ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
ইসলামী রাষ্ট্র বিশ্বরাষ্ট্র-জাতিসংঘের ব্যর্থতা- বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের নতুন প্রস্তাব- বশ্বরাষ্ট্রের জন্য বিশ্বমানবিক আদর্শ-বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইসলামের ভমিক-ঈমান-ই হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ মানব সৃষ্টির নিভুল ভিত্তি- উম্মত ঐক্যবদ্ধ জতিসত্তা গঠনের ইসলামী ভিত্তি-আইনের দৃষ্টিতে সাম্য-ন্যায়বিচারের পরিণতি সাম্য- ন্যায়পরতা ও সুবিচারের সুফল-সুবিচারের উপর ইসলামের গুরত্বারোপ-সুবিচার প্রতিষ্ঠার রূপরেখ।
পূর্ববতী দীর্ঘ ও বিস্তারিত আলোচনায় ইসলামী রাষ্ট্রের যে রূপ ও সংগঠন প্রক্রিয়া প্রতিভাত হয়ে উঠেছে, সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা দুনিয়ার অন্যান্য সমস্ত প্রাচিন ও নবীন রাষ্ট্র ও সরকারসমূহ সম্পূর্ণ ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। দুনিয়ার রাষ্ট্রসমূহ হয় রাজতন্ত্রিকা, স্বৈরতান্ত্রিক, সাংবিধানিক,না হয় গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার এর কোন একটিরও মত নয়। তা সর্বতোভাবে স্বতন্ত্র প্রকৃতির ও বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। ইসলামী রাষ্টের এই মৌলিক বিশেষত্ব অনিবার্যভাবে সম্পূর্ণ ভিন্নতর লক্ষণ, গুণাবলী ও অবদান নিরয় আত্নপ্রকাশ করেছে। ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার যেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যা প্রত্যেকটি মানবীয় রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় হলেও তা দুনিয়ার অপর কোন একটি রাষ্ট্রেও খুজে পাওয়া যাবে না। আমরা এখানে ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের কতিপয় বিশেষত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করছি।
ইসলামী রাষ্ট্র বিশ্বরাষ্ট্র
ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার বিশেষ কোন একটি দেশে বা ভূখন্ডে প্রতিষ্ঠিত হলেও তা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হয় না বলে তা স্বভাবতই বিশ্বরাষ্ট্রের দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করে। বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রাথমিক পর্যায়ে দুনিয়ায় সংকীর্ণ ভৌগোলিক, ভাষাভিত্তিক ও বংশ বা বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার ব্যাপক প্রচার ঘটে। বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন নামে ও পরিচয়ে এই মতাদর্শের প্রচারে নিমগ্ন হলেও সাথে সাথেই এর প্রতিবাদও শুরু হয়ে যায়। আর এই বিতর্কের গর্ভ থেকে সহসাই আত্নপ্রকাশ করে বিশ্বজনীন সাধারণ তন্ত্রের মতবাদ এবং এই মতবাদে এমন একটি বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত করা হয়, যা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রসমূহের নির্যাতন-নিষ্পেষণ-নিগ্রহ-হত্যাযঞ্জ- যা দুনিয়ার মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে নির্মমভাবে ভোগ করে আসছে- থেকে বিশ্বমানবতাকে রক্ষা করবে। বিশেষ করে বিগত দুইটি বিশ্বযুদ্ধে এই প্রয়োজনীয়তা অধিক তীব্র ও প্রকট হয়ে উঠেছে দুনিয়ার মানুষের নিকট। বর্তমানে এই চিন্তাটা অধিক সার্বজনীনতা লাভা করেছে। এ পক্ষের চিন্তাবিদগণ স্পষ্ট বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে যে ভৌগলিক ও প্রশাসনিক প্রাচীর দাঁড়িয়ে থেকে মানুষের মধ্যে বৈষম্যের প্রাচীর তুলেছে, তা-ই হচ্ছে মূলত জাতিসমূহের মধ্যকার হিংসা-বিদ্বেষ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহের মূল কারণ। এসব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে বিশ্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আর তা রচিত হতে পারে বর্তমানের হিংস সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক রাষ্ট্র সমূহের ধ্বংসস্তুপের উপর। সে জন্য সর্ব প্রথম জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা, জীবন-দর্শন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে-চুরে এগুলোর মধ্যে যতটা সম্ভব বিশ্ব রাষ্ট্রীয় চরিত্র ও গুণাবলী জাগিয়ে দিতে হবে, যেন শেষ পর্যায়ে সমগ্র দুনিয়াকে একটি মাত্র রাষ্ট্রের পতাকাকে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। মানুষ স্বভাবতই যুদ্ধকে ভয় করে! বিশেষ দুইটি বিশ্বযুদ্ধ সাধারণ মানুষের মনে এমন ভয় জাগিয়ে দিয়েছে যে, এখন যুদ্ধের নাম শুনলেই তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।[বিগত দুটি বিশ্ব যুদ্ধে কত কোটি কোটি নিরীহ মানুষ যে নিহত, আহত ও সর্বস্বান্ত হয়েছে, তার নির্ভূল হিসেবে যদিও পাওয়া কখনই সম্ভব নয়, তবুও একটি হিসেবে অনুযায়ী প্রথম মহাযুদ্ধেই ৯ মিলিয়ন মানুষ নিহত, ২২ মিলিয়ন মানুষ আহত ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল এবং প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ নিখোঁজ। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল প্রথমটির তুলনায় অনেক বেশী ব্যাপক ও সাংঘাতিক। তাতে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারিয়ে ছিল। আর ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি যে কি পরিমাণ হয়েছিল, তা অংকের ভাষায় বলা কোনক্রমেই সম্ভব হতে পারে না। ] মানুষ যুদ্ধকে ঘৃণা করে। মানুষ চায় না-রাষ্ট্রকর্তাদের ইচ্ছামত নিরীহ মানুষের জীবন অকারণ বিপন্ন হোক, নিরীহ মানুষের রক্তে ধরিত্রীর ধুলি রঞ্জিত হোক। তাই যুদ্ধের মৌল কারণ যে হিংস্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ, তা-ই বর্তমানে মানুষের একটা অতীব হীন ও ঘৃণ্য মতাদর্শ রূপে চিহ্নিত, যদিও দুনিয়ার মানুষ জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি। এখনও দেশে দেশে যুদ্ধ চলছে। আঞ্চলিক বা স্থানীয়ভাবেও যুদ্ধ হচ্ছে এবং নিরীহ মানুষ ধ্বংস হচ্ছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধের সর্বগ্রাসী ধ্বংসকারিতা ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ সম্মুখে রেখে বিশ্বের ২২টি প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্ব-জাতি সংস্থা (League of Nations) নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলে। আরও অধিক রক্তপাত বন্ধ করাই তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বলে প্রাচারও করা হয়। তাছাড়া জাতিসমূহের পাস্পরিক দ্বনদ্ব ও ঝগড়া-বিবাদ যুদ্ধ ও রক্তপাত করে নয়-পারস্পরিক আলাপ-আলোচানার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলার নীতিও ঘোষিত হয়। অস্ত্রের পরির্বতে যুক্তি ও মানবিকতাকে ভিত্তি করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শরু করে দেয়া হয়। কিন্তু এ সংস্থার সাংগঠনিক প্রকৃতিতেই যুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। কহু কতগুলি দিক দিয়ে তার মধ্যে এমন ক্রটি থেকে যায়, যুদ্ধের জের নিঃশেষ করতে গিয়ে এমন ভাগ-বাটোয়ারা কার্যকর করা হয়, যার ফলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে একন্তই অনিবার্য হয়ে পড়ে। তার ফলে যুদ্ধের কারণ দূর করা ও যুদ্ধের প্রজ্বলিত আগুন নির্বাপিত করা এ সংস্থার পক্ষে সাধ্যাতীত হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত সর্বাধিক প্রচণ্ড রূপ নিয়ে জ্বলে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিকুণ্ড। তুলনামূকভাবে বিশ্বের জানা ইতিহাসের অতীত অধ্যায়সমূহে যত যুদ্ধ ও রক্তক্ষয় হয়েছে, তার চাইতে অনেক-অনেক বেশী রক্তপাত ও সম্পদ ধ্বংস হয় এই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে । আর দ্বিতীয় মহাযদ্ধ চালকালেই বিশ্ব জাতিসমূহের একটি নতুন বিশ্ব সংস্থা গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়ে যায়। আরও অধিক বাস্তবতাকে ভিত্তি করে আরও অনেক বেশী সংখ্যক দেশ ও শামিল করে যে বিশ্ব সংস্থা পরবর্তীতে গঠিত হয়, তার নামকরণ হয় জাতিসংঘ ( United Nation Organization) ১৯৪৩ সনে-১৯৯৩ সনে মুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি-এই সংস্থার বীজ বপন করা হয়। অতঃপর দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে বটে, নিরীহ মানুষের অকারণ রক্তপাত এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে বর্তমান সময় পর্যন্ত-বিগত ৪০-৪৫ বছরের মধ্যে-কোন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়নি যেমন পূর্ব সংঘটিত হয়েছিল। জাতিসংঘ একটি সনদ ঘোষণা করেছে, যা ‘জাতিসংঘ সনদ’ নামে অভিহিত। বিশ্ব জাতিসমূহের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার জন্য গৃহীত উল্লিখিত দুইটি পদক্ষেপ মূলত সেই পথের দিকের পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য হতে পারে, যে দিকে বিশ্বমানবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইসলাম দেড় হাজর বছর ধরে দুনিয়ার মানুষর নিকট আকুল আহবান জানাচ্ছে। ইসলামের আহবা ব্যক্তি ও সামষ্টিকভাবে গোটা বিশ্বমানবতার প্রতি। মানবতা তদের পাস্পরিক সব পার্থক্য-তারতম্য, সব বিভেদ-বিবাহ সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাক এবং তাদের মধ্যে কাল্পনিকভাবে যেসব পার্থক্যের প্রাচীর দাঁড় করানো হয়েছে, তা র্নিমূল হোক এবং নির্বিশেষে সমম্ত মানুষ পরস্পর ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে গড়ে তুলুক- তা ই হচ্ছে ইসলামরে কাম্য। সমস্ত মানুষকে এক ও অভিন্ন নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে একটি মাত্র রাষ্ট্রের পতাকাতলে সমবতে করাই ইসলামের লক্ষ্য। কেননা এছাড়া জাতিতে জাতিতে বিভক্ত এই মানবতাকে রক্ষা করা-মানুষের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন ও স্থায়ী করে তোলা অন্য কোনভাবেই সম্বব হতে পারে না। অথচ যদি ইসলামের কাম্য ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করা হয়, তাহলে অকারণ যুদ্ধের দামামা বেজে উঠা এবং লক্ষ কোটি নিরীহ মানুষের রক্তের বন্যা বয়ে যাওয়ার কোন কারণই আর অবশিষ্ট থাকবে না।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা
বর্তমান জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পশ্চাত্যের বড় বড় চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদগণ ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করতে শুরু করেছে যে, বর্তমানে জাতিসংঘ যেমন করে এক ‘বিশ্ব সংসদ’-এর রূপ ধারণ করেছে, বিশ্বের একক কেন্দ্র হওয়ার মর্যাদা পেয়েছে, তা-ই ক্রমশ বিশ্বমানবকে হিংস্র সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত করে একটি বিশ্বরাষ্ট্রর নাগরিকত্ব গ্রহণে অধিকতর আগ্রহী ও উদ্যোগী করে তুলবে। ফলে ভু-পৃষ্ঠে বসবাসকারী সমস্ত মানুষ পূর্ণ সমতা ও অভিন্নতা সহকারে বেঁচে থাকার সুযোগ লাভ করবে। বিশ্বের বড় বড় চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদদের এই কামনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত শুভ, তাতে কোন দ্বিমতের অবকাশ নেই, একথাও সথ্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই কামনা বাস্তবায়িত করে তোলার সুস্থ ও স্বভাবসম্মত পন্থা কি হতে পারে?
বর্তমান জাতিসংঘই শেষ পর্যন্ত বিশ্বরাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করবে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে । বিষয়টি দীর্ঘ ও বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষও বটে। জাতিসংঘ বর্তমান ও সদা সক্রিয় থাকা অবস্থায়ও দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মধ্যে আঞ্চলিক বা স্থানীয় ভিত্তিতে হলেও যুদ্ধ ও রক্তপাত চলছে। এক অঞ্চলে কিছুকাল যুদ্ধ চলার পর হয়ত সে যুদ্ধ থেমেও গেছে, কি কোথাও তা বছরের পর বছর ধরে অব্যাহতভাবে চলছে, যুদ্ধ সম্ববনা সম্পূর্ণ বন্ধ করা জাতিসংঘের পক্ষে সম্বব হয়নি। তাতে তার চরম ব্যর্থতা ও অক্ষমতাই প্রকট হয়ে উঠা। জাতিসংঘের এ ব্যর্থতার মূল বহু কারণ- একাথা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। কারণসমূহের মধ্যে দুটি কারণ সর্বাধিক প্রকট বলে মনে হয়। তা হচ্ছেঃ ১ জাতিসংঘের কিংবা নিরাপত্তা পরিষদে বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের ‘ভেটো’ প্রয়োগ করার সুযোগ ও স্বীকৃতি এবং ২ জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত ও ঘোষণাকারী বাস্তবায়িত করার মত কোন শক্তি তার হাতে না থাকা।
জাতিসংঘ বর্তমান ও সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও আঞ্চলিক যুদ্ধেসমূহের বন্ধ না হওয়ার মূলে বৃহৎ শক্তিসমূহের কারসাজি খুবই মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে। হয় সে আঞ্চলে যু্দ্ধে কোন বৃহৎ রাষ্ট্র নিজেই প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত অথবা সেই বৃহৎ রাষ্ট্রের স্বার্থে ও ইঙ্গিতেই সে আঞ্চলিক যুদ্ধ ব্ন্ধ হোক-তা সেই বৃহৎ রাষ্ট্রই চায় না। দুনিয়ার রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শক্তির ভারষাম্যও নষ্ট হয়ে গেছে এই পরাশক্তিশমূহের মানবতা পরিপন্থী নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে। ফলে বর্তমান জাতিসংঘটি কার্যত পরাশক্তিসমূহের ক্রীড়নক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বর্তমান জাতিসংঘের দ্বারা যেমন আঞ্চলিক যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়া এবং সমগ্র বিশ্বব্যাপী পরম শান্তি স্থাপিত হওয়ার মর্যাদা লাভ করতে পারবে-এমন সম্ববানাও সূদুর পরাহত মনে হয়।
সহজেই বোঝা যায়, বর্তমান ‘জাতিসংঘ’ জাতিসমূহের সংঘ। দুনিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তার সদস্যপদ গ্রহণ বা লাভ করেছে। ফলে জাতীয়তার স্বাতন্ত্র্য ও বিভিন্নতা মৌলিকভাবেই স্বীকৃত। আর বিগত শতাব্দী কালের বাস্তব অভিজ্ঞতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করছে, এই জাতীয়তাই হচ্ছে বিশ্বমানবতাকে বিভিন্ন সাংঘর্ষিক খণ্ডে বিভক্ত করার অত্যাধুনিক হাতিয়ার। জাতিসংঘের সভায় বিভিন্ন দেশ জাতি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সমগ্র বিশ্বমানবতার প্রতিনিধি হিসেবে আসন গ্রহণ করে না, তথায় তারা প্রতিনিধিত্ব করে তাদের সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় বিভক্ত জাতি ও রাষ্ট্রের। জাতি ও রাষ্ট্র যখন বিভিন্ন, তখন তাদের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গিও অনিবার্যভাবে বিভিন্ন। ফলে তথায় বিশ্ব সমস্যা সম্পর্কে যত আলোচনা ও বিতর্ক হোক, তা বিশ্বমানবের সামষ্টিক সমস্যা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় না, হয় এক-একটি দেশে ও রাষ্ট্রের বিশেষ স্বার্থ, মর্যাদা ও অধিকারের দৃষ্টিতে। ফলে এতে আর কোন সন্দেহ-ই থাকছে না যে, বর্তমান জাতিসংঘই বিশ্বমানবতাকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করেই বিশ্বমানবের জন্য মহাক্ষতি ও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়য়েছে। যে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের সংগঠন প্রকৃতিতেই বিভেদ ও বিদ্বেষের বীজ বপিত, তার দ্বারা সামষ্টিকভাবে বিশ্বমানবের সুকঠিন ও প্রাণন্তকর সমস্যাবলীর সঠিক সমাধার হওয়া কি রূপ সম্ভব হতে পারে? আর তা সম্ভব যে হতে পারে না, জাতিসংঘের বিগত চল্লিশ বছরকালীন নির্লজ্জ ব্যর্থতাই তার অকাট্য প্রমাণ। জাতিসংঘ বিশ্বমানবের তো দূরের কথা কোন দুইট প্রতিবেশী জাতির পারস্পরিক বিরোধ, সংঘর্ষ ও যুদ্ধ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবি করা যেতে পারে কি?
