ইসলামে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির উৎস
[আনফাল –যাকাত –এক পঞ্চামাংশ –ফিতরার যাকারত –খারাজ ও ফসলের ভাগ –জিজিয়া –অন্যান্য –ব্যতিক্রমধর্মী –আয়।]
………………………………………………………………………………………………..
প্রত্যেক রাষ্ট্রের জন্যই অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের একটা সুস্পষ্ট পরিকল্পনা একান্তই প্রয়োজন। বর্তমান গ্রন্থের পূর্ববর্তী বিস্তারিত আলোচনায় ইসলামী রাষ্ট্রের বহুবিধ দায়িত্বের কথ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে দায়িত্বসমূহ যথাযথ পালনের জন্য বিপুল পমিরাণের অর্থ-সম্পদ রাষ্ট্রের নিকট মওজুদ একান্তই আবশ্যক। তাই ও পর্যায়ে দুটি প্রশ্নঃ
ইসলামী হুকুমত তার বিরাট দায়িত্ব পালন ও বিস্তৃত কার্যসূচীর বাস্তবায়নে যে অর্থ সম্পদের প্রয়োজন তা কোথেকে এবং কেমন করে পূরণ করা হবে? আর এই প্রয়োজনীয় অর্থ সম্পাদ সংগ্রহের দায়িত্ব কে বহন করবে?
অন্য কথায়, ইসলামী রাষ্ট্র অর্থ-সম্পদের কোন্ সব উৎসের উপর নির্ভরশীল? এক-পঞ্চমাংশ (আরবী*****) যাকাত ও খারাজ প্রভৃতি প্রচলিত করসমূহের দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব হবে কি? কিংবা এছাড়াও আরও কোন কোন আমদানি উৎস্য আছে কি, যা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পূরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে? এ পর্যায়ে একটি কথা সাধারণভাবে বলা হয় যে, আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ মদ্য উৎপাদন, মদ্য আমদানি-রপ্তানি, জুয়া, সূদী কারবার, বেশ্যাবৃত্তি, প্রমোদ কর ইত্যাদি বাবদ সাধারণত যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকে, তা ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, সে সবের দুয়ার চিরতরে বন্ধ। ফলে ইসলামী রাষ্ট্র বর্তমান যুগের আমদানির একটা বিরাট অংশ বা খাত থেকেই বঞ্চিত থেকে যাবে। তাহলে শুধু যাকাত ও এক-পঞ্চমাংশ আয় দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র তার বিরাট অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারবে কি?
আধুনিক রাষ্ট্রক সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, বেসরকারী প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, সড়ক ও নির্বাণ কার্যক্রম এবং সাধারণ স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে বিরাট ব্যয়ভারের সম্মুখীন হতে হয়।
আমরা বলব –না, ইসলামী রাষ্ট্র শুধু যাকাত ও এক-পঞ্চমাংশ আয়ের উপর নির্ভরশীর হয়ে থাকবে না। এ দুটি শুধু একদিকের প্রয়োজন পূরণের জন্য বিধিবদ্ধ হয়েছে। এ দুটি ‘ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের আরও আয়ের উৎস ও সূত্র রয়েছে। এখানে সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা যাচ্ছেঃ
আনফাল’–ফাই, গনীমত
ইসলামী রাষ্ট্র যেসব জমি-জায়দা যুদ্ধ ছাড়াই দখল করবে, রাষ্ট্রের পতিত জমি, পর্বতশৃঙ্গ, উপত্যকা-গর্ভ, বন-জঙ্গল এবং খনি, আর উত্তরাধিকারহীন ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ-সম্পত্তি, সরকারী অনুমোদন ব্যতীত যুদ্ধ করে শত্রু পক্ষের নিকট থেকে যোদ্ধারা যা পাবে, দেশের সমস্ত পানিরাশি, স্বতঃউদ্ভুত উদ্ভিদ-বৃক্ষলতা, মালিকবিহীন চারণভূমি, রাজা-বাদশা প্রদত্ত জমি ইত্যাদি।
