হিজরী প্রথম শতকের খোলার দৃষ্টান্তসমূহ
খোলার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মোকদ্দমা হচ্ছে সাবিত ইবনে কায়েস (রা)-এর। তাঁর স্ত্রীগণ তাঁর কাছ থেকে খোলা অর্জন করে নিয়েছিলেন। এ মোকদ্দমার বিস্তারিত বিবরণের বিভিন্ন অংশ হাদীসসমূহে বর্ণিত আছে। অংশগুলোকে একত্র করলে জানা যায়, সাবিত (রা) থেকে তাঁর দুই স্ত্রী খোলা অর্জন করেছিলেন। এক স্ত্রী হচ্ছেন জামীলা বিনতে উবাই ইবনে সালূল (আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের বোন)। [কেউ কেউ যয়নব বিনতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী তাঁর নাম জামীলা এবং তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কন্যা নন, বরং বোন।–গ্রন্হকার।] তাঁর ঘটনা এই যে, সাবিতের চেহারা তাঁর পসন্দনীয় ছিল না। তিনি খোলার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বিচার প্রার্থনা করলেন এবং নিম্নোক্ত ভাষায় নিজের অভিযোগ পেশ করলেনঃ
**********************************
“হে আল্লাহর রাসূল! আমার মাথা ও তার মাথাকে কোন বস্তু কখনও একত্র করতে পারবে না। আমি ঘোমটা তুলে তাকাতেই দেখলাম, সে কতগুলো লোকের সাথে সামনের দিক থেকে আসছে। কিন্তু আমি তাকে ওদের সবার চেয়ে বেশী কালো, সবচেয়ে বেঁটে এবং সবচেয়ে কুৎসিত চেহারার দেখতে পেলাম”।– ইবনে জারীর
**********************************
“আল্লাহর শপথ! আমি তার দীনদারী ও নৈতিকতার কোন ক্রটির কারণে তাকে অপসন্দ করছি না, বরং তার কুৎসিত চেহারাই আমার কাছে অপসন্দনীয়”।– ইবনে জারীর
**********************************
“আল্লাহর শপথ! যদি আল্লাহর ভয় না থাকতো তাহলে যখন সে আমার কাছে আসে, আমি তার মুখে থুথু নিক্ষেম করতাম”।– ইবনে জারীর
**********************************
“হে আল্লাহর রাসূল! আমি কিরূপ সুন্দরী ও সুশ্রী তা আপনি দেখছেন। আর সাবিত হচ্ছে এক কুৎসিত ব্যক্তি”।–ফাতহুল বারীর হাওয়ালায় আবদুর রাযযাক।
**********************************
“আমি তার দীনদারী ও নৈতিকতার ব্যাপারে কোন অভিযোগ করছি না। কিন্তু ইসলামে আমার কুফরের ভয় হচ্ছে”।-বুখারী [“ইসলামে কুফরের ভয়’ কথাটার অর্থ হচ্ছে- ঘৃণা ও অপসন্দ হওয়া সত্ত্বেও যদি আমি তার সাথে বসবাস করি তাহলে আমার আশংকা হচ্ছে স্বামীর আনুগত্য, বিশ্বস্ততা ও সতীত্বের হেফাযতের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যেসব নির্দেশ দিয়েছেন- আমি তা পালন করতে সক্ষম হবো না। এ হচ্ছে একজন ঈমানদার নারীর দৃষ্টিভংগী, যিনি আল্লাহ নির্ধারিত সীমালংঘন করাকে কুফরী মনে করেন। অথচ বর্তমান যুগের মৌলভীদের দৃষ্টিভংগী হচ্ছে, যদি নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত কিছুই আদায় না করা হয় এবং প্রকাশে ফাসেকী ও গর্হিত কাজ করা হয়- তবুও তারা এ অবস্থাকে একটি ঈমানী অবস্থা বলে আখ্যায়িত করতে বদ্ধপরিকর এবং এ ধরনের ব্যক্তিদের তারা জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করতে থাকেন। আর যে ব্যক্তি এটাকে ঈমানের পরিপন্হী অবস্থা বলেন, তাকে তারা ‘খারিজী’ আখ্যা দেন।–গ্রন্হকার।]
নবী সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়াসাল্লাম তার অভিযোগ শুনলেন, অতপর বললেনঃ
**********************************
“সে তোমাকে যে বাগানটি দিয়েছিল তুমি কি তা ফেরত দিবে?”
