উপসংহার
অত্র গ্রন্থে এ সত্যটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ইসলামকে নির্মূল করা, বিকৃত করা অথবা তার উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করাই জাহেলিয়াতের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য থেকে সে কখনো বিচ্যুত হয়নি। তাই লক্ষ্য করা যায়, মানবজাতির সূচনা থেকেই সকল যুগে ইসলামের উপর জাহেলিয়াতের আক্রমণ অব্যাহত রাখা হয়েছে। বলতে গেলে মানবজাতির সমগ্র ইতিহাসটাই ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সংঘাত-সংঘর্ষ ও জয়-পরাজয়ের ইতিহাস। কোন সময়ে ইসলাম বিজয়ী হয়েছে, কোন সময়ে জাহেলিয়াত।
এখন প্রশ্ন হলো এই যে, ইসলাম কি কোন পরাজয়ের বস্তু? অবশ্যই না। ইসলাম কখনো পরাজিত, নিশ্চিহ্ন ও নির্মূল হওয়ার বস্তু নয়। ইসলাম বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহতায়ালার দেয়া মানবজাতির জন্যে চিরসত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলকর এক পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা। এর প্রতি যারা বিশ্বাস পোষণ করে তারা মুসলিম বা মুসলমান নামে অভিহিত। মুসলমান যখন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ও বিভাগে পরিপূর্ণরূপে ইসলামী বিধান মেনে চলে, তার মন-মস্তিষ্কে, চিন্তাধারায়, রুচি ও মননশীলতায়, চরিত্র ও আচরণে, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ইসলামী আদর্শের প্রতিফলন ঘটায়, সর্বস্তরে মানুষ যখন ইসলামের অনুশাসন মেনে চলতে থাকে এবং একটি নির্মল, সুবিচারপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল সমাজ কাঠামো গড়ে ওঠে, তখন একেই বলা হয় মুসলমান তথা ইসলামের বিজয়। পক্ষান্তরে মুসলমান যখন ইসলামী আদর্শ ও বিধান ভুলে যায় অথবা পরিহার করে অথবা যখন কোন দেশ ও জনপদের মানুষ ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে, তখন ইসলামের, সত্য ও সুন্দরের পরাজয় হয় না, পরাজয় হয় ইসলাম বিস্মরণকারী মুসলমানের অথবা ইসলাম প্রত্যাখ্যানকারী মানুষের। এখন প্রশ্ন হলো এই যে, ইসলামের বাঁধন ও গাঁথুনি এতো মজবুত হওয়া সত্ত্বেও সেখানে জাহেলিয়াত প্রবেশাধিকার পায় কি করে। গ্রন্থে এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত করা হয়েছে। জাহেলিয়াত তো সর্বাবস্থায় ইসলামের উপর আঘাত হানার জন্যে ওত পেতে বসে থাকে। তাই সুযোগ পেলে ইসলামের বিজয়ী অবস্থাতেও কোথাও এটি নির্দোষ ও নিরীহ আচার-অনুষ্ঠান হিসেবে, কোথাও ইসলামের রূপ ধারণ করে এবং কোথাও কোন ব্যক্তিত্বের প্রতি সীমাতিরিক্ত ভক্তিশ্রদ্ধার ভাবাবেগ সৃষ্টি করে ইসলামের পরিমণ্ডলে অনুপ্রবেশ করে। অতঃপর ধীরে ধীরে মানুষের মনে তার প্রভাব বিস্তার করে তাকে ইসলামের মৌল চিন্তা-চেতনা থেকে, মূলনীতি ও সত্য-সঠিক পথ (সিরাতুল মুস্তাকীম) থেকে একটু একটু করে বিচ্যুত করতে থাকে। অবশেষে ইসলাম থেকে তাকে বহুদূরে ঠেলে দিয়ে জাহেলিয়াত বিজয়ের জয়ধ্বনি করে। খিলাফতে রাশেদার শেষের দিকে ইসলামের পরিমণ্ডলে জাহেলিয়াতকে এভাবেই অনুপ্রবেশ করতে দেখা যায়।
পরবর্তীকালে এভাবেই জাহেলিয়াতকে সকলের অলক্ষ্যে একটি পচনশীল ক্ষত (CANCER) হিসেবে ইসলামের দেহে প্রবেশ করতে দেখা যায়। তাসাওউফের ময়দানে সুফি-সাধকগণ ভালো নিয়তে এবং খোদাপ্রেম লাভের উদ্দেশ্যে এমন কিছু অতিরিক্ত ক্রিয়াকর্ম (আমল) অবলম্বন করেন যা নবী করীম (সা) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা) না করলেও ইসলামের দৃষ্টিতে দূষণীয় বলে মনে করা হয়নি। কিন্তু কাল ও সময়ের ব্যবধানে তা বিকৃতির শিকার হয়ে ইসলামের দেহ কাঠামোতে পচনশীল ক্ষতের আকার ধারণ করেছে।
