সূচনা
যে কোন সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের জন্য দুটি জিনিসের প্রয়োজন। একঃ এমন একটি পূর্ণাংগ আইন ব্যবস্থা- যা তার বিশেষ সংস্কৃতির মেজাজের দিকে লক্ষ্য রেখে তৈরি করা হয়েছে। দুইঃ যে দৃষ্টিভংগী সামনে রেখে এ বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে ঠিক তদনুযায়ী তা কার্যকর করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা বর্তমানে এ দুটি জিনিস থেকেই বঞ্চিত। নিসন্দেহে তাদের কাছে বইয়ের আকারে এমন একটি আইন-বিধান মওজুদ রয়েছে যা ইসলামী সংস্কৃতি ও তার স্বভাবের সাথে পুর্ণ সামঞ্জস্যশী এবং সামাজিকতা ও সংস্কৃতির সব দিক ও বিভাগে তা পরব্যপ্ত। কিন্তু এ বিধান বর্তমানে কার্যত রহিত হয়ে আছে। তদস্থলে এমন একটি আইন-বিধান তার সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ডের ওপর কর্তৃত্ব করছে যা সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনেক ব্যাপারেই সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পরিপন্হী। যদি কোথাও তার কিয়দাংশ ইসলাম মোতাবেক হয়েও থাকে, তবে তা অসম্পুর্ণ।
মুসলমানরা বর্তমানে যে রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীন, তা কার্যত তাদের সামাজিক জীবনকে দু টুকরা করে ফেলেছে। এর এক শাখা হচ্ছে, এ রাষ্ট্রব্যবস্থা উপমহাদেশের অন্য জাতির সাথে মুসলমানদের ওপরও এমন সব আইন-কানুন চাপিয়ে দিয়েছে যা ইসলামী সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে আদৌ সামঞ্জস্যশীল নয়। দ্বিতীয় শাখার আওতায় এ রাষ্ট্রব্যবস্থা মৌলিক-ভাবে মুসলমানদের এ অধিকার স্বীকার করে নিয়েছে যে, তাদের ওপর ইসলামী আইন কার্যকর করা হবে। কিন্তু কার্যত এ শাখার অধীনেও ইসলামী শরীয়াতকে সঠিকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে না। ‘মুহাম্মাদী ল’ নামে যে আইন এ শাখার অধীনে কার্যকর করা হয়েছে তা তার নিজস্ব রূপ ও প্রাণ উভয় দিক থেকেই মূল ইসলামী শরীয়ত থেকে অনেকটা ভিন্নতক। সুতরাং তার প্রয়োগকে সঠিক অর্থে ইসলামী শরীয়তকে কার্যকর করা হয়েছে বলা চলে না।
এ দুঃখজনক পরিস্থিতি মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের যেসব ক্ষতি করেছে সেগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, এ রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের অন্তর শতকরা পঁচাত্তর ভাগ পরিবারকেই জাহান্নামের প্রতীকে পরিণত করে দিয়েছে এবং আমাদের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশের জিন্দেগীর তিক্ত তথা ধ্বংস করে দিয়েছে।
নারী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক মূলত মানবীয় সমাজ-সংস্কৃতির ‘ভিত্তিপ্রস্তর’। যে কোন ব্যক্তি, চাই সে পুরুস হোক অথবা নারী, দাম্পত্য সম্পর্ককে সুসংহত করার জন্য রচিত আইনের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারে না। কেননা শৈশবকাল থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি স্তরে এ বিধান কোন না কোন অবস্থায় মানব জীবনের ওপর অবশ্যই প্রভাব বিস্তার করে আছে। যদি সে শিশু হয়ে থাকে তাহলে তার পিতা-মাতার সম্পর্ক তার লালন-পালন ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণে প্রভাব বিস্তার করবে। যদি সে যুবক হয়ে থাকে তাহলে একজন জীবন-সংগিনীর সাথে তার সম্পর্ক স্থাপিত হবে। আর যদি সে বয়োবৃদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে তার সন্তানগন এ বৈবাহিক সম্পর্কের বন্দীদশায় তাকে আবদ্ধ করে রাখবে। তার অন্তর ও মনের শান্তি তথা জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য অনেকটা পুত্র-পুত্রবধূ এবং মেয়ে-জামাইয়ের সাথে উত্তম সম্পর্কের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে থাকবে।
মোটকথা দাম্পত্য বিধান এমনই এক আইন-বিধান, যা সামাজিক বিধানসমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপুর্ণ এবং সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী। ইসলামে এ বিধানের মৌলিক গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে তা অত্যন্ত নির্ভুল বুনিয়াদের ওপর রচনা করা হয়েছে এবং মুসলমানরা দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের দীনের মধ্যে একটি উত্তম, পুর্ণাংগ বিধান লাভ করেছিল এবং তা যে কোন দিক থেকে দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মের বৈবাহিক বিধানগুলোর তুলনায় অধিক উত্তম বলা যেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ বিধানটিও ‘মুহাম্মদী ল’- এর প্রেতাত্মার খপপরে পড়ে এমনভাবে বিকৃত হলো যে, তার মধ্যে এবং ইসলামের মূল বৈবাহিক বিধানের মধ্যে দূরতম সাদৃশ্যমাত্র অবশিষ্ট থাকলো।
