আম্বিয়ায়ে কেরামের দাওয়াত
উপরের আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহতায়ালা মানুষকে যে জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক দিয়েছেন, তার সদ্ব্যবহার সকলে করে না এবং করতে জানেও না। ফলে তার ভয়াবহ পরিণাম মানুষকে ভোগ করতে হয়। মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে নানান মানবিক দুর্বলতাও আছে। মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে অসহায় অবস্থায় দেখে নীরব থাকতে পারেন না। ব্যাপারটি এমন নয় যে, ইসলাম ও জাহেলিয়াতের এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে সত্যের জয়লাভের জন্যে যতো প্রকারের চেষ্টা-তদবীর হতে পারে তার দায়িত্ব মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও স্বাভাবিক যোগ্যতার উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা-ভাবনা করে সব সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। কারণ তার জ্ঞান ও চিন্তার জগত অতি ক্ষুদ্র ও সীমিত। চিন্তার একপর্যায়ে তার গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তখন সে অসহায়ত্ব অনুভব করে এবং ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মানবজাতির অনেক চিন্তানায়ক সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে নতুন নতুন দর্শন ও মতবাদ আবিষ্কার করেছেন যা মানুষের জীবনে অকল্যাণ ব্যতীত কল্যাণ বয়ে আনতে পারে নি। এ জন্যে দয়াময় আল্লাহতায়ালা মানুষের প্রতি অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে তাঁর পক্ষ থেকে অভ্রান্ত জ্ঞান পরিবেশনের ব্যবস্থা করেছেন। একেই বলে ওহীর জ্ঞান বা ঐশীজ্ঞান। এ জ্ঞান তিনি মানুষকে সরাসরি পরিবেশন করেন না, সমাজের সবচেয়ে ভালো মানুষটিকে তিনি বেছে নেন এবং ওহীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সকল জ্ঞান দান করেন। মানুষকে সুস্থ প্রকৃতি ও জ্ঞানবুদ্ধি দেয়ার পর এ এক অতিরিক্ত জ্ঞান। মানুষের ভেতর ও বাইরে থেকে বহু চিন্তাচেতনা, ভয়ভীতি, প্ররোচনা এবং তার ষড়রিপুর প্রভাব যখন তাকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে তখন এই অতিরিক্ত জ্ঞান তার সহায়তায় এগিয়ে আসে এবং সঠিক পথ প্রদর্শন করে। অবশ্যি এ অতিরিক্ত জ্ঞান প্রত্যাখ্যান করা তার জন্যে অতি দুর্ভাগ্যজনক হলেও তা করার স্বাধীনতাও তাকে দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানুষকে এভাবে পরীক্ষায় নিক্ষেপ করে তা উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে উপায়-উপকরণও দান করেছেন যাতে করে সে মানুষের সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারে।
উপরে বর্ণিত এ অতিরিক্ত জ্ঞানকে ওহীর জ্ঞান বলা হয়েছে। সেই সাথে এ ওহীর বাহকও পাঠিয়েছেন, যিনি অন্যান্য মানুষের মতোই একজন মানুষ। তিনি ওহীর জ্ঞান মানুষের মধ্যে পরিবেশন করবেন। তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবেন এবং স্বয়ং তার বাস্তব জীবন দিয়ে সে জ্ঞান কার্যকর করে দেখাবেন। ওহীবাহক এ ব্যক্তিকে নবী বা রসূল বলা হয়। মানুষকে পথ প্রদর্শন, তাদের সত্যিকার মানবীয় চরিত্র গঠন এবং তাদের জীবনকে সুখী ও সুন্দর করার জন্যে যুগে যুগে দুনিয়ার বুকে নবী রসূলগণ প্রেরিত হয়েছেন।
নবীগণের দাওয়াত ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ
ইসলাম ও জাহেলিয়াতকে সত্য ও মিথ্যা এবং আলোক ও অন্ধকারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ সত্য ও মিথ্যা, আলোক ও অন্ধকারের যেমন এক মুহূর্তের জন্যেও সহাবস্থান সম্ভব নয়, তেমনি ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সহাবস্থান কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই যুগে যুগে যখন নবীগণের মাধ্যমে মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত, সত্যের দাওয়াত এসেছে, জাহেলিয়াত তাকে বরদাশত করতে পারে নি। তাই মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসই হচ্ছে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের তথা সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্বসংগ্রাম।
আল্লাহর মহিমান্বিত নবীগণই বিভ্রান্ত পথভ্রষ্ট ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবজাতির জন্যে সত্যসঠিক পথের আলোকবর্তিকা নিয়ে আসেন। সেজন্যে জাহেলিয়াত তাদের পথে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, নবীগণ জাহেলিয়াতের পতাকাবাহীদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হন এবং অনেকে প্রাণও হারান। সংক্ষেপে নবীদের দাওয়াত তথা ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কিছু বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো।
হযরত নূহ (আ)
হযরত নূহের (আ) সময় থেকেই আমরা মানব জাতির ইতিহাস কিছুটা জানতে পারি। মানবজাতির এক সুদীর্ঘকালের কোন মানব রচিত ইতিহাস নেই। এ সুদীর্ঘ যুগকে প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলে। তবে এ যুগের নবীগণের ইতিহাস আসমানী কিতাবগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছে এবং অতি নির্ভরযোগ্য বর্ণনা কুরআনে করা হয়েছে। হযরত নূহ (আ) তাঁর জাতিকে সম্বোধন করে বলেন-
“সে (নূহ) বললো, হে আমার জাতির লোকেরা! আমি তোমাদের জন্যে পরিষ্কার ভাষায় সাবধানকারী (একজন নবী)। (তোমাদেরকে এ কথা বলে সাবধান করে দিচ্ছি যে) আল্লাহর বন্দেগী কর ও তাঁকে ভয় কর এবং আমার অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নির্দিষ্ট সময় যখন আসে তখন আর তাকে রোধ করা যায় না। (এসব) যদি তোমরা জানতে তাহলে কতই না ভালো হতো”- (নূহঃ ২-৪)।
তাঁর দাওয়াত সুস্পষ্ট ও ন্যায়সঙ্গত। যে আল্লাহ মানুষকে পয়দা করেছেন এবং তার জন্ম সূচনা থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রত্যেকটি প্রয়োজন পূরণ করছেন- হুকুম শাসন তাঁরই মেনে চলা অত্যন্ত স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু তাঁর জাতির সমাজপতি ও সাধারণ লোকেরা তাঁর এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু হযরত নূহ (আ) অসাধারণ ধৈর্য্য সহকারে তাঁর দাওয়াতী কাজ অব্যাহত রাখেন। এক সুদীর্ঘকাল যাবত অর্থাৎ সাড়ে ন’শ’ বছর যাবত তিনি তাদেরকে সত্যের দিকে আহবান জানাতে থাকেন।
তিনি তাদেরকে এক সুদূর ভবিষ্যতের অর্থাৎ মৃত্যুর পর জীবনের কল্যাণের নিশ্চয়তাই দেননি, দুনিয়ার জীবনের কল্যাণের কথাও বলেছেন।
‘আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট ক্ষমা চাও। তিনি অবশ্যই বড়ো ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদেরকে ধনদৌলত ও সন্তানাদি দিয়ে ধন্য করবেন। তোমাদের জন্যে বাগ-বাগিচা তৈরি করে দেবেন এবং ঝর্ণা প্রবাহিত করবেন’- (নূহঃ ১০-১৪)।
দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভের জন্য তিনি একথা বলেন, তোমাদের মিথ্যা ও স্বরচিত খোদাদের পরিহার করে এক আল্লাহর বন্দেগী কর। জাতির সমাজপতিগণ তাঁর এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে জনসাধারণের প্রতি কঠোরভাবে নির্দেশ জারি করে,
‘তোমাদের মাবূদদেরকে তোমরা কিছুতেই পরিত্যাগ করবে না। পরিত্যাগ করবে না ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নসরকে’- (নূহঃ ২৩)।
জবাবে তারা হযরত নূহকে (আ) বলে-
‘আমরা তোমাকে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে লিপ্ত দেখতে পাচ্ছি’- (আ’রাফঃ ৬০)।
