পুরুষের অধিকারসমূহ
যেসব দায়িত্ব পালনের প্রেক্ষিতে পুরুষকে কর্তৃত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে ওপরে তা আলোচনা করা হয়েছে। এখানে দেখা যাক কর্তা হওয়ার কারণে পুরুষের কি কি অধিকার রয়েছেঃ
১. গোপনীয় বিষয়সমূহের হেফাযত করাঃ নারীর ওপর পুরুষের প্রথম অধিকারকে কুরআন মজীদ এমন শব্দে বর্ণনা করেয়ে যার বিকল্প অন্য কোন ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কুরআন বলেঃ
**********************************
“সুতরাং সতী নারীরা তাদের স্বামীদের অনুরক্ত হয়ে থাকে এবং তাদের অবর্তমানে আল্লাহর অনুগ্রহে তার যাবতীয় অধিকার সংরক্ষকারিণী হয়ে থাকে”।–সূরা আন নিসাঃ ৩৪
এখানে ******** বাক্যাংশ দ্বারা স্বামীর যাবতীয় জিনিস যা তার অনুপস্থিতিতে স্ত্রীর কাছে আমানত হিসাবে রক্ষিত থাকে তার হেফাযত করা বুঝানো হয়েছে। এর মধ্যে তার বংশের, তার বীর্যের, তার ইজ্জত-আব্রুর, তার ধন-সম্পদের হেফাযত, মোটকথা এর মধ্যে সবকিছুই এসে যায়। যদি স্ত্রী উপরোল্লেখিত অধিকারসমূহ থেকে কোন একটি অধিকার পূর্ণ করতেও ক্রটি করে তাহলে স্বামী সামনের আলোচনায় উল্লিখিত তার ক্ষমতা ও এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারবে।
২. স্বামীর আনগত্যঃ স্বামীর দ্বিতীয় অধিকার হচ্ছে, স্ত্রী তার আনুগত্য করবে। ******** ‘যারা নেক, সৎ ও চরিত্রসম্পন্না স্ত্রী তার স্বামীর খেদমতগার হয়ে থাকে’।
এ হচ্ছে একটি সাধারণ নির্দেশ, যার ব্যাখ্যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন জিনিস বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ
**********************************
“তাদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে যে, তারা এমন কোন ব্যক্তিকে তোমাদের ঘরে আসতে দিবে না যাকে তোমরা আদৌ পসন্দ করো না”।
**********************************
“স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে তার ঘরের কোন বস্তু সে দান-খয়রাত করবে না। সে যদি এরূপ করে তাহলে এর সওয়াব স্বামীই পাবে। কিন্তু স্ত্রীর হবে গুনাহ। স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী বাড়ীর বাইরে যাবে না”।
**********************************
“স্বামীর উপস্থিতিতে স্ত্রী তার অনুমতি ব্যতিরেকে রমযানের রোযা ছাড়া একদিনও নফল রোযা রাখবে না”।
**********************************
“সর্বোত্তম স্ত্রী হচ্ছে, যখন তুমি তার দিকে তাকাও তখন তোমার অন্তর আনন্দিত হয়ে যায়, যখন তুমি তাকে কোন আদেশ করো, সে তা পালন করে এবং যখন তুমি অনুপস্থিত থাকো, সে তোমার ধন-সম্পদ ও তার ওপর তোমার যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণ করে”।
আনুগত্যের এ সাধারণ আদেশের মধ্যে কেবল একটি জিনিসই ব্যতিক্রম, তা হচ্ছে স্বামী যদি স্ত্রীকে আল্লাহর নাফরমানী করার নির্দেশ দেয় তাহলে এ আদেশ পালন করতে স্ত্রী অস্বীকার করতে পারে, বরং সে তা অস্বীকার করবে। যেমন সে যদি কোন ফরয নামায পড়তে ও ফরয রোযা রাখতে নিষেধ করে বা মদ পানের আদেশ দেয় অথবা শরীয়ত নির্দেশিত পর্দা বর্জন করতে বলে কিংবা তাকে দিয়ে গর্হিত কাজ করাতে চায়, তাহলে স্বামীর এ নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করা স্ত্রীর জন্য শুধু জায়েযই নয়, রবং ফরয। কেননা স্রষ্টার আইন লংঘিত হয়, এমন কাজে সৃষ্টির আনুগত্য করা জায়েয নেই। হাদীসে বর্ণিত আছেঃ
**********************************
“স্রষ্টার নাফরমানীমূলক কাজে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না”।
এ বিশেষ দিকগুলো ছাড়া অন্য সব অবস্থায় স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর জন্য ফরয, তা না করলে সে অবাধ্য বলে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে স্বামী তার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারবে যার বর্ণনা সামনে আসছে।
পুরুষের ক্ষমতাসমূহ
ইসলামী আইন যেহেতু পুরুষকে কর্তা বা পরিচালক বানিয়েছে এবং তার ওপর স্ত্রীর মোহরানা, ভরণ-পোষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করেছে সেহেতু তা পুরুষকে স্ত্রীর ওপর এমন কতকগুলো ক্ষমতা ও এখতিয়ার প্রদার করেছে, যা পারিবারিক জীবনের শৃংখলা বজায় রাখতে, পরিবারে সদস্যদের আমল-আখলাক, চাল-চলন ও সামাজিকতা সংরক্ষণে এবং নিজেদের অধিকারসমূহ বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য তার হাতে থাকা প্রয়োজন। ইসলামী আইনে এসব এখতিয়ারের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং যে সীমার ভেতর এ ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে তাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
