পঞ্চম পরিচ্ছেদ
মানুষের পরিচয়
একটি সত্য স্বভাবতই চোখে পড়ে। এ যাবত সেসব মতবাদের উৎপত্তি হয়েছে, তাতে মানবজীবনের কোন বিশেষ দিকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, তারই আলোকে গোটা জীবনের ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য হয়েছে প্রয়াস। যদিও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নামে তারা জগতে প্রচারিত তবুও তাদের মধ্যে রয়েছে অবৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি। বিজ্ঞানের আসল কথা, জীবনের সকল তথ্যকে গ্রহণ করে, তার ব্যাখ্যার জন্য সার্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। এসব ব্যাখ্যায় সকল তথ্যকে গ্রহণ না করে বিশেষ থিয়োরি বা মতবাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার চেষ্টায় অনেকগুলোকে করা হয়েছে অস্বীকার অথবা তাদের বিকৃতি করে ফেলে দেয়া হয়েছে ছকের মধ্যে। তাতে আরোহ৯১ পদ্ধতির করা হয়েছে অবমাননা। কারণ বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য বিশেষ৯২ থেকে সার্বিকে৯৩ উপস্থিত হওয়া। অবরোহ পদ্ধতিতে৯৪ কোন বিশেষ নীতিকে গ্রহণ করে নিচের দিকে নেমে যাওয়া বৈজ্ঞানিক জগতে আত্মহত্যারই নামান্তর। অথচ লক্ষণীয় যে, আরোহ পদ্ধতিই বৈজ্ঞানিক জগতে একমাত্র বিষয় পদ্ধতি বলে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও সেই অবরোহ পদ্ধতির প্রভাব বিজ্ঞান এড়িয়ে যেতে পারেনি। তাই গোড়াতে জীব জগতে যুদ্ধ৯৫ বা কামপ্রবৃত্তির মৌলিকতা, মানুষের স্বার্থপরতা প্রভৃতি সূত্রগুলোকে স্বীকার করে তাদের একচোখা আলোকে জটিল জীবনের সবগুলো দিকের ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে।
এমনকি, যে কার্ল মার্কস হেগেলের চিন্তা মাধ্যমগুলোকে শ্রেণী-সংগ্রামে রুপান্তরিত করে উৎপাদন ও বণ্টন-ব্যবস্থার সূত্রে জীবনের গতি ও ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, তাঁর মনেও সবসময় হেগেলীয় দর্শনের প্রভাবই ছিল কার্যকরী। তাই তাকে অস্বীকার করেও জীবনের বিচিত্র ক্ষেত্রে তারই অমোঘতা স্বীকার করে নিয়েছেন। উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়া মানবজীবনে যতো সব ফ্যাকটর কার্যকরী সেগুলোকে তিনি করেছেন সম্পূর্ণ অস্বীকার বা যুক্তিবাদের প্রভাবে তিনি একটি ছকে ফেলে মানবজীবনে সবগুলো দিকের ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। তাই দেখা দিয়েছে অবৈজ্ঞানিক মনোভাব।
দ্বিতীয়ত, আধুনিক বিজ্ঞানে যুক্তি ও অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানের একমাত্র পন্থা বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এগুলো ব্যতীত মানবজীবনে জ্ঞানের অপর কোন পন্থা নেই বলে ধরে নেয়া হয়েছে।এ মনোভাবের মধ্যেও বিজ্ঞানের রয়েছে এক মস্তবড় গোঁড়ামি।
তৃতীয়ত, এসব আলোচনার ফলে আমরা দেখেত পেয়েছি মানবজীবনের মধ্যে রয়েছে মস্তবড় দ্বন্দ্ব। এক-চোখামি করে মানবজীবনের কোন ব্যাখ্যা করতে গেলেই মানবজীবনের অন্য দিক বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তার ফলে অন্য মতবাদের উৎপত্তি হয়। তাতেও জীবনের ব্যাখ্যা সুষ্ঠু হয় বলে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের উৎপত্তি ও সংঘাতের মধ্য দিয়েই মানব-সভ্যতার গতি চলছে ধেয়ে। কাজেই মানবজীবন সম্বন্ধে কোন সার্বিক সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছার আগে তার সম্বন্ধে পেতে হবে পূর্ণ জ্ঞান। সে পূর্ণ জ্ঞানের আলোকেই গড়ে উঠবে তার জীবন-দর্শন।
মানবজীবনের অসংখ্য বৃত্তি ও প্রবৃত্তির সন্ধান পাওয়া যায়। তার জীবনে রয়েছে যেমন স্ববোধ৯৬ তেমনি রয়েছে পরার্থপরতা৯৭ । তার যেমন রয়েছে ক্ষুদা, যৌন প্রেরনা, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার বাসনা, সৌন্দর্য ভোগ করার প্রবৃত্তি, তেমনি রয়েছে প্রেম, আত্মত্যাগ, স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা, রুচিবোধ, নীতিবোধ, এ বিশ্বের প্রকৃত পরিচয় পাওয়ার জন্য অদম্য আকাঙ্ক্ষা।
মানব-মনে রয়েছে মনন ক্ষমতা৯৮ প্রক্ষোভ৯৮ ইচ্ছাশক্তি১০০। মানবমনের সম্ভাব্য উৎসের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বোধি১০১ ভুয়োদর্শন১০২ ও যুক্তির১০৩ মাধ্যম আদি থেকেই মানুষ জ্ঞানলাভ করছে। গোড়াতে যে কোন একটিতে জ্ঞানের সূচনা হলেও পরবর্তীকালে তার বিস্তৃতি ও ব্যাখ্যার জন্য অপরটির প্রয়োগও সম্ভবপর।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানে বোধিলব্ধ জ্ঞানের তেমন কার্যকারিতা স্বীকার করা হয় না; কার্যকারণ-পরম্পরা সূত্রের১০৪ অমোঘ বিধান ধ্রুব সত্য বলে গৃহীত হওয়ার পরই বোধিলব্ধ জ্ঞানকে অসুস্থ ব্যক্তির বিকৃত কল্পনা বলে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, বিজ্ঞান অথবা তত্ত্বজ্ঞানের জগতেও বোধির মাধ্যমেই সবগুলো আবিস্কার হয় সম্ভবপর। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ বা আইনষ্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ১০৫তর্কবুদ্ধির দ্বারা আবিষ্কৃত হয়নি। তাদের সূচনা বাইরের উদ্দীপক১০৬ দ্বারা হলেও ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের দ্বারা তারা আবিষ্কৃত হয়নি। হটাৎ আলোর ঝলকানির মত মনীষীদের মনের আকাশে প্রকৃতির এসব সূত্র হয়ে ওঠে জলজ্যান্ত।
মানবজীবনে দেখা যায়, কোন এক বিশেষ বৃত্তির অতিরিক্ত অনুশীলনে ব্যক্তিজীবনে দেখা দেয় নৈরাজ্য। ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য মানুষ আহার করে। সেই আহার করতে গিয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই তাতে মগ্ন থাকে, তা হলে তার স্বাস্থ্যহানি তো হবেই, তার ওপর তাকে সম্মুখীন হতে হবে আরও নানাবিধ সমস্যার। তেমনি কামকলার অতিরিক্ত অনুশীলনে মানবজীবনে চরম অধঃপতনের স্তরে উপস্থিত হয়। কাজেই দেখা যায়, কোন বিশেষ বৃত্তির অতিরিক্ত বিকাশের ফলে অন্যান্য বৃত্তিগুলো হয় অবদমিত এবং তার পরিণতিতে এক বৃত্তির সঙ্গে অন্য বৃত্তির সংঘাত ও সংঘর্ষ হয়ে পড়ে অনিবার্য।
সেরূপ কেবল একটি পদ্ধতির অনুরণেরও জ্ঞানের অন্যান্য পন্থাগুলো হয়ে পড়ে অকেজো। জ্ঞানের অন্যান্য শক্তিগুলো১০৭ হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অসাড়। তাই বিকাশের পথে দেখা দেয় চরম অন্তরায়।
মানবজীবনকে সুস্থ,সবল ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত করে তুলতে হলে তার জৈব-জীবনের নানাবিধ প্রবৃত্তির সুস্থ বিকাশ তার পক্ষে অতীব প্রয়োজন। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও বোধি,বিচারবুদ্ধি ও ভূয়োদর্শনের যথাযথ স্থান নির্দেশ করে তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করলেই জ্ঞানের পথ হয় সুগম। মানুষ সত্যের সঙ্গে পরিচয় লাভে হয় ধন্য।
মানুষের জৈব-জীবনের বিভিন্ন বৃত্তির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা দরকার। সেই যোগসূত্রের১০৮ কল্যাণে পরস্পরবিরোধী ভিন্নমুখী প্রবৃত্তির মধ্যে শৃঙ্খলা হয় প্রতিষ্ঠিত এবং ব্যষ্টিজীবনে স্থাপিত হয় ভারসাম্য। মানব মনের আদিম স্ববোধ ও পরার্থিতার মধ্যে সমতা সাধিত হলে সমাজ-ব্যবস্থা১০৯ ও ব্যষ্টিকেন্দ্রিকতা বা সমষ্টি-কেন্দ্রিকতার দোলায় না দুলে প্রগতির পথে হয় অগ্রসর।
মানবজীবনে নানাবিধ সহজাত বৃত্তি ও প্রবৃত্তির আলোচনা করলে বা মনন, প্রক্ষোভ বা ইচ্ছাশক্তির আলোচনা করলে দেখা যায়-তারা আপাতত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বা পরস্পরবিরোধী মনে হলেও তাদের মধ্যে একটা মৌলিক ঐক্য রয়েছে। সে ঐক্যের মূলে রয়েছে মানুষের আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি এবং আত্ম-প্রতিষ্ঠার প্রবৃত্তি(Self perpetuation)। মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে তার স্বজাতীয় ও বিজাতীয় নানাশ্রেণীর শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে চায়। এজন্যই তার মধ্যে সহজাত নানাবিধ বৃত্তি দেখা দেয়। আবার এ বিশ্বের নানাবিধ শত্রু থেকে নিরাপদ হলে সে এ বিশ্বে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে চায়। এ দুটো বৃত্তিকে একত্রে আত্ম-সংরক্ষণ(Self preservation) – এর বৃত্তি বলা যায়। অনুধাবন করলে দেখা যায়-মানুষের ক্ষুধা,যৌন প্রেরণা, প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত হওয়ার বসনা, সৌন্দর্য ভোগ করার প্রবৃত্তি, প্রেম, আত্মত্যাগ,স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, এ বিশ্বের প্রকৃতি পরিচয় লাভ করার জন্য বাসনা, রুচিবোধ, নীতিবোধ প্রভৃতি সকল বৃত্তির মূলে রয়েছে সেই আত্মরক্ষা বা আত্মপ্রতিষ্ঠার বাসনা। ক্ষুধা নিবারিত না হলে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। এজন্য এ বৃত্তির চরিতার্থতা তার জীবনের পক্ষে প্রয়োজন। যৌন প্রেরণার মাধ্যমে মানুষ এ বিশ্বে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে মানুষ অমরত্ব লাভ করতে চায়। প্রকৃতির সঙ্গে বিরোধিতা করে মানুষ টিকে থাকতে পারে না বলে –তার আত্মরক্ষার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীর সম্বন্ধে আবদ্ধ হতে চায়। সৌন্দর্য ভোগের মধ্যে এমন এক চিরন্তন সত্তার সন্ধান পেতে চায়, যাকে লাভ করার ফলে সে এ বিশ্বে চিরস্থায়ী হয়ে বাস করতে পারে। প্রেমের মাধ্যমে সে তার জীবনে বলিষ্ঠতা লাভ করতে চায়, যার ফলে সে সবকিছুকেই তুচ্ছ করে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। এ বিশ্বের প্রকৃত পরিচয় লাভ তার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ এ পরিচয় লাভ করতে পারলেই তার পক্ষে স্থায়ী স্থিতির রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা। ভাল ও মন্দের পার্থক্য বিচার করার মধ্যেই তার মধ্যে রুচিবোধ প্রকাশিত হয়। এ পার্থক্য বিচারের মূল ভিত্তি হচ্ছে-তার জীবনের পক্ষে সহায়ক ও জীবনের পক্ষে মারাত্মক বিষয়ের পৃথকীকরণ। এ পার্থক্য বিচার না করতে পারলে সে বহু পূর্বেই ধরাপৃষ্ঠ থেকে উধাও হয়ে যেত। এ বিচারই কালে জীবন থেকে পৃথক নীতিবোধ হলে স্বতন্ত্র এক নীতিতে পরিণত হয়। কাজেই এ সকল বৃত্তি ও প্রবৃত্তির আলোচনা করলে একথাই প্রমাণিত হয়-সবগুলো বৃত্তির মূলেই রয়েছে দুটো লক্ষ্য। একটা হচ্ছে-মানুষের আত্মরক্ষা (Self protection) অপরটা হচ্ছে আত্মপ্রতিষ্ঠা (Self perpetuation)।
