বিশ্বনবীর আগমন
ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মক্কা শহরে আবির্ভূত হলেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখন আরবসহ সারা বিশ্ব ছিল জাহেলিয়াতের ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত।
নবী মুস্তাফাকে (সা) আল্লাহতায়ালা মানবজাতির জন্যে সর্বশেষ নবী হিসেবে প্রেরণ করেন এবং মানবজাতির জন্যে তাঁর সর্বশেষ হেদায়েতনামা তথা পথনির্দেশনা পাঠান। সর্বশেষ নবী এবং সর্বশেষ হেদায়েতনামা এ কথাই প্রমাণ করে যে, মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য একটি পূর্ণাংগ দ্বীন বা জীবন-বিধানই উপস্থাপিত করা হয়। এ কারণেই দ্বীনের নাম রাখা হয় ‘আল ইসলাম’ যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার জন্যে অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আল কুরআনের দাওয়াত উপস্থাপনের সহজ বোধগম্য প্রকাশভঙ্গিমা।
কুরআন তার দাওয়াত উপস্থাপনে আদেশব্যঞ্জক ভাষার পরিবর্তে উপদেশমূলক ভাষা ব্যবহার করলেও তার সাথে বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণও পেশ করেছে। কুরআন মানুষের মনে যে বিশ্বাস জন্মাতে চায়- তার সত্যতাকে প্রমাণ করার জন্যে বলিষ্ঠ যুক্তিসহ তা হৃদয়গ্রাহী ভাষায় পেশ করে। সে যুক্তি-প্রমাণ বিভিন্ন ধরনের হয়- বুদ্ধিবৃত্তিক, প্রাকৃতিক, সজ্ঞামূলক এবং ঐতিহাসিক। বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণসহ দাওয়াত পেশ করা এ কথারই প্রমাণ যে, কুরআন মানুষের বুদ্ধি-বিবেকের কাছেই তার আবেদন রাখে। যেমন-
“নিশ্চয়ই আসমান ও যমীন সৃষ্টির মধ্যে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে”- (আলে ইমরানঃ ১৯০)।
এ ধরনের আয়াত কুরআন পাকে বহু আছে যার থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, মানুষ একটি বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন সত্তা হওয়ার কারণেই তাকে দাওয়াত গ্রহণের যোগ্য গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ যে কেউ তার জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেককে সঠিকভাবে ব্যবহার করবে, এ দাওয়াতের সত্যতা তার নিকটে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। সত্যানুসন্ধিৎসা এবং নিষ্ঠা সহকারে চিন্তা ভাবনা করলে কেউ এ সত্যের আলোক থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে না।
জাহেলিয়াতের আঁধারে আচ্ছন্ন পরিবেশ
যুক্তিপ্রমাণ, ঐতিহাসিক সাক্ষ্য ও বিভিন্ন নিদর্শনাদিসহ হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ইসলামী দাওয়াত পেশ করা সত্ত্বেও অতীতের ন্যায় আরবের জাহেলিয়াতও এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। তার কারণ, সমাজে জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক ও অন্তর্দৃষ্টির অভাব ছিল। সূর্য উদিত হলে তার আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ আলোক থেকে তারাই সুযোগ সুবিধা লাভ করতে পারে, যাদের দৃষ্টিশক্তি থাকে। যে অন্ধ অথবা যে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, তার জন্যে সবকিছুই ঘন আঁধারে আচ্ছন্ন মনে হয়। অন্তর্দৃষ্টির বেলায়ও তা-ই হয়ে থাকে। এ অন্তরের চক্ষু যদি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে অথবা তার উপর যদি ছানির ন্যায় মোটা পর্দা পড়ে থাকে, তাহলে সে সত্যকে দেখতে পায় না। শেষ নবীর আগমনের সময় সমাজ এ ধরনের অন্ধ ও বধির লোকেই পরিপূর্ণ ছিল। নিম্নের ভাষায় কুরআন সে সময়ের অবস্থা বর্ণনা করেছে-