বিশ্বরাষ্ট্র গঠনে নতুন প্রস্তাব
জাতিসংঘের এই লজ্জাকর ব্যর্থতা প্রত্যক্ষ করে কতিটয় বিশ্ব চিন্তাবিদ একটি বিশ্বরাষ্ট্র কায়েম করার প্রস্তাব করেছেন। সেই বিশ্বরাষ্ট্রের অধীন তিনটি প্রধান বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান থাকবেঃ
১. একটি মাত্র আইন পরিষদ
২. একটি মাত্র প্রশাসনিক বা নির্বাহী সংস্থা এবং
৩. একটি মাত্র বিচার বিভাগ -বিশ্ব আদালত।
তাঁদের বক্তব্যের সারনির্যাস হচ্ছে, স্থায়ী ও ব্যাপক বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কেবলমাত্র প্রস্তাব পাস ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রাষ্ট্রসমূহের ওয়াদা প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট হতে পারে না। সেজন্য এমন একটি বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক, যার একটি মাত্র আইন পরিষদ থাকবে -যেখানে বিশ্বশান্তির পক্ষে অপরিহার্য আইন পাস হবে ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, একটি মাত্র নির্বাহী বিভাগ থাকবে -তার অধীন থাকবে একটি বিশ্ব পুলিশ ও বিশ্ব সৈন্য বাহিনী, যার কাজ হবে বিশ্বের কোথাও কোনরূপ সংঘর্ষ বাঁধলে সঙ্গে সঙ্গেই তথায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা এবং কার্যত ও রক্তপাত হতে না দেয়া, -এরূপ একটি বাহিনী থাকলে খুবই আশা করা যায় যে, আঞ্চলিক এ স্থানীয় ভিত্তিতে সংঘটিত সংঘর্ষসমূহ সঙ্গে-সঙ্গেই প্রতিরুদ্ধে হয়ে যাবে এবং বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হওয়ার তেমন কোন কারণ অবশিষ্ট থাকবে না। আর একটি বিশ্ব আদালত থাকবে -যেখানে জাতিসমূহের পারস্পরিক বিবাদীয় বিষয় ও ব্যাপারাদির মীমাংসা হবে।
১. বিশ্ব পার্লামেন্টে প্রত্যেক দেশে ও জাতির প্রতিনিধি থাকবে, প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিরই বক্তব্য পেশ করার ও ভোট দানের অধিকার থাকবে -তবে তা সবই হতে হবে সেই দেশের জনসংখ্যানুসারে। ফলে অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ তুলনামূলকভাবে বেশী সংখ্যক আসন ও ভোটের অধিকার পাবে।
২. নিরাপত্তা পরিষদেও প্রত্যেকটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি থাকতে হবে। বর্তমানের ন্যায় শুধুমাত্র পাঁচ শীর্ষ স্থানীয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধি-ই নয়।
এই পরিষদই বিশ্ব-সংসদের সিদ্ধান্তসমূহ কার্যকর করার জন্য দায়ী হবে এবং সংসদের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।
৩. বিশ্ব-সেনাবাহিনী হবে মূলত শান্তি বাহিনী, শান্তি স্থাপনকারী দল। তা অবশ্যই নিরাপত্তা পরিষদের অধীন থাকবে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য
৪. বিশ্ব-আদালন বিশ্ব-সংসদে গৃহীত আইন ও সিদ্ধান্তাবলী ব্যাখ্যাদানের ও তার ভিত্তিতে জাতিসমূহের মামলার বিচার করার জন্য দায়িত্বশীল হবে।
বিশ্বরাষ্ট্রের জন্য বিশ্ব মানবিক আদর্শ
কিন্তু বিশ্বচিন্তাবিদ ও বিশ্বশান্তির পক্ষে লোকদের উপরোক্ত চিন্তা-ভাবনা ও আশাবাদ যতই যুক্তিসঙ্গত ও গভীর চিন্তা-ভাবনা নিঃসৃত হোক, এ চিন্তা বা প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? তা বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য যেসব মৌল উপাদান অপরিহার্য, তার কোনটিই তো কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। উক্তরূপ একটি বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন একটি বিশ্ব মানবিক আদর্শ, প্রয়োজন সেই বিশ্ব মানবিক আদর্শে অকৃত্রিম বিশ্বাস ও নিষ্ঠাবান চরিত্রবান নেতৃত্ব, যারা জাতীয়তা প্রীতি ও জাতীয় বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে থেকে বিশ্বমানবিক আদর্শের ভিত্তিতে বিশ্বমানবকে নেতৃত্ব দিতে পারবে, যারা বিশ্বের সকল দেশের সকল জাতির আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হবে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বে একন কোন ব্যক্তিত্ব আছে কি, আছে কি এমন বিশ্বমানবিক আদর্শ, যা নির্বিশেষে বিশ্বের সমস্ত মানুষকে প্রকৃত ও সঠিক কল্যাণের দিকে পরিচালিত করবে?
পরিকল্পিত বিশ্বরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও পরিচালনা করতে পারে কেবল সেই সব ব্যক্তিত্ব, যারা মানুষকে মানুষ হিসেবেই ভালোবাসবে, তাদের কল্যাণ চাইবে। তারা বিশ্বের বিশেষ কোন জাতি প্রীতি অন্ধ হবে না, হবে না কোন পক্ষের অন্ধ সমর্থক।
কিন্তু বর্তমান দুনিয়ার সেরা রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনীতিকদের অবস্থা অত্যন্ত নৈরাস্যজনক। তেমনি বিশ্ব-আদর্শ হিসেবে বর্তমান দুনিয়ায় যে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র সুপরিচিত, তা-কখনই বিশ্বমানবিক আদর্শ হতে পারে না। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে শোষণ বঞ্ছনা ও প্রতারণা অত্যন্ত প্রকট। আর সমাজতন্ত্রে মানুষের মনুষ্যত্ব ও মানবিক অধিকার সম্পূর্ণ অস্বীকৃত।
এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, কেবল মাত্র ইসলামই হতে পারে সেই বিশ্বমানবিক আদর্শ। কেননা পুঁজিবাদী গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের ন্যায় দ্বীন-ইসলাম মানবতার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী কোন চিন্তাবিদের রচিত নয়, তা রচিত সেই মহান সত্তার, যিনি সমগ্র বিশ্বলোকের স্রষ্টা -সমগ্র মানুষের-ও স্রষ্টা ও প্রতিপালক। কোন বিশেষ জাতি বা ব্যক্তির প্রতি তাঁর কোন প্রীতি বা বিদ্বেষ থাকতে পারে না -নেই। কেননা নির্বিশেষে সকল মানুষই তাঁর ‘পরিবারভুক্ত’। সকলেরই জৈবিক প্রয়োজন পরিপূরণের জন্য তিনি এই অফুরন্ত উপায়-উপকরণের (Resources) ও সম্পদ (Wealth and power) সমাহার সৃষ্টি করেছেন এবং সর্বশেষ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে বিশ্ব-মানবিক আদর্শ হিসেবে বানিয়েছেন পূর্ণঙ্গ জীবন-বিধান ইসলাম।
দ্বীন-ইসলাম একমাত্র বিশ্ব-স্রষ্টার রচিত বিধান বলেই বিশ্বের আবহমান কালের সমস্ত মানুষকে একজন প্রথম মানুষ আদম ও তাঁর স্ত্রী হাওয়ার সন্তান-আদমের বংশধর লবে ঘোষণা করেছে, সকল মানুষের দেহে এবই পিতা-মাতার রক্ত প্রবহিত করেছে। মানুষে-মানুষে বর্ণ, বংশ,জাতীয়তা ও মানবিকতার দিক দিয়ে একবিন্দু পার্থক্য দ্বীন-ইসলামে স্বীকৃত নয়। কেউ নয় হীন নীচ, কেউ অভিজাত বংশীয়-সকলেই মানুষ। ইসলাম নির্বিশেষে সকল মানুষের পূর্ণাঙ্গ আদর্শ হিসেবে নাযিল হওয়া এবং বিশ্বমানবিক ঐক্য অভিন্নতা বাস্তবায়িত করার জন্য প্রথম থেকেই সচেষ্ট। তার বড় প্রমাণ, ইসলাম কোন দিনই বিশেষ কোন জাতি, শ্রেণী বা বর্ণের ভিত্তিতে কোন আহবান জানায়নি। ইসলামের আহবান নির্বিশেষে সমস্ত মানবতার প্রতি-মানুষ হিসেবেই। দ্বীন-ইসলামের সর্বশেষ বাহক ও উপস্থাপক ও বিশেষ কোন জাতির পক্ষে ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে পেশ করেন নি। প্রথম দিন থেকেই তাঁর সম্বোধনঃ [আরবী……………………]
হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্যই বিধান বাহক হয়ে এসেছি। আর তাঁকে যে বিশ্বস্রষ্টা-বিশ্বপালক আল্লাহ তা ‘আলা পাঠিয়েছেন, তিনি তাঁরই সম্পর্কে ঘোষণা করেছেনঃ [আরবী ………………..]
হে রাসুল! আমার তোমাকে সমগ্র মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি, অন্য কোন ভাবে নয়। হিজরতের পর ষষ্ঠ ও সপ্তম বছরই তিনি তখনকার সময়ে নানা দেশে শাসন ও বাদশাহ-সম্রাটদের প্রতি প্রেরিত পত্রের মাধ্যেমে ইসলাম কবুলের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। ফলে তিনি যে কোন আঞ্চলিক নবী ছিলেন না, ছিলেন বিশ্বনবী, তা নিঃসন্দেহে প্রমাণীত হয়ে গেছে।
বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানয় ইসলামের ভূমিকা
ইসলাম (একটি মাত্র) বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাওয়াত প্রথম দিন থেকে দিতে শুরু করেছে। সেজন্য মৌলক ও ভিত্তিগত চিন্তা হিসেবে বিশ্বমানবের একত্ব ঐক্য ও অভিন্নতা প্রমাণকারী বহু সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপিত করেছে। এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম উলেখ্য-সমস্ত মানুষের মৌলিক অভিন্নতা, বংশীয় সমতা ও একত্ব। ইসলাম উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে যে, দুনিয়ার সমস্ত মানুষ একই পিতা-মাতা-আদম ও হাওয়ার বংশধর। আদম ও হাওয়াই দুনিয়ায় সর্বপ্রথম মানব-মানবী। তাদের দুইজনকে মটির মৌল উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। সমুষ্যত্ব ও মানবীয় বিশেষত্ব সমস্ত মানুষ এক, সকলেরই পরিণতি সর্বতোভাবে এক। সকলকেই একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে। এ-ই যখন পরম ও চুড়ান্ত সত্য, তখন বিভিন্ন বৈষয়িক ও বস্তুগত পার্থক্যের ভিত্তিতে মানুষকে বিভিন্ন জাতীয়তায় বিভক্ত করা কোনক্রমেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। বস্তুগত উপকরণের দিক দিয়েও মানুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা নিতান্তই অমানুষিক কর্মকাণ্ড ছাড়া আর কি হতে পারে? ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ পৃথিবীর কোন্ ভৌগোলিক সীমার মধ্যে, কোন্ বংশে, কোন্ বর্ণে বা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোন্ শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ করেছে, তা বিন্দুমাত্র গুরুত্ববহ নয়। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদের এ আয়াতটি বিশেষভাবে বিবেচ্যঃ [আরবী*******************]
হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন মেয়ে লোক থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রভুক্ত বানিয়েছি শুধু এইজন্য, যেন তোমরা পরস্পরে পরিচিতি লাভ করতে পার। প্রকৃত কথা হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানার্হ সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহ ভীরু -আল্লাহ অনুগত।
বিশ্বরাষ্ট্র তো মানুষকে নিয়েই গড়তে হবে। আর মানুষকে নিয়ে বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন মানবীয় অভ্নিতা স্বীকৃত সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করা। কুরআন মজীদের উদ্ধৃত আয়াতটি সেই কাজ-ই করেছে। এ আয়াত অনুযায়ী মানুষের মৌলিক একত্ব ও অভিন্নতা চিরন্তন সত্য হিসেবে অবশ্য স্বীকৃতব্য। হবে একথাও অনস্বীকার্য যে, দুনিয়ার প্রচলন অনুযায়ী মানুষ বিভিন্ন বংশ-গোত্র ও ভৌগোলিক অঞ্চল ও বর্ণে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। কুরআন এই বিভক্তিকে অস্বীকার করেনি। বরং কুরআনের বক্তব্য হচ্ছে, এই পার্থক্যসমূহ স্বাভাবিক; কিন্তু তা যেমন মৌলিক পার্থক্য নয়, তেমনি তা এক বৈষয়িক ও ব্যবহাকি লক্ষ্যের জন্য নিবদ্ধ। আর তা হচ্ছে মানুষের পরস্পরের মধ্যে পরিচিতি লাভ। এই পরিচিতি লাভ কিছুমাত্র অপ্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু তাই বলে সে পার্থক্যের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে মৌলিক একত্ব ও অভিন্নতা অনস্বীকার্য।
বস্তুত বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে সমগ্র মানুষের মৌলিক একত্ব এবং কুরআন তা অকাট্য ও চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।কুরআনে ঘোষণা হচ্ছে- সমস্ত ব্শ্বিলোক যেমন এক আল্লাহর সৃষ্টি, তেমনি সমস্ত মানুষের সৃষ্টিকর্তাও সেই এক মহান আল্লাহ। অতএব তাদেরে সকলেরই জন্য আইন ও জীবন হতে পারে কেবলমাত্র তা-ই, যা সেই মহান আল্লাহ নিজে নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্য রচনা করে নাযিল করেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত সেই আইন ও বিধান-হতে পারে সমস্ত মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে পূর্ণ মাত্রায় সমঞ্জস্যশীল। কেননা মানুষ যে বিশাল বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে বসবাসকারী, সেই বিশ্ব প্রকৃতি-তার প্রতিটি অনু পরমাণু এক আল্লাহর প্রতিষ্ঠি আইন-বিধানের অধীন ও অনুগত। এর কোন একটি জিনিসও আল্লাহর প্রাকৃতিক আইনের অধীনতা থেকে মুক্ত নয়। সবকিছুই ইচ্ছায় হোক, প্রতি মুহূর্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ এই মানুষ সেই আল্লাহর আইনের আনুগত্য না করে কিছুতেই থাকতে পারে না। বরং সে আইনের আনুগত্য করা এবং তার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলায়ই মানুষের জীবন নিহিত। সে আইনের লংঘনে মানুষের বস্তুগত মৃত্যু ও ধ্বংস যেমন অনিবার্য, তেমনি মানুষের নৈতিক জীবনের জন্য সেই আল্লাহরই নাযিল করা আইনের লংঘন তার নৈতিক জীবনের নিশ্চত অপমৃত্যু, তাতে কোনই সংশয় থাকতে পারে না।
মানুষ এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য সারাটি দুনিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আল্লাহর অফুরন্ত ও অপরিমেয় জীবনোপকরণের প্রয়োজনীয় পরিমাণে নিরবচ্ছিন্ন প্রান্তের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু মানুষ বর্তমানে বিছিন্ন সাংঘর্ষিক জাতীয়তা ও রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্রের দ্বারা বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত বলে নিজের পরিমণ্ডলেই সব প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকে বঞ্ছিত থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এই কারণে -দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে মহান আল্লাহর সৃষ্ট সর্বপ্রকারের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণে ধন্য করে তোলার লক্ষ্যে বর্তমান জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলির বেড়াজাল ছিন্ন ভিন্ন করে একটি মাত্র বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। বর্তমানে দুনিয়ার কোথাও যদি ধন-ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য ও বন্যা প্রবাহ, অন্যত্র চলছে চরম শুষ্কতা, নিদারুণ অভাব-অনটন ও পীড়াদায়ক দারিদ্র্য। এক দেশে যদি খাদ্যের বিপুলতা, অন্য দেশে খাদ্যের চরম দুর্ভিক্ষ। ফলে লক্ষ লক্ষ লোক ক্ষুধার প্রচণ্ড আঘাতে জর্জরিত, অসহায়ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আবার অন্যত্র সম্পদের প্রাচুর্য পাহাড় সৃষ্টি করেছে, কে তা ভোগ-ব্যবহার করবে -তা পাওয়অ যায় না। ফলে অপচয় ও বিলাসিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে মানুষ রসাতলে চলে যাচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বে পাশ্চাত্যের বিভ্রান্ত দার্শনিক গুরুদের প্রদত্ত শিক্ষার প্রভাবে যে বংশীয় ও জাতীয় আভিজাত্য তথা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের আহবান চলছে, তা এই মানুষের জন্য কিছুমাত্র কল্যাণকর বিবেচিত হতে পারে না। কৃত্রিম ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে মানুষকে যে বিভিন্ন পার্থক্যপূর্ণ শ্রেণীতে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে, তা মানুষের মনুষ্যত্বকেই ক্ষত-বিক্ষত করছে, শ্রেণীসমূহের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ ধ্বংসাত্মক আত্মকলহে জর্জরিত হয়ে নিঃশেষ ধ্বংস হয়ে যাক, তারা যেন কোনদিনই মানুষের অধিকার ও মর্যাদা লয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগই না পায়।
