জাহেলিয়াতের মুকাবিলায় অবিচল থাকার উপায়
বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহেলিয়াতের মুকাবিলায় ইসলামের পথে অবিচল থাকার যেসব উপায় পদ্ধতি বলে দিয়েছেন, তার অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটির উল্লেখ নিম্নে করা হলো।
একঃ প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা
মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক ভূমিকা পালনের ও জীবনে সাফল্য অর্জনের জন্যে বুদ্ধিমত্তার অনিবার্য প্রয়োজন। আর এ বুদ্ধিমত্তা হতে হবে সুষ্ঠু ও সঠিক চিন্তাপ্রসূত। ইসলামে প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা বলতে যা বুঝায় তা হচ্ছে এই যে, মানুষের দৃষ্টি প্রতি মুহূর্তে নিবদ্ধ হয়ে থাকবে খোদার সন্তুষ্টি লাভের উপর। মানুষ যেন এমন কোন আচরণ না করে যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চিন্তা থেকে গাফেল ও বিমুখ করে রাখে এবং যা তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ হয়। এ কারণেই আল্লাহতায়ালা বার বার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন-
“হে বুদ্ধিবিবেকবান লোকেরা! আমাকে ভয় করে চল”- (বাকারাহঃ ১৯৭)।
ভয় তাঁকে এজন্যে করা যাতে তিনি অসন্তুষ্ট না হন। তিনি যেন কখনও অসন্তুষ্ট না হন- একথাটি হরহামেশা মনে রাখা এবং আপন আচরণ দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট রাখাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা।
“আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত দিনের আবর্তনে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে সেসব বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে যারা চলতে-ফিরতে, ওঠা-বসায় এবং শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে”- (আল ইমরানঃ ১৯০)।
বুদ্ধিবিবেকসহ আসমান ও যমীনের সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে যখন কেউ সঠিক চিন্তাভাবনা করে এবং সেই সাথে যার মনে খোদার ইয়াদ জাগ্রত থাকে, সৃষ্টিজগতের নিদর্শনাবলী জন্তু-জানোয়ারের মতো দেখে না বরঞ্চ চিন্তা-গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করে, সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘোষণা করে যে, এ গোটা সৃষ্টিরাজ্য একটা বিজ্ঞতাপূর্ণ ব্যবস্থাপনার অধীন।
চিন্তা ও কাজের এ ধরনকে নবী পাক (সা) তার নিজের কথায় এভাবে বর্ণনা করেনঃ “বুদ্ধিমান তো সে ব্যক্তি যে তার প্রবৃত্তিকে বশীভূত করে রাখে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্যে কাজ করে”- (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)।
প্রতিটি কাজের জন্যে আখিরাতে আল্লাহতায়ালার নিকটে জবাবদিহি করতে হবে- এ তীব্র অনুভূতি মনে সদা জাগ্রত থাকলে আল্লাহর অসন্তুষ্টিভাজন কাজ ও আচরণ থেকে বাঁচা যায়। এটাকেই বুদ্ধিমত্তা বলা হয়েছে। নবী মুস্তাফা (সা) বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণ ধারণাই সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। মৃত্যুর পরের জীবনের জন্যে কাজ করার অর্থ হলো, দ্বীন ও ঈমানের দাবি যদি এই হয় যে, দুনিয়ার নগদ প্রাপ্য-স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাখ্যান করতে হবে তাহলে এ দাবি অবশ্যই পূরণ করতে হবে এবং খোদার সন্তুষ্টি জান-মাল ও আরাম আয়েশ কুরবানী করার দাবি করলে তা দ্বিধাহীন চিত্তেই করতে হবে।
দুইঃ ধন-দৌলত ও মর্যাদা সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলাম এ কথা বলে যে, ধন-সম্পদের মালিক হওয়া ও পদমর্যাদা লাভ করা এবং খোদার প্রিয়পাত্র হওয়া এক জিনিস নয়। একথা ঠিক নয় যে, আল্লাহতায়ালা তাদের উপর সন্তুষ্ট যাদের মধ্যে এ দু’টি পাওয়া যায়। আল্লাহর সন্তুষ্টি সবর্তোভাবে নির্ভরশীল ঈমান ও আমলের উপরে। একজন ধসম্পদ ও পদমর্যাদা থেকে বঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও ঈমান ও আমলের বদৌলতে খোদার দৃষ্টিতে সম্মানিত বলে গণ্য এবং তাঁর প্রিয় হতে পারে। অপরদিকে একজন অঢেল ধন-দৌলত ও উচ্চমর্যাদা লাভ করার পরেও তাঁর অভিশপ্ত হতে পারে। কারণ দুনিয়াটা মানবের জন্যে কর্মক্ষেত্র, প্রতিদান ক্ষেত্র নয়। এখানে তাকে কাজ করে যেতে হবে। যার পূর্ণ প্রতিদান সে লাভ করবে আখিরাতে। এখানে কারো সচ্ছল হওয়া একথা প্রমাণ করে না যে, আল্লাহ তার কাজকর্মে খুশি এবং এ কারণে সে তাঁর প্রিয়পাত্র। কারো দুঃখ-দারিদ্র্য একথা প্রমাণ করে না যে, খোদা তার প্রতি অসন্তুষ্ট। অর্থের প্রাচুর্য হোক অথবা দারিদ্র্য, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উচ্চমর্যাদা হোক অথবা অপমান ও লাঞ্ছনা হোক এ দু’টি বিষয় বিশেষ উদ্দেশ্যে মানুষকে পরীক্ষা করার খোদায়ী আইনের সাথে সম্পৃক্ত। দুনিয়ার জীবনে মানুষকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করাই তার সৃষ্টির মুখ্য উদ্দেশ্য। সৃষ্টজগতের সমস্ত ব্যবস্থাপনা এ সত্যের সাক্ষ্যদান করে। যেহেতু এটি ছিল মানবজীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়, সেজন্যে কুরআনে হাকীম বার বার একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং তাকে পরীক্ষা করার খোদায়ী আইনের উপর বিস্তারিতভাবে ও বিভিন্নরূপে আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু জাহেলিয়াতের সৃষ্ট মানসিকতা তা মেনে নিতে পারেনি। জাহেলিয়াতের এ দৃষ্টিভংগির মধ্যে সেই মানসিকতা অবিচল থাকে যে, ধনসম্পদ ও পদমর্যাদা এবং খোদার সন্তোষ ও ভালবাসা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে যত বড়ো ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার মালিক হবে, সে ততটা খোদার প্রিয় ব্যক্তি হবে। দারিদ্র্য ও পদমর্যাদাহীনতা খোদার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ারই নিদর্শন। এ দৃষ্টিভংগির