এই সব কিছুর মালিকানা রাষ্ট্রের। কেননা আসলে এসব সর্বসাধারণ জনগণের হলেও সেই জনগণের প্রতিনিধিস্থানীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র সরকারের ব্যবস্থাধীন থাকবে। সরকারী ও সবের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যা আয় করবে, তা জনগণের কল্যাণেই ব্যয় করবে। এ পর্যায়ে দলীল হচ্ছে কুরআনের আয়াতঃ
(আরবী************)
তোমাকে লোকেরা গনীমতের মাল (এর ব্যয় খাত) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তুমি তাদের জানিয়ে দাও –এই গনীমতের মাল তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের পারস্পরিত সম্পর্ক সুষ্ঠু ও ঠিক রূপে গড়ে তোল। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মেনে চল –যদি তোমরা প্রকৃতই মু’মিন হয়ে থাক।
আর যেসব ধন-সম্পদ আল্লাহ ও রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট, তা মুসলিম জনগণের সার্বিক কল্যাণে ব্যয় হবে। কুরআন মজীদে ও পর্যায়ে বলা হয়েছেঃ
(আরবী********)
আর যে ধন-মাল আল্লাহ অন্য লোকদের দখল থেকে বের করে এনে তাঁর রাসূলকে ফিরিয়ে দিলেন, তা এমন নয় যার জন্য তোমরা ঘোড়া ও উট দৌড়িয়েছ। বরং আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে যে জিনিসেরই উপরই উপর ইচ্ছা কর্তৃত্ব ও আধিপত্য দান করেন। আর আল্লাহ সব কিছুর উপরই ক্ষমতাবান।
অন্য কথায়, মুজাহিদদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করা ছাড়াই যেসব ধন-মাল ইসলামী রাষ্ট্রের মালিকানায় আসবে, যা পাওয়া যাবে কোন জনগোষ্ঠীর সাথে সন্ধি করার ফলে অথবা পরাজয় বরণ করে অধীন হয়ে থাকতে বাধ্য হয়ে যে জিযিয়া ইসলামী রাষ্ট্রকে দেবে, এছাড়া ধ্বংসাবশেষ, পরিত্যাক্ত, অনাবাদী মালিকবিহীন জমি-জায়গা, ঘর-বাড়ি, কল-কারখানা ইত্যাদি ও উপত্যকা-গর্ভ সম্পদ –এ সবই রাসূলের –আর তাঁর অবর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তৃত্ব ও ব্যবস্থাপনাধীন থাকবে। সে তা সবই পরিকল্পিতভাবে জনসাধারণের জন্য ব্যয় করবে।
বলা বাহুল্য, এসব থেকে ইসলামী রাষ্ট্র বিরাট নগদ সম্পদ লাভ করতে পারবে-এককালীণ কিংবা মাসে বছরে, অথবা মৌসুম অনুযায়ী।
এ পর্যায়ে একটি মাত্র দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্তমান মুসলিম দুনিয়া সারা বিশ্বের তুলনায় শতকরা ৬৬ ভাগেরও বেশী কাঁচা তৈল উৎপাদন করে। যে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য এই খাতে আয় নেহায়েত কম নয়।
যাকাত
যাবতীয় গৃহ পালিত পশু-গরু, উট, ছাগল, মহিষ, নগদ অর্থ, স্বার্ণ-রৌপ্য ও ফসলাদি থেকে তা পাওয়া যাবে।
এক পঞ্চমাংশ
সাতটি জিনিসের এক পঞ্চমাংশ ইসলামী রাষ্ট্রের হাতে আসবেঃ
১. যুদ্ধরত শত্রুপক্ষের নিকট থেকে শক্তি প্রয়োগের ফলে যাই হস্তগত হবে;
