জীবন সমস্যার সমাধানে ইসলাম
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
বিষয়ক্রম
সূচনা
জীবন সমস্যা
প্রথম পরিচ্ছেদ
জীববিজ্ঞানের শিক্ষা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মনোবিজ্ঞানের শিক্ষা
ফ্রয়েডীয় মতবাদ
ম্যাকডুগাল
এ্যাডলার
জুঙ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষা
ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ
সামাজিক চুক্তিবাদ
ধনতন্র
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সমষ্টিকেন্দ্রিক মতবাদ
ইয়াহুদী ধর্ম
প্রাথমিক প্লেটো
মাজদাক
কার্ল মার্কস
মার্কসবাদ ও বস্তুবাদী সমাজতন্র
টলস্টয় বা নব্য খ্রিষ্টবাদ
গান্ধীবাদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
মানুষের পরিচয়
পূর্ণাঙ্গ দর্শন ও ইসলাম
ইসলামের অবলম্বন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বতঃসিদ্ধ
আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রশ্ন
আল্লাহ্র সার্বভৌমত্তের সঙ্গে মানুষের অধিকারের সমন্বয়
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ইসলামী নীতির রুপায়ণ-ব্যক্তিগত জীবনে, সমাজে ও রাষ্ট্রে ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি,সমাজ ও রাষ্ট্র
ইসলামী নীতির প্রয়োগ-ব্যক্তিগত জীবনেঃসালাত
সিয়াম ও রমযানের তাৎপর্য
হজ্জ ও কুরবানী
যাকাত
জিহাদ
সামাজিক জীবনে নর-নারী সম্পর্কঃ ইসলামি সমাজে নারীর মর্যাদা ও অধিকার
ইসলামের দৃষ্টিতে সুদপ্রথা
সাম্যবাদমূলক দায়ভাগ প্রথার প্রবর্তন
ইসলামী নীতির রুপায়ণ-রাষ্ট্রীয় জীবনেঃ মদীনার সনদের সারমর্ম
পুঁজি সৃষ্টির বিরুদ্ধে অর্ডিন্যান্স
ইসলামী গণতন্ত্রের ফলিত রুপ
খলীফার দায়িত্ব
ইসলাম ও ডিক্টেটরশিপ
সংখ্যালঘু সমস্যা
খলীফার নিয়োগ
অর্থনীতি
উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা
শাসন ও বিচার বিভাগ
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ইসলামী রাষ্ট্রের ভাঙ্গনের কারণ
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ইসলামী সমাজের ভূমিনীতি ও তার প্রয়োগ
ইসলামী জীবন দর্শন ও তার ফলিত রূপ
ইসলামী সমাজে ভোগদখলের অধিকার
তিনটি শর্ত রয়েছে
ভোগ-দখলের জমির পরিমাণ
জমি থেকে ফসল উৎপাদনের নীতি
উৎপাদনের পদ্ধতি
ইসলামী সমাজের ভূমিনীতি
আধুনিক যুগে ইসলামী নীতির প্রয়োগ
নবম পরিচ্ছেদ
ইসলামের বিকাশ
দশম পরিচ্ছেদ
অনাগত বিশ্বসংস্থা ও ইসলাম
ব্যবহৃত পারিভাষিক শব্দ
গ্রন্থপঞ্জি
পরিশিষ্ট
লেখকের কৈফিয়ত
আমরা বহুকাল যাবত অবরোহ পদ্ধতিতে (Deductive Method) ইসলামকে পাঠ করে এসেছি। এতে আমাদের জীবনের প্রত্যয়শীলতা বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়েছে; তবে সে প্রত্যয় বা faith-এর মূলে কোন যুক্তির অবতারণা করতে পারেনি। তাই এ দুনিয়ার অমুসলিম বা বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাধারায় অভ্যস্ত লোকের নিকট আমাদের এ প্রত্যয়শীলতা অন্ধবিশ্বাসের আকারেই রয়ে গেছে। তার ফলে ইসলাম যে বিশ্বজনীন ধর্ম বা মানব প্রকৃতির ধর্ম সে দিকটা রয়ে গেছে অস্পষ্ট। মানবজীবনকে একটা অতিশয় সত্য বিশয় বলে গ্রহণ করে যদি তারই ভিত্তিতে প্রকৃত সত্য লাভ করার চেষ্টা করা যায়, তা’হলে মানব-জীবনের প্রকৃত রূপ এবং তার সন্তোষ বিধানের জন্য যে বিষয়কে অবশ্য সত্য বলে গ্রহণ করতে হবে, তার আলোচনা করা প্রয়োজন। এমন একজন ধর্ম-বহির্ভূত মানুষ যার কোন মতবাদে বিশ্বাস নেই এবং যিনি জীবনের সন্তোষের জন্য যে কোন মতবাদই গ্রহণ করতে প্রস্তুত, তারই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ পুস্তকের আলোচনা আরম্ভ হয়েছে। এজন্য তার নামকরণ করা হয়েছে, “জীবন সমস্যার সমাধানে ইসলাম”। এতে জীবনের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে ইসলাম কিভাবে সার্থক সে বিষয়টাই মানব সাধারনের নিকট তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য কোন কোন বিষয় সাধারণ পাঠকের নিকট বিসদৃশ বলে প্রতিভাত হতে পারে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রত্যাদেশ বা ওহী খাস আল্লাহ্র এক দান। তা নবী মুরসালদের কাছে আল্লাহ ফেরেশতার মাধ্যমে নাযিল করেন। অথচ হিব্রুধর্ম গোষ্ঠী যথা-ইহুদী ও ঈসায়ী ধর্মাবলম্বী মানুষ ব্যতীত অপরাপর ধর্মালম্বী লোকদের নিকট তা গ্রহণযোগ্য নয়। একজন nonconformist- এর নিকট সে প্রত্যাদেশকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় পেশ করতে হলে তার মধ্যে নবী মুরসালদের সক্রিয়তার দিকটা প্রকাশ করা প্রয়োজনীয় গতিকে তাকে বৈজ্ঞানিক আকারেই প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজ্ঞান সতত পরিবর্তনশীল। কাজেই আজকের জগতে যা বৈজ্ঞানিক সত্য বলে স্বীকৃত, পরবর্তী যুগে তা স্বীকৃত নাও হতে পারে। তার উত্তরে বলা যায়, জীবনকে যদি সঠিকভাবে পরিচয় করার বাসনা কারো মনে জাগে এবং জ্ঞানের সকল ক্ষেত্র ও পদ্ধতিকে স্বীকার করা হয়, তাহলে স্বজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাদেশ বা ওহী নামক জ্ঞানকে স্বীকার করতেই হবে। কাজেই এক্ষেত্রে লেখক একজন nonconformist- এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিষয়টার আলোচনা করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন মতবাদবিহীন একজন স্বাধীন ও স্বাতন্ত্র্যবাদী লোকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও যদি আলোচনা করা যায়, তাহলেও ওহীকে স্বীকার করতে হবে।
ইসলামকে জগৎ সভ্যতায় পেশ করা হয়েছে প্রশ্নবিহীন অবশ্যগ্রহণীয় এক প্রত্যয় হিসেবে। জীবনের নানাবিধ চাহিদা পরিপূরণে সক্ষম এক মতবাদ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা থেকেই এ পুস্তকে নবুয়াত, রিসালার বা বেলায়েতকে যুক্তিসঙ্গত বিষয় বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এ পুস্তকের আলোচ্য বিষয় মানবজীবনের ইসলামী সমাধান- কেবল মুসলিম জীবনের সমাধান নয়, আশা করি এ বিষয়টা বিদগ্ধ পাঠক বিবেচনা করে দেখবেন। -মোহাম্মদ আজরফ
সূচনা
জীবন সমস্যা
মানব-জীবনে কত সমস্যা। জীবন-প্রভাতেই তাতে দেখা দেয় নানা প্রশ্ন। একটুখানি চলাফেরা বা বুদ্ধি-বিবেচনা দেখা দিলেই মানুষ ভাবতে আরম্ভ করে- “আমি কোথা থেকে এলাম? কোথায় আমি যাবো? কেন এখানে এলাম? আমাকে কি এই দুনিয়া ভালবাসে না হিংসা করে?” যখন ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় আকাশ প্লাবিত হয়, তখন ছোট ছোট শিশুরা মনে করে- চাঁদের দেশে বুঝি বা কত সুখ! কত সৌন্দর্য! যখন বাসন্তী সমীরণে গাছের পাতাগুলোর আড়ালে বসে কোকিল বা এ জাতীয় কোন পাখি মধুর সুরে আপ্যায়িত করে, তখন শিশুদের মনে স্বাভাবিকভাবেই কোকিলের পার্শে বসে তার মত গান গাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ পায়। তারা মনে করে- না জানি ওই গাছের ডালে বসে ওই পাখিটা কত আনন্দ উপভোগ করছে! আবার জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন আম, জাম ও কাঁঠাল পাকে, তখন সে কোকিল-বধূই যখন অপূর্ব গান গেয়ে রাত্রিকে সরব করে তুলে, তখন পাড়াপড়শিরা তার এ গানকে বলে “বউ কথা কও”- তখন শিশুর মনে এ পাখির প্রতি কত শ্রদ্ধাই না দেখা দেয়। সে মনে করে, বউ অভিমান করে কথা বলছে না বলে তার বরের মনে কি কষ্ট! সেজন্যই বোধ হয় বরের হয়ে পাখিটা বউকে সাধ্য-সাধনা করে বলছে- “বউ কথা কও”। ফাগুন মাসে যখন গাছে গাছে নানা জাতীয় ফুল প্রস্ফুতিত হয়ে চারদিকে সুবাসের বান বইতে থাকে, তখন শিশুর মনে সত্যিই প্রশ্ন দেখা দেয়, এ ফুলগুলো কে ফোটাচ্ছে, তাকে কি দেখা যায়, না সে লুকিয়ে থাকে- পালিয়ে বেড়ায়?
আবার যখন প্রবল ঝড়ে গাছ-গাছালি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, ঘর-দুয়ার সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তখন সেই শিশুই ভাবতে থাকে, এ আবার কি আপদ! এ কোন দৈত্য-দানব বা জিন দেখা দিল আমাদের সামনে? হটাৎ ভীষণ গর্জন করে আকাশে কি এমন কোন ব্যক্তি রয়েছে, যার গলার স্বরই গর্জনরূপে দেখা দিচ্ছে? বান-বন্যা দেখা দিলে বা ভূমিকম্পের ফলে দেশে হেথায় হোথায় নানা ফাটল দেখা দিলে শিশুরা ভয়ে হকচকিয়ে চায়- এ আবার কোন্ দুশমনের কাজ! কে এসব অনাচার অত্যাচার করে আমাদের দেশের এ সর্বনাশ করেছে অর্থাৎ সোজা কথায় এ দুনিয়া আমাদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বা আমাদের ভীষণ শত্রু, এ প্রশ্নটা তাদের মনে দোলা দেয়।
এ সকল প্রশ্নের পূর্বে যে সকল প্রশ্ন তাদের মানসে দেখা দিয়েছিল অর্থাৎ তারা কোথা থেকে এল; আবার কোথায় ফিরে যাবে? কেনই বা এল, আবার কেনই বা আবার ফিরে যাবে, ইত্যাকার প্রশ্ন বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধামাচাপা পড়ে রয়। কৈশোরের প্রারম্ভে নানা বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও এ দুনিয়াটা মানুষের কাছে আলো-ঝলমল রূপেই দেখা দেয়। মনে হয় এ দুনিয়ার সবকিছুই সুন্দর, সবকিছুই চমৎকার। ছেলেবেলায় এ দুনিয়ার যে সব বীভৎস দৃশ্য দেখে ছেলেরা ভয়ে ও বিস্ময়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে,কৈশোরে সেগুলোর এ ভয়ঙ্কর রূপকে অগ্রাহ্য করে কিশোর ও কিশোরী তার আনন্দময় রূপেই মুগ্ধ হয়ে পড়ে। তখন তাদের কাছে ‘সাময়িকভাবে এগিয়ে চলছি” জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে অপরের প্রতিযোগিতার প্রবৃত্তি দেখা দিলেও প্রেম, সখ্য, স্নেহ-প্রীতি প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি তাদের মানসকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। যারা একেবারে শৈশব থেকে অপরাধপ্রবণ, তাদের মানসে অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ দেখা দিলেও দলীয় মনোবৃত্তি বা Group mindedness দ্বারা তারা প্রভাবান্বিত হয় এবং দলের সভ্যদের সঙ্গে তাদের নিজেদের ঐক্য অনুভব করে, দলের স্বার্থ রক্ষার্থে নানাবিধ অপকর্ম করতেও প্রস্তুত হয়। এজন্য একালকে ব্যক্তি-স্বার্থহীনতার কাল বলা যেতে পারে। একদিকে যেমন শৈশবের যে সকল আদি প্রশ্ন সম্বন্ধে তাদের মধ্যে উদাসীনতার ভাব পরিলক্ষিত হয় তেমনি ব্যক্তিগত জীবনের গণ্ডি অতিক্রম করে বৃহত্তর গণ্ডির মধ্যে আত্মবিলোপের প্রবৃত্তি তাদের মধ্যে দেখা দেয়। জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে লালিত-পালিত হলেও সকল স্তরে কিশোর ও কিশোরীদের মানসে সে একই ভাব প্রবল হয়ে ওঠে।