১. উপদেশ, সদাচরণ ও শাসনঃ স্ত্রী যদি তার স্বামীর আনুগত্য না করে অথবা তার অধিকার খর্ব করে, তাহলে এ অবস্থায় স্বামীর প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাকে উপদেশ দেয়া। সে তা অমান্য করলে স্বামী তার ব্যবহারের প্রয়োগফল অনুযায়ী কঠোরতা অবলম্বন করবে। এরপরও যদি সে তা মান্য না করে তাহলে তাকে হালকা মারধরও করতে পারে।
**********************************
“আর তোমরা যে সমস্ত নারীর অবাধ্য [‘নুশুষ’ শব্দের অর্থ উচ্চতা, উত্থান। এর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে অধিকার আদায়ে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন- চাই তা স্বামীর পক্ষ থেকে হোক অথবা স্ত্রীর পক্ষ থেকে।-গ্রন্হকার।] হওয়ার আশংকা করো, তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করো, বিছানায় তাদের থেকে দূরে থাকো এবং প্রহার করো। অতপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায় তাহলে তাদের ওপর নির্যাতন চালাবান অজুহাত তালাশ করো না”।–সুরা আন নিসাঃ ৩৪
এ আয়াতে ***************** ‘বিছানায় তাদের ছেড়ে দাও’ বলে শাস্তিস্বরূপ সহবাস বর্জন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইতিপূর্বে উল্লিখিত ‘ঈলা’র আয়াত পৃথক বিছানায় রাখার জন্য একটি স্বাভাবিক সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ মুদ্দত চার মাস। যে স্ত্রী এতটা অবাধ্য ও উদ্ধত মস্তিষ্ক যে, স্বামী অসন্তুষ্ট হয়ে তার সাথে শোয়া পরিত্যাগ করেছে এবং সে এও জানে যে, চার মাস পর্যন্ত এ অবস্থায় বিদ্যমান থাকার পর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশানুযায়ী স্বামী তাকে তালকা দিবে, এরপরও সে নিজের অবাধ্যাচরণ থেকে বিরত হয় না, তাকে বর্জন করাই উপযুক্ত কাজ। চার মাসের সীমা আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষার জন্য যথেষ্ট। এর চেয়ে অধিক কাল পর্যন্ত শাস্তি দেয়া নিস্প্রয়োজন। এতদিন পর্যন্ত তার অবাধ্য আচরণের ওপর অবিচল থাকার পরিণাম হচ্ছে তালাক। এটা জানা সত্ত্বেও সংশোধন না হওয়া এটাই প্রমাণ করে যে, তার মধ্যে আদব-কায়দা শেখার যোগ্যতাই নেই অথবা অন্তত এ স্বামীর সাথে সে সৌজন্যপূর্ণ জীবন যাপন করতে সক্ষম নয়। অনন্তর যে উদ্দেশ্যে একজন পুরুষকে একজন নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়- এ স্ত্রীর মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্যে ব্যাহত হওয়ার আশংকা আছে। এ অবস্থায় স্বামীর যৌনস্পৃহা পূরণ করার জন্য কোন অবৈধ পথে ঝুঁকে পড়ারও আশংকা রয়েছে। স্ত্রীও কোন নৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে পড়তে পারে এবং এও আশংকা আছে যে, যেখানে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যে কেউ এতটা জেদী ও উদ্ধত সেখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি না হওয়ারই কথা।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী (র) থেকে ************ আয়াতের অর্থ প্রসংগে একটি কথা বর্ণিত আছে। তিনি আরবের প্রচলিত প্রবাদকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করে বলেছেন, ‘হিজরুন’ অর্থ বাঁধা। তারা বলে, ***************** ‘হিজরুন’ সে রশিকে বলা হয়, যার দ্বারা উটের পিঠ ও টাঙ্গা একত্র করে বাঁধা হয়। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার বাণী হচ্ছে, যদি সে (স্ত্রী) উপদেশ গ্রহণ না করে, তাহলে তাকে গৃহের মধ্যে বেঁধে (আবদ্ধ) রাখো। কিন্তু এ অর্থ কুরআন মজীদের উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে। *********** শব্দের মধ্যে কুরআন স্বীয় উদ্দেশ্যের দিকে সুস্পষ্ট ইংগিত করেছে। *********** শোয়ার জায়গাকে বলা হয়। অতএব শোয়ার ‘জায়গা’র স্থলে ‘বাঁধা’ অর্থ সর্ম্পূর্ণ নিরর্থক।
দ্বিতীয় শস্তি, যার অনুমতি অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় দেয়া হয়েছে, তা হচ্ছে মারধোরের শাস্তি। কিন্তু নবী করীম (স) এজন্য শর্ত আরোপ করেছেন যে, বেদম মার যেন না হয়।
**********************************
“যদি তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের কোন ন্যায়সংগত আদেশের ‘বিরুদ্ধাচরণ করে তাহলে তাদেরকে এরূপ মারধোর করো যেন তা অধিক যন্ত্রণাদায়ক না হয়। মুখাবয়বে আঘাত করা যাবে না এবং গালি-গালাজও করা যাবে না”।
এ দুই ধরনের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা পুরুষকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উল্লিখিত নির্দেশ অনুযায়ী অবাধ্যতা ন্যায্য অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট হলেই কেবল শাস্তি দেয়া যাবে। ন্যায়-অন্যায় প্রতিটি আদেশ মানার জন্য জোর-জবরদস্তি করা যাবে না এবং স্ত্রী তা অমান্য করলেই তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না। তাছাড়া অপরাধ ও শাস্তির মধ্য সামঞ্জস্য থাকতে হবে। ইসলামী আইনের মূলনীতিসমূহের মধ্যে এও এক মূলনীতিঃ
