সপ্তম পরিচ্ছেদ
ইসলামী রাষ্ট্রের ভাঙনের কারণ
আল্লাহ্র একত্ব, সার্বভৌমত্ব ও মানুষের খিলাফতের ভিত্তিতে গঠিত মানব-প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুকূল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা রসূলে আকরাম (সঃ)-এর দ্বারা হলেও তাকে পূর্ণ বিকাশের পথে নিয়ে যায় দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রাঃ)। তাঁর ইন্তেকালের পরে নানাবিধ কার্যকারণের ফলে সে রাষ্ট্রে অচিরেই শাহানশাহীতে পরিণত হয়।
পরবর্তীকালে দামিশকে উমাইয়াদের, বাগদাদে আব্বাসীয়দের, গ্রানাডায় মুরদের, ভারতে মুঘলদের বা তুর্কিতে উসমানীয়দের আধিপত্য বা রাজ্যবিস্তারকে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যায় না। তারা ইসলামের নামে জনসাধারণের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। কোন বিশেষ রাজ্যের ভাঙ্গাগড়া তখন বিশেষ বংশের উত্থান-পতনের অপর নাম হয়ে দাঁড়ায়।
এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, মানব প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুকূল সে আদর্শ রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অকালে ধ্বংস হয়ে গেল কেন? তাতে কি প্রমাণ হয় না যে, হয়ত সে রাষ্ট্র ব্যবস্থা মানব-প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুকূল ছিল না অথবা তার অর্থনৈতিক ভিত্তি এতই দুর্বল ছিল যে, তাতে মহান আদর্শ থাকলেও তার দুর্বলতার জন্যেই অকালে লয় পেয়ে গেছে?
বস্তুতান্ত্রিক সাম্যবাদীরা মনে করেন, ইতিহাসের ধারায় অর্থনৈতিক কার্যকারণের ফলেই মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের মাটিতে উৎপাদনের যে ব্যবস্থা ছিল- তার পরিবর্তন হওয়ায় ইসলামী সমাজেও তার কার্যকারিতার প্রতিফলন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ইসলামের অভ্যুদয়ের সময় একদিকে যাযাবর বেদুঈনেরা ছিল পশুচারিক পর্যায়ের২০৬ অপরদিকে মক্কা ও মদীনার অপেক্ষাকৃত উন্নত কেন্দ্রগুলোয় ছিল একদল ব্যবসায়ী। ইসলামের বিস্তৃতির ফলে ইরাক, সিরিয়া, বাহরাইন বিজিত হলে মুসলিমেরা ভূমির সংস্পর্শে আসে। তাই ভূমিতে উৎপাদনের ব্যবস্থাতে তারা অভ্যস্ত হওয়ার ফলে আস্তে আস্তে তাদের সমাজে সামন্ততন্ত্রের ভাবধারা প্রবেশ করে। কাজেই সমস্ত জগৎ যে ভাবধারা ধরে চলেছিল, সে ধারা ইসলামের মধ্যেও প্রবেশ করে। ইসলামের বিশিষ্ট অর্থনীতি তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। কাজেই ধর্ম হিসেবে ইসলামের বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে কিন্তু অর্থনীতিতে ইসলামের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। যে অর্থনৈতিক সূত্র ধরে দুনিয়া বস্তুতান্ত্রিক সমাজবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে-ইসলামপন্থীকেও সেই পথেই অগ্রসর হতে হবে। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাঙনের কারণের মধ্যে তাই আশ্চর্য কোন কিছুই নেই। এ ভাঙ্গন তার কাছে ছিল অবধারিত।
মাত্র সেদিন প্রকাশিত (Modern Islam in India) নামক পুস্তক উইলফ্রেড কেন্টওয়েল স্মিথ এ তত্ত্বই প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে ভারতের মুসলিমদের মতবাদও যুগে যুগে অর্থনৈতিক কারণের ফলে পরিবর্তিত হয়েছে।