ভিত্তিতে সে সত্যকে সত্যের মাপকাঠিতে বিচার করার পরিবর্তে ধনসম্পদ ও পদমর্যাদার মাপকাঠিতে বিচার করবে। নবী মুহাম্মাদ (সা) যখন তাঁর নবুওতের ঘোষণা করেন, তখন জাহেলিয়াতের মানস সন্তানেরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলে যে, তাঁর মর্যাদা তাদের স্বরচিত মাপকাঠি অনুযায়ী ছিল না। তারা বার বার এ কথা বলতে থাকে, প্রথম কথা এই যে, খোদার রসূলের অবশ্যই কোন ফেরেশতা হওয়া দরকার। আর যদি মানুষকেই রসূল হতে হয়, তাহলে তাকে সাধারণ স্তরের মানুষ কিছুতেই হওয়া চলবে না। বরঞ্চ এমন অসাধারণ মর্যাদার হতে হবে যেন আল্লাহতায়ালার মহান সম্পর্কের সাথে তা সংগতিশীল হয়। যেমন, মানুষ রসূল হলে প্রকাশ্যে তার উপর ফেরেশতা নাযিল হতো (সূরা আনআমঃ ৮), নিদেনপক্ষে তার জন্যে (আসমান থেকে) কোন ধনভাণ্ডার নামিয়ে দেয়া হতো, অথবা তার কোন (ফলবান বৃক্ষাদির) বাগান হতো যার থেকে সে প্রচুর জীবিকা অর্জন করতো (ফুরকানঃ ৮)। আর এমন অসাধারণ মানুষও যদি না হোত তবে অন্ততপক্ষে কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি হতো, কোন কওমের প্রধান হতো, কোন প্রসিদ্ধ গোত্রের সর্দার হতো এবং দৌলত ও পদমর্যাদার মালিক হতো, কিন্তু এখানে ব্যাপারখানা অন্যরকম। একজন অতি সাধারণ মানুষ দাবি করে বসলো যে, সে খোদায়ে যুলজালালের প্রেরিত- অথচ এ দাবি করার কোন গুণাবলীই তার মধ্যে নেই। একদিকে সে সমগ্র জাহানের রহমত হওয়ার দাবি করছে, আর অপরদিকে নিজেই বাজার থেকে সওদা খরিদ করে আনছে। তার কোন চাকরবাকরও নেই, যে জন্যে নিজেকেই সব কাজ করতে হয়।
তারা আরও বলে, এ কুরআন দু’টি প্রসিদ্ধ জনপদের (মক্কা ও তায়েফ) কোন বিশিষ্ট নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির উপর কেন নাযিল করা হলো না? (যুখরুফঃ ৩১)।
এ ধরনের কত অবান্তর কথা তারা নবী মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে বলতেই থাকে। আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে হলে তাকে অবশ্যই জীবনযাপনের যাবতীয় সামগ্রী, ধনদৌলত ও পদমর্যাদা লাভ অবশ্যই করতে হবে- এ ছিল তাদের বদ্ধমূল ধারণা। অতঃপর মক্কা বিজয়ের সেই শুভদিন যে বিপ্লব সংঘটিত করলো, তার ফলে তাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভংগির ভ্রম দূর হয়ে গেল।
তিনঃ গোটা জীবনে ইসলামের অনুসরণ
ইসলাম দুনিয়াকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্বস্রষ্টা মানুষকে বিনা উদ্দেশ্যে পয়দা করেননি। বরঞ্চ তাঁর দাসত্ব আনুগত্যের জন্যেই পয়দা করেছেন, যাকে ইসলামী পরিভাষায় ইবাদাত-বন্দেগী বলে। এ বন্দেগীর অর্থ গোটা জীবনকে আল্লাহতায়ালার হেদায়েত ও মর্জি অনুসারে পরিচালিত করা। এ বন্দেগী শুধু এমন নয় যে, ইবাদাতখানায় আল্লাহর কিছু পূজা-অর্চনা এবং সেইসাথে কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হবে, তারপর সমগ্র জীবন যেমন খুশি তেমনভাবে কাটিয়ে দেয়া হবে। এ আংশিক বন্দেগী আল্লাহতায়ালার সার্বিক ও নিরংকুশ আনুগত্যের অধিকারী হওয়ার মর্মকথার সাথে সংগতিশীল নয়। আর না এটা তাঁর নাযিল করা দ্বীন ও হেদায়েতনামার সাথে সামঞ্জস্যশীল। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম যখন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে খোদাপরস্তির বাস্তব প্রতিফলন দাবি করলো এবং মানুষের সকল চিন্তা-চেতনা ও কর্মের উপর সত্য ও সততার বন্ধন আরোপ করতে লাগলো তখন জাহেলিয়াতের ধারক-বাহকগণ বিস্ময় প্রকাশ করে বিদ্রুপবাণ ছুড়তে লাগলো। ধর্মের যে জাহেলী ধারণা তাদের মনমস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, এবং যেভাবে তারা ধর্মকে জীবনের এক অতিরিক্ত অংশ মনে করেছিল, তার মুকাবিলায় যখন তারা দেখলো যে, এ নতুন দ্বীন মনের স্বাধীনতার মোড়ে প্রহরী নিয়োগ করছে, পদে পদে পুরস্কার ও শান্তির সাহস শুনিয়ে দিচ্ছে, জীবনের বিভিন্ন সমস্যাগুলোকে একটা সুশৃংখল ও সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনার বন্ধনে বেঁধে দিচ্ছে এবং জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যা সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না, তখন এসব তাদের কাছে বর্বরতাই মনে হলো। যুগ যুগ ধরে তাদের ধর্ম-কর্ম এই ছিল যে, স্বহস্তে নির্মিত প্রতিমাগুলোকে কখনো কখনো সিজদা করতো, তাদের জন্যে উট ও ভেড়াছাগল উৎসর্গ করতো, উৎসর্গিত পশুর রক্ত পূজামন্দিরের দেওয়ালে লেপন করতো, কাবা ঘরের পাশে গিয়ে শিস ও হাততালি দিত, ধর্মীয় মেলা-পার্বণ ও রং তামাশা করতো। এ সবই ছিল তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তারপর জীবনের অবশিষ্ট সময়ে লুটতরাজ, হত্যা, ব্যভিচার, মদ্যপান, সুদী কারবার প্রভৃতি গর্হিত কাজে লিপ্ত থাকতো।
এ ছিল জাহেলিয়াতের ধর্ম সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা। জীবনের অতি সংকীর্ণ পরিসরে কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান (যদিও তা সুষ্ঠু ও মার্জিত চিন্তা ও যুক্তিভিত্তিক ছিল না) আর জীবনের বৃহত্তর পরিসরে ধর্মহীনতা এবং অনাচার-পাপাচারের অবাধ স্বাধীনতা। এটাকেই আধুনিক পরিভাষায় সেকিউলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলা হয়, এ চিন্তাধারা ও দর্শন জাহেলিয়াতের, ইসলামের নয়। নবী পরম্পরার সর্বশেষ নবী ও বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তাফার (সা) বিপ্লবী ঘোষণা এই ছিল যে, ইসলাম মানব জাতির জন্যে এক পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা। অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ও মুহূর্তে নিজেদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের অধীন করে দিতে হবে। সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিল্পকলা প্রভৃতি গড়ে উঠবে মানুষের স্রষ্টা ও প্রভু আল্লাহতায়ালার নিরংকুশ আনুগত্যের অধীনে। জাহেলিয়াতের অন্ধ পূজারীগণ এ কথা মেনে নিতে পারেনি। ইবলিস শয়তানেরও এটা মনঃপূত হতে পারে না। কারণ জীবনের সর্বক্ষেত্রে না হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে সে মানুষের আনুগত্য লাভের প্রত্যাশী। যে সব ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য অস্বীকার করা হবে, সেসব ক্ষেত্রে শয়তানের আনুগত্য ব্যতীত উপায় থাকবে না অথবা আল্লাহর স্থলে অন্য কারো আনুগত্য করতে হবে। আর গায়রুল্লাহর আনুগত্যকে সবচেয়ে বড় পাপ (শির্ক) বলা হয়েছে। জাহেলিয়াত মানুষকে শির্ক থেকে বেঁচে থাকতে দেয় না।