**********************************
“যে কেউ তোমাদের সাথে বাড়াবাড়ি করে তোমরাও তার সাথে অনুরূপ পরিমাণ বাড়াবাড়ি করো”।–সূরা আল বাকারাঃ ১৯৪
বাড়াবাড়ির তুলনায় অধিক শাস্তি দেয়া হচ্ছে যুলুম। যে অপরাধের ক্ষেত্রে উপদেশই যথেষ্ট সেখানে কথাবার্তা বন্ধ রাখা যেখানে কথাবার্তা বন্ধ রাখাই যথেষ্ট সেখানে সহাবস্থান বর্জন করা এবং যে ক্ষেত্রে বিছানা পৃথক করে দেয়াই যথেষ্ট সেখানে মারধোর করা যুলুম পরিগণিত হবে। কেননা মারধোর হচ্ছে সর্বশেষ শাস্তি, যা কেবল মারাত্মক ও অসহনীয় অপরাধের জন্যই দেয়া যেতে পারে। কিন্তু সেখানেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত সীমার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ সীমালংঘর করলে স্বামীর বাড়াবাড়ি হবে এবং এ ক্ষেত্রে স্ত্রী তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকারিণী হবে।
২. তালাকঃ পুরুষকে দ্বিতীয় যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা হলো, যে স্ত্রীর সাথে সে মিলেমিশে বসবাস করতে পারবে না তাকে তালাক দিবে। যেহেতু পুরুষ তার নিজস্ব ধন-সম্পদ ব্যয় করেই স্বামীত্বের অধিকার বর্জন করে, সেহেতু সে সমস্ত অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার ক্ষমতাও তাকে দেয়া হয়েছে। [একদল লোক পাশ্চাত্যের অনুকরণে এটা চাচ্ছে যে, তালকা দেয়ার ক্ষমতা স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আদালতকে দেয়া হোক। যেমন তুরস্কে এরূপ করা হযেছে। কিন্তু এটা চূড়ান্তরূপে কুরআন ও সুন্নাতের পরিপন্হী। কুরআন তালাকের আহকাম বর্ণনা করতে গিয়ে প্রতিটি স্থানে তালাকের ক্রিয়াকে স্বামীর দিকে নির্দেশ করেছেঃ ************** ইত্যাদি। এ থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, তালাক দেয়ার ক্ষমতা কেবল স্বামীকে দেয়া হয়েছে। আবার কুরআন পরিষ্কার ভাষায় স্বামীর সম্বন্ধে বলে *************** “বিবাহের বন্ধর তার (স্বামীর) হাতে”।–সূরা আল বাকরাঃ২৩৭
এখন কার এ অধিকার আছে যে, এ বন্ধনকে তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বিচারকের হাতে তুলে দিবে? ইবনে মাজা গ্রন্হে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা), থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। এক ব্যক্তি নবী করীম (স)-এর কাছে এসে অভিরোগ করলো, “আমার মালিক তার এক দাসীকে আমার সাথে বিবাহ দিয়েছিল। এখন সে তাকে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়”। এ প্রসংগে রাসূলূল্লাহ (স) তার ভাষণে বললেনঃ
**********************************
“হে লোকেরা! এ কেমন অদ্ভূত কথা যে, তোমাদের কেউ নিজের দাসীকে স্বীয় দাসের সাথে বিবাহ দেয়, আাবর উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে চায়? অথচ তালাকের ক্ষমতা কেবল স্বামীদেরই”।
এ হাদীসটি যদিও সনদের দিক থেকে মযবূত নয়, কিন্তু কুরআনের নির্দেধের সাথে এর সাঞ্জস্য একে শক্তিশালী করেছে। সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী অনুযায়ী তালাক দেয়ার ক্ষমতা স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বিচারালয়ের হাতে তুলে দেয়া কখনো জায়েয নয়। যুক্তির দিক থেকেও তা হচ্ছে ভ্রান্ত পদক্ষেপ। এর পরিণাম এছাড়া আর কি হতে পারে যে ইউরোপের মত আমাদের এখানেও পারিবারিক জীবনের লজ্জাকর বিবাদসমূহ ও অশোভনীয় ঘটনাবলী প্রকাশ্য আদালতের সামনে প্রচারিত হতে থাকবে?-গ্রন্হকার।]
নারীকে এ ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে না। কেননা যদি সে তালাক দেয়ার অধিকারী হতো তাহলে সে পুরুষের অধিকার খর্ব করার ব্যাপারে নির্ভীক হয়ে যেত। এটা সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি নিজের অর্থ বৌয় করে কোন জিনিস হাসিল করে, সে তা রক্ষা করার জন্য শেষ চেষ্টা করে যাবে এবং কেবল তখনই তা ত্যাগ করবে যখন তা বর্জন করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকবে না। কিন্তু যদি অর্থ ব্যয় করে এক পক্ষ এবং তাদ্বারা হাসিল করা বস্তু ধ্বংস করার ক্ষমতা অপর পক্ষের জুটে যায়, তাহলে এ দ্বিতীয় পক্ষের কাছ থেকে এটা কমই আশা করা যায় যে, সে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার বেলায় অর্থ ব্যয়কারী প্রথম পক্ষের লাভের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। সুতরাং পুরুষের হাতে তালাক প্রদান করা শুধু তার ন্যায্য অধিকার রক্ষা করাই নয়, বরং এর ভেতর আর একটি বিচক্ষণতা নিহিত রয়েছে যে, এতে তালাকের ব্যবহার ব্যাপরভাবে হবে না।
দ্বিতীয় মূলনীতি
