জাহেলিয়াতের পুনরুত্থান
ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব-সংঘাত যেহেতু চিরস্থায়ী ও চিরকালীন সেজন্যে জাহেলিয়াত ইসলামের দ্বারা পরাজিত ও পরাভূত হওয়ার পর পুনরায় ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবার অব্যাহত চেষ্টা করতে থাকে। আল্লাহতায়ালা মানুষকে জাহেলিয়াতের প্রভাব থেকে মুক্ত করে তাকে জীবনের সঠিক পথে চালাবার জন্যে যুগে যুগে নবী-রসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা মানুষের চিন্তাধারা, আকীদাহ-বিশ্বাস, স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণ জাহেলিয়াতের প্রভাব থেকে মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন করে আল্লাহর মনোনীত পথে পরিচালিত করে জীবনকে সুখী ও সুন্দর করেন। মানুষ তাদের নেতৃত্বে পরিশুদ্ধ জীবন যাপন করতে থাকে। কিন্তু তাঁদের তিরোধানের পর তাঁদের আদর্শ ও শিক্ষা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে এবং জাহেলিয়াত তাদেরকে নানান ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করে গোমরাহ করার সুযোগ লাভ করে। তারপর গোটা মানব সমাজ জাহেলিয়াতের অক্টোপাসে আবদ্ধ হয়ে যায়। যতোদিন নবীগণের আদর্শ ও নীতিমালা মানুষ আঁকড়ে ধরে থাকে ততোদিন জাহেলিয়াত আত্মগোপন করে সুযোগের সন্ধানে থাকে এবং বার বার সত্যনিষ্ঠ ও সত্যপন্থীদের মনে অসআসা (প্ররোচনা) সৃষ্টি করতে থাকে। এ প্ররোচনা সৃষ্টিকারী স্বয়ং ইবলিস শয়তান, তার অসংখ্য অগণিত অনুসারী জ্বিন ও মানুষ এবং স্বয়ং মানুষের নফস বা কুপ্রবৃত্তি। এ প্ররোচনার তীর বার বার নিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং একাধিকবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পর সঠিক স্থানে পৌঁছে যায় এবং জাহেলিয়াতের পুনরুত্থান শুরু হয়।
অবশ্যি এসব প্ররোচনাদানকারীদের প্ররোচনা থেকে আল্লাহ তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার জন্যে মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ উপেক্ষা করার ফলে এবং নানাবিধ পার্থিব স্বার্থের কারণে মানুষ প্ররোচনার শিকার হয়ে পড়ে। এভাবে জাহেলিয়াত তার গোমরাহীর সকল হাতিয়ারসহ সামনে অগ্রসর হয়।
ইতিহাস এ কথার সাক্ষী যে, সপ্তম শতকের প্রথমার্ধেই প্রথম ইসলামের সার্বিক বিজয় সূচিত হয়েছিল তা নয়। বরঞ্চ এর আগেও বার বার ইসলামের স্বর্ণযুগ এসেছে। কারণ এ এক ঐতিহাসিক সত্য যে, খোদার বান্দাহদেরকে সত্যপথ দেখাবার জন্যে বার বার নবী-রসূলগণ দুনিয়ায় তশরিফ এনেছেন। তাঁরা এমন অবস্থায় দুনিয়া ত্যাগ করেন যখন জাহেলিয়াত সত্যের কাছে মাথানত করেছে। কিন্তু কিছুকাল পর জাহেলিয়াত তার অশুভ তৎপরতা শুরু করে এবং মানুষ ক্রমশঃ বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়ে শির্ক ও কুফরে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বনী ইসরাঈলের ইতিহাসেও এ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। হযরত মুসা আলায়হিস সালাতু ওয়াসসালামের পর তাঁর সুযোগ্য ও সত্যনিষ্ঠ খলিফা ইউশা বিন নূনের জীবনকালে এবং তারপরও কিছুকাল যাবত আল্লাহর দ্বীন মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ছিল যার কারণে বিশ্ববাসীর উপর তাদেরই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ কথার উল্লেখ করে কুরআন পাকে বলা হয়েছে- “হে বনী ইসরাঈলগণ! স্মরণ কর তোমাদের প্রতি আমাদের দেয়া নিয়ামতকে। আর এ কথাও স্মরণ কর যে, আমি তোমাদেরকে দুনিয়ার জাতিসমূহের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম”- (সূরা বাকারাহঃ ৪৭, ১২২)।