চারঃ মানব জাতির ঐক্য
ইসলাম বলে সকল মানুষ একই মা-বাপের সন্তান। আল্লাহ বলেন, “হে মানব জাতি! তোমাদের সেই প্রভুকে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে একটি ‘প্রাণ’ থেকে পয়দা করেছেন। তার থেকেই তার জুড়ি তৈরি করেছেন এবং উভয় থেকে দুনিয়ায় বহুসংখ্যক পুরুষ ও নারীও ছড়িয়ে দিয়েছেন”- (সূরা নিসাঃ ৩)।
যেহেতু সকল মানুষের মূল এক এবং সকলে পরস্পরে একই পরিবারের সদস্যের ন্যায় সে জন্যে বংশ, গোত্র, বর্ণ ও ভাষার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে কেউ উচ্চ ও নীচ অথবা কুলীন ও অকুলীন হতে পারে না। প্রকৃত ব্যাপার যখন এই তখন বর্ণ, বংশ, দেশ ও জাতীয়তার ভিত্তিতে কারো উপরে কারো শ্রেষ্ঠত্ব হতে পারে না। এর কোনটিই গর্ব অহংকারের কোন কারণ হতে পারে না। এ ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করে নবী মুহাম্মাদ (সা) ঘোষণা করেন- সকল মানুষ আদমের সন্তান এবং আদমকে মাটি থেকে পয়দা করা হয়- (তিরমিযী)।
তিনি আরও বলেন, “হে মানবজাতি! তোমাদের সকলের রব মাত্র একজন। একমাত্র খোদাভীরুতা ব্যতীত অন্য কোন কারণে কোন আরববাসীর শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোন আজমবাসীর উপর, না কোন আজমবাসীর কোন আরববাসীর উপর। আর না কোন কালো কোন সাদা থেকে শ্রেষ্ঠ এবং না কোন সাদা কোন কালো থেকে শ্রেষ্ঠ”- (বায়হাকী)।
নবীর এ বিপ্লবী ঘোষণা কোন খেয়ালী মতবাদ অথবা সুবিধাবাদপ্রসূত ছিল না। বরঞ্চ দৃপ্তকণ্ঠে একটি ঈমান ও আকীদার ঘোষণা ছিল। এমন সময়ের ঘোষণা যখন আরব অনারব নির্বিশেষে মানুষকে বর্ণ, বংশ ও গোত্রের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকে নিজেদেরকে অপর থেকে অতি উচ্চ ও অভিজাত মনে করতো এবং তাদের কাছে অপরের জান মালের কোনই মূল্য ছিল না। বংশীয় আভিজাত্যের গর্বে যারা গর্বিত ছিল, যারা অপরকে দাসানুদাস বানিয়ে রেখে তাদের রক্ত পানি করা শ্রমের বদৌলতে নিজেদের ভাগ্য গড়েছিল তারা এ বিপ্লবী ঘোষণা মেনে নিতে পারে কি করে? কিন্তু জাহেলিয়াতের অন্ধ আবেগে যারা সদা বিভ্রান্ত ছিল না, যাদের মধ্যে সামান্য বিবেক ও বুদ্ধিমত্তা ছিল, তারা এ বিপ্লবী ঘোষণার মধ্যে উপলব্ধি করলো মানবজাতির ঐক্য এবং মানবতার প্রকৃত মর্যাদা। আর ইসলামই মানবতার এহেন মর্যাদার একমাত্র ধারক ও বাহক।
জনৈক কুরাইশ কাফেরের দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ ছিলেন আবিসিনিয়ার বিলাল (রা)। তিনি ইসলামের বিপ্লবী কালেমা মনে প্রাণে মেনে নিয়ে মুসলমান হন। প্রভু উমাইয়া তার উপর দিনের পর দিন অমানুষিক ও লোমহর্ষক নির্যাতন চালাতে থাকে। সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশীয় আবু বকর (রা) অপ্রত্যাশিত অধিক মূল্যে বিলালকে খরিদ করে স্বাধীন করে দেন। একজন অকুলীন, একজন দাস, একজন ম্লেচ্ছ মানবতার মহান মর্যাদা লাভ করেন, বহুদিনের গড়া অসাম্যের প্রাচীর ভেঙ্গে সকলের সাথে সমান মর্যাদার অধিকারী হন। হযরত বিলাল (রা) ইসলামের একটি শক্তি-স্তম্ভই ছিলেন না; বরঞ্চ তিনি মুসলিম মিল্লাতের অতীব স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন চিরকাল। এমনি আরও অনেকে দাসত্বের শৃঙ্খল অতিক্রম করে নবী পাকের (সা) দরবারে অন্যান্যের মতো সমমর্যাদা লাভ করেছিলেন।
পাঁচঃ আইনের চোখে সকলে সমান
মানব জাতির ঐক্য ও সাম্যের স্বাভাবিক দাবি এই যে, আইনগত মর্যাদাও সকল মানুষের সমান। আইনের চোখে কেউ বড়ো, কেউ ছোট নয়। ইসলামের ঘোষণা- সকলের জান-মাল-ইজ্জত ও আব্রু সমান শ্রদ্ধার পাত্র। খোদার আইন সকলের উপর সমভাবে প্রযোজ্য। এ আইন মযলুম মানবতার বহুদিনের আর্তনাদ-হাহাকার দূর করে তাদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করে। কিন্তু জাহেলিয়াতের সন্তানেরা এ বিপ্লবী ব্যবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়ে। কারণ তাদের কায়েমী স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, তাদের মিথ্যা আভিজাত্যের গর্ব-অহংকারের প্রাসাদ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। যে প্রথা বহু শতাব্দী যাবত প্রচলিত ছিল তা এই যে, মানুষের মর্যাদা তার বংশ-গোত্র, ধনদৌলত ও পদমর্যাদার মাপকাঠিতে পরিমাপ করা হবে। কোন সম্ভ্রান্ত গোত্রের কোন ব্যক্তির জীবন কোন নিম্নতর গোত্রের বিশটি জীবনের সমান। কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে হত্যা করা হলে, তার বদলায় হত্যাকারীর সাথে তার গোটা পরিবারকে হত্যা করা হতো। এ অবিচারমূলক ব্যবস্থা শুধু কাফের ও মুশরিক সমাজেই প্রচলিত ছিল না, খোদার শরীয়তের দাবিদার আহলে কিতাবদের মধ্যেও সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল। তাদের একটা বিধান এমন ছিল যে, কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি চুরি করলে তাকে ছেড়ে দেয়া হতো। কিন্তু সাধারণ লোক চুরি করলে তার উপর শরীয়তের বিধান জারি করা হতো- (বুখারী, দ্বিতীয় খণ্ড; কিতাবুল হুদুদ)।
এরূপে কোন প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ব্যভিচার করলে তাকে বেত্রাঘাত করার এবং মুখমণ্ডল কালো করে দেয়ার শাস্তি দেয়া হতো। কিন্তু এই অপরাধ কোন সাধারণ মানুষ করলে তাকে শরীয়তের নির্দেশ অনুযায়ী প্রস্তরাঘাতে নিহত করা হতো। (তাফসীরে কুরতুবী)
