অষ্টম পরিচ্ছেদ
ইসলামী সমাজের ভূমিনীতি ও তার প্রয়োগ
ইসলামী জীবনদর্শন ও তার ফলিত রূপ
ইসলামী জীবনদর্শনের আলোকেই ইসলামী সমাজের ভূমি-নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। আল্লাহ্র সার্বভৌমত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের চরম ও পরম তত্ত্ব। মানুষ আল্লাহ্র প্রতিনিধি হিসাবে সে আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তুলবে। সেখানে ব্যক্তিগত অথবা সমাজগৎ সুখ-সুবিধার জন্য বিলাসিতা প্রশ্রয় পেতে পারে না।
ইসলামী সমাজ অথবা রাষ্ট্রের কোন বস্তুর ওপরই কারো ব্যক্তিগত মালিকানা নেই, আছে শুধু ভোগের জন্য দখলের অধিকার। রাব্বুল আলামীনের খলীফা হিসেবে ব্যক্তিগত জীবনে অথবা সামাজিক জীবনে মানুষ আল্লাহ্র মালিকানাকে মেনে নিয়ে সেই সম্পদকে ভোগ করতে পারে, এর অতিরিক্ত কোন দাবিই করতে পারে না।
তাই, ইসলামী সমাজে মানবসাধারণকে জীবন ধারণের জন্য উপযুক্ত জমিরক্ষক হিসেবে ভোগ করতে দেওয়া হয়। অতিরিক্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়, অথবা গো-চারণ ভূমি, কবরস্থান, সর্বসাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়, যাতে ভূমি ব্যক্তিবিশেষের বা বংশবিশেষের সম্পত্তিতে পরিণত না হয়, তার প্রতি লক্ষ্য রেখেই ইসলামী রাষ্ট্রের ভূমি বন্টনের নিয়ম প্রবর্তন করা হয়েছে।
ইসলামী সমাজে ভোগ দখলের অধিকার
নবী করীম (সঃ)-এর মক্কা থেকে মদীনাতে হিজরতের পর ভূ-সম্পত্তিতে যে ইতিহাস পাওয়া যায় তা থেকে দেখা যায়, “আনসার ও মুহাজিরগণের ভূ-সম্পত্তির স্বত্বাধিকারের অর্থ এই যে, নবী করীম (সঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীন দান ও জায়গীরস্বরূপ যে জমি তাদের দিয়েছেন তাই তাদের সরল জীবন যাপনেও কাজে লাগতো”।
“বনজর’ (অনাবাদী) ভূমিকে আবাদ করে তাঁরা ফসলের উপযোগী করতেন। এগুলোও আয়তনের দিক থেকে বর্তমান যুগের বড় বড় গ্রাম বা মৌজার মত ছিল না। মাত্র কতক আবাদী জমির সমষ্টি ছিল-কাজেই দেখা যায়, ইসলামী সমাজে দুইভাবে রক্ষক হিসেবে জমির উপর মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। (১) যে সকল জমি কৃষকেরা নবী করীম (সঃ) অথবা খুলাফায়ে রাশেদীনের কাছ থেকে দান অথবা জায়গীরস্বরূপ পেয়েছিলেন অথবা (২) যে সকল অনাবাদী জমিকে তাঁরা আবাদ করে ফসলের উপযোগী করে তুলেছিলেন, মাত্র সেসব জমিতেই তাঁদের ভোগ দখলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কোন কোন শর্তে বনজর জমিতে জোত স্বত্ব বর্তাতে পারে, তার নজিরস্বরূপ দেখা যায়, কৃষিকার্যের উন্নতি এবং আবাদীর প্রচেষ্টাকে ইসলামী অর্থনীতিতে মৃতের জীবন দানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। পতিত, অনাবাদী