এ সব বৃত্তি এ প্রবৃত্তির মূলত উদ্দেশ্য সাধনমূলক স্থিতি থাকলেও বর্তমানে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণরূপেই দেখা দিচ্ছে। তবে এ ব্যাপারটি কেবল বৃত্তি ও প্রবৃত্তির বেলায়ি সত্য নয়। মানবজীবনের নানাবিধ আচরণেও তা প্রকাশ পায়। একদা দেহের পুষ্টির জন্যই মানুষ আহার করত, লজ্জা শরম নিবারণের জন্য কাপড় পরতো। এখন আহার্যের ব্যাপারে মানুষের লক্ষ্য শুধু ক্ষুধার নিবৃত্তি নয়-জিহ্বার স্বাদেরও পরিতৃপ্ত বটে। তেমনি নানাবিধ সূক্ষ্ম বস্ত্রাদি তৈরি করে মানুষ শুধু লজ্জা নিবারণই করতে চায় না সঙ্গে সঙ্গে পরিহিত বস্ত্রের মাধ্যমে তাকে অন্যান্য লোকের কাছে মোহনীয়ও করতে চায়। তবে গোড়াতে আহার্য পুষ্টিকর না হলে যতই সুস্বাদু হোক না কেন তাতে দীর্ঘকাল মানুষ মজে থাকতে পারে না। তেমনি পরিধানের বস্ত্র দ্বারা লজ্জা নিবারণ না হলে তার দ্বারা বস্ত্র পরিধানের আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না।
এ জন্য মানবজীবনকে সুষ্ঠুভাবে বিকাশের পথে নিয়ে যেতে হলে তার জন্য এমন এক প্রকল্প(Hypothesis) গ্রহণ করতে হবে যাতে তার জীবনে সম্পূর্ণভাবে সন্তোষ বিধান সম্ভবপর হয়। তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের এমন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, যা আমাদের জীবনকে নানাবিধ শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখতে পারে। তার দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে- এ প্রকল্পের মধ্যে এমন প্রতিশ্রুতি থাকবে- যাতে এ বিশ্বে আমরা অমরত্ব বা আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করার সান্তনা পেতে পারি।
যদিও নানাবিধ বৃত্তি ও প্রবৃত্তির মূলে রয়েছে আত্মরক্ষা বা আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-তবুও তারা আপাতত স্বাধীন ও স্বনির্ভর রূপেই দেখা দিচ্ছে, এজন্য সে প্রকল্পের মধ্যে এমন উপাদান থাকে- যাতে সে বৃত্তি ও প্রবৃত্তিগুলো ও সন্তোষ লাভ করতে পারে।
এ প্রকল্পের মধ্যে শুধু পূর্বোক্ত বিষয়গুলোর সন্তোষ বিধান হলেই হবে না- তার মধ্যে জ্ঞানের নানাবিধ মাধ্যমেরও সন্তোষ ও বিকাশ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আমরা পূর্বেই দেখেছি-জ্ঞানকে শুধু পঞ্চেন্দ্রিয়জাত সীমার মধ্যে আবদ্ধ করলে জ্ঞানের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না। তেমনি জ্ঞানকে শুধু বুদ্ধি অথবা বোধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করলেও জ্ঞানের প্রকৃত স্বরূপ প্রকটিত হয় না। পঞ্চেন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধি ও বোধির অনুশীলনের ফলে যে ব্যাপক ও সর্বাত্মক আকারে জ্ঞান দেখা দেয়- তারই ভিত্তিতে এ বিশ্ব জগৎ বা স্থিতি সম্বন্ধে যে প্রকল্প গঠন করা হয় সে প্রকল্পই প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক সন্তোষ দানে সমর্থ।
অতএব আমাদের জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ও তার সন্তোষ বিধানের এরূপ একটা প্রকল্প গঠন করা অত্যাবশ্যক।
এ ক্ষেত্রে বুদ্ধির সন্তোষ ও জীবনের সন্তোষের মধ্যেও পার্থক্য প্রদর্শন করা অবশ্য কর্তব্য। বুদ্ধির সন্তোষ দানের জন্য যুগে যুগে নানাবিধ দার্শনিক মতবাদের উৎপত্তি ও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। অতি আদিকালের গ্রিকদের মধ্যে যে সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছিল- তাতে একে একে জড় বস্তুগুলোকে এ জগতের আদি সত্তা হিসেবে গ্রহণ করে ক্রমশ গ্রিক চিন্তাধারা অমূর্ত বিষয়ের দিকে ধাবিত হয়েছে। তাতে সাময়িকভাবে মানস-মানস, বিশেষত মানববুদ্ধি সন্তোষ লাভ করলেও মানবজীবন তাতে সম্পূর্ণ সন্তোষ লাভ করেনি। কারণ, বুদ্ধিই মানবজীবনের একমাত্র বৃত্তি নয়। তার সঙ্গে প্রক্ষোভ বা ইচ্ছাশক্তি তো রয়েছেই; তার ওপর নানাবিধ উপরিভাগজাত বৃত্তিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-বুদ্ধিকে অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ কোন আদিম বৃত্তি বলেও গণ্য করা যায়, – তাহলেও প্রত্যক্ষণজাত ইমেজ(image) বা কল্পনা প্রভৃতিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তেমনি প্রক্ষোভজাত নানাবিধ বিষয় এবং ইচ্ছাশক্তির নানবিধ দাবী ও প্রকাশকেও অস্বীকার করা যায় না। কাজেই যে ক্ষেত্রে শুধু বৃদ্ধির সন্তোষ বিধানের জন্যই রয়েছে একমাত্র লক্ষ্য- সে মনোবৃত্তি বা তদ্জাত সিদ্ধান্তকে জীবনের চরম সন্তোষ বিধানের সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।
এ জন্যই এক্ষেত্রে দর্শন ও জীবন-দর্শনের অর্থাৎ শুধু বুদ্ধিজাত সিদ্ধান্তের ও নানাবিধ বৃত্তির সন্তোষ বিধানকল্পে গঠিত প্রকল্পের পার্থক্য সম্বন্ধে অবহিত হওয়া কর্তব্য। বুদ্ধির কারসাজিতে এখন পর্যন্ত মানুষ যেসব সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছে-তাতে কেবল বুদ্ধিই সন্তোষলাভ করেছে। মানবজীবনের আরও নানাবিধ বৃত্তি বা প্রবৃত্তি তাতে সন্তোষলাভ করেনি।
এখানেই দর্শন ও ধর্মের মধ্যে রয়েছে গুরুতর পার্থক্য। দর্শন মানুষের বুদ্ধিকে সন্তোষদানে সাময়িকভাবে সমর্থ হয়। ধর্ম বা জীবনদর্শনের সার্থকতা হচ্ছে মানবজীবনের নানা বিষয়ের সন্তোষদানের সামর্থ্য। এজন্য মানবজীবনের দর্শনের প্রভাবের চেয়ে ধর্মের প্রভাব গুরুতর ও দীর্ঘস্থায়ী। সমগ্র আদি যুগে কেবল দর্শনের চর্চা করা সত্ত্বেও খ্রিষ্ট ধর্মের আবির্ভাবের ফলে মানুষের মন সে ধর্মের প্রতি এমনভাবে আকৃষ্ট হল কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়-জীবনের একমাত্র বৃত্তি বুদ্ধির সন্তোষ বিধানে পর্যবসিত হওয়ার অন্যান্য বৃত্তি ও প্রবৃত্তির সন্তোষ-বিধানের জন্যই সে প্রতিক্রিয়া এরূপ প্রচণ্ডভাবে দেখা দিয়েছিল। দর্শন ও জীবন-দর্শনের মধ্যে আমরা এরূপ পার্থক্য করিনে বলে অনেক সময় শুধু বুদ্ধির আলোকে আমরা জীবন-দর্শনের আলোচনায় প্রবৃত্ত হই।
আমাদের তাই এ পার্থক্যকে সামনে রেখেই সে প্রকল্পের গঠনে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হবে এমন এক প্রকল্প গ্রহণ, যাতে কেবল বুদ্ধি নয়, সকল বৃত্তিও সন্তোষ লাভে হয় সমর্থ। এরূপ একটা প্রকল্পের সন্ধান আমরা পাচ্ছি ইসলামের আল্লাহ্ নামক ধারণার মধ্যে। এ ধারণার কোন ইন্দ্রিয়লব্ধ বা প্রত্যক্ষণজাত ধারণা নয়। বুদ্ধি দ্বারাও এ ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ধারণার সন্ধান পেয়েছেন হযরত রসূলই-ই আকরাম (সঃ) প্রত্যাদেশ বা revelation-এর মাধ্যমে। এ প্রত্যদেশ স্বজ্ঞারই এক বিশেষ সংস্করণ। আমরা মানব-জ্ঞানের আলোচনা প্রসঙ্গে পূর্বেই দেখতে পেয়েছি স্বজ্ঞা থেকে নানাবিধ আবিস্কার সম্ভব হতে পারে। জুঙের বর্ণনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, স্বজ্ঞার কার্যকারিতার ফলে দ্রষ্টার সৃষ্টি হতে পারে। হযরত রসূল-ই আকরাম (সঃ) দীর্ঘকাল হেরা পর্বতে সত্য লাভ করার জন্য যে তপস্যা করেছিলেন তারই ফল হিসেবে প্রথমে ২৭ শে রমযানের রাত্রিতে আল্লাহ্র বাণী নিয়ে ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) দেখা দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ্ সম্বন্ধে পূর্ণ ধারণা হযরতের মানসে জীবন্ত হয়ে দেখা দেয়।
এ জন্যই দেখা যায়, জ্ঞানের রাজ্যে অন্বেষণকারী যাতে অবলীলাক্রমে অগ্রসর হতে পারে, তার জন্য অন্য কোন স্বতঃসিদ্ধের প্রয়োজন দেখা দেয়নি। জ্ঞানবিস্তার আলোচনা করলে দেখা যায়-সাধারণত পঞ্চেন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান ও বুদ্ধিজাত জ্ঞানকেই শুধু দুটো রূপ বলে ধরে নেয়া হয়। অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের মতবাদ অনুসারে আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যে সব সংবেদন লাভ করি, তার ভিত্তিতেই আমাদের জ্ঞানের সৌধ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য এ মতবাদের প্রবর্তক জন্ লক মন্তব্য করেছেন- There is nothing in the intellect; which was not previously in sensation– অর্থাৎ আমাদের বুদ্ধিতে এমন কোন কিছুই নেই যা পূর্বে সংবেদনের মধ্যে ছিল না।
অপরদিকে বুদ্ধিবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে-বুদ্ধি দ্বারাই সত্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের রয়েছে একমাত্র সম্ভাবনা। বুদ্ধি বা যুক্তিবাদীদের মুখপাত্র হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেছেন- Whatever is real is rational and whatever is rational is real. অর্থাৎ যা কিছু বাস্তব বা যুক্তিপূর্ণ এবং যা কিছু যুক্তিপূর্ণ তা বাস্তব। এ নীতির প্রথম দিকটা গ্রহণ করতে সকলেই সম্মত। কারণ যা কিছু সত্য তা যুক্তিপূর্ণ হতে বাধ্য। যাতে কোন যুক্তির অবকাশ নেই- তা হয় কাল্পনিক, না হয় মিথ্যা। তবে যা যুক্তিপূর্ণ তা বাস্তব বলা সব সময় ঠিক নয়। কারণ যুক্তির ধারায় আমাদের পক্ষে এমন এক স্তরেও আসা সম্ভবপর, যার স্থিতির স্বপক্ষে কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণ নেই বা অন্য কোন প্রমাণও নেই। তবে অভিজ্ঞতাকে বা যুক্তিকে- যে কোন পদ্ধতিকেই জ্ঞান লাভের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করি না কেন- অভিজ্ঞতা বা যুক্তি সে আমাদের সঠিক জ্ঞান দান করতে পারে, সে সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনে। এক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা বা যুক্তির বহির্ভূত অন্য কোন প্রত্যয়ের ওপর আস্থা স্থাপন করতে হবে। কেননা, এ বিশ্ব বিধানে এমন কোন শক্তি থাকতে পারে, যা সবসময়ই মানুষকে প্রতারিত করে। আধুনিক দর্শনের পিতা ডেকার্থ তাঁর অনুসন্ধানের প্রথম স্তরে এজন্য সবকিছুইকেই অবিশ্বাস করতে ছিলেন প্রস্তুত। অবশেষে Cogito Ergo Sum (আমি চিন্তা করি বলে আমি আছি) এ সত্যে এসে উপনীত হন। তবে এখানে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। তিনি যে চিন্তা করেছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই- তবে সে চিন্তার বিষয়বস্তু সত্য কিনা তার তো বিচার হয়নি। এমনও তো হতে পারে যে, তাঁর চিন্তা সত্য, তবে তিনি চিন্তার ক্ষেত্রে বারবার শয়তানের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন। তারঁ চিন্তা তাঁর সামনে যত সব বিষয় উপস্থাপিত করছে- বাস্তবে সে সবের কোন অস্তিত্ব নেই। চিন্তার বিষয়বস্তু পরিচ্ছন্ন হলেই তা সত্য হয় না। কোন চিন্তা সত্য হতে হলে বাস্তবের সঙ্গে তার যোগ চাই। সে যোগ যে চিন্তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে,- তার কোন সার্টিফিকেট আমরা পাচ্ছিনে। এজন্য আমাদের ধরে নিতে হয় এ বিশ্ব চরাচরের সবকিছুই এমনভাবে সৃষ্ট যে, তা মানব জ্ঞানের পক্ষে অধিগম্য। সে স্বতঃপ্রমাণের ভিত্তি অভিজ্ঞতা বা যুক্তি নয়। সে স্বতঃপ্রমাণ আসে প্রত্যয় থেকে। ইসলামী মতে বলা হয়-আল্লাহ্কে স্বীকার করলে জ্ঞাতার সঙ্গে জ্ঞেয় বস্তুর সম্বন্ধ সবসময়ই পরিস্কার হয়ে দেখা দেয়। আল্লাহ্র বিধান মতে জ্ঞাতা সত্যিকার জ্ঞানলাভে সমর্থ। কেননা আল্লাহ্ এ বিশ্বকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, তাতে জ্ঞাতার পক্ষে গান লাভ করার রয়েছে সমূহ সম্ভবনা।
