পরিশিষ্ট- ২
পাশ্চাত্য সমাজে তালাক ও বিচ্ছেদের আইন
****************** “কোন বস্তুকে তার বিপরীত বস্তু দ্বারাই চেনা যায়”। পিছনের পাতাগুলোতে ইসলামের দাম্পত্য আইনের যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে তা দেখে এ আইনের পরিপূর্ণ মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পূর্ণরূপে অনুমান করা যাবে না, যতক্ষণ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রচলিত এর বিপরীতমূখী আইন সম্পর্কে তুলনামূলক অধ্যায়ন করা না হবে। কেননা বর্তমানে এটাকে উন্নত আইন ব্যবস্থা বলে দাবি করা হচ্ছে। এ তুলনামুলক অধ্যয়ন থেকে এটাও জানা যাবে যে, আল্লাহ তাআলার হেদায়অত ও পথনির্দেশকে উপেক্ষা করে মানুষ নিজেই যখন নিজের আইনগ্রণেতা হয়ে বসে তখন সে কি পরিমাণ হোঁট খেতে থাকে।
ইসলামী আইনের বিশেষত্বসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হচ্ছে- এর মলূনীতি ও বুনিয়াদী নির্দেশসমূহের মধ্যে এর প্রান্তসীমা পর্যন্ত সমতা, ইনসাফ ও ভারসাম্য বিদ্যমান। একদিকে তা নৈতিকতার উন্নততর লক্ষ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রাখে, অপরদিকে মানুষের স্বভাবগত দুর্বলতাকেও উপেক্ষা করে না। একদিকে তা সামাজিক তথা সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখে, অপরদিকে ব্যক্তির অধিকারকেও পদদলিত হতে দেয় না। একদিকে তা বাস্তব অবস্থার দিকে লক্ষ রাখে, অপরদিকে এমন কোন সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয় না যা কোন এক সময় বাস্তব জগতে ঘটে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। মোটকথা, এটা এমনই এক ভারসাম্যপূর্ণ আইন ব্যবস্থা, যার কোন নীতি ও নির্দেশের মধ্যে বাড়াবাড়ির কোন প্রবণতা নেই। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যতগুলো দিকের প্রতি লক্ষ রাখা প্রয়োজন, ইসলাম সেসব দিকে কেবল দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বরং বাস্তব ক্ষেত্রেও পূর্ণরূপে গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং এর মাঝে এতটা সঠিক ভারসাম্য স্থাপন করেছে যে, কোন একদিকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তা ঝুঁকে পড়েনি এবং অন্যদিককে উপেক্ষাও করেনি। এ কারণেই আজ তের শত বছর ধরে এ আইন ব্যবস্থা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা, জ্ঞান-গবেষণার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে এবং ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী জাতির মধ্যে কার্যকর ছিল। কোথাও কোন ব্যক্তিগত অথবা সামষ্টিক অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন এর কোন বুনিয়াদী নির্দেশকে ভ্রান্ত অথবা সংশোধনযোগ্য পায়নি। শুধু তাই নয়, মানবীয় চিন্তা আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও এর কোন একটি অংশের এমন কোন বিকল্প চয়ন করতে সফল হয়নি যা ন্যায়-ইনসাফ, ভারসাম্য ও সৌষ্ঠবের দিক থেকে এর কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারে।
ইসলামী আইনের মধ্যে এই যে গুণ-বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে তা শুধু মহান আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও দূরদর্শিতারই ফল। মানুষ তার অবশ্যম্ভাবী প্রতিবন্ধকতা ও স্বভাবগত সীমাবদ্ধতার কারণে কখনো কোন সমস্যার ক্ষেত্রে এর সার্বিক দিক আয়ত্বে আনতে সক্ষম হতে পারে না। বর্তমান-ভবিষ্যতের ওপর সে সমানভাবে নজর রাখতে সক্ষম নয়। কাজ ও শক্তির ওপর সমান দৃষ্টি দিয়ে, স্বয়ং নিজের ও অন্য সব মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির প্রকাশ্য ও গোপন বিশেষত্বের পূর্ণ বিবেচনা করে, নিজের পারিপার্শ্বিক প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে, নিজের আবেগ-প্রবণতা, ঝোঁক ও জ্ঞানগত দুর্বলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অপূর্ণতা থেকে সম্পূর্ণ পাক হয়ে এমন কোন নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব নয়, যা সর্বাবস্থায় সর্বযুগের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিকরূপে আদল-ইনসাফের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।
এ কারণে যেসব আইন মানবীয় চিন্তার ওপর ভিত্তিশীল, তার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য পাওয়া যায় না। কোথাও দৃষ্টিভংগীর মধ্যে ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হয়, কোথাও মানবীয় স্বভাবের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করার ক্ষেত্রে অক্ষমতা দেখা যায়, কোথাও মানুষের অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করার বেলায় ইনসাফ করা হয় না, কোথাও ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে সীমা নির্ধারণ ও অধিকার বণ্টনে বে-ইনসাফী করা হয়। মোটকথা, প্রতিটি নতুন অভিজ্ঞতা পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং প্রতিটি যুগের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানব মস্তিষ্কপ্রসূত এসব আইনের দুর্বলতা দিবালোকের মত প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এর ফলে মানুষ এসব মনগড়া আইনের রদবদল করতে অথবা বিশ্বাসগত দিক থে এর অনুগত থেকেও কার্যত এর বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি লাভ করতে বাধ্য হয়।
