জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি

বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস

অন্তর্গতঃ uncategorized
Share on FacebookShare on Twitter

সূচীপত্র

  1. গ্রন্থকারের কথা
  2. প্রথম অধ্যায়
    1. বাংলায় মুসলমানদের আগমন
  3. দ্বিতীয় অধ্যায়
    1. বিজয়ীর বেশে মুসলমান
    2. বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা
    3. বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ
    4. রাজা গনেশ
    5. ইলিয়াস শাহী বংশ
    6. হিন্দুজাতির পুনরুত্থান
    7. গশেণের বংশ
    8. ইলিয়াস শাহী বংশের পুনরুত্থান
    9. বাংলার মসনদে হাবশী সুলতান
    10. হোসেন শাহ
    11. শ্রীচৈতন্য
    12. হোসেন শাহী বংশ
  4. তৃতীয় অধ্যায়
    1. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাংলায় আগমন
    2. মীর জুমলা থেকে সিরাজদ্দৌলা
    3. নবাব শায়েস্তা খান
    4. ফিদা খান ও যুবরাজ মুহাম্মদ আজম
    5. সুবাদার ইব্রাহীম খান
    6. সুবাদার আজিমুশশান
    7. মুর্শিদ কুলী খান
    8. সুজাউদ্দীন
    9. সরফরাজ খান
    10. আলীবর্দী খান
    11. সিরাজদ্দৌলা
  5. চতুর্থ অধ্যায়
    1. বাংলার মুসলিম শাসন বিলুপ্তির পশ্চাৎ পটভূমি
    2. মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা
    3. বাংলার পতনের রাজনৈতিক কারণ
    4. বাংলায় ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের উচ্চভিলাষ
    5. ফলতার ইংরেজগণ
  6. পঞ্চম অধ্যায়
    1. ইংরেজদের আক্রমণ ও নবাবের পরাজয়
    2. সিরাজদ্দৌলার পতনের পর বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা
  7. ৬ষ্ঠ অধ্যায়
    1. মুসলিম সমাজের দুর্দশা
    2. ১. নবাব
    3. ২। সম্ভ্রান্ত বা উচ্চশ্রেণীর মুসলমান
    4. ৩। নিম্নশেণীর মুসলমানঃ কৃষক ও তাঁতী
    5. তাঁতী
    6. হিন্দু মুসলিম সম্পর্কঃ ধর্ম ও সংস্কৃতি
    7.  সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ
  8. সপ্তম অধ্যায়
    1. মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাদীক্ষা
    2. ইংরেজদের আগমনের পর
    3. খৃস্টান মিশনারী ও ইংরেজী শিক্ষার সূচনা
    4. বাংলার মুসলমান ও বোধনকৃত নতুন বাংলা ভাষা
    5. আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও সাম্প্রদায়িকতা
  9. অষ্টম অধ্যায়
    1. আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও মুসলমান
    2. উনবিংশ শতকে মুসলমান
      1. মুসলমান চরম অগ্নি পরীক্ষার মুখে
      2. ফকীর আন্দোলন
  10. নবম অধ্যায়
    1. ফারায়েজী আন্দোলন
  11. দশম অধ্যায়
    1. শহীদ তিতুমীর
    2. কোলকাতায় জমিদারদের ষড়যন্ত্র সভা
    3. আলেকজান্ডারের রিপোর্ট ও তার প্রতিক্রিয়া
  12. একাদশ অধ্যায়
    1. সাইয়েদ আদমদ শহীদের জেহাদী আন্দোলন
    2. মুহাম্মদ বিন ওয়াহহাব
    3. শাহ ওয়ালীউল্লাহ
    4. শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (রহ)
    5. শাহ ওয়ালিউল্লাহর বংশ তালিকা
    6. সাইয়েদ আহমদ শহীদ
    7. বালাকোট বিপর্যয়ের কারণ
    8. বালাকোটের বিপর্যয়ের পর
    9. মওলানা বেলায়েত আলী
    10. বিপ্লবী আহমদুল্লাহ
    11. মওলানা ইয়াহইয়া আলী
    12. মওলানা ইমামুদ্দীন
    13. সূফী নূর মুহাম্মদ নিযামপুরী
  13. দ্বাদশ অধ্যায়
    1. বৃটিশ ভারতে প্রথম আযাদী সংগ্রাম
  14. ত্রয়োদশ অধ্যায়
    1. স্যার সাইয়েদ আহমদ খান
    2. আর্য সমাজ
    3. ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
    4. বাল গংগাধর তিলক
  15. চতুর্দশ অধ্যায়
    1. বংগভংগ রদ ও তার প্রতিক্রিয়া
  16. পঞ্চদশ অধ্যায়
    1. উনিশ শ’ ছয় থেকে ছত্রিশ
    2. খেলাফত আন্দোলন
    3. হিজরত আন্দোলন
    4. মোপলা বিদ্রোহ
    5. ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের উপর সুপরিকল্পিত হামলা
    6. সংগঠন আন্দোলন
    7. মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের স্বাতন্ত্র দাবী
