদকে আঁকড়ে ধরে থেকে আমাদের ধ্বংস টেনে আনব, না বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহতায়ালার প্রেরিত বিধান অনুযায়ী আমাদের সমগ্র জীবন গড়ে তুলব। এবং দুনিয়ায় শান্তি, আখিরাতে মুক্তি ও চিরন্তন সুখের নীড় গড়ব?