এই মর্মান্তিক অবস্থায় অবস্থিতি বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধক যেমন, ঠিক তেমনি মানবতার অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এই বিভিন্নতা ভেঙ্গে একাকার করে দিয়ে একটি বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা প্রকট করে তুলছে।
ঠিক এই কারণে বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ আহবায়ক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) -বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেনঃ [আরবী*********************]
কোন আরব ব্যক্তির কোন অনারব ব্যক্তির উপর -কোন অনারব ব্যক্তি কোন আরব ব্যক্তির উপর একবিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব বা বিশিষ্টতা স্বীকৃত হতে পারে কেবলমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে। -[ আবরী টীকা*******************]
বলেছেনঃ [আরবী**********************]
তোমাদের সব মানুষই আদমের সন্তান। আর আদম তো মাটি থেকে সৃষ্ট। -[ আরবী টীকা*********************]
বলেছেনঃ
-[আরবী টীকা*********************]
হে মানুষ! আল্লাহ তা’আলা তোমাদের থেকে জাহিলিয়াতের আভিজাত্য গৌরব ও পূর্ণ বংশ নিয়ে অহংকারী ও বড়ত্বাভিমান দূর করে দিয়েছিলেন। তোমরা জেনে রাখবে, তোমরা সকল মানুষই আদমের সন্তান আর আদমকে তো মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। -[আরবী টীকা************************]
ইরশাদ করেছেনঃ [আরবী*******************************]
জেনে নাও, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে সেই বান্দা, যে তাদের সকলের তুলনায় অধিক তাকওয়অ সম্পন্ন। মানুষ আদমের সময় থেকে আজকের এই দিনটি পর্যন্ত চিরুনীর দাঁতগুলির ন্যায় সম্পূর্ণ সমান। যেমন আরব অনারবদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা উত্তম নয়, কৃঞ্চাঙ্গের উপর গৌরাঙ্গেরও কোন শ্রেষ্টত্ব বা আভিজাত্য নেই। যা কিছু শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য, তা কেবলমাত্র তাকওয়ার কারণে।
[আরবী****************************]
মানুষ গুণগতভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের মানুষ ঈমানদার তাকওয়া সম্পন্ন ও ভদ্র উদার, আল্লাহর নিকট সম্মানার্হ। আর এক প্রকারের মানুষ হচ্ছে পাপ প্রবণ, ভাগ্যহী দুষ্ট প্রকৃতির, আল্লাহর নিকট যার কোনই মর্যাদা নেই।
[আরবী**********************************]
জেনে রাখো, আরবত্ব বংশীয় ভাবে বা জন্মসূত্রে হয় না তা হচ্ছে বাকশক্তি সম্পন্ন বাণী। যার আমল ত্রুটিপূর্ণ, অক্ষম, সে বংশের জোরে সেই মর্যাদায় পৌছতে পারে না।
[আরবী*********************************]
জাতীয়তা নিয়ে অহংকার করা লোকদের পরিহার করা উচিত। যেসব লোক তা করে, তারা জাহান্নামের কয়লা মাত্র। অন্যথায় তারা আল্লাহর নিকট সেই ভারবাহীদের চেয়েও হীন হয়ে যাবে, যারা নিজেদের নাক দ্বারা ময়লা দূর করে।
রাসূলে করীম (স)-এর এসব ঘোষণায় মানুষ সম্পর্কে যে মৌলিক ধারণা পেশ করা হয়েছে তা যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মানুষ সম্পর্কে সুষ্ঠু চিন্তার সুষ্ঠু পদ্ধতিও। মানুষকে নিয়ে একটি বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের জন্য মানুষ সম্পর্কে যে মৌলিক ধারণা একান্ত অপরিহার্য, তা-ই রাসূলে করীম (স)-এর ভাষণে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে পেশ করা হয়েছে। সেজন্য সর্ব মানুষের এক ঐক্যবদ্ধ সবাজে পরিণত হওয়ার পথে যত প্রতিবন্ধকতাই রয়েছে, রাসূলে করীম (স) ঘোষিত আদর্শ সেই সব কিছুকেই নস্যাৎ করে দিয়েছে। যেসব কারণে মানুষের পরস্পরে, যেসব কারণে ব্যক্তিগতভাবে বা দলগত কিংবা জাতিগতভাবে যুদ্ধ-সংঘর্ষ বাঁধে, আর যার ফলে কোটি কোটি নিরীহ মানুষের মহামূল্য রক্ত অকারণ প্রবাহিত হয়, তা সবই দূর করে দেয়ার ব্যবস্থা তাতে রয়েছে। রাসূলে করীম (স) ঘোষিত আদর্শ অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা হলে এক দিকে যেমন নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত নিয়ামতসমূহ পেয়ে ধন্য হতে পারে, তেমনি বিশ্বমানবের জ্য এক অভিন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থা -বিশ্বরাষ্ট্র -গঠনের পথও উন্মুক্ত হতে পারে।
ঈমানই হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ মানব সৃষ্টির নির্ভুল ভিত্তি
বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সমাজ সৃষ্টি করা। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ মানব সমষ্টি গঠন কি করে সম্ভব, ব্যক্তিগণ এক এক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন স্বতন্ত্র সত্তা হওয়া সত্ত্বেও তারা এক ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তার অংশে পরিণত হতে পারে কিভাবে -অন্য কথায়, ইসলামী উম্মত গঠনের মৌল উপাদান কি কি, সে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কেননা মানুষ স্বভাবতই কাউকে আপন মনে করে, কাউকে মনে করে পর। কি কি কারণে মানুষ অপর মানুষকে আপন মনে করতে পারে না, তাদেরকে পর মনে করে, তাদের সাথে একাত্মতা সৃষ্টি করতে প্রস্তুত হয় না, এই পর্যায়ে তা বিশ্লেষণ করা একান্ত আবশ্যক।
মানুষে মানুষে একাত্ম হওয়ার জন্য সমাজ-বিজ্ঞানীরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উল্লেখ করে থাকেনঃ
১. এক দেশ, এক ভূ-খণ্ড বা এক ভৌগোলিক এককের মধ্যের লোক হওয়অ;
২. রক্ত-সম্পর্ক, একই সম্প্রদায় বা একই জাতিভুক্ত লোক হওয়া;
৩. একই ভাষাভাষী হওয়া;
৪. একই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অধিকারী হওয়া;
৫. স্বার্থ ও কল্যাণ লাভের ক্ষেত্রে অভিন্ন হওয়া।
এই বিষয়গুলি যখন কোথাও সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে একত্রিত হয়, তখনই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ পরস্পরের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এ দিক দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া লোকগুলি পরস্পরের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এ দিক দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া লোকগুলি পরস্পরকে আপন মনে করে এবং এর বাইরে অবস্থানকারী লোকদেরকে পর মনে করে। মনে করে ওরা ভিন্ন লোক, ওদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই -একাত্মতা নেই। দুনিয়ার জাতীয়তাবাদী দল বা লোক সমষ্টিসমূহ এই সবের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদী মনোভাব সৃষ্টি করেছে এবং এক-একটি জাতি গড়ে তুলেছে। জাতির লোকদেরকে অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর বানিয়ে নিয়েছে।
মোটকথা, উক্ত দিকগুলির ভিত্তিতে যে জনসমষ্টি এক ও অভিন্ন, তারা এই উম্মত (Nation) রূপে পরিচিত হয়েছে। আর যেসব এই দিক দিয়ে পরস্পর সাঞ্জস্যশীল নয়, তারা এদের থেকে ভিন্ন জাতিরূপে চিহ্নিত হয়েছে।
কিন্তু এই যে বিষয়গুলির দিক দিয়ে অভিন্নতার কারণে এক-একটি জাতি গড়ে উঠেছে এবং অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতি সত্তারূপে চিহ্নিত হয়েছে, এই দিকগুলি মানুষের ইচ্ছা-বহির্ভূত। এ গুলির উপর মানুষের কোন হাত নেই। আর মানুষের ইচ্ছা ক্ষমতা-ক্ষমতা বহির্ভুত ভিত্তির উপর জাতি গঠন কখনই প্রকৃত জাতি গঠন হতে পারে না। এ দিকগুলির কারণে যারাই অভিন্ন, প্রকৃত অবস্থার দিক দিয়ে তারা অভিন্ন প্রমাণিত হতে পারে না।
এরপরও এমন অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে যেতে পারে, যেগুলি মানুষের ইখতিয়ারভুক্ত এবং সে কারণে তাদের পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও একাত্মতা না হয়ে মারাত্মক ধরনের বৈপরীত্য, তারতম্য ও বিভিন্নতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। উপরোল্লিখিত দিকগুলির ভিত্তিতে অভিন্ন বলে চিহ্নিত ‘জাতিসত্তা’ এসব পার্থক্য ও বিভিন্নতার কারণে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে।
বস্তুত ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা গড়ে তোলার জন্য ব্যক্তিগণের মধ্যে এমন প্রকৃত ঐক্যভিত্তি থাকা একান্তই আবশ্যক, যা বিভিন্ন স্বতন্ত্র ব্যক্তিদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে -ভিন্ন ভিন্ন হতে দেয় না। আর সে ঐক্যভিত্তি তা-ই হতে পারে, যা মানুষের ইচ্ছা ও ইকতিয়ারভুক্ত। যার কারণে মানুষ অন্তরের তীব্র আকর্ষণে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পুরাপুরিভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়, পারস্পরিক সব বিভিন্নতা নিঃশেষ ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, যার দরুন মানুষ পরস্পরের সুকে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হয়ে উঠে। তখন মানুষ অপরের জন্য তাই কামনা করে, যা সে নিজের জন্য পছন্দনীয় ও কল্যাণকর মনে করে। অপরের জন্য তাই অপছন্দ করে, যা নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে করে। কিন্তু এই উচ্চতর মহান মানবীয় ভাবধারা জন্মস্থানের একত্ব, রক্ত, ভাষা, বর্ণ বা ইতিহাস-ঐতিহ্যের অভিন্নাতর কারণে লাভ করা সম্ভব নয়। কেননা এগুলি এমন নয়, যা মানুষের মধ্যে প্রকৃত ঐক্য ও একাত্মতা গড়ে তুলতে সক্ষম।
অন্য কথায়, চিন্তা ও বিশ্বাস এবং আদর্শগত বিভিন্নতা -জীবনের লক্ষ্য ও অন্তরের কামনা-বাসনার দিক দিয়ে বিভিন্নতা থাকলে পরস্পর অবিচ্ছিন্ন ঐক্যে পরস্পর মিলিত ও একত্রিত হতে পারে না। ফলে এমন জনসমষ্টি এক ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তার রূপ পরিগ্রহ করতে পারে না, যারা চিন্তা-বিশ্বাস, আদর্শ, জীবন লক্ষ্য ও অন্তরের কামনা-বাসনার দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন নয়।
ইচ্ছা ও ইখতিয়ার-বহির্ভূত বিষয়াদিতে ঐক্য ও একাত্মতা যতই দেখানো হোক, মানুষের মধ্যে প্রকৃত স্থায়ী ও দৃঢ় ঐক্যের ভিত্তি রচনা করতে পারে না। কেননা তাদের মধ্যে চিন্তা-বিশ্বাস, আদর্শ ও কামনা-বাসনার দিক দিয়ে চরম বৈপরীত্য থাকা তখনও খুবই সম্ভব।
মানুষের নিকট তার নিজের চিন্তা-বিশ্বাস ও নিজের সচেতনভাবে গৃহীত আদর্শকে ইচ্ছা ও ইখতিয়ার-বহির্ভূত বিষয়ে ঐক্যের তুলনায় অনেক বেশী পবিত্র ও অধিকতর সম্মানার্হ মনে করে। মানুষ নিজের আদর্শের জন্য জীবন ও ধন-মাল অকাতরে কুরবানী করতে পারে। ভিন্নতর আদর্শের ধারককে জন্মভূমি, বংশ, বর্ণ ও ভাষার দিক দিয়ে অভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও নিজের শত্রু মনে করতে পারে এবং স্বীয় চিন্তা-বিশ্বাস ও আদর্শ রক্ষার জন্য তার বিরুদ্ধে লড়াইও করতে পারে। তার সাথে মিলিত হয়ে কোন জাতি গঠন করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত না-ও হতে পারে। ফলে এই লোকদিগকে কোন ঐক্যের বন্ধনে বাঁধা যায় না, তাদের সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তোলা সম্ভবপর হয় না।
একটি ভূ-খণ্ডে বা ভৌগোলিক অঞ্চলে জন্ম গ্রহণকারী, একই ধরনের জীবন যাত্রা নির্বাহকারী, একই বংশমূল থেকে উৎসারিত, ভাষা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যে যাত্রা নির্বাহকারী, একই বংশমূল থেকে উৎসারিত, ভাষা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যে অভিন্ন ব্যক্তিরা আকীদা-বিশ্বাস এবং সচেতনভাবে গৃতীত মত, নীতি ও আদর্শের দিক দিয়ে পরস্পর বিভিন্ন হতে পারে। বলতে পারে, ব্যক্তির সার্বিক স্বাতন্ত্র্য ও ভিন্নতাই আসল ও মূল, তার বাইরে সমাজ-সমষ্টির কোন স্থান বা গুরুত্বই নেই। তখন মানুষ নিছক ব্যক্তিগত বৈষয়িক বস্তুগত স্বার্থের দরুন এমন স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করে দিতে পারে, যার দরুন ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠতে পারে, বাইরের কোন শক্তি ব্যক্তিদের বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত করে এই যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে এ উদ্দেশ্যে যে, অতঃপর উভয় দিকের লোকদের নিকট যুদ্ধ সরঞ্জাম ও অস্ত্র-শস্ত্র দেদার বিক্রয় করার মহাসুযোগ পাওয়া যাবে। এরূপ অবস্থায় অখণ্ড জাতিসত্তা রূপে ঘোষিত এই জনসমষ্টির অস্তিত্বই বিনষ্ট ও বিলীন হয়ে যাওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।
পক্ষান্তরে অন্য কিছু ব্যক্তি ভিন্নমতের বিশ্বাসী ও ধারক হয়ে সমাজ সমষ্টিকেই মূল ও আসল মনে করে তাকেই অগ্রাধিকার দিতে পারে। বলতে পারে, সমাজ বাঁচলেই ব্যক্তিও বাঁচবে। তাই ব্যক্তির উচিত সমাজ-সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যকে উৎসর্গ করে দেয়া। তখন সমাজই বড় হয়ে দেখা দেবে, ব্যক্তি অত্যন্ত হীন ও নগণ্য হয়ে দাঁড়াবে। চিন্তার এই মারাত্নক ধরণরে বিভিন্নতা ও বৈপরীত্য সম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে জন্মস্থানের-বংশের-রক্তের-ভাষা-ইতিহাস-ঐতিহ্যের অভিন্নতা কি একীভূত ও ঐক্যবদ্ধ এক জাতি গড়তে সক্ষম হতে পারে?
