জরুরী সংযোজন
বর্তমান সময়ে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও ইসলামী আদর্শবাদী ব্যক্তিবর্গের দ্বারা পরিচালিত সরকারকে সর্বসম্মতভাবে কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে রচিত সংবিধানের পুরোপুরি অনুসরণকারী করে রাখা এবং তাকে আদর্শ বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার জন্য একটি বিশেষ ও অম্যেঘ ভাবে কার্যকর পন্হা গ্রহণ করা একান্তই জরুরী মনে করি। সে পন্হাটি এই হতে পারে যে, দেশের সর্বজন পরিচিত, কুরআন ও সুন্নাহর গভির ও ব্যাপক ইলম-এর ধারক এবং তাকওয়া-পরহেযগারীর দিক দিয়ে পরীক্ষিত ও আস্থাভাজন ব্যক্তিকে ‘ইসলামী আদর্শের সংরক্ষক’ মর্যাদায় নির্বাচিত করা হবে, যাকে সকল প্রকারের প্রসাশনিক কর্তৃত্ত ও দায়িত্ব থেকে দূরে ও নিঃসম্পর্ক রাখা হবে। সংবিধানের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন বা কুরআন ও সুন্নাহর বিরুদ্ধতা দেখলে সে কঠোর হাতে তা দমন করবে এবং শুধু এই ব্যাপারে তার কথাই হবে চূড়ান্ত। অবশ্য এ পর্যায়ে তার বক্তব্য হতে হবে অকাট্য দলীল প্রমাণভিত্তিক।
এ কথা স্বীকৃত ও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলো শুধু পদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাখ্যা এবং যোগ্যতার মান বা শর্তসমূহ জনগণের নিকট পেশ করে স্বতন্ত্রভাবে এই পদে একজন বিশেষ ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা যেতে পারে।–গ্রন্হকার
যুক্তিসঙ্গত স্বাধীনতার নিরাপত্তা
স্বাধীনতা মানুষের নিকট সর্বাধিক প্রিয় বস্তু। বিশ্বমানবতা স্বাধীনতার জন্যই সর্বাধীক সংগ্রাম করেছে, লড়াই করেছে ও অকাতরে প্রাণ কুরবান করেছে। অতএব ‘স্বাধীনতা’ নিশ্চয়ই একটি পবিত্র ভাবধারাসম্পন্ন শব্দ। এ জন্য ব্যক্তি যেমন পাগলপারা, তেমনি পাগলপারা গোষ্ঠী, গোত্র ও জাতি। বিশেষ করে পরাধীন বা দুর্বল জনসমষ্টি তো স্বাধীনতার জন্য এতই উদগ্রীব যে, তা না হওয়া পর্যন্ত তারা স্বস্তির নিঃশ্বাসও ছাড়তে প্রস্তুত নয়।যে কোন উপায়েই হোক, স্বাধীনতা লাভের জন্য তারা সর্বক্ষণ চেষ্টায় নিরত থাকে। তবে দুনিয়ায় স্বাধীনতা লাভের জন্য লোকেরা যত কুরবানী দিয়েছে, রক্তের বন্যা বহিয়েছে, সেই অনুপাতে স্বাধীনতা খুব কমই অর্জীত হয়েছে। আর স্বাধীনতা অর্জিত হলেও তার সুফল লাভ করা খুব কম সংখ্যক লোকের ভাগ্যই সম্ভবপর হয়েছে। ফলে যুগ যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে দুনিয়ায় স্বাধীনতার সংগ্রাম চলা সত্তেও আজও দুনিয়ার মানুষের অধিকাংশই প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত, স্বৈর শাসন বা সাম্রাজ্যবাদী শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত।
স্বাধীনতা কি
স্বধীনতা বলতে কি বোঝায়, কি তার সংজ্ঞা- এ নিয়ে দুনিয়ার দার্শনিক- রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অনেক চিন্তা-গবেষণা করেছেন, অনেক লেখনী চালিয়েছেন।
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্টেস্কো বলেছেনঃ
স্বাধীনতা হচ্ছে আইনের দৃষ্টিতে বৈধ সব কিছু করার- করতে পারার অধীকার। আইনে নিষিদ্ধ কোন কাজ করলে সে স্বাধীনতা হারাল, বুঝতে হবে। কেননা একজন যেমন আইন বিরোধী কাজ করেছে, তার দেখাদেখি অন্যরাও তেমন আইন বিরোধী কাজ করতে পারে।[আরবী টীকা…………..]
