চতুর্দশ অধ্যায়
মাউন্টব্যাটেন মিশন
নতুন বছর, ১৯৪৭-এর প্রারম্ভে ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক পরিস্থিতি এমন ছিল যে কেন্দ্রে একটি অন্তবর্তী সরকার অথবা ভাইসরয়ের একজেকিউটিভ কাউন্সিল রয়েছে যেখানে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বিরাট মতপার্থক্যসহ অবস্থান করছে। ৯ই ডিসেম্বর ১৯৪৬ থেকে গণপরিষদের অধিবেশন চলছে যা লীগ বয়কট করে চলেছে। তার ফলে কংগ্রেস লীগকে ভাইসরয়ের কাউন্সিল থেকে বহিস্কারের দাবী জানাচ্ছে। ১৩ই ফেব্রুয়ারী নেহরু ভাইসরয়কে পত্র দ্বারা লীগকে বহিস্কারের দাবী জানান। ১৫ই ফেব্রুয়ারী প্যাটেল হুমকি প্রদর্শন করে বলেন, লীগ সরকার থেকে বেরিয়ে না গেলে কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকার ত্যাগ করবে। (The Indian Annual Register 1847, vol,1 p.35; I.H. Quershi The Struggle for Pakistan; p.287)।
এরূপ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ২০শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৭ প্রধানমন্ত্রী এটলী একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতি আর দীর্ঘায়িত হতে দেয়া যায় না। বৃটিশ সরকার পরিস্কার বলে দিতে চান যে, জুন মাসের ভেতরেই দায়িত্বশীল ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করবে। পূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল গণপরিষদ কর্তৃক সর্বসম্মত শাসনতন্ত্র এ সময়ের মধ্যে প্রণীত না হলে, সরকার বিবেচনা করবে বৃটিশ ভারতে ক্ষমতা কার কাছে যথাসময়ে হস্তান্তর করা হবে –বৃটিম ভারতে কোন ধরনের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অথবা বর্তমান কোন উপায়ে যা অত্যন্ত যুক্তিসংগত বিবেচিত হবে এবং যা ভারতীয় জনগণের স্বার্থের অনুকূল হবে।
বিবৃতির শেষে এ কথাও ঘোষনা করা হয় যে ওয়াভেলের স্থলে এডমিরাল দি ভাইকাউন্ট ম্যাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় করা হচ্ছে।
চারদিন পর ভারত সচিব হাউস অব লর্ডস –এ ঘোষণা করেন যে, এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ভারতের দায়িত্বশীল মহলের পরামর্শে। আর উদ্দেশ্য ছিল একটি চাপ সৃষ্টি করা যাতে ভারতীয় দলগুলো একটা সমঝোতায় পৌঁছে।
এখানে ভারতের দায়িত্বশীল মহল বলতে যে গান্ধী নেহরুকে বুঝানো হয়েছে এবং সমঝোতা বলতে কংগ্রেসের দাবী লীগকে মেনে নেয়া বুঝানো হয়েছে তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
ভারতের রাজনৈতিক চরম মুহুর্তে লর্ড ওয়াভেলকে কেন অপসারণ করা হলো তা জানার ঔৎসুক্য পাঠকবর্গের অবশ্যই থাকতে পারে। কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল একটী যতো কথাই বলুন, কংগ্রেসকে বিশেষ করে গান্ধী ও নেহরুকে খুশী করার জন্যই যে ওয়াভেলের শাস্তি হলো, কতিপয় ঘটনা তার সাক্ষ্য বহন করে।
প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলী ও তাঁর কেবিনেটের সাথে লর্ড ওয়াভেলের কি কোন চরম মতপার্থক্য হয়েছিল যার মূল্য ওয়াভেলকে দিতে হয়? এর কোন প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এর কারণ অন্য কিছু। তাই অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