ইসলাম যে আইনের শাসন কায়েম করে তার ঊর্ধ্বে কেউ থাকতে পারেনি। কাজী (বিচারক) স্বয়ং খলিফার বিরুদ্ধে রায় দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। আইনের এ সাম্য ও সুবিচার জাহেলিয়াতের অনুসারী কাফের-মুশরিক, আহলে কিতাব এবং অনেক নওমুসলিম যারা জাহেলিয়াতের প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি- মেনে নিতে পারেনি। তাদের আভিজাত্যের গর্ব-অহংকার তাদেরকে এ সুবিচারপূর্ণ খোদায়ী আইনের সামনে মাথানত করতে দেয়নি। দ্বিতীয় খলিফার শাসন আমলে জাবালা বিন আয়হাম গাসসানী নামক জনৈক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী নওমুসলিম হজ্বে এসেছিল। তাওয়াফের সময় তার চাদরের উপর তায়েফের এক ব্যক্তির পা পড়ে। সে ক্রোধান্বিত হয়ে তাকে এমন জোরে চপেটাঘাত করে যে, তার নাক কেটে রক্ত বেরোয়। হতভাগ্য তায়েফবাসী খলিফা হযরত ওমর (রা)-এর দরবারে নালিশ করে। খলিফা জাবালাকে সম্বোধন করে বলেন, “তুমি ঐ মযলুম ব্যক্তির কাছে কাকুতি-মিনতি করে ক্ষমা চাও। নতুবা বদলার জন্যে তৈরি হয়ে যাও।” জাবালার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। তার আভিজাত্যের অহংকার তাকে ইসলামের সাম্য ও সুবিচার মেনে নিতে দিল না। সে মনে করলো, যে আইনে সম্ভ্রান্ত ও অসম্ভ্রান্তের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় না, সে আইন বুদ্ধিবিবেক ও মানবতার অপমান করে। তারপর সে ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়।
ছয়ঃ জিহাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করা
ইসলাম যুদ্ধ-বিগ্রহের যে মহান উদ্দেশ্য বর্ণনা করে তার সাথে দুনিয়া পরিচিত ছিল না। আরব-অনারব সর্বত্রই মানুষ যুদ্ধ সম্পর্কে এ ধারণাই পোষণ করতো যে, রাজ্য প্রতিষ্ঠা, তার সম্প্রসারণ এবং মালে-গণিমত হাসিল করাই ছিল যুদ্ধের উদ্দেশ্য। কিন্তু ইসলাম এসে যুদ্ধের এ উদ্দেশ্য একেবারে বদলে দিল। ব্যক্তিগত ও জাতীয় স্বার্থে যুদ্ধ না হয়ে হতে হবে মানবতার কল্যাণের জন্যে এবং এভাবে যুদ্ধ অন্যায় রক্তপাত করার গর্হিত কাজ থেকে ইবাদাতের মর্যাদা লাভ করবে। ইসলাম ঘোষণা করলো যে, দেশ জয় এবং ধনসম্পদ লাভের জন্যে তরবারির ব্যবহার যুলুম, ফাসাদ এবং বিরাট পাপ। তা চরিত্র ও মানবতার জন্যে হলাহলস্বরূপ। তরবারি এ ধরনের গর্হিত কাজের জন্যে ব্যবহার না করে করতে হবে মানবতার কল্যাণের জন্যে, তার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্যে। তরবারি ধারণকারীর উদ্দেশ্য হবে খোদার সন্তুষ্টি লাভ করা, যিনি অকল্যাণ-অনাচার পছন্দ করেন না। তিনি চান যে দুনিয়ার বুক থেকে ফেৎনা-ফাসাদ, অনাচার-অশান্তি নির্মূল হয়ে যাক। একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই তরবারির ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত হবে। কোন পার্থিব স্বার্থে এর ব্যবহার সঙ্গত হবে না। সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত হবে যদি তা দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের জন্যে করা না হয়, বরঞ্চ করা হয় আখিরাতের কল্যাণের জন্যে। যুদ্ধে যদিও মূল্যবান জীবন বিনষ্ট হতে দেখা যায়, কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে যে যুদ্ধ, তার দ্বারা মানবতা জীবন লাভ করে। যুদ্ধের এই যে মহান ও কল্যাণকর উদ্দেশ্য ইসলাম বর্ণনা করেছে, এ উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এর নামকরণ করা হয়েছে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’।
সাহাবায়ে কেরাম (রা) এমন এক পরিবেশ থেকে ইসলামের আদর্শিক পরিবেশে প্রবেশ করেন যে, যুদ্ধের এ মহান উদ্দেশ্য তারা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন চিন্তা-চেতনার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। একটি দৃষ্টান্ত থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়। একবার হযরত আলী (রা) ইসলামের একজন দুশমনের মুকাবিলা করতে গিয়ে তাকে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন এবং বুকের উপর বসে তরবারি চালাতে উদ্যত হন। ঠিক এমন সময় সে ব্যক্তি হযরত আলীর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে। হযরত আলী (রা) তখন তাঁর হস্ত সংযত করেন এবং বুকের উপর থেকে নেমে আসেন। লোকটি বিস্মিত হয়ে হযরত আলীর এ আচরণের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি সত্যের জন্যে তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমার মুখে থুথু দেয়ার ফলে আমার ব্যক্তিস্বার্থ প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে আমাকে উত্তেজিত করে। এ অবস্থায় তোমাকে হত্যা করলে তা সত্যের জন্যে না হয়ে আমার ব্যক্তিস্বার্থের জন্যেই করা হতো এবং তা আমার জন্যে মন্দ পরিণাম বয়ে আনতো। তাই আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। এ একটি ঘটনা থেকে যুদ্ধের ইসলামী ধারণা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে এবং এ মানবীয় মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিতে সাধারণ সাহাবায়ে কেরামের মন-মানসিকতাও সহজেই অনুমান করা যায়। সাহাবায়ে কেরামের এ দলটি সর্বোচ্চ মানবীয় গুণাবলীতে ভূষিত ছিলেন এবং তাঁদের প্রত্যেকটি কাজকর্ম ছিল ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। নিঃস্বার্থতা এবং লিল্লাহিয়াতের তাঁরা ছিলেন মূর্ত প্রতীক। নবীপাকের সান্নিধ্যে থেকে তাঁর সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই তাদের মধ্যে এ গুণাবলী সৃষ্টি হয়েছিল। নবীপাক বার বার তাদেরকে এ কথা বলতেন যে, মালে গণিমত লাভের প্রত্যাশায় কেউ যুদ্ধে যোগদান করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য কোন প্রতিদান নেই। সুতরাং ব্যক্তিস্বার্থ বা মালে গণিমতের আশায় এসব খোদাপ্রেমিক কি করে নিজেদেরকে তাঁর সন্তুষ্টি থেকে বঞ্চিত করতে পারেন?
