চতুর্দশ অধ্যায়
বংগভংগ রদ ও তার প্রতিক্রিয়া
বাংলায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকার কর্তৃক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ফলে এ আন্দোলন ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। ১৯১০ সালের শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে ফিরে আসছিল। আন্দোলনের সিপাহীরা একরকম রণক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এ বৎসরেই জনৈক বাংগালী হিন্দু ব্যবস্থাপক সভায় বিষয়টি নতুন করে উত্থাপন করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। পরে তিনি তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে সম্মত হন। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ছিলেন আন্দোলনের উদ্যোক্তা। তিনিও সবশেষে তাঁর ‘বাঙালী’ পত্রিকার মাধ্যমে বলেন, “আমরা অবশ্য স্বীকার করি যে এ বিভাগ টিকে থাকার জন্যে হয়েছে এবং আমরা একে বানচাল করতে চাইনা”।
-(Fraser, India Under Cuzon and After, p.391. A. Hamid: Muslim Separatism in India, p.86)
কিন্তু সুদূর লন্ডনের বুকে কোন পোটন হস্ত বংগবিভাগের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র তৈরী করে চলেছিল তা জানা যায়নি।
রাজা পঞ্চম জর্জ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণের কথা আপন মুখে ঘোষণা করার অভিপ্রায়ে ১৯১১ সালে ভারতে আগমন করেন। শুধুমাত্র রাজ্যভিষেক ঘোষণার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে সুদূরবর্তী উপনিবেশে আগমন কর –এ ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে এক অভূতপূব ও নজীরবিহীন ঘটনা। সন্ত্রাসবাদীদের অশুভ ষড়যন্ত্রের আশংকা তখনো মন থেকে মুছে ফেলা যায়নি। ভারতে তখন দুর্ভিক্ষ বিরাজমান। ইতালী-তুর্কী যুদ্ধের কারণে মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ। এসব কারণে পঞ্চম জর্জের মন্ত্রীমন্ডলী ভারত সফর অবিবেচনা প্রসূত মনে করে তাঁকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেন। রাজা সকল উপদেশ উপেক্ষা করে ভ্রমণের প্রস্তুতি করতে থাকেন। নবেম্বর মাসে ভারতের উদ্দেম্যে যাত্রা করে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তিনি বোম্বাই অবতরণ করেন। ভারতবাসীকে কি কি পুরস্কার বা রোয়োদাদ প্রদানে আপ্যায়িত করেন। সবশেষে মে মুহুর্ত এসে গেলো। এক অতি জাঁকজমকপূর্ণ সমাবেশে ভাবগম্ভীর পরিবেশে রাজা পঞ্চম জর্জ এক একটি করে তাঁর অপার করুণা প্রিয় প্রজাবৃন্দের উপর বর্ষণ করতে লাগলেন। সকল রাজনৈতিক বন্দীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমাত ঘোষনা করা হলো, শিক্ষার উন্নয়ণে একটা মোটা রকমের অংক বরাদ্দ করা হলো; ভারতীয় সৈনিকদের জন্যে ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ সম্মান লাভের অযোগ্যতা দূরীভূথ হলো, অল্প বেতনভূক্ত সরকারী কর্মচারীদেরকে অতিরিক্ত অর্ধ মাসের বেতন দেয়া হলো; ভারতের রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লী স্থানান্তরিত করা হলো। সর্বশেষে বলা হলো ‘বংগভংগ’ রদ করা হলো। হিন্দুগণ আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়লো। বংগভংগ বাতিরের ঘোষণা দ্বারা তাৎক্ষণিক সুবিধা এই হলো যে, ভারত সাম্রাজ্যের অপরাধ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির মধ্য দিয়ে রাজদম্পতির নিরাপদ ভ্রমণের নিশ্চয়তা পাওয়া গেল।
কিছুদিন পর যখন রাজা কোলকাতায় এলেন, তখন হিন্দুবাংলা আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাজা ব্রিটিম সাম্রাজ্যের প্রতি তাদের অদম্য আনুগত্য প্রদশ্রন করে বিরাট বিরাট শোভাযাত্রা করে। হ্নিদু সংবাদপত্র এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয় যে, হিন্দু মন্দিরে শ্বেত মহারাজা ও মহারাণীর মুরতি স্থাপনের প্রস্তাব করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং লর্ড হার্ডিঞ্জের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়।