ইসরঅমের দাম্পত্য আইনের দ্বিতীয় মূলনীতি হচ্ছে, বৈবাহিক সম্পর্ককে যথাসাধ্য সুদৃঢ় করা এবং যে পুরুষ ও নারী একবার আত্মীয়তার এ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে তাদের পরস্পরকে একত্রে গ্রথিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা। কিন্তু যখন তাদের মাঝে ভালোবাসা ও মিলমিশের কোন উপায়ই আর অবশিষ্ট থাকে না এবং তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকায় আইনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়, তখন তাদের ঘৃণা-বিদ্বেষ ও আন্তরিক গরমিল থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের সাথে একত্র হয়ে থাকার জন্য জোরাজুরি করা উচিত নয়। এমতাবস্থায় তাদের বিচ্ছেদের পথ খুলে দেয়াই হবে তাদের ও সমাজের জন্য কল্যাণকর। এ ব্যাপারে ইসলামী আইন মানব স্বভাবের প্রবণতা এবং সামাজিক শৃংখলা ও অখণ্ডতা রক্ষার মধ্যে এমন সঠিক ভাসাম্য স্থাপন করেছে, যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন আইন-বিধানেই পাওয়া যাবে না। একদিকে তা বৈবাহিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে চায়। কিন্তু তা হিন্দু ও খৃস্ট ধর্মের মত নয়। এ দুই ধর্মে স্বামী-স্ত্রীর জন্য বৈবাহিক জীবনটা যত যন্ত্রণাদায়কই হোক না কেন, কোন অবস্থায়ই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে পারবে না। অপর দিকে ইসলামী আইন বিচ্ছেদের পথ খুলে দেয়্। কিন্তু তাও রাশিয়া, আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশের মত এত সহজে নয়। এসব দেশে বৈবাহিক সম্পর্কের কোন স্থায়িত্ব মোটেই অবশিষ্ট নেই। সেখানে দাম্পত্য সম্পর্কের দুর্বলতার ফলে পারিবারিক জীবনের সমস্ত শৃংখলা ছিন্নভিন্ন হতে চলেছে।
এ মূলনীতির অধীনে বিচ্ছেদের যে সমস্ত পন্তা রাখা হয়েছে তার সংখ্যা তিনঃ তালাক, খোলা ও বিচারকের ফায়সালা।
তালাক ও এর শর্তসমূহ
শরীয়তের পরিভাষায় ‘তালাকে’র অর্থ হচ্ছে ‘বিচ্ছেদ’ যার অধিকার পুরুষকে দেয়া হয়েছে। পুরুষ তার এ অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীন। সে যখনই চায় তার এ দাম্পত্য অধিকারসমূহ থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারে, যা সে মোহরেরর বিনিময়ে অর্জন করেছে। কিন্তু শরীয়ত তালাক পসন্দ করে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীঃ
**********************************
“সমস্ত হালাল বস্তুর মধ্যে তালাকই হচ্ছে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত”।
**********************************
“বিবাহ করো কিন্তু তালাক দিও না। কেননা আল্লাহ তায়ালা স্বাদ অস্বেষণকারী ও স্বাদ অন্বেষণকারিণীদের পসন্দ করেন না”।
এজন্য পুরুষকে তালাকের স্বাধীন এখতিয়ার দেয়ার সাথে সাথে তাকে কতগুলো শর্তেরও অধীন করে দেয়া হয়েছে। সে এ শর্তের আওতাধীনে কেবল সর্বশেষ হাতিয়ার হিসাবে তার এ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারবে।
কুরআন মজীদের শিক্ষা হচ্ছে-স্ত্রী যদি তোমার অপসন্দনীয়ও হয় তবুও যথাসাধ্য তার সাথে সদ্ভাবে মিলেমিশে জীবন যাপন করার চেষ্টা করো।
মহান আল্লাহ বলেনঃ
**********************************
“তোমরা (স্বামরা) তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করো। তারা (স্ত্রীরা) যদি তোমাদের মনের মতো না হয়, তাহলে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোন জিনিসকে অপসন্দ করো, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের জন্য তার মধ্যে অফুরন্ত কল্যাণ রেখে দিয়েছেন”।–সূরা আন নিসাঃ ১৯
কিন্তু যদি মিলেমিশে না-ই থাকতে পারো তাহলে তোমার এ অধিকার আছে যে, তাকে তালাক দাও। কিন্তু এক কথায় বিদায় করে দেয়া জায়েয নয়। এক এক মাসের ব্যবধানে এক এক তালাক দাও। তৃতীয় মাসের শেষ নাগাদ তৃমি চিন্তা-ভাবনার সুযোগ পাবে। হয়ত বা সমঝোতার কোন উপায় বেরিয়ে আসবে অথবা স্ত্রীর আচরণের মধ্যে পসন্দনীয় কোন পরিবর্তন এসে যেতে পারে কিংবা স্বয়ং তোমার অন্তরও পালটে যেতে পারে। অবশ্য এ সময়-সুযোগের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও বুঝাপড়া সত্ত্বেও স্ত্রীকে যদি ত্যাগ করাই তোমার সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে তৃতীয় মাসে শেষ তালাক দাও অথবা পুনঃগ্রহণ (রুজু) না করে ইদ্দাত অতিবাহিত হতে দাও। [ সর্বোত্তম পন্হা এই যে, তৃতীয়বার তালাক না দিয়ে এমনিতেই ইদ্দাতের সময় অতিবাহিত হতে দেয়া। এ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী ইচ্ছা করলে তাদের মধ্যে পুনর্বার বিবাহ হওয়ার সুযোগ অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু তৃতীয়বার তালাক দিলে তা ‘মুগাল্লাযা’ বা চূড়ান্ত তালাকে পরিণত হয়। এরপর তাহলীল ছাড়া প্রাক্তন স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পুনরায় বিবাহ হতে পারে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, লোকের সাধারণত এ মাসয়ালা সম্পর্কে অবহিত নয় এবং যখন তালাক দিতে উদ্যত হয়, একত্রে তিন তালাক ছুঁড়ে মারে। পরে অনুতপ্ত হয় এবং মুফতীদের কাছে গিয়ে ছল-চাতুরী করে বেড়ায়।–গ্রন্হকার।]
