আইনের মূলনীতিঃ প্রথম মূলনীতি
আইনের উদ্দেশ্য অনুধাবন করার পর আমাদের দেখতে হবে, ইসলামী দাম্পত্য বিধান কোন সব মূলনীতির ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। কেননা যতক্ষণ মূলনীতিগুলো যথাযথভাবে জানা না যাবে ততক্ষণ ছোটখাট ব্যাপারে আইনের নির্দেশাবলী সঠিক পন্হায় প্রয়োগ করা কষ্টকর হবে।
আইনের মূলনীতিগুলোর মধ্যে প্রথম মূলনীতি হচ্ছে, দাম্পত্য জীবনে পুরুষকে নারীর চেয়ে একধাপ বেশী মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এখান থেকে আইনের অনেক ধারা-উপধারা পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেনঃ
**********************************
“অবশ্য পুরুষদের জন্য তাদের ওপর একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে”।
-সূরা আল বাকারাঃ ২২৮
এ অধিক মর্যাদার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে নীচের আয়াতেঃ
**********************************
“পুরুষরা নারীদের পরিচালক। কেননা আল্লাহ তাদের একজনকে অপরজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং পুরুষ নিজের ধন-মাল ব্যয় করে। সুতরাং সতী নারী তার স্বামীর অনুরক্ত হয়ে থাকে এবং তাদের অবর্তমানে আল্লাহর অনুগ্রহে তাদের যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণকারিণী হয়ে থাকে”।–সূরা আন নিসাঃ ৩৪
এখানে এ আলোচনার অবকাশ নেই যে, পুরুষকে কিসের ভিত্তিতে নারীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে এবং কেনই বা তাকে কর্তা বানানো হয়েছে? [**** ‘কাওয়াম’ (Sustainer, Provider) কর্তা, রক্ষক, (Protector), অভিভাবক, পরিচালক।–গ্রন্হকার।] কারণ এটা আইনের আলোচ্য বিষয় নয়; বরং সমাজ দর্শনের আলোচ্য বিষয়। অতএব আমরা এখানে বিষয়বস্তুর গণ্ডির ভেতর থেকে এ কথার ব্যাখ্যা দেয়াই যথেষ্ট মনে করছি যে, পারিবারিক জীবনের শৃংখলা বজায় রাখার জন্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনের পরিচালক বা কর্তা হওয়া অপরিহার্য। কিন্তু উভয়েই যদি সমমর্যাদার এবং সমান কর্তৃত্বের অধিকারী হয়, তাহলে বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে বাধ্য। যেসব জতি কার্যত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমতা বিধান করার চেষ্টা করেছে সেসব জাতির মধ্যে বাস্তবিক পক্ষে এ বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলাম একটি স্বভাবসম্মত ধর্ম। কেননা তা মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি রেখে স্বামী-স্ত্রীর মধ্য থেকে একজনকে কর্তা ও পরিচালক এবং অপরজনকে তার অধীনস্থ বানানো প্রয়োজন মনে করছে এবং কর্তৃত্বের জন্য সেই সম্প্রদায়কে নির্বাচন করেছে, যারা প্রকৃতিগতভাবে এ যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।[এ বিষয়বস্তুর ওপর বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমার লেখা ‘পর্দা’ বইটি দেখুন। গ্রন্হকার।]
পুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলামী আইনের অধীনে দাম্পত্য জীবনের যে নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে পুরুষকে একজন কর্তা ও পরিচালকের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এ মর্যাদার কারণেই তার ওপর নিম্নলিখিত দায়িত্বসমূহ অর্পিত হয়েছেঃ
১. মোহরানাঃ স্বামী স্ত্রীকে মোহরানা প্রদান করবে। কেননা স্বামী হিসাবে স্ত্রীর ওপর তার যে অধিকার সৃষ্টি হয়েছে তা মোহরানার বিনিময়েই। ওপরে যে আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে এ ব্যাখ্যাও মওজুদ রয়েছে যে, যদিও পুরুষ প্রকৃতিগতভাবেই কর্তৃত্বের অধিকারী, কিন্তু কার্যত তার এ মর্যাদা মেহারানার আকারে ব্যয়িত অর্থের বিনিময়েই অর্জিত হয়ে থাকে। অন্য আয়াতেও এর ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছেঃ
**********************************
“এবং তোমরা স্ত্রীদের মোহরানা মনের সন্তোষ সহকারে আদায় করো”।–সূরা আন নিসাঃ৪
**********************************
“এ মুহরিম স্ত্রীলোকদের ছাড়া অন্য সব নারীকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে, যেন তোমরা নিজেদের ধন-সম্পদের বিনিময়ে তাদেরকে হাসিল করার আকাঙ্ক্ষা করো। তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য এবং অবাধ যৌনচর্চা প্রতিরোধের জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং বিনিময়ে তোমরা তাদের থেকে যে স্বাদ আস্বাদন করছো তার চুক্তি অনুযায়ী তাদের মোহরানা পরিশোধ করো”।
-সূরা আন নিসাঃ ২৪
**********************************
“অতএব তোমরা দাসীদেরকে তাদের মালিকের অনুমতি নিয়ে বিবাহ করো এবং তাদের ন্যায়সংগত মোহরানা আদায় করো”।–সূরা নিসাঃ ২৫
**********************************
“এবং মোহরানা আদায়ের বিনিময়ে তোমাদের জন্য সম্ভ্রান্ত ঈমানদার নারী এবং যাদের কাছে তোমাদের পূর্বে কিতাব পাঠানো হয়েছে (অর্থাৎ আহলে কিতাব) তাদের মধ্যকার সতী নারী হালাল করা হয়েছে”।–সূরা আল মায়েদাঃ ৫
সুতরাং বিবাহের সময় নারী ও পুরুষের মধ্যে মোহরানার যে চুক্তি হয়ে থাকে তা পরিশোধ করা পুরুষের অপরিহার্য কর্তব্য। সে যদি চুক্তি মোতাবেক মোহরানা আদায় করতে অস্বীকার করে তাহলে স্ত্রী তার থেকে নিজেকে আলাদা রাখার অধিকার রাখে। পুরুষের ওপর এটা এমনই এক দায়িত্ব যা থেকে রেহাই পাওয়ার কোন পথ নাই। তবে স্ত্রী যদি তাকে সময় দেয় অথবা তার দারিদ্রের কথা বিবেচনা করে সন্তুষ্ট মনে মাফ করে দেয় অথবা তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে খুশীর সাথে নিজের দাবি প্রত্যাহার করে নেয় তবে ভিন্ন কথা।
**********************************
“যদি তারা সন্তুষ্ট চিত্তে নিজেদের মোহরানার অংশবিশেষ মাফ করে দেয় তাহলে তোমরা তা তৃপ্তির সাথে ভোগ করো”।–সূরা আন নিসাঃ ৪
**********************************
“মোহরানার চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর তোমরা (স্বামী-স্ত্রী) পরস্পরিক সন্তোষের ভিত্তিতে যদি এর পরিমাণে কমবেশী করে নাও, তাহলে এতে কোন দোষ নেই”।–সূরা আন নিসাঃ ২৪