বর্তমানে ইসলামী শরীয়াতের নামে মুসলমানদের বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে আইন চালূ রয়েছে তা যেমন সুষ্ঠু নয়, তেমনি অর্থবহও নয়, পরিপূর্ণও নয়। এ আইনে ক্রটি ও অপূর্ণতা মুসলমানদের সামাজিক জীবনের ওপর এত বেশী ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছে যে, সম্ভবত অন্য কোন আইনের দ্বারা এতটা ক্ষতি করা সম্ভব হয়নি এরূপ একটি সৌভাগ্যবান পরিবার এ উপমহাদেশে অতি কষ্টেই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। জান-প্রাণ ধ্বংস হওয়া একটা সামান্য ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিপদ হচ্ছে- এ কালা-কানুনের কুফল অসংখ্য মুসলমানের সম্ভ্রমবোধকে বিলীন করে দিয়েছে, তাদের ঈমান ও চরিত্র-নৈতিকতা বরবাদ করে দিয়েছে। যেসব ঘর ছিল তাদের দীন ও সংস্কৃতির সুরক্ষিত দুর্গ, তা সেগুলোর মধ্যেও অশ্লীলতা ও ধর্মচ্যুতির সয়লাব পৌঁছে দিয়েছে। আইন-কানুন এবং তা বলবৎকারী যন্ত্রের ক্রটির ফলে যেসব অকল্যাণ দেখা দিয়েছে, দুটি কারণে তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
একঃ দীনী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব
এর ফলে মুসলমানরা ইসলামের দাম্পত্য আইনের সাথে এতই অপরিচিত হয়ে পড়েছে যে, বর্তমানে অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিও এ আইনের সাধারণ মাসয়ালা-মাসায়েল সম্পর্কেও অবহিত নয়।[উদাহরণস্বরূফ এটা মুর্খতারই ফল যে, মুসলমানরা সাধারণত তালাক দেয়ার একটি মাত্র নিয়মের সাথেই পরিচিত। তা হলো, একই সাথে তিন তালাক ছুঁড়ে মারা। এমনকি যাঁরা তালাকনামা লিখে থাকেন তাঁরাও তখন তিন তালাক লিখে দেন। অথচ এটা হচ্ছে ইসলামের বিদআত এবং শক্ত গুনাহের কাজ। এর ফলে বড় রকমের আইনগত জটিলতাও সৃষ্টি হয়। লোকেরা যদি জানতো, যে উদ্দেশ্যে তিন তালাক দেয়া হয় তা এক তালাক দেয়ার মাধ্যমেও হাসিল করা যায় এবং এ অবস্থায় ইদ্দাত চলার সময়ের মধ্যে তালাক প্রত্যাহার করে এবং ইদ্দাত শেষ হওয়ার সময় পুনরায় বিবাহ করার সুযোগ অবশিষ্ট থাকে, তাহলে অসংখ্য পরিবার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার সুযোগ পেত। একইভাবে অনেক আল্লাহর বান্দা মিথ্যা ছল-চাতুরী এবং আইন ভংগের অপরাধ থেকে বেঁচে যেত।– গ্রন্হকার।] ব্যাপক- ভাবে জানা তো দূরের কথা, এর মূলনীতিটুকু জানার এবং বুঝার মতো মুসলমানও খুব কমই পাওয়া যাবে। এমনকি যেসব লোক বিচারালয়ের কুরসীতে বসে তাদের বিয়ে তালাক সংক্রান্ত মোকদ্দমার মীমাংসা করে থাকেন তাঁরাও ইসলামের দাম্পত্য আইনের প্রাথমিক জ্ঞান থেকে পর্যন্ত বঞ্চিত। এ ব্যাপক মুর্খতা মুসলমানদের এমনভাবে পংগু করে দিয়েছে যে, তারা নিজেদের দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবেও ইসলামী আইনের যথাযথ অনুসরণ করতে পারছে না।
দুইঃ অনৈসলামী সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব
এর ফলে মুসলমানদের দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে কেবল ইসলামের দাম্পত্য আইনের মূলনীতি ও ভাবধারার পরিপন্হী অসংখ রসম-রেওয়াজ, ধ্যান-ধারণা ও কুসংস্কারের ও অনুপ্রবেশই ঘটেনি, বরং সাথে সাথে তাদের একটা বিরাট অংশের মন-মগজ থেকে বৈবাহিক জীবনের ইসলামী দৃষ্টিকোণই সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে গেল। কোথাও হিন্দুদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভংগীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এই যে, স্ত্রীকে দাসী এবং স্বামীকে প্রভু তথা দেবতা জ্ঞান করা হয়। আকীদা-বিশ্বাসের দিক থেকে না হলেও কার্যক্ষেত্রে বিবাহ বন্ধন কখনো ছিন্ন করা চলে না। তালাক ও খোলার প্রথা এতটা লজ্জা ও অপমানের ব্যাপার হয়ে পড়েছে যে, কোথাও এর প্রয়োজন হলে কেবল এ কারণে বর্জন করা হয় যে, এতে সম্মান ও সম্ভ্রমের হানি হয়, যদিও পর্দার অন্তরালে তালাক ও খোলার চেয়েও নিকৃষ্টতর অনেক কিছুই ঘটতে থাকে।তালাক প্রতিরোদের জন্য মোহরানার পরিমাণ এত অধিক করা হয় যে, স্বামী যেন কখনো তালাক দেয়ার সাহসও করতে না পারে এবং অনৈক্যের সময় স্ত্রীকে ঝুলিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। স্বামী পূজা স্ত্রীদের গৌরব ও নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে শামিল হয়ে পড়েছে। কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতেও সে কেবল সামাজিক নিন্দা ও তিরস্কারের ভয়ে তালাক অথবা খোলার নাম মুখেও আনতে পারে না। এমনকি স্বামী যদি মরে যায় তবুও হিন্দু নারীদের মত স্বামীর নাম জপ করে বসে থাকাই তার নৈতিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বিধবার দ্বিতীয়বার বিবাহ হওয়াটা কেবল তার জন্য নয়, বরং তার গোটা বংশের জন্য অপমানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতায় প্রভাবিত নব্য বংশধরদের অবস্থা হলো- ******************** – কুরআনের এ আয়াতটি তারা বেশ জোর গলায় উচ্চারণ করে। [“নারীদের ওপর পুরুষদের যেরূপ অধিকার রয়েছে, তদ্রূপ তাদের ওপরও নারীদের ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২৮] কিন্তু ******************** আয়াতে পৌঁছে হঠাৎ তাদের সুর নিচু হয়ে যায় [“অবশ্য পুরুষদের জন্য তাদের ওপর একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২৮] এবং যখন ******************** আয়াতটি তাদের সামনে এসে যায় তখন তারা সাধ্যমত চেষ্টা করে, কিভাবে এ আয়াতটি কুরআন মজীদ থেকে ‘খারিজ’ করে দেয়া যায়’।