জাতির তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে এক খোদাকে মেনে নেয়া মারাত্মক ভুল ও গোমরাহি। তাদের কথা-
যদিও এ বিশ্বজগত এক খোদার তৈরি, কিন্তু এ পরিচালনা করছে বহু খোদা। সে জন্যে অন্য খোদাদেরও এ অধিকার আছে যে, তাদেরও পূজা-উপাসনা করতে হবে। তাদের বুদ্ধিজীবী ও সমাজপতিগণ- যারা নূহের (আ) কথা মানতে অস্বীকার করেছিল, বললো- ‘আমাদের দৃষ্টিতে তুমি আমাদেরই মতো একজন মানুষ ছাড়া তো কিছু নও। আমরা আরো দেখছি যে, আমাদের মধ্যে যারা একেবারে হীন ও নিকৃষ্ট, তারা কোনপ্রকার ভাবনা-চিন্তা না করেই তোমার পথ ধরেছে। আমরা তো এমন কিছু দেখতে পাই না যে, তোমরা আমাদের থেকে ভালো ও অগ্রসর। বরং তোমাদেরকে মিথ্যাবাদীই মনে করি’- (হুদঃ ২২)।
সে সময়ে জনগণকে শাসন-শোষণ করতো এসব সর্দার-সমাজপতিরাই। মানুষের রুজি-রোজগারের চাবিকাঠিও তাদের হাতে ছিল। বাগবাগিচা, ক্ষেতখামার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিকও তারা ছিল। তারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে নিমগ্ন ছিল। তাদের দাপটে কেউ নবীর দাওয়াত গ্রহণের সাহস করতো না। করলে তাদের উপর নানা জুলুম উৎপীড়নের পাহাড় ভেঙ্গে পড়তো। কতিপয় উৎপীড়িত মজলুম মানুষ- সংখ্যায় অতি নগণ্য- হযরত নূহের দাওয়াত কবুল করেছিল। সমাজপতিরা এদেরকে ঘৃণার চোখে দেখত। যা হোক, হযরত নূহ (আ) তাদেরকে নানানভাবে মিষ্টি ভাষায় যুক্তিসহকারে বুঝাবার চেষ্টা করতে থাকেন।
‘সে বললো, হে আমার জাতির লোকেরা! একটু চিন্তা ভাবনা করে তো দেখ যে, যদি আমি আমার রবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট সাক্ষ্যের উপরে কায়েম হয়ে থাকি এবং তারপর তিনি যদি আমাকে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ দ্বারা ধন্য করে থাকেন এবং তোমরা দেখতে না পাও, তাহলে আমার কাছে এমন কি উপায় আছে যে, তোমরা মানতে চাও না এবং আমি বলপ্রয়োগে তোমাদের উপরে তা চাপিয়ে দেব? হে আমার জাতির ভাইবেরাদরগণ! আমি এ কাজের জন্যে তোমাদের কাছে কোন অর্থসম্পদ চাই না। আমার প্রতিদান তো আল্লাহর যিম্মায় রয়েছে। আমার কথা যারা মেনে নিয়েছে আমি তাদেরকে ধাক্কা দিতেও প্রস্তুত নই। তারা নিজেরাই তাদের রবের সামনে হাজির হবে। কিন্তু আমি দেখছি যে, তোমরা জাহেলিয়াতের মধ্যেই ডুবে আছ’- (হুদঃ ২৮-২৯)।
সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত বার বার বিভিন্নভাবে তাদের কাছে সত্যের দাওয়াত পেশ করার পরও তাদের হঠকারিতা, পদমর্যাদার অহংকার এবং সমাজের উপর তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুতেই সত্যের প্রতি তাদেরকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। হযরত নূহ যখন তাঁর রেসালাত মেনে নেবার আহবান জানান, তখন তার জবাবে তারা তা অতি বিস্ময় প্রকাশ করে প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলে, আচ্ছা যদি মেনে নেয়াই যায় যে, মাবুদ একজনই এবং মেনেও নিলাম যে, তিনি মানুষের জন্যে একজন পয়গম্বর পাঠাতে চান, তাহলে এটা কি করে হতে পারে যে, আমাদেরই মতো একজন মানুষকে তিনি পয়গম্বর করে পাঠাবেন? পাঠাতে চাইলে তো তাঁর নিকটস্থ ফেরেশতাকে পয়গম্বর হিসেবে পাঠাতে পারতেন।
তার জাতির যেসব সমাজপতিরা তার দাওয়াত মানতে অস্বীকার করে তারা বলেঃ ‘এ ব্যক্তি তোমাদেরই মতো একজন মানুষ ছাড়া তো আর কিছু নয়। তার উদ্দেশ্য হলো, সে তোমাদের উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আল্লাহর কাউকে পাঠাতে হলে তো ফেরেশতা পাঠাতেন। এ কথা তো আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমলে শুনিনি (যে মানুষ রসূল হয়ে আসে)। আর কিছু না, ব্যস, এ লোকটাকে কিছু পাগলামিতে পেয়েছে। আরও কিছুদিন দেখ (হয়তো পাগলামি সেরে যেতে পারে)’- (মুমেনূনঃ ২৩-২৪)।
তাদের এ যুক্তির বলে তারা শুধুমাত্র হযরত নূহের নবুওতকেই অস্বীকার করলো না, বরং সমগ্র নবী পরম্পরাকেই তারা অস্বীকার করলো। কারণ, আল্লাহতায়ালা যতো নবী-রসূল পাঠিয়েছেন, তাঁরা সকলেই মানুষ ছিলেন।
এক পর্যায়ে তারা হযরত নূহকে (আ) ভয়ানকভাবে শাসিয়ে দেয়।
‘হে নূহ! তুমি যদি এসব কাজ থেকে বিরত না হও, তাহলে আমরা তোমাকে পাথর মেরে মেরে খতম করে দেব’- (শুয়ারাঃ ১১৬)।
তারপর হযরত নূহ (আ) এবং তাঁর মুষ্টিমেয় অনুসারীদের উপর যে নির্যাতন শুরু হয়েছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ, একটা গোটা জাতির মধ্যে অর্ধশত লোকও ইসলামের দাওয়াত কবুল করেনি।
অবশেষে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে, যখন নূহ নবী খোদার আশ্রয় প্রার্থনা করতে বাধ্য হন।
‘আর নূহ বললোঃ হে আমার খোদা! এ কাফেরদের মধ্য থেকে এ জমিনে বসবাসকারী একজনকেও ছেড়ে দিও না। তুমি যদি এদেরকে ছেড়ে দাও, তাহলে এরা তোমার বান্দাহদেরকে গোমরাহ করে দেবে। আর এদের বংশে যারাই জন্মগ্রহণ করবে তারা কট্টর পাপাচারী কাফেরই হবে’- (নূহঃ ২৬-২৭)।
আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় নির্যাতিত নবীর দোয়া কবুল করেন এবং এক ভয়াবহ বন্যা দিয়ে গোটা জাতিকে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেন।
‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে গেল এবং সে চুলাটি উথলে উঠলো, তখন আমি বললাম, প্রত্যেক রকমের জন্তু জানোয়ার এক এক জোড়া করে নৌকায় তুলে নাও। তোমার পরিবারের লোকদেরকেও এতে সওয়ার করে নাও- শুধু তাদের ছাড়া যাদেরকে আগেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদেরকেও (নৌকায়) বসিয়ে নাও যারা ঈমান এনেছে। আর নূহের সাথে ঈমানদারদের সংখ্যা ছিল খুব নগণ্য’- (হুদঃ ৪০)।
নূহের মহাপ্লাবনের কথা সর্বজনবিদিত। কথিত আছে সর্বমোট চল্লিশজন- তাঁর পরিবারের লোকজনসহ অথবা ছাড়া- আল্লাহর এ গজব থেকে বেঁচে যায়। প্রায় একহাজার বছর ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সংঘাতের পর জাহেলিয়াত মূলোৎপাটিত হয়।
কুরআন পাকে হযরত নূহ (আ)-এর আন্দোলনের বিশদ বিবরণ আছে। এখানে মাত্র সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো।
আদ জাতি
ইতিহাস বিশারদগণ বলেন যে, হযরত নূহ (আ) এমন অঞ্চলে তাঁর দাওয়াতী কাজ চালান যাকে বর্তমানে ইরাক বলে। তাঁর তিরোধানের পর মানুষের সংখ্যা বর্ধিত হতে থাকে এবং তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তারা নবীর শিক্ষাদীক্ষা ভুলে পুনরায় গোমরাহীতে লিপ্ত হয়। নূহের জাতির পরে যে জাতি খুবই শক্তিধর ও প্রভাব প্রতিপত্তিশালী হয় তা হলো আদ জাতি। আদ জাতি সম্পর্কে আরবের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা অবহিত ছিল। তাদের শৌর্যবীর্যের কথা যেমন আরববাসীদের জানা ছিল, তেমনি তাদের ধ্বংসের বিবরণও তাদের জানা ছিল। তারা উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহন করার পর আবার তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতিসহ ধ্বংস গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়। তাদের বাস ছিল আহকাফ অঞ্চলে যা হিজায, ইয়ামেন ও ইয়ামামার মধ্যবর্তী ‘রাবউল খালী’-এর দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। তাদের সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনা নিম্নরূপ।