অন্যান্যরা বলেছেনঃ স্বাধীনতা হচ্ছে ব্যাক্তির যে কোন উত্তম চিন্তা বা কাজের পথে কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকা। স্বাধীনতার বহু কয়টি সংজ্ঞার মধ্যে একটি সংজ্ঞাকে ব্যাপক ও পূর্ণঙ্গ মনে করা যেতে পারে। তা হচ্ছেঃ ‘স্বাধীনতা’ অর্থ হচ্ছে সমাজ পরিপ্রেক্ষিত এমন হবে যে, প্রত্যেকটি নাগরিককই তথায় স্বীয় যোগ্যতা ও প্রতিভার বাস্তব প্রকাশ ও বিকাশ দানের সুযোগ পাবে, এর পথে কোন প্রতিবন্ধকতা আসবে না।
আল্লাহর নবী-রাসূলগণ এই স্বাধীনতার পয়গাম নিয়েই দুনিয়ায় এসেছেন এবং তাঁদের পেশ করা দাওয়াতের সারনির্যাস বা চরম লক্ষ্যই হচ্ছে ব্যক্তিদের এই স্বাধীনতা। কেননা সমাজের লোকেরা নানা প্রকার বাধা প্রতবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকে, তাদের উপর চাপানো থাকে মানুষের অকারণ চাপিয়ে দেয়া নানাবিধ দুর্বহ বোঝা। মানুষ মানুষের-কিংবা মানব রচিত আইন-বিধান ও রসম-রেওয়াজের শৃঙ্খলে থাকে বন্দী হয়ে।
মানুষকে সেই সব থেকে মুক্তিদান করাই হয় নবী-রাসূলগণের লক্ষ্য ও সাধনা। তাঁরা এমন এক সমাজ-পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সংগ্রাম চালাতে থাকেন, যার ফলে সব বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও ভুল ভাবে চাপানো সব বোঝা নিঃশেষ হয়ে যাবে, মানুষ সে সব কিছু থেকে মুক্তি লাভ করে কেবলমাত্র এক আল্লাহর দাসত্ব ও এই রাসূলের নেতৃত্ব মেনে চলতে পারে। এ ভাবেই যেন তারা তাদের মধ্যে নিহিত সব যোগ্যতা-প্রতিভার বিকাশ দান করতে পারে এবং যোগ্যতানুযায়ী কাজ করার পথে যেন কোনরূপ প্রতিবন্ধকতার দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়ে না পড়ে।
স্বাধীনতার কয়েকটি দিক
স্বাধীনতার কয়েকটি দিক বা পর্যায় রয়েছেঃ নিম্নলিখিতগুলি উল্লেখ্য ও গুরুত্বপূর্ণঃ
১. ব্যাক্তি-স্বধীনতা
২. চিন্তা ও আকীদা-বিশ্বাসের স্বাধীনতা
৩. রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও
৪. সমআলোচানর অধিকার
৫. নাগরিক স্বাধীনতা।
প্রত্যেকটি পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হচ্ছেঃ
১. ব্যাক্তি-স্বাধীনতঃ মৌলিকভাবে ও প্রকৃতপক্ষে কোন ব্যাক্তির উপর অপর কোন ব্যাক্তির কোন প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। প্রত্যেকটি মামুষই মুক্ত ও স্বাধীন জন্মগভাবেই।কেউ-ই কারোর অধীন নয়, দাস নয়, নয় মনিব। সকলে মানুষ সমান মর্যাদার ও সমান অধীকারের।
এ দৃষ্টিতে স্বাধীনতা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্মগত ও স্বভাবগত অধিকার। তা কারোর কাউকে দেয়া বা নেয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। অতীতকালের কয়েকজন দার্শনিক এর বিপরীত মত দিয়ে গেছেন। তাঁদের মতে, আল্লাহ তা ‘আলা মানুষকে মনিব ও দাস- এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। দাসরা স্বাধীন লোকদের সেবা ও খেদমত করার জন্যই দৈহিক শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। তাই স্বাধীন ব্যক্তিদের বিশেষত্ব ও অধিকারের কোন অংশই দাসদের প্রাপ্য হতে পারে না।
কিন্তু এই গ্রন্হকারের মতে প্রকৃত স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, ব্যক্তির নিজ ঈমান- আকীদা অনুযায়ী নির্বিঘ্নে কাজ করার অবাধ অধিকার। ব্যক্তি যখন নবী-রাসূলগণ থেকে এক আল্লাহর দাসত্ব কবুলের আহবান গ্রহণ করে ও তদানুযায়ী আল্লাহর বিধান পালন করে জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত ও সংকল্প গ্রহণ করে, তখন তার এরূপ জীবন যাপনে সমাজ-পরিবেশ থেকে তাতে আনুকূল্য পেলে বুঝতে হবে, সেই ব্যক্তি প্রকৃতই স্বাধীন, সে সমাজও স্বাধীন। অন্যথায় নির্ঘাত পরাধীনতা।
হযরত মূসা (আ) আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে যখন ফিরাউনের নিকট উপস্থিত হয়ে বনী ইসরাইলীদের মুক্ত করে দেয়ার আহবান জানালেন, তখন ফিরাউন বলেছিলঃ [আরবী*****************************]
তুমি যখন শিশু ছিলে তখন কি আমরা তোমাকে লালন-পালক করিনি?…..
(আর আজ তুমি আমার বিরুদ্ধতা করার জন্য উঠে গড়ে লেগে গেছ?)
জবাবে হযরত মূসা (আ) বলেছিলেনঃ
[আরবী*****************************]
তুমি আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছ, সেটা তো ছিল আমার জন্য আল্লাহর আয়োজিত একটি ব্যবস্থার নিয়ামত। আর সেই কথার দোহাই দিয়ে কি ইসরাইলী বংশের লোকদের তুমি তোমার দাসানুদাস বানিয়ে রেখেছ?
