ইসলামী রাষ্ট্রের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যসূচি
[ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বঃ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান-ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকার সংরক্ষণ-সংখ্যালঘুদের অধিকার-আহলি কিতাব লোকদের সাথে শুভ আচরণ-জিযিয়া।]
…………………………………………………………………………………………………..
ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বঃ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান
জনগণকে ইসলামী জীবন-বিধান শিক্ষাদান এবং তদানুযায়ী জীবন যাপনের বাস্তব প্রশিক্ষণ দান-জন জীবনকে পবিত্র পরিশুদ্ধকরণই ছিল নবী-রাসূল আগমনের আসল ও প্রকৃত লক্ষ্য। হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ) যখন কা’বা নির্মাণ করছিলেন, তখন ইবরাহীম (আ) যখন কা’বা নির্মাণ করেছিলেন, তখন তাঁরা দুইজন একত্রিত হয়ে মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন এই বলেঃ [আরবি………………]
হে আমাদের রব্ব, তুমি এই লোকদের মাঝে একজন রাসূল পাঠাও, যে তাদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শোনাবে, তোমার কিতাব ও হিকমাতের শিক্ষাদান করবে এবং তাদের পবিত্র-পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ করবে। হে আল্লাহ তুমিই হচ্ছ মহাশক্তিশালী-বিজয়ী, মহাবিজ্ঞানী।
বস্তুত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান ইসলামী আদর্শে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তি চরিত্র গঠনোপযোগী শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ব্যতীত কোন মানুষ মানুষ পদবাচ্য হতে পারে না, সামষ্টিকভাবে কোন উন্নতি-অগ্রগতিও লাভ করতে পারে না।
আল্লাহ প্রেরিত নবী-রাসূলগনই এ ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। জনগণকে আল্লাহর দ্বীন শিক্ষাদানে এবং তদনুরূপ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করে তোলবার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দানের জন্য সেই আদিকাল থেকেই প্রাণ-পণ চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। এ দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) সম্পর্কে কুরআন মজিদে বলা হয়েছেঃ [আরবি…………………….]
যেমন করে আমরা তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্যে থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে তোমাদের সম্মুখে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে, তোমাদের পবিত্র পরিশুদ্ধ করে এবং তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষাদান করে, আর তোমাদেরকে সেই সব বিষয়েই শিক্ষাদান করে, যা তোমরা জানতে না। অন্যত্র বলেছেনঃ [আরবি…………………..]
নিঃসন্দেহে আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহ করেছেন মু’মিনদের প্রতি এভাবে যে, তিনি তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের জন্য আল্লাহর তিলাওয়াত পাঠ করে, তাদের পবিত্র পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে আল্লাহর কিতাব ও হিকমাতের শিক্ষাদান করে-যদিও পূর্বে তারা সুস্পষ্ট গুমরাহির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।
এরূপ কথাই বলা হয়েছে এই আয়াতটিতেওঃ [আরবি*************************]
সেই আল্লাহই তিনি, উম্মী লোকদের মাঝে তাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে রাসূল তাদের সম্মুখে আল্লাহরই আয়াত তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ-পবিত্র করে তাদেরকে কিতাব ও হিকমাতের শিক্ষাদান করে, যদিও তারা পূর্বে সবাই চরম গুমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।
লক্ষণীয়, এই সব কয়টি আয়াতই রাসূলের চারটি কাজের তালিকা পেশ করেছে। তা হচ্ছেঃ লোকদের কাছে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করা, তাদের তাজকীয়া করা, তাদের কিতাবের তালিম দেয়া এবং হিকমাতের শিক্ষাদান। কোন আয়াতে শিক্ষাদানের কথাটি তাজকীয়া পবিত্র-পরিশুদ্ধকরণের আগে এসেছে, কোথাও এসেছে পরে। কেননা ব্যাপক অর্থে শিক্ষাদানের পরিণতিই হচ্ছে ‘তাজকীয়া’ । আর ‘তাজকীয়া’ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দ্বারাই লাভ হতে পারে। কিন্তু যেখানে ‘তাজকীয়া’-ই অতি উঁচু দরের লক্ষ্য, সেখানে তাজকীয়াকে শিক্ষাদানের পূর্বে স্থাপন করা উচিত। সে যাই হোক, রাসূলে করীম (স)-এর আগমনে যে কয়টি উদ্দেশ্য, যা তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পূর্ণ পরিণত করেছেন, তাই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। ইসলামী রাষ্ট্রকে এই কাজ করতে হবে অত্যন্ত গুরুত্ব ও দায়িত্ববোধ সহকারে।