[পুরুষরা হচ্ছে নারীদের পরিচালক”।–সূরা আল নিসাঃ ৩৪] তারা এ আয়াতের আজগুবি ব্যাখ্যা পেশ করে। তারা এ উদ্ভট ব্যাখ্যার অন্তরালে একথাও বলে যে, তারা মানসিকভাবে ভীষণ লজ্জিত। তাদের ধর্মের পবিত্র কিতাবে এ ধরনের আয়াত রয়েছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, ইউরোপীয় সভ্যতা নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ছক এঁকেছে, তাতে তারা আতংকিত হয়ে পড়েছে এবং তাদের মাথায় ইসলামের পূর্ণাংগ, মজবুত ও যুক্তি সংগত মূলনীতিগুলো অনুধাবন করার কোন যোগ্যতা অবশিষ্ট থাকেনি, যার ওপর সে তার সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এরূপ নানাবিধ কারণ পুঞ্জীভূত হয়ে মুসলমানদের পারিবারিক জীবনকে ততটা বিপথগামী করে ফেলে- কেন এক যুগে তা যতটা উত্তম ছিল। বিদেশী কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রবাবে তাদের দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তার জট খুলতে বর্তমানে আইন ও আইন প্রয়োগকারী যন্ত্র সম্পূর্ণরূপে অপারগ হয়ে পড়েছে। এ অপারগতা এসব জটিলতাকে আরো জটিল করে তুলছে। অজ্ঞতার কারণে মুসলমানদের একটি দল এ ভ্রান্ত ধারণার শিকার হয়ে পড়েছে যে, ইসলামী আইনের ক্রটির কারণেই এসব বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য একটি নতুন আইন-বিধান প্রণয়ন করার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। অথ বাস্তব ক্ষেত্রে ইসলামে এমন একটি পরিপুর্ণ দাম্পত্য বিধান মওজুদ রয়েছে যেখানে স্বামী-স্ত্রীর জন্য ন্যয় ও ইনসাফের ভিত্তিতে তাদের অধিকারসমূহ পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ অধিকার সংরক্ষণের জন্য এবং সীমালংঘনের ক্ষেত্রে (চাই তা স্ত্রীর পক্ষ থেকে ঘটুক অথবা স্বামীর পক্ষ থেকে) তার প্রতিকারের জন্য অভিযোগ পেশ করার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সেখানে কোন সমস্যা বাকি রাখা হয়নি যার সমাধান ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতে করা হয়নি।
অতএব মুসলমানদের জন্য নতুন কোন বিধানের আদৌ প্রয়োজন নেই। যে জিনিসটির প্রকৃত প্রয়োজন রয়েছে তা হচ্ছে- ইসলামের দাম্পত্য বিধানকে তার স্বরূপে পেশ করতে হবে এবং তাকে সঠিকভাবে কার্যকর করার চেষ্টা করতে হবে। অবশ্য এটা খুব সহজসাধ্য কাজ নয়। সর্বপ্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে আলেম সমাজের। তাঁরা অবিচল তাকলীদের পথ পরিহার করে বর্তমান যুগের প্রয়োজন ও চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে ইসলামের দাম্পত্য বিধানকে এমনভাবে ঢেলে সাজাবেন যেন মুসলমাননদের দাম্পত্য জীবনের সমস্যাসমূহের বর্তমান জটিলতার পূর্ণাংগ সমাধান করা যায়। অতপর মুসলমান সর্বসাধারণকে এ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এর ফলে তারা নিজেদের সামাজিক ব্যবস্থাকে সমস্ত জাহিলী রসম-রেওয়াজ ও দৃষ্টিভংগী থেকে পবিত্র করতে পরবে, যা তারা ইসলাম বিরোধী সমাজব্রবস্থা থেকে গ্রহণ করেছিল এবং তারা ইসলামী আইনের মূলনীতি ও ভাবধারা অনুধাবন করে তদনুযায়ী নিজেদের যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিবে। এছাড়া এমন একটি সুশৃংখল ও সুসংগঠিত ‘বিচার বিভাগে’র প্রয়োজন, যা স্বয়ং এ আইনের ওপর ঈমান রাখে এবং যার বিচারকদেরও জ্ঞান ও নৈতিকতার দিক থেকে এরূপ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারা এ আইনকে দুনিয়ার অন্যান্য আইনের প্রেরণায় নয়, বরং ইসলামের নিজস্ব প্রেরণা ও ভাবধারায় কার্যকর করবে।
