তৃতীয় অধ্যায়
মুসলিম লীগ-কংগ্রেস আলোচনা
উনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়কাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কংগ্রেসের সাথে সমঝোতায় আসার বহু চেষ্টা করা হয়। এতদুদ্দেশ্যে কংগ্রেস সভাপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদের সাতে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কয়েক দফা বৈঠক হয়। কিন্তু এসব বৈঠকে কোন লাভ হয়নি। সর্বশেষ উভয় নেতার পক্ষ থেকে যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়, তাতে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট সকল দলের নিকট গ্রহণযোগ্য সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান কল্পে যে প্রচেষ্টা চালানো হয় তা অবশেষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বলে তাঁরা দুঃখিত।
আটত্রিশের শুরুতে জিন্নাহ-গান্ধীর মধ্যে পত্র বিনিময় হয়। উভয় দলের মধ্যে যে মৌলিক মতপার্থক্য ছিল, তা এ পত্র বিনিময়ের দ্বারা সুস্পষ্ট হয়। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তেসরা মার্চ ১৯৩৮ মিঃ গান্ধীর নিকটে যে পত্র লেখেন, তাতে দুটি বাক্যে তিনি তাঁর আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মুসলিম লীগকে ভারতের মুসলমানদের একমাত্র নির্ভরশীল ও প্রতিনিধি মূলক দল হিসাবে মেনে নিন এবং অপর দিকে আপনি কংগ্রেস ও সারা দেশের প্রতিনিধিত্ব করুন। একমাত্র এর ভিত্তিতে আমরা সম্মুখে অগ্রসর হতে পারি এবং অগ্রগতির প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে পারি। জবাবে মিঃ গান্ধী ৮ই মার্চ বলেন, যে অর্তে আপনি বলেছেন, সে অর্থে আমি কংগ্রেস অথবা হিন্দু কোনটারই প্রতিনিধিত্ব করি না। তবে সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছার জন্যে আমি হিন্দুদের প্রতি আমার নৈতিক প্রভাব খাটাব। (The full Text of Jinnah-Gandhiletters in Durlab Singh, pp.16-32. The Struggle for Pakistan- I.H Quershi, p.109)
মিঃ গান্ধীর উপরোক্ত জবাবে কোন সত্যতা ও আন্তরিকতা ছিলনা। কোন একটি সংগঠনের ঘোষিত নীতি-পলিসি যাই হোক না কেন, তার সত্যিকার পরিচয় পাওয়া যায় তার বাস্তব কার্যকলাপ ও আচার আচরণে। কংগ্রেস যে পরিপূর্ণ একটি হিন্দু সংগঠন ছিল তা অস্বীকার করলে সত্যের অপলাপ করা হবে। কংগ্রেসের আচার আচরণে সর্বদা হিন্দু চেতনা ও স্বার্থেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ভারতে খেলাফত আন্দোলনে কংগ্রেসের সহযোগিতার কারণে কারো মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সে সহযোগিতায় তোস আন্তরিকতা ছিলনা। তাতে দুরভিসন্ধিই লুকায়িত ছিল, গান্ধীজির নিজের উক্তিই তার প্রমাণ। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, খেলাফত আমাদের দুজনের নিকট কেন্দ্রীয় বিষয় –মুহাম্মদ আলীর নিকট এটা তাঁর ধর্ম। আর আমার নিকট হচ্ছে খেলাফতের জন্যে জীবনপাত করে আমি গো-নিরাপত্তা নিঃসংশয় করছি। অর্থাৎ Jinnah & Gandh, p.61; মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদূদ-পৃঃ ১৬৮)
নিজউ ক্রনিকল-এর প্রতিনিধির কাছে মিঃ গান্ধী বলেন, এখানে একটি মাত্র দল আছে যা উন্নতি ও কল্যাণ করতে পারে। আর তা হলো কংগ্রেস। কংগ্রেস ব্যতীত আর অন্য কোন দল আমি মেনে নিতে রাজী না।
তিনি আরো বলেন, যে কোন মন্দ নামেই ডাকুক, ভারতে একটি মাত্র দল আছে এবং তা হলো কংগ্রেস। (Muslim Separatism in India, Abdul Hamid, p.217)
কায়েদে আজম পন্ডিত জওহর লাল নেহরুর সাথেও পত্র বিনিময় করেন। উল্লেখ্য যে, প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর নির্বাচনের পর পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেছিলেন, দেশে মাত্র দুটি দল আছে –কংগ্রেস এবং সরকার। আর যারা আছে তাদেরকে অবশ্যই কংগ্রেসের কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। যারা আমাদের সাথে নেই, তারা আমাদের বিরোধী। (Muslim Separatism in India, Abdul Hamid, p.217)