কিন্তু পরবর্তীকালে যখন তাদের দ্বীনী প্রাণশক্তি নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং চিন্তা, চরিত্র ও আচরণে বিকৃতি পরিস্ফুট হতে থাকে, তখন জাহেলিয়াত তাদের উপর সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর অবস্থা এমন হয়ে পড়ে যে, বনী ইসরাঈল জাহেলিয়াতের মধ্যে একাকার হয়ে যায়। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, জাহেলিয়াত অবস্থার প্রেক্ষিতে নীরবতা অবলম্বন করলেও তা সাময়িক; রণক্ষেত্র পরিত্যাগ করে না- শুধু সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকে। জাহেলিয়াতের উৎস যেহেতু স্বয়ং ইবলিস শয়তান, এবং বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহতায়ালার বিশেষ হিকমত ও ইচ্ছার দরুন এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে শয়তান কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকবে, সে জন্যে সত্য ও মিথ্যার, মঙ্গল ও অমঙ্গলের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চিরকাল চলতে থাকবে। এ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ প্রকৃতপক্ষে মানুষের পরীক্ষার জন্যে এবং এ জন্যেই তার সৃষ্টি।
অতএব কিয়ামত পর্যন্ত ইবলিস শয়তানের চিরজীবী হওয়ার কারণে অতীতের সকল নবীর উম্মাতের সাথে সে যে আচরণ করেছে, পরবর্তীকালে ইসলাম ও উম্মাতে মুসলেমার প্রতি তার আচরণ তা-ই হওয়াই অতি স্বাভাবিক।
এ সম্পর্কে নবী মুহাম্মাদ (সা) ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন। তিনি বলেন, “তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের পদে পদে অনুসরণ-অনুকরণ করবে। এমনকি তারা যদি গোসাপের গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তোমরাও তা-ই করবে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর রসূল! পূর্ববর্তী লোকদের বলতে কি ইহুদী-নাসারা বুঝায়?” তিনি বলেন, “তাছাড়া আর কে?”- (বুখারী)।
নবীপাকের উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বাণীর অর্থ ছিল এই যে, দুনিয়ার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মঞ্চে যেসব জাতি উল্লেখযোগ্য তাদের সাথে স্বাভাবিকভাবেই তোমাদের সংযোগ সম্পর্ক স্থাপিত হবে। তারপর যতোদিন তোমাদের ঈমানের দৃঢ়তা অম্লান থাকবে ততোদিন তোমরা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে তাদেরকেই প্রভাবিত করতে থাকবে। ফলে মুসলমানরা পদে পদে তাদের অনুসরণ করা শুরু করবে। তাদের রীতিনীতি, চিন্তা-পদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান তোমরা অবলম্বন করতে থাকবে। পথভ্রষ্ট জাতি ও পাপাচারী সম্প্রদায়ের আনুগত্য করতে কোন দ্বিধাবোধ করবে না। এসব হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা ও দ্বীনী আত্মসচেতনতা সংরক্ষণ করতে পারবে না। অতঃপর চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ ও যাবতীয় কর্মকাণ্ডের দিক দিয়ে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে রাখা হয়েছিল যার সংরক্ষণ দ্বীন ও ঈমান সংরক্ষণের মতোই অত্যাবশ্যক ছিল- তা স্থানে স্থানে ধসে পড়তে থাকবে এবং মুসলমান তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও পরিচয় হারিয়ে ফেলবে।
জাহেলিয়াতের চতুর্মুখী হামলা
জাহেলিয়াত তার পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলে দিয়ে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, সে পূর্ণশক্তি দিয়ে ইসলামের উপর চতুর্মুখী হামলা চালায়। তার হামলা ছিল দ্বীনী আকীদাহ-বিশ্বাসের উপর, ইসলামী শরিয়তের উপর, ইসলামের মূলনীতি ও ধ্যান-ধারণার উপর এবং মুসলমানের জাতীয় ঐক্যের উপর। তার সর্বপ্রথম লক্ষ্য ছিল ইসলামের মৌল আকীদাহ-বিশ্বাস। যে বুনিয়াদের উপর গোটা দ্বীনী প্রাসাদ প্রতিষ্ঠিত তা ধ্বংস করতে পারলে অন্যান্য ধ্যান-ধারণা, হেদায়েত ও হুকুম-আহকাম সহজেই নির্মূল করা যায়। সে একটি একটি করে ইসলামের মৌল বিষয়গুলোর উপর তার আক্রমণ জোরদার করে।