আদ জাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহতায়ালা হযরত হুদকে (আ) প্রেরণ করেন। জাহেলিয়াতের কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল এ জাতি। হযরত হুদের (আ) ইসলামী দাওয়াত পেশ করায় উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সূচনা হয়, তাদের কাছে দ্বীনে হকের যে কথাই বলা হতো তা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে উড়িয়ে দেয়া হতো। নূহের জাতি যে ধরনের আপত্তি উত্থাপন করে কূটযুক্তির জাল বিস্তার করে নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে, আদ জাতির লোকেরাও তা-ই করে।
‘তুমি কি আমাদের নিকটে এ জন্যে এসেছো যে, আমরা এক খোদার বন্দেগী করব এবং ঐ সব খোদাদেরকে পরিহার করব, যাদের বন্দেগী আমাদের বাপ-দাদা করে এসেছে?’- (আ’রাফঃ ৭০)।
হযরত হুদের (আ) সাথে আদ জাতির এ সংঘাত-সংঘর্ষ চলতে থাকে। আল্লাহর নবী হুদ (আ) তাদেরকে অত্যন্ত দরদের সাথে স্থায়ী কল্যাণের দিকে আহবান জানাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তারা আল্লাহর প্রিয় নবী যে সত্য নবী তা প্রমাণ করার দাবি জানায়।
‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে তুমি আমাদের যে আজাবের হুমকি দিচ্ছ, তা নিয়ে এস’- (আহকাফঃ ২২)।
তারা বার বার আজাবের দাবি করাতে তাদের ভাগ্যে তা-ই ঘটলো।
‘আদকে ধ্বংস করা হয়েছে এক প্রচণ্ড সাইক্লোন বা ঘূর্ণিবাতাস দিয়ে। আল্লাহ তাদের উপর তা (তুফান) ক্রমাগত সাতরাত ও আটদিন পর্যন্ত চাপিয়ে রাখেন। তুমি (সেখানে থাকলে) দেখতে পেতে তারা সেখানে এমনভাবে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে আছে, যেমন পুরাতন শুকনো খেজুর গাছের কাণ্ডসমূহ পড়ে থাকে। এখন তাদের মধ্যে কেউ কি বাকি আছে দেখতে পাও’- (আল-হাক্কাহঃ ৬-৮)।
এভাবে দুনিয়ার বুক থেকে আদ জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেল। তবে হযরত হুদের (আ) সাথে অবশ্যই কিছু নেক লোক ছিল যারা তাঁর দাওয়াত কবুল করে আল্লাহর সৎ বান্দাহ হিসেবে জীবন যাপন করছিল। তাদেরকে আল্লাহ এ ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বিচিত্র উপায়ে রক্ষা করেন।
‘এবং আদের জন্যে আমরা তার ভাই হুদকে পাঠালাম। সে বললো, হে আমার জাতির ভাইয়েরা! আল্লাহর বন্দেগী কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কেউ ইলাহ নেই। তোমরা শুধু মিথ্যা রচনা করে রেখেছো। হে আমার জাতির ভাইয়েরা! এ কাজের জন্যে তোমাদের কাছে আমি কোন প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান তো তাঁর যিম্মায় যিনি আমাকে পয়দা করেছেন। তোমরা কি একটু বিবেক-বুদ্ধিসহ কাজ কর না? হে আমার জাতির লোকেরা! তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও! তারপর তাঁর দিকে ফিরে যাও, তিনি তোমাদের জন্যে আসমান থেকে মুষলধারে পানি বর্ষণ করবেন। তোমাদের বর্তমান শক্তি আরো বাড়িয়ে দেবেন। অপরাধী হয়ে (বন্দেগী থেকে) মুখ ফিরিয়ে রেখো না।’
‘তারা জবাবে বলে, হে হুদ! তুমি আমাদের নিকটে কোন সুস্পষ্ট সাক্ষ্য নিয়ে আসনি এবং তোমার কথামতো আমরা আমাদের খোদাদের ছাড়তে পারি না এবং তোমাদের উপর আমরা ঈমানও আনব না। আমরা তো মনে করি যে, তোমার উপর আমাদের কোন খোদার অভিশাপ লেগেছে।’
‘হুদ বলে, আমি আল্লাহর সাক্ষ্য পেশ করছি এবং তোমরা সাক্ষী থাকো, এই যে তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যান্যকে খোদায়ীতে শরীক গণ্য করে রেখেছো, এর প্রতি আমি অসন্তুষ্ট। তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে যা করার তাতে কিছু কমতি রেখো না। এবং আমাকে সামান্য অবকাশও দিও না। আমার ভরসা তো আল্লাহর উপরে, যিনি আমার রব এবং তোমাদেরও। কোন প্রাণী এমন নেই যার মাথা তাঁর মুঠোর মধ্যে নেই। নিঃসন্দেহে আমার খোদা সোজা পথের উপর আছেন। তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও, তো ফিরিয়ে নাও। যে পয়গামসহ আমাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, তা আমি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এখন আমার রব তোমাদের স্থলে অপর জাতিকে উঠাবেন। আর তোমরা তাঁর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। আমার খোদা নিশ্চিতই সব কিছুই নিয়ন্ত্রণকারী। পরে যখন আমাদের ফরমান এসে গেল, তখন আমরা আমাদের রহমতের সাহায্যে এবং তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে নাজাত দিলাম এবং কঠিন আজাব থেকে তাদেরকে বাঁচালাম।
এই হচ্ছে আদ। তাদের খোদার আয়াতকে তারা অমান্য করলো এবং নবী-রসূলের কথাও তারা মানলো না। এবং সত্য দ্বীনের প্রবল পরাক্রান্ত দুশমনের তারা অনুসরণ করলো। শেষ পর্যন্ত এ দুনিয়াতেও তাদের উপর অভিসম্পাত হলো এবং কিয়ামতের দিনও। জেনে রাখ, আদ তাদের রবকে অমান্য করলো এবং দূরে নিক্ষেপ করা হলো আদ অর্থাৎ হুদের জাতির লোকদেরকে’- (হুদঃ ৫৪-৬০)।
হযরত নূহ (আ)-এর জাতির ধ্বংসের পর আল্লাহতায়ালা হুদ জাতিকে উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করার সুযোগ দান করেন। তৎকালে শৌর্য-বীর্যের দিক দিয়ে তাদের সমতুল্য আর কেউ ছিল না। শুধু খোদাদ্রোহিতার অপরাধে তাদেরকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।
সামূদ জাতি
আদ জাতির ধ্বংসের পর যাদেরকে তাদের নেক আমলের জন্যে আল্লাহতায়ালা রক্ষা করেছিলেন, তারা হযরত হুদ (আ)-এর শিক্ষাদীক্ষা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে থাকে। কিন্তু কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর তারা জাহেলিয়াতের খপ্পরে পড়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। তাদের হেদায়েতের জন্যে আল্লাহতায়ালা হযরত সালেহকে (আ) প্রেরণ করেন। আবার ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ শুরু হয়।
আরবের প্রাচীনতম জাতিসমূহের মধ্যে সামূদ দ্বিতীয় এবং আদ জাতির পর তারা ছিল সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। কুরআন নাযিলের পূর্বে তাদের কেচ্ছাকাহিনী আরবের আবাল বৃদ্ধ বনিতার মুখে শোনা যেত। জাহেলিয়াতের যুগের কবিতা ও বক্তৃতা-ভাষণের মধ্যে তাদের উল্লেখ করা হতো। আসিরিয়ার শিলালিপিতে এবং গ্রীস, আলেকজান্দ্রিয়া ও রোমের প্রাচীন ইতিহাসে তাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। আদ জাতির ধ্বংসের পর তাদের মধ্যে যারা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের বংশধর হযরত ঈসা (আ)-এর জন্মের কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। রোমীয় ঐতিহাসিকগণ বলেন, এসব লোক রোমীয় সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হলে নাবতীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাদের সাথে প্রাচীন শত্রুতা ছিল। তাদের আবাসস্থল ছিল উত্তর-পশ্চিম আরবের ঐসব অঞ্চলে যা আজও আল-হিজর নামে প্রসিদ্ধ। বর্তমানে মদীনা ও তাবুকের মধ্যবর্তী হেজাজ রেলওয়ের একটি স্টেশন আছে যাকে মাদায়েনে সালেহ বলা হয়। এ স্থানটি ছিল সামূদ জাতির কেন্দ্রীয় বাসস্থল। এখনও সেখানে হাজার হাজার একর এলাকা জুড়ে পাহাড়ী দালান কোঠার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়- যা তারা পাহাড় খোদাই করে তৈরি করেছিল। এসব দেখলে মনে হয় এ শহরের অধিবাসীর সংখ্যা চার পাঁচ লক্ষের কম ছিল না। কুরআন নাযিলের যুগে হেজাজের বাণিজ্যিক কাফেলা এসব ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে অতিবাহিত হয়। নবী আকরাম (সা) তাবুক অভিযানকালে এ দিক দিয়ে পথ অতিক্রমকালে এ শিক্ষণীয় ধ্বংসাবশেষগুলো দেখান এবং শিক্ষাগ্রহণ করতে বলেন। একস্থানে একটি কূপ চিহ্নিত করে তিনি বলেন, এই কূপ থেকে হযরত সালেহ (আ) এর উটনী পানি পান করতো। তিনি মুসলমানদেরকে অন্য কূপ থেকে পানি পান না করে এই একটি কূপ থেকে পানি পানের নির্দেশ দেন। নবী (সা) একটি উপত্যকা দেখিয়ে দিয়ে বলেন যে, এখান থেকে উটনী পানি পান করতে আসতো। এ স্থানটি এখনো ‘ফজ্জুন্নাকাহ’ নামে খ্যাত।
