ষষ্ঠদশ অধ্যায়
উপসংহার
এ ইতিহাসের শেষ ভাগে সংক্ষেপে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসও লিখতে হয়েছে। কারণ এ আন্দোলনের সাথে বাংলার মুসলমান ওতপ্রোত সম্পৃক্ত ছিলেন। তদুপরি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব তথা পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করার মর্যাদা লাভ করেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম দরদী কৃতী সন্তান ও বাংলার প্রধানমন্ত্রী মওলভী আবুল কাসেম ফজলুল হক (শেরে বাংলা)। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ থাকলেও এ আন্দোলনে বাংলার মুসলমানদের অবদান ছিল সর্বাধিক।
উনিশ শ’পাঁচ সালের ২০শে জুলাই বংগবিভাগের ঘোষনা এবং ১৬ই অক্টোবর থেকে তা কার্যকর করণ বাংলা এবং সমগ্র ভারতের হিন্দুজাতিকে অতিশয় ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং বংগভংগ রদের তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে এব বংগভংগ রদের তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে এক নবচেতনার জোয়ার সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র মুসলিম জাতিসত্তার প্রেরণা জাগ্রত করে। এর ফলে ১৯০৬ সালে ঢাকায় উপমহাদেশের মুসলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এ সালের ১লা অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ৩৬ জন মুসলমানের একটি প্রতিনিধি দল শিমলার বড়োলাটের সাথে সাক্ষাৎ ক’রে –মুসলমানগণ একটি স্বতন্ত্র জাতি বিধায় তাদের জন্য পৃথক নির্বাচন প্রথা প্রচলনের দাবী জানালে তা মেনে নেয়া হয়। ১৯০৯ সালে সম্পাদিত মলেমিন্টু রিফরমসে পৃথক নির্বাচন প্রথার প্রতি স্বীকৃতি দান করা হয়। ফলে এ এক সাংবিদানিক ডকুমেন্টে পরিণত হয়।
দেশ বিভাগের পর কোন কোন মহল থেকে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, পাকিস্তান দাবীর পশ্চাতে কি শুদু সাময়িক ভাবাবেগ সক্রিয় ছিল, না এর কারণ ছিল শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। অথবা কংগ্রেসের বৈরিসুলভ আচরণের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মুসলমানগণ পাকিস্তান দাবী করেন?
এর কোন একটিও পাকিস্তান আন্দোলনের মূল কারণ ছিলনা। ভাবাবেগ ত অবশ্যই চিল। এ ভাবাবেগই মানুষকে লক্ষ্যে পৌঁছার জীবন বিলিয়ে দিতে উদ্ধুদ্ধ করে। কিন্তু এ ভাবাবেগ কোন সাময়িক ও অর্থহীন ভাবাবেগ ছিলনা। নিছক ভাবাবেগ এতোবড়ো ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটাতে পারেনা। গান্ধী, অনেক হিন্দুনেতা ও পত্রপত্রিকা এ ধরনের মন্তব্য করেছেন যে মুসলমানদের এ সাময়িক ভাবাবেগ প্রশমিত হলে পুনরায় তারা অখন্ড ভারতভুক্ত হয়ে যাবেন। চার যুগের অধিক কাল অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন পাকিস্তানকামী মুসলমানদের ভাবাবেগ কণামাত্র প্রশমিত হয়নি, তখন একথা সত্য যে তাদের ভাবাবেগ কোন সাময়িক বস্তু ছিলনা। এ ভাবাবেগ সৃষ্টির পেচনে একটা মহৎ উদ্দেশ্য ছিল।
যে মহান উদ্দেশ্যে পাকিস্তান দাবী ও আন্দোলন করা হয়, কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মার্চ ১৯৪০ এ অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেনঃ
It is extremely dofficult why our Hidnu friends fail to understand the real nature of Islam and Hinduism. They are not religious in stricy sence of the word, but are, in fact, different and distinct social orders. It is a dreame that the Hindus and Muslims can ever evolve a common nationality, and this misconception of one Indian nation has gone far beyond the limits, and will lead India to destruction, If we fail to revise our nations in time. The Hindus and Muslims belong to two dofferent religious philosophies, social customs and Iiterature. They neither intermarry nor interdine together, and indeed they belong to two different civilizations. Which are based mainly on conflicting ideas and conceptions. Their aspect on life and of life are different. It is puite clear that Hindus and Musslamans derive their aspirations from diffirent and they have different espisodes. Very often the hero of one in a foe of the other and like wise their victories and defeats overlap. To yoke together two such nations under a singh atate, one as a numerical minority and the other as a majority, must lead to growing discontent and the final destruction of any fabric that may be built up for the government of such a state –(Ideological Foundations of Pakistan by Dr. Waheed Qurashy,pp.96-97)।
কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ভাষণে এ সত্যটিই তুলে ধরেছেন যে, হিন্দু ও মুসলমান বহু দিক দিয়ে দুটি পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতি এবং তাদেরকে একত্রে বেঁধে দিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব ও অবাস্তব। এ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই ভারত বিভক্ত হয়েছে।
কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান দুটি সম্পূর্ণ পৃথক ও বিপরীতমুখী জাতিসত্তা –এ তত্ত্ব কি জিন্নাহ বা মুসলমানদের কোন নতুন আবিস্কার? এর সঠিক জবাবের উপরই এ কথা নির্ভর করবে যে পাকিস্তান কোন ভাবাবেগ ও উত্তেজনা বশে অথবা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে দাবী করা হয়েছিল।
ইসলামী জীবনব্যবস্থা
উপরোক্ত প্রশ্নের সঠিক জবাব পেতে হলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের প্রয়োজন। আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রসূলগণ ইসলামের যে সঠিক ধারণা পেশ করেছেন, তা এই যে, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের ন্যায় শুধুমাত্র কতিপয় আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়। ইসলাম হচ্ছে আল্রাহর নাযিল করা মহাগ্রন্থ আল কুরআন এবং নবী মুহাম্মদ (সা) এর সুন্নাতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পূর্ণাংগ জীবন বিধান।
ধর্ম সম্পর্কে যে ধারণা বর্তমানকালে দুনিয়ায় প্রচলিত সেদিক দিয়ে ইসলাম একটি ধর্ম থেকে অনেক বেশী কিছু। এ নিছক স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে সম্পর্কের নাম নয়। ইসলামের ধর্মীয় ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। ঈমান আকীদাহ থেকে শুরু করে এবাদত এবং জীবনের সকল দিক ও বিভাগের উপর এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। ইসলামে নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতি আছে, ইতিহাস ঐতিহ্য আছে, নিজস্ব নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে। আছে আইন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, পারিবারিক ও শিক্ষাব্যবস্থা, আছে নিজস্ব যুদ্দ ও সন্ধিনীতি এবং বৈদেশিক ব্যবস্থা। একটি বৃক্ষের মূল, শাখাপ্রশাখা, পত্র পল্লব ও ফুলফলের মধ্যে যেমন অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক, তেমনি এসব ব্যবস্থাও পরস্পর অবিচ্ছিন্ন ও ওতপ্রোত জড়িত।
প্রকৃত পক্ষে ইসলাম মানব জাতির জন্যে দুনিয়ায় সার্থক জীবন যাপন করার এক পূর্ণাংগ জীবন বিধান। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে সার্থক জীবনযাপনের পদ্ধতি ইসলাম শিক্ষা দেয়। এ কারণে ইসলামের ধর্মীয় ধারণা অন্যান্য ধর্মের ধারণা থেকে একেবারে পৃথক।
ইসলামের ঐতিহাসিক ধারণা অনুযায়ী এ সত্য দ্বীন (ইসলাম) সর্বপ্রথম হযরত আদম (আ) এর উপর আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নাযিল হয়। আর হযরত আদম (আ) ছিলেন প্রথম মানুষ। তাঁর থেকেই মানব বংশ দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন থেকেই এ দ্বীনে হক –ইসলাম দুনিয়ায় প্রচলিত। তাঁর পর যুগে যুগে, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে নবী-রসূল আগমন করে দ্বীনে হকের দাওয়াত পেশ করতে থাকেন। সর্বশেষে নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা) দ্বারা ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করে।
ইসলামে জাতীয়তার ধারণা
এ দ্বীন ও ব্যবস্থাকে যারা মনেপ্রাণে মেনে নেয় তাদেরকে ‘মুমেন’ বলা হয়, আর যারা একে প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে ‘কাফের’ বলা হয়। মুমেন ও কাফের উভয়ে কখনো এক হতে পারেনা। প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হযরত আদম (আ) কে দুনিয়ায় পাঠাবার সময় আল্লাহতায়ালা যে নির্দেশ দেন তা এইঃ
“আমি বল্লাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। তারপর আমার নিকথ থেকে যে জীবন বিধান তোমাদের নিকট পৌঁছাবে, যারা আমার সে বিধান মেনে চলবে তাদের জন্যে চিন্তাভাবনার কোন কারণ থাকবেনা। আর যারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে এবং আমার বাণী ও আদেশ-নিষেধ প্রত্যাখ্যান করবে তারা হবে নিশ্চিতরূপে জাহান্নামী এবং সেখানে তারা থাকবে চিরকাল (সূরা বাকারাহঃ ৩৮-৩৯)।
কুরআন পাকের উপরোক্ত আয়াত থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, হেদায়েতে ইলাহী মানুষকে দুটি দলে বা দুটি জাতিতে বিভক্ত করে দিয়েছে –একটি মুমেন, অন্যটি কাফের। এ বিভক্তি দুনিয়ায় মানব জীবনের প্রথম দিনেই করে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক নবী তাঁর যুদে এ বিভক্তি অক্ষুন্ণ রাখেন। হযরত শুয়াইব (আ) এ দুটি দলকে দুটি পৃথক মিল্লাত বা জাতি বলে ব্যাখ্যা করেন। যেমনঃ ‘তাদের সরদার মাতব্বরগণ যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের গর্বে গর্বিত ছিল তাকে বল্লো, হে শুয়াইব! আমরা তোমাকে ও তোমার প্রতি ঈমানদার লোকদেরকে এ জনপদ থেকে বের করে দেব –অন্যথায় তোমাদেরকে আমাদের মিল্লাতে ফিরে আসতে হবে। শুয়াইব জবাব দিল, আমাদেরকে কি জোর করে ফিরিয়ে আনাহবে -আমরা যদি রাজী নাও হই?