নবুওতের উপর বিশ্বাস
তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস ছিল জাহেলিয়াতের জন্যে একেবারে অসহনীয়। কিন্তু প্রথমেই তার উপর আক্রমণ করার কোন পথ তার ছিল না। অতএব তার আক্রমণের সূচনা হয় নবুওতে মুহাম্মাদীর আকীদাহর উপর থেকে। অর্থাৎ নবুওতে মুহাম্মাদীর বিশ্বাসকে যদি নড়বড়ে অথবা বিনষ্ট করা যায় তাহলে ইসলামের অন্যান্য মৌল বিশ্বাসগুলি মন থেকে মুছে ফেলা সহজ হবে। এ উদ্দেশ্যে জাহেলিয়াত কয়েকটি রণক্ষেত্র তৈরি করে।
প্রথম রণক্ষেত্র ছিল মিথ্যানবী গঠনের। অর্থাৎ শেষনবী মুহাম্মাদ (সা)-এর পরও মিথ্যা নবুওতের দাবিদারগণের আবির্ভাব হতে থাকবে। এর প্রস্তুতি যদিও নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর জীবদ্দশাতেই চলছিল, কিন্তু তাঁর ওফাতের পর এ তৎপরতা জোরদার হয় এবং মুসায়লামা ও আসওয়াদুল আনাসী নামক দুই ব্যক্তিকে নবুওতের দাবিদার হিসেবে পেশ করা হয়। বনী হানিফা গোত্রসহ কতিপয় লোক মুসায়লামাকে এবং ইয়েমেনবাসী আসওয়াদুল আনাসীকে সমর্থন করে। কিন্তু প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) সর্বশক্তি দিয়ে এ ফেৎনার মূলোৎপাটন করেন।
অতঃপর খেলাফতে রাশেদার শেষের দিকে শিয়া ফের্কার আবির্ভাব ঘটে এবং পরবর্তীতে তা যখন বহু দলে উপদলে বিভক্ত হয় তখন তাদের মধ্য থেকে মিথ্যা নবীর আবির্ভাব ঘটতে থাকে। যেমন তাদের মনসূরীয়া ফের্কার প্রতিষ্ঠাতা আবু মনসূর ঘোষণা করে- “হযরত আলী (রা) আল্লাহর রসূল ও নবী ছিলেন। তারপর হযরত হাসান (রা), হুসাইন (রা), আলী ইবনে হুসাইন এবং মুহাম্মাদ বিন আলী সকলে রসূল ও নবী ছিলেন। আমিও একজন রসূল ও নবী এবং আমার পর ছয় পুরুষ পর্যন্ত নবুওতের ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে।”
সে আরও বলে যে, নবুওতের ধারাবাহিকতা কখনো শেষ হবে না- (আল মিলালে ওয়ান নিহালে, শাহরাস্তানী)।
খাত্তাবিয়া ফের্কার প্রতিষ্ঠাতা আবু খাত্তাব বলে, শিয়াদের সকল ইমাম নবী। মুগিরিয়া ফের্কার প্রতিষ্ঠাতা মুগিরা স্বয়ং নবুওতের দাবিদার ছিল। নূসাইরিয়া ফের্কার নেতা মুহাম্মাদ বিন নাসীরুন নুসাইরীও নবুওতের দাবি করে- (উপরোক্ত গ্রন্থ)। তাদের এসব দাবির সমর্থনে কোন যুক্তি নেই, প্রমাণ নেই, কোন খোদাপ্রদত্ত সনদ নেই। দরকারই কি? যুক্তি-প্রমাণের প্রশ্ন তুললেই তো গোলমাল, সব ভেস্তে যাওয়ার কথা। শুধু প্রয়োজন দুর্বল ঈমান ও বিকৃত মানসিকতার মুসলমানদের মধ্যে এক ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা। আর পেছনে থাকবে শয়তানের প্রবল প্ররোচনা ও প্রতারণা।
এসব মিথ্যা নবুওতের দাবিদারকে সাধারণভাবে প্রত্যাখ্যান করা হলেও মুষ্টিমেয় কিছু লোক তো অবশ্যই বিভ্রান্ত হয়েছে। জাহেলিয়াতের পাতানো ফাঁদে পড়ে বিভ্রান্ত হয়েছে, পথভ্রষ্ট হয়েছে।
এ হচ্ছে জাহেলিয়াতের নব অভিযানের একশ’ দেড়শ’ বছরের ঘটনা। হয়তো মুসলিম জগতের কোথাও কোথাও এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। বিশেষ করে মুসলমানদের পতনযুগে এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং তা ঘটেছেও। মুসলমানরা যখন তাওহীদ রিসালাত ও আখিরাতের মৌল বিশ্বাস থেকে কিছুটা সরে পড়ে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য ও রসূলের নেতৃত্ব পরিহার করে তাগুতি শক্তির কাছে মাথা নত করে তখন জাহেলিয়াত তার পূর্ণশক্তি নিয়ে মুসলমানদের আকীদাহ-বিশ্বাসের উপর চরম আঘাত হানে এবং পুরোপুরি না হলেও আংশিক বিজয় লাভ করে।
নতুন ধর্মের প্রবর্তন
