নবম পরিচ্ছেদ
ইসলামের বিকাশ
ইসলামকে ধারণা করা হয় পূর্ণ মানবতার ধর্ম বলে। মানবজীবনের সর্বাঙ্গিণ মঙ্গলের জন্য তার নানাবিধ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে পারে বলেই ইসলামের সার্থকতা। ইসলামের ইতিহাসে কিন্তু দেখা যায়, যে পূর্ণ বিকশিত মানবজীবনের আদর্শ সম্মুখে রেখে ইসলাম উল্কার গতিতে অগ্রসর হয়েছিল, দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রাঃ)-এর খিলাফতের পরে তাতে প্রতিবিপ্লবের সূচনা দেখা দেয় এবং আমীর মুআবিয়ার হাতে ইসলামী রাষ্ট্র সম্পূর্ণ উল্টা দিকে চলতে শুরু করে। তার পরিণতিতে এখনও মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে ইসলামের নামে চলছে অপব্যবহার। এখন তা হলে প্রশ্ন ওঠেঃ ইসলামের পক্ষে কি বিকাশের কোন সম্ভাবনা আছে? ইসলাম কি আবার সত্যিকার রূপ ফিরে পেতে পারে?
এ সম্বন্ধে অনেকেই সন্দিহান। এঁরা বলেন, ইসলামী রাষ্ট্রের এরূপ পরিবর্তনের মূলে দুনিয়ার অর্থনৈতিক কারণগুলো কার্যকরী। সে উৎপাদন ব্যবস্থার মূলে দুনিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো যুগে যুগে পরিবর্তিত হচ্ছে, ইসলামের মধ্যেও তার ছাপ পড়েছে। কাজেই, সামন্ততন্ত্রের যুগে ইসলামী রাষ্ট্রের যে রূপ ছিল, ধনতন্রের যুগে তার সে রূপ থাকেনি। সমাজতন্ত্রের যুগে আবার তার জন্য অন্য রূপ দেখা দিতে বাধ্য। ইসলামের নানাবিধ সমাধান থেকে নজির তুলে বলা হয়, ইসলাম মধ্যযুগে সে সমাধান দিতে সক্ষম হয়েছিল, বর্তমানে যুগে তাতে আর কৃতকার্য হতে পারবে না। কেননা সমাজতন্ত্রের যুগে ইসলাম যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল-বর্তমান কালের মত সেগুলো এত জটিল ছিল না। দুনিয়ার পুঁজিবাদের উত্থানের ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সে সময় এরূপ পরিস্থিতি ছিল না বলে ইসলামের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে। এখনকার বিরূপ পরিস্থিতিতে তা সম্ভব নয়।
প্রথমেই আমাদের বিচার করতে হবে- ইসলাম বলতে ওঁরা কি মনে করেন। ইসলাম একাধারে এক ধর্মবিশ্বাস, দার্শনিক মতবাদ, জীবন-পদ্ধতি। ইসলাম জীবনকে গ্রহণ করেছে পূর্ণভাবে। তাই মানবজীবনের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে তৎপর হয়েছে। একথা অবশ্য সত্য যে, অর্থনৈতিক বা অন্যান্য কারণে দুনিয়ার পরিস্থিতি যুগে যুগে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। তবুও বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে মানুষের সত্যিকার রূপের কোন পরিবর্তন হয়নি,হতে পারে না। মানুষ গোড়াতে ক্ষুধা-তৃষ্ণার তাড়নায় অধীর হত, বর্তমানেও হয়। মানুষের মধ্যে তখনও কাম-প্রবৃত্তি সহজ ছিল-বর্তমানেও রয়েছে। অপত্য-স্নেহ সুখচারী প্রবৃত্তি২২১ প্রভৃতি যেমন ছিল, বর্তমানেও রয়েছে। সেগুলোর পরিতৃপ্তিতে হয়ত পদ্ধতির পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু তাদের সত্যিকার রূপের কোন পরিবর্তন হয়নি। মানুষের স্বভাবের যদি কোন পরিবর্তন না হয়, তাহলে তার বিকাশের উপায় ও পথের পরিবর্তন হলেও তাতে কিছু যায় আসে না।
ইসলাম চায় মানবজীবনের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিকাশ, সে বিকাশের পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতিতে ইসলাম তার মূলনীতি পরিত্যাগ না করে যে কোন পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে।