অর্থাৎ অতীতে তুমি যদি কোন কারণে কোন ভালো কাজ করে থাক তাহলে সেই ভালো কাজের দোহাই দিয়ে আজ বিপুল সংখ্যক মানুষ –একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে –নিকৃষ্ট দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করে রাখবে, এটা কোন দিক দিয়েই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। কেননা মানুষকে দাস বানিয়ে রাখা –মানুষের স্বাধীনতা হরণ করার সাথে কারোর কোন অনুগ্রহের তুলনা হতে পারে না। স্বাধীনতা বঞ্চিত অবস্থার ন্যায় মানুষের চরম দুর্গতিপূর্ণ অবস্থা আর কিছু হতে পারে না। আহলি কিতাব লোকেরা তাদের নেতা-পণ্ডিত-পুরোহিতদের নিকট নিজেদের স্বাধীনতাকে বিক্রয় করে দিয়েছিল। তাদের হুকুম ও ফয়সালা বিনা শর্তে ও নির্বিচারে মেনে নিত। এ জন্য আল্লাহ তীব্র ভাষায় তাদের সমালোচনা করেছেন (সূরা আত-তওবাহঃ ৩১)। কেননা আল্লাহ তো মানুষকে মুক্ত ও স্বাধীন সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তারা নিজেরাই সে স্বাধীনতা পরিহার করে নিজেদেরকে তাদেরই মত মানুষের দাসত্ব-শৃঙ্খলে বন্দী করে দিয়েছে। মানুষের জন্য এর চাইতে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে। অথচ আল্লাহর ইচ্ছা এই ছিল যে, মানুষের উপর তাদেরই মত মানুষের কোন কর্তৃত্ব হবে না, কর্তৃত্ব হবে একমাত্র আল্লাহর আর এ লক্ষ্যেই কুরআন তাদের আহবান জানিয়েছেন এই বলেঃ
[আরবী**************************************]
হে কিতাবওয়ালা লোকেরা! তোমরা আস এমন একটি বাণীর দিকে, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে সমানভাবে গ্রহণীয় ও কল্যাণকর। তা এই যে, আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই দাসত্ব করব না, তাঁর সাথে কাউকে শরীক বানাবো না এবং আমরা পরস্পরকে রব্ব-ও বানাব না এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে।
কুরআন তো মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার এবং তাদের মধ্যে স্বাধীন মর্যাদার প্রাণ-শক্তি জাগিয়ে তোলার আদর্শ নীতি ঘোষণা করে দিয়েছিল এই বলেঃ
[আরবী************************************]
ইযযত-মর্যাদা ও শক্তি-দাপট রয়েছে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য এবং মু’মিন লোকদের জন্য। কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।
কুরআন এই অভয় বাণীও শুনিয়েছেঃ
[আরবী******************************************]
তোমরা সাহসহীন হয়ো না, দুশ্চিন্তাক্লিষ্ট হয়ো না, তোমরাই তো সর্বোচ্চ মর্যাদাভিষিক্ত, যদি তোমরা বাস্তবিকই ঈমানদার হও।
বস্তুত কুরআন মানুষকে যে ঈমানের আহবান জানিয়েছে, সেই ঈমানই হচ্ছে তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা রক্ষার একমাত্র অবলম্বন। সেই ঈমান যদি থাকে, তাহলে মানুষ কখনই নিজেকে তারই মত অন্য মানুষের দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দী করে –তারই মত মানুষকে ভয় করে নিজেকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতে পারে না। তাই হযরত উমর ফারুক (রা) মানুষকে মানুষের নিকট লাঞ্ছিত, অপমানিত ও নির্যাতিত হতে দেখে অত্যন্ত ক্রোধ সহকারে বলেছিলেনঃ [আরবী*******************************]
তোমরা মানুষকে কবে থেকে দাস বানাতে শুরু করলে, তাদের মায়েরা তো তাদেরকে স্বাধীন মুক্ত অবস্থায়ই প্রসব করেছিল!
হযরত আলী (রা) বলেছেনঃ [আরবী**************************************]
মহান আল্লাহ তো মু’মিনদেরকে সব কিছুই সোপর্দ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের নিজেদেরকে অপমানিত করার কোন অধিকার দেন নি।
ইসলামের ঘোষিত ঈমানের কালেমা [আরবী*************] এমন বিপ্লবী বাণী, যার প্রতি ঈমান থাকলে কোন লোকের পক্ষেই এক আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ ও একমাত্র রাসূলের নেতৃত্ব অনুসরণ ব্যতীত অন্য কারোর দাসত্ব করা এবং অন্য কারোর নেতৃত্ব মেনে চলার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। আল্লাহ তো তাঁর সর্বশেষ নবী-রাসূল (স)-কে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেনই এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি মানুষকে সকল প্রকার দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন করে দেবেনঃ [আরবী**********************************]
