সংস্কারের পথে প্রথম পদক্ষেপ
বিবাহ, তালাক ও শরীয়তের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাপারে সঠিক ফয়সালা পাওয়ার জন্য বর্তমানে যদি সামান্যতম কোন পন্হাও অবলম্বন করা সম্ভব হয়, তাহলে সেটা হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানদেরকে এখানে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জন (Cultural Autonomy) করতে হবে। [এ বিষয়ের ওপর আমি ‘মুসলমান এবং বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত’ গ্রন্হের ২য় খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।–গ্রন্হকার।] এর অধীনে মুসলমানরা নিজেদের যাবতীয় ব্যাপারে মীমাংসার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ শরীয়তী আদালত প্রতিষ্ঠার অধিকারী হবে। ইসলামী আইনের ওপর ফকীহসুলভ গভীর জ্ঞানের অধিকারী মুত্তাকী ও পরহেযগার আলেমগণ এসব আদালতের বিচারপতি নিযুক্ত হবেন। এটা এমনই এক প্রয়োজন, যার অবর্তমানে এখানকার মুসলমানদের বাস্তবক্ষেত্রে মুসলমান হিসাবে জীবন যাপন করা অসম্ভব। তারা যদি এটাও অর্জন করতে না পারে তাহলে অবরোহণ পন্হায় এতটুকুই যথেষ্ট এবং এটা একান্ত দায়ঠেকা অবস্থায় যে, মালিকী মাযহাব অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি পঞ্চায়েত গঠন করা যেতে পারে। এর সদস্যদের ওপর জেলার মুসলিম জনসাধারণের সাধারণ আস্থা থাকতে হবে এবং সদস্যদের মধ্যে অন্ততপক্ষে একজন নির্ভরযোগ্য আলেম হবেন। অতপর স্বৈরাচারী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এ কমিটির আইনানুগ স্বীকৃতি আদায় করতে হবে এবং মুসলমানদের বিবাহ, তালাক ইত্যাদি সংক্রান্ত ব্যাপারে পঞ্চায়েত যে ফায়সালা দিবে সরকার তাকে আদালতের সিদ্ধান্তের মর্যাদ দিবে। ইংরেজ আদালতে এর বিরুদ্ধে কোন আপীল করা যাবে না। এমনিক ইংরেজ আদালতে বিবাহ, তালাক ইত্যাদি সংক্রান্ত যেসব মোকদ্দমা দায়ের করা হবে তাও পঞ্চায়েতে স্থানান্তর করে দেয়া হবে।[হানাফী মাযহাবমতে পঞ্চায়েতের ফায়সালা বিচার বিভাগীয় কাযীর ফায়সালার সমকক্ষ হতে পারে না। কিন্তু যদি এ পঞ্চায়েত নিজেদের রায় বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখেন এবং তাঁদের এখতিয়ার যদি সালিসের পর্যায়ে না হয়ে বরং বিচারকের সমমর্যাদায় হয়, তাহলে হানাফী মাযহাব মতেও তাঁদের ফায়সালা শরীয়তী কোর্টের কাযীর রায়ের সমক্ষ হবে।–গ্রন্হকার।]
বৃটিশ ভারত ছাড়াও অমুসলিম রাজ্যে এবং যেসব মুসলিম রাষ্ট্রে ইংরেজ সরকারের অনুকরণে শরীয়তী বিচার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে শরঈ বিষয়গুলো সাধারণ দেওয়ানী আদালতের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে- সেসব দেশে এ ব্যবস্থার পুনঃ সংশোধনের জন্য সর্বপ্রথম হয় শরীয়তী বিচার ব্যবস্থার পুনঃ প্রবর্তন করতে হবে অথবা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কয়েম করে এসব রাজ্য সরকার থেকে তার আইনানুগ স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। যদি এটা করা সম্ভব না হয় তাহলে আইন পরিষদে কোন আইনের খসড়া পেশ করে তা পাশ করিয়ে নেয়া ইসলামের উদ্দেশ্যের জন্য কখনো ফলদায়ক হবে না।
আইনের একটি নতুন সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা
শরীয়তী বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সাথে আরো একটি জিনিসের প্রয়োজন রয়েছে। তা হচ্ছে এমন একটি আইনের বই সংকলন করা যাতে মুসলমানদের শরঈ ব্যবস্থাগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট আইনগত নির্দেশসমূহ (ফিকহী আহকাম) ব্যাখ্যামহ ক্রমিক মোহামেডান ল-এর ধারায় সাজানো থাকবে। এতে শরীআতী আদালতে অথবা পঞ্চায়েতে বর্তমান বৃটিশের পরিবর্তে এ আইনের প্রবর্তন করা সহজ হবে। মিসরে যখন মিশ্র আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেখানেও এ ধরনের একটি আইনের সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়েছিল, যার মধ্যে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সংগৃহীত সমস্ত জরুরী আইন-কানুন একত্রে সংকলিত থাকবে। সুতরাং মিসর সরকারের ইংগিতে এবং কুদরী পাশার নেতৃত্বে আল-আযহারের আলেমগণের কমিটি এ কাজ আনজাম দিয়েছেন। এ কমিটি কর্তৃক প্রণীত আইনের সংকলনটিকে সরকারী স্বীকৃতি দিয়ে আদালতে তা কার্যকর করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।[এ সংকলনটি ফরাসী ভাষায় অনুদিত হয়ে Droit Mussalman’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। মিসর ছাড়াও অন্যান্য দেশের আদালতসমূহ এ বইয়ের সাহায্য গ্রহন করে থাকে।–গ্রন্হকার।]
ভারতের এরূপ একটি কমিটি গঠন করা একান্ত প্রয়োজন। এ কমিটির অধীনে প্রতিটি গ্রুপের নির্বাচিত আলেমগণ কয়েকজন আইনবিশারদের সাথে মিলিত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ আইনের একটি বিশদ সংকলন তৈরি করবেন। প্রথমত এ সংকলনটিকে একটি খসড়ার আকারে প্রকাশ করে বিভিন্ন গ্রুপের আলেমদের অভিমত জানতে চাওয়া হবে। অতপর তাঁদের অভিমত ও পর্যালোচনাকে সামনে রেখে এতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। এটা যখন চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করবে তখন এটাকে শরীয়তের নির্দেশাবলীর একটি নির্ভরযোগ্য সংকলন হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হবে। অতপর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে যে, মুসলমানদের শরঈ ব্যাপারগুলো এ সংকলনের দিকে রুজু করা হবে এবং ইংরেজ আদালতের দৃষ্টিভংগী ও জ্ঞানহীন, ঈমানশূণ্য, অযোগ্য বিচারকদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যে Muhammadan Law (মুহাম্মদী আইন) প্রণীত হয়েছে সেগুলোকে বাতিল গণ্য করা হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের ফিকহের গ্রন্হগুলোতে যখন আইনের সার্বিক দিক সবিস্থারে বর্ণিত আছে, তখন এ রকম একটি নতুন সংকলন তৈরি করার কি প্রয়োজন আছে? এ রকম আপত্তি উত্থাপিত হওয়ার যে কেবল আশংকাই আছে তা নয়, বরং একটি গ্রুপের মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রেখে নিশ্চিত বলা যায়, এ প্রস্তাবের অবশ্যই বিরোধিতা করা হবে। অতএব যেসব কারণে এরূপ একটি পূর্ণাংগ সংকলন তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে আমি এখানে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করবো।
ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে দেখলেও যে কোন ব্যক্তি এটা বুঝতে সক্ষম যে, ফিকহের গ্রন্হসমূহে ইসলামী আইন-কানুন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। এগুলো প্রাচীন বর্ণনাভংগী ও পদ্ধতিতে লিখিত। বর্তমানে যেসব লোক এসব কিতাব পড়ান তাঁরাও সাধারণত এর পারিভাষিক সূক্ষ্মতা উত্তমরূপে বুঝতে অক্ষম। আজকাল আইনের বইগুলোতে আইনের ধারাসমূহ ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী সাজানো হয়েছে, প্রতিটি ধারার নীচে বিশেষ বিশেষ শব্দের ব্যাখ্যা, এর উদ্দেশ্যের বিশ্লেষণ, এর অধীনে আগত উপধারাসমূহ বিশদ-ভাবে বর্ণনা করা হয়। এতে বিভিন্ন বিচারকের দৃষ্টিভংগী-নির্ভরযোগ্য বিচারকদের দৃষ্টিভংগী, বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যাসমুহ এবং বিভিন্ন মোকদ্দমার রায়ও সন্নিবেশিত থাকে। উপরন্তু সূচীপত্র, বিষয়সূচী (Index) সংযোজন করে পুস্তকের অন্তর্গত বিষয়সমূহ খুঁজে বের করা সহজ করে দেয়া হয়েছে। এগুলো দেখে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এটা মেনে নিতে অস্বীকার করবে না যে, মানবীয় প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে প্রকাশনা শিল্পের বিন্যাসের ক্ষেত্রে এই যে উন্নতি সাধিত হয়েছে- ফিকাহের কিতাবসমূহের পুনবিন্যাসের ক্ষেত্রে এ নতুন বিন্যাস পদ্ধতিকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। পরিশেষে যে প্রাচীন পদ্ধতিতে ফিকাহের কিতাবগুলো সাজানো হয়েছে তা তো আর আসমানী নির্দেশের মাধ্যমে অনুমদিত নয় যে, এ পদ্ধতির অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক এবং এটা পরিত্যাগ করা গুনাহের কাজ।
কিন্তু এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই যে, পুরাতন ফিকহের গ্রন্হসমূহে যতগুলো নির্দেশ বর্ণনা করা হয়েছে তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানবীয় পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এ নির্দেশগুলোকে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং নির্বিচারে প্রতিটি ব্যাপারে প্রয়োগ করা মূলত ভূল। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সামনে রেখে এর সার্বিক পর্যালোচনা করতে হবেঃ
একঃ যে ইসলামী সমাজে এ আইন কার্যকর করা হচ্ছে, তার নৈতিক, তামদ্দুনিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা দৃষ্টির সামনে রাখতে হবে। এটাও দেখতে হবে যে, এ সমাজের সামগ্রিক অভ্যাস, প্রকৃতি ও রসম-রেওয়াজ কি ধরনের? তারা কিরূপ পরিবেশে বসবাস করে, তাদের ওপর এ পরিবেশের কি কি প্রভাব রয়েছে এবং তাদের বাস্তব স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার ও কার্যক্রমে ইসলামের প্রভাব কতটা শক্তিশালী অথবা দুর্বল? বাইরের প্রভাবে তাদের ইসলামী বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কতটা পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে এবং সমাজের সাধারণ অবস্থা পরিবেশ যাবতীয় বিষয়ের মধ্যে আইনগত দিক থেকে কি ধরনের পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটিয়েছে?
দুইঃ প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে পক্ষ্দবয়ের প্রত্যেকের বিশেষ অবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাদী-বিবাদীর স্বভাব-চরিত্র, বয়স, শিক্ষা, দৈহিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক পজিশন, অতীত ইতিহাস, বংশীয় রীতিনীতি এবং তাদের স্তরের সাধারণ অবস্থা- এসব কিছুর প্রতি দৃষ্টি রেখে রায় গঠন করতে হবে। কোন বিশেষ আনুষাংগিক ব্যাপারে তাদের ওপর কিভাবে আইন প্রয়োগ করা যেতে পারে- যাতে আইনের উদ্দেশ্যও যথাযথ-ভাবে পূর্ণ হতে পারে এবং আইনের মূলনীতি থেকেও বিচ্যুতি না ঘটে।
এ দুটি দিককে উপেক্ষা করে যদি কেউ ফিকহের কোন পুরাতন কিতাব থেকে একটি আনুষাংগিক নির্দেশ বের করে চক্ষু বন্ধ করে তা যে কোন মোকদ্দমায় সমানভাবে প্রয়োগ করতে থাকে যার সাথে এ আনুষাংগিক নির্দেশের মিল রয়েছে- তাহলে এমন একজন ডাক্তারের সাথেই তার তুলনা করা যায় যিনি বুকরাত [‘হিপ্পোক্রাটস’ খৃস্টপূর্ব ৫ম ও ৪র্থ শতকের বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎসা বিজ্ঞানী। Hippocrates the Great নামে পরিচিত। তাঁকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বলা হয়।– অনুবাদক।] এবং জালীনূসের [‘গ্যালেন’ আনুমানিক ১২৯ খৃস্টাব্দে বর্তমান তুরস্কের বিরগামা শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯ খৃস্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন। প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে হিপ্পোক্রাটসের পরে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তিনি একাধারে ডাক্তার, দার্শনিক ও ভাষাতত্ত্ববিদ ছিলেন।–অনুবাদক।] লেখা বই নিয়ে বসে গেলেন এবং দেশের আবহাওয়া, ঋতু, প্রত্যেক রোগীর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন রোগের পৃথক পৃথক ধরন ও উপসর্গ ইত্যাদি থেকে চক্ষু বন্ধ করে এ বইয়ের ওপর ভিত্তি করেই ব্যবস্থাপত্র দিতে শুরু করলেন।
প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের রচিত এ পুস্তক নিজ স্থানে যথার্থই সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু মূর্খ ঔষধ বিক্রেতাদের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তা কবে রচিত হয়েছে? এসব পুস্তক এ কাজে লাগানোর জন্যও বুদ্ধি-জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, কৌশল ও বোধশক্তির প্রয়োজন রয়েছে। ঠিক অনুরূপভাবে মুজহাতিদ ইমামগণ ইসলামী শরীয়তের মূলনীতি ও মৌলিক আইন থেকে যেসব আনুসংগিক আইন বের করছেন তাও স্বস্থানে যথার্থই সঠিক ও নির্ভূল। কিন্তু এ ইজতিহাদ ও গবেষণালব্ধ আইনগুলোকে জ্ঞান-বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা ছাড়াই ডাকপিয়নের ডাকে আসা সব চিঠির ওপর নির্বিচারে একই রকম সীলমোহর করার ন্যায় যথেষ্ট ব্যবহার করা হবে- এ মহান মুজতাহিদগণ তা কখনো কল্পনা করেননি।
ইসলামী আইন এমন যুক্তিসংগত মূলনীতির ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল যে, তার অধীনে কোন পুরুষ অথবা স্ত্রীলোকের বাধ্য হয়ে চরিত্রহীন কাজে লিপ্ত হওয়া অথবা সমাজের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হওয়ার কারণে পরিণত হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। আর এ আইনের কঠোরতার কারণে বাধ্য হয়ে কোন মুসলমান পুরুষ অথবা স্ত্রীলোকের ইসলামের সীমারেখা থেকে সরে পড়াটা তো ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু আজ আমরা দেখছি মুসলমানদের মধ্যে কেবল অসংখ্য পারিবারিক ঝগড়াই সৃষ্টি হচ্ছে না, বরং কঠিন নৈতিক বিপর্যয়, এমনকি ধর্ম ত্যাগের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। এ ধরনের বিপর্যয় কেবল এজন্য ছড়িয়ে পড়েছে যে, অধিকাংশ মামলায় ইসলামী আইনের অধীনে লোকেদের জন্য সঠিক ও ইনসাফপূর্ণ ফায়সালঅ হাসিল করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বুদ্ধি-বিবেক, গভীল জ্ঞান, চিন্তা-দূরদর্শিতা না মুফতীদের মধ্যে বর্তমান আছে আর না আদালতের বিচারকদের মধ্যে। তাঁদের কেউ লক্ষ্য করেন না, আমরা একটি সাধারণ নির্দেশকে যে দেশে, যে সমাজে এবং যে বিশেষ মামলায় কার্যকর করছি এর কোন কোন বিশেষত্বের দিকে দৃষ্টি রেখে তা এ নির্দেশের সাধারণ সীমার মধ্যে শরীয়াতের মূলনীতির অধীনে নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন, যাতে শরীয়তের কোন একটি উদ্দেশ্যও ব্যাহত হতে না পারে এবং এর কোন একটি মূলনীতির বিরোধিতারও প্রয়োজন না হয়। আদালতের বিচারকদের সম্পর্কে যতদূর বলা যায়- তাঁদের অক্ষমতা তো সুস্পষ্ট। বাকি থাকলেন আলেম সমাজ। তাদের মধ্যে একদলের অবস্থা এই যে, পুরাতন ফিকহের গ্রন্হগুলোতে আনুষাংগিক নির্দেশগুলো যেভাবে লিখিত আছে সেগুলোকে অবিকল পেশ করার চেয়ে অধিক যোগ্যতা তাঁদের মধ্যে নেই। আর কতিপয় আলেমকে যদিও আল্লাহ তাআলা দৃষ্টির প্রশস্ততা এবং দীনের গভীর জ্ঞান দান করেছেন, কিন্তু এককভাবে তাঁদের কারো মধ্যে এতটুকু দুঃসাহস নেই যে, কোন মাসয়ালার ক্ষেত্রে বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে কোন পুরাতন আনুষাংগিক নির্দেশ থেকে বিন্দু পরিমাণ বিচ্যুত হন। কেননা একদিকে তাঁরা ভূলে নিমজ্জিত হওয়ার ভয়ে এ দুঃসাহসিক পথে পা বাড়ান না। অপরদিকে তাঁদের ভয় হচ্ছে অপরাপর আলেমগণ তাঁদেরকে মাযহাবের অন্ধ অনুকরণ থেকে বিচ্যুত হওয়ার অপবাদ দিবেন। এ রোগের একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে, প্রতিটি প্রদেশের প্রখ্যাত ও প্রভাবশালী আলেমদের একটি দল এ কাজকে নিজেদের হাতে তুলে নেবেন। তাঁরা নিজেদের সম্মিলিত শক্তি ও প্রভাব কাজে খাটিয়ে শরঈ বিষয়গুলোর জন্য এমন একটি আইন কাঠামো প্রণয়ন করবেন, যা ভারতীয় মুসলমানদের বর্তমান নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এগুলো এতটা নমনীয় হবে য, কোন বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতিতে আইনের মূলনীতির অধীনে আনুষাংগিক নির্দেশের মধ্যে যেন প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্ভব হয়।