**********************************
“তালাক হচ্চে দুবার। অতপর হয় উত্তম পন্হায় ফিরিয়ে রাখতে হবে অথবা ভদ্রভাবে বিদায় করে দিতে হবে”।–সূরা আল বাকারাঃ ২২৯
**********************************
“যেসব স্ত্রীলোককে তালাক দেয়া হয়েছে তারা তিনবার মাসিক ঋতু আসা পর্যন্ত নিজেদেরকে (পুনর্বিবাহ থেকে) বিরত রাখবে।… তাদের স্বামীরা যদি পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করতে রাজী হয় তাহলে তারা এ অবকাশের মধ্যে তাদেরকে নিজেদের স্ত্রীরূপে ফিরিয়ে নেয়ার অধিকারী হবে”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২৮
এর সাথে সাথে এ নির্দেশও রয়েছে যে, তিন মাসের এ সময়ের মধ্যে স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দিও না, বরং নিজের কাছেই রাখো। আশা করা যায় সহঅবস্থানের ফলে পুনরায় আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনের কোন উপায় বের হয়ে যাবে।
**********************************
“তোমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দাও, তাদেরকে তাদের ইদ্দাতের মধ্যে পুনঃগ্রহণের সুযোগ রেখেই তালাক দাও। ইদ্দাতের সময় গুণতো থাকো এবং তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা (ইদ্দাত চলাকালে) তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দিও না এবং তারাও বের হয়ে যাবে না। তবে তোমরা কেবল তখনই তা করতে পারো যখন তারা প্রকাশ্যে কোন মন্দ কাজে লিপ্ত হয়। এ হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমালংঘন করে সে নিজের ওপর অত্যাচার করে। তুমি জানো না, হয়ত বা এরপর আল্লাহ সমঝোতার কোন একটা অবস্থা সৃষ্টি করে দিবেন। অতপর যখন তারা ইদ্দাতের নির্দিষ্ট সময়ের সমাপ্তিতে পৌঁছবে, তখন হয় তাদেরকে ভালোভাবে ফিরিয়ে রাখো অথবা উত্তম পন্হায় তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাও”।–সূরা আত তালাকঃ ১-২
তাছাড়া মাসিক ঋতু (হায়েয) অবস্থায় তালাক দিতে নিষেধ করা হয়েছে এবং আদেশ দেয়া হয়েছে, যদি তালাক দিতেই হয় তাহলে তুহর (পবিত্র) অবস্থায় তালাক দাও। এর দুটি কারণ রয়েছেঃ
একঃ হায়েয অবস্থায় নারীরা সাধারণত খিটখিটে মেযাজ ও চঞ্চলমতি হয়ে যায়। এ সময় তাদের শারীরিক ব্যবস্থার মধ্যে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে যে, তাদের থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে এমন সব কথাবার্তা প্রকাশ পায়, যা তারা নিজেরও স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকাশ করা পসন্দ করে না। এ হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নিগূঢ় তত্ত্ব। এজন্য হায়েয অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে বিবাদ ঘটে তার ভিত্তিতে তালাক দিতে নিষেধ করা হয়েছে।
দুইঃ এ সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক থাকে না, যা তাদের পারস্পরিক চিত্তাকর্ষণ ও প্রেম-ভালোবাসার একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এ সময় উভয়ের মাঝে তিক্ততা সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এ প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যাওয়ার পর আশা করা যায়, যৌন আকর্ষণ পুনরায় স্বামী-স্ত্রীকে দুধ-চিনির মতো পরস্পর মিলিয়ে দিবে এবং যে মলিনতা স্বামীকে তালাক দেয়ার দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছিল তা দূর হয়ে যাবে।
এসব কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাহ হায়েয অবস্থায় তালাক দিতে নিষেধ করেছেন। হাদীসে এসেছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাঁর স্ত্রীকে হায়েয অবস্থায় তালাক দিয়েছিলেন। হযরত উমর রা. এ ঘটনা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন। তিনি তা শুনে খুব রাগান্বিত হলেন এবং বললেনঃ তাকে আদেশ কারো সে যেন স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় এবং যখন সে মাসিক ঋতু থেকে পবিত্র হবে তখন তালাক দেবে। অপর এক হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে উমরকে তাঁর এ কাজের জন্য তিরস্কার করেছেন এবং তালাক দেয়ার নিময় এভাবে শিখিয়ে দিয়েছেনঃ
ইবনে উমর! তুমি ভুল পন্হা অবলম্বন করেছ। সঠিক পন্হা এই যে, তুমি তুহরের অপেক্ষা করো। অতপর প্রতি তুহরে এক তালাক দাও। অপর সে যখন (তৃতীয়বার) পাক হবে তখন হয় তাকে তালাক দাও অথবা ফিরিয়ে রাখো। ইবনে উমর (রা) বললেনঃ
**********************************
“হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি তাকে একত্রে তিন তালাক দিতাম তাহলেও কি আমার রুজু করার অধিকার বাকি থাকতো?”