উত্তরে তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি তা ফেরত দিতে রাজি আছি, বরং সে যদি আরো অধিক চায়, তাও দিবো”।
নবী স. বললেনঃ
**********************************
“অধিক কিছু নয়, তুমি কেবল তার বাগানটিই ফেরত দাও”।
অতপর তিনি সাবিত রা.-কে নির্দেশ দিলেনঃ
**********************************
“তুমি তোমার বাগন গ্রহণ করো এবং তাকে এক তালাক দাও”।
হযরত সাবিত (রা)-এর আর এক স্ত্রী ছিলেন হাবীবা বিনতে সাহল আল আনসারিয়াহ (রা)। তাঁর ঘটনা ইমাম মারিক ও ইমাম আবূ দাউদ (রা) এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ একদিন খুব ভোরে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে বের হয়েই হাবীবা (রা)-কে দরজায় দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ব্যাপার কি? তিনি বললেনঃ
**********************************
“আমার ও সাবিত ইবনে কায়েসের মধ্যে মিলমিশ হবে না”।
যখন সাবিত (রা) উপস্থিত হলেন নবী (স) বললেনঃ দেখো এ হচ্ছে হাবীবা বিনতে সাহল। এরপর সাবিত (রা) যা কিছু বলার তাই বললেন। হাবীবা (রা) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সাবিত আমাকে যা কিছু দিয়েছেন তা সবই আমার কাছে আছে। নবী স. সাবিত রা.-কে নির্দেশ দিলেনঃ
“এসব কিছু তুমি ফেরত নাও এবং তাকে বিদায় করে দাও”।
কোন কোন বর্ণনায় ************ এবং কোন কোন হাদীসে ************ শব্দ রয়েছে। উভয় শব্দের অর্থ একই। আবু দাউদ ও ইবনে জারীর হযরত আয়েশা (রা) থেকে এ ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
হযরত সাবিত রা. হাবীবাকে এমন মার দিয়েছিলেন যে, তাঁর হাড় ভেঙে গিয়েছিল। হাবীবা নবী স.-এর কাছে এসে অভিযোগ করলেন। তিনি সাবিত রা.-কে আদেশ দিলেনঃ “খুয বা’দু মালিহা ওয়া ফাররিকহা”- “তার সম্পদের কিছু অংশ নিয়ে নাও এবং তাকে পৃথক করে দাও”।
কিন্তু ইবনে মাজা হাবীবা (রা)-এর প্রসংগে যেসব শব্দ বর্ণনা করেছেন তা থেকে জানা যায়, সাবিত রা.-এর বিরেুদ্দে হাবীবা (রা)-এর যে অভিযোগ ছিল তা মারধোরের নয়, বরং তাঁর কুৎসিত আকৃতির। সুতরাং তিনিও একই অভিযোগ এনেছেন। হাদীসে জামীলা (রা) বর্ণিত হয়েছে, ‘যদি আল্লাহর ভয় না হতো তাহলে আমি সাবিতের মুখে থুথু দিতাম’।
হযতর উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সামনে এক মহিলা ও এক পুরুষের মোকদ্দমা পেশ করা হলো। তিনি স্ত্রীলোকটিকে উপদেশ দিলেন এবং স্বামীর সাথে বসবাস করার পরামর্শ দিলেন। স্ত্রীলোকটি তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেনি। এতে তিনি একটি ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ কুঠরিতে তাকে আবদ্ধ করে দিলেন। তিন দিন বন্দী করে রাখার পর তিনি তাকে বের করে এনে জিজ্ঞেস করলেন, “এখন তোমার কি অবস্থা?” সে বললো, “আল্লাহর শপথ! এ রাত কয়টিতে আমার কিছুটা শান্তি হয়েছে”। একথা শুনে হযরত উমর (রা) তার স্বামীকে নির্দেশ দিলেনঃ
**********************************
“তোমার জন্য দুঃখ হয়, কানের বালির মত সামান্য অলংকারের বিনিময়ে হলেও একে খোলা দিয়ে দাও”। [‘কাশফুল গুম্মাহ,’ ২য় খণ্ড।]
‘রুবাই’ বিনতে মুআওবিয ইবনে আফরা (রা) তাঁর সমস্ত সম্পদের বিনিময়ে স্বামীর কাছ থেকে খোলা করিয়ে নিতে চাইলেন। কিন্তু স্বামী তা মানলো না। হযরত উসমান (রা) –এর দরবারে মোকদ্দমা পেশ করা হলো। তিনি স্বামীকে নির্দেশ দিলেনঃ
**********************************
“তার চুল বাঁধার ‘ফিতাটা’ পর্যন্ত নিয়ে নাও এবং তাকে ‘খোলা’ দিয়ে দাও”। [ফাতহুল বারীর হাওয়ালায়- আবদুর রাযযাক।]
খোলার বিধান