২. স্ত্রীর খোরপোষঃ স্বামীর দ্বিতীয় কর্তব্য হচ্ছে স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। ইসলামী আইন-বিদান স্বামী-স্ত্রীর কর্মক্ষেত্রের সীমা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে দিয়েছে। স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে ঘরে অবস্থান করা এবং পারিবারিক জিন্দেগীর দায়িত্বসমূহ আনজাম দেয়া। ************** আর পুরুষের কর্তব্য হচ্ছে আয়-উপার্জন করা এবং পরিবারের সদস্যদের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করা। এ দ্বিতীয় বিষয়টির ভিত্তিতেই স্বামীকে স্ত্রীর ওপর এক ধাপ বেশী শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে এবং এটা ‘কর্তৃত্বে’র সঠিক অর্থের অন্তরভুক্ত। যে ব্যক্তি কোন বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং খোঁজ-খবর রাখে তাকে ‘কাওয়াম’ বলা হয়। এ অধিকারবলেই সে ঐ বস্তুর ওপর কর্তৃত্বের ক্ষমতা রাখে। কুরআন মজীদের আয়াত ************ এবং ************* থেকে যেরূপ মোহরানা আদায় করা ওয়াজিব প্রমাণিত হচ্ছে, অনুরূপভাবে খোরপোষের ব্যবস্থা করাও ওয়াজিব প্রমাণিত হচ্ছে। স্বামী যদি এ দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে আইন তাকে এ দায়িত্ব পালনে বাধ্য করবে। সে যদি তা অস্বীকার করে অথবা অসমর্থ হয় তাহলে আইন তাদের বিবাহ ভেংগে দিতে পারে। কিন্তু খোরাকী দেয়ার পরিমাণ নির্ধারণ স্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং তা স্বামীর সামর্থ্যের ওপরেই নির্ভরশীল। কুরআন মজীদ এ ব্যাপারে একটি মূলনীতি বলে দিয়েছেঃ
**********************************
“ধনী ব্যক্তির ওপর তার সামর্থ্য অনুযায়ী এবং গরীব ব্যক্তির ওপর তার সামর্থ্য অনুযায়ী ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা কর্তব্য”।– সূরা আল বাকারাঃ ২৩৬
কিন্তু এমন হতে পারে না যে, গরীবের কাছ থেকে আদায় করা হবে তার সাধ্যাতীত পরিমাণ এবং ধনীর কাছ থেকে আদায় করা হবে তার সামর্থ্যের তুলনায় কম পরিমাণ।
৩. যুলুম–অত্যাচার থেকে বিরত থাকাঃ পুরুষের তৃতীয় কর্তব্য হচ্ছে, স্ত্রীর ওপর তাকে যে অগ্রাধিকার ও কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে সে তার অপব্যবহার করতে পারবে না। অন্যায় আচরণের বিভিন্ন রূপ রয়েছে। যেমনঃ
‘ঈলা’: কোন ন্যায়সংগত কারণ ছাড়াই [‘ন্যায়সংগত কারন’ হচ্ছে, স্বামী অথবা স্ত্রীর রোগাক্রান্ত হওয়া অথবা স্বামীর সফরে থাকা অথবা এমন কোন অবস্থার সৃষ্টি হওয়া যে, স্ত্রীর কাছে যাওয়ার ইচ্ছা রাখে কিন্তু তার কাছে যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না।–গ্রন্হকার।] স্ত্রীকে শুধু শাস্তি ও যাতনা দেয়ার উদ্দেশ্যে তার যৌনক্ষুধা নিবৃত্ত করা থেকে বিরত থাকার নাম হচ্ছে ‘ঈলা’। এর জন্য ইসলামী বিধান সর্বোচ্চ চার মাসের সময়সীমা বেধে দিয়েছে। স্বামীর কর্তব্য হচ্ছে এ সময়ের মধ্যে সে তার স্ত্রীর সাথে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করে নিবে। অন্যথায় এ সময়সীমা অতিক্রান্ত হলে স্ত্রীকে ত্যাগ করার জন্য তাকে তাধ্য করা হবে।