“তাদের তো মন আছে, কিন্তু তা দিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না। চোখ আছে বটে কিন্তু তা দিয়ে দেখে না। তাদের কান আছে, তা দিয়ে শুনে না। তারা পশুর ন্যায় বরং তার চেয়েও অধিক পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত। তারা চরম গাফলতির মধ্যে ডুবে আছে”- (আ’রাফঃ ১৭১)।
এ কথার অর্থ এই যে, এসব লোক- যাদের সামনে নবী মুহাম্মাদ (সা) ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন, দাওয়াতে হক সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলেছে। সত্যতা ও প্রত্যেক বিষয়ের সঠিক তত্ত্ব লাভের জন্যে আল্লাহতায়ালা যেসব উপায়-উপকরণ তাদেরকে দিয়েছেন, তার মাধ্যমে অন্য সবকিছুই তারা করছে, কিন্তু প্রকৃত কাজটি তারা করছে না যা তাদের করা উচিত ছিল। অর্থাৎ সত্যকে উপলব্ধি করা। তাদেরকে চক্ষু তথা দৃষ্টিশক্তি এ জন্যে দেয়া হয়েছিল যে, তার দ্বারা তারা বিশ্বজগতের প্রকৃত তত্ত্বসমূহ পর্যবেক্ষণ করবে। শ্রবণশক্তি এ জন্যে দেয়া হয়েছিল যে, সত্যের দাওয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবে। মন বা বোধশক্তি এ জন্যে দেয়া হয়েছিল যে, চোখ দিয়ে যা তারা পর্যবেক্ষণ করলো এবং কান দিয়ে যা শুনলো দায়িত্বানুভূতিসহ তার সঠিক মূল্যায়ন করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছবে। কিন্তু তারা চতুষ্পদ পশুর ভূমিকাই পালন করলো। পশু তার চক্ষু ও কর্ণের দ্বারা যতোটুকু জ্ঞান লাভ করে, তারাও তা-ই করে। এসব চতুষ্পদ জন্তুর অবস্থা এই যে, রাখাল বা তাদের মালিক তাদেরকে চিৎকার করে কিছু বলে, তারা বুঝতে পারে না আসলে কি বলা হচ্ছে। তবে এতোটুকু অনুভব করতে পারে যে, কেউ আওয়াজ দিচ্ছে। ইসলামের দাওয়াতের ব্যাপারে এই একই অবস্থা আরবের মুশরিক-কাফেরদের। তারা তার সপক্ষে দেখাশুনা ও চিন্তাভাবনা করার শক্তি একেবারে হারিয়ে ফেলেছে। আহবানকারীর কথার অর্থ হাওয়ায় বিলীন হয়ে যায়। কুরআন পাক তাদের মানসিক অবস্থার চিত্র এভাবে এঁকেছে-
“যারা খোদার পথে চলতে অস্বীকার করেছে তাদের অবস্থা এরূপঃ রাখাল জন্তুগুলিকে ডাকে, কিন্তু তারা এ ডাকের আওয়াজ ব্যতীত আর কিছু শুনতে পায় না। তারা বধির, বোবা ও অন্ধ। এ জন্যে কোন কথা বুঝতে পারে না”- (বাকারাহঃ ১৭)।
অন্য এক স্থানে বলা হয়েছে-
“এরা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে না? অথবা এদের মনের (দরজায়) কি তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে?”- (মুহাম্মাদঃ ২৪)।
উপরোক্ত আয়াতের অর্থ এই যে, তারা কুরআন সম্পর্কে মোটেই চিন্তাভাবনা করে না। আর যদি বা কখনো করেও, তো তার মর্ম ও তাৎপর্য তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে না। তার কারণ এই যে, তারা সত্যকে গ্রহণ করতেই চায় না। তাদের হৃদয়ের প্রবেশপথ তালাবদ্ধ থাকে। তারপর তাদের আর ভালোমন্দ বুঝবার কোন শক্তিই থাকে না। আর এটাই হচ্ছে হৃদয়ের অন্ধত্ব।
অন্ধত্বের কারণ
এ অন্ধত্বের প্রথম কারণ হচ্ছে, জাতীয় এবং পারিবারিক গোঁড়ামি। তাদের কথা হলো এই, যে ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি ও রসম-রেওয়াজ তাদের পূর্বপুরুষ থেকে চলে আসছে তা-ই সঠিক। কারণ তারা ভুল করে থাকবেন এমনটি তো হতে পারে না। অতএব নবী মুহাম্মাদের (সা) নতুন দ্বীনের দাওয়াত যদি আমরা প্রত্যাখ্যান করি তাহলে তাই হবে আমাদের সৌভাগ্যের কারণ এবং পূর্বপুরুষদের ধর্মত্যাগ না করে তাদের অভিশাপ থেকেও আমরা বেঁচে যাব।
“আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে একটা রীতিনীতির অনুসারী পেয়েছি। আর আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছি”- (যুখরুফঃ ২৩)।
তাদের সপক্ষে কোন কিতাবে ইলাহীর কোন সনদ নেই। তাদের সনদ শুধু এই যে, এসব কিছু বাপ-দাদার সময় থেকে চলে আসছে। অতএব তারা যা যা করেছে আমরাও তাই করব। উল্লেখ্য যে, নবীগণের মুকাবিলায় দাঁড়িয়ে বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণের পতাকা বুলন্দকারী প্রত্যেক যুগে সমাজের বিত্তশালী লোকেরাই কেন ছিল? তার একটি কারণ ছিল যে- দুনিয়ায় ভোগ-সম্ভোগে তারা এতোটা মত্ত ছিল যে, হক ও বাতিলের বিতর্কে মাথা ঘামাবার জন্যে তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না- পাছে বিলাসী জীবন যাপনে কোন ছেদ পড়ে। দ্বিতীয় কারণ এই যে, সমাজে প্রচলিত ব্যবস্থার সাথে তাদের স্বার্থ ওতপ্রোত জড়িত ছিল। নবীগণের উপস্থাপিত ব্যবস্থা দেখার পরই তারা বুঝে নিয়েছিল যে, এ ব্যবস্থার অধীনে তাদের নেতৃত্ব ও প্রভাবপ্রতিপত্তি শেষ হয়ে যাবে এবং অন্যায়ভাবে তারা যতো কিছু ভোগ করছে তার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।
পূর্বপুরুষদের অন্ধ আনুগত্যই শুধু তাদেরকে সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেনি, বংশীয় গোঁড়ামি এবং বংশীয় স্বার্থও তাদেরকে ইসলামী দাওয়াত গ্রহনে বাধা দিয়েছে। কুরাইশ গোত্রের বনী কুসাই শাখাটির সাথে নবী পরিবার সম্পৃক্ত ছিল। সেজন্যে বনী কুসাই-এর বিরুদ্ধে অন্যদেরকে ক্ষিপ্ত করে দেয়া হয়। অন্যান্যরা এ জন্যে নবী মুহাম্মাদের (সা) নবুওত মেনে নিতে অস্বীকার করে যে, বনী কুসাই-এর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
বদরের যুদ্ধের সময় আবু জেহেলের জনৈক সাথী আখনাস বিন শুরাইক নির্জনে আবু জেহেলকে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি করে বলতো, মুহাম্মাদকে সত্যবাদী মনে কর, না মিথ্যাবাদী?”
জবাবে সে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে, “খোদার কসম, মুহাম্মাদ একজন সত্যবাদী লোক, যে জীবনে কখনো মিথ্যা বলে নি। কিন্তু লিওয়া (১) সিকায়েত (২) হেজাবাত (৩) এবং নবুওত সবই যদি বনী কুসাই’-এর অংশে এসে যায়, তাহলে তুমিই বল, অন্যান্য কুরাইশদের জন্যে কী রইলো?”
নবী (সা)-এর চাচা আবু তালিবের মতো লোকও শুধু এ জন্যে ইসলাম গ্রহণ করতে পারেননি যে, বাপ-দাদার ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস তাকে ইসলাম গ্রহণের অনুমতি দেয়নি। অথচ নবীর প্রতি তার স্নেহ-ভালবাসা ছিল অতুলনীয়। দুশমনদের মুকাবিলায় তিনি ছিলেন ঢালস্বরূপ। কিন্তু নবীপাকের বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি কালেমা উচ্চারণ করেননি। নবী (সা) তাকে কত ভক্তি ও দরদের সাথে বলেন, “চাচাজান, আপনি একবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে ফেলুন। তাহলে কিয়ামতের দিন আমি সাক্ষ্য দেব এবং আপনার মাগফেরাতের জন্যে আরজ করব।”
আবু জেহেল এবং অন্যান্য মুশরিক নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা বললো, “আবু তালিব, মৃত্যুর ভয়ে কি তুমি বুযর্গ পিতা আব্দুল মুত্তালিবের দ্বীন পরিত্যাগ করবে?”