এঁদের যুক্তির মধ্যে রয়েছে এক বিরাট ফাঁক। তার জন্যই আপাতত অবিশ্বাসী মানব-মনকে মুগ্ধ করলেও ন্যায়শাস্ত্রের কষ্টিপাথরে এঁদের যুক্তি কিছুতেই টেকে না। তাঁদের পক্ষে প্রমাণ করা উচিত (১) ইসলামী অর্থনীতি মানবজীবনে কার্যকরী হতে পারে না, তাকে সমাজে প্রয়োগ করলেও সে অন্য অর্থনীতিতে লয় পেতে বাধ্য। (২) সে অর্থনীতি গ্রহণ করে এবং তাকে বাস্তবজীবনে রূপায়িত করেও ইসলামী সমাজ টিকে থাকেনি।
এ দুটো বিষয় প্রমাণ না করে যদি জোর করে বলা হয়-যেহেতু ইসলামী অর্থনীতি টিকে থাকেনি- সেজন্যই তা অচল-তা’হলে কি বলতে হবে দুনিয়ার বুকে যা-ই ঘটে, তা-ই সচল ও সত্যি, আর যা এককালে ফলে ওঠেনি অথচ পরে রূপায়িত হয়েছে তা তখন ছিল অসত্য এবং বর্তমানে সত্য? মার্কসীয় অর্থনীতির সূত্র জগতে প্রথম প্রচারিত হয় Das Capital প্রকাশিত হওয়ার পরে। তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য মার্কস ও এঞ্জেলস কমিউনিষ্ট মেনিফেষ্টো প্রকাশ করেন ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। তার ফলে ফরাসী রাষ্ট্র বিপ্লবের পরিণতিতে প্যারিস কমিউন প্রতিষ্ঠিত হয় সে অর্থনীতিকে রূপায়িত করার জন্য, কিন্তু তা টিকে থাকেনি। মাত্র সেদিন ১৯৭১ সালে মার্কসীয় মতবাদের প্রতিষ্ঠাকল্পে রাশিয়ায় রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। সে জন্য কি বলতে হবে- মানব জীবনের পক্ষে মার্কসীয় মতবাদ তখন ছিল অকার্যকরী বা মার্কসীয় মতবাদ গ্রহণ করার ফলেই প্যারিস কমিউন ভেঙ্গে গেছে ?
তার উত্তরে যদি বলা যায়, প্যারিস কমিউন ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ সমাজজীবন যেসব ধাপের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন, সে ধাপগুলো তখন ডিঙ্গিয়ে যায়নি বলে অর্থনীতি গ্রহণ করতে পারেনি, তার অর্থনৈতিক বা সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে যায়নি- তা’হলে ইসলামী সমাজের বেলায়ও তো এই যুক্তিই প্রয়োগ করে বলা যেতে পারে-মানবজীবনের পূর্ন বিকাশের পক্ষে ইসলামী অর্থনীতি গ্রহণযোগ্য বলে তখনকার সমাজে তা আর দীর্ঘকাল কার্যকরী হয়নি।
জগৎ সভ্যতার আলোচনা করলে বিশেষভাবে এ সত্যই প্রমাণিত হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসের আলোচনায় দেখা যায়, মানবজীবনের বিকাশের সহায়করুপে ক্রমেই কতকগুলো মৌলিক অধিকারের২০৭ নীতি স্বীকৃত হয়েছে। বর্তমান জগতে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতাকে মানবজীবনে বিকশিত করার জন্য ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের দার্শনিক ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে পুঁজিবাদী সমাজ। তার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের ফলে বস্তুতান্ত্রিক সমাজবাদী প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে অবশ্যম্ভাবীরূপে। তার ফলে সমাজবাদী রাষ্ট্র গঠনের চলছে প্রচেষ্টা, তাতে সাম্য, মৈত্রী বিশেষভাবে ফলে উঠলেও স্বাধীনতাকে দেয়া হয়েছে বিসর্জন। মানবজীবনের মৌলিক অধিকার মানব-মনে দানা বাঁধতে থাকলে অনাগত বিশ্বসংস্থা গড়ে উঠবে এই তিনটে মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে-যা কেবল ইসলামী ব্যবস্থাতেই সম্ভব।
দ্বিতীয়ত ইসলামী সমাজ ইসলামের অর্থনৈতিক ভিত্তি অক্ষুণ্ন রেখেই ধ্বংস হয়নি, বরং বর্জন করেই ধ্বংস হয়েছে। এইটেই আজকের দিনে বিশেষভাবে প্রণিদানের বিষয়। যদি সে অর্থনীতি গ্রহণ করে ইসলামী সমাজ তলিয়ে যেতো, তা’হলে অবশ্য বলবার কারণ হতো-ইসলামের অর্থনৈতিক ভিত্তির দুর্বলতার জন্য ইসলামী সমাজ লয় পেতে বাধ্য হয়েছে।