উল্লেখ্য যে লর্ড ওয়াবেল প্রথমে কংগ্রেসের অতি প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৪৬ এর জুনে মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে চাইলে ওয়াভেল বাধা দেন। পরে আবার তিনি কংগ্রেসকে সরকার গঠনের অনুমতি দেন লীগকে বাদ দিয়েই। পূর্বে তিনি বেশ দৃঢ়তার সাথে এ কথা বলেন যে ভারতের ভৌগলিক ঐক্য বা অখন্ডতা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। যার জন্য লীগ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। পরবর্তীকালে ভাইসরয়-কংগ্রেস সম্পর্কে উষ্ণতা হ্রাস পেতে থাকে। কোলকাতার রক্তক্ষয়ী দাংগারপর কংগ্রেস ভাইসরয়কে বলেছিল, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদত্ত অধিকার ক্ষুণ্ণ করে হলেও বাংলার লীগ মন্ত্রীসভা ভেঙে দিতে। ভাইসরয় তাদে রাজী হননি। এর ফলে তিনি কংগ্রেসের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। তারপর লীগ কাউন্সিলারদেরকে ভাইসরয়ের Executive Council থেকে বহিষ্কার করার বার বার দাবী জানানোরপরও যখন ভাইসরয় তা মানতে অস্বীকার করলেন তখন সম্পর্কে ভাঙন চূড়ান্তে পৌঁছলো। তারপর ভাইসরয়কে অপসারণের জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে গান্ধীর তারবার্তা ও পত্রাদি প্রেরণ এবং একই উদ্দেশ্যে বৃটেনে নেহরুর বন্ধুবান্ধবকে তাঁর পত্র প্রেরণ; ভারত সচিব এ সবকেই বলেছেন ‘ভারতের দায়িত্বশীল মহলের পরামর্শে’। ওয়াভেলের অপসারণে এবং মাউন্টব্যাটেনের ভাইসরয় হিসাবে ভারত আগমনে নেহরু অত্যন্ত আনন্দিত হন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ২২শে মার্চ দিল্লী পৌঁছেন। তায়র নিয়োগ কংগ্রেসকে উল্লসিত করে। পূর্ব থেকেই নেহরুর সাথে তার সম্পর্ক ছিল। ভারতে তিনি কোন অপরিচিত লোক ছিলেন না। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি ছিলেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মিত্র বাহিনীর সুপ্রীম কমান্ডার। সে কারণে তাঁকে বার বার ভারতে আসতে হতো যা ছিল যুদ্ধের অপারেশন বেস (Base for operation)। দুবচল পূর্বে মালয়ে নেহরুর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁরা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হন। তবে তিনি যে কংগ্রেস ভক্ত ছিলেন তা জানা যায়নি। তাঁর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা লর্ড ইসমে ভয় করছিলেন যে –মাউন্টব্যাটেনকে হিন্দুভক্ত এবং মুসলিম লীগ বিদ্বেষী হিসাবে গ্রহণ করা হবে। (Cempbell-Johnson, Allan: Mission with Mountbatten, p.23; Abdul Hamid Muslim Separatism in India, p.239)।
নিয়মমাফিক ভাইসরয় স্টাফের অতিরিক্ত একটি ব্যক্তিগত সেক্রেটারিয়েট গঠনের অনুমতি মাউন্টব্যাটেনকে দেয়া হয়। সেটা চিল তাঁর ‘কিচেন কেবিনেট’। তাঁর সাফল্যের মূলে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন ভি.পি. মেনন। ভাইসরয় তাঁকে তাঁর নীতিনির্ধারণী পরিমন্ডলে টেনে এনেছিলেন। ভদ্রলোক ১৯৪২ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের সাংবিধানিক পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করে আসছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক যোগ্যতার সাথে রাজনৈতিক বিচক্ষণতাও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। তিনি ছিলেন প্যাটেলের শরণাগত। তাঁর নিজের লিখিত গ্রন্থ The Transfer fo Power, Calcutta, 1957’ পাঠে পরিস্কার জানা যায় যে তিনি ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত সেক্রেটারিয়েট সংশ্লিষ্ট হওয়ার পূর্বেও সর্বদা লীগের বিরুদ্ধেই তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এখন তিনি শাসনদন্ডের পেছনে এক বিরাট শক্তি হয়ে পড়লেন।
-(Abdul Hamid Muslim Separatism in India, p.239)।