আমরা খোদার প্রতি মিথ্যা আরোপকারী হবো যদি তোমাদের মিল্লাতে ফিরে আসি যখন আল্লাহ এর থেকে আমাদেরকে মুক্তি দান করেছেন।
-(সূরা আ’রাফ: ৮৯-৯০)
এ আয়াত থেকেও এ কথা সুস্পষ্ট যে, হযরত শুয়াইব (আ) এর যুগেও মুসলমানদের মিল্লাত পৃথক ছিল এবং কাফেরদের মিল্লাত পৃতক। এই বিভক্তিকরণ এবং এই পরিভাষা উম্মতে মুহাম্মদীতেও প্রচলিত আছে এবং আজ পর্যন্ত তা ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইসলামে জাতীয়তার ধারণা বিশ্বজনীন। যে কোন দেশ ও জাতির কোন ব্যক্তি কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করার পর দ্বীন ইসলামে প্রবেশ করে এবং ইসলামী জাতীয়তার সমান অংশীদার হয়ে যায়। ইসলামে ঈমান আকীদার প্রতি স্বীকৃতিই জাতীয়তা অর্জনের জন্য যথেষ্ট। জাতীয়তা লাভের ব্যাপারে দুনিয়ার অন্যান্য জাতির পন্থাপদ্ধতি থেকে ইসলামের পন্থাপদ্ধতি ভিন্নতর। ইহুদী জাতীয়তা লাভের জন্য ইহুদী আকীদার সাথে ইহুদী বংশোদ্ভূত হওয়া জরুরী। হিন্দু জাতীয়তা লাভের জন্য হ্নিদু পূজাঅর্চনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংমগ্রহণই যথেষ্ট।
স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থা
ইসলামের সর্বব্যাপী জীবন বিধান ও স্বতন্ত্র জাতীয়তার যুক্তিসংগত দাবী এই যে, এর জন্য একটা স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হতে হবে –যেখানে ইসলামের আদেশ নিষেধগুলো মেনে চলা যাবে। কিন্তু পরাধীনতার জীবনযাপন করতে হলে সেখানে অধিকাংশ হুকুম পালন সম্ভব নয়।
তের বছর মক্কায় মুশরিকদের নিয়ন্ত্রিত সমাজে জীবনযাপন করার পর নবী আকরাম (সা) যখন মদীনার অনুকূল পরিবেশে পৌঁছেন, তখন সেখানে তিনি ইসলামী সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র কায়েম করেন। তিনি ছিলেন এ রাষ্ট্রের পরিচালক। সেখানে তিনি পরিপূর্ণ রূপে ইসলামী বিধান জারী করেন। তারপর আল্লাহতায়ালা নিম্নের আয়াত নাযিল করেনঃ
‘তোমাদের জন্যে দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম’।
দ্বীন তার পরিপূর্ণতা লাভ করলো তখন যখন তার পরিপূর্ণতা, বাস্তবায়ন ও প্রচার প্রসারের জন্য একটা পৃতক আবাসভূমি পাওয়া গেল এবং একটা স্বাধীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো।
‘পাকিস্তান’ শব্দটি কোন ভৌগলিক অঞ্চল অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, এ ব্যবহৃত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র অর্থে। এই অর্থেই আল্লামা শাব্বীর আহমদ ওসমানী মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রকে ‘প্রথম পাকিস্তান’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেনঃ
আল্লাহতায়ালা কুদরাতের হস্ত অবশেষে রসূল মকবুল (সা) এর ঐতিহাসিক হিজরতের মাধ্যমে মদীনায় এক ধরনের ‘পাকিস্তান’ কায়েম করে দেয়।
(খুৎবায়ে ওসমানী, আল্লামা শাব্বীর আহমদ ওসমানী পৃঃ ১৪০; তারিখে নযরিয়ায়ে পাকিস্তান, অধ্যাপক মুহাম্মদ সালিম, পৃ: ৩১)।
লাহোর প্রস্তাবে যে একটি স্বাধীন আবাসভূমির দাবী করা হয়েছিল তার নাম পাকিস্তান বলা হয়নি। এ নামটি চৌদুরী রহমত আলী পছন্দ করেন। তিনি সর্বপ্রথম ১৯১৫ সালে ‘বজমে শিবরী’ অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন –উত্তর ভারত ‘মুসলিম’ এবং একে আমরা ‘মুসলিম’ রাখব। শুধু তাই নয়। একে আমরা একটি মুসলিম রাষ্ট্র বানাবো। এ আমরা তখনই করতে পারব যখন আমরা এবং আমাদের এ উত্তরাঞ্চল ভারতীয় হওয়া থেকে বিরত থাকব। এ হচ্ছে তার পূর্বশর্ত। যতো শীগগির আমরা ভারতীয়তাবাদ পরিহার করব ততোই ভালো আমাদের এবং ইসলামের জন্য (Chudhury Rahmat Ali: p.172; I.H. Qureshi: The Struggle for Pakistan. Pp.115-116)।
চৌদুরী রহমত আলীও প্রথমে পাকিস্তান নাম ব্যবহার করেননি। তিনি মুসলিম বা ইসলামী রাষ্ট্রের কথাই বলেছেন।
