মুসলমানদের ঐক্য ও পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত
জাহেলিয়াতের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে পুরোপুরি ইসলামের পথে চলার জন্যে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য অপরহার্য। ঐক্যবদ্ধভাবেই জাহেলিয়াতের মুকাবিলা করতে হবে। তারই জন্যে মুসলমানদের জামায়াতবদ্ধ জীবন ফরয করে দেয়া হয়েছে। কুরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ বলেন- “সকলে মিলে আল্লাহর রশি শক্ত করে ধর এবং দলাদলিতে লিপ্ত হয়ো না”- (আলে ইমরানঃ ১০৩)।
এখানে রশি অর্থে আল্লাহর দ্বীনকে বুঝানো হয়েছে। দ্বীনকে রশির সমতুল্য করে এজন্যে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এ দ্বীনের রশি দিয়ে একদিক দিয়ে যেমন ঈমানদারগণকে আল্লাহর সাথে বেঁধে দেয়া হয় অর্থাৎ আল্লাহর সাথে তাদের গভীর-নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয়া হয়, ঠিক তেমনি অপরদিক দিয়ে এটি সকল ঈমানদারকে পরস্পরের সাথে একাত্ম করে দেয় এবং তাদেরকে গভীর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি জামায়াত বানিয়ে দেয়। মুসলমানদের জীবনের লক্ষ্য যেহেতু ইকামাতে দ্বীন অর্থাৎ দ্বীন কায়েম করা ও কায়েম রাখা, সেজন্যে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব। আর এ কাজ করতে হলে জাহেলিয়াতের মুকাবিলা করে, তাকে জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে উচ্ছেদ করেই করতে হবে। তাই জামায়াতবদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম অপরিহার্য।
দ্বীনকে বা দ্বীনের রশিকে শক্ত করে ধরার অর্থ এই যে, মুসলমানের দৃষ্টিতে প্রকৃত গুরুত্ব দ্বীনের। এর প্রতিষ্ঠার জন্যে এবং প্রতিষ্ঠার পর তা অক্ষুণ্ণ ও অমলিন রাখার জন্যেই তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলবে। এ কাজের জন্যে একে অপরকে সাহায্য করবে। কিন্তু দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা ও তার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে যদি মুসলমান সরে পড়ে, ছোটো-খাটো ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি করে, তাহলে পূর্ববর্তী উম্মাতদের মতো তারা দলে উপদলে বিভক্ত হওয়ার পর জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতে চরম লাঞ্ছনার শিকার হবে। ঐক্য বিনষ্ট করে দলে-উপদলে বিভক্ত হলে জাহেলিয়াত তথা বাতিল শক্তি তার প্রভাব ও কর্তৃত্ব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। তাই বাতিলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের নির্দেশই আল্লাহ দিয়েছেন।
নবী মুহাম্মাদের (সা) নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে ইসলামের রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীকালে মুসলমানদের পারস্পরিক মতভেদ ও মতানৈক্যের কারণে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়- সে আলোচনা পরে করা হবে।
ইসলামী জামায়াত গঠন, জামায়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং জামায়াত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে হাদীসে বিশদ বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়।
ইসলামী জামায়াত, সমাজ ও রাষ্ট্রকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে মুসলমানদের অন্যান্য বহু ঈমানী গুণাবলীর সাথে আর একটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং তা হলো পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কুরআন পাকে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জামায়াত, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গৃহীত না হলে, নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয়, অনৈক্য ও দলাদলির পথ প্রশস্ত হয়। এজন্যে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
কুরআন বলে, “(হে নবী!) তুমি তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা কর; তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং দ্বীনের কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর”- (আলে ইমরানঃ ১৮৯)।
কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, “এবং যারা তাদের রবের ডাকে সাড়া দেয় (রবের প্রতিটি হুকুম মেনে চলে), এবং নামায কায়েম করে এবং নিজেদের কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে”- (শুরাঃ ৩৮)।
পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করে কাজ করাকে এখানে ঈমানের সর্বোৎকৃষ্ট গুণাবলীর মধ্যে শামিল করা হয়েছে। উপরে বর্ণিত সূরা আলে ইমরানেও এর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ইসলামী জীবন পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বিনা পরামর্শে কোন এক ব্যক্তির অথবা বিশেষ দল ও গোষ্ঠীর খুশি-খেয়াল মতো কাজ করা শুধু জাহেলিয়াতের রীতি-পদ্ধতিই নয়; বরং আল্লাহতায়ালার নির্ধারিত রীতি-পদ্ধতির একেবারে পরিপন্থীও।