কোন ব্যক্তি যদি এটাকে তাকলীদের পরিপন্হী সাব্যস্ত করে, তাহলে আমরা বলবো, সে ভূলের মধ্যে আছে। মুজতাহিদ ইমামদের তাকলীদ (অন্ধ অুকরণ) এবং নবী-রাসূলদের তাকলীদের মধ্যে যে কি ধরনের পার্থক্য হওয়া উচিত তাই সে জানে না। জাহেল-মুর্খ লোকের তাকলীদ ও সুযোগ্য আলেমের তাকলীদের মধ্যে যে কি পার্থক্য হওয়া উচিত তাও সে জানে না। সে এতটুকুও অবহিত নয় যে, কোন ফিকহভিত্তিক মাযহাবের অনুসরণ করার অর্থ কি? সে তাকলীদের অর্থ এই মনে করে, “নিজের ফিকহী মাযহাবকে দীনের স্থলাভিষিক্ত এবং এ মাযহাবের ইমামকে নবীর স্থলাভিষিক্ত মনে করতে হবে এ মাযহাবের মাসয়ালা-মাসায়েলকে আল্লাহর কিতাবের নির্দেশের মত অকাট্য মনে করতে হবে। আকীদা হিসাবে একথা মনের মধ্যে বদ্ধমূল করে নিতে হবে যে, এ মাযহাবের কোন মাসয়ালার সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন তো দূরের কথা, এর বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই করাও কঠিন গুনাহের কাজ। কোন মাসয়ালার ক্ষেত্রে এ মাযহাবের কোন আনুষাংগিক নির্দেশ পরিত্যাগ করা ইজতিহাদ ও গবেষণার যুগ অর্থাৎ চতুর্থ হিজরী শতক পর্যন্তই জায়েয ছিল, কিন্তু এরপর তা হারাম হয়ে গেছে”।
কিন্তু এ ধরনের তাকলীদ বা অন্ধ অনুকরণ পুর্বকালের আলেমদের কারো দ্বারাই প্রমাণিত নয়। আর না এর সমর্থনে কোন শরঈ প্রমাণ কোথাও থেকে পাওয়া যেতে পারে। ইমাম আযম আবূ হানীফা রহমাতুল্লাহ আলাইহির ছাত্রগণ হাজারো মাসয়ালায় নিজেদের ইমামের সাথে মতভেদ করেছেন। এ সত্ত্বেও তাঁরা হানাফী মাযহাব থেকে বহিষ্কৃত হননি। হানাফী মাযহাবের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ ইমাম আযম র. ও তাঁর ছাত্রদের মধ্যে মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে কতককে কতকের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং একজনের মত পরিত্যাগ করে অন্যজনের মত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এরূপ পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই করা সত্ত্বেও কেউ তাঁদের অ-মুকাল্লিদ বলতে পারেনি। চতুর্থ হিজরী শতক থেকে শুরু করে অষ্টম থেকে নবম হিজরী শতকের হানাফী আলেমগণ তাদের পূর্ববতীদের ইজতিহাদী মাসয়ালার ক্ষেত্রে যুগের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে পরিবর্তন ও সংশোধন করতে থাকেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অপরাপর মুজতাদি ইমামদের মাযহাবের মত গ্রহণ করে তদনুযায়ী ফতোয়া দিতে থাকেন। কিন্তু কেউই তাঁদের এ ইজতিহাদের ওপর অ-মুকাল্লিদের হুকুম লাগাননি। কারো এতটা দুঃসাহস নেই যে, আবুল লাইস সামারকান্দী, শামসুল আইম্মা সারাখসী, হিদায়ার সংকলক, কাযীখান, কানযুল উম্মালের রচয়িতা, আল্লামা শামী এবং এ পর্যায়ের অপরপর আলেমদের অ-মুকাল্লিদ বলে দোষারোপ করবে। কারণ তাঁরা হানাফী মাযহাবের মাসয়ালায় নিজ নিজ যুগের অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে নমনীয়তা সৃষ্টি করেছেন এবং যেসব ব্যাপারে এ মাযহাবের কোন নির্দেশকে ক্ষতিকর অথবা সাধারণ অবস্থা বিবেচনা করে কার্যকর করার অনুপযোগী পেয়েছেন সেসব ক্ষেত্রে অন্যান্য মাযহাবের মাসয়ালা অনুযায়ী ফতোয়া দিয়েছেন। তাঁরা এটাকে হানাফী মাযহাবের মূলনীতির অন্তরভুক্ত করে নিয়েছেন, ‘প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য মাযহাব অনুযায়ী ফতোয়া দেয়া জায়েয। তবে শর্ত হচ্ছে, এর মধ্যে যেন কৃপ্রবৃত্তি স্থান না পায়’।
এতে সন্দেহ নেই যে, লোকেরা যদি বলগাহীনভাবে নিজ নিজ প্রয়োজন মোতাবেক অন্য মাযহাব অনুযায়ী আমল করার অথবা নিজ মাযহাবের অবকাশের (Option) সুযোগ গ্রহণ করার ব্যাপারে স্বাধীনতা পেয়ে যায় তাহলে তার কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করার যথেষ্ট আশংকা রয়েছে। বিভিন্ন মাযহাব নিজ নিজ দৃষ্টিোকোণ থেকে বিশেষ বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব অনুমতি দিয়েছে তা থেকে অবৈধ ফায়দা ওঠানোর ও দীনের সাথে উপহাস করার দরজা খুলে যাবে এবং আচার-আচরণে কঠিন বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। কিন্তু দীনের আলেমগণ যদি তাকওয়া ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে মুসলমানদের প্রয়োজন ও অবস্থার দিকে লক্ষ রেখে এটা করতে যান তাহলে এর দ্বারা দীনী অথবা পার্থিব কোন ক্ষতির আশংকা নেই, বরং কোন মাসয়ালার ক্ষেত্রে যদি তাঁরা অজ্ঞাতসারে কোন ভুলও করে বসেন তাহলে ইসলামী শরীয়তের উৎসদ্বয় (নস) পরিষ্কার বলে দিচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা একজন্য তাঁদের ক্ষমা করবেন এবং তাঁদের সৎ উদ্দেশ্যের পুরস্কার দান করবেন।
এ পন্হা অবলম্বন করার ক্ষেত্রে খুব বেশী হলে এতটুকু আশংকা আছে যে, একদল লোক তাদের বিরোধিতা করার জন্য কোমর বেঁধে লেগে যাবে এবং তাঁদের অনুসারীদের মধ্যেও কিছু সংখ্যক লোক তাঁদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা করবে। ক্তিু এ পন্হা অবলম্বন না করার মধ্যে এর চেয়েও যে বড় আশংকা রয়েছে, তা হচ্ছে- মুসলমানরা যখন নিজেদের প্রয়োজনের সামনে অসহায় হয়ে ইসলামী আইনের পরিবর্তে কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করবে এবং তাদের মধ্যে দীনকে নিয়ে উপহাস করা, শরীয়তের আইনকে খেলনায় পরিনত করা, আল্লাহর নির্ধারিত সীমার বিরুদ্ধাচরণ করা, দীনী ও নৈতিক বিপর্য, কুফর ও আল্লাহদ্রোহী কাজের মহামারী ছড়িয়ে পড়বে এবং খৃস্টান জাতির ন্যায় তারাও নিজেদের ধর্মের আইন পরিত্যাগ করে মানুষের মনগা আইন গ্রহণ করবে, [যেমন তুরস্কে গ্রহণ করা হয়েছে।– গ্রন্হকার।] তখন কিয়ামতের দিন এসব গুনাহগারদের সাথে তাদের ধর্মীয় নেতারাও গ্রেফতার হয়ে আল্লাহর আদালতে হাযির হবেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের জিজ্ঞাসা করবেন, ‘আমি কি তোমাদের একজন্যই জ্ঞান-বুদ্ধি দান করেছিলাম যে, তোমরা তা কাজে লাগাবে না? আমর কিতাব ও আমার নবীর সুননাত কি তোমাদের সামনে এজন্যই রাখা হয়েছিল যে, তোমরা এগুলো নিয়ে বসে থাকবে আর মুসলমানরা পথভ্রষ্ট হতে থাকবে? আমি আমার দীনকে সহজ বানিয়েছিলাম, তাকে কঠিন করে তোলার তোমাদের কি অধিকার ছিল? আমি তোমদেরকে কুরআন ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার হুকুম দিয়েছিলাম। এ দু’জনকে অতিক্রম করে নিজেদের পূর্বতীদের অনুসরণ করা তোমাদের ওপর কে ফরয করেছিল? আমি প্রতিটি কাঠিন্যের প্রতিষেধক এ কুরআনে রেখে দিয়েছিলাম, এটাকে স্পর্শ করতে তোমাদের কে নিষেধ করেছে? মানুষের লেখা কিতাবগুলোকে নিজেদের জন্য যথেষ্ট মনে করার নির্দেশই বা তোমাদের কে দিয়েছে?’ এ জিজ্ঞাসার জবাবে কোন আলেমেরই কানযুদ-দাকায়েক, হিদায়া ও আলমগীরীর রচয়িতাদের কোলে আশ্রয় পাওয়ার আশা নেই।
এ প্রাসংগিক আলোচনাটি যেহেতু প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া অত্যবশ্যণীয় ছিল, তাএ এটাকে এতখানি জায়গা দিতে হয়েছে। এরপর আমি আমার মূল আলোচনায় ফিরে যাচ্ছি।
মৌলিক পথনির্দেশ
কুরআন মজদি যেহেতু একখানা মৌলিক গ্রন্হ, তাই এতে দাম্পত্য জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়নি। কিন্তু তাতে এমন কতগুলো ব্যাপক মূলনীতি দেয়া হয়েছে, যার অধীনে প্রায় সমস্ত প্রাসংগিক মাসয়ালাই এসে যায় এবং আনুষংগিক মাসয়ালা বের করার ক্ষেত্রেও তা উত্তমরূপে পথপ্রদর্শন করে। সুতরাং আইনের বিস্তারিত বিবরণের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার পূর্বে কুরআন মজীদে বর্ণিত মূলনীতি ও নিয়মাবলী উত্তমরূপে বুঝে নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
(১)
**********************************
“মুশরিক নারীরা যতক্ষণ ঈমান না আনবে, তোমরা তাদের বিবাহ করো না”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২১
**********************************
“মুশরিক পুরুষরা যতক্ষণ ঈমান না আনবে, তোমরা তাদের সাথে তোমাদের মহিলঅদের বিবাহ দিও না”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২১
**********************************
“আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের সতী-সাধ্বী নারীদের বিবাহ করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে”।– সূরা আল মায়েদাঃ ৫
এসব আয়াতে এ নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে যে, মুশরিক নারীর সাথে মুসলমান পুরুষের বিবাহ হতে পারে না। অবশ্র আহলে কিতাব নারীদের তাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। কিন্তু মুসলমান নারী না মুশরিক পুরুষের সাথে বিবাহ বসতে পারবে, আর না আহলে কিতাব পুরুষের সাথে।
(২)
**********************************
“তোমরা মুশরিক নারীদের বিবাহ করো না।…. মুশরিক পুরুষদের সাথে তোমাদের নারীদের বিবাহ দিও না”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২১
এ আয়াত থেকে আরো একটি মূলনীতি পাওয়া যায়। পুরুষ লোক নিজেই নিজের বিবাহ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এক্ষেত্রে স্ত্রীলোক সস্পূর্ণ স্বাধীন নয়। তাকে কারো সাথে বিবাহ দেয়া তার অভিভাবকদের দায়িত্ব। এতে সন্দেহ নেই যে, বিবাহের ব্যাপারে নারীদের সম্মতি গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তার মরযীর বিরুদ্ধে তাকে কারো কাছে বিবাহ দেয়ার অধিকার কারো নেই। যেমন হাদীসে এসেছেঃ
**********************************
“বিধবা নারী তার নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার অভিভাবকের চেয়ে অধিক ক্ষমতা রাখে”।
**********************************
“প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে তার অনুমতি ছাড়া বিবাহ দেয়া যাবে না”।
কিন্তু নারীর বিবাহের ব্যাপারটা যেহেতু বংশের স্বার্থের সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত, তাই কুরআন মজীদের দাবি হচ্ছে- বিবাহের ব্যাপারে কেবল নারীর পসন্দ ও ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়, বরং সাথে সাথে তার পুরুষ আত্মীয়দের মতামতও বিবেচনা করতে হবে।
(৩)
**********************************
“তোমরা তাদের কাছ থেকে যে ফায়দা উঠিয়েছো তার বিনিময়ে মোহরানা প্রদান করো- এটাকে ফরয মনে করো”।– সূরা আন নিসাঃ ২৪
**********************************
“তোমরা নিজেদের দেয়া মোহরানা কি করে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারো? অথচ তোমাদের একজন অপরজনের কাছ থেকে যৌনস্বাদ লাভ করেছ”।– সূরা আন নিসাঃ ২১
**********************************
“তোমরা যদি তাদের সাথে সহবাস করার পূর্বে এবং মোহরানা নির্ধারণ করার পরে তাদের তালাক দাও, তাহলে নির্ধারিত মোহরানার অর্ধেম পরিমাণ আদায় করতে হবে”।– সূরা আল বাকারাঃ ২৩৭
এসব আয়াত থেকে জানা যায়, পুরুষ তার স্ত্রীর নৈকট্য লাভ করে যে ফাদা (যৌনস্বাদ) অর্জন করে- মোহরানা তারই প্রতিদান। সুতরাং নৈকট্য লাভের পরই পূর্ণ মোহরানা আদায় করা ওয়াজিব হয় এবং কোন অবস্থায়ই বা বাতিল বা রহিত হতে পারে না। কিন্তু স্ত্রী যদি সন্তুষ্টি সহকারে পূর্ণ মোহরানা অথবা তার অংশবিশেষ মাফ করে দেয়, তবে ভিন্ন কথা।
**********************************
“তারা যদি খুশিমনে মোহরানার অংশবিশেষ তোমাদের ছেড়ে দেয়, তাহলে তোমরা তা সানন্দে গ্রহন করতে পারো”।– সূরা আন নিসাঃ ৪
অথবা যদি খোলার বিনিময় হিসাবে তা ছেড়ে দেয়- তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার।
**********************************
“স্ত্রী যদি কিছু বিনিময় দিয়ে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায় তাহলে এতে কোন দোষ নেই”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২৯
(৪)
**********************************
“তোমরা যদি তাদেরকে মোহরানা হিসাবে অঢেল সম্পদও দিয়ে থাকো তবে তার কিছু অংশও ফেরত নিতে পারো না”।–সূরা আন নিসাঃ ২০
এ আয়াত থেকে জানা যায়, ইসলামী শরীয়তে মোহরানার কোন পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। অতএব মনগড়া আইন তৈরি করে পরিমাণ সীমিত করা যায় না।
(৫)
**********************************
“পুরুষরা নারীদের ওপর কর্তৃত্ব করবে কারণ আল্লাহ তাদের এক দলকে অপর দলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং পুরুষরা তাদের জন্য নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে”।– সূরা আন নিসাঃ ৩৪
এ আয়াতের দৃষ্টিতে নারীর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা বা তার ব্যয়ভার বহন করা পুরুষের ওপর ওয়াজিব। বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে পুরুষ নারীর ওপর স্বামীত্বের যে অধিকার অর্জন করে- এটা তারই বিনিময়। নারীর খোরপোষ পাওয়ার এ অধিকার কোন অবস্থাতেই বাতিল হতে পারে না। তবে সে যদি স্বেচ্ছায় তার এ অধিকার ছেড়ে দেয় অথবা সে যদি স্বামীর অবাধ্য হয়ে যায়- তাহলে স্বতন্ত্র কথা।
(৬)
**********************************
“সচ্ছল ব্যক্তি তার সচ্চলতা অনুযায়ী (স্ত্রীর) ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে এবং যে ব্যক্তি অসচ্ছর- তাকে আল্লাহ যে পরিমাণ রিযিক দিয়েছেন তদনুযায়ী (স্ত্রীর) খোরপোষ দিবে”।– সূরা তালাকঃ ৭
এখানে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ও ব্যয়ভার সম্পর্কে এ নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে যে, এর পরিমাণ নির্ধারণের সময় স্বামীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে। সম্পদশালী ব্যক্তির ওপর তার সচ্চলতা অনুযায়ী এর পরিমাণ নির্ধারিত হবে এবং গরীব ব্যক্তির ওপর তার সামর্থ্য অনুযায়ী এর পরিমাণ ধার্য হবে।
(৭)
**********************************
“তোমরা যেসব স্ত্রীদের বিদ্রোহী হওয়ার আশংকা করো, তাদেরকে উপদেশ দাও, বিছানায় তাদের থেকে পৃথক থাকো এবং তাদেরকে দৈহিক শাস্তি দাও। অতপর তারা যদি তোমাদের অনুগত হয়ে যায় তাহলে তাদের ওপর বাড়াবাড়ি করার জন্য কোন পথ খুঁজবে না”।– সূরা আন নিসাঃ ৩৪
এ আয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, স্ত্রী যখন বিদ্রোহাত্মক মনোভাব এবং আনুগত্যহীনতার পথ গ্রহণ করে, কেবল তখনই তাকে শাস্তি দেয়ার অধিকার স্বামীকে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায়ও শাস্তির দুটি পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছেঃ
একঃ বিছানা ত্যাগ অর্থাৎ সহবাস পরিত্যাগ করা।
দুইঃ হালকা মারপিট, যা চরম বিদ্রোহী হয়ে পড়লেই কেবল জায়েয।
এ সীমালংঘণ করা অর্থাৎ বিদ্রোহী না হওয়া সত্ত্বেও শাস্তি দেয়া অথবা সাধারণ পর্যায়ের বিদ্রোহের কারণে গুরুদণ্ড দেয়া অথবা চরম বিদ্রোহের ক্ষেত্রে হালকা মারপিটের সীমালংঘন করা ইত্যাদি সবই যুলুম ও বাড়াবাড়ির অন্তরভুক্ত।
(৮)
**********************************
“তোমরা যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা করো, তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস পাঠাও। তারা যদি সংশোধনের ইচ্ছা করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তাদের উভয়ের মধ্যে আনুকূল্য সৃষ্টি করে দিবেন”।– সূরা আন নিসাঃ ৩৫
উল্লিখিত আয়াতে এ নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে যে, স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে যদি ঝগড়া-বিবাদ হয়ে যায় এবং নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে নেয়ার কোন পথ সৃষ্টি না হয়, তাহলে তাদের এ বিবাদ মীমাংসার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পূর্বে পুরুষের আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন এবং স্ত্রীলোকটির আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করা উচিত। তারা উভয়ে মিলে এদের মধ্যকার ঝগড়া মীমাংসা করার চেষ্টা করবে।