আল্লাহ প্রদত্ত আইন ও মানব রচিত আইনের মধ্যে এ মৌলিক পার্থক্য আজও এতটা প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে যে, অন্ধ ও রাতকানা ব্যক্তি ছাড়া সবাই-ই তা দেখতে পায়। গতকাল পর্যন্তও গোঁড়ামি অথবা মুর্খতার কারণে ইসলামী আইনের যেসব নির্দেশ ও মূলনীতির ওপর বেপরোয়াভাবে আক্রমণ করা হতো এবং এর মোকাবেলায় মানব রচিত আইনের যে দর্শন ও নীতিমালা নিয়ে গর্ব করা হতো- আজ সে সম্পর্কেই কোন বিতর্ক ও যুক্তি-প্রমাণ ছাড়াই শুধু বাস্তব ঘটনার অনস্বীকার্য সাক্ষ থেকে একথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং হয়ে চলেছে যে, ইসলাম যা কিছু শিখিয়েছিল তা-ই সঠিক ছিল। এর মোকাবিলায় মানব রচিত আইন যতগুলো পথই স্থির করেছিল তা সবই ভ্রান্ত ও অনুসরণের অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে। যদিও কল্পনার জগতে তা খুবই উজ্জ্বল মনে হয় এবং জিহ্বা আজো তার অকৃতকার্যতার স্বীকৃতি দিতে রাজী নয়, কিন্তু কার্যত দুনিয়া এসব আইনকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে যাকে গতকাল পর্যন্তও সে নেহায়েত পবিত্র জ্ঞান করতো এবং সংশোধনের উর্ধ্বে মনে করতো। আস্তে আস্তে দুনিয়া ইসলামের নির্ধারিত মূলনীতি ও আইন- কানুনের দিকে ফিরে আসছে, কিন্তু তা অনেক অঘটন ঘটানোর পরে।
উদাহরণস্বরূপ তালাকের প্রসংগটিই ধরা যেতে পারে। এ কয়েক বছর পূর্ব পর্যন্তও তালাকের ওপর খৃস্টান জগত মুসলমানদের কত না বিদ্রূপ করতো এবং বহু প্রভাবান্বিত মুসলমান লজ্জায় মরে গিয়ে এর প্রত্যুত্তর দিল যে, স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক ছিন্ন করা অনুপযুক্ত সাব্যস্ত করা এবং আইনের মধ্যে তালাক, খোলা, বিবাহ বাতিল ও ছিন্ন করার ব্যবস্থা না রাখা খৃস্টানদের কোন যৌক্তিক কাজ ছিল না, বরং এটা মানবীয় চিন্তার ভারসাম্যহীনতারই ফল। এর মধ্যে নৈতিক চরিত্র, মানবতা ও সমাজ ব্যবস্থার জন্য কোন কল্যাণ নিহিত নেই, বরং ধ্বংসের উপকরণই লুকিয়ে আছে। হযরত ঈসা (আ)-এর একথা কত চমৎকার ছিলঃ “ আল্লাহ যাদের জোড় বেঁধেছেন, মানুষ যেন তা বিচ্ছিন্ন না করে”।– মথি ১৯:৬।
কিন্তু খৃস্টানরা নবীর একথার উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলো এবং এটাকে নৈতিক পথনির্দেশ হিসাবে গ্রহণ করার পরিবর্তে দাম্পত্য আইনের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করলো। পরিণাম কি হলো? খৃস্টান জগত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাস্তব ক্ষেত্রে অনুপযোগী এ আইনের বিরুদ্ধে কূটকৌশল, ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে থাকলো। অতপর আইন অমান্য করার বদ অভ্যাস এতটা উন্নতি লাভ করলো যে, দাম্পত্য সম্পর্কের চেয়েও অধিক পবিত্র ছিল যে নৈতিক সীমারেখা তাও তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ্যভাবে লংঘন করতে থাকলো। অবশেষে লোকেরা বাধ্য হয়ে এ আইনে কিছুটা আংশিক ও ক্রটিপূর্ণ সংশোধন আনয়ন করে। ভুলবশত এটাকে তারা খোদায়ী আইন মনে করে নিয়েছিল। কিন্তু এ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ তখনই নেয়া যখন আইন অমান্য করার অভ্যাস ঈসা (আ)-এর অনুসারীদের অন্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোপিত কোন জিনিসের প্রতিই শ্রদ্ধাবোধ অবশিষ্ট রাখেনি। ফল হলো এই যে, এ আংশিক ও ক্রটিপূর্ণ সংশোধনের মাধ্যমে খৃস্টান বিশ্বে তালাক, বিবাহ বাতিল ও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার এক মহাপ্লাবন শুরু হয়ে গেল। এর বিভীষিকায় পারিবারিক ব্যবস্থার পবিত্রতম প্রাচীর খান খান হয়ে যেতে থাকলো। ইংল্যাণ্ডে ১৮৭১ সনে যেখানে মাত্র ১৬৬ টি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে অর্থাৎ আল্লাহর জুড়ে দেয়া প্রতি ৭৯ টি সম্পর্কের মধ্যে মানুষ একটিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আমেরিকায় ১৮৮৬ সনে যেখানে ৩৫ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছিল, ১৯৩১ সালে সেখানে ১ লাখ ৮৩ হাজার পবিত্র সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে। ফ্রান্সে তো এখন প্রায় প্রতি ১৫টি বিবাহের মধ্যে একটির শেষ পরিণতি হয় তালাক। পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের অবস্থাও কমবেশী এরূপ।
হযরত মসীহ (আ) যে শিক্ষা দিয়েছিলেন প্রায় অনুরূপ শিক্ষা কুরআন মজীদেও পাওয়া যাচ্ছে। কুরআনের বাণীঃ
**********************************
“যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সুদৃঢ় করে নেয়ার পর তা ভংগ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক জুড়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে, আর পৃথিবীতে বিপর্যয সৃষ্টি করে, প্রকৃতপক্ষে এরা ক্ষতিগ্রস্ত”।– সূরা আল বাকারাঃ ২৭