ব্যক্তি, দলীয় ও জাতীয় স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোন মহান উদ্দেশ্যে কোন দেশে কোন যুগে অতীতে ও বর্তমানে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে কি? একমাত্র ইসলামই যুদ্ধের উপরোক্ত মহান উদ্দেশ্য ও ধারণা মানব জাতির সামনে পেশ করেছে।
আল্লাহর পথে জান ও মালের ক্ষতি সত্যিকার লাভ
জাহেলিয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারণা অনুযায়ী যুদ্ধে জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতিকে প্রকৃত অর্থে ক্ষয়-ক্ষতি ও লোকসানই মনে করা হতো। ইসলাম এ সম্পর্কে এক বিপরীত ধারণা পেশ করে, যা জাহেলিয়াতের ধারক বাহকদের বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে। আল্লাহর পথে যুদ্ধে বা সংগ্রামে যারা জীবন দেয় তাদের জীবন বিনষ্ট হয় না। বরঞ্চ তাদের আত্মা দেহচ্যুত হওয়ার পর এক নতুন ও চিরন্তন জীবন লাভ করে। যুদ্ধে ধন-সম্পদ যা ব্যয় হয়- তা স্থূল দৃষ্টিতে বিনষ্ট মনে হলেও মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্যে তা সংরক্ষিত থাকে।
বিষয়টি সহজেই বোধগম্য হওয়ার কথা নয় বলে কতিপয় সাহাবীর মনেও বিষয়টি অস্পষ্ট ছিল। ওহুদের যুদ্ধে বহু সাহাবীর শাহাদাতের কারণে মুসলমানদের মধ্যে শোকের মর্সিয়া শুরু হয়। তাঁদের সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়-
“আল্লাহর পথে যারা নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত মনে করো না, বরঞ্চ তারা জীবিত। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে জীবিকা লাভ করছে”- (আলে ইমরানঃ ১৬৯)।
জীবনের দৈর্ঘ্য – দুনিয়ার কোন ফিতা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। জীবনের কোন শেষবিন্দু নেই। যাকে মৃত্যু বলা হয়ে থাকে, তা প্রকৃতপক্ষে জীবনের সমাপ্তি নয়, বরঞ্চ জীবনের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে স্থানান্তরের একটি প্রক্রিয়া। ঈমানদারদের এ কথাই মনে করা উচিত যে, স্থানান্তরের এ প্রক্রিয়া আপন শয্যার পরিবর্তে যদি জিহাদের ময়দানে হয়- তাহলে তা ধ্বংস না হয়ে এক চিরন্তন অনিন্দ্যসুন্দর জীবন দান করে। অতঃপর সে এমন এক মহান ও সুখময় জীবন-জীবিকার অধিকারী হয় যা কল্পনার অতীত।
নবীর একটি হাদীসে বিষয়টি সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মুসনাদে আহমাদে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তার সারবস্তু এই যে, যে ব্যক্তি নেক আমলসহ দুনিয়া ত্যাগ করে সে এমন এক আনন্দঘন জীবন উপভোগের সুযোগ লাভ করে যে, পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে আসার কোন বাসনাই পোষণ করবে না। কিন্তু শহীদান তার ব্যতিক্রম। তারা এ অভিলাষ পোষণ করে যে, পুনরায় তাদের দুনিয়ায় পাঠানো হোক যাতে খোদার পথে জীবন দেয়ার যে পরম আনন্দ- তা সে ভোগ করতে পারে। এ মহাসত্যটি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার পর একজন সত্যিকার মুমিন আল্লাহর পথে জীবন দেয়াকেই চরম ও পরম কাম্য মনে করে। আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী নয়, দুনিয়ায় ভোগ বিলাসই যাদের জীবনের কাম্য, EAT, DRINK AND BE MERRY- এ জীবনদর্শনে যারা বিশ্বাসী তারা মৃত্যুকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে। পক্ষান্তরে আল্লাহর জন্যে নিবেদিতপ্রাণ মুমিনগণ আল্লাহর পথে স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টিতে জীবন দিয়ে শাহাদাতের আবেহায়াত পানের জন্যে সর্বদা ব্যাকুল থাকে। জাহেলিয়াত ও ইসলাম জীবনের এই দুই বিপরীতমুখী ধারণা পেশ করেছে। নবী পাকের (সা) নিজহাতে গড়া সাহাবায়ে কেরাম জীবন মৃত্যুর এ ইসলামী ধারণাই পোষণ করতেন। মুষ্টিমেয় মুনাফিক ব্যতীত সকল সাহাবী শাহাদাতের অমৃত পানের আশায় ব্যাকুল থাকতেন। একটি দৃষ্টান্ত থেকে তাঁদের এ ঐকান্তিক অভিলাষের প্রমাণ পাওয়া যায়।
মক্কা বিজয়ের পর নিভৃত পল্লীর জনৈক অশিক্ষিত বেদুঈন বালক ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে চাচার দেয়া বিরাট সম্পদ পরিত্যাগ করে। অতঃপর মায়ের দেয়া একখানা কম্বল দু’টুকরো করে কোন রকমে সতর ও গা ঢেকে ইসলামের নবীর সাথে মিলিত হওয়ার অভিলাষে মদীনা যাত্রা করে। সারারাত্রি অজানা-অচেনা পথ চলার পর ভোর বেলায় মসজিদে নববীতে পৌঁছে যায়। শ্রান্ত-ক্লান্ত ও সারা দেহ ধুলিমলিন। উদ্ভ্রান্ত পাগলের মত দেখতে। পাগলই বটে। ইসলাম ও ইসলামের নবীর জন্যে পাগল হয়ে দুনিয়াকে জলাঞ্জলী দিয়ে মদীনায় হাজির হয়েছে। পথে প্রান্তরে, গিরি-কান্তারে, আকাশে-বাতাসে ইসলামের মধুর সুরধ্বনি তার কানে মধু বর্ষণ করেছে, নবী মুহাম্মাদের নাম শুনে উতলা হয়েছে। কিন্তু দেখেনি সে কোনদিন তার সে প্রেমাষ্পদকে। সারারাত মরুপথ অতিক্রম করে তাই সে এসেছে তার প্রিয়তমের দর্শনে।
বেলালের উচ্চকণ্ঠ- ‘আসসালাতু খায়রুম মিনান নাওম’ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হলো মদীনার ঘরদোর-গাছপালা ও পাহাড় পর্বতে। আগন্তুকের হৃদয়ের কুঠুরিতেও তা প্রতিধ্বনিত হলো।
একটু পরে রহমতের নবী বেরিয়ে এসে দেখলেন এক আগন্তুক দাঁড়িয়ে। কি যেন পাওয়ার আশায় আকুল। তার চোখমুখে যেন অফুরন্ত জিজ্ঞাসা, মন সত্যের পিপাসায় কাতর।
নবী (সা) স্নেহ ও দরদমাখা ভাষায় বললেন, ‘তুমি কে, কোথা থেকে এসেছ?’
আগন্তুকঃ আমার নাম আব্দুল ওয্যা। শুনেছি এক নতুন নবীর আবির্ভাব হয়েছে। তাঁর প্রেমে পাগল হয়ে এসেছি এতো দূরে। তারপর সে তার সমুদয় পারিবারিক ও বৈষয়িক অবস্থা বর্ণনা করলো।
নবীপাক বললেন, ‘খুব ভালো কথা, তুমি এখন থেকে আমার খাস মেহমান। তুমি আহলে সুফফার একজন। তবে তোমার নাম আজ থেকে আব্দুল্লাহ।’
নবী (সা) সাহাবায়ে কেরামকে বিশেষ তাকীদ সহকারে বললেন, ‘এর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আমার। তোমরা তাকে কুরআন ও ইসলামের তালীম-তরবিয়াত দাও।’
একবার মসজিদে কিছু লোকের নামাযের সময় আব্দুল্লাহ উচ্চস্বরে কুরআন পড়া শিখছিলেন। হযরত ওমর (রা) তাঁকে কড়া ধমক দিয়ে বললেন, ‘আস্তে পড়, দেখ না নামায হচ্ছে?’
রহমতের নবী (সা) হযরত ওমরের কণ্ঠ শুনে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘ওমর! ওকে কিছু বলো না। সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্যে সবকিছু কুরবানী করে এসেছে।’
তার কিছুকাল পরেই তবুকের অভিযানের প্রস্তুতি চলতে লাগলো। নবীর আহ্বানে আল্লাহর পথে দানের প্রতিযোগিতা শুরু হলো সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে। হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) তাঁর যাবতীয় সম্পদ নিয়ে হাজির হলেন নবীর দরবারে।
আব্দুল্লাহ এসব দানের প্রতিযোগিতা দেখেন। কিন্তু তাঁর দুঃখ যে এ প্রতিযোগিতায় তিনি অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। কারণ তিনি যে নিঃস্ব এবং নবীজীর পোষ্য।
আব্দুল্লাহ নীরব থাকতে পারলেন না। তিনি নবীকে বললেন, “হে আল্লাহর রসূল! আপনি তো জানেন আমার দেবার কিছুই নেই। আছে শুধু এ দেহ ও প্রাণ। আমি তা-ই আল্লাহর জন্যে সোপর্দ করলাম। দোয়া করুন যেন শহীদ হতে পারি।”
নবী মুহাম্মাদ (সা) তিরিশ হাজার মুজাহেদীনের এক বাহিনী নিয়ে তবুকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। আব্দুল্লাহও সংগে রয়েছেন। কিন্তু তিনি শাহাদাতের প্রেরণায় এতোটা অস্থির ও ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন যে, পথে একস্থানে নবীর সামনে হাজির হয়ে বলেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি হাত তুলে একটু দোয়া করুন যেন এ যুদ্ধে আমি শহীদ হতে পারি।”
নবী তাঁর আন্তরিক জযবা বুঝতে পেরে বললেন, “দেখতো আশে-পাশের কোথাও থেকে কোন গাছের ছাল আনতে পার নাকি?”