**********************************
“যারা নিজেদের স্ত্রীদের কাচে না যাওয়ার শপথ করে, তাদের জন্য চার মাসের অবকাশ রয়েছে। যদি তারা এ থেকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। আর যদি তারা তালাক দেয়ারই সংকল্প করে, তাহলে আল্লাহ সবকিছুই শোনেন ও জানেন”। – সূরা আল বাকারাঃ ২২৬-২২৭
এ মাসয়ালায় কোন কোন ফিকহবিদ হলফ বা শপথের শর্ত আরোপ করেছেন। অর্থাৎ স্বামী যদি স্ত্রীর কাছে না যাওয়ার শপথ করে তাহলেই ‘ঈলা’ হবে এবং তখনই এ হুকুম প্রযোজ্য হবে। কিন্তু কোনরূপ শপথ ছাড়াই স্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে স্বামী যদি দশ বছরও স্ত্রী থেকে আলাদা থাকে এমতাবস্থায় তার ওপর ঈলার হুকুম প্রযোজ্য হবে না। এ বক্তব্যের সাথে আমি একমত নই। এ প্রসংগে আমার দলীল নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
একঃ যদি কুরআন মজীদ কোন বিশেষ অবস্থার ক্ষেত্রে কোন নির্দেশ দেয় এবং এমন ধরনের শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করে যা শুধু সেই বিশেষ অবস্থার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তাহলে এ নির্দেশ কেবল সেই ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। উদাহরণস্বরূপ কুরআন মজদি সৎ কন্যাকে তার (সৎ) পিতার ওপর হামারা করার জন্য যে শব্দ ব্যবহার করেছে তা হচ্ছেঃ
**********************************
“তোমাদের স্ত্রীদের কন্যা, যারা তোমাদের ক্রোড়ে পালিত হয়েছে”।– সূরা আন নিসাঃ ২৩
যেসব মেয়ে শৈশবে তাদের মায়ের সাথে সৎ পিতার ঘরে এসেছে এব বাক্যে কেবল তাদের হারাম হওয়ার নির্দেশই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এমন কথা কোন ইমামই বলেননি যে, এ নির্দেশ কেবল উল্লিখিত অবস্থার সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট। বরং যে মেয়ে তার সৎ পিতার সাথে মায়ের বিয়ের সময় যুবতী ছিল এবং এক দিনের জন্যও তার এ পিতার গরে লালিত-পালিত হয়নি- তার হারাম হওয়ার ব্যাপারেও সব ইমাম একমত। অনুরূপভাবে কুরআন মজীদ যদিও *************** (যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস না করার শপথ করে) বাক্য ব্যবহার করেছে তবুও এসব ব্যক্তির জন্য যে হুকুম বর্ণনা করা হয়েছে তা কেবল শপথকারী লোকদের ওপরই প্রযোজ্র হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
দুইঃ ফিকহী নির্দেশ বের (ইস্তিম্বাত) করার ব্যাপারে এ মূলনীতি সংক্রান্ত প্রায় সব ইমামই একমত যে, যদি কোন ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশ না পাওয়া যায়, তাহলে এ ব্যাপারটি এমন কোন ঘটনার ওপর অনুমান (কিয়াস) করা যেতে পারে, যে সম্পর্কে নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে। তবে শর্ত হচ্ছে- উভয় ক্ষেত্রের এ নির্দেশের কারণসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ঈলা করে তাদের জন্য আইনপ্রণেতা (আল্লাহ) সময়সীমা কেন নির্ধারণ করেছেন? আর কেনই বা একথা বলেছেন, যদি সময়সীমার মধ্যে (স্ত্রীর দিকে) প্রত্যাবর্তন না করো তাহলে তাকে তালাক দাও? এর কারণ কি এছাড়া আর কিছু বলা যেতে পারে যে, চার মাসের অধিক কাল স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা স্ত্রীর জন্য ক্ষতিকর এবং বিধানদাতা এ ক্ষতিরই প্রতিরোধ করতে চান? এ আয়াতের পরবর্তী রূকু’তে আল্লাহর এ নির্দেশ মওজুদ রয়েছেঃ
