ইসলামী রাষ্ট্র স্বাস্থ্য ও সুস্থতা
[দৈহিক সুস্থতার প্রতি ইসলামের গুরুত্বারোপ-কুরআনের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত শিক্ষা-স্বাস্থ্য রক্ষা পর্যায়ে ইসলামী হুকুমতের দায়িত্ব।]
দৈহিক সুস্থতার প্রতি ইসলামের গুরুত্বারোপ
ইসলাম নিছক কোন ধর্ম নয়, পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা। তাই ইসলাম মানুষের শুধু পরকাল সম্পর্কেই চিন্তা-ভাবনা করেনি, তার ইহকালীন কল্যাণও ইসলামের কাম্য। কুরআন এজন্যই মানুষকে এই দোয়া করার আহব্বান জানিয়েছেঃ [আরবি**************************************]
হে আমাদের পরোয়ারদিগার, তুমি আমাদেরকে ইহকালে কল্যাণ দান কর, কল্যাণ দান কর পরকালেও।
এই কারণে ইসলাম মানুষের শুধু আত্না বা রুহ-এর উপরই গুরুত্বারোপ করেনি, মানুষের দেহের উপরও যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছে। ইসলাম চায় মানুষের দেহ সর্বতোভাবে সুস্থ থাক, যেমন কামনা করে তার ‘রূহ’ বা আত্নার সুস্থতা। তাই মানবিক শক্তি-সামর্থের সাথে সাথে দৈহিক শক্তির সুস্থতার উল্লেখ করা হয়েছে একটি সমাজের রাষ্ট্রিয় নেতৃত্বের গুণাবলীর তালিকায়। বলা হয়েছেঃ [আরবি*****************************]
জ্ঞান ও দেহ উভয়ের প্রশস্ততাই তার থাকতে হবে।
অনুরূপভাবে শ্রমিক হওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রেও দৈহিক শক্তির প্রয়োজনীয় উল্লেখ হয়েছে এ আয়াতেঃ [আরবি**************************************]
তোমার উত্তম শ্রমিক হতে পারে দৈহিক শক্তিসম্পন্ন ও নৈতিক বিশ্বস্ততার গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি।
বস্তুত অসুস্থ ব্যক্তি জীবনের কোন দায়িত্বই পালন করতে পারে না। অঙ্গহীন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হয় না পূর্ণাঙ্গ মানুষের ন্যায় কাজ করা। সুস্থ ও পূর্ণ দেহসম্পন্ন মানুষ সুস্থ মানব-সমাজের ভানসাম্যপূর্ণ অংশ ও অঙ্গ হতে পারে। কেননা মানবসত্তা রূহ ও দেহের সমন্বয়। একটি অপরটির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী। এ কারণেই কুরআন পূর্ণ-দেহ, সুস্থ দেহ ও দৈহিক শক্তির যথাযথ প্রশংসা করেছে। দৈহিক শক্তি বা সুস্থ দেহই আধার হতে পারে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির। আর তার পক্ষেই নির্ভুল চিন্তা-গবেষণঅ চালানো সম্ভবপর।রুগ্ন দেহ মানুষের উপর শরীয়াতও কষ্টদায়ক কাজের দায়িত্ব চাপায় না। যেমন রোযা ফরয করার আয়াতে বলা হয়েছেঃ [আরবি****************************************]
কিন্তু যে ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হবে অথবা যার মাথায় কোন রোগ হবে এবং সে কারণে মাথা মণ্ডন করবে, সে ‘ফিদিয়া’ (বিনিময়) হিসেবে রোযা রাখবে, অথবা সাদকা দেবে কিংবা কুরবানী করবে।
অথচ ইহরাম বাধা অবস্থায় মাথা মুণ্ডন নিষিদ্ধ।
এ থেকে বোঝা যায়, শরীয়াতের দৃষ্টিতেও স্বাস্থ্য ও সুস্থতার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা মানুষ দৈহিক ভাবে যদি সুস্থই না থাকে, তাহলে তার পক্ষে শরীয়াত পালন করা-শরীয়াতের বিধান অনুযায়ী কাজ করা-বাস্তবভাবেই সম্ভব হতে পারে না। অথচ শরীয়াত নাযিল-ই হয়েছে মানুষ তা পুরোপুরি ও যথাযথ পালন করবে বলে।
কুরআনের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত শিক্ষা
বস্তুত স্বাস্থ্য তত্ব ও রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে কুরআনের ধারাবাহিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার লক্ষ্য, মানুষের দেহকে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করা, রোগ প্রতিরোধ করা যেতে রোগ না হয়, পূর্বাহ্নেই তার বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ। আর এ পর্যায়ে কুরআন মজীদের শিক্ষাকে কাজে পরিণতি করা হলে মানুষের দেহ ও মন-উভয়ই বহু থেকে রক্ষা পেতে পারে। আমরা সকলেই জানি, কুরআন মজীদ কিছু কিছু জিনিস হারাম ঘোষণা করেছে, তা গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে। সেই নিষিদ্ধ জিনিসসমূহ বাদ অন্য সব ‘মুবাহ’ বলে বুঝতে হবে। কেননা সে বিষয়ে কোন নিষেধ বাণী উচ্চারিত হয়নি। আর কুরআন যা গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে, যা গ্রহণ করতে নিষেধ করেনি, তার মূল নৈতিক কারণের সাথে সাথে বস্তুগত কারণ নিহিত থাকা কিছু মাত্র অসম্ভব নয়। নিষিদ্ধ জিনিগুলির খারাপ ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া থেকে মানুষের দেহকে রক্ষা করা অন্যতম লক্ষ। কুরআন মৃত জন্তু, রক্ত ওশূকর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এ আয়াতেঃ
[আরবী*************************************************]
আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি শুধু মৃত,রক্ত শূকর গোশত নিষিদ্ধ করে দিয়েছেনঃ সেই জন্তুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ, যা আল্লাহ্ ছাড়া অপর কারো নামে বলি দেয়া হয়েছে। অবশ্য কোন ব্যক্তি যদি কঠিন ঠেকায় পড়ে- আইনের সীমা বা প্রয়োজনের সীমা লংঘন না করে- খায়, তাহলে তাতে তার কোন গুনাহ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ খুবই ক্ষমাশীল ও অতীব দয়াবান।আয়তে ‘মৃত’ বলতে মৃত- মরে যাওয়া জন্তু, যা জবাই করা হয়নি, কোন কারণে মরে গেছে,তা বুঝিয়েছে। কেননা এই মৃত্যু যদি কোন রোগের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে তার গোশত খাওয়া মানুষের সুস্বাস্থের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর হতে পারে। আর তা যদি রোগ-জীবাণুমুক্তও হয়, তবু তা খাওয়ার ফলে মানুষের শূল বেদনা (worm) ও পোকার ডিম বহন করে, যা খেলে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়ে বহু প্রকারের চিকিৎসা অযোগ্য রোগ দেখা দেয়া অবশ্যম্ভাবী।
অপর একটি আয়াতে এই নিষিদ্ধ গোশতের তালিকা এভাবে দেয়া হয়েছেঃ
[আরবী****************************************************]
তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত এবং সেই সব জন্তু, যা আল্লাহ্ ছাড়া অপর কারোর নামে হত্যা করা হয়েছে। আর যা গলায় ফাঁস পড়ে, আঘাত খেয়ে, উচ্চস্থান থেকে পড়ে গিয়ে কিংবা সংঘর্ষে পড়ে মরেছে অথবা যা কোন হিংস্র জান্তু-ছিড়ে খেয়েছে- যা জীবিতাবস্থায় যবেহ করা হয়েছে তা বাদ আর যা কোন দেবতার আস্তানায় যবেহ করা হয়েছে…………
গলায় ফাঁস পড়ে মরে যাওয়া জন্তু খুব দ্রুত পচে যায়, দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। আয়াত বলে অন্যান্য জন্তুর ব্যাপারও তাই। উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া জন্তু ব্যথার চোটে ছটফট করে মরে যায়, যা আঘাত খেয়ে মরে যায়, আর যা হিংস্রতার বশবর্তী হয়ে গুতোগুতি করে মরে যায়। এসবগুলির এই অবস্থা। এসব জন্তুর গোশতে খুব দ্রুত রোগ- জীবাণু সংক্রমিত হয়, যার দরুন খুব দ্রুত পচে যায়। তাই এগুলিও খাওয়া সম্পূর্ণ হারাম।