রাসূল তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র-উত্তম জিনিস হালাল ঘোষণা করবে, যাবতীয় নিকৃষ্ট-মন্দ-খারাপ জিনিসকে হারাম ঘোষণা করবে এবং তাদের উপর থেকে সব দুর্বহ বোঝা ও নিগ্রহকারী শৃঙ্খলকে –যা তাদের উপর চেপে বসেছে –ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে।
২. চিন্তা-বিশ্বাসের স্বাধীনতাঃ ব্যক্তি-স্বাধীনতার পর-পরই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা। তার অর্থ –প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ মত একটা বিশ্বাস গ্রহণের স্বাধীনতা পাবে, যে-চিন্তা গবেষণা চালাবার যোগ্যতা আছে, তা সে স্বাধীনভাবে চালাতে পারবে, তাকে অপর কারোর চিন্তা গ্রহণ করতে জোরপূর্বক বাধ্য করা হবে না। কুরআন মজীদ-এই দিকেই ইঙ্গিত করেছে এ আয়াতটি দ্বারাঃ [আরবী*********************************]
দ্বীন গ্রহণে কোন জোর খাটানো চলবে না। প্রকৃত হেদায়েত ও প্রকৃত গুমরাহী এক্ষণে স্পষ্ট, পরিস্ফুট ও প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।
আল্লাহ তার রাসূলকে পাঠিয়েছেন মানুষকে হেদায়েত করার লক্ষ্যে। কিন্তু তাঁর ক্ষমতা ও দায়িত্ব কতখানি? [আরবী***************************************************]
সে যা-ই হোক, হে নবী! তুমি উপদেশ দিতে ও নসীহত করতে থাক। কেননা তুমি তো একজন উপদেশ দানকারী রূপে নিযুক্ত ব্যক্তি মাত্র। তুমি তো কারোর উপর জোর প্রয়োগকারী রূপে নিযুক্ত নও। অতএব ইসলাম কারোর উপর ইসলামী আকীদা গ্রহণের জন্য জোন চালায় না, শক্তি প্রয়োগ করে না। তা চালাবার অধিকারও কাউকে দেয় না। কাউকে অন্য ধর্মমত থেকে ফিরিয়ে আনবার বা তা গ্রহণে বাধাদানের পক্ষপাতী নয়।
তবে এ কথা ঠিক যে, ইসলাম কোন মুসলিমকে ইসলাম ত্যাগ করার ও অন্য ধর্মমত গ্রহণ করার অনুমতি দেয় না। কেননা তা করা হলে তো দ্বীন ইসলামের চরম অবমাননা হবে, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। এইজন্য ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলাম ত্যাগকারী ব্যক্তি ‘মুরতাদ’ বলে অভিহিত এবং মৃত্যুদণ্ডই তার জন্য স্থিরীকৃত। কেননা তার এ কাজ দ্বীন-ইসলামী, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে চরম শত্রুতামূলক কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়, আর তা করার সুযোগ কাউকেই দেয়া যেতে পারে না। দ্বীন-ইসলামের ব্যাপারে কারোর মনে প্রশ্ন থাকলে বা সন্দেহ-সংশয় জাগলে তার জবাব দেয়া ও তাকে শাস্ত করার দায়িত্ব, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের। এজন্য দ্বীন-ইসলামের শিক্ষা ব্যাপক করার, নাগরিকদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্বও ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর অর্পিত হয়েছে। মানুষকে অশিক্ষিত রাখা –অশিক্ষিত হয়ে থাকতে দেয়া মানবতার অপমান, মানবতার বিরুদ্ধে পরম শত্রুতারূপে বিবেচিত।
তাই ইসলামী রাষ্ট্রে অসুস্থ, অনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় আদর্শ-পরিপন্থী এবং তার সাথে সাংঘর্ষিক চিন্তার কোন অবকাশ থাকতে পারে না; কিন্তু সুস্থ চিন্তা ও কল্যাণময় জ্ঞানচর্চা স্বাধীনভাবে চলতে পারে, তার উপর কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে না। শুধু তাই নয়, সেজন্য বিপুলভাবে উৎসাহ প্রদান করা হবে, তার সুযোগ-সুবিধারও ব্যবস্থা করা হবে। এমনকি মুশরিকদেরকে আল্লাহর কালাম শুনাবার পন্থাও গ্রহণ করা হবে, যাতে তারা তা শুনে তার মধ্যে নিহিত যৌক্তিক ভাবধারা অনুধাবন করার সুযোগ পায়। আল্লাহ ইরশাদ করেছেনঃ [আরবী******************************************]
আর মুশরিকদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যদি তোমার নিকট আশ্রয় চেয়ে আসতে ইচ্ছা করে, তাহলে তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেবে, যেন সে আল্লাহর কালাম শুনবার সুযোগ পায়। পরে তাকে তার নিরাপত্তার স্থানে পৌঁছে দাও। এই নির্দেশ এজন্য দেয়া হলো এবং তা করা এজন্য প্রয়োজন যে ওরা হচ্ছে এমন লোক যে, ওরা প্রকৃত ব্যাপার কিছুই জানে না।