এসব হাদীস থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১. ********************* সাবিত ইবনে কায়েসের স্ত্রীদের থেকে বর্ণিত অভিযোগই হচ্ছে এ আয়াতের তাফসীর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উত্থাপিত অভিযোগকে খোলার জন্য যথেষ্ট মনে করলেন যে, তাঁদের স্বামীর চেহারা অত্যন্ত কুৎসিত এবং তাঁরা তাঁকে মোটেই পসন্দ করেন না। তিনি তাঁদেরকে সৌন্দর্যের দর্শনের ওপর বক্তৃতা দেননি। কেননা তার দৃষ্টি ছিল শরীয়াতের উদ্দেশ্যের দিকে। যখন প্রমাণিত হয়ে গেলো যে, এ মহিলার অন্তরে স্বামীর প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুস্টি জমে গেছে, তিনি তাঁদের আবেদন মঞ্জুর করলেন। কেননা ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি বিদ্যমান থাকা অবস্থায় একজন নারী ও একজন পুরুষকে বাধ্যতামূলকভাবে পরস্পরের সাথে জবরদস্তিমূলক বেঁধে রাখার পরিণতি দীন, আমল-আখলাক এবং সমাজ-সভ্যতার জন্য তালাক ও খোলার চেয়ে মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। এতে শরীয়তের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশংকা রয়েছে। সুতরাং নবী সা.-এর এ কর্মধারা থেকে এ আইন পাওয়া যায় যে, খোলার বিধান কার্যকর করার জন্য কেবল এতটুকু প্রমাণিত হওয়াই যথেষ্ট যে, স্ত্রী ‘স্বামীকে নেহায়েত অপসন্দ করে এবং সে তার সাথে বসবাস করতে রাজী নয়।
২. হযরত উমর (রা)-এর কর্মনীতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীর ঘৃণা ও অসন্তুষ্টির ব্যাপারটি তদন্ত করার জন্য বিচারক যে কোন উপযুক্ত পন্হা অবলম্বন করতে পারেন, যেন সন্দেহের কোন অবকাশ না থাকে এবং নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, এদের মধ্যে এখন আর মিলমিশ হওয়ার কোন আশা নেই।
৩. হযরত উমর (রা)-এর কর্মনীতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীর ঘৃণা ও অসন্তুষ্টির কারণ অনুসন্ধান করা জরুরী নয়। এটা যুক্তিসংগত কথা, স্বামীর প্রতি বীবতশ্রদ্ধ হওয়ার এমন অনেক কারণ থাকতে পারে যা অন্য কারো সামনে প্রকাশ করা যায় না। বিতৃষ্ণার কারণগুলো এমন পর্যায়েরও হতে পারে যা বর্ণনা করা হলে শ্রবণকারী এটাকে ঘৃণার জন্য যথেষ্ট নাও মনে করতে পারে। কিন্তু দিন-রাত সে এ কারণগুলোরই সম্মুখীন হয় এবং তার অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্য এগুলো যথেষ্ট। অতএব কাযীর দাযিত্ব শুধু এতটুক যে, স্ত্রীর অন্তরে স্বামীর প্রতি ঘৃণা জমা হয়েছে কিনা তা যাচাই করা। স্ত্রীলোকটি যেসব কারণ বর্ণনা করেছে, তা ঘৃণা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট কিনা সেই ফায়সালা করা তার দায়িত্ব নয়।
৪. বিচারক উপদেশ দিয়ে স্ত্রীকে স্বামীর সাথে থাকার জন্য সম্মত করার চেষ্টা অবশ্যই করতে পারেন, কিন্তু তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বাধ্য করতে পারবেন না। কারণ খোলা তার ব্যক্তিগত অধিকার যা আল্লাহ তাআলা তাকে দিয়েছেন এবং সে যদি এ আশংকা প্রকাশ করে যে, এ স্বামীর সাথে বসবাস করতে গেলে সে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা ঠিক রাখতে পারবে না, এমতাবস্থায় তাকে একথা বলার কারো অধিকার নেইঃ তুমি চাইলে আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করতে পারো, কিন্তু এ ব্যক্তির সাথেই তোমাকে থাকতে হবে।
৫. ‘খোলা’র মোকদ্দমার ক্ষেত্রে বিচারকের অনুসন্ধানের কোন প্রশ্নই ওঠে না যে, স্ত্রী কি ন্যায্য প্রয়োজনের ভিত্তিতে খোলার দাবি করছে, না কেবল প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে বিচ্ছেদ চাচ্ছে? এ কারণে নবী (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদীন বিচারক হিসাবেব যখন খোলার মোকদ্দমাগুলোর বিবরণ গুনেছেন তখন এ প্রসংগটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। এর কারণঃ
প্রথমত, এ অভিযোগের যথাযথ অনুসন্ধান করা কোন বিচারকের পক্ষেই সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, নারীর খোলার অধিকার হচ্ছে পুরুষের তালাকের অধিকারের বিকল্প। অবাধ যৌনচর্চার প্রশ্ন তুললে উভয় ক্ষেত্রেই তার সমান আশংকা রয়েছে। কিন্তু আইনে পুরুষের তালাকের অধিকার প্রয়োগকে অবাধ্য যৌনচর্চার আশংকার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়নি। সুতরাং আইনগত অধিকারের দিক থেকে স্ত্রীর খোলার অধিকারকেও কোন নৈতিক শর্তের সাথে সম্পৃক্ত করা উচিত নয়।