    8. সর্বদলীয় সম্মেলন
    9. মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঐতিহাসিক চৌদ্দ দফা
    10. সাইমন কমিশন
    11. গোলটেবিল বৈঠক
    12. দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক
    13. তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক
    14. পুনাচুক্তি
    15. ভারত শাসন আইন
  17. দ্বিতীয় ভাগ
  18. প্রথম অধ্যায়
    1. ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫ (Govt. of India Act, 1935)
    2. প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন
    3. রক্ষাকবচ প্রশ্নে অচলাবস্থা সৃষ্টি
    4. নির্বাচনের ফলাফল
    5. বাংলা
    6. পাঞ্জাব
    7. সিন্ধু
    8. আসাম
  19. দ্বিতীয় অধ্যায়
    1. প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা
      1. প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস শাসন
      2. কোয়ালিশন সরকার গঠনে অস্বীকৃতি
    2. কংগ্রেস শাসন এবং মুসলমান
      1. পীরপুর রিপোর্ট
      2. ফজলুল হক সাহেবের বিবৃতি
      3. বিভিন্ন পত্রিকার অভিমত
      4. ওয়ার্ধা শিক্ষা প্রকল্প
  20. তৃতীয় অধ্যায়
    1. মুসলিম লীগ-কংগ্রেস আলোচনা
  21. চতুর্থ অধ্যায়
    1. পাকিস্তান আন্দোলন
      1. কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা
      2. উপমহাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তার উখান ও পতন
      3. ইসলামের সহজাত ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য
      4. মুসলমান একটি জাতি
      5. হিন্দুদের বিরোধিতা
      6. পাকিস্তানের চিন্তাভাবনা
  22. ষষ্ঠ অধ্যায়
    1. পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা
      1. ব্রিটিশ সরকারের আগস্ট প্রস্তাব
      2.  কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন ও মুসলমান 
      3. লিবারাল পার্টি প্রস্তাব-১৯৪১
      4. গান্ধীর প্রতিক্রিয়া
      5. প্রতিরক্ষা পরিষদ (Defence Council) গঠন
  23. অষ্টম অধ্যায়
    1. ক্রিপস মিশন
      1. ভারতীয়তের প্রতিক্রিয়া
      2. ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার পর
      3. ক্রিপসের বেতার ভাষণ
      4. ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন (Quite India Movement)
      5. সি, আর ফর্মূলা
      6. সি, আর ফর্মূলার ব্যর্থতার কারণ
      7. সাপ্রু প্রস্তাব
      8. দেশাই-লিয়াকত চুক্তি
  24. নবম অধ্যায়
    1. ওয়াবেল পরিকল্পনা ১৯৪৫
      1. শিমলা সম্মেলন
      2. ব্যর্থতার কারণ
      3. সাধারণ নির্বাচন
  25. দশম অধ্যায়
    1. কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা
      1. লীগ প্রতিক্রিয়া
  26. একাদশ অধ্যায়
    1. ডাইরেক্ট অ্যাকশন
      1. আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য
      2. মুসলিম লীগের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের পর
  27. দ্বাদশ অধ্যায়
    1. একজেকিউটিভ কাউন্সিলে লীগের যোগদান
      1. কংগ্রেস
      2. মুসলিম লীগ
      3. সংখ্যালঘু
      4. কোয়ালিশন সরকার
  28. ত্রয়োদশ অধ্যায়
    1. গণপরিষদ
  29. চতুর্দশ অধ্যায়
    1. মাউন্টব্যাটেন মিশন
      1. তেসরা জুন পরিকল্পনার ক্রমবিকাশ
      2. একটি প্রশ্ন যা মনকে আলোড়িত করে
  30. পঞ্চম অধ্যায়
    1. ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া
      1. বড়োলাটগিরি নিয়ে ক্যানভাসিং ও বিতর্ক
      2. জুন ৩ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
  31. ষষ্ঠদশ অধ্যায়
    1. উপসংহার
      1. ইসলামী জীবনব্যবস্থা
      2. ইসলামে জাতীয়তার ধারণা
      3. স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থা
      4. ইসলামের সহজাত বৈশিষ্ট্য
      5. উপমহাদেশে ইসলামী আইন-শাসন প্রতিষ্ঠা
  32. তথ্যসূত্র