এ কিতাবটি সেই প্রয়োজন সামনে রেখেই লেখা হয়েছে। সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে আমি ইসলামের দাম্পত্য আইনের একটি পূর্ণাংগ রূপরেখা পেশ করতে চাই। তাতে এ আইনের উদ্দেশ্যে, মূলনীতি ও ধারাসমূহ যথাযথ স্থানে বর্ণনা করা হবে। প্রয়োজনবোধে আমি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরারে সিদ্ধান্তের উদাহরণ এবং পরবর্তী যুগের ইমামদের ইজতিহাদী রায়ও নকল করবো। এতে খুঁটিনাটি মাসয়ালাসমূহ বের (ইস্তিম্বাত) করা সহজ হবে। পরিশেষে এমন কতগুলো প্রস্তাব পেশ করা হবে যাতে ইসলামী শরীয়াতের মূলনীতি অনুযায়ী মুসলমানদের দাম্পত্য জীবনের যাবতীয় বিষয়ে জটিলতা অনেকাংশে দূরীভূত হতে পারে। যদিও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও শরীয়াতী বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তনই হচ্ছে এসব জটিলতার আসল ও সঠিক চিকিৎসা, কিন্তু তবুও এখানে আমি এমন কতগুলো বিষয় বলে দিতে চাচ্ছি যেগুলো দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতেও মুসলমানদের দাম্পত্য জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াদির দোষ-ক্রটিগুলো তুলনামূলকভাবে শরীয়াতের সঠিক নিয়মে দূর করা যেতে পারে। তাহলে যাঁরা এসব সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছেন তাঁরা ভ্রান্ত পথে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে এমন পথ গ্রহণ করবেন, যার কিছুটা অন্তত শরীয়াত মোতবোক হবে।
দাম্পত্য আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
আইনকে ব্যাপকভাবে জানার পূর্বে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে অবগতি লাভ করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা আইনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উদ্দেশ্যে পুরণের জন্যই নীতিমালা নির্ধারণ করা হয় এবং নীতিমালার অধীনেই আইনের নির্দেশাবলী ও ধারাসমূহ বিবৃত হয়। যদি কোন ব্যক্তি উদ্দেশ্যেকে না বুঝেই নির্দেশকে কার্যকর করে, তাহলে ছোটখাট সমস্যার ক্ষেত্রে এমন সব রায় দিয়ে বসার খুবই আশংকা রয়েছে যার ফলে আইনের মূল উদ্দেশ্যেই বিলীন হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হবে না সে আইনের সঠিক ভাবধারা অনুযায়ী তার অনুসরণও করতে পারবে না। অতএব যেসব উদ্দেশ্যে সামনে রেখে ইসলামে দাম্পত্য বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে আমরা প্রথমে সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করবো।
নৈতিক চরিত্র ও সতীত্বের হেফাযত
ইসলামের দাম্পত্য আইনের প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্র ও নৈতিকতার হেফাযত করা। এ আইন যেনাকে হারাম ঘোষণা করেছে এবং মানব জাতির উভয় শ্রেণীর স্বভাবগত সম্পর্ককে এমন এক আইন কাঠামোর অধীন করে দেয়ার জন্য বাধ্য করেছে যা তাদের চরিত্রকে অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা থেকে এবং সমাজকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে। এজন্যই কুরআন মজীদে ‘নিকাহ’ শব্দকে ইহসান (**********) শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। হিসন (********) শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘দুর্গ’ আর ইহসান শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘দুর্গে আবদ্ধ হওয়া’। অতএব যে ব্যক্তি বিবাহ করে সে হচ্ছে মোহসিন অর্থাৎ সে যেন একটি দুর্গ নির্মাণ করছে। আর যে স্ত্রীলোককে বিবাহ করা হয় সে হচ্ছে মোহসিনা অর্থাৎ বিবাহের আকারে তার নিজের ও নিজ চরিত্রের হেফাযতের জন্য যে দুর্ঘ নির্মাণ করা হয়েছে তাতে আশ্রয় গ্রহণকারীনী। এ রূপক উদাহরণ পরিষ্কার বলে দিচ্ছে যে, চরিত্র ও সতীত্বের হেফাযত করাই হচ্ছে ইসলামের বিবাহ ব্যবস্থার সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য। আর দাম্পত্য আইনের প্রথম কাজ হচ্ছে এ দুর্গকে সুদৃঢ় করা যা বিবাহের আকারে চরিত্র ও সতীত্বের এ মহামূল্যবান রত্নকে হেফাযত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
**********************************
“এ মুহরিম স্ত্রীলোকদের ছাড়া অন্য সব মহিলা তোমাদের হালাল করা হয়েছে, যেন তোমরা নিজেদের ধন-সম্পদের বিনিময়ে তাদেরকে হাসিল করার আকাঙ্ক্ষা করো। তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য এবং অবাধ যৌনচর্চার প্রতিরোধের জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে যে স্বাদ আস্বাদন করেছ তার বিনিময়ে চুক্তি অনুযায়ী তাদের মোহরানা পরিশোধ করো”।– সূরা আন নিসাঃ ২৪
আবার স্ত্রীলোকদের জন্য বলা হয়েছেঃ
**********************************
“অতএব তোমরা তাদের অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে তাদের বিবাহ করো এবং ন্যায়সংগত পরিমাণে মোহরানা আদায় করো, যাতে তারা সতীসাধ্বী হয়ে থাকে এবং প্রকাশে অথবা গোপনে যেনা করে না বেড়ায়”।–সূরা আন নিসাঃ ২৫
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
**********************************
“আজ তোমাদের জন্য সমস্ত পবিত্র জিনিস হালাল করা হলো। ……………… আর ঈমানদার সতী নারী এবং তোমাদের পূর্বেকার আহলে কিতাবদের সতী নারীদের তোমাদের জন্য হালাল করা হলো। তবে শর্ত হচ্ছে- তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদানের বিনিময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করবে এবং প্রকাশ্যে অথবা গোপনে চুরি করে অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না”।– সূরা আল মায়েদাঃ ৫