তাদের জাহেলিয়াতের তীর তার লক্ষ্যস্থানে পৌঁছে গেল। আবু তালিবের মধ্যে পিতৃপূজার তীব্র অনুভূতি জাগ্রত হলো এবং তিনি বললেন, আমি আব্দুল মুত্তালিবের দ্বীনের উপরেই মৃত্যুবরণ করছি। ইবনে হিশাম তার ইতিহাসে এ ঘটনাটি বিবৃত করেছেন।
উপরোক্ত দু’টি ঘটনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আরব সমাজে জাতীয়, দলীয়, গোত্রীয় ও পারিবারিক গোঁড়ামি ও অন্ধঅনুসৃতি কতো প্রকট ছিল এবং কায়েমী স্বার্থের জন্যে তারা সত্যকে, নবীর দাওয়াতকে, কল্যাণের পথকে কিভাবে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করেছে।
দ্বিতীয় কারণ হলো বুদ্ধিবৃত্তিক অন্ধত্ব ও প্রবৃত্তিপূজা। প্রবৃত্তিপূজার প্রবণতা তাদের শিরা-উপশিরায় পরিব্যপ্ত ছিল। প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন পন্থা পদ্ধতি ও রীতিনীতি আবিষ্কার করতো এবং তার উপরে মনোমুগ্ধকর লেবাস পরিয়ে দিত। তাকে বৈধ করার যুক্তিপ্রমাণ সরবরাহ করা হতো। মদ্যপান, জুয়া, সুদ, নগ্নতা, অশ্লীলতা, নৃত্যগীত, যৌন অরাজকতা, খুনখারাবি, সন্তান হত্যা প্রভৃতির জন্যে কোথাও প্রকৃতিসুলভ দাবি, কোথাও অর্থনৈতিক কল্যাণ, কোথাও চারুশিল্প এবং কোথাও ধর্মীয় পবিত্রতার পোশাক পরিয়ে দেয়া হতো। এভাবে শয়তানী কামনা-বাসনা এবং ঘৃণ্য ক্রিয়া-কর্মের ভারে মানব প্রকৃতি এমনভাবে নিষ্পিষ্ট হয়ে পড়েছিল যে, এসবের বিরুদ্ধে টু শব্দ করতে পারতো না। ইসলাম যেহেতু এসবের লাইসেন্স দিতে পারে না, বরং এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, সেজন্যে একে তারা তাদের জন্যে বিপদ মনে করে। একে তারা তাদের উপর ভয়ানক জুলুম-অবিচার মনে করে। কারণ তারা প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রবৃত্তিকেই খোদা বানিয়ে নিয়েছিল। তাদের এ মানসিকতা ও আচরণে রহমতের নবী যখন হৃদয়ে বেদনাবোধ করতে লাগলেন, তখন আল্লাহতায়ালা বলেন-
“তুমি কখনো সে লোকের অবস্থা চিন্তা করে দেখেছ, যে নিজের প্রবৃত্তিকে তার খোদা বানিয়ে নিয়েছে? এমন লোককে সৎপথে আনার দায়িত্ব তুমি নিতে পার কি?”- (ফুরকানঃ ৪৩)।
প্রবৃত্তিকে খোদা বানিয়ে নেবার অর্থ তার বন্দেগী-দাসত্ব করা এবং বাস্তব অবস্থার দিক দিয়ে এটাও মূর্তিপূজার মতোই শির্ক। হযরত আবু উমামা (রা) বর্ণিত হাদীসে নবী (সা) বলেন, এ আসমানের নিচে আল্লাহ ছাড়া আর যতো মাবুদের পূজা করা হয় তাদের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট মাবুদ হচ্ছে প্রবৃত্তি যার হুকুম মেনে চলা হয়- (তাবারানী)।
যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে বিবেকের অধীন রাখে এবং বিবেকসম্মত ফয়সালা করে, সে যদি কোন প্রকার শির্ক ও কুফরে লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে সঠিক পথে আনা যায়। কিন্তু প্রবৃত্তির দাস লাগামহীন উটের মতো এবং তাকে কিছুতেই সংশোধন করা যায় না। প্রবৃত্তি তাকে যেদিকে পরিচালিত করে সেদিকেই চলে।
তৃতীয় হচ্ছে পূর্ব থেকে প্রচলিত রসম-রেওয়াজ। এসবের বিরুদ্ধে কোন কথা শুনতে তারা রাজি নয়, এতোকাল থেকে যে রীতিনীতি চলে আসছে তা পরিহার করার চিন্তাও তারা করতে প্রস্তুত নয়।
উপরোক্ত তিনটি বস্তু দুরারোগ্য ব্যাধির ন্যায় তাদের মন-মস্তিষ্ক আক্রান্ত করে রাখে। সত্যের আহবান তারা শুধু প্রত্যাখ্যানই করে না, বরং সত্যের আওয়াজ তাদের রাগ বর্ধিত করে।