এ উপমহাদেশের প্রথম জিহাদী আন্দোলনের সিপাহসালার জাহেলিয়াতের সকল আবর্জনা দূর করে একটি সত্যিকার ও নির্মল ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যে জিহাদ করতে গিয়ে বালাকোটে শাহাদাতের অমৃত সাগরে অবগাহন করে জান্নাতবাসী হন।
উল্লেখ্য যে, ইসলাম মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। যেহেতু স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা স্বয়ং তাঁর সৃষ্টজীব মানুষকে ভালোবাসেন, তাই মানুষও মানুষকে ভালোবাসবে। তবে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার একটা সীমা নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে, যে সীমা কখনো লঙ্ঘন করা যাবে না। সর্বোচ্চ ভালোবাসার পাত্র স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। তাঁর প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা তা-ই হবে অন্যান্য সকল ভালোবাসার নিয়ামক। আপন জানমাল থেকেও অধিক ভালোবাসতে হবে আল্লাহকে এবং তাঁর ভালোবাসার জন্যেই অন্য আর সকলকে ভালোবাসা। আল্লাহর ভালোবাসার পর সর্বোচ্চ ভালোবাসার পাত্র আল্লাহর প্রিয় নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা হবে সীমাহীন। কিন্তু নবীর প্রতি ভালোবাসার একটা সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, তা যেন সীমালঙ্ঘন করে তাঁকে আল্লাহর গুণাবলীতে ভূষিত না করে অর্থাৎ ‘উলুহিয়্যাতের’ তথা খোদায়ীর মর্যাদায় ভূষিত না করে। পূর্ববর্তী উম্মাতগণ এ সীমা লংঘনের ভুল করে পুরোপুরি পথভ্রষ্ট হয়েছে। আবার কোন অনবী মানুষই নবীর মতো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়। আবার পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের যে ভালোবাসা তা অন্য মানুষ পেতে পারে না। তবে আল্লাহর ভালোবাসার কষ্টিপাথরেই অন্যান্যের ভালোবাসার সীমা নির্ধারিত হবে।
ব্যক্তিত্বের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা সীমা অতিক্রম করলেই তা ব্যক্তিপূজার সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে এবং তা-ই জাহেলিয়াতের কাম্য। কোন ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালারকে তাঁর প্রাপ্য শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মর্যাদা অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু তাঁর প্রতি সীমাতিরিক্ত ভালোবাসা ইসলামী আদর্শ ও মৌল বিশ্বাসের পরিপন্থী। জিহাদ বা ইসলামী আন্দোলন নিঃসন্দেহে আমীর বা নেতার নেতৃত্বাধীন। কিন্তু নেতার প্রতি সীমাতিরিক্ত শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আন্দোলনের ক্ষতিসাধন করতে পারে যা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
উপমহাদেশের প্রথম জিহাদী আন্দোলনে সিপাহসালার হযরত সাইয়্যেদ আহমদ বেরেলভী এবং তাঁর সংগী-সাথী মুজাহিদগণ সকলে তাসাওউফপন্থী হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধের ময়দানে ও যুদ্ধ ছাউনিতে তাঁদের আচার-আচরণ সাহাবায়ে কেরামের আচার-আচরণেরই সাক্ষর বহন করে। কিন্তু মুজাহেদীনের মধ্যে অল্পসংখ্যক হলেও এমন কতিপয় ছিলেন, আমীরের প্রতি যাদের ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল সীমাতিরিক্ত। যে কারণে তারা সাইয়্যেদ সাহেবের শাহাদাত বিশ্বাস করতে পারেননি। তাদের বিশ্বাস, তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান করছেন এবং অবশ্যই একসময়ে আত্মপ্রকাশ করবেন। এ ধরনের ধারণা-বিশ্বাস পোষণকারীগণ জিহাদ থেকে সরে পড়েন।
অতীতের সুফিয়ায়ে কেরামের কেউ কেউ তাদের দরবারে ‘সামা’ প্রথার প্রচলন করেন। ‘সামা’ আরবি শব্দ যার অর্থ শ্রবণ করা বা এমন কিছু যা শ্রবণ ও প্রণিধানযোগ্য। তাওহীদ ও রিসালাতের ভিত্তিতে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রশংসাসূচক কবিতা রচনা করা হতো এবং তা সুফিদের দরবারে সুমিষ্ট স্বরে গাওয়া হতো। যে দরবারে তা গাওয়া হতো সেখানে কোন বালক-বালিকা ও মেয়েলোক থাকতো না। কোন বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করা হতো না। অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে খোদাপ্রেম-রসে আপ্লুত ‘সামা’ সুমধুর কণ্ঠে গীত হতো এবং শ্রোতাগণ ভাবাবেগে তন্ময় হয়ে পড়তেন। এ ‘সামা’ দৃশ্যতঃ এবং অর্থগত দিক দিয়ে ইসলামবিরোধী না হলেও আল্লাহর শেষ নবী কর্তৃক অনুমোদিত ও প্রচলিত ছিল না বলে সুফিদের অনেকেই এটাকে গ্রহণ করতে পারেননি। মনে হয় সামারই বিকৃত রূপ বর্তমানে প্রচলিত ‘কাওয়ালী’।
কাওয়ালী বাদ্যযন্ত্রসহ গানের সুরে গাওয়া হয় নারী-পুরুষের মিশ্র সমাবেশে। এ কাওয়ালীর অনুষ্ঠান চলে সারা রাত ধরে। কাওয়ালী গায়ক (কাওয়াল) হন একজন পেশাদার শিল্পী। কাওয়াল এবং শ্রোতাগণ ইসলামের সাথে কমই সম্পর্ক রাখেন। অতিথি আপ্যায়নে ইসলামের সীমাও লঙ্ঘিত হয়।
এ ধরনের বহু আচার-অনুষ্ঠান ইসলামের লেবাস পরিধান করে ইসলামী আচার-অনুষ্ঠানের তালিকাভুক্ত হয়। এ সবই জাহেলিয়াতের কর্মকাণ্ড। ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতিকে অবিকৃত ও কলুষমুক্ত রাখতে হলে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মাঝে এক সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে রাখতে হবে এবং প্রাচীরের কোন সূক্ষ্ম ছিদ্রপথেও যেন জাহেলিয়াত প্রবেশ করতে না পারে তার জন্যে সর্বদা সজাগ-সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে।
নিম্নের বিষয়গুলো জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্তঃ আঞ্চলিকতা, বাপদাদার অনুসৃত ইসলামবিরোধী প্রথা, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশাবলীর খেয়ালখুশি মতো ব্যাখ্যা করা, অমুসলিমদের সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন দেখে দুঃখ করা এবং ইসলামকে তার প্রতিবন্ধক মনে করা, কবরপূজা, কবরের নামে মানত ও নযর-নিয়ায পেশ করা, পীরের অথবা যে কোন মানুষের ছবি শ্রদ্ধাসহকারে ঘরে রাখা, কবর অথবা কোন ইট-পাথরের স্তম্ভে মাল্যদান, অনৈসলামী নাম রাখা, কোন স্থানকে বায়তুল্লাহর মতো শ্রদ্ধেয় মনে করা এবং আখিরাতের নাজাতের জন্যে কোন মানুষের উপর নির্ভর করা প্রভৃতি জাহেলিয়াতের শামিল। এসবের ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।
উপমহাদেশের মুসলমান
মাঝের কিছুকাল বাদ দিলে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় থেকে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত আট-ন’শ’ বছর মুসলিম শাসন চলেছে এ উপমহাদেশে। বিজয়ীর বেশে যারা এ উপমহাদেশে আগমন করেন তারা সকলেই ছিলেন বহিরাগত। কিন্তু তারা এ উপমহাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করার অভিপ্রায়ে আসেননি, কোন সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের নেশায়, কোন ঔপনিবেশিক শাসন কায়েমের জন্যেও নয়। তারা এসেছিলেন এ দেশে একটা সুন্দর ও সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ণ শান্তি-শৃংখলা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্যে। তাদের সাথে আরও যে অসংখ্য লোক এসেছিলেন- সামরিক বাহিনীর লোক, ব্যবসায়ী, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক, জ্ঞানীগুণী তারা সকলেই এ দেশকে ভালোবেসে আপন দেশ মনে করে নিয়েছিলেন এবং এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাদের বংশধরগণও তাদেরই পদাংক অনুসরণ করেছেন। তারা সকলে মুসলমান ও শাসক শ্রেণীভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের অমুসলিম অধিবাসীকে বলপ্রয়োগে ধর্মান্তরিত করার কোন চেষ্টাই করেননি। বরঞ্চ পারস্পরিক মধুর সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে পাশাপাশি শত শত বছর বসবাস করেছেন। একত্রে সুদীর্ঘকাল বসবাস করার পরেও মুসলমান ও অমুসলমান দু’টি সম্প্রদায় তাদের স্ব-স্ব জাতীয় স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে একাকার হয়ে যায়নি।
কিন্তু একে অপরের প্রভাব গ্রহণ করেছে নিশ্চয়ই। পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন যাপনের জন্যে যে ধরনের ইসলামী জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, তা অনেকের মধ্যেই ছিল না এবং ইসলামী মন-মস্তিষ্ক ও চরিত্র গঠনের কোন কর্মসূচিও তাদের ছিল না। তাই তাদের অনেকের মধ্যেই এ দেশীয় সাংস্কৃতিক প্রভাব কার্যকর হয় এবং বহু পৌত্তলিক আচার-অনুষ্ঠান ইসলামী লেবাস পরিধান করে মুসলিম সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে জাহেলিয়াত আংশিকভাবে হলেও মুসলিম সমাজদেহে তার আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। যার ফলে অনেক মুসলমান কয়েক শতাব্দী যাবত আধা-মুসলমান ও আধা-হিন্দুয়ানী জীবন যাপন করতে থাকে।
মুসলিম দেশগুলোতে ইউরোপীয় শাসনের প্রভাব
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে নানান কারণে মুসলিম দেশগুলোর উপর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম হতে থাকে। জাহেলিয়াত রাষ্ট্রীয় শক্তিসহ মুসলমানদের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে। ইউরোপীয় চিন্তাধারা, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, জীবনদর্শন সবকিছুই মুসলমানদের মন-মস্তিষ্ক প্রভাবিত করতে থাকে। বিজয়ী শাসকদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বিজিত মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে দূরে নিক্ষেপ করতে থাকে। সে শিক্ষার বুনিয়াদ ছিল জড়বাদ, নাস্তিক্য, ধর্মহীনতা (SECULARISM) ও জাতীয়তাবাদ। এসবের ভিত্তিতেই পাশ্চাত্য সভ্যতা গড়ে ওঠে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এ সভ্যতাকে শক্তিশালী করে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে যে কোন ভালো বা মন্দ কাজে ব্যবহার করা যায়। বিশ্বের মুসলমান ইসলামী আদর্শে অবিচল থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা করলে এ দুটোকে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করতে পারতো। কিন্তু তারা ইসলাম থেকেও দূরে সরে পড়লো এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চায়ও মনোযোগ দিল না। তাদের এ দ্বিবিধ দুর্বলতার সুযোগে জাহেলিয়াতের পতাকাবাহী পাশ্চাত্য শক্তি তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভু হয়ে বসলো। মুসলমান চরম হীনমন্যতার শিকার হয়ে পড়লো। পাশ্চাত্য