আল্লাহ্র এ ধারণাকে মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধানে সফল বলে স্পষ্টই প্রমাণিত হয়। কারণ, আমরা পূর্বেই দেখেছি-শুধু বিচার-বুদ্ধির সন্তোষ লাভই মানবজীবনের কাম্য নয়। মানুষের মধ্যে তার সবগুলো বৃত্তি ও প্রবৃত্তির সন্তোষ লাভের রয়েছে অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তার মধ্যে যেমন যৌন আবেগের পরিতৃপ্তির জন্য আকাঙ্ক্ষা তেমনি ক্রোধ, লোভ সবগুলো রিপুকেই যথাযথ ব্যবহার করার জন্যে রয়েছে তাগিদ। আল্লাহ্ নামক এ ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আদেশ-নিষেধপূর্ন যে পুস্তক-কুরআন-উল-করীমের আলোকে মানুষ তা সহজেই লাভ করতে পারে। এমনকি যে কল্পনাকে মানুষ শিশুদের জীবনে কার্যকরী এক বৃত্তি বলে উপহাস করে-সেই কল্পনারও যথাযথ সন্তোষ বিধানের সূত্র রয়েছে। অতএব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আল্লাহ্র বিভিন্ন গুণ কিভাবে কার্যকরী হতে পারে-সে সম্বন্ধে আমাদের আলোচনার প্রয়োজন।
পূর্ণাঙ্গ দর্শন ও ইসলাম
সে দর্শনের উপকরণ হবে জীবন্ত মানুষের সবগুলো বৃত্তি ও প্রবৃত্তি। তার লক্ষ্য হবে পূর্ণ মানুষ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ। তার নৈতিক আদর্শ হবে পরস্পর ভিন্নমুখী প্রবৃত্তির সামঞ্জস্যবিধান। তার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক আদর্শ হবে ব্যষ্টি ও সমষ্টির অধিকারের সমন্বয়।
সে পূর্ণাঙ্গ জীবন-দর্শনেরই অপর নাম ইসলাম। ইসলামকে তাই বলা হয় মানবতার ধর্ম। সেই ধর্মের উৎপত্তি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফার (সঃ) প্রচার থেকে নয়-সৃষ্টির আদি থেকেই নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভুল-ভ্রান্তির পথে মানুষ তার পূর্ণ পরিচয় লাভের জন্য এ পথেই চলছে। প্রয়োগ১১০ অথবা বৃদ্ধির১১১ আলোকে সে বিশাল জীবনের আংশিক আভাস যে মানুষ পেতে পারে না, তা নয়। কিন্তু সে আংশিক সত্যকে পূর্ণ সত্য ভ্রমে তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে মানুষ হয়ে পড়ে দিশেহারা।
হযরত মুহাম্মদের (সঃ) পূর্বে যারা দুনিয়ার সত্য প্রচার করেছিলেন ইসলাম তাঁদের অস্বীকার করেনি, বরং যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গেই তাঁদের স্মৃতি বহন করছে। তাঁদের মতবাদ কোন বিশেষ দেশের বা বিশেষ কওমের লোকের ওপর প্রযোজ্য হওয়ার অথবা মানবজীবনের কোন বিশেষ দিকের ওপর জোর দেওয়ার কালে তাদের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তবুও ইতিহাসের ধারায় জ্ঞানের ও নীতির এক একটা বিশিষ্ট পর্যায় হিসেবে এখনও তাদের মূল্য রয়েছে যথেষ্ট। ইসলামকে বলা হয় মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। মানব প্রকৃতির সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গি সম্বন্ধ বর্তমান। মানুষের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) বলেছেনঃ
“ সদ্যোজাত শিশু সত্য ধর্মেই জন্ম নেয়; তার পিতামাতা তাকে য়াহূদী, ক্রিশ্চিয়ান বা সেবিয়ান করে তোলে”।
ইসলাম গোড়াতেই মানবজীবনকে দেখেছে পূর্ণভাবে; সেজন্য বিভিন্ন প্রবৃত্তি বা জ্ঞানের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে তারতম্য করলেও কোনটাকেই অস্বীকার করেনি। মানবজীবনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি-ক্ষুধা, যৌনস্পৃহা প্রভৃতিকে ইসলাম কোনদিনই অস্বীকার করেনি; বরং কিভাবে ক্ষুধার নিবৃত্তি সুষ্ঠুভাবে হতে পারে, কিভাবে মানুষ জীবনে শান্তি পায়-তার ব্যবস্থা করেছে। মানব-প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশের পথ সুগম করার জন্য এ জীবনদর্শনে মানবজীবনের বৈচিত্র্য গোড়াতেই স্বীকৃত হয়েছে। জগতের পূর্ণ পরিচয়ের পদ্ধতিরুপে বোধির সঙ্গে প্রয়োগ ও যুক্তি গৃহীত হয়েছে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে যাতে কোনো কালেই কোন সীমারেখা টেনে দেওয়া না হয়, সেজন্য মানুষের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করেছেনঃ
জ্ঞান আহরণের জন্য যদি প্রয়োজন হয় চীন দেশেও যাও’।
অপর এক বাণীতে বলেছেনঃ
“জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও নারীর পক্ষে ফরয (অবশ্য কর্তব্য)”।
এক্ষেত্রে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, জ্ঞান বলতে তিনি শুধু ঐশী জ্ঞানকেই বুঝতেন না। জ্ঞান ছিল তাঁর কাছে ব্যাপক। সে চীন দেশের মনীষীর জ্ঞানই হোক তার সুদূর ইউরোপের জ্ঞানই হোক, যে কোন উপায়ে লব্ধ জ্ঞানকে তিনি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদানরূপে গ্রহণ করতেন।
এ দর্শনে ব্যষ্টিকে সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন স্বয়ম্ভরূপে কল্পনা করা হয়নি। দেহের এক অঙ্গের সঙ্গে অপর অঙ্গের যেমন অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বর্তমান, তেমনি মানুষের মধ্যেও যে একই প্রকৃতি, একই রক্তধারা বর্তমান-সে সত্যটি গোড়াতেই ঘোষণা করা হয়েছেঃ
“ এই যে তোমাদিগের জাতি-ইহা তো একই জাতি”। (সুরা আম্বিয়াঃ ২১-৬-৯১)
অপর জায়গায় বলা হয়েছেঃ
“প্রকৃতপক্ষে তোমাদের এ ভ্রাতৃত্ব একই ভ্রাতৃত্ব এবং আমি তোমাদের প্রভু; সুতরাং আমাকে ভয় কর। মানুষেরা তাদের বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করেছে এবং প্রত্যেক জাতি তার আইন-কানুন ও লোকাচারে আনন্দ বোধ করে”। ( আল মুমিনুনঃ ২৩: ৩৫২-৫৩)
আরও জোরালো ভাষায় অন্য এক স্থানে মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছেঃ
‘মানুষেরা গোড়াতেই একই জাতি ছিল কিন্তু পরবর্তীকে তাতে নানা বিভিন্নতা সৃষ্টি করেছে। (সূরা ইউনুসঃ ১০: ২-১৯)
কুরআনের এই যে শিক্ষা, সে সম্বন্ধে প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে- সে জ্ঞান কোন্ পর্যায়ের? তা’প্রয়োগলব্ধ, না অন্য কোন উপায় গৃহীত? তা কি সকল মানুষের পক্ষে সহজলভ্য? না, দুনিয়ার কয়েকজন সেরা প
মানুষের পক্ষেই সে জ্ঞানলাভ সম্ভবপর? কুরআনের শিক্ষা কি অন্য উপায়ে পাওয়ার ব্যবস্থা নেই?
কুরআনের জ্ঞান হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) লাভ করেন বোধির১১২ মাধ্যমে। তাকে অন্যান্য বোধিলব্ধ জ্ঞান থেকে পৃথক করার উদ্দেশ্য বলা হয় প্রত্যাদেশ১১৩ । সে জ্ঞান প্রয়োগ১১৪ বা যুক্তি১১৫ বিরোধী নয়। সে জ্ঞানলাভ সকল মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যেমন বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোর আবিস্কার সকল মানুষের পক্ষে অসাধ্য। মানুষের জীবনকে সর্বাবস্থায় সুসামঞ্জস্য ও সুস্থ করার জন্য এ প্রত্যাদেশমূলক জ্ঞানের ছিল অত্যন্ত প্রয়োজন। তা থেকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষ কিভবে তাকে নিয়ন্ত্র করবে, সে সম্বন্ধে রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশ। তবে প্রত্যাদেশমূলক জ্ঞানের আর যে বিশেষ প্রয়োজন নেই, তা হযরত মুহাম্মদের (সঃ) বাণী থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। মনীষী ইকবাল তাই উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করেছেনঃ ইসলামের নবুয়ত তার পরিপূর্ণতা লাভ ক’রে আবিস্কার করতে সমর্থ হয় যে, তার বিলোপের রয়েছে একান্ত প্রয়োজন। এ আবিস্কার আর কিছু নয়, শুধু এ উপলব্ধি যে, জীবন চিরকাল নেতৃত্বের সূত্রে আবদ্ধ থাকতে পারে না- তার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞানলাভের জন্য মানুষকে তার স্বীয় শক্তির ওপরই নির্ভরশীল হতে হবে
তাই স্পষ্ট বোঝা যায়, কুরআনের শিক্ষা গোড়াতেই মানুষকে বুঝতে দিয়েছিল যে, মানুষের পক্ষে আর প্রত্যাদেশ পাওয়ার প্রয়োজন নেই। মানুষকে তার প্রকৃতিদত্ত বিচারবুদ্ধি বা পঞ্চ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের ওপর নির্ভর করতে হবে। তা’ থেকে আরও অবরোহ১১৩ বা deductions টেনে নেওয়া যায়; কুরআনের বাণীগুলো মানুষ গ্রহণ করেও তার বুদ্ধি ও বিচার বুদ্ধিকে কার্যকরী রাখতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, পবিত্র কুরআন মজিদে যেসব আদেশ-নির্দেশ প্রদত্ত হয়েছে সেগুলোও মানুষ তাদের বিচার-বুদ্ধির আলোকে যাচাই করে দেখতে পারে। তবে এ সম্বন্ধে মানুষের হতে হবে হুঁশিয়ার। কুরআনের আদেশাবলী এ দুনিয়ার যেমন কার্যকরী, এ দুনিয়ার পরবর্তী অপর এক দুনিয়ায়ও ফলদায়ক। কাজেই সে আদেশাবলীর মধ্যে যেগুলো কেবল এ দুনিয়ার কার্যকরী, তাদেরই বিচার সম্ভবপর। অপরগুলোর বিচার হতে পারে না। তার ওপর কুরআনের জ্ঞান প্রত্যাদেশ বলে সে জ্ঞানলাভ সম্বন্ধেও থাকতে হবে স্পষ্ট ধারণা।
প্রত্যাদেশ এমন কোন অবাস্তব জ্ঞান নয়, যার সম্বন্ধে কোন কথা বলার কারও কোন অধিকার নেই। প্রত্যাদেশ বোধিরই এক সংস্করণ এবং বোধিলব্ধ জ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞানের জগতে ও মনোবিজ্ঞানে যথেষ্ট আলোচনা করা হয়েছে। কাজেই প্রত্যাদেশের সঙ্গে বোধির কি সম্বন্ধ এবং বোধি বাস্তবিকই জ্ঞানের এক পদ্ধতি কিনা, সে সম্বন্ধে আমাদের আলোচনা করা দরকার।
ইসলামের অবলম্বন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বতঃসিদ্ধ
ইসলামী প্রত্যাদেশ থেকে আমরা সর্বপ্রথম পাই আল্লাহ্র ধারণা। ইসলামী চিন্তাধারার মূল সূত্র আল্লাহ্। কুরআন শরীফে আল্লাহ্র স্বরূপ সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণা রয়েছে। আল্লাহ্কে সর্বপ্রথমে ধারণা করা হয়েছে সকল স্থিতির মূলরূপে। সূরা ফাতিহায় বলা হয়েছেঃ
“ যত স্তুতি সবই তো আল্লাহ্র
রব তিনি বিশ্বসমূহের”* (মরহুম মুনাওয়ার আলী কৃত অনুবাদ।)