**********************************
“তোমরা তাদেরকে শুধু পীড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে আটকিয়ে রেখো না, যেন তাদের প্রতি তোমরা অবিচার না করো”।–সুরা আল বাকারাঃ২৩১
এবং সূরা আন নিসার মধ্যে শরীয়াত প্রদানকারী বলেনঃ
**********************************
“অতএব তোমরা এক স্ত্রীর প্রতি এমনভাবে ঝুঁকে পড়ো না যদ্দরুন অন্য স্ত্রীরা ঝুলন্ত প্রায় হয়ে পড়ে”।–সূরা আন নিসাঃ ১২৯
এসব ইংগিত থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, স্ত্রীকে বিবাহের বন্ধনেও আবদ্ধ রাখা আবার তাকে দোদুল্যমান অবস্থায় সম্পর্কচ্যুত করে রাখা এবং শুধু যাতনা দেয়ার উদ্দেশ্যে আবদ্ধ করে রাখা, এসব কিছু শরীয়াত প্রণেতা আদৌ পসন্দ করেন না। চার মাসের মুদ্দত নির্ধারণ করার কারণ এছাড়া আর কিছু বর্ণণা করা যেতে পারে না। এখন যদি উক্ত কারণ এ অবস্থার মধ্যেও বিদ্যমান পাওয়া যায়, যখন স্বামী কোনরূপ শপথ ছাড়াই ইচ্ছাপূর্বক নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাস পরিত্যাগ করে- তাহলে কেন উল্লিখিত নির্দেশ এ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না? শপথ করা আর না করা শেষ পর্যন্ত মূল বিষয় ‘ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া’র মধ্যে এমন কি পার্থক্য সৃষ্টি করে? কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি এটা কল্পনা করতে পারে যে, স্বামী শপথ করে সহবাস ত্যাগ করলেই স্ত্রীর ক্ষতি হবে, আর সে যদি শপথ না করে সারা জীবনও স্ত্রীর কাছে না যায়, তাহলে তার ক্ষতি হবে না?
তিনঃ ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে দাম্পত্য বিধানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্র ও সতীত্বের হেফাযত করা। স্বামী যদি এক স্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করে তাহলে সে সহজেই নিজেকে কুকর্ম ও কৃদৃষ্টি থেখে হেফাযত করতে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু সে যে স্ত্রীকে সহবাসের সুখ থেকে স্থায়ীভাবে বঞ্চিত করে রেখেছে সে তার কাছে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত এ স্ত্রী কিভাবে নিজের সতীত্ব ও চরিত্রের হেফাযত করতে সক্ষম হবে? আইনদাতা মহাজ্ঞানী আল্লাহর কাছে এটা কি আশা করা যায় যে, এরূপ স্ত্রীর স্বামী যদি কার কাছ থেকে দূরে থাকার শপথ করে থাকে তাহলে তার চরিত্রের হেফাযতের ব্যবস্থা তিনি করবেন অথবা তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য চরিত্র কলংকিত হওয়ার আশংকায় ফেলে রাখবেন?