এসব আয়াতের শব্দ ও অর্থ নিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায়, ইসলামের দৃষ্টিতে পুরুষ ও নারীর দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ইহসান অর্থাৎ ‘চরিত্র ও সতীত্বের পূর্ণ হেফাযতই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’। এটা এমটি এক মহান উদ্দেশ্যে যার জন্য অন্য যে কোন উদ্দেশ্যকে কুরবানী করা যেতে পারে। কিন্তু অন্য যে কোন উদ্দেশ্যের জন্য এ উদ্দেশ্যকে বিসর্জন দেয়া যাবে না। স্বামী-স্ত্রীকে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, তারা যেন আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করে তাদের স্বভাবসুলব যৌন স্পৃহা পুর্ণ করে। কিন্তু যদি কোন বিবাহের বন্ধনে (অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে) এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যদ্দরুন আল্লাহ তা’আলার নির্ধারিত সীমা লংঘিত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়, তাহলে এ বিবাহের বাহ্যিক বন্ধনকে অটুট রাখার জন্য তাঁর নির্ধারিত অন্যান্য সীমারেখা লংঘন করার পরিবর্তে বরং এগুলোর হেফাযতের জন্য বিবাহ বন্ধনকে ছিন্ন করে দেয়াই অধিক উত্তম। এজন্যই ঈলাকারীদের [] নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন চার মাসের অধিক নিজের প্রতিজ্ঞার ওপর অবিচল না থাকে। স্বামী যদি চার মাস অতিক্রমের পরও স্ত্রীর কাছে প্রত্যাবর্তন না করে তাহলে সে স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অনিচ্ছুক, তাকে বিবাহের বন্ধনে আটকে রাখার কোন অধিকার তার নেই। কেননা তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম এই দাঁড়ায় যে, স্ত্রীলোকটি তার প্রাকৃতিক দাবি পূরণের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করতে বাধ্য হবে। আল্লাহর আইন কোন অবস্থায়ই তা সহ্য করতে পারে না। অনুরূপভাবে যারা একাধিক মহিলাকে বিবাহ করে, তাদেরকে কঠোরভাবে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ
**********************************
“তোমরা এক স্ত্রীকে একদিকে ঝুলিয়ে রেখে অপর স্ত্রীর দিকে একেবারে ঝুঁকে পড়ো না”।–সূরা আন নিসাঃ ১২৯
এ নির্দেশেরও উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন স্ত্রী যেন এ অবস্থার প্রেক্ষিতে আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করতে বাধ্য না হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে দাম্পত্য জীবনের বাহ্যিক বন্ধন অটুট রাখার পরিবর্তে তা ভেংগে দেয়াই উত্তম। এর ফলে স্ত্রীলোকটি বন্ধনমুক্ত হয়ে তার পসন্দসই অন্য পুরুষকে বিবাহ করার সুযোগ পাবে। এ একই উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে ‘খোলা’ করার ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। কোন স্ত্রীলোকের এমন ব্যক্তির কাছে থাকা- যাকে সে আদৌ পছন্দ করে না অথবা যার কাছে সে মানসিক শান্তি পায় না- এটা তাকে এমন অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে যার ফলে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘিত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। এ ধরনের স্ত্রীলোককে অধিকার দেয়া হয়েছে যে, সে মোহরানার আকারে স্বামীর কাছ থেকে যে অর্থ পেয়েছিল তার সম্পূর্ণটা অথবা কিছু কমবেশী তাকে ফেরত দিয়ে বিবাহের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে।
ইসলামী আইনের এ ধারাগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে। কিন্তু এখানে উল্লিখিত উদাহরণসমূহ পেশ করে এ নিগূঢ় তত্ত্ব উদঘটান করাই উদ্দেশ্য যে, ইসলামী আইন চরিত্র ও সতীত্বের হেফাযতকে সব জিনিসের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে, যদিও তা বিবাহ বন্ধনকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সুদৃঢ় করার চেষ্টা করে। কিন্তু যেখানে এ বন্ধন বহাল রাখলে চরিত্র ও সতীত্বের ওপর আঘাত আসার আশংকা দেখা দেয়, সেখানে এ মূল্যবান ঐশ্বর্যকে রক্ষা করার তাগিদেই বৈবাহিক বন্ধনের গিঁঠ খুলে দেয়াই সে জরুরী মনে করে। আইনের যে ধারাগুলো সামনে অগ্রসর হয়ে আলোচনা করা হবে তা অনুধাবন করার জন্য এবং সেগুলোকে আইনের স্পিরিট অনুযায়ী কার্যকর করার জন্য এ সূক্ষ্ম বিষয়টি উত্তমরূপে হৃদয়গম করা একান্ত্র প্রয়োজন।
ভালোবাসা ও আন্তরিকতা