“আমরা তো এ কুরআনের মধ্যে বিভিন্নভাবে দ্বীনের মর্মকথা বর্ণনা করেছি যাতে করে তারা হৃদয়ঙ্গম করে সচেতন হয়, কিন্তু প্রকৃত সত্য থেকে তারা আরও দূরে পালিয়ে যাচ্ছে”- (বনী ইসরাইলঃ ৪১)।
জাহেলিয়াতের মানসপুত্র এ ধরনের লোক সকল যুগেই পাওয়া যাবে।
জাহেলিয়াতপন্থীদের প্রতিক্রিয়া
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত ঘোষণার সাথে সাথে মক্কার মুশরিক-কাফেরদের প্রতিক্রিয়া পর্যায়ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। প্রথমে এ ঘোষণা তাদের কাছে এক চরম বিস্ময় বলে মনে হয়। তাদের দৃষ্টিতে যে মানুষটি ছিলেন সমাজে সবচেয়ে ভালো মানুষ, সত্যবাদী, পরম বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য এবং অতুলনীয় চরিত্রের অধিকারী, তার মুখে এমন অবাস্তব ও অবান্তর কথা কেন?
“আল্লাহ কি একজন মানুষকে তাঁর রসূল করে পাঠালেন?”- (বনী ইসরাইলঃ ১৪)।
“তাদের কাছে এটা এক বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল যে, একজন সাবধানকারী স্বয়ং তাদের মধ্য থেকে (মানুষের মধ্য থেকে) এসেছে। ফলে কাফেররা বলতে লাগলো- এ তো বড়ই আজব কথা”- (কাফঃ ২)।
জ্ঞান বিবেক বর্জিত লোকের মতো তারা সর্বত্র এ চাঞ্চল্যকর চর্চা শুরু করলো যে, খোদা নাকি কখনো মানুষকে তাঁর রসূল করে পাঠান। তাদের কথা- আমাদের সর্বজনপ্রিয় সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত লোকটির মুখে যখন এ ধরনের অবান্তর কথা শোনা যাচ্ছে, তখন নিশ্চয় তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে। অথবা জ্বিনে ধরেছে। এভাবে নবী মুহাম্মাদের (সা) বিরুদ্ধে মানুষের মনকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলার এক অভিযান শুরু হলো।
তারপর মৃত্যুর পর-জীবনের কথা, আখিরাতের কথা। এ তো তাদের কাছে আরও হাস্যকর-অবিশ্বাস্য।
তাদের ভাষ্য ছিল এরকমঃ “আমরা কি তোমাদেরকে এমন একজন লোকের কথা বলব, (যে তোমাদেরকে এ আজগুবী) খবর দেয় যে, তোমরা যখন (মৃত্যুর পর পচে গলে) ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, তখন নাকি তোমাদেরকে নতুন করে পয়দা করা হবে?”- (সাবাঃ ৭)।
এভাবে জাহেলিয়াতের পতাকাবাহীরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ-উপহাস সহকারে প্রথমে ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। পরে তাওহীদ ও আখিরাতকেও তারা অবান্তর বলে প্রত্যাখ্যান করে এ কারণে যে, এ ধরনের অবাস্তব কথা তারা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে কখনো শুনেনি। তারপর নবীর (সা) বিরোধিতা শুরু হয় এবং তা ক্রমশঃ নির্যাতন, নিষ্পেষণের রুপ ধারণ করে। কেউ ইসলাম গ্রহণ করা মাত্র তার উপর মুসিবতের পাহাড় ভেঙ্গে পড়তো। এভাবে মক্কায় অবস্থানকালে মুসলমানদের জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে তখন নবী ও ইসলাম দুশমনদেরকে শাসিয়ে দিয়ে আল্লাহ বলেন, যেসব লোক দুষ্কৃতি করছে তারা কি একথা মনে করে নিয়েছে যে, তারা আমাকে ডিঙ্গিয়ে যাবে? বড়ো ভুল সিদ্ধান্তই করেছে- (আনকাবুতঃ ৪)।
এর দু’প্রকার অর্থ হতে পারে। এক- তারা মনে করে নিয়েছে যে, আল্লাহ যে ইসলামী আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে চান তা হবে না। বরঞ্চ তারা যে একে মিটিয়ে দিতে চায় তা-ই হবে। দুই- তাদের বাড়াবাড়ির জন্যে আল্লাহ যে তাদের পাকড়াও করতে চান, সেই পাকড়াও থেকে তারা বেঁচে যাবে।