রাসূলূল্লাহ স. বললেনঃ
**********************************
“না, সে আলাদা হয়ে যেত এবং এটা গুনাহের কাজ হতো”।
এ থেকে আরো একটি কথা জানা গেলো, তা হচ্ছে- একই সময়ে তিন তালাক দেয়া মস্তবড় গুনাহ। এরূপ কাজ মূলত ইসলামী শরীয়তের সতর্ক নীতির পরিপন্হী। এতে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘিত হয়, যার মর্যাদা দেয়ার জন্য সূরা তালাকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।[যেমন আমরা একটু আগেই বলে এসেছি- যে দাম্পত্য সম্পর্ক একবার একজন মহিলা ও একজন পুরুষের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে, যতদূর সম্ভব বা টিকিয়ে রাখাই হচ্ছে শরীয়াতের লক্ষ্য। আর যদি তা ছিন্ন করতেই হয়, তাহলে যখন সমঝোতা ও আপোষ-মীমাংসার যাবতীয় সুযোগ শেষ হয়ে যায় কেবল তখনই তা ভাঙতে হবে। এজন্য শরীয়তের দাবি হচ্ছে- যদি কেউ তালাক দিতে চায়, সে যেন চিন্তা-ভাবনা করেই তালাক দেয় এবং তালাক দেয়ার পরও আপোষ-মীমাংসা ও সংশোধনের দরজা তিন মাস পর্যন্ত খোলা থাকে। কিন্তু যে ব্যক্তি একই সময়ে তিন তালাক দেয়, সে এক আঘাতেই এসব সুযোগ শেষ করে দেয়।–গ্রন্হকার।]
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, যে কোন ব্যক্তি একই বৈঠকে তিন তালাক দিয়ে তাঁর কাছে আসতো, তিনি তাকে দৈহিক শাস্তি দিতেন এবং স্বামী-স্ত্রীকে পৃথক করে দিতেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, এক ব্যক্তি একই সময় তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে, এর হুকুম কি? তিনি বললেনঃ
**********************************
“সে তার প্রতিপালকের নির্দেশ লংঘন করেছে এবং তার স্ত্রী তার থেকে পৃথক হয়ে গেছে”।
হযরত আলী (রা) বলেছেনঃ
**********************************
“মানুষ যদি তালাকের যথার্থ সীমার দিকে লক্ষ্য রাখতো, তাহলে কোন ব্যক্তিকেই নিজ স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হতো না”।
তালাকের পথে এতটা প্রতিবন্ধকতা রাখার পর সর্বশেষ এবং সবচেয়ে কঠিন যে প্রতিবন্ধক রাখা হয়েছে তা হচ্ছে, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ‘মুগাল্লাযা তালাক’ [‘তালাকে মুগাল্লাযা; অর্থাৎ তিন তালাক। এরপর এ স্ত্রীলোকটি পুনর্বার তার স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্দ হতে পারবে না, যতক্ষণ অন্য ব্যক্তির সাথে তার বিবাহ হযে আবার বিচ্ছেদ না হবে।–গ্রন্হকার।] দিবে, সে এ স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ করতে পারবে না, যে পর্যন্ত সে অপর ব্যক্তির কাছে বিবাহ না বসবে এবং সে ব্যক্তিও তাকে ভোগ করার পর স্বেচ্ছায় তালাক না দিবে। মহান আল্লাহর বাণীঃ
**********************************
“অতপর (দুই তালাক দেয়ার পর) স্বামী যদি স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়, তবে এ স্ত্রীলোকটি তার জন্য হালাল (পুনরায় বিবাহযোগ্য) হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে অন্য পুরুষ তার সাথে বিবাহ না করবে এবং সে তাকে স্বেচ্ছায় তালাক না দিবে। (দ্বিতীয় স্বামী তালাক দেয়ার পর) যদি তারা মনে করে যে, তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা বজায় রেখে জীবন যাপন করতে পারবে তাহরে তাদের পুনঃবিবাহে কোন দোষ নেই”।–সূরা আল বাকারাঃ২৩০
এ হচ্ছে এমন এক কঠিন শর্ত, যার কারণে কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তৃতীয় তালাক দেয়ার পূর্বে শতবার চিন্তা করতে বাধ্য হবে। যতক্ষণ সে ভালো করে চিন্তা-ভাবনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে না পৌঁছবে যে, এ স্ত্রীর সাথে তার বসবাস করা আর সম্ভব নয়- ততক্ষণ সে তৃতীয় তালাকের নামও নেবে না।
কতিপয় লোক এ শর্ত থেকে বাঁচার জন্য ছল-চাতুরীর আশ্রয় নেয়। যেমন কোন ব্যক্তি স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়ার পর লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে পুনরায় তাকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করে। এমতাবস্থায় সে এ স্ত্রীকে অন্য কোন ব্যক্তির সাথে বিবাহ দেয়। অতপর তাকে কিছু অর্থ দিয়ে স্ত্রীর সাথে নির্জনবাসের পূর্বেই তার থেকে তালাক আদায় করে নেয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছেন যে, তাহলীল (অর্থাৎ পূর্ব স্বামীর জন্য হালাল) করার উদ্দেশ্যে কেবল বিবাহই যথেষ্ট নয়। যে পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী তার থেকে যৌনতৃপ্তি লাভ না করবে ততক্ষণ সে প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হবে না। রাসূলুল্লাহ স. বলেনঃ