হযরত সালেহ (আ) তাদের সামনে একই দাওয়াত পেশ করেন, যা সকল নবী-রসূলের মৌলিক দাওয়াত ছিল।
‘এবং সামূদ জাতির প্রতি আমরা তাদের ভাই সালেহকে পাঠালাম। সে বললো, হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই’- (আ’রাফঃ ৭৩)।
উল্লেখ্য যে, নবুওতের পূর্বে হযরত সালেহ (আ) তাঁর জাতির অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং সকলেই তাঁর উপরে তাদের যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ন্যস্ত করেছিল। ইসলামের দাওয়াত পেশ করার পর তিনি তাদের ঘৃণার পাত্র হয়ে পড়লেন। তাঁর দাওয়াতের জবাবে তারা বলে-
‘হে সালেহ! গতকাল পর্যন্ত তোমার উপর আমরা বড়ই আশা পোষণ করেছিলাম। (কিন্তু আজ এ কি হলো যে) তুমি আমাদেরকে ঐসব মাবুদদের পূজা-উপাসনা করতে নিষেধ করছ, যাদেরকে আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ পূজা করতো?’- (হূদঃ ৬৩)।
তারা তাওহীদের দিকে দাওয়াতকেও একটা প্রতারণা বলে গণ্য করে এবং এ বিষয়ে এভাবে মন্তব্য করে-
‘তুমি নিছক যাদু প্রভাবিত। তুমি আমাদেরই মতো একজন মানুষ ব্যতীত কিছু নও’- (শুয়ারাঃ ১৫৪)।
একই রকমের ওজর-আপত্তি ও অভিযোগ তারা করে যা নূহ এবং হুদের জাতি করেছিল। হযরত সালেহ (আ) বহুভাবে তাদেরকে নসিহত করেন এবং ভয়াবহ পরিণাম থেকে সাবধান করে দেন। কিন্তু তারা তাঁর প্রত্যেকটি কথা প্রত্যাখ্যান করে। অবশেষে তারা ভয়াবহ পরিণামের সম্মুখীন হয়-
‘সাবধানবাণীকে সামূদ জাতি মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিল। তারা বললো, এক ব্যক্তি, যে আমাদেরই মতো একজন, তার পেছনে আমরা চলবো? তার অনুসরণ করলে তার অর্থ এই হবে যে, আমরা পথভ্রষ্ট হয়েছি এবং আমরা বিবেকহীন হয়ে পড়েছি। আমাদের মধ্যে এই এক ব্যক্তিই কি ছিল, যার উপর খোদার যিকর নাযিল করা হয়েছে? না, বরং সে ভয়ানক মিথ্যাবাদী ও আত্মবিভ্রান্ত। (আমরা আমাদের নবীকে বললাম) কালই তারা জানতে পারবে যে, কে ভয়ানক মিথ্যাবাদী ও স্বয়ংভ্রান্ত। আমরা উটনীকে তাদের জন্যে ফেৎনা হিসাবে পাঠাব। একটু সবর কর, তাদের কি পরিণাম হয় দেখ। তাদেরকে জানিয়ে সতর্ক করে দাও যে, পানি এদের এবং উটনীর মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে এবং প্রত্যেকে নিজেদের নির্দিষ্ট দিনে পানি পান করতে আসবে। সবশেষে তাদের এক (দুর্বৃত্ত) লোককে তারা ডাকলো। সে কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করলো এবং উটনীকে মেরে ফেললো। তারপর দেখ আমার আজাব ও হুঁশিয়ারী কত ভয়ংকর ছিল। আমরা তাদের উপর একটি মাত্র প্রচণ্ড ধ্বনি পাঠালাম এবং তারা খোয়াঁড়ওয়ালার নিষ্পেষিত ও চূর্ণবিচূর্ণ ভূষির মতো হয়ে গেল’- (আল-কাসাসঃ ২৩-৩১)।
কুরআন পাকের অন্যত্র বলা হয়েছে-
‘অতঃপর তারা সে উটনীকে মেরে ফেললো এবং পূর্ণ ঔদ্ধত্য সহকারে তাদের রবের আদেশ লংঘন করলো। তারপর তারা সালেহকে বললো, নিয়ে এসো সে আজাব যার হুমকি তুমি দিচ্ছ, যদি তুমি সত্যিই নবীগণের মধ্যে একজন হয়ে থাক। অবশেষে এক প্রলয়ংকরী বিপদ তাদেরকে গ্রাস করলো এবং তারা আপন আপন বাড়িতে উপুড় হয়ে পড়ে মরে রইলো। সালেহ একথা বলে তাদের জনপদ থেকে বেরিয়ে গেল, হে আমার জাতি! আমি আমার রবের পয়গাম তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের বড়ই মঙ্গল কামনা করেছি। কিন্তু কি করব, আমার এ উপদেশ, মঙ্গল কামনা তোমরা পছন্দ করলে না’- (আ’রাফঃ ৭৭-৭৮)।
লূত জাতি
হযরত সালেহের (আ) পর আরও কতিপয় নবীর আগমন হয় এবং প্রত্যেকের সাথে তাঁদের জাতির লোকেরা একই আচরণ করে। অর্থাৎ সত্যের দাওয়াত তারা প্রত্যাখ্যান করে। নবীগণকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে এবং তাঁদের উপর নানানভাবে নির্যাতন চালাতেও দ্বিধাবোধ করেনি। অবশেষে হযরত লূত (আ)- এর আগমন হয়। পূর্ববতী নবীগণ যেসব বাধা বিঘ্ন, প্রতিবন্ধকতা, ঠাট্টা বিদ্রুপ ইত্যাদির সম্মুখীন হন, হযরত লূত (আ)-কেও সে সবের সম্মুখীন হতে হয়। উপরিন্তু তাঁকে এক অভিনব, বিস্ময়কর ও ঘৃণ্য নৈতিক মতবাদের মুকাবিলা করতে হয়। আর তা ছিল সমাজে প্রচলিত ব্যাপক সমকামিতা। তাদের মতবাদের সারমর্ম হলো, কর্মের স্বাধীনতাকে নৈতিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা যেতে পারে না। লূত জাতি স্বাধীনতার এ পাশবিক মতবাদ দৃঢ় প্রত্য্যসহ গ্রহণ করে, যার ফলে তারা ঘৃণ্য নৈতিক পংকিলতায় নিমজ্জিত হয়েছিল। হযরত লূত (আ) শির্ক-কুফর খণ্ডনের সাথে সাথে তাদের এ ঘৃণ্য রুচিবোধেরও তীব্র সমালোচনা করেন। কিন্তু তারা তাঁর এসব কথায় মোটেই কর্ণপাত করে না।
“আর লূতকে আমরা পয়গম্বর বানিয়ে পাঠিয়েছি। তারপর স্মরণ কর, যখন সে তাঁর জাতির লোকদেরকে বললো, তোমরা কি এতোটা নির্লজ্জ হয়ে গিয়েছ যে, তোমরা এমন সব নির্লজ্জ কাজ করছ যা তোমাদের পূর্বে দুনিয়ায় আর কেউ করেনি? তোমরা নারীদের বাদ দিয়ে পুরুষের দ্বারা তোন্মাদের যৌন লালসা চরিতার্থ কর। তোমরা আসলে একেবারেই সীমালঙ্ঘনকারী। কিন্তু তার জাতির জবাব এছাড়া আর কিছু ছিল না, এসব লোকদেরকে বের করে দাও তাদের জনপদ থেকে; বড়ো পাক-পবিত্র হয়ে পড়েছে এরা”- (আ’রাফঃ ৮০-৮২)।
তাদের কথাটাই যেন এই, লূত ও তাঁর অনুসারীদের আমাদের এ কাজ পছন্দ না হয় তো না হোক। কিন্তু আমাদের কাজে বাধা দেবার কি অধিকার তাদের আছে?
চরিত্রবান হয়ে রুচিসম্মত জীবন যাপন করার যে নসিহত হযরত লূত (আ) করছিলেন, তা তাদের কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না, তাই তারা তাঁকে তাদের শহর থেকে বহিষ্কার করে দিতে মনস্থ করল। জাহেলিয়াতের ভ্রান্ত চিন্তাধারা ও মতবাদ হতভাগা জাতিকে সত্যের আলোক থেকে এতোটা দূরে নিক্ষেপ করেছিল এবং তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেককে এতোটা বিকল ও বিকৃত করে ফেলেছিল যে, তৌহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের দাওয়াতে তারা সাড়া দেবে কি করে? বরং সত্যের আহবানকারীকে তারা তাদের জীবনের শত্রু মনে করলো। সর্বাত্মক চেষ্টার পরও যখন তাদের কোন মানসিক পরিবর্তন হলো না, তখন আল্লাহতায়ালা তাঁর শাশ্বত নীতি অনুযায়ী তাদেরকে পাকড়াও করলেন এবং তাদেরকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেন।
এ জাতির ধ্বংসের বিবরণ কুরআন পাকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
“(হে নবী মুহাম্মদ!) ইব্রাহীমের সম্মানিত মেহমানদের কাহিনী কি তোমার কাছে পৌঁছেছে? তারা তার কাছে গিয়ে বললো, তোমার প্রতি সালাম। সে বললো, তোমাদের প্রতিও সালাম। তার কাছে তারা অপরিচিত লোক মনে হলো। তারপর সে তার স্ত্রীর নিকটে চুপি চুপি গেল এবং একটা মোটা তাজা ভুনা বাছুর এনে (খাবার জন্যে) মেহমানদের সামনে রাখলো। তারপর বললো, তোমরা খাচ্ছ না কেন? (তাদেরকে খেতে না দেখে) তাদের সম্পর্কে সে মনে মনে ভয় পেয়ে গেল। তারা বললো, ভয় পেয়ো না; তারা তাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দিল। এ কথা শুনে তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে সামনে এলো এবং আপন গাল চাপড়িয়ে বলতে লাগলো- এ বৃদ্ধা-বন্ধ্যার (ছেলে হবে)?
তারা বললো, তোমার রব তাই বলেছেন। তিনি বিজ্ঞ ও সবকিছু জানেন।
ইব্রাহীম বললো, হে খোদার প্রেরিত ফেরেশতাগণ, তোমরা কোন অভিযানে এসেছ?