ইসলামের দুশমনরা হরহামেশা এ ধারণাই পোষণ করে যে, ইসলামী আন্দোলন ও আন্দোলনকারীদেরকে তারা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তাদের এ ইসলাম-বিরোধিতার জন্যে এবং ইসলামপন্থীদের উপর যুলুম নির্যাতনের জন্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ যে তাদেরকে সমুচিত শাস্তি দিতে পারেন একথা তারা মোটেই বিশ্বাস করে না।
কিন্তু তাদের শত বিরোধিতা ও অত্যাচার-নির্যাতন সত্ত্বেও মুসলমানের সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধিই পাচ্ছিল। তার প্রধান কারণ আরবি ভাষায় অবতীর্ণ আল্লাহর বাণী আল কুরআন। কুরআনের কতকগুলো সাধারণ গুণ আছে। প্রথমতঃ তা এক অতি উচ্চমানের সাহিত্য, যার সমতুল্য দু’ একটি ছত্র রচনা করাও মানুষের সাধ্যের অতীত। দ্বিতীয়তঃ তার ভাষা প্রাঞ্জল, বোধগম্য, অতি আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী। শ্রোতার মনে তা বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। তার অর্থ ও অন্তর্নিহিত মর্ম শ্রোতার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে চিন্তার বিপ্লব সৃষ্টি করে। কুরআনের প্রতিটি কথা যেমন অতীব সত্য তেমনি অকাট্য যুক্তিপূর্ণ। সত্যের একটা আলাদা আস্বাদ থাকে যা সত্যানুসন্ধানীদেরকে সহজেই আকৃষ্ট ও বিমোহিত করে। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি বুদ্ধিমত্তা এবং প্রকৃতিরাজ্য ও তার ব্যবস্থাপনার সাথে, কুরআনের কথাগুলো সামঞ্জস্যশীল ও সংগতিপূর্ণ। তাই যারা মনোযোগ সহকারে কুরআন শ্রবণ করে ও চিন্তা-ভাবনা করে তাদের মনের দুনিয়ায় এক বিপ্লব ঘটে যায় এবং কুরআনের আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয়।
কুরআন শ্রবণে বাধাদান
জাহেলিয়াতের ধারক-বাহক তথা ইসলামের দুশমনরা যখন উপলব্ধি করলো যে, সমাজের সর্বোত্তম ও সকলের শ্রদ্ধাভাজন এক ব্যক্তির মুখে মানুষ এমন সব কথা শুনছে যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করছে এবং বর্তমান সমাজ ও তার নেতৃত্বের প্রতি তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে, তখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর কালাম কুরআনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। তারপর তারা কুরআন শ্রবণের বিরুদ্ধে এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তাদের সম্পর্কে কুরআন বলে,
“সত্যের অমান্যকারীরা বলে, কুরআন কখনো শুনবে না। (আর যখন শুনানো হয়) তখন তোমরা হৈ-হল্লা করে (প্রতিরোধ সৃষ্টি করবে)। তাহলে তোমরা এ কাজে জয়ী হবে।”
আল্লাহ বলেনঃ
“এ সত্য অস্বীকারকারীদেরকে আমরা কঠোর আযাবের স্বাদ গ্রহণ করাবো। আর যে নিকৃষ্টতম কাজ করছে তার পুরোপুরি প্রতিফল তাদেরকে দেব। আল্লাহর দুশমনদের প্রতিফল হলো জাহান্নাম। এর মধ্যেই তারা চিরকাল বাস করবে। এ শাস্তি এ জন্যে যে, তারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করেছিল।
সত্য অস্বীকারকারী এসব কাফের জাহান্নামে গিয়ে বলবে, হে আমাদের রব, সেই জ্বিন ও মানুষগুলোকে আমাদের একটু দেখিয়ে দাও যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। আমরা তাদেরকে পায়ের তলায় নিষ্পেষিত করব যেন তারা ভালোমত লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়”- (সূরা হা-মীম আসসাজদাহঃ ২৭-২৯)।