‘রব’ শব্দের অর্থ কেবল সৃষ্টিকর্তা নয়, ‘রব’ পালনকর্তা ও বিবর্তনকারীও বটে। ‘রব’ শব্দের অর্থ সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও বিবর্তনকারী।১১৭ অথচ, এই কুরআনেই অন্যান্য স্থানে তাঁকে সর্বব্যাপী সত্তারূপে১১৮, সর্বব্যাপী ও তুরীয় সত্তারূপে১১৯ ধারণা করা হয়েছে। আবার কোথাও কেবল জগৎ বহির্ভূত স্রষ্টারূপে১২০ ধারণা করা হয়েছে।
আবার এই কুরআন শরীফেই আল্লাহ্র শরণ নেওয়ার জন্য আদেশ করা হয়েছে। সূরা ফাতিহায় আল্লাহ্ মানুষকে শিখিয়ে দিচ্ছেন প্রার্থনা করতেঃ
সাহায্যের তরে যাচি
কেবলই তোমারে,
নেতা হয়ে আমাদের নিয়ে যাও
ঋজু পথে পথে।** (মরহুম মুনাওয়ার আলী কৃত অনুবাদ।)
কুরআন শরীফের সর্বত্রই মানুষের জন্য আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা তাঁর শক্তির সাহায্য ব্যতীত মানবজীবনের ব্যর্থতা ঘোষণা করা হয়েছে।
তা’হলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এর মধ্যে কোন্টি সঠিক ধারণা? তিনি রব্১২১ , না তিনি সর্বব্যাপী১২২,না সর্বব্যাপী ও তুরীয়১২৩ অথবা শুধু স্রষ্টা মাত্র? অপরদিকে গোড়াতেই যদি তাঁকে স্বীকার করে নেওয়া যায়, তা হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পক্ষে এক মস্তবড় প্রতিবন্ধক দেখা দেয়। এ স্বীকৃতি তো বিজ্ঞানের জয়যাত্রার পথে মস্তবড় প্রতিবন্ধক দেখা দেয়। এ স্বীকৃতি তো বিজ্ঞানের জয়যাত্রার পথে মস্তবড় বিঘ্নের সৃষ্টি করে মানব-মনকে করে তোলে গোঁড়া।১২৪ যদি আল্লাহ্র দ্বারাই জগতের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে মানুষের পক্ষে কাজকর্ম করার বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনার কি প্রয়োজন? তাঁর দ্বারাই তো সবকিছু সুসম্পন্ন হচ্ছে ও হবে। আবার এই কুরআন শরীফেই মানুষকে কর্মপ্রেরণা দেয়া হয়েছে তীব্রভাবে।
বলা হয়েছেঃ
‘যে পর্যন্ত না কোন জাতি তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে আল্লাহ্ ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেন না’।
কুরআনে বিজ্ঞানের গবেষণার জন্যও জোরালো তাগিদ দেয়া হয়েছেঃ ‘নিশ্চয়ই যে কোন সমস্যার সমাধান রয়েছে প্রত্যেক দুরূহতার জন্য প্রতিকার রয়েছে। তাই যখনই তুমি মুক্ত (অন্যান্য বিষয় থেকে ) তোমার ধ্যানকে তোমার প্রভু আল্লাহ্র দিকে কেন্দ্রিভূত করো__’।
অন্য এক স্থানে বলা হয়েছেঃ
‘ প্রভু যাকে ইচ্ছা তাকে হিকমত দান করেন এবং যারা হিকমত লাভ করে, তারা একটা পরম সুবিধা লাভ করে’।
কুরআন শরীফের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার আল্লাহ্র রসূল (সঃ) জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঐকান্তিক সাধনার জন্য মানব জাতিকে উদাত্ত স্বরে আহ্বান করেছেন। তাঁর বিভিন্ন বাণী থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আকুল আগ্রহের জাজ্বল্যমান প্রমাণ পাওয়া যায়।
তিনি বলেছেনঃ
‘শহীদের লোহু থেকে জ্ঞানীর দোয়াতের কালি অধিকতর পবিত্র’।* (Misbah us Sirat: Spirit of Islam Ameer Ali, p.361)
এক ঘণ্টার জন্যও বিজ্ঞানের পাঠ শ্রবণ ও জ্ঞানের অনুশীলন হাজার শহীদের জানাযাতে শামিল হওয়ার চেয়ে পূণ্যতর – হাজার রাত্রির নামাযের কাতারে দাঁড়ানোর চেয়ে পুণ্যতর কাজ’।
বারবার জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলনের জন্য তিনি প্রেরণা দিয়েছেনঃ
জ্ঞানী ব্যক্তির বাণী শ্রবণ এবং হৃদয়ে বিজ্ঞান পাঠের আলোকসম্পাত ধর্মীয় কার্যাবলি থেকে উৎকৃষ্টতর- কৃতদাসের মুক্তি দেয়ার চেয়েও উন্নততর।** (Spirit of Islam: Ameer Ali)
ইসলাম জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনঃ
‘বিজ্ঞানের (অনুশীলনে) সম্মান লাভ সবচেয়ে বড় সম্মান। সে জ্ঞানের ক্ষেত্রে জীবন সঞ্চার করে সে অমর’।
বিজ্ঞানের জগতে কিন্তু আরোহ পদ্ধতিই১২৫ একমাত্র পন্থা। অতি ক্ষুদ্র, অতি তুচ্ছকে উপকরণ বা দড়ি১২৬ রূপ গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে সার্বিক সত্যে এসে উপনীত হওয়া বিজ্ঞানের লক্ষ্য। বিজ্ঞানে অবরোহ১২৭ পদ্ধতি মোটেই গ্রহণীয় নয়। কোন কিছুকে গোড়াতে স্বীকার করে তা’ থেকে ফলাফল অবরোহ১২৮ করা বিজ্ঞানে জগত অচল।
তাই প্রশ্ন দাঁড়ায়, আল্লাহ্ সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণার মধ্যে কিভাবে সঙ্গতি১২৯ আনা যায় আর আল্লাহ্র ধারণার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কিসে খাপ খেতে পারে? কুরআন শরীফে আল্লাহ্কে ধারণা করা হয়েছে প্রথমে স্বতঃসিদ্ধরূপে১৩০ তার পরে সৃষ্টিকর্তা১৩১ সর্বব্যাপী১৩২ এবং সর্বব্যাপী ও তুরীয়১৩৩ শক্তিরূপে ধারণা করা হয়েছে। আল্লাহ্কে এভাবে ধারণা না করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ অগ্রসর হতে পারে না বলেই ধারণাগুলোর প্রয়োজন ছিল। তাঁকে চিন্তার স্বতঃসিদ্ধ১৩৪ রূপে গ্রহণ করে চিন্তার পরিণতিতে তাঁকে সৃষ্টিকর্তা, সর্বব্যাপী ও তুরীয় সত্তারূপে ধারণা করার ইঙ্গিত রয়েছে পবিত্র কুরআন শরীফে। আল্লাহ্র এ নানাবিধ ধারণা মানব-চিন্তার বিভিন্ন পর্যায়ের ফল। মানব মন অন্বেষণের প্রারম্ভে এ জগতের জ্ঞেয়তা১৩৫ এবং জ্ঞাতার শক্তির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য হয়। এ বিশ্বাস কেবল আল্লাহ্র অস্তিত্বের ওপর প্রত্যয়ের ফলেই সম্ভব হয়। এ প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে অন্বেষণকারী তার জ্ঞান অনুযায়ী আল্লাহ্ সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণায় পৌঁছতে সমর্থ হয় এবং তা নির্ভর করে তার অভিজ্ঞতা১৩৬ ও যুক্তির ওপর। সাধারণ বুদ্ধির অন্বেষণকারী পক্ষে আল্লাহ্কে সৃষ্টিকর্তারূপে গ্রহণ করাই সহজ। মননধর্মী তত্ত্বজ্ঞানী তাঁকে সর্বব্যাপীরূপে১৩৭ গ্রহণ করেন। তত্ত্বজ্ঞান ও নৈতিক জীবনের মানগুলোর সমন্বয় সাধনের জন্য তাঁকে ধারণা করা হয় সর্বব্যাপী ও তুরীয়রূপে। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে পড়বে। এ দুনিয়ার নানা কলাকৌশলের নিদর্শন দেখে মনে হয় এতে নিশ্চয়ই কোন কারিগরের হাত রয়েছে। কাজেই তাঁরা মনে করেন এতে এক জগৎ বহির্ভূত কারিগর রয়েছেন।
মননধর্মী মানুষ এতে দেখতে পান ন্যায়শাস্ত্রের নানানীতির প্রকাশ। মানব মন ন্যাশাস্ত্রের যে রীতি অনুসারে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে এক ধারণায় পৌঁছে স্বস্তি লাভ করে, তেমনি জগতের মাঝেও চলেছে এক মহাদ্বন্দ্বের লীলা। আল্লাহ্কে সর্বব্যাপী মূলাধররূপে ধারণা করলেই জগতের এ মহাদ্বন্দ্বের মীমাংসা হতে পারে। কাজেই এঁরা আল্লাহ্কে ধারণা করেন সর্বব্যাপী সত্তারূপে।* ( এ সম্বন্ধে দর্শনশাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পাওয়া যায়-হেগেলীয় Pan logism-এ এবং হেগেলের ইংরেজ শিষ্য ব্রাডলির সিদ্ধান্তে।)
আল্লাহ্ সর্বব্যাপী সত্তা বলে গৃহীত হলে দুনিয়ায় পাপ-পুণ্যের আর কোন বিচার থাকে না। তিনি সর্বমূলাধার অস্তিত্ব হওয়ায় পাপ-পুণ্য সমস্তই তাঁর সত্তা থেকে সৃষ্টি হয়। কাজেই ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনের মানগুলোর সঙ্গে তর্ক-বুদ্ধিজাত জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে ওরা বলেন, সর্বব্যাপী মাত্র নয়, জগতের বাইরেও তাঁর সত্তা রয়েছে সেজন্য তিনি এসব পাপ-পুণ্যের অতীত।
মানবজীবনের সকল পর্যায়ের সঙ্গে কুরআন শরীফের গভীর যোগ থাকার জন্যই আল্লাহ্কে বিভিন্নভাবে ধারণা করা হয়েছে, যাতে সকল স্তরে এবং সকল পর্যায়ের মানুষই এ থেকে শান্তি ও স্বস্তি পেতে পারে। কুরআন শরীফে আল্লাহ্ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারণা তাই পরস্পরবিরোধী নয় বরং মানব-জ্ঞানের পক্ষে উপযোগী করেই তাদের পরিবেশন করা হয়েছে।
তেমনি আল্লাহ্কে স্বতঃসিদ্ধ১৩৮ হিসেবে গ্রহণ করেও বিজ্ঞানের পথে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় না। বরং আল্লাহ্র এ ধারণাকে গ্রহণ না করলে অন্বেষণকারীর পক্ষে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিস্বরূপ যেসব ন্যায়শাস্ত্রের নীতি বর্তমান, সেগুলোর আলোচনা করলেই বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত্তি তর্কশাস্ত্র। তর্কশাস্ত্রের বুনিয়াদের উপরই বিজ্ঞান গড়ে তুলেছে তার সৌধ। যা ন্যায় অনুমোদিত নয়, তা কিছুতেই বিজ্ঞানের সম্মান লাভ করতে পারে না। যে ন্যাশাস্ত্রের স্বতঃসিদ্ধ রূপে চারটি নীতি গোড়াতেই গ্রহণ করা হয়, তাদেরকে যথাক্রমে একত্বের নীতি১৩৯ , দ্বন্দ্বের নীতি১৪০ , মধ্যপন্থা অর্জনের নীতি১৪১ ও যথাযোগ্য কারণের নীতি১৪২ বলা হয়।
একত্বের নীতিতে বলা হয়, জ্ঞানের রাজ্যে জ্ঞেয় বিষয়কে এককরূপে ধরে নেওয়া দরকার। কারণ জ্ঞেয় বিষয় সবসময়ই তার স্বরূপ অক্ষুণ্ণ রাখে। যেমন কোন গাছ সম্বন্ধে ভাবতে গেলে তাকে একক হিসেবেই ভাবতে হবে। যদি গাছকে এক না ভাবা যায় তাহলে তার সম্বন্ধে কোন কিছু বলার কোন অর্থ থাকে না। কাজেই সে গাছ সম্বন্ধে কোন চিন্তা করতে হলে বা তার সম্বন্ধে কোন যুক্তি-তর্কের অবতারণা করতে হলে তাকে সব সময়ই এক সত্তারূপে ধরে নিতে হবে।
অথচ জগতের সর্বত্র দেখা যায় পরিবর্তন১৪৩। যে গাছে একদা মাত্র দুটো পল্লব দেখা দিয়েছিল, কালে তা-ই নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে মহামহীয়ান বৃক্ষরূপে ঊর্ধ্বে মাথা তুলে অসংখ্য পাখির আবাসে পরিণত হয়। আবার কালের করাল গতিতে সেই গাছই জীর্ণ হয়ে পত্রবিহীন, শাখাবিহীন কিম্ভূতকিমাকাররূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ গাছের উৎপত্তি ও বিকাশের ধারায় মুহূর্তে মুহূর্তে নানাবিধ পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। তার বিভিন্ন বয়সের ভিন্ন ভিন্ন ফটোগ্রাফ একত্র করলে দেখা যাবে, তাতে কত পরিবর্তন হয়েছে। তা সত্ত্বেও গাছের মধ্যে এমন একটা শক্তি১৪৪ কাজ করেছে, যার কার্যকারিতায় পরিবর্তনের মধ্যেও রয়েছে এক ঐক্য। সেজন্যই এতসব পরিবর্তনের মধ্যেও তাকে একই গাছেরূপে আমরা পরিচিত করতে পারি। কাজেই আমাদের ব্যবহারিক জীবনে বা মনকে তার সম্বন্ধে আলোচনায় তার পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে, একত্বকেই গ্রহণ করতে হয়। অপরদিকে যে মানসে গাছ সম্বন্ধে কোন ধারণার সৃষ্টি হয় তাতেও মিনিটে মিনিটে দেখা দিচ্ছে পরিবর্তন। সেও চলেছে বিকাশের পথে। তাতেও দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন রূপ। তবু মনের এত সব পরিবর্তনের মধ্যেও যদি তার ঐক্য স্বীকার করা না যায় তাহলে গাছ সম্বন্ধে বিভিন্ন ধারণার তুলনা করার জন্য কোন ঐক্যসূত্র না থাকলে কোন কথা বলারই অবকাশ থাকে না। পরিবর্তনকে মানব-মনের সত্যিকার রূপ বলে ধরে নিলে, মানব মন বলে কোন কিছুই থাকে না। বিভিন্ন সংবেদনের১৪৫ উৎপত্তিও লয়ের ফলে তাতে দেখা দিচ্ছে ছায়াচিত্রের মত ভাবধারার উদয় ও অস্ত, তাদের কারো সঙ্গে কারোর কোন যোগসূত্র নেই। সেইজন্য জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানব মনকে ‘এক’ বলে ধরে নিতে আমরা বাধ্য এবং তাতে একটা একীকরণের১৪৬ শক্তি১৪৭ কার্যকরী বলে ভাবা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