এসব কারণে আমার মতে মালিকী মাযহাবের ফিকহবিদগণের অভিমত অনুযায়ী ফতোয়া হওয়া উচিত। তাঁরা বলেন, স্বামী যদি স্ত্রীকে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে সহবাস বর্জন করে তাহলে তার ওপরও ‘ঈলা’র হুকুম প্রযোজ্য হবে, যদিও সে শপথ করেনি। কেননা ঈলার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার ক্ষেত্রে আইনদাতার উদ্দেশ্যে সহবাস বর্জন করা হয়েছে সেখানেও এ কারণ (ইল্লাত) পাওয়া যাচ্ছে। [ইবনুল আরাবীর ‘আহকামুল কুরআন’, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৭৫ এবং ইবনে রুশদের ‘বিদয়াতুল মুজতাহিদ’, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৮৮।–গ্রন্হকার।]
************* আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়েও ফকীহদের মতানৈক্য রয়েছে। হযরত উসমান ইবনে আফফান, যায়েদ ইবনে সাবিত, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর রায় হচ্ছে, চার মাসের সময়সীমা অতিবাহিত হওয়াই প্রমাণ করে যে, স্বামী তালাক দেয়ার সংকল্প করেছে। অতএব এ সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর ‘রুজু’ অর্থাৎ তার পুনঃগ্রহণের অধিকার অবশিষ্ট থাকে না। হযতর আলী ও ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকেও এই মর্মে একটি বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু শেষোক্ত দুজনের অপর এক বর্ণনা ও হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনায় রয়েছে যে, মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর স্বামীকে এই মর্মে নোটিশ দিতে হবে- হয় নিজের স্ত্রীকে ফিরিয়ে নাও অন্যথায় তাকে তালাক দাও। কিন্তু আমরা যখন আয়াতের শব্দগুলো নিয়ে চিন্তা করি তখন প্রথম মতটিই সঠিক মনে হয়। আয়াতে ‘ঈলাকারী’কে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট শব্দে মাত্র চার মাসের সময় বেঁধে দিয়েছেন। তার পুনঃগ্রহণের অধিকারও এ সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। [এ ক্ষেত্রে তালাক কি এক তালাক বায়েনের পর্যায়ে নাকি এক তালাকে রিজঈর পর্যায়ে পড়বে-তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।–গ্রন্হকার।] সময়সীমা শেষ হওয়ার পর তালাক (পৃথক হয়ে যাওয়া) ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। এখন যদি কোন ব্যক্তিকে চার মাসের পর তাকে পুনঃগ্রহণের অধিকার দেয়া হয় তাহলে সে যেন অবকাশের সময়সীমাকে আরও বৃদ্ধি করলো। এ বৃদ্ধি প্রকাশ্যত আল্লাহ তা’আলার কিতাবের নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত।
ক্ষতিসাধন ও সীমালংঘন
স্ত্রীর প্রতি আকর্ষন না থাকলে তাকে রেখো না। কিন্তু শুধু নির্যাতন ও বাড়াবাড়ি করার জন্য তাকে আটকে রাখা, বারবার তালাক দেয়া, দুই তালাক দেয়ার পর তৃতীয় তালাকের পূর্বে পুনঃগ্রহণ করা, এরূপ আচরণ করতে কুরআন মজীদে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। কারণ এটা হচ্ছে যুলুম।