আধুনিক সমাজ-বিজ্ঞানীগণ জাতি গঠনের উপাদান হিসেবে যেগুলির কথা বলে-যা উপরে উদ্ধৃত হয়েছে-তা মানুষকে একই কেন্দ্রে একীভুত করার দিক দিয়ে কিছু-না-ভুমিকা পালন করে,তা অস্বীকার করা হচ্ছে না। কিন্তু তার সাথে ও ইচ্ছা ও ইখতিয়ারমুল উপাদান একীভুত না হলে প্রকৃত কোন জাতিসত্তা গড়ে উঠেতে পারে না। কেননা চিন্তা-বিশ্বাস ও আদর্শ এসব অভিন্নতার ভিত্তিকে গুড়িয়ে দিতে পারে। বাহ্যিক দৈনেক অভিন্নতা আন্তরিক ও অভ্যন্তরীণ একান্তত সৃষ্টি করতে পারে না। মানবাধিকারের সনদের প্রথম ধারা-মানুষ পরস্পরের ভাই হবে- বিশ্বাস ও ধর্মে যতই পার্থক্য থাক-না কেন- এ ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে না। চিন্তা-বিশ্বাস ও আদর্শের পরস্পর বিপরীত দুই ভাই-ও পরস্পরের প্রকৃত ভাই হতে পারে না, ঐক্যবদ্ধ জাতি হয়ে উঠা অনেক দূরের।
ব্যক্তিদের ঐক্য ও এক ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা গড়ে তোলার জন্য ব্যক্তিদের জীবন-সঙ্গী গ্রহণে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক। কিন্তু চিন্তা-বিশ্বাসে ও জীবন-দর্শনে অভিন্ন না হলে দুই ব্যক্তির পক্ষেও পরস্পর মিলত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব হয় না। এ যেমন বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত সত্য, তেমনি কুরআনে ঘোষিত সত্যও তাই। কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছেঃ
[আরবী……………….]
মু ‘মিন লোকেরা পরস্পরের ভাই।
অর্থাৎ ঈমানের দিক দিয়ে যারা পরস্পরের সাথে অভিন্ন, বাস্তব জীবনধারায়ঁও তার পরস্পরের সাথে ঐক্যবদ্ধ। এই ঈমান-ই ব্যক্তিগণকে একীভূত করতে সক্ষম- জন্মভূমির অভিন্নতা নয়। এগুলির অভিন্নাতার ভিত্তিতে জাতি গঠনের চিন্তা যে ব্যক্তি প্রথম পেশ করেছে, তার নাম ‘জুবিনো’ বলে শুনা যায়। ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের জন্য এই সব কয়টির কিংবা এর মধ্যে কোন একটির অভিন্নতাকে ভিত্তি করা যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিল সেই কোন দূর অতীতে। পরে তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ও সমাজবিজ্ঞানে স্বীকৃত মতাদর্শের স্থান দখল করে। মুসোলিনী ও হিটলার এই মতের উপর ভিত্তি করেই জার্মান ও ইটালীয়ান জাতি গড়ে তুলেছিলেন এবং মানবেতিহাসের মর্মান্তিক বিপর্যয় সর্বধ্বংসী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রকৃত কারণ-ও ছিল সেই মতটি।
উম্মত বা ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা গঠনের ইসলামী ভিত্তি
কিন্তু ইসলামে জাতি গঠনের উপাদান ও কার্যকরণ সম্পূর্ণ ভিন্নতর। আর তা হচ্ছে ‘ঈমান’। ইসলাম ঈমানের ভিত্তিতেই জাতি গঠন করে, ঈমানের উপরই তার স্থিতি, ঈমানের ভিত্তিতেই তার উৎকর্ষ, উন্নতি ও অগ্রগতি। এ জাতির গোটা জীবন-ই সার্বক্ষণিকভাবে পরিচালিত হয় সেই মৌলিক ও ভিত্তিগত ঈমান অনুযায়ী। যেখানেই ঈমানের লংঘন, সেখানেই জাতিসত্তার অস্তিত্ব বিপন্ন ও বিপর্যস্ত।
এই ঈমান বলতে বোঝায় আকীদা-বিশ্বাস পরম ঐক্য ও একাত্মতা। এ ঈমান বংশানুক্রমিক নয়, আঞ্চলিক নয়, ভাষা বা বর্ণভিত্তিক নয়! এ ঈমান বিশ্বজনীন, চিরন্তন ও শাশ্বত। এ ঈমান শুধু ব্যক্তিগতই নয়, সামষ্টিকও। সমগ্র জীবন ও জীবরেন সমগ্র দিক ও বিভাগ পরিব্যপ্ত। বস্তুত এই ঈমানই হতে পারে বহু ব্যক্তির মিলন-ভিত্তি। এ ঈমান প্রত্যেক ব্যক্তির চেতনা সজ্ঞাত, প্রত্যেক ব্যক্তির মর্মমূলে গভীরভাবে গ্রথিত, রক্ত-মাংসের প্রতিটি অণুর সাথে সংমিশ্রিত।
এ ধরনেরই একটি সনসমষ্টিকে ইসলামের ভাষায় ‘উম্মত’ বা ‘সম্মিলিত জাতিসত্তা’ বলা চলে।
কুরআনের পরিভাষায় ‘উম্মত’ জীবন লক্ষ্যে অভিন্নতা এবং ঐকান্তিক একাগ্রতার নিদর্শন। ‘উম্মত’ শব্দের মূল ও উৎস যদি হয় ‘উম্ম’ -অর্থাৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে, তাহলে বুঝতেই হবে যে, এক ও অভিন্ন লক্ষ্যাভিসারী এই জন-সমষ্টি। অন্তত এ দিক দিয়ে সামান্য বিভিন্নতাও নেই। আর ঈমান-আকীদার অভিন্নতাই যে জনসমষ্টির ম্যেধ জীবন-লক্ষ্যের অভিন্নতার স্থপতি তা-ও অনস্বীকার্য।
কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে এ দিকে স্পষ্ট ঈঙ্গিত রয়েছে। এ পর্যায়ের কতিপয় আয়াত এখানে উদ্ধৃত হচ্ছেঃ
[আরবী************************]
অর্থাৎ ঈমানের দিক দিয়ে যেসব ব্যক্তির মধ্যে একত্ব ও অভিন্নতা, তারাই পরস্পরের ভাই হতে পারে। পরস্পরের ‘ভাই’ হওয়া পরম ও চরম মাত্রার একত্ব ও একাত্মতা বোঝায়। এই একত্ব ও একাত্মতার মৌল উৎস হচ্ছে ঈমান। ঈমান না হলে এই একত্ব ও একাত্মতা যেমন হতে পারে না, তেমনি পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারে না।
[আরবী…………..]
এবং নিশ্চয়ই তোমাদের এই উম্মত একই উম্মত এবং আমি-ই তোমাদের রব্ব। অতএব তোমার কেবলমাত্র আমারই ইবাদত কর।
এ আয়াতে এক সাথে তিনটি কথা বলা হয়েছে। প্রথম আল্লাহ-ই সমগ্র মানুষের একমাত্র রব্ব-সার্বভৌম। সেই কারণেই দাসত্ব ও আনুগত্য করতে হবে সেই এক আল্লাহর, যিনি সকল মানুষের রব্ব। আর এক আল্লাহকে রব্ব রূপে মেনে নিয়ে কেবল তাঁরই ইবাদ করাই হচ্ছে গোটা জনসমষ্টির একমাত্র কর্তব্য।এই তিনটি কাজই পরম্পর সম্পর্কিত, ওতপ্রোত এবং পরস্পর সঞ্জাত।
[আরবী…………………………….]
নিঃসন্দেহে মনে রাখবে, তোমাদের এই জনসমষ্টি এক অভিন্ন। উম্মত। আর আমিই তোমাদের রব্ব। কাজেই তোমরা ভয় করবে-সমীহ করবে কেবলমাত্র আমাকে।
এ আয়াতেও সেই তিনটি কথাই বলা হয়েছে। তবে পূর্বোল্লিখিত আয়াতে বলা হয়েছে এক আল্লাহর ইবাদত করার কথা। আর এ আয়াতে বলা হয়েছে এক আল্লাহকে ভয় করার ও সমীহ করার কথা। ভয় করা ও ইবাদত করা-এ দুটি বিষয়ও ওতপ্রোত, একিট অন্যটির পরিমাণ আল্লাহকে ভয় করলেই মানুষ আল্লাহর ইবাদত করবে। কেননা ‘ভয়’ মানুষকে বাধ্য করে যাকে ভয় করে তার নিকট সমর্পিত হতে। যাকে ভয় করে না, মানুষ তাকে ‘কেয়ার’ করে না, করার কোন প্রয়োজনও মনে করে না। দ্বিতীয়ত আল্লাহর ইবাদত নিছক কোন আনুষ্ঠানিক ব্যাপার নয়, শুধুমাত্র উঠ-বস করা বা না খেয়ে থাকার ব্যাপার। ইবাদত মহান আল্লাহর সমীপে নিজের গোট সত্তার সমর্পিত হওয়ার-সম্পূর্ণরূপে অবনত হওয়ার ভাবধারা প্রকটভাবে বর্তমান থাকা আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু ইসলামে তা কাম্য নয়।
এখানে উল্লেখ্য, সূরা আল-আম্বিয়ার আয়াতটিতে মুসলিম জনগকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর সূরা আল মু ‘মিনুন- এর এই শেষোক্ত আয়াতটিতে রাসুলগন এবং তাঁদের উম্মত-উভয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে। এ দুটি আয়াতেরই মূল প্রতিপাধ্য, ঈমান ও আকীদা-বিশ্বাসের অভিন্নতাই হচ্ছে কুরআনের দৃষ্টিতে ঐক্যবদ্ধ ‘জাতিসত্তা’ বা উম্মত গঠনের মৌল ভিত্তি। এ কথা কেবল মুসলিম উম্মতের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের উম্মতের ক্ষেত্রে ছিল পরম সত্য। পূর্ববর্তী আয়াতটিতে হচ্ছেঃ
[আরবী……………………]
হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র দ্রব্যসমূহ ভক্ষণ কর এবং নেক আমল কর। তোমরা যা কিছুই কর, আমি সে ষিয়ে পূর্ণ অবহিত রয়েছি।
[আরবী…………………]
তোমরাই হচ্ছে সর্বোত্তম, জাতিসত্তা, মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যেই তোমাদেরকে গড়ে তোলা হয়েছে। তোমরা সব ন্যায় ও কল্যাণময় কাজের আদেশ কর,নিষেধ কর সব খারাপ-ঘৃণ্য-অকল্যাণকর কাজ থেকে ( আর সর্বোপরি ) তোমার সব সময়ই এক আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলে।
বস্তুত সব সময় ও সর্বাবস্থায় ঈমান রক্ষা করে চলাই এই সর্বোত্তম জাতিসত্তা গড়ে তোলার মৌল ভিত্তি। এই জাতসত্তা লক্ষ্যহীন উদ্দেশ্যহীন নয়। কননা জতি-সত্তা মাত্রেরই একটা-না-একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকতেই হবে। একটা-না একটা একক ও অভিন্ন লক্ষ ছাড়া কোন সম্মিলিত জাতিসত্তা গড়ে উঠতে পারে না। লক্ষ্যহীন সমবেত হওয়াকে যেমন ‘ঐক্যবদ্ধ ‘ জাতিসত্তা বলা যায় না, তেমনি বিভিন্ন লক্ষ্যের অভিসারী জন সমাবেশকেও ‘জাতি’ নামে অভিহিত করা চলে না। একটি ঐক্যবদ্ধ অভিন্ন জাতিসত্তার জন্য একটা লক্ষ্য অবশ্যই থাকতে হবে এবং তার মধ্যকার সমস্ত ব্যক্তিকে হতে হবে একই লক্ষ্যের অভিসারী।
[আরবী……………………]
অতঃপর ওরা যদি তওবা করে, সালাত কায়েম করে ও রীতিমত যাকাত দেয় ও আদায় করে, তাহলেই ওরা তোমাদের দ্বীনী ভাই।
কুরআনের দৃষ্টিতে লোকদের শুধু পরস্পরে ‘ভাই’ হওয়াই লক্ষ্য নয় । লক্ষ্য হচ্ছে লোকদের ‘দ্বীনী ভাই’ হওয়া। কননা দ্বীনের ভিত্তিতে যে ভ্রাতৃত্ব, তাই ইসলামের কাম্য, শুধু ‘ভাই হওয়াটার যেমন কোন অর্থ হয় না , তেমনি প্রকৃত সম্ববও নয়। দ্বীনের প্রতি ঈমান ও বাস্তবে সেই ‘দ্বীন’-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ লোকদের মধ্যে যে ভ্রাতৃভাব গড়ে তোলে, তাই পরস্পরকে প্রকৃতপক্ষে ভাই বানিয়ে দেয়। আর দ্বীন-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ তখনই হতে পারে, যখন সালাত কায়েম করা হবে ও যাকাত দেয়া হবে। সালাত কায়েম ও যাকাত দেয়া ব্যতীত দ্বীনের অনুসরণ হতে পারে না। দ্বীনী ভাই হওয়ার জন্য ঈমানী ঐক্যের ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে সালাত কায়েম ও যাকাত দিয়ে দেয়া একান্তই অপরিহার্য।
এই সব কয়টি আয়াত থেকে যে মৌল কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে, তা হচ্ছে আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মতকে মু’মিন হিসেবেই সম্বোধন করেছেন এবং ভ্রাতৃত্ব ও জন-ঐক্যের ভিত্তি ও প্রাণশক্তি হিসেবে ঈমান-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
রাসূলে করীম (স) বিভিন্ন বাণী ও ভাষণের মাধ্যমে এই তত্ত্ব উদ্ভাসিত করে তুলেছেন। একটি হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছেঃ [আরবী*********************]
মুসলিমদের কর্তব্য ও বাধ্যবাধকতা অভিন্ন। তাদের প্রত্যেকটি সাধারণ মানুষ-ও সেই কর্তব্য পালনে ও বাধ্যবাধকতা রক্ষার সচেষ্ট হবে। -[আরবী টীকা**************]
বলেছেনঃ [আরবী*********************************]
ঈমানদার লোকদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব-ভালবাসা, পারস্পরিক দয়া সহানুভূতি ও মায়া-মমতার দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন একটি দেহ। তার কোন অঙ্গ ব্যথা-ক্লিষ্ট হলে গোটা দেহই অনিদ্রা ও জ্বরের উত্তাপে জর্জরিত হয়ে পড়ে। -[বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্মল।]
[আরবী******************************************]
মুসলিমগণ ভাই-ভাই। তাদের রক্ত সমমর্যাদা সম্পন্ন। তাদের একজন সাধারণ ব্যক্তিও তাদের কর্তব্য-দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট। তাদের দূরবর্তী ব্যক্তিও তাদের নিকটে উপস্থিত। তারা তাদের ভিন্ন অন্যদের মুকাবিলায় এক ঐক্যবদ্ধ শক্তি বিশেষ। -[আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ্]
[আরবী*********************************************]
নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ইসলামকে তাঁর দ্বীন বানিয়েছেন এবং ঐকান্তিক নিষ্ঠার বাণীকে তার জন্য সৌন্দর্য বানিয়েছেন। অতঃপর যে লোক আমাদের কেবলার দিকে মুখ করে সালাত কায়েম করবে, আমাদের কেবলার দিকে মুখ করে সালাত কায়েম করবে, আমাদের শাহাদাত উচ্চারণ করবে, আমাদের যবেহ করা জন্তু খাওয়া হালাল মনে করবে, সেই হচ্ছে মুসলিম। তার অধিকার তাইড -যা আমাদের। তার দায়িত্ব ও কর্তব্যও তাই -যা আমাদের।
মুসলিম উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ইসলাম কেবল ঈমানকে ভিত্তি বানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তা ভিন্ন আর যে যে ভিত্তি মানুষ এই উদ্দেশ্যে গ্রহণ করে সেগুলিকে মানুষের মধ্যে বিচ্ছেদ ও বিভিন্নতা সৃষ্টির কারণ রূপে চিহ্নিতও করেছে।
নবী করীম (স) বাস্তবভাবেই এ আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
নবী করীম (স) একদা জুয়াইবির-এর প্রতি দয়া ও স্নেহ-মমতার দৃষ্টিতে তাকালেন। তাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ হে জুয়াইবির, তুমি যদি বিয়ে করতে তাহলে তোমার স্ত্রীর সাহচর্যে তোমার লজ্জাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করতে পারতে। আর সে দুনিয়া ও আখেরাতে তোমার সাথে সহযোগিতা করতে পারতে।
জবাবে জুয়াইবির বললঃ সে রাসূল! আমার পিতা ও মাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক, আমাকে বিয়ে করার জন্য কে আগ্রহী হবে। আমার তো বংশ ও মর্যাদার কোন গৌরব নেই। ধন-মালও নেই। নেই সৌন্দর্য। এরূপ অবস্থায় কোন্ মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাযী হবে?