‘ওয়া ইন খিফতুম’ ও ‘ফাব’আসু’ বাক্যাংশের দ্বারা মুসলমানদের যাবতীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে সম্বোধন করা হয়েছে। এজন্য সালিস নিযুক্ত করা তাদের কাজ। সালিসগণ যদি কোন মীমাংসা রতে না পারেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত মীমাংসা করার ক্ষমতা মুসলমানদের কর্তা ব্যক্তিই (উলিল আমর) লাভ করবেন।
(৯)
**********************************
“তোমাদের যদি আশংকা হয় যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা বজায় রাখতে পারবে না তাহলে স্ত্রী যদি কিছু বিনিময় দিয়ে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায়, তাতে উভয়ের কোন দোষ নেই”।–সূরা আল বাকারাঃ ২২৯
এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ফায়সালা করার সময় কাযীকে যে বিষয়টি সবচেয়ে অধিক বিচেনা করতে হবে তা হচ্ছে- স্বামী ও স্ত্রী নিজেদের দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্ধারিত সীমার ওপর টিকে থাকতে পারবে কি না? যদি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা ভেঙে যাওয়ার প্রবল আশংকা হয়, তাহলে এর চেয়ে অধিক কোন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নেই যার কারণে স্বামী-স্ত্রীকে একত্রে থাকার সিদ্ধান্ত জায়েয হতে পারে। আল্লাহর নির্ধারিত সীমার হেফাযত করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য প্রয়োজন হলে সবকিছুই কুরবানী করা যেতে পারে।
**********************************
“যেসব লোক আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করে, তারা যালিম”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২৯
(১০)
**********************************
“তাদের ওপর বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে কষ্টের মধ্যে আটকে রেখো না”।– সূরা আল বাকারাঃ ২৩১
এ আয়াতে ইসলামী আইনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির দিকে ইশারা করা হয়েছে। তা হচ্ছে- কোন স্ত্রীলোককে কোন পুরুষের বিবাহ-বন্ধনে এমনভাবে আবদ্ধ করে রাখা যাবে না যা তার ক্ষতির কারণ হবে এবং তার অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদি একত্রে বসবাস করতে হয় তাহলে তা ন্যায়সংগতভাবেই হতে হবে।
**********************************
“স্ত্রীদের সাথে ন্যায়নুগভাবে বসবাস করো”।–সূরা আন নিসাঃ ১৯
যদি স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণ করতে হয় তাহলে সেটাও ন্যায়সংগতভাবে হতে হবে। ************* “ন্যায়সংগতভাবেই স্ত্রীকে ফিরিয়ে রাখতে হবে”।– সূলা আল বাকারাঃ২২০
কিন্তু যেখানে এসবের কোন আশা নেই, বরং এর বিপরীত ক্ষতি এ অধিকার হরণের আশংকা রয়েছে- সেখানে ‘তাসরীহুম বি-ইহসান’ (ভদ্রভাবে বিদায় দেয়া)-র ওপর আমল করাই জরুরী। কেননা নবী আলাইহিস সালামের নির্দেশ অনুযায়ী ইসলামী আইনের মধ্যে কোন ক্ষতিকর উপাদানও নেই এবং তা কারো ক্ষতি করার অনুমতিও দেয় না।
**********************************
“ইসলামে ক্ষতিকর কিছু নেই এবং ক্ষতি করার সুযোগও নেই”।
(১১)
**********************************
“তোমরা এক স্ত্রীর প্রতি এমনভাবে ঝুঁকে পড়ো না যে, অন্য স্ত্রীরা ঝুলন্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে বাধ্য হয়”।– সূরা আন নিসাঃ ১২৯
এ আয়াত যদিও একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে, কিন্তু এর শেষ অংশে একটি সাধারণ নীতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তা এই যে, কোন স্ত্রীলোককে এমন অবস্থায় রেখে দেয়া যাবে না, সে এক ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকবে অথচ সে তার সংসর্গ লাভ করারও সুযোগ পাচ্ছে না, আবার অপর কারো সাথে বিবাহ বসার স্বাধীনতাও পাচ্ছে না।
(১২)
**********************************
“যেসব লোক নিজেদের স্ত্রীদের ঈলা করে তাদের জন্য চার মাসের অবকাশ আছে”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২৬
এ আয়াতে মহিলাদের ভারসাম্যপূর্ণ ধৈর্য শক্তির দিকে ইংগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদেরকে চার মাস পর্যন্ত কোনরূপ যন্ত্রণা এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন ছাড়া স্বামীর সহবাস থেকে বঞ্চিত রাখা যেতে পারে। [এ নীতির ভিত্তিতে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, কোন বিবাহিত ব্যক্তিকে একাধারে চার মাসের অধিক সময় সামরিক কাজে নিয়োজিত রেখে বাড়ি থেকে দূরে রাখা যাবে না।–গ্রন্হকার।] এরপর দুটি জিনিসের মধ্যে কোন একটি আশংকা রয়েছে। এ আয়াতও একটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছে, কিন্তু এ বিশে ঘটনা ছাড়াও এ আয়াত অন্যান্য ব্যাপারেও পথনির্দেশ দান করে।
(১৩)
**********************************
“যেসব লোক নিজেদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে যেনার অভিযোগ উত্থাপন করে এবং তাদের নিজেদের ছাড়া অন্য কোন সাক্ষী তারা হাযির করতে পারছে না”।– সুরা আন নূরঃ ৬
এ আয়াতে লি’আনের নিয়ম-কানুন বর্ণনা করা হয়েছে। তা এই যে, যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীল বিরুদ্দে যেনার অভিযোগ আনে এবং কোন সাক্ষ-প্রমাণ পেশ করতে না পারে, তাহলে চারবার এই বলে তাকে শপথ করানো হবে যে, সে যে অভিযোগ এনেছে তা সত্য। পঞ্চমবারে তাকে এভাবে বলানো হবে যে, যদি সে মিথ্যাবাদী হয় তাহলে তার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত নিপতিত হোক। এরপর স্ত্রীর যেনার শাস্তি থেকে বাঁচার একটি পথই আছে। সেও আল্লাহর নামে শপথ করে চারবার বলবে যে, তার স্বামীর উত্থাপিত অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। পঞ্চমবারে সে বলবে, যদি তার স্বামীর অভিযোগ সত্য হয় তবে তার নিজের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হোক। এভাবে লি’আন করা শেষ হলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিতে হবে।
(১৪)
**********************************
“কিন্তু স্ত্রীলোকটি নিজেই যদি অনুগ্রহ দেখায় (মোহরানা গ্রহণ না করে) অথবা যে পুরুষ লোকটির হাতে বিবাহের বন্ধন রয়েছে সে যদি অনুগ্রহ করে (পূর্ণ মোহরানা দেয়) তবে তা স্বতন্ত্র কথা”।
-সূরা আল বাকরাঃ ২৩৭
উক্ত আয়াতের শেষাংশে এ নীতির ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, বিবাহ বন্ধনের গিট পুরুষের হাতে রয়েছে এবং সে তা বেঁধে রাখার অথবা খুলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। কুরআন মজীদের যেখানেই তালাকের প্রসংগ এসেছে সেখানেই ‘পুংলিঙ্গের ক্রিয়াপদ’ ব্যবহার করা হয়েছে এবং তালাক ক্রিয়াকে পুরুষের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছৈ। যেমন *************** (তারা যদি তালাক দেয়।– সূরা আল বাকারাঃ ২২৭)। ********* (সে যদি তাকে তালাক দেয়।–সূরা আল বাকারাঃ ২৩০) এবং ************ ‘যখন তোমরা স্ত্রীলোকদের তালাক দাও, তখন তাদেরকে ইদ্দাত গণনা করার জন্য তালাক দাও”।–সূরা তালাকঃ ১
উপরোক্ত আয়াতগুলো একথাই প্রমাণিত করে যে, পুরুষ লোকটি স্বামী হওয়ার অধিকারবলে তালাক দেয়া বা না দেয়ার পূর্ণ এখতিয়ার রাখে। তার এ অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার মত আইন তৈরি করা যেতে পারে না।
কিন্তু ইসলামে প্রতিটি অধিকারের ওপর এ শর্ত আরোপ করে রাখা হয়েছে যে, তা ব্যবহার ও প্রযোগ করতে গিয়ে যেন যুলুমের আশ্রয় না নেয়া হয় এবং আল্লাহর সীমা লংঘিত না হয়। ***************** (যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করে সে নিজের ওপরই যুলুম করে-সূরা তালাকঃ ১)। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করে সে নিজেকে নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উপযুক্ত বানায়।
********************** (তোমরাও যুলুম করো না এবং তোমাদের ওপরও যুলুম করা হবে না- সূরা আল বাকারাঃ ২৭৯)। এটা একটা সাধারণ নীতি যা ইসলামী আইনের প্রতিটি বিভাগে, প্রতিটি ব্যাপারে চালূ রয়েছে এবং পুরুষের তালাকের অধিকারও এর ব্যতিক্রম নয়।
অতএব যখন কোন স্ত্রীলোকের পক্ষ থেকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে যুলুম-নির্যাতনের অভিযোগ উত্থাপিত হয় তা যথারীতি *************** [তোমাদে মধ্যে যদি কোন ব্যাপারে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের (বিধানের দিকে) রুজু করো-সূরা আন নিসাঃ ৫৯] আয়াতের আওতায় আসবে এবং স্ত্রীর তার অভিযোগ যথার্থ প্রমাণিত হলে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ মুসলমানদের যাবতীয় বিষয়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তির এ অধিকার রয়েছে যে, সে স্বামীকে তার এখতিয়ার থেকে বঞ্চিত করে তা নিজ হাতে প্রয়োগ করবে। ইসলামী শরীয়তে কাযীকে বিবাহ বাতিল করার, স্বামী-স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার এবং তালাক দেয়ার[তালাকের অধিকার স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে স্বয়ং (কাযী তাঁর পদাধিকারবলে) স্ত্রীলোকটিকে তালাক দেয়া।– গ্রন্হকার।] যে অধিকার দেয়া হয়েছে তা এ মূলনীতির ওপ র ভিত্তিশীল। ফিকহবিদদের এক দল ******************* আয়াত থেকে এ দলীল গ্রহন করেছেন, “পুরুষকে তালাকের যে অধিকার দেয়া হয়েছে তা কোন শর্তের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়নি এবং এ নীতির মধ্যে কোন ব্যতিক্রম নেই। পুরুষ লোকটি যদি তালাক দিতে রাযী না হয়, তাহলে কোন অবস্থায়ই কাযীর অধিকার নেই যে, স্বামীর হাত থেকে তালাকের এখতিয়ার ছিনিয়ে নিয়ে সে নিজে তা ব্যবহার করবে”। কিন্তু কুরআন মজীদ এ দলীলের সমর্থন করে না। কুরআন মজীদে তো মানুষের বেঁচে থাকার মত সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকারই ************ শব্দের দ্বারা শর্তসাপেক্ষ করে দেয়া হয়েছে। আর কোথায় তার তালাকের অধিকার! স্বামী যদি যুলুমও করে, আল্লাহর যাবতীয় সীমালংঘনও করে এবং অপর পক্ষের যাবতীয় অধিকার খর্বও করে- তারপরও স্বামীর তালাকের অধিকারকে অবাধ ও শতীহীন বলে মেনে দিতে হবে এবং তা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে- এরূপ কথাই অবান্তর।
(১৫)
**********************************
“তালাক দুইবার: অতপর হয় স্ত্রীকে ন্যায়সংগতভাবে ফিরিয়ে রাখবে অথবা ভদ্রভাবে বিদায় দিবে”।–সূরা আল বাকারাঃ ২২৯
**********************************
“অতপর স্বামী যদি স্ত্রীকে (তৃতীয়) তালাক দেয়, তাহলে এ স্ত্রীলোকটির যতক্ষণ অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ না হবে ততক্ষণ সে তার পূর্ব স্বামীর জন্য হালাল হবে না”।– সূরা আল বাকারাঃ ২৩০
এ আয়াতে তালাকের সংখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে। তা এই যে, দুই তালাক পর্যন্ত প্রত্যাহারযোগ্য এবং তৃতীয়বার তালাক হচ্ছে মুগাল্লাযা (বৈবাহিক সম্পর্ককে সম্পূর্ণরূপে ছিন্নকারী) তালাক।
প্রাসংগিক আলোচ্য বিষয়সমূহ
পূর্বের অধ্যায়ে মৌলিক নির্দেশসমূহ যেভাবে ক্রমিক ধারা অনুযায়ী বর্ণনা করা হয়েছে, এখন আমরা এ মৌলিক বিধানগুলোর প্রতিটির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রাসংগিক বিধানগুলোও একইভাবে ক্রমিক ধারা অনুযায়ী বর্নণা করবো। এখানে আমরা সমস্ত প্রাসংগিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে চাই না, বরং যুগের প্রয়োজন ও অবস্থার বিচারে যেসব মাসয়ালার ক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে, আমরা সেসব বিষয়ের বিশেষ ফিকহী নির্দেশগুলো বর্ননা করবো।
১. স্বামী-স্ত্রী যে কোন একজনের ধর্মচ্যুতি
বর্তমান সময়ে ধর্মচ্যুতির সমস্যাটা গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরুষদের ধর্মচ্যুতির ক্ষেত্রে তেমন কোন জটিলতা সৃষ্টি হয় না। কেননা কোন মুসলিম নারী কোন অমুসলিম ব্যক্তির বিবাহাধীনে থাকতে পারে না। এ ব্যাপারে সবাই একমত। কিন্তু নারীদের ধর্মচ্যুতির ক্ষেত্রে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বহু স্ত্রীলোকই কেবল যালিম অথবা অমনোপূত স্বামীর কবল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে গেছে এবং হচ্ছে। এ সমস্যার ক্ষেত্রে ইংরেজ বিচারালয়গুলো ইমাম আবূ হানীফা (রা) থেকে হিদায়া ও অন্যান্য গ্রন্হে বর্ণিত প্রকাশ্য বক্তব্য অনুযায়ী কার্যসম্পাদন করে থাকে। অর্থাৎ
**********************************
“স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে কেউ মুরতাদ হয়ে গেয়ে তালাক ছাড়াই বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে”।[অর্থাৎ সেই স্ত্রীলোক তার মুসলমান স্বামীর জন্য হারাম হয়ে যায়, কিন্তু এ বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে সে অন্য লোকের কাছে বিবাহ বসার অধিকার লাভ করতে পারে না।– গ্রন্হকার।]
কিন্তু ভারতীয় আলেমগণ এ ধরনের ধর্মচ্যুতির গতিরোধ করার জন্য বলখ ও সামারকান্দের বিশেষজ্ঞদের এবং বোখারার কোন কোন বিশেষজ্ঞের ফতোয়া অনুযায়ী কাজ করতে চান। তার সারসংক্ষেপ এই যে, স্ত্রী মুরতাদ হয়ে গেলে বিবাহ বাতিল হয় না, বরং সে তার মুসলিম স্বামীর বিবাহ বন্ধনেই আবদ্ধ থেকে যায়। উক্ত ফতোয়ার ভিত্তি এই যে, এ ধরনের স্ত্রীলোক যেহেতু বিবাহের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের জন্যই কেবল মুরতাদ হয়- তাই এ ছল-চাতুরীর পথ বন্ধ করার জন্য বিবাহের ওপর তার ধর্মচ্যুতির কোন প্রভাব স্বীকার করা হবে না। কিন্তু এ ফতোয়া গ্রহণ করতে কতগুলো অসুবিধা আছে। আলেমদের দৃষ্টি সম্ভবত এখনো সেদিকে যায়নি।
প্রথমঃ ইসলাম ও কুফরের ব্যাপারে দেশের প্রচলিত আইন এবং ইসলামী শরীয়ত উভয়ই কেবল মৌখির স্বীকারোক্তিকেই গ্রহণ করে থাকে। আমাদের কাছেও এমন কোন উপায় নেই যার মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে পারি যে, স্ত্রীলোকটি অন্তরের দিক থেকে ধর্মত্যাগী হয়নি, বরং সে কেবল স্বামীর কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মুরতাদ হয়েছে।
দ্বিতীয়ঃ যে স্ত্রীলোক আসমানী কিতাবভিত্তিক ধর্মগুলোর যে কোন একটি ধর্মে চলে যায়, তার ব্যাপারে তো ************** আয়াতের সুযোগ গ্রহণ করে অন্যভাবে বলা যায়, সে মুসলমান পুরুষের বিবাহাধীন থাকতে পারে। কিন্তু যে নারী হিন্দু অথবা মজূসী (অগ্নি উপাসক) হয়ে যায় অথবা অন্য কোন আসমানীয় কিতাববিহীন ধর্মে চলে যায়, তাহলে তার মুসলমান পুরুষের বিবাহাধীন থাকাটা তো কুরআন মজীদের সুস্পষ্ট নির্দেশের পরিপন্হী।
তৃতীয়ঃ যে নারী ইসলামের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে অন্য ধর্মে চলে গেছে তার ওপর ইসলামী আইন কিভাবে প্রযোজ্য হতে পারে? আমরা একটি অমুসলিম রাষ্ট্রের অধীনে আছি।[বইট বিভাগ পূর্বকালে রচিত।–অনুবাদক] আর এ রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে মুসলমান, হিন্দু, শিখ- সবাই এক সমান। আমরা এ রাষ্টের কাছে কি করে আশা করতে পারি য, কোন নারী মুসলমান থাকা অবস্থায় ইসলামী রীতি অনুযায়ী তার বিবাহ হয়েছিল, পরে সে, মনে করুন, শিখ অথবা আর্য সমাজের সাশে মিশে গেছে- এ রাষ্ট্রব্যবস্থা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কি করে তাকে এ বিবাহ বন্ধনে থাকতে বাধ্য করবে?