পঞ্চম অধ্যায়

ইংরেজদের আক্রমণ ও নবাবের পরাজয়

উনত্রিশে ডিসেম্বর ক্লাইভের রণতরী হুগলী নদী দিয়ে অগ্রসর হয়ে বজবজ দখল করে। তার চার দিন আগে ক্লাইভ মানিকচাঁদের মাধ্যমে নবাবকে যে পত্র লিখে তাতে বলা হয়, নবাব আমাদের যে ক্ষতি করেছেন, আমরা এসেছি তার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্যে, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে আসিনি তাঁর কাছে। আমাদের দাবী আদায়ের জন্যে আমাদের সেনাবাহিনীই যথেষ্ট। মানিকচাঁদ পত্রখানি নবাবকে দিয়েছিল কিনা জানা যায়নি। হয়তো দেয়নি। দিলে নবাব নিশ্চয়ই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। মানিকচাঁদ সর্বধা নবাবকে বিভ্রান্ত রেখেছে। তার ফলে বিনা বাধায় ক্লাইব ৩১শে ডিসেম্বর থানা ফোর্ট এবং ১লা জানুয়ারী, ১৭৫৭ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পুনরুদ্ধার করে। মানিকচাঁদ ইচ্ছা করলে নবাবের বিরাট সৈন্য বাহিনীর সাহায্যে ইংরেজদের আত্রমণ সহজেই প্রতিহত করতে পারতো। সে তার কোন চেষ্টাই করেনি। কারণ ইংরেজদের দ্বারা তার একং তার জাতির অভিলাষ পূর্ণ হতে দেখে সে আনন্দলাভই করছিল। এমনটি এ সকল স্থান ইংরেজ-কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার সংবাদটুকু পর্যন্ত সে নবাবকে দেয়া প্রয়োজন বোধ করেনি।

ইংরেজদের হাতে বলতে গেলে, ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ তুলে দিয়ে সে হুগলী গমন করে এবং হুগলী ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে। ক্লাইভ হুগলীতে তার নামে লিখিত পত্রে অনুরোধ জানায় যে, পূর্বের মতো সে যেন এখানেও বন্ধুত্বের পরিচয় দেয়। দু’দিন পর হুগলী আক্রমণ করে ক্লাইভ সহজেই তা হস্তগত করে। ইংরেজ কর্তৃক এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি অধিকৃত হওয়ার পর মানিকচাঁদ নবাবকে জানায় যে, ইংরেজদের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। হুগলী অধিকারের পর ইংরেজ সৈন্যগণ সমগ্র শহরে লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্ম ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বিরাট সন্ত্রাস সৃষ্টি করে।

হুগলীর পতন ও ধ্বংসলীলার সংবাদ পাওয়া মাত্র সিরাজদ্দৌলা বিরাট বাহিনীসহ ২০শে জানুয়ারী হুগলীর উপকন্ঠে হাজির হন। ইংরেজগণ তখন তড়িৎগতিতে হুগলী থেকে পলায়ক করে কোলকাতায় আশ্রয় গ্রহণ করে।

নবাব সিরাজদ্দৌলা একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্যে তাদেরকে বার বার অনুরোধ জানান। অনেক আলাপ আলোচনার পর ৯ই ফেব্রুয়ারী নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতিহাসে তা আলীনগরের সদ্ধি বলে খ্যান। এ সন্ধি অনুযায়ী ১৭১৭ সালের ফরমান মুতাবেক সকল গ্রাম ইংরেবদেরকে ফেরত দিতে হবে। তাদের পণ্যদ্রব্যাদি করমুক্ত হবে এবং তারা কোলকাতা অদিকতর সুরক্ষিত করতে পারবে। উপরন্তু সেখানে তারা একটা নিজস্ব টাকশাল নির্মাণ করতে পারবে।

সিরাজদ্দৌলাকে এ ধরনের অসম্মানজনক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। তার প্রথম কারণ হলো মানিক চাঁদের মতো তাঁর অতি নির্ভরযোগ্য লোকদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা। দ্বিতীয়তঃ আহমদ শাহ আবদালীর ভারত আক্রমণ এবং বাংলা অভিযানের সম্ভাবনা।

অপরদিকে ধূর্ত ক্লাইভের নিকটে এ সন্ধি ছিল একটা সাময়িক প্রয়োজন মাত্র। ইংরেজরা একই সাতে প্রয়োজনবোধ করেছিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার এবং ফরাসীদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করার। এতদুদ্দেশ্যে ক্লাইভ ওয়াটস এবং উমিচাঁদকে সিরাজদ্দৌলার কাছে পাঠিয়ে দেয় এ কথা বলার জন্যে যে, তারা ফরাসী অধিকৃত শহর চন্দরনগর অধিকার করতে চায় এবং তার জন্যে নবাবকে সাহায্য করতে হবে। এ ছিল তাদের এক বিরাট রণকৌশল (Strategy)। নবাব ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হন। তিনি তাঁর রাজ্যমদ্যে সর্বদা বিদেশী বণিকদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে আসছিলেন। এ নীতি কি করে ভংগ করতে পারেন? কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, ইংরেজদের সাহায্য না করলে তারা এটাকে তাদের প্রতি শত্রুতা এবং ফরাসীদের প্রতি মিত্রতা পোষণের অভিযোগ করবে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিরপেক্ষ নীতিতেই অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত করেন। তদনুযায়ী তিনি সেনাপতি নন্দনকুমারকে নির্দেশ দেন যে, ইংরেজরা যদি চন্দরনগর আক্রমণ করে তাহলে ফরাসীদের সাহায্য করতে হবে। অনুরূপভাবে ফরাসীরা যদি ইংরেজদেরকে আক্রমণ করে তাহলে ইংরেজদেরকে সাহায্য করতে হবে। ক্লাইভ দশ-বারো হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে নন্দকুমারকে হাত করে। সে একই পন্থায় নবাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকেও বশ করে। এভাবে ক্লাইভ চারদিকে উৎকোচ ও বিশ্বাসঘাতকতার এমন এক জাল বিস্তার করে যে, সিরাজদ্দৌলা কোন বিষয়েই দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারেন না। উপরন্তু হিন্দু শেঠ ও বেনিয়াগণ এবং তাঁর নিমকহারাম কর্মচারীগণ, যারা মনে প্রাণে মুসলিম শাসনের অবসান কামনা করে আসছিল, সিরাজদ্দৌলাকে হরহামেশা কুপরামর্শই দিতে থাকে। তারা বলে যে, ইংরেজদেরকে কিছুতেই রুষ্ট করা চলবে না। ওদিকে বাংলা-বিহার রক্ষার উদ্দেশ্যে বিরাট সেনাবাহিনী সেদিকে প্রেরণ করার কুপরামর্শ দেয়। এভাবে ইংরেজদের অগ্রগতির পথ সুগম করে দেয়া হয়।