জমিকে কৃষি উপযোগী করে তুললে তাতে রক্ষক হিসেবে চাষীর জোতস্বত্ব বর্তাতে পারে। … “পতিত জমিকে চাষের উপযোগী করার অর্থ তাকে পূর্ণ জীবন দেওয়া। নীরস, অনুর্বর জমি, বালুকাময় জমি, প্রস্তরপূর্ণ জমি বা টিলা সাধারণভাবে অনুপযুক্ত জমিরুপে পরিগণিত। শক্ত পরিশ্রমের দ্বারা অধিক পরিমিত ভূমিকে কৃষির উপযুক্ত করা সম্ভব। এরূপ অনুপযুক্ত সমস্ত জমিজমাকে কৃষিকার্যের উপযুক্ত করা এবং কাচাঁমাল দ্বারা দেশের সমৃদ্ধি সাধন ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রধানতম অংশ। যথাসাধ্য পতিত জমি থাকতে না দেয়া, যেসব জমি কৃষির উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পতিত পড়ে রয়েছে তাকে কৃষির উপযুক্ত করে তোলা-প্রভৃতির জন্য ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দুটো উপায় রয়েছেঃ
১.প্রথমত আমিরুল মুমিনিন দেশের জনসাধারণকে উৎসাহিত করবেন এবং এই মর্মে প্রচার করবেন যে, যে যতখানি পতিত জমি আবাদ করবে সে-ই তার অধিকারী হবে।
২.ইমামের কর্তব্য-পতিত জমিকে অথবা উত্তরাধিকারবিহীন, অধিকারীহীন জমিকে জায়গীরের মত দেশের লোকের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া, যাতে ঐ সব জমি কৃষির উপযুক্ত হতে পারে এবং এগুলোর বিলি ব্যবস্থায় সর্বসাধারণ মুসলমানের উপকার হয়।
ফিকাহ শাস্ত্রকারগণের মতে-যদি এরূপ বনজর জমি তৈরি করা অধিক ব্যয়সাপেক্ষ হয়, তাহলে দু’তিন বছরের খাজনা মাফ করার অধিকার ইমামের রয়েছে। এ সমস্ত জমি সম্বন্ধে জনাব রসূলে করীম (সঃ) ফরমায়েছেন-যে জমির কোন স্বত্বাধিকারী নেই, এরূপ জমিকে কেউ কৃষিকার্যের উপযুক্ত করে নিলে- সে ব্যক্তিই এ জমিনের স্বত্বাধিকারী (অবশ্য রক্ষক অর্থে) হওয়ার অধিকারী। যে ব্যক্তি মৃত জমিকে পুনর্জীবিত করে সে জমি তারই।
তিনটি শর্ত রয়েছে
(ক) জমি যেন শহরতলীতে না হয়, শহরের প্রয়োজনে না লাগে এবং গ্রামবাসীগণের ফায়, গোবর ও কবরস্থান না হয়। আব্বাসীয় খলীফা হারুন-অর-রশিদকে সম্বোধন করে ইমাম আবু ইউসুফ বলেছেন, “ হে আমিরুল মুমিনিন, যে সব জমি যুদ্ধ বিগ্রহ অথবা সন্ধির দ্বারা বিজিত হয়েছে সে সব জমি ও যেসব গ্রাম-অঞ্চলের জমি এমন অবস্থায় পড়ে রয়েছে যে, তাতে ঘর-বাড়ি বা ক্ষেত-খামারের কোন চিহ্ন নেই, সে জমি সম্বন্ধে আপনি আমার অভিমত জানতে চেয়েছেন। তার উত্তরে বলা যায়-যেসব জমিতে কোন ঘর-বাড়ির চিহ্ন না থাকে, গ্রামবাসীগণের কোন ‘ফায়’ সম্পত্তি, কবরস্থান চারণভূমি যা নয়, কারো স্বত্বাধিকার অথবা দখলাধিকার নয়-এরুপ জমিকে মৃত জমি বলা হয়। যে ব্যক্তি এরূপ জমিকে অথবা কোন অংশকে পুনর্জীবিত অর্থাৎ কৃষিকার্যের উপযোগী করে তুলে তার স্বত্ব (ভোগ দখলের) বর্তাবে। আপনার বিবেচনা মত এসব ভূমি জায়গীরের মত বন্দোবস্ত দিতে পারেন। ‘কিতাবুল খারাজ’ ‘ইসলাম কা একতেসাদি নেজামে’ ‘ফায় সম্পত্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যদি ইসলামী সেনার কাছে পরাজিত হয়ে অথবা ভয় পেয়ে যুদ্ধ না করে বিধর্মী তাদের সম্পত্তি ফেলে পলায়ন করে অথবা যুদ্ধের ভয়ে তাদের আপন জমি তাদের হাতে রেখেই ইসলামী রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট কর দিতে চায় অথবা যদি তাদের খাজনা বা জিযিয়া নির্দিষ্ট করে তাদের কাছেই তাদের জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যায়- তাহলে সেই নির্দিষ্ট কর, খাজনা অথবা জিযিয়াকে ‘কর’বলে। এ নীতি অনুসারে জিযিয়া বা খাজনাকে ‘ফায়’ বলে গণ্য করা হয়
(খ) যদি কেউ ইমামের কাছ থেকে এ জমি অধিকার করার পর তিনি বছর পর্যন্ত পতিত ফেলে রাখে আর জায়গীর দেওয়ার যে উদ্দেশ্য ছিল, তা পূর্ণ না করে তা’হলে তার হাত থেকে এ জমি ছিনিয়ে নিয়ে অন্য ব্যক্তিকে বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে।
(গ) তৃতীয় শর্ত- এই জমির মধ্যে শহর, তালাব, জলাশয়, ‘হবীম’ বা মসজিদ-সংলগ্ন ভূমি থাকবে না। সে ‘হবীমের’ পরিমাণ ৪০ গজ এবং ক্ষেতের জন্য নির্দিষ্ট ভূমির পরিমাণ ৬০ গজ।
এবং বিধ শর্তসাপেক্ষে যে কেউ-মুসলিম অথবা অমুসলিম-পতিত জমিকে আবার করলে তাতেও তার ভোগ-দখলের অধিকার বর্তাবে।
ভোগ-দখলের জমির পরিমাণ
সে জমির পরিমাণ হবে কোন ব্যক্তির বা তার পরিবারের জীবিকার পক্ষে উপযুক্ত, তার বেশি জমিতে তাকে কোন মতেই ভোগ-দখলের অধিকার দেওয়া যাবে না। হযরত উমর ফারুক (রাঃ)-এর কার্যাবলি থেকে এ নীতিরই সমর্থন পাওয়া যায়। যাতে কোন অবস্থায়ই জমিদারি বা বড় বড় জোতদারির সৃষ্টি না হয়, তার প্রতি দৃষ্টি রেখে তিনি ইসলামী সমাজে ভূমি বিলির ব্যবস্থা করেছেন। ইরাক ও সিরিয়া বিজিত হলে তিনি সাহাবীদের শত আবেদন সত্ত্বেও সেসব দেশের জমি তাদের জায়গিরস্বরূপ দান করেননি, তার ওপর প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলে হযরত বিলালের জায়গিরপ্রাপ্ত জমি থেকে একটি অংশ কেটে নিয়ে প্রকৃত হকদারের হাতে তুলে দিয়েছেন।
জমি থেকে ফসল উৎপাদনের নীতি
সে জমিতে চাষী কিভাবে ফসল উৎপাদন করবে, তার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে ইসলামী সমাজে। চাষী তার জমি নিজে চাষাবাদ করে তা’ থেকে ফসল উৎপাদন করবে। যদি কোন কারণবশত তাতে অসমর্থ হয় তা’হলে তার অপর ভাইকে সহানুভূতি প্রদর্শনপূর্বক চাষ করতে দেবে।