এসব কারনে আমাদের মতে ধর্মত্যাগের ক্ষেত্রে সামারকান্দি ও বলখের আলেমগণের ফতোয়া থেকে ভারতীয় আলেমগণ মোটেই লাভবান হতে পারবেন না। মূলত দেখার বিষয় হচ্ছে, নারীরা কেন মুরতাদ হচ্ছে? আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ের সথে বলতে পারি যে, প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে শতকরা মাত্র দু চারজনই এ রকম হতে পারে যাদের আকীদা-বিশ্বাসের বাস্তবিকই কোন পরিবর্তন এসেছে। বাস্তবিকপক্ষে যে জিনিস তাদেরকে ধর্মত্যাগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা স্রেফ এই যে, যুলুম-নির্যাতনের অনেক ক্ষেত্রে বর্তমান প্রচলিত আইনের অধীনে নারীদের ফরিয়াদ জানানোর কোন সুযোগ নেই। স্বামী কঠোর থেকে কঠোরতর নির্যাতন করে। কিন্তু স্ত্রী তার থেকে খোলা করে নিতে পারে না। স্বামী অকর্মণ্য, পাগল অথবা ভয়ংকর হিংস্র প্রকৃতির অথবা ঘৃণ্য রোগে আক্রান্ত অথবা কঠিন বদ অভ্যাগে লিপ্ত, স্ত্রী তার নাম পর্যন্ত শুনতে চায় না, পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে আছে- কিন্তু বিবাহের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের কোন পথ খোলা নেই। স্বামী নিখোঁজ রয়েছে, বছরের পর বছর ধরে তার কোন খোঁজ-খবর নেই, স্ত্রীর জন্য জীবন ধারণ দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে, কিন্তু তার এ বিপদ থেকে মুক্তি পাবার কোন উপায় নেই।
এ ধরনের করুণ পরিস্থিতি মূলত নারীদের ইসলাম থেকে কুফরীর মধ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য করছে। এখান সেখান থেকে ফিকহের খুঁটিনাটি মাসয়ালা বের করে আনা এ প্রবণতাকে প্রতিরোধ করার সঠিক পদ্ধতি নয়। এভাবে এ ভাগ্যাহত মহিলাদের কুফরীর আঁচলে আশ্রয় নেয়ার সুযোগটুকু বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে মুরতাদ হওয়ার পরিবর্তে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হবে। বরং এর সঠিক পথ এই যে, আমরা স্বয়ং আমাদের আইনগুলোকে একবার পর্যালোচনা করে দেখি এবং যেসব ইজতিহাদী আইনের কঠোরতার কারণে আমাদের বোন ও কন্যাদেরকে ইসলমের বন্ধন থেকে বের হয়ে কুফরীর মধ্যে আশ্রয় নিতে হচ্ছে- সেগুলোকে পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের দাবি অনুযায়ী পরিবর্তন ও সংশোধন করে নিই। আল্লাহ ও তাঁরা রাসূলের বাধ্যতামূলক নির্দেশসমূহ (নুসূস) পর্যন্ত যতদূর বলা যায়, তার মধ্যে মুরতাদ হতে বাধ্য হবার মত কঠোরতা থাকা তো দুরের কথা, সামান্য কোন ক্ষতি হওয়ার মত উপাদানও নেই। এ কঠোরতা কেবল কতিপয় ইজতিহাদী আইনের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এ ইজতিহাদী আইনকে অন্যান্য আইনের মাধ্যমে পরিবর্তন করে মুসলিম মহিলাদের ধর্মত্যাগী হওয়ার পথকে চিরতরে বন্ধ করা যেতে পারে।
২. প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষমতা প্রয়োগ
কুরআন মজীদে যদিও এ নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, “কোন স্ত্রীলোকের বিবাহের ব্যাপারে তার অভিভাবকদের মতামতের গুরুত্ব রয়েছে” কিন্তু নবী করীম (স) নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে এ নীতির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা থেকে জানা যায়, অভিভাবকদের মতামদের ওপর গুরুত্ব দেয়ার অর্থ এই নয় যে, নারীর জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির ক্ষেত্রে তার নিজের মোটেই কোন এখতিয়ার নেই। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ (স) ইতিবাচকভাবে নারীদের এ অধিকার দিয়েছেন যে, বিবাহের ব্যাপারে তার সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং আবূ দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজা ও মুসনাদে আহমাদ গ্রন্হে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ একটি মেয়ে রাসূলুল্লাহ (স)-এর কাছে অভিযোগ করলো, “আমার পিতা আমার মরযীর বিরুদ্ধে আমাকে বিবাহ দিয়েছেন”। তিনি বললেন, “এ বিবাহ প্রত্যাখ্যান করার অথবা অনুমোদন করার এখতিয়ার তোমার রয়েছে”।
নাসাঈ গ্রন্হে খানসা’ বিনতে খিযাম (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁর পিতা তাঁকে তার মরযীর বিরুদ্ধে বিবাহ দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (স) তাঁকেও একই অধিকার প্রদান করলেন।
দারু কুতনী গ্রন্হে হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত আছে, এ ধরণেরই একটি মোকদ্দমায় রাসূলুল্লাহ (স) স্বামী-স্ত্রীকে শুধু এ কারণে পৃথক করে দিলেন যে, স্ত্রীলোকটির অসম্মতিতে তাকে বিবাহ দেয়া হয়েছিল।
নাসাঈ গ্রন্হে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে, একটি স্ত্রীলোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অভিয়োগ করলো যে, তার পিতা নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে তার মরযীর বিরুদ্ধে তাকে বিবাহ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (স) তাকে বিবাহ ঠিক রাখার অথবা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার দিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল! আমার বাপ-মা যা করেছেন তা আমি অনুমোদন করলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের কেবল এটা জানিয়ে দেয়া যে, তাদের পিতারা এ ব্যাপারে কর্তৃত্বের অধিকারী নন”।
মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও মুওয়াত্তা গ্রন্হে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃ
**********************************
“বিধবা নারী তার পুনর্বিবাহের ব্যাপারে তার অভিভাবকের চেয়ে অধিক ক্ষমতার অধিকারী এবং যুবতীর বিবাহের ক্ষেত্রে তার অনুমতি গ্রহণ করতে হবে”।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেনঃ
**********************************
“বিধবা নারীকে তার অনুমতি না নিয়ে বিবাহ দেয়া যাবে না এবং কুমারী মেয়েকে তার অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত বিবাহ দেয়া যাবে না”।
৩. অভিভাবকের জোর-জবরদস্তি
উপরে যেসব হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে জানা যায় যে, শরীয়তের মূলনীতিসমূহের মধ্যে একটি মলূনীতি এই যে, বিবাহের ব্যাপারে স্ত্রীলোকের সম্মতি একান্ত প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কোন অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে তার পিতা অথবা কোন অভিভাবক বিবাহ দেন, তাহলে এ অবস্থায় তার ‘সম্মতি’র অধিকার বহাল থাকবে কি না? এ মাসয়ালার ক্ষেত্রে আমাদের ফিকহবিদগণ ফতোয়া দিয়েছেন যে, অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে যদি তার পিতা বা দাদা ছাড়া অন্যকেউ বিবাহ দিয়ে থাকে, তাহলে বয়োপ্রাপ্তির সাথে সাথে এই বিবাহকে বহাল রাখার অথবা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার তার থাকবে। কিন্তু যদি তার পিতা অথবা দাদা তাকে বিবাহ দিয়ে থাকেন, তাহলে বিবাহ প্রত্যাখখ্যান করার অধিককার তার থাকবে না। কিন্তু যদি পিতা অথবা দাদার ক্ষমতার অপব্যবহার প্রমাণিত হয়, তাহলে তার এ অধিকার বহাল থাকবে। যেমন সে (স্বামী) ফাসেক অথবা নির্লজ্জ অথবা নিজের কাজকর্মে গর্হিত পন্হা অবলম্বনকারী এবং অপরিণামদর্শিতার জন্য কুখ্যাত।
“অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়ের ওপর বাপ-দাদার জোর খাটানোর অধিকার আছে এবং তাদের দেয়া বিবাহকে সে বয়োপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রত্যাখ্যান করতে পারে না”।– এ মতটি কুরআন মজীদের কোন আয়াত অথবা নবী করীম (স)-এর কোন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। [আল-মাবসূত গ্রন্হে ইমাম সারাখসী অনেক চেষ্টা করে একটি মাত্র প্রমাণ পেশ করতে পরেছেন। তা হচ্ছে- হযরত আবূ বকর (রা) হযরত আয়েশা (রা)-কে নাবালেগ অবস্থায় নবী করীম (স)-এর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। তিনি যখন বয়োপ্রাপ্তা হলেন, নবী (স) তাঁকে একথা বলেননিঃ এ বিবাহ কবুল করার বা না করার তোমার অধিকার রয়েছে। অথচ নাবালেগ মেয়ের যদি এ ধরনের অধিকার থাকতো, তাহলে কুরআন মজীদের এখতিয়ারের আয়াত (সূরা আহযাবের ২৮ ও ২৯ আয়াত) নাযিল হওয়ার রাসূলুল্লাহ (স) তাদের যেভাবে (তাঁর স্ত্রীত্বে থাকার বা না থাকার) এখতিয়ার প্রদান করেছিলেন, এক্ষেত্রেও তিনি তাই করতেন।– ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২১৩।
এ থেকে জানা গেলো, অভিভাবকের জোর খাটানোর সমর্থনে অনেক খোঁজাখোঁজির পরও কিতাব ও সুন্নাহ থেকে এ দুর্বল প্রমাণটি ছাড়া আর কোন প্রমাণ পেশ করা সম্ভব হয়নি। এ প্রমাণটি এতই দুর্বল যে, আমাকে অবাক হতে হয়, শামসুল আইম্মা সারাখসীর মত ব্যক্তিত্ব কিভাবে এতবড় গুরুত্বপূণৃ একটি বিষয়ের ভিত্তি এর ওপর স্থাপন করলেন। অথচ তিনি একটুকু চিন্তা করলেন না যে, যে মত তিনি গঠন করতে যাচ্ছেন তার পরিণতিতে অসংখ্য নারীর একটা অধিকার চিরকালের জন্য ব্যাহত হতে যাচ্ছে। একথা যদি সঠিক হতো যে, হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে বাপের দেয়া বিবাহে কন্যার বালেগ হওয়ার পর ক্ষমতা প্রয়োগার অধিকার নেই, তাহলে সেটা এ ক্ষেত্রেই সঠিক হতে পারতো ‘যদি হযতর আয়েশা (রা) বালেগ হয়ে নিজের পিতার দেয়া বিবাহ প্রত্যাখ্যান করতেন অথবা তিনি যদি এ বিবাহের বিরুদ্ধে ‘প্রাপ্তবয়স্কার এখতিয়ার’ প্রয়োগ করার অধিকার প্রার্থনা করতেন এবং নবী করীম (স) যদি তাঁকে এ জবাব দিতেন, “না, এখন তোমার এ অধিকার নেই। কেননা তোমার ছোট বেলায় তোমার পিতা তোমাকে বিবাহ দিয়েছেন”। কিন্তু এ ধরনের কোন হাদীস বর্তমান নেই, বরং কোন হাদীসেই এতটুকুও উল্লেখ নেই যে, হযরত আয়েশা (রা) পরিষ্কার বাক্যে একথা বলেছেন যে, নবী করীম (স) এ ব্যাপারে আমাকে কোন এখতিয়ার দেননি। তার সার্বিক প্রয়োজনের ভিত্তি কেবল এতটুকু কথার ওফর রাখা হয়েখে যে, নবী করীম (স)কর্তৃক হযরত আয়েশাকে ‘এখতিয়ার’ দেয়ার কথা যেহেতু কোন হাদীসে উল্লেখ নেই- সুতরাং একথা মেনে নিতে হবে যে, তিনি তাঁকে (বিবাহ অনুমোদন করার অথবা প্রত্যাখ্যান করার) এখতিয়ার দেননি, আর যেহেতু তিনি তাঁকে এখতিয়ার দেননি। আর যেহেতু তিনি তাঁকে এখতিয়ার দেননি, তাই আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, এ ধরনের মেয়েদের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার নেই।
এ ধরনের হালকা দলীল পেশ করার সময় শামসুল আইম্মার এটাও মনে ছিল না যে, হাদীসে কোন ঘটনার উল্লেখ না হওয়াই যে ঘটনা সংঘটিত না হওয়ার প্রমাণ হতে পারে না; আর না তাঁর একটা খেয়ালে এসেছিল যে, কোন মেয়ে বালেগ হওয়ার পর নিজের পিতার কাজের ওপর সম্মত ছিল, সে এর বিরুদ্ধে কোন অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেনি এবং সে পিতার বিরুদ্ধে ‘প্রাপ্তবয়স্কার ক্ষমতা’ প্রয়োগ করার মোটেই দাবি করেনি- এ অবস্থায় যদি তাকে এখতিয়ার না দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে শেষ পর্যন্ত একথার দলীল কি করে হতে পারে যে, বাপের বিরুদ্ধে কন্যার ‘প্রাপ্তবস্কার ক্ষমতা প্রয়োগ’ করার মত অধিকার মোটেই নেই! এ ধরনের যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে যদি মানুষের অধিকার খর্ব হতে থাকে, তাহলে কোন ব্যক্তি এ দলীলও পেশ করতে পারে য, অমুক জায়গায় অমুক ব্যক্তিকে (যে কখনো পানি চায়নি) যেহেতু পানি দেয়া হয়নি, তাই কাইকে পানি দেয়া উচিত নয়।
শামসুল আইম্মার এর চেয়েও অদ্ভুত একটি যুক্তি এই যে, যদি পিতার বিরুদ্ধে কন্যার ‘প্রাপ্তবয়স্কার ক্ষমতা’ প্রয়োগের অধিকার থাকে তাহলে নবী করীম (স) হযরত আয়েশার দাবি উত্থাপন ব্যতিরেকেই তাঁকে এ এখতিয়ার অবশ্যই দিতেন। কেননা এখতিয়ারের আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি তাঁদেরকেক (নিজ স্ত্রীদের) এ এখতিয়ার প্রদান করেছিলেন। অন্য কথায় শামসুল আইম্মার যুক্তি এই যে, কোন একটি ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার সুস্পষ্ট নির্দেশ আসায় নবী করীম (স) যে কাজটি করেছিলেন, ঠিক একই কাজ তিনি অপর একটি ব্যাপারেও করতেন। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা তাঁকে কোন নির্দেশ দেননি।
উলামায়ে কিরাম চাচ্ছেন, এ ধরনের দুবর্ল যুক্তিগুলো চোখ বুজে মেনে নেয়া হোক। কারণ যে ব্যক্তি তা মানতে রাজী হবে না, তার ওপর মুকাল্লিদ না হওয়ার সীলমোহর মেরে দেয়ার আশংকা রয়েছে।–গ্রন্হকার।] বরং এটা ফিকাহবিদদের নিন্মোক্ত অনুমানের ওপর ভিত্তিশীলঃ “বাপ-দাদা যেহেতু মেয়ের অকল্যাণকামী হতে পারেন না, তাই তাঁদের দেয়া বিবাহ মেয়ের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত”। সুতরাং হিদায়া গ্রন্হে বলা হয়েছেঃ
**********************************
“(ছেলে অথবা মেয়েকে যদি তাদের পিতা অথবা দাদা অল্প বয়সে বিবাহ দেন তাহলে) বালেগ হওয়ার পর এ বিবাহ অনুমোদন করা অথবা প্রত্যাখ্যান করার অধিককার তাদের নেই। কেননা তাদের ব্যাপারে পিতা অথবা দাদার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত চলে বিবেচিত। (পিতা কখনো সন্তানের ক্ষতি করতে পারেন না)। তাছাড়া এদের প্রতি তাঁদের স্নেহ-মমতা প্রশ্নাতীত। সুতরাং তাদের বালেগ হওয়ার পর তাদের সম্মতিতে বিবাহ হলে তা যেরূপ বাধ্যতামূলক, একটাএ তদ্রূপ বাধ্যতামূলক”।
কিন্তু এটা কেবল কিয়াসভিত্তিক একটি রায়, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের মত অলংঘনীয় নয় এবং অলংঘনীয় হতেও পারে না। কুরআন- হাদীসের দলীল ও বুদ্ধিবৃত্তি- উভয় দিক থেকে এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে। যেমনঃ
একঃ সহীহ হাদীস থেকে জানা যায়, নবী করীম (স) হযরত হামযা (রা)-এর অল্প বয়সী মেয়েকে উমার ইবনে আবু সালামার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেনঃ বালেগ হওয়ার পর এ বিাবহ প্রত্যাখ্যান করা অথবা অনুমোদন করার এখতিয়ার তার রয়েছে। এ হাদীস থেকে অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়ের জন্য ‘প্রাপ্তবয়স্কার এখতিয়ার’ সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (স) এমন কোন ব্যাখ্যা দেননি যে, তিনি যেহেতু মেয়ের বাপ নন, বর চাচত ভাই, এজন্য তাঁর দেয়া বিবাদ তার জন্য বাধ্যতামূলত নয়।
দুইঃ এটা একটা অদ্ভুত কথা যে, প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ের তার বাপ-দাদার বিরুদ্ধে নিজের রায় ব্যবহার করার অধিকার আছে, কিন্তু এ মেয়েই যদি নাবালেগ হয়, তাহলে তার অধিকার সম্পূর্ণরূপে ছিনিয়ে নেয়া হবে। অথচ বিবাহের যাবতীয় ব্যাপারের সাথে নারীর সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি লক্ষ রেখে শরীয়তপ্রণেতা তাকে যে অধিকার দিয়েছেন তা উভয় অব্স্থায়ই সমান। কোন অভিভাবক ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকারী’ এবং ‘পরম স্নেহের আধার’ হওয়ার ভিত্তিতে যদি জবরদস্তি করার অধিকারী হতে পারে, তাহলে প্রাপ্তবয়স্কা কন্যার উপরও তার সেই অধিকার থাকা উচিত, যেভাবে অপ্রাপ্তবয়স্কার ক্ষেত্রে তা প্রমাণ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কা কন্যার ওপর যখন অভিভাবকের জোর-জবরদস্তি করার অধিকার নেই, তখন নাবালেগ কন্যার ওপর তার এ অধিকার থাকবে কেন?
তিনঃ বাপ-দাদার ‘অপরিসীম স্নেহের আধার’ এবং ‘পরিপূর্ণ সিদ্ধান্তের অধিকারী’ হওয়াটা কোন নিশ্চিত ও প্রমাণিত ব্যাপার নয়। শুধু প্রাবল্যের প্রতি লক্ষ করে একটি অনুমান (কিয়াস) দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু এ অনুমানের বিপরীতেও অনেক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে এবং যাচ্ছে- যা থেকে অপরিসীম স্নেহের ও পরিপূর্ণ রায়ের প্রমাণ খুব কমই পাওয়া যায়।
চারঃ যদি এ ধারণা সঠিকও হয়ে থাকে, তবুও এরূপ ঘটে যাওয়ার খুবই আশংকা রয়েছে, যে, বাপ-দাদা সৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে অপরিসীম স্নেহের আধার ও পরিপূর্ণ সিদ্ধান্তের অধিকারী হয়ে একটি নাবালেগ শিশুর সাথে তার নাবালেগ কন্যার বিবাহ দিলেন এবং ছেলেটি যৌবনে পদার্পন করে তাঁদের আশার গুড়ে বালি দিয়ে অপদার্থ প্রমাণিত হলো, বিশেষ করে বর্তমান যুগে যখন ইসলামী শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এলোমেলো হয়ে গেছে। শিক্ষা-দীক্ষার ক্রটির ফলে অত্যন্ত পিশাচ চরিত্র সৃষ্টি হচ্ছে এবং মুসলমানদের চারপাশে এত কলুষ পরিবেশ বিরাজ করছে যার মারাত্মক প্রভাব যুবকদের চরিত্র ও অভ্যাসের ওপর পতিত হচ্ছে- এ অবস্থায় অপল্প বয়সে বিবাহ দেয়ার প্রথাটি প্রতিরোধ করা খুবই প্রয়োজন এবং এসব বিবাহকে অন্তত বাধ্যতামূলক না করা উচিত। কেননা অনেক ছেলে- যাদের সম্পর্কে প্রথম দিকে একটা ভালো কিছু আশা করা যেত, পরবর্তী সময়ে হীনচরিত্র, কুঅভ্যাসে এবং আল্লাহ-বিরোধী আকীদা-বিশ্বাসে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে বাপ-দাদার জবরদস্তিমূলক কর্তৃত্ব স্বয়ং তাদের জন্যই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পাঁচঃ বাপ-দাদা তাঁদের কর্তৃত্বের অপব্যবহার করলে তাদের বিরুদ্ধে যে কোন মেয়ের ‘প্রাপ্তবয়স্কার ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার’ ব্যবহার করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়বে। কেননা এরূপ অবস্থায় তাকে আদালতের সামনে নিজের বাপ-দাদার বিরুদ্ধে অসৎ উদ্দেশ্য, অন্যায় আচরণ, নির্লজ্জতা, দূরভিসন্ধি, নির্বুদ্ধিতা, বোকামি ইত্যদির প্রমাণ পেশ করতে হবে। আর এটা তার জন্য শুধু কষ্টকরই নয়, বরং নিন্দনীয়ও বটে।