‘প্রকৃত ব্যাপার কিছুই জানে না’–অথবা আল্লাহর কালাম যে কত তাৎপর্য মাহাত্মপূর্ণ, তা ওরা জানতেই পারেনি। অতএব ওদের কেউ যদি ইসলামী রাষ্ট্রে ওদেরই প্রয়োজনে আশ্রয় চায়, তাহলে তা দেবে। কেননা এই সুযোগে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পাবে। আর তা শুনতে পেয়ে আল্লাহর কালামের মাহাত্ম্য অনুধাবন করে ইসলাম কবুলও করতে পারে। কেননা মুশরিকদেরও আল্লাহর কালাম শুনিয়ে ইসলাম কবুলের সুযোগ করে দেয়া ইসলামী রাষ্ট্রের একটা অতিবড় দায়িত্ব।
এ কারণেই ইরশাদ হয়েছেঃ
[আরবী*******************************]
অতঃপর সুসংবাদ দাও সেই সব বান্দাকে, যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে এবং তার উত্তম দিকগুলি মেনে নেয় ও পালন করে। এই ধরনের লোকদেরকেই তো আল্লাহ হেদায়েত দান করেন এবং (পরিণামে) তারাই বুদ্ধিমান প্রমাণিত হয়।
৩. রাজনৈতিক স্বাধীনতাঃ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার রয়েছে দেশের রাজনৈতিক ব্যাপারাদিতে অংশ গ্রহণের এবং প্রয়োজন ও সুযোগ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের কোন পদে নিযুক্ত হওয়ার, কোন কাজের জন্য দায়িত্বশীল হওয়ার।কোন নাগরিককে মৌলিকভাবে এই অধিকার থেকে বিরত রাখা বা বঞ্চিত করা যেতে পারে না। কেননা এ এক স্বাভাবিক –স্বভাবসম্মত অধিকার। এই অধিকার বিশেষ কোন শ্রেণী বা বংশের লোকের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত হওয়া অন্যদের তা থেকে দূরে রাখার কোন নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে না।
ইসলাম ছাড়া দুনিয়ায় অন্যান্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই অধিকার বিশেষ কোন বংশের বা বর্ণের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত (Reserved) করা হয়ে থাকে। প্রাচীন বংশভিত্তিক কিংবা শ্রেণীভিত্তিক শাসন ব্যবস্থায় তা করা হতো বিশেষ বংশের বা বর্ণের কিংবা বিশেষ শ্রেণীর লোকদের জন্য। আর বর্তমান কালের দলভিত্তিক শাসন ব্যবস্থায় তা করা হয় বিশেষ দলের লোকদের জন্য, যদিও গণতন্ত্রের আদর্শে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের শ্লোগান দেয়া হয় অত্যন্ত উঁচু গলায়। এর বিপরীত বংশ, শ্রেণী বা দলের লোকদের এক্ষেত্রে কার্যত কোন অধিকার দেয়া হতো না, এখনও হচ্ছে না। ফলে একালের গণতন্ত্র (?) প্রাচীনকালীন বংশ বা বর্ণ কিংবা শ্রেণীর লোকদের একচেটিয়া অধিকার ভোগের পরিণতিই নিয়ে এসেছে।
প্রাচীন গ্রীক, পারস্য, ভারত ও দুনিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রে উক্ত অবস্থা বিরাজ করছিল। আর বর্তমানে সে অবস্থা অত্যন্ত প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায় দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক (?) রাষ্ট্রে।
ইয়াহুদি বংশীয় রাষ্ট্রেও রাষ্ট্রীয় পদ লাভ করার অধিকার নির্দিষ্ট ছিল কেবলমাত্র ধনী ব্যক্তিদের জন্য। কেননা ধন-সম্পদই ছিল তাদের সামাজিক মর্যাদার ভিত্তি। যে লোক বিপুল ধন-সম্পদের মালিক নয়, তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় উচ্চতর মর্যাদার কোন পদ লাভ ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ কারণেই আল্লাহ যখন তালুতকে বনী ইসরাইলীদের বাদশাহ নিয়োগ করলেন, তখন তারা উপর কঠিনভাবে আপত্তি জানিয়ে বলে উঠলঃ [আরবী*************************]
আমাদের উপর বাদশাহ হয়ে বসার অধিকার তার কি করে –কেমন করে হতে পারে? আমরাই বরং ওর তুলনায় অধিক অধিকারী। কেননা ওর বিপুল ধন-সম্পদ নেই।
কিন্তু আল্লাহ ওদের এই আপত্তিকে গ্রাহ্য করেন নি। তিনি আগেই বলে দিয়েছেনঃ [আরবী***************************]
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা তালুতকে বাছাই ও পছন্দ করে তোমাদের উপর নিযুক্ত করেছেন এবং তাকে জ্ঞান ও দৈহিক শক্তির প্রশস্ততার বিপুলতা দান করেছেন।