কাজেই, আমাদের ধরে নিতে হবে-ভাববার বিষয় ও ভাববার শক্তিকে নির্বিকাররূপেই ভাবতে হবে। একেই ন্যাশাস্ত্রে ঐক্যের নীতি১৪৮ বলা হয়। এ নীতির স্বীকৃতি ব্যতীত আমাদের ভাববার বা যুক্তির অবতারণা করবার অধিকার থাকে না।
দ্বন্দ্বের নীতিতে১৪৯ বলা হয়, কোন বস্তু বা বিষয় সম্বন্ধে ভাবতে গেলে তাতে পরস্পরবিরোধী১৫০ গুণের সমাবেশ করা যায় না। কোন বস্তুকে স্থিতিশীল১৫১ ও অস্থিতিশীল১৫২ বলে আমরা ভাবতে পারি না। কোন বস্তুকে একই সঙ্গে কালো ও কালো নয় রূপে ভাবা মানব-মনের পক্ষে অসম্ভব।
মধ্যপন্থা বর্জনের নীতিতে১৫৩ বলা হয়, কোন বস্তুতে যেমন পরস্পরবিরোধী দুটো গুনের১৫৪ সমাবেশ ভাবা অসাধ্য, তেমনি পরস্পরবিরোধী দুটো গুণের বহির্ভূত অন্য কোন মধ্যবর্তী গুণ থাকাও কোন বস্তুতে সম্ভব নয়। রঙের দিক থেকে বিচার করলে যে কোন বস্তুই, হয় কালো না হয় কালো-নয়ই, হবে। এ দুটো গুণের বাইরে রঙের জগতে আর কিছুই নেই।
এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, দ্বন্দ্বের নীতি বা মধ্যপন্থা বর্জনের নীতি ঐক্যের নীতির ওপর নির্ভরশীল। ভাববার বিষয় যদি তার ঐক্য বজায় রাখতে না পারে, তা হলে তার মধ্যে পরস্পরবিরোধী গুণ থাকা না থাকার কোন মানে হয় না। আমাদের চিন্তার বিষয়১৫৫ এক থাকে বলেই তাতে পরস্পরবিরোধী গুণাবলির সমাবেশ করা যায় না বা পরস্পরবিরোধী গুণের একটিকে তাতে আরোপ করতে হয়। যদি বিষয়বস্তু বলে কোন কিছুরই অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে পরস্পরবিরোধী গুণের সমাবেশ বা তাদের কোনও একটি গ্রহণ বা বর্জনের প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে দেখা যায়, একত্বের নীতির১৫৬ মৌলিক নীতি। প্রয়োগের জন্য স্বীকার করতে হয় দ্বন্দ্বের নীতি বা মধ্যপন্থা বর্জনের নীতিকে।
যথাযোগ্য কারণের নীতিতে১৫৭ বলা হয়, জগতের যা কিছু ঘটেছে বা রয়েছে তার জন্য একটা উপযুক্ত কারণ আছে। এ জগৎ যদি খাপছাড়া হত, এতে যদি সবকিছুই স্বতঃউৎসারিত হত তাহলে এর স্থিতি সম্বন্ধে বা এর অন্তর্গত তার কারণ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করা হত অসম্ভব। কোন বিষয়কে জানার অর্থ তার কারণ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ সম্ভব হয়। একেই ন্যায়শাস্ত্রের আরোহ বিভাগে বলা হয় কারণের নীতি। এ কার্যকারণের নীতিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলে একে প্রকৃতির সমরুপতা রূপেই গ্রহণ করতে হয়। প্রকৃতিতে কার্যকারণের সূত্র রয়েছে সত্য। দুনিয়ার সকল কিছুই এই কারণের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় কিন্তু কার্যকারণের মধ্যে বা গোটা পৃথিবীর মধ্যে যদি সমরূপতা না থাকে; তাহলে কেবল কারণ দ্বারা কোন কিছুর ব্যাখ্যা করা যায় না।
কারণের নীতিতে বলা হয়-জগতে যা কিছু আছে বা ঘটেছে, তার মূলে রয়েছে একটা কারণ। একজনের হাত যদি পুড়ে যায় তাহলে আগুনকেই বলতে হবে তার কারণ। কিন্তু যদি মানুষ ও আগুন উভয়েরই প্রকৃতি বদলে যায় তাহলে আজকে পোড়ার কারণ আগুন হলেও অনাগতকালে তা আর কারণ থাকবে না। মানুষের শরীরের উত্তাপ যদি আগুনের উত্তাপ থেকে আরও বেড়ে যায়, তাহলে আগুনের স্পর্শে জ্বালা-যন্ত্রণা পাওয়া দূরের কথা, হয়ত চন্দনের প্রলেপের সুখ অনুভব করতে পারে অথবা যদি আগুন তার দাহিকা শক্তি হারায়, তাহলেও তার স্পর্শে বর্তমানেও আমরা আর জ্বালা-যন্ত্রণা পাবো না। তাহলে দাহিকা ও আগুনের মধ্যে যে কার্যকারণের সম্বন্ধে তাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে ভাবতে হবে, তাদের প্রকৃতি বদলায় না। তারা চিরদিনই এক এবং অবিকৃত থাকলেই তাদের কার্যকারণ সম্বন্ধে অব্যাহত থাকতে পারে। ন্যায়শাস্ত্রে তাকে বলা হয় Uniformity of essence অথবা সারের সমরূপতা।
দ্বিতীয়ত-আগুন ও উত্তাপের প্রকৃতি চিরকাল অবিকৃত থাকলেও বর্তমানে তাদের যে সম্বন্ধ তাই বা কেমন করে অব্যাহত থাকবে? আমরা কি ভাবতে পারি না-আজকে না হয় কোন বস্তুতে আগুন দিলে দেখা যায় তা’ জ্বলে পুড়ে খাক্ হয়ে যায়-আগুন ও দাহিকার সম্বন্ধে তাই বলে কি চিরদিন অব্যাহত থাকবে? ভবিষ্যতে তাদের এ কার্যকারিতার সম্বন্ধে তো নাও থাকতে পারে।
তার জন্য আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যে, তাদের ব্যবহারিক দিকের কোন পরিবর্তন হয় না। আজ তারা যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে অনাগত ভবিষ্যতে বা চিরদিনই তাদের স্বভাবে এ ব্যবহার প্রকাশ পারবে। একেই বলা হয় ব্যবহারের সমরূপতা।
তাহলে আমাদের চিন্তাধারার জন্য এবং বৈজ্ঞানিক বা ব্যবহারিক জীবনের ব্যাখ্যার জন্য শেষ পর্যন্ত দুটো নীতির স্বীকৃতিই অবশ্য গ্রহণীয়। একত্বের নীতি১৫৮ ও প্রকৃতির সমরূপতা নীতি১৫৯ না মেনে নিলে চিন্তাও চলে না, কোন গবেষণাও চলতে পারে না।
অথচ এ দুটোর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। কারণ এগুলোর ব্যাখ্যা দিতে গেলেই এগুলোকে গ্রহণ করে নিতে হবে। তাতে ন্যায়শাস্ত্রের ভাষায় Petitio principal হয়ে যাবে।
তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এ দুটো নীতির পশ্চাতেও রয়েছে আরও দুটো স্বতঃসিদ্ধ। একত্বের নীতিতে বলা হয়, কোন বস্তু বা বিষয় তারই মত। তাকে সাংকেতিকভবে প্রকাশ করা হয় ক=ক। অর্থাৎ বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যেও ‘ক’ নামক বিষয়ের মধ্যে রয়েছে এক ঐক্য। এ ছাড়া আমরা ‘ক’ সম্বন্ধে কোন বিষয় ভাবতেও পারি না এবং বলতেও পারি না। যেহেতু পারি না, তাই আমদের ধরে নিতে হবে ‘ক’ নামক বিষয়ের বিভিন্ন পরিবর্তনকে তুচ্ছ করে তার একত্বকেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
সমরূপতা নীতিতে১৬০ আমারা স্বীকার করে নিচ্ছি, পৃথিবীর সর্বত্র রয়েছে সমরূপতা১৬১ , কোন বস্তু বা শ্রেণী তার প্রকৃতি বদলায় না এবং দুটো বিষয়ের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ স্থাপিত হলে তার মধ্যেও কোন ছেদ হয় না।
এখানে ভেবে দেখবার বিষয় এই যে, আমরা চিন্তা করতে বা তর্কশাস্ত্রে অগ্রসর হতে পারি না বলে কেন এই নীতিকে গ্রহণ করবো? না হয় না-ই ভাবলাম, না-ই তর্ক করলাম, তাতে কি যায় আসে? জ্ঞানের রাজ্যের কার্যকারণ আবিস্কার না করলে হয়ত আমাদের অগ্রসর হওয়ার পথ নেই। তাতে এমন কি হল? না-ই বা অগ্রসর হলাম!
কিন্তু মানব-মন তাতে আশ্বস্ত হয় না। সে গোড়াতেই ধরে নেয়- এ জগৎ জ্ঞেয়১৬২ এবং মানুষ হিসাবে আমরা সকলেই জ্ঞাতা১৬৩ । মানবমন জ্ঞান অন্বেষণের আদিতেই স্বীকার করে নেয়, এ জগৎ কোন দুর্বোধ্য পুঁথি নয় এবং তাকে জানবার শক্তি মানুষের মধ্যে রয়েছে। কাজেই এটাই জ্ঞানের রাজ্যে আদিম নীতি, এটাই সবচেয়ে বড় স্বতঃসিদ্ধ। যদিও আমরা আপাতত এ স্বতঃসিদ্ধ সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল নই, তবুও জ্ঞানের রাজ্যে একে গ্রহণ করেই আমরা অগ্রসর হই।
অপরদিকে জ্ঞানের চরম পরিণতিতে আবার এসে চরম ঐক্যে পৌঁছার প্রবৃত্তিও রয়েছে মানুষের মনে। সকল বিশৃঙ্খলা, সকল বৈসাদৃশ্যের অন্তরালেও মানুষ আবিস্কার করতে চায় এক চিরন্তন নিয়ম, এক চরম শৃঙ্খলা প্রবণতা যদি স্বতঃসিদ্ধ নয়, তবুও তাকে মানব-মনের এক বিশেষ ঝোঁক বলতে হবে।
বিজ্ঞান ও দর্শনের ইতিহাসে রয়েছে তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত। ভাববাদ বা জড়বাদে জগতের আদি সত্তারুপে স্বীকার করে নেয়া হয় এক আদি নীতি। ভাববাদী দর্শনে সাধারণত জ্ঞানের পদ্ধতিরুপে স্বীকার করে নেয়া হয় যুক্তিকে। সে যুক্তির ধারার দ্বন্দ্বের ফলে অবশেষে উপস্থিত হতে হয় পরম ব্রহ্মে। তার উদাহরণস্বরূপ রয়েছে হেগেলীয় দর্শন। জড়বাদে জগতের আদি উপকরনরূপে স্বীকার করে নেয়া হয় কতকগুলো অবিভাজ্য অণুকে। জড়বাদী দর্শনে জ্ঞানের একমাত্র পদ্ধতি ভূয়োদর্শন অথবা ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান। সে জ্ঞানের আলোকে জগতের সব বস্তুর বিশ্লেষণ করলে ধরা পড়ে চেতনাহীন, সমগুণ বিশিষ্ট অণু ও পরমাণুর খেলা।
বহুবাদের বিভিন্ন রূপ থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে রয়েছে এক ঐক্য। লাইবনিটজের১৬৪ বা জেমসের১৬৫ মধ্যেও রয়েছে সাদৃশ্য। লাইবনিট্জ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁর স্বতন্ত্র monad১৬৬ গুলোর মধ্যে রয়েছে এক সংস্থা১৬৭ ও ঐক্য১৬৮ ,কারণ তাদের মধ্যে সমগ্রের রূপ প্রতিভাত হয়। তারা যুক্তিসঙ্গত নীতি দ্বারা পরিচালিত এবং তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই সেই যুক্তিসঙ্গত সংস্থা এক বিশেষ দিকে বা বিশেষ স্তরে প্রতিবিম্বিত হয়।* (Patrick: Introduction to Philosophy,p.228)
উইলিয়াম জেম্স্ বস্তুর বা বিষয়ের স্বাতন্ত্র্যের১৬৯ ওপর গুরুত্ব আরোপ করে নিয়ম ও শৃঙ্খলা পশ্চাৎভূমিতে ঠেলে দিয়ে বলেছেন, নিয়ম জাগতিক অভ্যাস, জীবনের পদ্ধতি ব্যতীত আর কিছুই নয়। বস্তুগুলো একত্র জড়ো হয়েছে আকস্মিকভাবে এবং তাদের স্ব-ইচ্ছায়ই একত্র আছে-তারাই নিয়মগুলো সৃষ্টি করেছে। যেমনভাবে পরস্পরের মিলনের জন্য সাম্প্রদায়িক নিয়ম গঠিত হয় তেমনি তারা নিয়ম গঠন করেছে১৭০। ** ( William James: The Will to Believe.) কিন্তু তারপরেই আবার বলেছেন, ‘সেই স্বতঃউৎসারিত স্বতন্ত্র সত্তাগুলোর সমষ্টির অভ্যাসের ফলেই প্রাকৃতিক নিয়মাবলির উৎপত্তি হয় এবং সে স্বতন্ত্র সত্তাগুলো এ সব নিয়ম থেকে অধিকতর বাস্তব১৭১ । কাজেই তাদের যে সমষ্টিগত অভ্যাস থেকে জগতের নিয়ম ও শৃঙ্খলার উৎপত্তি হয়, তাকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। সুতরাং শত অস্বীকার করলেও সকল চিন্তার পরিণতিতেই মান-মন নিয়ম, শৃঙ্খলা ও সংস্থা আবিস্কার করতে বাধ্য হয়।
তা’হলে স্পষ্টই বোঝা যায়, জ্ঞানের রাজ্য চলছে চক্রাকারে। ঐক্যের নীতি সমরূপতার নীতিকে স্বতঃসিদ্ধরূপে গ্রহণ করে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করে।অনুসন্ধানের পরিণতিতে মানব-মনে এসে পৌঁছায় সেই নিয়ম-শৃঙ্খলা বা একত্বের নীতিতে।