তৃতীয়ত, কথা হচ্ছে, খোলা দাবিকারিণী কোন মহিলা দুই অবস্থা থেকে খালি নয়। হয় খোলা দাবি করার পক্ষে তার বাস্তবসম্মত প্রয়োজন রয়েছে অথবা সে অবাধ যৌনচর্চায় লিপ্ত হওয়ার জন্য খোলার দাবি করছে। প্রথম ক্ষেত্রে তার খোলার দাবি প্রত্যাখ্যান করা অন্যায় হবে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাকে খোলার ক্ষমতা না দিলে শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যসমূহ ব্যাহত হবে। কারণ যে নারী দ্বিচারিণী হবে সে তার যৌনতৃপ্তির জন্য কোন না কোন পথ খুঁজতে থাকবেই। আপনি যদি তাকে বৈধ পন্হায় এটা করতে না দেন তাহলে সে অবৈধ পন্হায় তার কুস্বভাবের চাহিদা পূরণ করবেই এবং তা হবে অধিক গর্হিত কাজ। কোন নারীর পরপর পঞ্চশজন স্বামী বদল করা- একজন স্বামীর অধীনে থেকে একবার ‘যেনা’য় লিপ্ত হওয়ার চেয়ে অধিক উত্তম।
৬. স্ত্রী যদি খোলা দাবি করে, আর স্বামী যদি তাতে সম্মত না হয়, তাহলে বিচারক তাকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দিবেন। পূর্বোল্লিখিত হাদীসের সবগুলো বর্ণনায় এরূপই এসেছে যে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন এসব ক্ষেত্রে সম্পদ বা নগদ অর্থ গ্রহণ করে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যাই হোক, বিচারকের নির্দেশের অর্থও তাই এবং স্বামী তা মেনে নিতে বাধ্য। এমনকি সে যদি তা মেনে না নেয়, তাহলে কাযী তাকে বন্দী করতে পারবেন। কারণ শরীয়তে কাযীর মর্যাদা কেবল একজন পরামর্শ দাতার পর্যায়ের নয় যে, তাঁর আদেশ পরামর্শ হিসাবে বিবেচিত হবে, আর যার বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয়েছে- তার এটা মানা বা না মানার এখতিয়ার থাকবে। বিচারকের মর্যাদা যদি তাই হতো তাহলে মানুষের জন্য তার আদালতের দরজা খোলা থাকা সম্পূর্ণ নিরর্থক ছিল।
৭. মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী খোলার পরিণতি হচ্ছে ‘এক তালাকে বায়েন’। অর্থাৎ খোলার হুকুম কার্যকর হওয়ার পর স্ত্রীর ইদ্দাত চলাকালীন তাকে পুনঃগ্রহণের অধিককার স্বামীর থাকবে না। কেননা পুনঃগ্রহণের অধিকার অবশিষ্ট থাকলে ‘খোলা’র উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়ে যায়। এছাড়া স্ত্রী যে অর্থ তাকে দিয়েছে তা বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্তির জন্যই দিয়েছে। স্বামী যদি তা গ্রহণ করে তাকে রেহাই না দেয় তাহলে এটা হবে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা। শরীয়ত কিছুতেই এটা জায়েয রাখে না। হাঁ, যদি স্ত্রীলোকটি স্বেচ্ছায় তার কাছে পুনরায় বিবাহ বসতে চায় তবে তা সে করতে পারে। কারণ এটা মুগাল্লাযা তালাক নয়। এই শেষোক্ত ধরনের তালাকের পর দ্বিতীয়বার বিবাহের জন্য তাহলীল শর্ত।
৮. খোলা’র বিনিময় নির্ধারণে আল্লাহ তাআলা কোন শর্ত আরোপ করেননি। যে কোন পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বামী-স্ত্রী সম্মত হবে, তার ওপরই খোলা হতে পারে। কিন্তু খোলার বিনিময়ে স্বামীর দেয়া মোহরানার চেয়ে বেশী পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপসন্দ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ
**********************************
“কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে যে পরিমাণ মোহরানা দিয়েছে খোলার সময় সে এর অধিক পরিমাণ গ্রহণ করতে পারবে না”।
হযরত আলী (রা) এটাকে স্পষ্ট ভাষায় মাকরূহ বলেছেন। মুজতাহিদ ইমামদের এ ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু স্ত্রী যদি স্বামীর যুলূম-নির্যাতনের কারণে খোলার দাবি করে তাহলে বিনিময় গ্রহণ করা মূলত স্বামীর জন্য মাকরূহ। যেমন হিদায়া কিতাবে আছেঃ
**********************************
“স্বামীর পক্ষ থেকে যুলুম-নির্যাতন হয়ে থাকলে খোলার সময় স্ত্রীর কাছ থেকে বিনিময় গ্রহণ করা তার জন্য মাকরূহ”।
এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে সামনে রেখে শরীয়তের মূলনীতির অধীনে খোলার অধ্যায়ে নিম্নলিখিত নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারেঃ
ক. খোলা প্রার্থনাকারী স্ত্রীলোক যদি তার স্বামীর অত্যাচার প্রমাণিত করতে পারে অথবা এমন কোন কারণ দাঁড় করাতে পারে যা কাযীর কাছে যুক্তিসংগত মনে হবে- তাহলে কাযী তাকে মোহরানার একটা সামান্য অংশ অথবা অর্ধেক ফেরত দেয়ার বিনিময়ে তাকে খোলার ব্যবস্থা করে দিবেন।
খ. যদি সে স্বামীর নির্যাতন অথবা গ্রহণযোগ্য কোন কারণ পেশ না করে তাহলে সম্পূর্ণ মোহরানা অথবা এর একটা বিরাট অংশ ফেরত দেয়া তার জন্য বাধ্যতামূলক করে দেয়া হবে।