মসীহ (আ) ইহুদীদের পাষাণ হৃদয়বৃত্তি ও তালাকের আধিক্যের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বলেছিলেনঃ “ব্যভিচার দোষ ব্যতিরেকে যে কেহ আপন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যকে বিবাহ করে, সে ব্যভিচার করে”। (মথি ১৯:৯)। মুহাম্মদ (স) ও একই উদ্দেশ্যে এর চেয়েও অধিক মাপাজোকা ভাষায় তালাককে ************* (সর্বাধিক ঘৃণা বৈধ কাজ) বলেছেন এবং কুপ্রবৃত্তি চর্চার উদ্দেশ্যে তালাক দানকারীদের অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কিন্তু নৈতিকতার এ উচ্চতর মূলনীতি ছিল শুধু লোকদের শিক্ষার জন্য, যেন তারা নিজেদের কাজকর্মে তা সামনে রাখে। এটাকে হুবহু গ্রহণ করে তা একটি আইনে রূপান্তরিত করা উদ্দেশ্য ছিল না। মুহাম্মদ (স) শুধু চরিত্র গঠনের শিক্ষকই ছিলেন না, বরং শরীয়ত প্রণেতাও ছিলেন। এজন্য তিনি নৈতিকতার মূলনীতি বর্ণনা করার সাথে সাথে এটাও বলে দিয়েছেন যে, আইনের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের সংমিশ্রণের সঠিক গড় কি হওয়া উচিত এবং নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতির দাবির মধ্যে কিভাবে ভারসাম্য বজায় থাকতে পারে। পক্ষান্তরে মসীহ (আ) শরীয়ত প্রণেতা ছিলেন না, বরং শরীয়তের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনের সুযোগ আসার পূর্বেই দুনিয়াতে তাঁর নবুওয়াতী মিশনের সমাপ্তি ঘটেছিল। এজন্য তাঁর বাণীর মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের প্রাথমিক মূলনীতিগুলো ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। জীবনের বাস্তব সমস্যার ক্ষেত্রে এসব মূলনীতির সামঞ্জস্য বিধান করা যেত এবং তা মূসা (আ)-এর শরীয়তের আলোকেই হতে পারতো। কিন্তু খৃস্টানরা মনে করলো এবং সেন্ট পল তাদেরকে বুঝালো যে, মূলনীতি পেয়ে যাওয়ার পর এখন আমরা শরীয়তে ইলাহীর মুখাপেক্ষীহীন হয়ে গেছি এবং এখন এ মূলনীতি অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাজ নয়, বরং চার্চের দায়িত্ব।
তাদের বোধশক্তির এ চরম ভ্রান্তি চার্চ ও তার অনুসারীদের চিরকালের জন্য পথভ্রষ্টতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। খৃস্টানদের দুই হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সাইয়েদিনা মসীহ (আ) দীনের যতগুলো মূলনীতি বলে দিয়েছেন তার কোন একটি মূলনীতির ভিত্তিতেই সঠিক আইন রচনা করার ক্ষেত্রে চার্চ কুতকার্য হয়নি। শেষ পর্যন্ত খৃস্টান জাতি এসব মূলনীতি থেকে বিপথগামী হতে বাধ্যও হয়েছে।
মসীহ (আ) তালাকের যে সমালোচনা করেছেন তার মধ্যে ‘যেনায় লিপ্ত হওয়া’ কথাটিকে ব্যতিক্রম করে সম্ভবত এদিকে ইশারা করেছিলেন যে, তালাক সাধারণত খারাপ জিনি নয়, বরং বৈধ। কারণ ছাড়া তালাক দেয়া ঘৃণিত ব্যাপার। খৃস্টানরা তাঁর একথা বুঝতে সক্ষম হয়নি এবং এটাকে ‘আল্লাহ যাদের জোড়া বেঁধেছেন, মানুষ যেন তা ছিন্ন না করে’ আয়াতের সাথে সংঘর্ষশীল মনে করে কেউ কেউ তো সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে যে, ‘যেনায় লিপ্ত হওয়া’ কথাটি পরবর্তী কালে আয়াতের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ মাসয়ালা বের করলো যে, স্ত্রীর যেনায় লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীকে তো পৃথক করে দিতে হবে, কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক অটুট থেকে যাবে। অর্থাৎ দুজনের কেউই পুনর্বিবাহের অনুমতি পাবে না। শত শত বছর ধরে খৃস্টান জগত এভাবেই কাজ করে আসছে। মোটকথা, অন্যান্য আইনের মতো এ আইনও খৃস্টান জাতির মধ্যে চরিত্রহীনতা ও অশ্লীলতার মহামারী ছাড়ানোর ব্যাপারে অনেকখানি দায়ী।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, গির্জার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে এবং সম্পূর্ণরূপে বুদ্ধিবৃত্তিক মূলনীতির ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের দাবি করা সত্ত্বেও বৃটেন ও আমেরিকার মত দেশমূহে আজ পর্যন্ত আইনানুগ বিচ্ছেদের (Judicial Separation) অর্থ এই মনে করা হয় যে, স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পর থেকে পৃথক করে দিতে হবে। কিন্তু তাদের কেউই দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারবে না। এ হচ্ছে মানব-বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার পরিণাম। রোমান চার্চের ধর্মীয় আইনে (Canon Law) উপরিউক্ত মূলনীতির ভিত্তিতে যে আইন তৈরি করা হয়েছিল তার আলোকে তালাক (Divorce) অর্থাৎ বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয়ে যায়, পরে স্বামী ও স্ত্রীর স্বতন্ত্রভাবে বিবাহ করার অধিকার অর্জিত হয়- তা চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ ছিল। অবশ্য বিচ্ছেদের জন্য ছটি শর্ত স্থির করা হয়েছিলঃ
১. যেনা অথবা অস্বাভাবিক অপরাধ,
১. পুরুষত্বহীনতা,
৩. নির্যাতনমূলক আচরণ,
৪. অবাধ্যাচরণ,
৫. ধর্মত্যাগ,
৬. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন রক্তের সম্পর্ক উদঘাটিত হওয়া, যাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া আইনত নিষিদ্ধ (অর্থাৎ মুহরিম আত্মীয়)।