শুধু এগুলিই নয়। এছাড়া যা নৈতিকতার দিকদিয়ে ‘খাবীস’ (Bad, wicked) তা- ও ইসলামে হারাম ঘোষিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ বলেছেনঃ
[আরবী******************************]
আহলী কিতাবের মধ্য থেকে যার উম্মী নবী রাসূল [মুহম্মাদ (স)- এর অনুসরণ করে, যার বিষয়ে তাদের নিকট রক্ষিত তওরাত ও ইনজীল কিতাবে লিখিত দেখতে পায়, সে তাদেরকে ভালো ভালো কাজের আদেশ করে, মন্দ- নিষিদ্ধ কাজ করা থেকে বিরত রাখে এবং তাদের জন্য উত্তম-উৎকৃষ্ঠ জিনিসসমূহ হালাল ঘোষণা করে ও খবীস (খারাপ, ক্ষতিরকর) জিনিসসমূহ হারাম ঘোষণা করে।
এসবের সাথে সাথে মদ্য ও যাবতীয় মাদক দ্রব্য হারাম করার ব্যাপারটিও যোগ করতে হবে। এ পর্যায়ে কুরআনের ঘোষণা হচ্ছেঃ
[আরবী************************************]
মদ্য,জুয়া আস্তানা ও ভাগ্য জানার তীর তোলা- প্রভৃতি- শয়তানী কাজের চরম মলিনতা: অতএব তোমরা তার প্রত্যেকটিই পরিহার কর। আশা করা য়ায়, তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।
এসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে মানুষকে বহু প্রকারের মারাত্মক মারাত্মক রোগ থেকে বাঁচাবার লক্ষ্যে। এগুলির যেমন বস্তুগত ক্ষতি আছে, তেমনি আছে নৈতিক ক্ষতিও। কেননা মদ্য ও সর্বপ্রকারের মাদক দ্রব্য মানব দেহে অত্যন্ত খারাপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যার দরুন প্রথমে মানুষের হজম শক্তি নষ্ট হয়ে, পরে পাকস্থলীতে জখম হয় এবং গোটা স্বাস্থ্যের মর্মকেন্দ্রকে চুর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া। তার এই খারাপ প্রতিক্রায়া কেবল তার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা বংশানুক্রমে চলতে থাকে। মদ্যপায়ীর বংশ চরিত্রের দিক দিয়ে যেমন আদর্শ স্থানীয় হয় না, তেমনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ারও সম্ভব হয় না। কেননা মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে ব্যক্তির যৌন শক্তিও বিলুপ্ত হয়, শুক্রকীট রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
এমনিভাবে পানাহারে মাত্রাতিরিক্ততাও ব্যক্তির পক্ষে খুবই মারাত্মক পরিণতি নিয়ে আসে। তাই কুরআন মজীদে বলা হয়ছেঃ
[আরবী******************************]
তোমরা খাও, পান কর: তবে সীমাতিরিক্ততার প্রশ্রয় দিও না।কেননা আল্লাহ্ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসে না
আয়াতটি ক্ষুদ্রায়তন হলেও তাতে স্বাস্থ্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিধান নিহিত রয়েছে। মানুষের শরীর- স্বাস্থ্যর সুরক্ষা তার লক্ষ্য! কেননা পানাহরে মাত্রাতিরিক্ততার প্রশ্রয় দেয়া হলে তা হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনির্বাযভাবে বহু মারাত্মক রোগ দেখা দিতে পারে। পক্ষান্তরে কুরআন মুসলমানদের জন্য রোযা রাখা ফরয ঘোষণা করেছেঃ
[আরবী**********************]