অপরদিকে বিভাগ বাতিল করে মুসলমাদের প্রতি করা হয় চরম বিশ্বাসঘাতকতা। কার্জন বিভাগ সম্পাদন করে এবং হার্ডিঞ্জ তা বাতিল করে। কিন্তু উভয়ের কার্যপ্রনালীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য এই যে কার্জন প্রকাশ্যে বংগভংগের প্রস্তাব দেন তার সপক্ষে ন্যায়সঙ্গত যুক্তি পেশ করেন। এ নিয়ে বহুদিন আলাপ আলোচনা হয়, বহু কাগজ কালি ব্যয় হয়। প্রস্তাবটি যথারীতি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত এবং যথাসময়ে তা কার্যকর করা হয়। পক্ষান্তরে হার্ডিঞ্জের পরিকল্পনা অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে অগ্রসর হয় এবং জনসাধারণের কাছে তা প্রকাশ লাভ করে অতি আকস্মিকভাবে এবং এক অতি বিস্ময়ের রূপ নিয়ে। ব্রিটিশ সরকারের এ সিদ্ধান্তের দ্বারা একের সর্বনাশ করে অপরের পৌষ মাস এনে দিলেও এর দ্বারা তাদেরপ্রগলভতা, ডিগবাজী ও একটি অনুন্নত অঞ্চলের সম্প্রদায়ের ন্যায়সংগত অধিকার ফিরে দিয়ে আবার তা কেড়ে নেয়ার অন্যায় অবিচারমূলক মনোবৃত্তি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অক্ষয় হয়ে থাকবে।
ব্রিটিশ সরকারের এ হাস্যকর অভিনয়ের কার্যকারণ সম্পর্কে যতটুকু আভাস পাওয়া যায় তা হলো এই যে, বিভাগ রদের খেলাটা তৎকালীন ভারত সচিব ‘ক্রু’র (Crew) মস্তিষ্কে স্থান লাভ করেছিল। যারা বিভাগকে মারাত্মক ভুল বলে অভিহিত করে বিক্ষুব্ধ হয়েছিল, তাদেরকে শান্ত করাই ছিল ক্রুর অভিপ্রায়। হার্ডিঞ্জ বলেন, “পরে আমাকে এ কথা জানানো হলো যে, উভয় বাংলায় যদি শান্তি প্রতিষ্ঠি করতে হয়, তাহলে সমস্ত বাংগালী যেটাকে অন্যায় অবিচার মনে করেছে তা দূর করার জন্যে কিছু করা একেবারে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অবশ্য এ সময়ে বিদেশেও এমন আশা করা হচ্ছিল যে এ ‘অবিচার’ দূর করার জন্যে কিছু করা হবে। আমি অনুভব করলাম যে যদি কিছু করা না হয়, তাহলে অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতে আমাদেরকে অধিকতর বিপদের সম্মুখীন হতে হবে”।
-(Hardige of Penhurst My India Years, p.36, Murray London, 1948; A. Hamid Muslim Soparatism in India, p.88)
উপরে বর্ণিত স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির উক্তিতে বুঝতে পারা যায় যে, বিভাগ বিরোধী আন্দোলনকারীগণ এক রকম হতাশ হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছিলেন এবং বিভাগকে মেনে নিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডনে যেসব সাদা চামড়ার বন্ধুগণ ইন্ধন যোগাচ্ছিলেন, তাঁরা হাল ছেড়ে দেননি। তাঁরা তাদের কাজ করেই যাচ্ছিলেন যার দ্বারা ভারত সচিব ক্রু অবশ্যই প্রভাবিত হয়েছিলেন।
আবদুল হামিদ বলেন যে, বিভাগ রদ করার সপক্ষে যত প্রকার যুক্তি প্রদর্শন করা হয় তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, “উভয় বাংলার হিন্দুগণ প্রায় সব ভূসম্পদের মালিক ছিলেন। ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকুরী বাকুরীতেও ছিল তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব। ফলে তাঁরা জনগনের উপরও অত্যধিক প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিলেন। তাদের সম্পদ ও সংস্কৃতি তাদেরকে যে প্রভাব প্রতিপত্তি দান করেছিল, বংগ বিভাগের ফলে তাঁরা সে প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়বেন। কায়েমী স্বার্থ ও শ্রেণীপ্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখার সপক্ষে এ যুক্তি বটে।