গ. কিন্তু কাযী যদি স্ত্রীলোকটির হাবভাব ও আচরণের মধ্যে অবাধ্য যৌনচর্চার আলমাত দেখতে পান, তাহলে তিনি শাস্তিস্বরূপ তাকে মোহরানা অধিক পরিমাণ অর্থ প্রদানে বাধ্য করতে পারেন।
খোলার মাসয়ালায় একটি মৌলিক গলদ
খোলার উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ বাস্তব সত্য প্রকটিত হয়ে ওঠে যে, ইসলামী আইনে নারী ও পুরুষের অধিকারের মধ্যে কতটা সঠিক ভারসাম্য স্থাপন করা হয়েছে। এখন এটা আমাদের নিজেদেরও ভ্রান্তি যে, আমরা আমাদের নারীদের হাত থেকে কার্যত খোলার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছি এবং শরীয়তের মূলনীতির বিপরীত খোলা দেয়া বা না দেয়াকে সম্পূর্ণরূপে পুরুষের ইচ্ছার ওপর সীমাবদ্ধ করে দিয়েছি। এর ফলে প্রতিনিয়ত নারীদের যে অধিকার খর্ব হয়েছে ও হচ্ছে, এ জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান মোটেই দায়ী নয়। এখনো যদি নারীদের এ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে আমাদের দাম্পত্য জীবনে সৃষ্ট অনে সমস্যারই জট খুলে যাবে। সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পথই বন্ধ হয়ে যাবে।
“আইনপ্রণেতা খোলার ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে রেখে দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা কাযীর এখতিয়ার বহির্ভুত”- এ ভ্রান্ত ধারণাই কার্যত নারীর হাত থেকে খোলার অধিকার সম্পূর্ণরূপে ছিনিয়ে নিয়েছে। পরিমাণ হচ্ছে এই যে, খোলা দেয়া বা না দেয়া সম্পূর্ণরূপে পুরুষের মরযির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যদি স্ত্রী খোল হাসিল করতে চায় আর স্বামী নিজের দুষ্টামি, কপটতা অথবা হীনস্বার্থ সিদ্ধির জন্য তা না দিতে চায় তাহলে স্ত্রীর জন্য কোন উপায় অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু এটা আইনদাতার উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্হী। বিবাহের সাথে সংশ্লিষ্ট এক পক্ষকে সম্পূর্ণরূপে অসহায় করে সমস্ত ক্ষমতা অন্য পক্ষের হাতে তুলে দেয়া কখনও শরীয়ত প্রদানকারীর উদ্দেশ্য ছিল না। যদি এরূপ হতো তাহলে তিনি বৈবাহিক সম্পর্কের সাথে যে উৎকৃষ্ট নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্য সংযুক্ত করেছেন তা বিলীন হয়ে যেত।
যেমন ইতিপর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, ইসলামী শরীয়তে দাম্পত্য আইনের ভিত্তি এ মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, পুরুষ ও স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক যতক্ষণ পবিত্র নৈতিকতা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সাখথে কায়েম থাকতে পারে, তাকে আরো সুন্দর করা একান্ত জরুরী এবং একে ছিন্ন করা বা করানোর চেষ্টা কঠোর অপ্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু যখন এ সম্পর্ক উভয়ের জন্য অথবা উভয়ের মধ্যে কোন একজনের নৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় অথবা তার মধ্যে ভালোবাসা- আন্তরিকতার স্থলে ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে যায় তখন এ বিবাহ ভেঙে দেয়াই জরুরী এবং তা বহাল রাখা শরীয়তের উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্হী। এ মূলনীতির অধীনে শরীয়ত বিবাহের সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়কে এমন এক একটি আইনগত অস্ত্র দিয়েছে যে, বিবাহ বন্ধন অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছে গেলে সে তা সহজেই কাজে লাগাতে পারে। পুরুষের আইনগত অস্ত্রের নাম হচ্ছে ‘তালাক’। এর ব্যবহারের জন্য তাকে স্বাধীন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে স্ত্রীর আইনগত হাতিয়ারের নাম হচ্ছে ‘খোলা’। এর ব্যবহারের নিয়ম হচ্ছে, সে যখন বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করতে চায়, তখন সে প্রথমে স্বামীল কাছে এটা দাবি, করবে। সে যদি স্ত্রীর দাবি পূর্ণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে সে কাযীর সাহায্য নেবে।