সভ্যতা, তাদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক দর্শনকে (সেকিউলারিজম) মুসলমানগণ উন্নতি-অগ্রগতির চাবিকাঠি হিসেবে গ্রহণ করলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলো এক একটি করে গোলামির শিকল ছিন্ন করে স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতা লাভের পর শাসন ক্ষমতা তাদেরই হস্তগত হয় যারা ইসলামকে উন্নতি-অগ্রগতির অন্তরায় মনে করতো। ফলে জাহেলিয়াতের শাসন সর্বশক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এ শাসন কোন দেশেরই মুসলিম জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। পাশ্চাত্য সভ্যতার মানসিক দাস শাসকগোষ্ঠী ব্যতীত দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ইসলামী জীবন বিধানের দাবিদার। তাই প্রায় সর্বত্র শাসক ও শাসিতের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলতেই থাকে, যার সমাপ্তি এখনো ঘটেনি।
সুখের বিষয়, সর্বত্র মুসলমানদের মধ্যে এবং বিশেষ করে শিক্ষিত যুবসমাজের মধ্যে ইসলামী প্রেরণার নবজোয়ার শুরু হয়েছে। ইসলামকে একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনও চলছে। যুবসমাজের ইসলামী জিহাদী প্রেরণার যৌবনজোয়ার জলতরঙ্গে আফগানিস্তানে রাশিয়ার সামরিক শক্তি পরাজয়ে তলিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনে ‘ইন্তিফাদা’ জিহাদী ঝাণ্ডা উত্তোলন করেছে। কাশ্মীরের মুক্তিপাগল মুসলমানও ভারত রাষ্ট্রের সকল দুঃশাসন ও নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করছে। জাহেলিয়াত নীরবে বসে নেই। এ তিনটি সংগ্রাম নস্যাৎ করার জন্যে ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার ক্রীড়নক হিসেবে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র কুয়েতকে জবরদখল করে একদিকে বিশ্বের মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট করেন এবং অন্যদিকে ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান ও কাশ্মীরের মুক্তি আন্দোলনের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করেন। ইসলাম ও জাহেলিয়াতের চিরন্তন দ্বন্দ্বে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান জাহেলিয়াতের ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করলেন। এটা ইসলামের ইতিহাসের এক চরম লজ্জাকর ঘটনা।
চিন্তার বিষয় এই যে, একটি মুসলিম দেশের মুসলিম সৈন্যবাহিনী কি করে আর একটি নিরপরাধ মুসলিম রাষ্ট্র জবরদখল করতে পারে, কি করে অসংখ্য নিরপরাধ মুসলিম নাগরিক হত্যা করতে পারে, তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করতে পারে, কি করে মুসলিম পর্দানশীন ও ধর্মভীরু মহিলাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে তাদের অমূল্য সম্পদ ইজ্জত-আব্রু লুট করতে পারে! মুসলমান নামধারী হলেও এসব নরপশু কি খোদা ও আখিরাতের প্রতি কোন বিশ্বাস পোষণ করে? এটাই তো মুসলমানদের উপর জাহেলিয়াতের তথা কুফরের এক ঐতিহাসিক বিজয়। ইসলামের অনুসারীগণ এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন কি? কারণ ইসলামের বিরুদ্ধে জাহেলিয়াতের আক্রমণ এমনি চলতেই থাকবে।
আশার আলোক