২. স্বর্ণ, সীসা, পিতল, তামা, লোহা, মূল্যবান পাথরসমূহ, সালফার, তৈল, আলকাতরা, পীচ, লবণ, কাঁচ, সেঁকোবিষ (ইব্রণভধড্র) বুরমা, দস্তা প্রভৃতি। জমির তলদেশ থেকে প্রাপ্ত খনিজ পদার্থ মৌলিকভাবে ‘আনফাল’ হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ। কিন্তু সরকার তা পুজিঁ করে আটকে রাখাতে পারে না কিংবা কাউকে তা বিনামূল্যে দিয়ে দিতে পারে না। তা উত্তোলনের সময় যথাযথভাবে ওজন করে তার বিন্দু বিন্দুর হিসেব সংরক্ষণ করতে হবে! কেননা উদ্ধৃত আয়াত অনুযায়ী ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রই রাসূলের স্থলাভিষিক্ত। আর এই ঘরের যাবতীয় আমদানি জনগণের জল্যাণেই ব্যয় হবে;
৩. মাটির তলায় জমা রাখা সম্পদ (আরবী*****);
৪. সমুদ্র থেকে লব্ধ সম্পদ;
৫. যে সব হালাল সম্পদ হারাম সম্পদের সাথে সংমিশ্রিত হয়ে আছে এমন ভাবে যে, তা আলাদা করা সম্ভব হয় না;
৬. যিম্মীরা মুসলমানদের নিকট থেকে যে জমি ক্রয় করেছে, তা কৃষি জমি হোক, কি বসবাসের জমি; এবং
৭. ব্যবসায়, শিল্পোৎপাদন ও উপার্জনের মুনাফা এবং উপার্জনকারীর সাম্বাৎসরিক ব্যয় বহনের পর যা অতিরিক্ত ও উদ্ধৃত থাকবে। সকল প্রকারের পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থাই এর অন্তর্ভুক্ত। এর ভিত্তি হচ্ছে এ আয়াতৱ
(আরবী*******)
আর তোমরা জেনে রাখো, তোমরা যে গনীমতের মাল লাভ করেছ, তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ, তাঁর রাসূল, তাঁর রাসূল, নিকটাত্মীয়গণ, ইয়াতীম, মিসকনি ও নি৬স্ব পথিকদের জন্য নির্দিষ্ট-যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে থাক।
এই পর্যায়ের সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ খুব সামান্য পরিমাণের হবে না। বরং তার পরিমাণ হবে বিরাট।
‘গনীমত’ শব্দের আসল আভিধানিক অর্থ এমন জিনিস লাভ, যার মালিক কেউ নেই। পরে মুশরিকদের নিকট থেকে প্রাপ্ত জিনিসকে গনীমত বলা শুরু হয়। যে সব মাল-সম্পদ কোনরূপ শ্রম বা কষ্ট স্বীকার ছাড়াই লাভ হয় তাও গনীমত। আরবরা সেই সব মালকেই ‘গনীমত’ বলত, যা-ই মানুষ লাভ করে। যুদ্ধ ছাড়া লাভ করা হলেও তা গনীমত নামেই অভিহিত।
কুরআন মজীদেও এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ ভিন্নতর। যেমনঃ
(আরবী********)
তোমরা চাও দুনিয়ার সম্পদ পেতে, অথচ আল্লাহর নিকট রয়েছে বিপুল গনীমতের সম্পদ।
আয়াতের (আরবী*****) শব্দটি (আরবী************) এর বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত। কাজই মানুষ এ দুনিয়ায় যেসব সম্পদই লাভ করে, গনীমত বলতে কেবল তা-ই বোঝায়। যুদ্ধে লব্ধ ধন-মালই কেবল গনীমত নয়, বরং মানুষ যা কিছুই উপার্জন করে-তা বস্তু হোক, কি অ-বস্তু-তা সবই এর মধ্যে গণ্য।
হাদীসে গনীমত বলা হয়েছে মানুষ যে ফায়দাই লাভ করুক, তাকে। যাকাত সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী*******)
হে আল্লাহ! তুমি এই যাকাত গনীমত বানাও, জরিমানা বানিও না।
(আরবী****)
(আরবী******)
যিকর এর মসলিসসমূহের লব্ধ সম্পদ হচ্ছে জান্নাত।
(এবং ২. আরবী টীকা*******)
রমযান মাসের প্রমংসায় রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ
(আরবী**********)
তা মুমিনের জন্য গনীমত।
রাসূলে করীম (স)- এর বিভিন্ন ভাষণেও এই গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ দেয়ার উল্লেখ রয়েছে।