ইতিহাসে আলোচনা করলে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয় যে, পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল হিজরী ৯৩, রজব মাসে (৭১২ খৃঃ) যখন ইমাদুদ্দীন মুহাম্মদ বিন কাসিম, সতেরো বছরের সিপাহসালার দেবল বন্দরে (বর্তমান করাচী) অবতরণ করেন, রাজা দাহিরের কারাগার থেকে মজলুম মুসলমান নারীশিশুদের মুক্ত করেন এবং সেখানে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। কায়েদে আজম বলেন, পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয় তখন, যখন প্রথম মুসলমান সিন্ধুর মাটিতে পদার্পণ করেন যা ছিল ভারতে ইসলামের প্রবেশদ্বার।
দেবলের পর নিরন (বর্তমান হায়দারাবাদ) এবং তারপর সেহওয়ান ইসলামী পতাকার কাছে মাথানত করে। ১০ই রমজান রাওর দুর্গ দখল করা হয় এবং যুদ্ধে রাজা দাহির পরাজিত ও নিহত হন। পরে ব্রাহ্মণাবাদ (বর্তমান সংঘর) এবংআলওয়ার বিজিত হয়। ৯৬ হিজরী সনে মুলতান আত্মসমর্পণ করে এবং উত্তর ভারত স্বেচ্ছায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের বশ্যতা স্বীকার প্রস্তুত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুহাম্মদ বিন কাসিককে দামেশকে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি তাঁর অধীন অঞ্চগুলোতে সত্যিকার ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। এ ব্যব্সথা হ্নিদু এবং বৌদ্ধদেরকে এতোটা মুগ্ধ করে যে, তাদের বিরাট সংখ্যক লোক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে (Justice Syed Shameem Husain Kadri: Creation of Pakistan, pp-1-2)।
ইসলামের সহজাত বৈশিষ্ট্য
ইসলামের সহজাত বৈশিষ্ট্য এই যে মুসলমান এক ও লা শারীক আল্লাহ ব্যতীত আর কারো বশ্যতা, প্রভুত্ত কর্তৃত্ব, আইন শাসন মানতে পারেনা। ইসলাম একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান এবং এর মূলনীতি মানব জীবনের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক দিক পরিবেষ্টন করে রাখে। রাষ্ট্র ও ধর্মকে একে অপর থেকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কালেমায়ে তাইয়েবার মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও রসূলের (সা) নেতৃত্ব মেনে নেয়া হয়েছে।
উপমহাদেশে ইসলামী আইন-শাসন প্রতিষ্ঠা
মুহাম্মদ বিন কামিস শুধু এ উপমহাদেশে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না। বরঞ্চ তিনি ছিলেন ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির অগ্রদূত। যে সভ্যতা-সংস্কৃতির বৃক্ষ তিনি রোপন করেন তা কালক্রমে বর্ধিত ও বিকশিত হতে থাকে এবং সমগ্র ভারত উপমহাদেশে ইসলামী পতাকা উড্ডীয়মান হয়। মুসলমান বিজয়ীর বেশে ভারতে আগমন করতে থাকেন। তাঁদের সাথে আসেন সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী। এসব শাসকদের মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে অনেকেই ভালো মুসলমান ছিলেন না, এবং অনেক দরবেশ প্রকৃতির লোকও ছিলেন। তবে মুসলিম শাসন আমলে আগাগোড়া দেশে ইসলামী আইন প্রচলিত ছিল।
কিন্তু মুসলিম শাসনের অবসানের পর ইসলামী আইনের স্থলে প্রবর্তিত হলো পাশ্চাত্যের মানব রচিত আইন; ইন্ডিয়ান সিভিল এন্ড ক্রিমিনাল কোডস অব প্রসিজিয়র এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোড প্রবর্তন করা হলো। এভাবে মুসলমানগণ শুধু রাজ্যহারাই হলেননা, ইসলামী তথা আল্লাহর আইনের পরিবর্তে তাদের উপর কুফরী আইন চাপিয়ে দেয়া হলো। কিভাবে তাদের জীবন জীবিকার সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হলো, তাদের বহু লাখেরাজ ভূসম্পদ কেড়ে নেয়া হলো, তাদেরকে পথের ভিখারীতে পরিণত করা হলো –এ গ্রন্থে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
রেডিও পাকিস্তানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে মাওলানা মওদূদী পাকিস্তানের আদর্শিক পটভূমি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ
যদি আমাদের আলোচনাকে ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ শব্দগুলো এবং পরিভাষা পর্যন্ত সীমিত রেখে কথা বলি, তাহলে এ বিষয়টির প্রতি মোটেই সুবিচার করা হবেনা। কারণ একটা জিনিস হলো পাকিস্তানের শব্দ ও পরিভাষা এবং অন্যটি হলো এমন এক উদ্দেশ্য যা এ উপমহাদেশের মুসলমানদের সামনে সুদীর্ঘ কাল থেকে ছিল এবং মুসলমানগণ অবশেষে তাকে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিল যাতে তারা এ পরিভাষার সাথে একটা দেশও লাভ করার সংগ্রাম করতে পারে। এ লক্ষ্য তখনই ভারতীয় মুসলমানদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যখন এ উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। তারা তখন অনুবব করেছিল যে, যেহেতু তারা জগত এবং জীবন সম্পর্কে এক বিশেষ দৃষ্টিভংগি পোষণ করে এবং তারা একটা বিমেষ সভ্যতার অনুসারী, সেজন্য নিজেদের জাতীয় সত্তা তারা তখনই অক্ষুণ্ণ রাখতেপারে, যখন শাসন ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে। শাসন ক্ষমতা অমুসলমানদের হাতে চলে গেলে তারা এ দেশে মুসলমানদের চাহে চলে গেলে তারা এ দেশে মুসলমানদের জীবন যাপন করতে পারবেনা এবং মুসলমান হিসাবে তাদের কোন জীবনই থাকবে না। এ অনুভূতি ভারতে মুসলিম শাসনের পতনের পরই তাদের মধ্যেই সৃষ্টি হতে থাকে। আর এ অনুভূতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে।
কখনো এ অনুভূতি এভাবে আত্মপ্রকাশ করে যে, হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী এবং হযরত শাহ ইসমাইল শহীদ এক জেহাদী আন্দোলন নিয়ে আবির্ভূত হন। তাঁরা ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের জন্য নিজেদের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দেন। এ অনুভূতি আবার কখনো এ রূপ ধারণ করে যে, স্থানে স্থানে দ্বীনী মাদ্রাসা কায়েম করা হয় যাতে মুসলমানগণ তাদের দ্বীন ভুলে গিয়ে ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত খোদাহীন সভ্যতা এবং ধর্মহীন চিন্তাধারা ও মতবাদের প্রবল প্লাবনে ভেসে না যায়।
তারপর দ্বিতীয় পর্যায় এভাবে শুরু হয় যে, ইংরেজ শাসন এখানে পাকাপোক্ত হয়ে পড়ে এবং এদেশে ক্রমশঃ ঐ ধরনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কাজ তারা শুরু করে, যে ধরনে তাদের আপন দেশে শাসন ব্যবস্থা চলছিল। তাদের জাতীয়তা ও গণতন্দ্রের ধারণা ছিল এই যে, ইংলন্ডের সকল অধিবাসী এক জাতি এবং তাদের মেধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অধিকার স্বীকৃত। এ গণতান্ত্রিক মূলনীতি ইংরেজরা ভারতেও চালু করতে চায়। তাদের মতে ভারতের সকল অধিবাসীও এক জাতি এবং তাদের মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসননীতি চলতে পারে। এটাই মুসলমানদের মধ্যে এ অনুভূতির সঞ্চার করে যে, যদি এখানে সংখ্যাগুরু দলের সরকার কায়েম হয় তাহলে এখানে মুসলমানদেরকে চিরদিন সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে হবে এবং তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জাতীয় সত্তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ সে সরকারের অধীনে মুসলমানগণ তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন আইন রচনা করতে পারবেনা। সরকারের ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে তাদের কোন অধিকার থাকবেনা। অন্য কথায়, মুসলমানগণ তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জীবন দর্শন বাস্তবায়িত করতে পারবেনা। বরঞ্চ একটা অনৈসলামী সভ্যতা ও জীবনদর্শন তাদের উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়া হবে।