এসব কারণে ফিকহের এ আনুষাংগিক মাসয়ালাটি পুনর্বিবেচিত হওয়া দরকার। যুক্তি ও বিচক্ষণতার দাবি হচ্ছে, এ নিরেট ইজতিহাদী মাসয়ালার ক্ষেত্রে সংশোধন এনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েকে তাদের বালেগ হওয়ার পর যে কোন অব্স্থায় ‘প্রাপ্তবয়স্কার ক্ষমতা’ প্রয়েগের অধিার দেয়া উচিত। [আমরা এখানে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলের প্রসংগটি আলোচনা করিনি। কারণ বালেগ হওয়ার পরও তার তালাক দেয়ার পথ খোলা রয়েছে।–গ্রন্হকার।]
৪. প্রাপ্তবয়স্কার কর্তৃত্ব প্রয়োগ শর্তসাপেক্ষ
এ প্রসংগেও ফিকহবিদদের আরো একটি ইজতিহাদী মাসয়ালা পর্যালোচনার যোগ্য। পিতা ও দাদা ছাড়া অপরাপর অভিভাবকের বেলায় তাঁদের ফতোয়া হচ্ছে, “তারা যদি তাদের অপ্রাপ্তবয়স্কা কুমারী কন্যার বিবাহ দেয়, তাহলে সে প্রাপ্তবয়স্কার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করার অধিকার রাখে। তবে শর্ত হচ্ছে, বালেগ হওয়ার প্রথম নিদর্শন প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে অবিলম্বে সে তার অসম্মতি প্রকাশ করবে। সে যদি তার প্রথম মাসিক ঋতু প্রকাশ হতেই অনতিবিলম্বে এ অসম্মতির কথা জানিয়ে না দেয়, তাহলে তার এ এখতিয়ার বাতিল হয়ে যাবে”। মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা এ শর্ত কেবল অপ্রাপ্তবয়স্কা কুমারী কন্যার (বাকিরা) ক্ষেত্রে আরোপ করেছেন। সায়্যিবা [স্বামীহারা স্ত্রীলোক। যদি কোন মেয়ে বালেগ হওয়ার পূর্বে পুরুষ সংসর্গ লাভ করে থাকে- চাই তা বিবাহের মাধ্যমে হোক অথবা যেনার মাধ্যমে- সেও সায়্যিবা গণ্য হবে।–গ্রন্হকার।] ও নাবালেগ ছেলের ক্ষেত্রে হুকুম এই যে, বালেগ হওয়ার পর যতক্ষণ সে নিজের সম্মতি প্রকাশ না করবে, তার জন্য বিবাহ বাতিলের অধিকার বহাল থাকবে।
অপ্রাপ্তবয়স্কা বালিকার ক্ষেত্রেএই যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে এর সমর্থন আমরা কুরআন ও হাদীসে পেলাম না। এটাও একটা ইজতিহাদী মাসয়ালা এবং এর মধ্যেও সংশোধন আনা প্রয়োজন। বিবাহ বাতিল করার এখতিয়ার বালেগ হওয়ার সাথে শর্তসাপেক্ষ করার একমাত্র কারণ হচ্ছে- বয়ঃসদ্ধিক্ষণে পৌঁছে মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দের পার্থক্য করার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। সে জ্ঞান-বুদ্ধির সাহায্যে নিজের যাবতীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীল হিসাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বালেগ হওয়ার প্রথম নিদর্শন প্রকাশ পেতেই তার মধ্যে কোন বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয় এবং অবিলম্বেই তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতাও এসে যায়। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেয়া হয় যে, হ্যাঁ, এরূপ পরিবর্তন হয় তাহলে সাইয়্যেবা ও অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকের অবস্থা কুমারী কন্যার অবস্থা থেকে ভিন্নতর হতে পারে না। সুতরাং এ দুজনের ‘প্রাপ্তবয়স্কার এখতিয়ার’কে যখন তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে নিজেদের সম্মতি প্রকাশ না করা পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা হয়েছে, তখন কুমারী কন্যাকে বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট সময় না দেয়ার শেষ পর্যন্ত কি কারণ থাকতে পারে? একজন প্রাপ্তবয়স্কা বিধবা (সায়িবা) ও একজন যুবকের তুলনায় একজন অনভিজ্হ কুমারী কন্যা এ অবকাশ পাওয়ার অধিক হকদার। কেননা এ অসহায় বালিকা তাদের উভয়ের তুলনায় খুবই অনভিজ্ঞ।
৫. দেনমোহন
দেনমোহরের ক্ষেত্রে এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আইনে এর জন্য কোন সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা থেকে জানা যায়, হযরত উমর (রা) তাঁর খেলাফতককালে মোহরানার সর্বোচ্চ সীমা চল্লিশ উকিয়া [চল্লিশ দিরহামে এক উকিয়া।– অনুবাদক।] নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এক মহিলা তাঁর একথায় আপত্তি তুলে বলেন, কুরআনের আয়াতঃ ***************** (তোমরা যদি স্ত্রীদের কাউকে অঢেল সম্পদও দিয়ে থাকো তবে তা থেকে সামান্য পরিমাণও ফেরত নিও না)-এর দৃষ্টিতে আপনার এটা করার কোন অধিকার নেই। কুরআন থেকে তাঁর এ যুক্তি শুনে হযরত উমর (রা) বললেনঃ ************** (একজন মহিলা সঠিক কথা বলেছে, কিন্তু একজন পুরুষ ভুল করেছে।)
অতএব দেনমোহরের পরিমাণ সীমিতকরণের ব্যাপারে যতদূর বলা যায়, আইনে এর কোন সুযোগ নেই। কিন্তু সহীহ হাদীসসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, অধিক পরিমাণ দেনমোহর নির্ধারণ করার জন্য বাড়াবাড়ি করা এবং পুরুষের সামর্থ্যের অদিক দেনমোহর ধার্য করা একটি অপসন্দনীয় কাজ। নবী করীম (স) বলেছেনঃ
**********************************
“তোমরা নারীদেরকে পুরুষদের সাথে বাঁধতে চেষ্টা করো এবং দেনমোহর নির্ধারণের ক্ষেত্রে সীমালঙঘন করো না”।
আবূ আমর আল-আসলামী (রা) এক মহিলাকে দুই শত দিরহাম মোহরানা প্রদানের বিনিময়ে বিাবহ করলেন। নবী স. বললেনঃ
**********************************
“তোমরা যদি নিজেদের নদী-নালায় দিরহাম প্রবাহিত পেতে, তাহলেও হয়ত অধিক মোহরানা দিতে না”।
হযরত আনাস (রা), চার উকিয়ার (১৬০ দিরহাম) বিনিময়ে এক মহিলাকে বিবাহ করলেন। রাসূলুল্লাহ (স) বললেনঃ
**********************************
“মনে হচ্ছে তোমরা এ পাহাড় খুঁড়ে রূপা বের করছো”।
হযরত উমর (র) বলেন, “নারীদের দেনমোহর নির্ধারণের ক্ষেত্রে সীমালংঘন করো না। এটা যদি পার্থিব জীবনে সম্মানের বস্তু হতো এবং আখেরাতের জন্য তাকওযার ব্যাপার হতো, তাহলে রাসূলুল্লাহ (স) এটাকে তোমাদের চেয়ে অধিক বেশী পসন্দ করতেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের মধ্যে কারো মোহরানা বার উকিয়ার অধিক ছিল না”।
একথা তো হলো কেবল অধিক দেনমোহর ধার্য করার ক্ষেত্রে। কিন্তু আমাদের দেশে যে প্রথা প্রচলিত হয়ে গেছে, তা এর চেয়েও ঘৃণ্য। এখানে হাজার হাজার, লাখ লাখ টাকার বাকী মোহরানা বিবাদের দলীলে লিখে নেয়া হয়। কিন্তু এ বিরাট অংকের অর্থ তাদের পক্ষে আদায় করাও সম্বব হয় না, আর তা ধার্য করার সময় এটা আদায় করার নিয়্যতে লেখাও হয় না। এ প্রথা নিকৃষ্টতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে বিবাহের জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দেখা দেয়। নবী করীম (স) বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছেনঃ
**********************************
“যে ব্যক্তি মোহরানার বিনিময়ে কোন নারীকে বিবাহ করলো এবং তা পরিশোধ না করার নিয়্যত রাখলো- সে যেনাকার, ব্যভিচারী। আর যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করলো, কিন্তু তা পরিশোধ না করার ইচ্ছা রাখলো- সে চোর”।– কানযুল উম্মাল।[এ হাদীস থেকে মোহরানা আদায় করার যে গুরুত্ব প্রকাশ পাচ্ছে, তা সবার কাছে পরিষ্কার। যেসব লোক দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নিজেদের আর্থিক সামর্থ্যের অধিক পরিমাণ মোহরানা নির্ধারণ করেছেন, আমি তাদেরকে উল্লিখিত হাদীসের ভিত্তিতে এ পরামর্শ দিব যে, তারা যেন নিজেদের স্ত্রীদের নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী মোহরানা গ্রহন করার জন্য রাজী করারন, যা তারা একবারে অথবা কিস্তিতে কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারবেন। সৎকর্মশলী মহিলাদেরও আমি পরামর্শ দিতে চাই যে, তারা যেন এ হ্রাসৃত পরিমাণ মোহরানা গ্রহণ করত রাজী হয়ে যান। অনন্তর প্রত্যেক আল্লাহভীরু মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে- যত শীঘ্র সম্ভব এ মোহরানার বোঝা থেকে মুক্ত হওয়া। মোহরানা হচ্ছে এক প্রকার ঋণ। বুঝেঘুনে অথবা বেপরোয়াভাবে নিজের ওপর ঋণ রেখে মারা যাওয়া এতই ঘৃণ্য ব্যাপার যে, নবী করীম (স) এ ধরনের লোকদের জানাযা পড়তে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।–গ্রন্হকার।
স্ত্রীর প্রাপ্য মোহরানা স্বামীর জন্য এক প্রকার দেনা। তাই বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে এর বিকল্প পরিভাষা হচ্ছে দেনমোহর।-অনুবাদক]
এটা হচ্ছে উল্লিখিত ধরনের মোহরানার অভ্যন্তরীণ দোষ বা অনিষ্ট। প্রকাশ্য ক্ষতিও এর চেয়ে কম মারাত্মক নয়। এ ধরনের মোহরানা নির্ধারণ করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে- স্বামী যেন স্ত্রীকে তালাক দিতে না পারে। কিন্তু এর পরিণতি হচ্ছে এই যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি বিভেদ দেখা দেয় এবং উভয়ের একত্রে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন মোহরানার এ বাড়াবাড়ি নারীদের জীবনের জন্য মুসীবত হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী শুধু মোহরানার মোকদ্দমার ভয়ে তালাক দেয় না এবং স্ত্রী বেচারী বছরের পর বছর বরং সারাটা জীবন বিড়ম্বনাপূর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকে। আজকাল যেসব জিনিস নারীদের সচরাচর বিপদের মধ্যে ফেলে রেখেছে, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে এ মোহরানার আধিক্য। যদি ন্যায়-ইনসাফের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ মোহরানা নির্ধারণ করা হয়, তাহলে প্রায় শতকরা পঁচাত্তর ভাগ সমস্যা জটিল আকার ধারণ করার আগেই সমাধান হয়ে যাবে।
আমাদের মতে এর সংশোধনের জন্য ইসলামী শরীয়তের বিরোধিতা না করে এ পন্হা অবলম্বন করা যায় যে, যদি মোহরে মু’আজ্জাল (********) [যে মোহরানা তৎক্ষণাৎ নগদ আদায় করতে হয়।–গ্রন্হকার।] হয়ে থাকে, তাহলে উভয় পক্ষ কোন সীমা ছাড়াই যতদূর চায় নির্ধারণ করে নিতে পারে। কিন্তু যদি মোহরে মুআজ্জাল (**********) [যে মোহরানা কিছুকাল পরেও আদায় করা যায়।–গ্রন্হকার।] হয়ে থাকে, তাহলে তার চুক্তিপত্র যথারীতি স্ট্যম্পের ওপর লেখা বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে এবং মেহরপত্রের ওপর শতকরা পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্প লাগাতে হবে। স্ট্যাম্পবিহীন অথবা শতকরা পঞ্জাশ ভাগ কম মূল্যের স্ট্যাম্পের লিখিত কোন মোহরানার চুক্তিপত্র দাবি পেশের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হবে না। যদি এ রকম আইন তৈরি করে দেয়া যায়, তাহলে মোহরে মুআজ্জালেরও আপাদমস্তক ক্রুটিপূর্ণ এ পদ্ধতি সহজেই বন্ধ হয়ে যাবে। তখন লোকেরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী মোহরানা নির্ধারণ করতে বাধ্য হবে এবং টকা-পয়সার অপব্যয় করার পরিবর্তে নগদ অর্থে ধন-সম্পদ ও জায়গা-জমির আকারে বিবাহের সময়ই মোহরানা আদায় করবে। অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেলে তো এ শর্ত পরিত্যাগও করা যেতে পারে।
৬. স্ত্রীর ভরণ-পোষণ
এ অনুচ্ছেদে ঝগড়ার দুটি দিক রয়েছে। এক. স্বামী স্ত্রীর খোরপোশ ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করার সামর্থ্য রাখে, কিন্তু তা করে না। দুই. ভরণ-পোষণের ব্যবস্থাা করার সামর্থ্য তার নেই।
প্রথম অবস্থার ক্ষেত্রে কাযী সকল সম্ভাব্য পন্হায় তাকে স্ত্রীর খোরপোশ দিতে বাধ্য করতে পারেন- এ ব্যাপারে সকল আইনবিদ একমত। কিন্তু সে যদি কাযীর নির্দেশ পালন না করে, তাহলে এ অবস্থায় কি করা উচিত তা নিয়ে আইনজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হানাফী মাযহাবের আইনবিদের মতে এ অবস্থায় কিছুই করার নেই। স্ত্রীলোকটি তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে- চাই তা স্বামীর নামে ঋণ নিয়ে হোক অথবা কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে হোক অথবা নিজের কোন শুভাকাঙ্ক্ষীর সাহায্যে হোক।
পক্ষান্তরে মালিকী মাযহাবের আইনবিদদের মত হচ্ছে- এ অবস্থায় তালাক সংঘটিত করে দেয়ার অধিকার স্বয়ং কাযীর রয়েছে। একদল হানাফী আলেম মালিকী মাযহাবের এ ফতোয়া গ্রহণ করা পসন্দ করেছেন। তবে তাঁরা এর সাথে যে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন তা হচ্ছে- স্ত্রীলোকটি যদি নিজের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে অক্ষম হয়ে থাকে অথবা সে নিজের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে সক্ষম, কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে পৃথক থাকলে তার পাপ কাজে জাড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে।
কিন্তু এ শর্ত মোটেই সঠিক মনে হয় না। কুরআন মজীদের দৃষ্টিকোণ থেকেক খোরপোশ পাওয়াটা স্ত্রীর অধিককার। এর বিনিময়েই তার ওপর স্বামীর দাম্পত্য অধিকার অর্জিত হয়। যখন কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এ অধিকার পূরণ করতে অস্বীকার করে, তখন স্ত্রীলোকটিকে জোরপূর্বক তার বিবাহাধীনে বন্দী হয়ে থাকতে বাধ্য করার কোন যুক্তিসংঘত কারণ নেই। কোন জিনিস নিয়ে তার বিনিময় দিতে এবং কোন মাল নিয়ে তার মূল্য পরিশোধ করতে যে ব্যক্তি অস্বীকার করে, সে ব্যক্তি কেমন করে শেষ পর্যন্ত এ জিনিস এবং মারের অধিকারী হয়ে থাকতে পারে? কোন স্ত্রীলোক যতক্ষণ কোন পুরুষের বিবাহাধীন থাকবে, তার ব্যয়ভার বহন করার দায়িত্ব স্বামীর উপরই থাকবে। এ অবস্থায় স্ত্রী নিজে রুজি-রোজগার করার অথবা নিজের আত্মীয়-স্বজনের উপর বোঝা হওযা অথবা এক যালেক স্বামীর নামে ঋণ পাওয়ার অযৌক্তিক চেষ্টা করার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত কি ধরনের ইনসাফের ভিত্তিতে তার ওপর চাপানো হবে?
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আবার হানাফী ফিকহবিদদের মত হচ্ছে- স্ত্রীলোকটিকে ধৈর্যধারণ ও সাওয়াবের আশা করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে এবং তাকে বলা হবেঃ ধারকর্জ করে অথবা শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্য নিয়ে দিন কাটাও। ইমাম আযম (র)-এর মতে অবিবাহিত অবস্থায় এ ধরনের মেয়েদের ব্যয়ভার যারা বনহ করতো, এ ক্ষেত্রেও তার ভারণ-পোষণের দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে। কিন্তু ইমাম মারিক, ইমাম শাফিঈ ও আমহাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর মাযহাব এই যে, স্ত্রীলোকটি যদি এ ধরনের স্বামীর সাথে বসবাস করতে না পারে এবং বিবাহ বিচ্ছেদের দাবি করে তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দেয়া হবে। ইমাম মালিক (র)-এর মতে স্বামীকে এক. দুই অথবা তিন মাসের কিংবা একটা যুক্তিসংগত মেয়াদ পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হবে। ইমাম শাফিঈ (র) মাত্র তিন দিনের অবকাশ অনুমোদন করেছেন। ইমাম আহমাদ (র)-এর ফতোয়া এই যে, অবিলম্বে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দিতে হবে।
এক্ষেত্রে কুরআন মজীদের যে মূলনীতি ****************** আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, তা-ই শুধু তিন ইমামের সমর্থনই করে না, বরং হাদীস ও সাহাবাদের কার্যাবলীও তাঁদের এ মতের সমর্থন করে। দারা কুতনী ও বায়হাকী গ্রন্হদ্বয়ে নবী করীম (স) একটি ফায়সালা উদ্ধৃত হয়েছে, “খোরপোশ না দেয়ার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দেয়া হবে”। হযরত আলী (রা) হযরত উমর (রা), হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকেও একথা বর্ণিত হয়েছে। তাবিঈদের মধ্যে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যবের ফতোয়াও তাই। হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র)-এ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করার পর উপরোক্ত ফতোয়া অনুযায়ী কাজ করেছেন। পক্ষান্তরে হানাফীদের দলীল হচ্ছে এ আয়াতঃ
**********************************
“আর যাকে কম রিযিক দেয়া হয়েছে, সে তাকে আল্লাহ যতটুকু দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যত দিয়েছেন তার অধিক ব্যয় করার দায়িত্ব তার ওপর চাপান না”।–সূরা আত তালাকঃ ৭