**********************************
“দ্বিতীয় স্বামী তার মধু এবং সে এ দ্বিতীয় স্বামীর মধু এবং সে এ দ্বিতীয় স্বামীল মধু (যৌন স্বাদ) পান না করা পর্যন্ত সে প্রথম স্বামীর জন্য হালাল (বিবাহযোগ্য) হবে না”।
যে ব্যক্তি তার তারাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে কেবল নিজের জন্য হালাল করার উদ্দেশ্যে অন্যের সাথে বিবাহ দেয়, আর যে ব্যক্তি এ উদ্দেশ্যে বিবাহ করে, এদের উভয়কে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন।
**********************************
এরূপ ব্যক্তিকে তিনি ******** অর্থাৎ ভাড়াটে ষাঁড়ের সাথে তুলনা করেছেন। বাস্তবিক পক্ষে এ ধরনের বিবাহ আর যেনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
যেসব আলেম মানুষকে এ প্রকাশ্য হারাম এবং অত্যন্ত গর্হিত ও লজ্জাকর ছল-চাতুরীর পক্ষে ফতোয়া দিয়ে থাকেন তাদের ব্যাপারে হতবাক হতে হয়।
খোলা
ইসলামী শরীয়ত যেভাবে পুরুষকে এ অধিকার দিয়েছে যে, সে যে স্ত্রীকে পসন্দ করে না অথবা যার সাথে কোন রকমেই তার বসবাস করা সম্ভব নয়- তাকে সে তালাক দিতে পারে; অনুরূপভাবে স্ত্রীকেও এ অধিকার দিয়েছে যে, সে যে পুরুষকে পসন্দ করে না বা যার সাথে তার কোন মতেই বসবাস করা সম্ভব নয়-সে তার থেকে খোলা করিতে নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দেশের দুটি দিক রয়েছেঃ এক. নৈতিক দিক, দই. আইনগত দিক।
নৈতিক দিক এই যে, চাই পুরুষ হোক অথবা স্ত্রীলোক, প্রত্যেকে তালাক অথবা খোলার ক্ষমতা কেবল অনন্যোপায় অবস্থায় সর্বশেষ হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা উচিত। শুধু যৌনচর্চার উদ্দেশ্যে তালাক ও খোলাকে যেন খেলনায় পরিণত করা না হয়। হাদীসের গ্রন্হসমূহে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশসমূহ বিবৃত হয়েছেঃ
**********************************
“নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা স্বাদ অন্বেষণকারী ও স্বাদ অন্বেষণকারিণীদের আদৌ পসন্দ করেন না”।
**********************************
“বারবার তালাকের পথ অবলম্বন করে অবাধ যৌনচর্চাকারীদের আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন”।
**********************************
“যে স্ত্রীলোক স্বামীর কোনরূপ ক্রটি ও বাড়াবাড়ি ছাড়াই খোলার আশ্রয় নেয়, তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল ও মানব জাতির অভিসম্পাত। খোলাকে খেলনায় পরিণতকারী স্ত্রীলোকেরা মুনাফিক”।
কিন্তু আইন- যার কাজ হচ্ছে ব্যক্তির অধিকার নির্ধারণ করা, তা নৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা করে না; তা পুরুষকে স্বামী হওয়ার প্রেক্ষিতে যেমন তালাকের অধিকার দেয়, অনুরূপভাবে নারীকে স্ত্রী হওয়ার প্রেক্ষিতে খোলার অধিকার দেয়, যেন উভয়ের জন্য প্রয়োজনবোধে বিবাহ বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা সম্ভব হয় এবং কোন পক্ষকেই যন এমন অবস্থায় না ফেলা হয় যে, অন্তরে ঘৃণা জমে আছে, বিবাহের উদ্দেশ্যেও পূর্ণ হচ্ছে না, অথচ দাম্পত্য সম্পর্ক একটা বিপদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন অপরজনের সাথে কেবল এ কারণেই বন্দী হয়ে আছে যে, এ বন্দীখানা থেকে মুক্তি লাভের কোন উপায় নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে? এ ক্ষেত্রে আইন যতদূর সম্ভব যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপ করে। কিন্তু ন্যায় অথবা অন্যায়ভাবে ক্ষমতার ব্যবহার হওয়াটা স্বয়ং ক্ষমতা ব্যবহারকারীর যাচাই ক্ষমতা, তার সততা, ন্যায়-ইনসাফ ও আল্লাহ ভীতির ওপর অনেকটা নির্ভর করে। সে নিজে ও তার আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ এ বিচার করতে পারে না যে, সে কেবল অবাধ যৌনচর্চার উদ্দেশ্যে এ ক্ষমতা ব্যবহার করছে, না আসলে এ অধিকার ব্যবহার করার তার বৈধ প্রয়োজন। আইন তাকে তার প্রাপ্য অধিকার দেয়ার পর তা অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার জন্য সে কেবল প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ তার ওপর আরোপ করতে পারে।
আপনারা তালাকের আলোচনায় দেখেছেন যে, পুরুষকে তার স্ত্রী থেকে আলাদা হওয়ার অধিকার দেয়ার সাথে সাথে তার ওপর বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়েছে। যেমন সে স্ত্রীকে মোহরানারূপে যা কিছু দিয়েছে এর ক্ষতি তাকে সহ্য করতে হবে, হায়েয চলাকালীন তালাক দিতে পারবে না, প্রতি তুহরে এক এক তালাক দিবে, ইদ্দাতের সময় স্ত্রীকে নিজের ঘরে রাখতে হবে। অতপর যখন সে তিন তালাক দিবে তখন তাহলীল ছাড়া এ স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ করতে পারবে না। অনুরূপভাবে স্ত্রীকেও খোলার অধিকার দেয়ার সাথে সাথে তার প্রতিও কতগুলো শর্ত আরোপ করে দেয়া হয়েছে, যা কুরআন মজীদের এ সংক্ষিপ্ত আয়াতে পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