তখন নবী করীম (স) বললেনঃ হে জুয়াইবির! তুমি মনে রাখবে, জাহিলিয়াতের যুগে যে ছিল হীন ও নীচ, ইসলাম তাকে উন্নীত অভিজাত ও মর্যাদাবান বানিয়ে দিয়েভে। ইসলাম জাহিলিয়াতের সমস্ত আভিজাত্যাভিমান এবং বংশ-গৌরবকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। সমস্ত মানুষকে একই আদম বংশজাত গণ্য করে একাকার করে দিয়েছে। এক্ষণে সব মানুষ বংশের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ অভ্নিন। সকলের পিতা আদম এবং আদম মাটির উপাদানে সৃষ্ট। এক্ষণে এই নীতি কার্যকর যে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আল্লানুগত ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশী প্রিয় -ইহকালেও এবং পরকালেও। হে জুয়াইবির, এক্ষণে কোন মুসলিম তোমার চাইতে বেশী মর্যাদাবান, আমি তা মনে করি না। তবে যে লোক তোমার চাইতেও অধিক মুত্তাকী, অধিক আল্লানুগত, তার কথা আলাদা।
এর পর বললেনঃ হে জুয়াইবির! তুমি জিয়াদ ইবনে লবীদের নিকট চলে যাও। সে আনসার সম্প্রদায়ের বনু-বিয়াজা উপ-গোত্রের সরদার। তাকে গিয়ে বলঃ আমি রাসূলে করীম (স) কর্তৃক প্রেরিত, তিনি তোমাকে বলে পাঠিয়েছেন যে, জুয়াইবির-এর নিকট তোমার কন্যা যুলফাকে বিয়ে দাও।
জুয়াইবির রাসূলে করীম (স) কর্তৃক প্রেরিত হয়ে জিয়াদের নিকট চলে গেলেন। জিয়াদ ঘরেই ছিলেন। তাঁর নিকট তাঁর গোত্রের বহু লোক উপস্থিত ছিল। জুয়াইবির অনুমতি নিয়ে তথায় উপস্থিত হয়ে সালাম করে বললেনঃ হে লবীদ-পুত্র জিয়াদ। রাসূলে করীম (স) একটি বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। আপনি অনুমতি দিলে আমি তা এখানেই প্রকাশ করতে পারি।
অনুমতি পেয়ে তিনি রাসূলে করীম (স) কর্তৃক শেখানো কথা বলে দিলেন।
জিয়াদ বললেনঃ রাসূলে করীম (স) এ জন্যই কি আপনাকে আমার নিকট পাঠিয়েছিলেন?
জুয়াইবির বললেনঃ হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই রাসূলে করীম (স) সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলছি না।
জবাবে জিয়াদ বললেনঃ আমরা আমাদের কন্যা আনসার বংশের সমমর্যাদার ছেলের নিকটই বিয়ে দিতে পারি। অতএব হে জুয়াইবির! তুমি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট চলে যাও এবং তাকেঁ আমার অক্ষমতার কথা জানাও।
পরে জিয়াদ-কন্যা যুলফা জুয়াইবিরের কণ্ঠে বলতে শুনতে পেলঃ
কুরআন তো একথা নিয়ে নাযিল হয়নি। মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়্যাতও একথা প্রকাশ করেনি।
পরে সে পিতার নিকট জুয়াইবিরের সাথে তার কথোপকথন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে পিতা কন্যাকে সব কথা খুলে বলল। যুলফা সব শুনে বললঃ আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, জুয়াইবির রাসূলের নামে নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেননি। এক্ষণই তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য লোক পাঠিয়ে দিন।
জিয়াদ রাসূলে করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ জুয়াইবির আমার নিকট উপস্থিত হয়ে আপনি তার নিকট আমার কন্যা দেবার হুকুম দিয়ে পাঠিয়েছেন বলে প্রকাশ করলে আমি তার নিকট স্বীয় অক্ষমতার কথা বলেছি।
তখন নবী করীম (স) বললেনঃ ‘হে জিয়াদ, জুয়াইবির একজন মু’মিন। আর যে কোন মু’মিন পুরুষ যে কোন মু’মিন পুরুষ যে কোন মু’মিন মেয়ের জন্য কুফু। মুসলিম পুরুষ যে কোন মুসলিম কন্যার জন্য কুফু। অতএব তুমি তোমার কন্যাকে জুয়াইবিরের নিকট বিয়ে দিতে পার।
পরে জিয়াদ কন্যায় নিকট সবকথা খুলে বললে যুলফা বললঃ পিতা! আপনি রাসূলে করীম (স)-এর অমান্যতা করেছেন। আপনি অবিলম্বে জুয়াইবিরের সাথে আমার বিয়ে দিন। পরে এ বিবাহ সুন্নাত মুতাবিক অনুষ্ঠিত হয় এবং বাস্তবে প্রমাণ করা হয় যে, মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ-নীচ -আভিজাত-অনভিজাতের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই।
অপর একটি বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছেঃ সাইস ইব্ন মুতাতিবা নামক এক মুনাফিক আওস ও খাজরাজ -দুই গোত্র ইসলাম কবুল করে রাসূলে করীম (স)-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা করছিল বলে সে বিষয়ে বিদ্রূপাত্মক উক্তি করে রাসূলে করীম (স) তা শুনে মসজিদের এক জরুরী ভাষণে বলেনঃ
[আরবী*************************************]
হে জনগণ! তোমরা নিশ্চিত জানবে, রব্ব এক ও একক, দ্বীন ইসলামও এক ও অভিন্ন। আরবী তোমদের কোন বাপ-মা নয়। তা একটা ভাষা মাত্র। তাই যে লোক আরবী ভাষায় কথা বলে সে আরব। এজন্য তার স্বতন্ত্র কোন মর্যাদা নেই।
হযরত আলী (রা) বলেছেনঃ
হে জনগণ! আদম বংশে দাস-দাসীদের জন্ম হয়নি। সব মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন তবে আল্লাহ তোমাদের কতককে উপর দায়িত্বশীল করেছেন মাত্র। অতএব যে ব্যক্তি বিপন্ন হয়ে কল্যাণময় কাজে ধৈর্য ধারণ করল, সে যেন আল্লাহর উপর নিজের কোন অনুগ্রহ প্রদর্শন না করে।
একবার তিনি মদীনার আশরাফ শ্রেণীর লোকদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে তিন দীনার করে বন্টন করলেন। একজন মুক্ত ক্রীতদাসকেও তা-ই দিলেন। তখন জনৈক ব্যক্তি বললঃ আপনি এই দাসকে গতকালই মুক্ত করেছেন। আর আজই তাকে আমাদের সমান দান করলেন?
হযরত আলী (র) জবাবে বললেনঃ
আরবী*****************************]
আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি। তাতে ইসহাকের বংশের উপর ইসমাঈল বংশের লোকদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব দেখতে পাইনি। ইসলামের রাষ্ট্রীয় সস্পদে ইসমাঈল বংশের লোকদের অন্যদের তুলনায় বেশী পাওয়ার অধিকারের কথা লিখিত নেই।
এসব কারণে ইসলাম বংশধারা বা দেশমাতৃকা ভিত্তিক জাতীয়তা সমর্থন করেনি। ইসলাম জাতীয়তার ভিত্তি স্থাপন করেছে ইসলামী আকীদা গ্রহণ ও না গ্রহণের উপর। যারা সে আকীদা গ্রহণ করেছে তারা ইসলামী জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত, যারা তা গ্রহণ করেনি, তারা তার বাইরে। বিবাদ ও মীরাস প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও আকীদার ঐক্যই ভিত্তি হিসেবে গৃহীত, ঘর-বাড়ী, বংশ-রক্ত বা দেশমাতৃকা নয়। -[আরবী টীকা*************]
ইমানের সূত্র কেবল উপস্থিত জীবিত লোকদেরকেই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত করে না, তাদেরকে নিয়েই জাতীয়তা গড়ে তোলে না। তা পূর্বে চলে যাওয়া লোকদের মধ্যেও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে। কুরআন মজীদে আল্লাহ বলে দিয়েছেনঃ
[আরবী*******************************]
যেসব লোককে তাদের দিলের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে, তারাই কল্যাণ লাভে সফল। তা সেই লোকদের জন্যও, যারা আগের লোকদের পরে এসেছে, যারা বলেঃ হে আমাদের রব্ব! আমাদেরকে ও আমাদের সেই সব ভাইকে ক্ষমা দান কর, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে। আর আমাদের দিলে ঈমানদার লোকদের প্রতি কোনরূপ হিংসা-শত্রুতার ভাব জাগিয়ে দিও না। তুমি তো বড়ই অনুগ্রহসম্পন্ন -অতিশয় দয়ালু।
বস্তুত ঈমান-ই হচ্ছে স্বভাবসম্মত ঐক্যসূত্র, মিলন ভিত্তি, যেখানে একত্রিত ও অভিন্ন লোকেরাই ইসলামের দৃষ্টিতে একটি জাতিরূপে গণ্য হতে পারে। এই ব্যক্তিগণের পরস্পরের মধ্যে সমতার সম্পর্ক রচিত ও ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই দৃষ্টিতেই মুসলিম উম্মতের সম্পর্ক স্থিরীকৃত হয় দুনিয়ার অপরাপর জাতি ও সম্প্রদায়ের সাথে।
সর্বসমর্থিত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, ঈমান ও আকীদাগত অভিন্নতাই বহু ব্যক্তিকে অধিক বেশী একত্রিত এবং এক অভিন্ন ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে সক্ষম। সক্ষম সেই সব ব্যক্তিকে একই জীবন লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করতে, তাদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব-ভালবাসা ও প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম ধর্মহীন সমাজবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত-জাতি ভিত্তিসমূহের ব্যবধান নস্যাৎ করে এক উন্নত মানবতাবাদী জাতি গঠন করতে। তা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় য়ে, দুনিয়ায় ভাষা, বংশ, অর্থনৈতিক শ্রেণী বা দেশমাতৃকার ভিত্তি যে জাতি গঠন হয়, তা যেমন আদর্শ মানবিকতাবাদী জাতি হতে পারে না, তেমনি তা কোন স্থায়িত্বে গঠিত জাতিও হতে পারে না। এক জাতির লোকদের মধ্যে যে পার্থক্যহীনতা, গভীর আন্তরিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ গড়ে উঠা একান্তই আবশ্যক, তা কখনই গড়তে পারে না। তাদের পরস্পরের মধ্যে সেই স্বার্থহীন সহযোগিতা গড়ে উঠে না, যা একটি জাতির লোকদের মধ্যে জেগে উঠা কাম্য।
তাই দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য আদর্শ জাতি গঠনের জন্য ঈমানই হচ্ছে একমাত্র সূত্র ও ভিত্তি। অন্য সকল প্রকারের জাতীয়তাকে অস্বীকার করে ঈমানভিত্তিক জাতীয়তা গড়ে তোলাই দুনিয়ার বর্তমান জাতিসমূহের পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও লড়াই-ঝগড়া নির্মূল করে বিশ্বশান্তি স্থাপনের জন্য অপরিহার্য। আর এইরূপ জাতিই হতে পারে বিশ্বরাষ্ট্র স্থাপনের জন্য অপরিহার্য। আর এইরূপ জাতিই হতে পারে বিশ্বরাষ্ট্র স্থাপনের অগ্রবর্তী বাহিনী। এই জাতিই দুনিয়ার অন্যান্য মানব সমষ্টিকে ঈমানভিত্তিক জাতি গঠনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম।
আইনের দৃষ্টিতে সাম্য
ইসলামী রাষ্ট্র আইনের দৃষ্টিতে সমস্ত নাগরিক সর্বতো নাগরিকদের অধিকার ও মর্যাদা এবং অপরাধের দণ্ডদানের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য না করাই ইসলামের চিরন্তন নীতি ও আদর্শ। ইসলামী আইনের সমীপে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সুকৃতকারী ও দুষ্কুতকারী সকলেই সমান, সকলের প্রতিই অভিন্ন অচরণ গ্রহণ করা হয় এবং যার যা যতটুকু প্রাপ্য তাকে তাই এবং ততটুকুই দেয়া হয়। এ দিক দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্যকে বরদাশ করা হয় না।
আইনের দৃষ্টিতে নাগরিকদের এই সাম্য ও সমতা তুলনাহীন। কেননা দুনিয়ার অপর কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থায়াই আইনের নিটক সকল নাগরিকের সমান মর্যাদা ও অধিকারের কোন ব্যবস্থা নেই বললেও একবিন্দু অতুক্ত হবে না।
ইসলামী রাষ্ট্রের এ সাম্যনীতি মূলত দ্বীন -ইসলামের পরম সাম্যনীতিরই পরিণতি। এই ক্ষেত্রে ইসলাম দুনিয়ার অপরাপর ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে মৌলিকভাবেই ভিন্নতর। ইসলাম এ ব্যাপারে যতটা গুরুত্ব আরোপ করেছে দুনিয়ার অপর কোন ধর্ম বা মতবাদ তা করেনি, করতে পারেনি। দেশের ও সমাজের লোকেরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যত শ্রেণীতে এবং সমাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে যত পর্যায়েই বিভক্ত হোক না কেন, আইনের দৃষ্টিতে ইসলাম তাদের মধ্যে একবিন্দু পার্থক্য করতে প্রস্তুত নয়।
ইসলামের এই সমতার নীতির মূলে দুইটি ভিত্তি বিদ্যমান। প্রথম-ইলামরে মৌল বিশ্বাস হচ্ছে, সমস্ত মানুষ এক ও অভিন্ন। মানুষরে বংশ উৎপাত্তি ও বিকশ অভিন্ন ধারায় হচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে কোন দিক দিয়েই পার্থক্য বা তারতম্য করা যেতে পারে না। মানুষ যত দিন মানুষ পদবাচ্য থাকবে, ততদিনই তাদের এ অভিন্নতা অক্ষণ্ণ থাকবে। কনেনা সমস্ত মানুষ আদম ও হাওয়ার সন্তান। আর আদম ও হাওয়া মাটির উপাদানে সৃষ্টি। মানুষের মানবীয় চেতনা, অনুভূতি প্রয়োজন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা যতদিন অপরিবর্তিত থাকবে, ততদিন তারা সকলেই সমনভাবে এক আল্লাহর বান্দা। সকলেই এক আল্লাহর সৃষ্টি। অতএব তাদের মধ্যে কোন বস্তুগত কারণে পার্থক্য সৃষ্টি করা কোনক্রমেই যুক্তিঙ্গত হতে পারে না।
সমাজিকতা ও অর্থনৈতিক অবস্থার দিক দিয়ে মানুষে মানুষে পার্থক্য হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। কিন্তু সেই কারণের দোহাই দিয়ে মর্যদা ও অধিকারের দকি দিয়ে মানুষে মানুষে পার্থক্য করা-কতক মানুষকে অপরাপর মানুষের তুলনায় অধিক সম্মানিত বা সম্মানার্হ গণ্য করা এবং কারোর অধিকার বেশী কারোর অধিকার কম মনে করা বা আইনের চোখে কাউকে বেশী সুযোগ-সুবিধা দান ও অন্যান্যদের কম সুযোগ-সুবিধা দান অন্তত ইসলামের দৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।
দ্বিতীয়- আইনের ক্ষেত্রে ও তার প্রয়োগ বা কার্যকরকরেণে কাউকে অপর কিছু লোকের তুলনায় অগ্রাধিকার দান, কাউকে কম অধিকার দান, কেউ আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ করলেও কোন ধর-কাপড় হবে না, আর অপর কেউ আইন অনুযায়ী চললেও পদে পদে তাকে বাধাগ্রস্থ করা হেব-এমন অবস্থা ইসলামে কখনই হতে পারে না। কারোর জন্য এক রকমের আইন, আবার অন্যদের জন্য অপর ধরনের আনেই দ্বারা (Low of the Land) শাসিত হবে, সেই আইনে যা অপরাধ তা যেই করবে সেই-সে যে লোকই হোক-না কেন -সেই অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এই হচ্ছে ইসলামে আইনের শাসনের বৈশিষ্ট্য। এ পর্যায়ে আল্লাহ বলেছেনঃ
[আরবী……………………]
না-না তোমার রব্ব-এর শপথ এই লোকের কখখনই ঈমানদার ( বলে গণ্য ) হতে পারে না, যতক্ষণ তারা তাদের পারস্পরিক ব্যাপরিক ব্যাপারাদিতে হে নবী আপনাকে বিচারক মেনে না নেবে এবং আপনি যে রায়-ই দেবেন তা মেনে নিতে নিজেদের মধ্যে কোনরূপ কুণ্ঠাবোধ করবে না। বরং তা মাথা পেতে মেনে নেবে।
আয়াতটি মসলিম হওয়ার জন্য সাধারণ শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে রাসুলে করীম (স)-কে লোকদের পারস্পরিক ও সামষ্টিক ব্যাপার চুড়ান্ত বিচারকরীরূপে মেনে নেয়া এবং তার বিচার-বিচারের রায় অকুন্ঠ চিত্তে মাথা পেতে নেয়ার কথা। এ এক সাধারণ ও কোনরূপ পার্থক্যহীন নীতি। এ নীতির মানদণ্ডে যারাই উন্নীত, তারাই মুসলিম, যারা উত্তীর্ণ নয়, তারা মুসলিম নয়। এই সাধারণ কথাটি মুসলিম নামধারী, মুসলিম পরচিয় দানকারী ও মুসলিম বংশে জন্মগ্রহণকারী ও নওমুসলিম-সর্বজনে প্রযোজ্য্
প্রতিষ্টিত ও কার্যকর আইনে নিজের স্বার্থ ক্ষণ্ণ হতে দেখলে তা এড়িয়ে চলা এবং তাতে নিজেদের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে মনে করলে তার প্রতি এগিয়ে আসার নীতিও ইসলামে সমর্থনীয় নয়। কেননা এ হচ্ছে সুবিধাবাদী চরিত্র। আর সুবিধাবাদ ( utilitarianism ) ইসলামে তীব্র ভাষায় সমালোচিত ও তীব্রভাবে ঘৃণিত। সুবিধাবাদ কখনই আদর্শ চরিত্রের ভূমিকা হতে পার না, সুবিধাবাদী ব্যক্তি কখনই আদর্শ মুসলিম হতে পারে না, সুবিধাবাদ ও ইসলাম পালন-এ দুয়ের মাঝে আসমান যমীনের পার্থক্য। এ জন্যই কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
[আরবী…………………………………]
তাদেরকে যখন আল্লাহ ও তার রাসলের দিকে ডাকা হয়-যেন রাসুলে তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের মামলার ফয়সালা করে দিতে পারেন, তখন তাদের মধ্য থেকে একটি গোষ্ঠী পাশ কাটিয়ে দূরে চলে যায়। অবশ্য সত্য যদি তাদের অনুকূল হয়, তাহলে তারা রাসুলের নিকট বড় আনুগত্যশীল হয়ে এগিয়ে আসে।
এই পর্যায়ে আরও বলা হয়েছেঃ
[আরবী……………………….]
লোকদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থেকে আল্লাহর বন্দেগী করে। কল্যাণ দেখলে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়,আর যখনই কোন বিপদ দেখা দেয়, অমনি পিছু সরে দাঁড়ায়। তাদের ইহকালও গেল, গেল পরকালও। সুস্পষ্ট ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
কুরআন অনুযায়ী বছরের চারটি মাস যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত হারাম। প্রাচীনকাল থেকেই-হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর সময় থেকেই হ্জ্জ পালনে নিরাপত্তা ব্যবস্থার লক্ষ্যে এ নিয়ম চলে এসেছে। ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতরে সময়ও তা মোটামুটি পালন করা হতো। কিন্তু তখনকার লোকেরা নিজদের সুবিধানুযায়ী এই হারাম মাস কখনও অদল-বদল করে দিতে। যে মাসে তাদের যুদ্ধ ও রক্তপাত করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়, সে মাসে তারা তাই করত। আর বলত, এ মাসের পরিবর্তে অপর একটি হারাম মাস আমরা পালন করব। মুহাররম-এর পরিবর্তে সফর মাসেকে তারা নিজেরদের ইচ্ছমত হারাম বানিয়ে নিত। কাবার ব্যবস্থাপকরাও তা সমান্য বৈষয়িক স্বার্থ লাভের জন্য মেনে নিত। এই সুবিধাবাদী নীতির তিব্র সমালোচনা করে আল্লাহ বলেছেনঃ
[আরবী…………………………………]
নাসী ( হারাম মাসকে হালাল ও হালাল মাসকে হারাম করণ ) তো কুফরির উপর আর একটি অতিরিক্ত কুফরির কাজ, যদ্দারা এই কাফির লোকদিগকে গুমরাহীতে নিমজ্জিত করা হয়। এক বছর একটি মাসকে হালাল করে নেয়, আবার কোন বছর সেই মাসকেই হারাম বানিয়ে নেয়, যেন এভাবে আল্লাহর হরাম করা মাসগুলির সংখ্যাও পুরা করা হয়। আর আল্লাহর হরাম করা মাস হালালও হয়ে যায়। আসলে তাদের খারাপ কাজগুলিকে তাদের জন্য খুবই চাকচিক্যময় করে দেয়া হয়েছে। আর আল্লাহ সত্য অমান্যকারীদের কখনই হেদায়েত দেন না।
এই সুবিধাবাদী চারিত্রের কারণেই ইয়াহুদী পণ্ডতরা সাধারণ মানষকে খশী করা ও তাদের থেকে সামান্য হীন বৈষয়িক স্বার্থ লাভের জন্য আল্লাহর কিতাব বিকৃত করত। কুরআন তাদের এই হীন কাজের সমলোচনা করে বলা হয়েছেঃ
[আরবী……………………….]
যারা ইয়াহুদী সেজেছে, তারা কালামসমুহকে তাদের আসল স্থান থেকে এক পাশে সরিয়ে দিত।
বলা হয়েছেঃ
[আরবী……………………………]
তাই সেই সব লোকের ধ্বংস নিশ্চিত, যারা নিজেদেরই হাতে শরীয়াতের বিধান রচনা করে এবং তারপর লোকদেরকে বলেঃ এটা আল্লাহর নিকট থেকে নাযিল হয়েছে।- এরূপ বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর বিনিময়ে তারা সামান্য স্বার্থ লাভ করবে। বস্তুত তাদের হাতের এ লিখনও তাদের ধ্বংসের কারণ এবং এর সাহায্যে তারা যা কিছু উপার্জন করে, তা তাদের ধ্বংসের উপকরণ। আরও বলেছেনঃ
[আরবী……………………………..]
অতঃপর তাদের নিজেরদেরই ওয়াদা ভঙ্গ করাই ছিল ( তাদের বড় অপরাধ ) যে কারণে আমরা তাদরেকে আমাদের রহমত থেকে বহু দুরে নিক্ষেপ করেছি এবং তাদের দিলকে শক্ত, নিমর্ম ও মায়ামহব্বতহীন করে দিয়েছি। এখন তাদের অবস্থা এই যে শব্দের উল্টা করে মূল কথার নাড়াচাড়া করে ফেলে। যে শিক্ষা তাদেরকে দেয়া হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই তা ভুলে গিয়েছে এবং প্রায় প্রত্যেক দিনই তাদের কোন-না কোন খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতার সন্ধান পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই এই দোষ থেকে বেঁচে আছে।
সাধারণ ইয়াহুদীরা ইয়াহুদী সমাজের নেতৃবৃন্দ ও আলিমগণের সুস্পষ্ট মিথ্যা ভাষণ, হারাম খাদ্য গ্রহণ, ঘুষ-রিশওয়াত গ্রহণ এবং আল্লাহর আইন-বিধান পরিবর্তন প্রভৃতি হীন কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত ছিল। তারা সাধারণ লোকদেরকে আল্লাহর নাফারমানী করার অনুমতি দিত এবং বলতঃ আমরাই তোমাদের শাফা ‘আতের জোরে উতরিয়ে নেব। তারা ছিল ভয়ানক রকমের হিংসুক। এই হিংসার দরুন তাদের দ্বীনকে তারা ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছিল। তাদের হিংসা-প্রতিহিংসার শিকার লোকেরা নিজেদের মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে যেত। তাদের ধন-সম্পদ পর্যন্ত তারা লুটে পুটে নিত। তারা জনগণের উপর জুলুম-নিষ্পেষণের পাহাড় ভেঙ্গে ফেলত।
এই কারণে ইসলাম ইসলামী শরীয়াত কার্যকরকরণের পথে বাধাদানকারী কোনরূপ শাফ ‘আত করাকে সমপূর্ণরুপে হারাম করে দিয়েছি। ইসলামী দ্ন্ডসমূহ সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের উপর যথাযথ কার্যকর জন্য প্রবল তাকীদ দিয়েছে এবং যা যার প্রাপ্য তাকে তা-ই দেবার জন্য আহবান জানিয়েছে এবং যার যা প্রাপ্য নয়, তাকে তা দিতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন।
নবী করীম ( স )-এর বেগম উম্মে সালমা ( রা )-এর একটি দাসী ছিল। সে অন্য লোকদের ঘরে চরি করে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তখন রাসুল ( স ) বলেছিলেনঃ উম্মে সালমা! এটা হচ্ছে আল্লাহর ঘোষিত ও নির্ধারিত ‘হদ্দে’ বা শান্তি। তা কার্যকরকরণে কোনপরূপে বাধা বরদাশত করা যেতে পারে না। পরে রাসুলে করাম (স) সে অপারাধিনীর হাত কেটে দেয়ার নির্দেশ কার্যকর করিয়েছিলেন। [আরবী টীকা………………………….]
রাসুলে করীম (স) উসামা ইবনে জায়েদ (রা)-কে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ আল্লাহ নির্ধারিত দন্ডের ব্যাপারে কোন সপারিশ করবে না। হযরত উসামা ( রা) এক অপরাধী সম্পর্কে উক্ত রূপে সুপারিশ করবে করেছিলেন। [ আরবী টীকা…………………………..]
তিনি আল্লাহর রাসুল ছিলেন, ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রেম প্রতিষ্ঠাতা প্রধান। তিনি নাজেকে পর্যন্ত আইনের উর্ধ্বে রাখেন নি। বরং আইনের দিক দিয়ে তিনি নিজেকে সর্বসাধারণের স্তরে নামিয়ে রেখেছিলেন। নবী করীম (স) অসুস্থ হয়ে পড়লে একদা মসজিদের মিম্বর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেনঃ আমার নিকট কারোর কিছু প্রাপ্য থাকলে তা যেন সে চেয়ে নেয়, কারোর উপর অবিচার করে থাকলে সে যেন তার প্রতিশোধ আমার উপর নিয়ে নেয়। এই কথা শুনে সাওদা ইবন কাইস ( রা ) দাঁড়িয়ে বললেনঃ ইয়া রাসুলল্লাহ! আপনি যখন তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, আপনি তখন আপনার উষ্ট্রের উপর আরোহী ছিলেন। আপনার হাতে উট চালানোর চাবুক ছিল। আপনার চাবুক উর্ধ্বে তুললে তা আমার পেটে লেগেছিল। তখন নবী করীম (স) নিজের পৃষ্ঠদেশ ( বা পেট ) উম্মক্ত করে দিয়ে বললেনঃ ‘আজ তুমি তার প্রতিশোধ গ্রহন কর। তখন সাওদা নবী করীম (স)-এর পিঠে মুখ রাখার অনুমতি নিয়ে বললেনঃ
[ আরবী…………………]
আমি রাসুলের উপর প্রতিশোধ নেয়ার স্থানের বিনিময়ে জাহান্নাম থেকে আল্লাহর নিকট পানাহা চাই।
[ আরবী টীকা…………………….]
রাসুলে করীম (স) জিজ্ঞাসা করলেনঃ হে দাওদা! তুমি প্রতিশোধ নিচ্ছ, না ক্ষমা করে দিচ্ছ? সাওদা বললেন আমি বরং ক্ষমা করে দিচ্ছি। এ কারণেই নবী করাম (স) বলেছেনঃ [ আরবী………………….]
মানুষ চিরুনীর কাটাগুলির মতই সমান। [ আরবী………………]
মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সর্বতোভাবে সমান। আল্লাহ তা ‘আলা এই সমান সমানের আইনই জারি করেছেন। বলেছেনঃ [আরবী………………………….]
তাওরাতে আমরা তাদের প্রতি এ আইন লিখে দিয়েছিলাম যে, জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক কানে বদলে কান , দাঁতের পরিবর্তে দাঁত এবং সব রকমের যখমের জন্য সমান বদলা নির্দিষ্ট। আইনের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্যকরণ-ধনী-গরীব বা শক্তিশালী-দুর্বলের মধ্যে কাউকে আইনের অধীন ও অন্য উকে আইনের উর্ধ্বে রাখাকে জাতীয় ধ্বংস ও কঠিন বিপর্যয়ের কারণ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। নবী করীম (স) ইশাদ করেছেনঃ
[আরবী…………………………]
হে জনগণ! মনে রেখো তোমাদের পূর্বে এমন সব লোক ছিল, যাদের অবস্থা এই ছিল যে, তাদের মধ্যকার কোন শরীফ-অভিজাত-ব্যক্তি চুরি করলে তার উপর আইনের দন্ড কার্যকর করা হতো না। আর কোন দুর্বল চুরি করলে তার উপর আইন ও দন্ড কার্যকর করা হতো। [ আরবী টীকা………………..]
নবী করীম (স) কর্তৃক ঘোষিত আইনের এ সমতা ও অভিন্নতাকে তিনি নিজে সারাটি জীবন ব্যাপী কার্যকর ও বাস্তবায়িত করেছেন। বিদায় হজ্জ-এর ভাষণকালে সমস্ত সূদী কারবার স্থগিত ঘোষণা প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম তার চাচা হযরত আব্বাস (রা)-এর সূদ বাবদ জনগণের উপর যা প্রাপ্য ছিল, তা রহিত ঘোষণা করে বলেছিলেনঃ [ আরবি…………………..]