মাউন্টব্যাটেন ইংলন্ড থেকে সযত্নে ও সাবধানতা সহকারে তাঁর স্টাফের লোক বেছে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লর্ড ইসমে যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চার্চিলের ব্যক্তিগত সাধারণ উপদেষ্টা ছিলেন। আরও ছিলেন এরিক সিভিল, লর্ড উইনিংডনের প্রাক্তন প্রাইভেট সেক্রেটারী এবং ৬ষ্ঠ জর্জের এসিস্ট্যান্ট প্রাইভেট সেক্রেটারী, এ দুজন ছিলেন ভাইসরয়ের সাধারণ ও বেসামরিক দিকের প্রধান উপদেষ্টা এবং লর্ড ইসমে ছিলেন চীফ অব স্টাফ। ভি, পি, মেনন ছিলেন সাংবিধানিক পরামর্শদাতা। প্রায়ই স্টাফের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। প্রথমতঃ মাঝে মাঝে মেননকে বৈঠকে ডাকা হতো। পরে প্রত্যেক বৈঠকে তাঁকে ডাকা হতো। ভাইসরয় এবং অন্যান্য সকলের জানা ছিল যে মেনন ছিলেন সকল প্যাটেলের অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক। এর ফলে ভাইসরয়ের কাউন্সিলের আভ্যন্তরীণ সকল গোপন তথ্যই শুধু প্যাটেল জানতেন না, বরঞ্চ তাঁর এ মুখপাত্রকে দিয়ে তিনি ভাইসরয়ের পলিসি প্রভাবিত করতেন। মেননের স্থলে কোন মুসলমান যদি হতেন এবং তিনি জিন্নাহর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন, তাহলে ভাইসরয় এবং কংগ্রেস কারো পক্ষ থেকেই তাঁকে বরদাশত করা হতোনা। এঁদের নিকটে মুসলিম লীগ তথা ভারতের মুসলমান সুবিচার আশা করতে পারতো কি?
তেসরা জুন পরিকল্পনার ক্রমবিকাশ
কেবিটেন মিশন পরিকল্পনার ভিত্তিতে অখন্ড ভারতের জন্য সর্বসম্মত সমাধান প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যে মাউন্টব্যাটেনকে ভারতে ভাইসরয় নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বারতে পৌঁছার পর ঘটনা প্রবাহ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিপরীতমুখী দৃষ্টিভংগী লক্ষ্য করার পর সর্বসম্মত সমাধান এবং অখন্ড ভারতো কোন সম্ভাবনা দেখা যায় না। অতএব প্রধানমন্ত্রীর ২০শে ফেব্রুয়ারীর ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই পরিকল্পনা তৈরীর প্রতি ভাইসরয় মনোনিবেশ করেন।
তিনি তাঁর পরামর্শদাতাগণের সাথে পরামর্শের পর ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন। তার ভিত্তি হলো প্রদেশগুলোর হাতে, অথবা সেসব প্রদেশগুলোর কনফেডারেশনের হাতে যারা বাস্তবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে দলবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত করবে –তাদের হাতে ক্ষমতা ও অধিকার হস্তান্তর করা হবে। ১ই এপ্রিল ইসমে পরিকল্পনার খসড়া মেননকে দেন তার সংশোধনীসহ সময়সূচী তৈরীর জন্য। মেনন আদেশ পালন করেন এবং সেই সাথে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, এ একটি মন্দ পরিকল্পনা এবং এ কার্যকর হবে না। গভর্ণরদের সম্মেলনে চূড়ান্ত পরিকল্পনা পেশ করা হয় এবং তা অনুমোদিত হয়। দুসরা মে লর্ড ইসমে এবং জর্জ এবেল হোয়াইট হলের অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনাটি নিয়ে লন্ডনে রওয়ানা হন। ভাইসরয়ে আশা করছিলেন যে ১০ই মের ভেতরে অনুমোদন পেয়ে যাবেন এবং ১৭ই মে দলীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য একত্রে মিলিত হওয়ার আবেদন জানাবেন।
অতঃপর মাউন্টব্যাটেন স্যার এরিক সিভিল ও মেননসহ শিশলা গমন করেন। এখানে মেনন ভাইসরয়ের সাথে নিরিবিল কথা বলার সুযোগ পান এবং লন্ডনে প্রেরিত পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন, এ কার্যকর হবেনা। মেননের সকল যুক্তি শুনার পূর্বে হঠাৎ নেহরু এবং কৃষ্ণ মেনন ভাইসরয়ের সাথে থাকার জন্য ৮ই মে শিমলা পৌঁছেন। ভাইসরয় মেননকে নেহরুর সাথে কথা বলতে বলেন। ৯ইমে মেনন নেহরুকে বলেন, ডমিনিয়ন স্টেটাসের ভিত্তিতে ক্ষমতা দুটি ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হবে –প্রদেশগুলো তা তাদের কনফেডারেশনের কাছে নয়। ১০ই মে ভাইসরয় নেহরু, মেনন ও স্যার এরিক সিভিলকে নিয়ে পরিকল্পনাটির উপর আলোচনা করেন যা কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং ভারত সরকারের রেকর্ডের অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়।