ইতিমদ্যে ৫ই মার্চ ইংলন্ট থেকে সৈন্যসামন্তসহ একটি নতুন জাহাজ ‘কাম্বারল্যান্ড’ কোলকাতা এসে পৌঁছায়। ৮ই মার্চ ক্লাইভ চন্দরনগর অবরোধ করে। নবাব রায়দুর্লভ রাম এবং মীর জাফরের অধীনে একটি সেনাবাহিনী চন্দরনগর অভিমুখে প্রেরণ করেন। কিন্তু তাদের পৌঁছাবার পূর্বেই ফরাসীগণ আত্মসমর্পণ করে বসে। তারা চন্দরনগর ছেড়ে যেতে এবং বাংলায় অবস্থিত তাদের সকল কারখানা এডমিরাল ওয়াটসন এবং নবাবের হাতে তুলে দিয়ে যেতে রাজী হয়। অতঃপর বাংলার ভূখন্ড থেকে ফরাসীদের মূলোচ্ছেদ করার জন্যে ক্লাইভ নবাবের কাছে দাবী জানায়। উপরন্তু পাটনা পর্যন্ত ফরাসীদের পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে কোম্পানীর দু’হাজার সৈন্য স্থলপথে অগ্রসর হওয়ার জন্যে নবাবের অনুমতি প্রার্থনা করে। নবাব এ অন্যায় অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। এতে ফরাসীদের সাহায্য করা হয়েছে বলে নবাবের প্রতি অভিযোগ আরোপ করা হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল কমিটি ২৩শে এপ্রিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারা আরও অভিযোগ করে যে, নবাব আলীনগরের চুক্তি ভংগ করেছেন।

নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে পাকাপোক্ত ষড়যন্ত্র করে, সিরাজেরই তথাকথিত আপন লোক রায়দুর্লভ রাম, উমিচাদ ও জগৎশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দের সাথে। তাদেরই পরামর্শে নবাবের বখশী (বেতনদাতা কর্মচারী) মীর জাফরকে নবাবের স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করা হয়। ইংরেজ ও মীর জাফরের মধ্যেও সকল বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। শুধু উমিচাঁদ একটু অসুবিধার সৃষ্টি করে। সে নবাবের যাবতীয় ধন-সম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ দাবী করে বসে। অন্যথায় সকল ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয়। ক্লাইভ উমিচাঁদকে খুশী করার জন্যে ওয়াটসনের জাল স্বাক্ষরসহ এক দলিল তৈরী করে। মীর জাফরের সংগে সম্পাদিত চুক্তিতে সে আলীনগরের চুক্তির সকল শর্ত পুরাপুরি পালন করতে বাধ্য থাকবে বলে স্বীকৃত হয়। উপরন্তু সে স্বীকৃত হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানীকে দিতে হবে এক কোটি টাকা, ইউরোপীয়ানদেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানদেরকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনিয়ানদেরকে সাত লক্ষ টাকা। কোলকাতা এবং তার দক্ষিণে সমুদয় এলাকা চিরদিনের জন্যে কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে হবে।

সুচতুর ক্লাইভ নবাবের সন্দেহ নিরসনের জন্যে চন্দরনগর থেকে সৈন্য অপসারণ করে। মীর জাফর পরিকল্পিত বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্যে ক্লাইভকে অতিরিক্ত বায়ান্ন লক্ষ টানা পুরস্কার স্বরূপ দিতে সম্ত হয়।

আহমদ শাহ আবদালীর ভারত ত্যাগের পর সিরাজদ্দৌলা মীর জাফরকে একটি সেনাবাহিনীসহ পলাশী প্রান্তরে ইংরেজদের প্রতিহত করার আদেশ করেন যদি তারা ফরাসীদের অনুসরণে উত্তরদিকে অগ্রসর হয়। ক্লাইভ সিরাজদ্দৌলাকে জানায় যে, যেহেতু আলীনগর চুক্তি পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেহেতু ব্যাপারটির পর্যালোচনার জন্যে মীর জাফর, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ রাম, মীর মদন এবং মোহনলালকে দায়িত্ব দেয়া হোক। কিন্তু ওদিকে সংগে সংগে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে তার সৈন্য প্রেরণ করে। সিরাজ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সৈন্যদের সম্মুখীন হন। নবাবের সৈন্য পরিচালনার ভার ছিল মীর জাফর, রায়দুর্লভ রাম প্রভৃতির উপর। তারা চরম মুহুর্তে সৈন্য পরিচালনা থেকে বিরত থাকে। ফলে ক্লাইভ যুদ্ধ না করেও জয়লাভ করে। হতভাগ্য সিরাজ যুদ্ধের ময়ধান থেকে পলায়ন করেন, কিন্তু পথিমধ্যে মীর জাফরপুত্র মীরন তাকে হত্যা করে। এভাবে পলাশীর বেদনাদায়ক রাজনৈতিক নাটকের যবনিকাপাত হয়।