আব্দুল্লাহ গাছের ছাল সংগ্রহ করে দিলেন, নবী (সা) সেটা আব্দুল্লাহর হাতে বেঁধে দিয়ে দোয়া করলেন, “আয় আল্লাহ! আব্দুল্লাহর খুন কাফেরদের জন্যে হারাম করে দাও।”
আব্দুল্লাহ এ দোয়া শুনে ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, “হে আল্লাহর রসূল! আমি তো শহীদ হতে চাই, এ দোয়া করলেন কেন?”
নবী বললেন, “আব্দুল্লাহ! এর পরে তুমি যদি জ্বর হয়েও মর, তুমি হবে সত্যিকার শহীদ।”
মুজাহিদ বাহিনী তবুক নামক স্থানে পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন। হঠাৎ সন্ধ্যার পর খবর রটলো যে, আব্দুল্লাহ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেছেন। খবরটি নবীর কানে পৌঁছামাত্র তিনি দাফনের ব্যবস্থা করতে বললেন।
তবুকের ময়দান। অন্ধকার রাত। হযরত আব্দুল্লাহর জন্যে কবর তৈরি হয়ে আছে। হযরত বেলাল (রা) মশাল হাতে দাঁড়িয়ে কবর ও তার পাশ আলোকিত করে রেখেছেন। একজন কবরে নেমেছেন মাইয়্যেতকে ধরে শুইয়ে দেবার জন্যে। দু’জন মিলে মাইয়্যেতকে কবরে নামিয়ে দিচ্ছেন। কবরের মধ্যে দাঁড়ানো ব্যক্তি ধমকের স্বরে উক্ত দু’জনকে বলছেন, “আদাবান ইলা আখাকুমা- তোমাদের ভাইকে ভক্তি শ্রদ্ধার সাথে কবরে নামিয়ে দাও”।
কবরে মাইয়্যেত নামিয়ে দিচ্ছেন নবীর পর মিল্লাতের শ্রেষ্ঠতম দু’ব্যক্তি হযরত আবু বকর (রা) এবং হযরত ওমর (রা)। কবরের ভেতর দাঁড়িয়ে ধমকের স্বরে বলছেন শহীদ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহর স্নেহশীল অভিভাবক স্বয়ং রহমতের নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
মাইয়্যেতকে যথারীতি শুইয়ে রেখে নবী পাক (সা) উপরে উঠে এসে সকলকে বললেন, তোমরা সব সরে যাও।
সাহাবীগণ ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে চারদিকে সরে দাঁড়ালেন। নবীপাক নিজে তাঁর মুবারক হাত দিয়ে চারদিক থেকে বালি, পাথর ও মাটি দিয়ে কবর ঢেকে দিলেন। তারপর হাত তুলে দোয়া করলেন, “পরওয়ারদেগার! আমি আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আব্দুল্লাহর প্রতি খুশি ছিলাম। তুমিও তার প্রতি খুশি থাক।”
হাদীস বর্ণনাকারী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বলেন, আমার মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কথাগুলো বেরিয়ে গেল- ‘এ কবরে আব্দুল্লাহ না হয়ে যদি আমি হতাম’।
শাহাদাতের মর্যাদাকে সাহাবীগণ এভাবেই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। এ মর্যাদা কোনদিন ম্লান হয়নি। যুগে যুগে আল্লাহর সৈনিকদেরকে শাহাদাতের এ প্রেরণা অকাতরে আল্লাহর জন্যে জীবন দিতে উদ্বুব্ধ করেছে। ইসলামের ইতিহাসে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আধুনিককালে মুসলমানদের চরম অধঃপতনের যুগেও দ্বীন ইসলামের মুজাহিদগণ আল্লাহর পথে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেয়াকে তাদের চরম ও পরম পাওয়া বলে মনে করেন। বৃহৎ পরাশক্তি রাশিয়ার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে আফগান মুজাহেদীন শাহাদাতের অমৃত পানের আশায় জীবন দিচ্ছেন স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্ট চিত্তে। তাঁদের এ শাহাদাতের বিনিময় তাঁরা মৃত্যুর পরজীবনেই শুধু লাভ করবেন না, এখানেও তাঁদের বিজয় সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে সকলের ধারণা।
অর্থ ও ধন সম্পদ ব্যয়ের ব্যাপারেও ইসলাম ও জাহেলিয়াতের ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। জাহেলিয়াতের চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, চেষ্টা-চরিত্র, আশা-আকাংখা শুধুমাত্র দুনিয়ার জীবনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। দুনিয়ার জীবনের পর আরেকটি জীবন আছে, জাহেলিয়াত এ কথা স্বীকার করে না। তাই দুনিয়ার জীবনকে সুখী ও সুন্দর করার, জীবনকে কানায় কানায় উপভোগ করার, সম্মান, খ্যাতি, ক্ষমতা, পদমর্যাদা, কর্তৃত্ব-প্রভুত্ব লাভ করার জন্যে জাহেলিয়াত মানুষকে সদা কর্মতৎপর রাখে। অবশ্য স্বাভাবিকভাবে এসব যে মানুষের লালসার বস্তু তাতেও কোন সন্দেহ নেই। তবে এসবের চেয়েও মহত্তর বস্তু আছে যা মানুষের কাম্য হওয়া উচিত। যেমন কুরআন বলে-
“মানুষের জন্যে তাদের মনঃপূত জিনিস নারী, সন্তান, সোনাচাঁদির স্তূপ, উৎকৃষ্ট ঘোড়া, গৃহপালিত পশু ও ক্ষেতখামার বড়োই আনন্দদায়ক ও লালসার বস্তু বানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ সবকিছু প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র”- (আলে ইমরানঃ ১৪)।
দুনিয়ার এসব লালসার বস্তুর অত্যধিক মোহে জাহেলিয়াতের পতাকাবাহী ও তাদের অনুসারীগণ মৃত্যুর পরবর্তী চিরন্তন জীবনকে ভুলে যায়।
আল্লাহ বলেন- “প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর (আখিরাত সম্পর্কে) প্রতিশ্রুতি একেবারে সত্য। অতএব এ দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারিত করে না রাখে, আর না প্রতারক (শয়তান) তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকা দিতে পারে”- (লুকমানঃ ৩৩)।
উপরে সূরা আলে ইমরানের ১৪ আয়াতে যেসব লালসার বস্তুর উল্লেখ করা হয়েছে তা সব মানুষের পরীক্ষার জন্যে দেয়া হয়েছে। এ সব প্রতারণার সামগ্রী মাত্র। এসব সামগ্রী স্থূলদৃষ্টিসম্পন্ন লোকদেরকে নানান বিভ্রান্তিতে লিপ্ত করে। এ বিভ্রান্তির ফলে কেউ মনে করে এ দুনিয়ার জীবনের পর আর কোন জীবন নেই। অতএব যতো পার এবং যেভাবে পার দুনিয়াকে উপভোগ কর। তার জন্য কোথাও কারো কাছে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। কেউ ক্ষমতা মদমত্ত হয়ে মনে করে তার ক্ষমতা, প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, বিলাসবহুল জীবন যাপন ও অবাধ আনন্দ-সম্ভোগ কোনদিন শেষ হবার নয়, কেউ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক উপেক্ষা করে শুধুমাত্র বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা ও আনন্দ-উচ্ছল জীবন যাপনকে জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নেয়। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ব্যতীত জীবনের আর কোন উদ্দেশ্য থাকে না। তার ফলে মনুষ্যত্বের মান যতোই হীন ও ঘৃণ্য হোক না কেন, তার কোন পরোয়াই সে করে না। কেউ মনে করে, জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই সত্য-মিথ্যা, হক ও বাতিলের প্রকৃত মানদণ্ড। যে নীতি ও পন্থা-পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করলে অভীষ্ট বস্তু লাভ করা যায় তাই সত্য, তার বিপরীত সবই মিথ্যা। কেউ আবার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখী জীবন যাপনকে খোদার প্রিয়পাত্র হওয়ার নিদর্শন মনে করে। তার বিশ্বাস, যার জীবন যতো সুখের তা যে কোন অবৈধ আয়েই হোক না কেন, সে খোদার প্রিয়পাত্র। আর যার দুনিয়ার জীবন বড়ো দুঃখ-কষ্টের- তা ন্যায়নীতি ও সত্যসঠিক পথে থাকার কারণে হলেও- আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট এবং তার পরিণামও খারাপ হতে বাধ্য। এ ধরনের যতো ভ্রান্ত ধারণা তা বৈষয়িক জীবনের প্রতারণা বলে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন।