**********************************
“এবং তোমরা তাদেরকে নির্যাতন ও অত্যাচার করার উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না। যে ব্যক্তি এমন করবে সে নিজের উপর অত্যাচার করবে। সাবধান! আল্লাহুর আয়াতসমূহকে তামাশার বস্তু বানিও না”।–সূরা আল বাকারাঃ ২৩১ [আইনের শব্দগুলো থেকে এমন অবৈধ ও নাজায়েয ফায়দা হাসিল করা যা আইনের উদ্দেশ্যে ও স্পীরিটের বিপরীত-মূলত তা হচ্ছে আইনের সাথে তামাশা করারই নামান্তর। কুরআনে পুরুষদের অধিকার দেয়া হয়েছে যে, এক তালাক অথবা দুই তালাক দেয়ার পর স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করো; তাও কেবল এ উদ্দেশ্যেই যে, এ সময়ের মধ্যে যদি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে একটা সমঝোতা হয়ে যায় এবং পরস্পর মিলেমিশে বসবাস করার কোন রকমের উপায় বের হয়ে আসে তাহলে শরীয়াতের পক্ষ থেকে যেন কোন প্রতিবন্ধকতা তাদের পথরোধ করে না দাঁড়ায়। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি এ সুযোগ থেকে অবৈধ ফায়দা হাসিল করে স্ত্রীকে তালাক দিল, অতপর ইদ্দাত শেষ হওয়ার পূর্বে ‘রুজু’ করে নিল এবং সে পুনরায় তালাক দিল, আবার পূর্বে মত ‘রুজু’ করলো, তার এরূপ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে অযথা স্ত্রীকে দোদুল্যমান অবস্থায় রাখা। সে তাকে নিজের ঘরেও রাখে না আবার মুক্তও করে দেয় না যে, বেচারী অন্য কোথাও বিবাহ করে নিবে। সুতরাং এরূপ আচরণ আল্লাহর আইনের সাথে প্রহসন বৈ কিছুই নয়। কোন সাচ্চা মু’মিন ব্যক্তি এরূপ করার সাহস করতে পারে না।–গ্রন্হকার।]
‘দিরার’ (ক্ষিতিসাধন) ও ‘তাআদ্দী’ (সীমালংঘন) শব্দদ্বয় ব্যাপক অর্থবোধক। এটা সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি নির্যাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে কোন স্ত্রীকে আটকে রাখবে, সে তাকে সবরকম পন্হায়ই নির্যাতন করবে। তাকে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দিবে। ইতর প্রকৃতির লোক হলে মারধন ও গালিগালাজ করবে, উচ্চ শ্রেণীর লোক হলে নির্যাতন ও হেয়প্রতিপন্ন করার বিভিন্ন পন্হা অবলম্বন করবে। ক্ষতিসাধন ও সীমা লংঘনের শব্দগুলোর মধ্যে এর সব ধরনের পদ্ধতিই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে এ ধরনের সব পন্হাই নিষিদ্ধ। যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে এ ধরনের আচরণ করে তবে সে বৈধ সীমালংঘনকারী সাব্যস্ত হবে। এমতাবস্থায় স্ত্রীর অধিকার রয়েছে যে, সে আইনের সাহায্য নিয়ে এ ব্যক্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবে।
স্ত্রীদের মধ্যে ইনসাফ না করা
একাধিক স্ত্রী থাকা অবস্থায় কোন একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে অন্য স্ত্রী বা স্ত্রীদেরকে ঝুলিয়ে রাখা অন্যায়। কুরআন মজীদ পরিষ্কার ভাষায় এটাকে নাজায়েয বলেছেঃ
**********************************
“তোমরা কোন এক স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে পড়ো না যদ্দরুন অন্যান্য স্ত্রী ঝুলন্ত প্রায় হয়ে পড়ে”।–সূরা আন নিসাঃ ১২৯
কুরআন মজীদে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি আদল ও ইনসাফের শর্তেই দেয়া হয়েছে। যদি কোন ব্যক্তি ইনসাফ না করে, তাহলে এ শর্ত সাপেক্ষ অনুমতি থেকে ফায়দা ওঠানোর অধিকার তার নেই। স্বয়ং যে আয়াতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে তাতেও পরিষ্কার নির্দেশ রয়েছে যে, যদি ইনসাফ করতে অক্ষম হও তাহলে একজন স্ত্রীই গ্রহণ করো।