পলাশী যুদ্ধেল পটভূমির বিশদ বিবরণ থেকে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।

এক. বাংলার জমিদার প্রধান, ধনিক বণিক ও বেনিয়া গোষ্ঠী দেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে হলেও মুসলিম শাসনের অবসানকল্পে ইংরেজদের সংগে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

দুই. ইংরেজগণ হিন্দু প্রধানদের মনোভাব বুঝতে পেরে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যে হিন্দুদের পুরাপুরি ব্যবহার করে।

তিন. নবাবের সকল দায়িত্বপূর্ণ পদে যারা অধিষ্ঠিত ছিল তারা সকলেই ছিল হিন্দু এবং তাদের উপরই তাঁকে পুরাপুরি নির্ভর করতে হতো। কিন্তু যাদের উপরে তিনি নির্ভর করতেন তারাই তাঁর পতনের জন্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।

চার. পলাশীর যুদ্ধকে যুদ্ধ বলা যায় না। এ ছিল যুদ্ধের প্রহসন। ইংরেজদের চেয়ে নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক গুণ বেশী। নবাবের সৈন্যনাবাহিনী যুদ্ধ করলে ইংরেজ সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো এবং ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। অথবা সিরাজদ্দৌলা যদি স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, তাহলেও তাঁকে পরাজয় বরণ করতে হতো না।

পাঁচ. যাদেরকে সিরাজ দেশপ্রেমিক ও তাঁর শুভাকাংখী মনে করেছিলেন –তারা যে দেশের স্বাধীনতা বিক্রয় করে তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করবে, একথা বুঝতে না পারা তাঁর মারাত্মক ভুল হয়েছে। অথবা বুঝতে পেরেও তাঁর করার কিছুই ছিল না। তাঁর এবং তাঁর পূর্ববর্তী শাসকদের দ্বারা দুধ-কলা দিয়ে পোষিত বর্ধিত ও পালিত কালসর্প অবশেসে তাঁকেই দংশন করে জীবনের লীলা সাংগ করলো।

পলাশীর মর্মন্তুদ নাটকের পর

পলাশী প্রান্তরে সিরাজদ্দৌলার পরাজয় শুধুমাত্র এক ব্যক্তির পরাজয় নয়। বাংলা-বিহার তথা গোটা ভারত উপমহাদেশের পরাজয়। এ পরাজয় দ্বারা উন্মোচন করে দেয় ভারতের উপরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের। শুধু তাই নয়। এশিয়ার ইউরোপের কাছে, প্রাচ্যের প্রতীচ্যের কাছে। পরবর্তী ধারাবাহিক ঘটনাপুঞ্জ এ কথারই সাক্ষ্য দান করে। নিদেনপক্ষে ভারত উপমহাদেশের উপরে ব্রিটিশ আধিপত্য ও প্রভুত্ব চলেছিল একশ’ নব্বই বছর ধরে।

পলাশীর এ বেদনাদায়ক রাজনৈতিক নাটকের পরিচালক কে বা কারা ছিল, বাংলা-বিহার তথা ভারত উপমহাদেশের গলায় দু’শ বছরের জন্যে পরাধীনতার শৃংখল কে বা কারা পরিয়ে দিয়েছেন, ইতিহাস তাদেরকে খুঁজে বের করতে ভোলেনি। অতীব ঘৃণিত ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, উৎকোচের মাধ্যমে মস্তক ক্রয় এবং কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিশোধ গ্রহণের হিংস্র নীতি অবলম্বনে, যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র পরিচালনা না করেই, ক্লাইভ ও তার গোত্র-গোষ্ঠী সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত ও নিহত করে এ দেশে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৃতকার্য হয়েছিল।

সিরাজদ্দৌলার পতনের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। ১৭৫৭ সালের পর যাদের বিজয় নিনাদ প্রায় দু’শ বছর পর্যন্ত ভারত তথা এশিয়ার বিশাল ভূখন্ডে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এবং এ বিজয় লাভে সহায়ক শক্তি হিসাবে যাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তাদেরই মনোপৃত মনগড়া ইতিহাসে সিরাজদ্দৌলাকেই দায়ী করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার ইতিহাস কি তাই?