স্বামী-স্ত্রীর অধিকারের মধ্যে এভাবেই ভারসাম্য বজায় থাকতে পারে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রকৃতপক্ষে এ ভারসাম্যই স্থাপন করেছেন। কিন্তু মাঝকান থেকে কাযীর শ্রবণ করার ক্ষমতাকে খারিজ করে এ ভারসাম্য বিনষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কেননা নারীকে আইন অনুযায়ী যে হাতিয়ার দেয়া হয়েছিল, তা এভাবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে এবং কার্যত আইনের রূপ বিকৃত হয়ে এমন হয়ে গেছে যে, পুরুষ যদি দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘিত হওয়ার আশংকা করে অথবা এ সম্পর্ক তার জন্য অসহনীয় হয়ে পড়ে, তাহরে সে তা ছিন্ন করতে পারবে। কিন্তু যদি স্ত্রীর ক্ষেত্রে এ একই আশংকা দেখা দেয় অথবা দাম্পত্য সম্পর্ক তার জন্য অসহনীয় হয়ে পড়ে তাহলে এ সম্পর্ক ছিন্ন করার কোন উপায় তার হাতে থাকে না। পুরুষ যতক্ষণ তাকে মুক্ত করে না দেয়, সে এ বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য, চাই তার জন্য আল্লঅহর নির্ধারিত সীমার ওপর কায়েম থাকা অসম্ভবই হোক না কেন এবং বিবাহের শরঈ উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ ব্যাহত হোক না কেন। আল্লাহও তাঁর রাসূলের শরীয়তের ওপর এরূপ সুস্পষ্ট বে-ইনসাফী ও অবিচারের দোষারোপ করার এতটা দুঃসাহস কারো মধ্যে আছে কি? কেউ যদি এ দুঃসাহস করে তাহলে ফিকহবিদদের মতামত নয়, বরং কিতাব ও সুন্নাহ থেকে তাকে এ প্রমাণ পেশ করতে হবে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল খোলার ব্যাপারে কাযীকে কোন অধিকার বা কর্তৃত্ব দেননি।
খোলার ব্যাপারে কাযীর এখতিয়ার
কুরআন মজীদের যে আয়াতে খোলার নিয়ম-কানুন বর্ণনা করা হয়েছে তা আবার পড়ুনঃ
**********************************
“যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, তারা (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা বজায় রাখতে পারবে না তাহলে তাদের জন্য এটা কোন দূষণীয় ব্যাপার নয় সে, (স্ত্রী) কিছু ফিদয়া (বিনিময়) দিয়ে বিচ্ছিন্নতা অর্জন”।– সূরা আল বাকারাঃ ২২৯
এ আয়াতে স্বয়ং স্বামী-স্ত্রীকে নামপুরুষের (3rd person dual Number) ক্রিয়াপদে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ********** (যদি তোমাদের আশংকা হয়) শব্দটিতে তাদেরকে সম্বোধন করা হয়নি। এখন অবশ্যই মানতে হবে যে, মুসলমানদের যাবতীয় বিষয়ে কর্তৃত্বসম্পন্ন (উলিল আমর) লোককেই এখানে সম্বোধন করা হয়েছে এবং আল্লাহর নির্দেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মতিতে খোলা সম্পন্ন না হলে তা ‘উলিল আমরে’র আছে রুজু করতে হবে।
আমরা উপরে যেসব হাদীস উল্লেখ করে এসেছি সেগুলো থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। নবী করীম (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের কাছে খোলার দাবি নিয়ে স্ত্রীলোকদের আগমন এবং তাদের অভিযোগ শ্রবণ করা স্বয়ং একথাই প্রমাণ করে যে, খোলার ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মত হওয়া সম্ভব না হলে স্ত্রীলোকটি কাযীর শরণাপন্ন হবে। এখন কাযী যদি বাস্তবিকপক্ষে শুধু অভিযোগ শোনার ক্ষমতা রাখেন, কিন্তু পুরুষ লোকটির সম্মত না হওয়ার ক্ষেত্রে তাকে নিজের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করার ক্ষমতা না রাখেন, তাহলে কাযীকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের কেন্দ্র হিসাবে নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ নিরর্থক। কারণ তাঁর কাছে না গেলে যে ফল দাঁড়ায়, তাঁর কাছে গিয়েও সেই একই ফল হচ্ছে। কিন্তু হাদীসের ভাষ্য থেকে কি একথা প্রমাণিত হয় যে, এ ব্যাপারে কাযীর কোন এখতিয়ার নেই? নবী করীম (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যতগুলো ফায়সালা উপরে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর সবকটিতে নির্দেশসূচক (Imperative) বক্তব্য এসেছে।