উঁচু স্তরের সাহাবীরা জমি থেকে উপস্বত্ব ভোগের এ পদ্ধতিকেই খাঁটি ইসলামী পদ্ধতি বলে গ্রহণ করেছে। এ সম্বন্ধে হযরত রাফে বিন খাদিজ (রাঃ) বলেন-আল্লাহ্র রসূল (সঃ) আমাদের এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, যাতে বাহ্যত আমাদের উপকার হতে পারে। যেমন আমাদের মধ্যে যদি কারো জমি থাকে, তবে সে জমিকে ভাগে অথবা লগ্নিতে দিতে পারবে না। হযরত (সঃ) ফরমিয়েছেন-যার জমি আছে, সে নিজেই তা চাষ-আবাদ করবে অথবা অন্য মুসলমান ভাইকে বিনালাভে সহানুভূতি প্রদর্শনপূর্বক চাষ করতে দেবে।
রাফে-বিন খাদিজের মতে, ভাগে চাষাবাদের প্রবর্তন হলে নানা ঝঞ্ঝাটের সৃষ্টি হতে পারে। কারণ জমি যদি ভাগে দেওয়ার প্রচলন হয়, তা’হলে ভোগ-দখলকারী চাইবে জমির উর্বর অংশ থেকে ফসল নিতে। অপরদিকে যে আবাদ করেছে, সেও চাইবে অনুরূপ অংশ। তার ফলে নানা ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টির ভয়ে আল্লাহ্র রসূল এ প্রথাকে নিষিদ্ধ করেছেন।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন- “আল্লাহ্র রসূল ফরমিয়েছেন-যার জমি আছে সে নিজেই তা চাষাবাদ করবে বা, অন্যকে বিনালাভে সহানুভূতি প্রদর্শন করে চাষ করতে দেবে। অস্বীকারকারীর প্রতি হযরত (সঃ) অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন”।
হযরত জাবির (রাঃ) বলেছেন- “আল্লাহ্র রসূল (সঃ) জমির পরিবর্তে কোন কিছু গ্রহণ বা ইজারা দ্বারা উপকৃত হতে নিষেধ করেছেন”।
হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) তাঁর জমিকে হযরত (সঃ)-এর আমল থেকে মু’আবিয়ার আমলের প্রথম ভাগ পর্যন্ত চাষীদের মধ্যে লগ্নিতে বন্দোবস্ত দিতেন, কিন্তু যখন তিনি রাফে (রাঃ)-এর হাদীস শুনতে পেলেন তখন তিনি এ কাজ ভয়ে ছেড়ে দিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হল-সম্ভবত হযরত (সঃ) তাঁর শেষজীবনে এ সম্পর্কে এ মীমাংসায় উপনীত হয়েছেন।
হযরত আবুযর গিফারী (রাঃ)-এর মত এই যে, ‘জমি নগদ লগ্নি বা ভাগে দেওয়া নাজায়েয এবং জমিদারি প্রথা কোন অবস্থায়ই জায়েয নয়”।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন- ‘নবী করীম (সঃ)-এর নিষেধের অর্থ মুসলমান নিজে চাষাবাদ করবে অথবা একে অন্যের সৌহার্দ্য বা বন্ধুত্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যে অন্যের প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য ভাইকে বিনালাভে দেবে।
শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীও ইজারা দেওয়াকে বিশেষ গর্হিত কাজ বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি কোন ব্যক্তি অসুস্থতার দরুন অথবা কোন কার্য উপলক্ষে স্বয়ং উপস্থিত না থেকে চাষাবাদ করতে না পারে অথচ জমির উপস্বত্ব ব্যতীত তার বেঁচে থাকবারও অন্য কোন উপায় না থাকে-সেরূপ অবস্থায় জমির কি ব্যবস্থা করা হবে?