উল্লেখ্য যে, সূরা লুকমানের উপরোক্ত আয়াতটিতে মানুষকে যে প্রতারণা থেকে আত্মরক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা আসে দুনিয়ার চাকচিক্যময় জীবন ও শয়তানের পক্ষ থেকে। দ্বিতীয় স্থানে কুরআনে ‘গারুর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘গারুর’ বলতে শুধু ইবলিস শয়তানকেই বুঝানো হয়নি, ইবলিসের অনুসারী জ্বিন এবং মানুষকেও বুঝানো হয়েছে। বুঝানো হয়েছে জাহেলিয়াতের ধারক-বাহক ব্যক্তি, দল-গোষ্ঠী ও গোত্রকে; জাহেলিয়াতের শিক্ষা ব্যবস্থা, সমাজ, শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও পরিবেশকে। এ সবকিছুই মানুষকে ইসলাম থেকে জাহেলিয়াতের অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায়। মানুষের তৈরি নানান ভ্রান্ত মতবাদ ও দর্শন মানুষকে বিভ্রান্ত করে। তাদের মন থেকে খোদা ও আখিরাতের বিশ্বাস মুছে ফেলে দেয়। সমাজ থেকে ন্যায়, সততা, সত্যবাদিতা, দয়া, স্নেহ, ভালোবাসা, পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা, সুবিচার, জান-মাল-ইজ্জত-আব্রুর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন মানুষের সমাজ আর মানুষের সমাজ থাকে না; হিংস্র পশুর সমাজে পরিণত হয়।
দুনিয়া ও জীবন সম্পর্কে উপরোক্ত ভ্রান্ত ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে সম্পদ বৃদ্ধি ও জীবনের মান উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রাখে। অর্থ ব্যয় সম্পর্কে তাদের নীতি এই হয় যে, যে কাজে এবং যে পথে অর্থ ব্যয় করলে নগদ মুনাফা লাভ করা যেতে পারে, শুধু সে পথেই তারা অর্থ ব্যয় করবে। আল্লাহর পথে ব্যয় করা দু’টি কারণে সে পছন্দ করে না। প্রথম কারণ এই যে, এ ব্যয় নগদ বা তাৎক্ষণিক কোন মুনাফা লাভের কোন নিশ্চয়তা দেয় না। দ্বিতীয়তঃ আখিরাতকে সে বিশ্বাসই করে না। অতএব সেই অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব আখিরাতের জন্য অর্থ ব্যয় করা সে নির্বুদ্ধিতা ও অপচয় মনে করে। এ ধারণা-বিশ্বাস একেবারে জাহেলিয়াতের চিন্তাধারার ফসল। অবশ্যি ইসলামের প্রতি ঈমান আনার পরও যাদের ঈমান ততোটা মজবুত হয়নি অথবা জাহেলিয়াতের চিন্তাধারার প্রভাব পুরোপুরি কেটে উঠতে পারেনি তারাও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “খোদার পথে সম্পদ ব্যয় করতে থাক এবং নিজেদের হাতেই নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না”- (বাকারাঃ ১৯৫)।
এ কথার মর্ম এই যে, তোমরা যদি আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের জন্যে সম্পদ ব্যয় না কর এবং তাকে জীবনের প্রিয়তম বস্তু মনে করে সঞ্চিত রাখ, তাহলে তা তোমাদের দুনিয়ার জন্যেও ধ্বংসের কারণ হবে এবং আখিরাতের জন্যেও। দুনিয়ায় তোমরা গোলামির জীবন যাপন করবে এবং আখিরাতে জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে।
সাতঃ আল্লাহর পথে ব্যয়
আল্লাহর পথে ব্যয় অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনকে একটি বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার জন্যে আল্লাহতায়ালা বার বার মানুষের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এ ব্যয় সম্পর্কে এক নতুন ধারণা দেয়া হয়েছে। তা হলো এই যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে তাঁর পথে যে অর্থসম্পদ ব্যয় করা হবে তা স্থূলদৃষ্টিতে ব্যয়িত হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ব্যয়িত ও ক্ষয়িত হয় না। বরঞ্চ তা ব্যয়কারীর পরবর্তী জীবনের সঞ্চয় খাতে (Saving Account) সঞ্চিত থাকে এবং কয়েকগুণ বর্ধিত আকারে ফেরত দেয়া হবে অর্থাৎ তার বিনিময়ে তত পরিমাণে প্রতিদান দেয়া হবে। এ কথাটিই কুরআন পাকের বহু স্থানে বলা হয়েছে।
“এবং নামায কায়েম কর। যাকাত দাও। আর আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিতে থাক। যা কিছু ভালো ও কল্যাণ তোমরা নিজেদের জন্যে অগ্রিম পাঠিয়ে দেবে তা আল্লাহর নিকট সঞ্চিত মওজুদরূপে পাবে। এটাই অতীব উত্তম। আর তার শুভ প্রতিফলও অতি বিরাট”- (মুযযাম্মিলঃ ২০)।
“এবং (হে মুসলমানগণ) খোদার পথে লড়াই কর এবং খুব ভালো করে জেনে রাখ যে, আল্লাহ সবকিছু শুনেন এবং সবকিছু জানেন। তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে আল্লাহকে কর্জে হাসানা (উত্তম ঋণ) দিতে প্রস্তুত। তাহলে আল্লাহ তাকে কয়েকগুণ বেশি ফিরিয়ে দেবেন”- (বাকারাহঃ ২৪৪-২৪৫)।
উপরের আয়াতগুলোতে কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ দানের মর্ম হচ্ছে, নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে তাঁর পথে অর্থসম্পদ ব্যয় করা। তার আগে খোদার পথে লড়াই-এর কথাও বলা হয়েছে। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে যে লড়াই অপরিহার্য তার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ অবশ্যই সংগ্রহ করতে হয়। এ উদ্দেশ্যে যারা অর্থসম্পদ ব্যয় করে তাদের এ ব্যয়কে আল্লাহ তাঁর নিজের জন্যে কর্জে হাসানা বলে গ্রহণ করেন এবং তা কয়েকগুণে অধিক ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন। একথা ঠিক যে, আল্লাহতায়ালার অর্থের কোনই প্রয়োজন নেই। তিনি কোন কিছুর জন্যে কারো মুখাপেক্ষী নন। বরঞ্চ প্রতিটি সৃষ্টি প্রতি মুহূর্তে তাঁর করুণার মুখাপেক্ষী। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ করা। এ মহান উদ্দেশ্যে অর্থসম্পদ ব্যয় করা প্রকৃতপক্ষে মানবকল্যাণের জন্যেই করা হচ্ছে। এ কাজকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়ার জন্যেই আল্লাহ একে তাঁর জন্যে কর্জে হাসানা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কুরআন পাকে আরও বলা হয়েছে-
“এমন কে আছে যে আল্লাহকে কর্জ দেবে- কর্জে হাসানা? আল্লাহ তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে ফেরত দিতে পারেন এবং তার জন্যে (ঋণদাতার জন্যে) অতীব উত্তম প্রতিফল রয়েছে”- (হাদীদঃ ১১)।
এ ঋণদান প্রসংগে আল্লাহতায়ালা দু’টি ওয়াদা করেছেন। একটি এই যে তিনি তা কয়েকগুণ বেশি করে ফেরত দেবেন। আর দ্বিতীয় এই যে, তিনি নিজের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত উত্তম প্রতিফলও দান করবেন।
আল্লাহতায়ালার এ ওয়াদা কত হৃদয়গ্রাহী, কত আকর্ষণীয়। আর তিনি যে তাঁর ওয়াদা পুরোপুরি পালন করবেন এ দৃঢ় প্রত্যয় প্রত্যেক মুমিন অবশ্যই পোষণ করে।
এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। উপরোক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর তা যখন সাহাবীগণ নবীপাকের (সা) যবান মুবারক থেকে শুনতে পেলেন, তখন সাহাবী হযরত আবুদ দাহদাহ আনসারী (রা) আরজ করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ কি আমাদের নিকট থেকে ঋণ চান?