পরামর্শভিত্তিক কাজের উপর এতোটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে কেন তা গভীরভাবে চিন্তা করলে তিনটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একটি হচ্ছে এই যে, যে বিষয়ের সাথে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির স্বার্থ জড়িত, সে বিষয়ে কোন এক ব্যক্তির খেয়াল-খুশি মতো সিদ্ধান্ত করে ফেলা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা নিঃসন্দেহে অন্যায় এবং অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। সামষ্টিক ও বহু ব্যক্তি সম্পর্কিত কার্যকলাপে কারো স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার থাকতে পারে না। যে বিষয়ের সাথে বহু মানুষের স্বার্থ জড়িত, তাদের সকলের স্বাধীন মতামত গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় এবং ইনসাফ তা-ই দাবি করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সংখ্যা যদি খুব বিরাট হয়, তাহলে তাদের আস্থাভাজন প্রতিনিধিগণকে পরামর্শে শরীক করাই বাঞ্ছনীয়।
দ্বিতীয় এই যে, একমাত্র সে ব্যক্তিই সামগ্রিক সামষ্টিক ব্যাপারে অন্যান্যের সাথে পরামর্শ না করে আপন স্বেচ্ছাচারিতা চালাতে চায়, যে শুধু নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। পরামর্শ না করার পেছনে তার এ মানসিকতা কাজ করে যে, সে নিজেকে সকলের চেয়ে বড়ো ও বুদ্ধিমান মনে করে এবং অপরকে তুচ্ছ ও পরামর্শের অযোগ্য মনে করে। এ হচ্ছে জাহেলিয়াতের সৃষ্ট মানসিকতা তথা ইবলিশী মানসিকতা। একজন ঈমানদার লোক এমন স্বার্থপর হতে পারে না যে, অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে নিজের স্বার্থ হাসিল করবে এবং এ গর্ব অহংকারও করতে পারে না যে সে-ই একমাত্র বুদ্ধিমান ও সবজান্তা। আর যতসব বুদ্ধিহীন ও গাধা-গর্দভ। একজন মুমিন এমন ধরনের চিন্তাও করতে পারে না।
তৃতীয় এই যে, যেসব বিষয় অপরের অধিকার ও স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেসবের ফয়সালা করা এক বিরাট দায়িত্ব। আর ইসলামের সুস্পষ্ট ঘোষণা যে, যার উপরে যে দায়িত্ব অর্পিত আছে, তাকে তার জন্যে অবশ্যই আখিরাতে খোদার কাছে জবাবদিহি করতে হবে যে, সে সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছে কিনা। অতএব যে ব্যক্তি খোদাকে ভয় করে এবং মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে, খোদার সামনে তাকে কত কঠিন জবাবদিহি করতে হবে, তাহলে সে এতো কঠিন দায়িত্বের বোঝা স্বেচ্ছায় মাথায় নেয়ার দুঃসাহস করতে পারে না। এমন কাজ তো সে-ই করতে পারে যে না খোদাকে ভয় করে আর না আখিরাতে জবাবদিহির কোন পরোয়া করে। যার মধ্যে খোদার ভয় এবং আখিরাতে জবাবদিহির অনুভূতি আছে সে অবশ্যই চেষ্টা করবে যে, একটি বিষয়ের সাথে যে যে ব্যক্তির স্বার্থ জড়িত তাদের সবাইকে অথবা তাদের মনোনীত প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সে বিষয়ে ফয়সালা করার আলোচনায় শরীক করবে যাতে সঠিক ও ইনসাফপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়।
উপরের তিনটি বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলাম যে ধরনের চরিত্রবান লোক তৈরি করতে চায় এবং তাদের মাধ্যমে সমাজে যে ইনসাফ কায়েম করতে চায় তার জন্যে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য দাবি। এ দাবি পূরণ না করা জাহেলিয়াতেরই চরিত্র। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দাবিই এই যে, প্রত্যেকটি ছোটো বড়ো সামগ্রিক-সামষ্টিক ব্যাপারই পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সমাধা করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরেই এ নীতি পালন করতে হবে। পারিবারিক ব্যাপার হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং পুত্রগণ প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদেরকেও আলোচনায় অংশীদার করতে হবে। গোত্রীয় ও মহল্লার ব্যাপারে হলে এবং সকলের সম্মিলিতভাবে আলোচনা সম্ভব না হলে সকলের সম্মিলিত ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে নির্বাচিত ও নির্ভরযোগ্য পঞ্চায়েত বা প্রতিনিধিবর্গের মাধ্যমে সমাধান করবে। কোন সম্প্রদায়ের (COMMUNITY) ব্যাপার হলে তা পরিচালনা করার জন্যে সম্প্রদায়ের সকলের অথবা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে কারো উপরে দায়িত্ব অর্পিত হবে। তখন সে ব্যক্তি সকলের সাথে অথবা তা সম্ভব না হলে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সে ব্যক্তির নেতৃত্ব বা তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ততোক্ষণ পর্যন্ত চলবে যতোক্ষণ লোক তার উপর আস্থা পোষণ করতে থাকবে। আস্থা বিনষ্ট হলে তাকে নেতৃত্ব থেকে অপসারণও করতে পারবে। কোন ঈমানদার ব্যক্তি বলপ্রয়োগে নেতা হতে বা নেতা থাকার চেষ্টা করতে পারে না। এমন ধরনের ধোঁকাও সে দিতে পারে না যে, বল প্রয়োগে জাতির নেতৃত্ব দখল করলো এবং জুলুম করে জাতির সমর্থন আদায় করলো। সে এমন ধরনের চালবাজিও করতে পারে না যে, জনগণ তাদের মর্জিমতো স্বাধীনভাবে পরামর্শ পরিষদের (শূরা বা পার্লামেন্ট) সদস্য নির্বাচন করতে পারলো না, বরং ক্ষমতা দখলকারী ব্যক্তির পছন্দ অনুযায়ী করল। ইসলামের নির্ধারিত পন্থা-পদ্ধতি পরিহার করে বলপ্রয়োগ ও ধোঁকা-প্রতারণার আশ্রয় সে ব্যক্তিই নিতে পারে যার মনে খোদার ভয় ও আখিরাতে জবাবদিহির কোন অনুভূতি নেই।
এ নীতি নবী পাক (সা) স্বয়ং মেনে চলতেন। তাঁর নিকটে আল্লাহর ওহীর মাধ্যমে সুস্পষ্ট নির্দেশ আসতো। আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ তো প্রশ্নাতীত। সে সম্পর্কে কোন পরামর্শ বা আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। তবে নির্দেশ কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে, কোন পরিবেশে কার্যকর করা হবে সে সম্পর্কে আলোচনা ও পরামর্শের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে এবং এরূপ ক্ষেত্রে নবী মুস্তাফা তা করেছেন। নবীর পরে খোলাফায়ে রাশেদার যুগেও এ নীতি পুরোপুরি মেনে চলা হয়েছে।