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানব জাতির উভয় শ্রেণীর লিংগের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে ভালোবাসা ও আন্তরিকতার ভিত্তিতে। বৈবাহিক সম্পর্কে সাথে সমাজ ও সভ্যতার যে সমস্ত উদ্দেশ্য সংযুক্ত রয়েছে সেগুলোকে তারা নিজেদের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সফলতার সাথে পূর্ণ করতে পারবে এবং পারিবারিক জীবনে তারা শান্তি, আনন্দ ও আরাম উপভোগ করতে পারবে। তাদের সামাজিক জীবনের মহান উদ্দেশ্যসমূহকে পূর্ণ করার জন্য শক্তি যোগাবার ক্ষেত্রে এসব জিনিসের খুবই প্রয়োজন। কুরআন মজীদে এ উদ্দেশ্যকে যে ভংগীতে বর্ণনা করা হয়েছে সে সম্পর্কে চিন্তা করলে জানা যায়, ইসলামের দৃষ্টিতে দাম্পত্য জীবনের দর্শনই হচ্ছে ভালোবাসা ও হৃদ্রতা। স্বামী-স্ত্রীকে এজন্যই সৃ্টি করা হয়েছে যে, একজন যেন অপরজনের কাছ থেকে প্রশান্তি লাভ করতে পারে।
অতএব এরশাদ হচ্ছেঃ
**********************************
“এবং তাঁর নির্দশনসমূহের মধ্যে একটি নির্দশন হচ্ছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তার কাছে মানসিক শান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি তোমাদের মাঝে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন”।–সূরা আর রূমঃ ২১
অন্য এক স্থানে বলা হয়েছেঃ
**********************************
“তিনি সেই সত্ত, যিনি তোমাদেরকে একটি দেহ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার জন্য স্বয়ং সেই বস্তু থেকে তৈরি করেছেন একটি জোড়া, যেন তোমরা তার কাছ থেকে শান্তি ও আরাম হাসিল করতে পারো”।
-সূরা আল আ’রাফঃ ১৮৯
**********************************
“তারা হচ্ছে তোমাদের জন্য পোশাক এবং তোমরা হচ্ছো তাদের জন্য পোশাক”।–সূরা আল বাকারাঃ ১৮৭
এখানে স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের পোশাক বলা হয়েছে। পোশাক হচ্ছে যা মানুষের শরীরের সাথে মিশে থাকে, তাকে আবৃত করে রাখে এবং বাইরের অনিষ্টকর বস্তু থেকে হেফাযত করে। কুরআন মজীদে স্বামী-স্ত্রীর জন্য পোশাকের এ রূপক ব্যবহার করে এটাই বুঝানো হয়েছে যে, ব্যক্তিগত দিক থেকে তাদের মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক এমন হওয়া উচিত যেরূপ সম্পর্ক পোশাক ও শরীরের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। তাদের অন্তর ও আত্মা পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকবে। একে অপরের গোপনীয়তা রক্ষা করবে এবং একজন অপর জনের চরিত্র ও সম্ভ্রমকে কলংকের প্রভাব থেকে বাঁচিয়ে রাখবে। এটাই হচ্ছে প্রেম, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার দাবি এবং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই হচ্ছে দাম্পত্য সম্পর্কে আসল প্রাণ। যদি কোন দাম্পত্য সম্পর্কে মধ্যে এ প্রাণ বস্ত না থাকে তাহলে সেটা যেন এক প্রাণহীন লাশ।
ইসলামে দাম্পত্য সম্পর্কে ক্ষেত্রে যেসব বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে এ উদ্দেশ্যকেই সামনে রাখা হয়েছে। যদি স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস করতে চায় তাহলে পারস্পরিক সমঝোতা, মিল-মহব্বতের সাথে একমুখী হয়ে বসবাস করবে, পরস্পরের ন্যায্য অধিকার আদায় করবে এবং উভয় উভয়ের সাথে উদার ব্যবহার করবে। কিন্তু যদি তারা এরূপ করতে অসমর্থ হয়, তাহলে তাদের একত্রে বসবাস করার চেয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াই উত্তম। কেননা প্রেম ও আন্তরিকতার ভাবধারা খতম হয়ে যাওয়ার পর দাম্পত্য সম্পর্ক হবে একটি মৃতদেহ। যদি তা দাফন না করা হয় তাহলে এ থেকে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হবে এবং এর ফলে পরিবারিক জীবনের সমস্ত পরিবেশটাই বিষময় ও দুর্গন্ধময় হয়ে যায়। এ কারণে কুরআন মজদে বলছেঃ
**********************************
“যদি তোমরা আপোষে মিলেমিশে থাকো এবং পরস্পর সীমালংঘন করা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করো, তাহলে আল্লাহ নিশ্চয়ই ক্ষমাকারী ও দয়াশীল। যদি (তা সম্ভব না হয়) দম্পতি পরস্পর পৃথক হয়ে যায় তাহলে আল্লাহ তা’আলা আপন অসীম অদৃশ্য ভাণ্ডার থেকে উভয়কে সন্তুষ্ট করবেন”।–সূরা আন নিসাঃ ১২৯-১৩০
আবার জায়গায় জায়গায় আহকাম বর্ণনা করার সাথে সাথে তাকিদ করা হয়েছেঃ
**********************************
“হয় ন্যায়সংগত পন্হায় তাকে ফিরিয়ে দিবে অথবা সৌজন্যের সাথে তাকে বিদায় দিবে”।–সূরা আল বাকারাঃ২২৯
**********************************
“তোমরা হয় উত্তমভাবে তাদেরকে নিজেদের কাছে রাখবে অন্যথায় ন্যায়ণীতির সাথে তাদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে যাবে”।
-সূরা আত-তালাকঃ২
**********************************
“তোমরা স্বীয় স্ত্রীদের সাথে সদাচারণ করো”।– সূরা আন নিসাঃ১৯
**********************************
“তোমরা হয় তাদেরকে উত্তম পন্হায় ফিরিয়ে নাও অন্যথায় উত্তম পন্হায় বিদায় দাও। শুধু কষ্ট দেয়ার জন্য তাদের আটকে রেখো না। কেননা এতে তাদের অধিকার খর্ব করা হয়। যে ব্যক্তি এরূপ কাজ করবে সে নিজের ওপরই অত্যাচার করবে”।– সূরা আল বাকারাঃ ২৩১