রাসুলে করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করে উম্মী সমাজকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, যার ফলে উম্মী অশিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই প্রেরিত হয়েছিলেন।
তার আরও একটি কারণ এই যে, কুরআন মজীদে ঈমান ও ইসলামকে পরস্পর সংশ্লিষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানহীন ইল্ম বা ইলমহীন ঈমান প্রাণহীন দেব বা দেহহীন প্রাণ সমতুল্য। বাস্তবতার দৃষ্টিতে সমপূর্ণ অর্থহীন। কুরআনের আয়াতঃ
[আরবী টীকা———————————]
আল্লাহ্ উচ্চ মর্যদায় অতিষিক্ত করেন সে সবকে, যারা তোমাদের মধ্যে ঈমানদার ও ইল্ম প্রাপ্ত।
আয়াতটি থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, ব্যক্তি বা সমাজ উন্নতি-অগ্রগতি লাভ করতে পারে – ইহকাল ও পরকাল উভয় ক্ষেত্রেই-ঈমান ও ইল্ম উভয়ের সমম্বয় সংঘাটিত হলে। শুধু ঈমান দ্ধারা উন্নতি লাভ সম্ভব নয়, যেমন আল্লাহর মর্জী অনুযায়ী অগ্রগতি লাভ সম্ভব নয় ঈমানহীন ইল্ম দ্ধারা। তাই ইসলামী সেই সাথে ইলম শিক্ষাদানের জন্যও চলতে হবে।এই শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জ্ঞান- বিজ্ঞানের মধ্যে কোন পার্থক্য করা যাবে না- এক বিষয়ে শিক্ষা দান করা হবে আর অপর বিষয়ে শিক্ষাদান করা হবে না- ইসলামী রাষ্ট্রে এ নীতি অচল। বরং সকল জরুরী বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করাই কর্তব্য। শিক্ষার বিষয়বস্তুকে ‘ধর্মীয় শিক্ষা’ ও বৈষয়িক শিক্ষা’-এই দুই ভাগে বিভিক্ত করাও ইসলামের শিক্ষানীতির দৃষ্টিতে চলতে পারে না। কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে ও মানদণ্ডে সর্বপ্রকারের জরুরী ও কল্যাণকর জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাদানই ও মসলমানের চিরন্তন ঐতিহ্য।
ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বঃ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকার সংরক্ষণ
মানুষের প্রয়োজন স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধিশীল ও বিকাশমান। সভ্যতার বিকাশ ও অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষেরে নিত্য নব প্রয়োজনের দিক উম্মক্ত হয় এবং সে প্রয়োজন পরিপূরণের তাকীদ অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দেয়। ব্যক্তিগণের নিবিড় সম্পর্কের পরিণতিই হচ্ছে সমাজ। ব্যক্তির প্রয়োজন বৃদ্ধি পাওয়া। ও সম্প্রসারিত হওয়ার অর্থ, সমষ্টির প্রয়োজন বৃদ্ধি পাওয়া ও সম্প্রসারিত হওয়া। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রয়োজন ও সমষ্টির প্রয়োজনের মাঝে দ্বন্ব পবল হয়ে উঠা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এ সমস্যার সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সমধান না হলে সুস্থ সমাজ গড়ে উঠাতে পারে না।
প্রাচিনকালে এই সমস্যার সমধান করা হতো শকক্তিবলে, অস্ত্রের সাহায্যে। শক্তি ও সৈন্যবলে বলীয়ান ব্যক্তিরাই সমজের উপর সওয়ার হয়ে বসত এবং জনগণকে তাদের সম্মুখে মাথা নত করতে বাধ্য করা হতো।
কিন্তু মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা লাভের দরুন শক্তি ও অস্ত্র ছাড়াই এ সমস্যার সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে মানুষের অধিকার সংক্রান্ত জ্ঞানের সাহায্যে তা হওয়া সম্ভব। এই জ্ঞানের সাহায্যেই ব্যক্ত ও সমষ্টির প্রয়োজনের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন একান্তই জরুরী। ব্যাক্তিগণের অধিকার সংরক্ষণ এবং তারই পরিণতিতে মানব-সমাজের উন্নয়ন বিধান সংস্কৃতিসম্পন্ন (cultured) সমাজের বৈশিষ্ট্য। এ দুইয়ের মাঝে দ্বন্দ্ব ও সংঘের্ষর পরিণাম গোটা মানবতার পক্ষেই চরম বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই কানণে ইসলামী শরীয়াতে ব্যক্তি ও সমষ্টির অধিকার সংক্রান্ত বিদ্যা বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। আর এর ফলেই একমাত্র ইসলামী সমাজে ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থ রক্ষা ও প্রয়োজন পূরণের কাজ অত্যস্ত ভারসাম্যপূণভাবেই সম্ভব হয়েছে। এ দিক দিয়ে দুনিয়ার অপর কোন সমাজের কোন তুলনাই হতে পারে না ইসলামী সমাজের সাথে।