জাহিলিয়াতের সময়ের সকল প্রকারের সূদী কারবার স্থগিত হয়ে গেল। আর কার্যত আমি সর্বপ্রথম রহিত ঘোষণা করছি আবদুল মুতালিব পুত্র আব্বসের যাবতীয় সূদী কারবার।
অনুপভাবে জাহিলিয়াতের কালের সকল রক্তপাতের দাবি স্থগিত ঘোষণা কালে নবী করীম (স) তার নিকটত্নীয় রবীয়ার রক্তপাতের দাবীকে সর্বপ্রথম রহিত করে দিলেন। বস্তুত নিকটবর্ত-আত্নীয় ও অনাত্নীয় নির্বিশেষে সকলের উপর শরীয়াতের দন্ড সমানভাবে কার্যকর করা, ক্রোধ ও ক্রোধহীনতা উভয় অবস্থায় আল্লাহর আইন বাস্তবায়িত করা এবং সাদা-কৃষ্ণ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ইনসাফ ও ভারসম্য সহকারে অধিকার বন্টন করাই ইসলামের চিরন্তন বিধান। খুলাফায়ে রাশেদুন (রা) ইসলামের এই সাম্যের নীতির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন এবং ও ব্যাপারে এক বিন্দু দুর্বলতার প্রশ্রয় দেন নি। এই সাম্য নীতির ঘোষণাকে দৃঢ় ভিত্তিক ও বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যেই আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় ইরশাদ করেছেনঃ [আরবি……………………]
ওরা যে তোমাদেরকে মসজিদে হারামে যাওয়ার পথে বাধাগ্রস্ত করেছে সেজন্য তোমাদের ক্রোধ-যেন তোমাদেরকে ওতদূর উত্তেজিত করে না তোলে যে, তোমরাও তাদের শত্রুতায় অবৈধ বাড়াবাড়িতে উদ্বুদ্ব হয়ে উঠবে। তোমরাসকল পূণ্যময় ও আল্লাহর ভয়মূলক কারজ অবশ্যই পরস্পরের সাথে সাহয্য-সহযোগিতার কাজে একিগয়ে যাবে। অবশ্য গুনাহ ও নাফরমানীর কাজে কারোর সাথেই সহযোগিতা করবে না। তোমরা সব সময়ই আল্লাহকে ভয় করতে থাকবে। কেননা একথা তো জানো-ই যে, আল্লাহ অত্যন্ত কঠিন আযাব দানকারী।
নবী করীম (স) স্বপ্নযোগে আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে মক্কায় উমরা পালনের উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কিরাম সমভিব্যাহারে মক্কার দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন পর কা’বার নিকট উপস্থিত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করার সুযোগ পাওয়ার আশায় সকলের মনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দিপনা জেগে উঠেছিল। কিন্তু হুদায়বিয়া নামক স্থানে উপস্থিত হতেই মক্কার কাফিরগণ তাদের পথ রোধ করে বসে। শেষ পর্যন্ত তাদের সাথে সন্ধি করে নবী করীম (স) মদীনায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন। এ সময় সাহাবীগণের মনে মক্কার কাফিরদের বিরুদ্ধে যে শত্রুতার প্রচণ্ড আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে (সম্ভবত), সেই অবস্থার প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তা’আলা উপরোক্ত আয়াতে মুসলমানদেরকে সান্তনা দিয়ে সঠিক ইসলামী নীতির শিক্ষাদান করেছিলেন। কা’বা ঘরের সন্নিকটে যেতে মুসলমানদেরকে বাধা দিয়ে কাফিরগণ চরম মাত্রার শত্রুতা করেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সময়ও আল্লাহ তাঁর নেক বান্দাদেরকে ক্রুদ্ধ হয়ে শত্রুতামূলক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং আল্লাহর তাকওয়ার ভিত্তিতে সকল শুভ ও কল্যাণময় কাজের সহযোগিতা ও সকল পাপ-নাফরমানীর কাজে পূর্ণ অসহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন। বাহ্য দৃষ্টিতে এ নির্দেশ বে-খাপ্পা ও অস্বাভাবিক মনে হলেও আল্লাহর ব্যবস্থায় তা-ই ছিল অতীব কল্যাণকর, তা পরবর্তী পাঁচ-ছয় বছরের ইতিহাস নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে।
অনুরূপ আর একটি নির্দেশের কালাম হচ্ছেঃ [আরবী********************]
কোন জনগোষ্ঠীর শত্রুতা যেন তোমাদেরকে সুবিচার না করতে উদ্ধুদ্ধ না করে। তোমরা (সর্বাবস্থায়ই) ন্যায়বিচার অবশ্যই করবে। জানবে, সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচার করাই হচ্ছে তাকওয়ার অতীব নিকটবর্তী (ও তার সাথে সামঞ্জস্যশীল) নীতি।
মুসলিম সমাজ-ই হচ্ছে তাকওয়ার ধারক। আর এ তাকওয়ার দাবি হচ্ছে সর্বাবস্থায় নির্বিশেষে সকলের প্রতি ন্যায়বিচার কার্যকর করা। কিন্তু কোন বিশেষ জনগোষ্ঠীর সাথে শত্রুতা থাকার কারণে এ তাকওয়ার ধারক লোকেরাই সেই জনগোষ্ঠীর প্রতি অবিচার করে বসতে পারে। এ জন্য আল্লাহ তা’আলা তাকওয়ার অনিবার্য দাবি ন্যায়বিচারকে সব সময় ঊর্ধ্বে ও উন্নতশির করে রাখার নির্দেশ দিলেন। বস্তুত এই তাকওয়াভিত্তিক ন্যায়বিচারে আইনের দৃষ্টিতে সকল মানুষ যে সম্পূর্ণভাবে সমান হবে তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না।শক্রতার করাণে বিষেশ কোন জনগোষ্ঠীর সীমালঙ্ঘনমূলক আচরণ গ্রহন করতে কুরঅআন নিষেধ করেছে, কারোর প্রতি অবিচার করতে বা ন্যায়বিচার না করার জন্য উদ্ধুদ্ধ হতে নিষেধ করেছে, তেমনি নবীর প্রতি শক্রতা ও বিদ্বেষের কারণে তাঁর দাওয়াত কবুল না করে নিজেদেরকে কঠিন বিপদে নিক্ষেপ করতেও নিষেধ করেছে। প্রথম পর্যায়ের নির্দেশ হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেনি-এমন লোকদের প্রতি। কুরআনে হযরত শুয়াইব (আ)-এর এই আহবান উদ্ধত হয়েছেঃ
[আরবী…………………………….]
আর হে আমার জনগণে! আমার সাথে শক্রতা-আমার বিরুদ্ধতা যেন তোমাদেরকে এমন অবস্থায় ফেলে না দেয় , তোমাদের উপর সেই মহাবিপধ এসে পড়বে, যা নূহ হুদ বা সালেহর সমেয়র লোকদের উপর এসে পড়েছিল। আর লুত-এর জনগণও এই পরিণতিরই সম্মুখনি হয়েছিল, তারা তো তোমদের থেকে খুব দূরে নয়।
হযরত শুয়াইব (আ)-এর সাথে শক্রতা ও তাঁর বিরুদ্ধতা-বিদ্বেষই ছিল তাঁর তওহীদী দাওয়াত কবুল না করার একমাত্র ও বিদ্বেষ তোমাদেরকে কঠিন বিপদে ফেলতে পারে। কেননা অকারণ বিদ্বেষ ও এক ব্যাক্তির সাথে নির্বিচার শক্রতায় অন্ধ হয়ে আল্লাহর তওহীদী দাওয়াত কবুল না। তা ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।এসব কারণেই ইসলাম নিরপেক্ষ সুবিচার করার নীতি উপস্থপিত করেছে। তা মানসিক সাম্য ও অভিন্নতার বিপরীত ব্যাপার।
সাম্য ন্যায়বিচারের পরিণতি
ইসলাম যে সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠার উদাত্ত আহবান জানিয়েছে, তার অনিবার্য পরিনতি হচ্ছে লোকদের মধ্যে পূর্ণ মাত্রার সাম্য। এ কারনেই নিরপেক্ষ ন্যায়পরতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে। কুরআন পাঠে স্পষ্ট মনে হয়, ইসলাম যতটা গুরুত্ব এই ন্যায়বিচার নিরপেক্ষ সুবিচারের উপর আরোপ করেছে, অতটা অন্য কিছুর উপর আরোপ করেনি। ওই নিরপেক্ষ সুবিচার ইসলামের ভিত্তিরূপে ঘোষিত হয়েছে। তা-ই হচ্ছে এ দুনিয়ায় ইসলামের প্রধান লক্ষ্য। ইসলাম এই সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়েছে নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি। তাদের জাতি, বংশ, ভাষা, বর্ণ ও জন্মস্থান নির্বিশেষ।
ইসলাম দুনিয়ার সমস্ত মানুষেকে একই পিতা-মাতার সন্তান বলে ঘোষণা করেছে, যেন তাদের মধ্যে বংশ ও রক্তের দিক দিয়ে কোনরূপ পার্থক্য বা বৈষম্য সৃষ্টি করা না হয়। এ কারণে কুরআন ও রাসূলে করীম (স) এর ভাষণে সাধারণত[আরবি…………..] হে জনগণ! বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ফলে নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের প্রতিই ইসলামের এই উদাত্ত আহবান ধ্বনিত হয়েছে। বলে দেওয়া হয়েছে যে, এই সুবিচার নীতি পরিহার করার পরিণাম চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও নিপীড়ন নিষ্পেষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। ইরশাদ করেছেঃ [আরবি……………..]
অতএব তোমরা নিজেদের নফসের খাহেশের (প্রবৃত্তির কামনার) অনুসরণ করতে গিয়ে সুবিচার ও ন্যায়পরতা থেকে বিরত থেকো না।
মানুষ যখন আল্লাহর তাকওয়া শুন্য হয়ে যায়, তখন সে অনিবার্যভাবে স্বীয় অন্ধ কামনা-বাসনার অনুসরণ করতে বাধ্য হয়! আর অন্ধ কামনা-বাসনার অনুসরণ করলে ন্যায়পরতা ও নিরপেক্ষ সুবিচার করা কখনই সম্ভব হতে পারে না। অন্ধ কামনা-বাসনার আনুসরণ ও সুবিচার ন্যায়পরতা বিরোধী। যারা অন্ধভাবে শুধু নিজেদের মনের কামনা-বাসনারই অনুসর করে,তারা কখনই সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। পক্ষান্তরে যারা সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি, তাদেরকে নিজেদের নফসের কামনা-বাসনার অন্ধ অনুসরণ অবশ্যই পরিহার করতে হবে। বস্তুত সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠার পথে মনের কামনা-বাসনার অন্ধ অনুসরণ প্রচন্ডতম বাধা। অথচ মানব-সমাজে পূর্ণ সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠাই প্রধান কাম্য, তা মধুর চাইতেও অধিক মিষ্টি ও সুস্বাদু।
কেননা ন্যায়পরতা ও সুবিচার সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার পক্ষে অত্যন্ত জরুরী। সামাজিক ন্যায়পরতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত না হলে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
এ কারণে নবী করীম (স) এর সারা জীবনের সাধনা ও সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল মানবিক সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ন্যায়পরতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা। এ জন্য আল্লাহ তা’আলা নবী করীম (স) এর জবানীতে বলিয়েছেনঃ[আরবি………………….]
এবং তোমাদের মাঝে ন্যায়পরতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি আদিষ্টত হয়েছি।
সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠাকারী ও যে লোক ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠার পক্ষের নয়-এই দুইজনের মধ্যে তুলনা করে কুরআন বলেছেঃ [আরবি……………………]
(আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেনঃ দুইজন ব্যক্তি, তাদের একজন বোবা-বধির। কোন কাজ-ই করতে সক্ষম নয়। সে নিজের মনিবের উপর বোঝা হয়ে আছে। যে দিকেই সে তাকে পাঠায় কোন একটি ভাল কাজ-ও তার দ্বারা হয় না।) অপর একজন আছে এমন, যে ইনসাফের নির্দেশ দেয় ও আর নিজেও সঠিক-সুদৃঢ় পথে মজবুত হয়ে আছে, বল, এই দুইজনই একই রকম হতে পারে?
এক কথায়, যে লোক সঠিক আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে ন্যায়পরতা ও সুবিচারের আদেশ করে এবং তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করে, সে নিশ্চই সেই লোকের সমতুল্য হতে পারে না, যে তা করে না বা করতে পারে না সাধ্য নেই বলে।
আল্লাহ এবং রাসূল নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে ন্যায়পরতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নিঃশর্ত আহব্বান জানিয়েছেন। বলেছেনঃ [আরবি………………….]
নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচার-ন্যায়পরতা ও কল্যাণ কামনার আদেশ করেছেন। আল্লাহর এ আহবান শাশ্বত। স্থান-কাল-বংশ-বর্ণ-ভাষা-জাতীয়তা নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতিই এই আহবান।
ন্যায়পরতা ও সুবিচারের সুফল
ন্যায়পরতা ও সুবিচারের সুফল হচ্ছে মানুষের মধ্যে নিহিত যোগ্যতা-কর্মক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ যখন নিঃসন্দেহে জানতে ও বুঝতে পারবে যে, তার সাধনা-শ্রম কখনই নিষ্ফল যাবে না,বরং সে যদি তার প্রতিভা অনুযায়ী কোন শুভ কর্ম সাধন করতে পারে তাহলে তা স্বীকৃতি ও মর্যদা পাবে, অসাম্য ও অবিচারের মধ্যে পড়ে ব্যর্থ হয়ে যাবে না তাহলে বেশী বেশী শ্রম ও সাধনা করবে। অলসতা ও অকর্মণ্যতার প্রহেলিকায় পড়ে সে তার যোগ্যতা ও প্রতিভাকে বিনষ্ট করবে না।
সুবিচার ও ন্যায়পরতার ভিত্তিতে সামাজিক কার্যাদি সম্পন্ন হবে, প্রত্যেকেই তার ন্যায্যা হক পেলে, মানুষ হবে শান্ত-শিষ্ট, নিশ্চিন্ত। সকল প্রকার উচ্ছৃঙ্খলতাকে পরিহার করে সে এক মনে এক ধ্যানে কাজ করে যাবে। তখন সে নিজের প্রতি, নিজের প্রতিভা-যোগ্যতার প্রতি হবে অত্যন্ত আন্তরিক, অন্যান্য লোকদের প্রতিও সে হবে কল্যাণকামী। সে নিজের শ্রম-সাধনার ব্যর্থতা যেমন চাইবে না, পছন্দ করবে না, তেমনি অন্যান্য লোকদের সাধনা ব্যর্থ হোক, তা-ও তারা পছন্দ করবে না। নবী-রাসূলগণকে দুনিয়ায় প্রেরণ এবং কিতাব নাযিল করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই ন্যায়পরতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা। আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেনঃ [আরবী**********************************]
নিঃসন্দেহে আমরা আমাদের রাসূলগণকে অকাট্য প্রমাণ সহকারে পাঠিয়েছি, আর তাদের নিকট আমরা কিতাব ও মানদন্ড নাযিল করেছি শুধু এই লক্ষ্যে যে, লোকেরা পরম সুবিচার সহকারে জীবন যাপন করবে। এ ছাড়া লৌহও নাযিল করেছি। তাতে যেমন রয়েছে বিরাচ শক্তি, তেমনি জনগণের জন্য অফুরন্ত কল্যাণও।
সুবিচারের উপর ইসলামের গুরুত্বারোপ
ইসলাম দুনিয়ার সমাজে নিরপেক্ষ সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠার উপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে। এজন্য ইসলাম জুলুম উচ্ছৃঙ্খলতা এবং জালিম ও বিচ্ছৃঙ্খলাকারীর নিকটে যেতেও নিষেধ করেছে। এই সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠর জন্যই মু’মিনদের পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসা করার জন্য মুসলিম সমাজকে এগিয়ে আসতে বলেছে।
বলা হয়েছেঃ [আরবী********************************]
মু’মিনদের দুইটি গোষ্ঠী বা পক্ষ পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হলে –হে মুসলিম সমাজ –তোমরা তাদের মধ্যে সন্ধি-সমঝোতা করা হবে, তা অবশ্যই ইনসাফ ও সুবিচারের ভিত্তিতে হবে। পক্ষপাতিত্ব বা জুলুমের ভিত্তিতে হবে না। কেননা তাহলে মূল ইনসাফের দাবি-ই অপুরণ থেকে গেল। এই সন্ধি ও সমঝোতা করার পর যে পক্ষ অপর পক্ষের উপর আক্রমণ করবে, পরে সেই আক্রমণকারী পক্ষের বিরুদ্ধে গোটা মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে এবং সে পক্ষকে দমন করার জন্য যুদ্ধ করতে হলেও সকলে মিলে সে পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও দ্বিধা করবে না। বলা হয়েছেঃ [আরবী******************************]