জওহরলাল নেহরুর ফ্যাসীবাদী মনমানসিকতা জানা সত্ত্বেও কায়েদে আজম উভয় দলের মধ্যে একটা আপোষ নিষ্পত্তির জন্যে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। পন্ডিত নেহরু ৬ই এপ্রিল (১৯৩৮) তারিখে লিকিত দীর্ঘ পত্রে কায়েদে আজমের সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কংগ্রেস ‘বন্দে মাতরম’ সংগীত ত্যাগ করতে রাজী নয়। কারণ একটা জাতীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ধরনের কিছু করা সংগত হবে না। কংগ্রেস পতাকা ব্যবহারেও তো কারো কোন আপত্তি দেখিনা। মুসলিম লীগ একটি গুরুত্বপূর্ণ সাম্প্রদায়িক সংগঠন বিধায় তার সাথে আমরা সে ধরনের আচরণই করি। অন্যান্য মুসলিম সংগঠনগুলোকেও উপেক্ষা করা যায় না। অতএব মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র সংগঠন হিসাবে স্বীকার করার প্রশ্নই ওঠেনা।
পত্রে তিনি আরও বলেন, কংগ্রেস উর্দুকে খর্ব করার কোন চেষ্টা করছে, অথবা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তা আমার জানা নেই। কে এসব করছে? তিনি আরও বলেন, কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা বলতে কি বুঝায় তা আমার জানা নেই।
তাঁর কথায় সহজ সরল অর্থ এই যে, প্রদেশগুলোতে মুসলিম লীগ অথবা অন্য কোন দলের সাথে ক্ষমতার অংশীদরিত্বে কংগ্রেস কিছুতেই রাজি নয়, এ কথায় সে অটল। পত্রের শেষে নেহরু বলেন, কোন চুক্তি বা সমঝোতা এবং এ ধরনের কোন কিছু ব্যক্তিগতভাবে আমি পছন্দ করি না।
সুভাসচন্দ্র বোস ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। গান্ধী-নেহরুর সাথে পত্রালাপে ব্যর্থতার পর কায়েদে আজম সুভাস বোসের সাথে পত্র বিনিময় করেন। মে মাসে কায়েদে আজম মিঃ বোসের লিখিত পত্র আলেচনার জন্যে মুসলিম লীগ কার্যকরী পরিষদে পেশ করেন। এর উপর যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে বলা হয় যে, হিন্দু মুসলিম মতবিরোধের মীমাংসা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কংগ্রেসের সাথে কোন আলোচনা করতে মুসলিম লীগ রাজি নয় যতোক্ষণ না মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের আস্থাভাজন এবং প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসাবে মেনে নেয়া হবে। তদনুযায়ী কায়েদে আজম মিঃ বোসের নিকটে দুসরা আগষ্ট লিখিত পত্রে বলেন,
লাখনোতে ১৯১৬ সালে যে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাতে মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের আস্থাভাজন ও প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসাবে মেনে নেয়া হয়। সে সময় থেকে ১৯৩৫ সালে জিন্নাহ-রাজেন্দ্রপ্রসাদ আলোচনা পর্যন্ত এ নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। যেসব মুসলমান কংগ্রেসে আছে, তাঁরা ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনা। মুসলিম লীগের এ কথাও জানা নেই যে, কোন মুসলিম রাজনৈতিক দল ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের দাবী করেছে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এর এক বিস্ময়কর জবাব আসে। অর্থাৎ মুসলিম লীগের কোন দাবীই কংগ্রেস মানতে রারিজ নয়। (The Struggle for Pakistan, I.H. Qureshi, pp.107-112)
কংগ্রেস-মুসলিম লীগের আলাপ আলোচনা ও পত্র বিনিময়ের ফলে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় যা অতি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমতঃ কংগ্রেসী মন্ত্রীসভাগুলোর বিরুদ্ধে অত্যাচার অবিচারের অভিযোগ কংগ্রেস অস্বীকার করে। দ্বিতীয়তঃ কংগ্রেস হিন্দু মুসলিম সমস্যাকে কোন সমস্যাই মনে করেনা। তার মতে এ এক সাময়িক ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাস। সময়ের পরিবর্তনে তা বিস্মৃতির অতল তলে নিমজ্জিত হবে। তৃতীয়তঃ কংগ্রেসের দাবী এই যে, তা সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। কংগ্রেসন একমাত্র অকৃত্রিম জাতীয় সংগঠন যা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতিনিধিত্ব করে। অনেক মুসলিম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসকে সমর্থণ করে। শুধুমাত্র মুসলিম লীগ দূরে অবস্থার করছে। আর কত দিন তারা এভাবে থাকবে? হয়তো সত্বরই কংগ্রেসের সাথে ভিড়ে যাবে। অতএব মুসলিম লীগের দাবীর প্রতি গুরুত্বদানের প্রয়োজন কি?