অধিকার ও প্রয়োজনকে দু ‘ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
অভ্যন্তরণী, এই উম্মতের ব্যক্তিগণের পারস্পরিক সাংঘর্ষিক সম্পর্কের সাথে জড়িত।
২. বহ্যিক বা বৈদেশিক, দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের পাস্পরিক সাংঘর্ষিক সম্পর্কের সাথে ইসলামের প্রশাসনিক বিধানে প্রথম পর্যায়ের অধিকার ও প্রয়োজন পূরণে যেমন ভারসাম্য স্থাপন করা হয়েছে, দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্ষেত্রে। ইসলাম নিধারিত অধিকার সংক্রান্ত আইন-বিধান কুরআন ও সুন্নাত থেকে নিঃসৃত। অতএব তাতে কোনরূপ রদ-বদল বা বৃদ্ধি-কমতির অবকাশ নেই।
সংখ্যালঘুদের অধিকার
ইসলামী রাষ্ট্র যেহেতু আল্লাহর দেয়া পূণাঙ্গ বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত এ কারণে নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের অধিকার আল্লাহর বিধানে পুরাপুরি স্বীকৃত। এ কারণে ইসলামী রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের অধিকার যতটা উত্তমভাবে আদায় করার ব্যবস্থা রয়েছে, ততটা অন্য কোন ব্যবস্থাধীন সমাজে কোনক্রমেই সম্ভব হতো না। তাদের এ অধিকার মানুষ হিসেবে যেমন, ইসলামের সুবিচার ও ন্যায়নীতিপূর্ণ বিধানের কারণেও তেমনই।
ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার মানবিক ও সুবিচারের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বিলিষ্ঠ ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ
[আরবী টীকা—————————————]
আল্লাহ্ তোমাদেরকে- হে মুসলিমগণ-নিষেধ করেন না এ কাজ থেকে যে, দ্বীনের ব্যাপার নিয়ে যেসব লোক তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কৃতও করেনি-তাদের সাথে তোমরা কল্যাণময় ও সুবিচারপূর্ণ নীতি অবলম্বন করবে। কেননা সুবিচারকারীদের তো আল্লাহ পছন্দ করেন-ভালোবাসেন।
এ আয়াত স্পষ্ট করে বলছে যে, যেসব অমুসলিম মুসলমানদের বিরুদ্ধে দ্বীন-ইসলামের কারণে যুদ্ধ করেনি, মুসলমানদের সাথে শক্রতা করে তাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি ও জায়গা-জমি থেকে বঞ্চিত করেনি, তারা মসলমানদের নিকট-ইসলামী রাষ্ট্রের বিশেষ মর্যাদা ও অধিকার লাভ করবে। তাদের প্রতি পূর্ণ ইনসাফ করা হবে, তাদের অধিকার পুরাপুরি আদায় করা হবে এবং তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করা হবে। ইসলামী সমাজে তারা পূর্ণ মর্যাদা এ অধিকার সহকারে পরম নিশ্চিন্ততা ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারবে। সকল প্রকারের মানবিক অধিকার পেয়ে তারা হবে পরম সৌভাগ্যবান।
কিন্তু যেসব অমুসলিম ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে শক্রতামূলক আচারণ করবে, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং মুসলামন সার্বিক কল্যাণ পরিপন্হী কাজ করবে, তাদের ব্যাপারে কুরআনের ঘোষণা নিম্নরূপঃ
[আরবী টীকা——————————]
তোমাদের সেসব লোককে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে আল্লাহ নিষেধ করছেন, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে দ্বীনের ব্যাপারে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘড়-বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করেছে ও দাপট দেখায়েছে। এ ধরনের লোকদেরকে যারাই বন্দ্ধুরূপে করবে, তারাই হবে জালিম।
অমুসলিম সংখ্যালঘদের প্রতি ইসলামের আছরণ- নীতি কি হওয়া উচিত, তা উপরোদ্ধৃত আয়াতদ্ধয় থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। এতে সন্দেহ নেই যে, ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিক বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা সহকারেই বসবাস করবে। মসলিম জনগণের কর্তব্য হচ্ছে তাদেরকে সম্পপূর্ণ শান্তিতে ও নিরাত্তায় বসবাস করার সুযোগ দেয়া। তবে তা ততক্ষণ পযর্ন্ত সম্ভব হবে, যতক্ষণ পযর্ন্ত তারা- তাদের সন্তান ও লোকজন- সংখ্যাগুরু মুসলিদের স্বাধীন অধিকার ও মর্যাদা উপর কোন বিপদ বা অসুবিধা টেনে না আনবে, যতক্ষণ তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কোন তৎপরতা না