এ ছয়টি শর্তের ক্ষেত্রে যে আইনগত সমাধান নির্ণয় করা হয়েছিল তা হচ্ছে- স্বামী-স্ত্রী পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যাবে এবং আজীবন অবিবাহিত অবস্থায় কাটাবে। কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ সমাধানকে যুক্তিসংগত বলতে পারেন? মূলত এটা কোন আইনানুগ সমাধানই ছিল না, বরং এটা ছিল একটা শাস্তি, যার ভয়ে লোকেরা বিচ্ছেদের মোকদ্দমা নিয়ে আদালতে যেতেই সাহস পেতো না। বিচারের কষাঘাতে যদি কোন দম্পতির মধ্যে বিচ্ধে হয়ে যেতো তাহলে তাদেরকে পাদ্রীদের মতো বৈরাগীর জীবন যাপন করতে হতো।
এ নিষ্ঠুর অবাস্তব আইনে খপ্পর থেকে বাঁচার জন্য খৃস্টান পাদ্রীরা অসংখ্য কূটকৌশল আবিষ্কার করে রেখেছিল। তার সুযোগ গ্রহণ করে গির্জার আইন এ ধরনের হতভাগ্য স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বাতিল করে দিতো। মোটকথা তাদের একটি ধোঁকাবাজি ছিল এই যে, যদি কোনভাবে এটা প্রমাণিত হয়ে যায় যে, স্বামী-স্ত্রী আজীবন একত্রে বসবাস করার যে অংগীকার করেছিল তা অনিচ্ছায় তাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, অন্যথায় কেবল একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য অর্থাৎ মুত’আ (********) বিবাহ এ অবস্থায় গির্জাভিত্তিক আদালত বিবাহ বাতিলের (Nullity) ঘোষণা দেবে। কিন্তু খৃস্টীয় আইনের দৃষ্টিতে ‘বিবাহ বাতিলে’র অর্থ কি? এর অর্থ হচ্চে- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন বিবাহই হয়নি, এ পর্যন্ত তাদের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক ছিল এবং এর ফলে যে সন্তান জন্ম নিয়েছে সে জারজ সন্তান। এ অর্থের দিক থেকে আইনের এ দ্বিতীয় সমাধানটি ছিল প্রথমটির চেয়ে আরো অধিক অপমানকর।
পক্ষান্তরে রোমান চার্চের তুলনায় পূর্বাঞ্চলীয় গির্জা (Orthodox Eastern Church), যা ইসলামী ফিকহের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে- একটি উত্তম ও কার্যক্ষম আইন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এ গির্জার মতে নিম্নলিখিত কারণে স্বামী-স্ত্রী বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারেঃ
১. যেনা-ব্যভিচার ও এর প্রাথমিক উপকরণসমূহ, ২, ধর্মত্যাগ, ৩. স্বামীর জীবনকে পাদ্রী হিসাবে ধর্মের সেবায় ওয়াকফ করে দেয়া, ৪. অবাধ্যচারণ, ৫. বিদ্রোহ, ৬. নপুংসক, ৭. উন্মাদ, ৮. কুষ্ঠ ও ধবল, ৯. দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্দী হওয়া, ১০. পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ অথবা উভয়ের মেজাজ ও স্বভাবের চরম অমিল।
কিন্তু পাশ্চাত্যের ধর্মীয় নেতারা এ আইন মানে না। তারা রোমান চার্চের ফিকহের ওপর ঈমানকে কেন্দ্রীভূত করে রেখেছেন যার মধ্যে চূড়ান্তভাবে এ সিদ্ধান্ত করে দেয়া হয়েছে যে, মৃত্যু ছাড়া আর কোন কিছুতেই বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হতে পারে না। এখন এ ফতোয়ার পর তাদের বুদ্ধি খাটানো তো দূরের কথা, স্বয়ং নিজেদের ধর্মের অপর একটি মাযহাবের ফিকহ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করাও হারাম। ১৯১২ সালে রয়েল কমিশনের সামনে বিশপ গোর (Bishop Gore) প্রাচ্যের গির্জার ফিকহ থেকে কোন কোন ব্যাপারে আইন গ্রহণ করার বিরোধিতা শুধু এ যুক্তিতে করেছেন যে, বৃটিশ চার্চ রোমান চার্চের ফিকহের অনুসারী। ১৯৩০ সালের ল্যামবেথ সম্মেলনে (Lambeth Conference) পরিষ্কার ভাষায় নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ‘আমরা এমন কোন পুরুষ অথবা স্ত্রীলোকের বিবাহ পড়াতে পারি না- যার প্রাক্তন স্বামী অথবা স্ত্রী এখনো জীবিত রয়েছে’। সর্বশেষ সংশোধন, যার ওপর ১৯৩৫ সালে ইংল্যান্ডের ধর্মীয় নেতাদের একটি সম্মেলন (Joint Committee of Convocation) ঐকমত্য পোষণ করেন, তা হচ্ছে ‘বিবাহের পূর্বে যদি কোন পক্ষ ঘৃণিত রোগে আক্রান্ত হয় অথবা স্ত্রীলোকটি অন্তঃসত্তা হয় এবং বিবাহের সময় স্বামীর কাছে তা গোপন রাখে তাহলে বিবাহ বাতিল করা যেতে পারে’। এর অর্থ হচ্ছে, যদি বিবাহের পর এ ধরনের কোন ঘটনার সম্মুখীন হয়, তাহলে স্ত্রীর জন্যও ধর্মীয় দিক থেকে উপায় নেই এবং স্বামীর জন্যও মুক্তির কোন পথ নেই।
এতো ছিল ধর্মীয় গোষ্ঠীর অবস্থা, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একাধারে বড় বড় আলেম ফিকহবিদের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে মসীহ আলাইহস সালাম-এর একটি বাণীর তাৎপর্য ও আইনগত মর্যাদা অনুধাবন করতে তাদের ধর্মীয় নেতাদের যে ভুল হয়ে গিয়েচিল, তার প্রভাব এদের মন-মগজে এমন গভীরভাবে জমে গিয়েছে যে, যুগের পরিক্রমা, অবস্থার পরিবর্তন, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি ও বিবর্তন, মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতির অধ্যয়ন, শত শত বছরের অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন, স্বয়ঙ বুদ্ধি-বিবেকের ফায়সালা এবং আইন ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত- মোটকথা এসব জিনিস মিলেও তাদেরকে এ প্রভাব থেকে মুক্ত করতে পারেনি। হাজার বছর দীর্ঘ সময়েও রোমান চার্চের সর্বোত্তম মস্তিক্তগুলো নিজেদের আইনে ভারসাম্য আনয়ন করতে এবং তাকে ন্যায়-ইনসাফের সঠিক নকশার ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়নি।