বিরাট মোগল সাম্রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হ’য়ে পড়েছিল –ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্বাদীন আধা স্বাধীন শাসক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। মারাঠাশক্তি উত্তর ও মধ্য ভারতকে গ্রাস করার পরিকল্পনা নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু আহমদ শাহ আবদালী পানি পথের তৃতীয় যুদ্ধে (১৭৬১) তাদের শক্তি চূর্ণ বিচূর্ণ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। বাদশাহ আকবর ভারতের দুর্ধর্ষ মুসলিম সামরিক শক্তির বিনাশ সাধন করেছিলেন। বিকল্প কোন সামরিক শক্তি গঠিত হ’তে পারেনি। নৌশক্তি বলতে মুসলমানদের কিছুই ছিলনা বল্লেও চলে। ইংরেজ বণিকগণ এদেশে এসেছিল দ্বিবিধ উদ্দেশ্য নিয়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে স্থানে স্থানে দুর্গ নির্মাণ, নৌবহর-স্থাপন, স্বদেশ থেকে সৈন্যবাহিনী আমদানি প্রভৃতিরক দ্বারা ক্রমশঃ শক্তিশালী হ’য়ে উঠেছিল। তাদের এ উদ্দেশ্য সাধনে সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছিল বাংলার দেশপ্রেমিক (?) বাংগালী হিন্দু ধনিক বণিক শ্রেণী।

বাংলায় মুর্শিদকুলী খাঁর সময় থেকে সকল প্রশাসনক্ষেত্র থেকে মুসলমানদেরকে অপসারিত করে তথায় বাংলার হিন্দুদের জন্যে স্থান করে দেয়া হয়েছিল। এ ছিল অতীব স্বদেশপ্রীতি ও একদেশদর্শী উদারতার ফল। যদিও পরবর্তীকালে তার মাশুল দিতে হয়েছে কড়ায় গণ্ডায়। আলীবর্দীর সময় থেকে তারাই হ’য়ে পড়ে রাজ্যের সর্বেসর্বা। বাংলার মসনদ লাভ ছিল তাদেরই কৃপার উপরে একান্ত নির্ভরশীল। তারা ছিল বাংলার রাজস্রষ্টা (King-Makers)।

সিরাজদ্দীলা নবাব আলীবর্দীর স্থলাভিষিক্ত মনোনীত হওয়ার সময় জগৎশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দ, মানিক চাঁদ, দুর্লভ রাম প্রভৃতি এমন শক্তিশালী ছিল যে, তাদের বিরাগভাজন হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা সিরাজের পক্ষে ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এসব শক্তিশালী রাজকর্মচারীবৃন্দ রাজকোষ দ্বারা লালিত-পালিত হওয়া সত্ত্বেও প্রভুর প্রতি কণামাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মনোভাব পোষণ করেনি। তারা সর্বধান সিরাজকে কুপরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরঞ্চ ভিতরে ভিতরে কোম্পানীর সাথে একাত্মতাই পোষণ করেছে। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সিরাজের পতনের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে এদেশে ইংরেজ শাসন পত্তন করতে।

সিরাজদ্দৌলা শুধু একজন দেশপ্রেমিকই ছিলেন না। তিনি একজন অত্যন্ত সাহসী বীরপুরুষও ছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি যেরূপ ক্ষিপ্রতার সাথে ঘেসেটি বেগম ও শওকত জং-এর বিদ্রোহ দমন করেন, তাতে তাঁর সৎসাহস ও বিচক্ষণতারই পরিচয় পাওয়া যায়। কয়েকবার ইংরেজদের সাথে সংঘর্ষেও তাঁর বিজয় সূচিত হয়। আলম চাঁদ, জগৎশেঠ প্রভৃতি হিন্দু প্রধানগণ যদি চরম বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকা পালন না করতো, তাহলে বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। মীর জাফরের ভূমিকাও কম নিন্দনীয় নয়। কিন্তু পলাশী নাটকের সবচেয়ে ঘৃণিত ও অভিশপ্ত ব্যক্তি করা হয়েছে তাকে। কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়মের যুদ্ধে ইংরেজদেরকে শোষনীয়ভাবে পরাজিত করার পর নবাব সিরাজদ্দৌলা কোলকাতা শাসনের ভার অর্পণ করেন মানিক চাঁদের উপর। মানিক চাঁদ ইংরেজদেরকে কোলকাতা ও হুগলীতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্তা হয় রায় দুর্লভ রাম, উমিচাঁদ ও জগৎশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দের পরামর্শে। এ কাজের জন্যে মীর জাফর যে দোষী ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ হীন ষড়যন্ত্রে তার অংশ কতটুকুই বা ছিল? বড়োজোর এক আনা। কিন্তু তার দুর্ভাগ্যের পরিহাসই বলতে হবে যে, ইতিহাসে তার চেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি আর কেউ নেই। তাই সকল সময়ে বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তির নামের পূর্বে ‘মীর জাফর’ শব্দটি বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়।

দেশপ্রেমিক সিরাজদ্দৌলা বাংলা বিহারের স্বাদীনতা বিদেশী শক্তির হস্তে বিক্রয় না করার জন্যে মীর জাফরসহ হিন্দু প্রধানগণের কাছে বার বার আকুল আবেদন জানান। কিন্তু তাঁর সকল নিবেদন আবেদন অরণ্যে-রোদনে পরিণত হয়।