এ উপমহাদেশে বিগত শতাব্দীতে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ বেরেলভীর (র) তাহরিকে মুজাহেদীন মুসলমানদের মধ্যে দুর্বার জিহাদী চেতনার সঞ্চার করে। ব্রিটিশ শাসকদের অমানুষিক ও লোমহর্ষক নির্যাতন নিষ্পেষণ মুসলমানদের মন থেকে জিহাদী চেতনা নির্মূল করতে পারেনি। ১৮৩১ সালে বালাকোটে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদের শাহাদাতের একশ’ বছর পর নতুন করে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তথা ইসলামী আন্দোলনের সূচনা হয়। এ আন্দোলন ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী নামে একটি শক্তিশালী সংগঠনে রূপান্তরিত হয়। এ আন্দোলন ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও রূপকার ছিলেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেমে দ্বীন মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী (র)। তার তের বছর আগে (১৯২৮) ইখওয়ানুল মুসলিমুন নামে মিশরে একটি ইসলামী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শায়খ হাসানুল বান্না শহীদ (র)। বর্তমান বিশ্বের এ দু’টিই একমাত্র শক্তিশালী সুশৃঙ্খল ও সুসংহত সংগঠন যা সত্যিকার অর্থে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
মিশরের ইসলামবিরোধী শাসকবৃন্দ ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বহু নেতা-কর্মীকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে, কারাপ্রাচীরের অভ্যন্তরে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন করে ধুঁকে ধুঁকে মরতে বাধ্য করে এবং শত শত নেতা-কর্মীকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরঞ্চ সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে; যে নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং জম্মু-কাশ্মীর দেশগুলোতেই তার কর্মতৎপরতা সীমিত রাখেনি। এ আন্দোলনের বহু দায়িত্বশীল কর্মী গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছেন এবং সর্বত্র তারা বিভিন্ন নামে ইসলামী আন্দোলন পরিচালনা করছেন।
আশার বিষয়, বর্তমানে পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে কোন না কোন প্রকারে ও নামে ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে না। ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবৃন্দ এসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রধান প্রধান ভাষায় ইসলামের বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে এবং সর্বত্র মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান পরিবেশন করা হচ্ছে।
বিভিন্ন ধর্মের বিশেষ করে খৃস্টান, ইহুদী ও হিন্দু ধর্মের শিক্ষিত যুবক ও পণ্ডিত ব্যক্তি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করছেন।
বলতে গেলে পৃথিবীর সর্বত্র ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে। পাশ্চাত্যের জড়বাদী মানবসমাজেও পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। অবাধ ভোগবিলাস, দিবারাত্রি মদ ও নারীর প্রেম সাগরে অবগাহন, যৌন অনাচার- এসবে কোন তৃপ্তি নেই, আনন্দ নেই, মনের প্রশান্তি নেই। ভোগের অতৃপ্ত লালসা-বাসনা মানুষকে অধিকতর ভোগের জন্যে অধীর ও চঞ্চল করে তোলে। ভোগের নেশায় সে ভুলে যায় জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। স্থায়ী ও স্থিতিশীল কোন কিছুর পরিবর্তে সে আঁকড়ে ধরে ক্ষণভঙ্গুরকে। অবশেষে তার জীবনটা নিজের কাছে হয়ে পড়ে এক বিরাট লায়াবিলিটি। এককালীন ভোগ-লালসার লেলিহান শিখা নিরাশা-দুরাশার লেলিহান শিখায় পরিণত হয়। জীবনের সুখ-শান্তির জন্যে যে পারিবারিক ব্যবস্থা, তাও ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মানসিক শান্তির অন্বেষায় সে তখন ছুটে বেড়ায় চারদিকে। তার জাগ্রত বিবেক বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ইসলামকেই বেছে নেয় শেষ অবলম্বন হিসেবে। সে উপলব্ধি করে ইসলামের প্রতি বিশ্বাসের অর্থ এমন এক শক্ত রজ্জু ধারণ করা- যা কোনদিন ছিন্ন হবার নয়। যার মধ্যে নেই কোন ব্যর্থতা, নেই কোন নৈরাশ্য। আছে পূর্ণ সাফল্য এবং জীবন সমস্যার সকল সমাধান। ইসলামের সুনিশ্চিত ঘোষণাঃ মৃত্যুর সাথে সাথে সবকিছু শেষ হয়ে যায় না, বরঞ্চ চিরন্তন আনন্দ ও সুখশান্তি অথবা দুঃখ-যাতনার এক নতুন জীবনের দ্বারোদঘাটিত হয়।