সত্যিকার ইতিহাস পাঠকমাত্রেই জানেন, ইসলামী অর্থনীতি যতদিন পর্যন্ত সমাজজীবনে চালু ছিল, ততদিন রাষ্ট্রে অভাব-অভিযোগ বলে কিছুই ছিল না। যেই তাতে শাহানশাহীর ভাবধারার প্রবর্তন হয়, তখনই তাতে জনগণের দুঃখ-দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয় । খলীফা উমর (রাঃ)-এর খিলাফতের সময়কে ইসলামী সমাজে সুবর্ণ যুগ বলা যেতে পারে, সে সময় বায়তুল মালের আমদানি সব সময়ই উদ্ধৃত্ত থাকতো। কাজেই, যাঁরা ইসলামের অর্থনীতি সম্বন্ধে এরূপ মন্তব্য করেন তাঁদের এসব মন্তব্য বিদ্ধেষপ্রসূতই বলতে হবে।
খোলা চোখে বিচার করলে দেখা যায়, অর্থনৈতিক দুর্বলতার জন্য নয়, নানাবিধ কারণেই ইসলামী রাষ্ট্র ভেঙ্গে গেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের ভাঙনের কারণঃ
১.যে জীবন দর্শনের ওপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত, তা আরব-জীবনে রূপায়িত হয়নি। তার পক্ষে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল বর্তমান। ইসলামের মূল ভিত্তি আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব ও মানুষের প্রতিনিধিত্ব। সে ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে রূপায়িত করতে হলে মানুষকে আল্লাহ্র গুনে গুণান্বিত হতে হয়। আল্লাহ্র প্রতিনিধিত্ব দুনিয়ার বুকে তার রাষ্ট্র রূপায়িত করার জন্য গুণের মাপকাঠিতে আল্লাহ্র রসূলের খলীফা বা প্রতিনিধি নির্বাচন করতে বাধ্য। তাতে আধুনিক গণতন্ত্রে২০৮ যেমন সংখার দিক দিয়ে গুরুত্ব আরোপ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়, তা না করে গুণের ভিত্তিতে খলীফা নির্বাচন করা ছিল সুযোগ ও সুবিধা। এতে সর্বসাধারণের ভোটের অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিস্তৃতির ফলে ইসলাম আরব থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লে বিজিত দেশের লোকেরা ইসলামী সমাজে তাদের কোন প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তাই ইসলাম ক্রমেই আরবকেন্দ্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় পরিণত হয়। ইসলামের বিস্তারের ফলে ক্রমশ সিরিয়া, ইরাক, ইরান, মিসর প্রভৃতি দেশ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে এলে পর, সে দেশের সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলিমেরা আরব দেশীয় নানা গোত্রের সঙ্গে এক কাল্পনিক রক্ত সম্পর্ক স্থাপনে হয় উৎসুক। এ প্রথাকে মাওলি প্রথা বলা হয়।
এতে একদিকে মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক গাঢ়তর হলেও অন্যদিকে তার ফল বিষের মত দেখা দেয়। কারণ এভাবে আরব গোত্রের লোকের সঙ্গে রক্ত সম্পর্ক স্থাপন করার ফলে তারা খলীফা নির্বাচনে আরবের মাটিতে তাদের মাওলাদের ওপর সমস্ত ভার ছেড়ে দিত। ইসলামের মূলনীতি অস্বীকার করে স্বয়ং তাতে হস্তক্ষেপ না করে মাওলাদের মারফতে তাদের অভিমত ব্যক্ত করত। তার ফলে খলীফার নির্বাচনে আরবেরা সরাসরি নির্বাচনে২০৯ ও আরব জাতিরা পরোক্ষ নির্বাচনে২১০ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। গোটা মুসলিম জাতি তার জন্য অখন্ড জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। বলা বাহুল্য, সে জন্য নির্বাচনের ব্যাপারে আরব দেশীয় অভিজাত সম্প্রদায়ের মতামতই ছিল বেশি গ্রহণযোগ্য।