তারা বললো, আমরা এক অপরাধী জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছি, যেন তাদের উপর পাকা মাটির পাথর বর্ষণ করি যা তোমার খোদার সীমালংঘনকারী লোকদের জন্যে চিহ্নিত আছে”- (যারিয়াতঃ ২৪-৩৪)।
কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে-
“আর আমরা লূতকে পাঠালাম, যখন সে তার জাতির লোককে বললো, তোমরা তো এমন নির্লজ্জ গর্হিত কাজ কর যা তোমাদের আগে দুনিয়ায় কেউ করেনি। তোমাদের অবস্থা কি এই যে, তোমরা (যৌনক্রিয়ার জন্যে) পুরুষদের কাছে যাও, রাহাজান কর এবং নিজেদের মজলিসে (সবার সামনে) খারাপ কাজ কর।
তার জাতির কাছে এ ছাড়া আর জবাব ছিল না- ‘নিয়ে এসো তোমার আল্লাহর আজাব যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাক’।
লূত বললো, হে আমার খোদা! এসব দুষ্কৃতিকারী লোকদের মুকাবিলায় তুমি আমাকে সাহায্য কর।
তারপর আমার প্রেরিত ফেরেশতারা যখন সুসংবাদসহ ইব্রাহীমের কাছে পৌঁছলো, তখন তারা বললো, আমরা এ জনপদের লোকদেরকে ধ্বংস করে দেব। তারা বড়ো জালেম হয়ে পড়েছে।
ইব্রাহীম বললো, সেখানে তো লূতও আছে। তারা বললো, আমরা ভালোভাবে জানি সেখানে কে কে আছে। আমরা তাকে এবং তার স্ত্রী ছাড়া তার পরিবারের অন্যান্য লোকদেরকে রক্ষা করব। তার স্ত্রী পেছনে পড়ে থাকা লোকদের মধ্যে ছিল (এ জন্যে)। পরে আমার ফেরেশতারা যখন লূতের নিকট পৌঁছলো তখন তাদের আগমনে সে খুবই উদ্বিগ্ন ও মনমরা হয়ে পড়লো। তারা বললো, ভয় নেই, চিন্তা ও দুঃখ করো না, আমরা তোমাকে ও তোমার পরিবারের লোকদেরকে বাঁচাব- তোমার স্ত্রী ছাড়া, যে পেছনে পড়ে থাকা লোকদের মধ্যে গণ্য। আমরা এ লোকদের উপর আসমান থেকে আজাব নাযিল করব, সে সব পাপাচারের জন্যে যা তারা করে”- (আনকাবুতঃ ২৮-৩০)।
আল্লাহর ফেরেশতাগণ সুশ্রী ও সুদর্শন বালকের রূপ ধারণ করে হযরত লূতের মেহমান হয়েছিলেন। হযরত লূত (আ) বুঝতে পারেননি যে, তাঁরা ফেরেশতা ছিলেন। শহরের পাপিষ্ঠ লোকেরা সুন্দর সুন্দর বালকের আগমেন সংবাদের আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে পড়ে এবং হযরত লূতের বাড়ীতে ভিড় জমাতে থাকে। কুরআনে তার এভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে-
“ইতোমধ্যে শহরবাসী আনন্দে গদগদ হয়ে লূতের বাড়িতে চড়াও হলো। লূত বললো, ভাইসব, এসব আমার মেহমান, আমার মুখ কালো করো না। আল্লাহকে ভয় কর, আমাকে লাঞ্ছিত করো না। তারা বললো, তোমাকে কি আমরা বার বার বারণ করে দেইনি যে, সারা দুনিয়ার ঠিকাদার হয়ো না? অবশেষে অতি প্রত্যুষে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ তাদেরকে পেয়ে বসলো। গোটা জনপদকে আমরা লণ্ডভণ্ড ও ওলট-পালট করে দিলাম। পোড়ামাটির পাথর তাদের উপর বর্ষণ করলাম”- (আল হিজরঃ ৬৭-৭৪)।
এমনও হতে পারে যে, একটি আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে এসব প্রস্তর মাটির তলা থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে জনপদ ধ্বংস করেছে। অথবা এমনও হতে পারে যে, প্রচণ্ড ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রস্তর বর্ষণ করে।
হযরত লূতের কর্মক্ষেত্র
হযরত লূত (আ) ইব্রাহীম (আ)-এর ভাইপো ছিলেন। এমন অঞ্চল তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল যাকে আজকাল ট্রান্সজর্দান (Trans Jordan) বলে যা ইরাক ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ অঞ্চলের সদর ও কেন্দ্রীয় স্থানের নাম বাইবেলে সদোম (SODOM) বলা হয়েছে। যেহেতু সদোমবাসী লূত জাতি সমকামিতার পাপাচারে লিপ্ত ছিল, সেজন্যে বর্তমানকালেও পুরুষদের মধ্যে পরস্পর যৌনক্রিয়াকে sodomy বলা হয়। এ শহরটি লূত সাগরের (DEAD SEA) পার্শ্ববর্তী কোন স্থানে অবস্থিত ছিল যা সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
যে ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক দুষ্কর্মের জন্যে লূত জাতি কুখ্যাত হয়ে আছে, তা আজও চরিত্রহীন লোকেরা পরিত্যাগ করতে পারেনি। গ্রীক দার্শনিকরা এ জঘন্য অপরাধকে একটা নৈতিক গুণ বলে অভিহিত করে এবং জার্মানীসহ বিভিন্ন পাশ্চাত্য দেশে একে আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। অতীত জাহেলিয়াতের যুগের যে ঘৃণ্য অপরাধকে মানুষ অপরাধ মনে করেনি, বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা তথা আধুনিক জাহেলিয়াতের যুগে এ কাজকে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রচার করা হচ্ছে।
সমমৈথুন একটি প্রকৃতি-বিরোধী কাজ। মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে সমমৈথুন দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যে কর্মস্বাধীনতা দান করা হয়েছে। মানুষ এ স্বাধীনতার অপব্যবহার করে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা সমস্ত জীবজন্তুর মধ্যে স্ত্রী ও পুরুষের পার্থক্য করে রেখেছেন বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। মানুষের বেলায় এর পশ্চাতে অতিরিক্ত এক মহান উদ্দেশ্য রয়েছে তা এই যে, স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি পরিবার গঠন করবে এবং তার থেকে গড়ে উঠবে সমাজ ও সভ্যতা। এ উদ্দেশ্যে উভয়ের লিংগ ভিন্ন ধরনের করা হয়েছে। তাদের আকার-আকৃতি, গঠন, আপন-আপন কর্মক্ষমতা ও কর্মধারাও পৃথক করা হয়েছে। একটিকে কর্মক্ষমতা দান করা হয়েছে এবং অপরটিকে সে কর্মের প্রভাব গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের পারস্পরিক মিলন ও সংগমে রেখে দেয়া হয়েছে এক অপূর্ব স্বাদ আস্বাদন যা পরস্পরকে আকৃষ্ট করে। যে মানুষ (মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণী এ কাজ করে না) প্রকৃতি পরিপন্থী সমমৈথুনের মাধ্যমে যৌন লালসা চরিতার্থ করে, সে একই সাথে কয়েক প্রকারের অপরাধ করে।
এক- সে নিজেই তার ক্রিয়াকর্মের ধরন ও গঠন এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে এবং এতে এক চরম বিকৃতি ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে, যার ফলে তার দেহ, মন ও নৈতিকতার উপর বিরাট প্রভাব পড়ে।
দুই- সে প্রকৃতির সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে। কারণ যে যৌন আনন্দ আস্বাদনকে সমাজ-সভ্যতার খেদমতের পারিশ্রমিক গণ্য করা হয়েছে এবং যে পারিশ্রমিক লাভের জন্যে কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আরোপ করা হয়েছে, তা সে লাভ করতে চায় কোন প্রকার দায়িত্ব-কর্তব্য পালন না করেই।
তিন- সে সমাজের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করে। সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন তামাদ্দুনিক প্রতিষ্ঠানের ফায়দা হাসিল করে। কিন্তু নিজে এ সবের কোন খেদমত না করে একান্ত স্বার্থপরতার সাথে তার দৈহিক শক্তি ও সময় এমন কাজে ব্যয় করে- যা সমাজ সভ্যতা ও নৈতিকতার জন্যে ভয়ানক ক্ষতিকর হয়। সে নিজেকে তার বংশ-পরিবারের খেদমতের একেবারে অযোগ্য বানিয়ে দেয়। সে নিজের সাথে অন্ততঃ একজন পুরুষকে অস্বাভাবিক নারীসুলভ কাজে নিয়োজিত করে এবং অন্ততঃ দু’জন নারীর জন্যে যৌন উৎশৃংখলতা, নৈতিক অধঃপতন ও বিপর্যয়ের দুয়ার খুলে দেয়। এ কারণেই লূত জাতিকে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেন, যাতে করে বিবেকবান মানুষ এ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
শুয়াইব জাতি
মাদইয়ানবাসী এবং আয়কাহবাসীকে শুয়াইব জাতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাদের হেদায়েতের জন্যে আল্লাহতায়ালা হযরত শুয়াইব (আ)-কে নবী করে পাঠান। এ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে যে, মাদইয়ানবাসী ও আয়কাহবাসী কি একই জাতি ছিল, না পৃথক পৃথক দু’টি জাতি। কেউ কেউ এ দু’টিকে দু’টি পৃথক জাতি বলেছেন। কেউ কেউ উভয়কে একই জাতি বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। অনুসন্ধানে জানতে পারা যায় যে, উভয় মতই সঠিক। মাদইয়ানবাসী ও আয়কাহবাসী দু’টি পৃথক জাতি হলেও তারা একই বংশের দু’টি শাখা। হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর যেসব সন্তান তাঁর বিবি কাতুরার গর্ভজাত তারা বনী কাতুরা নামে খ্যাত। তাদের মধ্যে যে গোত্রটি সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ তা মাদইয়ান বিন ইব্রাহীমের দিক দিয়ে ‘আসহাবে মাদইয়ান’ নামে খ্যাত। তাদের আবাসস্থল উত্তর হেজাজ থেকে শুরু করে, ফিলিস্তিনের দক্ষিণাঞ্চল এবং সেখান থেকে সিনাই উপত্যকার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত লোহিত সাগর ও আকাবা উপসাগরের তীর পর্যন্ত বিস্তৃত। তার সদর কেন্দ্রীয় স্থল মাদইয়ান শহর। বনী কাতুরার অবশিষ্ট গোত্রগুলোর মধ্যে দেদান (Dedanites) তুলনামূলকভাবে অধিক প্রসিদ্ধ। তারা উত্তর আরবের তাইমার এবং তবুক ও আলউলার মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের কেন্দ্রীয় শহর ছিল তবুক, যাকে প্রাচীনকালে আয়কাহ বলা হতো। মাদইয়ানবাসী ও আয়কাহবাসীদের জন্যে একই পয়গম্বর পাঠাবার কারণ সম্ভবতঃ এ ছিল যে, উভয়ে একই বংশোদ্ভূত ছিল এবং একই ভাষায় কথা বলতো। উভয়ের অঞ্চল পরস্পর সংলগ্ন ছিল। তাদের মধ্যে হয়তো বিয়ে-শাদীরও প্রচলন ছিল এবং উভয়ের পেশা ছিল ব্যবসায়-বাণিজ্য। তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা একই রকম। তারা ব্যবসায়ে ছিল অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ। শির্ক-কুফরেও তারা নিমজ্জিত ছিল।
“আর মাদইয়ানবাসীদের প্রতি আমরা তাদের ভাই শুয়াইবকে পাঠালাম। সে বললো, হে আমার জাতির লোকেরা! আল্লাহর দাসত্ব-আনুগত্য কর। তিনি ছাড়া তোমাদের খোদা কেউ নেই। আর ওজন ও মাপ-জোকে কম করো না। আজ তোমাদেরকে আমি ভালো অবস্থায় দেখছি। কিন্তু আমার ভয় হয়, কাল তোমাদের উপর এমন দিন আসবে যার আজাব তোমাদের সকলকে ঘিরে ফেলবে। হে আমার জাতির ভাইয়েরা! ঠিক ঠিকভাবে ইনসাফ সহকারে পূর্ণ ওজন ও পরিমাপ কর। আর লোকদের জিনিসে (ভেজাল বা খারাপ মাল দিয়ে) কোনরূপ ক্ষতির সৃষ্টি করো না। আর দুনিয়ায় ফাসাদ ছড়িয়ে বেড়িয়ো না”- (হুদঃ ৮৪-৮৫)।
পূর্ববর্তী নবীর শিক্ষা-দীক্ষা ভুলে যাওয়ার ফলে তারা প্রকৃতির দাস হয়ে পড়েছিল। খোদার পরিবর্তে তারা মনগড়া দেবদেবীর পূজা করতো। তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতকে তারা অস্বীকার করতো। ফলে তারা হয়ে পড়েছিল দুর্নীতিপরায়ণ, জালেম ও পাপাচারী। লূত জাতির ন্যায় বিশ্বাসমূলক গোমরাহির সাথে সাথে নৈতিক অবক্ষয়, ব্যবসায়ে অসাধুতা ও দুর্নীতিতে তারা কুখ্যাত হয়ে পড়েছিল। শুয়াইব নবী তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চারিত্রিক সংশোধনের জন্যে নামাযের তাগিদও করেন। তারা তা কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না।
শুয়াইবের জাতির লোকেরা জবাবে বলে-
“হে শুয়াইব! তোমার এ নামায কি (আমাদের প্রতি এ দাবি করার) হুকুম দিচ্ছে যে, আমরা ঐসব খোদা পরিত্যাগ করব আমাদের পূর্বপুরুষ যাদের পূজা করতো?”- (হুদঃ ৮৭)।
‘আমাদের পূর্বপুরুষ যাদের পূজা করতো’- কথাটির মধ্যে জাহেলিয়াতের সেই অন্ধ অনুসরণ নীতির এক খোঁড়া যুক্তি লুকায়িত আছে। তাদের কথা হলোঃ আমাদের জ্ঞানী গুণী মনীষীদের তুলনায় তোমার কথার কি মূল্য আছে? তাঁরা যে অমুক অমুককে খোদা বলে মানতেন- তা ভুল ছিল, আর তোমার কথাই ঠিক?