কিন্তু এ আয়াতের দ্বারা কেবল এতটুকুই প্রমাণিত হয় যে, খোরপোশের জন্য শরীয়তের কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়নি, বরং খোরপোশ দানকারীদের সামর্থ্যের ওপর তার পরিমাণ নির্ভর করে। উল্লিখিত আয়াতের অর্থ এই নয় যে, যেখানে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করার মত সামর্থ্যই বর্তমান নেই, সেখানে স্ত্রীলোকটিকে ভরণ-পোষণ ছাড়াই জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হবে। নিসন্দেহে এটা চরম সংকল্পের ব্যাপার। যে কোন মহিলা বিপদাপদ ও উপোস সহ্য করেও স্বামীর সাথে বসবাস করতে সম্মত থাকে। ইসলাম এ ধরনের প্রতিজ্ঞা করারই শিক্ষা দেয় এবং একজন সম্ভ্রান্ত মহিলার এরূপ বৈশিষ্ট্যই হওয়া উচিত। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা এক জিনিস, আর আইনগত অধিকার আরেক জিনিস। খোরপোশ পাওয়াটা স্ত্রীর আইনগত অধিকার। সে যদি স্বেচ্ছায় ও সন্তোষ সহকারে এ অধিকার ছেড়ে দেয় এবং খোরপোশ ছাড়াই স্বামীর সহযোগিতা করার পসন্দ করে, তাহলে এটা খুবই প্রশংসার ব্যাপার। কিন্তু সে যদি তার এ অধিকার পরিত্যাগ করতে না চায় অথবা পরিত্যাগ করতে না পারে, তবুও তাকে কষ্ট দিয়ে এবং জোরপূর্বক চরম সংকল্পের উচ্চতর স্থানে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে হবে- ইসলামী আইনের আদল ও ইনসাফের মধ্যে এরূপ করার কোন অবকাশ নেই।
অতএব আমাদের মতে এ মাসয়ালার ক্ষেত্রে সব মাযহাবের মধ্যে ইমাম মারিক (র)-এর মাযহাবই সবচেয়ে উত্তম। এ মাযহাব স্বামীকে একটা যুক্তিসংগত মেয়াদ পর্যন্ত অবকাশ দেয়ার পর বিবাহ-বিচ্ছেদের নির্দেশ দেয়।
৭. অবৈধভাবে নির্যাতন করা
কুরআনের আয়াতঃ
**********************************
“আর তোমরা যেসব নারীর অবাধ্যতার আশংকা ক রবে, তাদের বুঝতে চেষ্টা করো, বিছানায় তাদের থেকে দূরে থাকো এবং প্রহার করো। অতপর তারা যদি তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তাহলে তাদের ওপর নির্যাতন করার অজুহাত তালাশ করো না”।– সূরা আন নিসাঃ ৩৪
এ আয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন বৈধ কারণ ছাড়া নিজের স্ত্রীর ওপর কোন প্রকার কঠোরতা বা নির্যাতন করার অধিকার স্বামীর নেই, চাই তা দৈহিক অথবা মৌখিক নির্যাতন হোক না কেন। যদি সে তা করে তবে স্ত্রীর আইনের আশ্রয় নেবার অধিকার আছে। এ ব্যাপারে আমরা কোন বিস্তারিত নির্দেশ জানতে পারিনি। কিন্তু আমরা মনে করি ইসলামী আইনের মূলনীতির মধ্যে এতটুকু সযোগ রয়েছে যে, এ ধরনের নির্যাতন থেকে নারীকে হেফাযত করার এবং অসহনীয় নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর ক্ষমতা কাযীকে দেয়া যেতে পারে। আজকাল আমরা দেখছি, বিভিন্ন স্তরে নারীদের সাথে অন্যায় আচরণ করার একটা সাধারণ রীতি চালু হয়ে পড়েছে। ‘স্বামীত্বে’র অর্থ মনে করা হচ্ছে যুলুম-নির্যাতন ও জোর-জবরদস্তি করার সীমাহীন অবাধ লাইসেন্স। এ প্রবণতার প্রতিরোধের জন্য আইনের নতুন ধারা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরী। আর কিছু না হলেও অন্তত এতটুকু হওয়া একান্ত প্রয়োজন যে, মারপিট ও গালি-গালাজের অভ্যাসকে খোলা দাবি করার বৈধ কারণসমূহের মধ্যে গণ্য করতে হবে। কোন স্বামীর বিরুদ্ধে যদি এ ধরনের বদ অভ্যাস প্রমাণিত হয় তাহলে তার স্ত্রীকে কোন বিনিময় ছাড়াই খোলার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
৮. সালিস নিয়োগ
এ ক্ষেত্রে হযরত আল (রা) যে পন্হা অবলম্বন করেছেন তা আমাদেরকে সঠিক পথ দেখায়। কাশফুল গুম্মাহ গ্রন্হে উল্লেখ আছে, এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর মোকদ্দমা তাঁর দরবারে পেশ করা হলে তিনি কুরআন শরীফের আয়াত **************** -এর নির্দেশ অনুযায়ী আদেশ দিলেন, “উভয়ে নিজ নিজ পক্ষ থেকে একজন করে সালিস মানবে”। অতপর তিনি সালিসদ্বয়কে সম্বোধন করে বলেন, “তোমাদের কাজ হলো- যদি তোমরা উভয়ের মধ্যে মিলমিশ করে দেয়া উপযুক্ত মনে করো তবে তাই করবে”। অতপর তিনি স্ত্রীলোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি এ সালিসদ্বয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজী আছ?” সে বললো, “হ্যাঁ, রাজী আছি”। অতপর তিনি পুরুষ লোকটিকে একই কথা জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল, “তারা যদি আমাদের উভয়ের মাঝে আপোষ করে দেয়া তাহলে আমি তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেব। আর যদি তারা পৃথক করে দেয় তবে আমি তা মানবো না”। একথার প্রেক্ষিতে তিনি বললেনঃ
**********************************
“তোমার এ অধিকার নেই। তুমি ঐ মহিলার মত যতক্ষণ নিজের সম্মতি প্রকাশ না করবে, এ স্তান থেকে এক কদমও নড়তে পারবে না”।
স্বামী-স্ত্রীর এ ধরনের পারিবারিক ঝগড়ার ক্ষেত্রে যা বৃহত্তর ও গুরুত্বপূর্ণ আইনগত বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়-মীমাংসার এ পদ্ধতি গ্রহণ করা সবচেয়ে উত্তম। এ সম্পর্কে আইনের মধ্যে এমন কতকগুলো ধারা সংযোজন করা প্রয়োজন, যার মধ্যে সালিসীল পন্হা, সালিসদের ক্ষমতা, তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পন্হা এবং মতভেদের ক্ষত্রে বিচারালয়ের কর্মপন্তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকবে। ইসলামী আইনের মধ্যে এটা একটা খুবই মূল্যবান ব্যবস্থা যে, পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদকে যতদূর সম্ভব প্রকাশ্য আদালতে উত্থাপন করা থেকে বিরত থাকা উচিত। এ ধরনের বিবা যদি আদালতে এসেই যায়, তাহলে বিচারক এ সম্পর্কে অনুসন্ধান ও ফায়সালা করার পূর্বে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ সমস্যার সমাধানের জন্য সাহায্য গ্রহণ করবেন। এ প্রস্তাবকে সামাজিক জীবনের জন্য একটি রহমত মনে করা উচিত।
৯. দোষ প্রমাণে বিবাহ রদ (ফাদখ) করার ক্ষমতা [‘খিয়ারে ফাসখ’ অর্থাৎ বিবাহ হয়ে যাওয়ার পর একথা বলার ক্ষমতা,’ এ বিবাহ আমার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়’।–গ্রন্হকার।]
স্বামী-স্ত্রীর দোষ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ফিকহবিদদের মধ্যে প্রচুর মতবিরোধ রয়েছে। একদলের মত হচ্ছে- পুরুষ অথবা স্ত্রীর কারো দোষের ভিত্তিতে অপর পক্ষের বিবাহ বাতিল করার ক্ষমতা নেই। অতএব দুররুল মুখতার গ্রন্হে আছেঃ
**********************************
“স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের একজন অপরজনের ক্রটির কারণে বিবাহ বাতিল করার এখতিয়ার রাখে না, চাই তা যত মারাত্মক ক্রটিই হোক না কেন। যেমন উন্মাদনা, ধবল, কুষ্ঠরোগ, পায়খানা-পেশাবের স্থান সংযোজিত ইত্যাদি”।
সাহাবাদের মধ্যে হযরত আলী (রা) ও ইবনে মাসউদ (রা) এবং মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে আতা, নাখঈ, উমর ইবনে আবদুল আযীয, ইবনে আবী লাইলা, আওযায়ী, সাওরী, আবু হানীফা এবং আবু ইউসুফ (র) প্রমুখের এই মত।
দ্বিতীয় দলের মত হচ্ছে, যেসব ক্রটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিবদ্ধনস্বরূপ এর যে কোন ক্রটির কারণে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের বিবাহ বাতিল করার এখতিয়ার রয়েছে। যেমন উন্মাদনা, ধবরল, কুষ্টরোগ, দুর্গন্ধযুক্ত মুখ, বিভিন্ন প্রকার ঘৃণিত রোগ এবং যৌনাঙ্গে এমন ধরনের ক্রটি যা সহবাসে বিঘ্ন ঘটায়। এটা হচ্ছে ইমাম মালিক (র)-এর মাযহাব। অতএব মুহাম্মদ ইবনুল জাযঈ (আল-কালবী আল-গারনাতী, ১১৯৩- ১৩৪০ খৃ.)- ‘আল কাওয়ানীনুল ফিকহিয়্যা’ গ্রন্হে উল্লিখিত দোষগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলেনঃ
**********************************
“যদি এ ক্রটিগুলোর মধ্যে কোন একটি ক্রটি পুরুষ বা স্ত্রীর মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে তার সাথে থাকা বা পৃথক হয়ে যাওয়ার অধিকার অপরজনের রয়েছে”।
ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতে উন্মাদনা, শ্বেত ও কুষ্ঠরোগের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই বিবাহ বাতিল করার এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু লজ্জাস্থানের ক্ষত, যা থেকে সবসময় ক্ষরণ হয়, মুখের দুর্গদ্ধ, পাঁচড়া ইত্যাদি রোগে বিবাহ বাতিলের এখতিয়ার নেই। অবশ্য যদি স্ত্রীলোকদের দেহের অভ্যন্তরে এমন রোগ থেকে থাকে যা সহবাসে বিঘ্ন ঘটায় অথবা পুরুষ লোকটি যদি নপুংসক অথবা কর্তিত-লিঙ্গ হয়ে থাকে তবে এ অবস্থায় অপর পক্ষের বিবাহ বাতিল করার এখতিয়ার রয়েছে।
ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর মতে স্ত্রীর কোন শারীরিক ক্রটির ভিত্তিতে বিবাহ বাতিল করার এখতিয়ার স্বামীর নেই। কিন্তু স্বামীর উন্মাদনা, শ্বেত, কুষ্টরোগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্ত্রীর বিবাহ বাতিল করার এখতিয়ার রয়েছে।
উল্লিখিত মাযহাবগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় মাযহাবই কুরআন মজীদের শিক্ষার কাছাকাছি। কুরআনের দৃষ্টিতে পুরুস ও স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে দুটি জিনিসই উদ্দেশ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এক, চরিত্র ও নৈতিকতার হেফাযত; দুই. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি। উল্লিখিত দোষ-ক্রটির বিদ্যমানতার এ দুটি উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। এর ফলে স্বামী-স্ত্রী স্বভাবতই একে অপরকে ঘৃণা করতে বাধ্য হয় অথবা একে অপরের প্রকৃতিগত চাহিদা পূরণ করতে পারে না। আমরা যেমন প্রথমে বর্ননা করে এসেছি- এটা ইসলামের দাম্পত্য আইনের মূলনীতির অন্তরভুক্ত যে, দাম্পত্য সম্পর্ক যেন স্বামী-স্ত্রীর জন্য ক্ষতিকর এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা লংঘনের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। উল্লিখিত দোষ-ক্রটির কারণে বিবাহ বাতিল করার ক্ষমতা প্রয়োগ করার ব্যবস্থা না রাখলে এ নীতিমালা ব্যাহত হয়ে যায়। ওপরে যেসব রোগের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো সবই ক্ষতিকারক এবং এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর কোন একজনের ঘৃণার কারণে অথবা নিজের যৌন চাহিদা পূরণ না হওয়ার কারণে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা লংঘন করার আশংকা রয়েছে। এজন্য উল্লিখিত ধরনের যাবতীয় রোগ ও দোষ-ক্রটির কারণে স্বামী-স্ত্রীর জন্য বিাহ বাতিল করার এখতিয়ার সংরক্ষিত থাকা উচিত।
এতো হলো স্বামী-স্ত্রীর বিবাহের পূর্বে পরস্পরের অবস্থা সম্পর্কে অবগত না থাকার এবং পরে তা জানার সাথে সাথে নিজের অসম্মতির কথা প্রকাশ করে দেয়ার ক্ষেত্রে এখতিয়ার প্রয়োগের প্রসংগ। কিন্তু যে ক্ষেত্রে বিবাহের পূর্বে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের অবস্থা অবহিত ছিল এবং তারা জেনেশুনেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে অথবা তাদের জানা ছিল না, কিন্তু পরে জানার পরও বিবাহ বাতিল করার এখতিয়ার প্রয়োগ করেনি অথবা বিবাহের পর এসব ক্রটি দেকা দিয়েছে- এসব অবস্থায় পুরুষের কাছে তো এমন একটি উপায় বর্তমান রয়েছে যার মাধ্যমে সে যে কোন সময় কাজ সমাধা করতে পারে অর্থাৎ তালাক। এছাড়া তার কাছে আরো একটি উপায় মওজুদ রয়েছে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহ। কিন্তু নারীদের ব্যাপারে কোন কোন ক্ষেত্রে ফিকহবিদগণ কোন উপায় বিবেচনা করেননি এবং কোন ক্ষেত্রে কেউ তাদের মুক্তি পাওয়ার পন্তা বের করেছেন, আাবর কেউ বের করেননি। এ প্রসংগে যেসব ফতোয়া রয়েছে তা আমরা পৃথক পৃথকভাবে বর্ণনা করে তার পর্যালোচনা করবো।
১০. নপুংসক, লিঙ্গ কর্তিত ইত্যাদি
স্বামী যদি কর্তিত লিঙ্গ হয় তাহলে স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের দাবি তোলার অধিকার রয়েছে এবং ব্যাপারটি তদ্ন্ত করার পর অনতিবিলম্বে বিচ্ছেদ করিয়ে দিতে হবে। এ ব্যাপারে প্রায় সব ফিকহবিদই ঐকমত্য পোষন করেন।
স্বামী যদি নপুংসক হয় এবং স্ত্রী যদি বিচ্ছেদ দাবি করে তাহলে হযরত উমর (রা)-এর ফায়সালার ভিত্তিতে তাকে চিকিৎসার জন্য এক বচরের সময় দিতে হবে। এরপরও যদি সে সংগমে সক্ষম না হয় তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দিতে হবে। কিন্তু ফিকহবিদগণ এর সাথে নিম্নলিখিত শর্তগুলো জুড়ে দিয়েছেনঃ
১. স্ত্রী যদি বিবাহের পূর্বেই তার পুরুষত্বহীনতার কথা না জেনে থাকে কেবল তখনই এ হুকুম কার্যকর হবে। কিন্তু সে যদি পূর্ব থেকে তার এ অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকে এবং স্বেচ্ছায় তার সাথে বিবাহ বসে তাহলে বিচ্ছেদের দাবি তোলার অধিকার তার নেই।
২. স্ত্রীর যদি বিবাহের পূর্বে এটা জানা না থাকে, কিন্তু পরে জানার পরও সে তার বিবাহাধীনে থাকার জন্য প্রকাশ্যভাবে সম্মতি জ্ঞান পরে- তাহলে তার বিবাহ বাতিলের দাবি তোলার অধিকার অবশিষ্ট থাকবে না।
৩. স্বামী যদি একবারও সংগম করতে সক্ষম না হয়ে থাকে এবং কেবল তখনই বিচ্ছেদ করিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় সে যদি একবারও সংগম করতে সক্ষম হয়, চাই তা কোন রকমেই হোক না কেন, তাহলেও স্ত্রী বিচ্ছেদের দাবি তোলার অধিকার রাখে না।
উল্লিখিত শর্তগুলোর কোন একটির পক্ষেও কুরআন ও হাদীসের কোন প্রমাণ বর্তমান নেই এবং আমরা শর্ত তিনটিকে সঠিক মনে করি না। যদি কোন নারী ইচ্ছাকৃতভাবে আহাম্মাকী করে কোন ব্যক্তিকে নপুংসক জানা সত্ত্বেও তার কাছে বিবাহ বসে, তাহলে তার জন্য এ শাস্তি যুক্তিসংগত ও উপযোগ হতে পারে না, তাকে সমস্ত জীবন পুরষত্বহীন এক স্বামীর সাথে কাটাকে বাধ্য করা হবে। এতে যে কি ধরনের বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে তা এতটা সুস্পষ্ট যে, এটা বর্ণনা করার অপেক্ষা রাখে না। এ ধরনের বেকুফ নারীর জন্য এতটুকু শাস্তিই যথ্টে যে, তাকে মোহরানা থেকে বঞ্চিত করে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দিতে হবে।
বিবাহের পর যদি স্ত্রী জানতে পারে যে, তার স্বামী নপুংসক এবং প্রথম দিকে সে তার সাথে বসবাস করতে রাজী হয়ে থাকে- তাহলে এটা এমন কোন মারাত্মক অপরাধ নয় যে, সারা জীবন তাকে এক অসহনীয় অবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হবে। একটি অনভিজ্ঞ মেয়ে প্রথমে এ প্রকৃতিগত দুরবস্থার কথা অনুমান করতে পারে না, এক নপুংসকের স্ত্রী যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। হতে পারে সে তার সৎ স্বভাবের কারণে এ ধারণা করেছে যে, স্বামী যদি নপুংসক হয় তাতে কি আছে? আমি এভাবেই তার সাথে জীবনটা কাটিয়ে দিব। কিন্তু পরে সে এমন এক অসহনীয় কষ্টের সম্মুখীন হলো, যে সম্পর্কে প্রথমে তার কোন ধারণাই ছিল না। সে তার স্বাস্থ্যের অবনতি অথবা পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে অস্থির হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের আকাঙ্ক্ষা করলো। এ অবস্থায় এটা কি জায়েয হবে যে, তার প্রথম দিককার সম্মতিকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করে তার মুখ বন্ধ করে দেয়া হবে এবং তাকে বলা হবে, তুমি প্রথমেই যে বুর করেছ তার শাস্তি এই যে, এখন তুমি মাথা ঠুকে মরো অথবা নিজের মান-ইজ্জতকে জলাঞ্জলি দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করো। আমরা যতদূর চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, এটা কুরআন মজীদের শিক্ষার পরিপন্হী। এর পরিণতিতে এমনসব অনিষ্ট সৃষ্টি হওয়ার আশংকা রয়েছে যা এ নারীর নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমাজেও ছড়িয়ে পড়বে এবং ভবিষ্যত বংশধরের মধ্যেও স্থানান্তরিত হবে। এতবড় ক্ষতি স্বীকার করার পরিবর্তে একজন পুরুষ লোকের ক্ষতি স্বীকার করাই ভলো। মূলত বিবাহ বিচ্ছেদেও তার কোন ক্ষতি হবে না। স্ত্রীলোকটির ভূলের জন্য যদি তাকে শাস্তি দিতে হয় তবে সর্বাধিকক এতটুকু দেয়া যেতে পারে যে, তাকে পুরো মোহরানা অথবা এর অংশবিশেষ থেকে বঞ্চিত করা যায়। আমার মতে এটাও বাড়াবাড়ির মধ্যে শামিল। কেননা যে ব্যক্তি নপুংসক হওয়া সত্ত্বেও বিবাহ করেছে- শাস্তি তো তারই হওয়া উচিত।
তৃতীয় শর্তটিও আমার ধারণায় অত্যন্ত কঠোর। বিবাহ ব্যবস্থার মধ্যে শরীয়তের যে উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে তা এ দরনের দাম্পত্য সম্পর্কের মাধ্যমে কখনো পূর্ণ হতে পারে না। ইসলামের আইন কোন আসমাণী জীবনের জন্য নয়, বরং সর্বসাধারণের জন্যই। সর্বসাধারণের মধ্যে যেসব মহিলাকে দেখতে পাওয়া যায় তাদের জন্য যদি এটা অসম্ভব নাও হয়, তবে চরম কঠিন তো বটেই যে,একবার অথবা দু-চারবার স্বামীর সাথে যৌনতৃপ্তি লাভ করাই তার জন্য যথেষ্ট হবে। এরপর সারাটা জীবন সে এ সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে হাসি-খুশিতে কাটিয়ে দিবে এবং ইজ্জত-আব্রুকে যে কোন ধরনের বিপদ থেকে নিরাপদ রাখবে। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, শতককরা পঞ্চাশজন নারী এরূপ ধৈর্য ধারণ করতে সক্ষম, কিন্তু তবুও অবশিষ্ট পঞ্চাশ ভাগ নারীর কি করুণ অবসথা হবে- যাদের ধৈর্য, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও নিষ্কলূষ চরিত্রের মান এতটা উন্নত নয়? তাদের পাপ কাজে জড়িয়ে পড়া এবং সমাজে তাদের কারণে নানা রকম দুষ্কৃতি ছড়িয়ে পড়ার দায়দায়িত্ব কি এ আইনের ওপর বর্তাবে না, যা তাদের জন্য হালালের পথ বন্ধ করে তাদেরকে হারামের পথেচলতে বাধ্য করেছে?