এখন স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী এবং প্রশস্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আধুনিক আইন প্রণেতাদের অবদানের ওপর কিছুটা দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক, যারা ধর্মীয় আইনের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে স্বয়ং নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধির সহায়তায় নিজ নিজ জাতির জন্য দাম্পত্য আইন রচনা করেছে।
ফরাসী বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপের অধিকাংশ দেশে রোমান চার্চের ধর্মীয় আইন কার্যকর ছিল এবং তা একই ধরনের অন্যান্য আইনের সাথে মিলিত হয়ে পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের সমাজ ও তাদের চিরত্রকে চরম অবক্ষয়ের মধ্যে নিমজ্জিত করে রেখেছিল। বৈপ্লবিক যুগে যখন স্বাধীন সমালোচনা ও চিন্তা-ভাবনার হওয়া বইতে লাগলো, তখন ফরাসী জাতিই সর্বপ্রথম নিজেদের আইনের ক্রটি ও অপূর্ণতা অনুধাবন করলো। তাদের পাদ্রী সমাজ কোনক্রমেই এ আইন সংশোধন করতে প্রস্তুত নয়- এটা লক্ষ করে তারা ধর্মের জোয়াল সম্পূর্ণরূপে নিজেদের কাঁধ থেকে নিক্ষেপ করলো (১৭৯২ খৃ.)। এরপর একই হাওয়া অন্যান্য দেশেও বইতে লাগলো। ক্রমান্বয়ে বৃটেন, জার্মানী, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, হল্যাণ্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, সুইজারল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশও ধর্মীয় আইনকে পরিত্যাগ করে নিজ নিজ জাতির জন্য পৃথকভাবে বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত আইন রচনা করে নিল। এর মধ্যে আইনানুগ বিচ্ছেদ ও বিবাহ বাতিলের ব্যবস্থা ছাড়াও তালাকের সুযোগও রাখা হলো।
এভাবে খৃস্টান জাতিসমূহের এক বিরাট অংশের নিজেদের ধর্মীয় আইনের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া খৃস্টান পাদ্রীদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী, অজ্ঞতা ও গোঁড়ামিরই ফল। তারা নিজেদের গোঁড়ামির আশ্রয় নিয়ে একটি অকার্যকর, স্বভাব বিরোধী ও মারাত্মক ক্ষতিকর আইনকে কেবল ধর্মের নামে জোরপূর্বক জনগণের ওপর চাপিয়ে রাখার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। এ আইন আল্লাহর তৈরি আইন ছিল না, শুধু গুটিকয়েক ব্যক্তির ইজতিহাদের ভিত্তিতে রচিত ছিল। কিন্তু খৃস্টান পাদ্রীরা এটাকে আল্লাহ প্রদত্ত আইনের মত পবিত্র ও অপরিবর্তনীয় বলে স্থির করলো। তারা এর প্রকাশ্য ভ্রান্তি, অনিষ্টকারিতা ও বিবেক-বুদ্ধি বিবর্জিত বিষয়গুলো দেখতে ও অনুধাবন করতে শুধু এ কারণেই চরমভাবে অস্বীকার করলো যে, কোথাও সেন্ট পল এবং অমুক অমুক প্রাচীন পাদ্রীর আবিষ্কৃত মাসয়ালা ভুল হওয়ার সম্ভাব্যতাকে মেনে নিলে হয়ত ঈমান চলে যেতে পারে! এমনকি নিজেদের ধর্মের অন্তরগত অন্যান্য ফিকহী মাযহাবের সহায়তা গ্রহণ করারও তারা বিরোধিতা করলো। পাশ্চাত্য চার্চের আইন-কানুন প্রাচ্য চার্চের তুলনায় অধিক উত্তম- একথার ভিত্তিতে কিন্তু বিরোধিতা হয়নি, বরং বিরোধিতা হয়েছে শুধু এ কারণে, ‘আমরা পাশ্চাত্য চার্চের অনুসারী’! ধর্মীয় নেতাদের এহেন কর্মপন্হা পাশ্চাত্য জাতি-সমূহের জন্য এ ধরনের আইনের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এটাকে দূরে নিক্ষেপ করা ছাড়া আর কোন পথ অবশিষ্ট রাখেনি। কেননা এর অনিষ্টকারিতা ও ভ্রান্তি পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয়ার পরও তা সংশোধনযোগ্য বিচেনা করা হয়নি।
এক দাম্পত্য বিধানের ওপরই বা কতটুকু দোষ চাপানো যায়? মূলত এ পাদ্রীসুলভ মানসিকতাই ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যের জাতিসত্তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ধর্মবিমুখতা, ধর্মহীনতা, ধর্মদ্রোহিতা ও নাস্তিকতার দিকে নিয়ে গেছে।
ধর্মীয় আইনের বন্ধন থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে গত সত্তর-আশি বছরের মধ্যে যে দাম্পত্য আইন প্রণীত হয়েছে, তা রচনা করতে যদিও হাজার হাজার ও লাখ লাখ মেধা নিজেদের সর্বোত্তমরূপে নিয়োজিত করেছে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে ক্রমাগতভাবে রদবদল ও সংশোধন করে আসছে- কিন্তু তা সত্ত্বেও আরবের এক নিরক্ষম নবী আলাইহিস সালাতু ওয়াসাল্লামের পেশকৃত আইনের মধ্যে যে ভারসাম্য ও ন্যায়-ইনসাফ বিদ্যমান রয়েছে তা তাদের রচিত আইনের মধ্যে কখনো সৃষ্টি হতে পারেনি। শুধু তাই নয়, তারা ধর্মীয় আইনের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েও নিজেদের মন-মস্তিষ্ককে রোমান চার্চের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপনকারীদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধ্যান-ধারণা থেকে আজো পবিত্র করতে পারেনি।