বিভাগ রদ করার পেছনে যেকোন মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না, বরঞ্চ বলতে গেলে ছিল এক চরম দুরভিসন্ধি, তা উপরের কথায় সুস্পষ্ট বুঝতে বাকী ছিল না যে সরকার তাদেরকে প্রতারিত করেছে। তাদের আনুগত্যের বিনিময়ে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে। এ সম্পর্কে মুশতাক হোসেন তাঁর এক নিবন্ধে বলেন,
“মুসলমানরা এ পদক্ষেপকে (উভয় বাংলার একত্রীকরণ) অবজ্ঞার চোখেই দেখবে। ব্রিটিশ মন্ত্রীমন্ডলী কার্জনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে অস্বীকার করেন। অতঃপর উভয় বাংলার একত্রীকরণ এটাই প্রমাণ করে যে কর্তৃপক্ষ পংগু হয়ে পড়েছেন। ভবিষ্যতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতির উপর কেউ আস্থা পোষণ করতে পারবে না। ….আমরা এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাল্টাবার কোন আন্দোলন করব না। কিন্তু আমাদের দাবী এই যে বিভাগের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ যেসব সুযোগ সুবিধা লাভ করেছিল, তা যেকোন ভাবে তাদের জন্যে সুনিশ্চিত করতে হবে। …ত্রিপলী ও পারস্যের ব্যাপারে ব্রিটিশ নীতি মুসলমাদেরকে ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে। …এই কঠোর পদক্ষেপ আমাদের জাতির মনে তিক্ততার সৃষ্টি করেছে। তারা ভাবতে শুরু করেছে যে কংগ্রেস থেকে সরে থেকে বিশেষ লাভ হয়নি। কেউ বা হয়তো মুসলিম লীগ ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদান করবে। এতদিন ধরে ঠিক এই টাই কংগ্রেস প্রত্যাশা করছিল। কিন্তু আমরা এরূপ চিন্তাধারার সাথে একমত নই। আমরা আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বিসর্জন দিয়ে একটি শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারি না। এ হচ্ছে আত্মহত্যার পথ। একটি স্রোতস্বিনী সমুদ্রে মিলিত হওয়ার পর তার সত্তা হারিয়ে ফেলে। সরকারের প্রতি আনুগত্য থাকার কারণে আমরা কংগ্রেসের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন নই। আনুগত্যই আমাদের আসল উদ্দেশ্য নয়, বরঞ্চ উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মাত্র। আনুগত্য সর্বদাই শর্তসাপেক্ষ। আনুগত্য অসম্ভব রকমের চাপ সহ্য করতে পারে না।
….এ দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট যে, মুসলমাগণ সরকারের প্রতি আর আস্থা স্থাপন করতে পারে না। আমাদের নির্ভর করতে হবে খোদার উপরে এবং আমাদের চেষ্টাচরিত্রের উপরে। ….এদিক দিয়ে যদি আমরা সুসংবদ্ধ হতে পারি তাহলে সরকার আমাদের অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হবেন। যা কিছু ঘটেছে তার থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
…….আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের সাথে আলাপ আলোচনা সরকার অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। রাজার পক্ষ থেকে ঘোষণাটি যেন একটি গোলান্দাজ বাহিনীর ন্যায় মুসলমানদের শবদেহকে নির্মমভাবে নিষ্পেষিত করে গেল”।
-(Zuberi Tazkira Waqar, pp.228-40; A Hamid Muslim Separatism in India, p.91)
১৯১২ সালে মার্চ মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনের সভাপতির ভাষণে বংগভংগ সংগ্রামের আহত সৈনিক খাজা সলিমুল্লাহ বলেনঃ