তাঁর নবুওতের দাবির প্রতি উপহাস করে বললো, তুমি আল্লাহর প্রেরিত এ কথা মিথ্যা। আমাদের মতই একজন মানুষ হয়ে তুমি বিশ্বপ্রভুর প্রেরিত কি করে হতে পার? তুমি তো একটি পাগল। যাদু করে তোমার বুদ্ধি-বিবেক বিকল ও বিকৃত করা হয়েছে।
“তুমি একজন যাদুগ্রস্ত লোক। আর আমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া কিছু নও। আমরা তো তোমাকে মিথ্যাবাদীই মনে করি”- (শুয়ারাঃ ১৮৬)।
দাওয়াতের বুনিয়াদী দফা তারা যেভাবে প্রত্যাখ্যান করে, যেসব আজেবাজে যুক্তি পেশ করে তার মধ্যে নতুনত্ব কিছু ছিল না। পূর্ববর্তী নবীগণের দাওয়াত জাহেলিয়াত ও প্রবৃত্তির দাসগণ যেভাবে এবং যেসব খোঁড়া ওজর-আপত্তি তুলে প্রত্যাখ্যান করে, শুয়াইব জাতিও তাই করে। নবী শুয়াইব (আ) যখন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্নীতি, প্রতারণা ও বেঈমানীর তীব্র সমালোচনা করেন, তখন জাহেলিয়াতের এক নতুন দৃষ্টিভংগী প্রকাশ লাভ করলো। তাদের যুক্তি হলো যে, রুজি-রোজগারের সাথে নৈতিকতার কি সম্পর্ক? তারা নবীর মুখের উপর বলে দিলঃ তোমার এ মূর্খতাসুলভ কথায় আমরা আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ কুরবানী করব? পরিমাপে হেরফের করে আমরা ব্যবসায়ে যে সুযোগ-সুবিধা লাভ করি তা এজন্যে পরিত্যাগ করব যে, আখিরাতে আমাদের ক্ষতি হবে? আর সেই আখিরাতটাই বা কি তা তো আমাদের বুঝে আসে না? আর যদি কখনো সংঘটিত হয়ও, তার জন্যে আমরা আমাদের দুনিয়া বরবাদ করব? নগদ ছেড়ে বাকীর আশায় থাকা আমরা চরম বোকামি মনে করি। তোমার যা ভালো লাগে কর। আমাদের উপর তা চাপিয়ে দিচ্ছ কেন?
জাতির সমাজপতিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে একে অপরকে সাবধান করে দিল।
“যেসব সর্দারেরা তাঁর কথা মানতে অস্বীকার করেছিল তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলোঃ তোমরা যদি শুয়াইবের কথা মেনে চল তাহলে (আর্থিক দিক দিয়ে) বরবাদ হয়ে যাবে”- (আ’রাফঃ ৯০)।
এ সামান্য কথাটির তাৎপর্য অনেক বেশি। মাদইয়ানের সমাজপতি ও নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ছিল এই যে, হযরত শুয়াইব (আ) যেসব কথা বলছেন, যে ঈমানদারী ও সততার দাওয়াত দিচ্ছেন এবং যেসব স্থায়ী নীতি-নৈতিকতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাইছেন, তা আমরা কি করে মেনে নিতে পারি? আমরা দুনিয়ার সর্ববৃহৎ দু’টি বাণিজ্যিক রাজপথ নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। আমরা মিসর ও ইরাকের মতো দু’টি উন্নত রাষ্ট্রের সীমান্তের উপরে বসবাস করি। আমরা যদি বাণিজ্যিক কাফেলাগুলির উপর আমাদের প্রভাব ও চাপ সৃষ্টি না করি এবং সৎ ও ভালো মানুষের মতো আচরণ করি, তাহলে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমরা যেসব সুযোগ-সুবিধা লাভ করছি তা সব নষ্ট হয়ে যাবে। তারপর পার্শ্ববর্তী জাতিগুলির উপর আমাদের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে তাও শেষ হয়ে যাবে।
দুনিয়াবী স্বার্থহানির এ আশংকা শুধু শুয়াইব জাতির সমাজপতিদের মধ্যেই সীমিত ছিল না, প্রত্যেক যুগের বিকৃত মন-মানসিকতা ও চরিত্রের লোকেরাই সততা ও বিশ্বস্ততার আচরণে এ আশংকাই অনুভব করেছে। প্রত্যেক যুগের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী লোকদের এ ধারণাই ছিল যে, ব্যবসায়-বাণিজ্য, রাজনীতি এবং অন্যান্য পার্থিব কাজ-কারবার মিথ্যা, বেঈমানী এবং শঠতা-প্রতারণা ব্যতীত চলতে পারে না। প্রত্যেক যুগে ও স্থানে দাওয়াতে হকের মুকাবিলায় যেসব ভয়ানক ওজর-আপত্তি পেশ করা হয়েছে তার মধ্যে একটা এও ছিল যে, দুনিয়ার প্রচলিত পথ ও পন্থা পরিহার করে এ দাওয়াত মেনে নিলে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। বর্তমান যুগের জাহেলিয়াতপন্থীরাও ঐ একই ধারণা পোষণ করে।
মাদইয়ানবাসী শুধু নবীর দাওয়াত অস্বীকারই করেনি, তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার ধমকও দিয়েছে।
“গর্ব অহংকার মদমত্ত তাঁর জাতির সর্দার সমাজপতিরা বললো, হে শুয়াইব! তোমাকে এবং তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে অবশ্য অবশ্যই বের করে দেব, অন্যথায় তোমাদেরকে আমাদের মিল্লাতে ফিরে আসতে হবে”- (আ’রাফঃ ৮৮)।
যখন তাদের সৎপথে ফিরে আসার আর কোন সম্ভাবনাই রইলো না, তখন আল্লাহতায়ালা তাদেরকে ধ্বংস করে দিলেন।
“তারপর হলো এই যে, এক প্রলয়ংকরী দুর্যোগ তাদের উপর এসে পড়লো। তারপর তারা তাদের আপন আপন গৃহে উপুড় হয়ে মরে পড়ে রইলো”- (আ’রাফঃ ৯১)।
তাদের এ ধ্বংসকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-
“শুয়াইবের দাওয়াতকে মিথ্যা মনে করে যারা প্রত্যাখ্যান করেছিল, (তারা এমনভাবে নিশ্চিহ্ন হলো যে) যেন তারা কোনদিন এসব স্থানে মোটেই বসবাসই করেনি”- (আ’রাফঃ ৯২)।
মাদইয়ানবাসীর এ ধ্বংসলীলা বহুকাল যাবত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লোকদের জন্যে স্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রইলো। বাতিলপন্থীদের ধ্বংস এভাবেই হয়ে থাকে।
ফেরাউনের জাতি
কালের চাকা ঘুরতেই থাকে এবং ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষও চলতেই থাকে। অবশেষে এক সময় মিসর ভূখণ্ডে আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত ইউসুফ (আ)-এর তিরোধানের কয়েকশ’ বছর পর কিবতী জাতি উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করে এবং ফেরাউনী পরিবারের শাসন কায়েম হয়। ফেরাউনী শাসনকালে গোটা জাতি জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। ইসলামের প্রতি বিশ্বাস পোষণকারী বনী ইসরাইলের প্রতি চরম নির্যাতন-নিষ্পেষণ শুরু হয়। কিবতীদের ভ্রান্ত সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রভাবে বনী ইসরাইলগণও বিকৃতির শিকার হয়। তাদের সংস্কার, সংশোধন ও পথনির্দেশনা এবং ফেরাউনী শাসনের অক্টোপাস থেকে তাদের মুক্তির উদ্দেশ্যে যখন হযরত মুসাকে (আ) সে দেশে প্রেরণ করা হয়, তখন কিবতী জাতির মধ্যেও ইসলামী দাওয়াতের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়। নবীগণের দাওয়াতের রীতিনীতি অনুযায়ী হযরত মুসা (আ) জাতির শাসক হিসেবে ফেরাউন ও তার সভাসদবৃন্দকে তাঁর দাওয়াতের প্রথম টার্গেট (লক্ষ্য) হিসেবে বেছে নেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি সে নির্দেশই দেয়া হয়।
“ফেরাউনের কাছে যাও। সে বিদ্রোহী হয়েছে। তাকে গিয়ে বলঃ তুমি কি এজন্যে প্রস্তুত যে, পবিত্রতা অবলম্বন করবে এবং আমি তোমার রবের দিকে তোমাকে পথ দেখাই যাতে তোমার মধ্যে তাঁর ভয় সৃষ্টি হয়”- (নাযিয়াতঃ ১৭-১৯)।
“জালেম জাতির কাছে যাও- ফেরাউন জাতির কাছে, এরা কি ভয়াবহ পরিণাম থেকে বাঁচতে চায় না?”- (শুয়ারাঃ ১১)।