মাওলানা বলেন, এ ছিল সেই অবস্থা যা ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এক প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জের রূপ নিয়ে মুসলমানদের সামনে দেখা দেয়। এর জবাব পেতে মুসলমানদের সুদীর্ঘ সময় কেটে যায়। সুদীর্ঘকাল ধরে তারা এ কঠিন প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করতে থাকে যে, এমন এক শাসন ব্যবস্থার যেখানে ভারতের অধিবাসীদেরকে এক জাতি ধরে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠন পদ্ধতি চালু করা হবে, সেখানে সংখ্যালঘু হিসাবে মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার কি রূপ হতে পারে। এ নিরাপত্তা লাভের ধরন এবং তা নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের মূল্যায়ন করা হয়। এক পর্যায়ে এ উদ্দেশ্যে পৃথক নির্ভাচন প্রথার দাবী করা হয় (শিমলা প্রতিনিধি, ১৯০৬)। তারপর তার ভিত্তিতে লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে সমঝোতা হয় (লাখনো চুক্তি, ১৯১৬)। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন প্রস্তাবাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়। ক্রমশঃ মুসলমানগণ বুঝতে পারে যে, এ ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোন আইনগত নিরাপত্তা তাদের কোনই কাজে আসবে না। এ কথা তারা স্পষ্ট অনুভব করলো তখন, যখন ১৯৩৭ সালে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে কংগ্রেসের শাসন কায়েম হয়। সে সময়ে মুসলমানদের এ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় যে, এ উপমহাদেশে সংখ্যাগুরু দলের সরকার হওয়া এবং তাদের অধীনে মুসলমানদের সংখ্যালঘু হিসাবে বসবাস করার অর্থ এই যে, ক্রমশঃ তাদের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেয়া। এ অভিজ্ঞতা লাভের পর মুসলমানগণ এভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করেন যে, এখন পর্যন্ত এ সমস্যাটির যেদিক দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা চলে আসছিল তা অর্থহীন ও অবাস্তব।
মাওলানা বলেন, সে সময়ে মুসলমানদেরকে বার বার এ নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছিল যে ভারতের মুসলিম-অমুসলিম মিলে এক জাতি। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তারা কোন দিন এক জাতি ছিল না এবং হতেও পারেনা। মুসলমান যখন থেকে এ দেশে এসে বসবাস করতে থাকে তখন থেকে তাঁরা অমুসলিমদের সাথে কখনো এক জাতি হিসাবে বসবাস করেনি। ….এক জাতি হলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এ ছুতমার্গ ব্যাধি কোথা থেকে এলো? তাদের জাতীয় নায়ক (National heroes) আলাদা আলাদা কেন? তাদের অনুপ্রেরণা ও আবেগ অনুভূতির উৎস বিভিন্ন কেন? এক জাতি হলে হিন্দুদের থেকে পৃথক জাতি হেয় তারা কি করে বাস করতে পারতো? অতএব এ এক পরম সত্য যে, তারা এক জাতি কখনো ছিল না এবং কোন সময়ের জন্য হতেও পারেনা। এখন একটা অবাস্তব কল্পনা (Hypithesis) বলপূর্বক মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে। এ যে কার্যকর ও ফলদায়ক হতে পারেনা তা কংগ্রেসের কয়েকটি প্রদেশে সরকার কায়েম হওয়ার পর (১৯৩৭-৩৯) দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে গেল। যারা হিন্দু মুসলমান মিলে এক জাতির ঘোষণা দিচ্ছিল তারা স্বয়ং তাদের কার্যকলাপ দ্বারা একথা প্রমাণ করলো যে, হিন্দু মুসলিম এক জাতি নয়। বরঞ্চ এ ছিল একটা বিরাট রাজনৈতিক প্রতারনা যার দ্বারা তারা মুসলমাদেরকে এক গোলাম জাতিতে পরিণত করে রাখতে চেয়েছিল।
মাওলানা বলেনঃ
এ ছিল এমন এক সময় যখন আমি ১৯৩৭ সালে আমার সে প্রবন্ধগুরো লেখা শুরু করি যার দ্বারা মুসলমানদের মধ্যে এ অনুভূতির সঞ্চার করি যে, আপনারা একটি অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অধীনে থেকে …..নিজের জাতীয় অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবেন না। ……তখন আমি গভীরভাবে অনুভব করলাম যে, কোন প্রকার আইনানুগ নিশ্চয়তা দান মুসলমানদেরকে বাঁচাতে পারবেনা। এ জন্যে এ ছাড়া গত্যন্তর নেই যে, এ উপমহাদেশে মুসলমানদের নিরাপত্তার অন্য উপায় চিন্তা করতে হবে। আমার নিকটে বিকল্প পন্থা এই ছিল এবং তা আমি সুস্পষ্ট করে পেশ করলাম যে, সর্বপ্রথম মুসলমানদের মধ্যে জাতীয় স্বাতন্ত্রবোধ পরিপূর্ণরূপে জাগ্রত করা হোক যার দ্বারা তারা তাদের আপন পরিচয় জানতে পারবে। তারা জানতে পারবে তাদের জীবনের মূলনীতি