উদাহরণস্বরূপ ইংল্যান্ডের আইনকেই নিন। ১৮৫৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে শুধু যেনা ও নির্যাতনমূলক আচরণকে এমন দুটি কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হতো যার ভিত্তিতে আইনগতভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের ফায়সালা দেয়া হতো। তালাক সংঘটিত হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অন্যত্র বিবাহ করার জন্য আযাদ হয়ে যায়। কিন্তু সেখানে এটা তখনো নিষিদ্ধ ছিল। ১৮৫৭ সালের আইনে উল্লিখিত দুটি কারণের সালে ঈলা (Desertion)- কেও বিচ্ছেদের একটি বৈধ কারণ হিসাবে সংযুক্ত করা হয়। তবে শর্ত হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী পরস্পর থেকে আলাদা থাকার সময়সীমা দু বছর বা ততোধিক হতে হবে। উপরন্তু এ আইনে তালাককেও (বিবাহ বন্ধন থেকে চূড়ান্ত মুক্তি) বৈধ করা হয়েছে। তবে এর জন্য শর্ত রাখা হয়েছে, স্বামীকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে, নিজে সরাসরি তালাক দিতে পারবে না। অনুরূপভাবে স্ত্রীর জন্যও এটা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে যে, সে যদি তালাক দাবি করে তাহলে পারিবারিক পর্যায়ে স্বামীর কাছে তা দাবি করতে পারবে না, বরং যে কোন অবস্থায় তাকেও আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে।
অতপর আদলতের জন্যও তালাকের ডিক্রী (Decree) দেয়ার মাত্র একটি পন্হাই রাখা হয়েছে। তা হচ্ছে, স্বামী যদি তালাক চায় তাহলে তাকে ‘স্ত্রী যেনায় লিপ্ত হয়েছে’ বলে প্রমাণ করতে হবে। আর যদি স্ত্রী তালাক চায় তাহলে তাকেও ‘স্বামী যেনায় লিপ্ত হয়েছে’ এটা প্রমাণ করার সাথে সাথে তার ওপর স্বামীর অমানুষিক আচরণ অথবা নির্যাতনের ব্যাপারটিও প্রমাণ করতে হবে। এভাবে যেন পুরুষ ও নারীকে বাধ্য করা হচ্ছে, তারা যে কোন কারণেই হোক একে অপরকে ত্যাগ করতে চাইলে একজনকে অপরজনের ওপর যেনার অপবাদ অবশ্যই লাগাতে হবে এবং প্রকাশ্য আদালতে তার প্রমাণ পেশ করে চিরকালের জন্য সমাজের একজন সদস্যের জীবন কলংকময় করে দিতে হবে।
এ আইন এভাবে যেনার মিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করানোর একটি দরজা খুলে দিয়েছে। বিচারালয়কে সমাজের সমস্ত দুর্গন্ধময় কাপড় পরিষ্কার করার ধোপাখানায় পরিণত করা হয়েছে। তাছাড়া আদালত থেকে তালাকের মোকদ্দমা প্রচার যেন নির্লজ্জ চরিত্রহীনতা প্রচারের মাধ্যমে পরিণত হয়ে গেছে। উপরন্তু এ আইন স্বামীদের দায়ূদ (*******) [‘দয়ূস’– অসতী স্ত্রীর স্বামী, ব্যভিচারের দূত; যে পুরুষ গোপন প্রণয়ের নায়ক–নায়িকার মিলন সংসাধন করে। অনুবাদক।] হওয়ার প্রশিক্ষণও দিল। কেননা এ আইনে স্বামীদের অধিকার দেয়া হলো যে, তারা যদি চায় তাহলে নিজ নিজ স্ত্রীর প্রেমিকদের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে- ক্ষতিপূরণ অর্থাৎ স্ত্রীর সতীত্ব বিক্রির বিনিময়ে! অবৈধ মিলনৈর আর্থিক মূল্য- যা নিজ স্ত্রীকে পরপুরুষের ভোগে প্রদান করার মাধ্যমে উপার্জিত হয়।
১৮৮৬ সালের আইনে আদালতকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে যে, আদালত ইচ্ছা করলে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করার সাথে সাথে অপরাধী স্বামীর ওপর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর ভরণ-পোষণের বোঝাও চাপাতে পারে। ১৯০৭ সালের আইনে স্বামীর অপরাধী হওয়ার শর্ত তুলে দেয়া হয় এবং আদালতকে সম্পূর্ণরূপে অধিকার দেয়া হয় যে, আদালত যেখানে উচিত মনে করবে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তালাকদাতা স্বামীর ওপর চাপাতে পারবে। এটা হচ্ছে প্রকাশ্যতই নারীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। এখানে পরিষ্কারভাবেই ভারসাম্যহীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পুরষ ও নারীর মধ্যে যখন কোন সম্পর্কই অবশিষ্ট থাকলো না তখন শুধু পূর্বেকার সম্পর্কের ভিত্তিতে একজন ভিন্ন নারীকে একজন ভিন্ন পুরুষের কাছ থেকে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে দেয়া যুক্তির বিচারেও ঠিক নয়।, আর এটাকে ইনসাফের ওপর ভিত্তিশীলও বলা যায় না। কেননা পুরুষ তার কাছ থেকে বিনিময়স্বরূপ কিছুই পাচ্ছে না।
১৮৯৫ সালের আইনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, স্ত্রী যদি স্বামীর যুলুম-অত্যাচারের কারণে তার সংসার ত্যাগ করে চলে যায় এবং তার থেকে পৃথক বসবাস করে, তাহলে আদালত স্বামীকে তার কাছে যেতে বাধা দিবে, তাকে নিয়ে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে এবং বাচ্চাদেরও স্ত্রীর কাছে রাখার অধিকারী সাব্যস্ত করবে। এ আইনে আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, স্ত্রী যদি তার স্বামীর দুর্ব্যবহার অথবা তার অনীহা ও উপেক্ষার কারণে যেনায় লিপ্ত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে স্বামীর তালাকের দাবি গ্রহণযোগ্য হবে না।
একথার অর্থ সম্পর্কে কিছুটা চিন্তা করুন। স্বামীর নির্যাতন প্রমাণ করে স্ত্রী তার থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে। স্বামীকে তার কাছেও ভিড়তে দেয়া হচ্ছে না, অথচ ভরণ-পোষণের অর্থ তার কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে এবং সে প্রেমিকদের কাছ থেকে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করছে! আবার স্বামী যদি এ ধরনের স্ত্রীর কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চায়- তাহলে এটাও সম্ভব নয়। এ হচ্ছে সেই দাম্পত্য আইন- যা উনিশ শতকের শেষভাগে ইংল্যান্ডের সর্বোৎকৃষ্ট মস্তিষ্কগুলো পঞ্চাশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রচনা করেছে!