প্রাচীন জাহেলিয়াতের ধারক-বাহকরা যেমন কুরআন প্রচার ও প্রসারকে বরদাস্ত করতে পারেনি এবং তা বন্ধ করার কোন চেষ্টা ও কূট-কৌশলই বাকী রাখেনি, তেমনি আধুনিক জাহেলিয়াতের ধারক-বাহক তথা ইসলামের দুশমনরাও কুরআনকে মোটেই ভালো চোখে দেখতে পারেনি। কিন্তু কুরআন প্রচার বন্ধ করার চেষ্টা কোনদিনই সফল হয়নি, বরঞ্চ উল্টো ফলই হয়েছে। এককালীন ইসলামের ঘোরতর দুশমন হযরত ওমর (রা) নবী মুহাম্মাদকে (সা) হত্যার উদ্দেশ্যে মুক্ত তরবারি হাতে অগ্রসর হয়ে ঘটনাক্রমে পথিমধ্যে কুরআনের কয়েকটি ছত্র পাঠ করে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, তাঁর মনের মধ্যে সত্য উদঘাটিত হয়। ফলে নবীর দুশমন নবীপ্রেমে পাগল হয়ে পড়েন। আবিসিনিয়ার খৃস্টান সম্রাট কুরআন পাঠ শুনে আনন্দে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। নাজরানের খৃস্টান প্রতিনিধিগণ নবী মুহাম্মাদের (সা) পবিত্র মুখ থেকে কুরআন পাঠ শুনে মুগ্ধ হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে কুরআনের প্রচার ও প্রসার বন্ধের হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু ফল উল্টোই হয়েছে। কুরআন পাকের ইংরেজি তর্জমা অসংখ্য অগণিত সংখ্যায় বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং স্বয়ং ইংল্যান্ডের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং এখনও করছেন। পৃথিবীর সর্বত্র এই একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ভারত থেকেও চেষ্টা করা হয়েছিল কুরআনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ভারতের কয়েকটি ভাষায় কুরআনের অনুবাদ হয়েছে। অমুসলিমদের মধ্যেও কুরআন পাঠের আগ্রহ বেড়ে চলেছে। ভারতের বহু উচ্চশিক্ষিত ও পণ্ডিত ব্যক্তি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করছেন। মুসলিম নামধারী মেকি মুসলমানরাও কিন্তু কাফেরদের অনুসরণে কুরআনের প্রচার-প্রসার বন্ধ করার চেষ্টা করে আসছে। সর্বপ্রথম এ কাজ শুরু হয় তুরস্কে কামাল পাশার শাসনামলে। আরবী বর্ণমালা তুরস্কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আরবী ভাষায় অবতীর্ণ কুরআন প্রচার বন্ধ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। কিন্তু সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
মুসলিম নাম ধারণ করার পর কেউ মেকি মুসলমান হলে অমুসলিম কাফের অপেক্ষা ইসলামের বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার হয়। তাই ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, অমুসলিম কাফেরদের দ্বারা ইসলামের যত ক্ষতি হয়েছে মেকি মুসলমান ও মেকি আলেমদের দ্বারা তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে।
তবে ইসলামে অবিশ্বাসী কাফের হোক অথবা কাফেরদের মানসিক দাস মেকি মুসলমান হোক তাদের জেনে রাখা দরকার যে, কুরআন আল্লাহতায়ালার শাশ্বত বাণী এবং চিরকাল তাকে আসলরূপে সংরক্ষিত রাখার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। তার প্রচার ও প্রসার বন্ধ করা অথবা তাকে সামান্যতম বিকৃত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। যারা কুরআন প্রচার বন্ধের নির্দেশ দিচ্ছে এবং এ নির্দেশ অন্ধভাবে পালন করতে গিয়ে যারা মাঠে-ময়দানে নর্তন-কুর্দন করছে, ফ্যাসিবাদী কায়দায় কথা বলছে ও প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে, তাদের উপরে বর্ণিত কুরআনের আয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আখিরাতে এসব ফ্যাসিবাদী মেকি মুসলিম নেতা ও তাদের অন্ধ অনুসারীদের পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কুরআনের দিকে আন্তরিকভাবে ফিরে আসাটাই তাদের জন্য মঙ্গলজনক।