হযরত আবুবকর (রাঃ) ও হযরত উমর (রাঃ)-এর খিলাফতের সময় আরবের মাটিতে বনি হাশিম ও বনি উমাইয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কোন সুবিধা না হওয়ায় আরবের লোকের প্রাধান্যের জন্য কোন ক্ষতি হয়নি। তাদের ইন্তিকালের পরে ক্রমেই বনি হাশিম ও বনি উমাইয়ার দ্বন্দ্ব প্রকট মূর্তি ধারণ করায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে বনি হাশিম ও বনি উমাইয়ার মত দুই শিবিরে বিভক্তে হয়ে পড়ে। তার ফলে (ক) ইসলামী রাষ্ট্রে আরবের গৃহযুদ্ধ বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে (খ) ইসলামের মূলনীতি সর্বসাধারন মুসলিমের খলীফা নির্বাচনে সাধারণ অধিকার প্রকারান্তরে অস্বীকৃত হয় এবং (গ) সর্বসাধারণ মুসলিমের মনে সংঘ-চেতনা দানা বাঁধতে পারেনি।
খলীফার নির্বাচনে মদিনার উচ্চ শ্রেণীর মতামত গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় আরবের মাটির অন্যান্য অবজ্ঞাত সমাজেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। হযরত আলী (রাঃ) ও মু’আবিয়ার দ্বন্দ্বে খারিজিরা তখনকার দিনের মুসলিম জনসাধারণের বিক্ষুব্ধ মানসেরই পরিচয় দিয়েছে। তারা চেয়েছিল সবসময়ই খলীফা নির্বাচনে সর্বসাধারণ মুসলিম অভিমতই গ্রহণ করা হবে। ধর্ম সংক্রান্ত অন্যান্য মতবাদে খারিজিরা অন্ধত্বের পরিচয় দিয়েছে সত্য, তবু তাদের রাজনৈতিক মতবাদের সত্যিকার ইসলামী নীতির প্রতি শ্রদ্ধা আজও আমাদের বিস্ময়ের বিষয়।
তখন পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রে দাস-প্রথা এবং কুরায়েশদের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন থাকায় তাদের এ অভিমত বৈপ্লবিক ঘোষণার মত শুনিয়েছিল। ইসলামী সমাজে সে কালে কিছুতেই দাসপ্রথা থাকতে পারে না, এ সত্য মুসলিম জনসাধারণ বুঝতে পারেনি বলে খারিজিরা তখন সমাজজীবনে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে। খারিজিদের নীতি গৃহীত হলে ইসলামী রাষ্ট্র এভাবে আরবদেশীয় বিভিন্ন গোত্রের দ্বন্দ্বে বিচ্ছিন্ন হত না, অপরদিকে মাওলি প্রথার প্রবর্তন না হলে গোটা মুসলিম অখন্ড জাতিরুপেই পরিগণিত হতে পারত।
২. হযরত রসূলে আকরাম (সঃ)-এর আহ্বানে যারা ইসলাম কবুল করেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল মুনাফিক। ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আদর্শ তাদের মুগ্ধ করেনি। নব-প্রবর্তিত বৈপ্লবিক জীবনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ব্যর্থকাম হয়েই তারা ইসলামে প্রবেশ করে। ঘরের শত্রু হয়ে ইসলামের ধ্বংস ত্বরান্বিত করার দুরভিসন্ধি ছিল তাদের মনে বদ্ধমূল। এদের হাতেই ইসলাম পরবর্তীকালে শাহানশাহীতে পরিণত হয় এবং এদের হাতেই অমুসলিমদের চেয়ে ইসলামের অবমাননা হয় বেশি। এদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যুগে যুগে সত্যিকার ইসলামপন্থীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।
আমীর মুআবিয়ার জীবনেই ইসলামী সমাজে শাহানশাহীর ভাবধারা প্রথম প্রকাশিত হয়। হযরত উসমান (রাঃ)-এর সরলতার সুযোগ নিয়ে দামিশ্কে তিনি পুঁজিবাদী নীতির প্রবর্তন করলে তার বিরুদ্ধে রসূলে আকরাম (সঃ)-এর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) বিদ্রোহ ঘোষণা করে, ইসলামের শৈশবাবস্থা স্মরণ করে স্বেচ্ছায় নির্জনবাসে চলে যান। হযরত আলী (রাঃ) ও তাঁর প্রিয় পুত্র হোসেন (রাঃ) ইসলামী আদর্শকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য শাহাদাত বরণ করেন।