ইসলামের মূলনীতি ভ্রাতৃত্ববোধের আলোকে তার মীমাংসা করতে হলে বলতে হবে, তার পাড়া-পড়শি অন্য ভাইরা তার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে কোন মুনাফা না নিয়েই তার জমি চাষ করে দেবে। যাতে কোন অবস্থায় মুনাফা স্বীকারের কোন সুযোগ ও সুবিধা না থাকে, ইসলামী সমাজে সে নীতিই গ্রহণ করা হয়েছে।
উৎপাদনের পদ্ধতি
আবার প্রশ্ন দাঁড়ায়-চাষী একাকী চাষ-আবাদ করবে না প্রয়োজনবোধে সমষ্টিগতভাবে২১৪ ফসল উৎপাদন করবে? এ সম্বন্ধে ইসলামী সমাজে দুটো পদ্ধতিই স্বীকৃত হয়েছে-
এ প্রশ্ন মীমাংসার জন্য অংশীদারের স্বত্ব২১৫ এবং চুক্তিকৃত২১৬ স্বত্বের মধ্যে প্রভেদ বিশেষ লক্ষণীয়। কোন সম্পত্তিতে কারো স্বত্ব তখনই বর্তে, যখন সে সম্পত্তিতে অন্যের সঙ্গে কোন ব্যক্তির ন্যায্য অংশ থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোন ব্যক্তি সম্পত্তি রেখে পরলোকগমন করলে তার সম্পত্তিতে তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সকলেরই অংশ স্বীকৃত হয়। অপরদিকে দশজন লোক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের সম্পত্তি আরও বিশজনের মধ্যে ভাগ করে নিতে পারে বা সে সম্পত্তির সমান অংশে ভোগ করার জন্য চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে।
ইসলামের মূলনীতি দুনিয়ার সম্পদ রক্ষক২১৭ হিসেবে মানুষ ভোগ দখল করবে, এতে কোন মালিকানা থাকবে না। তাই উৎপাদন ব্যবস্থার অংশীদারি স্বত্ব যেমন থাকতে পারে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার ফলেও স্বত্বের সৃষ্টি হতে পারে। চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ায় কিভাবে ভোগ-দখলের স্বত্বের সৃষ্টি হয় তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। মদীনাতে হযরত (সঃ)-এর হিজরতের পরে আনসাররা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের খেজুর গাছগুলো ফল মুহাজিরদের সঙ্গে সমভাবে ভোগ করতে স্বীকৃত হন। তার ফলে উৎপন্ন খেজুর তাঁরা সমানভাবেই ভোগ করতেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘(তারপরে) আনসাররা আল্লাহ্র রসূল (সঃ)-কে এসে বললেন- আমরা ও আমাদের ভাইগণের (মুহাজিরগণের) মধ্যে আপনি গাছগুলো ভাগ করে দিন’। তার উত্তরে আল্লাহ্র রসূল (সঃ) বলেন, ‘না আমরা যে উপস্বত্ব পাচ্ছি, তা-ই যথেষ্ট এবং তোমাদের সঙ্গে ফলের অংশ আমরা ভোগ করছি এই ভালো’। তাঁরা বলেন, ‘আমরা আপনার কথা শুনেছি- আদেশও প্রতিপালন করবো’।
কাজেই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে অন্যের সঙ্গে সম শরীকানা ভোগ করা ইসলাম অনুমোদন করে। বন্টনের নীতি ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত যে কোনোভাবেই উৎপাদন করুক না কেন, উৎপন্ন ফসল চাষীর নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে তার কি ব্যবস্থা করা হবে- এ প্রশ্নটিও অত্যন্ত স্বাভাবিক। তার উত্তরে বলা যায়, তার বা তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অতিরিক্ত দ্রব্যে আত্মীয়-স্বজন, দীন-দুঃখীদের হক রয়েছে।