স্বতঃসিদ্ধের আলোচনায় আমরা পূর্বেই দেখেছি, সর্ব-মূলাধার স্বতঃসিদ্ধ হচ্ছে জ্ঞাতার শক্তির উপর ও জ্ঞেয়তার উপর বিশ্বাস এবং যেহেতু বিজ্ঞান বা দর্শন সেই জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের সম্বন্ধে বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞান ও দর্শন আজও স্বতঃসিদ্ধের কোন প্রমাণ দিতে পারেনি। এগুলো ব্যতীত জ্ঞানের চর্চা চনে না বলে এগুলোকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ইসলাম ধরে নিয়েছে জ্ঞাতার পক্ষে জ্ঞেয় সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ সম্ভবপর, যেহেতু উভয়ে একই কারণ থেকে উদ্ভূত। তাদের উভয়েরই উৎপত্তি একই আল্লাহ্ থেকে। আল্লাহ্ স্থিতির মূল উৎস বিধায় তাঁরই কার্যকারিতার ফলে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে এ মিলন সম্ভবপর। ইসলামী চিন্তাধারায় তাই আল্লাহ্কে স্বতঃসিদ্ধের ভিত্তিরূপেই গ্রহণ করা হয়েছে।
মানব-মন যে স্বাভাবিক প্রবণতার ফলে স্থিতির১৭২ মূলে আবিস্কার করে চরম ঐক্য ও শৃঙ্খলা, ইসলাম সেই শৃঙ্খলা ও ঐক্যকে মানব-মনের প্রতিভাস বলে মনে করেনি। আল্লাহ্র অস্তিত্বের ওপর বিশ্বাস করার ফলে এবং সেই ঐক্যও যে জগতের আদি সত্তায় বর্তমান তার ভিত্তি সুদৃঢ় করেছে। আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস বা কুরআন শরীফের বাণীতে আস্থা স্থাপন, জ্ঞান অন্বেষণের পথে তাই বিঘ্ন নয় বরং জ্ঞানের পথকে সুগম করে-তার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে।
এ দুনিয়ার সমস্ত কিছুর জ্ঞান মানবের পক্ষে সম্ভবপর; জ্ঞানের পথে মানুষের কোন প্রতিবন্ধক নেই- জ্ঞানের চরম পরিণতিতে মানুষ আবিস্কার করবে নিয়ম-শৃঙ্খলা- এটাই ইসলামী জীবন-দর্শনের গোড়ার কথা।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার আরোহ পদ্ধতিকে১৭৩ গ্রহণ তাই ইসলামের দৃষ্টিতে বর্জনীয় নয় বরং তার মূলকে দৃঢ় করার ভিত্তিস্বরূপ। আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিরূপ যেমন একত্বের নীতি১৭৪ বা সমরূপতা নীতি১৭৫ অবশ্য গ্রহণীয়, তেমনি জ্ঞাতা১৭৬ এবং জ্ঞেয়ের১৭৭ সম্বন্ধ স্বীকারও অবশ্য প্রয়োজনীয়। পরবর্তী নীতি স্বীকার করে নিলে আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মৌলিক ঐক্য। সে মৌলিক ঐক্যের স্বীকৃতি ব্যতীত আমাদের পক্ষে এক পা অগ্রসর হওয়ার সাধ্য নেই। ইসলামী চিন্তাধারায় তাই জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মৌলিক ঐক্যস্বরূপ আল্লাহ্র অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার আলোচনায়ও আমরা দেখতে পাই মানব মন তার সকল চিন্তার পরিণতিতে এসে পৌঁছায় এক ঐক্যে। সে ঐক্য জড় বা চৈতন্যময়-দু’ই হতে পারে। তাকে জড়বস্তু বলে ধারণা করলে আমাদের মানসে দেখা দেয় নানাবিধ দ্বন্দ্ব- নৈতিক ও উচ্চতর মানগুলো তাতে কোন ভিত্তি খুঁজে পায় না। অপরদিকে কার্যকারণ পরস্পরা নীতির১৭৮ সুষ্ঠু ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। মানব-মনের বিভিন্ন চিন্তা নীতি ইত্যাদি বোধঃ শক্তিহীন জড়পদার্থ থেকে উৎপন্ন হলে আমাদের স্বীকার করতে হয়, আদিতে কারণে কোন গুণ না থাকলেও কার্যে যেসব গুণের উৎপত্তি হতে পারে। অথচ কার্যকারণের নীতিতে বলা হয় শূন্য থেকে শূন্যই আসে১৭৯ । সে নীতিকে কার্যকরী রাখতে হলেও আমাদের ধরে নিতে হয়, যদিও জড় বলে জগতের আদি সত্তা আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে প্রতিভাত হয়, যদিও জড় হলে জগতের যাবতীয় সম্পদ তা সে মননধারারই হোক বা সামাজিকই হোক, উহ্য রয়েছে। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা বাহ্য হয়ে পড়ে।
ইসলাম তাই কুরআনের ভাষায় মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে এ জগতের আদি কারণকে চৈতন্যময় সত্তারুপে নির্দেশ করেছে। ইসলামের নিকট তাই আল্লাহ্র অস্তিত্ব একাধারে স্বতঃসিদ্ধ১৮০ ও মানব চিন্তার চরম পরিণতি। আল্লাহ্র অস্তিত্বের স্বীকৃতি ব্যতীত জ্ঞানের পথে মানুষ এক তিল অগ্রসর হতে পারে না। অপরদিকে আল্লাহ্র অস্তিত্ব মানুষের জ্ঞানের চরম পরিণতি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় মানুষ সর্বশেষে তাঁরই অস্তিত্বে আস্থা স্থাপন করে স্বস্তিলাভ করে।
বিজ্ঞানের প্রাথমিক ভিত্তির আলোচনায়ও আমারা দেখেছি একত্বের নীতি, সমরূপতার নীতি প্রভৃতি মৌলিক নীতিকে স্বীকার করে চিন্তার পরিণতিতে মানুষ আবার এ দুনিয়ার মধ্যে এক চরম ঐক্য আবিস্কার করে। ইসলামী চিন্তাধারার মূলসূত্র আল্লাহ্র অস্তিত্বের স্বীকৃতি তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের পক্ষে প্রতিবন্ধক নয় বরং প্রেরণাদানকারী।
আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রশ্ন
‘আল্লাহ্ আছেন কি না’- প্রশ্নটি মানব জীবনে নতুন নয়। মানব মনের চিন্তার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে এ সম্বন্ধে মানুষ ভেবেছে, এখনও ভাবছে। এ প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ্র সংজ্ঞার ওপরই নির্ভর করে। আল্লাহ্ বলতে যদি আমরা চতুর্দশ লুই বা হিটলারের মত এক প্রচণ্ড শক্তিশালী দণ্ডধর বা আসমানের অধীশ্বর বলে কল্পনা করি, তাহলে তাঁর অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আল্লাহ্ বলতে যদি মনে করা হয়-সদ্,চিদ্ ও আনন্দ স্বরূপ এক বিশ্ব-সত্তা, তাহলে জ্যামিতিক প্রমাণ না দেওয়া গেলেও একটা গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে।
সাধারণত আল্লাহ্ বলতে আমরা বুঝতে পারি এ বিশ্বের স্রষ্টা পরম মঙ্গলময়, পরম বুদ্ধিমান, সর্বগুণাধার, বিশ্বের সকল বস্তুর নিয়ামক এক শক্তি। আল্লাহ্র এবং বিধ ধারণার পোষকতায় দর্শনশাস্ত্রে তিনটে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।
আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পারি, জগতে যা কিছু ঘটে তার মূলে রয়েছে একটা কারণ। কারণ ব্যতীত কোন কার্যের উৎপত্তি হয় না। তাই আমরা ভাবতে বাধ্য হই, নিশ্চয়ই এ বিশ্ব-সৃষ্টির মূলে রয়েছে একটা বিরাট কারণ। কার্যকারণ-পরস্পরা-সূত্রের অমোঘতা স্বীকার করে নিলে তখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মূলে কার কার্যকারিতা বিদ্যমান? দর্শনশাস্ত্রে তাই এই স্রষ্টা তত্ত্ববিষয়ক প্রমাণের১৮১ উপর কোন বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
দ্বিতীয় প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, দুনিয়ার সর্বত্র রয়েছে বুদ্ধি ও করুণার নিদর্শন, তাতে প্রমাণিত হয় দুনিয়ার সৃষ্টির মূলে রয়েছে এক পরম মঙ্গলময়ের হস্ত। মানব জীবনের নানা ঘটনা থেকেই বুঝতে পারা যায়, এতে রয়েছে এক মহান উদ্দেশ্য। সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের বুকে দুধ সঞ্চিত হয়। যদি তা না হত, তাহলে পৃথিবীর এতগুলো শিশু আহারের অভাবে অকালে মারা যেত। অবুঝ ইতর প্রাণীদের মধ্যে যদি অপত্য স্নেহ না থাকত তাহলে সদ্যোজাত বাচ্চাগুলো শত্রুর আক্রমণে জন্মের সঙ্গে-সঙ্গেই লয় পেত। এতে প্রমাণ পাওয়া যায়, জীবের বিকাশের জন্য উপায়স্বরূপ১৮২ জনক-জননীর বুকে এই স্নেহ কেউ গোড়াতেই ঢেলে দিয়েছেন। এই যুক্তিকে দার্শনিক পরিভাষায় বলা হয় ধর্মতত্ত্বমূলক যুক্তি১৮৩। তার বিরুদ্ধে বলা যায়-দুনিয়ার সর্বত্র লক্ষ্য ও উপায় সুসামঞ্জস্য নেই। অনেকগুলো জীব পিতামাতার যত্নের অভাবে অকালে মারা যায়। অনেকগুলো পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধে লোপ পায়। আবার অনেকগুলোর জন্য পর্যাপ্ত আহারের ব্যবস্থা নেই।
জীব-জগৎ ব্যতীত দুনিয়ায় অনেকগুলো জরা-ব্যাধি, প্রাকৃতিক উৎপাদন১৮৪ রয়েছে। তাদের অস্তিত্বের কোন প্রয়োজন আবিস্কার করা যায় না। সাহারা বা গোবি মরুভূমি দুনিয়ার কার কোন্ প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে? আগ্নেয়গিরির উৎপাত জগতের কোন্ কাজে লাগছে? যদি পৃথিবীর মঙ্গলময় দিকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই তাকে এক আদর্শ কারিগরের সৃষ্টি বলে ধরে নেয়া হয়-তাহলে অপরদিকে অশুভ ও অকল্যাণকর দিকের বিচার করলে তাকে এক পিশাচের সৃষ্টিই বলতে হয়।
এ দুটো বৃত্তিই আল্লাহ্ সম্বন্ধে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ্কে ধারণা করা হয়েছে সর্বত্রুটিহীন, সর্বগুণাধার, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তারুপে। তাই তার প্রমাণস্বরূপ বিশ্ব সৃষ্টি থেকে বিশ্বের নানাবিধ কলাকৌশল১৮৫ থেকে নযীর তুলে বলা হয় আল্লাহ্ই এসব কার্যের১৮৬ মূলাধার।
তার তৃতীয় যুক্তিস্বরূপ বলা হয় আল্লাহ্র অস্তিত্ব নিশ্চয়ই রয়েছে। কারণ আল্লাহ্র ধারণা থেকেই তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। যিনি সর্ব গুণাধার, তাঁর মাঝে অস্তিত্ব নামক গুণের অভাব হলে তাঁকে সর্বগুণাধার বলা পরস্পরবিরোধী উক্তি মাত্র। মধ্যযুগে সেন্ট এলসেম এ যুক্তির অবতারণা করে বেশ বাহবা পেয়েছিলেন।
এ যুক্তিও ত্রুটিহীন নয়। আল্লাহ্কে সর্বগুণাধার বলে আমরা মাত্র তাঁর অস্তিত্ব ঘোষণা করছি-তাঁর কোন প্রমাণ দিতে পারিনি। দার্শনিক শ্রেষ্ঠ ক্যান্ট একে উপহাস করে বলেছেন, ‘আমার পকেটে একশত ডলার রয়েছে বলে যদি আমার ধারণা থাকে, তাতে কি প্রমাণ হয় যে, বাস্তবিকই একশত ডলারের অস্তিত্ব রয়েছে’।
এসব যুক্তির দ্বারা আল্লাহ্র অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। এ তিনটি প্রমাণের মধ্যে প্রণিধানযোগ্যে বিষয়টি এইঃ দুটোতে অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করতে তার অনুকূলে প্রমাণ দেয়া হয়েছে। অপরটিতে ধারণা থেকে অস্তিত্বের প্রমাণ নেয়া হয়েছে। তবে তিনটি যুক্তিতেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে ধারণার সত্যাসত্য বিষয়ের সঙ্গে যোগসূত্রই নির্ধারিত হবে। আল্লাহ্র অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমাদের মনে যে ধারণা রয়েছে- যদি বাস্তব জগতে সেরূপ কোন সত্তা থেকে তাহলে এটি সত্য’। যদি না থেকে তাহলে মিথ্যা। কাজেই আল্লাহ্ সম্বন্ধে আমাদের ধারণাগুলো সত্য না মিথ্যা, এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে সত্য ও মিথ্যার সংজ্ঞা নির্দেশ করতে হয়।