অতএব আমদের মতে সংগমে অক্ষমতাজনিত যে কোন ক্রটির বিরুদ্ধে, চাই তা বিবাহের পূর্ব থেকেই বর্তমান থাকুক অথবা বিবাহের পরেই হোক, স্ত্রীর জন্য আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার থাকা উচিত। এক বছরের সময়সীমার মধ্যে যথার্থ পরিমাণ চিকিৎসা করানোর পরও যদি এ ক্রটি দূর না হয় তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দেয়া উচিত।
ফিকহবিদগণ বলেছেন, ‘এক বছর চিকিৎসা গ্রহণ করার পরও স্বামী যদি একবারও সংগশ করতে সক্ষম হয়, চাই তা কোন রকমেই হোক না কেন, স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের দাবি তোলার অধিকার চিরদিনের জন্য বাতিল হয়ে যাবে’। এর মধ্যেও অনর্থক কঠোরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের মতামতের ওপর নির্ভর করাই সবচেয়ে উত্তম। চিকিৎসার পরও যদি বিশেষজ্ঞের মত এই হয় যে, সে স্ত্রী সহবাস করতে পূর্ণরূপে সক্ষম হয়নি, তাহলে বিবাহ ভেঙে দেয়া উচিত।
ফিকাহবিদগণ নপুংসকের জন্য যে বিধান রেখেছেন, অণ্ডকোষ-কর্তিত ব্যক্তির জন্যও একই আইন রেখেছেন। অর্থাৎ তাকেও চিকিৎসা গ্রহণের জন্য এক বছরের সময় দিতে হবে। এর কারণস্বরূপ বলা হয়েছে যে, তার সহবাসে সক্ষম হওয়ার আশা করা যেতে পারে। কিন্তু যেখানে ডাক্তারী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুসন্ধানে প্রমানিত হয়েছে, এক্ষেত্রে অণ্ডকোষ কর্তিত ব্যক্তি ও লিঙ্গ কর্তিত ব্যক্তির মধ্যে কোন পর্থক্য নেই, পরুষ চাই লিঙ্গ কর্তিত হোক অথবা অণ্ডকোষ কর্তিত, উভয় অব্স্থায়ই সে সংগম করতে সমানভাবেই অক্ষম। কোন চিকিৎসাই তার এ হারানো ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে পারে না। অতএব অণ্ডকোষ কর্তিত ব্যক্তি এবং লিঙ্গ কর্তিত ব্যক্তির জন্য একই আইন হওয়া উচিত।
১১. উন্মাদ বা পাগল
উন্মাদ ব্যক্তি সম্পর্কে হযরত উমর (রা)-এর সিদ্ধান্ত এই যে, তার চিকিৎসার জন্য এক বঝর সময় নির্দিষ্ট করতে হবে। এ সময়-সীমার মধ্যে সে যদি সুস্থ না হয় তাহলে তার স্ত্রীকে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করিয়ে দিতে হবে। ফিকহবিদগণও এ মত প্রকাশ করেছেন এবং বিভিন্ন পন্হায় প্রাসংগিক ক্ষেত্রে এ নির্দেশই বলবৎ রেখেছেন।
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে যে ব্যক্তি বিবাহের পূর্ব থেকেই পাগল ছিল এবং সে বিবাহের পর সহবাস করতে সক্ষম হয়নি, কেবল তার বেলায় এ হুকুম প্রযোজ্য হবে। এ দিক থেকে চিন্তা করলে মনে হয় সেও যেন নপুংসক এবং এজন্য তাকে এক বছরের অবকাশ দেয়া হচ্ছে।
ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর মতে যদি মাঝে মাঝে পাগলামি দেখা দেয় তাহলে তাকে চিকিৎসার জন্য এক বছরের সময় দেয়া হবে। আর তা যদি স্থায়ী হয় তাহলে সে লিঙ্গ কর্তিত ব্যক্তির হুকুমের আওতায় পড়বে এবং কোন সময়-সুযোগ না দিয়েই বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দিতে হবে।
ইমাম মালিক (র)-এর মতে স্থায়ী পাগল ও অস্থায়ী পাগল- উভয়ের ক্ষেত্রেই চিকিৎসার জন্য এক বচরেরর সময় দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যে সে যদি সুস্থ না হয় তাহলে বিবাহ বেঙে দিতে হবে। কিন্তু এর সাথে মালিকী মাযহাবের ফিকহবিদগণ নিম্নলিখিত শর্তগুলো জুড়ে দিয়েছেনঃ
১. যদি বিবাদের পূর্ব থেকেই উন্নাদ হয়ে থাকে এবং স্ত্রীলোকটি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে তার কাছে বিবাহ বসেছে- এ ক্ষেত্রে সে বিবাহ বিচ্ছেদের দাবি করতে পারে না।
২. বিবাহের পর যদি সে জানতে পারে যে, তার স্বামী পাগল এবং তার সাথে বসবাস করার সম্মতি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে থাকে তাহলে বিচ্ছেদের অধিকার তার থাকবে না।
৩. বিবাহের পর যদি উন্মাদনা দেখা দেয়, তাহলে স্ত্রীর কেবল তখনই বিচ্ছেদের দাবি তুলতে পারে যদি সে তার স্বামীর পাগলামি দেখা দেয়ার পর তার সাথে বসবাস করার সম্মতি প্রকাশ্যভাবে ব্যক্ত করে না থাকে এবং নিজের ইচ্ছা ও সম্মতিতে তাকে সহবাসের সুযোগ না দিয়ে থাকে।
এসব শর্তের ধরন ঠিক নপুংসকের অধ্যায়ে বর্ণিত শর্তের অনুরূপ। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে এর কোন উৎস নেই এবং এসব শর্তের বিরুদ্দে আমাদের ঠিক একই অভিযোগ রয়েছে। কোন স্ত্রীলোককে জোরপর্বক একটি পাগলের বিবাহ বন্ধনে আটকে রাখা অবস্থায় শরীয়ত, সমাজ, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও নৈতিকতার উদ্দেশ্য কখনো পূর্ণ হতে পারে না। সে যদি স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে তার কাছে বিবাহ বসেও থাকে তাহলে তার জন্য এতটুকু শাস্তিই যথেষ্ট যে, তাকে মোহরানা থেকে বঞ্চিত করা হবে। আর বিবাহের পর যদি সে তার পাগলামি সম্পর্কে জানতে পারে এবং প্রথম দিকে তার সাথে বসবাস করার প্রকাশ্য সম্মতি জ্ঞাপন করেত থাকে, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে এটা আত্মিক ও দৈহিক দিক থেকে তার জন্য অসহনীয় হয়ে দেখা দেয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে সে এমন কোন অরাধ করেনি যে, এর শাস্তিস্বরূপ তাকে সারাটা জীবন পাগলের সাথে দুঃখ-ক্ট, দুশ্চিন্তা ও আশংকায় পরিপূর্ণ অবস্থায় কাটাতে বাধ্য করতে হবে।
বিবাহের পর যদি উন্মাদনা সৃষ্টি হয় এবং এর প্রাথমিক পর্যায়ে স্ত্রী যদি স্বামী ভক্তি, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সহযোগিতা, সরলতা ও ভদ্রতাসুলভ আবেগ নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে যেতে রাজী না হয়ে থাকে, যথাসাধ্য তার দেখাশোনা করে থাকে এবংআগের মতো দাম্পত্যসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখা ভালো মনে করে থাকে, তাহলে এটা কি করে বাধ্যতামূলক হতে পারে যে, স্বামীর উন্মাদনা যখন এ বেচারীর জন্য অসহনীয় হয়ে দাঁড়ালো তখনো তাকে এ বিবাহের বন্ধন থেকে রেহাই দিতে অস্বীকার করা হবে? তাহলে এ শর্ত আরোপ করার পিছনে আইনের উদ্দেশ্য কি এই যে, কোন স্ত্রীলোকের স্বামীর মধ্যে যখনই পাগলামির উপসর্গ দেখা দিবে সে তৎক্ষণাৎ তার পিচনের সমস্ত ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতাকে ভুলে গিয়ে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং তাকে ছেড়ে চলে যাবে? কেননা তার মনে তো এ আশংকা দানা বাঁধা থাকবে যে, পাগলামির মাত্রা যদি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন স্বামীর প্রতি তার এ সহযোগিতা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও কর্তব্যনিষ্ঠা তার নিজের জীবনের জন্যই বিপদ হয়ে দেখা দিবে এবং এর একটা বিরাট মাশুল তাকে দিতে হবে।
এ ধরনের শর্তগুলো আরোপ করে পুরুষদের অধিকারসমূহকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করে পেশ করা হয়েছে, অপরদিকে নারীদের সাথে বড়ই কঠোরতা প্রর্দশন করা হয়েছে। নারী যদি অক্ষম হয়ে পড়ে অথবা পাগল হয়ে যায় অথবা ঘৃণিত বা ক্ষতিকর রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে সেই ক্ষেত্রে পুরুষ তাকে তালাত দিতে পারে অথবা দ্বিতীয় বিবাহ করে আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু পুরুষ যদি এসব ক্রটির কোন একটিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে তাহলে স্ত্রী তাকে না তালাক দিতে পারে, আর না তার বর্তমান থাকা অবস্থায় পুনবির্বাহ করতে পারে। তার জন্য বিচ্ছেদের পথ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এখন যদি একটি মাত্র পথেও এমন সব বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখা হয় যার কার অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার রেহাই পাওয়ার আর কোন উপায়ই অবশিষ্ট থাকে না- তাহলে এটা ইসলামী আইনের মধ্যে ন্যয়া-ইনসাফ ও ভারসাম্যের যে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে তার পরিপন্হী হবে।
পথনির্দেশ হওয়া উচিত যাতে বলা হয়েছে, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ন্যায়নীতি ও সৌজন্যবোধ থাকা দরকার। নারীদের যদি পুরুষের বিবাহাধীনে রাখতে হয় তাহলে এভাবে রাখতে হবে যে, তাতে নির্যাতন, মানবিক যাতনা ও বাড়াবাড়ি থাকবে না এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা লংঘিত হওয়ার আশংকা থাকবে না। কিন্তু যদি কোথাও দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে এ অত্যাবশ্যকীয় শর্তগুলো পূর্ণ না হয় তাহলে সসম্মানে বিদায় দেয়ার কুরআনী নীতির ওপর আমল করতে হবে। এখন কে বলতে পারে, এক পাগল অথবা প্রমেহ, শ্বেত অথবা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত স্বামীর সাথে জোরপূর্বক বেঁধে রাখার চেয়ে কোন নারীর ওপর নির্যাতন, ও বাড়াবাড়ি করার মারাত্মক আর কোন পথ আছে কি? আর একথা কে না বুঝে, যে নারীকে জোরপূর্বক এ অবস্থার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে, আল্লাহর নির্দেশিত সীমারেখা লংঘন করার ব্যাপারে তার জীবনে যে কি পরিমাণ সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে? এসব সুযোগ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা একজন সাধারণ মহিলার জন্য কতটা কষ্টকর?
১২. নিখোঁজ স্বামীর প্রসংগ
নিখোঁজ স্বামীর ব্যাপারে কুরআন মজীদে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ বর্তমান নেই। হাদীসসমূহ থেকেও কোন নির্ভরযোগ্য বিধান জানা যায় না। ইমাম দারা কুতনী (র) তাঁর সুনান গ্রন্হে একটি হাদীস সন্নিবেশ করেছেন। এর ভাষা নিম্নরূপঃ
**********************************
“রাসূলূল্লাহ (স) বলেনঃ নিখোঁজ ব্যক্তির অবস্থা সঠিকভাবে জ্ঞাত না হওয়া পর্যন্ত তার স্ত্রী তাই থাকবে”।
কিন্তু এ হাদীসটি সাওয়ার ইবন মুসআব ও মুহাম্মদ ইবনে শারজলি আল-হামদানীর মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। তাঁরা উভয়ই হাদীসবিশারদদের মতে বিতর্কিত (**********)। ইবনে শারজীল সম্পর্কে ইবনে আবু হাতেম লিখেছেন, ************************** (সে মুগীরার কাছ থেকে এমন সব কথা বর্ণনা করে যা অসমর্থিত, প্রত্যাখ্যাত ও মিথ্যা)। সাওয়ার (**********) ইবনে মুসআব সম্পর্কে ইবনুল কাত্তান লিখেছেন, “সে প্রত্যাখ্যাত ও কিতর্কিত ব্যক্তিদের মধ্যে শারজীরের চেয়েও অধিক খ্যাত”। সুতরাং এ হাদীসটি দুবর্ল এবং প্রমাণ হিসাবে গ্রহণের অযোগ্য। উপরন্তু নিখোঁজ ব্যক্তির প্রসংগে হযরত উমর (রা), হযরত উসমান (রা) হযরত আলী (রা), হযরত ইবনে আব্বাস (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর মত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবীদের রায়ের মধ্যে যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তাঁদের মধ্যে কারোরই হাদীসটি জানা ছিল না এবং তাঁদের সমসাময়িক কোন সাহাবী এ হাদীস সম্র্কে অবহিত ছিলেন না। কেননা হাদীসটি যদি কোন সাহাবীর জানা থাকতো তাহলে তিনি এটা উল্লিখিত সাহাবীদের সামনে তুলে ধরে তাঁদের মধ্যে মতবিরোধের অবসান ঘটাতেন।
মুহাম্মদ ইবনে শরজীল এ হাদীস মুগীরা ইবনে শো’বা (রা)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি (মুগীরা) হযরত উমর (রা) ও হযরত উসমান (রা)-এর সময়কার অন্ত্যন্ত প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের অন্তরভুক্ত ছিলেন এবং গভর্নরের উচ্চ পদে সমাসীন ছিলেন। এটা কি করে সম্ভব হতে পারে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীস তাঁর জানা ছিল এবং তিনি এরপরও হযরত উমর ও উসমান (রা)কে এর পরিপন্হী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাঁধা দেননি? এসব কারণে এটা বুঝা উচিত যে, নিখোঁজ স্বামীল প্রসংগে কুরআন-হাদীসে কোন সুস্পষ্ট বিধান নেই, বরং বিশেষজ্ঞ আলেমদের ইজতিহাদ এ বিধানের উৎস।
সাহাবা, তাবিঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণ এ সম্পর্কে রায় কায়েম করতে গিয়ে মতভেদ করেছেন। হযরত উমর, হযরত উসমান, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)-এর মত হচ্ছে, নিখোঁজ ব্যক্তির স্ত্রীকে চার বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হবে। সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব, যুহরী, নাখঈ, আতা, মাকহূল ও শা’বীরও এ মত। ইমাম মালিক (র)-ওএ মত গ্রহণ করেছেন এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর ঝোঁকও রয়েছে এ দিকেই।
অপরদিকে রয়েছেন হযরত আলী (রা) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)। তাঁদের রায় হচ্ছে- নিখোঁজ ব্যক্তি যতদিন ফিরে না আসে অথবা তার মৃত্যুর খবর জানা না যায় ততদিন তার স্ত্রীকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। সুফিয়ান সাওরী, ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফিঈ (র) এ মত গ্রহণ করেছেন। স্ত্রীর অপেক্ষা করার জন্য ইমাম আবু হানীফা (র) এ নীতি নির্ধারণ করেছেন যে, নিখোঁঝ ব্যক্তির সমবয়সী লোক যতদিন তার বসতিতে অথবা তার দেশে জীবিত থাকবে, স্ত্রী ততদিন তার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকবে। অতপর প্রত্যেক বিশেষজ্ঞ আলেম স্ব স্ব অনুমানের ভিত্তিতে মানুষের সর্বাধিক বয়সের সীমা নির্ধারণ করেছেন এবং বলেছেন, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ যত বয়স পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, স্ত্রী ততদিন তার নিখোঁজ স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকবে। যেমন কোন ব্যক্তি যদি তিরিশ বছর বয়সে নিখোঁজ হয় তাহলে তার স্ত্রীকে কারো মতে নব্বই বছর, কারো মতে ষাট বছর এবং কারো মতে পঞ্চাশ বছর অথবা কমপক্ষে চল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কেননা কতকের মতে মানুষের স্বাভাবিক বয়স ১২০ বছর, আবার কেউ ১০০ বছর অথবা ৯০ বছর অথবা ৭০ বছর নির্ধারণ করেছেন। অতএব এখন যে নারীর বয়স বিশ বচর, তাকে যে বিশেষজ্ঞ সবচেয়ে বেশী রেয়াত দিয়েছেন তাঁর ফতোয়া অনুযায়ী ষাঠ বষর বয়সে পৌঁছা পর্যন্ত নিখোঁজ স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকতে হবে। অতপর সে পুনর্বিবাহের অনুমতি পাবে।
এ মাসয়ালার ক্ষেত্রে আমরা যখন কুরআন মজীদের মৌলিক নির্দেশের দিকে প্রত্যাবর্তন করি, তখন হযরত উমর (রা)- এবং তাঁর অনুসারীদের মতই সহীহ মনে হয়। ইসলামী আইনের প্রাণসত্তা, এর আদল-ইনসাফ, এর ভারসাম্য ও এর স্বভাবের সাথে এটাই অধি সামঞ্জস্যশীল। কুরআন মজীদে আমরা দেখতে পাই, চারজন স্ত্রী পর্যন্ত রাখার অনুমতি দেয়ার সাথে সাথে এ হুকুম দেয়া হয়েছেঃ
**********************************
“তোমরা এক স্ত্রীর দিকে এমনভাবে ঝুঁকে পড়ো না যে, অপর স্ত্রীরা ঝুলন্ত অব্স্থায় পড়ে থাকবে”।–সূরা আন নিসাঃ ১২৯
এ আয়াত থেকে জানা যায়, কুরআন মজীদ স্ত্রীলোককে ঝুলন্ত বা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রেখে দেয়া পসন্ধ করে না। কুরআন যখন স্বামীর বর্তমানে এটা পসন্দ করে না, তাহলে তার নিখোঁজ অবস্থায় কি করে তা পসন্দ করতে পারে? অন্যত্র স্বামীদের হুকম দেয়া হয়েছে, যদি তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে ঈলা করো তাহলে সর্বাধিকক চার মাস এরূপ করতে পারো। এরপর তোমাদের তাদের তালাক দিতে হবে। এখানে আবার ইসলামী আইনের ভাবধারা এই মনে হচ্ছে যে, কোন স্ত্রীলোককে তার স্বামীর সঙ্গ থেকে এত দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন রাখা যাবে না যা তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে অথবা আল্লাহর নির্দেশিত সীমারেখা লংঘনের কারণ হবে। পুনরায় বলা হয়েছেঃ ***************** এর পরিষ্কার উদ্দেশ্য এই যে, দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ক্ষতি ও নির্যাতনের উপসর্গ থাকা উচিত নয়। আর একথা পরিষ্কার যে, নিখোঁজ ব্যক্তির স্ত্রীকে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করার নির্দেশ দেয়ার মধ্যে সীমাহীন দুর্ভোগ রয়েছে। এর সাথে যে আয়াতে বলা হয়েছে, যদি আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা লংঘিত হওয়ার আশংকা দেখা দেয় তাহলে খোলা করতে কোন দোষ নেই- তাও প্রণিধানযোগ্য।
এখানে আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমারেখার সংরক্ষণকে দাম্পত্য সম্পর্ক অটুট রাখার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছ্ আর এটা কে অস্বীকার করতে পারে যে, যেই নারীর স্বামী বছরের পর বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছে তার জন্য আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে স্থির থাকা খুবই কঠিন ব্যাপার। এ সমস্ত আইনের মূলনীত, এর পরিণামদর্শিতা ও যৌক্তিকতা, রহস্য ও দার্শনিক দৃষ্টিভংগী সম্পর্কে গভীলভাবে চিন্তা করলে একথা উত্তমরূপেই বুঝা যায় যে, নিখোঁজ ব্যক্তির স্ত্রীকে এক অজানা ও অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার নির্দেম দেয়া এবং তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেয়া জায়েয নয়।
১৩. নিখোঁজ ব্যক্তি সম্পর্কে মালিকী মাযহাবের আইন
এসব কারণে হানাফী মাযহাবের আলেমগণ নিখোঁজ ব্যক্তির বেলায় মালিকী মাযহাবের নির্দেশ অনুসারে ফতোয়া দেয়া পসন্দ করেছেন। অতএব এখন আমাদের দেখা দরকার, এ সম্পর্কে মালিকী মাযহাবের বিস্তারিত নির্দেশ কি? মালিকী মাযহাব অনুযায়ী নিখোঁজ স্বামীর তিনটি অবস্থা রয়েছে এবং এর প্রতিটির নির্দেশ ভিন্নতর। যেমনঃ
১. নিখোঁজ ব্যক্তি এতটুকু পরিমাণ সম্পদ রেখে যায়নি যাতে তার স্ত্রীর ভরণ-পোষণের খরচ সংকুলান হতে পারে। এ অবস্থায় বিচারক তাকে স্বামীর জন্য অপেক্ষায় থাকার নির্দেশ দিবেন না, বরং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার পর বিনা প্রতীক্ষায় নিজ কর্তৃত্ববলে তাকে তালাক দিবেন অথবা তাকে নিজের ওপর তালাক আরোপ করার অধিকার দিবেন। [বিচ্ছেদের উদ্দেশ্যে স্বয়ং হাকিমের তালাক দেয়ার পরিবর্তে বরং স্ত্রীলোকটিকে নিজের ওপর তালাক আরোপ করার অনুমতি দেয়াই অধিক উত্তম। কেননা নবী করীম (স) বারীরা (রা)-কে বলেছিলেনঃ
**********************************
“তুমিই তোমার মালিক। তোমার স্বামীর সাথে বসবাস করার অথবা তার থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার এখতিয়ার তোমার রয়েছে”।–গ্রন্হকার।] শাফিঈ ও হাম্বলী মাযহাবও এক্ষেত্রে মালিকী মাযহাবের সমর্থন করে। কেননা তাঁদের মতে ভরণ-পোষণের কোন ব্যবস্থা না থাকাটাই বিচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট।