কুরআন শরীফে রসূল (সঃ)-কে লক্ষ্য করে আল্লাহ্ বলেছেন, “তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে তারা (আল্লাহ্র পথে) কত (অংশ) ব্যয় করবে। তাদের বলো- তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা কিছু”।
কেবল কুরআন শরীফেই নয়, হাদীসেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছু আল্লাহ্র পথে অর্থাৎ মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় করা কর্তব্য বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবনে হাজম জাহেরী তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুহাল্লা’তে উল্লেখ করেছেন- হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, “আল্লাহ্র রসূল (সঃ) বলেছেন যে, যে ব্যক্তির কাছে শক্তি ও সামর্থ্যের সরঞ্জাম নিজেদের আবশ্যকের অতিরিক্ত রয়েছে, তাদের উচিত অতিরিক্ত সামান দীন-দুঃখীকে বিতরণ করা”। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেছেন- ‘নবী করীম (সঃ) এভাবে নানা প্রকারের উল্লেখ করেছেন, তাতে আমার এরূপ ধারণা জন্মেছে যে, আমাদের মধ্যে কারো কোন প্রকার মালের উপর দাবি থাকতে পারে না”।
হযরত উমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন- “যে-যে বিষয়ে আজ আমার ধারণা জন্মেছে সে সম্পর্কে যদি প্রথম থেকে অনুরূপ ধারণা জন্মাতো- তাহলে আমি কখনও দেরি করতাম না এবং নিঃসন্দেহে ধনীদের অতিরিক্ত ধন এনে গরিব মুহাজিরদের মধ্যে বিলিয়ে দিতাম”।
হযরত আবু উবায়দা (রাঃ) ও তিনশত সাহাবা দ্বারা সত্য বলে গৃহীত বর্ণনা থেকে জানা যায়, কোন এক সময়ে যখন খাওয়া-পরার দ্রব্যাদির শেষ হওয়ার উপক্রম হয়, তখন হযরত রসূল করীম (সঃ) হুকুম দেন, ‘যার যা কিছু আছে,এনে উপস্থিত করো’। তারপর সমস্ত দ্রব্য এক জায়গায় জড়ো করে সকল কিছু তাদের মাঝে সমানভাবে বেঁটে সকলের জীবন ধারণের উপযুক্ত পরিমাণ বন্দোবস্ত করে দেন।
হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন- “ আল্লাহ্ তা’আলা ধনীদের ওপর গরিবের আবশ্যকীয় জীবিকা সরবরাহ করা ফরয করেছেন। যদি তারা (গরিবেরা) ভুখা থাকে, নগ্ন থাকে অথবা জীবিকার জন্য বিপদগ্রস্ত হয় তাহলে ধনীরা দায়িত্বশীল নয় বলেই বুঝতে হবে এবং সংকীর্ণতার জন্য তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। নানাবিধ হাদীস ও কুরআন শরীফের দলীল দ্বারা মুহাদ্দিস ইবনে হাজম এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন- “প্রত্যেক মহল্লার ধনীদের ওপর গরিব-দুঃখীদের জীবিকার জন্য জামিন (দায়ী) হওয়া ফরয (অবশ্য কর্তব্য)। যদি বায়তুলমালের আমাদানি গরিবদের জীবিকা সরবরাহের জন্য যথেষ্ট না হয়, তাহলে (সময়ের) শাসক বা আমীর (সামন্ততন্ত্রীয় অর্থে নয়) ধনীদিগকে এ কাজের জন্য বাধ্য করতে পারেন। অর্থাৎ তাদের মাল বলপূর্বক গরিবদের প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারেন। তাদের জীবিকার সংস্থানের জন্য কমপক্ষে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য জরুরি আবশ্যক অনুযায়ী ক্ষুধার অন্ন, পরিধানের বস্ত্র এবং ঝড়, বৃষ্টি, গরম , রোদ ও প্লাবন থেকে রক্ষা করতে পারে এমন বাসগৃহ”। কাজেই সর্ববস্থায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদিত শস্য কোন চাষী ইসলামী সমাজে মুনাফার জন্য ব্যবহার করতে পারে না। উদ্ধৃত্ত সবকিছুই তাকে সমাজের কল্যাণের জন্য ব্যয় করতে হয়।