ইসলামে এক আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের জন্য তাকিদ রয়েছে। সে আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর হযরত রসূলে আকরম (সঃ) স্থাপন করেছিলেন। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রাঃ)-এর খিলাফতের সময় সে রাষ্ট্র বিশেষ বিকাশ লাভ করে। আমীর মু’আবিয়ার কার্যকারিতার ফলে তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতের সময় প্রতিবিপ্লবের বীজ উপ্ত হয় এবং আমীর মু’আবিয়ার শাসনকালে তা সম্পূর্ণ উল্টা দিকে ধাবিত হয়। তাই ইসলামের রাষ্ট্রীয় আদর্শ সম্পূর্ণ রূপায়িত হতে পারেনি।
প্রতিপক্ষ ইসলামী রাষ্ট্র বলতে বিভিন্ন কালের মুসলিম রাষ্ট্রকে মনে করে এক মস্ত বড় ভুল করে থাকেন। ইসলামের মূলনীতি আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব২২২ ও মানুষের প্রতিনিধিত্ব২২৩। এই দুই ভিত্তি ব্যতীত গঠিত কোন রাজ্য বা রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যায় না। কাজেই ইসলামের নামে ব্যক্তিগত বা বংশগত আধিপত্যের যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁদের রাজ্যকে কিছুতেই ইসলামী রাষ্ট্র বলা যায় না। গ্রানাডার মুরদের, ভারতীয় মোগল বা উসমানী তুর্কিদের রাজ্যকে কিছুতেই ইসলামী বলা যায় না। তাদের রাজ্যগুলো ইসলামী রাষ্ট্র নয় বলেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে এ প্রভাব বাড়তে পারে না। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে কোন ছকের মধ্যে ফেলা যায় না। তাকে সামন্ততন্রীয়, ধনতন্ত্রীয় বা বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রীয় বললে সত্যের অপলাপ করা হবে। দুনিয়ার বুকে যেসব অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যের দরুন এসব মতবাদের সৃষ্টি হয়েছিল ইসলাম গোড়াতেই সে অর্থনীতিকে বর্জন করে এমন এক অর্থনৈতিক মতবাদ গ্রহণ করেছে,যার ফলে মানবসভ্যতাকে সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র নামক বিভিন্ন ধাপ ডিঙিয়ে অগ্রসর হতে হয় না। মানবজীবনের পূর্ণ বিকাশের পক্ষে অনুকূল অর্থনীতি গ্রহণ করার ফলে একই সূত্র ধরে সে অগ্রসর হতে পারে। ইসলাম যে আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের নীতি নির্ধারণ করেছিল, তারই আলোকে বর্তমানে বা অদূর ভবিষ্যতে সে রাষ্ট্র রূপায়িত হওয়ার বিস্তর সম্ভাবনা করেছে। এ সম্বধে শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ দেহলভী বা মাওলানা উবায়েদ উল্লাহ সিন্ধির বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁদের দুজনের কাছেই ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শ জীবনসংস্থা, যা এখনও সম্পূর্ণ রূপায়িত হয়নি, ভবিষ্যতে হতে বাধ্য।