**********************************
“তোমরা পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহৃয়তা দেখাতে কখনো ভুল করো না”। -সূরা আল বাকারাঃ ২৩৭
যেখানে ‘রিযয়ী’ (প্রত্যাহারযোগ্য) তালাকের বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে পুনরায় গ্রহণের জন্য সৎ উদ্দেশ্যের শর্ত আরোপ করা হয়েছে অর্থাৎ দুই তালাক দেয়ার পর এবং তৃতীয় তালাক দেয়ার পূর্বে স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করার অধিকার স্বামীর রয়েছে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, তার উদ্দেশ্য হতে হবে সমঝোতা, মিল-মহব্বত ও আন্তরিকতার সাথে বসবাস করা, যাতনা দেয়া এবং ঝুলিয়ে রাখার জন্য নয়। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
**********************************
“তাদের স্বামীরা যদি পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনে রাজী হয় তাহলে তারা এ অবকাশের মধ্যে তাদেরকে নিজেদের স্ত্রীরূপে ফিীরয়ে নেয়ার অধিকারী হবে”।– সূরা আল বাকারাঃ২২৮
অমুসলিমদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের কুফল
এ কারণেই মুসলিম নর-নারীকে আহলে কিতাব ছাড়া অন্য সব অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা নিজের ধর্ম, দৃষ্টিভংগী, সমাজ-সংস্কৃতি ও জীবন যাপন প্রণালীর দিক দিয়ে মুসলমানদের থেকে তাদের সাথে এতটা পার্থট্য যে, কেন খাঁটি মুসলমান আন্তরিক ভালোবাসা ও মন-প্রাণের একমুখিনতা নিয়ে তাদের সাথে মিলিত হতে পারে না।
এ বিরোধ সত্ত্বেও যদি তাদের পরস্পরের সাথে সংযোগ হয় তাহলে তাদের এ দাম্পত্য সম্পর্ক কোন খাঁটি সামাজিক সম্পর্ক হিসাবে স্বীকৃত হবে না, বরং তা হবে কেবল একটা যৌন সম্পর্ক। এ সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সৃষ্টি হবে না, আর হলেও তা ইসলামী সমাজ-সংস্কৃতি এবং স্বয়ং সেই মুসলমানের জন্য উপকারী না হয়ে উল্টো ক্ষতির কারণই হবে।
**********************************
“তোমরা মুশরিক নারীদের কখনো বিবাহ করো না, যে পর্যন্ত তারা ঈমান না আনে। বস্তুত একটি ঈমানদার দাসী একটি সম্ভান্ত মুশরিক নারীর চেয়ে অনেক উত্তম, যদিও শেষোক্ত নারী তোমাদের অধিক পসন্দনীয়। তোমরা মুশরিক পুরুষদের সাথে তোমাদের নারীদের বিবাহ দিও না, যে পর্যন্ত না তারা ঈমান আনে। কেননা একটি ঈমানদার দাস একটি সম্ভ্রান্ত মুশরিকের চেয়ে অনেক উত্তম যদিও এ মুশরিক যুবকটি তোমাদের অধিক পসন্দনীয়”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২১
আহলে কিতাবদের ক্ষেত্রে আইন যদিও এর অনুমতি দেয় যে, তাদের নারীদের বিবাহ করা যেতে পারে।[এরপরও আহলে কিতাব পুরুষদের সাথে মুসলিম নারীদের বিবাহ নিষিদ্ধ রয়েছে। কেননা নারীদের স্বভাবের মধ্যে সাধারণত প্রভাবান্বিত হওয়া এবং গ্রহণ করার ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশী। অতএব একটি অমুসলিম পরিবার ও সমাজে অমুসলিম স্বামীর সাথে তার বসবাস করার কারণে এ আশংকা অনেক বেশী থাকে যে, সে তার স্বামীর চালচলন ও আদর্শ গ্রহণ করে বসবে। কিন্তু সে তাদেরকে স্বীয় আদর্শে প্রভাবান্বিত করতে পারবে এটা খুব কমই আশা করা যায। এছাড়া যদি সে তাদের আদর্শ গ্রহণ নাও করে, তবুও এটা নিশ্চিত যে, তাদের এ সম্বন্ধে কেবল একটা জৈবিক সম্পর্ক হিসাবেই থেকে যাবে। অমুসলিম স্বামীর সাথে সমাজের সাথে তার কোন ফলপ্রসূ সামাজিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে।–গ্রন্হকার।] সভ্যতা-সংস্কৃতির মৌল চিন্তার ক্ষেত্রে এক পর্যায়ে আমাদের ও তাদের মধ্যে অংশীদারিত্ব রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামে এটাকে মনঃপূত দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। হযরত কা’ব ইবনে মালিক রা. আহলে কিতাবের এক নারীকে বিবাহ করতে চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিষেধ করলেন এবং নিষেধাজ্ঞার কারণ সম্পর্কে বললেনঃ
**********************************
“সে তোমাকে চরিত্রবান বানাতে পারবে না”।
একথার তাৎপর্য এই যে, এ অবস্থায় তাদের উভয়ের মধ্যে ভালোবাসা ও হৃদ্যতা সৃষ্টি হতে পারে না যা দাম্পত্য সম্পর্কে প্রাণ। হযরত হুযাইফা রা. এক ইহুদী নারীকে বিবাহ করতে চাইলেন। হযরত উমর রা. তাঁকে লিখে পাঠালেন, “এ ইচ্ছা পরিহার করো”। হযরত আলী রা. ও হযরত ইবনে উমর রা. আহলে কিতাব নারীদের বিবাহ করাকে সুস্পষ্ট ভাষায় ‘মাকরূহ’ বলেছেন। আলী রা. মাকরূহ হওয়ার প্রমাণ হিসাবে নিম্নের আয়াত পেশ করেছেনঃ
**********************************
“যে ব্যক্তি মু’মিন সে এমন লোকদের সাথে ভালোবাসা স্থাপন করতে পারে না যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধী”। -সূরা মুজাদালাঃ ২২
সুতরাং দম্পতির মধ্যে যদি প্রেম-ভালোবাসাই না হলো তাহলে এ ধরনের বিবাহ কি কাজে আসবে?