সাধারণত সত্য বলতে বোঝা যায়-প্রতিষঙ্গ১৮৭ । আমাদের মনে রয়েছে অনেকগুলো ধারণা। বাইরের জগতে রয়েছে অসংখ্য বস্তু ও গুণাবলি। কোন ধারণা সত্য হলে তার সঙ্গে বাইরের বস্তু বা গুণাবলির যোগ থাকা চাই। যেমন ধরা যাক, কারো মনে জ্বিন কোন জাত আছে বলে যদি ধারণা থাকে, তাহলে তা সত্য কি মিথ্যা বিচার করতে হলে তলিয়ে দেখতে হবে জ্বিন বলে কোন জাত আছে কি না। যদি থাকে, তাহলে এ ধারণা সত্য। যদি না থাকে, তাহলে তা মিথ্যা। একে দর্শনের পরিভাষায় সত্যের প্রতিষঙ্গমূলক মতবাদ১৮৮ বলা হয়। এখানে প্রশ্ন দাঁড়ায় পাওয়া যায়, তাহলে সেও আমাদের মনেরই একটা ধারণা হবে। কাজেই কোন ধারণার সত্যাসত্যের বিচার অপর ধারণার দ্বারাই করতে হবে।
তার ওপর এতে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে বিষয়বস্তু বা গুণাবলি অপরিবর্তনীয়। তাদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা সব সময় একই থাকবে। আমাদের অভিজ্ঞতায় কিন্তু দেখতে পাই বস্তুজগতে চলছে এক দ্রুত পরিবর্তন। উদ্দীপক থেকে যে সংবেদন আমরা পাই, বিভিন্ন চিন্তার মাধ্যমে১৮৯ তাকে আমরা যেসব বস্তু সম্বন্ধে পূর্বে যেসব ধারণা করে নিয়েছি, তার সত্য বিচার করতে গিয়ে যদি পূর্বের ধারণাগুলোকে আবার বস্তুর সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে স্পষ্টই দেখতে পাব- আমাদের ধারণার পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। কারণ বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে বস্তু পরিবর্তিত হয়ে গেছে অথচ আমাদের ধারণার পরিবর্তন হয়নি অথবা বস্তু অপরিবর্তিত রয়েছে কিন্তু তার সম্বন্ধে আমাদের ধারণার হয়েছে পরিবর্তন।
তাছাড়া সত্যাসত্য বিচার কেবল বাইরের বস্তুর সঙ্গে আমাদের তুলনা করেই শেষ হয় না। মানব মনের আবিষ্কৃত অনেকগুলো তত্ত্বের সঙ্গে আমাদের পরবর্তী ধারণাগুলোর সত্যাসত্য নির্ণয় করা চলে। জ্যামিতি শাস্ত্রের একটা প্রতিপাদ্য১৯০ বা সম্পাদ্য১৯১ সত্য না মিথ্যা বিচার করতে হলে পূর্ববর্তী প্রতিপাদ্য, সম্পাদ্য বা স্বতঃসিদ্ধ থেকে তাকে যুক্তিসহকারে অবরোহন করা১৯২ যায় কি না, তাই বিচার করতে হয়। কাজেই সত্যের এ সংজ্ঞা নির্দেশ নিতান্তই একদেশদর্শী।
এ থিয়োরির সমালোচনাতেই সঙ্গতিবাদের১৯৩ উৎপত্তি। Coherence theory মতে আমাদের মনে যেসব ধারণা বর্তমান তাদের মধ্যে যদি সঙ্গতি থাকে তাহলে বুঝতে হবে তারা সত্য। যদি কোন ধারণার সঙ্গে অন্য সুপ্রতিষ্ঠিত ধারণার সংঘর্ষ বাধে, তবে সবগুলো ধারণার আলোকেই নতুন বেখাপ্পা ধারণার বিচার করতে হবে।
এ থিয়োরি মতে অনেক অসত্যকেও সত্য বলে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে। সাধারণত সত্য বলতে ধারণার সঙ্গে বিষয়ের যোগ বোঝা যায়। যদি ধারণার সঙ্গতি-অসঙ্গতি সত্যাসত্য বিচারের মানদন্ড হয়, তাহলে বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এমন অনেক বিষয়কে সত্য ব’লে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে। ধরা যাক, একটি স্কুলের ছেলে এসে তার আম্মার নিকট অভিযোগ করল যে, তাকে হেডমাস্টার কান ম’লে দিয়েছেন। তার আম্মা অনুসন্ধান করে দেখল বাস্তবিকই ছেলেটির কান লাল। তার চোখের কোণেও রয়েছে পানির দাগ। আম্মার নিশ্চয় বিশ্বাস হবে,তার ছেলের অভিযোগ সত্য। বাস্তবিক পক্ষে হেডমাস্টার তাকে মারেননি। অন্য ছেলের সঙ্গে লড়াই করতে দেখে হেডমাস্টার তাকে ধমক দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ছেলে তার আম্মার কাছে যে জবানবন্দি দিচ্ছে, তাতে কোন অসঙ্গতি নেই। মাস্টার ছাত্রের সম্পর্ক বা হেডমাষ্টারের কড়া মেজাজের সম্বন্ধে তার আম্মার ধারণাগুলোর সঙ্গে ছেলের বিবরণ হুবহু খাপ খাচ্ছে, কাজেই আম্মার তাকে ধরে নিচ্ছে সত্য বলে। আদতে কিন্তু বর্ণনাটি নিছক কাল্পনিক ও বিদ্বেষমূলক।
তার ওপর গোটা মনোজগতের সবগুলো ধারণার সঙ্গে নতুন ধারণার সঙ্গতি দ্বারা যদি তার সত্য বিচার করা যায়, তাহলে অন্যদিকে মস্ত অন্যায় করা হবে। কারণ আমাদের পূর্বতন ধারণাগুলোও সম্পূর্ণ অলীক হতে পারে। জগতে নানাবিধ আবিস্কারের সূচনাতে তাদের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন হয়েছে। কোপারনিকাসের১৯৪ সূর্যকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত১৯৫ বা ডারউনের বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে সমসাময়িক যুগে নানা কটূক্তি বর্ষিত হয়েছে। পরবর্তীকালে আবার সেই সব ধারণার আলোকেই জগতের মানব-কাঠামো পুনর্গঠিত হয়। সঙ্গতি কথার তাহলে অর্থ থাকে কি?
উইলিয়াম জেমস তাই সত্য সম্বন্ধে প্রয়োগবোধ১৯৬ নামক তাঁর নিজস্ব মতবাদ প্রচার করেন। তাঁর ধারণা ছিল বাস্তব জগতে স্থিতিশীল বলে কোন কিছু নেই, সব কিছুই পরিবর্তনশীল। তাই কোন ধারণার সত্যাসত্য তার কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের ধারণা ছিল, যা সত্য তাই কার্যকরী। জেমস তার বিরুদ্ধে ঘোষনা করেন, যা কার্যকরী তাই সত্য। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মনে নানা ধারণা, নানা ভাব, নানা থিয়োরি বর্তমান। তাদের প্রত্যেকটি সম্বন্ধে আমরা সত্যের দাবি করি। তাদের কার্যকারিতা দিয়েই সত্যের বিচার করে। যদি তাদের মধ্যে কোনোটা কার্যকরী হয়, তাহলে সেটি সত্য, যদি কার্যকরী না হয়, তাহলে মিথ্যা।
ধর্ম সম্বন্ধে সে মতবাদ অনুসারে বলা যায়, জীবনে ধর্মের কার্যকারিতা রয়েছে, কাজেই ধর্মের ধারণাগুলো সত্য। জেমস তাঁর বলিষ্ঠ ভাষায় প্রকাশ করেছেন, আমাদের প্রক্ষোভজাত প্রয়োজন দুনিয়াকে ধার্মিকের মনোবৃত্তি নিয়ে গ্রহণ করার মত দুঃসাহসিক কর্মের পোষকতা করে। ধর্ম সত্য হতে পারে, এই আশাকে পোষণ করা ধর্ম মিথ্যা, এই আশঙ্কার চেয়ে ভালো, কারণ এ দুটো বিশ্বাসের একটাকে আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। কাজেই আল্লাহ্র অস্তিত্বের ধারণা আমাদের জীবনের অনেকগুলো কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে, সেইজন্যই এটি আমাদের জীবনে সত্য।
এ মতবাদের জের টানলে এক বিরূপ সিদ্ধান্তে এসে উপস্থিত হতে হয়। correspondence Theory বা Coherence Theory দুটোই সত্যের কার্যকারিতা স্বীকার করে নেয়। যা সত্য তা জীবনে কার্যকরী হবেই। কিন্তু যা কার্যকরী তা সত্য কি করে হতে পারে? যেমন ধরা যাক, গভীর রাতে কোন ব্যক্তির যদি রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়, তাহলে ভ্রমের বশবর্তী হয়ে সে ভয় পায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ায়। কিন্তু তা বলেই কি বুঝতে হবে সেই রজ্জু বাস্তবিকই একটা সাপ? এ যুক্তির ধারামতে একটা ভুল হলেও সাময়িকভাবে সত্য। কারণ সেই ভ্রমাত্মক ধারণা সেই ব্যক্তির জীবনে কার্যকরী। কাজের মধ্যেই সত্যের সার্থকতা। যদি রজ্জুকে সাপ মনে করে পথিক ভুল করে ভয় পায়, তাহলে একটা জীবন্ত সাপ ঠিক তার মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, এই রজ্জুও সেই প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি করে এবং এই জন্যই তা’ সত্য।
এভাবে বিচার করলে অবশ্য জেমসের মতবাদের যৌক্তিকতা আমাদের কাছে অত্যন্ত দুর্বল মনে হয়। তাহলে সত্যাসত্যের বিচার নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যা একজনের কাছে এক বিশেষ সময়ে সত্য, তা অপরের নিকট সত্য নাও হতে পারে। দুনিয়া তখন হয়ে পড়ে ছন্নছাড়া খেয়ালী রাজ্য। সত্য সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলাই হয়ে পড়ে অসঙ্গত।
জেমস নিশ্চয়ই এই অর্থে সত্য শব্দের প্রয়োগ করেন নি। ব্যষ্টির ব্যক্তিগত জীবন ব্যতীত সমষ্টি জীবনে এমন কতকগুলো ধারণা কার্যকরী, যেগুলোর সপক্ষে ন্যায়শাস্ত্র অনুমোদিত কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, অথচ মানবচিন্তার সূচনা থেকে সেগুলোর ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। স্থান ও কাল আমাদের সকল চিন্তার মূলেই রয়েছে। এ দুটো ধারণাকে প্রমাণ করা সহজ নয়। অথচ কোন বিষয় সম্বন্ধে চিন্তা করতে হলে স্থান-কালের মাধ্যমেই চিন্তা করতে হয়। দার্শনিক ক্যান্ট তাদের বলেছেন, Forms of Institutions.
কার্যকারণ পরস্পরাসূত্র১৯৭ এবং বস্তু১৯৮, এগুলোও প্রামাণ্য ধারণা নয়। এগুলো ব্যতিরেকে মানবজীবনের অভিজ্ঞতা বা বিজ্ঞান এক পা-ও অগ্রসর হতে পারে না। কাজেই তাদের সত্যতা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। আল্লাহ্র অস্তিত্ব যদি এমন কোন ধারণা হয় যা স্বীকৃতি ব্যতীত আমরা জাগতিক অভিজ্ঞতার কোন সুষ্ঠু ব্যাখ্যা করতে পারি না, তাহলে তাকে স্বীকার করতে আমরা বাধ্য। সম্ভবত এই অর্থেই জেমস বলেছিলেন, যা জীবন কার্যকরী, তা-ই সত্য।
এখানে প্রশ্ন দাঁড়ায়, আল্লাহ্র অস্তিত্ব বাস্তবিকই সেরূপ কোন ধারণা কিনা। আমাদের অভিজ্ঞতাকে যদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জগতে সীমাবদ্ধ করা যায় তা’হলে অবিচার করা হবে। বিজ্ঞানের জগতে আমরা পরিচালিত হই বুদ্ধিবৃত্তি১৯৯ দ্বারা। সেখানে বোধির কোন স্থান নেই। পরিদৃশ্যমান জগতের বিভিন্ন উদ্দীপক থেকে যে সংবেদন আমরা পাই, বিভিন্ন চিন্তার মাধ্যমে তাকে আমরা সুসংবদ্ধ করে সার্বিক সিদ্ধান্তে২০০ এসে পৌঁছি। সেই সিদ্ধান্তগুলোকে ব্যবহারিক জীবনে কার্যকরী করে তোলা ফলিত বিজ্ঞানের কাজ। বৈজ্ঞানিক জগৎ ব্যতীত নৈতিক বা ধর্মীয়জীবনে নানা অভিজ্ঞতা আমাদের হয়। সেগুলোর ভিত্তিতেও নীতিবিজ্ঞান বা ধর্মীয় বিজ্ঞান গড়ে তোলা সম্ভবপর। তবে বাস্তবজীবনে তাদের প্রয়োগ ঠিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত ফলপ্রসূ নয়। তাদের দ্বারা মানুষের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান ঠিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পর্যায়ের নয়। মানবমনের বিকাশসাধন করে তারা সমাজজীবনে নানাভাবে উন্নত করে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ফলিত রূপের নানা দওলতে আপাতত মুগ্ধ হয়ে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা বলে ভুল করে থাকি। এজন্যই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে নৈতিক জীবনের বা ধর্মীয়জীবনের নানাবিধ দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বুদ্ধি ও বোধির এ দ্বন্দ্ব বাস্তবিকই মারাত্মক।
মানবজীবনের সবগুলো অভিজ্ঞতা ও তার জ্ঞানের সবগুলো পদ্ধতিকে স্বীকার করে নিলে, তবে এই দ্বন্দ্বের নিরসন হতে পারে।
আল্লাহ্র অস্তিত্বের যেসব প্রমাণ পাওয়া যায়, তাতে মাত্র এক সুরই প্রমাণিত হয়। ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ শক্তিতে মানবমন তার প্রকৃত সত্তা খুঁজে পায় না বলে আজীবন অসীম সত্তার আশ্রয়ে সে স্বস্তিলাভ করতে চায়। এখানেই রয়েছে ধর্মের অপরিহার্যতা, যাকে ইংরেজ দার্শনিক জন কেয়ার্ড বলেছেন, Necessity of Religion.