সে আশা আমরা পাই ইসলামের প্রতিকৃতির মধ্যে। সে প্রতিকৃতি সফল হতে বাধ্য। কারণ ইসলামের পরিস্থিতিতে তার বিকাশের পক্ষে অনুকূল পদ্ধতি গ্রহণ করার সুবিধা রয়েছে। সকলেই জানেন, ইসলামী আইন-কানুনের বুনিয়াদ চারটি স্তরের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ্র বাণী কুরআনের বাণীর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেসব কথা বলেছিলেন বা যেসব কাজ করেছিলেন পরবর্তীকালে তা-ই হাদীস হয়ে পড়ে। কুরআনের আদেশ-নিষেধ ব্যতীত হাদীসের আইন-কানুনগুলোও ইসলামপন্থীর পক্ষে অবশ্য পালনীয়। ইসলামী আইনের তৃতীয় স্তম্ভ ইজমা বা সর্বসাধারণ মুসলিম কর্তৃক গৃহীত আইন এবং চতুর্থ কিয়াস। এ চারটি উৎস থেকেই পরবর্তীকালে ফিকাহ শাস্ত্র গড়ে ওঠে। ইসলামের পতন যুগে যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে এই চারটি উৎসের মধ্যেই আইন-কানুনকে সীমাবদ্ধ করা হয়। তবুও আনন্দের কথা এই যে, ইসলামের মধ্যেই রয়েছে বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগের তাকিদ। এই বিচার-বুদ্ধির আলোকে মুসলিম মানস সর্বাবস্থায় চিন্তা করার প্রয়াস পেয়েছে এবং নতুন পরিস্থিতিতে পুরাতন জীবনকে আবার নতুন জ্ঞানের আলোকে দেখবার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। জাতিগত না হলেও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মধ্যে মুসলিম মানসের সে পরিচয় রয়েছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। হিজরী শতকের মধ্যভাগ থেকে চতুর্থ হিজরীর সূচনা পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে উনিশটি আইন সংক্রান্ত মতবাদের সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাদের প্রেরণার উৎস ছিল ইজতিহাদ।
প্রশ্ন করেন, ‘যদি আল্লাহ্র রসূলের জীবন থেকে পূর্ববর্তী কোন উদাহরণ না পাও? তার উত্তরে মা’আজ বলেন, তাহলে আমি আমার বিচার-বুদ্ধির প্রয়োগ করবো’। তাঁর এ উত্তরে আল্লাহ্র রসূল (সঃ) বিশেষ সন্তোষ লাভ করেন।
এ ইজতিহাদের জোরে ইসলামপন্থীরা নানা যুগে জীবন সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ হয়েছে। চারটা সুন্নী মতবাদ, অসংখ্য শিয়া মতবাদের উৎপত্তি ও স্থায়িত্বের পরে মুসলিম-মানস যুগে যুগে জীবনকে আবার নতুন করে দেখবার চেষ্টা করেছে।
এ জন্যেই বোধ হয় এ যুগের মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ’র মত সূক্ষ্ম সমালোচক বলতে বাধ্য হয়েছেন- “ It is the only religion which appears to me to prosses assimilating capacity to the changing phase of existence which can make its appeal to every age. I believe if a man like Mohammad were to assume the dictatorship of the world, he would succeed in solving the problem in a way that would bring in much needed peace and happiness.”
বুদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা যদি যুগে যুগে পরিবর্তিত অবস্থার মধ্যে নানবিধ সমস্যার সমাধান করার সুবিধা ইসলামের মধ্যে থাকে, তাহলে মৌলিক নীতি পরিত্যাগ না করে এ পরিবর্তনের যুগেও উপায় ও পদ্ধতি গ্রহণের বেলায় ইসলাম ইজতিহাদের সাহায্য নিতে পারে। ইসলামের পক্ষে তাই কোন পরিস্থিতিতেই অবরুদ্ধ থাকার কোন কারণ নেই। প্রায় চৌদ্দ শত বছর আগে বছর ত্রিশেক বিকশিত হয়ে তার গতি রোধ হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ইজতিহাদকৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বা রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি তার পক্ষে খুবই সম্ভব-এইটেই সবচেয়ে বড় আশার কথা।