কংগ্রেসের উপরোক্ত দৃষ্টিভংগী মুসলিম লীগের মধ্যে স্বভাবতঃই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং মুসলিম লীগকে ঐক্যবদ্ধ, সংহত ও শক্তিশালী করে। এ দীর্ঘ আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট হয় যে কংগ্রেস হিন্দু ভারতের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে দাবিয়ে রাখাই শুধু তার উদ্দেশ্য নয়, তাদেরকে নির্মূল করাও তার উদ্দেশ্য। বাল গংগাধর তিলকের আন্দোলন, স্বামী শ্রদ্ধানন্দের শুদ্ধি আন্দোলন, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসনভার রাজনৈতিক দর্শনের একই লক্ষ্য ছিল এবং তা হলো মুসলমানদেরকে দমিত ও বশীভূত করে রাখা অথবা নির্মূল করে হিন্দু রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
উল্লেখ্য ১৯০৬ সালে বংগভংগ রদ আন্দোলন চলাকালীন সারা ভঅরতে হিন্দুধর্ম পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে ‘শিবাজী উৎসব’ পালন করা হয়। সকল হিন্দু সমাজ নেতা, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষাব্রতী এ উৎসবে সানন্দে যোগদান করেন। এ উপলক্ষে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিবাজী উৎসব’ লিখে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন কর্মে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেন এবং ‘শুভশঙ্খনাদে জয়তু শিবাজী’ উচ্চারণ করে এ ধ্যানমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেনঃ
ধ্বজা ধরি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন-
দরিদ্রের বল।
এক ধর্মরাজ্য হবে ‘এ ভারতে’ এ মহাবচন
করিব সম্বল।
রাজনীতি ও হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন অংগাংগীরূপে মিশে গেল। ধর্মীয় বোধের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় রাজনীতিকে গণআন্দোলনে রূপায়িত করার চেষ্টা হলো।
(B.B. Misra The Indian Class Their Giowth). আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধেল আগে ‘দি টাইমসের’ সংবাদদাতা স্যার ভ্যালেন্টাইন চিরলকে তাঁর এক মুসলমান বন্ধু বলেন, তিলক, তাঁর অনুসারিগণ এবং পাঞ্জাব ও বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদীগণকে প্রকাশ্যে বলাবলি করতে শুনা যায় যে, অতীতে স্পেন থেকে যেভাবে মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করা হয়, ঠিক তেমনি ভারত থেকে মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করা হবে। স্যার ওয়াণ্টার লরেন্সও অনুরূপ কথা বলেন। তিনি ছিলেন ভাইসরয় কার্জনের স্টাফ সদস্য। তিনি ইদোরের মহারাজা স্যার প্রতাপ সিংকেও অনুরূপ মনোভাব ব্যক্ত করতে শুনেন। তিনি বলেনঃ তিনি পূর্বে তাঁর এ ঘৃণার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারিনি। লর্ড কার্জন আমার এবং আমার স্ত্রীর সম্মানে শিমলার আগমন করেন। ডিনার দিয়েছিলেন তাতে যোগদানের জন্যে স্যার প্রতাপও শিমলা আগমন করেন। ডিনার শেষে স্যার প্রতাপ রাত দুটো পর্যন্ত তাঁর আশাআকাংখা ও অভিলাষ সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করেন। তাঁর অভিলাষের মধ্যে একটি হলো ভারতে বুক থেকে মুসলমাদেরকে নির্মূল করা।
…তিনি ভালো ইংরেজী জানতেন, বহু জাতির সাথে মিশেছেন, ছিলেন বিশ্বজনীন সভ্যতার বিশ্বাসী। কিন্তু তাঁর মহৎ হৃদয়ের তলায় চিল মুসলমানদের জন্যে দুরপনৈয় ঘৃণা।
(Sir Walter Lawrence: The India We Served, p.209; Abdul Hamid: Muslim Separatism in India, pp.83-84)
নিরপেক্ষ মন নিয়ে যিনিই উপমহাদেশের হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের চুলচেরা বিশ্লেষণে সক্ষম হয়েছেন, তাঁর কাছে মুসলমানদের সম্পর্কে উক্ত হিন্দু মানসিকতাই ধরা পড়েছে। তাই এশিয়াটিক রিভিউ পত্রিকায় প্যাট্রিক ফ্যাগান তাঁর এক লিখিত প্রবন্ধে বলেন, পরাধীন ভারতে মুসলমানের দুটি মাত্র পথ খোলা আছে, একটি হিন্দু তাতিতে লীন হয়ে যাওয়া অন্যটি দৈহিক শক্তি বলে ভারতের কোন কোন অঞ্চলে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র সৃষ্টি করা। অবশেষে ভারতের দশ কোটি মুসলমানের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ সংগ্রাব ব্যতীত উপায়ান্তর রইলোনা।