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেমন করে তা ফরয করে দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববতী লোদের প্রতি আশা করা যায়, রোযা রাখার ফলে তোমরা বহু প্রকারের ক্ষতিকর জিনিস থেকে বাচতে পারব। রোযার নৈতিক কল্যাণ ছাড়াও অকল্পনীয় দৈহিক কল্যাণ রয়েছে। আধুনিক কালের উন্নত স্বাস্থ্য- বিজ্ঞানও রোযার এই দৈহিক কল্যাণকে স্বীকার করেছে এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় তা প্রয়োগ করা হচ্ছে।
কুরআন শুধু ক্ষতিকর জিনিসসমূহ চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হয়নি, কল্যাণকর প্রাকৃতিক সামগ্রী ও রোগ নিরাময়ের উপকরণাদির সন্ধান দিয়েছে। এপর্যায়ে বিশেষভাবে মধুর উল্লেখ খুব বেশী গুরুত্ববহ। বলা হয়েছেঃ
[আরবী****************************]
আর লক্ষ্য কর, তোমার রব্ব মধু- মক্ষিকার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন যে, পাহাড়- পর্বতে, গাছে ও ওপরে বিস্তীর্ণ লতা- পাতায় নিজেদের চাক নির্মাণ করা। অতঃপর সর্ব প্রকারের ফলের রস চুষে লও এবং তোমার রব্ব-এর নির্ধারিত উপায়ে চলতে থাক। এই মক্ষিকার পেট থেকে রঙ-বেরঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে রয়েছে লোকদের জন্য রোগ- নিরাময়ত। আর নিঃসন্দেহে এতে চিন্তা-গবেষণাসম্পন্ন লোকদের জন্য গুরুতর নিদের্শন রয়েছে। বস্তুত মধুতে যে বিপুল মাত্রায় রোগ নিরাময়তা ও শক্তি-উপকরণ নিহিত,আধুনিক রাসায়নিক বিশ্লেষণ নিঃন্দেহে প্রমাণিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তাতে কুরআনের এই ঘোষণায় পরম সত্যতাই প্রমাণিত হয়েছে অকাট্যভাবে। এ ছাড়াও যেসব জিনিস, কর্ম ও পন্হা ব্যাক্তি ও সমষ্টির সুস্বাস্থ্যের অনুকূল, কুরআন মজীদে সেগুলিরও নিদের্শ করেছে। এ পর্যায়ে বিশেষভাবে উল্লেখ্য সাধারণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ময়লা আবর্জনার নিমূর্লতা। বিশ্বনবী (স)-এর প্রতি দ্বিতীয়বারে অবতীর্ণ আয়াতে আল্লাহ্ তাঁর নবী (স)-কে নির্দেশ দিয়েছেলেন (আরবী) এবং তোমার পরিচ্ছদ ভূষণ পবিত্র-পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ কর। আয়াতটি আকারে ক্ষুদ্র হলেও তাৎপর্য বিশাল। এতে নবী করীম (স)- কে তাঁর পোশাক- পরিচ্ছদ মলিনতা- অপবিত্রতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র রাখার নিদের্শ দেয়া হয়েছে। কেননা দেহ ও পোশাকের পবিত্রতা- পরিচ্ছন্নতা এবং মন-মানসিকতা আত্মার পবিত্রতা ওতপ্রোত, একটি অপরটি থেকে অবিচ্ছিন্ন । একটি পবিত্র-পরিচ্ছন্ন-পরিশুদ্ধ মন মনিল ও দুর্গদ্ধময় দেহ ও ময়লাযুক্ত পোশাক এক মুহূর্তের তরেও বরদাশত করতে পরে না। তদানীস্তন আরব সমাজ কেবল মন- মানসিকতার দিক দিয়েই মলিনতা কলুষতায় জর্জরিত ছিল না, সাধারণ পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা- পবিত্রতার প্রাথামিক ধারণাটুকুও তারা হারিয়ে ফেলেছিল।
[তাফহীমুল-কোরআন, ১৮ খণ্ড, পৃঃ ১০৬]
তাই আল্লাহর এই নির্দেশ কেবল রাসূলে করীম (স)-এর প্রতিই নয়, সাধারণভাবে সব মানুষের প্রতিও। কুরআন যে, ‘তাহারাত’ পবিত্রতা- পরিচ্ছন্নতা- পরিশুদ্ধতার নিদের্শ ও উৎসাহ প্রাদান করা হয়েছে, তা মন- মানসিকতা সহ পোশাক ও দেহ এবং ঘর- বাড়ি ও পরিবেশ—সবকিছু পরিব্যাপ্ত। আর এই কাজের জন্য প্রধান উপকরণ হচ্ছে আল্লাহর দেয়া পানি। পানি দ্বারাই পরিচ্ছন্নতা- পবিত্রতা লাভ করা সম্ভব। এজন্য আল্লাহ তা ‘আলা পবিত্র পানি নাযিল করেছেন। ইরশাদ হয়েছেঃ
[আরবী*************************]