ঐদিনই লন্ডন থেকে অনুমোদিত পরিকল্পনা ভাইসরের হস্তাগত হয় অবশ্য কিছু সংশোধনীসহ। ডিনারের পর ভাইসরয়ে নেহরুকে ডেকে পরিকল্পনাটি দেখান যা অনুমোদিত হয়ে এসেছে। পরিকল্পনাটি পড়ার পর নেহেরু ভয়ানক রেগে গিয়ে বলেন, আমি, কংগ্রেস এবং ভারত –কারো কছেই এ গ্রহণযোগ্য নয়।
মাউন্টব্যাটেন ১১ই মে মেননকে ডেকে নেহরুর প্রতিক্রিয়া তাঁকে জানান এবং বলেন যে এখন কি করা যায়। মেনন বলেন, ৯ই এবং ১০ই মে আমার যে পরিকল্পনা কার্যকর করার ফলে দেশ বহু ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং আমার পরিকল্পনা ভারতের অত্যাবশ্যক ঐক্য বজায় রাখবে। আর যেসব অঞ্চল ভারতের অংশ হিসাবে থাকতে ইচ্ছুক নয় তাদেরকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে।
তড়িঘড়ি স্টাফ মিটিং আহবান করা হয় এবং নেহরুকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভাইসরয় নেহরুকে জিজ্ঞাস করেন যে মেননের পরিকল্পনা তিনি অনুমোদন করেন কিনা। তা দেখার পর নেহরু অনুমোদন করেন।
অতঃপর ভাইসরয় ১৪ই মে দিল্লী প্রত্যাবর্তণ করেন এবং ১৮ই মে লন্ডন যাত্রা করেন পরিকল্পনাটি অনুমোদনের উদ্দেশ্যে কেবিনেটকে সম্মত করার জন্য। লর্ড ইসমে এবং জর্জ এবেল মেননের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। ভাইসরয় জোর দিয়ে বলেন, বৃটিশ সরকার এ পরিকল্পনা অনুমোদন না করলে আমি পদত্যাগ করব। কেবিনেট পরিকল্পনাটির একটি ‘কমা’ পর্যন্ত পরিবর্তন না করে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে অনুমোদন করেন। ভাইসরয় বিজয়ীর বেশে ৩১ মে তাঁর দলসহ ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন।
এখন এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে, যে পরিকল্পনাটি ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ত্বরান্বিত করে এশিয়া ও পৃথিবীর মানটিত্রে একটি পরিবর্তন সূচিত করতে যাচ্ছে, তা তৈরী হলো ভাইসরয়ের একজন কংগ্রেসভক্ত হিন্দু উপদেষ্টার দ্বারা এবং নেহরু ও কৃষ্ণ মেননের সহযোগিতায়। দেশ ও দেশেল কয়েক কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের এ পরিকল্পনা নিয়ে ভাইসরয় একমান যাবত তাঁর মুষ্টিমেয় প্রিয়জন নিয়ে আলাপ আলোচনা করলেন, কিন্তু তার কোন এক পর্যায়ে একটি বারের জন্য্যও জিন্নাহকে ডাকা হলোনা। এর দ্বারা মাউন্টব্যাটেন তথা বৃটিশ সরকারের অতি সংকীর্ণ ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী মানসিকতাই পরিস্ফুট হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় তা চিরদিন অংকিত থাকবে।
একটি প্রশ্ন যা মনকে আলোড়িত করে
ভারত বিভাগের পরিকল্পনা বৃটিশ সরকার কর্তৃক চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে। তেসরা জুন তা সরকারীভাবে ঘোষণা করা হবে। পরিকল্পনাটি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পূর্বেই তার প্রতি নেহরু তাঁর সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। এখন প্রশ্ন এই যে এটা কি করে সম্ভব হলো? কংগ্রেস, হিন্দুভারত ও তার প্রধান মুখপাত্র গান্ধী, নেহরু ও প্যাটেল কিভাবে ভারতমাতার অংগচ্ছেদে রাজী হলেন? তাঁরা কি অখন্ড ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার বহুদিনের সোনারী স্বপ্ন পরিহার করলেন?