চালাবে, কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কিন্তু এসব কাজ যদি শুরু করে, যদি ইসলাম ও মুসলমানদের শক্রদের সাথে যোগসাজস বা বন্ধুত্ব করে, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রে তারা উক্তরূপে অধিকার ও সুযোগ-সবিধা পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলবে। তখন মুসলমানদের জন্য শুধু জায়েযই হবে না- কর্তব্য হবে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ও অনমনীয় হয়ে দাঁড়ানো। তখন আর তাদের প্রতি কোন বন্ধুত্ব বা দুর্বলতা পোষণ করা হবে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্বয়ং তাদেরই পদচারণা।
অমুসলিমদের প্রতি ইসলামের নমনীয়তা এতদূর যে, তাদের ধর্মমতে মদ্য পান ইত্যাদি কাজ সঙ্গত হয়-যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ-সেই কাজ করার সুযোগ পাবে। তাবে প্রকাশ্যভাবে, বিশেষ নগ্নতা সহকারে করার অনুমতি দেয়া হবে না। তা করলে দেশী আইন অর্থাৎ শরীয়াতের আইন অনুযায়ী তাদেরকে দণ্ডিত করা হবে। এছাড়া ব্যভিচার পর্যায়ের অপরাধে তাদেরকেও সেই শাস্তিই দেয়া হবে, যা অনুরূপ অপরাধে মুসলিম নাগরিকদেরও দেয়া হবে।
এরূপ অপরাধের বিচার ইসলামী আদালতের বিচারক হয় ইসলামী শরীয়াতের আইনের ভিত্তিতে করবে, না হয় বিচার করার জন্য তাদের ধর্মমতের ভিত্তিতে বিচাররের জন্য সোপর্দ করবে। কুরআনের বিধান হচ্ছেঃ
[আরবী টীকা——————————-]
ও রা যদি তোমাদের নিকট আসে (বিচার চায়, মামলা দায়ের করে) তাহলে তুমি হয় ওদের মধ্যে বিচার কার্য সম্পাদন কর, না হয় ওদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।
ইমাম কুরতুবী আয়াতটির বিস্তারিত ব্যাখ্যায় ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন বসবাসকারী অমুসলিমদের বিভিন্ন ব্যাপারে বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থার উল্লেখ করে বিভিন্ন প্রকারের নির্দেশের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ কাফিররা ইসলামী রাষ্ট্রের যিম্মী না হলে তাদের কোন বিষয়ের বিচার করার কোন দায়িত্ব ইসলামী রাষ্টের উপর বর্তয় না। হ্যাঁ যদি ইচ্ছ ও সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে তা করা যেতে পারে। আর যিম্মীদের মামলা ইসলামী রাষ্ট্রে দায়ের হলে তার বিচার অবশ্যই করা যাবে এবং তা কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ইনসাফ সহকারে করতে হবে। এ ব্যাপারে ইজমা হয়েছে যে, আহলি কিতাব লোকেরা ইসলামী সহকারে মামলা দায়ের করলে তার বিচার কার্য সম্পাদন করা কর্তব্য, তা প্রত্যাখ্যান করা বা তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা কোন কোন মনীষীর মতে কর্তব্য পালন না করার শামিল।[আরবি টিকা………………………]
আহলি কিতাব লোকদের সাথে শুভ আচরণ
ইসলাম আহলি কিতাব লোকদের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ গ্রহণের জন্য মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। তদের ধর্মমতের কোনরূপ অসম্মান না করতে বলেছে। তারা যাতে করে নিশ্চিন্তে নিজেদের ধর্স ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে পারে, তার ব্যাপারে সহযোগিতা করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ [আরবি…………………………]
তোমরা মুসলমানর আহলি কিতাব লোকদের সাথে ঝগড়া-ফসাদ, বাকবিতণ্ডা করো না। যদি কর-ই হবে তা উত্তমভাবে করবে। তবে যারা জালিম, তাদের প্রসঙ্গে এই এই নির্দেশ নয়। তোমরা বরং বলঃ আমরা ঈমান এনেছি যা আমাদের জন্য নাযিল হয়েছে তার প্রতি, আর যা তোমাদের প্রুতি নাযিল হয়েছে, তার প্রতিও।
কেননা আল্লাহর নিকট থেকে যা কিছু নাযিল হয়েছে, তা হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আ)-র প্রতি নাযিল হোক, তা সবই সত্য, তা সবই এক ও অভিন্ন ইসলাম।
নবী করীম (স) বলেছেনঃ [আরবি…………………………….]
যে লোক কোন চুক্তিবদ্ধ নাগরিকের উপর জুলুম করবে ও তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজের চাপ দেবে-করতে বাধ্য করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হয়ে দাড়াব। [আরবি টিকা………………..]
তিনি আরও বলেছেনঃ [আরবি………………………….]
যে লোক কোন যিম্মিকে জ্বালা-যন্ত্রণা দেবে, আমি তার প্রতিবাদকারী। আর আমি যার প্রতিবাদকারী হব, তার বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়াব। [আরবি…………………………..]
নবী করীম (স) নাজরান এলাকার প্রধান খৃষ্টান পাদরী আবুল হারিস ইবনে আল-কামাতাকে যে চুক্তিপত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন, তা নিম্মোক্ত ভাষায় গ্রন্হসমূহে উদ্ধৃত হয়েছেঃ [আরবি……………………………]
দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (স)-এর পক্ষ থেকে নাজরানের প্রধান পাদরী আবুল হারিস, নাজরানের অন্যান্য পাদরী, তাদের পুরোহিত, তাদের অনুসরণকারী ও রাহেবগণের প্রতি এই চুক্তি…..তাদের জন্যই থাকবে কম-বেশী যা কিছুই তাদের হাতে আছে তা সবই, তাদের উপাসনালয়, মন্দির ও রাহেব কেন্দ্র ও আচরণ। তারা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতিবেশী, কোন পাদরী তার পাদরীত্ব থেকে, কোন রাহেবকে তার বৈরাগ্য থেকে এবং পুরোহিতকে প্রত্যাখ্যান করা হবে না, তাদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব বদলানো যাবে না, তাদের উপর ধার্য রয়েছে, যে নীতিতে তারা চলছে, তাতেও কোন পরিবর্তণ আনা হবে না-যতক্ষণ তারা কল্যাণ ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখবে, তাদের উপর কোন জুলুম চাপানো হবে না, তাদেরকে জুলুমকারী হতে দেয়া হবে না।[আরবি টিকা………………………………]
এখানে নবী করীম (স) ঘোষীত এক সুদীর্ঘ চুক্তিনামার বাংলা অনুবাদ দেয়া হলোঃ
পরম অনুগ্রহশীল আল্লাহর নামে-তারই সাহয্য সহকারেঃ এটা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর সমস্ত মানুষের সাথে ঘোষিত চুক্তিনামা। মুহাম্মদ (স) আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী রূপে নিযুক্ত। আল্লাহর আমানতের আমানতদাতার তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যে, যেন জনগণ রাসূল আগমণের পর আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি পেশ করতে না পারে। আর আল্লাহ তো মহা পরাক্রমশালী সুবিজ্ঞানী। মুহাম্মদ (স) এই চুক্তিনামা লিখেছেন তাঁর সময় মিল্লাতের লোকদের জন্য, পূর্ব ও পশ্চিম এলাকায় বসবানকারী খৃষ্ট ধর্মবিশ্বাসী সমস্ত লোকদের জন্য। তার নিকটবর্তী ও দূরবর্তী, তাদের স্বভাষাভাষী, তাদের কম বাকপুট, তাদের পরিচিত অপরিচিত সব মানুষের জন্য। এই লিখনীটি মূলত তাদের সঙ্গে কৃত এক চুক্তিনামা-ওয়াদাপত্র।এই ওয়াদা যে ভঙ্গ করবে, তার বিরুদ্ধতা করবে, এতে যে আদেশ দেয়া আছে তার বিপরীত কাজ করবে, সে আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা-চুক্তি ভঙ্গ করেছে, তাঁর দ্বীনের প্রতি অপমান ও বিদ্রূপ করেছে, এজন্য সে লা’নতে পড়ার যোগ্য হয়েছে, শাসন কর্তৃপক্ষ হোক বা মু’মিন মুসলিমের মধ্য থেকে কেই হোক। কোন রাহেব বা সাধক পাহাড়ে, উপত্যকায়, গুহায়, সভ্য এলাকায়, প্রস্তরময়, বালুকাময়, কুটিরবাসী, মন্দির যেই হোক-না-কেন, আমি-ই তাদের সকলের পৃষ্টপোষকতার দ্রবীভূত হব, তাদের সংখ্যকের জন্য, আমি নিজে এবং আমার সহায়তাকারী আমার মিল্লাতের ও আমার অনুসরণকারী লোক। ওরা যেন আমার রক্ষণাবেক্ষণ অধীন, আমার দায়িত্বভুক্ত, যুক্তিবদ্ধ লোকেরা খারাজ ইত্যাদির যে বোঝা বহন করে, সেই কষ্টদায়ক অবস্হা তাদের থেকে আমি দূর করব, তবে তারা যা খুশী হয়ে দেবে তাই গ্রহণ করব, তাদের উপর কোন জোর খাটাব না, কোন ব্যাপারেই তাদের উপর জবরদস্তি করা হবে না। কোন পাদরীকে তার পদ থেকে বিচ্যুত করা হবে না, কোন রাহবকে তার বৈরাগ্য থেকে বিরত রাখা হবে না, কোন ধ্যাণমগ্ন ব্যক্তিকে তার ধর্ম কেন্দ্র থেকে বহিষ্কৃত করা হবে না, কোন বাউলকে তান বাউলী কাজ থেকে ফিরানো হবে না, তাদের গির্জা, মন্দির, ধর্ম কেন্দ্রকে ধ্বংস করা হবে না, তাদের গির্জা বা ধর্মকেন্দ্রের কোন জিনিস মসজিদ নির্মাণে ব্যবহার করা হবে না, মুসলমানদের ঘর-বাড়ি নির্মাণে ব্যবহার করা হবে না। যদি তা কেউ করে, তবে সে আল্লাহর প্রতিশ্রুতিই ভঙ্গ করল, তার রাসূলের বিরুদ্ধতা করল। রাহেব, পাদরী,পুরোহিত ও অন্যান্য ধরনের উপাসনাকারীদের উপর কোন জিযিয়া বা জরিমানা ধার্য কারা হবে না। তারা যেখানেই বাস করুক, স্থলেভাগে বা নদী-সমুদ্রে, পূর্বে বা পশ্চিমে, উত্তরে বা দক্ষিণে- তাদের সকলের দায়িত্ব আমি পালন করব, সংরক্ষণ করব। তারা সকলেই আমার যিম্মায়, আমার চুক্তিতে এবং সকল প্রকার অবাঞ্চিত অবস্থার মধ্যে পূর্ণ নিরাপত্তা থাকবে।
অনুরূপভাবে যারা পাহাড়-পর্বতে, অন্যান্য পবিত্র স্হানে ইবাদতে এককভাবে রত হয়ে আছে, তারা চাষাবাদ করলেও তাদের উপর ওশর বা খারাজ ধার্য হবে না। তাদের বিলাস বহুল জীবন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভাগ বসানো হবে না, বরং তারা ফসল পেলে একই পরিমান পাত্র ব্যবহারে তাদের সাথে সহযোগিতা করা হবে, যুদ্ধে যেতে তাদের বাধ্য করা হবে না,জিযিয়া বা খারাজ দিতে ও বাধ্য করা হবে না। ধনশালী, জামি-জায়গার মালিক ও ব্যবসায়ীদেরকে প্রতি বছর মাত্র বারো দিরহাম দিতে বলা হবে। কারোর উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানো হবে না, তাদের সাথে ঝগড়া বিবাদ করা হবে না, শুধু উত্তম ও যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তাই বলা হবে। তাদের জন্য দয়ার বাহু বিছিয়ে দেয়া হবে, তারা যেখানেই ও যে অবস্থাই থাকুক, সব রকমের খারাপ আচরণ থেকে তাদের রক্ষা করা হব।
মুসলমানদের নিকট কোন খৃষ্টান বসবাস করলে সে তা-ই দেবে, যা দিতে সে রাযী হবে। তাকে তার উপাসনালয়ে প্রতিষ্টিত রাখা হবে এবং তার ও তার ধর্মীয় নিয়ম-নীতি পালনের মাঝে কোন আড়াল দাঁড়াতে দেয়া হবে না।
যে লোক আল্লাহর এই চু্ক্তির বিরুদ্ধতা করবে, এর বিরুদ্ধে শক্ত হয়ে দাঁড়াবে, সে আল্লাহর ও তার রাসূলের প্রতিশ্রুতির নাফরমানী করল। তাদের উপাসনালয় মেরামতে তাদের সাহায্য করা হবে, এটা হবে তাদের ধর্ম পালনের ব্যাপারে তাদের প্রতি সাহায্য ও সহযোগিতা। তা করা হবে চুক্তি পরিপূরণ স্বরূপ। তাদেরকে অস্ত্র বহনে বাধ্য করা হবে না, মুসলমানরাই তাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। কিয়ামত কায়েম হওয়া ও এই দুনিয়ার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত মুসলমানরা এই চুক্তিকে রক্ষা করবে, এর বিরুদ্ধতা করবে না।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (স) লিখিত এই চুক্তি সমস্তে খৃষ্টানদের জন্য এবং এর মধ্যে লিখিত যাবতিয় শর্ত রক্ষার ব্যাপারে সাক্ষী হলেন হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা) । [আরবি টিকা…………….]
হযরত মুহাম্মদ (স) বিরচিত এই সুদীর্ঘ চুক্তিনামায় তিনি খৃষ্টানদের জন্য যে কয়েকটি বিষয়ের প্রতিশ্রূতি দিয়েছেন, তা তিন পর্যায়ে বিভক্তঃ
১.ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ইসলামের দেয়া বিশ্বাসগত পূর্ণ স্বাধীনতা;
২. ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার এসব সংখ্যালঘুদের জন্য আনুকুল্য ও সমর্থনের বিশালতা ব্যাপকতা;
৩. সংখ্যালঘুদের জন্য দ্বীন-ইসলামের দয়া-অনুগ্রহের ব্যাপকতা।
বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে বসবাসকারী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে এসবই হচ্ছে ইসলামের চিরন্তন ও শাশ্বত নীতি। বিশ্বের অপর কোন ধরনের বা আদর্শের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এর কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। যখন-ই এবং যেখানেই ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হবে, সেখানেই অমুসলীম সংখ্যালঘুদের এরূপ অবাধ অধিকার দেয়া হবে।রাসূলে করীম (স) এর পর খুলাফায়ে রাশেদুন এই চুক্তিনামার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন, ইতিহাস তার অকাট্য প্রমাণ পেশ করে।
খলীফা উমর (রা) একজন বৃদ্ধ ইয়াহুদীকে দুয়ারে ভিক্ষা করতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ তোমার এ অবস্থা হলো কেন? সে বললঃ জিযিয়া দেয়ার বাধ্যবাধকতা, প্রয়োজন, অভাব এবং বার্ধক্য। খলীফা তার হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন এবং নিজের নিকট থেকেই তার প্রাথমিক ও তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণ করে দিলেন এবং বায়তুলমাল পরিচালককে এই ব্যক্তির অবস্থানুযায়ী প্রয়োজন পূরণ সাসিক ভাতা নির্ধারণের নির্দেশ দিলেন। বললেনঃ [আরবী******************************]
এই লোকটির যৌবনকাল তো সমাজের কাজে আতব্যাহত হয়েছে, আর এখন এই বৃদ্ধকালে তাকে অসহায় করে ছেড়ে দেব, এটা কখনই ইনসাফ হতে পারে না। -[আরবী টীকা*******************]
চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রা) এক বৃদ্ধ খৃষ্টানকে লোকদের নিকট ভিক্ষা চাইতে দেখে বললেনঃ [আরবী***********************]
তোমরা এই লোকটিকে কাজে লাগিয়েছ, এখন সে বৃদ্ধ ও অক্ষম, আর এখন তোমরা তাকে রোজগার থেক বঞ্চিত করেছ। এটা হতে পারে না। তোমরা বায়তুলমাল থেকে তার প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা কর। -[আরবী টীকা****************]
ইসলাম শুধু জীবিত মানুষের জন্যই সম্মানজনক ব্যবস্থা করেনি, মৃত মানুষ –অমুসলিমের –প্রতিও সম্মান প্রদর্শনের নীতি গ্রহণ করেছে। একটি ‘জানাযা’ (লাশ) বহন করে নিয়ে যেতে দেখে নবী করীম (স) দাঁড়ালেন। বলা হলো, ইয়া রাসূল! এ তো এক ইয়াহুদির জানাযা। তিনি বললেবঃ কেন, ইয়াহুদি কি মানুষ নয়? তিনি বললেনঃ [আরবী********************************]
তোমরা যে কোন জানাযা বহন করে নিয়ে যেতে দেখলে অবশ্যই দাঁড়াবে। -[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড. পৃ. ৮৫।]
অমুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি ইসলামের এই উদার মানবিক আচরণ দেখেই তো তদানীন্তন দুনিয়ার অমুসলিম জনতা ইসলামী দেশজয়ীদেরকে সাদর সম্বর্ধনা জানিয়েছে দেশে দেশে। তারা তাদের স্বধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জন্য তাদের নগরীর ফটক খুলে দিয়েছে। হযরত আবূ উবায়দাতা ইবনুল জাররাহ (রা)-র নেতৃত্বে ইসলামী মুজাহিদগণ যখন জর্দান এলাকায় উপনীত হলেন, তখন জর্দানের খৃষ্টানগণ তাকে এক পত্র লিখে জানালঃ [আরবী******************************]
হে মুসলিম বাহিনী! তোমরা আমাদের নিকট রোমানদের তুলমায় অনেক বেশী প্রিয়, পছন্দনীয়, যদিও ওরা ও আমরা একই ধর্মে বিশ্বাসী ও পালনকারী। কিন্তু তোমরা আমাদের জন্য অধিক পূণ্যশীল। আর ওরা আমাদের উপর শাসন চালিয়েছে, সেই সময় আমাদের ঘর-বাড়ী, ধন-মাল সব লুটে নিয়েছে। -[টমাস আর্নল্ডঃ ‘ইসলামের দাওয়াত’ গ্রন্থ. পৃঃ ৫৩]
ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের প্রতি ইসলামের এই উদার মানবিক নীতি কার্যকর হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছেঃ
প্রথম, শান্তি নিরাপত্তা বিনষ্টকারী কোন কাজ-ই তারা করবে না, যেমন মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, মুসলমানদের শত্রু মুশরিকদের সাহায্য-সহযোগিতা করা –মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে মুসলমানদের কল্যাণ পরিপন্থী কার্যক্রম গ্রহণ করা।
দ্বিতীয়, ইসলামী রাষ্ট্র সরকার তাদের দেয় হিসেবে যা ধার্য করবে, তা দিতে এবং পালন করার জন্য যেসব আদেশ-নিষেধ জারি করবে, তা পালন করতে বাধ্য থাকবে। এবং
তৃতীয়, জিযিয়া দিতে বাধ্য ও রাযী হওয়া।
এসব শর্ত পূরণ যিম্মী হওয়ার –ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে তাদের দায়িত্ব গ্রহণের ভিত্তিরূপে পরিগণিত। এ ছাড়াও চুক্তি হিসেবে যেসব শর্ত গ্রহণ করা হবে, তা-ও অবশ্যই পালন করতে হবে। -[আরবী টীকা*******]
ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইসলামী রাষ্ট্রে পূর্ণ স্বাধীনতা সহকারে জীবন যাপন করবে। তারা সেই সব অধিকার পাবে, যা পাবে মুসলিম নাগরিকগণ। তাদের উপর সেই সব দায়িত্ব কর্তব্য চাপবে মুসলমান নাগরিকদের উপর। তা সামষ্টিক অধিকার যেমন, তেমনি অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ও বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতা –এই সব দিক দিয়েই। ইসলামী রাষ্ট্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট এই যে, তাতে শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্র বিপুলভাবে বিস্তারিত ও সম্প্রসারিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য, তাদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হয়, তাদের জান-মাল ও ইযযত-আবরুর পূর্ণ সংরক্ষণ হয়, তাদের প্রতি অকারণ কোন সন্দেহ বা শত্রুতা পোষণ করা হয় না। অবশ্য তা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পূর্ণ নিষ্ঠা সহকারে সন্ধি-চুক্তির শর্তাবলী পালন করতে থাকবে।