মানবজীবনের নানাবিধ অভিজ্ঞতায় আল্লাহ্র অস্তিত্বের স্বীকৃতি অনিবার্যরুপে দেখা দেয়। তাকে বুদ্ধির আলোকে প্রমাণ করতে চাইলে তাতে ত্রুটি দেখা দেয়া সত্য। কিন্তু যা কবির চোখে, ধ্যানীর মর্মে একান্ত বাস্তব, যা ব্যক্তি-জীবনের নানাবিধ অভিজ্ঞতার সুসামঞ্জস্য বিধানে কার্যকরী, রাষ্ট্রীয় জীবনে যে ধারণার কল্যাণে হয় ব্যষ্টি ও সমষ্টির অধিকারের সমন্বয়, তাকে অবাস্তব বলার অর্থ সত্যকে অস্বীকার করা।
পরলোকগত ইংরেজ কবি ওয়ার্ডস ওয়ার্থ আল্লাহ্র অস্তিত্বের কোন প্রমাণ চাননি। তাঁর কাছে তাঁর নিজের অস্তিত্বের মতই তা’ই ছিল জীবন্ত সত্য। অনবদ্য ভাষায় তিনি বলেছেনঃ
‘ যে প্রকাশ আমায় সমুন্নত চিন্তার দ্বারা বিচলিত করে, যার মহান অনুভূতি অত্যন্ত গভীরভাবে (আমার সত্তায়) অনুপ্রবেশ করে, যার আবাস অস্তগামী সূর্যের রশ্মিতে, সমুদ্রের দিকবলয়ে, মুক্ত জীবন্ত বাতাসে, ঘন-নীল আকাশে এবং মানব মনে (রয়েছে বিরাজমান) যে গতি ও আত্মা সকল চিন্তাশীল জীবকে ও চিন্তার বিষয়বস্তুকে দোলা দেয় এবং সকল বস্তুতে প্রবাহিত তা আমার কাছে জীবন্ত সত্য।২০১
উইলিয়াম জেমসও ঠিক ওয়ার্ডস ওয়ার্থের মত আল্লাহ্র অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাঁর ধারণা প্রকাশ করেছেনঃ
“ প্রাকৃতিক বিজ্ঞান যেভাবে বিশ্বসংস্থাকে জানবার চেষ্টা করে তাতে তার মাঝে সুসংবদ্ধ পারমার্থিক অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। ( এভাবে দেখলে) তাকে চন্সি রাঈটের ভাষায় আবহ বলতে হয়- উদ্দেশ্যবিহীন ভাঙ্গা গড়াই তার খেলা।
আর কিছু হোক না কেন- এটি নিশ্চিত যে, বর্তমান কালের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানজাত জ্ঞানের দ্বারা আমরা পৃথিবীর যে সন্ধান পাই, সে পৃথিবী অন্য এক বৃহত্তর পৃথিবী দ্বারা পরিবেষ্টিত। তার সেই অবশিষ্ট গুণাবলী সম্বন্ধে বর্তমানে আমরা কোন সার্থক ধারণা করতে পারি না।*২০২
কেন পারি না তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি আবার বলেছেনঃ
‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা জাতিকে এবং সার্বিক (সত্য) নিয়ে আলোচনা করি ততক্ষণ আমরা সত্যের সংকেত নিয়েই আলোচনা করি। যেই ব্যক্তিগত ও ব্যক্তিত্বগত বিষয় নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হই তখনই মাত্র সত্যের সর্বাঙ্গীণ রূপের আলোচনা আমাদের দ্বারা হয়।২০৩
আমাদের জীবনে অনেকগুলো আদর্শ বর্তমান, সত্য শিব ও সুন্দর সব সময়েই জ্ঞানের রাজ্যে, কর্মের ক্ষেত্রে ও সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের প্রেরণা যোগায়। এগুলোর মূল্য কি? বাস্তব জগতে পরম সত্য ও পরম শুভ বা পরম সুন্দর বলে কিছু আছে কিনা এ প্রশ্ন আমাদের মনে ওঠে। এগুলো সম্বন্ধেও ন্যায়শাস্ত্রসম্মত কোন প্রমাণ দেওয়া যায় না। তবু এগুলো জীবনে কার্যকরী। কেবল ব্যক্তিজীবনে এগুলো কার্যকরী নয়, সমষ্টি জীবনেও কার্যকরী, কাজেই এগুলোর স্থিতি সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত, তাই আমরা ভাবতে বাধ্য হই-বিশ্বসত্তায় সেগুলো বর্তমান। ব্যবহারিক জীবনে আল্লাহ্র অস্তিত্বে আস্থা স্থাপন অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে পড়ে অপরিহার্য। জীবনের নানবিধ সংকট-সঙ্কুল অবস্থায়, নানা বিপর্যয় ও সংঘর্ষের মধ্যে কেবল আল্লাহ্র অস্তিত্বের ওপর প্রচণ্ড বিশ্বাসের ফলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। আদর্শের অনুসরণ ও রুপায়ণে আল্লাহ্র অস্তিত্বে আস্থা স্থাপন হয়ে পড়ে অনিবার্য। আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস নৈতিক জীবন যাপন করার পক্ষে অত্যাবশ্যক। ‘আল্লাহ্ আছেন’ বলার সোজা অর্থ দাঁড়ায় দুনিয়া এমনভাবেই তৈরি যাতে পাপের ক্ষয় ও পুণ্যের জয় হয়। অর্থাৎ এ দুনিয়ায় রয়েছে এক নৈতিক শাসন ব্যবস্থা। সকল আইন-কানুনকে ফাঁকি দেওয়া চলে কিন্তু একে ফাঁকি দেওয়া চলে না। এই যে নৈতিক শাসনব্যবস্থা২০৪ যার ওপর বিশ্বাস স্থাপনের ফলে মুজাহিদ জ্বলন্ত অনলের লেলিহান শিখা তুচ্ছ করে তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এ বিশ্বাসের ফলেই সত্য-অনুসন্ধানী নানা উত্থান ও পতনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও অকুতোভয়ে আদর্শের অনুসরণ করে।
রাজনৈতিক জীবনেও সত্য, শিব ও সুন্দরের আদর্শ গ্রহণ আরও প্রয়োজনীয়। জগতের সত্তা যদি অণু-পরমাণুর লীলাক্ষেত্রই হয়, জীব-জগৎ যদি ডারউইনের বিবর্তনবাদের সূত্র অবলম্বন করেই চলে, তা’হলে কেবল উপযুক্ততমের উদ্বর্তনের নীতিই গ্রহণ করতে হয়। যারা এ জীবন-যুদ্ধে উপযুক্ততম কেবল তারাই বেঁচে থাকবে-যারা দুর্বল, যারা পঙ্গু তাদের মরতে হবে। এবং বিধ মতবাদে বিশ্বাসী লোকদের পক্ষে রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়। কারণ রাষ্ট্র হবে সকল লোকেরই রক্ষাকর্তা। তার মাঝে সবলের সঙ্গে দুর্বলও আশ্রয় পাবে। রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য সবলের অত্যাচার থেকে দুর্বলকে রক্ষা করা। তা’ রাষ্ট্র কেন করবে? এ জগতের মূলে নৈতিক শাসন আছে বলেই রাষ্ট্র তা’করতে বাধ্য, যদি কোন নৈতিক শাসন না থাকে তাহলে দুর্বলকে রক্ষার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
তাই সকল রাষ্ট্র বা সরকার গঠন করার মূলে একটা অদৃশ্য নৈতিক শাসন স্বীকার করে নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। দুনিয়ার সম্পদের অধিকার নিয়েও ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যে দ্বন্দ্বের অন্ত নেই। ব্যষ্টির হাতে সম্পদের অধিকার ছেড়ে দিলে দু’দিনেই এক শ্রেণী চল্লিশ তলার উপর দাঁড়ায়, আর অন্য এক শ্রেণী বেওয়ারিশ কুকুরের মত পথে-ঘাটে ধুঁকে মরে। সমষ্টির হাতে সমস্ত অধিকার ছেড়ে দিলে ব্যষ্টি তার স্বাধীনতা হারায় আর সমস্ত অধিকার আল্লাহ্র হাতে ছেড়ে দিলে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখেও মানুষ পৃথিবীর সম্পদ ভোগ করতে পারে। অপরদিকে রাষ্ট্র জনমতের দ্বারা গঠিত হলেও জন্মের পরে জনসমষ্টি থেকে তার সত্তা পৃথক হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদ বা সমাজতান্ত্রিক মতবাদ দ্বারা গঠিত রাষ্ট্রে সর্বসাধারণের কর্তৃত্ব থাকে না। তার নিয়ামকরূপে রাষ্ট্র পরিচালনা করে মুষ্টিমেয় লোক। তাদের ব্যক্তিগত জীবনের ছায়া সর্বাবস্থায়ই রাষ্ট্রের ওপর পড়া অপরিহার্য। কাজেই এদের মনে যদি কোন বৃহত্তর আদর্শের চেতনা কার্যকরী না থাকে তাহলে তাতে জনগণের নানা অমঙ্গল ঘটাবার সম্ভাবনা।
সর্বাবস্থায়ই আদর্শকেন্দ্রিক রাষ্ট্র সর্বশ্রেষ্ঠ। সেই আদর্শ যদি মানবজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণগুলো- যেমন ব্যক্তিত্ব, শক্তি,ন্যায়-বিচার প্রভৃতির আলোকে গ্রহণ করা যায়, তাহলেই রাষ্ট্র পরিচালনায় পারদর্শিতা দেখা দিতে পারে।
এখন উপসংহারে আমরা এ সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছতে পারি। আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণের মূলে রয়েছে মানব-মনের এক চিরন্তন নির্ভরশীলতা।
মানুষ আপনাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে না বলে স্বয়ংসম্পূর্ণ কোন সত্তাকে আশ্রয়রূপে গ্রহণ করতে চায়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই জ্ঞানের একমাত্র পথ নয়। বিচার-বুদ্ধির বাইরে, বোধির মাধ্যমে জ্ঞানলাভ সম্ভবপর। সে জ্ঞানের আলোকে দেখলে আল্লাহ্র অস্তিত্বের জন্য কোন প্রমাণের প্রয়োজন নেই, কারণ সেটি বোধিলব্ধ জ্ঞানের ব্যাপার এবং তা সরাসরি অভিজ্ঞতার২০৫ উপর নির্ভরশীল।
নানাবিধ বৈজ্ঞানিক প্রত্যয়ের মত আল্লাহ্র অস্তিত্বের ধারণা আমাদের ভূয়োদর্শনকে সুসংবদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন। সমাজজীবনে ও রাজনৈতিক জীবনে এ প্রত্যয়ের মূল্য সর্বাপেক্ষা অধিক। সুতরাং তথাকথিত বিজ্ঞানের দ্বারা সে প্রত্যয়ের অনুকূলে কোন সত্তার অস্তিত্ব না পাওয়া গেলেও আল্লাহ্র অস্তিত্ব আমাদের জীবনে কেবল সত্যি নয় জলজ্যান্ত সত্যি। এজন্যই ইসলাম গোড়াতেই আল্লাহ্র অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে।
আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের মানুষের অধিকারের সমন্বয়
আল্লাহ্র অস্তিত্বের স্বীকৃতি ব্যতীত অনেকগুলো অভিজ্ঞতার কোন সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না বলে এবং সমাজজীবন বা রাষ্ট্রজীবনে চরম নৈরাজ্য দেখা দেয় বলে ইসলাম গোড়াতেই এ দুনিয়ার সকল অধিকার, সকল সম্পদ আল্লাহ্র হাতে তুলে দিয়েছে। পবিত্র কুরআন শরীফে ঘোষণা করা হয়েছে- ‘আসমান যমীনে যা কিছু রয়েছে তার মালিক আল্লাহ্’ (নিসা ৪:১৯:১৩১)। তাহলে স্বীকার করে নিতে হবে, এ দুনিয়ার একমাত্র সার্বভৌম অধিকার আল্লাহরই। অথচ এই কুরআন শরীফের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
‘হু আল্লাযি খালাকালাকুম মা’ফিল আরদে জামিয়া’- আল্লাহ্ দুনিয়ার সবই মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন।
তা’হলে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের মধ্যেও মানুষের ভোগের অধিকার রয়েছে। এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ আলিম মাওলানা মাহমুদুল হাসান বলেনঃ
‘সব জিনিসই মানুষের সম্পত্তিবিশেষ অর্থাৎ আল্লাহ্ সকল জিনিসই মানুষের প্রয়োজন মিটাবার জন্য সৃষ্টি করেছেন। কোন জিনিসই সৃষ্টির দিক থেকে ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়, পক্ষান্তরে সকলেরই সম্পত্তি। সব জিনিসই মানুষের মঙ্গলের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে- তাই সকল জিনিসেই মানুষের দখল-ভোগের অধিকার আছে। যখন কোন জিনিস কারো ভোগ-দখলে থাকবে তখন তাকেই কেবল সে জিনিসের একমাত্র মালিক বলে গণ্য করা হবে। অন্য কেউ তার ওপর আধিপত্য স্থাপন করতে পারবে না। হাঁ! কোন জিনিসের দখলকারীর জেনে রাখা উচিত, সে নিজের প্রয়োজনে অতিরিক্ত বস্তু অনর্থক নিজ কবলে না রেখে অন্যকে অবাধে ভোগ-দখল করতে দেবে। কেননা, মানুষ হিসেবে সৃষ্টির ভোগ প্রত্যেক মানুষেরই প্রাপ্য’।
এ কারণেই রীতিমত যাকাত আদায় করা সত্ত্বেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাল সঞ্চয় করা সঙ্গত নয়। নবীগণ ও ধর্মভীরু লোকগণ এ কারণেই ধন সঞ্চয়ে বিরত রয়েছেন। এমনকি হাদীস দ্বারা পরিস্কার বোঝা যায়, সাহাবা ও তাবেয়ীগণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তু রাখা বা ব্যবহার করাকে হারাম বলেছেন।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তু সঞ্চয় বা ব্যবহার অনুচিত বা অসঙ্গত তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তুতে তার কোন আবশ্যকতা নেই। ‘সব সৃষ্টিই মানুষের জন্য’ নীতিতে (সব কিছুতেই) সকলের দাবি রয়েছে, বরং প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তু ভোগ দখলকারী (তার নিজের প্রয়োজনের অংশের অতিরিক্ত ভোগ করার দরুন) অন্যায় দখলকারীরূপে মালিক বটে।* ( ইজাহুল আদিল্লাঃ পৃ,২৬৮। ইসলাম কা ইকতেসাধি নিজাম পৃ,৪২।)
ব্যষ্টিকে তাই দুনিয়ার সম্পদ যথেচ্ছ ভোগ করার অধিকার ইসলাম দেয়নি। যে দুনিয়ার সমস্ত মালিকানা আল্লাহ্র, যে রাজ্যে মানুষ তার প্রতিনিধি,হিসাব রক্ষক, সেখানে আল্লাহ্র খলীফা হিসেবে সে তার প্রয়োজনমত ভোগ করবে—
প্রয়োজনের অতিরিক্ত একতিলও সে অপব্যয় করবে না।
স্পষ্ট বোঝা যায়-আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের সঙ্গে ব্যক্তি-স্বাধীনতার নীতি স্বীকার করা হয়েছে। তবে যাতে এ স্বাধীনতা আধুনিক কালের বীজমন্ত্র Laissez Faire– এ পরিণত না হয়, তার জন্য কুরআন শরীফে নানাবিধ নৈতিক কানুনের প্রবর্তন করা হয়েছে।