আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার
মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম (র)
পূর্ব কথা
রাষ্ট্র ও সরকার মানব জীবনের দুটি অপরিহার্য বিষয়। দুনিয়ায় মানুষের স্থিতি, বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্যে রাষ্ট্র ও সরকারের অস্তিত্ব একান্তই আবশ্যক। অন্তত মানুষের সমাজব্দ্ধ জীবন যে রাষ্ট্র ও সরকার ছাড়া চলতে পারে না, এ বিষয়ে প্রাচীন ও আধুনিক কালের মনীষীগন প্রায় সকলেই একমত। তবে কোন্ ধরনের রাষ্ট্র ও সরকার মানুষের জন্যে সত্যিকারভাবে কল্যাণকর, সে বিষয়ে মনীষীদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। এই মদভেদ মানবজাতিকে শুধু নানা বর্ণ, গোত্র ও শ্রেণীতেই বিভক্ত করেনি, তাকে এক নিরন্তর সংগ্রামের মাঝেও ঠেলে দিয়েছে। এই সংগ্রামের ফলে সমাজ ও সভ্যতা বারবার ওলট-পালট হয়েছে, মানুষের জীবনে অন্তহীন দুঃখ-দুর্দশা নেমে এসেছে। মানব জাতির গোটা ইতিহাস এ সত্যেরই অকাট্য সাক্ষ্য বহন করেছে। রাষ্ট্র ও সরকার যেখানে মানুষের প্রয়োজনে অস্তিত্ব লাভ করেছে, সেখানে রাষ্ট্র ও সরকারের যুপকাষ্ঠেই মানবতাকে বারবার বলি দেয়া হয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্র ও সরকারের অস্তিত্ব বহুতর ক্ষেত্রেই মানুষের জন্যে আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ রূপে দেখা দিয়েছে। ইসলাম মানুষের জন্যে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবন-ব্যবস্থা। রাষ্ট্র ও সরকার এ জীবন-ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য্ অংশ। ইসলামের প্রধান উৎস আল-কুরআন মানুষকে শুধু কতিপয় নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বরং মানুষের সমাজবদ্ধ জীবনের জন্যেও দিয়েছে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা। এই দিক নির্দেশনাতেই স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে উঠেছে দেশ-কাল-নির্বিশেষে মানুষের জন্যে কল্যাণকর এবং গতিশীল রাষ্ট্র ও সরকারের এক অনবদ্য চিত্র। ইসলাম নির্দেশিত এই রাষ্ট্র ও সরকার কোন অবাস্তব কল্পনা-বিলাস নয়, বিশ্ববাসী এর বাস্তব নমুনা প্রত্যক্ষ করেছে সুদীর্ঘকাল ধরে। প্রকৃতপক্ষে এই রাষ্ট্র ও সরকারই যে মানব জাতির জন্যে অফুরন্ত আশীর্বাদ বয়ে আনতে সক্ষম, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তারও সাক্ষ্য-প্রমান লিপিবদ্ধ রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। বর্তমান শতকের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হযরত আল্লামা মোহাম্মাদ আব্দুর রহীম (রহ) ইসলামের নির্দেশিত এই রাষ্ট্র ও সরকারেরই এক সুবিস্তৃত চিত্র এঁকেছেন তাঁর আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার গ্রন্থে। এই গ্রন্থে তিনি ইসলামের রাষ্ট্র ও সরকার বিষয়ক ধ্যান-ধারণাকে উপস্থাপন করেছেন প্রধানতঃ কুরআনের প্রাসঙ্গিক আয়াত ও বক্তব্যের আলোকে। এর ফলে কুরআনের বিষয়-ভিত্তিক তফসীর রচনার ক্ষেত্রেও একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। তবে এই গ্রন্থে স্বীয় বক্তব্য উপস্থাপনে গ্রন্থাকার শুধু কুরআনের প্রাসঙ্গিক আয়াতসমুহই উদ্ধৃত করেননি, সেসবের ব্যাখ্যায় মযহাব নির্বিশেষে প্রাচিন ও আধুনিক কালের বিশিষ্ট মুফাসসিরদের অভিমতসমূহও তিনি উল্লেখ করেছেন অত্যন্ত কুশলতার সাথে । এর ফলে ইসলামের রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে সকল মযহাবের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি অভিন্ন চিত্র ফুঠে উঠেছে এই গ্রন্থে। এই সবৃহৎ গ্রন্থটি ১৯৮৫ সালে রচিত হলেও এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালের ১লা অক্টোবর গ্রন্থাকারের স্মৃতি বার্ষিকিতে। গ্রন্থটি পাঠক মহলে বিপুলভাবে সমাদৃত হয় এবং অত্যল্পকালের মধ্যেই এর সমুদয় কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। বর্তমানে মুদ্রণ সামগ্রির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির মাঝে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এর অঙ্গসজ্জা ও মুদ্রণ পারিপাট্যও বহুলাংশে উন্নত হচ্ছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, গ্রন্থটির এই সংস্করণ পাঠক মহলে অধিকতর সমাদর লাভ করবে। মহান আল্লাহ্ গ্রন্থাকারের এই অনন্য খেদমতের বদৌলতে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদৌসে স্থান দিন, এটাই আমাদের সনুনয় প্রার্থনা।
মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
ঢাকাঃ আগষ্ট ১৯৯৫ চেয়ারম্যান
মাওলানা আবদুর রহিম ফাউন্ডেশন
গ্রন্থকার পরিচিতি
মাওলানা মোহাম্মদ আবদুর রহিম (রহ্) বর্তমান শতকের এক অনন্যসাধারণ ইসলামী প্রতিভা। এ শতকে যে কজন খ্যাতনামা মনীষী ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েমের জিহাদে নেতৃত্ব দানের পাশাপাশি লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে একটি কালজয়ী জীবন দর্শন রূপে তুলে ধরতে পেরেছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। এই ক্ষণজন্মা পুরুষ বাংলা ১৩২৫ সনের ৮ ফাল্গুন, (ইংরেজী ১৯১৮ সালের ২ মার্চ) সোমবার বর্তমান পিরোজপুর জিলার কাউখালি থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৩৮ সনে তিনি শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম এবং ১৯৪৪০ ও ১৯৪২ সনে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে যথাক্রমে ফাযিল ও কামিল ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানগর্ভ রচনাবলী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সন পর্যন্ত তিনি কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণায় নিরত থাকেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এই ভূখন্ডে ইসলামি জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহন করেন এবং অত্যল্প কালের মধ্যেই একজন দক্ষ সংগঠক রুপে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
বাংলা ভাষায় ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মওলানা মোহাম্মদ আবদুর রহিম (রহ্) শুধু পথিকৃতই ছিলেন না, ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পরকে এ পর্যন্ত তার ৬০ টিরও বেশি অতুলনীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘ইসলামি রাজনীতির ভূমিকা’,‘ইসলামের অর্থনীতি’, ‘মহাসত্যের সন্ধানে’, ‘বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব’, ‘আজকের চিন্তাধারা’, ‘পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’, ‘কমিউনিজম ও ইসলাম’, ‘সুন্নাত ও বিদয়াত’, ‘নারী’, ‘ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন’, ‘পরিবার ও পারিবারিক জীবন’, ‘আল-কুরআনের আলোকে উন্নত জীবনের আদর্শ’, ‘আল-কুরআনের আলোকে শিরক ও তওহীদ’, ‘আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার’, ‘বিজ্ঞান ও জীবন বিধান’, ‘ইসলাম ও মানবাধিকার’, ‘ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তাধারা’, ‘আল-কুরআনের আলোকে নবুয়্যাত ও রিসালাত’, ‘ইসলামী শরীয়াতের উৎস’, ‘অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম’ ইত্যাকার গ্রন্থ দেশের সুধীমহলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে। এছাড়া অপ্রকাশিত রয়েছে তাঁর অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি।
মৌলিক ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী মনীষীদের রচনাবলী বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারেও তাঁর কোন জুড়ি নেই। এসব অনুবাদের মধ্যে রয়েছে মওলানা মওদুদী (রহঃ)-এর বিখ্যাত তফসীর ‘তাফহীমুল কুরআন’, আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী কৃত ‘ইসলামের যাকাত বিধান’ (দুই খন্ড) ও ‘ইসলামে হালাল-হারামের বিধান’, মুহাম্মদ কুতুবের ‘বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত’ এবং ইমাম আবু বকর আল-জাসসাসের ঐতিহাসিক তফসীর ‘আহ্কামুল কুরআন’। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৬০টির ঊর্ধ্বে।
মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) ১৯৭৭ সনে মক্কায় অনুষ্টিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন ও রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলন, ১৯৭৮ সনে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইসলামী দাওয়াত সম্মেলন, একই বছর করাচীতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় ইসলামী মহাসম্মেলন, ১৯৮০ সনে কলম্বোতে অনুষ্টিত আন্তঃপার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং ১৯৮২ সনে তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিকী উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে
এই যুগস্রষ্টা মনীষী বাংলা ১৩৯৪ সনের ১৪ আশ্বিন (ইংরেজী ১৯৮৭ সনের ১ অক্টেবর) বৃহস্পতিবার এই নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।