কুফু প্রসংগ
ইসলামী শরীয়াত স্বয়ং মুসলমানদের কাছেও এরূপ দাবি করে যে, সম্পর্ক সেই নারী ও পুরুষের মধ্যে স্থাপিত হোক যাদের মধ্যে সার্বিক দিকের বিচারে প্রেম-ভালোবাসার পরিবেশ গড়ে ওঠার আশা করা যায়। যেখানে এরূপ আশা করা যায় না, সেখানে আত্মীয়তা করা ‘মাকরূহ’। এ কারণেই নবী স. বিবাহের পূর্বে পাত্রী দেখে নেয়ার আদেশ (অথবা অন্তত পরামর্শ) দিয়েছেন।
**********************************
“তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোন নারীকে বিবাহের পয়গাম পাঠায় তখন যতদূর সম্ভব তাকে দেখে নেয়া উচিত যে, তার মধ্যে এমন কোন গুণ আছে কি ন যা তাকে বিবাহ করার জন্য আকৃষ্ট করে”।
এজন্যই বিবাহের ব্যাপারে শরীয়াত ‘কুফু’র বা সমপর্যায়ভুক্ত হওয়ার প্রতি দৃষ্টি রাখা উত্তম মনে করে এবং অসম পর্যায়ের বিবাহকে উপযুক্ত মনে করে না। যে নারী ও পুরুষ নিজেদের নৈতিকতায়, ধর্মানুরাগে, পারিবারিক রীতি-নীতিতে, সামাজিক মর্যাদা ও জীবনযাত্রায় পরস্পর সমপর্যায়ের অথবা প্রায় কাছাকাছি- তাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে ওঠার খুবই আশা করা যায়। তাদের পরস্পরের বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে এও আশা করা যেতে পারে যে, তাদের উভয়ের পরিবারও এ ধরনের আত্মীয়তার ফলে পরস্পর একাত্ম হতে থাকবে। পক্ষান্তরে যাদের মধ্যে এ সমতা বর্তমান নেই তাদের ব্যাপারে খুবই আশংকা রয়েছে যে, তাদের পারিবারিক জীবনে এবং আন্তরিক ও মানকি সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরস্পর একাত্ম হতে পারবে না। স্বামী-স্ত্রী যদিও একাত্ম হয়ে যায় তবুও তাদের উভয়ের পরিবারের একাত্ম হয়ে যওয়ার খুব কমই আশা করা যায়। ইসলামী শরীয়তে ‘কুফু’র ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে মূল বিবেচ্য বিষয়।
উপরে উল্লিখিত উদাহরণ থেকে একথাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, নৈতিক নির্মলতা ও সতীত্ব সংরক্ষণের পর দ্বিতীয় বস্তু, যা ইসলামী দাম্পত্য বিধানের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, তা হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ভালোবাসা ও হৃদ্যতা। যে পর্যন্ত তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে এগুলো বিদ্যমান থাকার আশা করা যায়, ইসলামী বিধান তাদের এ বৈবাহিক সম্পর্ককে যথাযথভাবে হেফাযত করার জন্য পুর্ণ শক্তি ব্যয় করে। কিন্তু যখন এ প্রেম ও ভালোবাসা অবশিষ্ট থাকে না এবং তার পরিবর্তে আন্তরিক শূণ্যতা, পাষাণ মনোবৃত্তি, বিদ্বেষ, মনুষ্যত্বহীনতা, উপেক্ষা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, তখন দাম্পত্য বন্ধনকে খুলে ফেলার দিকেই আইন ঝুঁকে পড়ে। এ সূক্ষ্ম বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করা প্রয়োজন। কেননা যারা এ সূক্ষ্ম বিষয়টিকে উপেক্ষা করে ইসলামী আইনের মূলনীতিগুলোতে এর অংশ ও শাখা-প্রশাখা স্থাপন করে তারা পদে পদে এত মারাত্মক ক্রটি করে যে, এতে আইনের মূল উদ্দেশ্যই বিলুপ্ত হয়ে যায়।