১. আবদুল কাইস গোত্রের লোকেরা রাসূলে করীম (স)-নিকট ইসলাম কবুলের পর বলল, আমরা কেবল মাত্র হারাম মাসেই আপনার সাথে সাক্ষাৎ করবার সুযোগ পাব। কাজেই আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বলুন, যা আমরা অনুসরণ করব ও অন্যান্য লোককে পালনের আহবান জানাব। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ
(আরবী*******)
আমি তোমাদেরকে চারটি কাজের আদেশ করছি ও চারটি কাজের নিষেধ করছি। আদেশ করছি আল্লাহর প্রতি ঈমান গ্রহণের জন্য! তোমরা কি জান, ঈমান কি? তা হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া কেউ মাবুদ নেই বলে সাক্ষ্য দান, সালাত কায়েম করা যাকাত দেয়া এবং এজন্য যে, তোমরা গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ দেবে।
(আরবী টীকা*********)
এ কথা স্পষ্ট যে, এই হাদীসটিতে যে গনীমত কথাটি রয়েছে, তা নিশ্চয়ই যুদ্ধে কাফিরদের নিকট থেকে পাওয়া মাল-সম্পদ নয়। কেননা আবদুল কাইস গোত্রের তখনকার অবস্থায় কারোর সাথে যুদ্ধ করার কোন প্রশ্নই উঠে না। তাই এখানে গনীমত শব্দের আসল আভিধানিক অর্থ গ্রহণই শ্রেয়। আর তা হচ্ছেঃ
(আরবী********)
গনীমত হচ্ছে সেই মাল-সম্পদ যা কোনরূপ শ্রম বা কষ্ট স্বীকার ব্যতীত অর্জিত হয়।
২. হযরত আমর ইবনে হাজম (রা)-কে ইয়ামন প্রেরণকালে রাসূল (স) যে লিখিত দলীল দিয়েছিলেন, তাতেও এই গনীমত শব্দের উল্লেখ হয়েছেঃ
(আরবী*********)
তাদের আদেশ করবে সব ব্যাপারে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনের জন্য এবং গনীমত থেকে আল্লাহর এক-পঞ্চমাংশ গ্রহণ করবে।
(আরবী টীকা********)
ফিতরার যাকাত
একে যাকাতুল-আবদাল বা দেহের যাকাত-ও বলা হয়। ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাযের পূর্বেই প্রত্যেক পরিবারের মাথাপিছু ফিতরার যাকাত দিতে হয়।
খারাজ ও ফসলের ভাগ
মুসলমানরা যুদ্ধ করে যে জমি দখল করে, সেই জমি চাষ করে যারা ফসল ফলায়, তাদেরকে এই দুটি কর দিতে হয়। কেননা এই জমি সর্বসাধারণ মুসলিমের মালিকানা সম্পত্তি। অতএব সেই জমির আয় জনগণের কল্যাণেই ব্যয় হতে হবে। অবশ্য চাষকারীরা তা থেকে নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে নেবে।
আর খারাজ হচ্ছে জমির উপর ধার্যকৃত নগদ দেয় কর। যেমন প্রতি একরে জমি ভোগ-দখলকারী ব্যক্তি দশ দীনার বা অনুরূপ পরিমাণের অর্থ সরকারে দিয়ে দেবে প্রতি বছর।
আর জমির ফসলের ভাগ মূলত জমির উৎপাদনে অংশীদারিত্ব। তা অমুসলিমদের হাতে থাকলে খারাজ দিতে হবে, আর মুসলমানদের মালিকানাধীন জমির ফসলের এক দশমাংশ বা তার অর্ধের বায়তুলমালে জমা করতে হবে।
জিযিয়া
ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম যিম্মীদের নিকট থেকে এই কর আদায় করা হয় তাদের পূর্ণ নিরাপত্তার দায়িত্ব ইসলামী সরকার গ্রহণ করে বলে।
অন্যান্য
এছাড়া আরও বহু প্রকারের কর ধার্য হতে পারে। যার পরিমাণ শরীয়াতে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি, তার জন্য বিশেষ কোন সময়কালও নির্দিষ্ট নেই। ইসলামী রাষ্ট্র সরকারই তা প্রয়োজনানুপাতে ধার্য করবে।
ব্যতিক্রমধর্মী আয়