বিশ্বাসঘাতকের দল তাদের বহুদিনের পুঞ্চিভূত আক্রোশের প্রতিশোধ গ্রহণ করে দেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে। এতেও তাদের প্রতিহিংসা পুরাপুরি চরিতার্থ হয়নি। সিরাজদ্দৌলাকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করেই তারা তাদের প্রতিহিংসার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি নির্বাপিত করে।

সিরাজদ্দৌলাকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে অপসারিত করে অন্য কাউকে বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত করা –ইংরেজদের উদ্দেশ্যে ছিল না। তারা চেয়েছিল এদেমে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। মীর জাফর তাদের ক্রমবর্ধমান অন্যায় দাবী মিটাতে সক্ষম হয়নি বলে তাকেও অবশেষে সরে দাঁড়াতে হয়। হিন্দু প্রধানদের নিকটে শুধু সিরাজদ্দৌলাই অপ্রিয় ছিলেন না। যদি তাই হতো, তাহলে তাঁর স্থলে কাসিক তাদের অপ্রিয় হতো না। তাদের একান্ত কামনার বস্তু ছিল মুসলিম শাসনের অবসান। তাই নিজের দেশের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে মুসলিম শাসনের পরিবর্তে বিদেশী শাসনের শৃংখল স্বেচ্ছায় গলায় পরিধান করতে তারা ইতস্ততঃ করেনি। মীর জাফরের পর মীর কাসিক আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন করতে এবং তার সংগে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তিনিও ইংরেজদের অদম্য ক্ষুধার খোরাক যোগাতে পারেননি বলে বাংলার রাজনৈতিক অংগন থেকে তাঁকেও বিদায় নিতে হয়। (হিল, যদুনাথ সরকার; ম্যালিসন, ডঃ মোহর আলী)

বাংলা বিহার তথা ভারতে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দু’শ’ বছরে দেশের জনগণের ভাগ্যে যা হবার তাই হয়েছে। অবশ্য কিছু বৈষয়িক মংগল সাধিত হলেও পরাধীনতার অভিশাপ, লাঞ্ছনা-অপমান জাতিকে জর্জরিত করে মুসলমানদের উপরে যে শোষণ নিষ্পেষণ চলেছিল তার নজির ইতিহাসে বিরল। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, দারিদ্র, দেশকে গ্রাস করে ফেলে। এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হয়েছে পরবর্তী অধ্যায়ে।

সিরাজদ্দৌলার পতনের পর বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা

পলাশী ও বকসারের যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়। ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লির নামমাত্র মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী মঞ্জুর করার পর এ অঞ্চলের উপরে তাদের আইনগত অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলার যে চিত্র ফুটে উঠে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও নৈরাশ্যজনক। পলাশী যুদ্ধের পর মীর জাফর প্রভৃতি নামমাত্র নবাব থাকলেও সামরিক শক্তির নিয়স্তা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। ১৭৬৫ সালের পর দেশের অর্থনীতিও সম্পূর্ণ তাদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। ফলে বাংলার মুসলিম সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছিল সর্বাপেক্ষা ও সর্বদিক দিয়ে।

সিরাজদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে উমিচাঁদ-মীর জাফরের সাথে কোম্পানীর যে ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার অর্থনৈতিক দাবী পূরণ করতে দিয়ে বাংলার রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। পূর্বে বলা হয়েছৈ যে, এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানীকে ভূয়া ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হয় একশ’ লক্ষ টাকা। ইউরোপীয়দেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনীয়দেরকে সাত লক্ষ টাকা। বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পূর্বেই ক্লাইভকে দিতে হয় বায়ান্ন লক্ষ টাকা (Fall of Sirajuddowla-Dr. Mohar Ali)।

মীর জাফরের ভূয়া নবাব হিসাবে বাংলার মসনদে আরোহণ করার পর কোম্পানীর দাবী উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। মীর জাফর, তাদেরকে প্রীত ও সন্তুষ্ট রাখতে বাধ্য হয়। রাজস্ব বিভাগ কোম্পানীর পরিচালনাধীন হওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে হিন্দু ও ইংরেজ আদায়কারীগন অতিমাত্রায় শোষণ নিষ্পেষণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে কোম্পানীর রাজকোষে পূর্ণ করতে থাকে। ইতিপূর্বে প্রজাদের নিকট থেকে আদায়কৃত সকল অর্থ দেশের জনগণের মধ্যে তাদেরই জন্যে ব্যয়িত হতো। তখন থেকে ইংল্যান্ডের ব্যাংকে ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলিতে স্থানান্তরিক হতে থাকে।