কুরআন পাকের বহু স্থানে প্রসংগক্রমে হযরত মুসা (আ) ও ফেরাউনের উল্লেখ করা হয়েছে। তা একত্র করলে এক দীর্ঘ ইতিহাস হবে। সে ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা করার পরিবর্তে এখানে জাহেলিয়াতের চিরাচরিত কূটতর্ক, হঠকারিতা, অন্ধ অনুসরণ ও কুসংস্কারের মৌলিক দিকগুলি তুলে ধরা হচ্ছে। প্রথমে তাদের কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের কিঞ্চিৎ আলোচনা করা হলো।
ফেরাউন নামের অর্থ
ফেরাউন শব্দের অর্থ সূর্যদেবতার সন্তান। প্রাচীন মিসরবাসীর মহাদেবতা ছিল সূর্য এবং সূর্যকে তারা রা’ বলতো। ফেরাউন বলতে তার সন্তানদেরকেই বুঝাতো। মিসরবাসী বিশ্বাস করতো যে, দেশ শাসনের ক্ষমতা সেই পেতে পারে যে রা’ দেবতার রূপ ধারণ করে তার অবতার হিসেবে আগমন করবে। এ বিশ্বাস অনুযায়ী মিসরে যে রাজবংশই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদেরকে সূর্যদেবতার বংশধর বলে প্রচার করা হতো। যে ব্যক্তিই শাসন ক্ষমতার আসনে সমাসীন হতো সে নিজেকে ফেরাউন নামে অভিহিত করতো। আসলে এটা প্রকৃত নাম নয়, একটি রাজউপাধি মাত্র। এর থেকে এ ধারণাও দেয়া হতো যে, যেহেতু সে দেবতার অবতার, অতএব সে সেই দেশবাসীর পরমেশ্বর বা মহাদেবতা।
উল্লেখ্য যে, হযরত মুসা (আ)-এর কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে কুরআন পাকে দু’জন ফেরাউনের উল্লেখ পাওয়া যায়। একজন যার শাসনকালে হযরত মুসা (আ) জন্মগ্রহণ করেন এবং তার দ্বারা লালিত-পালিত হন। গবেষকদের মতানুসারে তার নাম ছিল দ্বিতীয় আমীস। যার নিকটে ইসলামের দাওয়াত ও বনী ইসরাইলের মুক্তির দাবিসহ হযরত মুসা (আ) প্রেরিত হয়েছিলেন- সে ছিল দ্বিতীয় ফেরাউন, নাম ‘মুনফাতা’ বা ‘মিনফাতা’।
ফেরাউনের জাতিকে আল্লাহতায়ালা স্বয়ং জালেম জাতি বলে অভিহিত করেন। গোটা জাতি জালেম এবং ফেরাউন সে জালেমদের সর্দার ছিল। এতে করে তার অত্যাচার, নির্যাতন যে কত নিষ্ঠুর, পৈশাচিক ও লোমহর্ষক ছিল তা অনুমান করা যায়। তাই ইসলামী দাওয়াতের জবাবে তারা পূর্বের খোদাদ্রোহীদের মতোই আচরণ করেছিল। তারা বলেছিল-
“এসব কথা তো আমাদের বাপ-দাদার আমলে কখনোই শুনিনি”- (কাসাসঃ ৩৬)।
নবীর দাওয়াত অস্বীকার করার পেছনে যুক্তি ঐ একই ছিল। অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ। তাদের মূলকথাঃ আমাদের পূর্বপুরুষ অবশ্যই জ্ঞানী-গুণী ছিলেন, তারা যখন খোদাকে এক ও লা-শরীক মানতেন না, আখিরাতেরও কোন ধারণা পোষণ করতেন না, আর না এ ধারণা রাখতেন যে, সাধারণ এক মানুষ খোদার প্রেরিত হতে পারে, তাহলে এ ব্যক্তির কথা কি করে বিশ্বাস করা যায়?
সকল যুগের এ ধরনের মানসিকতা সম্পর্কে কুরআনে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে-
“তাদেরকে যখন বলা হয় যে, আল্লাহ যেসব হুকুম নাযিল করেছেন তা মেনে চল, তখন তারা জবাবে বলে, আমরাও সেসব রীতিনীতিই মেনে চলব যেসব মেনে চলতে আমরা আমাদের বাপদাদাকে দেখেছি।”
“আচ্ছা যদি তাদের বাপদাদা বুদ্ধি-বিবেচনাসহ কোন কাজ করে না থাকে এবং সরল-সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে না থাকে, তাহলেও কি এরা তাদের অনুসরণ করতে থাকবে?”- (বাকারাহঃ ১৭০)।
“আল্লাহর পথে চলতে অস্বীকার যারা করেছে তাদের অবস্থা ঠিক এরূপ, যেমন রাখাল পশুগুলিকে ডাকে, কিন্তু তারা ঐ ডাকের আওয়াজ ব্যতীত আর কিছুই শুনতে পায় না। এরা বধির, বোবা, অন্ধ। এ জন্যে কোন কথা এরা বুঝতে পারে না”- (বাকারাহঃ ১৭১)।
খোদা ও আখিরাতের ভয়, সৎকর্মশীলতা, মহান চারিত্রিক গুণাবলীর ধারণা সুস্থ বিবেকেরই কামনার বস্তু। এতে আত্মার পরম প্রশান্তি লাভ করা যায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করে। এ নির্বুদ্ধিতাসুলভ আচরণের কারণ সকল যুগে একই ধরনের হয়ে থাকে। মানুষের আত্মবিস্মৃতি, মন মানসিকতা ও চিন্তাচেতনার বিস্মৃতি, প্রবৃত্তিপূজা, পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুকরণপ্রিয়তা, ক্ষমতামদমত্ত গর্ব অহংকার প্রভৃতি এমন কঠিন যবনিকা বা লৌহ প্রাচীরের মত কাজ করে যে, তা অতিক্রম করে হেদায়েতের আলো মানুষের হৃদয় প্রদেশে প্রবেশ করতে পারে না। তাই তাদেরকে বধির, বোবা ও অন্ধের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
সকল যুগে, কি অতীত যুগে আর কি আধুনিক যুগে, একই অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গের মধ্যে তা-ই দেখা গেছে। ক্ষমতামদমত্ত ফেরাউন আল্লাহতায়ালার একত্ব, প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, সার্বভৌমত্ব, সৃষ্টিজগতের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য সবকিছুই অস্বীকার করে বসে। হযরত মুসা (আ) এবং তাঁর ভাই হযরত হারুন (আ) খোদার নির্দেশে ফেরাউনের মন্ত্রীসভার বৈঠকে সকলের সামনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন-
“নিঃসন্দেহে আমরা রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে প্রেরিত”- (শুয়ারাঃ ১৬)।
“তারা সাথে সাথেই বলে ওঠে, এ রাব্বুল আলামীন আবার কোন জিনিস?”- (শুয়ারাঃ ২৩)।
তাদের এ জিজ্ঞাসার মধ্যে বিস্ময় ছিল এবং কিছুটা বিদ্রুপও ছিল। তার অর্থ এ ছিল না যে, তারা একেবারে নাস্তিক ছিল, খোদার অস্তিত্ব অস্বীকারকারী ছিল। বরং বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ এমনকি তাঁর ফেরেশতাদের অস্তিত্বেও তারা বিশ্বাসী ছিল।
“একদিন ফেরাউন তার জাতির লোকদেরকে ডেকে বললোঃ হে জাতির লোকেরা! মিসরের বাদশাহী কি আমার নয়? আর এ নদ-নদীগুলি কি আমার অধীনে প্রবাহিত নয়? তোমরা কি তা দেখছ না? আমি কি ভালো মানুষ, না এ ব্যক্তি যে হীন ও লাঞ্ছিত? সে নিজের কথাও স্পষ্ট করে বলতে পারে না। তার উপর সোনার কাঁকন ফেলে দেয়া হয়নি কেন? অথবা (আল্লাহর প্রেরিত হলে) ফেরেশতাদের একটা বাহিনী তার আগে-পিছে পাহারাদারীর জন্যে এলো না কেন?”- (যুখরুফঃ ৫১-৫৩)।
তার ভ্রান্ত সংকীর্ণ চিন্তাধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি এই ছিল যে, আল্লাহ বিশ্বজগতের স্রষ্টা এবং বিরাট বিশাল প্রকৃতিরাজ্যে তাঁর কর্তৃত্ব ও হুকুম শাসন চলছে, চলুক। কিন্তু মিসর ভূখণ্ডের বাদশাহ যেহেতু আমি এবং এ দেশের পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, গাছপালা, মানুষ ও জীবকুলের মালিক যেহেতু আমি, অতএব আমার দেশে আমার হুকুম শাসন ছাড়া আর কারো হুকুম শাসন চলতে পারে না। সে ছিল অত্যন্ত ক্ষমতা গর্বিত। যার ফলে সে গোটা জাতিকে তার অনুগত দাসানুদাসই মনে করতো। সে সকলকে তুচ্ছ, নগণ্য ও ঘৃণ্য লাঞ্ছিত মনে করতো। তার ক্ষমতা-দাপট ও গর্ব-অহংকার হযরত মুসার (আ) নবুওত মেনে নিতে দেয়নি। তাছাড়া তার দৃঢ় বিশ্বাস, মানুষ কখনো আল্লাহর প্রেরিত রসূল হতে পারে না। আর আল্লাহর কাউকে রসূল করার ইচ্ছা থাকলে সমাজে যে ধন-ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার অধিকারী তাকেই রসূল বানানো মানায়। হযরত মুসা (আ) সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রভাব-প্রতিপত্তিশীল ও ধনশালী কোন ব্যক্তি নয়, তার হাতে সোনার কাঁকনও নেই এবং আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধি হলে অবশ্যই সামনে এবং পেছনে ফেরেশতাদের বিরাত বাহিনী থাকতো, রাজা বাদশাহদের মতো সে শান-শওকতসহ চলাফেরা করতো। এর কোনটিই যখন নেই, তখন তার সকল দাবি মিথ্যা।