পরবর্তীকালে উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে মুসলিম রাষ্ট্র প্রগতির পথে আর অগ্রসর হতে পারেনি। তার স্রোত উল্টো বইতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে যে বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে প্রথম দুই খলীফার সময় ইসলামী রাষ্ট্র প্রবল গতিতে আদর্শ বাস্তবায়নে ছুটে চলে হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতের সময় থেকেই প্রতিবিপ্লবের২১১ ফলে আস্তে আস্তে উল্টোদিকে চলতে শুরু করে। বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসীয়ের মধ্যে উমর ইবনে আব্দুল আযীয বা আব্দুল্লাহ আল-মামুন তাঁদের বংশের ব্যক্তিক্রম হলেও সে সময়কার বাদশাহী স্রোতের তলায় তাঁদের ব্যক্তিগত সদিচ্ছা কার্যকরী হতে পারেনি।
৩. ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভাঙনের কারণস্বরূপ বলা যেতে পারে- ভূমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার নীতি গ্রহণের২১২ ফলেই ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনীতির মূলে কুঠারাঘাত করা হয়। ইসলাম কোন অবস্থাতেই মাটির ওপর ব্যক্তির মালিকানা স্বীকার করেনি। আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের সঙ্গে ব্যক্তিগত মালিকানা কিছুতেই খাপ খায় না। ইসলামী সমাজে ব্যক্তিকে রক্ষক২১৩ বা ভোগদখলকারী হিসাবে তার প্রয়োজনমত আল্লাহ্র নিয়ামত ভোগ করতে দেওয়া হয়।
ইসলামী রাষ্ট্রের সুবর্ণ যুগে হযরত উমর (রাঃ) সে নীতিই গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আদর্শ ছিল সর্বাবস্থায় মুসলিম জনসাধারণকে রাষ্ট্রের অঙ্গ জ্ঞান করে তাদের খোরাক-পোশাক প্রভৃতি জীবন যাপনের সমস্ত উপকরণ রাষ্ট্র থেকে সরবরাহ করা। তাঁর বিজিত দেশের ভূমি তিনি মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করেননি, বিজিত জাতির মধ্যে তিনি সে ভূমি ভাগ করে দেন। সে আদর্শ রাষ্ট্র সকল সময়েই জনসাধারণের সুখ-দুঃখের জন্য দায়ী থাকায় ব্যক্তিগত শোষণ বা ভোগ-বিলাসের যাতে কোন সুবিধা না হয়, তার সকল ব্যবস্থাই তিনি করেছিলেন। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রাঃ)-এর সরলতার সুযোগ নিয়ে সিরিয়ার গভর্নর মুআবিয়া সিরিয়াতে এক বিস্তৃত ভুখন্ড জায়গীর স্বরূপ আদায় করেন। মুআবিয়া তাঁর শাসনকালে মিসরের সমস্ত রাজস্ব আমর বিন’আসকে দান করেন।
এসব কার্যকারণের ফলেই আল্লাহ্র রাষ্ট্রের মালিকানা অবশেষে ব্যক্তিবিশেষ বা বংশবিশেষের হাতে চলে যায় ও ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। যার ফলে জায়গীরপ্রাপ্ত ভূমি থেকে আয় বন্ধ হয়ে ক্রমেই সেই রাষ্ট্রের অন্যান্য নানা প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করার পক্ষে উপযুক্ত অর্থের অভাব দেখা দেয়।
৪.ইসলামী রাষ্ট্রের ভাঙনের সর্বপ্রধান কারণ তার অগ্রবর্তিতা। ইসলাম যে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা দুনিয়ায় কায়েম করতে চেয়েছে, সে সময়কার সাধারণ মানুষ সে ব্যবস্থ মোটেই বুঝতে পারেনি। মানব জীবনকে ব্যাপক ও পূর্ণভাবে বিকশিত করে তুলতে হলে যে মানবিক অধিকার গোড়াতেই স্বীকার করে নিতে হয়, সেগুলো তখনকার আরব সমাজে মোটেই স্বীকৃত হয়নি।