জেনালের টুকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রতিহিংসা পরায়ণ মনোভাবের উপর আলোকপাত করে বলেন-
অবশেষে তারা বল্লেন, আচ্ছা, মুসলিম লীগ যদি পাকিস্তান পেতে চায়, তা ঠিক আছে পেতে দাও। আমরা তাদের অঞ্চলের একটি ইঞ্চি কেটে কেটে নিয়ে নেব যাতে মনে হবে যে আর তা টিকে থাকবে না এবং যতোটুকু তাকবে তা আর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চালানো যাবে না। (Sir Francis Tuker: White Memory Server, London, Cassel, 1950, p.257; Choudhury Mohammad Ali: The Emergence of Pakistan, p.123)।
প্যাটেল ১৯৪৯ সালে ভারতের গণপরিষদে যে ভাষণ দেন, তা টুকারের উপরোক্ত মন্তব্যের যথার্থতাই ব্য্কত কের। প্যাটেল তাঁর ভাষণে বলেন, আমি সর্বশেষ উপায় হিসাবে দেশবিভাগে সম্মত হই, যখন আমরা সব হারিয়ে ফেলেছিলাম। মিঃ জিন্নাহ কাটছাট করা পাকিস্তান চাননি কখনো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই তাঁকে গিলতে হলো। (Quoted in Kewnl L. Panjabi, The Indemiable Sardar, Bombay, Bharatiya Vidya Bhaban, 1962, p. 124; Choudhury Mohammad Ali-Ibid, p.123)।
কংগ্রেসের দেশবিভাগ মেনে নেয়াটা ছিল একটা কৌশলগত পদক্ষেপ। কিন্তু লক্ষ্যস্থল অপরিবর্তিত ছিল; এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে প্রয়োজন-
১। হিন্দুস্তান বা ইন্ডিয়ান ইউনিয়নকে ভারতে বৃটিশ সরকারের উত্তরাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পাকিস্তানকে মনে করা হবে যে কিছু অঞ্চলসহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
২। পাকিস্তানের সাথে যেসব এলাকা সংশ্লিষ্ট করা হতে তা হবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং তা পূর্ব বাংলা, পম্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানের বাইরে থাকবে। ফলে পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে পরিবেষ্টিত করে রাখা হবে।
৩। সময়, উপায় উপাদান, সামরিক-বেসামরিক জনশক্তি ও মাল মশলা থেকে পাকিস্তানকে বঞ্চিত করে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে যাতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারে।
৪। পাকিস্তান যাতে টিকে থাকতে না পারে তার জন্যে যা কিছু করা দরকার তা করা হবে। (কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ নিশ্চিত ছিলেন যে পাকিস্তান বেশী দিন টিকে থাকতে পারবেন। এজন্যে তাঁদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অর্থনীতি ধ্বংস করার চেষ্টা করা)।
এসব হীন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে হিন্দুভারতের প্রয়োজন ছিল বৃটিশের সাহায্য যারা গোটা বেসামরিক প্রশাসন ও সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতো। বিদায়ের প্রাক্কালে মাউন্টব্যাটেন-র্যাডক্লিফ সহ গোটা প্রশাসন হিন্দুভারতের স্বার্থে কাজ করেছে যা পরে উল্লেখ করা হবে।
-(Chudhury Mohammad Ali: The Emergence of Pakistan, pp.123-24)।