হুযুর (সা) জবাবে বললেন, হে আবুদ দাহদাহ! হাঁ, তিনি ঋণ চান।
আবুদ দাহদাহ বলেন, আপনার হাতখানা আমাকে একটু দেখান তো।
নবী পাক (সা) তাঁর হাতখানা উক্ত সাহাবীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। নবীর মুবারক হাতখানা সাহাবী তাঁর হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন- আমি আমার বাগানখানি আমার খোদাকে ঋণ দিলাম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, সে বাগানে ছয়শত উৎকৃষ্ট খেজুরের গাছ ছিল। সে বাগানের মধ্যেই উক্ত সাহাবীর বাড়ি ছিল যার মধ্যে তিনি তাঁর পরিবারসহ বাস করতেন। নবীর সাথে উপরোক্ত কথা বলার পর হযরত আবুদ দাহদাহ (রা) সোজা আপন ঘরে গিয়ে পৌঁছলেন। স্ত্রীকে ডেকে বললেন, দাহদাহর মা! ঘর থেকে বেরিয়ে এসো। আমি এ বাগান আমার খোদাকে ঋণ দিয়েছি।
তাঁর স্ত্রী বললেন, দাহদাহর পিতা! তুমি এটা করে খুবই মুনাফার কারবার করেছ। তারপর তাঁরা তাঁদের যাবতীয় আসবাবপত্র, লটবহর এবং সন্তান-সন্ততিসহ বাগান থেকে বেরিয়ে যান- (ইবনে আবি হাতেম)।
আল্লাহর পথে এমন সর্বস্ব দানের কোন দৃষ্টান্ত ইসলাম ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যাবে কি? জাহেলিয়াত তো ঠিক এর বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। জাহেলিয়াতের প্রধান প্রবক্তা ও সর্বাধিনায়ক ইবলিস শয়তান ও তার অনুচরবৃন্দ এ ধরনের দানকে নির্বুদ্ধিতা ও দারিদ্র্যের কারণ বলে তার থেকে মানুষকে বিরত থাকতে বলে।
আল্লাহতায়ালা যখন মুমিন বান্দাদেরকে এ ধরনের ত্যাগের জন্যে উৎসাহিত করেন, তখন শয়তান ও তার অনুসারীগণ বলে, অবাস্তব ও মিথ্যা আশায় ধন-সম্পদ অপচয় করে দারিদ্র্যের অভিশাপ টেনে এনো না। বরঞ্চ জীবনকে উপভোগ করার জন্যে অর্থসম্পদ ব্যয় কর। কারণ মৃত্যুর পরে আর উপভোগ করার কোন সুযোগ হবে না।
“শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের কথা বলে ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কর্মকাণ্ড করতে প্রলোভিত করে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের আশা প্রদান করেন”- (বাকারাহঃ ২৬৮)।
বৈধ-অবৈধ উপায়ে অঢেল সম্পদের মালিক যারা, তাদের কাছে কোন মহৎ কাজের জন্যে, ইসলামের সমুন্নতির জন্যে, ওয়াজ মাহফিল, সীরাত মাহফিল, ইসলামী সম্মেলন, পাপাচার-অনাচার বন্ধের জন্যে অর্থ সাহায্য চাইলে তারা অক্ষমতা প্রকাশ করে। অথচ তারা ছেলেমেয়ের বিয়ে-শাদীর জন্যে, নাচ-গান ও বিভিন্ন অপসংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্যে, নৈতিক মেরুদণ্ড ধ্বংসকারী অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক ছায়াছবির জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে কোন কুণ্ঠাবোধ করে না। এ সবকিছুই জাহেলিয়াতের চিন্তাধারা ও মনমানসিকতার ফসল। তাদের সকল চেষ্টা-চরিত্র এবং চাওয়া-পাওয়া দুনিয়ার জীবনকে কেন্দ্র করেই। তারা দুনিয়ায় যা পেতে চায় তার সবটুকু না হলেও অনেক কিছুই আল্লাহ তাদেরকে দেন। কিন্তু আখিরাতে তাদের প্রাপ্য কিছুই থাকে না। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা একথা কুরআনে ঘোষণা করেছেন।
অপরদিকে জাহেলিয়াতের মুকাবিলায় ইসলাম জীবন সম্পর্কে ধারণা ও দৃষ্টিভংগি সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেয়। দুনিয়া ও আখিরাতের জীবন মিলেই মানুষের পূর্ণাংগ জীবন। দুনিয়ার জীবন আখিরাতের জীবনের কর্মক্ষেত্র। দুনিয়ার জীবনের কর্মফলই আখিরাতে মানুষ ভোগ করবে। আখিরাতের জীবনকে সুখী ও সুন্দর করার জন্যে ইসলাম পরিপূর্ণ কর্মসূচি পেশ করেছে এবং প্রতিটি কর্মে আখিরাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ বিশ্বাস যার পাকাপোক্ত সে আখিরাতের জন্যেই তার দুনিয়ার জীবন, তার ধন-সম্পদ সবকিছুই বিলিয়ে দেবে। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এ বিশ্বাস ও তার ভিত্তিতে মন-মানসিকতা ও চরিত্র তৈরি হয়েছিল। ইসলামের জন্যে যখন যে ধরনের ত্যাগের প্রয়োজন হয়েছে, তাঁরা অকাতরে সে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নবম হিজরীতে লক্ষাধিক রোমীয় সৈন্যের নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের উপর আক্রমণের সংবাদে নবী (সা) যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তবুক প্রান্তরে শত্রুর মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
যুদ্ধের জন্যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তার জন্যে নবী আহবান জানালেন। জিহাদের প্রেরণা তীব্রতর করার জন্যে কুরআন-এর সূরার কিয়দংশ নাযিল হলো। সাহাবীদের মধ্যে অর্থ ও যুদ্ধের উপকরণ সরবরাহের প্রতিযোগিতা শুরু হলো। হযরত ওমর (রা) তাঁর সমুদয় সম্পদ দু’ভাগ করে এক ভাগ জিহাদ ফান্ডে দান করলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) তাঁর সর্বস্ব এনে হাজির করলেন। তা দেখে নবী (সা) বললেন, ‘মা আবকায়তা লে আহলিকা ইয়া আবা বাকার?’ ‘আবু বকর! তোমার পরিবারের জন্যে কি রেখেছ?’
“আমার পরিবারের জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রসূল ছাড়া আর কিছুই নেই”- অম্লান মুখে জবাব দিলেন সিদ্দীকে আকবর (রা)।
এই হলো ইসলামের মহান শিক্ষা, চরিত্র ও ত্যাগ। তারা দুনিয়ার জীবনও সামগ্রিকভাবে বিলিয়ে দিয়েছেন আখিরাতের জীবনের জন্যে।