বহু অকাট্য যুক্তি, সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি ও অলৌকিক ক্রিয়াকর্ম প্রদর্শনের পরও সে তার অন্ধ জিদ, ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতা থেকে বিরত না হয়ে আল্লাহর নবীর প্রতি কঠোরতর হতে থাকে। সে মুসাকে (আ) কঠোর ধমকের স্বরে বলে-
“ফেরাউন বললো, তুমি যদি আমি ছাড়া আর কাউকে খোদা মেনে নাও, তাহলে তুমি তাদের মধ্যে শামিল হবে যারা জেলের অন্ধকার কুঠরিতে ধুঁকে ধুঁকে মরছে”- (শুয়ারাঃ ২৯)।
“আমরা মুসাকে ফেরাউন, হামান ও কারুনের কাছে আমাদের নিদর্শনাবলী এবং নবী হিসেবে নিয়োগের সুস্পষ্ট সনদসহ পাঠালাম। কিন্তু তারা বললো, সে যাদুকর, মিথ্যাবাদী। তারপর যখন সে আমাদের পক্ষ থেকে সত্য তাদের সামনে নিয়ে এলো, তারা বললো- তাকে হত্যা কর এবং তারা সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদের সন্তানদেরকেও। আর মেয়েদেরকে জীবিত ছেড়ে দাও। কিন্তু তাদের কূটকৌশল ব্যর্থ হলো। এবং ফেরাউন বললো, আমাকে ছেড়ে দাও, তাকে আমি হত্যা করছি। সে তার রবকে ডাকুক। আমার ভয় হচ্ছে যে সে তোমাদের দ্বীন বদলে দেবে অথবা দেশে ফাসাদ সৃষ্টি করবে। মুসা বললোঃ আমি প্রত্যেক গর্বিত অহংকারীর মুকাবিলায়- যে হিসেবের দিনের প্রতি ঈমান রাখে না- আমার এবং তোমাদের রবের আশ্রয় নিয়েছি”- (মুমেনঃ ২৩-২৭)।
অর্থাৎ মানুষের সকল প্রকার আনুগত্য-গোলামীর শৃঙ্খল ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহর গোলামী বা হুকুম-শাসনের অধীন হওয়াই ছিল নবীগণের দাওয়াতের লক্ষ্য। ফেরাউন-নমরুদের মতো সকল যুগের স্বৈরাচারী শাসক তাদের দেশের সকল মানুষের একচ্ছত্র প্রভু হয়ে থাকতে চায়। সকলের উপর তাদেরই হুকুম শাসন চলবে, জনগণ যেন তাদেরই আইনের অধীন হয়ে থাকে। হযরত মুসার (আ) ইসলামী দাওয়াতের ফলে ফেরাউনের এ আশংকাই হয়েছিল যে, তার একচ্ছত্র প্রভুত্ব-আধিপত্য আর চলবে না। মুসার দাওয়াত মানুষের মধ্যে এমন এক মানসিক বিপ্লব এনে দেবে যে, তারা মানুষের গোলামি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করবে। এ আশংকা পোষণ করেই ফেরাউন তার সভাসদদের কাছে বললো, মুসার দ্বারা এক বিপ্লবের আশংকা আমি করছি। বিপ্লব করতে না পারলেও নিদেনপক্ষে এ আশংকা তো অবশ্যই আছে যে, তার প্রচার-প্রচারণায় দেশে বিশৃংখলা-অরাজকতা সৃষ্টি হবে, মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। অতএব হত্যার অপরাধী না হলেও নিছক জননিরাপত্তার (Maintenance of Public Order) খাতিরে তাকে হত্যা করা উচিত।
ফেরাউন বিপ্লব এ অর্থে বলেছে যে, প্রচলিত দ্বীন মুসা (আ) পরিবর্তন করে দেবেন।
“আমার ভয় হয় যে, সে তোমাদের দ্বীন বদলে দেবে।”
দ্বীন বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে শাসন ব্যবস্থা। ফেরাউন ও তার পরিবারের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির যে ব্যবস্থা মিসরে চলছিল তা-ই ছিল সে দেশের ‘দ্বীন’। হযরত মুসার (আ) দাওয়াতের ফলে তাদের এ দ্বীন পরিবর্তনের আশংকা দেখা দিয়েছিল, তার নিজের বাদশাহী, তার প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব খতম হয়ে যাবে। অতএব দ্বীন পরিবর্তনকারীকে হত্যা অবশ্যই করতে হবে। প্রত্যেক যুগেই এমনকি আধুনিক যুগের স্বৈরাচারী ফেরাউনরা যখন উপলব্ধি করেছে যে, ইসলামী আন্দোলন তাদের স্বৈরশাসনের ভিত প্রকম্পিত করে দিয়েছে, তখন হয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ খাড়া করতঃ বিচারের প্রহসন করে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, অনেককে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে এবং অনেকের উপরে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোদাদ্রোহী স্বৈরাচারী শক্তিই ধ্বংস হয়েছে। ফেরাউন তার সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করেও হযরত মুসা (আ), তাঁর ইসলামী আন্দোলন ও শক্তিকে নির্মূল করতে পারেনি। স্বয়ং সে ধরাপৃষ্ঠ থেকে নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
ফেরাউন যখন হযরত মুসাকে (আ) হত্যা করার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করলো, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি নির্দেশ এলো সমগ্র ইসলামী জনশক্তি নিয়ে মিসর ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে পড়ার।
“রাতের মধ্যেই তুমি আমার বান্দাহদের নিয়ে বেরিয়ে পড়। তোমাদেরকে কিন্তু ধাওয়া করা হবে। সমুদ্রকে তার নিজের (প্রবহমান) অবস্থায় ছেড়ে দিও। এ সমগ্র বাহিনী নিমজ্জিত হয়ে মরবে। কত বাগবাগিচা, ঝর্ণাধারা, ক্ষেতখামার ও আলীশান রাজপ্রাসাদ তারা পেছনে ফেলে গিয়েছিল। কতই না বিলাস সামগ্রী যা তারা উপভোগ করছিল, পেছনে পড়ে রইলো। এ হলো তাদের পরিণাম এবং আমরা অন্য লোকদেরকে এসবের উত্তরাধিকারী বানালাম। তারপর না আসমান, না যমীন তাদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করলো এবং তাদেরকে কিছুমাত্র অবকাশও দেয়া হলো না”- (দুখানঃ ২৩-২৯)।
হযরত মুসা (আ) আল্লাহতায়ালার নির্দেশে লোহিত সাগরের উপর তাঁর অলৌকিক লাঠি দ্বারা আঘাত করা মাত্র এপার-ওপার একটি সুন্দর ও শুকনো রাজপথ তৈরি হয়ে যায়। গোটা ইসলামী জনশক্তি নিরাপদে সমুদ্র পার হয়ে যায়। অতঃপর ফেরাউন তার বিরাট বাহিনীসহ রাজপথ দিয়ে চলা শুরু করলে হঠাৎ সমুদ্র তার স্বাভাবিক রূপ ধারণ করে এবং সমগ্র বাহিনী সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে প্রাণ হারায়। এ ধরনের স্বৈরাচারী শাসকদের যতোই বিজয়ডংকা বাজুক না কেন, এবং চাটুকার দল তাদের প্রশংসায় যতোই পঞ্চমুখ হোক না কেন, তাদের মৃত্যুর পর কেউ তাদের জন্যে শোক প্রকাশ করে চোখের পানি ফেলে না। বরং সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে আমরা ইসলাম ও জাহেলিয়াতের, হক ও বাতিলের এ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষই দেখতে পাই। ইসলাম-বিরোধী খোদাদ্রোহী শক্তির দ্বারা সত্যের পতাকাবাহীগণ নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হলেও অবশেষে বাতিল শক্তিই ধ্বংস হয়েছে।