বংগভংগের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর প্রসংগটি পুনরায় উত্থাপনের কোন ন্যায়সংগত কারণ কোন দায়িত্বশীল বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি আবিস্কার করতে পারেনি। এ বিভাগ ১৯০৫ সালে অনুষ্ঠিত হয়ে ১৯১১ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। মুসলমানদের আশা আকাংখার সম্ভাবনা দেখে আমাদের শত্রুগণ ব্যথিত হয়ে পড়লেন। প্রকৃত পক্ষে বিভাগের ফলে আমরা তেমন বিশেষ কিছুই লাভ করিনি। যতটুকুই লাভ করেছিলাম আমাদের প্রতিবেশী অন্য সম্প্রদায় স্বর্গমর্ত্য আলোড়ন সৃষ্টি করে তাও আমাদের নিকট থেকে কেড়ে নিল। হত্যা ও দস্যুবৃত্তি করে তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করলো, তারা বিলাতী দ্রব্যাদি বর্জন করলো। সরকার এতে কিছুই মনে করলেন না। এসব হত্যাকান্ডে মুসলমানগণ অংশগ্রহণ কা করে সরকারের প্রতি অনুগতই রইলো। …বিভাগের ফলে মুসলমান কৃষককুল লাভবান হলো। হ্নিদু জমিদারগণ তাদেরকে আন্দোলনে টেনে নামাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু তারা কর্ণপাত করলো না। এত করে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ শুরু হলো। সরকা দমননীতি অবলম্বন করলেন। তাতে ফলোদয় হলো না। একদিকে ছিল সম্পদশালী বিক্ষুব্ধ সম্পদ্রায এবং অপরদিকে দরিদ্র মুসলমান এবং এরা ছিল সরকারের সাথে। এভাবে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হলো। আকষ্মিকভাবে সরকার বিভাগ রদ করে দিলেন। এ বিষয়ে আমাদের সাথে কোন আলাপ আলোচনাও করা হলো না। (Ahmed, Ruh-i-Raushan Mustaqbil, pp 58-59; A. Hamid:Muslim Separatism in India, p.92)
১৯২৩ সালে কোকোনাদায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে মাওলানা মুহাম্মদ আলী তাঁর সভাপতির বাষণে বংগভংগ রদের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেনঃ “আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ তাদের সদ্যলব্ধ অধিকারসমূহ থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হরো এবং (সরকারের প্রতি) সন্তোষ প্রকাশকে চরম অপরাধ বলে শাস্তি দেয়া হলো। এ এমন এক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত যা ইতিহাস থেকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে”।
-(Iqbal Select Writings & Speeches, p.162)
ব্রিটিশ সরকার যে মুসলমানদের সাথে বিশ্বাঘাতকতা করেছিলেন, ডিগবাজী খেয়েছিলেন, মুসলমানদের প্রতি যে চরম অন্যায় করা হয়েছিল এবং এক শ্রেণীর সন্ত্রাস ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্যে তাঁদের চির গর্বিত মস্তক অবনত হয়েছিল, এ অনুভূতি তাঁদের অনেকেরই মধ্যে এসেছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত দীর্ঘ দিনের সুটিন্তিত সিদ্ধান্তকে সাত বৎসর পর রাজা পঞ্চম জর্জের মুখের ঘোষণা দ্বারা পরিবর্তিত করে দুনিয়ার সামনে তাঁদের মর্যাদা যে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল এ অনুভূতিও তাঁদের ছিল। তাই অনেকে বংগভংগের কার্যকারণের ইতিহাসকে বিকৃত করে রাজা পঞ্চম জর্জের মন রক্ষার চেষ্টা করেছেন। অবশেষে পূর্ব বাংলঅল মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দেবার জন্য এবং বংগভংগ রদের দরুন তাদের যে বিপুল ক্ষতি হয়েধিছল তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত সরকার করেন যাতে করে এ অঞ্চলের অনুন্নত লোকদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা হতে পারে। দুই বাংলার একত্রীকরণে বাংলার হিন্দুগণ আনন্দে গদগদ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মুসলমানদো কোন প্রকার উন্নতি ও সুখ সমৃদ্ধি তারা বরদাশত করতে কিছুতেই রাজী ছিল না। তাই সরকার কর্তৃক ঢকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত তাদের মাথায় যেত আবার বজ্রাগাত হলো। কতিপয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অগ্নিশর্মা হয়ে এ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন। যেহেতু কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হিন্দু শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রভাবের মূল উৎসকেন্দ্র, সেজন্য আর একটি প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হলে