উপরে ইসলামী রাষ্টের কতিপয় মৌলিক অর্থনৈতিক উৎসের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ কয়টিই একমাত্র চূড়ান্ত উৎস নয়। এ কয়টি ছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের আরও বিভিন্ন আয়ের উৎস রয়েছে। এ সব সূত্র ও উৎস থেকে যা কিছু আয় হবে তাও সর্বসাধারণ মুসলিমের সার্বিক কল্যাণে ব্যয় করা হবে। তবে সেগুলি বাধ্যতামূলক নয়। এই পর্যায়ে কতিপয় আয়ের সূত্রের উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ
(ক) আল-মাযালিমঃ ব্যক্তির বাড়াবাড়িমূলক কিংবা কর্তব্যে অবহেলামূলক কার্যকলাপে অথবা অন্য লোকের ধন-সম্পদ বিনষ্টকরণের দরুন –যা তার মালিক জানে না, তার ক্ষতি পূরণের সাথে সংশ্লিষ্ট। যার উপর জুলুম করা হলো, তার জন্য ব্যয় করার লক্ষ্যে সেই ব্যক্তির নিকট থেকে আদায় করা হবে। এই সব ক্ষেত্রে সরকার হস্তক্ষেপ করবে এবং যা কিছু জরিমানা ইত্যাদি বাবদ আদায় করা হবে তা নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা হবে।
(খ) কয়েক প্রকারের কাফফারাঃ যেমন ইচ্ছামূলক হত্যা বা ভুলবশত হত্যা, মানত রক্ষা না করার, ওয়াদা খেলাফী করা, কিরা-কসম ভঙ্গ করা –যা খাদ্য খাওয়ানো ও কাপড় পরানোর সাথে সংশ্লিষ্ট, -প্রভৃতি ক্ষেত্রে আদায় করা হবে। সরকার এ সব ক্ষেত্রে কাফফারা দেবার জন্য দায়ী ব্যক্তির সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
(গ) লুকতাঃ পড়ে পাওয়া মাল-সম্পদ, হারিয়ে যাওয়া ধন-মাল যার মারিক বহু খুজেঁও পাওয়া যায়নি। সরকার সে মালের ধারক হবে শরীয়াত আরোপিত শর্তানুযায়ী।
(ঘ) ওয়াকফ, অসীয়ত, সাধারণ মানত আর মিনায় হাজীদের দেয়া কুরবানীসহঃ ইসলামী হুকুমাত এসব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে এবং জনগণের কল্যাণে ব্যয় করবে।
উপরে উল্লিখিত আয়ের উৎসসমূহ নিয়েই সরকার ক্ষান্ত থাকবে না। সরকার নিজেই বহু শিল্প-কারখানা, ব্যবসা, বাণিজ্য, মুদ্রা প্রচলন, বীমা, কৃষি ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব, অর্থনৈতিক শক্তির বৃদ্ধির, পানি সাপ্লাই ব্যবস্থামূলক প্রতিষ্ঠান, স্থল জল ও আকাশ পথের যানবাহন ব্যবস্থা, জলকর, ডাক-ব্যবস্থা, টেলিফোন, টেলিগ্রাম ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমেও বিপুল আয় সরকারের হস্তগত হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য –আমদানি ও রফতানি শুল্পও একটা বিরাট উৎস হিসেবে গণ্য।
এ প্রেক্ষিতে মনে করা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের পরিমাণ তার ব্যয় বাজেটের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট হবে। কাজেই উপরে উল্লিখিত উৎসসমূহকে সীমিত ও নগণ্য মনে করা কোন ক্রমেই বাঞ্চনীয় হতে পারে না। বরং এ সব উৎস ও সূত্র থেকে লব্ধ সম্পদ রাষ্ট্র সরকারকে তার সার্বজনীন কল্যাণ সাধনের কার্যসূচী সফল করার জন্য যথেষ্ঠ হবে। বলা যায়, শুধু যাকাত যদি রীতিমত পুঙ্কানুপুঙ্খ হিসেব-নিকেশ ও কড়াকড়ি করে আদায় করা হয়, তাহলে জনগণের সাধারণ দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন অনায়েসেই দূর হয়ে যাবে। জনগণের মধ্যে সাধারণ সচ্ছলতা দেখা দেবে। এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। ধনীরা যদি তাদের উপর ফরযরূপে যাকাত নিয়মিতভাবে ও সঠিক হিসেব করে দিয়ে দেয়, তাহলে উপর ফরযরূপে যাকাত নিয়মিতবাবে ও সঠিক