ইসলামের প্রতি বহুদিনের পুঞ্জীভূত বিদ্বেষ ও ভুল ধারণা যাদের মনে বদ্ধমূল তাদের হতাশা ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু নিরপেক্ষ ও সুস্থ মন নিয়ে যারা ইসলাম সম্পর্কে জানবার কিছু চেষ্টা করছে তারাই আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে এর বিশ্বজনীন আদর্শ ও শিক্ষার প্রতি। ইসলামকে একটি গতিশীল, চিরন্তন ও সর্বাংগ সুন্দর জীবন বিধান হিসেবে মেনে নিতে তারা দ্বিধাবোধ করছে না। ইসলামের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের এ এক সুস্পষ্ট নিদর্শন।
আফগানিস্তানে সাম্প্রতিককালে যে মুষ্টিমেয় মুজাহেদীনের কাছে চরম মার খেয়ে রাশিয়ার মতো বৃহৎ পরাশক্তি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়েছে তা ইসলামেরই বিজয় ঘোষণা করছে। ইসলামী চেতনা ও প্রেরণার প্রচণ্ড তরংগাঘাতে রাশিয়ার লৌহপ্রাচীর নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। ইসলামের পুনর্জাগরণ আজ রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে ভীতিপ্রদ।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোর প্রায় সকল শহরে ইসলামী আন্দোলনের কাজ শুরু হয়েছে। যে স্পেন থেকে একদা মুসলমানদেরকে নির্মূল করা হয়েছিল সেখানেও ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলো; আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সিংগাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানে বেশ কিছুকাল যাবত ইসলামী সংগঠন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি মেক্সিকো, কোস্টারিকা, ইকুয়েডোর, আল সালভেদর, নিকারাগুয়া ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে রীতিমত ইসলামী সংগঠন কায়েম হয়েছে। সকল স্থানে ইসলামী সেন্টার প্রতিষ্ঠিত করে ব্যাপকভাবে ইসলামী দাওয়াতের কাজ ছড়ানো হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ। এসব আন্দোলনের উদ্যোক্তা বিভিন্ন দেশের ইখওয়ান ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মীবৃন্দ। সর্বত্র এসব আন্দোলন ইসলামের উজ্জ্বল ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করছে।
জাহেলিয়াত তার সকল শক্তি ও অস্ত্র দিয়ে ইসলামের অগ্রগতি রুখবার চেষ্টা করছে। এখন ইসলামের বিজয় নির্ভর করছে মুসলমানদের ইসলামের প্রতি অবিচলতার উপর; ঐক্য, ত্যাগ ও কুরবানী এবং সহনশীলতার সাথে অবিরাম সংগ্রামের উপর। আল্লাহতায়ালার মদদ ব্যতীত কোন বিজয় সম্ভব নয়। তাই প্রতি মুহূর্তে পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলেই তাঁর মদদ হবে নিশ্চিত এবং বিজয় হবে অতি সন্নিকট।
আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের ঈমান ও বিবেক জাগ্রত করে দিন, ঈমানের হেফাজত করুন এবং জাহেলিয়াতের প্রতি-আক্রমণ প্রতিহত করার তাওফীক দান করুন- যেন ইসলাম একটি বিজয়ী শক্তি হিসেবে দুনিয়ার বুকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
।।সমাপ্ত।।