তোমরা যখন নামাযের জন্য প্রস্তুত হবে, তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল, কনুই পযর্ন্ত দুই হাতে, গিড়া পযর্ন্ত দুই পা ধৌত করবে ও মাথা মুসেহ করবে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অন্ততঃ পাচঁবার বহিরাঙ্গের উক্ত অংশগুলি নিয়মত ধৌত করা হলে বা পরিচ্ছন্ন করলে দেহ যে পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। আর স্ত্রী- সঙ্গমের পর গোটা দেহ যে ময়লাযুক্ত ও ক্লেদাক্ত হয়ে পড়ে, তা থেকেও পবিত্রতা অর্জনের জন্য গোসলের নিদের্শ দেয়া হয়েছেঃ [আরবী*****************************************]
স্ত্রী-সঙ্গমের কারণে অপবিত্র হয়ে পড়লে তোমরা অবশ্যই পবিত্রতা অর্জন করবে ।আর পানি পাওয়া না গেলে মাটির স্পর্শে পবিত্রতা অর্জন করতে বলা হয়েছেঃ [আরবী************************************]
আর পানি না পেলে তোমরা পবিত্র মাটিকে লক্ষ্যস্থলরূপে গ্রহণ কর ও তোমাদের মুখমণ্ডল ও হস্তদয় মুসেহ কর।
কেননা মাটি সাধারণ ও স্বতঃই পবিত্র। তা মানব দেহকে সব রকমের রোগ- জীবাণু থেকে রক্ষা করে।
এ সব উপায়ে যে পবিত্রতা অর্জন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার মূলে যে লক্ষ্য নিহিত রয়েছে, কুরআনে তা বলা হয়েছে এ ভাষায়ঃ [আরবী************************************]
আল্লাহ্ তোমাদের উপর কোন অসুবিধা চাপাতে চান না। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন-পবিত্র-ময়লামুক্ত করে রাখতে চান, চান তার নিয়ামত তোমাদের প্রতি স্মপূর্ণ করে দিতে এই আশায় যে, তোমরা শোকর করবে।
দেহকে পবিত্র রাখার লক্ষেই আল্লাহ্ তা’আলা স্ত্রীর ঋতু অবস্থায় তার সাথে সঙ্গম করতে নিষেধ করিছেন। সেই নিষেধে কারণও দর্শিয়েছেন। বলেনঃ
[আরবী************************************]
হে নবী! লোকেরা তোমার নিকট ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করা সম্পর্কে (আল্লাহ্ হুকুম) জানতে চায়। তুমি বল, তা কস্টজনক-ক্ষতিকর। অতএব এই অবস্থায় স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাক হায়য চলাকালে। আর যতক্ষণ তারা পবিত্র না হচ্ছে, ততক্ষণ তাদের সাথে সংঙ্গম করবে না।
স্ত্রীলোকের ঋতু অবস্থাকে আয়াতে [আরবী************************************] বলা হয়েছে। তার অর্থ এমন সব ক্ষতি যা কোন জীবের প্রাণ বা দেহে পৌঁছতে পারে। তা বস্তুগতভাবে ক্ষতিকর হোক কি নৈতিক দৃষ্টিতে। ঋতু অবস্থাকে [আরবী************************************] বলার মূলে শরীয়াতের কারণ নিহিত- কেননা আল্লাহ্র শরীয়াত তা ক্ষতিকর মনে করে অথবা তা স্বাস্থ্য- বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ক্ষতিকর। ১ এক সাথে এই দু’টি দিক সম্মুখে থাকাই স্বাভাবিক। তবে আধুনিক স্বাস্থ-ঋতু অবস্থার সঙ্গমকে স্বামী স্ত্রী উভয়ের জন্য ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেননা ঋতুস্রাবে রক্ত, পচা, ময়লা ও মারাত্মক রোগ জীবাণু জর্জরিত। পুরুষ তার সংস্পশে এলে তার প্রদাহ রোগ (inflammation) হতে পারে। অনুরূপভবে ঋতু অবস্থায় স্ত্রী সঙ্গম হলে স্ত্রী অভ্যন্তরীণ ঝিল্লী (membrane) দীর্ণ হয়ে অস্বাভাবিক রক্ত সঞ্চয় (congestion) বা ক্ষরণ হতে পারে। এই সময়ের যৌন সঙ্গম এমন অভ্যন্তরণী দীর্ণতার সৃষ্টি হতে পারে, যার ফলে ব্যাপক রোগ জীবাণু (microbe) সমস্ত দেহে ছরিয়ে পড়তে পারে। স্বাস্থ্যে এমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে স্ত্রী সম্পূর্ণরূপে স্বাস্থ্যহীনা হয়ে যেতে পারে। এর ফলে কর্কট রোগ (cancer) হওয়াও অসম্ভ নয়।