যেমন ************* (তাকে তালাক দাও) এবং ************ (তাকে পৃথক করে দাও) এবং ************* (তার পথ ছেড়ে দাও) অথবা বলা হয়েছে, তিনি (রাসূল) পুরুষ লোকটিকে নির্দেষ দিয়েছেন, ‘তুমি এরূপ করো’। ইবনে জারীর র. ইবনে আব্বাস (রা) থেকে যে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন তার শব্দগুলো হচ্ছে ‘ফাফাররাকা বাইনাহুমা’ (অতপর তিনি উভয়কে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন)। স্বয়ং জামীলা বিনতে উবাই ইবনে সালূলের বর্ণনাও এ শব্দগুলো উল্লিখিত হয়েছে। এরপরও একথা বলার কোন সুযোগ থাকে না, ‘খোলার ব্যাপারে কাযীর হুকম দেয়ার কোন এখতিয়ার নেই’।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্বামী যদি কাযীর এ হুকুমকে পরামর্শ মাত্র মনে করে তা মানতে অস্বীকার করে, তাহলে তিনি কি জোরপূর্বক তাকে নিজের হুকুম মানাতে বাধ্য করতে পারবেন? এর জবাব হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলের এরূপ কোন দৃষ্টান্ত পাচ্ছি না যে, তিনি কোন ফায়সালা দিয়েছেন আর কেউ তাঁর সামনে মাথানত না করার দুঃসাহস করেছে। কিন্তু এক্ষত্রে আমরা আলী (রা)-এর একটি সিদ্ধান্তের ওপর অনুমান (কিয়াস) করতে পারি। এতে তিনি এক উদ্ধত স্বামীকে বলেছিলেনঃ
**********************************
“অনুরূপ স্ত্রীলোকটি যেভাবে বিচারকের ফায়সালা মেনে নিয়েছে, তুমি যতক্ষণ তা মেনে না নিবে ততক্ষণ তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে না”।
বিচারকদের ফায়সালা মানতে অস্বীকার করার দরুন তিনি যদি কোন স্বামীকে বন্দী করার ক্ষমতা রাখেন তাহলে তিনি নিজের ফায়সালা মেনে নিতে তার ওপর শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা অবশ্যই রাখেন। এমন কোন কারণ নেই যে, দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ের মধ্যে কেবল এক খোলার ব্যাপারেই কাযীর অধিকারের ব্যতিক্রম করা হবে। ফিকহের কিতাবসমূহে এমন অনেক খুঁটিনাটি মাসয়ালা পাওয়া যায় যেখানে কাযীকে এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, স্বামী যদি তাঁর নির্দেশে তালাক না দেয় তাহলে তিনি নিজেই উভয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করে দিবেন। তাহলে খোলার ক্ষেত্রে তাঁর এরূপ ক্ষমতা কেন থাকবে না?
সামনে অগ্রসর হয়ে যে আলোচনা করা হবে তা থেকে এ সত্য আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, নপুংসক, লিংগ কর্তিত, খোজা, কুষ্ট রোগাক্রান্ত এবং উন্মাদ স্বামীদের ক্ষেত্রে মহান ফিকহবিদগণ যেসব নিয়ম-কানুন বর্ণনা করেছেন এবং অনুরূপভাবে মেয়েদের বালেগ হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের নিজের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার (খিয়ারে বুলূগ) এবং এছাড়া অন্যান্য মাসয়ালার ক্ষেত্রে ইজতিহাদের ভিত্তিতে যেসব আইন-কানুন নির্ধারিত করেছেন, তার বর্তমানে নারীদের খোলা দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা কাযীর হাতে থাকা অত্যন্ত জরুরী, অন্যথায় যেসব মহিলা এরূপ করুণ অবস্থায় নিপতিত হবে তাদের জন্য দুটি পথ ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। হয় তারা সারা জীবন মুসীবতের মধ্যে কাটাবে অথবা আত্মহত্যা করবে কিংবা নিজেদের জৈবিক উত্তেজনায় বাধ্য হয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়বে অথবা ধর্মত্যাগী (মুরতাদ) হয়ে বিবাহের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করার চেষ্টা করবে। আলোচ্য বিষয়টি সুস্পষ্ট করার জন্য একটি উদাহরণ পেশ করাই যথেষ্ট মনে করছি।
সহবাসে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন ব্যক্তির ব্যাপারে ফিকহের মাসয়ালা এই যে, তাকে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য এক বছরের সময় দেয়া হবে। চিকিৎসা গ্রহণের পর সে যদি একবারও সংগম করতে সক্ষম হয়, এমন কি অপূর্ণ সহবাসেও [**********************************