কি, তারা কিভাবে অন্য জাতি থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতি বরঞ্চ এম মিল্লাত এবং তাদের এ জাতীয় স্বাতন্ত্রবোধ জাগ্রত রাখার পন্থা কি। সে সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনাও হয়নি। সে সময়ে সর্বপ্রথম করার কাজ এই চিল যে, যেমনি আমি বলেছি, মুসলমানদেরকে সেই এক জাতীয়তার বেড়াজাল থেকে কি করে বাঁচানো যায় যা তাদের চারদিকে ছড়ানো হচ্ছিল। -[মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতীয়তা প্রমাণ করে মাওলানা ‘মাসয়ালায়ে কাওমিয়াত’ নামে যে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন তার ফলে মুসলমানদের মধ্যে পৃথক জাতীয়তার ধারণা বদ্ধমূল হয়।]
মাওলানা আরও বলেন, যখন মুসলমানদের মধ্যে পৃথক জাতীয়তার ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে, তাদের মধ্যে এ প্রয়োজনের অনুভূতিও বাড়তে থাকে যে, পৃথক রাষ্ট্র কায়েম করা হোক। এভাবে পাকিস্তান আন্দোলন এক রীতিমত এবং সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে। এ পরিস্থিতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দেয়। এক এই যে, যেসব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগুরু তাদের একটি অপরটি থেকে বহুদূরে অবস্থিত। কোন বস্তু ইসলাম ছাড়া আর কিছু নয় এবং হতেও পারেনা। দ্বিতীয় প্রশ্ন এই ছিল যে, ভারতের বৃহৎ অংশে মুসলমান সংখ্যালঘু। যদি গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হয় তাহলে অনিবার্যরূপে সেখানে মুসলমানদেরকে সংখ্যাগুরুর গোলামি অবলম্বন করতে হবে। এ অবস্থায় তাদের নিরাপত্তার কি উপায় হবে? এ প্রশ্নের কোন সুস্পষ্ট জবাব ছিল না। কিন্তু এর থেকে এ সত্য সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় মুসলমানদেরকে যে ধ্যান-ধারণা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ করে এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে তা কোন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবাবেগ ছিলনা। বরঞ্চ তা ছিল একটা নির্ভেজাল দ্বীনী আবেগ অনুরাগ। নতুবা মাদ্রাজ, বোম্বাই, সিপি, ইউ,পি প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলমানদের পাকিস্তান হাসিলের জন্য সংগ্রাম করার কোনই কারণ থাককে পারেনা। তারা কখনো এ আশা করতে পারেনি যে, তাদের এলাকা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হবে। প্রকৃত ঘটনা এই যে, পরবর্তীকালে যেসব অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো সেসব অঞ্চলে পাকিস্তান আন্দোলন এতোটা জোরদার হয়নি যতোটা হয়েছে মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলোতে। এর কারণ এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, একমাত্র ইসলামী আবেগ অনুভূতিই ছিল এ আন্দোলনের প্রেরণাদায়ক শক্তি। মুসলমাদের এ পূর্ণ অনুভূতি ছিল যে, তাদের পরিণাম যা কিছুই হোক না কেন, তাদের কুরবানী দ্বারা অন্ততঃপক্ষে ইসলামের নামে একটা রাষ্ট্র ত অস্তিত্ব লাভ করবে যেখানে ইসলামের বানী সমুন্নত হবে এবং ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবে কায়েম হবে। এটাই ছিল সেই আবেগ অনুরাগ যা এ শ্লোগানে রূপায়িত হয়েছিল –“পাকিস্তানের উৎস কি –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। এ এমন এক শ্লোগান ছিল যা শুনে মুসলিম পতংগের মতো পাকিস্তান আন্দোলনের আগুন ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর এমন বিরাট সংখ্যক লোক পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করে যে, বড়োজোর শতকরা দু’একজন মুসলমান মাত্র দ্বিমত পোষণ করে। আমার নিকটে পাকিস্তান আন্দোলনের দুটি মাত্র বুনিয়াদ ছিল। একটি এই যে, আমরা দুনিয়ার অন্য কোন জাতির অংশ নই, বরঞ্চ একটি স্বতন্ত্র জাতি। আর অন্য কোন জাতির সাথে মিলিত হয়ে কোন মিশ্র জাতীয়তাও বানাতে পারিনা। দ্বিতীয়তঃ আমাদের জাতীয়তার ভিত্তি আমাদের দ্বীন। এ ছাড়া আমাদের জাতীয়তার অন্য কোন ভিত্তি নেই। আমার কাছে পাকিস্তান দর্শনের এই একমাত্র অর্থ।
