ইসলামের একরূপতা ও একমুখীনতা
ইসলামের মেজাজ-প্রকৃতি হচ্ছে একেবারে একমুখো। সকল দিক, সকল আদর্শ, মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহমুখী হওয়াই ইসলামের দাবি। ইসলাম ও তার অনুসারীদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মে একই রং ও সাদৃশ্য দেখতে চায় যা তাদের মধ্যে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা সৃষ্টি করবে। বাইরের কোন আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও ধ্যান-ধারণার কোন সামান্যতম সংমিশ্রণ ইসলাম বরদাশত করে না। সে এতোটা সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি মনে করে যে, সে জাহেলিয়াতপন্থীদের ওসব রসম-রেওয়াজ ও আচার-অনুষ্ঠানও গ্রহণ ও পালনের অনুমতি দেয় না, যার মধ্যে শির্ক-কুফর ও পাপাচারের কোন কিছু দেখা যায় না। যা শুধু গতানুগতিক বা প্রচলিত ধারার অনুবর্তী। ভিন্ন জাতির কোন কিছু বলে অথবা কোন জিদের বশবর্তী হয়ে এ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে তা নয়। বরঞ্চ দ্বীনের একটা বিশেষ তাৎপর্য, উদ্দেশ্য ও দূরদর্শিতার জন্যে এ সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাৎপর্য এই যে, ইসলামের অনুসারীদের চিন্তা ও কাজের দিক দিয়ে একমাত্র আল্লাহমুখী হওয়ার প্রবণতা যেন সংরক্ষিত থাকে। এমনটি যেন না হয় যে, জাহেলিয়াতের ছোটোখাটো কোন নির্দোষ বস্তু অনুকরণ করা হলো, এবং পরবর্তীকালে এ অনুকরণপ্রিয়তা জাহেলিয়াতের চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে গোমরাহির পথ প্রশস্ত করে দিল। এ আশংকা কোন কাল্পনিক আশংকা নয় বরঞ্চ বাস্তব। মানবীয় মনস্তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতা অতীতে এর বহু দৃষ্টান্ত পেশ করেছে।
এ এমন এক গূঢ় তত্ত্ব যে সাধারণতঃ মানুষের অন্তর্দৃষ্টি সেখানে পৌঁছতে পারে না। এমন কি কতিপয় সাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের দৃষ্টান্ত আছে। হযরত আবু ওয়াকেদ লায়সী (রা) বলেন, নবী করীম (সা) যখন হুনায়েনের সিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন মুসলিম সেনাবাহিনীকে একটি বিশেষ গাছের পাশ দিয়ে যেতে হয়েছিল যাকে ‘যাতে-আনওয়াত’ বলা হতো। একথা প্রচলিত ছিল যে, মুশরিকগণ এ গাছে তাদের অস্ত্রশস্ত্র লটকিয়ে রাখতো। তা দেখে কতিপয় মুসলমান বললেন, “হে আল্লাহর রসূল! মুশরিকদের যেমন ‘যাতে আনওয়াত’ রয়েছে, তেমনি আমাদের জন্যে একটি ‘যাতে আনওয়াত’ নির্ধারিত করে দিন।”
নবীর সংগী-সাথী সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেছিলেন- নবী (সা) তাঁদের জন্যে যে কোন একটি গাছ নির্দিষ্ট করে দিলে তার উপরে তাঁদের যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখবেন। এটাকে তারা দূষণীয় মনে করেননি। এ কাজের মধ্যে শির্ক-কুফরেরও কোন গন্ধ ছিল না। এসব চিন্তা করেই তাঁরা নবীকে উপরোক্ত অনুরোধ জানান। তাঁদের এ ধরনের চিন্তায় কোন ত্রুটি ছিল বলেও তো মনে করা যায় না। কিন্তু নবীর সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি এ সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল যে এভাবে মুসলমানদের মধ্যে এমন এক মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে যে, জাহেলিয়াতের ভ্রান্ত চিন্তাধারা থেকে যতোটা পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার তা আর থাকবে না। দ্বীনের যে আল্লাহমুখী মেজাজ প্রকৃতি তার সাথে এ ধরনের আবেদনের কোন মিল দেখা যায় না। এ কারণেই নবী পাক (সা) তাঁদের আবেদনের জবাবে বলেন, “সুবহানাল্লাহ! এতো ঠিক সেই ধরনের কথা যেমন মুসার (আ) লোকজন তাঁকে বলেছিল- আমাদের জন্যেও একটি প্রতিমা বানিয়ে দাও, যেমন তাদের অনেক প্রতিমা রয়েছে।” তিরমিযী শরীফে এ ঘটনা বিবৃত করা হয়েছে।
বনী ইসরাঈলের উপরোক্ত আবেদন এবং নবীর সাহাবীদের আবেদনের মধ্যে তো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তথাপি তাদের সাথে এদের আবেদনকে একইরূপ মনে করার কারণ এ ছাড়া আর কিছু ছিল না যে, এ আবেদনের পেছনে যে মানসিকতা ছিল তা ক্রমশঃ বিশ্বাসমূলক ও বাস্তব কুফল বয়ে আনতে পারে এবং জাহেলিয়াতপন্থীদের দৃশ্যতঃ একটা নির্দোষ ও সাদাসিধে প্রচলন-পদ্ধতির অনুসরণ জাহেলিয়াতের চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড অনুসরণের প্রবণতা সৃষ্টি করতে পারে। এজন্যে দূরদর্শী ও সূক্ষ্মদর্শী নবী উপরোক্ত কথা বলার পর এ আশংকা করে ভবিষ্যদ্বাণীও করেন। তিনি বলেন-
“সেই সত্তার কসম যাঁর মুষ্ঠির মধ্যে আমার জীবন, তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের আচরণ অনুসরণ করবে”- (তিরমিযী)।
নবীর এ ভবিষ্যদ্বাণীতে ‘তোমরা’ বলতে সাহাবায়ে কেরামকে বুঝানো হয়নি, পরবর্তীকালের মুসলমানদের বুঝানো হয়েছে। ‘পূর্ববর্তীদের’ বলতে বুঝানো হয়েছে ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে। নবী পাক (সা) এ কথাই বলতে চেয়েছেন- আজ তো আমি তোমাদেরকে এ চিন্তার ভ্রান্তি ও তার ভয়াবহ পরিণাম থেকে রক্ষা করব। কিন্তু ভবিষ্যতে যখন মুসলমানদের ঈমানী অনুভূতি দুর্বল হয়ে পড়বে; তখন জাহেলিয়াতের প্রভাব বাড়তে থাকবে। ফলে যেভাবে ইহুদী ও নাসারা জাহেলিয়াতের অনুপ্রবেশের পথ উন্মুক্ত করতে থাকে, মুসলমানরাও তা-ই করবে।