২. নিখোঁজ ব্যক্তি ধন-সম্পদ রেখে গেছে, কিন্তু তার স্ত্রী যুবতী এবং তাকে যদিক দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষমান অবস্থায় রাখা হয় তাহলে তার পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। এ অবস্থায় হাকিম (বিচারক) তাকে এক বছর অথবা ছয় মাস অথবা যতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা যুক্তিসংগত মনে করেন ততদিন স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষার নির্দেশ দিবেন। এক্ষেত্রে হাম্বলী মাযহাবও মালিকী মাযহাবের অনুরূপ, বরং কঠিন অবস্থায় উভয় মাযহাবে অপেক্ষা করা ছাড়াই বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দেয়া জায়েয রয়েছে। অনন্তর পাপে লিপ্ত হওয়ার আশংকার ক্ষেত্রে এটা জরুরী নয় যে, স্ত্রী স্বয়ং মুখ খুলে বলবে, ‘আমাকে এ স্বামীর বন্ধন থেকে মুক্ত করে দাও অন্যথায় আমি যেনায় লিপ্ত হবো’। বরং এটা কাযীর বিবেচ্য বিষয় যে, যে নারী স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ নিয়ে এসেছে, তার বয়স কত, সে কি ধরনের পরিবেশে বসবাস করে এবং অভিযোগ নিয়ে আসার পূর্বে কতকাল স্বামীর অপেক্ষায় কাটিয়েছে। এসব বিষয়ের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিচারক নিজেই রায় কায়েম করতে পারবেন যে, তার আখলাক-চরিত্রের হেফযতের জন্য তার অপেক্ষার সময়-সীমা কি পরিমাণ কমিয়ে দেয়া উচিত।
৩. নিখোঁজ ব্যক্তি ধন-সম্পদও রেখে গেছে এবং স্ত্রীর পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশংকাও নেই; এক্ষেত্রেও আবার মাসয়ালার চারটি দিক রয়েছে।
একঃ নিখোঁজ ব্যক্তি যদি কোন মুসলিম দেশে অথবা এমন কোন দেশে হারিয়ে গিয়ে থাকে যার সাথে সভ্য দুনিয়ার যোগাযোগ রয়েছে এবং যেখানে তার সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব, তাহলে তার স্ত্রীকে চার বছর পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকার নির্দেশ দেয়া হবে।
দুইঃ সে যদি যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিখোঁজ হয়ে থাকে তাহলে তার অনুসন্ধানের জন্য সম্ভাব্য চেষ্টা চালানোর পর স্ত্রীকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
তিনঃ সে যদি নিজ এলাকার কোন দাঙ্গা বা সংঘর্ষের সময় নিখোঁজ হয়ে থাকে তাহলে দাঙ্গা বন্ধ হওয়ার পর তাকে খোঁজ করার জন্য সম্ভাব্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অতএব অপেক্ষা করা ছাড়াই তাকে মৃত্যুর ইদ্দাত অর্থাৎ চার মাস দশ দিন ইদ্দাত পালন করার অনুমতি দিতে হবে।
চারঃ সে যদি এমন কোন অসভ্য জনপদে নিখোঁজ হয়ে থাকে যার সাথে সভ্য দুনিয়ার কোন যোগাযোগ নেই এবং সেকানে তার খোঁজ নেয়ারও কোন সম্ভাব্য সুযোগ নেই, তাহলে তার স্ত্রীকে একজন মধ্যম শ্রেণীর লোকের যে পরিমাণ হায়াত পাওয়ার আশা করা যায়- সে পরিমাণ সময় অপেক্ষা করতে হবে। এ ধরনের লোকের সম্ভাব্য বয়সসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতভেদ আছে। কেউ আশি বছর, কেউ পচাঁত্তর বছর বলেছেন। কিন্তু আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করে এসেছি যে, স্বামী যদি স্ত্রীর ভরণ-পোষণের জন্য যথেষ্ট সম্পদ রেখে যায় এবং স্ত্রীরও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কোন আশংকা না থাকে- কেবল তখনই এটা প্রযোজ্য হবে। হানাফী আলেমগণ নিজেদের ফতোয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত মালিকী মাযহাবের অনুসরণ করেন। কিন্তু এর সাথে সম্পৃক্ত শর্তগুলো উপেক্ষা করে থাকেন। তাঁরা নিখোঁজ স্বামীল ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় চার বছর অপেক্ষায় থাকার ফতোয়া দিয়ে থাকেন। কিন্তু তা ঠিক নয়, বিশেষ করে বর্তমান যুগে যেখানে নৈতিক চরিত্রের বিপর্যয় ঘটানোর জন্য অসংখ্য কারণ-উপকরণ সৃষ্টি হয়ে গেছে, সেখানে যে কোন স্ত্রীকে চার বছর অপেক্ষা করানোর জন্য জেদ ধরা শরীয়তের পরিণামদর্শিতার পরিপন্হী। আজ ইসলামী সমাজে সেই শক্তিশালী শৃংখলা ব্যবস্তা বর্তমান নেই যা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল। যৌন চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ইসলাম যেসব বিধিনিষেধ কায়েম করেছিল, ইসলাম বিরোধী রীতিনীতির প্রচলন মানুষকে তা থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। উলঙ্গ ছবি, যৌন অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দেয়া উপন্যাস ও গল্পের বই, রেড়িও-টেলিভিশনের যৌন উত্তেজনামূলক গান ইত্যাদি থেকেক শহর ও জনপদের লোকদের বেঁচে থাকার কোন পথ নেই। উপরন্তু দেশের প্রচলিত আইন যেনা-ব্যভিচারকে বৈধ করে রেখেছে। তাছাড়া পর্দার শরয়ী বিধান কার্যত চালূ না থাকার কারণে গায়রে মুহরিম (যাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে) নারী-পুরুষকে অবাধ্য মেলামেশা যৌন অনুভূতিকে নাড়া দেয়ার এত বড় উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করে দিয়েছে যে, কোন ব্যক্তির পক্ষের নিজ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে পরহেযগারী ও দীনদারীর সাথে জীবন যাপন করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
এ অবস্থায় কোন যুবতী নারী নিজের নিখোঁজ স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় দুই-তিন বছর কাটিয়ে দেয়ার পর অপারগ হয়ে যখন আদালতের শরণাপন্ন হয় তখন আদালত যদি তাকে আরো চার বছর অপেক্ষা করার নির্দেশ দেয় তাহলে এটা কতটুকু যুক্তিসংগত হতে পারে? এটা এতই কঠোর নির্দেশ যে, তা কেবল নারীর জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং এর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। সুতরাং আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, নিখোঁজ ব্যক্তির ক্ষেত্রে মালিকী মাযহাবের সব শর্তগুলো আইনের অন্তরভুক্ত করে নেয়া উচিতি। নিরুদ্দেশ ব্যক্তির স্ত্রীর বয়স, তার পরিবেশ এবং স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার পর যতদিন অপেক্ষা করে সে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে এ সময়টাও বিচেনা করার জন্য আইনের উপধারায় শামিল করে নেয়া উচিত।
১৪. নিরুদ্দেশ ব্যক্তি ফিরে এসে তার বিধান
স্ত্রীকে অপেক্ষায় থাকার জন্য আদালতের দেয়া সময়-সীমা শেষ হয়ে যাওয়ার পর যদি নিখোঁজ স্বামী ফিরে আসে তাহলে এর হুকুম কি? এ প্রসংগে উল্লিখিত প্রশ্নটিও আলোচনার দাবি রাখে। হযরত উমর (রা)-এর সিদ্ধান্ত হচ্ছে, স্ত্রীলোকটির দ্বিতীয় বিবাহের পূর্বেই যদি তার স্বামী ফিরে আসে তাহলে এ স্ত্রী তারই থাকবে। কিন্তু স্ত্রীলোকটির দ্বিতীয় বিবাহের পর যদি সে ফিরে আসে এবং দ্বিতীয় স্বামী তখনো তার সাথে নির্জনবাস করে থাকুক বা না থাকুক, উভয় অবস্থায় তার ওপর প্রথম স্বামীর কোন অধিকার থাকবে না। ইমাম মালেক (র) তাঁর মুওয়াত্তা গ্রন্হে হযরত উমর (রা)-এর এ মতকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং এ মত অনুযায়ী মালিকী মাযহাবের ফতোয়া দেয়া হয়।
হযরত আলী (রা)-এর ফায়সালা অনুযায়ী যে কোন অবস্থায় প্রথম স্বামী স্ত্রীকে ফেরত পাবে, দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তার নির্জনবাস, এমন কি সন্তানই ভুমিষ্ঠ হোক না কেন? উপরন্তু নির্জনবাস হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্বামীর কাছ থেকে এ নারীর মোহরানাও আদায় করে দিতে হবে। হানাফী আলেমগণ এ মত গ্রহণ করেছেন এবং তাঁরা বলেন, হযরত উমর (রা) এবং শেষ দিকে হযরত আলী (রা) এ ফায়সালার দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন। কিন্তু ইমাম মালিক (র)-এর মতে হযরত উমর (রা)-এর নিজ মত প্রত্যাহার করা প্রমাণিত নয়।
হযতর উসমান (রা)-এর ফায়সালা হচ্ছে- স্ত্রীলোকটি যদি দ্বিতীয় বিবাহ করে থাকে, অতপর প্রথম স্বামী ফিরে আসে তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করা হবেঃ তুমি কি স্ত্রী ফেরত চাও না মোহরানা ফেরত চাও? সে যদি মোহরানা ফেরত নেয়া অথবা মাফ চাইয়ে নেয়া পসন্দ করে তাহলে স্ত্রীলোকটি দ্বিতীয় স্বামীর কাছেই থাকবে। কিন্তু সে যদি স্ত্রীকে ফেরত পাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে তাহলে স্ত্রীলোকটিকে দ্বিতীয় স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তালাকের উদ্দাত পালন করতে হবে। অতপর তাকে প্রথম স্বামীর কাছে সোপর্দ করা হবে এবং দ্বিতীয় স্বামীর কাছ থেকে তার মেহারানা আদায় করে নিতে হবে। কোন কোন বর্ণনায় হযরত উমর (রা)-এরও এরূপ একটি মত উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু ইমাম মালেক (র)-এর মতে একথা প্রমাণিত নয়।
আমাদের মতে এ তিনটি ফায়সালার মধ্যে হযরত উমর (রা)-এর ফায়সালাই সবচেয়ে উত্তম যা ইমাম মালেক (র) দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এটা পরিষ্কার যে, স্ত্রীলোকটির দ্বিতীয় বিবাহ হয়ে যাওয়ার পরও যদি তার প্রথম স্বামীর অধিকার বলবৎ থাকে, তাহলে এ ধরনের মহিলাকে বিবাহ করতে কোন পুরুষ পসন্ধ করবে? কেননা তাকে বিবাহ করে দ্বিতীয় স্বামী সবসময়ই এটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্র হবে- এই না জানি কখন তার প্রথম স্বামী ফিরে আসে এবং তার কাছ থেকে একে ছিনিয়ে নিয়ে যায়! তাকে স্ত্রীও হারাতে হবে, আবার মোহরানাও পরিশোধ করতে হবে এবং সন্তান হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অবস্থা আরো করুণ হয়ে দাঁড়াবে। মায়ের চলে যাওয়ার পর সন্তান অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে।
এ ধরনের শর্ত আরোপ করার মধ্যে মহিলাদের জন্য সীমাহীন ক্ষতির আশংকা রয়েছে। এর অর্থ এই যে, একটি দীর্ঘ অসহনীয় সময় পর্যন্ত অপেক্ষায় কাটানোর পরও তার বিপদ শেষ হয়নি। বিচারালয় থেকে মুক্তির সনদ অর্জন করার পরও তার পায়ে একটি জিঞ্জির লটকেই রয়েছে এবং তাকে সারাটা জীবন ঝুলন্ত বা অপেক্ষমাণ অবস্থায় কাটাতে হবে।
১৫. লি’আন
স্বামী চাই পরিষ্কার ভাষায় তার স্ত্রীর ওপর যেনার অপবাদ দিক অথবা সন্তান সম্পর্কে বলুক যে, ‘সে তার সন্তান নয়—উভয় অবস্থায় লি’আন করা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। নবী করীম (স)-এর সামনে এ ধরনের একটি মোকদ্দমা উত্থাপিত হলি তিনি বাদী-বিবাদী উভয়কে সম্বোধন করে তিনবার বললেনঃ
**********************************
“আল্লাহ খুব ভালোভাবেই জানেন, তোমাদের উভয়ের মধ্যে কোন একজন মিথ্যাবাদী। অতএব তোমাদের কোন একজন কি তওবা করবে?”
উভয়ে যখন তওবা করতে অস্বীকার করলো, তিনি কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী প্রথমে স্বামীকে চারবার এই বলে শপথ করালেন, স্ত্রীর বিরুদ্ধে সে যে অভিযোগ এনেছে এ ব্যাপারে সে সত্যবাদী। পঞ্চমবার তাকে এভাবে শপথ করানো হলো, যদি সে মিথ্যা বলে থাকে তাহলে তার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত। অতপর স্ত্রীলোকটিকেও এভাবে চারবার শপথ করানো হলো যে, তার ওপর যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা। পঞ্চমবার তাকে বলানো হলো, যদি এ অপবাদ সত্য হয় তাহলে তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। এরপর নবী করীম (স) বললেনঃ
**********************************
“কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি লি’আনকারী দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদের এটাই হলো পথ। এ বিচ্ছেদের পর তারা আর কখনো পুনরায় একত্র হতে পারবে না”।
স্বামী আরজ করলো, যে মাল আমি তাকে মোহরানা বাবদ দিয়েছিলাম তা ফেরত দেয়ানোর ব্যবস্থা করা হোক। এর উত্তরে নবী করীম (স) বললেনঃ
**********************************
“তুমি তোমার মাল ফেরত পাবে না। তুমি যদি তার বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়ার ব্যাপারে সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তুমি এ মালের বিনিময়েই তার লজ্জাস্থানকে বৈধ করে নিয়েছিলে। আর তুমি যদি এর ওপর মিথ্যা অভিযোগ এনে থাকো তাহলে মাল ফেরত পাবার অধিকার তোমার থেকে আরো দূরে চলে গেছে”।
রাসূলুল্লাহ (স)-এর এ ফায়সালা থেকে নিম্নলিখিত আইনগুলো পাওয়া যায়ঃ
১. লি’আন কাযীর সামনে হতে হবে। পুরুষ ও নারী পরস্পরের সামনে অথবা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের সামনে লি’আন করতে পারে না, আর এরূপ করলেও তাতে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে না।
২. লি’আন করানোর পূর্বে বিচারক পুরুষ ও নারী উভয়কে সুযোগ দিবেন যাতে তাদের কোন একজন দোষ স্বীকার করতে পারে। উভয়ে যখন নিজ নিজ কথায় অবিচল থাকবে কেবল তখনই লি’আন করানো হবে।
৩. উভয়ের পক্ষ থেকে লি’আনের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর বিচারক ঘোষণা করবেন যে, উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ করিয়ে দেয়া হয়েছে। জমহূর আলেমদের মতে লি’আন দ্বারা স্বয়ং বিচ্ছেদ ঘটে যায়। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফার রায় হচ্ছে- বিচ্ছেদের জন্য হাকিমের হুকুম অত্যাবশ্যকীয়। এ মাসয়ালা সম্পর্কে যেসব নির্ভরযোগ্য হাদীস আমাদের কাছে পৌঁছেছে তা সবই ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতের পোষকতা করে। কেননা এ ধরনের প্রতিটি মোকদ্দমায় লি’আনের কাজ শেষ হওয়ার পর নবী করীম (স) বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, নবী করীম (স) বিচ্ছেদের জন্য কেবল লি’আনকেই যথেষ্ট মনে করেননি।
৪. লি’আনের মাধ্যমে যে বিচ্ছেদ ঘটে তা চিরকালের জন্য। এরপর উভয়ে যদি পুনর্বিবাহে সম্মত হয় তাহলে এটা কোন রকমেই সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে তাহলীল সংক্রান্ত আইন কার্যকর হবে না যা *********** আয়াতে বর্ণণা করা হয়েছে।
৫. লি’আনের দ্বারা মোহরানা বাতিল হয় না। স্বামীর অভিযোগ বাস্তবিক পক্ষে সত্য হোক বা না হোক, উভয় অবস্থায় তাকে মোহরানা অবশ্য দিতে হবে অথবা আগে দিয়ে থাকলে তা ফেরত চাওয়ার অধিকারও তার থাকবে না।
স্ত্রীর বিরুদ্ধে যেনার অভিযোগ উত্থাপন করার পর স্বামী যদি লি’আন করতে অস্বীকার করে, তাহলে জমহূর আলেমদের মতে তার ওপর যেনার অপবাদ দেয়ার ফৌজদারী দণ্ড (৮০ বেত্রাঘাত) কার্যকর হবে। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে সে ফৌজদারী দণ্ডের উপযুক্ত নয়, বরং তাকে কয়েদ করা হবে। অনুরূফভাবে স্বামীল লি’আন করার পর স্ত্রী যদি তা করতে অস্বীকার করে, তাহলে ইমাম শাফিঈ, মালিক ও আহমাদ রাহিমাহুল্লাহুর মতে তাকে রজম (পাথর মেরে হত্যা) করা হবে এবং ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মতে তাকে বন্দী করা হবে। এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মাযহাব সর্বাধিক সহীহ ও পরিণামদর্শিতার ওপর ভিত্তিশীল। কিন্তু এ উপমহাদেশে (বিভাগ-পূর্ব ভারতের প্রেক্ষাপটে) লি’আন করতে অস্বীকার করার অপরাধে শাস্তি দেয়ার সুযোগ নেই। এজন্য আপাতত শরীয়তের বিধানের উপযুক্ত কাঠামো এই হবে যে, স্বামী যদি লি’আন করতে অস্বীকার করে তাহলে স্ত্রীকে মানহানির দাবি তোলার অধিকার দিতে হবে। আর যদি স্ত্রী লি’আন করতে অস্বীকার করে তাহলে তাকে মোহরানা থেকে বঞ্চিত করা হবে। আমাদের ওপর যতক্ষণ অমুসলিম সরকার চেপে থাকবে এবং আমরা যতদিন ইসলামী দণ্ডবিধি অনুসরণ করতে অক্ষম থাকবো- উল্লিখিত ব্যবস্থা কেবল ততদিনই বলবৎ থাকবে।
১৬. একই সময়ে তিন তালাক প্রদান
একই সময়ে তিন তালাক দিয়ে স্ত্রীকে পৃথক করে দেয়া কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ অনুযায়ী চরম অপরাধ। উম্মতের আলেমগণের মধ্যে এ মাসয়ালার ক্ষেত্রে যা কিছু মতবিরোধ রয়েছে তা শুধু এ নিয়ে যে, এ ধরনের তিন তালাক কি এক তালাক রিজঈ (প্রত্যাহারযোগ্য) গণ্য হবে, না তিন তালাক মুগাল্লাযা (চূড়ান্ত) গণ্য হবে? কিন্তু এটা যে বিদআত ও মারাত্মক গুনাহের কাজ- এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। তাঁরা সবাই স্বীকার করেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তালাকের যে নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছেন- একই সময়ে তিন তালাক দেয়া এ নিয়মের পরিপন্হী। শরীয়তের বিধানে যে সতর্ক দৃষ্টিভংগী নিহিত রয়েছে এতে তাও ব্যাহত হয়। হাদীসে এসেছে, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একই সময় তিন তালাক দিয়ে বসলো। রাসূলুল্লাহ (স) অসন্তুষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেনঃ
**********************************
“আমি তোমাদের মাঝে বর্তমান থাকা অবস্থায়ই সে কি মহামহিম আল্লাহর কিতাব নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে”?
অপরাপর হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূলূল্লাহ (স) এটাকে চরম গুনাহের কাজ গণ্য করেছেন। হযরত উমর (রা) সম্পর্কে হাদীসের বর্ণনায় এ পর্যন্ত এসেছে যে, যে ব্যক্তিই একই সাথে নিজ স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে তাঁর কাছে আসতো, তিনি তাকে বেত্রাঘাত করতেন। এ থেকে প্রমাণিত হলো যে, এরূপ কাজের জন্য শাস্তিরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
আমাদের যুগে এটা একটা সাধারণ অভ্যাগে পরিণত হয়ে গেছে যে, লোকেরা কোন সাময়িক উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে স্ত্রীকে ঝটপট তিন তালাক দিয়ে বসে। অতপর লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে শরীয়তের মধ্যে ছল-চাতুরী খুঁজে বেড়ায়। কেউ মিথ্যা শপথ করে তালাকই অস্বীকার করে বসে। কেউ বা হিলাম করানোর উপায় খুঁজে বেড়ায়। আবার কেউ তালাকের ব্যাপারটি গোপন রেখে স্ত্রীর সাথে পূর্বের সম্পর্ক বজায় রাখে। এভাবে একটি গুনাহের পরিণতি থেকে বাঁচার জন্য আরো অসংখ্য গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়। এ অনাচারের প্রতিরোধ করার জন্য একই সময়ে তিন তালাক দিয়ে স্ত্রীকে বিদায় করে দেয়ার ওপর এমন কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন, যাতে লোকেরা এ ধরনের কাজ করতে সাহস না পায়। উদাহরণস্বরূপ এর একটি উপায় এই যে, যে মহিলাকে একই সাথে তিন তালাক দেয়া হয়েছে তাকে আদালকে ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করার অধিকার দিতে হবে এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অন্ততপক্ষে মোহরানার অর্ধেক হতে হবে।
এছাড়াও অনাচারের প্রতিরোধের জন্য আরো অনেক পন্হা বের করা যেতে পারে। আমাদের আলেম সমাজ ও আইন বিশেষজ্ঞগণ চিন্তা-ভাবনা করে তা বের করতে পারেন। উপরন্তু লোকদের মধ্যে ও মাসয়ালাটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার যে, এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তাহলে লোকেরা যে অজ্ঞতার কারণে এতে জড়িয়ে পড়ছে, সঠিক পন্হার ব্যাপক প্রচারের ফলে তারা সতর্ক হয়ে যেতে পারে।