এ সন্ধিক্ষণেই নারী ও পুরুষের দৈহিক পার্থক্য ক্রমশ প্রকট হয়ে দেখা দিলে একের প্রতি অপরের আকর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে হিংসার ভাবও দেখা দেয়। কোন কোন বিষয়ে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পেলে কিশোরীদের মানসে একটু হিংসার ভাবও দেখা দেয়। আবার কিশোরদের মানসে মেয়ে ছেলের সে কমনীয়তা- সে পেলবতার প্রতি হিংসার উদ্রেক হয়। ক্রমে উভয়ের জীবনের মধ্যে বিভিন্নতা আরও প্রকট হলে তাদের মধ্যে বিচ্ছিনতার সঙ্গে সঙ্গে একে অপর থেকে শ্রেষ্ঠতর বলে প্রতিপন্ন করার ইচ্ছাও প্রবল হয়ে দেখা দেয়। এভাবে কৈশোরের স্তর পার হয়ে যৌবনের প্রবল জোয়ারের মধ্যে যখন মানুষেরা ভেসে চলে, তখন তাদের মানসে কত সাধ, আহলাদ,কত স্বপ্ন, কত লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার মধ্যে অর্থের লালসার সঙ্গে সঙ্গে নর অথবা নারীর আসঙ্গ কামনা অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে। তা থেকেই তাদের জীবনে দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা। অন্ন সমস্যা ও যৌন সমস্যা যেমন মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে-তেমনি তাদের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ সমস্যাও দেখা দেয়। এ সকল সমস্যাও আবার পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। অন্ন সমস্যার সমাধান করতে হলে বস্ত্র সমস্যার সমাধান করতে হয়। শীত-গ্রীষ্মের অত্যাচার থেকে শরীরকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে ছুটাছুটি করে মানুষ তার আহারের সংস্থান করতে পারে না। আবার পেটের যোগাড় না হলে মানুষের কাজ করবার শক্তিও থাকে না। প্রয়োজনমত পুষ্টিকর আহার্য ব্যতীত মানুষের শরীর টিকে থাকে না। তাই অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করা মানুষের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য।
কেবলমাত্র অন্ন-বস্ত্রের সমস্যা নয়, যৌন সমস্যাও মানব জীবনে নানাভাবে দেখা দেয়। বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বা তরুণের বৃদ্ধা ভার্যা হলে যেমন যৌন সমস্যা দেখা দিতে পারে, অসমর্থ পুরুষের সমর্থ স্ত্রী অথবা সমর্থ স্ত্রী অসমর্থ স্বামী থাকলেও যৌন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব ব্যতীত জীবন্ত ধর্ম, সমাজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানও প্রকৃত প্রেমিকার মিলনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। এ সকল সমস্যা ব্যতীত মানুষের মধ্যে যে বৈরীভাব রয়েছে, তার ফলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বা জাতিতে জাতিতে প্রায় সব সময়ই নানাবিধ স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে, যার ফলে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে বা শ্রেণীগত জীবনেও নানাবিধ দ্বন্দ্ব-কলহ প্রায় দেখা দেয়। যৌন সমস্যাও অন্ন সমস্যার ওপর নির্ভরশীল। প্রেমিক-প্রেমিকার আসক্তি যতই প্রবল হোক না কেন, উভয়ের মধ্যে কোনও একজন উপার্জনক্ষম না হলে এবং সংসারের ঠেলা সামলাতে না পারলে, কিছুদিন পরেই তাদের প্রেমের হাটে ভাঙ্গন শুরু হয়। কোন কোন দেশের হাজার হাজার পতিতার জীবন অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, অন্ন সমস্যার