তার অর্থ, সমাজ ও রাষ্ট্রের যথার্থ নেতৃত্ব দানের জন্য প্রথমে প্রয়োজন জ্ঞানে বিপুল প্রশস্ততা, আর দ্বিতীয় প্রয়োজন সুস্বাস্থ্যের ও দৈহিক শক্তির বিপুলতা। তালুত এই দুইটি গুণেরই অধিকারী এবং একারণেই তাকে তোমাদের উপর বাদশাহ রূপে নিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ইসরাইলী সমাজে এই দুইটি গুণের কোন গুরুত্ব ছিল না। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পদ লাভের জন্য তাদের নিকট সবচাইতে বেশী গুরুত্ব ছিল, বিপুল ধন-মালের অধিকারী হওয়া। আর সেদিক দিয়ে তালুতের উল্লেখযোগ্য কোন স্থান ছিল না। সে বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী ছিল না। ইয়াহুদীরা ধন-মালের এত বেশী পূজারী ছিল যে, আল্লাহ তালুতকে প্রয়োজনীয় গুণের অধিকারী বলে ঘোষণা করার পর-ও তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গীকে আল্লাহর কথার প্রতিবাদে পেশ করতেও দ্বিধাবোধ করল না।
হযরত ইউসুফ (আ) ছিলেন মিসরে নিতান্তই বিদেশাগত। আর তাঁর ধন-মালের অধিকারী হওয়ার কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। তিনি আল্লাহর নবী হিসেবে রাষ্ট্রীয় পদাধিকারী হওয়ার প্রয়েজানীয় যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলতে পেরেছিলেনঃ [আরবী*************************************]
আমাকে ধন-মালের সমস্ত ভান্ডারের কর্তৃত্বশালী নিযুক্ত কর। কেননা আমি যেমন সেসবের হেফাযতকারী তেমনি ধন-মাল বিলি-বন্টনের সুষ্ঠু নিয়ম সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত। -[এ পর্যায়ে একটি কথা বিশেষভাবে স্মর্তব্য। এক মিশরের বাদশাহ হযরত ইউসূফ (আ)-এর জ্ঞাণ-গরীমায় মুগ্ধ হয়ে পূর্বেই তাঁকে অতি উচ্চ পদমর্যাদা দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই প্রেক্ষাপটে হযরত ইউসূফ (আ) দেশের চরম দুর্ভিক্ষাবস্থা লক্ষ করে অপেক্ষাকৃত কম দায়িত্বপূর্ণ এই পদটি গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন –সম্পাদক]
বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্তির শর্ত হিসেবে ধন-মালের মালিক হওয়া, বিশেষ বংশ, গোত্র বা শ্রেণীর লোক হওয়ার এক বিন্দু গুরুত্ব নেই। বরং গুরুত্ব রয়েছে যোগ্যতার, উপযোগীতার, জ্ঞানের এবং নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার। ইসলামের মহান নবী (স)-ও এ দিকেই গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেনঃ [আরবী********************************************]
যে লোক মুসলমানদের মধ্য থেকে কোন একজনকে কর্মচারী নিযুক্ত করল এরূপ অবস্থায় যে, সে জানে যে, তাদের মধ্যে নিযুক্ত ব্যক্তির তুলনায় অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ও আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত সম্পর্কে অধিক জ্ঞানবান ব্যক্তি রয়েছে, সেই নিয়োগকারী আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুসলিম জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। -[আরবী টীকা****************]
অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রে কোন পদ লাভের জন্য দুটি গুণের প্রয়োজন। একটি হচ্ছে উপযোক্তা, যোগ্যতা এবং দ্বিতীয়, কুরআন ও সুন্নাতের ইলম- অবহিত। এই দুইটি গুণের দিক দিয়ে যে ব্যক্তি অগ্রসর প্রতিপন্ন হবে, তাকেই নিযুক্ত করতে হবে। তার তুলনায় ন্যুনতম ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হলে তা হবে বিশ্বাসঘাতকতার ন্যায় মারাত্বক অপরাধ।
এই পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোদ্ধৃত কথাটি আরো বলিষ্ঠ, অধিক কঠিন সাবধানকারী। বলেছেনঃ [আরবি…………..]
যে লোক মুসলিম জনগণের কোন বিষয়ের সর্বোচ্চ পদাধিকারী নিযুক্ত হবে, যে যদি সেই মুসলিম জনগণের উপর কাউকে শুধু খাতির রক্ষার্থে শাসক নিযুক্ত করে, তাহলে উপর আল্লাহর অভিশাপ, আল্লাহর তার কোন কার্য়ক্রম বা বিনিময় গ্রহণ করবেন না। শেষ পর্যন্ত তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। [আরবী টীকা…………..]