-(একটি ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার। রেডিও পাকিস্তান এ সাক্ষাৎ টেপ করে এবং পাঁর বছর পর ১৯৮০ সালে তা লিপিবদ্ধ ও প্রকাশিত হয়।)
এখন এ কথা দিবালোকের মতো পরিস্কার যে, নিছক কোন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে অথবা সাময়িক ভাবাবেগে পরিচালিত হয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করা হয়নি। আন্দোলনের ভাবাবেগ ত অবশ্য ছিল। কিন্তু সে ভাবাবেগের উৎস চিল মুসলমানদের ঈমান ও আকীদাহ বিশ্বাস যার সূচনা হয়েছিল মানব জাতির সৃষ্টির সাথে সাথেই।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর দ্বিজাতিততত্ত্ব ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে বেল জোরেসোরে প্রচার করা হচ্ছে। প্রচারকগণ এতোটা কল্পনাবিলাসী যে, দ্বিজাতিতত্ত্ব ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে ধরে নিয়ে উপমহাদেশকে ১৯৪৭ পূর্ব ভৌগলিক অবস্থায় রূপান্তরিত করার আন্দোলন করছে।
একদিকে ভারতে ও কাশ্মীরে মুসলিম নিধনযজ্ঞ পূর্ণমাত্রায় চলছে, মসজিদ ধ্বংস করে মন্দির নির্মান করা হচ্ছে, অপরদিকে একজাতীয়তার মিথ্যা ও প্রতারণামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে অতীতেও যেমন তাদের এ ধরণের প্রচারণা কোন কাজে লাগেনি, ভবিষ্যতেও লাগবেনা।
বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, হিন্দুগণ উপমহাদেশে মুসলমানদের কয়েক শ’বছরের শাসনের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে তাদেরেক তাদের গোলাম বানিয়ে রেখে অথবা নির্মূল করে। তার জন্য ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে এভাবে যে মুসলিম শাসন আমলে হিন্দুদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাদেরকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছে, তাদের নারীজাতিকে অবাদে ভোগ করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। হিন্দু সাহিত্যিকগণ তাঁদের সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার করে হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলেছেন। এ ব্যাপারে হিন্দুজাতি ও বৃটিশ সরকার একে অপরের পূর্ণ সাহায্য সহযোগিতা করেছেন, হিন্দুদের সক্রিয় সাহায্য সহযোগিতা ব্যতীত এ দেশে যেমন ইংরেজদের মসনদ পাকাপোক্ত হতে পারতো না ঠিক তেমনি ইংরেজদের আশীর্বাদ ব্যতীত হিন্দুগণ মুসলমানদের প্রতি অমানবিক ও পৈশাচিক আচরণ করতে পারতো না। সর্বশেষে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া মুসলমানদেরকে অন্ধকারে রেখে যেভাবে তড়িঘড়ি প্রণয়ন করা হলো, পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্ত করে পাকিস্তানকে ক্ষুদ্রতর ও সংকুচিত করা হলো এবং যেভাবে সীমানা চিহ্নিতকরণে মুসলমানদের প্রতি চরম অবিচার করা হলো, এর দ্বারা হিন্দুদেরকে খুশী করে বৃটিশ সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের বহুদিনের পুঞ্জিভূত বিদ্বেষের প্রতিশোধ নিলেন। উপরন্তু পাকিস্তানের ন্যায্যা প্রাপ্য গুরুদাসপুর জেলাকে হঠাৎ দুদিন পর ভারতভুক্ত করে দিয়ে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব সংঘাতের বীজ বপন করা হলো। বিভক্ত বাংলার সীমানা নির্ধারণেও অনুরূপ অবিচার করা হয়েছে।
এ ইতিহাস এখানেই শেষ হচ্ছে। যে প্রেক্ষাপটে এবং যে দৃষ্টিকোণ থেকে এ ইতিহাস লেখা হয়েছে, আমরা বিশ্বাস অধিকতর সুন্দর করে লেখার যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের অভাব সমাজে নেই। নতুন প্রজন্মকে তাদের অতীত ইতিহাসের সঠিক জ্ঞানদান করে মুসলিম জাতিসত্তার মধ্যে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে –চিন্তাশীলগণ এগিয়ে আসবেন এ আবেদন রেখে আমার লেখার ইতি টানছি।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০