সমাধানে অসমর্থ হয়েই তারা এ বৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে যৌন-জীবনের উচ্ছৃঙ্খলতা যে রোজগারের পক্ষে কত বড় প্রতিবন্ধক তার প্রমাণ ঘটে সব জায়গায়ই পাওয়া যায়। একজন লোক হয়ত উপার্জন করতে খুবই সক্ষম, কিন্তু পূর্ণ বয়সে যৌন পরিতৃপ্তির অভাবে সে হয়ত বিকৃত রুচির পরিচয় দিতে পারে এবং সেই বিকৃত পথেই হয়ত তার জীবনের সমস্ত আয়-ব্যয় করতে পারে! কাজেই তার জীবনের যৌন সমস্যার সমাধান না হলে তার পক্ষে অন্ন সমস্যার করাও অসম্ভব।
অন্নের জন্য, বস্ত্রের জন্য বা যৌন-পরিতৃপ্তির জন্য নানা কারণেই মানব জীবনে যুদ্ধ বাধে। সে যুদ্ধ যখন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে হয়,তখন তার জন্য গোটা সমাজের মনে কোন আশঙ্কা দেখা দেয় না। সেই যুদ্ধ যদি দুই দেশের মধ্যে প্রবলভাবে বাধে, তা হলে দুই দেশেরই নরনারীর জীবনে নানাবিধ সমস্যা উগ্রমূর্তি হয়ে দেখা দেয়। যুদ্ধের প্রয়োজন সমর্থ বয়সের পুরুষেরা চাষ-আবাদ ছেড়ে কামান-বন্দুক-গোলাগুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লে দেশের চাহিদার পক্ষে উপযুক্ত শস্য উৎপাদন করা সম্ভবপর হয় না। সমাজ-জীবনেও না বিশৃঙ্খলা ও বৈকল্য প্রকাশ পায়। যুদ্ধের সঙ্গে অন্ন সমস্যা ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত। কোন দেশ যদি তার প্রয়োজনে উপযুক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে অপারগ হয়, তাহলে অন্য দেশের খাদ্যসামগ্রীর প্রতি সে আকৃষ্ট হবেই। সে দেশ থেকে তার প্রয়োজনমত খাদ্যদ্রব্য জোর করে ছিনিয়ে আনবার লোভ তার মনে প্রবলভাবে প্রকাশ পাবে। আবার যদি কোন দেশে তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে সে উদ্ধুত্ত মাল অন্য দেশে চালান দিয়ে তা থেকে দু’পয়সা লাভ করতে লোভী হতে পারে। এতে বাধা পেলে যে কোন দেশ তেরিয়ে হয়ে সরাসরি হানাহানিতে লিপ্ত হয়।
অন্যান্য সমস্যার সমাধানে যখন মানুষ প্রমত্ত হয়, তখন গোটা সমাজজীবনে এত আলোড়ন হয় যে, যুদ্ধের ব্যাপারে এক হুলস্থুল কাণ্ড দেখা দেয়। সমাজজীবনে নানাভাবে আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়।
এ সকল সমস্যাই সাধারণভাবে মানবজীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। যে সকল দেশে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার লোপ করে দেশের সম্পদকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্তাধীন করা হয়েছে, সেসব দেশে অন্ন সমস্যা, বস্ত্র সমস্যা বা যৌন সমস্যা পূর্ববর্ণিত আকারে দেখা না দিলেও সেসব সমস্যার এখনও সমাধান হয়নি। সে সকল দেশের রাষ্ট্রে বা রাষ্ট্রের কর্ণধারদের পক্ষে এ সকল সমস্যার সমাধান অত্যন্ত গুরুতর কর্তব্য হয়ে দেখা দেয়। দেশের সকল লোকের পক্ষে উপযুক্ত খাদ্য, পরিধেয়, ও নর-নারীর যৌন ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করা সম্ভবপর হলেও যৌন সমস্যা বা যুদ্ধ সমস্যার সমাধান তত সহজ হয় না- কারণ সেসব রাষ্ট্রেও পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে সর্বসাধারণ মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য পাত্র বা পাত্রীকে বাধ্য হয়েই তার মনোমত পাত্র বা পাত্রী নির্বাচনের সম্পূর্ণ অধিকার পরিত্যাগ করতে হয়। তার ওপর ব্যক্তিগত জীবনে সকল মানুষের মানসেই অল্পবিস্তর হিংসা রিপু থাকায়- সে সব দেশেও আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কঠোর হস্তে দুষ্কৃতকারীদের দমন করতে হয়। সেজন্য নানাবিধ পদ্ধতিতে সেসব দৃষ্টান্তকারী লোকদের এ সকল কর্মের মূলে অবস্থিত মানসিকতার বীজ আবিস্কার করা একটা মহাসমস্যা হয়ে দেখা দেয়। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যতীত এ দুনিয়ার অপরাপর যেসব রাষ্ট্র রয়েছে- তাদের সঙ্গে নানাবিধ বিষয় নিয়ে নানাভাবে সংঘর্ষ দেখা দেয়। এমনকি সমাজতান্ত্রিক মতবাদে প্রত্যয়শীল দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখা দেয়।
এতেই স্পষ্টই প্রমাণিত হয়- মানবজীবন যে পর্যায়েই থাকুক না কেন এবং সমাজ বা রাষ্ট্র যেভাবেই গঠিত হোক না কেন- তাতে যে নানা সমস্যা রয়েছে- সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
ব্যক্তি-জীবনে আবার এ সকল সমস্যার মধ্যে শৈশবের প্রশ্নগুলো প্রৌঢ় বয়সে পুনরায় অত্যন্ত প্রবলভাবে দেখা দেয়। শৈশবের যে আদি প্রশ্নগুলো- আমি কোথা থেকে এসেছি? আমি আবার কোথায় যাব? আমার সঙ্গে এ পৃথিবীর সম্বন্ধ কিরূপ ইত্যাকার প্রশ্ন মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। মৃত্যুর পথে মানুষ যতই অগ্রসর হতে থাকে, ততই সে জানতে চায়- সে কোথায় যাচ্ছে- সে আবার কি এ পৃথিবীতে ফিরে আসবে , না সে বিদায়ই তার পক্ষে চিরবিদায়? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রি-পুত্র কন্যা সকলের নিকট থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে কি সে আবার এ জীবনের মতই টিকে থাকতে পারবে, না তার মাটির দেহ মাটিতেই মিশে যাবে- এ প্রশ্ন নর-নারী-নির্বিশেষে সকল মানুষের মনে দেখা দেয় এবং সেগুলোর মীমাংসার জন্য মানুষ কোথাও বা গুরুজনের, কোথাও বা পীর মুর্শেদ দরবেশের, কোথাও বা ধর্মাবতার, আবার কোথাও বা শেষ বিচারের আশ্রয় নেয়।
তাই স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে- মানবজীবনেই কেন এ সকল প্রশ্ন দেখা দেয়? অন্যান্য পশুপক্ষীর জীবনে তো সেসব প্রশ্ন দেখা দেয় না। দেখা দিলেও তার সমাধানের কোন লক্ষণ তাদের জীবনে পরিলক্ষিত হয় না। এজন্য প্রয়োজন গভীরভাবে মানবজীবনকে অধ্যয়ন করা। মানবজীবনের প্রকৃত সত্তার আলোকে তার জীবনের নানাবিধ সমস্যার সমাধান করতে পারলে মানুষ সুস্থ জীবন যাপনে সমর্থ হতে পারে। অন্যথায় তার জীবনের কোন বিশেষ দিকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করার ফলে জীবনের অন্যান্য দিকগুলোতে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে এবং সে বিদ্রোহের ফলে জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া অবশ্যম্ভাবী। মানবজীবনকে নানাভাবে দেখবার সুযোগ রয়েছে। যেমন দেহধারী জীব হিসেবে তাকে জীববিজ্ঞানের দিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার প্রকৃত স্বরূপ নির্ণয় করার চেষ্টা করা যায়, তেমনি সমাজবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত অনুসারেও তার প্রকৃত রূপের পরিচয় পাওয়া সম্ভবপর হতে পারে। অপরদিকে মানসিক ক্রিয়াকলাপের অধিকারী হিসেবে তাকে মনোবিজ্ঞানের আলোকে মানবজীবনের প্রকৃত রূপের পরিচয় পাওয়া সম্ভবপর হতে পারে। অপরদিকে মানসিক ক্রিয়াকলাপের অধিকারী হিসেবে তাকে মনোবিজ্ঞানের আলোকে মানবজীবনের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটন করা আমাদের পক্ষে কর্তব্য এবং তারই আলোকে তার জীবনের মূল লক্ষ্য সম্বন্ধে অবহিত হওয়া উচিত।