ভারতের বাদশাহ আকবর ইসলাম নির্মূল করার উদ্দেশ্যে ‘দ্বীনে ইলাহী’ নামে এক উদ্ভট ধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। ইসলামের বিকল্প হিসেবেই এ নতুন ধর্মটি চালু করাই ছিল আকবরের ইচ্ছা। এ নতুন ধর্ম প্রবর্তনের পেছনে তার যে মানসিকতা কাজ করছিল তা এই যে, ভারতের মতো বিশাল ভূখণ্ডে তার শাসন স্থায়ী ও মজবুত করতে হলে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মন অবশ্যই জয় করতে হবে। ধর্মের হাতিয়ার দিয়ে তাদের মন জয় করা তিনি সমীচীন মনে করেন। সেজন্যে তার প্রচেষ্টা ছিল সকল ধর্মের সমন্বয়ে এক নতুন ধর্মের প্রবর্তন। এ নতুন ধর্মে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলি পরিহার করা হয় এবং হিন্দু ধর্মের বহু আচার-অনুষ্ঠান মুসলমানদের জন্যে বাধ্যতামূলক করা হয়। যেমন মুসলমানরা তাদের চিরাচরিত মুসলিম নাম রাখতে পারবে না, পুত্রসন্তানদের খাৎনা করাতে পারবে না, দাড়ি রাখা যাবে না, গরুর গোশত খাওয়া যাবে না। মুসলমান-অমুসলমানের মধ্যে অবাধে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে এবং তার জন্যে কোন অমুসলমানকে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে না।
মজার ব্যাপার এই যে, এ ধর্মের অধীনে হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ প্রভৃতি সকল ধর্মাবলম্বীগণ তাদের স্ব স্ব ধর্ম যথাযথভাবে পালন করতে পারতো। শুধু ইসলামী শরিয়তের বহু বিধি-বিধান রহিত করা হয়। ইসলাম বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যেই যে এ ধর্মের আবিষ্কার করা হয় তা অতি সুস্পষ্ট।
আকবরের প্রতি অমুসলিম জনগোষ্ঠী অতিমাত্রায় তুষ্ট হয়েছিল বটে, কিন্তু তারাও এ ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। অবশ্য মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী ও পথভ্রষ্ট মুসলমান এ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠী এ ধর্ম প্রত্যাখ্যান করে। তৎকালীন প্রসিদ্ধ আলেম ও তাপস শায়খ আহমদ সিরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রাহ) এ নতুন ধর্ম প্রচারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। আকবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র জাহাঁগীর ‘দ্বীনে ইলাহী’ ধর্মের ধারক ও বাহক সেজে তা প্রবর্তনের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আলফেসানীকে গোয়ালিয়র দুর্গে কারারুদ্ধ করে এবং তার সকল রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করেও এ উদ্ভট ধর্মটির অপমৃত্যু রোধ করতে পারেননি। অবশেষে তিনি তার গদি রক্ষার জন্যেই আলফেসানীকে মুক্তি দান করেন এবং তাঁর কাছে তাওবা করে নতুন করে মুসলমান হন। আকবর তার নিজের তথা মোগল শাসন স্থায়ী ও সুদৃঢ় করার জন্যে যে কৌশল অবলম্বন করেন তা মোগল সাম্রাজ্যের পতনের বীজ বপন করেছিল।
মিথ্যা নবীর পুনরাবির্ভাব
ভারতের ব্রিটিশ শাসন আমলে মির্জা গোলাম আহমদের মিথ্যা নবুওতের এক ষড়যন্ত্র-জাল বিস্তার করা হয়। এ ষড়যন্ত্রে সর্বতোভাবে সাহায্য করে ব্রিটিশ সরকার। বড় বড় সরকারি চাকুরি, পদোন্নতি ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ বহু মুসলমানকে প্রতারিত ও পথভ্রষ্ট করে। রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় খ্রিস্টান মিশনারীদের ব্যাপক তৎপরতা মুষ্টিমেয় মুসলমানকেই মাত্র খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে পেরেছে। কিন্তু মিথ্যা নবুওতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ফলে যে এক নতুন নবী ও নতুন মুসলমান সম্প্রদায় আবিষ্কার করা হলো তার দ্বারা একদিকে কুরআনের সত্যতা অস্বীকার করা হলো এবং এ নতুন নবীর অবিশ্বাসকারীকে কাফির বলে ঘোষণা করা হলো। এ জাহেলিয়াতের এক সাময়িক কৃতিত্ব সন্দেহ নেই। কিন্তু দুনিয়ার প্রায় সকল মুসলিম দেশ বিদেশী ও বিধর্মী শক্তির উপনিবেশে পরিণত হলেও এবং বিপুলসংখ্যক মুসলমান ইসলামী আচার-আচরণ থেকে দূরে সরে থাকলেও সামগ্রিকভাবে মুসলিম মিল্লাত মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মিথ্যা নবুওতের দাবি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে।