ইসলামী সমাজের ভূমিনীতি
উপরের আলোচনা থেকে ইসলামী সমাজের ভূমি-নীতির ছ’টি সূত্র পাওয়া যায়ঃ
১.রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণেই ভূমির বিলি-ব্যবস্থা হবে। চাষীকে রাষ্ট্রের নিকট থেকে দানপত্র ভোগ-দখলের অধিকার হিসেবে অথবা রাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে অনুর্বর ভূমিকে আবাদের যোগ্য করে তাতে ভোগ-দখলের অধিকার পেতে হবে ।
২. যারা নিজেরা চাষাবাদ করে না, তাদের ভূমির ওপর ভোগ দখলের অধিকার নেই। এক্ষেত্রে ‘লাঙ্গল যার মাটি তার’ নীতিই গ্রহণীয় হয়েছে।
৩.রাষ্ট্রের বিবেচনায় কোনও কৃষকের জমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিবেচিত হলে রাষ্ট্রে অবাধে সেই জমিকে আয়ত্ত করে নিতে পারে।
৪.জমি থেকে উপস্বত্ব ভোগ করার অধিকার চাষীর আছে, তবে শোষণের কোন সুযোগ নেই।
৫. উৎপাদন ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবেও চলতে পারে।
৬.প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফসল চাষীকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই অপর গরিব লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে, তাতে ত্রুটি দেখা দিলে রাষ্ট্র আইন প্রয়োগে২১৮ তা কার্যকরী করতে পারে।
আধুনিক যুগে ইসলামী নীতির প্রয়োগ
বর্তমানকালে শুধু হাতের দ্বারা মানুষ কোন কাজই করতে পারে না। শিল্প-বিপ্লবের পরে জীবনযাত্রার প্রত্যেক কাজকর্মেই যন্ত্রের প্রয়োগে সল্প পরিশ্রমে প্রচুরতম উৎপাদন করা যায়। যন্ত্রপাতি প্রয়োগের আর একটি বিশেষ সুবিধা এই যে, তাতে ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখ, আরাম-ব্যারামের ফলে উৎপাদন-ব্যবস্থায় কোন তারতম্য হয় না।
উৎপাদন-ব্যবস্থায় যন্ত্রপাতি প্রয়োগ করতে গেলেই সংঘবদ্ধভাবে২১৯ উৎপাদন করতে হয়। কেননা, যন্ত্রপাতি প্রয়োগের জন্য বহু লোকের শ্রম ও তার বিভাগ দরকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে লাঙ্গল এক ব্যক্তি চালনা করতে সক্ষম। কিন্তু একটা ট্রাক্টর চালনা করতে হলে অনেক লোকের প্রয়োজন। লাঙ্গল দ্বারা জমি যে সময়ের মধ্যে এবং যেভাবে কর্ষিত হয় ট্রাক্টর দ্বারা তার কম সময়ে কর্ষিত হতে পারে। জমি ফসলের পক্ষেও উপযোগী হয় বেশি। এতে শ্রম ও সময় দু’ই ই বাঁচে।
দ্বিতীয়ত, সেচের বা বাঁধের জন্য সবসময় যন্ত্রপাতির সাহায্য নেওয়া অবশ্য প্রয়োজনীয়। আমাদের দেশে বর্তমানে যেভাবে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সেচ অথবা বাঁধের কাজ চলে তাতে জমির পক্ষে উপযুক্ত সেচ অথবা বাঁধের ব্যবস্থা করা হয় না।
কাজেই, এ যন্ত্রযুগে কৃষিকার্যের উন্নতির জন্য যে যন্ত্রের সাহায্য নিতেই হবে, যন্ত্রের সাহায্য নিতে গেলেই বহু লোকের সাহায্য ও সহযোগিতার দরকার। সুতরাং ব্যক্তিগতভবে উৎপাদন-ব্যবস্থার নীতি ত্যাগ করে সংঘবদ্ধভাবে উৎপাদন-ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে।