“রদ্দুল মুহতার গ্রন্হে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তির পুরষাঙ্গ থলথলে হয়ে গেছে সে যদি মাত্র একবার পুরষাংগের অগ্রভাগ স্ত্রী অংগে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয় তাহলে সে নপুংস বা পুরুষত্বহীন নয়। তার পুরুষাঙ্গ যদি কর্তিত হয় এবং যে যদি এর অবশিষ্ট অংশ স্ত্রীর অংগে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয় তাহলেও সে নপুংসক বা পুরুষত্বহীন নয়”।] সক্ষম হয়, তাহলে বিবাহ করার অধিকার স্ত্রীর থাকবে না, বরং তার এ অধিকার চিরকালের জন্য রহিত হয়ে গেল। বিবাহের সময় স্ত্রীর জানা ছিল যে, তার স্বামী নপুংসক। এরপরও সে তার সাথে বিবাহ বসতে সম্মত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্চেদের দাবি নিয়ে বিচারকের কাছে যাওয়ার মূলত তার কোন অধিকার নেই।[**********************************
“আলমগীরী নামক ফিকহের কিতাবে আছে, বিবাহের সময় স্ত্রীর যদি জানা থাকে যে, তার স্বামী নপুংসক এবং স্ত্রীলোকদের সাথে মিলিত হতে অক্ষম, তাহলে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করার অভিযোগ উত্থাপন করার অধিকার তার নেই”] পুরুষ লোকটি বিবাহের পর একবার সহবাস করার পুরুষত্বহীন হয়ে গেছে, তবুও স্ত্রীলোকটি বিবাহ বিচ্ছেদের দাবি উত্থাপন করার অধিকার রাখে না। [**********************************
“দুররুল মুখতার গ্রন্হে আছে, স্ত্রীর সাথে একবার সহবা করার পর যদি পুরুষাংগ থলথলে হয়ে যায় অথবা নপুংসক হয়ে যায় তাহলে এ সংগম স্বাদ লাভ করার পর স্ত্রীলোকটি বিবাহ বিচ্ছেদের দাবি তোলার অধিকার রাখে না”।] বিবাহের পর স্ত্রীলোকটি জানতে পারলো তার স্বামী নপুংসক, এরপরও সে তার সাথে ঘর-সংসার করার জন্য সম্মত হলো, এক্ষেত্রেও সে বিবাহ বাতিল করার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলো।[**********************************
“আল্লামা শামী বলেন, ‘বাতিল হবে না’ বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, স্ত্রী যতক্ষণ না বলবে, ‘আমি তার সাথে ঘর-সংসার করতে সম্মত আছি,’ ততক্ষণ তার বিবাহের বন্ধন ছিন্ন করার অভিযোগ উত্থাপন করার অধিকার বাতিল হবে না”।]
এসব অবস্থায় স্ত্রীলোকটির বিবাহ বাতিল করার ক্ষমতা তো এভাবে বাতিল হয়ে গেল। এরপর এ অপদার্থ স্বামীর হাত থেকে মুক্তিলাভের দ্বিতীয় পথ হচ্ছে- খোলা দাবি করা। কিন্তু তাও সে পেতে পারে না। কেননা সে যখন স্বামীর কাছে খোলা দাবি করে তখন সে সম্পূর্ণ মোহরানা অথবা তার চেয়েও কিছু বেশী গ্রহন করেও তাকে পরিত্যাগ করতে রাজী নয়। সে ব্যাপারটি আদালতে উত্থাপন করলে আদালত স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করতে অথবা উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে অক্ষমতা জ্ঞাপন করে। এখন চিন্তা করুন, এ বেচারী মহিলার কি পরিণতি হবে? হয় সে আত্মহত্যা করবে অথবা খৃস্টান মহিলা পাদ্রীর ন্যায় বৈরাগ্যের জীবন যাপন করবে এবং মানসিক যাতনা ভোগ করতে থাকবে অথবা বিবাহ বন্ধনের মধ্যে অবস্থান করে গর্হিত কাজে লিপ্ত হবে অথবা দীন ইসলামকে একদম ‘খোদা হাফেজ’ বলবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামী আইনের উদ্দেশ্য কি এই হতে পারে যে, কোন স্ত্রীলোক উল্লিখিত পরিস্থিতির কোন একটিতে নিমজ্জিত হোক? শরীয়তের যে উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য দাম্পত্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা কি এ ধরনের দাম্পত্য সম্পর্কের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে? এ ধরনের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি ভালোবাসা ও সম্প্রতি সৃষ্টি হতে পারে? তারা কি একত্র হয়ে সমাজ ও সভ্যতার জন্য কোন অবদান রাখতে সক্ষম হবে? তাদের ঘরে কি কখনো খুশী ও আনন্দের বার্তাবাহক ফেরেশতা প্রবেশ করতে পারবে? এ ধরনের দাম্পত্য বন্ধন কি কোন দিক থেকে সুরক্ষিত দুর্গের সংজ্ঞায় আসতে পারে এবং এর দ্বারা দীন, নৈতিক চরিত্র ও মান-সম্ভ্রমের হেফাযত হতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি না- সূচক হয় তাহলে বলুন, একজন নিরপরাধ মহিলার জীবন বরবাদ হওয়া অথবা বাধ্য হয়ে গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে যাওয়া অথবা দীন ইসলামের গণ্ডী থেকে বের হয়ে যাওয়ার দায়-দায়িত্ব কার মাথায় চাপবে? আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তো নিশ্চয়ই দায়িত্বমুক্ত। কেননা মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় নবী নিজেদের দেয়া আইনের মধ্যে এ ধরনের কোন ক্রটির অবকাশ রাখেননি।