যৌন রোগের সংক্রমণ রোধ করা ব্যভিচার নিষিদ্ধ হওয়ার মূলে নৈতিক অধঃপতন ও পাপাচার প্রসারত ছাড়াও স্বাস্থ্যগত মারাত্মক ক্ষতির আশাংকাকে কারণ বলা যেতে পারে। বলা হয়েছেঃ
[আরবী*****************************]
তোমরা ব্যভিচারের নিকটেও যাবে না। কেননা তা যেমন চরম মাত্রার নির্লজ্জতা, আর অতীব খারাপ পথ ও পন্হা।
ব্যভিচার চরম মাত্রার নির্লজ্জতা, চরিত্রহীনতা ছাড়াও সংক্রামক যৌন রোগ দেখা দেয়া খুবই সম্ভব। আর ইসলামে তা হারাম হওয়ার মূলে এণ্ড যে কারণ, তাতে সন্দেহ নেই।
মোটকথা, কুরআন মজীদ মানুষের সুস্বাস্থ্য রক্ষার উপর পূর্ণ মাত্রার গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং ইসলামী স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানের সুদৃঢ় ভিত্তিও রচনা করেছে। কুরআন উপস্থাপিত এই স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানের চিরন্তনতা ও বৈজ্ঞানিকতা অনস্বীকার্য। রাসূলে করীম (স) এই কুরআনী স্বাস্থ্য তত্ত্বের ভিত্তিতে এক পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তৃত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুনিয়ার মানুষের নিকট দিয়ে গেছেন, যার বিস্তারিত বিবরণ এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
হাদীসে রাসুলে করীম (স) কথিত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তত্ত্ব ও তথ্যাদি নিয়ে বিভিন্ন বিরাট গ্রন্থ লিখিত হয়েছে। সেই পর্যায়ে কতিপয় গ্রন্থের নাম এখানে উদ্ধৃত করছিঃ
ক) (আরবী*******) হাফেয আবু নয়ীম আহমদ আবদুল্লাহ আল-ইসফাহানী (মৃতঃ ৪৩০ হিঃ) লিখিত।
খ) (আরবী*****) শায়খ আল ইমাম আবুল আব্বাস আল-মুসতাগফিরী লিখিত।
গ) (আরবী******) আবুল ওয়াজীর আহমাদ আল-আবহারী।
স্বাস্থ্য ও বিবাহ
বিবাহের সাথে স্বাস্থ্যের নিকট সম্পর্ক। এ পর্যায়ে বহু তত্ব ও তথ্যও উদঘাটিত হয়েছে। আধুনিক স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানে সুস্বাস্থ্য রক্ষার দিক দিয়ে বিবাহের অসাধারণ গুরুত্ব সর্বজনমতের ভিত্তিতে স্বীকৃত হয়েছে, যদিও ইসলাম চৌদ্দশ বছর পূর্বেই এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে। কুরআন মজীদ ও পর্যায়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা উপস্থাপিত করেছে, আধুনিক স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান তা জানতে পেরেছে অতি সম্প্রতি।
পুরুষ ও নারীর সুস্বাস্থ্যের জন্য বিবাহ –শুধু যৌন মিলনন নয় –অপরিহার্য। কিন্তু সেই বিবাহ হতে হবে এমন নারী পুরুষে, যাদের মধ্যে রক্ত সম্পর্ক খুব নিকটে নয়। আর এই কারণেই কুরআন কতিপয় নারী-পুরুষের পারস্পরিক বিবাহ হারাম করে দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ
(আরবী*******)
তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভাই’র কন্যা, বোনের কন্যা, তোমাদের দুগ্ধদানকারী মা, তোমাদের দুধ-বোন, তোমাদের স্ত্রীর মা, তোমাদের স্ত্রীদের কোলে নিয়ে আসা তোমাদের পালিতা কন্যা, -যেমন স্ত্রীর সাথে তোমরা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছ তাদের, যৌন সম্পর্ক স্থাপিত না করে থাকলে কোন গুনাহ হবে না, তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের বিবাহিতা, এ-ও হারাম যে, তোমরা দুই সহোদরাকে একসাথে স্ত্রীত্বে গ্রহণ করবে –পূর্বে যা তা তো হয়েই গেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, অতীব দয়াবান।
এ আয়াতে সাত পর্যায়ে মেয়েলোককে বিবাহ করা পুরুষের জন্য হারাম করা হয়েছে। তারা পুরুষটির সাথে বংশগতভাবে সম্পর্কিত।
এতে দুধ সম্পর্কের কারণেও স্ত্রীলোককে হারাম করা হয়েছে। এটা মানব ইতিহাসের ধর্মসমূহের মধ্যে কেবলমাত্র ইসলামেরই উপস্থাপন। তার কারণ হচ্ছে, যে নারী সন্তানকে দুগ্ধ দেয়, সে আসলে তার দেহের অংশ গড়ে, যা সেই দুগ্ধপায়ী সন্তানের দেহ গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এক কথায়, সে দুগ্ধ তার দেহের অংশে পরিণত হয়। এই দুধই তার রক্ত, তা থেকেই দেহের গোশত। আর অস্থি-মজ্জাও তাতেই গড়ে উঠে। ফলে সে মহিলার তার আপন মা’র স্থানীয় হয়ে যায়। আর মা তো চিরকালের জন্যই হারাম।
হাদীসে এই পর্যায়ে বহু বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, ফিকাহর কিতাবেও বিস্তৃত আলোচনা আছে।
স্বাস্থ্য রক্ষা পর্যায়ে ইসলামী হুকুমাতের দায়িত্ব
ব্যক্তিগণের ও গোটা সমাজ-সমষ্টির সাধারণ স্বাস্থ্ রক্ষার জন্য দুইটি বিষয়ের ব্যাপক প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরীঃ
ক. সার্বক্ষণিকভাবে স্বাস্থ রক্ষার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকা।
খ. প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক বিনিয়োগ ও জরুরী ঔষধসমূহের সুপ্রাপ্য করা –যা সাধারণত হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্ভব হয়। কোন এলাকায় মহামারী আকারে রোগ দেখা দিলে তার ব্যাপক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
এ দুটি কাজ-ই অত্যন্ত কঠিন ও ব্যাপক শক্তি-সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখেনা। এজন্য ব্যাপক ও নির্ভুল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। প্রয়োজন অমোঘ আইন-বিধানের ও বিপুল অর্থ-সম্পদের। বাস্তবতার দৃষ্টিতে ও কাজ কেবলমাত্র কোন রাষ্ট্র সরকারের পক্ষেই সম্ভব। তাই এতে কোনই সন্দেহ নাই যে, ইসলামী রাষ্ট্রের সকল প্রকারের দায়-দায়িত্বের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে গণ্য হতে হবে। কেননা ইসলামী শাসন কায়েম হবে ও চলতে তো জনগণের উপর। কিন্তু সেই জনগণ-ই যদি সুস্বাস্থের অধিকারী না হয়, তাদের রোগ নিরাময়তার ব্যাপক ও কার্যকর ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে সে হুকুমত কোথায় দাড়াবে?
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর ব্যবস্থা অবশ্যই ইসলামী সরকারকে করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণের জান-মালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রিয় দায়িত্ব। এখানে রাসূলে করীম (স)-এর এ কথাটি স্বরণ না করে পারা যায় না।
(আরবী******)
শক্তিমান সুস্বাস্থের অধিকারী মু’মিন ব্যক্তি অতীব কল্যাণময় এবং আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় দুর্বল স্বাস্থ্যহীন মু’মিন ব্যক্তির তুলনায় –সকল কল্যাণময় ব্যাপারেই।
ষহিহ মুসলিম শরীফ।
ইসলামী রাষ্ট্র প্রথম দিন থেকেই এই ব্যাপারে স্বীয় দায়িত্ব মেনে নিয়েছে এবং সব সময়ই এই কর্তব্যের বাধ্যবাধকতাকে কার্যকর করতে চেষ্টিত রয়েছে।