১৭৭৬ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক প্রাণত্যাগ করে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের বেলায় কোন প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শিত হয়নি। দুর্ভিক্ষ যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন পূর্বের বৎসরের তুলনায় ছয় লক্ষ টাকা অধিক রাজস্ব আদায় করা হয়, বাংলা ও বিহার থেকে পরবর্তী বছর অতিরিক্ত চৌদ্দ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়। মানব সন্তানেরা যখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও মৃত্যু যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল, তখন তাদের রক্ত শোষণ করে পৈশাচিক উল্লাসে নৃত্য করছিল ইংরেজ ও তাদের রাজস্ব আদায়কারীগণ। এসব রাজস্ব আদায়কারী ছিল কোলকাতার হিন্দু বেনিয়াগণ, সুদী মহাজন ও ব্যবসায়ীগণ। মানবতার প্রতি এর চেয়ে অধিক নির্মমতা ও পৈশাচিকতা আর কি হতে পারে? (Baden Power-Land system etc. –British Policy & the Muslim in Bengal-A.R Mallick)।

আর এক ঘৃণিত পন্থায় এদেশের অর্থসম্পদ লুণ্ঠন করা হতো। কোম্পানী এবং তাদের কর্মচারীগণ যাকে খুশী তাকে নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করতে পারতো এবং যাকে খুশী তাদে ক্ষমতাচ্যুত করতো। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত মাত্র আট-ন’ বছরে এ ব্যাপারে কোম্পানী ও তার দেশী-বিদেশী কর্মচারীদের পকেটে যায় কমপক্ষে ৬২,৬১,১৬৫ পাউন্ড। প্রত্যেক নবাব কোম্পানীকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দানের পরও বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতো।

আবদুল মওদুদ বলেনঃ

পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী দল কী মহামূল্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজদন্ড এ দেশবাসীর জন্য ক্রয় করেছিল, তার সঠিক খতিয়ান আজও নির্ণীত হয়নি। হওয়া সম্ভব নয়। কারণ –কেবল লিখিত বিবরণ থেকে তার কিছুটা পরিমাণ জ্ঞাত হওয়া সম্ভব। কিন্তু হিসাবের বাইরে যে বিপুল অর্থ সাগর পারে চালান হয়ে গেছে, কিভাবে তার পরিমাপ করা যাবে?

ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হলো –সুপরিকল্পিত শোষণের মর্মভেদী ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামোটি হিসাব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংলন্ডে চালান গেছে প্রায় তিন কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা। কিন্তু ১৯০০ সালের মূল্যমানের তিনশো কোটি টাকা (I.O Miller, quoted by Misra, p.15)।

মুর্শিদাবাদের খাযাঞ্চিখানা থেকে পাওয়া গেল পনর লক্ষ পাউন্ডের টাকা, অবশ্য বহুমূল্য মণিমাণিক্য দিয়ে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশ স্থলসেনা ও নৌসেনা পেলো চার লক্ষ পাউন্ড; সিলেক্ট কমিটির ছয়জন সদস্য পেলেন নয় লক্ষ পাউন্ড; কাউন্সিল মেম্বররা পেলেন প্রত্যেকে পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার পাউন্ড; আর খোদ ক্লাইভ পেলেন দু’লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড, তাছাড়া ত্রিশ হাজার পাউন্ড বার্ষিক আয়ের জমিদারীসহ বাহশাহ প্রদত্ত উপাধি ‘সাবাত জং’। অবশ্য পলাশী বিজয়ী ক্লাইভের ভাষায় ‘তিনি এতো সংসম দেখিয়ে নিজেই আশ্চর্য’। মীর কাসিম দিয়েছেন নগদ দু’লক্ষ পাউন্ড কাউন্সিলের সাহায্যের জন্যে। মীর জাফর নন্দন নজমদ্দৌলা দিয়েছেন এক লক্ষ উনচল্লিশ হাজার পাউন্ড। এছাড়া সাধারণ সৈনিক, কুঠিয়াল ইংরেজ কত লক্ষ মুদ্রা আত্মসাৎ করেছে, বলা দুঃসাধ্য। বিখ্যাত জরিপবিদ জেমস রেনেল ১৭৬৪ সালে বাইশ বছর বয়সে বার্ষিক হাজার পাউন্ডে নিযুক্ত হন, এবং ১৭৭৭ সালে বিলাত ফিরে যান ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে। এ থেকেই অনুমেয়, কোম্পানীর কর্মচারীরা কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতেন। তারা এ দেশে কোম্পানী রাজ্যের প্রতিভূ হিসেবে এবং চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর হোমে প্রত্যাগত হয়ে এরূপ রাজসিক হালে বাস করতেন যে, তাঁরা ‘ইন্ডিয়ান নেবাবস’ রূপে আখ্যাত হতেন।

…ক্লাইভ নিজেই স্বীকর করেছেন, “আমি কেবল স্বীকার করতে পারি, এমন অরাজকতা বিশৃংখলা, উৎকোচ গ্রহণ, দুর্নীতি ও বলপূর্বক ধনাপহরণের পাশব চিত্র বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্ট হয়নি”। অথচ নির্লজ্জ ক্লাইভই এ শোষণ যজ্ঞের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদুদ, পৃঃ ৬০-৬২)।

Page 6 of 31
Prev1...567...31Next

© Bangladesh Jamaat-e-Islami

  • আমাদের সম্পর্কে
  • প্রাইভেসি পলিসি
  • যোগাযোগ
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস

@BJI Dhaka City South