এই কারণেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, মক্কা বিজয় দিবসে নবী করীম (স) মক্কার শাসনর্কতা হিসেবে হয়রত ইবনে উসাইদ (রা)- কে নিযুক্ত করলেন শুধু তাঁর অধিক যোগ্যতার কারণে। অথচ তিনি ছিলেন যুবক, আর তাঁর সঙ্গে তখন বহু বয়স্ক সাহাবী ছিলেন। নবী করীম (স) তাঁকে লক্ষ্য করে বললেনঃ
[আরবী———————————-]
হে ইতাব! তুমি কি জানো কোন সব লোকের উপর তোমাকে শাসনর্কতা নিযুক্ত করেছি? জানবে- তারা হচ্ছে সব আল্লাহ ওয়ালা লোক। তোমার চাইতে অধিক ভালো আর কাউকে মনে করলেও জানাবে আমি এদের উপর নিশ্চয় তাকেই নিযুক্ত করতাম।
[আরবী টীকা—————————]
ইতাব অল্প বয়সের লোক ছিলেন বলে পরে কেউ কেউ তাঁর এই নিয়োগের উপর আপত্তি তুলেছিলেন। তখন নবী করীম (স) মক্কাবাসীদের নামে লিখিত এক ফরমানে বললেনঃ
[আরবী টীকা—————————–]
তোমাদের কেউ যেন ইতাবের অল্প বয়স্কতার কারণ দেখিয়ে তার বিরুদ্ধতা না করে। কেননা বয়সে বড় হলেই সে সর্বোত্তম হয় না, সর্বোত্ত যে, সে-ই বড়।
[আরবী টীকা—————————]
৪. সমালোচনার অধিকারঃ বস্তুত নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারে অনেক বিষয়ই শামিল রয়েছে। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হচ্ছে- শরীয়্যাতের আওতার মধ্যে শাসন কর্মকর্তাদের সমালোচনা করার অধিকার। অবশ্য তা শুধু দোষ বের করার জন্যই হবে না, হবে সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে, নির্ভুল উদ্দেশ্যে। কেননা এইরূপ সমালোচনা দোষ-ক্রটি দূর করার জন্য বিশেষ সহায়ক। সমালোচনার ফলেই সমাজ-সমষ্টি পূর্ণত্ব লাভ করতে পারে, কর্মকর্তাদের সঠিক লালন প্রশিক্ষণ-ও তার দ্বারাই সম্পন্ন হতে পারে। পক্ষান্তরে সমালোচনার সুযোগ ও ব্যবস্থা না থাকলে ক্রটি- বিচ্যুতি ও জুলুম- অবিচার পাহাড় সমান স্তুপ জমা হয়ে যেতে পারে। আর এরূপ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত এমন বিস্ফোরণ সংঘাটিত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে, যার ফলে গোটা শাসন ব্যবস্থাই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
এ পর্যায়ে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হচ্ছে নবী করীম (স)-এর এই প্রসিদ্ধ হাদিস। ইরশাদ হয়েছেঃ
[আরবী——————–]
তোমাদের যে-কেউ কোন অন্যায়কে দেখতে পাবে, সে যেন তা নিজ হস্তে পরিবর্তন করে দেয়া। তার সামর্থ্য না হলে তার বিরুদ্ধে যেন মুখে প্রতিবাদ জানায়।আর তার করাও সম্বব না হলে সে যেন অন্তর দিয়ে তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। মনে রেখো, এটাও না হলে অতঃপর তার দিলে এক- বিন্দু পরিমাণ ঈমান আছে বলে মনে করা যায় না।[ বুখারী,মসলীম……………………..]
হযরত উমর (রা) মসজিদে ভাষণ দিচ্ছিলেন। এই সময় মুসলিম বাহিনী একদিকে রোমান শক্তির সাথে এবং অপর দিকে পারসিক শক্তির সাথে প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। সমগ্র ইসলামী রাজ্যে অবস্থা বিরাজ করছিল। একজন সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেনঃ আপনি যতক্ষণ পযর্ন্ত আপনার পরনের জামায় অধিক কাপড় ব্যবহারের কৈফিয়ত না দেবেন, আপনার ভাষণ আমরা শুনব না।
হযরত উমর (রা) ভাষণ বন্ধ করে তার ছেলের প্রাপ্ত কাপড় মিলিয়ে এই জামা তৈরী হয়েছে এ কথা সাক্ষ্য দ্ধারা প্রমাণ করেন। তখন তিনি বলেনঃ হ্যাঁ, এখন বলুন, আমরা শুনতে প্রস্তুত।
এক কথায় বলা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্র পরিচালকদের সমালোচঁনা করার এত বেশী সুযোগ- বরং সেজন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে- দুনিয়ার অপর কোন ধরনের রাষ্ট্রে তার কোন তুলনা বা দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। শসকগণ সেসব সমালোচনার যথাযথ জবাব দিতে বাধ্য হতেন, জবাব না দিলে একবিন্দু চলতে দেয়া হতো না। হযরত উমর (রা)- এর খলীফাতুল মুসলিমীন হিসেবে ভাষণ দানকালে- যখন আধুনিক ভাষয় চরম জরুরী অবস্থা সমগ্র দেশে বিরাজিত- তাঁর ভাষণ থামিয়ে তাঁর ব্যক্ষিগত একটা ব্যাপারের যথাযথ জবাব আদায় করে নেয়া এবং সান্ত্বনাদায়ক জাববের পরই তাঁকে ভষণ দেবার সুযোগ
করে দেয়া কোনক্রমেই সামান্য ব্যাপার মনে যায় না।এর এক হাজার ভাগের এক ভাগ সমালোনার সুযোগ কি তথাকথিত ব্যবস্থায় দেখাতে পাওয়া যায়?