মির্জা গোলাম আহমদ পূর্ব পাঞ্জাবের কাদিয়ান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন বলে তার অনুসারীদেরকে কাদিয়ানী বলে অভিহিত করা হয়। তাদেরকে আহমদীয়াও বলা হয়। এ শতাব্দীর প্রথম পাদেই বিশ্বের আলেম সমাজের পক্ষ থেকে কাদিয়ানী বা আহমদীয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম বা কাফির বলে ঘোষণা করা হয়। এ নবুওতকে মিথ্যা ও প্রতারণামূলক প্রমাণিত করে বহু প্রামাণ্য গ্রন্থও রচিত হয়। অতঃপর ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ফলে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার পর এ মিথ্যা নবুওতের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু হয়। আরব দেশগুলোতে তাদের প্রচারণা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অবশেষে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করে আইন পাস করা হয়।
শির্ক ফিন্নবুওত
ইসলামের বিরুদ্ধে জাহেলিয়াতের প্রথম রণক্ষেত্র (WAR FRONT) তৈরি হয়েছিল মিথ্যা নবুওতের দাবি নিয়ে। এ দাবি বিভিন্ন যুগে করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের দ্বিতীয় রণক্ষেত্র হলো শির্ক ফিন্নবুওতের। অর্থাৎ নবুওতের মধ্যে অংশীদারিত্বের এক উদ্ভট আকীদাহ-বিশ্বাস আবিষ্কার করা হয়। এ জন্য সর্বপ্রথম হযরত আলী রাদিআল্লাহু আনহুর সত্তাকে বিশেষভাবে আবরণরূপে ব্যবহার করা হয়। এ ছিল ইসলামী ইতিহাসের এক অতি বেদনাদায়ক ঘটনা যে, খিলাফত সম্পর্কিত অবাঞ্ছিত বিতর্ক মুসলিম মিল্লাতকে দ্বিধাবিভক্ত করে শিয়া নামে একটা স্থায়ী ফের্কার উদ্ভব হয়। এ ফের্কার অন্তর্ভুক্ত লোক এ ধারণা-বিশ্বাসকে তাদের ঈমানের অংগ-অংশ বলে গ্রহণ করেন যে, নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা) হযরত আলীকে (রা) তাঁর প্রতিনিধি ও খলিফা হিসেবে অসিয়ত করে যান। এর চেয়ে অধিকতর বেদনাদায়ক ব্যাপার এই যে, তারা হযরত আলী (রা) সহ তাদের ইমামগণকে নিষ্পাপ বলে বিশ্বাস করেন। মুসলমানদের এ যাবত মৌল আকীদা-বিশ্বাস এ ছিল যে, মানবজাতির মধ্যে শুধুমাত্র নবীগণ নিষ্পাপ এবং এ নিষ্পাপ হওয়ার কৃতিত্ব তাঁদের নিজেদের নয়। বরঞ্চ আল্লাহ তাঁদেরকে মানবগোষ্ঠীর মধ্য থেকে নবুওতের মহান কাজের জন্যে বেছে নিয়েছেন বলে তিনি তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে তাঁদেরকে নিষ্পাপ রেখেছেন। এখন নবী ব্যতীত অন্য কাউকে নিষ্পাপ গণ্য করলে নবী ও অ-নবীর মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য তা আর থাকে না।
শিয়াদের মনে এ বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয় যে, শুধু হযরত আলী (রা) নন, বরঞ্চ তাঁর বংশোদ্ভূত সকল ইমাম ঠিক তেমনি নিষ্পাপ ছিলেন যেমন নিষ্পাপ ছিলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)। নবুওত সম্পর্কিত ইসলামী আকীদার পরিপন্থী জাহেলিয়াতের এ এক বিরাট কৃতিত্ব। কারণ আহলে বায়ত বা নবী পরিবারের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার অতিশয়োক্তি শির্ক ফিন্নবুওতের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কোন অ-নবীকে নিষ্পাপ মনে করার অর্থ তাকে প্রকৃতপক্ষে নবুওতের পদমর্যাদা ও অধিকারে সমমর্যাদা দান করা। অতঃপর রিসালাতে মুহাম্মাদীর আকীদা আর ইসলামী আকীদা থাকে না। ফলে সে মহান উদ্দেশ্য হাসিলের কোন আশা করা যায় না যার জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ বিশ্বজনীন ও চিরন্তন রিসালাতের মর্যাদা কায়েম করেছিলেন এবং নবী মুহাম্মাদকে (সা) সর্বশেষ নবী হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। কারণ এমতাবস্থায় তিনি (নবী মুস্তাফা) একাকী হেদায়েতের উৎস ও একমাত্র স্বীকৃত হকের মাপকাঠি আর রইলেন না। আর শর্তহীন আনুগত্যের অধিকারও তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট রইলো না। বরঞ্চ তারাও এসব ব্যাপারে নবীর সমমর্যাদা লাভ করেছেন যাদেরকে নিষ্পাপ মনে করা হচ্ছে।
খিলাফত থেকে রাজতন্ত্র
খিলাফতে রাশেদা উচ্ছেদ করে রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা জাহেলিয়াতের বিরাট বিজয়। চতুর্থ খলিফা হযরত আলীর (রা) শাহাদাতের পর রাজতন্ত্রের পথ সুগম হয় এবং হযরত মুয়াবিয়ার (রা) ইসলামী রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে খিলাফতে রাশেদার পতন হয়।
খিলাফতে রাশেদার পতনকে জাহেলিয়াতের বিরাট বিজয় এ জন্যে বলা হয় যে, খিলাফতে রাশেদা নিছক একটা রাজনৈতিক শক্তি বা সরকার ছিল না, বরঞ্চ তা ছিল নবুওতে মুহাম্মাদীর পরিপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব। তার কাজ শুধু এতোটুকু ছিল না যে, দেশের আইন-শৃংখলা পরিচালনা করবে, শান্তি-নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করবে ও সীমান্ত রক্ষা করবে। বরঞ্চ তা মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনে শিক্ষক, মুরব্বী ও পথপ্রদর্শকের সেসব দায়িত্ব পালন করতো যা নবী করীম (সা) তাঁর জীবদ্দশায় পালন করে যাচ্ছিলেন। খিলাফতের দায়িত্ব এটাও ছিল যে, দারুল ইসলামের মধ্যে দ্বীনে হকের গোটা ব্যবস্থাকে তার প্রকৃত আকার-প্রকৃতি ও প্রাণশক্তিসহ প্রাণবন্ত রাখবে এবং দুনিয়ার মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার কাজে নিয়োজিত রাখবে। হযরত উসমান যুন্নুরাইন রাদিআল্লাহু আনহুর খিলাফতের আমলে কিভাবে খিলাফতে রাশেদার পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং হযরত আলীর (রা) খিলাফতের পর তা রাজতন্ত্রে পরিণত হয়- এ দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করার অবকাশ এখানে নেই। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেরই তা জানা থাকার কথা। তবে খিলাফতে রাশেদার অবসানের পর ইসলামের বিরুদ্ধে অধিকতর রণক্ষেত্র তৈরি করা জাহেলিয়াতের জন্যে সহজ হয়ে পড়ে।
খিলাফতে রাশেদার পর
খিলাফতে রাশেদার অবসানের পর রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, (যদিও তাকে খিলাফত নামেই অভিহিত করা হয়) সেখানে ইসলামী আদর্শ ও মূলনীতি পরিহার করে চলা হয়। নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা) যে একটি পরিপূর্ণ ইনসাফভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করেন তা খিলাফতে রাশেদার যুগে অমলিন ও অবিকৃৎ রইলেও রাজতন্ত্রের অধীনে তার আর কোন অস্তিত্ব রইলো না। ইসলামের জনকল্যাণকর শাসনের পরিবর্তে বলপ্রয়োগে আনুগত্যের স্বীকৃতি আদায় করা হয়। মানুষের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার আর কোন সুযোগই রইলো না এবং স্বাধীন মত ব্যক্ত করতে গিয়ে অনেককে জীবনও দিতে হয়।
এ কথা সত্য যে, রাজতন্ত্রের অধীনে দেশের পর দেশ বিজিত হয়। রাষ্ট্রের পরিধি বর্ধিত হয়। কিন্তু ইসলামের পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্তের পরিবর্তে এক ব্যক্তির মর্জিমতো সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার ফলে মুসলমানদের মধ্যে চিন্তার ঐক্য বিনষ্ট হয় এবং তারা বহু দল-উপদলে বিভক্ত হতে থাকে। ইসলাম-বিরোধী আদর্শ ও চিন্তাধারা তাদেরকে প্রভাবিত করতে থাকে।
খিলাফতে রাশেদা তথা কুরআন ও সুন্নাহর শাসন রহিত হওয়ার পর মুসলিম সমাজ ও মন-মানসে, চিন্তা ও চরিত্রে বিকৃতি শুরু হয়। ইসলামী জ্ঞান ও চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিগণ রাজতন্ত্রের অধীনে কোন সরকারি দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করেন এবং সমাজের দৃশ্যপট থেকে সরে পড়েন।