প্রথকটির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে বলে তাঁরাপ্রচার করতে লাগলেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল অবিলম্বে বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জের সাথে সাক্ষাৎ করে। তাঁরা বলেন যে, প্রদেশে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ফলে জাতীয় জীবনের শান্তি সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাধীন অধিবাসীদের মধ্যে বিরাজমান অনৈক্য উত্তরোত্তর বর্ধিত হবে। তাঁরা বড়োলাটকে এ বিষয়েও সাবধান করে দেন যে, নতুন বিশ্ববিধ্যালয়ের সূচনা হবে অত্যন্ত নগণ্য ও হাস্যখর। কারণ, তাঁদের মতে, যথেষ্ট প্রজ্ঞাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর অবাব হবে এবং মূলতঃ মুসলমান কৃষিজীবীদের জন্যে প্রস্তাবিত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের কোন মূল্য হবে বলেও তাঁদের সন্দেহ আছে।
-(Govt. of India, Speeches by Lord Hardinge of Penhurst. Vol.1, pp.203-20, Calcutta,1916)
এ সম্পর্কে বাংলার মুসলিম জননেতা মরহুম এ কে ফজলুল হক বংগীয় ব্যবস্থাপক সভায় ১৯১৩-১৪ সালের বাজেট অধিবেশনে যে বক্তৃতা করেন তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য বলে তার কিঞ্চিত উদ্ধৃত করলাম। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেনঃ
“ভারত সরকারের ২৫শে আগষ্টের প্রতিবেদনে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে, বংগভংগ রদের দরুন যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তার দ্বারাম মুসলিম স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে না, তারপর আঠার মাস অতিবাহিত হয়ে গেল এবং এখন দেখার সময় এসেছে তাঁরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি কতখানি পালন করেন।দিল্লী দরবারের ঘোষণার অল্পদিন পর মহামান্য বড়োলাট যখন ঢাকায় পদার্পন করেন, তখন প্রত্যেকেই আশা করেছিল যে, মুসলমানদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তিনি কোন একটা ঘোষনা করবেন। অবশ্য আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা শুনতে পেয়েছি। কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে আমরা যা আশা করেছিলাম, সেদিক দিয়ে এ অতি তুচ্ছ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বকে ছোট করতে চাই না। কারণ, পূর্ব বাংলার শিক্ষার উন্নয়নে যে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছিল, তা এর দ্বারা বিদূরিত হবে। একটি মুসলিম কেন্দ্রে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অমেষ সুযোগ সুবিধার কথাও অস্বীকার করিনা। কিন্তু এই যে বলা হচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু মুসলমানদের উপকারার্থে করা হচ্ছে অথবা এটা হচ্ছে মুসলমানদের খুশী করার একটা বিশিষ্ট পদক্ষেপ –আমি এসবের প্রতিবাদ করছি। বড়োলাট সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যায় হিন্দু মুসলমান উভয়েরই জন্যে এবং তাই হওয়া উচিত’। এ সংকুচিত করা হয়েছে এই ভয়ে যে হিন্দুদের মদ্যে আমর বংগভংগের প্রতিক্রিয়া জাগ্রত হতে পারে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে পরিকল্পিত একটি মুসলিম জলেক এবং ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজ –এটাকে মুসলমাদের প্রতি অনুগ্রহ করার অভিপ্রায় বলেও ধরা যেতে পারে না। কারণ অর্ধশতাব্দীর অধিককাল যাবত ষোল আনা শিক্ষক-কর্মচারী ও প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জামাদি সহ সরকার কোলকাতায় একটি একচেটিয়া হিন্দু-কলেজ চালিয়ে আসছেন এবং ঢাকায় একটি মুসলিম কলেজ হলে তা হবে মুসলমানদের দীর্ঘ দিনের অবহেলিত দাবীর দীর্ঘসূত্রী স্বীকৃতি। ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ সম্পর্কে কথা এই যে, যে অঞ্চলে মুসলমানগণ দীর্ঘকাল যাবত আরবী ও ফার্সী শিক্ষার বাসনা পোষণ করে আসচে, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের শুধু স্বাভাবিক ফল মাত্র এই ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ। এটা সকলের জানান না থাকতে পারে যে, পূর্ব বাংলার জেলাগুলি থেকে অদিক সংখ্যক ছাত্র বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলিতে পড়াশুনা করে এবং এই শ্রেণীর অধিবাসীদের প্রয়োজন পূরণ ও শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের কোন ব্যবস্থা ব্যতীত একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিছুতেই ন্যায়সংগত হতোনা। আমি আশা করি সরকারী কর্মকর্থাগণ এ কথা উপলব্ধি করবেন যে, যদিও মুসলমানগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই রায় দিয়েছে, কিন্তু এটাকে, এমনকি একটি মুসলিম কলেজ এবং ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজকেও তাদের প্রতি কোন অনুগ্রহ বলে তারা মনে করে না।
-(Bangladesh Historical Studies Speech ni the budget for 1913-14, pp.149-50)
উপরের আলোচনায় এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, বংগভংগ, ঢাকায় বিশ্ববিধ্যালয় প্রতিষ্ঠা, তথা মুসলমানদের কোন সুযোগ সুবিদার ব্যাপারে হিন্দু ভারত ও ইংরেজদের মানসিকতা ও আচরণ কি ছিল।
বংগভংগ ও বংগভংগ রদের ফলে মুসলমানরা কি লাভ করলো আর কি হারালো তাই আমাদের যাচাই পর্যালোচনা করে দেখা দরকার।
সুষ্ঠু ও সুসমঞ্জস্য প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রয়োজনে ভারতের ব্রিটিশ আমলাগণ বহু দিন যাবত কতিপয় প্রাদেশিক এলাকার পুনর্বন্টন ও পুনর্বিন্যাসের চিন্তাভাবনা করছিলেন এবং এ বিষয়ে সেক্রেটারিয়েটে ফাইলের পর ফাইল তৈরী হয়েছিল। লর্ড কার্জন এসবকে ভিত্তি করে সর্ববৃহৎ প্রদেশ বাংলাকে বিভক্ত করে ‘পূর্ববাংলা ও আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন। বাংলার মুসলমানদের এ বিষয়ে কোন ধ্যান-ধারণাই ছিল না। অবশ্য বিভাগের ফলে মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলার মুসলমানদের সর্ববিধ মংগল ও উন্নতির আশা পরিকল্পিত হলো। বাংলার হিন্দু নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের ভবিষ্যৎ সুযোগ সুবিধায় নিছক ঈর্ষান্বি হয়ে বিভাগের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। সে আন্দোলন পরে সন্ত্রাসবাদ ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের রূপ গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে মুসলমানদের প্রহি হিন্দু মানসিকতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। ভারতভূমিতে মুসলমানগণ তাদের অস্তিত্ব, তাহজি তামাদ্দুন, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে বিপন্ন মনে করে। আত্মরক্ষার জন্যে ‘মুসলিম লীগ’ নামে ভারতীয় মুসলমানের জন্যে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কায়েম হয়। ভারতের হিন্দু মুসলিম মিলে একজাতীয়তার ছদ্মনামে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করে তাদের হিন্দুজাতীয়তার মধ্যে একাকার করার ষড়যন্ত্রও মুসলমানরা উপলব্ধি করে। আগা খানের নেতৃত্বে ৩৬ জন বিশিষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দ একটি প্রতিনিধি দল বড়োলাটকে তাঁদের আশা আকাংখা ব্যাখ্যা করে পৃথম নির্বাচন প্রথার প্রবর্তন করেন। মুসলমানগণ একটি পৃথম জাতি হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে, যার ফলশ্রুতি স্বরূপ –ভারত বিভক্তি হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব লাভ হয়।