তার জন্য সর্বপ্রথম দরকার সমস্ত জমিকে রাষ্ট্রের করায়ত্ত করে লোকসংখ্যার অনুপাতে জমি বিলির ব্যবস্থা করা। জমি বিলিতে যারা চাষী, চাষ-আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করা যাদের জীবনের কাম্য, তাদের মাঝেই জমি বেঁটে দেয়া দরকার। পতিত অনাবাদী ‘বনজর’ জমিকে চাষ-আবাদ করার উপযুক্ত করে তোলার জন্য উৎসাহ দান করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের পক্ষে খাজনা না দিয়ে এসব জমি পত্তন করা উচিত। বাঁধ, সেচ অথবা যন্ত্রপাতি ক্রয় করার জন্য অগ্রিম টাকা ধারে দেওয়া কর্তব্য। প্রত্যেকটি গ্রামকে কেন্দ্র করে যাতে সমবায়মূলক পদ্ধতিতে২২০ উৎপাদন চলতে থাকে, তার জন্য একটি সরকারি বিভাগ খোলা উচিত। সেই বিভাগের প্রধান কাজ হবে চাষীদের সংঘবদ্ধভাবে উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত করা। তারা যাতে যন্ত্রপাতির সাহায্যে অল্প শ্রমে অধিক উৎপাদনে সমর্থ হয় তার জন্য সংগঠনের ব্যবস্থা করা। চাষের পক্ষে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি সংগ্রহ পূর্বে প্রয়োজনবোধে গরু-মহিষাদি দ্বারা হাল চালনা দরকার হলে প্রত্যেক গ্রামের জন্য কতক জমি গোচারণভূমি রিজার্ভ রাখতে হবে। উৎপাদিত শস্য যাতে কোন অবস্থায়ই নষ্ট না হয় তার জন্য প্রত্যেক গ্রামেই সরকারি খরচে একটি গোলা গড়ে তোলা দরকার। অতিরিক্ত শস্যাদি যাতে চাষীদের মুনাফা শিকারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য প্রত্যেক সংঘের ওপর কড়া দৃষ্টি রাখতে পারে এরূপ নৈতিক চরিত্র-বলে উন্নত সরকারি কর্মচারী নিয়োগ প্রয়োজন।
সকলের উপরে প্রয়োজন মানুষের মন থেকে স্বার্থপরতা, নিচাশয়তা প্রভৃতি দূরীকরণের জন্য শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রবর্তন। রাষ্ট্রকে যাতে চাষী ভাইরা অপ্রয়োজনীয় মনে না করে, তার জন্য চাই রাষ্ট্রেরও তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার। আপদে-বিপদে রাষ্ট্র তাদের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তাদের জীবনের সুখ-দুঃখের ভাগী হলে তবেই রাষ্ট্রের প্রতি তাদের দরদ ও সহানুভূতির সৃষ্টি হতে পারে।
ইসলামী সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি স্বীকার করে নিয়েও কিভাবে শোষণের পথ বন্ধ করা যায় তার ব্যবস্থা নবী করীম (সঃ) ও প্রথম দুই খলীফার জীবন ও কার্যাবলি থেকে বিশেষভাবে পাওয়া যায়। বর্তমানে যুগের পুঁজিবাদী ও বস্তুতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মাঝখানে সিরাতুল মুস্তাকিম হল ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা। সেখানে সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার সমন্ব্য করা হয়েছে বলে ব্যক্তি স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার স্বীকার করেও শোষণের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনাগত বিশ্বসংস্থা গড়ে উঠবে মানবিক অধিকারের এই নীতিকে স্বীকার করেই। ইসলাম চৌদ্দশত বছর পূর্বেই এ নীতিগুলোকে স্বীকার করে গড়ে তুলেছিল তার রাষ্ট্র, প্রতিকূল পরিবেশে তা টিকে থাকেনি সত্য কিন্তু সেদিন দূরে নয়, যখন আবার এ মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েই জগৎসভ্যতাকে হতে হবে অগ্রসর।