**********************************
“যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, তোমরা ন্যায় ও ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে এক স্ত্রীই গ্রহণ করো অথবা যেসব দাসী তোমাদের মালিকানাধীন রয়েছে, তাদের স্ত্রীরূপে গ্রহণ করো। অবিচার থেকে বেঁচে থাকার জন্য এটাই হচ্ছে অধিকতর সঠিক কাজ”।–সূরা আন নিসাঃ ৩
ইমাম শাফিঈ র. ***********-এর অর্থ করেছেন, ‘যেন তোমাদের সন্তান অধিক না হয়, যাদের লালন-পালনের ভার তোমাদের ওপর ন্যস্ত হয়ে পড়বে’। কিন্তু এ অর্থ মূল অভিধানের বিপরীত। অভিধানে ******-এর অর্থ হচ্ছে ‘ঝুঁকে যাওয়া”। আবু তালিবের কবিতাঃ
**********************************
এখানে ****** (আয়েল) ঝুঁকে যাওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ কারণে ***** আওল) শব্দটি অন্যায়-অত্যাচার ও ইনসাফের পথ থেকে সরে যাওয়ার অর্থেই ব্যবহৃত হয়। অতএব ইবনে আব্বাস (রা) হাসান, মুজাহিদ, শা’বী ইকরিমা ও কাতাদা (র) প্রমুখ *******-এর অর্থ করেছেন ******* (ন্যায় থেকে সরে পড়ো না)। অতএব কুরআন মজীদের উল্লিখিত আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি দুই অথবা ততোধিক স্ত্রীর মধ্যে ইনসাফ করে না এবং এক স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে অন্যদের অধিকার আদায় করার ব্যাপারে ক্রটি করে সে যালেম। সুতরাং ‘একাধিক স্ত্রী রাখার অনুমতি’ দ্বারা তার উপকুত হওয়ার কোন অধিকার নাই। এমতাবস্থায় আইনত তাকে একজনমাত্র স্ত্রী রাখার জন্য বাধ্য করা উচিত এবং অন্য স্ত্রী বা স্ত্রীদের এ অধিকারও থাকা উচিত যেন তারা এ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনের সাহায্যে প্রতিকার লাভ করতে পারে।
আদল ও ইনসাফের ক্ষেত্রে কুরআন মজীদ বিশদ ব্যাখ্যা করে দিয়েছে যে, আন্তরিক ভালোবাসার ক্ষেত্রে যতদূর সম্পর্ক রয়েছে, তাতে সমতা রক্ষা করা না মানুষের পক্ষে সম্ভব, আর না সে শরীয়তের দৃষ্টিতে দায় বহনকারী।
**********************************
“স্ত্রীদের মধ্যে পুরোপুরি সুবিচার বজায় রাখা তোমাদের সাধ্যে বাইরে। তোমরা অন্তর দিয়ে চাইেও তা করতে সমর্থ হবে না”।– সূরা আন নিসাঃ ১২৯
অবশ্য যে ব্যাপারে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে তা হচ্ছে, ভরণ-পোষণ, সদাচরণ এবং স্বামী-স্ত্রী সুলভ জীবনযাপনে সকলের সাথে সমান ব্যবহার।
পুরুষের এ তিন প্রকারের অন্যায় আচরণে আইন হস্তক্ষেপ করতে পারে। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন অনেক ব্যাপারএ আসতে পারে এবং আসছেও যা প্রেম ও ভালোবাসার পরিপন্হী। কিন্তু সেখানে আইনের হস্তক্ষেপ করার সুযো্গ নাই। কুরআন মজীদ এসব ব্যাপারে স্বামীদের সাধারন নৈতিক উপদেশ প্রদান করেছে। এর সারসংক্ষেপ হচ্ছে, স্ত্রীর সাথে স্বামীর আচরণ উদার ও প্রেমময় হওয়া বাঞ্ছনীয়। দিন-রাত ঝগড়াঝাটি আর কেলেংকারীর মাঝে জীবনযাপন করা আহাম্মকী ছাড়া আর কিছু নয়। যদি স্ত্রীকে রাখতে হয় তাহলে সরলভাবেই রাখো, বনিবনা না হলে ভালোয় ভালোয় বিদায় করে দাও। কুরআনের এ উপদেশগুলো শক্তি ও ক্ষমতাবলে কার্যকর করা সম্ভব নয়। আর এও সম্ভব নয় যে, স্বামী-স্ত্রীর যে কোন বিবাদে আইন হস্তক্ষেপ করবে। কিন্তু এসব কিছু থেকে আইনের স্পীরিট এটাই মনে হয় যে, তা ন্যায়-ইনসাফ, আন্তরিকতা ও ভালোবাসাপূর্ণ ব্যবহারের দায়িত্ব বেশীর ভাগই স্বামীর ওপর ন্যস্ত করে।