**********************************
“তোমরা স্ত্রীদের যা কিছু দিয়েছ (তালাকের সময়) তা থেকে সামান্য কিছুও ফেরত নেয়া তোমাদের জন্য হালাল নয়। কিন্তু তারা উভয়ে যদি আশংকা করে যে, তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অটুট রাখতে পারবে না (তবে এটা স্বতন্ত্র অবস্থা)। তোমরা যদি আশংকা করো যে, স্বামী-স্ত্রী আল্লাহর সীমা রক্ষা করে জীবন যাপন করতে পারবে না- এমতাবস্থায় স্ত্রী যদি কিছু বিনিময় প্রদান করে বিবাহের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায় তাতে কোন দোষ নেই”।–সূরা আল বাকারাঃ ২২৯
এ আয়াত থেকে আইনের নিম্নলিখিত ধারাসমূহ পাওয়া যায়ঃ
এক. এমন অবস্থায় খোলার আশ্রয় নিতে হবে যখন আল্লাহর সীমা লংঘিত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। ‘ফালা জুনাহা আলাইহিমা’ শব্দগুলো থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, যদিও ‘খোলা’ একটি মন্দ জিনিস, যেমন তালাক একটি মন্দ জিনিস, কিন্তু যখন এ আশংকা হয় যে, আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘিত হয়ে যাবে তখন খোলা করে নেয়ার মধ্যে কোন দোষ নেই।
দুই. স্ত্রী যখন বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায় তখন তাকেও আর্থিক ক্ষতি মেনে নিতে হবে, যেভাবে পুরুষ স্বেচ্ছায় তালাক দিলে তাকেও আর্থিক ক্ষতি মেনে নিতে হয়। কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে স্বেচ্ছায় তালাক দিলে সে স্ত্রীর কাছ থেকে মোহরানা হিসাবে প্রদত্ত অর্থের সামান্য পরিমাণও ফেরত নিতে পারে না। যদি স্ত্রী বিচ্ছেদ কামনা করে তাহলে সে স্বামীর কাছ থেকে মোহরানার আকারে যে অর্থ গ্রহণ করেছিল তার অংশবিশেষ অথবা সম্পূর্ণটা ফেরত দিয়ে স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে।
তিন. ********** অর্থাৎ বিনিময় প্রদান করে মুক্তিলাভ করার জন্য শুধু বিনিময় প্রদানকারীর ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়, বরং এ ব্যাপারটির আপোষ নিষ্পত্তি তখনই হবে যখন বিনিময় গ্রহণকারীও এতে সম্মত হবে অর্থাৎ স্ত্রী শুধু কিছু পরিমাণ অর্থ পেশ করে নিজেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারে না, বরং তার দেয়া অর্থ গ্রহণের বিনিময়ে স্বামীর তালাক দেয়া বিচ্ছিন্নতার জন্য অপরিহার্য।
চার. ‘খোলা’র জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, স্ত্রী তার সম্পূর্ণ মোহরানা অথবা তার এক অংশ পেশ করে বিচ্ছেদের দাবি তুলবে এবং পুরুষ তা গ্রহণ করে তাকে তালাক দিবে। ‘ফালঅ জুনাহা আলাইহিমা ফীমাফতাদাত বিহী’- বাক্যাংশ থেকৈ জানা যায়, খোলার কাজটি উভয় পক্ষের সম্মতিতে সম্পন্ন হয়ে যায়। যেসব লোক খোলার কাজ সম্পন্ন হওয়ার জন্য আদালতের ফয়সালাকে শর্ত হিসাবে জুড়ে দেয়- এ আয়াতের মাধ্যমে তাদের ধারণার অপনোদন হয়ে যায়। যে বিষয়গুলো পরিবারের অভ্যন্তরে মীমাংসা করা সম্ভব তা আদালত পর্যন্ত নিতে যাওয়া ইসলাম আদৌ পসন্দ করে না।
পাঁচ. যদি স্ত্রী ‘ফিদয়া’ (মুক্তির বিনিময়) পেশ করে এবং স্বামী তা গ্রহণ না করে, তাহলে এ অবস্থায় স্ত্রীর জন্য আদালতের আশ্রয় নেয়ার অধিকার আছে। যেমন উপরোল্লিখিত আয়াতে- ‘ফাইন খিফতুম আল্লা ইউকীমা হুদূদাল্লাহ’- থেকে প্রকাশ্যভাবে জানা যায়। এ আয়াতে ‘খিফতুম’ বলে মুসলমানদের ‘উলিল আমর’ বা সরকারী কর্মকত্যাকেই সম্বোধন করা হয়েছে। যেহেতু আমীর বা শাসকদের সর্বপ্রথম দায়িত্বই হচ্ছে আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত সীমার হেফাযত করা, তাই যখন আল্লাহর সীমা লংঘিত হওয়ার আশংকা প্রকাশ পায় তখন তার কর্তব্য হচ্ছে এ সীমারেখার হেফাযত করার জন্য আল্লাহ তাআলা তাকে (স্ত্রীকে) যেসব অধিকার দিয়েছেন তা তাকে দেয়ার ব্যবস্থা করা।
এ হচ্ছে সংক্ষিপ্ত নির্দেশ। এখানে একথার বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই যে, আল্লাহর সীমালংঘন হওয়ার আশংকা কোন কোন অবস্থায় সাব্যস্ত হবে? ‘ফিদায়া’র পরিমাণ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ইনসাফ কিভাবে হবে? স্ত্রী যদি ফিদয়া দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু স্বামী যদি তা গ্রহণ না করে, তাহলে এ অবস্থায় বিচারকের কোন পন্হা অবলম্বন করা উচিত? নবী করীম (স) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সামনে খোলার যেসব মোকদ্দমা এসেছিলম তার কার্যবিবরণী থেকে আমরা এসব প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব পেয়ে যাবো।