উল্লেখ্য যে, নবী মুস্তাফার দ্বারা পূর্ণাংগ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার সাথে সাথে দলে দলে লোক ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। অতঃপর তাদের অনেকেই তাদের জীবন পরিশুদ্ধ করার সুযোগই পায়নি। নবী পাকের সাক্ষাৎ লাভের ভাগ্যও অনেকের হয়নি।
নবী পাকের ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত উসমান (রা)- এর খিলাফতকালে ইসলামী দাওয়াত ও বিজয় অব্যাহত থাকে। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল, জাতি ও শ্রেণীর অসংখ্য লোক তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মত্যাগ করে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা সাধারণতঃ ইসলামকে সত্য দ্বীন হিসেবে মনে-প্রাণে মেনে নেয়। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেক এমনও ছিল, যাদের ইসলাম গ্রহণের পেছনে কোন সদিচ্ছা ছিল না। তারা অন্তরে ইসলামের জন্যে মর্মজ্বালা ভোগ করতো এবং ইসলামের প্রতি প্রতিহিংসা ও শত্রুতা পোষণ করতো। ইসলামের উপর চরম আঘাত হানার সুযোগসন্ধানী তারা ছিল। তারা তাদের এ অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে নিজেদেরকে মুসলমানের দলে শামিল করে নেয়। তারা ছিল প্রকৃতপক্ষে মুনাফিক। জনৈক ইহুদী আলেম আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা ছিল তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সে ইসলামের নামে মুসলিম মিল্লাতকে দ্বিধাবিভক্ত করে এবং তাদের মধ্যে এক পৃথক আকীদাহ-বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও আচার-আচরণ প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়।
রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কর্তৃত্বের চাবিকাঠি ইসলামের পরিবর্তে জাহেলিয়াতের হাতে চলে যায়। আর রাষ্ট্রক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার পর জাহেলিয়াতের অগ্রগতি রোধ করার শক্তি ইসলামের ছিল না। তাছাড়া ইসলামের জন্যে জাহেলিয়াতের মুকাবিলা করা বড় কঠিন ছিল এ জন্যে যে, জাহেলিয়াত তার আসল রূপ নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ না হয়ে বরং ‘মুসলমান’-এর রূপ নিয়েই অবতীর্ণ হয়। জাহেলিয়াত ইসলামের প্রকাশ্য দুশমন হিসেবে নাস্তিক, কাফির বা মুশরিকের রূপ ধারণ করে ইসলামের উপর আঘাত হানতে এলে গোটা মুসলিম মিল্লাত ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার মুকাবিলা করতো। কিন্তু জাহেলিয়াতের মুখে ছিল তাওহীদ-রিসালাতের স্বীকৃতি এবং সে যা কিছু করতো তা ইসলামেরই নামে। ইসলামের আবরণেই জাহেলিয়াত তার শিকড় মজবুত করতে থাকে।
জাহেলিয়াত রাষ্ট্র ও সম্পদ করায়ত্ত করে তার নাম দেয় খিলাফত। কিন্তু আসলে তা ছিল রাজতন্ত্র যা খতম করাই ছিল ইসলামের লক্ষ্য। এ রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় শাসকগোষ্ঠী, তাদের অধীন আমীর-ওমরাহ, গভর্নর, সেনাবাহিনী ও সমাজের কর্তৃত্বশালী ব্যক্তিদের জীবনে জাহেলিয়াতের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তার লাভ করে। সেই সাথে জাহেলিয়াতের দর্শন, সাহিত্য এবং শিল্পকলাও বিস্তার লাভ করতে থাকে।
জাহেলিয়াত যেহেতু রাষ্ট্রশক্তির অধিকারী হয় সে জন্যে ওলামা, সুফী ও খোদাভীরু লোকদের উপরও প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মুসলিম সমাজে প্লেটোর দর্শন, বৈরাগ্যবাদী চারিত্রিক আদর্শ এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসার লাভ করে।
সমাজের চরিত্রবান লোকদেরকে তাকওয়া পরহেজগারীর নামে সমাজের কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহেলিয়াতের পতাকাবাহীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়।
অনৈসলামী তাসাউফ
উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, ইসলামের বিরুদ্ধে জাহেলিয়াতের প্রথম ও দ্বিতীয় রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল মিথ্যা নবুওতের ও নবুওতের অংশীদারিত্বের দাবিতে। এ দু’টি ফ্রন্টের প্রথমটিতে জাহেলিয়াত জয়লাভ করতে না পারলেও দ্বিতীয়টিতে তার প্রাধান্য বিস্তার লাভ করে মুসলিম মিল্লাতের ঐক্য বিনষ্ট করে এবং ইসলামী খিলাফতের প্রাসাদকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। অতঃপর প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় জাহেলিয়াত তার কালো হাত বিস্তার করতে থাকে। যে সকল সৎ ও খোদাভীরু লোক পরিস্থিতির চাপে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরে গিয়ে তাসাউফ তথা আত্মশুদ্ধি, জিকির-আজকার ও দ্বীনী ইলমের চর্চা ও শিক্ষাঙ্গনে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখেন, সেখানেও জাহেলিয়াত তার প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ফলে ইসলামভিত্তিক তাসাউফের মুকাবিলায় জাহেলী তাসাউফের আবির্ভাব ঘটে। এ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে জাহেলিয়াতের তৃতীয় WAR FRONT বা রণক্ষেত্র।
এ জাহেলী তাসাউফ নবুওতের আকীদাহ বিশ্বাসকেই মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছিল। এ তাসাউফের বুনিয়াদী চিন্তা ছিল এই যে, যে বন্দেগীর লক্ষ্য খোদা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া, তার জন্যে না কোন নবীর মধ্যস্থতার প্রয়োজন আছে, আর না তাঁর আনুগত্যের প্রয়োজন। এ ছাড়াও লোক এ মনজিলে মকসূদে পৌঁছতে পারে। সম্ভবতঃ এ বাতিল তাসাউফপন্থীগণ একটি শিয়া ফের্কা থেকে এ চিন্তা-ধারণা গ্রহণ করে। কাইয়ালিয়া নামক শিয়া ফের্কাটির প্রতিষ্ঠাতা আহমদ বিন আল কাইয়ালের বক্তব্য এই যে, যাদের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টির অভাব তারাই নবীগণের অন্ধ অনুসারী হয়।
এ চিন্তাধারাকে একটু পালিশ করে এভাবেই বলা হয়ঃ হাকিমের দরবারে নিজের আরজ পেশ করার জন্যে যেমন কোন উকিলের মধ্যস্থতা অপরিহার্য ঠিক তেমনি খোদার দরবারে বান্দার পক্ষ থেকে কিছু পেশ করতে হলে পীরের মধ্যস্থতা অপরিহার্য। এভাবে বান্দা ও খোদার মধ্যে নবীর মধ্যস্থতা অর্থাৎ নবীর আনুগত্যের মাধ্যমেই খোদার আনুগত্য এবং খোদা প্রাপ্তির যে সহজ-সরল রাজপথ নবী দেখিয়ে দিয়েছেন- সে নবীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পীরের আনুগত্যকেই একমাত্র খোদা প্রাপ্তির মধ্যস্থতা মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বান্দার সকল আনুগত্য পীর পর্যন্তই সীমিত হয়ে থাকে এবং আনুগত্যের ধারণা তার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। ফলে হালাল-হারাম, ভালো-মন্দ এবং বন্দেগী ও নাফরমানীর মাপকাঠি একমাত্র পীর হয়ে পড়ে। এভাবে খোদা ও নবীর সাথে বান্দার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
এ চিন্তাধারা ও দর্শন যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে ‘নবুওতে মুহাম্মাদী’ কেন ‘ঈমান বির রিসালাত’ই অনাবশ্যক হয়ে পড়ে। ইসলাম, কুরআন ও নবীর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী কেউ কি অমন ধরনের চিন্তা-ধারণা পোষণ করতে পারে? কিন্তু চরম দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, জাহেলিয়াত এ ভ্রান্ত চিন্তাধারার মারাত্মক রোগ এক শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে সংক্রমিত করেছে এবং ইসলামের নামেই এক শ্রেণীর লোক এ চিন্তার ধারক-বাহক ও প্রচারক সেজেছে।
উল্লেখ্য যে, ইসলামসম্মত তাসাউফ ও তাসাউফপন্থীদের অস্তিত্ব সমাজে বিদ্যমান থাকলেও তাঁদের সংখ্যা অতি নগণ্য। বাতিল তাসাউফপন্থীদের অধীনে শরিয়তের কোন অনুশাসন মেনে চলার প্রয়োজন হয় না বিধায় সুবিধাবাদীর দল এদিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে। জাহেলিয়াতের প্রচার প্রোপাগান্ডাও এর স্বপক্ষে বড়ো জোরদার।