মানবজীবনের এই সন্ধিক্ষণে এসে দেখা দিয়েছিল মানুষের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। জীবন বিকাশের যে চাবিকাঠি তিনি নিয়ে এসেছিলেন তখনকার অনুন্নত আরব সমাজ তার প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পারেনি। আল্লাহ্র ওয়াহ্দানীয়ত ও সার্বভৌমত্ব মন্ত্র তারা গ্রহণ করেছিল বটে তবে তার সুদূরপ্রসারী ফলে মানবজীবনে বিভিন্ন সমস্যার কিভাবে সমাধান করা যায় এবং তার প্রয়োগে জীবনধারা কিভাবে সরলরেখায় অগ্রসর হতে পারে সে তত্ত্ব উপলব্ধি করার শক্তি তাদের ছিল না। কাজেই আল্লাহ্র রসূলের ব্যক্তিগত চরিত্রমাধুর্য ও নিষ্কলঙ্ক জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ইসলামের বৈপ্লবিক প্রেরণায় তারা উদ্ধুদ্ধ হয়নি। খুলাফায়ে রাশেদীন, হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) বা আরও দু’একজন দূরদর্শী মহাপ্রাণ ব্যক্তি ব্যতীত মানবজীবনের কল্যাণ সাধনে ইসলাম কিভাবে কার্যকরী সে তত্ত্ব অনেকের কাছেই সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল।
ইসলামের বাইরের খোলস দেখে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, পরবর্তীকালে উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে তাদের মনেই আবার গায়ের ইসলামী ভাবধারা প্রবল হয়ে পড়ে।
কুরআন শরীফের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল মনোবৃত্তিতে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কুরআন শরীফে মানবজীবনকে চিরকাল পরিচালিত করার জন্য রয়েছে কতগুলো আদর্শ নীতি। আবার কতগুলোতে আরবের তৎকালীন সমাজজীবনের রীতিনীতি পরবর্তিত অবস্থায় গ্রহণ করা হয়। সেগুলো যে জীবন বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানবজীবন থেকেক নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য তার ইঙ্গিতও কুরআন শরীফে রয়েছে। সুদ,ব্যভিচার,শরাব,শূকরের গোশত ইসলামে চিরকালই অকল্যাণকর। তাই সকল যুগেই তা’ হারাম ও নিষিদ্ধ। দাসপ্রথা, বহুবিবাহ প্রথা সে আরব সমাজে ছিল বিশেষভাবে প্রচলিত। সেগুলো কুরআন শরীফে নিষিদ্ধ হয়নি সত্য কিন্তু তাদের ওপর যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তা প্রতিপালন করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই কুরআন শরীফে বাহ্যত নিষিদ্ধ নয়, এমন কতকগুলো নীতি যে পরবর্তী সমাজব্যবস্থায় নিশ্চিহ্ন করা হবে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
সামাজিক রীতিনীতির মধ্যেও কুরআন শরীফের আদেশ-নিষেধগুলোর মধ্যে একটি পার্থক্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যে সকল কার্যকলাপ ইসলাম চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, সেগুলো প্রচলনের কোন সুবিধা নেই। সুদ,যিনা (ব্যভিচার)শরাব- কোনকালে কোন অবস্থাতেই জায়েয হতে পারে না। কিন্ত কতগুলো জায়েয কাজকে পরবর্তীকালের মুসলিমদের সর্ববাদীসম্মত অভিমত (ইজমা) দ্বারা পরিবর্তন করা না-জায়েয নয়। চার স্ত্রীর পরিবর্তে এক স্ত্রী গ্রহণ বা দাস প্রথারবিলোপ ইসলামের চোখে নিন্দনীয় নয়।
অনেক ক্ষেত্রেই স্বীয় বিচার-বুদ্ধির ব্যবহার ইসলাম অনুমোদন করেছে। আফসোসের বিষয়, পতন যুগে ইসলামের মূল আদর্শ হারিয়ে কুরআন শরীফ অথবা হাদিস শরীফের শাব্দিক ব্যাখ্যা নিয়ে মাথা ঘামানো মুসলিম সমাজে অভ্যাসে পরিণত হয়। ফলে যে বৈপ্লবিক জীবনধারার প্রবর্তনের জন্য ইসলাম নাযিল হয়েছিল তা’ ব্যর্থ হয়। এর জন্য দায়ী ছিল অনুন্নত সমাজজীবন। সে সমাজজীবন মানবতার পারিপার্শ্বিক আদর্শ গ্রহণ করে সে সমাজ ব রাষ্ট্র সামন্ততন্ত্রের আওতায় চলে যায়।