১৯১০ সালে তালাক ও দাম্পত্য বিষয়ের ওপর পর্যালোচনা করার জন্য একটি রাজকীয় কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশন দীর্ঘ তিন বছরের পরিশ্রমের পর ১৯১২ সালের শেষ দিকে নিজেদের রিপোর্ট পেশ করে। এ রিপোর্ট যেসব পরামর্শ পেশ করা হয় সেগুলোর কয়েকটি নিম্নরূপঃ
১. তালাকের কারণগত দিক থেকে পুরুষ ও নারী উভয়কে এক সমান সাব্যস্ত করতে হবে এবং যেসব কারণের ভিত্তিতে পুরুষ তালাকের ডিক্রী পাওয়ার অধিারী হয়- অনুরূপ কারণের ভিত্তিতে নারীকেও তালাক লাভ করার অধিকারী সাব্যস্ত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ স্বামী যদি একবারও যেনায় লিপ্ত হয় তাহলে স্ত্রী তার কাছ থেকে তালাক আদায় করতে পারবে।
২. তালাকের পূর্বোল্লেখিত কারণগুলোর সাথে নিম্নলিখিত কারণগুলোও সংযোজন করার প্রস্তাব করা হয়েছেঃ
ক. একাধারে তিন বছর আলাদা ফেলে রাখা, খ. দুর্ব্যবহার, গ. চিকিৎসার অযোগ্য রোগ, ঘ. উন্মাদনা- এ অবস্থায় পাঁচ বছর অতীত হওয়া, ঙ. এতটা মাদকাসক্তি যে, তা ছাড়ার কোন আশা নেই [পাশ্চাত্য পরিভাষায় ‘মাদকাসক্তি’র অর্থ অভ্যাসগতভাবে মদ্যপান নয়, বরং সীমাতিরিক্ত মদ্যপান করে মারপিট, ঝগড়াঝাটি, চিৎকার, হৈ–হুলোড় ও গালি–গালাজ করা এবং প্রকাশ্য দিবালোকে অর্থহীন প্রলাপ, অশ্লীল বাক্য ব্যবহার এবং পাগলের মতো কার্যকলাপ করা। –গ্রন্হকার।] এবং চ. মৃত্যুদণ্ড ক্ষমা করে যে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
৩. মাদকাসক্তির কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তিন বছরের জন্য বিচ্ছেদ ঘটনো হবে। এ সময়সীমার মধ্যে যদি এ কুঅভ্যাস দূর না হয় তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ তালাকের ডিক্রী লাভ করার অধিকারী হবে।
৪. বিবাহের পূর্বে যদি কোন পক্ষের উন্মাদনা অথবা ঘৃণিত কোন রোগ হয়ে থাকে এবং তা অপর পক্ষোর কাছে গোপন রাখা হয় অতবা স্ত্রীলোকটি যদি গর্ভবতী হয়ে থাকেক এবং সে তার এ গর্ভের কথা গোপন রেখে থাকে, তবে এটাকে বিবাহ বাতিলের উপযুক্ত কারণ বলে সাব্যস্ত করা হবে।
৫. তালাকের মামলা চলাচালে তালাকের রিপোর্ট প্রকাশ করা যাবে না এবং পরবর্তীকালে আদালত মামলার কার্যবিবরণীর যে অংশ প্রকাশ করার অনুমতি দিবে, শুধু সেই অংশ প্রকাশ করা যাবে।
এসব প্রস্তাবের মধ্যে প্রথম প্রস্তাবটি ছিল সবচেয়ে অযৌক্তিক এবং কেবল সেটাকেই গ্রহণ করে ১৯২৩ সালের দাম্পত্য আচরণবিধির (Matrimaonial Cases Act) অধীনে তা প্রকাশ করা হয়। অবশিষ্ট প্রস্তাবগুলোর কোন একটিকেও আজ পর্যন্ত আইনের কাঠামোর অধীনে আনা হয়নি। কেননা ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ (Archbishop of Canterbury) এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি এর সাথে একমত হতে পারেননি।
ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ আইনবিগণের জ্ঞানের বহর এখান থেকেই অনুমান করে নিন যে, তারা পুরুষ ও নারীর যেনায় লিপ্ত হওয়ার আইনগত ও স্বভাবগত পার্থক্যটুকুও বুঝতে অক্ষম। তাদের এ ভ্রান্ত আইন প্রণয়নের বদৌলতে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে নিজেদের স্বামীদের বিরুদ্ধে এত অধিক সংখ্যায় তালাকের দাবি উঠেছে যে, ইংল্যান্ডের আদালতসমূহ এতে অস্থির হয়ে পড়েছে এবং ১৯২৮ সালে লর্ড মেরিভ্যাল (Lord Merrivalle)- কে এর প্রতিরোধের প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়েছিল।
ইউরোপ মহাদেশের যেসব রাষ্ট্রে রোমান গির্জার অধিক প্রভাব রয়েছে, সেখানে এখন পর্যন্ত ‘বৈবাহিক সম্পর্ক’ ছিন্ন করার মত বস্তু নয়। অবশ্য কোন কোন অবস্থায় আইনগত বিচ্ছেদ হতে পারে। এরপর স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর মিলতেও পারে না, আাবর স্বাধীনভাবে দ্বিতীয় বিবাহও করতে পারে না। আয়ারল্যান্ড ও ইতালীর দাম্পত্য আইন ব্যবস্থা এ মূলনীতির ওপর ভিত্তিশীল।
ফ্রান্সের দাম্পত্য আইন অনেক উত্থান-পতন দেখেছে। ফরাসী বিপ্লবের পর তালাকের ব্যাপারটিকে খুবই সহজ করে দেয়া হয়েছে। নেপোলিয়ন কোড (Code Nepolian)- এর ওপর কয়েকটি বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ১৮১৬ সালে তালাককে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। ১৮৮৪ সনে পুনরায় এটাকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। অতপর ১৮৮৬, ১৯০৭ ও ১৯২৪ সালে এজন্য বিভিন্ন রকম আইন প্রণয়ন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তালাকের জন্য নিম্নলিখিত কারণগুলো স্থির করা হয়ঃ
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন একজনের যেনায় লিপ্ত হওয়া, নির্মম আচরণ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন একজনের এমন কার্যকলাপ যার ফলে অপরজনের সম্মানের হানি হয়, দাম্পত্য অীধকার আদায়ে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, শরাব পানের বদভ্যাস ও আদালতের মাধ্যমে এমন শাস্তির যোগ্য হওয়া যা অত্যন্ত অপমানজনক।
এছাড়া আদালত থেকে তালাকের ডিক্রী লাভ করার পর স্ত্রীর জন্য তিন শত দিনের ইদ্দাত নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা ইসলামী আইনেরই ক্রটিপূর্ণ অনুকরণ।[ইদ্দাত পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে– এক পুরুষের বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার পর অপর পুরুষের বিবাহ বন্ধনে যাওয়ার পূর্বে নারী গর্ভবতী কি না তা নিশ্চিত হওয়া। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইসলাম সম্পূর্ণরূপে স্বভাবসম্মত পন্হা অবলম্বন করেছে। তা হচ্ছে, তিনটি মাসিক ঋতু (হায়েয) অতিক্রান্ত হরেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। অবশ্য স্ত্রীলোকটি যদি অন্তঃসত্তা হয় তাহলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত তার ইদ্দাত প্রলম্বিত হবে– এমনকি তালাকের দশ দিন পরই সন্তান ভূমিষ্ট হোক না কেন। এর বিপরীতে তিন শত দিন অথবা দশ মাস পর্যন্ত ইদ্দাত পালন করার কোন স্বভাবসম্মত ভিত্তি নেই।–গ্রন্হকার।]
ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের তালাকের বিধান পরস্পর থেকে অনেকটা ভিন্নতর, কিন্তু অপূর্ণাংগ ও ভারসাম্যহীন হওয়ার ব্যাপারে সবগুলোই সমান।
অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, সইজারল্যান্ড ও নরওয়েতে স্বামী-স্ত্রী কেবল পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই তালাকের ডিক্রী লাভ করতে পারে। ইসলামের খোলা ব্যবস্থার সাথে এর কিছুটা মিল আছে, কিন্তু তাও ক্রটিপূর্ণ অনুকরণ মাত্র।
জার্মানীতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন একজনের অপরজনকে পরিত্যাগ করা এবং তার সাথে সম্পর্কহীন অবস্থায় থাকাটাই তালাকের জন্য যথেষ্ট নয়- যতক্ষণ এ অবস্থা একাধারে এক বছর পর্যন্ত চলতে না থাকে। এ আইন হচ্ছে ইসলামের ঈলা ব্যবস্থার একটা অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। সুইজারল্যান্ডে এর জন্য তিন বছরের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে এবং হল্যান্ডে (নেদারল্যান্ডস) পাঁচ বছর মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যান্য দেশের আইন এ ব্যাপারে নীরব।
নিখোঁজ স্বামীর ক্ষেত্রে সুইডেনের আইন অনুযায়ী স্ত্রীকে ছয় বছর পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে এবং হল্যান্ডে দশ বছর। এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের আইন নীরব।
পাগলের ক্ষেত্রে জার্মানী, সুইডেন ও সুইজাল্যান্ডের আইনে তিন বছরের অবকাশ রয়েছে। অন্যান্য দেশ পাগলের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বেলজিয়ামে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে দশ মাস ইদ্দাস পালন করতে হয়। ফ্রান্স ও বেলজিয়াম ছাড়া অন্য কোন দেশে স্ত্রীলোকের দ্বিতীয় বিবাহের জন্য ইদ্দাত নির্দিষ্ট নেই।
অস্ট্রিয়ায় স্বামী-স্ত্রীল কোন একজনের পাঁচ বছর অথবা ততোধিক সময়ের জন্য কারাদণ্ড হওয়া তালাক দাবি করার জন্য যথেষ্ট। বেলজিয়ামে কেবল শাস্তির দণ্ড হওয়াই স্বামী অথবা স্ত্রীকে নিজ সংগীর বিরুদ্ধে তালাকের ডিক্রী লাভ করার অধিকারী বানিয়ে দেয়। সুইডেন ও হল্যান্ডে এর জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড শর্ত।
দুনিয়ায় যাদেরকে সবচেয়ে উন্নত মনে করা হয় এটা হচ্ছে সেই সব জাতিরই আইন। এর ওপর গভীর দৃষি।ট নিক্ষেপ করলে জানা যায়, তাদের কেউই একটি পূর্ণাংগ ও ভারসাম্যপুর্ণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সফল হয়নি। তাদের বিপরীতে যে ব্যক্তি ইসলামী আইনের দিকে ইনসাফের দৃষ্টিতে তাকাবে, তাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ন্যায়-ইনসাফের ভারসাম্য, মানব প্রকৃতির বিচেনা, বিপর্যয়ের মূলোৎপাটন, চরিত্র-নৈতিকতার হেফাযত, সামাজিক কল্যাণের প্রতি দৃষ্টিদান এবং দাম্পত্য জীবনের যাবতয়ি সমস্যা ও আচরণের ওপর পূর্ণাংগভাবে ব্যাপৃত হওয়ার ব্যাপারে ইসলামী আইন যে পরিমাণ পূর্ণতায় পৌঁছেছে- পাশ্চাত্য শুধু এককভাবেই নয়, বরং সমষ্টিগতভাবেও এর দশ ভাগের এক ভাগের পূর্ণতায়ও পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। অথচ এ আইন উনিশ শতকের ‘আলো’র যুগে পাশ্চাত্যের হাজার হাজার পাদ্রী ও বুদ্ধিজীবী প্রায় এক শতাব্দীর অনুসন্ধান, চিন্তা-ভাবনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা ও আইনগত অভিজ্ঞতা অর্জন করার পরই রচনা করেছেন। আর ইসলামী আইন-বিধান আজ থেকে তের শত বছর পূর্বে প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেদুইন আরবের এক নিরক্ষর ব্যক্তি কোন পার্লামেন্ট অথবা কোন বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করেননি।
এরূপ সুস্পষ্ট ও বিরাট পার্থক্য অবলোকন করার পরও যদি কোন ব্যক্তি বলে, ইসলামের আইন আল্লাহর দেয়া বিধান নয় বরং মানুষের তৈরি বিধান, তাহলে আমরা বলবো- এরূপ ব্যক্তির ব্যক্তির তো খোদায়ী দাবি করা উচিত ছিল। কিন্তু তাঁর সত্যবাদিতার এর চেয়ে অধিক স্পষ্ট প্রমাণ আর কি হতে পারে যে, তিনি স্বয়ং অতিমানবীয় অবদানের কৃতিত্ব নেননি, বরং তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, “আমি আমার মন-মগজ থেকে কিছুই পেশ করতে পরি না, আল্লাহ তাআলা আমাকে যা কিছু শেখান তাই তোমাদের কাছে পৌঁছে দিই”।
অতপর এরূপ সুস্পষ্ট ও বিরাট পার্থক্য সত্ত্বেও মানুষ যদি নিজের জীবনের যাবতীয় ব্যাপারে স্রষ্টার পথনির্দেশের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে এবং নিজেকেই নিজের পথপ্রদর্শক ও আইনপ্রণেতা হওয়ার দাবি করে, তাহলে তার এ হঠকারিতাকে আহাম্মকী ছাড়া আর কি বরঅ যেতে পারে? তার চেয়ে বড় আহাম্মক আর কে হতে পারে যাকে সহজ-সরল পথ বলে দেয়ার জন্য একজন নিঃস্বার্থ ও হিতাকাঙ্ক্ষী পথপ্রদর্শক সদা প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু সে বলে, “আমি নিজেই রাস্তা খুঁজে নেব”। আর খোঁজাখুজি করতে গিয়ে অযথা সে বিভ্ন্নি রাস্তায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
— সমাপ্ত —