হিসেব করে দিয়ে দেয়, তাহলে দেশে দারিদ্র্য ও অভাব-অনটনের নাম-চিহ্নও কোথাও থাকবে না। যাকাত আল্লাহ ফরযই করেছেন সর্বকালের সকরল সমাজের সাধারণ দারিদ্র্য দূর করার প্রধান ও কার্যকর মাধ্যম হিসেবে। যাকাতের হিসেব ও দেয় পরিমাণ শরীয়াত কর্তৃক যাই নির্ধারিত হয়েছে, তাই জনগণের দারিদ্র্য দূরকরণ ও সাধারণ সচ্ছলতা বিধানে এতই কার্যকর, যার কোন তুলনা দুনিয়ার অর্থ দুনিয়ার অর্থ ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে কোথাও খুজেঁ পাওয়া যাবে না।
তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্র নির্দিষ্ট কতিপয় আয়ের উৎসের উপর এমনভাবে একান্ত নির্ভরশীরও নয় যে, এ কয়টি উৎস থেকে যা আয় হবে, তাই হবে তার একমাত্র ধন। বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্র আল্লাহর বিধানভিত্তিক এক ক্ষমতাবান রাষ্ট্র। সাধারণ অয়ের উৎস থেকে লব্ধ সম্পদ তার দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট না হলে প্রয়োজন পরিমাণ আরও অধিক আয়ের জন্য নতুন নতুন পথ ও পন্থা গ্রহণ করার পূর্ণ ইখতিয়ার তার রয়েছে এবং তাদ্ধারা তার সার্বিক কল্যাণমূলক বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্য উপায় গ্রহণ করতে পারবে।
এক কথায় বলা যায়, ইসলামী রাষ্ট্র আল্লাহর জীমনে আল্লাহর খিলাফত প্রতিষ্ঠাকারী রাষ্ট্র। আর আল্লাহ সমগ্র বিশ্বলোকের একমাত্র স্রষ্টা। এখানকার শক্তি ও সমপএদর নিরংকুশ মালিক দুনিয়ার সব কিছুই তিনি মানুষের সার্বিক কল্যাণে নিয়োজিত করে রেখেছেন। এ থেকে ব্যক্তি যেমন তার প্রয়োজন পূরণের অধিকারী ব্যক্তিগত দখল (Possession)-এর মাধ্যমে নিরংকুশ মালিকানা অধিকার ছাড়াই, তেমনি রাষ্ট্র ও তার কল্যাণমূরক ও প্রতিনিধিত্বশীর কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য পূর্ণ অধিকারী ও দাযিত্বশীর। ব্যক্তিদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে এই রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত, পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিোত, তেমনি রাষ্ট্র আল্লাহ অনুমোদন প্রাপ্ত ও জনগণের সার্বিক সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত বলে শরীয়াতের সীমার মধ্যে থেকে মরীয়াতেরই দাবি পূরণের যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকারী। তা যেমন রাজতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক কিংবা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বা সরকার নয়, তেমনি নয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে গড়ে না-উঠা ও না-চলা রাষ্ট্র।
অতএব এই রাষ্ট্র মানুষের মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য পুরা মাত্রায় দায়িত্বশীল। এই রাষ্ট্রই সক্ষম মানুষের বৈষয়িক ও পরকালীন –বস্তুগত ও নৈতিক –দৈহিক ও মানসিক যাবতীয় চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করতে
মানবতার সার্বিক কল্যাণ কেবলমাত্র এই রাষ্ট্রের উপরই একান্তভাবে নির্ভরশীর। এরূপ রাষ্ট্রই মজলুম, বঞ্চিত মানবতার একমাত্র আশা ভরসার শেষ লক্ষ্যস্থ্ল।
(আরবী******************************)
— সমাপ্ত —