এরূপ অবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্রের যিম্মীদের এই অধিকার দেয়া হবে যে, তাদের ধর্মীয় ব্যাপারাদি পরিচালনের জন্য তারা চাইলে তাদের লোকদেরই সমন্বয়ে একটি স্বাধীন বোর্ড গঠন করা যাবে। তাদের মন্দির, গির্জা বা মঠ ইত্যাদি উপাসনালয়ের ব্যবস্থাপনাও তারা স্বাধীনভাবে করবার অধিকারী হবে। তাদের বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা স্বতন্ত্রভাবেও করা যেতে পারে। বিশেষভাবে তাদের বিষয় ব্যাপারাদির মীমাংসার কাজ তাদের লোকদের দ্বারা গঠিত বিচার-ব্যবস্থার মাধ্যমে আঞ্জাম দিতে পারবে। আর ইচ্ছা হলে দেশীয় আদালতেও তা নিয়ে আসতে পারবে। স্থানীয় মুসলিম নাগরিকদের সাথে কোন ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হলে তারা সেই বিষয়ে মীমাংসা বা সুবিচার পাওয়ার লক্ষ্যে দেশীয় কোর্টে মামলাও দায়ের করতে পারবে।
অমুসলিম যিম্মী মুসলিম শাসক বা প্রশাসক কর্মমর্তার বিরুদ্ধে ন্যায্যা অভিযোগও দায়ের করতে পারবে। শালীনতা ও আইনসিদ্ধতা সহকারে তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ও সরকারী নীতি কার্যক্রমের সমালোচনাও করবার অধিকারী হবে।
খৃষ্টান ঐতিহাসিক রবার্টসন লিখেছেনঃ
দুনিয়ায় মুসলমানগণ এমন এক জাতি, যারা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর প্রতি জিহাদ ও ক্ষমা –উভয়কে সমন্বিত করেছে। মুসলমানরা তাদের উপর বিজয়ী হয়েও এবং কর্তৃত্ব লাভ করবার পরও তাদেরকে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি স্বাধীণভাবে পালন করার অবাধ ও নির্বিঘ্ন সুযোগ করে দিয়েছেন। -[আরবী******************]
জিযিয়া
সকলেরই জানা কথা, ইসলাম আহলি কিতাব লোকদের উপর বিজয় লাভ করে তাদের উপর জিযিয়া ধার্য করে। কিন্তু জিযিয়া ধার্য হওয়া তাদের জন্য কোন অপমানের ব্যাপার নয়। এটা একটা বিশেষ ‘কর’, যা কেবল অমুসলিম নাগরিকদের নিকট থেকে আদায় করা হয়, ঠিক যেমন মুসলিম নাগরিকদের নিকট থেকে আদায় করা হয় যাকাত, এক-পঞ্চমাংশ ও অন্যান্য বহু প্রকারের সাদকা। আর এই কারণেই অক্ষম, পুঙ্গ, বৃদ্ধ, পাগল, বালক নারীদের থেকে তা নেয়া হয় না। কেননা জিযিয়া আয় অনুপাতে ধার্য হয়ে থাকে।
অবশ্য রাষ্ট্র-সরকার ইচ্ছা করলে জিযিয়া জমির পরিবর্তে মাথাপিছু কিংবা মাথাপিছুর পরিবর্তে জমির উপর-ও ধার্য করতে পারে। এই সময় পাশাপাশি বসবাসকারী মুসলমানদের নিকট থেকেও তো অনেক প্রকারের কর আদায় করা হয়। অমুসলিমদের নিকট থেকে জিযিয়া ভিন্ন অন্য কিছু আদায় করা হয় না। উপরন্তু তা ব্যক্তির সাধ্যের বেশী কখনই ধার্য করা হয় না। এজন্য ইসলামে কোন পরিমাণ স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট নেই।
আল্লামা সাইয়্যেদ রশীদ রেজা লিখেছেনঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে জিযিয়া সেই ধরনের কোন কর নয়, যা কোন দেশের বিজয়ী বাহিনী বিজিতদের উপর সাধারণভাবে ধার্য করে থাকে, ধার্য করে থাকে বড় পরিমাণের জরিমানা, যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতির পরিপূরণার্থে। জিযিয়া মূলত খুবই সামান্য পরিমাণে ধার্য করা হয় এবং তদ্দারা সেই প্রয়োজিন পূরণ করা হয়, যা তাদের বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনে সরকারকে ব্যয় করতে হয়। – [আরবী টীকা***********]
বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্র এর বিনিময়ে অমুসলিমদের রক্ষণাবেক্ষণের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। আর এর-ই ফলে যে-কোন অমুসলিম নাগরিক পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা সহকারে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে পারে, বাঁচাতে পারে তাদের মান-সম্মান ও ধন-মাল।
যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সাথে অমুসলিমরা আবহমান কাল থেকে বসবাস করে আসে, তথায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর-ও সে সব অমুসলিম সেই দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করবে না –বরং অমুসলিম হয়েও ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত নাগরিক হয়ে বসবাস করতে প্রস্তুত হবে, তারা সরকারের নিকট থেকে সর্ব প্রকারের ব্যাপারে পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে, সরকার তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আর এ জন্য তার নাম ‘জিযিয়া’ই হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। -গ্রন্থকার