সেই যুধ্যমান দুই দল মুসলিমের মধ্যে মীমাংসা ও সন্ধি-সমঝোতা করে দেয়ার পর উভয় দলের মধ্য থেকে কোন একটি দল যদি অপর দলের উপর আক্রমণ করে, তাহলে তোমরা –মুসলমানরা –সেই আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, যতক্ষণ না সেদল আল্লাহর বিধানের দিকে ফিরে আসে, তাহলে অতঃপর সেই দুইটি দলের মধ্যে আবার সন্ধি-সমঝোতা করে দেবে –পূর্ণ মাত্রায় সুবিচার ও ন্যায়পরতা সহকারে তোমরা –হে মুসলিম সমাজ –ন্যায়পরতা রক্ষা করে যাবে। কেননা আল্লাহ এই ন্যায়পর সুবিচারকারী লোকদেরকেই ভালোবাসেন।
এ কারণে ন্যায়পরতা ও সুবিচার দ্বীন-ইসলামের একটি মৌলিক বিধান ও চরম লক্ষ্য রূপে নির্ধারিত হয়েছে। ইসলামে তা সম্পূর্ণ নিঃশর্ত। কোন শর্ত আরোপ করে তার এই নীতি-সাধারণত্বকে ক্ষুন্ন করা যেতে পারে না।
উপরোক্ত নীতির দৃষ্টিতে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে –দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যকার বিবাদ-যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য যদি যুদ্ধও করতে হয়, রক্তের বন্যাও বহাতে হয়, তবু তা করতে হবে। জুলুমদের জুলুম-মুক্তির উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করার অনুমতি স্বয়ং আল্লাহই দিয়েছেন এবং আল্লাহ এই জুলুম-মুক্তির উদ্দেশ্যে যুদ্ধকারীদের সাহায্য করবেন বলে ওয়াদাও করেছেন। বলেছেনঃ [আরবী*************************]
যারা মজলুম, তাদের জুলুম মুক্তির উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর আল্লাহ যে তাদের সাহায্যকরণে খুবই সক্ষম, তাতেও কোন সন্দেহ নেই।
তবে ইসলাম এই শর্ত আরোপ করছে যে, এ যুদ্ধ যেন কখনই ন্যায়পরতা ও সুবিচারের সীমালঙ্ঘন করে না যায়। কেননা যুদ্ধে ন্যায়পরতা ও সুবিচার রক্ষিত না হলে আর একটি জুলুম সংঘটিত হবে। তখন এ জুলুমের রিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দেবে। এ কারণে সন্ধি-সমঝোতা করে দেয়ার পর যে পক্ষ আক্রমণ করবে, তার বিরুদ্ধে অতটাই শক্তি প্রয়োগ করা যাবে, যতটা তাকে পুনরায় সন্ধি-সমঝোতা করার জন্য প্রয়োজন। তার বেশী কিছুই করা যাবে না। ইরশাদ হয়েছেঃ [আরবী************************************]
যারা তোমদের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন করেছে, তোমরা তাদের বিরুদ্ধে ততটাই সীমালঙ্ঘন করবে, যতটা তারা তোমাদের বিরুদ্ধে করেছে (তার একটুও বেশী নয়)। আর জেনে রাখবে, আল্লাহ মুত্তাকী লোকদের সঙ্গে রয়েছে।
এই ‘মুত্তাকী’ বলতে তাদের বোঝানো হয়েছে, যারা সন্ধি-সমঝোতা করে দেয়ার পর পুনরায় হামলাকারী পক্ষের বিরুদ্ধে তাদের দমন করা ও আল্লাহর বিধান মাথা পেতে মেনে নিতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে একটুও সীমালঙ্ঘন করবে না।
এই সুবিচার ও ন্যায়পরতা যেমন ইসলামের লক্ষ্য ও আদর্শ, তেমনি ইসলামের যাবতীয় হুকুম-আহকামের ভিত্তিও তাই। বস্তুত ইসলামের আইন-বিধানে সুবিচার ও ন্যায়পরতা-পরিপন্থি কিছুই নেই। অতএব ইসলামী আইন-বিধানই হচ্ছে সমাজের লোকদের মধ্যে সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় ও মাধ্যম। আর সমাজে সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠাকল্পে দায়েরকৃত মামলায় যে সাক্ষ্যদান করা হবে, তা-ও এই ন্যায়পরতা ও সুবিচার –এক কথায় পক্ষপাতিত্বহীন হতে হবে। এই কারণেই কুরআনে আল্লাহর এ নির্দেশ ঘোষিত হয়েছেঃ [আরবী******************************]
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা সুবিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়াও, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হয়ে দাঁড়াও। সে সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে দিতে হলেও।
মামলার বিচারে সাক্ষ্যদান সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরী কার্যক্রম। সাক্ষ্য নিরপেক্ষ ও নির্ভুল হলেই বিচারের রায়ও নিরপেক্ষ ও সুবিচারপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু সাক্ষ্যই যদি হয় ভুল বা পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট, তাহলে বিচারের রায় কখনই নিরপেক্ষ বা ইনসাফকারী হতে পারে না। এ কারণে আয়াতে সাক্ষীদেরকে আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা [আরবী******] বলা হয়েছে। এ কথাটিতে যেমন মর্যাদার প্রকাশ, তেমনি বিরাট ঝুঁকিও এতে নিহিত। আর আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হয়ে যখন ঈমানদার ব্যক্তি প্রকৃত সত্যকে সাক্ষ্যের মাধ্যমে বিচারকের সম্মুখে উদঘাটিত করবে, তখন তার সাক্ষ্যের আঘাত কার কার উপর পড়েছে, সে সাক্ষ্যে কার কার স্বার্থ নষ্ট হচ্ছে বা কার কার বিরুদ্ধে পড়ছে, সেদিকে বিন্দুমাত্রও লক্ষ্য দেবে না। বরং সত্য সাক্ষ্য যা’র বিরুদ্ধেই হোক-না-কেন, দিতে একবিন্দুও কুণ্ঠিত হবে না। এই জন্যই আল্লাহ বলেছেনঃ [আরবী************************]
(তোমাদের সত্য সাক্ষ্যের আঘাত তোমাদের নিজেদের উপর) কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটস্থ লোকদের উপরই পড়ুক না-কেন, আর পক্ষদ্ধয় ধনী কিংবা গরীব যা-ই হোক-না কেন, তাদের সকলের অপেক্ষা আল্লাহর এই অধিকার অনেক বেশী যে, তোমরা তাঁর দিকেই বেশী লক্ষ্য দেবে। অতএব নিজেদের নফসের খাহেশের অনুসরণ করতে গিয়ে সুবিচার ও ন্যায়পরতা থেকে বিরত থাকবে না। তোমরা যদি মন রাখা কথা বল কিংবা সত্যবাদিতা থেকে দূরে সবে থাক, তাহলে জেনে রাখবে, তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত।
বস্তুত ধনী-গরীব বা প্রভাবশালী –কারোরই উচিত নয় সুবিচার ও ন্যায়পরতার পথে প্রতিবন্ধক হওয়ার এবং তার অধিকারও থাকতে পারে না কারোর। কেননা সুবিচার ও ন্যায়পরতা কেবল মুসলিম উম্মতের জন্যই সামষ্টিক শান্তি ও নিরাপত্তার বিধান করে না বরং বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য স্বাভাবিক উপায়ও গড়ে তোলে। কাজেই বিশ্বকে যদি যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত এড়াতে হয়, যদি আগ্রাসন ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজ বন্ধ করতে হয়, তাহলে সুবিচার ও ন্যায়পরতার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সকল প্রকারের কার্যক্রম তাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। আর তা কেবল মাত্র ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন –তথা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব। অপর কোন ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার দ্বারা বিশ্বশান্তি স্থাপন সম্পূর্ণ অসম্ভব। বরং সত্যি কথা হচ্ছে, আজ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত নেই বলেই বর্তমান বিশ্বশান্তি চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেছে।
সুবিচার প্রতিষ্ঠার রূপরেখা
সুবিচার প্রতিষ্ঠার কয়েকটি দিক রয়েছে। কুরআন মজীদে তার উল্লেখ হয়েছে। এখানে আমরা সংক্ষেপে সেই দিকগুলি তুলে ধরছি।
১. শাসন-প্রশাসনে সুবিচারঃ শাসন-প্রশাসনে পূর্ণ সুবিচার ও ন্যায়পরতা-নিরপেক্ষতা রক্ষা করা কর্তব্য। এজন্য কুরআন ন্যায়বাদী-সুবিচারক শাসক নিয়োগের শর্ত করেছে এবং প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের সুষ্ঠু নীতি অনুসরণ তার জন্য ফরয করে দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ [আরবী*************************]
(ঈমানদার লোকেরা) আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, যাবতীয় আমানত সেসবের প্রকৃত উপযোগী (বা মালিক) লোকদের নিকট সোপর্দ করে দাও। আর লোকদের পরস্পরের মধ্যে যখন কোন বিষয়ে ফয়সালা করবে (বা নীতি গ্রহণ করবে) তখন তা পূর্ণ ইনসাফ সহকারে করবে। আল্লাহ তো তোমাদেরকে উত্তম নসীহত করেছেন। আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও দেখেন।
[আরবী*******************************************************************]
প্রকৃত সুবিচারকারী শাসক ওরা হতে পারে, যাদের আমরা পৃথিবীতে (কোথাও) প্রতিষ্ঠিত করে দিলে তারা ‘সালাত কায়েম’ করবে, যাকাত আদায়-বন্টনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা কার্যকর করবে এবং যাবতীয় ভালো-উত্তম-শরীয়াতসম্মত কাজের আদেশ করবে, সব ঘৃণ্য মন্দ-শরীয়াত বিরোধী কাজ নিষিদ্ধ করে দেবে (তা থেকে লোকদের বিরত রাখবে)। আর সমস্ত ব্যাপারের শেষ পরিণতি আল্লাহরই জন্য।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সবচেয়ে বড় ‘মারূফ’ হচ্ছে সুবিচার ও ন্যায়পরতা কার্যকর করা এবং সবচেয়ে বড় ‘মুনকার’ হচ্ছে জুলুম, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনা –তা বন্ধ করাই সবচেয়ে বড় মা’রূফ।
২. আইন প্রয়োগে সুবিচার ও ন্যায়পরতাঃ সমাজের সকল লোকের উপর নিরপেক্ষ ন্যায়পরতা ও সুবিচার কার্যকর করার জন্য ইসলাম বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, উৎসাহ দিয়েছে ও আকুল আহবান জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোন পক্ষপাতিত্ব বা কোন ব্যতিক্রম করার কারোরই অধিকার নেই বলে বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করেছে। ইসলাম আইনের দৃষ্টিতে সকল মানুষকে সমান মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে। তাতে শাসক-শাসিত, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা নারী ও পুরুষের মদ্যে –কিংবা নগরবাসী ও গ্রামবাসীর মধ্যে কোনরূপ তারতম্য করাকে সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছে। রাসূলে করীম (স) বলেছেন (পূর্বেও উদ্ধৃত হয়েছে) আইনের সম্মুখে সকল মানুষ সমান।
হযরত আলী (রা) বলেছেনঃ
সত্য একজনের পক্ষে যেমন, তেমনি তার বিপক্ষেও।
তা একজনের উপর কার্যকর হলে তার পক্ষেও কার্যকর হবে। -[আরবী টীকা*************]
৩. অর্থনীতির ক্ষেত্রে সুবিচারঃ ইসলাম সুবিচারপূর্ণ অর্থনীতি গ্রহণ করেছে, অর্তনৈতিক ব্যাপারাদিতে পূর্ণ সুবিচার, ন্যায়পরতা, নিরপেক্ষতা ও তারতম্যহীনতার নীতি কার্যকর করার জন্য বিশেষ তাকীদ দিয়েছেন। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তা ও কর্মচারীদের কর্তব্য হচ্ছে এই নীতি অনুসরণ করা ও বাস্তবায়িত করে তোলা সম্ভাব্য সকল উপায় গ্রহণ করে। এ জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোন প্রকারের জুলুম, শোষণ ও বঞ্চনার প্রশ্রয় দিতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে। সূদ, পণ্য আটকরণ, অন্যায়ভাবে উচ্চমূল্য গ্রহণ, কাউকে দেয়া ও কাউকে না দেয়া –এই সবই হচ্ছে জুলুম ও অবিচারের বিভিন্ন দিক।
ইসলাম সূদী কারবার বন্ধ করে দিয়েছে মানুষকে শোষণের পথ বন্ধ করার লক্ষ্যে এবং তা করতে গিয়েও কোনরূপ জুলুম হওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখেনি।
এইজন্য ঘোষণা করেছেঃ [আরবী*****************************]
তোমরা যদি সূদী কারবার থেকে তওবা কর –আর করবে না বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর –তাহলে তোমাদের মূলধণ তোমরা ফেরত নিতে পারবে। তার ফল হবে এই যে, তোমরাও জুলুম করলে না আর তোমাদের উপরও জুলুম করা হলো না।
আয়াতের শেষাংশে বলা কথাটিই বিশেষ করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে মৌলনীতি হিসেবে স্বীকৃত। ইসলাম অর্থনীতির ক্ষেত্রে কাউকে জুলুম করার অনুমতি দিতে প্রস্তুত নয়, কারোর উপর জুলুম হোক তা-ও ইসলাম বরদাশত করতে রাযী নয়। ইসলাম সকল পর্যায়ের শাসন-কর্তৃপক্ষকে অর্থনৈতিক ব্যাপারে পূর্ণ সুবিচার করার জন্য দায়িত্বশীল করে দিয়েছে। সে নিজে কারোর ‘হক’ হজন করবে না, অন্য কাউকেও হজম করতে দেবে না।
৪. সামাজিক সম্পর্ক রক্ষায় সুবিচারঃ ইসলাম সামাজিকক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ণ সুবিচার ও ন্যায়পরতা রক্ষার উপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে, যেন এ ক্ষেত্রে কোন তিক্ততা বা সম্পর্কহীনতা প্রশ্রয় পেতে না পারে। এইজন্য ব্যক্তির উপর তার পিতা-মাতার নিকটাত্মীয়ের প্রতিবেশীর এবং ইয়াতীশ, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের ‘হক’ ধার্য করেছে, তা যথাযথভাবে আদায় করার জন্য তাকীদ করেছে। ক্রয়-বিক্রয়েও কোনরূপ ঠকবাজি না হতে পারে –সেজন্য অত্যন্ত কড়া ভাষায় কুরআনে বলে দেয়া হয়েছেঃ [আরবী******************]
এবং তোমরা সঠিক-দৃঢ়-ভারসাম্যপূর্ণ পাল্লায় পণ্য ওজন কর। একা যেমন উপস্থিতভাবে কল্যাণকর, তেমনি পরিণতির দিক দিয়েও অতীব উত্তম।
কেননা সমাজে জুলুম যদি বিন্দু বিন্দু করেও পূঞ্জিভূত হয়, তাহলে একদিন তা বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে। বস্তুত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জুলুম শোষণ দীর্ঘ দিন চলতে পারে না। তার একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া অনিবার্য। এইজন্য স্বৈরতন্ত্র, পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্ব ইসলামের দৃষ্টিতে মানব প্রকৃতি পরিপন্থী ব্যবস্থা। এসব ব্যবস্থা সাধারণ মানুষ কিছুদিনের জন্য হয়ত সহ্য করতে থাকে। কিন্তু একদিন বিদ্রোহের প্রলয়কান্ড সংঘটিত হয়, যা প্রতিরোধ করার সাধ্য কারোরই থাকে না।
এই কারণে ইসলাম মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে পূর্ণ ইনসাফ, সুবিচার, ন্যায়পরতা ও নিরপেক্ষতাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। অন্যথায় এর খারাপ প্রতিক্রিয়া কেবল পরকালেই নয়, ইহকালেও অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়া একান্তই অবধারিত।
ইসলাম ঘোষিত পরিপূর্ণ সুবিচার ও ন্যায়পরতার জন্য যে কার্যসূচী গ্রহণ করেছে, তা এভাবে বলা যায়ঃ
১. সমগ্র মানুষের ঐক্য ও অভিন্নতা –মানুষ হিসেবে;
২. মুসলিম উম্মার ঐক্য –মুসলিম ও ঈমানদার হিসেবে;
৩. জাতীয়তার দিক দিয়ে পূর্ণমাত্রার অভিন্নতা, পার্থক্যহীনতা;
৪. দ্বীন ও জীবন বিধানের ঐক্য ও অভিন্নতা;
৫. সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-মানবিক অধিকারে অভিন্নতা;
৬. আইনের দিক দিয়ে –আইন কার্যকরকরণে পার্থক্যহীনতা;
৭. আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাতীয়তার অভিন্নতা।
এইসব ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন ইসলমী রাষ্ট্রের বিশেষ নীতি ও কার্যসূচী, ইসলামী রাষ্ট্রের একা একটা দায়িত্ব।