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতা বাছাই করার ব্যাপারটিও ইসলামে গণরায়ের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। কোন ব্যক্তিকেই নিজ ইচ্ছমত রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে বসার সুযোগ দেয়া হয়নি এবং রায় জানাবার ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী উভয়ই সমান অধিকার সম্পন্ন।
কুরআন ও সুন্নতের ব্যাখ্যাদানের ব্যাপরেও প্রত্যেক দ্বীনী ইল্ম সম্পন্ন ব্যক্তির পূর্ণ অধিকর আছে, আধিকার রয়েছে একজনের দেয়া ব্যাখ্যার সাথে দ্বিমত পোষণ করার এবং পাল্টা ব্যাখ্যা দানের। অবশ্য তা অকাট্য দলীল ও প্রমাণের ভিত্তিতে হবে- গায়ের জোরে হলে চলবে না। কেননা কুরআন ও সুন্নতের ইল্ম অর্জন করার অধিকার সকলেরই দলীলের ভিত্তিতে তার একটা ব্যাখ্যা দেয়ার অধিকারও সমানভাবে সকলের- অবশ্য কুরআন ও সুন্নাতের যথাযর্থ ইল্ম যারা অর্জন করেছে তাদের জন্য, যারা তা অর্জন করেনি, তাদের জন্য এই অধিকর থাকতেই পারে না।তেমনি কেউ নিজের দেয়া ব্যাখ্যাকেই একমাত্র ও চুড়ান্ত বলেও দাবি করতে পারে না, কারোর দেয়া ব্যাখ্যার সাথে মতপার্থক্য পোষণ করার অধিকার কেউ হরণও করতে পারে না। এ সম্পর্কে হযরত আলী (রা)-র একটি উক্তি স্মরণীয়। তিনি বলেছেনঃ
[আরবী***************************]
যে লোক কোন বিষয়ে বিভিন্ন প্রকারের মতের সম্মুখীন হলো, সে সেই মতসমূহের মধ্যে কোনটি ভুল তাও সহজেই বুঝতে ও ধরতে পারে। [আরবী টীকা*******************]
মূলত নবী করীম (স) নিজেই এই অধিকারকে বাস্তবভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।তিনি সকল প্রকারের প্রশ্ন, আপত্তি ও সমলোচনা অত্যন্ত শান্তভাবে ও ধৈর্য সহকারে শুনতেন এবং প্রত্যেকটিরই সংশয় অপনোদনকারী (convincing) জবাব দিতেন।
নবী করীম (স) তাঁর প্রিয় পুত্র ইবরাহীমের রোগক্লিষ্ট ধ্বনি শ্রবণ করে কেঁদে উঠেছিলেন। তখন সাহাবী হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা) বললেনঃ ‘আপনি না আমাদেরকে শব্দ করে কাঁদতে নিষেধ করেছেন? তখনই জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ হ্যাঁ তা নিষেধ করেছি বটে: কিন্তু আমি নিষেধ করেছি আহাম্মকের ন্যায় চিৎকার করা থেকে। আরও দুইটি বিকট ধ্বনির ব্যাপারেও আমি নিষেধ করেছি! একটি হচ্ছে বিপদকালে চিৎকার করা শয়তানেরে মুখোমুখি হয়ে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আনন্দ উল্লাসে চিৎকার করা
[আরবী টীকা*************************]
৫. নাগরিক স্বাধীনতাঃ প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার আছে যে কোন স্থানে- শহরে, গ্রামে বসবাস গ্রহণ করার, যে কোন হালাল উপার্জন-পন্হা, পেশা বিশেষ জীবন ধারা গ্রহণের, প্রাকৃতিক অবদান থেকে কল্যণ গ্রহণের-অবশ্য শরীয়াতের মধ্য থেকে- অধিকার রয়েছে।
বসবাস গ্রহণের ব্যাপারে ইসলাম প্রত্যাকটি নাগরিককে এই অধিকার দিয়েছে যে, নাগরিক যেখানেই নিরাপদে ও সুবিধাজনকভাবে বসবাস করতে পারবে বলে মনে করবে, সেখানেই সে অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে, নিজের জমিতে ঘর-বাড়ি বানাতে পারবে। নবী করীম (স)-এর এই কথাটি স্মরণীয়ঃ [আরবি………………………………]
দেশ-শহর-নগর-এর মালিক আল্লাহ। মানুষ সব আল্লাহর বান্দা। অতএব তুমি অবস্থান গ্রহণ কর।[আরবি টিকা…………………………..….]
আর যে দেশের অধিবাসীদের উপর জুলুম ও জালিমের সর্বগ্রাসী আধিপত্য স্থাপিত হয়েছে, তাদেরকে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ প্রশ্ন করেছেনঃ [আরবি………………………………….]
আল্লাহর যমীন কি বিশাল প্রশস্ত ছিল না?..তোমরা সেই জুলুমের দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র হিজরত করতে পারতে না কি?
প্রত্যেক ব্যক্তির কর্মের-যে কোন পেশা গ্রহণের স্বাধীনতা রয়েছে, যতক্ষণ না তা শরীয়ত-পরিপন্হী হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের কোন নাগরিককে বিশেষ কোন পেশা গ্রহণ বা বর্জনের জন্য জোর প্রয়োগ করা হয় না, কাউকে সেজন্য বাধ্য করা হয় না। হযরত আলী (রা) তাঁর সময়ের এক শাসনকর্তাকে লিখে পাঠিয়েছিলেনঃ [আরবি………………………..……]
যে লোক যে কাজ করা পছন্দ করে না, তাকে সেই কাজ করতে বাধ্য করা আমি বৈধ মনে করি না। [আরবি টিকা………………………..…]
তবে যদি কেউ উপার্জনহীন হওয়ার কারণে পরিবারের ব্যয়ভার বহনে ও তাদের প্রয়োজন পূরণে অসমর্থ হয়, তখন তাঁকে নিশ্চয়ই কোন-না-কোন বৈধ উপার্জনে বাধ্য করা হবে।
প্রাকৃতিক সামগ্রী, সম্পদ ও শক্তি উদ্ভাবন, ব্যবহারোপযোগী বানানো এবং তা নিজের দখলে রেখে তা থেকে উপকৃত হওয়া-তা ভাগ ও ব্যবহার করার অধিকার প্রত্যেকটি নাগরিকেরই রয়েছে। পুঁজিবাদি সমাজের ন্যায় তা বিশেষ ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বা সমাজতান্ত্রিক সমাজের ন্যায় তা মুষ্টিমেয় ক্ষমতাসীনের ও ক্ষমতাসীন দলের লোকদের একচেটিয়া অধিকারের জিনেস নয়। সে অধিকার প্রত্যেকটি নাগরিকের, নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের।